কবি মুহম্মদ খান ও তাঁর কাব্য
০১.
মুহম্মদ খান আমাদের সাহিত্যে একটি জনপ্রিয় নাম। তিনি প্রখ্যাত মঞ্জুল হোসেন তথা হোসেন বধ কাব্যের রচয়িতা।
কারবালা কাহিনী নিয়ে অনেক যুদ্ধকাব্য ও মর্সিয়া-সাহিত্য রচিত হয়েছে। কাব্যগুলো সাধারণত জঙ্গনামা এবং গান-গাথাগুলো জারি নামে পরিচিত। যুদ্ধকাব্যের ফারসি নাম জঙ্গনামা। কিন্তু বাঙলায় নামটি যোগরূঢ় হয়ে কেবল কারবালা যুদ্ধ বিষয়ক কাব্যই নির্দেশ করে।
কারবালার যুদ্ধে প্রতারিত ইমাম হোসেনের শোচনীয় পরাজয় ও নিধনের করুণ বৃত্তান্তই এ কাব্যে বর্ণিত। দুর্ভাগ্য লাঞ্ছনা পীড়ন পরাজয় ও হত্যার এমনি অগুণতি ঘটনা দুনিয়াব্যাপী ঘটেছে, আজো ঘটছে। ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে সে সবের বীভৎস কিংবা করুণ বিবরণ। লোকে সব কথা মনে রাখে না, সব ঘটনায় গুরুত্বও দেয় না। মুসলমানের হোসেন প্রীতি রসুল ও আলী-প্রীতির প্রতিচ্ছায়া। কারুণ্য বেদনা উত্তেজনা ও উচ্ছ্বাসের অপ্রতিরোধ্য উৎস ঐটিই। তাই বছরে একবার অন্তত মুসলমানেরা প্রিয়জন নিধনের সদ্যশোক অনুভব করে। বিশেষ করে পাকপঞ্চতন-ভক্ত শিয়া সম্প্রদায় সে শোকের অভিঘাতে বক্ষবিদারী রক্তক্ষরা বেদনায় অভিভূত হয়ে পড়ে। এমনি করে হোসেন বিষয়ক কাব্য ও গানগাথা রচন, পঠন ও শ্রবণ স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মীয় নিষ্ঠা ও জাতীয় প্রবণতায় রূপ পায়।
মুঘল আমলে বিশেষ করে জাহাগীরের আমল থেকে এদেশে ইরানি প্রভাব প্রবল হতে থাকে। ইরানের সাফাভী বংশীয় শাসনের অবসান ঘটলে বহু শিয়া মুর্শিদাবাদেও আশ্রয় পায়। তার ফলে এদেশে কারবালা মহরমের পার্বণিক বিকাশ ও প্রসার ত্বরান্বিত হয়। সুন্নীদের মানস-প্রশ্রয়ে তা শহরে শহরে সর্বজনীন জাতীয় পার্বণের রূপ নেয়। এদেশের এমনি আবহে লোকের কৌতূহল মিটানোর প্রয়োজনে অনেক জঙ্গনামা রচিত হয়েছে।
বাঙলায় মক্তুল হোসেন বা জঙ্গনামা কিংবা শহীদ-ই-কারাবালার আদি কবি দৌলত উজির বাহরাম খান (ষোলো শতক), দ্বিতীয় কবি মীর বা শেখ ফয়জুল্লাহ- র (ষোলো শতক) রচিত চৌতিশায় যয়নবের বিলাপ পাওয়া গেছে। তৃতীয় কবি আমাদের আলোচ্য মুহম্মদ খান। এর পরে যারা জঙ্গনামা রচনা করেছেন তাদের মধ্যে হায়াত মাহমুদ, জাফর, জিন্নত আলী, আলী মুহম্মদ, আবদুল ওহাব, হামিদুল্লাহ খান, ফকির গরীবউল্লাহ, ইয়াকুব (?), সাদ আলী, রাধাচরণ গোপ, মুহম্মদ মুনশী, জনাব আলি ও আবদুল হামিদের নাম উল্লেখ্য।
.
০২.
মুহম্মদ খানের মক্তুল হোসেন ঐতিহাসিক উপাদানের আধার হিসেবেও মূল্যবান গ্রন্থ। তিনি মঞ্জুল হোসেন কাব্যে তাঁর সমকাল অবধি চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাসের আভাস দিয়েছেন। কবির মাতৃকুল ছিল পীর পরিবার, আর পিতৃকুল ছিল শাসক পরিবার। কবির পীর ছিলেন নবীবংশ-এর কবি পীর মীর সৈয়দ সুলতান। সৈয়দ সুলতান মোলো শতকের সাহিত্য, ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একজন দিকপাল। অতএব কবি মুহম্মদ খান ছিলেন সতেরো শতকের চট্টগ্রামের ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুখ্য ব্যক্তিদের অন্যতম। তাঁর মাতৃকুল ও পিতৃপুরুষের বংশ-তালিকা এরূপ :
কবির মাতামহ সদরজাহার পিতৃদত্ত নাম আবদুল ওহাব। গরিব-দুঃখীর প্রতি সদয় ছিলেন বলে তিনি শাহ ভিখারী তথা ভিখারীর বাদশা [ভিক্ষুকজনের পতি যাহাকে বুলিলা] রূপে জনপ্রিয় হন। আর পীর-ই-মুলক অর্থে তিনি সদরজাহ খেতাব কিংবা পদ বা খ্যাতি লাভ করেন পীর ই-মুলুক যারে বোলে সর্বজন]। এই আবদুল ওহাব সদরজাহাঁ গৌড়সুলতান ও আরাকান রাজের প্রশংসা অর্জন করেছিলেন, এবং তিনজন ঐতিহাসিক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর নাম জড়িত রয়েছে। ইতি রাস্তিখানের বংশধর নসরত খানের জামাতা, ভূঁইয়া-প্রমুখ ঈসা খান ও রামু-চকরিয়ার সামন্ত শাসক আদমের প্রিয় কিংবা পীর ছিলেন।
কবির পূর্বপুরুষ রাস্তিখান গৌড়সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহর অধীনে চট্টগ্রামের শাসক ছিলেন। তারপর চট্টগ্রাম কখনো গৌড়শাসনে কখনো আরাকান অধিকারে থাকলেও এঁরা বংশপরম্পরায় শাসক পদে নিযুক্তি পেয়েছেন। মিনা খান সম্ভবত পরাগল খানের ছোটভাই ও ছুটি খানের পিতৃব্য। মুহম্মদ খান মিনা খানের বংশধর বলেই পরাগল খানের নামোল্লেখ করেননি। লক্ষণীয় যে, পিতা ও পিতৃব্য এবং মাতামহ ও মাতামহের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ছাড়া কবি সর্বত্র একক বংশধরেরই পরিচয় দিয়েছেন।
মুহম্মদ খানের পিতৃব্য ইব্রাহিম খান ছিলেন আরাকান রাজ্যের চট্টগ্রামস্থ অধিকারের শাসক বা উজির। মুহম্মদ খানও সম্ভবত শখ ও মাতামুহুরী নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে নায়েব-উজির ছিলেন। আঠারো-উনিশ শতকের কবি মুহম্মদ চুহর কবিপ্রণামে মুহম্মদ খানকে পীর-কবি বলে উল্লেখ করেছেন :
আদ্য গুরু কল্পতরু ছৈদ সুলতান
কবি আলাওল পীর মোহাম্মদ খান।
.
০৩.
কবি সৈয়দ সুলতানের ইচ্ছে ছিল সৃষ্টিপত্তন থেকে শুরু করে কেয়ামত অবধি ইসলামী ধারার একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিকথা রচনা করবেন। সৃষ্টি-পত্তন থেকে ওফাত-ই-রসুল ত রচনা করে কোনো কারণে তিনি লেখনী ত্যাগ করেন। মঞ্জুল হোসেন-এ তাঁর আরব্ধ কর্মে সমাপ্তি দান করে, তার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করেন তাঁর প্রিয় শিষ্য কবি মুহম্মদ খান।
পীরের পাণ্ডিত্য ও জ্ঞান-গভীরতা শিষ্যের ছিল না সত্য, কিন্তু কবিত্বে, সহৃদয়তায়, সংবেদনশীলতায়, ভাষার লালিত্য ও বর্ণনভঙ্গির নিপুণতায় শিষ্য পীরকে অতিক্রম করেছেন। এখন পীর-সাগরেদ সংবাদ মুহম্মদ খানের মুখেই শোনা যাক :
ইমাম হোসেন বংশে জন্ম গুণনিধি।
সর্বশাস্ত্রে বিশারদ নবরস দধি
শ্যাম নবজলধর সুন্দর শরীর
দানে কল্পতরু পৃথিবী সম স্থির।
অসীম মহিমা পীর শাহ্ সুলতান।…
উদরেত বৈসে তান জগতের গুণ
বিজয় করিলা শাস্ত্র পৃথিবী ত্রিকোণ।
হৃদয় মুকুর তান নাশে আন্ধিয়ার।
বহু যত্নে এহি রত্নে কৈলা করতার।
নবীবংশ রচিছিলা পুরুষ প্রধান
আদ্যের উৎপন্ন যত করিলা বাখান।
রসুলের ওফাত রচি আর না রচিলা
অবশেষে রচিবারে মোক আজ্ঞা দিলা।
তান আজ্ঞা শিরে ধরি মনে আকলি।
চারি সাবার কথা কৈলু পদাবলী।
দুই ভাই বিবরণ সমাপ্ত করিয়া
প্রলয়ের কথা সব দিলু প্রচারিয়া
অন্তে পুনি বিরচিলু প্রভু দরশন
এহা হন্তে, ধিক কথা নাহি কদাচন।
দুই পঞ্চালিকা যদি একত্র করএ
আদ্যের অন্তের কথা সন্ধিযুক্ত হএ।
মঞ্জুল হোসেন এগারো পর্বে সমাপ্ত। কবির ভাষায় এর বিষয়সূচি এই :
১. আদিপর্বে ফাতেমার বিবাহ কহিব
দুই ভাইর জন্ম তবে পাছে বিরচিব।
২. কহিব দ্বিতীয় পর্বে শুন দিয়া মন
চারি আসহাবের কথা শাস্ত্রের নিদান।
৩ কহিব তৃতীয় পর্বে হাসনের বাণী
যয়নবকে বিবাহ করিলা মনে গুণি।
৪. চতুর্থ মুসলিম পর্ব শুন দিয়া মন
৫. কহিব পঞ্চম পর্বে যুদ্ধ অবশেষে পাছে
৬. ষষ্টমে হোসেন পর্ব কহিবাম পাছে
৭. সপ্তমে স্ত্রীপর্ব কহিবাম পুনি
৮. অষ্টমেত দূতপর্ব শুন দিয়া মন
৯. নবমে ওলিদ পর্ব শুন গুণিগণ।
১০. দশমে এজিম পর্ব কহিবাম এবে
১১. একাদশ পর্ব তার পশ্চাতে কহিব
প্রলয় হইতে যথ অনর্থ হইব।
যেন মতে দজ্জাল পাপী ভুলাইব নর।
যেন মতে আসিয়া পুনি ঈসা পয়গাম্বর।
মোহাম্মদ হানিফা ইমাম সঙ্গে করি
যেমতে পালিবা নোক দজ্জাল সংহারি।
এআজুজ মাজুজ সেই দুই বাহিনী।
যেনমতে হেসাব দিবেক সর্বজনি।
একাদশ পর্বটি কেয়ামতনামা ও দজ্জালনামা নামে পৃথক দুখানি পুস্তিকা হিসেবেও চালু ছিল। এজিদ পর্বও হানিফার লড়াই নামে জনপ্রিয় হয়। এভাবে মুহম্মদ খান একটিমাত্র গ্রন্থে কেয়ামত অবধি বর্ণন করে পীরের অভিলাষ পূর্ণ করেন। মক্তুল হোসেন কাব্যের রচনাকাল মিলেছে :
মুসলমানি তারিখের দশ শত ভেল
শতের অর্ধেক পাছে ঋতু বহি গেল।
হিন্দুয়ানি তারিখের শুন কহি কত
বাণ বাহু শত অব্দ আর বাণ শত।
বিংশ তিন পূর্ণ করি চাহ দিয়া দধি।
পঞ্চালিকা পূর্ণ হৈল সে অব্দ
মাধবী মাসের সপ্ত দিবস গইল
সেই রাত্রি পঞ্চলিকা সমাপ্ত হইল।
[এত হিজরী ১০০০+৫০+৬=১৬৪৫-৪৬ খ্রীস্টাব্দ; এবং শক ৫ x ২ = ১০০০ +৫০০ + ২০ X ৩+৭= ১৫৬৭ + ৭৮ = ১৬৪৬ খ্রীস্টাব্দ মেলে।
.
০৪.
সব দেশের কাহিনী-কাব্যই ঐতিহ্য-নির্ভর। আমাদের বাঙালি মুসলিম রচিত সাহিত্যের উপজীব্যও ছিল মুসলিম ইতিকথা। তার মধ্যে ইসলামের উন্মেষ যুগের বীরত্ব-মহত্ত্বজ্ঞাপক গৌরবময় কাহিনীই বিশেষ করে তাঁদের কাব্য-সৌধ নির্মাণের উপকরণ যোগায়।
আরব দেশ, রূপকথার ভাষায়, সাত সাগরের ওপারে। সেকালে যানবাহনের সুবিধে ছিল না। আজকের মতো পৃথিবী তখনো মানুষের পদচারণের ক্ষুদ্র ক্ষেত্রে পরিণত হয়নি। তাই সত্যিকথাও কল্পনাপ্রিয় অজ্ঞ মানুষের মুখে মুখে রূপকথার মতো অবাস্তব, অস্বাভাবিক ও রোমান্টিক হয়ে উঠত। তাছাড়া মানুষের মনোজগতে–সাহিত্যের আনন্দ-মেলায়, আদর্শায়িত জীবন স্বপ্নে বাস্তবের মূল্য চিরকালই নগণ্য। যুক্তি-বুদ্ধির প্রভাব সেখানে সামান্যই। তাই ইসলামের উদ্ভবকালের জাতীয় বীরদের নানা যুদ্ধকাহিনী মনোময় কল্পনার অবাধ প্রশ্রয়ে রূপে-রসে, সত্য-মিথ্যায়, সম্ভব-অসম্ভবে, বাস্তবে-কল্পনায় আকর্ষণীয় অবয়ব পেয়েছে। মুহম্মদ খানের মঞ্জুল হোসেনও এমনি একটি করুণ মধুর, জ্বালা-বেদনা, হর্ষ-বিষাদ মিশ্রিত সুন্দর রচনা। এ কাব্য মৌলিক রচনা নয়, ফারসি কাব্যের অনুসৃতিমূলক। আবার এর আংশিক অনুকৃতি মেলে মীর মুশাররফ হোসেনের গ্রন্থে। জঙ্গনামা-র চরম ও সুন্দরতম রূপায়ণ হচ্ছে মীর মুশাররফ হোসেনের বিষাদসিন্ধু। কিন্তু মধ্যযুগীয় কাব্য হিসেবে মঞ্জুল হোসেন এ জাতীয় কাব্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। মুহম্মদ খান নিজেই বলেছেন :
মুহম্মদ খানে কহে শুনিতে মরম দহে।
পাষাণ হইয়া যায় জল।
এই দাবীতে অত্যুক্তি নেই। তাঁর কাব্য সত্যি কারুণ্যের নিঝর। তাই বলে বীররস-বিহীন নয়। যে যুগের, যে সমাজের, যে মানুষের কথা এতে বর্ণিত তা আজ ধূসর কল্পনার বিষয়। কিন্তু আজো সেই ক্রুরতা মানুষের ঘৃণা উদ্রেক করে; হোসেনের আত্মসম্মান বোধ, সত্যনিষ্ঠা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, নির্ভীকতা, আত্মত্যাগ আজো মানুষকে তার প্রতি শ্রদ্ধান্বিত করে; আজো তার বীরত্ব, মহত্ত্ব ও স্বাধীনতা-প্রীতি মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।
শির দেগা সের দেগা, নেহি দেগা আমামা –এই ছিল হোসেনের বক্তব্য। অন্যায় ও জুলুমের কাছে আত্মসমর্পণ করে অনুগৃহীতের সুখ তার কাম্য ছিলো না। জানের চেয়ে মান বড়, তার চেয়েও বড় স্বাধীনতা। সে-স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে এজিদের কৃপাজীবীর নিশ্চিন্ত জীবন তাঁর অভিপ্রেত ছিল না। তাই মৃত্যুর মাধ্যমে তিনি তাঁর মর্যাদা ও আদর্শ রক্ষা করলেন। সংগ্রামের ভেতরেই জীবনের সার্থকতা খুঁজলেন, মুযাহীদের জীবন এবং শহীদের মৃত্যুই তাঁর লক্ষ্য হল। শহীদ হয়েও যিনি মনুষ্যস্মৃতিতে অমর গাজীর গৌরব নিয়ে বেঁচে রইলেন। সেই হোসেনের সংগ্রামের কথা, শাহাদাঁতের কথা আজো এবং চিরকাল স্মরণীয় থাকবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! বিশেষ করে, রসুলের দৌহিত্রের হৃদয়বিদারক কাহিনী সাড়ে তেরো শ বছর ধরে মুসলমানের চক্ষু অশ্রুসিক্ত রাখছে, কেয়ামত তক্ এমনি অশু ঝরবে তাদের দু-চোখের কোণ বেয়ে, যখন মুহম্মদ খানের লেখা-চিত্র তারা মানসচক্ষে প্রত্যক্ষ করবে :
স্বর্গ মর্ত্য পাতালে উঠিল হাহাকার
কান্দস্ত ফিরিস্তা সব গগন মাঝার।
বিলাপন্ত যথেক গন্ধর্ব বিদ্যাধর।
আর্শ কুর্সি লওহ্ আদি কাঁপে থরথর।
অষ্ট স্বর্গবাসী যথ করন্ত
ধিক ধিক কুফি সৈন্য অধার্মিক পাপ।
এ সপ্ত আকাশ হৈল লোহিত বরণ
কম্পমান সূর্য দেখি হোসেন নিধন।
ক্ষীণ হৈল নিশাপতি আমীরের শোকে
মঙ্গল অরুণ বর্ণ রক্ত মাখি মুখে।
বুধে বুদ্ধি হারাইল গুরু এড়ে জ্ঞান
শনি কালা বস্ত্র পিন্দে পাই অপমান।
জোহরা নক্ষত্র কান্দে ত্যাজি নাট গীত
ফাতেমা জোহরা কান্দে শোকে বিষাদিত।
সমুদ্রে উঠিল ঢেউ পরশি আকাশ
পর্বত ছাড়ে সঘন নিশ্বাস।
কম্পমান পৃথিবী যতেক চরাচর
হইল শোণিত বর্ণ দিগদিগন্তর।
জল ত্যাজে মীনগণে পক্ষী ত্যাজে বাসা
সব কান্দে হাসএ ইব্লিস অনা-আশা।
.
০৫.
মুহম্মদ খান সত্যকলি বিবাদ সম্বাদ নামে নীতিশিক্ষামূলক একখানি রূপককাব্যও রচনা করেছিলেন। এটিই তার প্রথম গ্রন্থ। এ কাব্যে সত্য ও কলির তথা ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, পাপ-পুণ্য আর সুমতি-কুমতির দ্বন্দ্ব ও সংঘাত একটি সরস উপাখ্যানের মাধ্যমে সার্থকভাবে চিত্রিত। এ কাব্যের বিষয়সূচি কবির জবানিতে এরূপ :
ক. প্রথমে সত্যক সত্যবতী দুই মিলি
যেন মতে কলির দুঃশীলা সঙ্গে কেলি।
সত্য সঙ্গে যুঝিতে কলির আগমন
মিত্র কণ্ঠ দূত গেলা নিষেধিতে রণ।
না করিল সন্ধিপত্র আইল পুরোহিত
নারদের স্থলে যুদ্ধ হৈল অতুলিত।
খ. দ্বিতীয় অধ্যায়ে দুই সৈন্যের সংগ্রাম
সত্যকলি বিবাদ সম্বাদ অনুপাম।
কপটে জিনিল সত্যে কলি ধনুর্ধর
মুহুশ্চিত সত্য লই পুনি গেল ঘর।
গ. তৃতীয় অধ্যায়ে তবে কহিলু কথন
কাঞ্চলি মুখেত শুনি সত্য অচেতন।
যেন মতে বিলাপিলা সত্যবতী নারী।
সুবুদ্ধি আনিলা গিয়া যোগী ধন্বন্তরী।
জ্ঞান-বড়ি দিয়া যোগী সত্যে চেতাইল
যোগী-সত্যবতী যেন সম্বাদ ঘুচিল।
ঘ. চতুর্থ অধ্যায়ে পুনি সত্য পাইল জয়
পুনি মুহুশ্চিত হৈল কলি পাপাশয়।
মৃতবৎ কলি লৈয়া দুঃশীলা কান্দিল
ভোগী-ধন্বন্তরী আসি কলি চেতাইল।
ভোগী সঙ্গে দুঃশীলার আছিল সম্বাদ
ঙ. পঞ্চম অধ্যায়ে পুনি যুদ্ধের বিবাদ
তৃতীয় [ ত্রেতা] দ্বাপরে যেন নিবারিল রণ
লাজ পাই ঘরে গেল কলীন্দ্র দুর্জন।
তত্ত্বকথা যেন গুরুভার হয়ে না পড়ে, সেদিকে কবির সতর্ক দৃষ্টি ছিল। তাই কবি চন্দ্ৰদৰ্প ইন্দুমতী, সূর্যবীর্য-চন্দ্ররেখা প্রভৃতি প্রণয়োপাখ্যানও প্রাসঙ্গিক করে সুকৌশলে এর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন। সত্য ও পুণ্যের জয় এবং মিথ্যা ও পাপের পরিণামে ক্ষয় প্রদর্শনই কবির লক্ষ্য হলেও কবি শিল্পীসুলভ সংযম রক্ষা করেছেন এবং বাস্তবজীবনে উপলব্ধ সত্যে তার তাচ্ছিল্য ছিল না। বাস্তবজীবনে পাপ ও মিথ্যা যে সত্যের ও পুণ্যের উপরে জয়ী হয় (তা যত সাময়িকই হোক না কেন) এবং সত্য ও পুণ্যের পথ যে বন্ধুর, দুঃখ-দুষ্ট এবং বর্থতাকীর্ণ তাও কবি নিপুণতার সঙ্গেই চিত্রিত করেছেন।
কবির প্রতীকী চরিত্রগুলোও জড়প্রতীক নয়, একান্তভাবে রক্তমাংসের মানুষ। আমাদেরই ঘরের ও সমাজের লোক। চিনতে একটুও কষ্ট হয় না, বরং মনে হয় নিত্য-দেখা অতি পরিচিত জন। কোথাও রহস্যের কিংবা অজানার আড়াল নেই।
পাত্র-পাত্রীর নামগুলো যেমনি গুণপ্রতীক, তেমনি সুন্দর : সত্য, কলি, দুঃশীলা, পাপসেন, ভীতসেন, দুঃশল, মিথ্যাসেতু, কৃপণ, ভোগী, নারদ, মিত্ৰকণ্ঠ, সত্যকেতু, সত্যবতী, বীর্যশালী, ধর্মকেতু, সুখ, সুদাতা, যোগী প্রভৃতি।
সত্যের ধ্বজা সূর্য, কলির পতাকা চন্দ্র–এ দুটোও গভীরতর তাৎপর্যপূর্ণ। সূর্য অগ্নিময়– সত্যে দাহ আছে; চন্দ্র স্নিগ্ধ ও সুন্দর–পাপ আপাতমধুর ও লোভনীয়।
যোগী-সত্যবতী ও ভোগী-দুঃশীলা সম্বাদে ব্যবহারবিধি, নিয়ম-নীতি, পাপ-পুণ্য ও সংযম অসংযমের যে তত্ত্ব ব্যক্ত হয়েছে তা মানবজীবনের চিরন্তন সমস্যার ইতিকথা।
কবি প্রসঙ্গক্রমে তার সমকালীন লোকচরিত্রের যে আভাস দিয়েছেন, তাতেই বোঝা যায়। সতেরো শতকে বিশ শতকে তফাৎ নেই কিছুই। অধিকাংশ মানুষের অমানুষিকতা আজো তেমনি রয়েছে।
মুহম্মদ খান পীরের দৌহিত্র, সূফীপীরের মুরীদ ও নিজে পীর ছিলেন। আবার দুর্লভ কবিত্বও তাঁর ছিল, সর্বোপরি তিনি প্রশাসনিক বিভাগে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অতএব তাঁকে আমরা সতেরো শতকের ধার্মিক ও ধর্মপ্রবক্তা, কবি ও সংস্কৃতিবিদ, রাজনীতিক ও অভিজাত নাগরিক হিসেবেই গ্রহণ করব। তিনি সতেরো শতকের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী মানুষের একজন। কাজেই তাঁর রচনা সে-শতকের সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্মচিন্তার এবং নীতিবোধের প্রতীক ও প্রতিভূ।
[দশ শত বাণ শত বাণ দশ ধিক সনে তথা ১০০০ + ৫০০ + ৫ X ১০ + ৭ = ১৫৫৭ শকে-১৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে এ গ্রন্থ রচিত।]