কবি-প্রিয়া
পুরাকালে আমাদের দেশে এক কবি ছিলেন। নবপ্রভাতের অরুণচ্ছটায় তিনি জন্মেছিলেন এবং মধ্যাহ্নের জ্বলজ্জ্যোতিশিখার মধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। তাই তাঁকে সকল দেশের এবং সকল যুগের কবি বলে আমরা চিনতে পেরেছি। নব-প্রভাতের অরুণচ্ছটা আর মধ্যাহ্নের জ্বলৎ-জ্যোতি শিখা তাঁকে আমাদের প্রাণের মধ্যে অমর করে রেখেছে।
কবির ধারণায় কেবল একটি মাত্র সুর ছিল, সেটি আনন্দের সুর। তাঁর গানে বেদনা ছিল না, নৈরাশ্য ছিল না, বৈরাগ্য ছিল না—ছিল শুধু আশা উল্লাস আর আনন্দ। তিনি সকলকে ডেকে বলতেন—দুঃখের কাছে হেরে যেও না ভাই; দুঃখটা মিথ্যা, আনন্দ তাই দিয়ে তোমার পরীক্ষা করছেন। যদি হেরে যাও—আনন্দের বর পাবে না। দুঃখের আঘাতে আঘাতে তোমার বুকের বর্ম থেকে আনন্দের আগুন ঠিকরে পড়ুক—
ব্যথা এসে ধরবে যবে কেশে
দুঃখ যখন হানবে বুকে বাণ
কাঁদিস নেরে, উচ্চ হাসি হেসে
কণ্ঠে তুলিস সুখের জয় গান।
অবিশ্বাসীরা বলত—কিন্তু কবি, মৃত্যুকে তো আনন্দ দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। সে তো একদিন আসবেই, মরতে তো একদিন হবেই।
কবি হেসে জবাব দিতেন—তোমায় কোনও দিন মরতে হবে না বন্ধু, শুধু একটু সরতে হবে; চৈত্রের তরুপল্লবের মতন শুধু ঝরতে হবে; যারা আসছে, তোমার আনন্দ যাদের সৃষ্টি করেছে, তাদের জন্যে একটু জায়গা করে দিতে হবে। তারা যে তোমার আনন্দের উত্তরাধিকারী; তাদের মধ্যে তুমিই যে মৃত্যুঞ্জয় হয়ে থাকবে বন্ধু!
ক্রমে অবিশ্বাসীদের বিশ্বাস হতে লাগল; দেশের লোক কবির আনন্দ-মন্ত্র গ্রহণ করতে লাগল। শেষে রাজা একদিন কবিকে ডেকে পাঠালেন। বললেন—কবি, তোমার বাণী আমার রাজ্য থেকে দুঃখকে নির্বাসিত করেছে—তুমি ধন্য। আমার কণ্ঠের মালা তোমার কণ্ঠে উঠে ধন্য হোক।
কবি বললেন—রাজন, আনন্দের বাণী আমার নয়। বিশ্বপ্রকৃতির। আমি বিশ্বপ্রকৃতির দূত। আমার গানে যদি একজনেরও আনন্দ মন্ত্রে দীক্ষা হয়ে থাকে, আমার দৌত্য সার্থক।—এই বলে কবি ঘরে ফিরে গেলেন।
তারপর ক্রমশ যখন দেশসুদ্ধ লোক কবির গানে মেতে উঠেছে, তখন একদিন কবি তাঁর স্ত্রীকে বললেন—সকলকে আনন্দের মন্ত্র শোনালাম, শুধু যিনি আমার অন্তরের আনন্দ-স্বরূপা, তাঁকে সে মন্ত্র দেবার অবসর পেলাম না। মানুষকে দিলাম বিশ্বপ্রকৃতির বাণী, আর তোমাকে দিলাম কেবল ভালবাসা। যিনি আমার সকলের চেয়ে আপনার তিনিই বঞ্চিত হলেন।
কবি-প্রিয়া কোনও উত্তর দিলেন না, স্বামীর মুখের পানে চেয়ে একটু হাসলেন। মনে হল সে হাসির দীপ্তিতে কবির আনন্দ-মন্ত্রও ম্লান হয়ে গেল।
তারপর একদিন বিনামেঘে বজ্রাঘাত হল, যৌবনের অন্তিম সীমা অতিক্রম না করতেই কবির মৃত্যু হল। দেশসুদ্ধ লোক হাহাকার করতে লাগল; সেদিনকার মতো কবির উপদেশও কারুর মনে রইল না।
রাজা শোকে অধীর হয়ে কবির গৃহে গেলেন—শেষবার তাঁকে দেখবার জন্য। সঙ্গে অমাত্যরা গেলেন।
কবির গৃহের সম্মুখে বিশাল জনতা। সবাই আক্ষেপ করছে, দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করছে, অশ্রুমোচন করছে, রাজা শোক-কাতর জনতার ভিতর দিয়ে কবির অঙ্গনে প্রবেশ করলেন।
প্রবেশ করে বাষ্পাচ্ছন্ন চক্ষু মুছে স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন যে কবি-প্রিয়া মৃত স্বামীর মস্তক ক্রোড়ে করে বসে বসে হাসছেন।
রাজার মনে হল, তাঁর সেই হাসির অম্লান দীপ্তিতে রাজ্যসুদ্ধ লোকের শোক পাংশু হয়ে গেছে।
১৩৫০