কবি-কাহিনী
১
সুমন্ত্র গোস্বামী প্রথম নীল লেফাফাটা পেয়েছিল তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘অন্যপূর্বা’ বেরোবার তিন দিন পর। ৬ই ফেব্রুয়ারি। তারিখটা মনে থাকার কারণ ‘অন্যপূর্বা’ বেরিয়েছিল সেবার বইমেলায়। একটু বিশেষ আড়ম্বরের সঙ্গে। আগে থেকে জানা হয়ে গিয়েছিল এ বইও কোনও বিশেষ পুরস্কার পাচ্ছে। প্রকাশক এবং কবি উভয়েরই উৎসাহ তাই ছিল মাত্রাতিরিক্ত। আসলে কবিতাগুলো আগেই বেরিয়েছে বহু বিখ্যাত পত্র-পত্রিকায় এবং লিটল ম্যাগাজিনে। তখনই বহু জনের সেগুলো ভালো লাগে। সুমন্ত্র তার প্রথম বই ‘পরিযায়ী নক্ষত্র’-এর জন্য খুব সম্মানজনক পুরস্কার পেয়েছিল। সম্বর্ধনাও পেয়েছিল অসাধারণ। সব জিনিসটাই তার কাছে অভাবনীয় এবং অপ্রত্যাশিত। সদ্য-ত্রিশ এই যুবক খুব অস্পষ্টভাবে যে যশঃপ্রার্থী ছিল না তা নয়, কিন্তু এই সুকঠিন কাণ্ডজ্ঞান সর্বস্ব বর্তমান জগতেও সে শুধুই লেখাতেই মগ্ন ছিল। একটি লিট্ল ম্যাগাজিনের প্রভুত্ব অথবা দাসত্ব তার সম্বল। এবং কবিতারা তার কাছে আসে শীতের মরশুমে সাইবেরিয়ার প্রাত থেকে উড়ে আসা প্রত্যাশী বালি-হাঁসের ঝাঁকের মতো। চাকরি সে যে একেবারে পায়নি তা নয়। কিন্তু ন’টার সময়ে অফিসের ভাত খেতে গিয়ে যদি গলায় কবিতার অর্ধেক পংক্তি আটকে যায়, বাকি অর্ধেক দিয়ে যাকে তোলাটা জরুরি, জুতোয় পা গলাতে গিয়ে যদি কবিতার অন্তিম শ্লোক মনে আসে প্রাথমিক পদগুলো পূরণ করার জরুরি দাবি নিয়ে এবং অফিসের হাজিরা খাতায়, দরকারি ফাইলে, কলম-স্ট্যান্ডে সংলগ্ন বাক্যবন্ধ ভেসে উঠে উঠে তাকে অসংলগ্ন করে দিয়ে যায়, তাহলে সে কি করেই বা চাকরি করবে! কাজেই বাড়িতে দ্বিতীয় ব্যক্তি অনতিপ্রৌঢ় বাবাকে কিছু না বলে কয়ে সে চাকরিটা ছেড়ে দেয় এবং চাকরির সময়টুকু নিয়মিত বেরিয়ে, নোটবুক কলমসেমত পাড়ি দিতে থাকে সেইসব জায়গায় যেখানে যুবকরা প্রেমিকাদের নিয়ে যায়। যেহেতু প্রেমিকা নোটবুকের পাতায়, ঘড়ি অত্যন্ত সস্তা, পকেটে বাসের ভাড়া এবং মুড়ি ছোলাভাজার অতিরিক্ত রসদ নেই সেহেতু চোর-ডাকাত-মস্তানরা তাকে বিরক্ত করে না। বাড়িতে সুমন্ত্রর পুরো সময়টাই ব্যয় হয় তার পত্রিকা ‘কিন্তু এবং বরং’-এর তাঁবেদারিতে। বাবা অবশ্য তার চালাকি ধরে ফেলেছিলেন মাস না ফুরোতেই। কিছু বলেননি। সুমন্ত্রর বাবা সেই প্রজন্মর লোক যাঁরা প্রচুর ইংরিজি-বাংলা কবিতা কণ্ঠস্থ করে পরীক্ষা পাস করতেন। রবীন্দ্রনাথকে প্রকৃতই গুরুদেব মনে করা যাঁদের মনোবৃত্তির অঙ্গ ছিল। ছেলে গাঁজা খাচ্ছে না, মেয়ে চরাচ্ছে না, এমন কি যখন তখন আড্ডা বসাচ্ছে না, শুধু অখণ্ড মনোযোগে পাতার পর পাতা কবিতা লিখে যাচ্ছে, একটি পত্রিকার জন্য প্রাণপাত পরিশ্রম করছে, এর মধ্যে ছেলের যে একটা অসাধারণত্ব আছে এটা তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন। শুধু বলেছিলেন—‘আর তিন বছর পর আমার রিটায়ারমেন্ট মনু মনে রাখিস।’ সুমন্ত্র মনে রেখেছে। সুমন্ত্র নয়, তার ভাগ্য। সে প্রথম কবিতার বইয়ের জন্যই আশাতীত সম্মানমূল্যের পুরস্কার পেয়েছে। শুরুতেই এই পুরস্কার পাওয়ায় তার প্রতিভার পালে মন্দ-মধুর হাওয়া লেগেছে।
এমন দিনে নীল লেফাফা। সুমন্ত্র যে ভক্ত পাঠকদের চিঠি পায় না তা নয়। পায়। সে এখন নবীন-নবীনা মহলে প্রায় ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই নীল লেফাফায় কিছু অসাধারণত্ব ছিল।
প্রিয় কবি,
‘কবি ছাড়া তুমি কি অন্য কিছু? নাম-পদবী ঠিকানা সবই তোমার বাইরের পরিচয়। অন্তর-মহলে তুমি শুধু কবি। উদ্দেশ্যমুখী বিপুল জনস্রোতে তুমিই একমাত্র যে অন্য অভিমুখে যাচ্ছো। অন্য কোনও স্তরে। সেখানে সবই ছন্দোময়। তোমার কাছে মিনতি তুমি গদ্যে এসো না। গদ্যে নয়, কখনও গদ্যে…।’
এইভাবে বিন্দু বিন্দু অশেষ দিয়ে সেই অদ্ভুত নীল চিঠি শেষ হয়। তার অন্তে কোনও নাম নেই। ঠিকানা নেই। ছোট এক পাতা সম্বন্ধ প্রলাপ। ব্যস। আগাগোড়া রোম্যান্টিক। কোনও অর্বাচীন, না কি অর্বাচীনা?
এর পরেও অনিয়মিতভাবে কিন্তু নিয়মিত এসে গেছে চন্দন রঙের, ফিকে বেগুনি রঙের, গোলাপ পাপড়ির রঙের খাম। ভিতরে একই রঙের কাগজে অক্ষরমালা যা নারীরও হতে পারে, পুরুষেরও।
‘আস্তিকের সভা থেকে উবে গেলে কর্পূরের মতো
ধূপের নিকৃষ্ট গন্ধে, শঙ্খের বাচাল নাদে ভয়।
শুভ শুক্রবার ভোজ, আঁটোসাঁটো সার্প্লিসের ভাঁজে
পিছল শিথিল খোঁজো। আজানে ত্রিসন্ধ্যা জপ
তীব্ৰ গৃধ্নু হাওয়ায় ছড়ালে স্বেচ্ছা নিবাসনে চলে যাও।
তুমি ভীত, তুমি ধৃষ্ট, মরুবালু তৈলভূমে তুমি হতাহত
গৃধিনীরা নিয়ে গেছে তোমার রক্তের ঘ্রাণে শ্বাস।
সম্প্রতি প্রকাশিত এই কবিতার চরণগুলি উদ্ধৃত করে আরম্ভ হয় চন্দন রঙ চিঠি।
‘তুমি কি আমাদের নিহত ঈশ্বরের খোঁজে যেতে বলো? প্রাচীন কালের খ্যাপা পণ্ডিতটি যে লণ্ঠন হাতে নিয়ে মানুষের খোঁজে যেতেন সেই লণ্ঠনটাই যদি আমাদের দরকার হয়? ভেবে দ্যাখো, কবি ঈশ্বরের সন্ধানে যাবে, না লণ্ঠনের সন্ধানে।’
চন্দন-চিঠির মধ্যে এক ধরনের সমালোচনা নিহিত আছে। সমালোচনা নয় এক ধরনের সম্প্রসারণ যা সুমন্ত্রকে ভাবায়। সুমন্ত্র প্রায় নিশ্চিত হয় এ কোনও অর্বাচীনের চিঠি নয়। কিন্তু তারপরেই আসে গোলাপফুলের রঙের খাম। যার মধ্যে ছেলেমানুষি ভাবাবেগ। ভাষার বাঁধুনি তাকে চাপা দিতে পারেনি। প্রথম চিঠি তাকে বিভ্রমে ফেলেছিল, দ্বিতীয় চিঠি তাকে উদভ্রান্ত করল। বলা বাহুল্য তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম চিঠিগুলির প্রত্যেকটি সুরাসুর আলাপের এক একটি আরোহী স্বরে চড়া। আরোহী এবং সম্বাদী। এ এমনই একজন সুমন্ত্রর প্রত্যেকটি ভাবনা যার তারে তান চড়ায়। সে বোঝে, আরও ভাবে, কবিতার আড়ালে কবিকে ধরবার চেষ্টা করে। কিন্তু নিজেকে কিছুতেই ধরা দেয় না। সুমন্ত্র আজকাল কেমন একটা অস্থিরতা অনুভব করে, তার কবিতায় এই অজানার প্রতি আকুতি মিশে থাকে।
হাতে লাঠি নিয়ে পিঠে রুকস্যাক
মরুৎ পাহাড়ে অকুতোভয়
ঠিকানা জানি না, বেসক্যাম্পের
আগুনে জ্বালাব অপ্রত্যয়।
ঠিকানা নেই তো! ক্ষীরোদ সাগরে
ডুবো জাহাজের চৌকিদার।
প্রযত্নে দিও জুল ভের্ন দক্—
খিনা রঞ্জন মজুমদার।
অযুত লীগের দূরত্ব খুঁড়ে
পরিশ্রান্ত উর্ধ্বশ্বাস।
ঠিকানা জানাই।শিশিরে কি ভয়।
সাগরে শ্রীহরি করেন বাস।
কচি কলাপাতা রঙের লেফাফা এলো তখন বসন্ত শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফটাফট ফাটতে আরম্ভ করেছে শিমূলের ফল। তার হোরিখেলা এবারের মতো সাঙ্গ হল। আগের দিন কালবৈশাখীর প্রচণ্ড দাপটে এবং পরবর্তী শিলাবৃষ্টির চোটে পথপাশের টুকরো টাকরা প্রকৃতি তছনছ, তবু ভেজা পাতা, ভেজা মাটির সুগন্ধ যেন কস্তুরীমৃগের মতো সকাল বেলার হালকা রোদে মম করছে। কাঁপা কাঁপা হাতে খামটা খুলে কাগজটা মেলে ধরল সুমন্ত্র। ‘ঠিকানা জানাচ্ছি।’ বুকের মধ্যেটা ধ্বক করে উঠেছে। ‘রবীন্দ্রজয়ন্তীর জন্য ইস্পাতনগরীর রবীন্দ্রভবনে অনুষ্ঠান। তুমি সমাহূত। সরকারি চিঠি যাচ্ছে। অবশ্যই এ সভা গদ্যের সভা নয়। যদি গদ্য থাকে তো তাকে সমূলে উৎপাটিত করা কিম্বা তাকে পদাবলীতে পরিণত করার শক্তি তোমার নিশ্চয় আছে।’
যাঃ এই ঠিকানা? যাবে তো অবশ্যই। কিন্তু এ কি হেঁয়ালি? খুঁজে নিতে হবে না কি? প্রথমে এসেছিল হতাশা, কিন্তু পরে সে মনে মনে চ্যালেঞ্জটা নিয়ে নিল। এতো শুধু সাধারণ একটা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া নয়, রোমাঞ্চকর অভিযান একটা। দুষ্প্রাপ্য অভিজ্ঞতার সন্ধানে পাড়ি দেওয়া। তাছাড়া সূত্র তো কিছু আছেই। পত্রলেখিকা শৌখিন। উচ্চ শিক্ষিত, ভাবুক। রবীন্দ্রভবনের সঙ্গে যুক্ত। সুমন্ত্র হঠাৎ চমকে উঠল। সে কেন লেখিকা ভাবছে। লেখক হওয়াও একই রকম সম্ভব। চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে নামিয়ে রেখেছিল, তুলে নিল। যাঃ বরফ হয়ে গেছে। আধ-খাওয়া কাপটা তুলে নিয়ে রান্নাঘরের সামনে রাখল। পাঞ্জাবিটা গায়ে চড়াল। বাবা কাগজ পড়ছিলেন। চশমার ওপর দিয়ে বললেন—‘বেরোচ্ছিস?’
‘একটু।’
‘তাড়াতাড়ি আসিস। একসঙ্গে খাবো।’
‘নিশ্চয়ই।’
কোথাও যাবে বলে সে বেরোয়নি। একটা দুটো চক্কর শুধু। ভেতর থেকে উত্তেজনার ঠেলা। এখন বাড়িতে থাকলে সে একটার পর একটা বই টেনে টেবিলে নামাবে শুধু। কিম্বা ঘরের মধ্যে, দালানের মধ্যে অশান্ত পায়চারি। একটার পর একটা আধখানা সিগারেট। তার চেয়ে আজাদ হিন্দ বাগের ভেতরটা একটা চক্কর দিয়ে বেথুন কলেজের পেছন দিয়ে ঘুরে স্কটিশ স্কুলের পাশ দিয়ে কারবালা ট্যাঙ্ক লেনে ঢুকে পড়ো। বিডন স্ট্রিটে সুকান্তর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
‘কি রে তুই নাকি রবীন্দ্রজয়ন্তীতে বিশেষ অতিথিগিরি করতে টাটা যাচ্ছিস?’
সুমন্ত্র বলতে যাচ্ছিল—‘হ্যাঁ।’ চট করে সাবধান হয়ে গেল, বলল—‘কে বলল?’
—‘আমার দিদি জামাইবাবু থাকে না! আরে বাবা টিসকোর মস্ত অফিসার আমার জামাইবাবু।’
—‘রন্টুদি? সে তো⋯’
—‘দূর। আমার নিজের দিদি নয়। কাজিন। লিখেছে এবার রবীন্দ্র জয়ন্তী ঘটা করে হচ্ছে। কবি সুমন্ত্র গোস্বামী আসছেন। ওঁর মুখে ওঁর নিজের কবিতা এবং রবীন্দ্রনাথ শুনবো। ভালোভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ক আসছেন, তুই তোর বউকে নিয়ে ঘুরে যা। দিদি জানেও না প্রধান অতিথি মহোদয়টি আমাদেরই অপোগণ্ড এই ইয়ার।’
সুমন্ত্র গম্ভীর হয়ে বলল—‘যাক অপোগণ্ডর ওপর দিয়ে গেছে, গলগণ্ড বলিসনি এই ভালো।’
সুকান্ত খুব খানিকটা ঠা-ঠা করে হাসল। বেবি ফুড কোম্পানির সেলসম্যান বন্ধুটি দিবারাত্র মোটর সাইকেলে ঘ্যাঁঘাসুরের মতো শব্দ করে ঘোরে। কোনও সূক্ষ্ম জিনিস এর মাথায় কোন দিন ঢোকেনি। স্কুলের বেঞ্চি থেকে ভাব। কিন্তু বরাবর বলেছে ‘কী করে তোর এই আগডোম বাগডোমগুলো শুনে লোকে মুচ্ছো যায় বল তো! তুমি তুমি করে কি সব বাতেল্লা দিস অথচ বাস্তবে তুমি যে কি ফ্যানটাসটিক জিনিস জানলিই না।’ সুমন্ত্র যদি বলতো তার এই ‘তুমি’ বেশিরভাগ সময়েই ‘আমি’, কখনও কখনও ঈশ্বর, আবার কখনও সাধারণভাবে মানুষ, তাহলে হয়ত সুকান্তর হার্ট অ্যাটাক হত।
সুকান্ত আরও বলে—‘কি যে খুচুর খুচুর করে খর্চা করিস! পকেটে রেস্ত না থাকলে আবার জীবন।’ সুকান্ত জানে না, লিখে সে আজকাল ভালই রোজগার করছে। বড় বড় পত্রিকা থেকে বাঁধা চাকরির ডাকও আসছে। সে খালি ভাবছে ভাবছে। ছকে বাঁধা জীবনের মধ্যে তার বনের পাখিটি যদি মরে যায়? কিম্বা যদি আস্তে আস্তে খাঁচার পাখি হয়ে যায়। দুটো বিকল্পই সমান ভয়াবহ।
সুকান্ত তখনও বলে চলেছে— ‘বাঁচতে গেলে ফুর্তি চাই, বন্ধু, ফুর্তি চাই। অটোগ্রাফ চাইতে আসবে কতো তন্বী, শ্যামা, কটা, মোটা। একটাকে বান্ধবী টান্ধবী বানিয়ে নিস। আর বারে যাবি না, না-ই গেলি। দু চারজন আমার মতো ঘনিষ্ঠ বন্ধু নিয়ে গোল হয়ে বোস, চাক্কু ঘোরা, ছিপি খোল, চেপে চুপে ঢাল, খিলখিল হাসতে হাসতে মোরগার বুকভাজা দিয়ে খা আঃ।’
এটাও সুমন্ত্রর একটা ভয়। সুমন্ত্রর বাবারও ভয়। কিন্তু এবং বরং-এর পঞ্চবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ওরা কবি সম্মেলন করেছিল। দূর-দূরান্ত থেকে তাঁরা এলেন। যাঁরা থেকে গেলেন, অর্থাৎ বাধ্য হয়ে থেকে গেলেন, তাঁদের একজনকে ছাত থেকে নামানো গেল না। আরেকজন সারা রাত বোতল নিয়ে শ্মশানে বসে রইলেন। সুকান্ত তাঁকে রাতের খাওয়ার জন্য তৃতীয়বার ডাকতে গেলে জড়ানো গলায় বললেন—‘চিতের আগুন না দেখে, মেয়েছেলের মড়াকান্না না শুনে কবিতা লিখবে? শ্ শালা। ’
সুমন্ত্রর বাবা যেদিন প্রথম টের পেলেন সে বন্ধু সংসর্গে কিছু তরল বস্তু গলাধঃকরণ করেছে, যৎসামান্য, কিন্তু করেছে, সেইদিনই তাকে জীবনের প্রথম এবং শেষ বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন।
‘কবি হতে চাও মনু, ঈশ্বর তোমায় ভাষা দিয়েছেন, ভাব দিয়েছেন, হও। নিশ্চয়ই হবে। আমি তোমাকে মার্চেন্ট অফিসের অ্যাসিস্টান্ট হতে কি ব্যাঙ্ক কর্মচারী, কি মাস্টার মশাই হতে সাধাসাধি করব না। যদিও এগুলো হয়েও কবি হওয়া যায়, অনেকে হয়েছেও। কিন্তু তুমি হোল-টাইমার হতে চাও। ঠিক আছে, হয়ে যাও। কিন্তু কৃত্রিম উত্তেজনা যদি তোমার কাব্য-প্রেরণার জন্য মাস্ট হয়, তো তুমি ডোপ নেওয়া খেলোয়াড়ের মতো হয়ে গেলে। আসলি চীজ নয়। হোল টাইমার হবার যোগ্যও নয়। আর একবার যদি ধরো ছাড়তে পারবে না। সমাজের উঁচু তলায় দে নো হাউ টু ট্রিট এ মাতাল, নিচু তলাতেও তাই। কিন্তু তুমি মাঝে আছো। মাঝেই থাকবে। মাসে দশ হাজার রোজগার করলেও থাকবে। জীবনের প্রথম ত্রিশটা বছর সেখানেই থেকেছো কি না। তুমি জানো না, আমিও জানি না মদ্যপ নিয়ে কি করতে হয়। মনু তুমি তো মরতে চাও বলে কবি হও নি?’
বঙ্কিমচন্দ্র ব্রজেশ্বর প্রসঙ্গে দেবী-চৌধুরানীতে যে সব বাপের সুপুত্তুর ছেলেদের কথা বলেছিলেন সুমন্ত্র ঠিক সেই জাতীয় না হলেও বাবা তাঁর নিজের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা তার থেকে অনেক দিন আদায় করে নিয়েছেন। সুমন্ত্রর অতি-কিশোর বয়সে মা মারা যাবার পর কোনও ছুতোতেই দ্বিতীয় বিবাহ করেননি, সব আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছেন, ছেলের পড়াশুনো দেখেছেন।
খেলাধুলো-গান-কবিতায় উৎসাহ দিয়েছেন। প্রথম দিকে তো তিনিই শ্রোতা ছিলেন। সুমন্ত্র যা করতে চেয়েছে বাধা দেননি। দুজনে পাশাপাশি ঘরে শোন। জ্বর হলে জলপটি দেওয়া, মাথা ধুইয়ে দেওয়া এসব নিঃশব্দে করে থাকেন। হঠাৎ-হঠাৎ টনিকের বোতল কিম্বা ভিটামিনের পাতা সামনে রেখে বলেন, ‘মনু তোমার খিদেটা কম। দেখছি, চেহারাটা শুকনো শুকনো। বি কমপ্লেক্সটা দরকার। মনে করে খেও।’
বন্ধুরা টিটকিরি দিলেও সুমন্ত্র বাবাকে উড়িয়ে দিতে পারে না।
যথাসময়ে সরকারি চিঠি সমেত দুটি কিশোর এলো। একজনের নাম নওল, আরেকজন দীপন। চিঠি রবীন্দ্রভবন কমিটির প্রেসিডেন্টের নামে। সনির্বন্ধ অনুরোধ। তিনদিনের অনুষ্ঠান। তিন দিনই থাকতে হবে। প্রধান অতিথি নয়, সে বিশেষ অতিথি। গায়ক-গায়িকা আবৃত্তিকারদের তালিকা সম্ভ্রম উৎপাদক। সুমন্ত্রর হৃৎকম্প হল। এইসব বিখ্যাত পেশাদার আবৃত্তিকারদের পাশাপাশি তাকেও আবৃত্তি করতে হবে নাকি? সুমন্ত্র জানে না তার চেহারার আশ্বিনের কাশফুলের মতো সহজ স্বাভাবিক সতেজ চরিত্র, তার উচ্চারণের স্পষ্টতা, জড়তাহীন গম্ভীর কণ্ঠলাবণ্য এবং কবিতার প্রতি তার আন্তরিক ভালোবাসা খুব সহজলভ্য নয়। চলনদার আসবে চব্বিশে বৈশাখ। না বলার কোনও উপায়ই থাকে না। ইচ্ছেও সম্ভবত না। যদিও সে সভালাজুক।
গেস্ট হাউসটা নগর এলাকার সামান্য বাইরে। এখানকার অনেক কর্মীই অবসরগ্রহণের পর এখানেই জমি কিনে মনের মতো বাড়ি তৈরি করেন। এখানেই বসবাস। সোনারির এই সুন্দর বাংলোর অধিকারী এমনি একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। কিন্তু তিনি দিল্লিতে এখন নিজের ফার্ম খুলেছেন। সোনারির বাংলো পড়েই আছে। রবীন্দ্রভবন সেটাকে অস্থায়ী গেস্ট হাউস হিসেবে ব্যবহার করছে। দোতলায় একটা গোল লাউঞ্জ। মাথার ওপর লালটুকটুকে টালির ছাত। নিচ থেকে তার ওপর মর্নিং গ্লোরি আর তরুলতার ডাল তুলে দেওয়া আছে। লাউঞ্জে গোল গোল জানলা, জাহাজের পোর্ট হোলের মতো।
সুমন্ত্র যখন পৌঁছলো, তখন গায়ক বাদকদের কেউ কেউ পৌঁছলেও সব যে যার ঘরে। নিজেদের মালপত্র রাখা, বিশ্রাম, গুছিয়ে বসা, তা সে যত অল্প সময়ের জন্যই হোক—এ সবের জন্য সময় চাই। আপাতত দোতলার এই জাহাজি ডেক ফাঁকা। মার্বেল-ঢাকা গোলাপি মেঝের ওপর আরামদায়ক কয়েকটা চেয়ার দূরে দূরে বসানো। অনুপম টবে কয়েকটা সুন্দর পাতাবাহার। গোল জানলার মধ্যে দিয়ে তাকালে রোদ ঝলসানো এক সবুজ দিগন্ত দেখা যাবে। লাল রাস্তা। ধারে ধারে আধ ময়লা দোকান, আপাতত রোদের তাড়ি খেয়ে টলছে। সুমন্ত্রর গুছিয়ে বসার দরকার নেই। জামাকাপড় বদলাবার তাড়া নেই, এমন কি বিশ্রামেরও এক্ষুনি এক্ষুনি প্রয়োজন নেই। সে অতটা গেরস্ত এখনও হয়ে ওঠেনি। কড়া ইস্ত্রি করা যোধপুরী পাজামা তার ওপর তসর রঙের চুড়িদার পাঞ্জাবি। এই তার সাজ, ঘরেও, বাইরেও। কখনও কখনও রঙ-কটা জীনস আর ঝলঝলে টি-শার্ট। ঘরের মধ্যে ঝোলাটা রেখে এসে সে একটু বারান্দায় বসলো। তারপর কী মনে করে মুখ হাত ধুতে টয়লেটে গেল। মুখে চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে ধবধবে সাদা তোয়ালেতে মুখটা মুছতে বেশ কিছুটা লালচে কালো ছোপ ধরল। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
এভাবে যা কিছু শুভ্র ধরিত্রীর বুকে
নিজস্ব ময়লা মুছে কালো করি।
সেই মনুগাত্রমল ঈশানে নৈর্ঋতে
সর্বনাশা কালো মেঘ।
দুর্দান্ত অম্লবর্ষা ধিনি ধিনি নাচে
ত্বক খায়, মেদ খায়।
স্নায়ুতন্ত্রী নিহত কেন্নোর মতো কুঁকড়ে খসে যায়।
নিষ্কলঙ্ক কঙ্কালের খটাখটি প্রলয় বাতাসে।
‘ইস্, আপনি লিখছিলেন। সো সরি!’ ভীষণ চমকে, নোটবুক বন্ধ করে ফেলল সুমন্ত্র। তিন চারজন মেয়ে এমনি পা টিপে টিপে এসেছে যে একদম বুঝতে দেয়নি। পরিবেশের নির্জনতা ও সুমন্ত্রর মনোনিবেশের ওপর পাহাড়ি চিতার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
—‘এ সঙ্ঘমিতা, আমি রিয়া আর এই যে আয় না সামনে⋯এ কিশুয়ার। আপনি নিশ্চয়ই টাইটেল জিজ্ঞেস করবেন না।’ বলে ঝলমলে কিশোরীটি কলকল করে হেসে উঠল।
অন্যরাও হাসল। সুপুরি গাছের মতো সহজ দোলা দুলে।
—‘আমরা এলাম।’
—‘বেশ করেছ, তো টাইটল জিজ্ঞেস করব না কেন?’
মেয়ে তিনটি পরস্পরের দিকে চেয়ে মুখ টিপে হাসল। সরলভাবে বলল, ‘বদারেশন। হু রিয়ালি কেয়ার্স। রিয়া কিশুয়ার নামের মেয়েটিকে দেখিয়ে বলল—‘শী ইজ কিউরিয়াস। শী হ্যাজ নেভার সীন আ পোয়েট।’ কিশুয়ার রিয়ার পিঠে কিল মেরে বলল—‘ইউ রিয়া, ইউ নটি গার্ল। শী, শী ইজ কিউরিয়াস।’
সুমন্ত্র বলল,—‘ঠিক আছে। আমি বুঝে নিয়েছি। তোমরা সবাই কৌতূহলী। দূর থেকে মানে ছবি-টবিতে বিস্তর কবি দেখেছো। কিন্তু এমন কাছ থেকে কখনও কেউ দেখোনি। রাইট!’
কিশুয়ার জোরে জোরে ঘাড় নাড়ল, দাঁতে নখ কাটছে।
—‘যাক গে এখন তো দেখলে? কী মনে হচ্ছে? কবি এপম্যান জাতীয় কিছু না ভূত-প্রেত?’
তিনজনে এবার লুটিয়ে লুটিয়ে হাসছে। এতো হাসির কী হল? রিয়া অনেক কষ্টে হাসি চেপে বলল—‘য়ু শিওর লুক লাইক আ পোয়েট। এই কিশুয়ারটা এতো নটি যে, বলছিল টিসকোর জুনিয়ার অফিসারের মতো দেখতে হবে পোয়েটকে। আসলে আমরা পড়েছি। কিন্তু দেখিনি তো?’
—‘কি পড়েছো?’
—‘ওহ, লংফেলো, ইয়েটস, টেনিসন।’ কাঁধটা ঝাঁকাল রিয়া। কিশুয়ার যোগ করল—‘অ্যান্ড অফ কোর্স টেগোর।’
এরা তাহলে বেচারি সুমন্ত্র গোস্বামী নব্য কবির কোনও কবিতাই পড়েনি। লংফেলো টেনিসন পড়ে সুমন্ত্র গোস্বামীকে দেখতে এসেছে। এই সময়ে সঙ্ঘমিতা মেয়েটি বলল—‘প্রেসিডেন্ট এইটা আপনাকে পাঠালেন।’ সে একটা মাঝারি পিকনিক কেস মেঝের ওপর নামিয়ে রাখল। স্কার্টের পকেট থেকে একটা খাম বার করে সুমন্ত্রর দিকে এগিয়ে দিল। আর তার পরেই যেন শালিখের দল ‘পালা পালা’ রব পড়ে গেল, দেখতে দেখতে তিনজনেই কে আগে যায় কে আগে যায় করতে করতে পগার পার।
খামটার দিকে নিবিড় চোখে তাকাল সুমন্ত্র। বেশ শৌখীন বড় খাম, সাদা। প্রথম থেকেই তার অনুমান এই প্রেসিডেন্টই তার পত্র লেখিকা-লেখক। খাম খুলতে বেরোল প্রেসিডেন্টের লেটার হেডে চিঠি। নির্ভেজাল ডান দিকে ঝোঁকা মেয়েলি হাতের লেখা।
“মাননীয়েষু,
আশা করি অসুবিধে হচ্ছে না। একটু পরেই সরেজমিনে তদন্ত করতে যাচ্ছি। আপাতত একটু রসদ পাঠালুম। ঘরে গিয়ে খুলবেন। নমাস্কারান্তে, অনিন্দিতা সান্যাল।
খুব কৌতূহলের সঙ্গে নিজের ঘরে গিয়ে পিকনিক কেসটা খুলল সুমন্ত্র। একটা বেঁটে চ্যাপটা বোতল। বিদেশি হুইস্কি। পাশে সোডা ওয়াটারের বোতল। একটা সাদা পলিথিনের চৌকো বাক্সে লালচে কালো রঙের শুকনো মাংস, লাল সবুজ লংকা তার গায়ে লেগে আছে। চামচ, প্লেট, সার্ভিয়েৎ সব মজুত।
বাক্সটা বন্ধ করে টেবিলের ওপর রেখে দিল সুমন্ত্র। খুব রাগ হল। তিনটি কিশোরীর হাত দিয়ে এসব পাঠাবার মানে কি? তাই-ই ওদের অত ঝটপটি। সে আর বাইরে বেরোল না। রোদের তাপ বাড়ছে। জানলার পর্দাগুলো টেনে দিল। দুটো হাত মাথার তলায় দিয়ে চুপচাপ শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগল। রিয়া বা সঙ্ঘমিতার মধ্যে কেউ কি তার পত্রলেখিকা হতে পারে? রিয়াকে সঙ্গে সঙ্গেই বাদ দেওয়া যায়। সঙ্ঘমিতা মেয়েটি কিন্তু একটু বিশিষ্ট। বেশি কথা বলে না। বেশি কেন, বলেই না। একটা মোটার দিকে দোহারা চেহারা। সজল চোখ, নীলচে চুলে বিনুনি সে যেন ওদের চেয়ে একটু বয়স্ক। হাব-ভাব গম্ভীর, অচপল। যেন অনেক কিছু ভাবে। কিন্তু বিহারী শহরের কনভেন্টে পড়া সতের আঠারো বছরের কিশোরী কি ওভাবে বাংলা কবিতার বিশ্লেষণ করতে পারবে? না। বোধ হয় না।
দরজার টোকা পড়ল। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দিল সুমন্ত্র। সামনে দুটি ভদ্রলোক, দুটি মহিলা। দামি পুষ্পসার এবং আফটার শেভের গন্ধে ঘরের বাতাস ভরে গেল।
শার্ট-প্যান্টালুন পরা ভদ্রলোকটি হাত জোড় করে বললেন—‘আমি অরিন্দম সান্যাল। একজন সাধারণ ভদ্রলোক। প্রতিভাবান মানুষদের কাছে আমার অন্য পরিচয় নেই। ইনি অনিন্দিতা। আমার স্ত্রী, আপাতত রবীন্দ্র জয়ন্তী কমিটির প্রেসিডেন্ট। নামেই প্রেসিডেন্ট অবশ্য। আসলে সব করে আমার এই বোন দোলা।’ দোলা নামক মহিলাটি একটু শান্ত হেসে বললেন, ‘না। সুমন্ত্রবাবু মোটেই না। আমি বউদিকে একটু সাহায্য করি মাত্র।’
অরিন্দিম সান্যাল অপর পুরুষটির দিকে তাকিয়ে বললেন—‘ইনি ওসমান আজিজ। আমাদের মধ্যে একমাত্র গুণী ও সমঝদার মানুষ। পাবলিক রিলেশসনস-এর লোক। কিন্তু আপনার একনিষ্ঠ ভক্ত পাঠক। সবরকম সাহিত্যেরই। সে অবশ্য আমার স্ত্রী এবং বোনও। তবে ওসমান সাহেব বুঝে, এরা খুব সম্ভব না বুঝে। আমি ভাই সোজাসুজি স্বীকার করি কবিতা-টবিতা বুঝি না। কিন্তু বুঝি না বলেই সে জিনিসটা ফ্যালনা তা বলব না।’ এবার গলা পাল্টে অরিন্দম বললেন—‘মে উই জয়েন য়ু?’
—‘আসুন।’ সুমন্ত্র এতক্ষণ হাসিমুখে হাতজোড় করে সঙের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। এবার দরজা হাট করে খুলে দিল।
অনিন্দিতা সান্যাল একটু এগিয়ে গিয়ে জানলার পর্দাগুলো সরিয়ে দিলেন। বাইরে থেকে রোদ লাফিয়ে পড়ল। গরম হওয়া সঙ্গে সঙ্গে। একটু মাফ চাওয়া স্বরে অনিন্দিতা বললেন,—‘মিঃ সেন, যাঁর বাড়ি আর কি। এয়ার কুলার লাগাননি ; আপনার খুব কষ্ট হবে। পর্দাগুলো কাচিয়েছি। তা-ও কেমন ধুলো ধুলো গন্ধ।’
ওসমান আজিজ বললেন—‘একি আপনি যে শুরুই করেননি।’ পিকনিক বাকসটি খুলে, চেয়ার টেনে তিনি বসলেন।
সুমন্ত্র একটু আড়ষ্ট হেসে বললো—‘আমি⋯মানে⋯আমি আসলে খাই না।’
অরিন্দম সান্যালের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠছে।
‘খান না? আপনি বলছেন কি? একজন নোটেড পোয়েট আপনি খান না?’ অনিন্দিতা বললেন—‘এরকম কথা আমি জন্মেও শুনি নি।’
ওসমান সাহেব বললেন—‘ইয়ং ম্যান, লাঞ্চের আগে একটু হুইস্কি⋯ ইটস অলওয়েজ গুড ফর ইয়োর স্টম্যাক। উই কান্ট থিংক অফ⋯’
সুমন্ত্র হেসে বলল, ‘ইউ আর ওয়েলকাম। আপনারা খান না।’
—‘তা কি হয়?’
—‘কেন হয় না? আমার সঙ্গী সাথীরা খাচ্ছে আমি গল্প স্বল্প করছি এতো প্রায়ই হয়।’
—‘স্ট্রেঞ্জ।’ অরিন্দম বললেন, স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে তিনি খুব হতাশ।
—‘কবিতা না বুঝলেও আমি অন্তত কবি বুঝি, এ বিশ্বাসটাও ভেঙে দিলেন?’ অরিন্দম নিরাশ গলায় বললেন।
নামী কবি হবার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঘরে এয়ার কুলার, লাঞ্চ ডিনারের আগে পান ইত্যাদি উচ্চবিত্ত অভ্যাসগুলো করে ফেলতে হবে এই অকুপেশন্যাল হ্যাজার্ডের কথা সুমস্ত্র ভেবে দেখেনি। এই সব মহলে সে বোধ হয় অচল।
ওসমান বললেন,—‘যা-ই হোক। উনি যখন অনুমতি দিচ্ছেন আমরা নিয়মরক্ষার্থ একটু খাই। সান্যাল বসুন। দোলা, মিসেস সান্যাল দাঁড়িয়ে রইলেন কেন?’
সকলকার চেয়ার কুলোল না। দুই মহিলা বিছানার ওপরে বসলেন। সুমন্ত্র বাইরে থেকে একটা চেয়ার বয়ে আনল।
অনিন্দিতা বললেন—‘আর ইউ শিওর, আপনার খারাপ লাগবে না?’
—‘একেবারেই না,’ সুমন্ত্র হেসে জবাব দিল।
—‘এই সব পাঁড় মাতালদের কথা ছেড়ে দিন।’ মিসেস সান্যাল বললেন, ‘মিঃ সান্যালের ঠাকুদাদার নামই ছিল মাতাল সান্যাল। জানেন তো? এরা নিত্য নতুন সঙ্গী খোঁজে। সঙ্গী যত সফিস্টিকেটেড, এদের উৎসাহ তত বেশি।’
—‘আমি কিছু মনে করব না। আপনারা খান।’
—‘তাহলে আপনি ছোট্ট একটু নিন প্লীজ।’
বারবার লাজুক মেয়ের মতো না না করতে খারাপ লাগে। সুমন্ত্র বলল, ‘ঠিক আছে। দিন একটু।’
অরিন্দম সোৎসাহে বললেন— ‘এই জন্যেই বলেছে নারী নরকের দ্বার।’
অনিন্দিতা সবাইকার গ্লাস সাজাচ্ছিলেন। বললেন—‘পুরুষ বলে নারী। নারী বলে পুরুষই নরকের দ্বার। কী বল দোলা?’
দোলা চুপ করে রইল, হাসল না। সুমন্ত্রর গ্লাসে ততক্ষণে গ্লাস ঠেকাচ্ছেন ওসমান আজিজ। দোলা বসেছে আলোর দিকে পিঠ ফিরিয়ে। জানলার দিকে তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। মেয়েটি কৃশাঙ্গী। পাতলা মুখের গড়ন। আবছায়ায় যতটা দেখা যাচ্ছে মনে হচ্ছে নাক, চোখ, ঠোঁট সবই খুব পাতলা ধরনের। বলবার মতো কিছু নয়। কিন্তু ব্যাখ্যাতীত একটা আকর্ষণী শক্তি আছে। সেটাও কিছুক্ষণ পরে প্রকাশ্য। প্রথম দেখলে কিছুই মনে হয় না। একে ক্ষীণা। তার ওপর বাংলা অর্থে শ্যামা। হাতির দাঁতের রঙের শাড়িতে ছোট ছোট নীল বুটি। পাড় নেই, মেয়েটির চুল এবং ভ্রূর রং একটু বাদামি। আধা আলগা বিনুনি। মৃদু সুগন্ধ।
অনিন্দিতা যখনই ঘুরছেন, ফিরছেন সোনালি সিল্ক চমকাচ্ছে। সোনার গয়না চমকাচ্ছে, সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। সুমন্ত্রর নারীবর্জিত সংসারে বাস। অনিন্দিতার নারীত্ব একটা প্রবল হাওয়ায় মতো তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়, কিম্বা বলয়গ্রাসে ঘিরে ফেলে। মহিলার একহারা অথচ ভরাট গড়ন। মুখটি তিল তিল করে সাজানো। সিংহের কেশরের মতো ঝাঁকড়া চুল। কিন্তু তিনি চুলটা ঘাড় পর্যন্ত ছেটে ফেলবার আধুনিক ভুলটি করেছেন। পঁয়ত্রিশ-টিশের পরে চুল ছেঁটে ফেললে, বিশেষ করে তীক্ষ মুখশ্রীর মেয়েদের চেহারায় ব্যক্তিত্ব যে অনুপাতে বাড়ে, মিষ্টত্ব সেই অনুপাতে কমে। এ কথা সুমন্ত্র তার এক ঘনিষ্ঠ দাদার ঘনিষ্ঠ বউকে বলেছিল। বউদি বলেছিল—‘মিষ্টত্ব? মানে ছেলে-ভোলানোর কল? চাই না চাই না চাই না। ব্যক্তিত্ব? চাই চাই চাই।’ সুতরাং…। অনিন্দিতা হয়ত তাই চান। কিম্বা শুধুই ফ্যাশনদুরস্ত হতে চান। ওঁরা চলে যাবার পর সুমন্ত্র একদম নিশ্চিত হয়ে গেল যে দোলা সান্যালই তার পত্র লেখিকা।
২
সন্ধেবেলাতেও বিহারী গরম কমে না, তবে শুকনো। গা জ্বালা করে, ঘাম হয় না। অনুষ্ঠানের পরিবেশ অপূর্ব। এরকম মঞ্চসজ্জা তার সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতায় সুমন্ত্র দেখেনি। করেছে এখানকার ছাত্র-ছাত্রীরাই। তাদের গুরুদের সাহায্যে। অর্থাৎ রঙ দিয়ে ভরেছে সব আলপনা। সব ছবি। আসল কৃতিত্ব গুরুদের। হলের দুদিকে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির প্যানেল। মঞ্চময় গ্রীষ্মের অজস্র ফুল। পেছনে লম্বা লম্বা তিনটে কাঠের ফ্রেমে বিভিন্ন নাটকের চরিত্রের রূপসজ্জায় রবীন্দ্রনাথের ছবি। মাঝে মানানসই আলপনা। গুরু দুজনের সঙ্গে অনুষ্ঠানের আগে আলাপ হল। সাম্যর বয়স অর্জুনের থেকে কমই হবে, দীপালিও মনে হয় তাই। এরা শান্তিনিকেতনের ছাত্র। রামকিংকর, বিনোদবিহারী এঁদের সংস্পর্শে এসেছে। সাম্য থাকে বিষ্ণুপুরে। আঁকার স্কুলে করেছে। নিজেরও স্টুডিও আছে। দীপালি থাকে সাকচি। মেয়েদের স্কুলে আঁকা শেখায়। নিজের কথা বিশেষ বলতে চায় না, খালি বলে, ‘দেখবার মতো কিছু নয়। এখানে কত কি⋯’
দীপালি হেসে বলল—‘এখানে রক্তমাংসের মানুষগুলি দেখবার, স্বীকার করছি। কিন্তু তুমি যে তোমার মনের মানুষ তৈরি করেছো।’
সুমন্ত্র বলল—‘কাল পরশুর মধ্যে নিশ্চয়ই যাবো। ঠিকানাটা দিন।’ পাশপকেট থেকে নোটবই বার করে সে সাগ্রহে দীপালির দিকে এগিয়ে দিল। তারপর সাম্যর দিকে। হাতের লেখাগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে নিল।
দীপালি বলল—‘আমার ঠিকানা নিয়ে কী করবেন? দেখবার শোনবার কিছুই নেই। অবশ্য কবি-শিল্পীর চোখ সাধারণের মধ্যে অসাধারণ দেখে। কী বলল সাম্য?’
সুমন্ত্র চকিত হয়ে বলল—‘নিশ্চয়ই। সত্যিকার শিল্পী বা কবি হলে অবশ্য। আপনার বাসস্থান সাধারণ কিনা সেটাও বিচার্য।’
দীপালি বলল—‘সাম্য অনেক কিছু দেখতে পায়। এমন কি আমারও একটা পোর্ট্রেট এঁকেছে জানেন ; এতো ওয়াশ করেছে যে আমাকে তো চেনা যায়ই না, কোনও রক্তমাংসের মানবী কি না সন্দেহ হয়।’
সাম্য বলল—‘বিশ্বাস করুন সুমন্ত্রদা, দীপালিদি বড় বাজে কথা বলে। আমি কখনও মডেল ব্যাবহার করি না। তবু ওর ধারণা ওটা ওর ছবি। হতে পারে কোনও সাদৃশ্য এসে গিয়ে থাকবে। আসলে ওটা যাকে বলে আমাদের অবচেতনা তারই ছবি⋯।’ এতো কথা বলে ফেলে সাম্য লজ্জা পেয়ে চুপ করে গেল। দীপালি তখনও মিটিমিটি হাসছে।
ছাত্রছাত্রীদের রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে শুরু। তারপর বিখ্যাত আবৃত্তিকার। তারপর কলকাতা থেকে আসা গায়িকা। তারপর সুমন্ত্রর নিজস্ব কবিতা। কবিতা সে পড়ে ভালোই। কিন্তু আজকের পড়া যেন দিনের পড়াকে ছাপিয়ে গেল। সুমন্ত্রর পাঠের পর কোনও ঘোষণা ছাড়াই গেয়ে উঠল অরিন্দম সান্যালের বোন দোলা সান্যাল—‘আঁধার রাতে একলা পাগল। ’
মন্ত্রমুগ্ধের মতো বেরিয়ে এসে বাইরের আলো-জ্বলা রাতের চত্বরে একলা দাঁড়িয়ে রইল সুমন্ত্র। একটু আড়ালে। ওধার দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে শ্রোতারা। বেশির ভাগই ত্রিশোর্ধ্ব মনে হয়। বয়স্ক আছে অনেক। তবে রিয়া কিশুয়ারদের দলকেও দেখা গেল। এখান থেকে সোনারি অনেক দূর। তবু হাঁটতেই ইচ্ছে করছে। সাদাটে নীল আকাশের রঙ, চতুর্দিকে টিপটিপ আলো জ্বলছে। লম্বালম্বা পরিচ্ছন্ন রাস্তা। টেলিগ্রাফের তার চলে গেছে। বহু দিন একলা হেঁটে এতো আনন্দ পায়নি সে। এমন সুগন্ধ মৃদু আলো জ্বলা রাতে কখনও হাঁটেনি।
হাঁটছি তো হাঁটছিই, হাঁটতে-হাঁটতে
এক ফোঁটা শিশির,
বললে আমায় তুলে নাও।
হাঁটছি তো হাঁটছিই হাঁটতে হাঁটতে
এক টিপ জোনাকি
দপ করে মুঠোর মধ্যে ঢুকে গেল।
হাঁটছি তো হাঁটছিই হাঁটছি হাঁটছি
লক্ষ্মীপেঁচা ডেকে উঠল
সে আমার কাঁধের ওপর ডানা ছড়িয়ে বসেছে।
বলল ‘ভালো হবে, তোমার লক্ষ্মী হবে
খোকা, তোমার সরস্বতী হবে।’
ডরিক থামগুলো দেখা যাচ্ছে।
আমি পার্থেনন পৌঁছতে চাই।
দেবী এথিনার হাত থেকে
ছাগ-রক্ত নেবো।
সাক্ষী এক টিপ শিশির, এক ফোঁটা জোনাকি
একটি গোলাপি-পেট প্যাঁচা।
পৌঁছে যাই।
দেবীর পায়ের কাছে নামিয়ে রাখি অর্ঘ্যগুলি
শিশিরের জায়গায় চোখের জলের লোনা দাগ।
জোনাকিটা নিবে গেছে।
পেঁচাটা ক্যাঁ ক্যাঁ শব্দে উড়ে গেল।
গেস্ট হাউজের এখানে ওখানে নিকষ অন্ধকারের মধ্যে আলো জ্বলছে। দূর থেকে একটা টুনি বাল্ব লাগানো বনস্পতির মতো দেখায়। হাতার মধ্যে ঢুকতেই একটা আলোর বিন্দু থেকে নওল বেরিয়ে এলো। —‘সুমন্ত্রদা, আপনার খানা গরম হচ্ছে। ঘরে গিয়ে বসুন। দিচ্ছে।’ নওলের গলায় সম্ভ্রম। বলল, ‘আপনার পোয়েমস, রীডিং সব আমায় ভীষণ টাচ করেছে।’ সুমন্ত্র ফিকে হাসল। সে এখন অন্য মেজাজে। শিশির, জোনাকি, পেঁচা, এবং প্রত্যাখ্যাত এথিনার জন্যেও তার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। সে বলল—‘অল্প দিতে বলল।’
খাবার মাঝের লাউঞ্জে দিতে বলল সে নওলকে, বলল—‘তুমিও বসো। আমরা একসঙ্গে খাই।’
নওল অপ্রস্তুত মুখে বলল—‘আমি যে স্ট্রিক্ট ভেজিটেরিয়ান।’
‘এঁরা ভেজ কিছু দেন নি?’
—‘অরিন্দম আঙ্কল আর অনিন্দিতা মাসির ব্যাপার, ওঁরা খুব মাংস খান। আমরা নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা করে বলি ক্যানিবাল্স্।’
—‘তুমি হঠাৎ বাংলার প্রতি এতো অনুরাগী হলে কী করে নওল?’
—‘আমার মা যে বাঙালি।’ উজ্জ্বল মুখে বলল নওল।
—‘তবু তুমি মাছ-মাংস খেতে শেখোনি!’
—‘মা নিজেই ছেড়ে দিয়েছে!’
—‘তোমার মা বাবা আসেননি সভায়?’
—‘এসেছিলেন। বাবা না মা। ছুটি তো ছিল না। বাবা ইজ টায়ার্ড। মা গান আর বিশেষ করে, কবিতা শুনতে চলে এলো। নট দ্যাট শী আন্ডারস্ট্যান্ডস পোয়েট্রি মাচ্!’
—‘তাহলে শুনলেন যে বড়?’
—‘ভাষাটা বাংলা তো! মাদার সেজ-পুজোর মন্ত্রও কি আমরা সব বুঝি?’
চমৎকৃত হয়ে সুমন্ত্র বলল—‘আচ্ছা! নওল তুমি বোঝো?’
নওল ভীষণ অপ্রস্তুত হল, বলল—‘ভালো লাগে কিছু কিছু, বুঝি কি না বুঝি আপনি ক্রস করতে পারবেন না কিন্তু!’
সুমন্ত্রর মাথা থেকে এখনও আঁধার রাতের একলা পাগল যাচ্ছে না। সে ভালো করে খেতে পারল না। তার ভেতরের একলা পাগলই বা কী বোঝবার আশা নিয়ে দেবীর মন্দিরে যাচ্ছিল, কেনই বা তার জোনাক পোকাটি নিবে গেল? নওল উঠছে। সুমন্ত্র অন্যমনস্ক গলায় বলল—‘কোনদিকে যাবে?’
—‘বাংলোগুলো দেখেছেন? কাঁচ ঢাকা? ওই বাংলোয় থাকি।’
—‘অনেক যে রাত হল।’
—‘হ্যাঁ, এগারটা। সাইকেল রয়েছে ঝট করে চলে যাবো।’
—‘স্কুটার বা মোটর সাইকেল ব্যবহার করো না?’
—‘বাড়িতে রয়েছে। আমি স্কুল ডেজ থেকে সাইকেলে চলি, ভালো লাগে।’
নওলকে একটু এগিয়ে দিয়ে ফিরে এলো সুমন্ত্র। মাঠে ঘাটে এতক্ষণে একটা সুন্দর ঠাণ্ডা ভাব। উপভোগ করার মতো। ফিরতে ফিরতে দূর থেকে দেখল বাংলোর ডান দিকে ছায়া-ছায়া মতো একটা গাড়ি যেন। দোতলায় লাউঞ্জের জানলায় কি কেউ দাঁড়িয়ে আছে? চট করে সরে গেল। দোতলার ঘরগুলোতে আজ কেউ নেই। গায়ক-বাদক-আবৃত্তিকাররা সভা থেকেই সোজা স্টেশনে চলে গেছেন। কালকের অধিবেশনের জন্য অন্য আর্টিস্টরা আসবেন। তাঁদের কেউ?
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সে একটা চেনা-চেনা পার্ফুমের গন্ধ পেলো। পুষ্পসার বিষয়ে সে খুব অভিজ্ঞ নয়। কোনটা ফরাসী, কোনটা দেশি বলতে পারে না। কাজেই চেনা-চেনা লাগলেও ধরতে পারল না। কে মেখে এসেছিল এই পার্ফুম? দোলা সান্যাল নয় তো! তার গা ছমছম করে উঠল। এতক্ষণের কবিতা থেকে সে মুহূর্তে একটা গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়ল। আকাশি রঙের চিঠি দিয়ে সে গল্প আরম্ভ।
গোল ফ্রস্টেড বাতির মায়াময় অন্ধকারমাখা আলোয় অনিন্দিতা বসে আছেন। ঘন ভায়োলেট রঙের হালকা কি একটা শাড়ি পরেছেন। কানে হাতে কি সব পাথর আধা অন্ধকারে দারুণ চমকাচ্ছে। সুমন্ত্র হীরের জহুরি নয়, সে আসল-নকল চিনতে পারে না। অনিন্দিতা বললেন—‘একা একা চুপি চুপি বেশ তো পালিয়ে এলেন! আমরা সবাই খুঁজে খুঁজে হয়রান। কী করে এলেন?’
—‘কেন যেভাবে আসা যায়, হাঁটতে হাঁটতে।’
—‘হাঁটতে হাঁটতে? বাঃ বেশ বললেন তো! গেটে গাড়ি রেডি। এতটা পথ আপনি অমনি হাঁটতে হাঁটতে চলে এলেন!’
—‘আমার হাঁটতে খুব ভালো লাগে’, সুমন্ত্র একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল।
—‘সে তো বুঝতেই পারছি। আমাদের কম্প্যানি বোধহয় ভালো লাগছিল না।’
—‘কী যে বলেন। এতো সুন্দর রাত। হাঁটার আনন্দই আলাদা।’
—‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। কেমন খেলেন, বলুন।’
—‘খুব ভালো।’ আপনাদের, কি বলব খানসামা না বাবুর্চি, খুব ভালো রাঁধে।’
হেসে উঠলেন অনিন্দিতা—‘বাবুর্চি বেঁধেছে! কে বলল?’
—‘রাঁধেনি?’
—‘উঁহু। সে হয়তো আমার চেয়ে ভালোই রাঁধত, কিন্তু কবি সুমন্ত্র গোস্বামীকে নিজের হাতে রেঁধে খাইয়ে কৃতার্থ হওয়ার সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে?’
—‘এতো ভালোবাসেন আপনারা কবিতা? এ কিন্তু আমার ধারণার বাইরে।’
—‘কী ধারণার বাইরে? আমার মত মেটিরিয়্যালিস্টিক মহিলা কবিতা ভালোবাসতে পারে কি না?’
সুমন্ত্র অপ্রস্তুত হয়ে বলল—‘মোটেই তা নয়। আপনিই বা মেটিরিয়্যালিস্টিক হতে যাবেন কেন?’
—‘তাই মনে হওয়াই স্বাভাবিক। গাড়ি ছাড়া চড়ি না। এয়ারকুলার ছাড়া বসি না। বাবুর্চি ছাড়া খাই না। প্লেনে ছাড়া ঘুরি না। এই দেখুন না, সাজসজ্জাও তো সব বিলাসিনীর।’
—‘শৌখীনতার সঙ্গে কবিতার তো কোনও বিবাদ নেই! অনেকেই তো চিঠির খাম-কাগজ ইত্যাদি বিষয়ে ভীষণ শৌখীন। নানা রঙের কাগজ ব্যবহার করেন। করেন না?’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সুমন্ত্র আধো অন্ধকারের মধ্যে। অনিন্দিতার মুখের ভাব পাল্টালো না। বললেন—‘চিঠির কাগজ? কাকে চিঠি লিখব? বাবার জন্যে ইনল্যান্ড লেটারই যথেষ্ট, আর শ্বশুরের জন্যে পোস্টকার্ড।’
উনি কি ছলনা করছেন? ধরা দেবার ইচ্ছে নেই? আরও বেশি লুকোচুরি খেলবেন? ইচ্ছে করলে উনি তা পারেন।
সুমন্ত্র বলল—‘মিস সান্যাল এলেন না?’
—‘মিস সান্যাল? মিস সান্যাল কে? ও দোলা?’ হঠাৎ হাসিতে ফেটে পড়লেন অনিন্দিতা। দোলা কোন দুঃখে সান্যাল হতে যাবে? ও অরিন্দম সান্যালের বোন এই মিথ্যাটা আপন চট করে বিশ্বাস করে নিলেন? দোলা অরিন্দমবাবুর পিসতুত না মাসতুত পিসির ভাসুরের মেয়ে। এখানে বরাবরের মতো থাকতে হলে ওকে বোন-টোন সাজতেই হয়।’
ভেতরে একটা ধাক্কা লাগল। সুমন্ত্র চুপ করে গেল।
অনিন্দিতা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন—‘হয়ত এইজন্যেই কবিতা ভালোবাসি। মানুষ যেমনি গুমরোয়, কবিতাও তেমনি গুমরোয়। হয়ত বুঝি না। অনধিকার-চর্চা করি, কিন্তু তবু কোথাও কবিতার মধ্যে মুক্তি পাই। সুমন্ত্র, তুমি হয়ত মনে করবে দিনকাল বদলে গেছে, আমিই বা কেন এই অসহ্য অবস্থা সহ্য করে আছি, ছেড়ে দিলেই তো পারি সান্যাল সাহেবকে। কিন্তু সাহেবই যে ছাড়তে চায় না, আমি দুজনের মাঝখানে শীলতার আড়াল। লোকচক্ষুকে ঢেকে রাখবার চিক। স্ক্যাণ্ডাল কি ওর পক্ষে ভালো? তাছাড়া, দোলা তো ওকে পুরোপুরি নেবেও না। সাহেব অনেক আশা করে ওকে এনেছিলেন। কিন্তু তাঁর দৌড় এখন লক্ষ্মণের গণ্ডি অব্দি।’
সুমন্ত্র ইতস্তত করে বলল—‘যাক, দোলা যে মাথার ঠিক রেখেছেন, তাঁর যে বুদ্ধিভ্রংশ হয়নি⋯।’
এরকম পরিস্থিতিতে সে তো কখনও পড়েই নি। কি বলা উচিত তা-ও জানে না, অথচ পরিস্থিতি যেন তার কাছ থেকে কিছু হার্দ্য প্রতিক্রিয়া আশা করছে।
—‘বুদ্ধিভ্রংশ?’ অনিন্দিতা একটু হাসলেন—‘একে বলে হৃদয়ভ্রংশ। এর ওপর কারো হাত নেই। যুক্তি এখানে চলে না। অরিন্দমকে এখন আর চায় না তাই মাথার ঠিক রেখেছে দোলা।’
—‘কী চান দোলা?’ সুমন্ত্রর ভেতরে একটা অসহিষ্ণুতা, সে জটিলতার মধ্যে বড় হয়নি। জটিলতায় অসহায়, বিরক্ত বোধ করে।
অনিন্দিতা বললেন, ‘ভালো বলেছ। কি চায় দোলা? তুমিই বলো না। তুমি তো কবি, তোমার বলা উচিত।’
সে কবি বলে দোলার মনের কথা বলে দিতে পারবে? কবি হওয়ার আরও ঝক্কি ঝামেলা রয়েছে তাহলে!
সুমন্ত্র হেসে বলল—‘মনস্তত্ত্ববিদ নই, জ্যোতিষীও নই, আমি একজন বেচারি কবি, আমার কাছ থেকে এতে অন্তর্দৃষ্টি আশা করা কি ঠিক?’
—‘বেশ আমি তোমায় সাহায্য করছি। দোলা আর কাউকে চায়।’
—‘কে আজিজ সাহেব?’
—‘টু অবভিয়াস হয়ে গেল, না?’
সুমন্ত্রর কিন্তু মোটেই ব্যাপারটা অবভিয়াস মনে হয় নি। চতুর্থ ব্যক্তি ওসমান আজিজ ছাড়া আর কেউ ছিল না, তাই সে অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো করে নামটা বলেছিল।
আজিজ সাহেবের ঘন চুলে কিছু কিছু পাক ধরেছে। তিনি দোলার থেকে অনেক বড়। দোলার বয়স ত্রিশের মধ্যে। নিঃসন্দেহে। যদিও আজকাল নারী পুরুষ সবারই বয়স বোঝা দায়। ওদিকে আজিজ সাহেব চল্লিশের ওপারে। ভদ্রলোক ভীষণ, যাকে বলে সফিস্টিকেটেড। কেতাদুরস্ত। দোলাকে খুব সহজ স্বাভাবিক শ্যামলী বাঙালি মনে হয়। দুজনকে ঠিক মেলাতে পারা যায় না।
অনিন্দিতা এবার একটা অদ্ভুত হেসে বললেন—‘অথচ আজিজ ওকে চান না।’
সুমন্ত্র কিছু বলছে না, চেয়ে আছে। অনিন্দিতা রহস্যময় সুরে বললেন—‘ওসমান আজিজ পরকীয়ায় একেবারে মজে আছেন।’
নীচে স্কুটারের শব্দ হল। অনিন্দিতা হাসতে লাগলেন। অরিন্দম সান্যাল ঝড়ের বেগে ওপরে উঠে আসছেন।—‘যাক, তুমি এখানে? দোলা ঠিকই ধরেছে। দেখুন তো সুমন্ত্র, এই মহিলা আমার মাথা খারাপ করে দিলে।’
—‘অটো ধরে এলেন?’ সুমন্ত্র হালকা গলায় বলল।
অরিন্দম বললেন—‘আর কি করা! এখানকার রাস্তাঘাট একলা মহিলার পক্ষে মোটেই সেফ না। তার ওপর অর্নামেন্টস রয়েছে। এই সব হীরে টিরে পরে⋯’
সুমন্ত্র চকিত হয়ে বলল—‘সত্যি, আপনি খুব অন্যায় করেছেন।’
—‘আই ডোন্ট লাইক টু প্লে ইট সেফ।’ অনিন্দিতা এখন একটু গম্ভীর, কারুর অপেক্ষা না রেখে তরতর করে নেমে গেলেন।
অরিন্দম কাতর গলায় বললেন, ‘আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখবেন, সুমন্ত্রবাবু? আমার মতো হতভাগা কবিতার অযোগ্য, যদি গল্প-টল্প হয়।’
অরিন্দমবাবুর আলুথালু অবস্থা। ধুতি-পাঞ্জাবি পরেছেন। কুঁচোনো ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি, সব যেন লণ্ডভণ্ড। অথচ অরিন্দম পান করেছেন বলে মনে হল না।
সারারাত অরিন্দম সান্যালের অনুনয় ঘুমের ঘোরে মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করতে লাগল। সুমন্ত্র তার জোনাক পোকা মুঠোয় ভরে দেবী এথিনার কাছে যাচ্ছে। মাথার ওপর ঝটপট করতে করতে পাখি যাচ্ছে একটা। একি তার সেই লক্ষ্মীপেঁচা? স্বপ্নের সুমন্ত্র অবাক হয়ে তাকায়, পাখি নেই। অরিন্দম সান্যালের কোঁচা লুটোচ্ছে। কুঁচকে গেছে পাঞ্জাবি। হাহাকারের মতো করে বলছেন, ‘আমি কবিতার অযোগ্য। হতভাগা, আমায় নিয়ে লিখতে পারেন না?’
চট করে ঘুমটা ভেঙে গেল সুমন্ত্রর। নিশুতি রাত। ঝিঁঝিঁর আওয়াজ হচ্ছে একটানা। হতভাগ্যের জন্যেও তো কবিতা। হতভাগ্যের গান! অরিন্দম বোধহয় অন্যরকম হতভাগ্য!
৩
ঝকঝকে সকালে অটো নিয়ে সুমন্ত্র বিষ্ণুপুরের দিকে গেল। আজ সকালের প্রাতরাশ নওলের বাড়ি। দুপুরে আজিজ সাহেব। উভয় জায়গাতেই সে কিছু না কিছু নিয়ে যেতে চায়। নওলের মায়ের জন্য অবশ্য সে নিজের দুখানা বই রেখেছে। কিন্তু আজিজ সাহেবের ওসব পড়া। বিষ্ণুপুরে পৌঁছে তার মাথায় একটা মতলব খেলে গেল। সে একে ওকে তাকে জিজ্ঞেস করে সাম্যর স্টুডিওয় পৌঁছে গেল।
—‘সুমন্ত্রদা আপনি সত্যি এসেছেন?’ সাম্য একেবারে অবাক।
—‘না আসলে ঠিকানা নেবো কেন?’ এরা সবাই তাকে মহা দামি একটা ব্যাপার বানিয়ে দিচ্ছে।
দু’ ঘরের ছোট্ট বাড়ি। সামনে খোলা দাওয়া। পেছন দিকে খুব সম্ভব উঠোন এবং তার ওদিকে রান্নাঘর-টর। এই গরমেও সাম্যর স্টুডিও ঘরটা ভারী ঠাণ্ডা। ঠাণ্ডা সাদা দেয়াল, কোথাও কোথাও চুন খসে গেছে।
পলিথিন-মোড়া কয়েকটি বড় বড় ছবি দেয়ালের উপর উল্টো করে রাখা। ইজেলের ওপর একটা ক্যানভাস। আন্দাজ তিন ফুট বাই চার ফুটের মধ্যে সুমন্ত্র মাইলের পর মাইল খোয়াই দেখল। মুখ ব্যাদান করে শুয়ে আছে। ওপরে নক্ষত্র জ্বলা আকাশ। নক্ষত্রের আলোয় দেখা খোয়াই। তার ওপর কেমন একটা তীব্র গতিময় ছায়া। দেখতে দেখতে সুমন্ত্রর চারপাশ থেকে গ্রীষ্মের বিহারি সকাল নিবতে থাকে। পায়ের তলা থেকে শানের মেঝে সরে যায়। সে শুকনো প্রাগৈতিহাসিক ধুলোর স্তরে, মাটির ফাটলে ডুবতে থাকে।
বাতাসে ধুলোর রুক্ষ গন্ধ।
টিমটিমে তারাগুলোয় তুই মশাল জ্বেলে দিলি
এখনও অনেক কাজ বাকি, অনেক
হাঁটুভর সিলিকেট আর ধাতুসংকরের মধ্যে
গুঁজে দিচ্ছিস একটার পর একটা মৌল
এখনও তোর রসায়ন সবুজ আনতে পারল না।
ফেটে যাচ্ছে তোর মাটি
শূন্যের দিকে চেয়ে তুই বুক চাপড়ে কাঁদছিলিস।
একটা বিস্ফোরণ
দূর ফাটলের মধ্যে থেকে তোর শেষ সৃষ্টি
মাথা তুলছে দেখতে পেলি
তোর হাহাকার এখন আর্তনাদ
ঝোলার মধ্যের সবচেয়ে তেজস্ক্রিয় বিস্ফোটকটা
ছুঁড়ে দিয়ে
তুই পালাচ্ছিস, পালাচ্ছিস…
কী ভীষণ আত্মঘাতী, ঈশ্বরঘাতী দ্বিতীয় ঈশ্বর
সৃষ্টি করেছিস তুই!
—‘কী ভাবছেন, সুমন্ত্রদা!’—সাম্য খুব চুপিচুপি জিজ্ঞেস করল।
সুমন্ত্র মগ্ন স্বরে বলল—‘সাম্য, এ ছবিটা তুমি কেন কীভাবে…’
—‘সামান্য ল্যান্ডস্কেপ। এর ভেতরে তো ব্যাকরণগত কোনও জটিলতা নেই। সুমন্ত্রদা। আসলে আমি এটা স্মৃতি থেকে আঁকি।’
—‘আঁকো? মানে মাঝে মাঝেই আঁকো নাকি? এক একই ছবি?’
সাম্য অপ্রস্তুত মুখে বলল—‘খানিকটা তাইই। আমি শান্তিনিকেতনের ছেলে তো! গুরুপল্লীতে থাকতাম। সাবজেক্টের খোঁজে বেরোলেই প্রথমে চোখে পড়ত খোয়াই। খোয়াই আমার চেতনার মধ্যে মিশে গেছে।’
—‘তাই দেখছি,’ সুমন্ত্র হেসে তারপর বলল—‘তোমার এই ছবিটির কত দাম হতে পারে!’
সাম্য বলল—‘হাজার-টাজার হবে, আপনি নিলে আমি শুধু রঙ, ক্যানভাসের দাম নিয়ে ছেড়ে দেব।’
সুমন্ত্র বলল—‘না, না, এটা আমি নেবো বলে জিজ্ঞেস করিনি, আমার এসব বিষয়ে জানা নেই, কৌতূহল হচ্ছিল।’
—‘এগজিবিশন করে ছবি দেখাবার সুযোগ তো আমরা পাই না!’
—‘পাবে। আজ না হোক কাল। সাম্য তোমার এই খোয়াইয়ের ওপর একটা পলাতকা ছায়া ফেলে রেখেছে, এ কার? কেন?’
সাম্য হাসল, বলল—‘কি জানি, আমি হয়তো রোদ-জ্বলা ওই খোয়াইয়ে ছায়া চাইছিলাম। হয়ত ওটা আমার আশা।’
—‘কিন্তু ও তো স্পষ্টই গতিমান। এবং পলাতক। আশা কি পলাতক হতে পারে?’
—‘পারে না?’ সাম্য সংক্ষেপে প্রশ্ন করল।
—‘আমাকে একটা ছোটখাটো মেমেন্টো কিছু দিতে পারো? উপহার দেওয়ার মতো!’
সাম্য একটু চিন্তা করল। তারপর বলল—‘কার্ড জাতীয় কিছু?’
—‘না। ধরো সাজিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে…’
—‘তাহলে আপনি দীপালিদির কাছে দেখতে পারেন। ও অনেক রকম কাটুম কুটুম করে।’
—‘ঠিক আছে। চলো একবার দীপালির বাড়ি যাই। নিয়ে যাবে?’
—‘বেশ তো!’ একটু আমতা আমতা করে বলল সাম্য।
অটোতে উঠতে উঠতে সুমন্ত্রর মনে হল—যিনি চিঠি লেখেন, তিনিও তো ক্রমাগত আত্মপ্রকাশের তাগিদেই লেখেন। আত্মপ্রকাশের একটা উপায় পেয়ে গেলে চিঠি লেখার তাগিদটা বোধহয় খুব বেশি থাকার কথা না। সাম্যকে তার পত্রলেখকের ফ্রেমের মধ্যে আটকানো যাচ্ছে না।
প্রচুর গাড়ি ঘোরাফেরা করছে। বড় বড় দোকানপাট। চওড়া রাস্তা। তবু যেন সুমন্ত্র লাল এবড়ো খেবড়ো মাঠের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। কোনও অদৃশ্য ছায়াকে ধরতে। তার মুঠোর মধ্যে একটি জোনাক পোকার আলো জ্বলছে নিবছে, জ্বলছে নিবছে।
দীপালি দরজায় তালা দিয়ে বেরোচ্ছিল। সাম্য বলল, ‘তাড়াতাড়ি গিয়ে ধরুন, ওর পায়ে চাকা লাগানো আছে।’ সুমন্ত্রকে আসতে দেখে দীপালি অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি?’
—‘আসতে বলেছিলেন তো, অনাহূত তো আর আসিনি!’
দীপালি অনেকটা হেসে বলল, ‘উঃ, আপনি না! আমি কি স্বপ্নেও ভেবেছি যে আসবেন!’
—‘বাঃ চমৎকার। আমি কি হারুন-অল-রশিদ। ’
—‘হারুন-অল-রশিদ তো আসতেন, গরিবের ঘরে ছদ্মবেশে আসাটা তো তাঁর প্রোগ্রামে থাকত। কিন্তু আপনি ওপর মহলের আতিথ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, আমি সত্যি আশা করিনি।’
সুমন্ত্র গম্ভীর মুখে বলল—‘এসে বিপদে ফেললুম দেখছি। ঘরের মধ্যে অনেক লুকোবার জিনিস আছে বোধহয়, সুন্দর সুন্দর রাইটিং প্যাড…’
দীপালি আশ্চর্য হয়ে বলল—‘লুকোবার জিনিস থাকতেই পারে, ছাড়া কাপড়, এঁটো কাপ, ঘরটা খুব গোছানো নেই, কিন্তু এত্তো জিনিস থাকতে রাইটিং প্যাড, আবার সুন্দর…লুকোতে যাবো কেন? থাকলে শো দিয়ে রেখে দেবো। আসুন!’
সুমন্ত্র বলল—‘এসো সাম্য।’
—‘সাম্য! সে কোথায়? সে তো আপনাকে নামিয়ে দিয়েই চলে গেছে।’
—‘সে কি? এমন তো কথা ছিল না!’ সুমন্ত্র আশ্চর্য হয়ে বলল।
—‘ওকি আসবে বলেছিল?’
—‘না, তা অবশ্য ঠিক বলেনি। কিন্তু…’
—‘কি মুশকিল, তার কাজ থাকতে পারে না?…’
দীপালি ঘরের একমাত্র চেয়ারটা এগিয়ে দিল। চেয়ারে বসতে বসতে সুমন্ত্র বলল—‘সত্যি সত্যি আপনি লিখতে ভালোবাসেন না? চেয়ার রয়েছে, টেবিল রয়েছে, একখানা কচি-কলাপাতা রঙের রাইটিং প্যাড হলেই তো দিব্যি লেখা যায়। যায় না?’
দীপালি হেসে বলল—‘লিখলেই বা পড়ছে কে? এক আপনার মতো কবিরাই বোধহয় ওসব আবোলতাবোল পড়তে পারেন।
সুমন্ত্র সোজা হয়ে বসল, তাহলে দীপালিই? সে বলল—‘বেশ তো কবিরা তো আবোলতাবোল বকেও। পড়ান না আপনার লেখা। যেন আইভরির মতো রং প্যাডটার!’
দীপালি মজার মুখ করে বলল—‘কবিরা সত্যিই আবোলতাবোল বকে দেখছি, একটু আগে বললেন কচি-কলাপাতা প্যাড, এখন বলছেন আইভরি। প্যাড-ফ্যাড নয়, একখানা রোজনামচা আছে আমার। এখন পড়াতে পারছি না, উইল করে আপনাকে দিয়ে যাবো।’
মুহূর্তের মধ্যে এক গ্লাস শরবত তৈরি করে এনে দিল দীপালি। চুমুক দিয়ে সুমন্ত্র বলল—‘বাঃ, কী দিয়ে তৈরি করেছেন?’
—‘আপনি বুঝি রান্না-টান্নাও করেন?’
—‘জানেন তো, আমাদের পিতা-পুত্রের সংসার, অতিথি-আপ্যায়নের রীতিগুলো জেনে রাখা ভালো। বলুনই না।’
—‘কেন আপনার ওই কচি-কলাপাতা আর আইভরি!’
—‘গোলাপ-পাপড়ির নির্যাস, নীল অপরাজিতার কোল এ সব না?’
দীপালি এবার হেসে খুন হয়ে গেল। হাসির আড়ালে সে কিছু লুকোবার চেষ্টা করছে কি না খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল সুমন্ত্র।
দীপালি বলল—‘আপনার মাথায় পোকা আছে!’
সুমন্ত্র নিশ্বাস ফেলল। বলল—‘আমার মাথায় না থাকলেও অন্য একজনের মাথায় নিশ্চয় আছে।’
—‘কার কথা বলছেন? সাম্য তো? সাম্যর মাথায় পোকা আছে তো বটেই!’
শরবতের গ্লাস নামিয়ে রেখে সুমন্ত্র বলল, ‘কেন?’
দীপালি কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে বলল—‘নইলে আমাকে বিয়ে করতে চায়?’
—‘এতো খুব আনন্দের কথা…।’ সুমন্ত্রর গলায় বিস্ময়।
—‘ব্যস, বিয়ের কথা হল অমনি পাত পেড়ে ফেললেন? জানেন আমি ওর চেয়ে বড়, ও আমাকে বরাবর দিদি ডেকে এসেছে!’
সুমন্ত্র নরম গলায় বলল, ‘দেখুন লাভ ইজ লাভ, কোন পক্ষ বয়সে বড়, এসব প্রশ্ন আজকাল আমরা ছাড়িয়ে এসেছি। এই সামান্য কারণে আপনি ওকে কষ্ট দেবেন না।’
দীপালি বলল, ‘লাভ? সে আপনি বুঝবেন না সুমন্ত্রদা, আপনি কবি, ভাব-রাজ্যে বিচরণ করেন, পৃথিবীটা নীরস, নিরেট গদ্য, বুঝলেন? আপনার তো আশ্চর্য লাগবেই : আমার মতো মেয়ের কারো কাছ থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাওয়াই এক আশ্চর্য, ফিরিয়ে দেওয়া তো আরেক আশ্চর্য, তাই না?’
সুমন্ত্র আহত গলায় বলল—‘এসব আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার দীপালি, কোনও কথা বলা, মন্তব্য করা আমার অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করা ছাড়া কি? আচ্ছা আমি চলি!’
সুমন্ত্র উঠে দাঁড়াল।
দীপালি এগিয়ে এসে সজল গলায় বলল—‘আপনি রাগ করলেন? কিন্তু আমার মতো হতশ্রী মেয়েকে করুণা করে ছাড়া কেউ বিয়ে করতে চায়? তার ওপরে বয়সে বড়! ও করণাকে ভালোবাসা বলে ভুল করছে। ভুল ভাঙলে…ভাঙবেই, আমার কী হবে বলুন!’
সুমন্ত্র বলল, ‘আপনি একজন শিল্পী, আপনার মূল্যবোধে এতো ভুলভ্রান্তি কেন, দীপালি? সাম্য কিন্তু আপনার সত্যিকার বন্ধু! ওর দাবি মেনে নিন। সুখী হবেন।’
—‘আমি একজন সামন্য কারুশিল্পী সুমন্ত্রদা, তাছাড়া আমি মেয়ে। সমাজ আমাকে যেভাবে ভাবতে বাধ্য করে আমি সেইভাবে ভাবি। সাম্যর কথা অনেক দ্বিধা সত্ত্বেও আমি মেনে নিতাম, কিন্তু ও কেন ওই ছবিটা আঁকে?’
—‘কী ছবি?’ সুমন্ত্র জিজ্ঞেস করল।
—‘আপনাকে দেখায়নি, না?’
—‘কী ছবি, আগে বলুন! তবে তো বুঝবো দেখিয়েছে কি না।’
—‘ও থেকে থেকেই একটি মেয়ের ছবি আঁকে। আদলটা আমার, যে-কেউ বুঝতে পারবে, তবু সে আমি নই, আমি যে-রকম হবার স্বপ্ন দেখি সে রকম। ওয়াশ করে করে ছবিটাতে শেষ পর্যন্ত ও আর কিছু রাখে না, অ্যাবস্ট্রাক্ট একটা ফিমেল-ফর্ম ছাড়া। আমার সম্পর্কে ওর মনোভাব এই। ও বলে আমাকে ও আঁকেনি। ওটা নাকি মগ্নচৈতন্য। খুব ভালো কথা। আমিও তাই মনে করি। ওটা ওর নিজের ভেতরটা। ভেতরের দ্বন্দ্ব।’
সুমন্ত্র খুব মন দিয়ে শুনছিল, শেষ হলে বলল—‘আপনি এতো কথা অনুমান করতে পারলেন? আপনি তো ভাবুক দেখছি।’
দীপালির চোখ ছলছল করছে, বলল—‘অনেক দুঃখ মানুষকে এটুকু ভাবুক করে সুমন্ত্রদা। সাম্যর বুকের ভেতরটা পর্যন্ত আমার দৃষ্টি চলে যায়। ও খুব সহজে নিজেকে প্রকাশ করে ফেলে।’
সুমন্ত্র বলল—‘দেখুন দীপালি, আপনাকে একটা কথা বলি। আপনি যে ব্যাখ্যা করলেন সেটা হয়তো সত্যি। কিন্তু সব শিল্পীর পক্ষেই সত্যি। সে যাকে চায় সেই সুন্দর বিমূর্ত। তাকে আলোয় টেনে আনবার পর শিল্পীর মনে হবেই—ঠিক হল না। আধো-অন্ধকারই ছিল ভালো। দেখা না দেখায়, বোঝা না বোঝায় মেশা। কিন্তু সেটা শিল্পীর সৃজনী স্তরের অনুভব, তাতে দাম্পত্যের কোনও অসুবিধে হয় না। শিল্পীর প্রিয়াকে চিরদিনের জন্য এই প্রতিদ্বন্দ্বিনী স্বীকার করে নিতে হয়।’ দীপালি চুপ করে রইল। মুখ একটু নিচু।
সুমন্ত্র বলল—‘চলি।’ দরজা পার হয়ে রাস্তায় নেমেছে, দীপালি হঠাৎ ধরা-ধরা গলায় বলল, ‘আমায় নিয়ে একটা গল্প লিখবেন? আমার মতো একটা হতভাগা মেয়েকে নিয়ে?’
৪
এখন পথে রোদ খুব। রাস্তায় নামতে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। দীপালির স্নিগ্ধ ঘর আর এই রোদ-জ্বলা চওড়া পথ যেন দুই মেরু। নিজের অজান্তেই সুমন্ত্র কখন দীপালির ভাবনায় ডুবে গেছে। আচ্ছা দীপালি কি সাঁওতাল বা মুণ্ডা? ছোটবেলা থেকে শান্তিনিকেতনে মানুষ হয়েছে, পদবী জিজ্ঞাসা করার কথা মনে হয়নি, কিন্তু যখন রবীন্দ্রভবনে পরিচয় হয়েছিল তখন বলেছিল—‘আমি দীপালি, যদিও বিশ্রী, তবু শ্রীনিকেতনের মেয়ে।’ ওর কেউ নেই। কিন্তু সাম্যর সবাই আছে। দুজনেই এতো জায়গা থাকতে জামশেদপুরে এসে চাকরি নিয়েছে কেন? ওদের মধ্যে কোনও একটা সমঝোতা নিশ্চয় ছিল। অথচ এখন সাম্যর প্রস্তাব মানতে চাইছে না একটা অদ্ভুত গূঢ় মনস্তাত্ত্বিক কারণে। দীপালি কি ছিন্নমূল? তাই তার নিরাপত্তাবোধের এমন অভাব?
নওলের মা সুজাতা দেবী আক্ষেপের সুরে বললেন—‘নওলের বাবা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে এইমাত্র বেরিয়ে গেলেন, ওঁকে খুব দরকারি কাজে বম্বে যেতে হল।’
সুমন্ত্র মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বস ফেলল—একজন বয়স্ক হিন্দিভাষী এঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে তার কিই বা কথা থাকতে পারে! যে-সব কবিরা কবি ছাড়াও অন্য কিছু, তাঁদের তত মুশকিল হয় না। কিন্তু সে যে শুধুই কবি। একজন আবিষ্ট মানুষের সঙ্গে অন্যদের সম্পর্ক শুধু কৌতূহলের।
সুজাতা শর্মা সামনে আঁচল করে শাড়ি পরেছেন। বেশ দোহারা চেহারা। নাকে হীরে ঝকঝক করছে। আপাতদৃষ্টিতে বাঙালি বলে বোঝা যায় না। শুধু কথা বলার সময়ে বাঙালি। খাওয়াতে বসিয়ে তিনি বললেন—‘বাঙালি খাবার তো অনেক খান। এদের খানাগুলোও কিন্তু মন্দ নয়। আপনার মুখ বদলের জন্য এদেশি খাবারই করেছি।’
সুমন্ত্র বলল—‘দেখুন আপনি আসতে বলেছেন এসেছি। খাবার যে দেশিই হোক, আপনার হাতে পড়লে ভাল হবেই। কিন্তু আমার দুপুরেও একটা নিমন্ত্রণ আছে। প্লীজ অল্প দিন।’
সুজাতা শর্মার মুখের আলো নিভে গেল। বললেন—‘কোথায়?’
—‘ওসমান আজিজ সাহেবের বাড়ি।’
—‘ও। ওঁর অবশ্য খুব ভাল বাবুর্চি আছে।’
সুমন্ত্র অপ্রস্তুত মুখে বলল—‘বাবুর্চি-টাবুর্চি না। আসলে সেখানেও তো আমাকে কিছু না কিছু খেতেই হবে। আমি খুব খাইয়েও না।’
—‘সে কি?’ সুজাতা অবাক হয়ে বললেন, ‘খাওয়ার সঙ্গে কবিতা লেখার কোনও ঝগড়া আছে নাকি? এখানে যাঁরা অনুষ্ঠান করতে আসেন তাঁদের অনেককেই আমি খাইয়েছি। আপনি…তুমি নেহাতই ছেলেমানুষ…লাজুক।’
নওল সারাক্ষণ চুপ করে ছিল, এখন তাড়াতাড়ি বলল—‘মা, সুমন্ত্রদাকে তুমি করে বলছো! য়ু আস্ক ফর হিজ পারমিশন!’
সুজাতা হাসিমুখে বললেন—‘ওরে তোদের আপের চাইতেও বাঙালা আপনিটা অনেক দূর। তুমি ডাক কত আপন। পারমিশান না চাইলেও ক্ষতি নেই। কবি মানুষ যে আমাদের কত আপনার জন!’
সুমন্ত্র আশ্চর্য হয়ে বলল—‘সত্যি আপনি তাই মনে করেন?’
—‘সত্যি না তো কি? আমাদের মনের কথাগুলো তোমরা এমন করে বলো’…
বলতে বলতে সুজাতা শর্মার গলাটা ধরে গেল, তিনি তাড়াতাড়ি উঠে চলে গেলেন, বললেন—‘কফিটা আনি।’
তার কোন কবিতার আবেদন সুজাতা শর্মার কাছে এত গভীর হতে পারে, ভাবতে গিয়ে থই পেলো না সুমন্ত্র। তার বেশিরভাগ লিরিকের লক্ষ্য হচ্ছে সে নিজেই। কিন্তু কবিতা তো কখনই কবির নিজস্ব ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করে চলে না!
চমক ভাঙল নওলের কথায়—‘সুমন্ত্রদা, আমাকে দু’লাইন লিখে দিন না।’ তার হাতে হাতির দাঁতের রঙের আঁশওলা হ্যান্ডমেড পেপারের একটা স্কেচ-বুক বা রাইটিং প্যাড। সুমন্ত্র সামনে সেটা নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। নওল উৎসুক হয়ে চেয়ে রয়েছে। কিন্তু সুমন্ত্রর মাথায় কিছু আসছে না।
অনেক সময় পার হিসেব অনেক ভুল
গোলক ধাঁধায় ঘোরা সংশয়সঙ্কুল ॥
সুজাতা পড়ে একটু বিষন্ন হেসে বললেন, ‘এতো নওলের মায়ের, নওলের জন্য তো নয়।’
সুমন্ত্র বলল—‘সত্যি তাই। নওল দুঃখিত। এ পদ্য তোমার বয়সের নয়।’
নওল বলল—‘আপনার যেই রকম মুড থাকবে আপনি সেইরকম লিখবেন। আ ক্রিয়েটিভ আর্টিস্ট কান্ট টার্ন আউট পোয়েম্স্ লাইক পিনস ফ্রম আ মেশিন। ইট্স্ ওকে বাই মি।’ সে হাসল। মা ছেলে দুজনেই চুপচাপ প্রকৃতির। কিন্তু কথা বললে, হাসলে দুজনেই ভারি বুদ্ধিমন্ত দেখায়। নওল তার সাইকেলের পেছনে বসিয়ে সুমন্ত্রকে আজিজ সাহেবের বাড়ি পৌঁছে দিল।
৫
উত্তর কলকাতার এই গলিতে সুমন্ত্রদের তিনপুরুষের বাস। কার্নিশে বকবকম, ঘরের মধ্যে চ্যাঁ-ভ্যাঁ, রান্নাঘরের তেল-পাঁচফোড়নের গন্ধ উপচে পড়া রাস্তায় বেকার-জটলা। এই কলকাতাংশটুকুর সঙ্গে সেই শিল্প শহরের কত তফাত! সেখানে আকাশ কত বড়! হয়ত নীলও বেশি। সবুজের আয়োজন পর্যাপ্ত। সেসব রাস্তার মধ্যে দু-তিনটে এই গলি শুয়ে থাকতে পারবে। সোনারির গেস্ট হাউজ, নওলদের আগাগোড়া কাচ-ঢাকা বাংলো, আজিজ সাহেবের বাংলো সবই এই গলি থেকে সামান্য দূর। একদিনের মধ্যে গিয়ে ফিরে আসা যায়। অথচ লক্ষ যোজন দূর। তার কাঁধের ব্যাগটার দিকে উৎসুক চোখ রেখে বাবা বললেন, ‘কিরে? কখন এলি? বুঝতে পারিনি তো।’
—‘দরজা-টরজা খুলে চলে গিয়েছিলে, কী ব্যাপার? তোমার বাড়িতে কি ভ্যালুয়েবলস কিছুই নেই?’
—‘ভ্যালুয়েবলস-এর মধ্যে তো আমি আর তুই। আমাকে বাজার, আধ ঘন্টার কড়ারে বন্ধক রেখেছিল আর তুই তো বাবা লীজ দেওয়া প্রপার্টি। ডাকাতি হয়ে গেলেও আমার বলবার কিছু নেই। তো তোকে পৌঁছে দিল না যে বড়?’
—‘ট্রেনে চাপিয়ে দিল আবার কি।’
—‘বাসে এলি?’
—‘হ্যাঁ, দুশ উনিশ।’
—‘বাঃ নিজেকে এইরকম ঝরঝরে তরতরে রাখতে পারলে…’ রান্নাঘরের দিকে চলতে চলতে বাবা বললেন—‘কবি হবে ঘোরাফেরায় প্রজাপতির মতো হালকা ফুরফুরে। ভেতরটা হবে মধুর বোয়েমের মতো ভারি।’
আলনায় পাঞ্জাবিটা টাঙিয়ে রাখতে গিয়ে বাবার শেষ কথাগুলো শুনে সুমন্ত্র ভাবল বাবাই বোধহয় তাদের দুজনের মধ্যে আসল কবি, ভেতরের কথা যখন এতো ভালো জানেন। তার ভেতরটা সত্যিই গাঢ়, আঠা আঠা, ভারি-ভারি হয়ে আছে।
ওসমান আজিজ তাঁর অতিকায় ডিনার টেবিলে একটিমাত্র অতিথি নিয়ে খেতে বসেছেন। ক্ষুধা উৎপাদক হিসেবে তরল বস্তু তো আছেই, সেইসঙ্গে আছে নানান শ্লোক। সংস্কৃত, উর্দু, জাপানি, ল্যাটিন আমেরিকান, হার্লেমের কবিতা।
আয়োজন দেখে সে বলল—‘একি করেছেন।’
টেবিল-ভর্তি সুন্দর সুন্দর পাত্রে ভোজ্য। তার বেশির ভাগ সুমন্ত্র চেনেই না।
মৃদু হেসে আজিজ সাহেব বললেন, ‘একটু একটু চাখবেন। রাজা-বাদশাদের আমলে এরচেয়ে অনেক বেশি আয়োজন হত মন-পসন্দ শায়েরদের জন্যে।’ সযত্নে তার প্লেটে কিছু তুলে দিতে দিতে শের বলতে লাগলেন ওসমান।
‘বাদ এক উম্ৰ কঁহী তুমকো জো তন্হা পায়া।
ডরতে ডরতে হী কুছ আহবাল সুনায়া হমনে ॥’
এতকাল পরে যেই তোমায় কাছে পেলাম,
ভয়ে ভয়ে কিছু দুঃখের কথা শোনালাম।’
—‘ডরতে ডরতে কেন?’ সুমন্ত্র জিজ্ঞেস করল।
—‘বয়সে ছোট। অভিজ্ঞতাতেও। কিন্তু খুদা যদি আমাকে একটা ফুটো পয়সা দিয়ে পাঠিয়ে থাকেন তো তোমাকে পাঠিয়েছেন গোটাগুটি একটি মোহর দিয়ে। ভয় তো পেতেই হবে।’ কাঁটা দিয়ে এক টুকরো কাবাব বিঁধে তিনি আবার বললেন—‘ফ্লার্ট করেছো কখনও?’
—‘সুযোগ পাইনি এখনও’—সুমন্ত্র আর কি জবাব দেবে।
—‘বিবেকানন্দ পশ্চিমের যে কটা জিনিস ঘোর অপছন্দ করতেন তার একটা গ্যালান্ট্রি জানো?’
ওসমান কোনদিকে যেতে চাইছেন সুমন্ত্র বুঝতে পারছিল না।
—‘যদি শান্তি চাও মহামানবের কথা ভুলো না। নৈব নৈব চ।’
—‘আপনি যেন একটা গল্প বলবেন মনে হচ্ছে?’
—‘বলব কি? বলছি। বলতে আরম্ভ করে দিয়েছি। তবে আমি গল্প বলার প্রচলিত নিয়মগুলো মানি না। তুমি যদি একখানা বেগবান পাহাড়ি ঝর্না পাও, চান করবে না?’
—‘করতেই পারি।’
—‘যদি একটা দিঘি পাও, বেশ গভীর স্বচ্ছ, অবগাহন করবে না?’
— ‘করতেই পারি।’
—‘করতেই পারো নয়, করবে। স্নান করে ফেলবে, নইলে স্নিগ্ধ সজীব হবে কী করে? ঝরনার কলস্বনকে, দিঘির গাঢ় শীতলতাকে উপেক্ষা করবেই বা কী করে? আমি তাই করেছি। এই আমার দুঃখের কথা তোমায় শোনালাম। এই আমার গল্প। এখন “আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে।”
সুমন্ত্র চুপ করে রয়েছে দেখে ওসমান বললেন—‘কাল রাতে মিসেস সান্যাল গেস্ট হাউজে গিয়েছিলেন শুনলাম।’
—‘কে বলল?’
—‘অরিন্দম, দা পুওর ফেলো। মিসেস সান্যাল নিশ্চয় তোমাকে একটা গল্প বলেছেন।’
—‘গল্প?’
—‘ওই হলো। গল্প মানেই তার তলায় একটা ছোট্ট সত্যের বীজ থাকে। তিনি ভাবতে ভালোবাসেন তাঁর স্বামী অন্যে আসক্ত। তাতে আত্মনির্যাতনের আনন্দটাও পাওয়া যায়, আবার নিজেও দায়িত্বমুক্ত হওয়া যায়। তিনি ভাবতে ভালোবাসেন আজিজ তাঁর প্রেমে মজে আছেন এবং সেই জন্যেই তাঁদের আশ্রিতা দোলাকে বিয়েশাদী করতে পারছেন না। ভাবতে ভালোবাসতে বাসতে সেটাই এখন তাঁর কাছে সত্য বলে প্রতিভাত হচ্ছে।’
সুমন্ত্র আশ্চর্য হয়ে বলল—‘সত্য তাহলে কতটুকু?’
—‘অনুমান করো কবি, সত্য ওই ঝর্নায় আর দিঘিতে স্নান অবধি। কিন্তু মুসাফিরকে যদি সেখানেই থেমে থাকতে হয়!’
ওসমান সাহেবের সামান্য খাওয়া। তিনি খুব ছটফটে মানুষও। সুমন্ত্র হাত গুটিয়ে নিয়েছে দেখে বললেন—‘চলো গান শুনি।’
পড়ার ঘরে নিয়ে গিয়ে টেপ চালিয়ে দিলেন তিনি। জানলার পর্দা টানা। ঘরের মধ্যে দুপুরেই সন্ধ্যা। ‘আঁধার রাতে একলা পাগল’ বেজে উঠল। সুমন্ত্র টান-টান হয়ে বসল। গান শেষ হয়ে এলে বলল—‘আপনি টেপ করে রেখেছেন। ভাল করেছেন। তখনই আমার মনে হয়েছিল এ গান থেকে যাওয়া উচিত।’
—‘দোলার সব গান আমি টেপ করে রাখি। একেবারে দ্য থিং। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং থাকলেও তাই বলতেন। বলো কবি তুলনাটা কি আমি খারাপ দিয়েছি?’
—‘দিঘির সেই জল শীতল কালো।’ পায়চারি করছেন ওসমান—‘তাহারই কোলে গিয়ে মরণ…’ ঘুরে দাঁড়িয়ে সুমন্ত্রর মুখোমুখি কৌচে বসে ওসমান ঝুঁকে পড়ে তাকে একটা সিগারেট দিলেন, নিজেও একটা ধরালেন। সিগারেটের আগুনের দিকে তাকিয়ে বললেন—‘কিন্তু দোলা কেন আমার সমঝদারিকে, বিবেকানন্দ নিন্দিত গ্যালান্ট্রিকে ভালোবাসা বলে ভুল করল? অনিন্দিতার মতো?’
সুমন্ত্র তার ব্যাগ থেকে জিনিসপত্রগুলো টেনে টেনে বার করতে লাগল।পাজামা-পাঞ্জাবি তোয়ালে সব ব্যবহার-মলিন। চামড়া বাঁধানো নোটবুক। শেভিং-কিট। একি? একটা মুখ-বন্ধ বড় হলুদ খাম। ওঁরা তো তাকে সম্মান-দক্ষিণা দিয়েইছেন। হঠাৎ কি মনে হল। সে তাড়াতাড়ি খামের মুখ খুলে ফেলল। ভেতরে এক টুকরো হলুদ কাগজ—‘কী? ঠিকানা দেওয়া সত্ত্বেও পৌঁছতে পারলে না তো?’
সুমন্ত্র অন্যমনস্ক হয়ে চান করল, কী খেল বুঝতে পারল না। দুপুরবেলা মাথার তলায় হাত দিয়ে শুয়ে রইল। সে তাহলে হেরেই গেল। ওখানে যাবার পর অনেকক্ষণ সে সচেতন ছিল, তাকে একটি ঠিকানা পেতেই হবে। কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির পরস্মৈপদী সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে সে আস্তে আস্তে ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু এ চিঠিটা তাকে কে কখন দিল? এই ব্যাগ নিয়ে সে শেষ দিনের বিকেলের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। মঞ্চে তার সঙ্গে ছিলেন অনিন্দিতা, দোলা, ওসমান আজিজ। এসেছে, গেছে, দীপালি, সাম্য, স্টেশনে পৌঁছে দিয়েছে নওল। পেছনের সীটে বসেছিলেন সুজাতা শর্মা। ‘কচ ও দেবযানী’ পাঠ করলেন অনিন্দিতা আর ওসমান। আজিজ সাহেব যে গুণীমানুষ জানা হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু অনিন্দিতা যে অত ভালো অভিনয় করতে পারেন সেটা একটা আবিষ্কার। তিনি যে এক ধরনের অপ্রকৃতিস্থতায় ভুগছেন এবং তার কারণ যে আজিজ সাহেব সেটা তাঁদের কাজকর্ম দেখলে বোঝা দায়। দোলা গাইল ‘কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন’ এবং ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যামসমান।’ সে পড়ল ‘খোলো খোলো হে আকাশ স্তব্ধ তব নীল যবনিকা।’ নামবার সময়ে প্রচুর ভিড়। সুন্দর অনুষ্ঠানের জন্য অভিনন্দন, জনস্রোতের মাঝখান দিয়ে আচ্ছা চলি, বড় ভালো লাগল, এভাবেই যেন আবার দেখা…অরভোয়া…সোজা স্টেশন।
রাত-ট্রেন। ঘুম, ভোর সকালে বাড়ি। সন্ধে। বাবা বললেন, ‘চা খাবি আয়।’ সাবি বলল, ‘রাতে কী খাবে দাদা, সকালে তো কিচ্ছু খেলে না।’ চায়ে চুমুক। বাবা আড়চোখে তাকালেন। জানেন এটা ওর হয়। কিচ্ছু জিজ্ঞেস করা যাবে না। ঘর। বারান্দা। বেগুনি আকাশ, আস্তে আস্তে কালচে। একটা দুটো, তারপর ঝাঁকে ঝাঁকে তারা। মাঝে মাঝে কেউ কেউ চলন্ত। কে কোথায় স্যাটেলাইট ছেড়ে রেখেছে, ভ্রমণ করে চলেছে সেগুলো নক্ষত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। আজিজ যে গল্পটা বললেন সেটা সত্যি তো? অনিন্দিতা আর আজিজ মিলে তাকে বোকা বানাননি তো? কিন্তু অরিন্দম সান্যালের সেই আলুথালু অবস্থা? দোলার গান…দীপালি কি তার দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠতে পারবে? একটা তারা খসে পড়ল। কোনদিকে? অস্তাচলের দিকে। আপাতদৃষ্টিতে। কোথায় পড়বে? সাগরে? মরুভূমিতে? উল্কা কখনও জনবসতিতে পড়ে না কেন?
এতো জ্যোতির্ময় তুমি, তবু এতো ম্লান।
এতো কাঁদো কেন?
এ শব তোমার নয়, ওই অভাগিনী সেও
তোমার অচেনা
কেঁদো না কেঁদো না।
এক অঙ্ক শেষ হলে, ভিন্ন অঙ্কে করহ প্রস্থান
অভ্যুদয়ে থাকো উল্কা, থাকো জ্যোতিষ্মান।
বারান্দা থেকে ঘরে। ড্রয়ার থেকে ধূপ বার করে জ্বালালো। সুগন্ধ তার একটা বাতিক। একমাত্র শখ বলতে গেলে। এক গোছা চন্দন ধূপ জ্বালিয়ে দিলে ঘরে অনেকক্ষণ সুগন্ধ থাকে। ঘুমের ঘোরেও হাজির থাকে।
অন্ধকার ঘরে ধোঁয়ার রেখাগুলো কেমন নিবিড় হয়ে ফুটে উঠছে!
এতো কান্না কেন?
এ শব আমারই, ওই অভাগিনী নারী
চিরকাল চেনা ছিল, আজও বড় চেনা…দোলা? দোলা?
দোলার কী হবে?
হঠাৎ চমকে উঠল সুমন্ত্র। সে মনে মনে একটা গল্প বুনে যাচ্ছে। মুক্ত ছন্দে।
ধূপের ধোঁয়া এখন আর দেখা যায় না। কিন্তু মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো সে মিশে আছে ঘরের বাতাসে। টেবিলের ওপর হলুদ রঙ লেফাফা পড়ে আছে। এখন অনেক রাত। কে যে তাকে চিঠি লেখে সে জানতে পারে নি। সুজাতা শর্মার বাড়ি চিঠির কাগজ, ওসমানের ভাবনা-চিন্তা…। দোলার বিপদ, অনিন্দিতার জটিল জীবনের আবর্ত, দীপালির আত্মকথনের প্রয়োজন। এঁদের যে কেউ হতে পারে। সবার ভেতরেই অনেক গুণ, বলবার অনেক কথা, জমা রয়েছে অনেক কষ্ট, তবু হয়ত কেউই নয়। সে হয়ত ওই শ্রোতার ভিড়ে নীরবে মিশে ছিল। চিঠির ওই সূক্ষ্ম রসিকতার সুরটা কি কারও মধ্যে ধরা পড়ল? কে সে জানতে পারেনি, কিন্তু সেই রহস্যময় অথবা রহস্যময়ী সত্যিই তাকে হাত ধরে এক অঙ্ক থেকে আর অঙ্কের চৌকাঠে পৌঁছে দিয়ে গেছে। স্পন্দমান জীবনকে শুধু ভাবে নয়, রক্তমাংসে ধরবার একটা উপায় সে পেয়ে গেছে। আধুনিক জীবনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেনি বলে যে আখ্যান কাব্য আস্তে আস্তে বাতিল হয়ে গিয়েছিল, সে-ই এখন তার কলমে নতুন চেহারা নিয়ে ফিরে আসছে। আধুনিক মানুষ, আধুনিক মনন এবং চিরন্তনী প্রকৃতিকে প্রেক্ষাপটে রেখে সে দ্রুতগতিতে একটা কাব্যকাহিনী লিখে যাচ্ছে। সে আজ সম্ভবত সারা রাত লিখবে।