কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ – ১২
সালেহ ফরিদউদ্দিন কবি হিশেবে নাম করেছে, এর মাঝে পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ বের ক’রে ফেলেছে, কবিতা ছাড়া আর কিছু সে বোঝে না; তার এলোমেলো কাতর হাহাকারভরা পংক্তির সমষ্টি খুব আলোড়িত করছে তরুণদের; মাঝেমাঝে সালেহ আসছে। হাসানের অফিসে; আজও এসেছে। খুব শুকিয়ে গেছে সালেহ, হাসানের প্যাকেট থেকে একটির পর একটি সিগারেট টানছে, চা খাচ্ছে কাপের পর কাপ, কেঁপে কেঁপে উঠছে থেকে থেকে, নিজের কবিতা আবৃত্তি করছে একটির পর একটি, ভুল করছে আবার সংশোধন করছে।
সালেহ বলে, দোস্ত, মনে হইতেছে আমি পাগল হইয়া যাইতেছি।
হাসান বলে, না, না, তুমি পাগল হবে কেনো? তোমাকে আরো অনেক কবিতা লিখতে হবে, তুমি চমৎকার লিখছো।
সালেহ বলে, কবিতা লেখনের থিকা পাগল হইতেই আমার বেশি ভাল লাগতেছে। পাগল হওন অনেক সুখের, গাঁজা খাওনের মতন, মাথার ভিতর মাঘের কুয়াশার মতন শাদা হইয়া কবিতা নামতেছে, ম্যাঘের মতন কবিতা জমতেছে, এত ভাল কবিতা হয়। না, জীবনানন্দের থিকা অনেক ভাল।
হাসান জিজ্ঞেস করে, সেগুলো লিখে ফেলছো না কেনো?
সালেহ বলে, আরো দোস, ল্যাখতে গ্যালেই দেখি সেইগুলি নাই, কুয়াশা নাই, ম্যাঘ নাই, কবিতা নাই, খালি আজেবাজে লাছ। কিন্তু পাগল হওন মায়ের প্যাটে ঘুমাই থাকনের মতন, পাগল হওয়াই হইব আমার শ্রেষ্ঠতম কবিতা।
সালেহ চোখ বন্ধ ক’রে নিজের কবিতা আবৃত্তি করতে থাকে।
হাসান বলে, তোমার ডাক্তার দেখানো দরকার, সালেহ।
সালেহ বলে, ডাক্তার দেখাইছি, ডাক্তার বলছে আমার সিফিলিসের সিম্পটম দেখা দিছে, শুইন্যা আমার ভাল লাগতেছে। একদিন আমি নিজের নাম ভূইল্যা যামু, আয়নায় নিজেরে দেইখ্যা সালাম দিমু, বাইর প্রচ্ছদ দেইখ্যা ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া নিজের নাম লেখুম।
হাসান চমকে ওঠে, বলে, তোমার ভালো চিকিৎসা দরকার।
সালেহ বলে, বড় কবিগো সিফিলিস হইতেই হয়, দোস্ত, সিফিলিস হইল বড় কবিগো রোগ, সিফিলিস হইল কবিতার গডেজ, তোমরা বড় কবি হইতে পারব না, বদলেয়ারের সিফিলিস হইছিল, হেল্ডার্লিনের সিফিলিস হইছিল, নজরুলের সিফিলিফ হইছিল, আমারও সিফিলিস হইছে।
হাসান বলে, না, সালেহ, সব বড়ো কবির সিফিলিস হয় নি; কালিদাস, দান্তে, চণ্ডীদাস, রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব, এলিয়টের সিফিলিস হয় নি; এবং হেসে বলে, আমারও সিফিলিস হয় নি; কবিতার সাথে সিফিলিসের কোনো সম্পর্ক নেই; তুমি চিকিৎসা করাও।
সালেহ বলে, চিকিৎসা করাইতে ইচ্ছা হয় না; আমার তরুণ কবি হিশাবে মইরা অমর হইতে ইচ্ছা হয়; তুমি আমারে লইয়া একটা কবিতা একটা প্ৰবন্ধ ল্যাইখো, আমি অমর হমু।
সালেহ বছরখানেক ধ’রে আছে ফরিদা খানমের সাথে। ফরিদা দশটি বছর ও তিনটি দেশিবিদেশি বিয়ে কাটিয়ে এসেছে আমেরিকায়, প্রচণ্ড রূপসী ও প্রচণ্ড দানবী সে, ফিরে এসেই তার পরিচয় হয়েছে সালেহর সাথে, এবং উন্মুল উদ্বাস্তু অসহায় সালেহকে তুলেছে নিজের ফ্ল্যাটে। সালেহর কাতর কবিতার সে তীব্ৰ অনুরাগী, বেশ কিছু অনুবাদ করেছে ইংরেজিতে এবং নিজেও লিখেছে একগুচ্ছ তীব্ৰ কবিতা।
হাসান জিজ্ঞেস করে, ফরিদা কেমন আছে?
সালেহ বলে, ওই মধুর ডেঞ্জারাস ডাইনিটা আমারে মাইরা ফ্যালতেছে; ওই ডাইনিটার রূপসী আগুনে আমি জ্বইলা যাইতেছি; তয় আমি তারে ভালবাসি, সে আমারে ভালবাসে, আমার কবিতারে ভালবাসে।
হাসান জিজ্ঞেস করে, ভালোবেসে সে তোমাকে কীভাবে মেরে ফেলছে?
সালেহ বলে, সিফিলিসে আমি পাগল হইয়া যাইতেছি, কিন্তু দুই তিনবার ওই ডাইনিটার ক্ষিধা আমার মিটাইতে হয়, তার ক্ষিধার শ্যাষ নাই।
হাসান জিজ্ঞেস করে, তুমি পা্রো?
সালেহ বলে, পারি না, তয় পারতে হয়; অরাল, দোস অরাল, আসলটা ত বেশি পারি না।
হাসান জিজ্ঞেস করে, ফরিদা তোমার অসুখের কথা জানে না?
সালেহ বলে, খুবই জানে, সে-ই বলে যে বড় কবিগো সিফিলিস হইতে হয়, সেও সিফিলিস চায়, দিনরাইত বলে আমারে সিফিলিস দেও, আমিও সিফিলিসে মরতে চাই, সিফিলিস তার কাছে গোল্ডেন ডিজিজ।
হাসান সালেহর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে; আর সালেহ নিজের নখের দিক স্মিত হেসে তাকিয়ে বলতে থাকে, সিফিলিস সিফিলিস, সবচেয়ে মধুর শব্দ, শ্ৰেষ্ঠ শব্দ শ্রেষ্ঠ ধ্বনিগুচ্ছ সি-ফি-লি-স সি-ফি-লি-স সি-ফি-লি-স…
দু-দিন পরই ফরিদার সাথে একই রিকশায় যাচ্ছিলো, সালেহ, একটির পর একটি নিজের কবিতা আবৃত্তি করছিলো সে, ফরিদাকে বলছিলো জীবন তার কাছে এতো সুখের আর কখনো লাগে নি, আর তখনি একটি দ্রুত ছুটে আসা ট্রাক দেখে সে রিকশা থেকে ট্রাকের সামনে লাফিয়ে পড়ে। ফরিদা প্রথম বুঝতেই পারে নি কী ঘটেছে, তার রিকশা বেশ এগিয়ে যাওয়ার পর পেছনে হৈচৈ শুনে সে বুঝতে পারে সালেহ লাফিয়ে পড়েছে ট্রাকের সামনে।
হাসান সংবাদ পাওয়ার পর বুঝতে পারে না সালেহকে দেখতে যাবে কি যাবে না। কী হবে গিয়ে, যাকে দেখতে যাবো তার সাথে যদি দেখা না হয়? সালেহর সাথে তো আর কখনো দেখা হবে না, যদি তার সাথে কাফন প’রে কবরেও নেমে যাই, পাশাপাশি শুয়ে থাকি। সালেহর কথা ভাবতে ভাবতে হাসান একটা অ্যাড সংশোধন করে, একটি মেয়ে তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে কবি সালেহ, তার বন্ধু, মারা গেছে; তাতে হাসানের মুখে কোনো করুণ রেখা না দেখে মেয়েটি ভয় পায়। হঠাৎ হাসান উঠে দাঁড়ায়, কাউকে কিছু না ব’লে বেরিয়ে পড়ে; হাসপাতালে গিয়ে দেখে থ্যাৎলে প’ড়ে আছে কবি, যে পেরিয়ে যেতে চেয়েছিলো জীবনানন্দকে, এবং জীবনানন্দের মতোই লাফিয়ে পড়েছে কোনো এক নিস্তব্ধতা দেখে।
সালেহ, অমরতা কি তোমার এতো শিগগিরই দরকার ছিলো? সালেহর লাশের পাশে দাঁড়িয়ে সালেহর সাথে কথা বলতে থাকে হাসান।
সালেহ, তোমাকে নিয়ে একটি কবিতা একটি প্রবন্ধ লিখতে হবে আমাকে? আমি কি পারবো? মনে হয় পারবো না, আমি পারবো না।
সালেহ, আমি যে শোকার্ত হ’তে পারছি না, দ্যাখো, এই মুহূর্তে শোকের বদলে আমার ভেতরে একটি প্রেমের কবিতার পংক্তি ঢুকে গেলো, পংক্তিটি ঘুরে ঘুরে উড়ছে, পংক্তিটিকে আমি কবিতা করবো।
সালেহ, এমন মুহূর্তে কেনো বুকে প্রেমের কবিতা আসে?
সালেহ, তুমি কি কবিতা আবৃত্তি করছো? আমাকে একটি কবিতা শোনাও।
সালেহ, তুমি কি ব্যঙ্গ করছো আমার বেঁচে থাকাকে, আমাদের বেঁচে থাকাকে?
সালেহ, সত্যিই আমি কষ্ট পাচ্ছি না; যদি তোমার মতো আমি থ্যাৎলে পড়ে থাকতাম আর তুমি দেখতে আসতে আমাকে, তাহলে তুমিও কষ্ট পেতে না। আমি কোনো ঘন্টাধ্বনি শুনছি না, মনে হচ্ছে না যে আমার ওপর ঝরিছে কবরের মাটি।
আবহাওয়া বদলে যাচ্ছে, দেশে গণতান্ত্রিক মুক্তসমাজ গড়ে উঠবে, স্বাধীনতাটি নিয়ে আসবে সব দিকে মুক্তি, এমন একটি লঘু আশা সে পোষণ করেছিলো; আর অন্যরা যখন পথেঘাটে মেতে উঠেছিলো রাজনীতিক কবিতায় শ্লোগানে লঘু আশাবাদে, জনপ্রিয়তার ঘিনঘিনে পথে একে একে নেমে যাচ্ছিলো সবাই, তার থেকে সেও একেবারে দূরে থাকতে পারে নি, দু-একটি আশাবাদী কবিতা লিখেছিলো সেও, স্বপ্ন দেখেছিলো প্রেমিকার লাল নখের মতো উজ্জ্বল দিন আসবে, ওসবের কথা মনে হ’লে খুব করুণ একটা হাসিতে তার ভেতরটা ছেয়ে যায়। নির্বোধ, নির্বোধ, হাসান তুমিও নির্বোধের মতো আশা পোষণ করেছিলে? অন্ধকার নেমে আসছে ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল ভ’রে। এতো রক্ত ঢালা হলো এই অন্ধকারের জন্যে? রক্ত কি চিরকাল ব্যর্থ হয়। এভাবেই? কোথায় মুক্তি, কোথায় প্রাণভরে নিশ্বাস নেয়ার মতো বিশুদ্ধ বাতাস?
দিকে দিকে রক্তপিপাসু নিশ্বাসরোধকারী সংস্কৃতিহীন বর্বরগণ। এরা কবিতার কথা জানে না; কবিতা এদের কাছে তুচ্ছ, মানুষই এদের কাছে মূল্যহীন। কী ক’রে এদের ছুরিকার ক্ৰোধ থেকে রক্ষা পাবে মানুষ? কবিতা? শিল্পকলা?
নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। হাসানের, দেশে বায়ু নেই নিশ্বাস নেয়ার।
সর্বহারাদের কয়েকজন দেখা করেছে তার সাথে, তারা দেশকে আমূল বদলে দিয়ে, তার ছালবাকল তুলে ফেলে, মাংস কেটে ফেলে, হাড্ডি টেনে খুলে, প্রতিষ্ঠা করবে সর্বহারার একনায়কত্ব।
একজন বলে, আপনারে আমাগো পক্ষে থাকতে হইব, আপনারে সর্বহারাগো পক্ষে কবিতা লেখতে হইব, শ্লোগান দিতে হইব।
হাসান বলে, আমি তো পক্ষবিপক্ষের কবিতা লিখি না, শ্লোগান দিই না।
আরেকজন বলে, এইটা পক্ষ লওয়ার সময়, নিউট্রাল আপনে থাকতে পারবেন না, আমাগো পক্ষ না লইলে বুঝুম আপনে শ্রেণীশত্রুগো পক্ষে আছেন।
আরেকজন বলে, এই বছরই সর্বহারাগো একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হইব। আমাগো বন্দুক আছে, আমাগো সামনে শ্রেণীশত্রুরা দারাইতে পারব না।
হাসান বলে, আমি যে একটি মুক্তসমাজ চাই, যেখানে প্রতিটি মানুষের স্বাধীনতা আছে, স্বপ্ন আছে, কারো একনায়কত্ব নেই।
একজন বলে, মুক্তসমাজ পুঁজিবাদী ইম্পিরিয়ালিস্টগো কথা। আমরা ক্ষমতায় আইসা মুক্তসমাজের কথা যারা কয় তাগো সাফ কইরা ফেলুম; কোটি দুই কমাইয়া ফেলতে হইব। একনায়কত্ব ছারা মানুষের কল্যাণ নাই।
হাসান বলে, আমার রক্ত পেলে কি দেশে সর্বহারার একনায়কত্ব আসবে, সব মানুষ ভাত পাবে, কাপড় পাবে? আমি কবিতা না লিখলে কি সবাই ঘর পাবে, ভাত পাবে, চিকিৎসা পাবে? তাহলে না হয়। আমি কবিতা লেখা ছেড়েই দেবো।
তারা যাওয়ার সময় বলে, বিপ্লবের কথা মনে রাইখেন, ভাইব্যাচিস্তা কইর্যা কাম কইরেন, বাচতে চাইলে আমগো পক্ষে থাইকেন।
তারা চ’লে যাওয়ার পর থেকেই হাসানের মনে হ’তে থাকে তার দিকে উদ্যত হয়ে আছে একরাশ রাইফেল; সে শ্রেণীশত্রু, সে মুক্তি চায়, স্বাধীনতা চায় ব্যক্তির। তাকে সাফ ক’রে ফেলাই ভালো। কিন্তু ওরা পারবে তো? পারবে তো সর্বহারকার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করতে? দেশে এখন কতোগুলো সর্বহারকার একনায়কত্বের দল রয়েছে? দশ, বিশ, পঁচিশ, তিরিশ? তারা একে অন্যকে সাফ করবে না তো? তার আগে তাকে সাফ ক’রে নেবে? তারা কি তার জন্যে একটা বুলেট খরচ করবে? সে কি এতো মূল্যবান? তাকে খুঁচিয়ে মারবে? তাকে খুঁচিয়ে মেরে কী লাভ? তার মূল্য না থাক, তার হাত আর পা দুটির তো মূল্য আছে। সে-চারটিকে কাজে লাগানো যেতে পারে। এই অ্যাড আর কবিতা লেখার পাপের শাস্তি হিশেবে তাকে তো খালটাল কাটার কাজে লাগানো যেতে পারে, বাঁধে মাটি ফেলার কাজে লাগানো যেতে পারে, গরুর রাখালের কাজ দেয়া যেতে পারে। সে কি ওই কাজের উপযুক্ত নয়? ভাবতে ভাবতে হাসানের হাসি পায়, ভয়টা কেটে যেতে থাকে, হঠাৎ একটি কবিতার পায়ের শব্দে সে চোখ বোজো।
কয়েক দিন পর আসে জাতীয় সাম্যবাদীদের কয়েকজন; দেশে বিপ্লবের, আমূল বদলে দেয়ার, সর্বগ্রাসী প্রেরণা দেখা দিয়েছে।
একজন বলে, আপনে জানেন দ্যাশ জুইর্যা শ্রেণীশত্রু খতম করন চলছে, দ্যাশে আমরা অবিলম্বে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
হাসান বলে, সেটা খুবই ভালো কাজ হবে; কিন্তু এভাবে খতম ক’রে কি সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন?
আরেকজন বলে, বেশি দিন লাগিব না, শিগ্রই আমরা দ্যাশে বিপ্লব ঘটাইতে যাইতেছি, সর্বহারার একনায়কত্ব অবিলম্বেই প্রতিষ্ঠিত হবে। আপনের উপর আমরা চোকা রাখছি, সেইজন্যই দেখা করতে আসলাম।
হাসান জিজ্ঞেস করে, আমাকে কি আপনাদের শ্রেণীশত্রু মনে হয়? একজন বলে, অইরকমই আমাগো মনে হয়; তয় আপনেরে সাবধান করতে আসলাম। বিপ্লবের পক্ষে কবিতা ল্যাখলে আপনের ভয় নাই।
হাসান বলে, আমি তো কারো পক্ষে কবিতা লিখি না।
একজন বলে, এখন থিকা ল্যাখতে হইব, নাইলে বাচন নাই।
তারা চ’লে যায়; হাসান একবার নিশ্বাস নিতে গিয়ে দেখে সে সহজে নিশ্বাস নিতে পারছে না।
নিশ্বাস নেয়া এবার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়ে গেলো। মানুষ পরিণত হলো কেঁচো, তেলাপোকা, পিঁপড়ে, গুবরেপোকায়; না কি আরো শোচনীয় কিছুতো? হাসান, তুমি আর মানুষ নও, স্বাধীন সন্তান নাও তোমার জন্মভূমির; তুমি দাস, তোমার অধিকার নেই, ওরা চাইলে তুমি থাকবে, না চাইলে থাকবে না। গুজব চলছিলো বেশ কিছু দিন ধ’রেই দিন দিন সেই ভয়ঙ্কর সম্ভাবনাটি অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছিলো, অবশেষে বাস্তবায়িত হলো : দেশে প্রতিষ্ঠিত হলো একদলপদ্ধতি— শাসনের শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি। প্রচণ্ড বজ্রের গর্জনের সাথে প্রতিষ্ঠিত হলো নতুন গণতন্ত্র, যাতে জনগণ নয় একটি ব্যক্তিই সব, সে-ই রাষ্ট্র সে-ই সমাজ সে-ই দেশ, সে-ই বর্তমান সে-ই ভবিষ্যৎ, আর কারো কোনো অধিকার দরকার নেই, শুধু তার অধিকার থাকলেই চলবে, তার অধিকারই সকলের অধিকার; হাসান ভেবেছিলো প্রতিবাদ উঠবে চারদিকে, দেখলো প্রতিবাদ উঠছে না, বরং দলে দলে উল্লাসে লোকজন যোগ দিতে শুরু করেছে একদলে–শুরু হয়ে গেছে পতনের শোচনীয় উৎসব, রাজনীতিক অধ্যাপক লেখক শ্ৰমিক সাংবাদিক আমলা দোকানদার দলে দলে মালার বোঝা মাথায় ক’রে গিয়ে যোগ দিচ্ছে একদলে, বিশেষণের পর বিশেষণে সৃষ্টি ক’রে চলছে মহামানব মহানায়ক মহাকালের মহত্তম। হাসান দু-একজনের সাথে কথা বলতে গিয়েছিলো, দেখতে পায় তারা নিশ্চুপ প্রশান্ত থাকতেই পছন্দ করছে, আর যখনই কথা বলছে তখনই বিশেষণ তখনই অতিশয়োক্তি। কে বলেছে মানুষকে ধ্বংস করা সম্ভব, কিন্তু পরাজিত করা সম্ভব নয়? মানুষকে পরাজিত করা যেমন কঠিন তেমনি সহজ মানুষকে পরাজিত করা; ওটা নির্ভর করে সময়ের ওপর, যে-মানুষ এক সময় উদ্ধত অপরাজিত আকাশস্পর্শী, আরেক সময়ে সে পরাভূত মেরুদণ্ডহীন মস্তকছিন্ন পদতলচুম্বী। নিজেকে হাসানের একটা পাহীন পোকা মনে হয়; ইচ্ছে করে কোনো ছিদ্র খুঁজে তার ভেতরে লুকিয়ে পড়তে; তার মেরুদণ্ড নেই, মাথা নেই, পা নেই; শুধু সে পারে বুক দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে অন্ধকার গর্তে ঢুকে যেতে।
হায় জনগণ, আজ কে বলবে তোমরা একদিন বিদ্রোহ করেছিলে; কে বলবে তোমরা একদিন স্বাধীনতা চেয়েছিলে।
হায় জনগণ, কী সহজে তোমরা বিদ্রোহী থেকে পরিণত হও ক্রীতদাসে।
হায় জনগণ, যারা একদিন রক্ত দিতে ভয় পেতে না, তারা আজ চেটে খাচ্ছো পায়ের ধুলো; রক্ত তোমাদের আজ পুঁজে পরিণত।
হায়, জনগণ, হায় সিংহ, এতো সহজে পরিণত হও শুয়োরে।
হায় মহানায়ক, তুমি বুঝতে পারছো না আত্মহত্যা করেছো তুমি; তোমার জীবনে শুরু হলো ধারাবাহিক আত্মহত্যা।
হায় মহানায়ক, ইতিহাস থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যাচ্ছো তুমি।
হায় মহানায়ক, বুঝতে পারছো না তুমি এখন কী।
হায় মহানায়ক, তোমার পতনে আমি গভীর বেদনা বোধ করছি; তোমার এমন পতনের কথা ছিলো না।
কয়েক রাত ধ’রে ঘুমোতে পারছে না হাসান; নিশ্বাস বন্ধ, চারদিকে অন্ধকার, স্তব এবং স্তব এবং স্তব, বিশেষণ এবং বিশেষণ এবং বিশেষণ, অতিশয়োক্তি এবং আরো অতিশয়োক্তি এবং আরো অতিশয়োক্তি, মালা, দলে দলে গিয়ে একদল।