কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ – ০৬

কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ – ০৬

দুটি সাময়িকীতে তার দু-গুচ্ছ কবিতা ছাপা হওয়ার পর সে নিজেই চঞ্চল বোধ করে, দুটি সম্পূর্ণ রাত কাটিয়ে দেয় বারবার নিজের কবিতা পড়ে, এবং নিজেকে প্রশ্ন ক’রে- কবিতাগুলো কি ঠিক এভাবেই লেখা অবধারিত ছিলো, সে কি এভাবেই লিখতে চেয়েছিলো, না কি এগুলো বাস্তবায়িত হ’তে পারতো অন্য রূপেও, এবং এগুলো আদৌ লেখার কোনো দরকার ছিলো কি না? স্ক্রিপ্টের জন্যে সে প্রশংসা পাচ্ছে, কিন্তু ওই প্রশংসাকে সে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে স্যান্ডল দিয়ে ডলছে; ব্যাকুল হয়ে থাকছে তার কবিতার জন্যে একটুকু প্রশংসার জন্যে, একটু প্ৰশংসা পেলে তা সে রক্তে গুচ্ছগুচ্ছ ফুলের মতো সাজিয়ে রাখছে। আধটুকু একটুকু প্রশংসার জন্যে সে এক সপ্তাহে দুটি আড্ডায় যায়, সিগারেট খাওয়ায় অন্যমনস্কভাবে, তবে অনেকে কেড়েই নেয় সিগারেট, তবু কারো মুখ থেকে প্রশংসা বেরোয় না; তবে সে বুঝতে পারে তার কবিতাগুলো পড়েছে। এরা, এই সম্ভাব্য মহাকবিরা, যারা নিজেদের ছাড়া অন্যদের কখনো প্রশংসা করে না।

হাসান, তুমি কেনো একটুকু প্রশংসার জন্যে কাতর? নিজেকে প্রশ্ন করে সে। ওই প্রশংসায় তো তুমি মহাকবি হয়ে উঠবে না, শহরে তোমার একটা চারতলা বাড়ি উঠবে। না, তবু তুমি কেনো সামান্য তুচ্ছ প্রশংসা চাও মনে মনে? কেনো এই এই লাল ক্ষুধা, কেনো এই সোনালি পিপাসা?

সামান্য একটু প্রশংসা হঠাৎ আলোর ঝিলিকের মতো, তাতে ভেতরের অন্ধকার কেটে যায়, শরীর জুড়ে অপার্থিব কােপন লাগে; চারতলা বাড়ি তোমাকে সে সুখ দিতে পারে না। সে নিজেকে বলে, মনে মনে বলে, কবি একটুকু প্রশংসার জন্যে নিরবধি কাল অপেক্ষা ক’রে থাকে, আমিও তো সেই কবি, অপেক্ষা ক’রে থাকবো, যদি একটু প্রশংসা পাই।

তাহলে তুমি যাও, হাঁটাে, বিব্রতভাবে গিয়ে আড়ায় বসো, প্রত্যাশা ক’রে থাকো অপেক্ষা ক’রে থাকো অসম্ভবের; তোমার ওই সঙ্গী কবিদেরই মনে করো মহাকাল, তারা প্ৰসন্ন হ’লে মহাকাল প্রসন্ন হবে। মহাকাল কী? মহাকাল তো এই তুচ্ছরাই; তারাই তো মহাকালের প্রতিনিধি।

কবিতাগুলো বেরোনোর দু-এক দিনের মধ্যেই আলাউদ্দিন রেহমান ফোন ক’রে তার কাতর রক্তে কাঁপন ধরিয়ে দেয়, অতিশয়োক্তিতে তাকে পুলকিত ক’রে তোলে; এবং দুপুরে বিয়ার খাওয়াতে নিয়ে যায়।

আলাউদ্দিন বলে, দোস্ত তোমার স্ক্রিপ্ট ফাসক্যালাস হইছে, কিন্তু তোমার কবিতা অসাধারণ, প্রত্যেকটা লাইন আমারে কাঁপাই দিছে। স্ক্রিপ্ট তোমারে ভাত দিবো বিয়ার দিবো, আর কবিতা তোমারে বাঁচাই রাখবো।

হাসান বলে, তুমি আমার অনুরাগী বন্ধ ব’লে এতোটা প্রশংসা করছে। কিন্তু আড্ডায় গেলে শোনা যাবে ওইগুলো কবিতাই হয় নি।

হা হা হা ক’রে আলাউদ্দিন বলে, কবিরা কবে আবার অন্য কবির প্রশংসা করে? আমরা গার্মেন্টস্‌রা অন্য গার্মেন্টসের যেমুন প্রশংসা করি না, কবিতার ব্যবসায়েও একই ব্যাপার, অগো প্রশংসা তুমি পাইবা না। তাছাড়া অরা পড়েও না, অরা পড়ে না খালি ল্যাখে মাথায় যা পাগলামি আসে।

আলাউদ্দিন রেহমানের প্রশংসা তাকে সম্পূর্ণ ভরাতে পারে না, ভেতরে একটা বড়ো শূন্যতা থেকে যায়, তার কবিতার যদি প্রশংসা করতো রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী তাহলেও ওই শূন্যতা ভরতো না; তার সাধ হয় ওই যারা শস্তা রেস্তোরাঁয় স্টার টানছে ময়লা চা খাচ্ছে খিস্তি করছে বুকের ভেতর থেকে একটি-দুটি পংক্তি উচ্চারণ করছে, তাদের কথা শুনতে।

একদিন হেঁটে হেঁটে শেখ সাহেব বাজার রোডের এক রিকশা’আলা রেস্তোরাঁঁর আড্ডায় গিয়ে উপস্থিত হয় হাসান। রেস্তোরাঁঁর টেবিলে টেবিলে রিকশাআলারা পিরিচে ঢেলে চা খাচ্ছে দু-হাতে টেনে রুটি খাচ্ছে উচ্চস্বরে রেডিও বাজছে, তাদের লুঙ্গিগামছার গন্ধে চারদিক ভ’রে আছে; আর একপাশে সমকালীন কবিরা মহাকাল তৈরি করছে। হাসান দেখে অতিশয় উত্তেজিত অনুপ্রাণিত শিহরিত তুরীয় গলিত হয়ে আছে কবি সালেহ ফরিদউদ্দিন আর কবি আহমেদ মোস্তফা হায়দার। তাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরোতে যাচ্ছে, নবাবপুরের আলেকজান্ড্রা প্রেসে লাইনোতে কম্পোজ শুরু হয়ে গেছে, তারা কবিতার প্রুফ দেখছে আর স্টার ফুঁকছে, চায়ের পেয়ালায় ছাই বাড়ছে, নীল বলপয়েন্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ, প্রথম প্রেমের মতোই উজ্জ্বল অমর শাশ্বত ব্যৰ্থ।

সালেহ ফরিদউদ্দিন বলে, আসো আসো দোস্ত আমাগো কবিতার বই বাইর হইতে যাইতেছে, প্রুফ দ্যাখতাছি।

হাসানের ভেতরটা কেঁপে ওঠে; সে জিজ্ঞেস করে, কারা বের করছে? আহমেদ মোস্তফা হায়দার বলে, বাংলাবাজারের চৌধুরী ব্রাদার্স, তারা তরুণ কবিগো কাব্যগ্রন্থ বের করবে ব’লে ঠিক করছে, আমাগো দুইজন দিয়াই শুরু করছে, পরে অন্যগো কাব্যও বের করবো।

হাসানের ভেতরটা আবার কেঁপে ওঠে, একটা ঝিলিক ও একগুচ্ছ অন্ধকার তার ভেতর দিয়ে বয়ে যায়।

সালেহ ফরিদউদ্দিন কবিতার জন্যে পাগল, হয়তো পাগলের থেকেও বেশি, হয়তো সে মরবেও কবিতার জন্যে; ইংরেজিতে অনার্স ভর্তি হয়েছিলো, কবিতার জন্যে পড়াশুনো ছেড়ে দিয়েছে অনেক আগে; ও যে কীভাবে বেঁচে আছে হাসান জানে না। সালেহ হাসানের থেকে বছরখানেকের ছােটাে, কিন্তু এর মাঝে অনেক বেশি কবিতা লিখে ফেলেছে হাসানের থেকে। তার সাথে হাসানের প্রথম দেখা হয়েছিলো ব্রিটিশ কাউন্সিলে। হাসানের তখন বেশ কিছু কবিতা বেরিয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়, তরুণ কবি হিশেবে একটা পরিচিতি তার গ’ড়ে উঠছে, এবং সে তা উপভোগও করছে। সে একটি টেবিলে বসে পাউন্ডের ‘একগুচ্ছ নিষেধ’ প’ড়ে বেশ মজা পাচ্ছিলো, তখন একটি বিনম্র বিব্রত লাজুক তরুণ তার পাশে এসে দাঁড়ায়। গায়ে আগের দিনের দুই জেবের শার্ট, পাজামা পরা, চুল উস্কো খুস্কো, মুখে দু-এক দিনের না-কাটা দাড়ি, চোখ মান উজ্জ্বল, শরীরটা অসহায়।

তরুণটি জিজ্ঞেস করে, আপনি তো হাসান রশিদ?

হাসান একটু গোপন গৌরব বোধ করে, তাহলে তাকে এখন অনেকে চেনে।

হাসান হেসে বলে, হুঁ, আর আপনি?

তরুণটি বলে, আমার নাম মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন, এবার ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়েছি। আমিও কবিতা লিখি।

হাসান বলে, আপনার কোনো কবিতা আমি এখনো পড়ি নি। তরুণটি তখনই খাতা খুলে নিজের কবিতা সুর ক’রে পড়তে শুরু করে। হাসান বলে, ব্রিটিশ কাউন্সিলে এভাবে কবিতা পড়লে সবাই বিরক্ত হবে, চলুন বাইরে যাই।

বাইরে গিয়ে হাসানের মনে পড়ে আলাউদ্দিন রেহমানকে, যে তার নাম বদলে দিয়েছিলো; হাসানের মনে হয় মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন নামেও চলবে না; একেও ভাঙতে হবে, নাম দিয়েই শুরু হবে তার ভাঙাভাঙি।

হাসান বলে, আপনার নামটি ঠিক আধুনিক কবির নামের মতো নয়, নামটি সম্ভবত বদলাতে হবে।

মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন বলে, আমি শুনেছি আপনিও নাম বদল করেছেন, আমিও আমার নাম বদলাবো।

কিছু দিন পর মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন নিজেকে ভেঙে হয় সালেহ ফরিদউদ্দিন, এবং কবিতার জন্যে উৎসর্গ ক’রে দেয় নিজেকে, অনবরত ভাঙতে থাকে নিজেকে। প্রথম দিকে সে চলতি বাঙলা বলতো, বেশ চমৎকারভাবে বলতো, পরে অন্যদের মতো সেও মিশ্র বলতে থাকে। হাসান কখনো মিশ্রতে যেতে পারে নি, সম্ভবত সে বেশি আড্ডায় যায় না আর বেশি মেশে না ব’লে।

সালেহর কবিতায় একটা এলোমেলো সুন্দর পাগলামো আছে, শব্দ নিয়ে পাগল কিশোরের মতো খেলা আছে, মাঝেমাঝে চমৎকার কাতর পংক্তি আছে, ছবি আছে, ভেতরে জীবনানন্দ আছে, এবং ওর মুখে একটা করুণ অসহায়তার আভা আছে। সালেহকে এজন্যে ভালো লাগে হাসানের।

সালেহর প্রিয় অভ্যাস নিজের কবিতা প’ড়ে শোনানো; শুধু প’ড়ে নয় নিজের কবিতা সে অনর্গল আবৃত্তি করতে ভালোবাসে।

ওর আরো একটি প্রিয় অভ্যাস অন্যের কোনো পংক্তি ভালো লাগলে সেটাকে নিজের কবিতার ভেতর সে অনায়াসে ঢুকিয়ে দেয়। তাই ছাপানোর আগে সালেহকে কবিতা শোনাতে ভয় হয়, হয়তো কোনো পংক্তি সে হরণ ক’রে নেবে, ছাপিয়ে ফেলবে, তখন পুরো কবিতাটিই বাতিল হয়ে যাবে।

 

সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকার সময় কোনো কোনো দিন হঠাৎ ছিন্নভিন্ন ওয়ার্ডস্‌ওয়ার্থি মেঘের মতো তার ঘরে আসতো সালেহ, বলতো দোস, তোমার হলে খাইতে আসলাম তোমার হলের চ্যাপ্টা রান আর টেবিলগুলি আমার খুব ভালো লাগে, তোমার লগে খাইলে প্যাট ভরে।

সে নিজের কবিতা আবৃত্তি করতে থাকতো, এমন কি খাওয়ার সময়ও। হাসান সব সময়ই লজ্জা পায় নিজের কবিতা আবৃত্তি করতে, অন্যকে পড়ে শোনাতে; কিন্তু সালেহর এটা বড়ো আনন্দ। খাওয়ার পর নিজের কবিতা আবৃত্তি করতে করতে তার ক্যাপস্টেনের প্যাকেট থেকে একটার পর একটা সিগারেট ধরাতো, তারপর বলতো, দোস, পাঁচটা ট্যাকা দেও, সিনেমা দেখুম।

হাসান অবাক হতো, ও কী ক’রে ওই পচা দুৰ্গন্ধপূর্ণ আবর্জনা দেখে, আবার সিনেমার থেকে বহুদূরবর্তী কবিতা লেখে!

কবিতার জন্যে সে সব ছেড়েছে, এমন কি ছেড়েছে নিজের শরীরটিকেও, ওর শরীরটি নানাভাবে ভাঙছে বলে মনে হচ্ছে হাসানের।

হাসান জিজ্ঞেস করতো, শুধুই কি সিনেমা দেখবে, না কি অন্য কিছুও?

সালেহ লজ্জা পেয়ে বলতো, হল থিকা একবার ব্ৰোথোলেও যামু, দোস।

আহমেদ মোস্তফা হায়দার একটু অন্যমনস্ক ধরনের, আল্পতেই ভেঙে পড়তে চায়, কিন্তু ভেঙে পড়বে না ব’লেই মনে হয়; একটি দৈনিকে কাজ করে। পাশের বাড়ির একটি ইস্কুলে-পড়া মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছিলো আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়, এবং কয়েক দিন পর ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলো। পালানোর জন্যে তারা নদী সাঁতরে গিয়েছিলো, কিন্তু মেয়েটিকে সে ধ’রে রাখতে পারে নি। ওই মেয়েটির জন্যে শোক চিরকালের জন্যে লেগে আছে আহমেদের চোখে মুখে চুলে কণ্ঠস্বরে। আহমেদ কাতর সেন্টিমেন্টাল প্রেমের কবিতা লিখে চলছে, প্রতিটি বাক্যের শেষে অশ্রুর মতো একটি ক’রে বিস্ময়চিহ্ন বসাচ্ছে, হয়তো সারাজীবনই বসাবে। হয়তো এজন্যেই আহমেদ মোস্তফা হায়দারকে ভালো লাগে হাসানের।

দুটি টেবিল ঘিরে চলছে। জমজমাট আড্ডা, সিগারেটের ছাই জমছে পিরিচে কাপে; পাশাপাশি ব’সে প্রুফ দেখছে আহমেদ ও সালেহ। তাদের মুখোমুখি একটি নড়োবড়ো চেয়ারে বসে হাসান।

তাদের প্রুফের গুচ্ছগুচ্ছ নিউজপ্রিন্ট থেকে একটা ভেজা ভারি অদ্ভুত সুগন্ধ এসে ঢুকে যাচ্ছে হাসানের বুকের ভেতর, হয়তো কবিতার গন্ধ; আর নিউজপ্রিণ্টের প্রুফে লাইনো অক্ষরগুলোকে নক্ষত্রের থেকেও জ্বলজ্বলে দেখাচ্ছে।

হাসান বলে, লাইনের অক্ষরগুলো দেখতে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বলে, এগুলোর সম্ভবত সুগন্ধ পাচ্ছি।

সালেহ ফরিদউদ্দিন বলে, আরে দোস, লাইনো আর কবিতা একই কথা, লাইনােতে না ছাপলে কোনাে কিছুই কবিতা মনে হয় না।

আহমেদ মোস্তফা হায়দার বলে, লাইনো মিন্স্‌ পোয়েট্রি, এই জন্যেই তা হাইট্টা হাইট্টা নবাবপুর যাই, যখন ঝনাৎ ঝনাৎ কইর‍্যা লাইনগুলি পড়ে মনে হয় আমার ভিতর থিকা ঝনাৎ ঝনাৎ কইর‍্যা কবিতার লাইন বাইর হইতেছে।

হাসান বলে, তোমার কবিতার লাইন তো ঝনাৎ ঝনাৎ ক’রে বেরোনোর কথা নয়, ওগুলো তো অশ্রদ্ধর মতো গড়িয়ে বেরোনোর কথা।

হৈ হৈ ক’রে ওঠে আহমেদ, দোস, অশ্রু জইম্যা সীসা হইয়া গ্যাছে, আইজ লাইনো অক্ষর হইয়া ঝানাৎ ঝনাৎ কইর‍্যা পড়ে।

খুব সুখী মনে হচ্ছে আহমেদ মোস্তফা হায়দার ও সালেহাকে। ওরা প্রুফ দেখছে, কিন্তু শুধু বানান দেখছে না, পাণ্ডুলিপির সাথে মিলিয়ে দেখছে না, নতুন নতুন পংক্তিও যোগ করছে প্রুফে। আর প্রুফের চিহ্নগুলো দিচ্ছে পরম আদরে, ক্লাশের খাতায় ওরা কখনো এতো আদরে কিছু লেখে নি। প্রুফের চিহ্নগুলোকে রহস্যময় মনে হচ্ছে হাসানের; সে কখনো প্রুফ দেখে নি, তাই ওই চিহ্নগুলোর অর্থ সে বুঝতে পারছে না, তাকিয়ে থাকছে ওদের আঙুলের দিকে, কবিতার থেকেও রহস্যময় চিহ্ন রাশি নিৰ্গত হচ্ছে ওদের আঙুল থেকে।

সালেহর থেকে প্রচ্ছদের কয়েকটি পাতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে হাসান। একদিন কি এমন প্রুফ সেও দেখবে, বর্ণের ওপর দাগ দেবে, শব্দ ফাঁক করবে, যুক্ত করবে, পাতার পাশে এই বিস্ময়কর চিহ্নগুলো বসাবে? বেশ কয়েকটি বানান ভুল রয়ে গেছে সালেহর প্রুফে, কিছু বাক্যও অশুদ্ধ।

হাসান একটি শব্দ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে, সালেহ এই শব্দটি কী?

সালেহ বলে, আরো দোস, শব্দটা হইল ‘মুমুর্ষ’, মানে মরা মরা।

সে কি শব্দটি ঠিক ক’রে দেবে?

হাসান বলে, সালেহ, শব্দটির বানান। কিন্তু ‘মুমূর্ষ’। সালেহ বলে, আরো দোস, বানানে কি হয়, কবিতা হইলেই হইল, কবিগো বানান লাগে না, তুমি ত আবার আমাগো থিকা বানান বেশি জানো, দেও দেও দোস বানানটা শুদ্ধ ক’রে লই।

সালেহ বানানটি শুদ্ধ ক’রে নেয় প্রুফে।

সালেহ বলে, দোস, তোমারও একটা বই বাইর হওন দরকার। বিয়ার বয়সের মতন প্রথম কাব্যগ্রন্থ বাইর করনেরও একটা বয়স আছে।

তার হৃৎপিণ্ডটি বিপজ্জনকভাবে লাফিয়ে ওঠে, থামতে চায় না।

হাসান বলে, না, না, এখনো সময় আসে নি; আমি বেশি কবিতা লিখি নি।

আহমেদ মোস্তফা বলে, আরে দোস, বিনয় কইরো না, ছয় ফর্ম পদ্য তুমিও ল্যাখছো, অই যে দুইটা গুচ্ছ ছাড়লা তাতেই তা তিন ফর্ম হইয়া যাইবো। যাও, কবিতার বইর নাম ঠিক কইর‍্যা ফালাও।

হাসান বিব্রতভাবে জিজ্ঞেস করে, তোমরা কি আমার কবিতাগুলো পড়েছে?

সালেহ বলে, পরুম না ক্যান, ভালই ল্যাখছো দোস, যাও, কপি বানাই ফালাও, আমাগো বইর পর তোমার বইও চৌধুরী ব্রাদার্স বাইর করবো।

ওদের এই সামান্য কথা, ওরা তার কবিতা পড়েছে, এটাকেই হাসানের মনে হয় শ্ৰেষ্ঠ প্ৰশংসা; যেনো মহাকাল বলছে, কপি বানাই ফালাও, কবিতার বইর নাম ঠিক কইর‍্যা ফালাও।

কিন্তু চৌধুরী ব্রাদার্স কি তার নাম জানে? কী ক’রে জানবে? সে তো কখনো কোনো প্রকাশকের কাছে যায় নি, আর সে শুনছে প্রকাশকরা কবিতা পড়ে না, বই পড়ে না, বই ছাপে। তারা কি ছাপিবে তার কবিতার বই? প্রথম কাব্যগ্রন্থ?

বাসায় ফেরার সময় রিকশা নিতে ইচ্ছে হয় না তার, সে হেঁটে হেঁটে একটির পর একটি ক্যাপস্টেন টানতে টানতে মহাকালের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, মহাকালের গ্ৰীবা দেখতে পায়, যেনো তাকে কে যেনো ডাকছে সে তার পেছন পেছন হাঁটছে, এই হাঁটা ফুরোবে না কোনোদিন। তার হাঁটা অনন্ত হোক, গন্তব্যহীন হোক, অশেষ হোক; সে শুধু হাঁটবে, কোনোদিন পৌছোবে না, হাঁটাই গন্তব্য। সে কি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রেসকপি বানাবে, তৈরি ক’রে ফেলবে পাণ্ডুলিপি, ঠিক ক’রে ফেলবে বইয়ের একটা নাম? চিরকালের জন্যে ওটিই হয়ে যাবে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম? শিউরে ওঠে হাসান, তার মনে হয় সে এমন কিছু সম্পর্কে ভাবছে যা সম্পর্কে বাস্তবে বাস ক’রে ভাবা উচিত নয়, ভাবা উচিত স্বপ্নে, বা একলা পানশালায় বসে প্রচুর বিয়ার পান করতে করতে। অনেকগুলো কবিতার পংক্তি অনেকগুলো চিত্রকল্প তার মাথায় বাকব্যাক ভোরের টিয়ের মতো উড়ছে, এদিকে যাচ্ছে সেদিকে যাচ্ছে, সেগুলোকে সে খাতার খাঁচায় ধরতে পারছে না, ধরতে গেলেই ওড়া বন্ধ ক’রে দিচ্ছে ডাক বন্ধ ক’রে দিচ্ছে ওই বিস্ময়কর সবুজ স্বপ্নগুলো, সেগুলোকে কি সে ধরবে না? কী নাম রাখবে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের? একটি একটি ক’রে নাম ভেসে আসতে থাকে, উড়ে যেতে থাকে;

ইচ্ছে করে বুকের ভেতরে।

হাঁটতে হাঁটতে নিজের কবিতার নাম ও পংক্তি একটি একটি ক’রে মনে আসতে থাকে হাসানের; এবং এক সময় সব কিছু এলোমেলো হয়ে তার মগজে খেলা করতে থাকে। পূর্বপুরুষদের বিস্ময়কর পংক্তির পর পংক্তি।

পাতার আড়াল হতে বিকালের আলোটুকু এসে আরো কিছুখন ধ’রে ঝালুক তোমার কালো কেশে।

কবিতা, মানসী, তুই প্রাসাদের উপাসক, জানি। কিন্তু বল, যখন প্রদোষকালে, হিমেল বাতাসে, নির্বোদে, নীহারপুঞ্জে জানুয়ারি কালো হয়ে আসে–নীলাভ চরণে তোর তাপ দিবি, আছে তো জ্বালানি?

আনরিয়েল সিটি, আন্ডার দি ব্ৰাউন ফগ অফ এ উইন্টার ডন, এ ক্রাউড ফ্লোউড ওভার লন্ডন ব্রিজ, সো মেনি, আই হ্যাড নট থট ডেথ হ্যাড অন ডান সো মেনি।

সারারাত চিতাবাঘিনীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে নক্ষত্রহীন, মেহগনির মতো অন্ধকারে সুন্দরীর বন থেকে অর্জুনের বনে ঘুরে ঘুরে সুন্দর বাদামী হরিণ এই ভোরের জন্যে অপেক্ষা করছিল।

থিংজ ফল অ্যাপার্ট; দি সেন্টার ক্যানট হৌল্ড; মেয়ার অ্যানার্কি ইজ লুজ্‌ড্‌ আপন দি ওয়ার্ল্ড’ দি বেস্ট ল্যাক অল কনভিকশন, হোয়াইল দি ওয়স্ট আর ফুল অফ প্যাশোনেট ইন্টেনসিটি।

একটি কথার দ্বিধাথরথর চূড়ে ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী; একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণী জুড়ে, থামিল কালের চিরাচঞ্চল গতি।

আই হ্যাভ সাং উইমেন ইন থ্রি সিটিজ ৷ বাট ইট ইজ অল ওয়ান। আই উইল সিং অফ দি সান।

অ্যামং টুয়েন্টি স্নোয়ি মাউন্টেন্স দি অনলি মুভিং থিং ওয়াজ দি আই অফ দি ব্ল্যাকবার্ড।

তুমি ভ’রে তুলবে, তাই শূন্যতা। তুমি আসবে উষ্ণতা, তাই শীত।

আই হ্যাভ মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ।

এই সব অবিস্মরণীয় জলের মতো ঘুরে ঘুরে বুকের ভেতর কথা বলা পংক্তির ভেতর থেকে আবার জেগে ওঠে নিজের পংক্তিমালা, এগুলোর পাশে তারগুলোকে কি খুব করুণ গরিব দেখাচ্ছে? নিজের পংক্তিমালার উদ্দেশে সে বলতে থাকে :

আমার করুণ গরিব বিপন্ন রুগ্ন পংক্তিমালা
তোমরা জেগেছো তোমরা জন্মেছো আমার ভেতর থেকে
আমি সামান্য, তোমাদের আমি অমরত্ব দিতে পারি নি
ক’রে তুলতে পারি নি অবিস্মরণীয়
তোমরা হয়তো কবিতাও হয়ে ওঠে নি
তোমরা হয়তো কারো হৃদয়েই ঢুকতে পারবে না
ঢুকতে পারবে না। কারো রক্তে
কিন্তু তোমরা নতুন তোমরা এই ভয়ঙ্কর সময়ের
তাই তোমরা হতে পারো কাব্যগ্রন্থ।
তোমরা সূচনা, একদিন দেখা দেবে তারা
যারা বেঁচে থাকবে, হবে অবিস্মরণীয়।

কয়েক দিনের মধ্যে দুটি ঘটনা ঘটে যায়; হাসান দেখে তার ভেতর একটি অন্য হাসান জ্বলছিলো। সে-আগুন হঠাৎ বের হয়ে ঝলসে দেয় প্রথাগত ভাবনার মুখমণ্ডল। নিজের এ-রূপ দেখে সে বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়, আর অন্যরা তাকে ভয় পেতে থাকে, যদিও সে মনে করে সে ভীতিকর নয় একটুও।

গাড়লদের একটি ভাঙাচোরা দুর্গ আছে, ওই পদ্মলোচনের নাম অ্যাকাডেমি; কিন্তু ওটা একটা গোশালা একটা ছাগশালা।

সেখানে পালিত হবে সুকান্তজয়ন্তী;–দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর গরু গাধা মোষ খচ্চর সিংহ সবাই সমাজতান্ত্রিক হয়ে উঠছে; ওই দুর্গের একজনের সাথে একদিন দেখা হয়ে যায় হাসানের, যে পছন্দ করে হাসানকে। হাসান ওই অনুষ্ঠানে স্থান পায় আলোচক হিশেবে। একরাশ বাজেকথা, ভজভজে বাজেকথা, হবে বটগাছের নিচে, হাসান জানে, যেমন হয়ে আসছে। বছরের পর বছর; কোনো পদস্থ মুর্খ সুকান্তের কবিতা থেকে একশো চল্লিশটা উদ্ধৃতি দিয়ে একটা চল্লিশ মিনিটের প্রবন্ধ পড়বে, তারপর আলোচকেরা প্রবন্ধের কথা ভুলে বিশ্বজগত ভুলে অনর্গল আবোলতাবোল বকবে প্যাচাল পাড়বে। বড়ো গৌরবের কথা, সে আলোচক হয়ে উঠছে। এবার একটি বিশেষ আকর্ষণও আছে, কলকাতা থেকে প্রধান অতিথি হয়ে আসছেন সুকান্তের ভাই। ভেতরে একটা কাঁপনও লাগে, সে মঞ্চে কথা বলতে পারবে তো, পা কেঁপে উঠবে না তো, গলা শুকিয়ে যাবে না তো, চোখে অন্ধকার দেখবে না তো? সে যখন জানতে পারে প্রবন্ধ পড়বে অধ্যাপক জমিরালি পিউবিক হ্যায়ার ড্রেসার, সে হো হো ক’রে ভেতরে ভেতরে হাসে, সুকান্তের সমস্ত কবিতাই হয়তো জমিরালি সাহেব উদ্ধৃত করবে প্রবন্ধে। সে আলোচনা করবে জমিরালির প্রবন্ধ? একবার ইচ্ছে হয় গিয়ে ব’লে আসে সে আলোচনায় অংশ নিতে পারবে না, জমিরালির প্রবন্ধে আলোচনার যোগ্য কিছু থাকবে। না। জমিরালির মুখোমুখি হ’তে হবে তাকে? বিশ্ববিদ্যালয়ে জমিরালি তার শিক্ষক ছিলো, কিন্তু জমিরালির কাছে থেকে সে কিছু শেখে নি, যেমন কিছুই শেখে নি কদম আলি মনু মিয়া তোরাব উদ্দিন সোরাব চাকলাদারের কাছে; এবং সে তো জমিরালি ও অনেককেই ঘৃণা করে। জীবনে কখনাে তাদের মুখ যে সে দেখতে চায় না। জমিরালি যে তার শিক্ষক ছিলো এটাও সে আর স্বীকার করতে চায় না বা স্বীকার করলে সব কিছু নিরর্থক হয়ে ওঠে। শিক্ষক শিক্ষক শিক্ষক, কাকে বলে শিক্ষক? সে নিজেকে বলে, এটা এক আকস্মিক দুর্ঘটনা কে কখন কোথায় কোন অবস্থায় থাকে, ক্লাশকক্ষে কে শিক্ষক হিশেবে ঢোকে কে ঢোকে ছাত্র হিশেবে।

অনুষ্ঠানের বিকেলে হাসান গিয়ে দেখে লোকজন আসতে শুরু করেছে।

বটগাছের সামনে সারিসারি চেয়ার পাতা, সে একজন আলোচক ব’লে বেশ বিনয়ের সাথে এক কর্মকর্তা তাকে সামনের সারির একটি চেয়ারে বসান। খুবই বিব্রত বোধ করে হাসান। সে আলোচক? তার কাছে হাস্যকর মনে হয় এটা। ইচ্ছে করে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু সে চুপচাপ বসে থাকে, এমন সময় অধ্যাপক জমিরালি বেশ হাসিখুশি মুখে তাদের সামনে এসে উপস্থিত হয়। জমিরালি মনে করেছিলো হাসান উঠে তাকে সালাম দেবে, কিন্তু হাসান সে-সব কিছুই করে না। জমিরালির হাসিটা কালো হয়ে ওঠে। তার কালো হাসিটা দেখে বেশ সুখ পায় হাসান।

কিন্তু জমিরালি দমার পাত্র নয়, সে তার মর‍্যাদা রক্ষা ক’রে ছাড়বে।

সে আবার হেসে বলে, তুমি হাসান রশিদ না?

হাসান কোনো উত্তর না দিয়ে একটি পায়ের ওপর আরেক পা দিয়ে বসে, এবং পকেট থেকে বের ক’রে একটি সিগারেট ধরায়।

জমিরালি আবার হেসে হেসে বলে, আমার কি ভুল হচ্ছে, আমার কি ভুল হচ্ছে, তুমি হাসান রশিদ না?

হাসান ধুঁয়ো ছাড়তে ছাড়তে বলে, হু, আমি হাসান রশিদ, আর আপনি?

কেঁপে ওঠে জমিরালি, তুমি আমাকে চিনতে পারলে না, তুমি আমাকে চিনতে পারলে না? আমি তোমার শিক্ষক।

হাসান বলে, না, চিনতে পারলাম না। শিক্ষক? ইস্কুলের পর আমার আর কোনো শিক্ষক নেই।

জমিরালি টলতে টলতে অন্য দিকে পা বাড়ায়, মাটিতে প’ড়ে যাবে মনে হয়, তবে দু-তিনটি সালাম পেয়ে আবার সুস্থ বোধ ক’রে ঠিক মতো দাঁড়ায়।

মঞ্চে ছটি চেয়ার; এক সময় অনুরোধ করা হয় সভাপতি, প্রধান অতিথি, প্রাবন্ধিক, ও তিনজন আলোচককে মঞ্চে উঠতে। হাসান, সবচেয়ে তরুণ, সবার শেষে মঞ্চে উঠে। উত্তরতম চেয়ারটিতে বসে। জমিরালি সভাপতি আর প্রধান অতিথির সাথে প্রচুর কথা বলতে চেষ্টা করছে; সে সম্ভবত পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে নি, প্ৰবন্ধ পড়ার আগে সুস্থ হয়ে উঠতে চাচ্ছে, কিন্তু সুস্থ হয়ে উঠতে পারছে না। হয়তো সারাজীবনেও সে আর সুস্থ হবে না, অসুস্থতাটা থেকে যাবে, অন্তত হাসানের কথা মনে পড়লে; কিন্তু হাসান কয়েক বছর পর আজই চমৎকার সুস্থ বোধ করছে, তার মাংস প্রসন্নতা বোধ করছে।

হ্যাঁ, জমিরালি জমিরালির মতোই প্ৰবন্ধ লিখেছে, জমিরালির মতোই পড়ছে।

সময় কাটানোর জন্যে হাসান গুণে দেখতে চেষ্টা করছিলো জমিরালির প্রবন্ধে কটি উদ্ধৃতি আছে, পঁচিশটা গোণার পর ক্লান্ত হয়ে সে দূরের আমগাছের ডালে কয়েকটি ব্যস্ত কাকের কয়েকটি চঞ্চল শালিখের সৌন্দর্য দেখতে থাকে–দেখে মুগ্ধ হয়, চোখ ফিরিয়ে সামনের সারিতে বসা এক প্রচণ্ড উদ্ভিন্ন উল্লসিত চল্লিশোত্তরার দর্শনীয় সম্মুখভাগের পর্বতমালার উচ্চতা, ভর ও ওজন পরিমাপ করতে থাকে, অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে তার বক্ষবন্ধনির রঙ, বিবর্ণিতা, ও আকার নির্ণয় করতে থাকে। জমিরালির প্রবন্ধের থেকে এগুলো অনেক বেশি মননশীল, অনেক বেশি সৃষ্টিশীল; অনেক বেশি মনোযোগ দাবি করে। জমিরালি প্ৰবন্ধ পড়তে থাকে, প্রাবন্ধিক না হয়ে সে ধারাবর্ণনাকারী ও আবৃত্তিকার হ’লেই ভালো হতো; হাসানের মাথার ভেতর দিয়ে তখন ছুটে চলছে কয়েকটি কাক শালিখ, আর রানার, আঠারো বছরের দুঃসহ বয়স, বিদ্রোহ আজ বিপ্লব চারিদিকে, হিমালয় থেকে সুন্দর বন হঠাৎ বাংলাদেশ, সিগারেট, পূর্ণিমা চাঁদ যেনাে ঝলসানাে রুটি, এবং ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। ঝলসে ওঠে হাসান, আসলেই ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়? একটি গরম তাওয়া থেকে উঠে একটা তাপের প্রবাহ বয়ে যায়। তার চামড়ার নিচ দিয়ে।

জমিরালির শেষ হ’লে প্রথমে আলোচনা করার জন্যে ডাকা হয়। হাসানকে।

সে তরুণতম, সবচেয়ে নির্জ্ঞান, তাই শুরু হয় তাকে দিয়েই, এটাই সূত্র; প্রাজ্ঞ মহাজ্ঞানী মহাজনেরা, যাঁরা পাঁচশো পঁচিশ বছর ধ’রে কবিতা পড়েন না, যাদের কাছে কবিতা হচ্ছে ‘চিরসুখী জন ভ্ৰমে কি কখন’, বড়োজের ‘অন্ন চাই, প্ৰাণ চাই, আলো চাই চাই মুক্ত বায়ু’, তাঁরা পরে আলোচনা করবেন, বাণী দেবেন; বৈদিক শাশ্বত শ্লোক যতো পরে উচ্চারিত হয় ততো বেশি প্রাজ্ঞ শাশ্বত শোনায়।

হাসান কাঁপতে কাঁপতে কোনোদিকে না তাকিয়ে মাইক্রোফোনে গিয়ে সরাসরি আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছিলো, হঠাৎ তার মনে পড়ে যে সভাপতি, প্রধান অতিথি প্রমুখ বা ইত্যাদিকে স্মরণ ক’রে দু-চারটি বিশেষণ ব্যবহার করা বিধেয়, তাই সে তাদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে একটি দীর্ঘ বাক্য বলে–বাক্যটি ভেঙে পড়তে পড়তে শুদ্ধ হয়ে ওঠে, যদিও প্রত্যেককে তার মনে হচ্ছিলো স্তূপস্তূপ সম্মানিত পেটমােটা শূন্যগর্ভতা, অসার অপার অপদার্থতা; এবং সে আলোচনা শুরু করে।

হাসান বলে, অধ্যাপক জমিরালি সাহেবকে অশেষ ধন্যবাদ তাঁর ৬১টি উদ্ধৃতির জন্যে; তবে প্রবন্ধটি শোনার সময় তার মনে হচ্ছিলো এটা কোনো মেধাবী স্নাতক শিক্ষার্থীর লেখা, এতে সুকান্তের কবিতার বিষয়, ছন্দ, অলঙ্কার সবই উদাহরণসহ আলোচিত হয়েছে, তাঁর প্রবন্ধ শুনে সুকান্তের কবিতার আবৃত্তি শোনার সুখ পাওয়া গেছে, শুধু সুকান্তের কবিতার মর্ম বোঝা যায় নি। তবে জমিরালি সাহেবকে ধন্যবাদ উদ্ধৃতিগুলোর জন্যে, যদিও ভুল রয়েছে কয়েকটি উদ্ধৃতিতে।

হাসান অনুভব করে শ্রোতাদের মধ্যে বিকট অদ্ভুত উল্লাস আর মঞ্চে অতল অশরীরী আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে।

ঘোষক এসে তার হাতে এক টুকরো কাগজ দেয়, তাতে লেখা ‘শ্ৰদ্ধা ও বিনয়ের সাথে আলোচনা করুন; আলোচনা সংক্ষিপ্ত করুন।’

হাসান কিছুক্ষণ ধ’রে কাগজটি পড়ে, তার ইচ্ছে হয়। আর আলোচনা না ক’রে মঞ্চ থেকে নেমে বটগাছের ছায়া পেরিয়ে বিক্রমপুর পার্বতীপুর সাগাইয়া কিশোরগঞ্জের ধানক্ষেতে গিয়ে চাষবাস করতে, পুকুরে পলো বা ঝাঁকিজাল দিয়ে মাছ ধরতে, বাড়ৈখালির বাজারে গিয়ে দোকানে ব’সে ঘোলাটে চা খেতে।

শ্রোতাদের মধ্যে একজন চিৎকার করে ওঠে, আপনে বলেন, হাসান রশিদ সাব, আপনে ঠিক কথাই বলতেছেন, আপনে বলেন, আমরা শোনতে চাই।

হাসান বলতে থাকে, সুকান্ত বাঙলা ভাষার একমাত্র বিশুদ্ধ মার্ক্সবাদী কবি, তার কবিতা সাম্যবাদী ইশতেহারের কাব্যরূপ। বাঙলার কবিরা সকলের কবি, তাঁরা সাধনা করেন। সকলের কবি হওয়ার, কিন্তু সুকান্ত সকলের কবি হওয়ার দুর্বলতাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন; তিনি সকলের কবি হ’তে চান নি, তিনি হ’তে চেয়েছিলেন একটি শ্রেণীর কবি। সুকান্ত সকলের কবি নন, তিনি একটি শ্রেণীর কবি, তিনি দুর্গত সর্বহারা শ্রেণীর কবি।

হাসান পেছনে উচ্চ ‘না, না, না’ শব্দ শুনতে পায়; তাকিয়ে দেখে সুকান্তের ভাই, প্রধান অতিথি, চিৎকার করছেন, না, না, সুকান্ত ছিলো সকলের কবি। সুকান্ত সকলের কবি, সুকান্ত সকলের কবি।

হাসান বলতে থাকে, সুকান্তের স্পষ্ট পক্ষ ও প্রতিপক্ষ ছিলো; তিনি চাইতেন প্রতিপক্ষকে উৎখাত ক’রে নিজের পক্ষের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে।

হাসান শুনতে পায় পেছনে কে যেনো বলছে, এইটা বলা ঠিক হইতেছে না, সুকান্তকে সকলের কবি বলতেই হবে।

হাসান বলে, সুকান্তের কোনো স্ববিরোধিতা ছিলো না। নজরুলের কথা মনে পড়ছে, নজরুল কয়েক বছর বিদ্রোহী ছিলেন, কিন্তু ছিলেন স্ববিরোধী, কন্ট্রাডিকশনে পরিপূর্ণ, কিন্তু সুকান্তে কোনো কন্ট্রাডিকশন নেই।

পেছনে কে যেনো বলে, নজরুলরে টেনে আনা ঠিক হচ্ছে না, নজরুল সমালোচনার উর্ধ্বে।

হাসান বলে, সুকান্তের একটি পংক্তির সাথেই শুধু আমি দ্বিমত পোষণ করি, আর ওই পংক্তিটি তাঁর দুটি শ্ৰেষ্ঠ পংক্তির একটি; তিনি বলেছিলেন, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়; এটা খুবই স্মরণীয় পংক্তি, কিন্তু কবিতা শাশ্বত, ক্ষুধার রাজ্যেও পৃথিবী কবিতাময়।

সম্মানিত প্রাজ্ঞ আলোচকগণ এর পর আর সুকান্তের কবিতা নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করেন না, তারা ঝাল ঝাড়া আলোচনা করেন হাসানকে; তাঁরা সবাই অকপটে নিন্দা জানাতে থাকেন হাসানের বক্তব্যের, তাঁরা বলেন সুকান্ত অবশ্যই সকলের কবি, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী অবশ্যই গদ্যময়; আর তরুণ অর্বাচীন আলোচনা হাসান রশিদ উদ্ধত দুর্বিনীত, সে কবিতা আর সাহিত্য বোঝে না, সে এমন এক পবিত্র সভায় স্থান পাওয়ার অযোগ্য।

শ্ৰোতাদের মধ্যে থেকে দু-তিনজন প্রতিবাদ জানালে আলোচকেরা ভয় পান, তাঁরা সংযত হন; এমনকি সভাপতি হাসানের প্রশংসাও করেন।

হাসান চুপ ক’রে বসে থাকে, মাঝেমাঝে তার মনে হয় লাফিয়ে মাইক্রোফোন কেড়ে সে এসবের প্রতিবাদ করে, আবার মনে মনে সে হেসে ওঠে। সভা শেষ হ’লে আস্তে চুপচাপ নেমে আসে মঞ্চ থেকে, একাডেমির কেউ তার সাথে কথা বলে না। সুকান্তের ভাই তার দিক থেকে ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নেন।

কিন্তু মাঠে কয়েকটি তরুণ ও কয়েকটি তরুণ সাংবাদিক তাকে ঘিরে ধরে। এই তাকে প্রথম ঘিরে ধরা, এই প্রথম তার কথা শোনার জন্যে নতুন সময়ের নতুন বিকেলের প্রথম উজ্জ্বল উৎসাহ।

একটি তরুণ বলে, আপনার কথা শুনে আমরা মুগ্ধ হয়েছি, এই নতুন কথা শুনলাম, সুকান্তকে নতুনভাবে বুঝলাম।

আরেক তরুণ বলে, কবিরাও যে গুছিয়ে কথা বলতে পারেন, এই প্রথম দেখলাম। আগেও কয়েকজন কবির বক্তৃতা শুনেছি, তারা আবোলতাবোল বলেন, কিছু পড়েছেন ব’লে মনে হয় না।

হাসান হেসে বলে, তাহলে আমি হয়তো কবি নাই।

একটি তরুণ সাংবাদিক বলে, আমরা আপনার কথাগুলোই রিপোর্ট করবো, বহু দিন এমন বক্তৃতা শুনি নি। মিছে কথা শুনতে শুনতে আমাদের কান প’চে গেছে।

হাসান চঞ্চল হয়ে ওঠে, তার রক্তে কিসের যেনো সুর বাজে। সে গুছিয়ে কথা বলতে পারে তাহলে? নতুন কথা বলতে পারে? সত্য কথা? কবি হয়েও পারে কথা বলতে? কিন্তু সে কি কবি? কোথায় তাৱ কবিতার বই?

এক বুড়ো এগিয়ে আসেন তার দিকে।

বুড়ো বলেন, আপনার কথা শুনে মুগ্ধ হয়েছি, বুড়ো বয়সে সভায় আসি সময় কাটানোর জন্যে, পচা পচা কথা শুনি মিথ্যে কথা শুনি, মনে হয় আমার সময় প্ৰভু কবে কাটাবেন; আজি সুখ পেলাম যে নতুন সত্য কথা বলার লোকও জন্ম নিচ্ছে আমাদের এই মিথ্যেবাদী সমাজে।

হাসান বলে, আপনাকে ধন্যবাদ, কিন্তু দেখলেন তো সবাই আমাকে কেমন বকাবকি করলেন; দেখলেন তো সাহিত্য সমালোচনাও এখানে রাজনীতি।

বুড়ো বলেন, ওরা মিথ্যে বলেন ব’লেই মঞ্চে জায়গা পান। আপনার জন্যে আমার ভয় হচ্ছে, এমন সত্য কথা বলতে থাকলে ভবিষ্যতে আপনি মঞ্চে স্থান পাবেন না, সমাজেও হয়তো স্থান পাবেন না।

আমি শূদ্র হয়েই থাকবো, সমাজের বাইরে নর্দমার পাশের বস্তিতে থাকবো, আমার দিকে তাকাতে সমাজ ঘেন্না বোধ করবে।

সমাজ, হায় রে সমাজ, হায় রে সুন্দর ভাগাড়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *