কবিরাজ চেখফ

কবিরাজ চেখফ

উত্তম গুরুর সদুপদেশ পেলেই যদি সার্থক লেখক সৃষ্টি হতেন তবে ইহ-সংসারে আমাদের আর কোনও দুর্ভাবনা থাকত না। কারণ আমার বিশ্বাস, এতাবৎ বহুতর গুরু অপ্রচুর পুস্তকে নানাবিধ সদুপদেশ দিয়ে গিয়েছেন, এবং সদুপদেশ-তিয়াষী তরুণ সাহিত্যযশাভিলাষীরও অনটন এই বঙ্গদেশে নেই।

আমি সার্থক সাহিত্যিক নই, তবে কিছুটা লোকায়ত (জনপ্রিয় বললে বড় বেশি দম্ভভাষণ হয়ে যায়) বটি। ট্রেনে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর তিনি সোল্লাসে বলেছিলেন, আপনার লেখা পড়লেই পাঁচকড়ি দের কথা আমার মনে আসে।

আমি সাতিশয় শ্লাঘা অনুভব করেছিলুম। আমি জানি আপনারা পাঁচজন পাঁচকড়িকে বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখেন না। যদিও শুধোই, বুকে হাত দিয়ে উত্তর দিন তো, পনেরো বছর বয়সে পাঁচকড়ি পড়ে আপনার পঞ্চেন্দ্রিয়াস্তম্ভন হয়নি? আপনার চৈতন্যকে এরকম সূক্ষ্ম, তীক্ষ্ণ একাগ্ৰমনা করতে পেরেছেন ক-জন লেখক এবং স্বয়ং গীতা বলেন, চৈতন্যকে সর্বপ্রথম নিষ্কম্প প্রদীপশিখার ন্যায় একাগ্র করে তবে ধ্যানলোকে প্রবেশ করবে। স্বয়ং পতঞ্জলিও বলেন, ধ্যানের বিষয়বস্তু অবান্তর। তা সে যাক্। আসল কথা সে বয়সে পাঁচকড়ি আপনাকে এমনি একাগ্ৰমনা করে দিয়েছিলেন যে, আপনি তখন দেশকালপাত্র ভুলে গিয়েছিলেন। এবং এটা যে আর্টের অন্যতম লক্ষণ সেটি সর্বজনবিদিত। তা হলে আজ আপনি পাঁচকড়ির নামে নাক সেঁটকান কেন? পাঁচকড়ি পড়ার পূর্বে সাত বছর বয়েসে আপনি রূপকথা পড়েছিলেন, আজ পড়েন না, কিন্তু তাই বলে তো আপনি ওর পানে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হাসেন না, কেন?

টলস্টয় বলেন, যে বই সর্বযুগে সর্ববয়সের লোক পড়ে আনন্দ পায় সেই বই-ই উত্তম বই। সেরকম বই ইহসংসারে অতিশয় বিরল। টলস্টয় মহাভারতের নাম করেছেন। আমরা সম্পূর্ণ একমত। (তিনি তাঁর নিজের বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস যুদ্ধ ও শান্তির নিন্দা করেছেন। আমরা একমত নই)।

অতি অল্প লেখককেই টলস্টয় আর্টিস্ট বা সৃষ্টিকর্তারূপে স্বীকার করেছেন। চেখফ তাদেরই একজন* [*টলস্টয় চেখকে এত গভীরভাবে ভালোবাসতেন যে, একদিন টলস্টয়ের বাড়ি ইয়াসানা পলিয়ানাতে যখন তিনি আর গোর্কি বসে গল্প করছেন তখন চেখ বাগানের অন্য প্রান্ত দিয়ে চলে যাচ্ছেন দেখে টলস্টয় গোর্কিকে বলেন, জানো গোর্কি, চেখফ যদি মেয়েছেলে হত তবে আমি ওকে বিয়ে না করে থাকতে পারতুম না। যারা বর্তমান লেখকের অত্যধিক বাগাড়ম্বর অপছন্দ করেন, তারা বাকি প্রবন্ধ না পড়ে সোজা চেখফের দুলালী গল্পের অনুবাদে চলে যাবেন।] তাকে তিনি বলেছেন, রিয়েল আর্টিস্ট;- পাঠক সেটি পরে সবিস্তর শুনতে পাবেন।

চেখফের দিকে তাকিয়ে আমার বিস্ময়ের অন্ত নেই।

প্রথম ছবি দেখি, রুশের এক গগ্রামে ঘরের ছেলে চেখফ গাঁয়ের পাঁচজন মাতব্বরের চালচলন কথাবার্তার ভঙ্গির অনুকরণ করে বাড়ির পাঁচজনকে হাসাচ্ছে। আবার সঙ্গে সঙ্গে সে ক্লাসের সর্দার পড়ুয়াও বটে।

তার পরের ছবি দেখি মস্কোতে। গরিব পরিবারে। একটা ছোট্ট ঘরে মা কচুঘেঁচু রাধছেন, বাবা অর্থাভাবের কথা চিন্তা করে আপন মনে গজগজ করছেন, ভাইবোনেরা কিচিরমিচির করছে, আর মেডিকেল কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র চেখ– বয়স উনিশ– তারই এককোণে, হট্টগোল সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, খস্ খস্ করে পাতার পর পাতা ফার্স লিখে যাচ্ছেন। তিনি জানেন, খুব ভালো করেই জানেন, রসিকতাগুলো কাঁচা, কিন্তু তার চেয়েও ভালো করেই জানেন, খবরের কাগজের গ্রাহক রামাশামা এ ধরনের রসিকতাই পছন্দ করে, সম্পাদকমশাইও সেই মালই চান। লেখা শেষ হল। রান্না তখনও শেষ হয়নি। চেখক ছোট ভাইকে বললেন, লেখাটা নিয়ে যা তো অমুক পত্রিকার আপিসে। দু-পাঁচ টাকা যদি দেয় তবে কিন্তু কাবাব-টাবাব কিনে আনিস। কচুঘেঁচু গেলার সুবিধে হবে।

এর পাঁচ বছর পর চেখফ মেডিকেল কলেজ পাস করলেন।

কিন্তু ভালো করে প্র্যাকটিস করা চেখফের আর হয়ে উঠল না। ইতিমধ্যে রুশদেশ জেনে গিয়েছে, চেখফের সার্জিকাল ছুরির চেয়ে তার কলমের ধার বেশি। তবু সরকার তাঁকে পাঠালেন সাখেলিন দ্বীপের কয়েদিদের সম্বন্ধে মেডিকেল তদন্ত করতে। সে রিপোর্ট তিনি এমনই বুক-ফাটানো জোরালো ভাষায় লিখেছিলেন যে, তারই ফলে সরকার কয়েদিদের জন্য বহু সুব্যবস্থা অবলম্বন করলেন। এ রিপোর্টখানা আমি কিছুতেই সংগ্রহ করে উঠতে পারিনি। আমার বড় বাসনা ছিল দেখবার, সাহিত্যিক যখন মেডিকেল রিপোর্ট লেখে তখন তার কলমফ কীভাবে চালায়? সংযত করে? যাতে করে লোকে না ভাবে সাহিত্যিক তার হৃদয়-উচ্ছ্বাস দিয়ে তথ্যের দীনতা ঢাকতে চেয়েছে– কেসে পয়েন্ট না থাকলে উকিল যে-রকম গরম লেকচার ঝাড়ে আর টেবিল থাবড়ায়। কিংবা তার জোরদার কলমফ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন হয়ে? কিংবা উভয়ের অভূতপূর্ব সংমিশ্রণে? রবীন্দ্রনাথ যখন সভ্যতার সংকট লিখেছিলেন তখন তার লেখনে কতখানি রাষ্ট্রদর্শন আর কতখানি কবির তীব্র হৃদয়-বেদনার পরিপূর্ণ প্রকাশ!

তার পর একবার লেগে যায় রুশ দেশে জোর কলেরা। সেই এক বছর চেখফ ডাক্তারি করেন প্রাণপণ। ব্যস।

খাস পশ্চিমের লোক বয়েস হওয়ার পর বিয়ে-শাদি করে কস্মিনকালেও বাপ-মায়ের সঙ্গে বসবাস করে না। ভিন্ন সংসার পাতে। রুশদেশ বোধহয় কিছুটা প্রাচ্যের আমেজ ধরে।

কিছুটা প্রতিষ্ঠা লাভ করার সঙ্গে সঙ্গেই চেখফ গ্রামাঞ্চলে কিঞ্চিৎ জমিজমা ও ছোট্ট একটি বসতবাড়ি কিনলেন। বাপ-মায়ের সঙ্গে সেখানে ছ-টি বছর চেখফ বড় আনন্দে কাটালেন। চেখফের সমগোত্রীয় আরেকজন অতিশয় দরদী লেখক, আলফঁস দোদেও ঠিক ওইরকমই মোটামুটি ওই সময়েই অসুরের মতো খেটে পয়সা রোজগার করে গরিব বাপ-মাকে গ্রাম থেকে এনে প্যারিসে আরামে রেখেছিলেন। জীবনের এই ছ-টি বছর চেখফের বড় শান্তি আর আনন্দের মধ্যে কাটে। এর পরই দেখা দিল তার শরীরে ক্ষয়রোগের চিহ্ন এবং বাকি জীবনের অধিকাংশ তাঁকে কাটাতে হয় ক্রিমিয়ার স্বাস্থ্যনিবাসে, সমুদ্রপারে। চেখফের বয়স তখন একচল্লিশ। তার ক্ষয়রোগের কথা জেনেশুনেও তারই নাট্যের অসাধারণ সুন্দরী এক অভিনেত্রী তাকে বিয়ে করেন। তিন বছর পর খ্যাতির মধ্যগগনে চেখ-ভাস্কর অস্ত গেল। দাম্পত্য জীবনে সুখ বলতে তার স্ত্রী পেয়েছিলেন স্বামীকে সেবা করার আনন্দ। অভিনেত্রীদের চরিত্র সম্বন্ধে নানা লোকে নানা কথা কয়। তাই বলে নেওয়া ভালো, চেখফের স্ত্রী বিধবা হওয়ার পর বাকি জীবন নির্জনে অতিবাহিত করেন। মডার্ন গল্প-উপন্যাসের পাঠক-পাঠিকারা বোধহয় তাজ্জব মানবেন। চেখফের বিধবা তখন যুবতী। রুশে বিধবাবিবাহ নিন্দনীয় তো নয়ই, যুবতী বিধবা পুনরায় বিয়ে না করলে তাকে আহাম্মুখ আখ্যা দেওয়া হয়। মা হওয়ার গৌরব থেকে তিনি নিজেকে বঞ্চিত করলেন। তিনি ত্যাগ ও প্রেমের নিষ্ঠায় বিশ্বাস করতেন। এ কথাটা বলতে হল চেখফ-চরিত্র বোঝাবার জন্য। তিনি নিশ্চয়ই এমনই গভীর প্রেম দিয়ে তার স্ত্রীর জীবন উদ্দীপ্ত করে দিয়েছিলেন যে, সেই দীপ্ত দীক্ষায় প্রজ্বলিত তাঁর প্রেম-প্রদীপ চেখফের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নির্বাপিত হল না। তারই অনির্বাণ বহ্নিতে তার ভবিষ্যতের পথ আলোকিত হয়ে রইল।

চেখফের জীবন সংক্ষিপ্ত ও আদৌ ঘটনাবহুল নহে। যে কটি ছবি আমাদের চোখের সামনে আসে সেগুলোই মধুর। শুধু শেষের চিত্রটি বড় করুণ। রঙ্গমঞ্চ থেকে চিরতরে বিদায় নিয়ে আজীবন বিলাসে লালিতা এই যে অসাধারণ গুণবতী রমণী তাঁর স্বামীর প্রাণরক্ষার জন্য কন্টিনেন্টের খ্যাতনামা স্বাস্থ্যনিবাস থেকে স্বাস্থ্যনিবাস, এক ধন্বন্তরী থেকে অন্য ধন্বন্তরীর পদপ্রান্তে পাগলিনীর মতো ছুটোছুটি করলেন, আপন হৃদয়াবেগ শান্ত মুখের আড়ালে লুকিয়ে রেখে, কত না বিন্দ্ৰি যামিনী স্বামীর শয্যাপাশে কাটালেন, অসীম ধৈর্যে মিশ্রিত অক্ষয় সেবায় ক্ষয়রোগীর প্রতিটি পীড়িত মুহূর্তের যন্ত্রণাভার লাঘব করলেন– এ ছবিটি একাধিক রুশ লেখক এঁকেছেন।

টলস্টয়ের বৃদ্ধ বয়সে চেখফের তিরোধান তার বুকে বড় বেজেছিল– চেখফকে তিনি কতখানি স্নেহ করতেন সে-কথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। গোর্কি তখন লেখেন চেখফ সম্বন্ধে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ। ইয়াসানা পলিয়ানাতে এই ত্রিমূর্তির আলাপ-আলোচনা, হৃদ্যতার আদান-প্রদান সম্বন্ধে অত্যন্ত মনোরম একাধিক প্রবন্ধ রুশ ভাষায় বেরিয়েছে। চেখ স্বয়ং তার নোটবুকে কিছু কিছু লিখে গিয়েছেন। টলস্টয়ের প্রতি তার শ্রদ্ধা ছিল অকৃত্রিম। অবশ্য সে শ্রদ্ধা তাকে মোহাচ্ছন্ন করতে পারেনি। মাত্র অল্প কিছুদিনের জন্য তিনি টলস্টয়ের নীতিমূলক (স্টোরি উইথ এ মরাল) গল্পের অনুকরণ করেছিলেন। কিন্তু রিয়েল আর্টিস্ট (টলস্টয়ের ভাষায়) তো বেশিদিন অন্যের পথে চলতে পারে না- তা সে-পথ যতই শান-বাঁধানো প্রশস্ত হোক না কেন।

গোর্কি তাঁর নাট্যরচনায় চেখফের অনুকরণ করেছেন। এস্থলে পাঠক-পাঠিকার স্মরণার্থে উল্লেখ করি–

টলস্টয় : জন্ম ১৮২৮ মৃত্যু ১৯১০
চেখফ :  ১৮৬০  ১৯০৪
গোর্কি :  ১৮৬৮  ১৯৩৬

চেখফ আমাকে এমনই মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছেন যে, তাঁর সম্বন্ধে আমি এক যুগ ধরে লিখে যেতে পারি। তাঁর প্রতিটি গল্পের টীকা লিখতে লিখতেই আমার বাকি জীবন কেটে যাবে। অথচ এই প্রবন্ধ শেষ করতে হবে, এবং কী উদ্দেশ্য নিয়ে এটি লিখছি সেটি ভুললেও চলবে না।

পূর্বেই বলেছি, বঙ্গসাহিত্যে আমি যশস্বী লেখক নই, কিন্তু পপুলার বটি। সেই কারণেই বোধহয়, আমি কিছু অনুরোধ পেয়েছি, পত্র-লেখকদের জানাতে, কোন কোন্ লেখক পড়লে তারা লাভবান হবেন। বিদায় নেবার প্রাক্কালে নিবেদন, ছোটগল্প দিয়েই সাহিত্যিক জীবন আরম্ভ করা প্রশস্ত এবং সম্মুখে চেখফের ফটোগ্রাফ টাঙিয়ে নিয়ে। এমনকি যারা পরবর্তীকালে উপন্যাস লিখবেন তারাও চেখফ চেখে, শুঁকে, সর্বাঙ্গে মেখে উপকৃত হবেন। এ প্রবন্ধটি তাদেরই উদ্দেশে লেখা।

কিন্তু সাবধান করে দিচ্ছি, রুশ সাহিত্যে চেখফের অনুকরণ করেছেন অনেকেই, কিন্তু টলস্টয়-ঘরানা, ডস্টয়েফস্কি-ঘরানার মতো চেখফ-ঘরানা কখনও নির্মিত হয়নি। তার কারণ চেখফকে অনুকরণ করা অসম্ভব।

তবে সে উপদেশ দিচ্ছি কেন?

কারণ অসম্ভবের চেষ্টা করলেই সম্ভবটা হাতে আসে, সম্ভব হয়।

***

চেখফের আছে কী?

অদ্ভুত সহানুভূতি। সমবেদনা। সহানুভূতি সমবেদনা বললে কমই বলা হয়। মপাসাঁর বুল দ্য সুইফ (চর্বির গোলা, এ বল অব্‌ ফ্যাট) যখন ঘোড়াগাড়িতে ফিরে অঝোরে কাঁদছে তখন মপাসাঁও সঙ্গে সঙ্গে কাঁদছেন কিন্তু চেখক যখন তাঁর কোচম্যানের দুঃখের কাহিনী বলেন তখন মনে হয় তিনি স্বয়ংই যেন সেই কোচম্যান।

গল্পটির প্লট এতই সরল যে কয়েক ছত্রে বলা যায়। এক ছ্যাকড়াগাড়ির কোচম্যান শহরে গাড়ি খাটায়, একমাত্র ছেলে থাকে গ্রামে। হঠাৎ খবর পেল তার সে জোয়ান ছেলে মারা গিয়েছে। বুড়োর তিন কুলে কেউ নেই যাকে সে তার দুঃখের কাহিনী বলে। পেটের ধান্দায় বেরোতে হয়েছে গাড়ি নিয়ে। উঠেছে এক সোয়ারি। বুড়ো কোচম্যান আস্তে আস্তে আলাপচারী জমিয়ে যখন তার পুত্রশোকের কাহিনী বলতে যাবে, তখন ঘাড় ফিরিয়ে দেখে সোয়ারি ঘুমিয়ে পড়েছে। থামতে হল। তার পর উঠলেন এক জেনারেল। জলদি চল, জলদি চল আর ধমকের চোটে সে তার কাহিনী আরম্ভ করেও শেষ করতে পারল না। তার পর উঠল জনাতিনেক ছাত্র। তাদের হৈ-হল্লার মাঝখানে বুড়ো কোনও পাত্তাই পেল না। তার পর উঠলেন আর এক ভদ্রলোক ভারি দরদী। তাকে যখন দুঃখের কাহিনী বলতে বলতে পুত্রের মৃত্যুসংবাদটা দেবে ঠিক তখনই তিনি বলে উঠলেন, থ্যাঙ্ক গড়। ওই আমার বাড়ি পৌঁছে গিয়েছি। বলা হল না। রাত তখন ঘনিয়ে এসেছে। বুড়ো বাড়ি ফিরল। ঘোড়াটাকে দানা দিয়ে ডলাই-মলাই করতে করতে আপন মনে বিড়বিড় করতে লাগল, তোকে কি আর আমি ভালো করে ডলাই-মলাই করতে পারি, বাছা। বুড়ো হাড়ে আর কি আমার তাগত আছে? থাকত আমার ছেলে! তাকে তো তুই চিনিসনে। হ্যাঁ, তার ছিল গায়ে জোর। হ্যাঁ, সত্যি বলছি। সে যদি থাকত আজ, তবে বুঝিয়ে দিত ডলাই-মলাই কারে কয়। ঘোড়াটা আপন খেয়ালে গরুগরু করে নাক দিয়ে শব্দ ছাড়ল। কেমন যেন দরদভরা– অন্তত বুড়োর তাই মনে হল।

তখন– তখন বুড়ো ঘোড়াটাকে তার শোকের কাহিনী বলে দিল।৮ [*গল্পটির প্লট আমার ঠিক ঠিক মনে নেই, তবে হরেদরে এই।]

যতবার গল্পটি পড়ি চোখে জল ভরে আসে– এখন আরও বেশি, কারণ আমার বয়স ওই কোচম্যানেরই কাছাকাছি… আর মনে হয়, কে বলে চেখফ ডাক্তার ছিলেন, কে বলে তিনি রূপসী অভিনেত্রী বিয়ে করেছিলেন, কে বলে তিনি টলস্টয়ের বন্ধু? তিনি নিশ্চয় ছিলেন। ওই কোচম্যান।

অনুকরণ করুন এই গল্পটির। কিংবা আরম্ভ করুন অন্যভাবে।

যেমন মনে করুন আপনার প্রিয়া সর্বাংশে আপনার চেয়ে গুণবান একটি লিভার পেয়ে ড্যাং ড্যাং করে চলে গেলেন তার সঙ্গে। আপনি ঘন ঘন উদ্ভ্রান্ত প্রেমে পড়ে হৃদয়বেদনায় মালিশ করছেন, কিন্তু কোনও ফায়দা ওত্রাচ্ছে না। হঠাৎ মনে পড়ল আপনার এক্স-বান্ধবীর এক বান্ধবী আছেন এবং তার সঙ্গে পরিচিত আরেক ভদ্রলোকও আপনার বন্ধু। আপনি ভাবলেন, তাঁদের কাছে গিয়ে আমার দুঃখের কাহিনী কই। দুজনেই বড় দরদী। দুজনাই আপনার আপসাআপসি সাতিশয় মনোযোগ সহকারে শুনলেন। কিন্তু হায়, শেষটায় দেখলেন, ওদের দুজনারই পাকা রায়, আপনাকে কলার খোসাটির মতো রাস্তায় ফেলে দিয়ে আপনার প্রিয়া অতিশয় বিচক্ষণার কর্ম করেছেন।

এটা আপনি ব্যঙ্গ করে লিখতে পারেন, হাস্যরসে ভর্তি করে লিখতে পারেন, দু-ঘটি চোখের জল ফেলে করুণ রসে ঢেলে বানিয়ে লিখতে পারেন, যৌনবিজ্ঞানের বিশ্লেষণ দিয়েও লিখতে পারেন কিন্তু আপনি চেখ হবেন তখনই যখন পাঠক পড়ে মনে করবে এটি একান্ত আপনারই অভিজ্ঞতা। অথচ আপনার এই নিদারুণ অভিজ্ঞতা আদপেই হয়নি, আমার কাছে প্লটটি শুনে, এবং চেখফের কোচম্যানের গল্পটি পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছেন মাত্র।

এবারে টেকনিকাল দিক।

এখানে এসে সর্ব আলঙ্কারিকের ওয়াটারলু।

রস কী, এস্থলে কথাসাহিত্যে কী সে বস্তু যা আমার মনে কলারসের সঞ্চার করে– সেখানে যদি-বা কোনও গতিকে সংজ্ঞাবদ্ধ বর্ণনা করা যায়, তবু করা যায় না রস কোন উপাদানে, কোন প্রক্রিয়ায়!

কাজেই আমি সামান্য দুটি নির্দেশ দেব।

প্রথম বাকসংযম। সে বলে বিস্তর মিছা যে বলে বিস্তর–বলেছেন ভারতচন্দ্র। এ-স্থলে সে রচে নীরস রস যে বলে বিস্তর।

এখানে চীনা চিত্রকরদের কথা স্মরণে আনবেন। পাঁচটি আঁচড়ে আঁকা বাঁশের মগডালে একটি পাতা– আপনি স্পষ্ট শুনতে পেলেন পাতাটি ফর ফর করছে। তিনটি আঁচড়ে আঁকা একটি উড়ন্ত হাঁস। আপনি দেখতে পেলেন যেন নীলাকাশে শরতের সাদা মেঘ ভালো করে তাকানোই যায় না, চোখ ঝলসে দেয়।

তার অর্থ উড়ন্ত হাঁস আঁকার সময় চিত্রকর সম্পূর্ণ হাঁস আঁকেন না। ঠিক কোন কোন জায়গায় বিন্দু ও বক্ররেখা (পইন্ট কার্ভ) দিলে পাঠকের মন নিজেই বাকিটা এঁকে নেবে, পাঠকের চোখ নিজেই বাকিটা দেখে নেবে ঠিক সেই সেই জায়গায় চিত্রকর তুলি ছুঁইয়েছেন।

চেখফও ঠিক তাই করতেন। কয়েকটি পইন্ট ও কার্ভ- শব্দের মারফতে– এমনই ভাবে এঁকে দিয়েছেন যে সম্পূর্ণ ছবিটি চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে থাকে। শুধু তাই নয়, এমনই সূক্ষ্ম দানালা ফিলমে তোলা ফটোগ্রাফ যে, যার যেমন কল্পনার লেন্স্ সে তেমনি বিরাট আকারে সেটিকে এনলার্জ করতে পারে। কোচম্যান চেষ্টা করেছিল তিন না চার টাইপের সোয়ারির কাছে তার হৃদয়বেদনা প্রকাশ করার; আপনি দেখতে পাবেন সে তাবৎ মস্কো শহরের লক্ষ লক্ষ নরনারীর হৃদয়দুয়ারে শির হেনে হেনে হতাশ হচ্ছে। আর সেই দরদী ঘোড়ার গার শব্দ যে শুধু শুনতে পাবেন তাই নয়, শুনতে পাবেন সে যেন বহু আবেগ থেকেই কোচম্যানকে বলছে, কেন তুমি আজেবাজে লোকের কাছে এসব দুঃখের কথা বলতে যাও? কে বুঝবে তোমার হৃদয়-বেদনা? সবাই আপন স্বার্থ নিয়ে মগ্ন। বল আমাকে। হাল্কা হবে। তার পর হয়তো আপন মনে বলছে, জানি তো সবই। কিন্তু হায় করি কী? এ যে ভগবানের মার।

গুণীরা বলেন সর্বনিম্নে জড়জগৎ, তার পর তৃণজগৎ, তার পর পশুজগৎ– সর্বোচ্চে মানুষ। চেখফের গল্পটি পড়ার পর মত পালটাতে হয়।

এস্থলেই ক্ষান্ত হোক আমার অক্ষম লেখনীর ক্ষীণ প্রচেষ্টা।

এইবার পড়ুন চেখফের একটি গল্পের বাঙলা অনুবাদ। অনুবাদটি করেছেন আমারই অনুরোধে, আমার সখা মৌলানা খাফী খান। যদৃষ্টং এবং প্রিয়াঙ্গীর লেখক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *