কবিতা ৭৮-৮০
৫৬ পাতার বইটি ছাপা হয়েছিল কৃষ্ণনগরের চার্চ থেকে। বইটির কবিতাগুলো লেখা হয়েছিল ৭৮ থেকে ৮০ সালের মধ্যে, তাই তার এ রকম নাম। যদিও তাঁর প্রথম কবিতার বই, কিন্তু আগের চার বছর যেসব কবিতা তিনি লিখেছিলেন, সেগুলো নিয়ে তাঁর আসল প্রথম বইটি ছাপা হতে পারত, কিন্তু সেসব কবিতা হারিয়ে গেছে।
বইটির শেষে, ব্যাক কভারে একটি ভূমিকা আছে যেটিকে ব্লার্ব হিসেবে রাখা হয়েছে। সেটি এখানে তুলে দেওয়া যাক:
‘অমনোযোগী হয়ে উঠতে উঠতে আমি দেখি কাশবন, একটি বিলুপ্ত মুরগি, তার গায়ে আলো এসে পড়েছে। আমি দেখি— যেখানে বিকেল, আর আমার বন্ধুর বউ বেড়াতে এসেছেন, আমি আমার জগৎ থেকে ঢিল ছুঁড়ি, এরপর কেবল দিগন্ত, বিলোনিয়া, পেট্রল, বর্ডার, বোমবিঙ-এর পর তিনটে পাপিয়া।
বইটির দ্বিতীয় অর্ধেকে একটি পায়রা উড়ে যেতে যেতে যেখানে থামতে চাইছে— সেটি গতজন্ম। একটি শিশু তার বল পাউডারের কৌটো কোনোটিই মূর্ত নয়, ফিরে আসি একেবারে ৭৮-এ, যেখানে আমার সাথে বারবার দেখা হয়ে যাচ্ছে একটি মেয়ের। এ সবই আমার অনুসন্ধান, সংকট এবং গন্তব্য।’
প্রকাশক ওয়েসিস, কৃষ্ণনগর। এই একটি মাত্র বই প্রকাশ করে ওয়েসিস উঠে যায়। আসলে বইটি ছাপা হয়েছিল গয়না বিক্রি করে, গোপনে গয়নাটি এসেছিল এক মহিয়সী মায়ের কাছ থেকে। উৎসর্গ করা হয় কবি রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরীকে।
.
বিলুপ্ত মুরগি
বিলুপ্ত মুরগি
ভাঙা টেম্পু করে এসে পড়েছি অনন্তে
সাথে দিদিরাও ছিল
কয়েক কিলোমিটার ধবধবে কাশবন
আর ইঞ্জিনের শব্দ— এরকম ঝামেলায় আর
কখনও পড়িনি।
আলো নেই
পাখি ডাকছে না, শুনে দিক ঠিক করে নেব
ফিসফিস করে যারা কথা বলে, তারা
ছোট ছোট পরি, নীল বেলুন ফাটিয়ে
বেড়িয়ে পড়েছে
এদের কখনও যদি একটাকে ধরতে পারি, বাড়ি নিয়ে যাব
তাকানো মাত্রই লুপ্ত হয়ে যায়, হয়তো এমন
ওপরের থেকে নির্দেশ রয়েছে।
দেখি একটি মুরগি— আকাশি-খয়েরি
হেঁটে যায়, আর
তার গায়ে আলো এসে পড়ে
হেঁটে যায়, আলো লীলা করে পেছনে পেছনে।
এই সেই মুরগি, বাবা এনেছিল
হাতে করে ছোলা শাক বাদামের খোসা খাইয়েছি
ভাইবোন সব জড়ো হয়ে এক রবিবার কেটে খাব—
ঠিক ছিল
আমি থামাই ইঞ্জিন— নেমে ছুটে যাই
দড়ি ছিঁড়ে পালিয়েছ; আজ ধরবই
সে মুহূর্তে ওপরের থেকে আলো তুলে নেওয়া হয়
আমি বুঝে ফেলি
অনন্ত না ছাই
আমি, কাশবন আর বিলুপ্ত মুরগি।
এরকম ঝামেলায় আর কখনও পড়িনি
কিন্নরের দেশ
এইখানে স্বর্গ, আমি গাছ থেকে ডাল ভেঙে
পুঁতে দিই, আর একখানা ডাল মাঝখানে
বেঁধে দিয়ে বের করে আনি দু’দিকে দু’খানা
হাত, একটি মাটির ভাঁড় চুন দিয়ে এঁকে জুড়ে দিই মাথা
সবশেষে তাকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নিই:
এইখানে স্বর্গ: দূরে একটি ছাগলছানা ঘাস
খায়, আর তাকে কিন্নর পাহারা দেয়
আরও দূরে একটি গাছের ডালে বসে, পা ঝুলিয়ে।
নিরন্তর চম্পা: টুকি
একটি কালো সরষের দানা চাপে চাপে
ফেটে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ার আগে একটি নক্ষত্র হয়ে ফুটে ওঠে
দেখি: আমার কুকুর বাঘা
দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায় মল্লিক পাড়ায়
বিভাসে বিভাসে
ওই তো আমাদের বাড়ি, একটি ডালিয়া টব
ছাদে টুপ করে নেমে, মনে হয়, একখানা ফ্রক চুরি করে
উঠে আসি
লিলি কাঁদুক, কাঁদাতে চেয়েছি, পারিনি
আজ শোধ নিই,
পুরো বাড়িটাকে মানুষের মাথার মতন মনে হয়, আর
বাঘা পৌঁছে গিয়ে কেবল ডাকছে।
নিজের মাথার টুপি শূন্যে ছুড়ে দিই
গিয়ে বেঁধে থাক শালবনে
যে বনে গিয়েছি আমি একবার, ছিল একটি তরুণী
একাকার, চকিত বিড়াল।
দেখা যায়: একটি বাগান
তুলো যেন তুষারের হয়ে উড়ে যায়
অল্প আলো
আমার বন্ধুর বউ যেখানে বিকেল ভেবে বেড়াতে এসেছে
অনুপম ভেড়ার শাবক তার আগে আগে চলে
তাকে ধরে, তার পশম জড়িয়ে
আদর করতে যাবে যেই— শাবকটি
শূন্যে মিশে যেতে যেতে আমি প্রতিশোধ নিই:
‘চম্পা, টুকি!’
বাড়ি ফিরে এসে ঘর বন্ধ করে দ্রুত শাড়ি ছেড়ে নেয়
তার বাইরের
চুড়ির বাজনা ছাড়া অন্য সংকেত নেই
জড়ো, পরিত্যক্ত, ছাড়া শাড়ি থেকে বলে উঠি:
‘চম্পা, টুকি!’
নিরন্তর টেলিফোন থেকে মুক্তি তুমি কখনও পাবে না
টবে ধরে রাখা ডাল, তাতে কুঁড়ি
সে ফুটছে, সমস্ত কুসুম নিয়ে ফেটে
চারদিক সাদা করে ফুটে ওঠে, তার ভেতরের থেকে
উঁকি দেয় চুল, অল্প মাথা
বলে উঠি:
‘চম্পা, টুকি!’
এরপর গাছে গাছে জ্বেলে দিই বাল্ব, ছড়ানো প্রদীপ
আর মৌমাছি পাঠাচ্ছি যেন আমরাই
একদল কাক ঝুপ করে ব্যাঙ ধরে উঠে আসে ডালে
ঠুকরে ঠুকরে তাকে মারে আর মোহন আহার করে
আর আমরাই হইচই করে, টিন পিটে ছত্রখান করি কাক
সময় এমন
যেখানে বিকেল ভেবে আমার বন্ধুর বউ বেড়াতে এসেছে
আর আমি
আমার জগৎ থেকে ঢিল ছুড়ি।
স্বর্গ আর চড়ুই
যূথীদের চিলেকোঠা থেকে সবার অলক্ষ্যে
একটি চড়ুই ধরে এনে ছেড়ে দিই স্বর্গে
আরও দুটি আবার লুকিয়ে এনে ছাড়ি, বলি: হুস
স্বর্গ মাত করে উড়ে যাক কেবল চড়ুই।
আমি শ্যাম
মশারি টাঙিয়ে নিই দিগন্তের কাছে
সাড়ে আটটায় দেবুর মা এসে খুলে দেয়
বলে: ভোর হল।
এ বাড়ি, বুড়ো মা, বাড়ির বিড়াল
সব সত্যি বলে ধরে নেব?
তুমি কল্যাণীতে পড়ো সত্যি?
সত্যি মেয়েটিকে গাছের পেছনে গিয়ে রেখে এলে, তার যদি
ক্ষতি করে কেউ
চরিত্র বলে তো কথা আছে, যদি সে লজ্জায় জুঁই হয়ে ফুটে ওঠে ডালে
খুঁজে পাবে?
‘তাকাও মাঠের দিকে, গোরুগুলি চরিতেছে’
এও সত্যি! চাষিরা সময় হলে বাড়ি নিয়ে যাবে।
বাড়ি চাষিদের বাড়ি— নেই
সব ঘর আকাশে আটকানো
সকালে অনন্ত থেকে নেমে এসে মাঠে কাজ করে যায়।
সেই ধান, আজ প্লেটে করে খাচ্ছ, লজ্জা করছে না?
যদি সব কেড়ে নিই
বাড়ি তুলে এনে রেখে দিই বনে, বাড়ি কাগজের
মানুষ সমান উঁচু কাশের ভেতর নিয়ে গিয়ে
নিশ্বাস না নিতে দিই
যার সঙ্গে সহবাস করো, তাকে যদি বলি
দুপুর তিনটে, ব্যালকনি, চুল বেঁধো, আমি শ্যাম হয়ে পথ দিয়ে
তুমি অফিসে তখন
আমি আভাসেই বেশি ভাল থাকি।
হইচই করে বাচ্চা ছেলেমেয়ে ঢুকে পড়ে
এরা সকলেই ঝুমা
এরা সকলেই বাপী
থোকা থোকা চুল, মোম দিয়ে বানিয়েছি
হাতে করে মাঠে নিয়ে গিয়ে
শূন্যে তুলে রেখে দিই, যদি কোনওদিন দরকার পড়ে
এই শূন্য থেকে আবার ফিরিয়ে নেব
যদি বাড়ি করি
তখন জ্বালাস, ঘাড়ে উঠে চুল ছিঁড়ে নিস
যদি এ বাড়ি, বুড়ো মা, বাড়ির বিড়াল
সব সত্য বলে মেনে নিই।
একটি করবী পাখি
স্বর্গ শুরু। শূন্য থেকে একটি বিশাল
দড়ি ঝুলে আছে, তাতে বাঁধা হাইপাওয়ারের
বাল্ব, সেটা এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে
দুলে যায়, আর চমকায় গাছপালা, খেত
কাননের শাড়ি, আমি সে মুহূর্তে
চলে আসি আরও ভেতরের দিকে
কুঁড়েঘর, চালে লাউ তাতে আলো পিছলিয়ে
চলে যায়, আর উঠোনে তখন
চরাচর, তাতে এ রাত্তিরে
কিছু হংস চড়ছে, আর তাদের পেছনে
তুমি— একটি করবী পাখি, এইখানে নারীরূপে
পরিচিত, থালা থেকে গম ছিটিয়ে চলেছ।
কার্বন
ডিম ফেটে গিয়ে ছিটকোচ্ছে মহাজগতের মধ্যে, অপূর্ব বিকেল
আমি চাই আরও বর্ণ চাই
হয়তো অবাক করে অল্প দিয়ে খুশি রাখো
লোনে বাড়ি করে দাও বনশ্রীর নামে
যদি কোনও দিন কাজে আসি, কোনও পরিবারের প্রধান হয়ে
যদি নিজের দেশকে ভাল লেগে যায়
যদি নিজের পয়সা দিয়ে সমস্ত প্রকৃতি— ধুবুলিয়া ঘুরে আসি।
দেহ নিয়ে এত চিন্তা এর আগে কখনও করিনি
কেবল কার্বন বলে মনে হত, যাকে বারবার ধুয়ে
পরিষ্কার করি, জামা খুলে
লুকিয়ে বিরলে দেখি ক্লেদ, অক্সিজেন
পাম্প করে নিচ্ছে আর ছেড়ে দিচ্ছে।
তেল দরকার
রোদ দরকার
রোদ পোহাবার ব্যালকনি, মালতীকনকে ঘেরা, সামনের মাসে
দুই সেট সোফা
এত যদি দাও
প্রভু, কলেজে প্রথম যাকে ভালবেসে ফেলি ছ’বছর আগে
তাকে নীচে রাস্তা দিয়ে একবার নিয়ে গেলে ভাল করতে না?
হে ঈশ্বর হে ঈশ্বর
বাইরে বেরিয়ে দেখি রোদ এসে পড়েছে পুকুরে
মনে হয় রোদ জল থেকে তুলে প্লেটে করে রেখে দিই
‘হাঁসগুলি ডাকিতেছে, আমারে হেরিয়ে’— ঋষি বলেছেন
এখানে দেহের প্রশ্ন আসতেই পারে না,
আমি বললাম: চোখ, সেই ফুচি, নিরন্তর জুজু
ওটিকে অগ্রাহ্য করা এতই সহজ? লজ্জা করবে না?
কার্নিসের ফুটো দিয়ে উঁকি মেরে
ঘরে কিশোরীরা বড় হয়
শুধু তাই নয়, যা দেখা যায় না
যেমন দিগন্ত
যার কোনও মানে নেই— বিলোনিয়া, পেট্রল, বর্ডার, বোমবিংয়ের পর
তিনটে পাপিয়া
এরপর সবটাই ধ্বনি, বাড়ির পেছনে
ছোটবেলা থেকে ছাদে উঠে শুনতাম
যদি নাই চিনি ঝোপ, ছেঁড়া ফ্রক পোকা ও বোতাম
তুমিও চেনো না: এই সব নিয়েই মর্মর
পাতা কাঁপলেই হল? তাকেই হিল্লোল বলে ছেড়ে দেবে?
পরীক্ষা না করে?
এই দেহ— যদি পুরোটা মর্মর বলে ধরে দিই
সখী ক্ষমিবে না?
মেধা?
মেধা আবদার করে? তার চেয়ে মেয়েটির উনিশ বছর
যার সব অন্তর্বেগ
স্ট্রাপে ও তরঙ্গে আটকানো
নেমে গিয়ে পান করো সোডাওয়াটার
বাইরে তখন পিঠে বেনি আছড়াক, কত আছড়াবে?
শোনো, মর্মর এখনও আমাদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয়?
ধরে দেখবার রীতি নেই
যে দিনটি এইমাত্র শেষ হয়ে গেল কল্যাণীতে
তার কি তুলনা আছে?
ক’টা মেয়ে দেয়
ঠোঁট ধরে দেখবার উৎসাহ
যদি তীব্র হও
অসীম স্টেশনে আজ সবার সামনে দুই হাত দিয়ে ধরে বলো:
‘হাসো, প্রাণ খুলে হাসো অবাধ আমৃত্যু।’
দেহ নিয়ে এত চিন্তা এর আগে কখনও করিনি
বাড়ি চাই
আর রেডিয়োর মতো ছোট ফ্ল্যাট নিয়ে উঠে গেলে
সহ্য করো তরঙ্গ ঝামেলা
বিছানায়
উলটো করে খুলে দেখে উঠে আসো
তারপর ভয়ে ভয়ে দেখো শাড়ি, জড়ো করা উনিশ বছর
কত ভাঁজ, টুকিটাকি পুঁথি
দেবি, ততক্ষণে
আমি ঘুরে আসি
এসে দেখি প্রান্তরে বসানো টব
বাটির মতন ফুল, সেটা উপচিয়ে, তার থেকে উঠে
শাড়ি ঠিক করে নিতে নিতে রিনি নেমে আসে
কি মৌ গায়ে রেণু আর জামা
‘তুমি ঈশ্বরের মেয়ে, আজ কলেজ যেও না’
মাথার ওপর দিয়ে একটি অমল ফিঙে ডেকে উড়ে যায়
লক্ষ করো রিনি, শুধু আমরাই নই, সেও
জগৎকে প্রকাশ করার চেষ্টা করে গেল।
দৈব
মাঠ,
আর একখানা তারা
মাঠ নয়, আমি
সাদা বেডসিটের ওপর দুটি পোকা
সংগম করছে।
আমার এলিজি
ব্যালকনি থেকে ঝাঁপ দিয়ে নেমে পড়লাম তুলো আর ইথারের দেশে
ভাল মনে নেই
শেষ কবে আমি এখানে এসেছি, চেরিফুল ছিল
রাশি রাশি, আজ
তারা প্রিন্ট হয়ে বাচ্চা ছেলেদের গায়ে উঠে গেছে।
দৃশ্য খুব কম, খানিকটা মাঠ
টেনিসের কোর্ট ছিল, ধারে ধারে টব, রেলিং গ্যালারি
সব উঠে গেছে স্টেডিয়ামে
আজ নেট ছিঁড়ে বেঁধে আছে গাছে
তাকে ধরে রোদ পেঁচিয়ে উঠছে ডালে, আর
একটা পায়রা, সংরক্ত
গোল করে ঘিরে আরও তিনটে পায়রা
হেঁটে যায়, বন্ধ করুন ঈশ্বর
আপনি এ দুপুর আমাদের চিলেকোঠা থেকে নিয়েছেন।
বাতাস দরজা খুলে দিল, ভয়ে ভয়ে ঢুকে দেখি ছেঁড়া চেন
বাটি উলটো করা— ভোলা পালিয়েছে
বারান্দায় সাদা কাপড় টাঙানো
এরকম মেঘ বিধবা মায়ের জন্য
কে রেখে গেছেন, বলা মুশকিল, অল্প উড়ছেও
ছোট বোন কলেজে কি?
সে তো এক ছোকরার সাথে বিহারের দিকে চলে গেছে
বনে বনে ঘুরে ক্লাস নিত
তার কথা কেন?
সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে দেখি কুয়োতলা, মনে পড়ে গেল
কুয়োর ওপরে ছোট নীল রঙের একটা বাল্ব জ্বেলে দিতাম আমরা
সেটা কই? যে পাখিটি আসত
সে কি খুলে মুখে করে নিয়ে গেছে ডিম ভেবে
কুয়োতলা!
এর পারে বসে আজও আমাকে কেউ জামা কেচে দেয়
আর ফিসফিস করে দড়ি বালতি
ছেড়ে দেয় কুয়োর ভেতর।
শেষ কবে আমি এখানে এসেছি, মনে নেই
জড়ো করে রোদে দিত বিছানা বালিশ
বাড়ির এসব কাজ মিনুদের ছিল, ওরা এখন অন্যের
ঘাস উঠে ঢেকে দিচ্ছে সেই শয্যা
কোত্থেকে একটি মাছরাঙা
উড়ে এল, শোনো
এইদিকে বিল নেই, বাড়ি
তুমি ভাতজাংলার লেকে উড়ে যাও—
প্রচুর কচুরি পাবে, মেঘলা দিনও আছে, রাত্রে জ্যোৎস্নায়
মাছ ধরে গাছে বসে খাও।
রেডিয়ো ছিল না?
মঞ্জরির থোকা, ছিল
একদিন আমি আর বোন, বাজছে না দেখে
ফেলে এসেছি জঙ্গলে
এক যুগ পরে, আজ, মাঝেমধ্যে বাজে, ওই বনে, একসঙ্গে
তিন-চারটে সেন্টার, বেতার কি হিরন্ময়, কি মৌচাক
সারাক্ষণ ওইখানে তিনটে শালিক উড়ছে
ভাত খেতে এল লেবুতলায়, যেখানে
বাসন নামিয়ে দেবুর মা গেছে ছাই আনতে, আমি বলি:
‘মাত্র ক’খানা বাসন, নিজেরাই মাজলে পারো?’
যদি উনি থাকতেন, মিনু তুই ছাদে উঠে
চুল আঁচড়াবার সাহস পেতিস?
মেজো ভাইটার কথা মনে নেই?
মুরগি চালান দিত হাটে, যেদিন সে তোমাদের ছেড়ে
চলে যায়, তার এক ঝুড়ি মুরগি ডালা ছিঁড়ে উড়ে বসল জঙ্গলে
জঙ্গল না, ঝোপ, যেটা একটা থালার মতো
সমস্ত মুরগি নিয়ে উড়ে গেল পৃথিবীর থেকে
মনে হল লাল তারামালা, কেবল ছুটছে, আর ডাকছে
আর তুমি নিজে
যাকে ভালবাসো, ভুলিয়ে অসীমে নিয়ে গিয়ে
তার শরীরের থেকে একটা একটা করে পাতলা কাগজ
খুলে আকাশে উড়িয়ে দাও
পরিবর্তে একটা মালতী দাও চুলে, আর মুখ দিয়ে
শব্দ করো: উঃ উঃ…
বাড়ি থেকে অল্প দূরে, এই কবিতায়, যে লনের কথা
বলতে পারিনি
দেখি সেখানে একটি অমল ছাগলছানা ঘাস খেতে এসে
আর যেতে চাইছে না
যাও ওগো রাই বাড়ি ফিরে যাও
এখানে দেবদূতেরা বসে বিশ্রাম করেন
তুমি জানছ না, তুমি বাড়ির সামনে এই লনটিকে কত
জনপ্রিয় করে রেখে গেলে?
স্বপ্নে এক মেয়ে আছে, সে আমার
তার ওড়না আমার
নূপুর আমার, যদি বাজে
গামছা সাবান এনে রেখে যাচ্ছে, ওই ডোবাটায়
দেবতারা স্নান করে যান
ডোবাটার চারপাশে ওরা গোল হয়ে বসে গা মোছেন
বাড়ি থেকে মনে হয়
দশখানা তারা আকাশের থেকে নেমে এসে কেবল নড়ছে।
কুকুরের রোগা বাচ্চা,
মহাজগতের থেকে ধরে এনে
যাকে আবার পুষছি
সে ককিয়ে ডেকে ওঠে একবার, ঝুমা
দৌড়ে ফিরে যায় স্বপ্নে।
মৃত্যুদিবস: বাবাকে
মাঠে গিয়ে দাঁড়ালাম সূর্যাস্তের আগে
মাঠে একটাই গাছ, পাখি নেই
গাছ থেকে বেরিয়ে এলেন এক ভদ্রলোক, ধুতি পরা
আমি বললাম: বেশ রোগা হয়েছেন, তখন ছিলাম
ক্লাস এইটের ছাত্র, অল্প মাইনার দিন আপনার
দিদিদের নিয়ে অশান্তি, ঝগড়া। এখন আমরা
বেশ আছি, সামনের মাসে বাড়ি দেখে উঠে যাচ্ছি
চলুন পারলে—মা-র সঙ্গে মজা করে আলাপ করিয়ে
দেব, চিনতেই পারবে না।
রোদ
প্রথমে নারকেলের গায়ে পড়ে, তারপর পাতায় ছিটকে
কয়েকটা বিভাগে আছড়ে পড়েছিল
আশ্চর্য আকারে, গাঢ়, প্রকৃতি তখন
গাছের তলায় একটি লোক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল
মাথায় উজ্জ্বল টাক— পড়ল সেখানে
চঞ্চল চৌচির হয়ে ফেটে গেল রশ্মিগুলো
যে অসংখ্য বর্ণ তখন ছড়িয়ে পড়ছে জগতে
তার থেকে একটি জলে গিয়ে, ভিজে
জলের তলায় নেমে গেল
আর সে কী সঞ্চার লাগাল মাছেরা, ঢেউ
তোলপাড়, গুল্ম আলোড়িত।
সময় কি লতা, রং, ছায়া, ফিসফিস সব জড়ো হয়ে তৈরি
হয় দিন।
এদের প্রত্যেকে
একে অন্যে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে আকর্ষণ করে
হুড়হুড় করে প্রবেশ করছে পৃথিবীতে
শুষে নিচ্ছে
বর্ণ ছায়া
ছায়া মর্মরকে
আর মর্মর, ফস্কে পালিয়ে যেতে গিয়ে জঙ্গলে আটকে যায়
একটা বিরাট ইস্পাতের প্লেট, চকচকে
ঠিক ইস্পাতের নয়, বিভূতির
এসে পড়ছে সেখানে সবশেষে, আর
আমি সেই লোভে ঘুম থেকে উঠে পড়ি
আর ভাবি— বাড়িটির পাশ দিয়ে, কুকুরের চেন ধরে
আমি চলে গিয়েছিলাম সকালে।
বোতাম
একটি বোতাম গুঁজে দিই চুলে, লাল
জমা কাচ সারা চুল খুব আলোকিত করে
জ্বলে ওঠে বোতামটি, মাথার ওপর
দিয়ে যাচ্ছিল একটি ফিঙে— এই দেখে
ঢিলের মতন পড়ে মাটি স্পর্শ
করবার এক ফুট আগে আনন্দ সামলিয়ে উঠে গেল।
ধ্রুব টিয়াপাখি
আমাদের ঘোড়াগুলি তীব্র ছুটে যায়
ওদের ভুলিয়ে ঘরে এনে গতি বাদ দিয়ে ছোট করে
রেখে দিই আমার টেবিলে।
এসে দাঁড়ালাম
সজল পুকুর, গাছ, কিছুতেই নাম মনে পড়ল না
বাড়িটির, রোদ পড়ে আছে
বাড়িটির ক্যাকটাস ঝোপে
আর পুকুরের চারপাশ দিয়ে হেঁটে চলে যায় ক্যাম্বিসের বল
ডাহুকের বাচ্চাগুলো খাবারের জন্য বেরিয়েছে।
গতজন্ম
আমাদের গতজন্ম ফিরে পাচ্ছি আজ।
দৌড়ে এসে
দেখি— টিয়াপাখি, ডালে, কেবল অনিত্য
দুলে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে
ছোট ভাই পাইলট ছিল, প্রতিদিন আকাশের স্বপ্ন
খুব সোজা, স্বপ্ন সোজা, আমিও পারতাম
ওর স্ত্রী আমারও।
আর ভাবব না: বাল্ব জ্বেলে নিই ঘরে
এত আলো চৌবাচ্চায়
নেমে স্নান করা যেতে পারে, আলোর কিছুটা
গিয়ে পড়ে আছে লেবুগাছে
আলোকিত লেবুগাছ, দরকার নেই, আলো অপচয় হচ্ছে
আমি বাটি করে ধরে রেখে দিতে চাই, তারপর
বনে গিয়ে ছেড়ে দেব— গাছপালা, পাতা, পাখি
ও ওড়না
সব আলোকিত হয়ে থাক বনে।
পাতা পাতা, পাখি পাখি
যে যার আশ্চর্যে আছে, কাকে গিয়ে বলি, ‘রিনি, ভালবাসো
আর পারছি না।’
উড়ে যায় একটি তিতির, ধরে ফেলি
গতজন্ম!
মুঠো খুলে দেখি: একটি পালক
একটি শিশির এসে পড়ুক পালকে, যদি
চিকচিক করে, ধ্রুব, স্বপ্ন সোজা বলে মেনে নেব।
দৃশ্য: ফুটো দিয়ে
একটি টিনের কৌটো ফুটো করে চোখে
দিয়ে দেখি: স্বর্গ; যেখানে এখন অভিরূপ
ভেড়ার শাবক, তাকে একটি বালিকা
শ্যামল ঘাসের দিকে নিয়ে যেতে চায়
কিছুতেই যেতে চাইছে না সে, অদূরে
ঝুপ করে আম পড়ে গাছ থেকে, আর
দুটি ছেলে ছুটে গিয়ে কাড়াকাড়ি করে।
বাড়ি নেই
মাধবীলতার ঝোপ থেকে বেরিয়ে এলাম
যুদ্ধ থেমে গেছে
জলের অনেক নীচে মাছ— তাও।
আমার একটু ডিগবাজি খেতে ইচ্ছা হল, শব্দ করে দেখলাম
শব্দ হয় কিনা
হঠাৎ খেয়াল হল— এখানে পুকুর ছিল না একটা?
এলোমেলো হেঁটে
এসে দেখি একখানা বাঁশ, তাতে লাল ওড়না উড়ছে
কিছুটা দেয়াল, দু’-তিনটে গর্ত
হঠাৎ আমার চুল টেনে পালাল কে; আমি
আর একটু ধুলো মেখে নিই।
আমাদের বাড়ি ছিল, যদি গিয়ে দেখি বাড়ি নেই— মাঠ
মা বলে ডাকতেই— নাক নেই চোখ নেই, চুল পুড়ে গেছে
কেউ বেরিয়ে আসেন
যদি কেয়ার পা পড়ে থাকতে দেখি?
কেয়ার পা
দিঘিতে ডুবিয়ে, মনে আছে, কেবল নাড়াত!
আমি ভেবে চিন্তে আর একটু ধুলো মেখে নিই।
তারপর দেখি শনশন করে
গাড়ি ছুটে আসে। সাদা ধবধবে গাড়ি। প্রায় না থামার
মতো থেমে আমাকে নিমেষে তুলে নিল।
অপার ইঁদুর
আমি এসে দাঁড়াতেই আমার শরীর থেকে তরুণ পরিরা
জামা খুলে নিয়ে উঠে গেল করবীর ডালে; দিদিরা কি আর
আছে, কবে মারা গেছে, আমি উঁকি দিয়ে দেখি শূন্য, বললাম:
‘শোনো, শোনো, যূথী যদি ভালবাসে অল্প, তোমরাও তবে অল্প
শুভেচ্ছা পাঠাও’ কথা বললাম আমি, অভিযোগ করলাম আমি
শোনালাম গল্প, আর আমার পেছনে ঠিক আমার মতোই
কে যেন দাঁড়িয়েছিল, একবার তার গলা আর একবার
আমার, এভাবে শোনা গেল, আমি ঘুরে দাঁড়াতেই: কেউ নেই
দেখি অনন্য অপার সব দীর্ঘ জল, দুটি ইঁদুর কীভাবে
জলের ওপর দিয়ে চলে যায়, ও আবেগে কিচির কিচির
করে, লাফাতে লাফাতে; সময় এমন: আলো জ্বালতেই দেখি
সামনের উঁচু তালগাছ থেকে রস চুরি করে চুপচাপ
মাটির কলসি বেঁধে কোমরে ঝুলিয়ে নেমে যায় দেবদূত।
জুঁই
সাদা কাগজ টাঙানো, তখন একটি
ডালে কম হাওয়ায় দুলছিল জুঁই
আর থাকতে না পেরে, ছোট হতে হতে
কুচকুচে কালো মাছিতে রূপান্তরিত
হয়ে বোঁটা থেকে খসে উড়ে গিয়ে বসল কাগজে
জুঁই, তুমি কি কলেজে যাও আর, ছেলেটি কি
আগের মতোই আছে? আমি ফুটো দিয়ে
লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি সমস্ত কাগজে
ঘুরে বেড়ায় মাছিটি, আগের মতোই… …
রাষ্ট্রনীতি
চলো
অ্যাক্সিডেন্ট, ধানখেত, হাত কেটে বের করে এনে দেব
তোমার ছেলেকে
‘বিপদেও ঠাট্টা ছাড়ব না’
এনে রাখো নরম মাংস, কিছু দ্রাক্ষা
বাড়ির সামনে গড়ে তোলো মাধবীনিকুঞ্জ
তুলে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব, ফুল দিক আমার বাড়িতে
ভাল জামা পরে এসো
‘বিভাস একদিনের জন্য দিস’— এই লোভ থেকে যাবে, মরে গিয়ে
তোদের আলনা থেকে তুলে নিয়ে উঠে যাব ছাদে, বেলগাছে
গায়ে দিয়ে মহাশূন্য থেকে ফেলে দেব
কাদার ভেতর—
স্প্যানিয়েল— রাত্রে তার
আমার গৌরব— এই বাণী প্রচারিবে।
প্রকৃতির দিকে গিয়ে ব্যাগ থেকে বিড়ালের বাচ্চাগুলো ছেড়ে দিই
বলি: তোরা যা, তোরা যা পুষি
ভাল থাক অসীমের মধ্যে, গরিবের বাড়ি থেকে চুরি কর
হাঁড়ি মুখে করে নিয়ে গিয়ে ফেলে রাখ কাশবনে।
ঋষি বলেছেন: কোনও রাষ্ট্র এইভাবে বেশিদিন চলতে পারে না
ডাকো: মার্ক্স সাহেবকে
[টানাটানি করো, যদি উনি ছিঁড়ে যান, লাগবে না?]
প্রান্তিক চাষিকে ঋণ কে দিচ্ছেন?
তুমি টর্চ মারো ধানে, ধান কি মায়ার, বিস্ময়ের, শরতের
যদি দোলে তাও শরতের।
তুমি একা নও,
প্রতিনিধিত্ব করছ একটা শ্রেণির
অনন্য ড্রয়িংরুমে, প্রেমে, সোফায়, পোস্টারে
একটি মেয়েকে যদি এনে রাখি, সমাজের থেকে কোনও গাছ
তুলে দিই তার ডানদিকে, একখানা ডাল তার মাথার ওপর
দিয়ে নিয়ে যাই, সবশেষে রাখি রিং, পুষ্প
বাতাস দোলাচ্ছে যাকে, চুক্তি না করেই
তার সব চুল হাত দিয়ে খুলে নাও স্বপ্নে।
‘এইভাবে কোনও রাষ্ট্র বেশি দিন চলতে পারে না।’
চলো তবে ফিরে যাই আবার বিপ্লব করি, লোককে বোঝাই
মাস্টারের দোষ বেশি ছিল গতবার, এবারেও
মাস্টারের দোষ বেশি দেব, যুগে যুগে তারা দেখা দেন
স্কুলে, ছাতিম তলায়।
পথ আছে, ওগো শ্যাম, পথ আছে
আমি শোষণ করার রীতি পালটিয়ে ফেলেছি, তোমাকে দিয়েই
আমি তোমাকে শোষণ করে যাব
পাড়ায় পাড়ায় রক, কফি হাউসের রঙ্গ
তারপর মাসে মাসে কি অনন্য পঞ্চাশটি টাকা
যদি বিপ্লব পিছিয়ে দিতে পারো।
বলি: তোরা যা, তোরা যা পুষি
ভাল থাক অসীমের মধ্যে, হাঁড়ি মুখে করে
নিয়ে গিয়ে ফেলে রাখ কাশবনে।
ঝাউবনে
আছে মহাকাশ
নীচে অল্প বিছানায় তুমি শুয়ে আছ।
ঝুঁকে, আস্তে করে
কামড়িয়ে দিই গরম মঞ্জরি
দুটি পাখি ডেকে উড়ে যায়, তারা সাক্ষী, প্রকৃতির রায়
এই ভেবে বাড়ি ফিরে আসি
কার বাড়ি, বাবা বানিয়েছে?
সামনে বাগান; তার হাতে করা, পেঁচিয়ে লতিয়ে ওঠা
পাতাঝোপ
ঘরে এসে খিল আটকিয়ে দিই।
বিবিধ শিরীষ রোদ ধাতু পুষ্প মরাল কল্পনা
কিছু ধরব না
যদি ফস্কে খানখান হয়ে ভেঙে যায় বাটি
যাকে গ্রাহ্য করি জ্ঞান
ভাবি বিশেষ তরঙ্গ, যাকে দিয়ে যোগাযোগ করি
এই ভেবে বাড়ি ফিরে আসি
কার বাড়ি, বাবা বানিয়েছে?
সামনে বাগান?
লেপের তলায় শীতে কেতকীকে আঁকড়িয়ে
গভীর কল্পনা করো পাখি দিকে দিকে
একটিও উড়ছে না ঝাউবনে, অসীম অভ্যাসে
তুলোয় প্রবেশ করে বন্ধ করে দিই বিশেষ বেতার।
ঠাট্টা
আপনি কাঠবিড়ালিকে ছেড়ে দিলেন ডালে, গায়ে দিলেন লোম
আর মেয়েকে পাঠালেন কলেজে, ছেলেটির বারোটা বাজাতে
প্রকৃতি, এরকম ভুল আপনি আরও করেছেন।
নেপথ্য মর্মর
শিশুটি বিমূর্ত
কী করে আরম্ভ হল এ জগৎ মনে নেই, তবে
একদিন আস্তে করে পরীক্ষামূলকভাবে আমি
তাকিয়েছিলাম আর দেখি ধীরে ধীরে সব ধরা
দিতে এল, ফুরফুরে কচুর পাতাকে কেন্দ্র করে
একটি মৌমাছি, তার সবচেয়ে লক্ষ করবার
মতো যে ব্যাপার, তার সে গুনগুন, আমাকে অবাক
করে দিল— এখানেই সমস্ত বিস্ময় দিয়ে দিলে
চলবে না— এই ভেবে আমি চোখ নিয়ে যাই দূরে
যেখানে একটি স্তব্ধ বারান্দা এবং তার শেষে
হাওয়ায় নড়ছে একটি বল সেটি লক্ষ করে
হামাগুড়ি দিচ্ছে একটি শিশু, এসময় যদি আর
এক ঝাপটা বাতাস লাগে যাবে বলটি গড়িয়ে
অসীমের মধ্যে, তবু শিশুটির মগ্ন হামাগুড়ি
এর ভেতর যে সংকট, গন্তব্য তা আমি নষ্ট
করতে চাই না, বল আর শিশুটিকে লক্ষ করি।
এই যে বারান্দা নিয়ে এতক্ষণ ধরে বলে গেলে
এটা সত্যি নয়, সব সময় কি ওটা স্তব্ধ ছিল?
মেয়েটি আশ্চর্যভাবে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়াত যখন?
স্তব্ধতা কি বেড়ে যেত বলে মনে হয়, ওপারের
গাছ থেকে পাখি যেতে চাইত না বলে ধরে নেব?
এ বারান্দা আমাদের বাড়ি থেকে নিয়ে আসলে না?
তবে এর সঙ্গে যোগ করে নাও একটি টেবিল
টেবিলে চায়ের কাপ, ফ্লাক্স, শিশি, লবণের বাটি
টুল দু’-তিনটে, অল্প দূরে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে
দিয়েছেন এক ভদ্রলোক, সম্ভবত মেয়েটির
বাবা, ক’মিনিট আগে অফিসের থেকে ফিরেছেন
চুপচাপ, ওদিকের খুব ছোট একখানা ঘর
থেকে খুন্তি, কড়াইয়ের শব্দ আসছে, তা আসতে দাও
এই সব পরিবেশ করে তুলেছিল উচ্ছ্বসিত।
আজ এই এতদিন পরে সেই বারান্দায় এসে
দাঁড়াতেই থমকে গেলাম, টেবিলটি আর নেই
রান্নার আওয়াজ নেই, পড়ে আছে একখানা
বল, সেটি হাওয়ায় নড়ছে, যদি আর একটু জোরে
হাওয়া লাগে, গড়িয়ে পড়বে একেবারে নীচে
অসীমের মধ্যে, শোনো এরকম অবস্থায় আমি
এসে দাঁড়াতে চাইনি কখনওই, শিশুটি যখন
হামাগুড়ি দিয়ে বলটির দিকে এগিয়ে চলেছে।
আত্মা, একটি বল
কাবেরীর মধ্যে গিয়ে সব জল খেয়ে গায়ে মেখে
বিভোর আচ্ছন্ন বুনো পাতাঝোপ থেকে ফুস করে
বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি এক অপূর্ব মৌমাছি
আর মনে মনে ঠিক করে নিই যাকে পাব ছোঁব
প্রথমেই যাকে চোখে পড়ে তাকে কোথাও দেখেছি
বলে মনে পড়ল না, বেশ অসভ্যতা হয়, তবু
তার গালে একবার উড়ে গিয়ে বসে খুব ভাল
লেগে গেল, আর একবার বসব বসব করে
যেই বসতে গিয়েছি সে মুহূর্তে আমি সংকটে
চরম থাপ্পড় খেয়ে ঠাস করে পড়ে যাই শানে।
শান: এক চির ঝলসানি, পড়ে দেখো, আছড়াও
হে পিছল সিমেন্ট, তুমি শ্বেত, আমাকে শাসাচ্ছ
এক বহুবর্ণ ডোরাকাটা মাছ এনে ছেড়ে দিয়ে
দুই চোখ বড় করে দেখি তুমি জলের আনন্দ
ছাড়া মরে যাও, ‘সামনের জন্মে অ্যাকোয়েরিয়মে
যদি একটু জায়গা করে দেন, নীলাভ উপল
যার পাশ দিয়ে তৃণ উঠে গেছে দুটি, ওইখানে
থাকব, কিছুই করব না শুধু বুদ্বুদ পাঠাব।’
এই বলে রেখে চলে গেল প্রাণ, সে মুহূর্তে তার
মৎস্যদেহ থেকে সব ডোরা সব কাটা তুলে নিয়ে
শাড়িতে স্থাপন করে দেখছি কেমন লাগে রং
আর যূথী আস্তে করে পড়ার টেবিল থেকে উঠে
এসে, সেই শাড়িটিই শরীরে জড়িয়ে, এমনিই
আলোকিত ফুটো দিয়ে একটি ছোটমতো কাঠি পুরে
এক এক করে ভেঙে যাচ্ছে সেই বুদ্বুদগুলোকে,
ফেটে যায়, ফেটে যাওয়ার শব্দ জড়ো হচ্ছে টিনে
দু’-একটা ঢুকে যায় বাল্বে যেটি রাত্রে জ্বালা থাকে
আর এ সময় আমি কেমন করে যে ঢুকে পড়ি
যূথীদের ঘরে, আমি নিজেই বুঝি না, একবার
ঢুকেই পড়েছি, তুমি কি চাইবে না এই এতদিন
পরে দেখা, কিছুক্ষণ থেকে যাই, আর একবার
তোমার কাপড়ে বসে উড়ে যাই আবার তখনই৷
উড়ে গিয়ে কী করব? আমাকে তো কোথাও বসতে
হবে, কোনও ডালে, কোনও পল্লবের একটু কম্পনে
যেতে যেতে দেখলাম তুমি কোনও বিশিষ্ট বিকেলে
বেড়াতে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছ ফোয়ারার কাছে
তক্ষুনি কী মনে হয় একটি কিশোর হয়ে যদি
ফিরে গিয়ে ফোয়ারাটি খুলে হাতে ধরে নিরন্তর
পিচকারি করি আর তুমি হাত কপালের কাছে
নিয়ে ফোয়ারা রুখছ, এ দৃশ্যে যে আমি কি তন্ময়
কিশোরের সব দোষ, লোভ নিয়ে বিরাজ করব
সে তো বুঝছই, তা না হলে আজ আমাকে আবার
বাড়িতে ফিরিয়ে নাও, কলাপাতা কেটে গোল করে
রবিবারের দুপুরে খেতে ডাকো, গলিপথে গিয়ে
আবার দাঁড়াতে দাও, চাঁদের ভেতর দিয়ে চলে
হে গলি, কী! কী রোমাঞ্চ, হাতে বই লাল ডটপেন
তোমার কলেজ থেকে ফেরবার পথ, সাইকেলে
করে গিয়ে নেমে পড়ি…
আজ সেই পথ ক্রমে এসে
থামে মাঠের ভেতর, যেখানে দু’খানা ছোট ছোট
অপূর্ব চেয়ার রেখে গেছে দেবদূত, এখানেই
দেখা হত আমাদের, তুমি শাড়ি আরও ভাল করে
পিঠের সবটা নিয়ে ঘুরিয়ে সামনে এনে রাখো
আর সে মুহূর্তে আমি পেছনের থেকে নির্নিমেষ
আবার মৌমাছি হয়ে উড়ে গিয়ে তোমার শরীরে
বসে আবার তক্ষুনি উড়ে যাই
এই দোষটুকু
আমি করবই, ধরে শিশিতে আটকে রাখো, আমি
শিশির ভেতর থেকে গুনগুন করে দোষ করে
যাব, যেদিন বাড়িতে কেউ থাকবে না, শুয়ে আছ
তোমার শরীর ছেড়ে আত্মা ছোট একটি নরম
বল হয়ে ঘর ছেড়ে বারান্দা উঠোন গেট সব
ছেড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যাচ্ছে অনন্তের দিকে
আমি টেবিলের থেকে শিশি উলটে শানে পড়ে ফেটে
দ্রুত উড়ে গিয়ে ধরে ফেলি বলটিকে, আর বসে
থাকি বলের ওপর, ভরতি ঘাস দিয়ে যেতে যেতে
বলি: চলো আত্মা চলো কোথাও সমাপ্ত নও তুমি।
পায়রা ও গতজন্ম
রোদে গম খেতে এসেছিল একবার, ‘এই হুস’
বলে যেই ভয় দেখিয়েছ পায়রাটি বন দিয়ে
সরোবর ছেড়ে উড়ে যেতে যেতে যেখানে থামল
সেটি আমাদের গতজন্ম, কাশবন, নীল আলো
পাখির অস্ফুট ডাক বলে দিচ্ছে জায়গাটি চুপ
করে ছিল এতদিন, সে পায়রা উড়ে যেতে যেতে
দেখে তুমি সেই তরুণীটি, চুল বাঁধা ফেলে রেখে
এক বিশেষ আবেগে অনন্য দু’হাত দিয়ে হুস
বলে ভয় দেখিয়েছ, সে কি মেয়ে প্রথম দেখল?
যেন, মহিমা না বুঝে উড়ে গেছ, এরকম দিনে
যেখানে মানুষ বলে কেউ নেই, তোমার মতোই
খাবারের জন্য বেরিয়েছে আর একটি পায়রা
খুবই আশ্চর্য হয়ে গাছ থেকে একটু ওপরে
শুকনো ডালের আশ্রয়ে গিয়ে বসে আছে, এরকম
দিনে সেখানেও অল্প রোদ গিয়ে পড়ল তখন।
এই পুরো দৃশ্যটিকে— লাঠির ওপরে রোদ, রোদে আস্তে আস্তে
ডানা মেলে দিচ্ছে পায়রাটি, নীচে যার লক্ষ্য থেকে থেকে, আর
যূথী তুমি নাকি, শোনা যায়, কাশের ভেতর একপাশে শুয়ে
আড়মোড়া ভাঙছিলে— এই পুরো দৃশ্যটিকে আমি একেবারে
একটুও না পালটে তুলে এনে খুব যত্ন নিয়ে তোমাকে বোঝাই
দেখা দিয়েছিলাম সেদিন এইভাবে, আজ যখন তোমাকে
ছাড়া দৃশ্য নেই, করে নিতেও পারি না, যেই তোমার টেবিলে
এনে রাখি পুরো দৃশ্যটিকে তুমি ঝুঁকে খুব যত্ন নিয়ে লক্ষ
করো আমাদের গতজন্ম! আর তুমি ঝুঁকে পড়বার সাথে সাথে
আমাদের গতজন্ম থেকে, সেই অনিমেষ ডাল, রোদ ছেড়ে
অস্ফুট পাখির ডাক সব ছেড়ে দিয়ে পায়রাটি উড়ে যায়।
শব্দ শোনো, মনে কি হয় না সব চুপ করে ছিল এতদিন?
ডেকচির আশেপাশে
নীল জামা গায়ে দিয়ে যে পুতুল শিশুর হাতের
থেকে উঠে এসে খুব মগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে
আমার টেবিলে, তাকে নিমিষে ফিরিয়ে দিই আর
এক শিশুর জগতে, জগৎ বলতে আমি দেখি
যেখানে একটি বড় ধরনের বল আর মেঝে
পাশে উলটোনো ডেকচি, পাউডার কোটো ও চিরুনি
আমি পারি যে কোনও মুহূর্তে উঠে গিয়ে বলটিকে
অন্তত একটু শূন্যে তুলে একবার লুফে নিয়ে
চৌকির তলায় রেখে দিতে পারি, যেন আজকেই
ঘাড়ে তুলে নিতে পারি শিশুটিকে, আর উপচানো
চুল নেড়ে দেখবার মতো দোষ আমিও করব
সে সময় আমার টেবিল থেকে ঈষৎ ছায়াময় আলো
গিয়ে পড়ে থাকে ডেকচির আশেপাশে, চিরুনিতে
যে জগতে একটিই বড় বল থেমে আছে আজ।
এই দৃশ্য সামলিয়ে চলে আসি বাড়ির বাইরে।
বিনু ও ফড়িং
কলাগাছ, আর তার বিরাট পাতায় এসে পড়ে
রোদ, আরও একখানা বড় পাতা কাপড়ের মতো
যেখানে নড়ছে, সেটি ছোট ডোবা যার এককোণে
বিনোদিনী হাঁস ছেড়ে দিয়ে একভাবে চেয়ে আছে
একটি ফড়িং খুব চেষ্টা করে চলেছে তখন
ঘাসের শিশিরে বসতে, পাখা যার নেপথ্য মর্মর।
আমি এই ঘটনাকে ফড়িং সমেত তুলে নিয়ে
আসি, বিনু তোমাদের ছাদে, মৌন বিকেলের ছাদে
তুমি স্কুল থেকে ফিরে বিনুনি খুলছ, আর আমি
পাপড়ির ভেতর দিয়ে যেতে যেতে খুঁজে পাই রেণু
আর তোমার বয়স বেয়ে বেয়ে লক্ষ লক্ষ ফুটো
সুড়ঙ্গে এসেছি, সব ফুটো দিয়ে আলো আসছে যাচ্ছে
তার অনেক ভেতরে সবার প্রথমে আমি দেখি
একটি ছোট্ট রিং একবার বেজে আর বাজছে না।
যে দৃশ্যকে আমি ডোবা থেকে তুলে এনে আস্তে করে
বিনু, তোমাদের ছাদে ছায়াময় গ্রিলের ভেতর
ফড়িং সমেত ছেড়ে দিয়েছি, যেখানে আমি জানি
ফড়িং মর্মর, তার শুধু চেষ্টা আছে কোনওদিন
যদি কোথাও কখনও অল্প একটু বসে যেতে পারে
কোনও বাটির ওপর, উলটো করা বাটি, যার নীচে
বিনু, তুমি আত্মা, চুপ করে শুয়ে আছ, দৌড়ে গিয়ে
বাটি তুলে দেখি কেউ নেই, দুটি ছিপছিপে ঘাস
আর একটি পিঁপড়ে গোল হয়ে যাতায়াত করে
সেখানে কী করে ফিরি, ফিরে গিয়ে কী করে আবার
ডাকি বিনু, শোনো বিনু, দেখো বিনু আমি, বিনু আমি।
হাততালি, তারপর
বড় বড় ঘাসের ভেতর অল্প শাড়ি তুলে তুমি
পার হচ্ছ এক বড় আর খুব প্রিয় অভিজ্ঞতা
এরকম দৃশ্যে আমি যতবার লুকিয়ে লুকিয়ে
কাছে গেছি, দৃশ্যটিকে নষ্ট করে ফেলি, হে বাতাস
আমি দেবদূত হয়ে যদি না জানিয়ে অতর্কিতে
দেখা দিই, আর যদি চমকিয়ে ওঠো তুমি, তবে
ধরে নেব আমি পারি, সব পারি, এখনও তোমাকে
এক স্তব্ধ অপরিকল্পিত দেশে চমকাতে পারি।
চমকাতে কে বলেছে? অনেক অনেক সিঁড়ি দিয়ে
তুমি উঠে যাচ্ছ দূরে দূরে আর ভাবছ চুড়োয়
একটা জানলা, নীল কাচে ঢাকা যার মধ্যে দিয়ে
তাকাবে দিগন্তে, ভাঙা সেতু, বিল, একটি নিঃসঙ্গ
মাঝি, আরও নিঃসঙ্গ একটি ভেলা, দেশলাই জ্বলল,
চোখ নিয়ে যাবে যেই কাচের ভেতর, সে মুহূর্তে
দেখা দিলাম সেখানে, তুমি আর কী করবে বলো
পুরো দোষ যে আমার, সে তো স্পষ্ট, তবে যে পাখিটি
ঘুলঘুলি ছেড়ে ঝাপটিয়ে উড়ে চলেছে তখন
দেখি সে কোথায় গিয়ে বসে, আজ এতদিন পরে
আর একবার দেখা দিতে ইচ্ছা হয়, এর মধ্যে
পাখিটি নিশ্চয় গিয়ে বসে আছে সেই ডালটিতে
যেটি দোলনার মতো নেমে গেছে বিলের কিনারে
কিশোরেরা দোল খেয়ে আরও নামিয়ে এনেছে
আমি ভুল করে প্রায় একেবারে কাছে চলে গিয়ে
দেখি তুমি উলটো দিকে মুখ করে ঠিক বিল নয়,
বিলের ওপরে ভেসে থাকা নৌকোটিকে লক্ষ করছ
পেছনের থেকে ঘাড়ে টোকা মেরে চমকিয়ে দেব?
না তারও আগে হাততালি দিয়ে মগ্ন পাখিটিকে
আকাশে তাড়াব, সে সময় তুমি মুখ ফেরাতেই
আমি খুব তাড়াতাড়ি একটি শাবকরূপে দেখা দিই
আর হাততালি যেটা পাখি ওড়াবার জন্য দিয়ে
ফেলেছি তখন, সেটা শোনা যেতে থাকে ফিরে ফিরে।
আওয়াজ, পাইন বাগানে
ঠিক এরকমই দেখি— যে মৌমাছি ছেড়ে দিয়ে গেছি
আমার আত্মার প্রতিনিধি; চুপ করে উড়ে যায়
ভেবেছিলাম এই যে থমথমে ভাব চারপাশে
তাতে সে বিশেষ মাত্রা হয়ে উঠবে, দেখি তা হয়নি
দূর দিয়ে চরাচর মাঠ হয়ে চলে গেছে, যেটি
একদিন বাইশটা কিশোর একটি বল নিয়ে
কেবল ছুটবে, পরিবর্তে খুব সাবধানে, পাশ
দিয়ে আরও চুপ করে চলে গেছে একটি বারান্দা
আর তার রেলিঙের ধার ধরে ঝুঁকে আছে ও কে?
কালো লম্বা যে তরুণী, শাড়ি পরা, কোথায় দেখেছি?
সব অলৌকিক মাছেদের সঙ্গে কলেজ ক্যাম্পাসে?
আমি তার পাশে গিয়ে দেখি তার দৃষ্টি মৌমাছির
দিকে— যাই হোক সেও তো বাংলার মেয়ে, কালো মেয়ে
বাংলার বৃষ্টিতে ভিজে তরুণী হয়েছে, তারপর
এইখানে তুমি আজ প্রথম এসেছ, মনে করে
দ্যাখো আমি তোমাদের বাড়িতে যেতাম, আর ঠিক
এই রেলিঙের ধার ধরে দাঁড়াতাম আমরাই
মনে পড়ে? তোমার বাবার সঙ্গে পাইন বাগান
দিয়ে জীবনে প্রথম বড় হয়ে টুক টুক করে
হাঁটছিলে, যে দুটি কিশোর আর থাকতে না পেরে
তোমাকে ও তোমার বাবাকে আওয়াজ দিয়েছিল
তার একজন আমি…
সে রেলিং, রেলিঙের ধার
অসীমের মধ্যে দিয়ে চলে যাচ্ছে সুদূর ট্রেনের
মতো, তোমাদের বাড়ি পড়ে আছে গরিব বাংলায়
গমকল আর তার ডাক ঝোপের ভেতর, তার চালে
অল্প সজনের ছায়ায় শুয়ে আছে বাড়ির বিড়াল
এই সব থেকে মুক্ত হয়ে চলে এসেছে রেলিং
তুমি ধরে ছিলে, শাড়ি পালটাবার সময় পাওনি
হাতে কাঁটা, উল, গরমের ছুটি কবে হচ্ছে, শোনো
তুমি বিনু, আমি চাই তুমি এই স্তব্ধ জায়গায়
একটু বিরাজ করো, তোমার হাতের উল আমি
নিজে ধরে রাখলাম, তুমি প্রকৃতির মধ্যে গিয়ে
বাইরে বেড়িয়ে এসে একটি মৌমাছি হয়ে দেখা
দাও, বারান্দায়— যেটি এ মাঠের একপাশ দিয়ে
চলে গেছে, শোনো আমি আবার তোমার সাথে দেখা
করে নেব কলেজ ক্যাম্পাসে; আর যদি নাই পারি
তোমার বাবাকে নিয়ে বড় হয়ে বেরিয়েছ যেই
সেদিন আবার আওয়াজ দেব পাইন বাগানে।