কফন ॥ প্রেমচন্দ / ননীগোপাল শূর
কফন – প্রেমচন্দ
ঝুপড়ির দরজায় বাপ-বেটা দুজনে নিভে যাওয়া আগুনটার সামনে চুপচাপ বসে। ওদিকে ঘরের ভেতরে ছেলের জোয়ান বউ বুধিয়া প্রসববেদনায় আছাড়পাছাড় খাচ্ছে। থেকে-থেকে ওর মুখ দিয়ে এমন কলজে-কাঁপানো আওয়াজ আসছে যে ওরা দুজন বুকে। পাথর চেপে কোনও মতে তা সহ্য করছে। শীতের রাত, প্রকৃতি নিস্তব্ধতায় ডুবে আছে। সমস্ত গ্রামখানা মিশে গেছে অন্ধকারে।
ঘিসু বলে—’মনে হচ্ছে বাঁচবে না। সারাটা দিন দৌড়ঝাঁপ করেই কাটাল। যা না, গিয়ে একবারটি দেখে আয় না।’
মাধব ক্ষেপে দিয়ে বলে—’মরবেই যদি তো তাড়াতাড়ি মরে না কেন? দেখে করবটা কী?’
‘পরাণে তোর একটুও দরদ নেই রে! সারাটা বছর যার সঙ্গে সুখে-শান্তিতে ঘর করলি, তার সঙ্গেই অমন বেইমানি!’
‘আমি যে ওর ছটফটানি আর হাত-পা ছোঁড়া চোখে দেখতে পারছি না।’
চামার-বাড়ি; সারা গায়ে ওদের বদনাম। ঘিসু একদিন কাজে যায় তো তিনদিন ঘরে বসে থাকে। মাধবটা কাজে এত ফাঁকিবাজ যে আধঘণ্টা কাজ করে তো একঘণ্টা বসে ছিলিম টানে। তাই ওরা কোথাও মজুরি পায় না। ঘরে যদি একমুঠো খাবার থাকে তো ব্যস, ওরা যেন কাজ না-করার শপথ নেয়। দুচারটে উপোস দেবার পর ঘিসু গাছে উঠে কাঠকুটো ভেঙে আনে আর মাধব বাজারে গিয়ে বেচে আসে সেগুলোকে; তারপর যতক্ষণ সে পয়সা হাতে থাকে দু’জনে টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। আবার যখন উপোস করার হাল হয়, তখন আবার হয় কাঠকুটো কুড়িয়ে আনে কিংবা জনমজুরির খোঁজে বের হয়। গায়ে কাজের কমতি নেই। চাষাভুষোর গাঁ, খেটে-খাওয়া মানুষের হাজার রকমের কাজ। তবু ওদের দুজনকে লোকে কেবল তখনি ডাকে যখন দুজনের মজুরি দিয়ে একজনের কাজটুকুতেই সন্তুষ্ট হওয়া ছাড়া তাদের গত্যন্তর থাকে না। এ দুজন যদি সাধু-সন্ন্যাসী হত, তবে সন্তোষ এবং ধৈর্যের জন্য কোনো সংযম-নিয়মেরই আবশ্যকতা হত না, কারণ এ-সব ছিল ওদের স্বভাবজাত। ছন্নছাড়া অদ্ভুত জীবন ওদের। ঘরে দুচারখানা মাটির বাসন ছাড়া সম্পত্তি বলতে কিছু নেই। ছেঁড়া কাপড় পরে নিজেদের নগ্নতাকে কোনোমতে ঢেকে জীবন কাটায়। সংসারের সব রকমের ভাবনাচিন্তা থেকে মুক্ত। ঋণে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। গালাগালি খায়, খায় মারধরও, তবুও কোনো দুঃখ নেই। গরিব এত যে, পরিশোধের আশা লেশমাত্র নেই জেনেও সবাই ওদের কিছু না-কিছু ধার দেয়। মটর বা আলুর সময় অন্যের ক্ষেত থেকে মটর কিংবা আলু চুরি করে তুলে নিয়ে এসে সেগুলোকে ভেজে বা পুড়িয়ে খেয়ে নেয়; কিংবা পাঁচদশ গাছা আখ ভেঙে এনে রাতের বেলা বসে-বসে চোষে। ঘিসু এই রকম আকাশবৃত্তিতেই ষাট-ষাটটা বছর কাটিয়ে দিয়েছে; আর মাধবও বাপের বেটা, অনুসরণ করে চলেছে তারই পদাঙ্ক; বরং বলা চলে বাপের নামকে আরও উজ্জ্বল করে চলেছে। এই যে এখন দুজনে আগুনের সামনে বসে আলুগুলো পোড়াচ্ছে তা-ও কারো-না-কারো ক্ষেত থেকে তুলে আনা। ঘিসুর বউটা তো অনেকদিন আগেই দেহরক্ষা করেছে। মাধবের বিয়ে হয়েছে এই গত বছর। মেয়েটি এদের ঘরে এসে পরিবারে একটা শৃঙ্খলা এনেছে। গম পিষেই হোক বা ঘাস তুলেই হোক সেরটাক আটার যোগাড় সে ঠিক করে নিত আর এই বেহায়াদুটোকে পিণ্ডি গেলাত। মেয়েটা ঘরে আসার পর এরা দু’জন আরও আলসে, আরও আরামপ্রিয় হয়ে উঠেছিল; বরং বলা চলে ওদের গুমরও যেন বেড়ে গিয়েছিল। কেউ কাজ করতে ডাকলে ইদানিং বিনাদ্বিধায় দুনো মজুরি হেঁকে বসত। এই মেয়েটিই আজ এদিকে প্রসববেদনায় মরে যাচ্ছে আর এরা দু’জন বোধকরি এই আশায় অপেক্ষা করে আছে যে, ও চোখ বুজলে আরাম করে ঘুমোতে পারবে।
ঘিলু আলু বের করে খোসা ছাড়াতে-ছাড়াতে বলে, ‘গিয়ে দেখ তো কী অবস্থা বেচারির! পেত্নীর নজর লেগেছে, তাছাড়া আর কি? এসব ঝাড়াতে-টাড়াতে তো ওঝা কম করেও একটা টাকা চাইবে!’
মাধবের ভয়, সে ঘরে ঢুকলে ঘিসু আলুগুলোর বেশির ভাগটা-না সাবাড় করে দেয়। বলে—’ওর কাছে যেতে আমার ভয় করছে।’
‘ভয় কিসের রে, আমি তো এখানে রয়েছিই!’
‘তাহলে তুই-ই গিয়ে দেখ না।‘
‘আমার বউ যখন মারা গিয়েছিল, আমি তিনদিন ওর কাছ থেকে নড়িনি। আর তাছাড়া আমাকে দেখলে ও লজ্জা পাবে না? কোনোদিন যার মুখ দেখিনি, আজ তার উদলা গা দেখব! ওর তো এখন গা-গতরের হুঁশ-টুশও নেই। আমাকে দেখে ফেললে ভালো করে হাত-পা-ও হুঁড়তে পারবে না।’
‘আমি ভাবছি যদি বাচ্চাটাচ্চা হয়ে পড়ে তাহলে কী হবে? শুঠ, গুড়, তেল কিছুই তো ঘরে নেই।’
‘সবই এসে যাবে। ভগবান দিক তো! যারা এখন একটা পয়সা দিচ্ছে না, তারাই কালকে যেচে এসে টাকা দেবে। আমার ননটা ছেলে হয়েছে, ঘরে তো কোনোদিন একটা কানাকড়িও ছিল না, তবু ভগবান কোনও-না-কোনও মতে কাজ তো চালিয়ে দিয়েছেন।’
.
যে-সমাজে দিনরাত খেটে-খাওয়া মানুষের হাল ওদের চাইতে বেশি কিছু ভালো নয়, যেখানে চাষিদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে যারা মুনাফা লোটে তারাই চাষিদের চেয়ে অনেক বেশি সংগতিপন্ন, সে-সমাজে এ-ধরনের মনোবৃত্তির সৃষ্টি হওয়া কিছু অবাক হবার মতো কথা নয়। বরং বলব ঘিলু চাষিদের চাইতে ঢের বেশি বুদ্ধিমান, তাই সে নির্বোধ চাষিদের পালে না-ভিড়ে আড্ডাবাজদের কুৎসিত দলে গিয়ে জুটেছিল। তবে হ্যাঁ, ওর মধ্যে এতটা ক্ষমতা ছিল না যে, আড্ডাবাজদের নিয়মকানুন ঠিকঠাক রপ্ত করে। তাই ওর দলভুক্ত অন্য সবাই যেখানে গাঁয়ের মাতব্বর কিংবা মোড়ল হয়ে গেছে, সেখানে সারা গাঁ ওর নিন্দে করে। তবু এ-সান্ত্বনাটুকু ওর আছে যে, ওর হাঁড়ির হাল খারাপ হলেও অন্ততপক্ষে ওকে ওসব চাষিদের মতো হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয় না। ওর সরলতা এবং নিরীহতা থেকে অন্যরা অনুচিত মুনাফা লুটতে পারে না।
দুজনে আলু বের করে-করে গরম-গরম খেয়ে চলে। কাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। তাই আলু ঠাণ্ডা হবার তর সইছে না। ফলে বারকয়েক দুজনেরই জিভ পুড়ে যায়। খোসা ছাড়ালে আলুর ওপরটা খুব বেশি গরম বলে মনে হয় না, কিন্তু দাঁতের নিচে পড়া মাত্রেই ভেতরটাকে, জিভ, গলা আর টাকরাকে পুড়িয়ে দেয়। ওই অঙ্গারটাকে তখন মুখে রাখার চাইতে অনেক বেশি ভালো পেটের ভেতরে পাচার করে দেয়া। সেখানে ওটাকে ঠাণ্ডা। করার মতো যথেষ্ট বস্তু রয়েছে। তাই দুজনে গপাগপ গিলে ফেলছে। যদিও এ করতে গিয়ে চোখে জল এসে পড়ছে ওদের।
খেতে-খেতে জমিদারের বিয়েতে বরযাত্রী যাবার কথা ঘিসুর মনে পড়ে যায়। বছর কুড়ি আগে সেই বরযাত্রী হয়ে গিয়েছিল। সেই ভোজ খেয়ে যে তৃপ্তি সে পেয়েছিল তা তার জীবনে মনে রাখার মতো ঘটনা, আজও সে স্মৃতি তার উজ্জ্বল হয়ে আছে। বলে—’ওই ভোজের কথা ভুলতে পারি না। তারপর সারা জীবনে অমন খাবার আর পেট পুরে খাইনি। মেয়ের বাড়ির লোকেরা সবাইকে পেট ভরে পুরি খাইয়েছিল, সব্বাইকে! ছোট-বড় সবাই পুরি খেয়েছিল, একেবারে খাঁটি ঘিয়ে ভাজা! চাটনি, রায়তা, তিন রকমের শুকনো তরকারি, একটা ঝোল, দই, মিষ্টি। কী বলব, এ-ভোজে সেদিন কী আস্বাদ পেয়েছিলাম! কোনও নিষেধ-মানা ছিল না। যে-জিনিস যত খুশি চেয়ে নাও, যত চাই খাও। সবাই অ্যাত্ত-অ্যাও খেয়েছিল যে, কেউ জল পর্যন্ত খেতে পারেনি। পরিবেশকরা পাতে গরম-গরম, গোল-গোল, সুগন্ধি কচুরি দিয়েই। চলছিল। যত মানা করি আর চাই না, পাতের উপর হাতচাপা দিয়ে রাখি, কিন্তু তবু ওরা দিয়ে যাচ্ছিল তো যাচ্ছিলই। তারপর যখন আঁচিয়ে এলাম, তখন পান-এলাচও পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার তখন পান খাবার হুঁশ কোথায়। দাঁড়িয়ে থাকতেই পারছিলাম না। চটপট গিয়ে আমার। কম্বল পেতে শুয়ে পড়েছিলাম। এত দিলদরিয়া ছিলেন ওঁরা।’
মাধব মনে-মনে জিনিসগুলোর স্বাদ কল্পনা করতে-করতে বলে—’আজকাল কেউ তো আর আমাদের অমন ভোজ খাওয়ায় না।’
‘আজকাল আর খাওয়াবে কে, খাওয়াবেই-বা কী? ওই জমানাটাই ছিল আলাদা। এখন তো সবাই পয়সা বাঁচানোর ধান্দাতেই আছে। বিয়ে-সাদিতে খরচ করে না, ক্রিয়া-করমে খরচ করে না। বলি গরিবগুলানের পয়সা লুটে-লুটে রাখবি কোথায়?’
লুটবার বেলায় ক্ষ্যামা নেই, শুধু খরচের বেলাতেই যত্ত হিসাব।
‘তুমি খানবিশেক পুরি খেয়েছিলে বোধহয়? ‘বিশখানার বেশিই খেয়েছিলাম।’
‘আমি হলে পঞ্চাশখানা সেঁটে ফেলতাম।’
‘খানপঞ্চাশের কম আমিও খাইনি। তাগড়া জোয়ানমদ্দ ছিলাম। তুই তো আমার আদ্দেকও নোস।’
আলু খাওয়া হয়ে গেলে দুজনেই জল খেয়ে ওখানেই আগুনের সামনে কাপড়ের খুঁট গায়ে জড়িয়ে পেটে পা গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ে। যেন দুটো বড়-বড় অজগর কুণ্ডলি পাকিয়ে পড়ে আছে।
ওদিকে বুধিয়া সমানে ঝাঁকিয়ে চলেছে।
সকালে ঘরে ঢুকে মাধব দেখে বউটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ওর মুখের উপর মাছি ভন করছে। উপরদিকে চেয়ে রয়েছে পাথরের মতো স্থির নিশ্চল দুটি চোখ। সমস্ত শরীর ধুলোয় মাখামাখি। ওর পেটে বাচ্চাটা মরে গেছে।
মাধব ছুটতে-ছুটতে ঘিসুর কাছে যায়। তারপর দুজনে জোরে-জোরে হাহাকার করতে-করতে বুক চাপড়াতে থাকে। পাড়াপড়শিরা কান্নাকাটি শুনে ছুটতে-ছুটতে আসে এবং চিরাচরিত রীতি অনুসারে এই হতভাগা দু’জনকে সান্ত্বনা দেয়।
কিন্তু বেশি কান্নাকাটির সময় নেই। শবাচ্ছাদনের নতুন কাপড় আর কাঠের ভাবনা ভাবতে হবে। এদিকে ঘরে পয়সা তো যেমন চিলের বাসায় মাংস তেমনি শূন্য।
বাপ-বেটা দুজনে কাঁদতে-কাঁদতে গায়ের জমিদারের কাছে যায়। উনি এই দুজনের মুখই দেখতে পারেন না। বারকয়েক এ দুজনকে নিজের হাতে পিটুনি দিয়েছেন চুরি করেছে বলে কিংবা কথা দিয়ে ঠিকমতো কাজে আসেনি বলে। জিজ্ঞেস করেন—’কী হয়েছে রে ঘিলুয়া, কাঁদছিস কেন? আজকাল তো কোথাও তোর দেখা মেলা ভার। মনে হচ্ছে যেন এ গাঁয়ে থাকার ইচ্ছে নেই তোর।‘
ঘিসু মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে জলভরা চোখে বলে—’কত্তামশায় গো! বড় বিপদে পড়েছি! মাধবের বউটা কাল রাতে মরে গেছে। সারাটা রাত ছটফট করেছে কত্তা! আমরা দুজন ওর শিয়রে বসে ছিলাম। ওষুধবিমুদ যদুর পেরেছি, সব করেছি। তবুও বউটা আমাদের দাগা দিয়ে গেল, কত্তা। একখানা যে রুটি করে খাওয়াবে এমন কেউ আর রইল না। কত্তাবাবু! একেবারে পথে বসেছি। সংসারটা ছারখার হয়ে গেল, হুজুর। হুজুরের গোলাম আমরা। এ-বিপদে হুজুর আপনি ছাড়া কে ওর ঘাটের দায় উদ্ধার করবে? আমাদের হাতে যা কিছু দু-চার পয়সা ছিল, সব ওষুধ আর পথ্যিতে শেষ হয়ে গেছে। হুজুর যদি দয়া করেন তাহলেই ওকে ঘাটে তুলতে পারব। আপনি ছাড়া আর কার দোরে গিয়ে হাত পাতব, হুজুর!’
জমিদারবাবু দয়ালু। তবে ঘিসুকে দয়া করার মানে তো ভস্মে ঘি ঢালা। ইচ্ছে হল বলে দেন–ভাগ, দূর হ সামনে থেকে। এমনিতে তো ডেকে পাঠালেও আসিস না। আজ গুরজ পড়েছে, তাই এসে খোশামোদ করছিস। হারামদাজা, বদমাস কোথাকার! কিন্তু রাগ করার বা সাজা দেয়ার সময় এখন নয়। মনে-মনে গজগজ করতে-করতে দুটো টাকা বের করে ছুঁড়ে দেন। সান্ত্বনার একটি কথাও মুখ দিয়ে বের হয় না। ওদের দিকে ফিরেও তাকান না, যেন কোনোমতে ঘাড় থেকে আপদ দূর করেন।
জমিদারমশাই যখন দু’টাকা দিয়েছেন, তখন গাঁয়ের বেনে মহাজনেরা নিষেধ করে কী করে! ঘিসু জমিদারের নামের ঢাক পেটাতেও খুব ওস্তাদ! ওরা কেউ দেয় দু’আনা, কেউ চার আনা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ঘিসুর হাতে টাকাপাঁচেকের মতো পুঁজি যোগাড় হয়ে যায়। এছাড়া কেউ গমটম দেয়, কেউ-বা কাঠ। তারপর দুপুরবেলা ঘিসু আর মাধব বাজার থেকে কফনের জন্য নতুন কাপড় আনতে যায়। এদিকে অন্যরা বাঁশ কাটতে শুরু করে।
গায়ের কোমলমনা মেয়েরা এসে মৃতাকে দেখে, বেচারির অসহায় অবস্থার কথা ভেবে দুফোঁটা চোখের জল ফেলে চলে যায়।
বাজারে এসে ঘিসু বলে–’ওকে জ্বালানোর মতো কাঠ তো যোগাড় হয়ে গেছে, তাই না রে মাধব?’
মাধব বলে—’হ্যাঁ, কাঠ তো অনেক হয়েছে, এখন কফন হলেই হয়।’
‘তাহলে চল সস্তা দেখে একখানা কফন কিনে নিই।‘
‘হ্যাঁ, তাছাড়া আর কী? মড়া তুলতে-তুলতে রাত হয়ে যাবে। রাতের বেলায় কফন অত কে দেখতে যাচ্ছে?’
‘কেমনতর যে বাজে নিয়ম সব, বেঁচে থাকতে গা ঢাকার জন্য একখানা ঘেঁড়া তেনাও
যে পায়নি মরলে তার নতুন কফন চাই।
‘কফনটা তো মড়ার সঙ্গেই পুড়ে যায়।’
‘তা না তো কি থেকে যায় নাকি? এই টাকা পাঁচটা আগে পেলে বউটাকে একটু ওষুধ-পথ্যি খাওয়াতে পারতাম।’
দুজনেই দুজনের মনের কথাটা টের পাচ্ছে। বাজারে এখানে-ওখানে ঘুরছে তো ঘুরছেই। কখনো এ দোকানে, কখনো ও-দোকানে। নানা রকমের কাপড়-রেশমি কাপড়, সুতি কাপড় সব দেখে, কিন্তু কোনোটাই পছন্দ হয় না। এই করতে-করতে সন্ধ্যা নামে। তখন দুজনেই এক দৈবী প্রেরণাবশে একটি পানশালার দরজায় এসে দাঁড়ায়, তারপর প্রায় পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা মতো ভেতরে ঢুকে পড়ে। ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণ দুজনে অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর গদির সামনে গিয়ে ঘিসু বলে–’সাহজী, এক বোতল আমাদেরকেও দিন।’
এরপর কিছু চাট আসে, মাছভাজা আসে, আর ওরা দুজনে বারান্দায় বসে নিশ্চিন্ত মনে মদ গিলে চলে।
কয়েক ভাড় তড়বড় করে গেলবার পর দুজনেরই একটু-একটু নেশার আমেজ আসে। ঘিসু বলে–কফন দিলে হতটা কী? শেষঅব্দি পুড়েই তো যেত। বউয়ের সঙ্গে তো আর যেত না।’
মাধব আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন সব দেবতাকে তার নিষ্পাপ কাজের সাক্ষী মেনে বলে—’দুনিয়ার দস্তুরই যে এই, নইলে লোকে বামুনঠাকুরদের হাজার-হাজার টাকাই-বা দেয় কেন? কে দেখছে, পরলোকে কী পাচ্ছে না-পাচ্ছে।’
বড়লোকদের হাতে পয়সা আছে, ইচ্ছে হলে ওড়াক গে। আমাদের কাছে উড়িয়ে দেয়ার মতন আছেটা কী!
কিন্তু ওদের সবাইকে কী বলবি? ওরা জিজ্ঞেস করবে-না কফন কই? ঘিলু হাসে—’আরে ধ্যাৎ, বলব টাকা ট্যাক থেকে কোথায় যে খসে পড়ে গেছে, অনেক খুঁজেছি, পাইনি। ওরা বিশ্বাস করবে না ঠিকই, তবু ওরাই আবার টাকা দেবে।’
মাধবও হেসে ফেলে; এই অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যে বলে–’আহা! বড় ভালো ছিল গো বেচারি! মরেও খুব খাইয়ে গেল।
আধ বোতলের ওপর শেষ হয়ে যায়। ঘিষু দুসের পুরি আনিয়ে নেয়। সঙ্গে চাটনি, আচার, মোটর কারি। গুঁড়িখানার সামনেই দোকান। মাধব ছুটে গিয়ে দুটো ঠোঙায় করে সব জিনিস নিয়ে আসে। পুরো দেড়টি টাকা আরও খরচ হয়ে যায়। হাতে শুধু ক’টা পয়সা বাকি থাকে।
দুজনে এখন খোশমেজাজে বসে পুরি খাচ্ছে, দেখে মনে হচ্ছে যেন বনের বাঘ বনে বসে তার শিকার সাবাড় করছে। না-আছে জবাবদিহি করার ভয়, না-আছে বদনামের ভাবনা। এসব ভাবনাচিন্তাকে ওরা অনেক আগেই জয় করে নিয়েছে।
ঘিসু দার্শনিকের মতো বলে–এই যে আমাদের আত্মা খুশি হচ্ছে, এতে কি বউ আনন্দ পাবে না?
মাধব ভক্তিতে মাথা নুইয়ে সায় দেয়–‘খুব পাবে, আলবৎ পাবে। ভগবান, তুমি অন্তযামী। ওকে সগৃগে নিয়ে যেও। আমরা দুজনে মন খুলে আশীৰ্বাদ করছি। আজ যে খাওয়াটা খেলাম অমনটা সারাজীবনে কোনোদিন কপালে জোটেনি।
খানিক বাদে মাধবের মনে একটা সন্দেহ জাগে। বলে–’আচ্ছা বাবা, আমরাও তো একদিন ওখানে যাব।’
ঘিসু এই সোজা সহজ প্রশ্নটার কোনো জবাব দেয় না। পরলোকের কথা ভেবে এই আনন্দটাকে মাটি করতে চায় না সে।
‘যদি ও ওখানে আমাদের জিগ্যেস করে তোমরা আমাকে কফন দাওনি কেন, তাহলে কী বলবি?’
বলব, তোর মুণ্ডু।’
‘জিগ্যেস তো ঠিকই করবে।’
‘তোকে কে বলেছে যে ও কফন পাবে না? তুই কি আমাকে অমন গাধা ঠাউরেছিস? ষাটটা বছর কি দুনিয়াতে ঘোড়ার ঘাস কেটে আসছি। বউ কফন ঠিকই পাবে আর এর থেকে অনেক ভালো পাবে।’
মাধবের বিশ্বাস হয় না। বলে–’দেবেটা কে? পয়সা তো তুই খেয়ে ফেলেছিস। ও তো আমাকেই জিগ্যেস করবে। ওর সিথেয় সিঁদুর যে আমিই পরিয়েছি।’
ঘিসু গরম হয়ে বলে–’আমি বলছি ও কফন পাবে। তোর পেত্যয় হচ্ছে না কেন?
‘দেবেটা কে বলছিস-না কেন?
ও লোকগুলানই দেবে যারা এবার দিয়েছে। হ্যাঁ, তবে এর পরের টাকাটা আর আমাদের হাতে আসবে না।
যেমন অন্ধকার বেড়ে চলে, আকাশের তারাগুলোর দীপ্তি বাড়ে, মদের দোকানের রঙতামাশাও তেমনি বাড়তে থাকে। কেউ গান গায়, কেউ ডিগবাজি খায়, কেউ-বা তার সাথীর গলা জড়িয়ে ধরে। কেউ তার ইয়ারের মুখে মদের ভাড় তুলে দেয়।
এখানকার পরিবেশে মাদকতা, হাওয়াতে নেশা। কত লোক তো এখানে এসে এক টোক খেয়েই মাতাল হয়ে পড়ে। মদের থেকেও বেশি এখানকার হাওয়া ওদের নেশা ধরায়। জীবনের দুঃখ-কষ্ট ওদের এখানে টেনে আনে। কিছু সময়ের জন্য ওরা ভুলে থাকে ওরা বেঁচে আছে না মরে গেছে। নাকি বেঁচেও নেই, মরেও নেই।
বাপ-বেটা দুজনে এখনো মৌজ করে-করে চুমুক দিয়ে খাচ্ছে। সবার নজর ওদের দুজনের ওপর। কী ভাগ্য দুজনের! পুরো একটা বোতল ওদের মাঝখানে! পেট ভরে খেয়ে মাধব বেঁচে যাওয়া পুরির ঠোঙাটা নিয়ে গিয়ে একটি ভিখারিকে দিয়ে দিল।
ভিখারিটি দাঁড়িয়ে ওদের দিকে ক্ষুধাতুর চোখে তাকাচ্ছিল। দেয়ার গৌরব, আনন্দ আর উল্লাসে মাধব জীবনে এই প্রথম অনুভব করে।
ঘিসু বলে–’নে রে, যা ভালো করে খা আর আশীৰ্বাদ কর। যার দৌলতে খাওয়া ও তো মরে গেছে। তবু তোর আশীৰ্বাদ ওর কাছে পৌঁছবে। মন খুলে পরান খুলে আশীৰ্বাদ কর, বড় কষ্টের রোজগারের পয়সা রে!
মাধব আবার অকাশের দিকে তাকিয়ে বলে–ও ঠিক বৈকুণ্ঠে যাবে গো বাবা, ও বৈকুণ্ঠের রানী হবে।’
ঘিসু উঠে দাঁড়িয়ে যেন উল্লাসের তরঙ্গে সাঁতরাতে-সাঁতরাতে বলে–’হ্যাঁ বাবা, বৈকুণ্ঠেই যাবে বৈকি। কাউকে কষ্ট দেয়নি, দুখখু দেয়নি। মরতে-না-মরতে আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সাধটি পুরিয়ে দিয়ে গেছে। ও যদি বৈকুণ্ঠে না-যাবে তো কি ওই ধুমসো-ধুমসো লোকগুলো যাবে যারা গরিবগুলোনরে দুহাতে লুটছে আর নিজেদের পাপ ধুয়ে ফেলতে গঙ্গায় গিয়ে চান করছে, মন্দিরে পুজো দিচ্ছে!’
ভক্তিশ্রদ্ধার এই অনুভূতিটি তাড়াতাড়ি বদলে যায়। অস্থিরতাই নেশার বৈশিষ্ট্য, এর পর দুঃখ আর হতাশা মনে ভর করে।
মাধব বলে–’বাবা, বেচারি কিন্তু জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছে। মরল, তা-ও কত যন্ত্রণা সয়ে।’
বলে চোখে হাত-চাপা দিয়ে কাঁদতে শুরু করে দেয়। ভেউ-ভেউ করে কেঁদে ওঠে। ঘিলু বোঝায়–কাঁদছিস কেন বাবা, আনন্দ কর। বউ এই মায়া থেকে ছুটি পেয়ে গেছে। এই জঞ্জাল থেকে রেহাই পেয়েছে। বড় ভাগ্যিমানী ছিল রে, তাই তো এত তাড়াতাড়ি মায়ামমতা কাটিয়ে চলে গেছে।’
তারপর দুজনে উঠে দাঁড়িয়ে গান গাইতে শুরু করে দেয়– ঠগিনী, কেঁয়ো নৈনা ঝমকায়ৈ। ঠগিনী!’ সব মাতাল এদের দুজনকে দেখছে। এরা দুজনে মত্ত হয়ে গান গেয়ে চলে। তারপর দুজনে নাচতে শুরু করে দেয়। লাফ দেয়। ঝাঁপ দেয়। পড়েও যায়। উঠে হেলেদুলে। চলে। কতরকম ভাবভঙ্গি করে। অভিনয় করে। তারপর শেষ পর্যন্ত নেশায় চুরচুর হয়ে ওখানেই টলে পড়ে যায়।