অধ্যায় ৮৫
সকাল থেকে আলভীকে অনেক বার ফোন করেও তার ভ্রমণ সঙ্গিরা পায়নি তাকে। এমন কি যে মেয়েটাকে নিয়ে গেছে তাকেও ফোন করে ব্যর্থ হয়েছে।
গত রাতে আলভীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু শাকিল চৌধুরি একটা বাজে কাজ করেছে। নায়িকা খুকুমনিকে ভোগ করার খায়েশ মেটাতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল। কোকেন নেবার পর মাথা আউলে যায় তার, রগ রগে ব্যাপারগুলো ফোনের ক্যামেরায় ধারণ করার খায়েশ জাগে। বাঁধ সাধে মেয়েটা, এ নিয়ে শুরু হয় বাক্-বিতণ্ডা। এক পর্যায়ে খুকুমনিকে চড় মেরে বসে শাকিল, চুলের মুঠি ধরে মারধর করার চেষ্টা করে।
কিন্তু এই মেয়ে আলাভোলা, সহজ-সরল কেউ না। মেজাজ হারালে সে- ও বাঘিনি হয়ে ওঠে। আক্রান্ত হয়ে সেই নায়িকা তার আক্রমণকারির বিচিতে কঠিন থাবা বসায়, আর তাতেই কুপোকাত হয়ে পড়ে শাকিল। বাকিরা বাইরে থেকে তার গগনবিদারী চিৎকারটা শোনার পরই ছুটে যায় বন্ধ দরজার দিকে। ধাক্কাধাক্কি করার পর বিধ্বস্ত খুকুমনি দরজা খুলে দিলে সবাই দেখতে পায় শাকিল চৌধুরি চোখ উল্টে মার্বেল ফ্লোরে চিৎ হয়ে পড়ে আছে।
প্রথমে তারা ভেবেছিল লোকটা বুঝি মরে-ই গেছে কিন্তু পরে দেখে শ্বাস- প্রশ্বাস চলছে। মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরায় নারীলোলুপ লোকটির। এরপরই বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কান্নাকাটি করতে শুরু করে দেয়। তার নাকি প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে, দম বেরিয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত সাধের অণ্ডকোষদুটো আর অক্ষত নেই। শেষ রাতে বায়না ধরে হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য।
এই আইল্যান্ডে হাসপাতাল না থাকলেও একটা টোয়েন্টি-ফোর/সেভেন ক্লিনিক আছে, সেখানকার ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাওয়া যেতো কিন্তু আলভীকে ফোন করে ঘটনাটা জানালে সে সোজা না করে দেয়। ক্লিনিকে গেলে এই ঘটনা রিপোর্ট হয়ে যাবে পুলিশের কাছে।
আলভীর কথা-ই ঠিক, শাকিলের আসলে তেমন কিছু হয়নি-অণ্ডকোষে প্রচণ্ড ব্যথা হওয়া ছাড়া। সারা রাত নেড়ি কুকুরের মতো কু কু করে কেঁদেছে আর খুকুমনির চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেছে। জাহান গ্রুপের সিইও”র নির্দেশে খুকুমনিকে আলাদা ঘরে নিরাপদে রাখা হয়। সকালে এসে আলভী নিজে ব্যাপারটা দেখবে বলেছিল কিন্তু তার থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে রুহুল নামের এক সহকারি ফ্লোটিং ভিলায় গিয়ে খোঁজ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
সঙ্গিদের মধ্যে একজন এই বলে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে, সম্ভবত অনেকদিন পর কোকেন পেয়ে আলভী খুব বেশি বেশি নিচ্ছে কি না কে জানে! সমুদ্রের উপরে নির্জন ফ্লোটিং ভিলায় গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত নিয়ে ফেললে বিপদে পড়ে যাবে তারা। ড্রাগ ওভারডোজের কেস হলে তো সর্বনাশ! এসব শুনে আলভীর এখানকার এক সহকারি রুহুল সকাল সকাল একটা বোট নিয়ে চলে এলো সি-হর্স নামে পরিচিত ভাসমান ভিলায়।
“স্যার?” সুনশান গ্রাউন্ড লেভেলে দাঁড়িয়ে রুহুল ডাকলো। “হ্যালো স্যার?”
কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সিঁড়ি দিয়ে আন্ডারওয়াটার লেভেলে চলে গেল সে। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ ডিঙানোর সময় তার বুক ধুকপুক করতে লাগলো। ভালো করেই জানে সকালের এ সময়টায় তাদের সিইও ঘুমিয়ে আছে, এমন সময় ডাকাডাকি করলে রেগে যাবে, তারপরও ঝুঁকিটা নিয়েছে সে।
নিচের ল্যান্ডিংয়ে এসে বেডরুমের দরজায় আলতো করে নক করলো দু বার। “স্যার, আছেন?” ভেতর থেকে নারী কণ্ঠের একটা গোঙানি শুনতে পেলো, বুঝতে পারলো না নক করা ঠিক হবে কি না। কোন অবস্থায় আছে কে জানে! একবার ভাবলো ফিরে যাবে কিন্তু মেয়েটার গোঙানি কেমনজানি লাগছে। অজানা আশঙ্কা জেঁকে বসলো তার মধ্যে, দরজার নব ধরে মোচড় দিলো। ভেতর থেকে লক্ করা নেই!
দরজা খুলে যেতেই নারী কন্ঠের চিৎকারটা কাঁপিয়ে দিলো পুরো নিচতলা। এতক্ষণ ধরে মেয়েটা চিৎকার করে গেলেও সাউন্ডপ্রুফ হবার কারণে খুব বেশি শব্দ বাইরে যায়নি।
রুহুল দেখতে পেলো বিছানায় পুরোপুরি নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে সেই মডেল মেয়েটি, তার এক হাত বিছানার হেডবোর্ডের সঙ্গে হ্যান্ডকাফ দিয়ে আটকানো। প্রাণপনে চিৎকার করছে আর কাঁদছে!
“ম্যাডাম!” বলেই বিছানার দিকে এগিয়ে যাবে অমনি থমকে দাঁড়ালো সে। চোখের সামনে যে দৃশ্যটা দেখতে পেলো সেটা যেমন ভয়ঙ্কর তেমনি গা শিউরে ওঠার মতো।
“হায় আল্লাহ!” একটা চিৎকার দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো রুহুল।
অ্যাকুরিয়াম বেডরুমের বিশাল কাচের ওপাশে জাহান গ্রুপের সিইও আলভী করিমের মৃতদেহটা পানিতে ভাসছে! তার হাত পেছনমোড়া করে একটা হ্যান্ডকাফ দিয়ে বাঁধা!
অধ্যায় ৮৬
দুবাই এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসে আছে বাস্টার্ড।
ঢাকাগামী ফ্লাইটটা আরো এক ঘণ্টা পর ছাড়বে কিন্তু কিসিঞ্জার তাকে রীতিমতো জোর করে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে।
রাতের বেলায় অনলাইন থেকে বেশ চড়া দামে টিকেট কেটে রেখেছিল লোকটা। এর আগেই তাকে বলেছিল, আজকের মিশন সফল হোক আর ব্যর্থ, ওয়ার্ল্ড আইল্যান্ড ছেড়ে চলে যেতে হবে পরদিন সকাল সকাল, সেজন্যে চেকআউটও আগেভাগে করে ফেলেছিল কিন্তু টিকেটটা সম্ভবত ভিলায় ফিরে গিয়ে করেছে।
হাসপাতালে যাবার পথে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে তাদের কথা হয়, তখনই তাকে জানায় তার জন্য এয়ার টিকেট করা আছে, হোয়াটসঅ্যাপে সেটার পিডিএফ কপি পাঠিয়েও দিয়েছে, সে যেন দেরি না করে এক্ষুণি চলে যায়, তার সঙ্গে হাসপাতালে যাওয়ার কোনো দরকার নেই।
অবাক হয়েছিল সে। প্রথমে ভেবেছিল লোকটার শরীর সত্যি সত্যি খারাপ। আইল্যান্ড ছাড়ার আগে কিসিঞ্জারের হাসি দেখেও বুঝতে পারেনি। এই লোক তো সারাক্ষণই হাসে! একটা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গেছিল সে, তার সেই বিভ্রান্তি দূর হয়ে যায় অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে কথা বলে।
সব শুনে মনে মনে লোকটার বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারেনি।
সহজ আর কার্যকরী একটা বুদ্ধি : ক্যান্সারের টার্মিনাল স্টেজে থাকা একজন রোগি হিসেবে দুবাইর একটি হাসপাতালে নিয়মিত চিকিৎসা নেয়। ভোরের দিকে যখন তাকে ফ্লোটিং ভিলায় দেখতে পায় তখনই ইমার্জেন্সিতে ফোন দিয়ে বলে, তিন দিন ধরে ওয়ার্ল্ড আইল্যান্ডে আছে, একটু আরাম করার জন্য এসেছিল, হুট করে এখন খুব খারাপ লাগছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার, হাঁটাচলা করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। তারা যেন এক্ষুণি একটা ওয়াটার-অ্যাম্বুলেন্সে পাঠিয়ে দেয়।
কিন্তু রাতের ঐ সময়ে ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে দেরি হবে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোস্টাল-পেট্রল টিমকে অনুরোধ করে অসুস্থ একজনকে নিয়ে আসার জন্য। কোস্টাল-পেট্রল টিমের একটি ওয়াটার- ট্যাক্সি সেই কাজটাই করেছে।
কিসিঞ্জার আসলে কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি। তার হিসেবটা সহজ ছিল : ভোরের দিকে কাজটা করবে বাস্টার্ড, এরপর চার-পাঁচ ঘণ্টা থাকতে হবে ওয়ার্ল্ড আইল্যান্ডে। এই সময়ের মধ্যে কোনোভাবে যদি আলভীর খুন হওয়ার কথাটা জানাজানি হয়ে যায় তাহলে দ্বীপ ছেড়ে বের হবার উপায় থাকবে না। সঙ্গত কারণেই পুলিশ এসে খতিয়ে দেখবে সবকিছু। প্রথমেই দ্বীপের সব গেস্টকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে তারা। তখন যদি দেখে ভিক্টিমের স্বদেশি আরো দুজন আছে এখানে তখন সন্দেহের তীর তাদের উপরেই বিদ্ধ হবে, ইন্টেরোগেশন আর তদন্তের মধ্যে পড়ে যাবে তারা, পুলিশের সন্দেহের তালিকা থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত দুবাই ছাড়তে পারবে না।
সেটা যদি না-ও হতো, অন্য একটা বিপদ ছিল। তারা চলে যাওয়ার পর খুনের কথাটা জানাজানি হলে পুলিশ সবার আগে সন্দেহ করতো যারা সকালে দ্বীপ ছেড়ে চলে গেছে তাদেরকে। সেক্ষেত্রে তারা দুজন সন্দেহের শীর্ষে থাকতো। কিন্তু অসুস্থ একজন রোগি ভোরের আগে দিয়ে কোস্টাল- পেট্রল টিমের সাহায্যে দ্বীপ ছেড়েছে-এমন তথ্য কিছু সময়ের জন্যে হলেও তাদের দিক থেকে সন্দেহের তীরটা সরিয়ে দেবে।
সত্যি বলতে, কিসিঞ্জারের বুদ্ধিটা যে দুর্দান্ত ছিল এখন বুঝতে পারছে। মনে মনে প্রার্থনা করলো, মানুষটার শেষ দিনগুলো যেন একটু শান্তিতে কাটে। অ্যাম্বুলেন্সটা হাসপাতালে পৌঁছাতেই তাকে এয়ারপোর্টে পাঠিয়ে দিয়েছে লোকটা, সেজন্যে ধন্যবাদও দিতে পারেনি।
একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো তার ভেতর থেকে। আর কখনও দেখা হবে না এই মানুষটার সঙ্গে। বড়জোর এক মাস বেঁচে থাকতে পারে। এদিকে দুবাইতেও সম্ভবত কখনও আসা হবে না তার। ভালোমতো ইনভেস্টিগেট করলে কাজটা কে করেছে সেটা বের করা কঠিন কিছু হবে না। দুবাইর কর্তৃপক্ষ তাদের জিরো ক্রাইম সিটির সুনামটি ধরে রাখার জন্য দুনিয়ার সেরা ইনভেস্টিগেটর নিয়ে আসবে। বলা যায় না, আলভী হত্যার বিস্তারিত তদন্তের পর কর্তৃপক্ষ সন্দেহভাজন হিসেবে তার নামে রেড নোটিশ দিয়ে রাখতে পারে এয়ারপোর্টে, পা দেয়া মাত্রই গ্রেফতার করা হতে পারে তাকে।
পিএ সিস্টেমে তার ফ্লাইট নাম্বারটা ঘোষণা করা হলে উঠে দাঁড়ালো সে। ছোট্ট একটা ব্যাকপ্যাক নিয়ে সারিবন্ধ মানুষের সঙ্গে এগিয়ে গেল আস্তে আস্তে। তার দ্বিতীয় লাগেজটা কাশিমের কাছে আছে, ওটা নেয়া সম্ভব হয়নি।
দুবাই মিশনটা যে এভাবে শেষ হবে, শুরুতে অতোটা আশা করেনি সে। সে শুধু দেখতে চেয়েছিল আলভীকে বাগে নেবার সুযোগ পায় কি না। নিজেকে পরিস্থিতিটার মধ্যে নিক্ষেপ করতে চেয়েছিল। ভালো করেই জানতো, ঘটনার মধ্যে ঢুকে পড়লে অনেক পথই বের হয়ে আসবে। আর সেটাই হয়েছে। জিরো-ক্রাইম-সিটিতে একটা খুন করে নির্বিঘ্নে চলে যাচ্ছে এখন।
তার অন্য কাজগুলোর চেয়ে এটা সব দিক থেকেই আলাদা। একটা অস্ত্রও ব্যবহার করেনি, একটা ঘুসিও দিতে হয়নি। স্রেফ ক্লোরোফর্মের স্প্রে ব্যবহার করে আলভীকে অচেতন করে ফেলেছিল। এরপর বেডরুম গিয়ে মেয়েটার এক হাতের হ্যান্ডকাফ খুলে নিয়ে আসে। চাবিটা বেডসাইড টেবিলের উপরেই ছিল। আলভীর দু হাত পেছন মোড়া করে বেঁধে ফেলে সেটা দিয়ে। অচেতন লোকটাকে কাঁধের উপরে তুলে নিয়ে উঠে আসে গ্রাউন্ড লেভেলে, ফ্লোটিং ভিলার পশ্চিম দিকের প্রান্তসীমায় গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে সে, আস্তে করে হাত-বাঁধা আলভীর অচেতন শরীরটা আরব সাগরে ফেলে দেয়।
পানিতে তলিয়ে যাবার পর পরই জ্ঞান ফিরে এসেছিল সম্ভবত কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। একে তো কোকেনে বুঁদ হয়ে ছিল, তার উপরে হাতদুটো বাঁধা- এমন অবস্থায় কিছুই করা সম্ভব হয়নি। তারপরও ঘড়ি ধরে পুরো তিন মিনিট অপেক্ষা করেছে, পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে রোয়িং বোটটা নিয়ে রওনা দিয়েছে ফ্লোটিং ভিলা থেকে।
প্লেনে ওঠার পর জানালার কাছে সিট পেয়ে বসে পড়লো বাস্টার্ড। এতক্ষণে সম্ভবত আলভীর মৃত্যুর খবরটা জানাজানি হয়ে গেছে। যদি তাই হয়, কতোক্ষণ লাগবে এয়ারপোর্টে অ্যালার্ট জারি করতে? বিমানে যারা উঠে গেছে তাদেরকেও কি তল্লাশী করা হবে? টেকঅফ করার জন্য যেসব বিমান টারমার্কে আছে, সেগুলোও কি তল্লাশীর আওতায় পড়বে?
এ কাজ করতে গেলে যে বিপুল পরিমাণ লোকবলের দরকার হবে সেটা হুটহাট জোগাড় করা সম্ভব নয়। ব্যস্ততম একটি বিমানবন্দর হিসেবে এখানে এই কাজ করতে গেলে এয়ার ট্রাফিকিং সিস্টেম পুরোপুরি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে। শত শত ফ্লাইট ডিলে হবে ঘন্টার পর ঘন্টা।
দুবাইর কর্তৃপক্ষ এত বড় ঝুঁকি নেবে না। সবাই মনে করবে টেররিস্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা করছে বুঝি। আবার যদি বলা হয় একজন খুনিকে ধরার জন্য এটা করা হচ্ছে, সেটাও কম আতঙ্কের বিষয় হবে না। মাঝখান থেকে জিরো ক্রাইম সিটির সুনামটা বিনষ্ট হবে। শেখ পরিবারের কেউ হলেও না হয় কথা ছিল, ভিনদেশের এক ধনীর দুলালের হত্যাকাণ্ড নিয়ে তারা খুব বেশি কিছু করবে না।
তাছাড়া খুনটা ওদের নিজেদের মধ্যে কেউ করেছে কি না সেটা নিয়েও পুলিশ ব্যস্ত থাকবে, শুরুতে বাইরের কাউকে সন্দেহ করবে না।
নিশ্চিন্ত হয়ে হেলান দিয়ে বসলো বাস্টার্ড। বিমানে যাত্রিরা উঠছে, ধীরে ধীরে ভরে যাচ্ছে সিটগুলো। আর মাত্র সাড়ে পাঁচ ঘন্টা পরই সে চলে যাবে ঢাকায়। গভীর করে শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করলো। বক বক করে আর বেশি নড়াচড়া করে এমন সহযাত্রি না পেলে নিজেকে আরেকটু ভাগ্যবান মনে করবে আজ।
কিছুক্ষণ পর সিটবেল্ট বাঁধার এনাউন্সমেন্টটা হতেই চোখ খুলল বাস্টার্ড, নিজের সিট বেল্টটা বাঁধতে যাবে অমনি চোখের কোণ দিয়ে কিছু একটা দেখতে পেয়ে চমকে তাকালো।
পাশের সিটে কিসিঞ্জার বসে আছে, তার মুখে মিটিমিটি হাসি। “…খুব ইচ্ছা, দেশের মাটিতে মরবো।”
অধ্যায় ৮৭
হোমিসাইডে যোগ দেবার পর থেকেই নিজেকে কাজের মধ্যে ব্যস্ত রেখেছে জেফরি বেগ।
লাঞ্চের পর নিজের অফিসের ডেস্কে ফিরে এসে সোনিয়া হত্যা তদন্তের একটি ফাইলে চোখ বুলাচ্ছে। কাজের অগ্রগতি বেশ আশাব্যঞ্জক। সময়টা বিবেচনায় নিলে, এত দ্রুত আর কম সময়ে যে অগ্রগতি হয়েছে সেটাকে বাহবা দিতেই হয়। রেবার দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটা না ঘটলে, এ কয়টা দিন কাজ থেকে বিরত না থাকলে হয়তো আরো বেশি অগ্রগতি হতো।
রেবার দুর্ঘটনার একটা নিয়মিত মামলা করেছে পুলিশ। সত্যি বলতে ওর বড় ভাই জানেও না বোনের সঙ্গে আসলে কী হয়েছে। জানলেও মামলা- মোকদ্দমায় যেতো কি না সন্দেহ। মামলা করলেও সেটা হতো অনাথ মামলা! কেউ তার খোঁজ রাখতো না। এসব কারণে প্রথম থেকেই রেবার হত্যা নিয়ে ওদের পরিবারের কারোর সঙ্গে কথা বলেনি। হোমিসাইডের বাইরে দিলান মামুদ ছাড়া আর কেউ জানেও না এটা।
বাবলু জানে!
নামটা তার মাথায় উচ্চারিত হতেই উদাস হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য।
ছেলেটা এখন কোথায় আছে জানে না। কায়সার আর দিলান মামুদের কাছ থেকে যে তথ্য পেয়েছে, তাতে করে এটা নিশ্চিত, আলভী দুবাইতেই আছে এখন। কায়সারের দেয়া তথ্যকে সে খুব একটা আমলে নেয়নি কিন্তু দিলান মামুদকে অগ্রাহ্য করার কোনো কারণ নেই।
আলভী যদি দুবাইতে গিয়ে থাকে তাহলে কি বাবলুও সেখানে আছে? কিন্তু দুবাই সম্পর্কে যতোটুকু খোঁজ নিয়েছে, ওখানে গিয়ে কাউকে খুন করাটা শুধু অসম্ভবই না, আত্মঘাতিও হবে। ওদের সার্ভিলেন্স সিস্টেম আর পুলিশিং ব্যবস্থা বিশ্বসেরা। নিজেদের শহরকে ওরা জিরো ক্রাইম সিটি হিসেবে দাবি করে। এমন ঔদ্ধত্য দেখানোর সাহস ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশগুলোও করতে পারে না।
তারপরও কথা থাকে। এত নিরাপত্তা আর নজরদারির পরও পৃথিবীর অনেক বড় বড় সন্ত্রাসী ওখানে গিয়ে আস্তানা গেঁড়েছে। ইন্টারপোলসূত্রে এরকম অনেক তথ্যই সে জানে। বাকি দেশগুলোর কথা না হয় বাদই দেয়া গেল, ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশেরও অনেক খুনি-সন্ত্রাসী-অপরাধী ওখানে গিয়ে বহাল তবিয়তে বসবাস করছে। এরকম দুয়েকজনকে চিহ্নিত করে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনার প্রচেষ্টার সঙ্গেও জেফরি বেগ জড়িত ছিল। বছরের পর বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, ওখানকার কর্তৃপক্ষ না দিয়েছে সাড়া না নিয়েছে কোনো উদ্যোগ। বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো প্রবাদটি দুবাইর বেলায়ও খাটে।
মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে আবারো নজর দিলো ফাইলের দিকে সোনিয়া হত্যাকাণ্ডের জন্য তাকে আরো কিছু শক্তিশালী প্রমাণ হাজির করতে হবে যাতে করে পৃথিবীর সবচেয়ে জাঁদরেল আর ব্যয়বহুল আইনজীবীর পক্ষেও তার মক্কেলকে রক্ষা করা সম্ভব না হয়।
ফোনটা ডেস্কের উপরেই ছিল, রিং বেজে উঠলে আনমনেই হাতে তুলে নিলো সে। “হ্যালো?”
“কেমন আছেন, মি. বেগ?” ওপাশ থেকে দিলান মামুদ বলল।
“ভালো…আপনার কী খবর?”
“ভালোই,” একটু থেমে আবার বলল, “অফিসে আছেন?”
“হুম।”
“আলভীর খবরটা মনে হয় জানেন না… অবশ্য এখনও আমাদের মেইনস্ট্রিম সেটা ব্রেক করতে পারেনি।”
ভুরু কুঁচকে গেল জেফরি বেগের। “কী হয়েছে ওর?”
ফোনের ওপাশ থেকে গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক দিলান মামুদ। “একটু আগে দুবাইতে ওর লাশ খুঁজে পেয়েছে ওখানকার পুলিশ।”
“বলেন কী!” বিস্মিত কণ্ঠে বলল জেফরি। কয়েক মুহূর্ত অদ্ভুত এক অনুভূতিতে আক্রান্ত হলো সে। রেবার খুনিকে শাস্তি দেয়া গেছে তাহলে! কিন্তু বাবলু এমন অসম্ভব কাজ করলো কিভাবে?!
বাবলুই তো করেছে, নাকি!
“হ্যালো, আছেন?”
সম্বিত ফিরে পেলো জেফরি বেগ। “হুম…আপনি কিভাবে জানলেন এটা?”
“সাংবাদিক হিসেবে কি আমার উচিত সোর্সের কথা কাউকে বলা?”
মাথা দোলালো হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটর, তারপরও খুব জানতে ইচ্ছে করছে। “না, মানে…আপনি নিশ্চিত হলেন কী করে?”
“প্রাইম মিনিস্টারের অফিসে আমার এক পরিচিত লোক আছে, ঘন্টাখানেক আগে উনি বলেছেন।”
আবারো কপালে ভাঁজ পড়লো জেফরির। সন্দেহগ্রস্ত হয়ে বলল, “উনি কী করে জানলেন এটা?”
“আহ্!” আমোদিত হবার অভিব্যক্তি দিলান মামুদের কণ্ঠে। “প্রেসিডেন্টের মেয়েজামাই শাকিল চৌধুরিও ছিল আলভীর সঙ্গে… নায়িকা খুকুমনিসহ আরো কয়েকজন আছে ওখানে…সবাইকে দুবাইর পুলিশ গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে এখন। ফরেন মিনিস্ট্রিতে ব্যস্ততা বেড়ে গেছে, বুঝলেন!”
নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো জেফরি।
“সত্যি বলতে তারপরও আমার বিশ্বাস হয়নি, মানে পুরোপুরি শিওর হইনি, সেজন্যে জাহান গ্রুপে আমার পরিচিত এক লোককে ফোন দিয়েছিলাম, ও আমাকে বলল লাঞ্চের আগে তাদের গ্রুপের টপ লেভেলের কর্মকর্তাদের মধ্যে চাপা আতঙ্ক টের পাচ্ছে তারা। কেউ কিছু বলছে না, সবার মুখ থমথমে। বিরাট কিছু যে হয়েছে বুঝতে পারছে সবাই।”
“আপনি তাহলে নিউজটা ব্রেক করবেন এখন?” কৌতুহল থেকে জানতে চাইলো জেফরি বেগ
“বিশ্বস্তসূত্র থেকে জানা গেছে…” কথাটা বলে হেসে ফেলল দিলান মামুদ। “…এভাবে একটা নিউজ তো করা-ই যেতে পারে, তাই না?”
“হুম,” সায় দিলো হোমিসাইডের জেফরি বেগ।
“শেষে বলে দেবো কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা পাওয়া যায়নি। কিংবা “এখন পর্যন্ত এই খবরের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি?”
“ওখানকার পুলিশ যদি আলভীর লাশ উদ্ধার করে থাকে, এ দেশের অতোগুলো সিটিজেনকে গ্রেফতার করে থাকে তাহলে সেটা জানা কঠিন কিছু হবে না।”
“এক্সাক্টলি!” উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল দিলান। “আর এই কাজটা আপনার জন্য খুবই সহজ।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। “আমি খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি।” “থ্যাঙ্কস…আমি এখন ল্যাপটপে ছোট্ট করে নিউজটা লিখছি, একটু পরই আপ দেবো। আশা করি তারপরই সার্কার্স শুরু হয়ে যাবে।”
“আপনাকে একটু পর ফোন দিচ্ছি আমি।”
“ওকে।”
ফোনটা রেখে কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে বসে রইলো জেফরি বেগ। কারোর মৃত্যুতে খুশি হবার মতো রুচিবোধ তার গড়ে ওঠেনি। ফাদার জেফরি হোবার্ট তাকে এই শিক্ষা দেনওনি। তিনি বিশ্বাস করতেন ঘৃণার বদলে ভালোবাসার নীতিতে। ছোটোবেলা থেকে এভাবেই বেড়ে উঠেছিল সে। ঘৃণার বদলে ভালোবাসা আদতে খৃস্টিয় নীতি। এক গালে চড় খেয়ে আরেক গাল বাড়িয়ে দেয়াটা গান্ধীবাদি দর্শন। জেফরি বেগ অবশ্য নিজ অভিজ্ঞতা থেকে অন্য কিছু শিখেছিল-ঘৃণাকে পাশ কাটিয়ে যেতে হয় অবজ্ঞাভরে। আর গালে থাপ্পড় আসার আগেই প্রতিহত করতে হয়।
কিন্তু রেবার মৃত্যু তাকে আরেকটি নতুন অভিজ্ঞতা দিয়েছে-দানবের সঙ্গে লড়াই করতে গেলে তাকে স্রেফ বধ করতে হয়, নইলে দানবের হাতে বিনাশ হয়ে যেতে হবে! তার করুণায় দাস হয়ে বেঁচে থাকতে হবে।
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল তার, সঙ্গে সঙ্গে ফোনে ইন্টারনেট কানেক্ট করলো। ফোনে সাধারণত খুব কম সময়ই নেট ব্যবহার করে সে। প্রতিদিন সকালে উঠে মেসেজ চেক করার বাতিকও তার নেই। একজন হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটর হিসেবে এ কাজগুলো তুলে রাখে দিনের শেষ দিকে, অফিস আওয়ারের পরে।
তার একটা পার্সোনাল আর একটা অফিশিয়াল অ্যাকাউন্ট আছে। প্রথমে অফিশিয়াল অ্যাকাউন্টটা ওপেন করলো-এটা হোমিসাইডের ওয়েব-সাইটে দেয়া আছে।
যেমনটা ধারণা করেছিল, নতুন একটা মেইল এসেছে, আর সেটা মাত্র এক শব্দের : ডান।
মেইলের সঙ্গে একটা ছবি অ্যাটাচড করা, সেটা ওপেন করলো জেফরি বেগ। বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো ফোনের ছোট্ট স্ক্রিনটার দিকে।
ঘিয়েরঙা পুরু কার্পেটের উপরে অচেতন হয়ে পড়ে আছে জাহান গ্রুপের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার আলভী করিম!
অধ্যায় ৮৮
কিসিঞ্জার এখন শয্যাশায়ি।
জীবনের শেষ দিনগুলো একা একা বিদেশের মাটিতে মরতে চায়নি সে। যে কয়টা দিন আছে পুরান ঢাকার বাড়িতে কাটাতে চেয়েছিল। তার আশা পূরণ হয়েছে, ফিরে এসেছে ঢাকায়।
পুরান ঢাকায় তার পৈতৃক বাড়িটা এখনও আগের মতোই আছে। অবশ্য পরিবারের একমাত্র সদস্য তার ছোটো ভাই ইমরুল ছাড়া আর কেউ নেই। বাকিরা আমেরিকায় স্থায়ি হয়েছে আরো সাত-আট বছর আগে।
তার শিয়রে বসে আছে অমূল্যবাবু। একটু দূরে, ঘরের এককোণে বুকের উপর দু হাত ভাঁজ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অমূল্যবাবুর কথিত সন্তান পার্থিব রায় চৌধুরি।
দুবাইর হাসপাতালে যাবার পর কিসিঞ্জার বলেছিল, তার এখন একটু ভালো লাগছে। মনে হয় সি-ফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল ওয়ার্ল্ড আইল্যান্ডে গিয়ে। ডাক্তাররাও চেকআপ করার পর দেখেছে রোগি মোটামুটি ঠিকই আছে, হয়তো প্যানিক্ড অ্যাটাক হয়েছিল। ক্যান্সারের টার্মিনাল স্টেজে যারা থাকে তাদের মধ্যে এমনটা হওয়া সাধারণ ঘটনা।
হাসপাতালে ঢোকার মুখেই অ্যাম্বুলেন্স থেকে বাবলুকে বিদায় করে দিয়েছিল, তখনও বলেনি দুটো টিকেট কিনেছিল সে। প্রায় আধঘণ্টার মতো হাসপাতালে থাকার পর ডাক্তারদেরকে বলে তার ফ্লাইট আছে একটু পর, শেষ দিনগুলো দেশের মাটিতেই কাটাবে। বহুদিনের চেনা ডাক্তার আর নার্সদের বিদায় জানিয়ে চলে আসে নিজের ফ্ল্যাটে, সেখান থেকে দরকারি সব কাগজপত্র ছোট্ট একটা লাগেজে ভরে বের হয়ে যায় এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।
দুবাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে আসার পর সবকিছু স্বাভাবিক দেখতে পায়। কিন্তু ততক্ষণে আলভীর লাশটা খুঁজে পাবার কথা। তার সঙ্গে একগাদা ভ্রমণসঙ্গি গেছে ওখানে, তারা নিশ্চয় দীর্ঘ সময় ধরে তাকে না পেয়ে খুঁজেছে। বুঝতে পারে ওয়ার্ল্ড আইল্যান্ডে যে একজন পর্যটক খুন হয়েছে সেই খবর চেপে যাওয়া হয়েছে দুবাইর ব্র্যান্ডনেমটি ঝুঁকিতে ফেলতে চায়নি বলে।
বাবলু তাকে প্লেনের ভেতরে দেখতে পেয়ে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছিল। ছেলেটার অমন বিস্ময়মাখা চেহারা দেখতে বেশ লেগেছিল তার। এমন জাঁদরেল একজনকে বিস্মিত করা চাট্টিখানি কথা নয়। মানুষকে বিস্মিত করার প্রবণতাটি কিসিঞ্জারের ছোটোবেলার অভ্যাস।
“আপনি যে ওখানে যাচ্ছেন জেফরি বেগ তো আপনাকে ধরবে।”
বাবলুর এমন উদ্বেগ দেখে প্রসন্নভাবে হেসেছিল সে। কথাটা মিথ্যে নয়, জেফরি বেগের কারণে আবার দুবাইতে ফিরে গেছিল কিন্তু এখন তার যে অবস্থা, হারাবার আর কিছু নেই। “এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করার অবস্থা কি আমার আছে!” দীর্ঘশ্বাসের সাথে বলেছিল। “বাবুর সঙ্গে কথা হয়েছে, উনি আমাকে বলেছেন শেষ ক”টা দিন শান্তিতে থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন।”
অমূল্যবাবুর সঙ্গে কথা হয়েছে?! কবে?
“আপনার এই ছেলেটা…” মৃদু কণ্ঠে বলল কিসিঞ্জার। …যখন প্রথম ওর কথা শুনেছিলাম বিশ্বাস করিনি…আমাকে যখন নাকানি চুবানি খাওয়ালো বুঝতে পেরেছিলাম ভুল শুনিনি,” একটু থামলো সে। “আপনার কাছ থেকে যখন শুনলাম দুবাইতে আলভীকে মারতে এসেছে, মনে হয়েছিল ছেলেটা একটু বেশি আত্মবিশ্বাসি, এই কাজ এখানে করা অসম্ভব। কিন্তু আবারো সে ভুল প্রমাণ করেছে আমাকে।” তার নিঃশব্দ হাসিটা প্রসারিত হলো।
প্রশংসাটুকু নির্বিকার মুখে গ্রহণ করলো অমূল্যবাবু। আর যার প্রশংসা করা হয়েছে সে ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো। বাস্টার্ড বুঝতে পারলো কিসিঞ্জারের সঙ্গে দুবাইতে দেখা হওয়াটা মোটেও কাকতালিয় ঘটনা ছিল না- কাকতালিয় ছিল আইনাতেরটা।
“আমার সময় শেষ, গুরু!” মুখের হাসিটা অমলিন রেখেই বলল। “আপনি যে আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন তার জন্য আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।”
অমূল্যবাবু খুব কম সময়ই আবেগ তাড়িত হয়। এ মুহূর্তে সেই বিরল ঘটনাটিই ঘটলো, আস্তে করে মরণাপন্ন লোকটির হাত ধরলো সে।
“প্রতিটি জীবিত প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে!” কথাটা বলে হাসলো কিসিঞ্জার। সেই হাসি পরিহাসের নাকি গভীর অন্তর্দৃষ্টির, বোঝা গেল না। “আমার কথা না, কোরানের কথা এটা। আমরা সবাই মরে যাবো। জীবন নামের যে সফর শুরু করি সেটা শেষ করতে হয় একদিন…কারোরটা আগে কারোরটা পরে…আমরা এসব ভুলে থাকি। হয়তো ভুলে না থাকলে জীবন অনেক বেশি কঠিন হয়ে যায়!”
মাথা নেড়ে সায় দিলো বাবু।
“জীবনের এই সফরে আমরা কতো কিছুই না করি! জঙ্গলের পশুদের মতো একে অন্যের সঙ্গে কামড়াকামড়িও করি!” হঠাৎ চুপ মেরে গেল লোকটা, তারপর গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো। “কিন্তু পরবর্তি প্রজন্মের জন্য কিছু করে যাওয়া উচিত…উচিত না, গুরু?”
অমূল্যবাবু একটা ভারি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“কারে কী কই!” পরিহাসের হাসি দেখা গেল কিসিঞ্জারের মুখে। আচমকা তার প্রমিত ভাষাটাও খেই হারিয়ে ফেলল। “আপনি তো যৌবনেই এটা করেছেন…দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন! চাইলে-ই পালিয়ে যেতে পারতেন, গর্ত করে লুকিয়ে থাকতেন কোথাও!”
কয়েক মুহূর্ত কেউ কিছু বলল না।
“আমরা যখন থাকবো না, দেশটা থাকবে, অন্য এক প্রজন্ম থাকবে। আমাদের চেনা পথঘাট চেনা পৃথিবীতে তারা হাঁটবে, খেলবে। জীবন তো আসলে রিলে রেইস, বাবু… ব্যাটনটা পরের প্রজন্মকে দিয়ে যেতে হয়!” দম ফুরিয়ে হাঁপিয়ে গেল মৃত্যুপথযাত্রি মানুষটি।
“তুমি এত কথা বোলো না তো,” আস্তে করে বলল বাবু।
প্রসন্নভাবে হেসে ফেলল কিসিঞ্জার। “বললে কী হবে? আমি এখন কিছু হওয়া না হওয়ার অনেক ঊর্ধ্বে। বলতে দেন যতোক্ষণ শ্বাস আছে!”
মাথা নিচু করে রাখলো বাবু।
“কয়েক বছর আগে, ঠিক মনে করতে পারছি না কোন এক বইতে পড়েছিলাম…সম্পদ-সম্পত্তি খারাপ মানুষের হাতে পড়লে দশের ক্ষতি, দেশের ক্ষতি। ভালো মানুষের হাতে পড়লে মহৎ কিছুর জন্ম হয়।”
অমূল্যবাবু তার স্বঘোষিত শিষ্যের দিকে তাকালো।
“আপনি কি জানেন, আমার অনেক সম্পত্তি?” পরিহাসের হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটের কোণে। “অনেকগুলো বেহাত হয়ে গেছে কিন্তু যা আছে তাও কম না। ছোটো ভাই ইমরুলকে দুটো ফ্ল্যাট আর একটা কমার্শিয়াল স্পেস দিয়ে যাবো, এর বেশি দেবো না। দরকারের চেয়ে বেশি কিছু থাকলেই মানুষের বদঅভ্যাস তৈরি হয়।” বাবুর হাতটা আরো শক্ত করে ধরলো সে। “বাকি সম্পত্তিগুলোর একটা ব্যবস্থা করতে চাই, গুরু।”
“দান করতে চাও?…কোথায়?”
“এমন একজনকে দিতে চাই, যে সম্পত্তিগুলো ভালো কাজে ব্যবহার করতে পারবে।”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো বাবু।
“দেশটা খারাপ লোক দিয়ে ভরে গেছে! ওরা সংখ্যায় এত বেশি বেড়ে গেছে…দেশটা আর নিতে পারছে না!”
বাবুর ভুরু সামান্য কুঁচকে গেল। কথাগুলোর মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করলো সে।
“দরকারি প্রাণীর সংখ্যাও যদি বেশি বেড়ে যায় শিকারী দিয়ে গণহারে হত্যা করা হয়। কেন করা হয়, গুরু? ভারসাম্য রাখার জন্য…নইলে প্রকৃতিতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। সবার ভালোর জন্য তখন নির্মম কাজটাই করা হয়, কমিয়ে আনা হয় তাদের সংখ্যা।” একটু থেমে আবার বলল, “আমার দেশে খারাপ লোকের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে, এখন সেটা কমিয়ে আনতে হবে! কন্ট্রোল করতে হবে!”
অমূল্যবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “এ কাজ তো আগেও করা হয়েছে, লাভ হয়নি।”
“ক্লিনহার্টের কথা বলছেন? ক্রসফায়ার?” তাচ্ছিল্যের হাসি দেখা গেল তার ঠোঁটে। “পুঁটিমাছ ধরেছে…রুই-কাতলারা নাকে তেল দিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে…আপনি তো সবই জানেন!”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল বাবু। এ দেশে ভালো কোনো প্রচেষ্টাই ঠিকঠাকভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি এখন পর্যন্ত
“দয়া করে মৃত্যুপথযাত্রির প্রলাপ ভাববেন না। এখনও প্রলাপ বকতে শুরু করিনি…হুঁশ-জ্ঞান আছে আমার,” বলল সে। “যাদের কথা বলছি তারা আমার চেয়েও ভয়ঙ্কর মানুষ! আমিও ঐসব খারাপদের সঙ্গেই ছিলাম। ওদেরকে শেষ করতে না পারলে এই দেশের বিপদ আছে! আমি চাই এরকম একটা কাজে আমার একটু অবদান থাকুক।”
স্থিরচোখে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো বাবু তবে মুখ ফুটে কিছু বলল না।
“দানবদের বিনাশ করতে হয়। এ দেশে অনেক দানব পয়দা হয়ে গেছে, বাবু! ওদের কাউকে কাউকে বিনাশ করে একটা সিগন্যাল দেয়া দরকার…অন্যায় করলে পার পাওয়া যাবে না! সবকিছু ম্যানেজ করা যাবে না…কেউ না কেউ ঠিকই সুদে আসলে উসুল করে নেবে!”
দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাস্টার্ডের দিকে ফিরে তাকালো বাবু কিন্তু তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই।
“আমাকে হয়তো পাগল ভাবছেন আপনারা!” মুখের হাসিটা ফিরে এলো আবার। “ভাবতেই পারেন কিন্তু আমি এই পাগলামিটা করবো, আমার সম্পত্তির বড় একটা অংশ এ কাজে দান করে যাবো।” বাস্টার্ডের দিকে তাকালো সে, মুখে প্রসন্ন হাসি। “আমার গুরু অমূল্যদাকে!” প্রশান্তির অভিব্যক্তি দেখা গেল তার চোখেমুখে।
ঘরে নেমে এলো সুকঠিন নিরবতা।
“অমূল্যদা এ সম্পত্তি দিয়ে কী করবেন সেটা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই আমার। আমি জানি তিনি আমার কথা রাখবেন।” চকিতে বাস্টার্ডের দিকে আবারো তাকালো, তারপর বাবুর দিকে। “এই আইডিয়াটা কোত্থেকে পেয়েছি, জানেন?”
স্থিরচোখে চেয়ে রইলো অমূল্যবাবু।
“ক-দিন আগে ঢাকা থেকে এক লোক কুমিল্লায় গিয়ে ওখানকার এক জালিমকে মেরে এসেছিল…দুবাইতে বসে অনলাইন পত্রিকায় খবরটা পড়ার পর আমার মনে হয়েছিল, আমার গুরু করালো না তো?…ওকে দিয়ে!” বাবলুর দিকে মুচকি হেসে তাকালো। “যাই হোক, আমার কেনজানি মনে হয়েছিল, কাজটা যে-ই করুক টাকার বিনিময়ে করেনি!”
মৃত্যুপথযাত্রির দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালো বাস্টার্ড।
“টাকার বিনিময়ে এমন কাজ কে করাবে? ওখানকার লোকগুলো তো ঠিকমতো খেতেই পায় না…গরীব আর অসহায়!” বাবলুর দিকে তাকালো আবার। “তোমার কি মনে হয়, টাকার বিনিময়ে করেছে কাজটা?”
ঠোঁট উল্টে কাঁধ তুলল বাস্টার্ড।
হাহা করে হেসে ফেলল মরণব্যধি ক্যান্সারে আক্রান্ত লোকটি। “কিন্তু আমি জানি!”
আবারো নিরবতা নেমে এলো দেড় শ” বছরের পুরনো ঘরটাতে।
“এই দেশটারে লুটেপুটে খাচ্ছে একদল ব্লাডি পলিটিশিয়ান্স, বিজনেসমেন, বুরোক্র্যাটস…” দম ফুরিয়ে অমূল্যবাবুর দিকে তাকালো কিসিঞ্জার। “কঠিন নেক্সাস তৈরি করেছে ওরা! এই নেক্সাস ভাঙতে হবে…যেভাবেই হোক!”
কিসিঞ্জারের ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেও চুপ মেরে রইলো বাবু।
“ওকে আর অন্য কারোর হয়ে কাজ করতে দেবেন না। এর কোনো দরকারও নেই। এরকম প্রতিভা ভালো কাজে লাগানো উচিত, আরো বেশি মহৎ কোনো কাজে…” স্মিত হাসিটা এই যন্ত্রণাদায়ক অবস্থায়ও অমলিন রইলো। “আমি যা দিয়ে যাচ্ছি সেটা দিয়ে ওকে বাকি জীবনের জন্য কন্ট্রাক্ট করে ফেলুন, গুরু!”
গভীর করে শ্বাস নিলো অমূল্যবাবু।
অধ্যায় ৮৯
অমূল্যবাবু জানতো এমনটা হবে।
পড়ন্ত বিকেলে এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসে ছিল। আজকে কোচিং করতে গেছিল বলে সংবাদগুলো পড়ে শোনাতে পারেনি নন্দ। তবে দায়িত্বে অবহেলা করেনি সে, চা দেবার পরই তার পাশে বসে পড়ে। দুটো পত্রিকার কিছু খবর পড়ে শোনানোর পর মোবাইলফোন থেকে অনলাইন খবরগুলোও পড়ে শোনাচ্ছিল। কোনো খবরের প্রতিই বাবুর তেমন আগ্রহ ছিল না, তবে জাহান গ্রুপের বিপর্যয়ের খবরটা শুনে মনোযোগ দেয়।
জাহান গ্রুপের মালিকের ছেলে এবং সিইও আলভী করিম দুবাইতে রহস্যজনকভাবে মারা গেছে। একদল ভ্রমণসঙ্গি নিয়ে দুবাইর একটি প্রাইভেট দ্বীপে গিয়েছিল ফূর্তি করতে। ঢাকা থেকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল বিতর্কিত নায়িকা খুকুমনিকে। প্রেসিডেন্টের একমাত্র মেয়ের জামাইও ছিল সেই দলে, যদিও পরিবার থেকে সেটা অস্বীকার করা হয়েছে। তারা সবাই এখন দুবাই পুলিশের হেফাজতে রয়েছে।
এদিকে ছেলের মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর শুনে বয়োবৃদ্ধ শাহজাহান করিম অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তিনি এখন ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে আছেন। ঘটনার সময় আলভীর স্ত্রী এবং মা-ও দুবাইতে ছিল, গতকাল তারা লাশ নিয়ে ফিরে এসেছে।
দুবাই পুলিশের মতে, পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়েছে জাহান গ্রুপের সিইও”কে। ঐ প্রাইভেট দ্বীপে আলভীর সঙ্গে তার ভ্রমণসঙ্গিদের কথা কাটাকাটি হয়েছিল আগের দিন রাতে, নিজেদের মধ্যে মারামারিও হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এরপরই এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। সন্দেহের তালিকায় আছে ভ্রমণসঙ্গিদের অনেকেই। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র দাবি করেছে, নারীঘটিত সমস্যা থেকে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকতে পারে বলে দুবাই পুলিশের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, পুলিশ আলভী করিম এবং তার সঙ্গিসাথিদের কাছ থেকে কোকেন জব্দ করেছে। জব্দের তালিকায় আরো আছে নিষিদ্ধ কিছু যৌন সামগ্রী এবং প্রচুর পরিমাণের ডলার।
নন্দর পড়া যখন শেষের দিকে তখনই কলিংবেলটা বেজে ওঠে। গেট খুলে সে দেখতে পায় হোমিসাইডের জেফরি বেগ আবারো এসেছে তাদের বাড়িতে। ভড়কে গেছিল ছেলেটা, আর সেটার যৌক্তিক কারণও আছে।
হোমিসাইডের এই লোকটার প্রতি তার মনোভাব এখনও আগের মতোই আছে, একটুও বদলায়নি। ভয়ার্ত চোখেমুখে ফিরে তাকিয়েছিল অমূল্যবাবুর দিকে, াকে ইশারায় আশ্বস্ত করলে গেটটা পুরোপুরি খুলে দেয়।
এখন জেফরি বেগ একটা চেয়ারে বসে আছে বাবুর পাশে, একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে নন্দ।
“চা খাবেন?” হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটরকে জিজ্ঞেস করলো অমূল্যবাবু।
“না। আমি চা খেয়েই এসেছি।”
“তুই ভেতরে যা,” এবার ছেলেটাকে বলল। “পরে দরকার হলে ডাকবো তোকে।”
“বাবলু কি ফিরে এসেছে?” নন্দ চলে যেতেই জানতে চাইলো জেফরি বেগ।
কাঁধু তুলল অমূল্যবাবু। “আমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই…জানি না।”
পরিহাসের হাসি ফুটে উঠল জেফরির ঠোঁটে। “আপনার এখনও ধারণা আমি ওর পেছনে লেগে আছি?”
স্থিরচোখে তাকালো বাবু। “এটাই তো আপনার কাজ।”
মুচকি হাসলো হোসিমাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। এমন জবাব সে আশা করেনি। “আপনার সঙ্গে ওর যোগাযোগ নেই এ কথাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?”
গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো বাবু। “আপনার ধারণা আমি মিথ্যা বলছি?”
লোকটার দিকে তাকালো জেফরি বেগ। “আপনার কি মনে হয়, সত্যি বলছেন?”
এক চিলতে হাসি দেখা গেল অমূল্যবাবুর ঠোঁটের কোণে। “এক কথায় তো বলা যাবে না…” একটু থেমে আবার বলল, “আপনি যে প্রশ্নের জবাব দিতে চাচ্ছেন না, যে কথাটা বলতে চাচ্ছেন না সেটা যদি কেউ জানতে চায় তাহলে কী করবেন?”
“সেক্ষেত্রে আমি চুপ করে থাকবো কিন্তু মিথ্যে বলবো না।”
প্রসন্নভাবে হেসে ফেলল বাবু। “ভুলে গেছেন, মৌনতা সম্মতির লক্ষণ!”
জেফরি বেগ লোকটার দিকে চেয়ে রইলো।
“সব সময় সব প্রশ্নের উত্তরে চুপ থাকা যায় না, মি. বেগ…তাহলে সেই প্রশ্নটার জবাব দেয়া হয়ে যায়। অথচ আপনি চাইছেন না কেউ জানুক সেটা…তখন কী করবেন?”
কিছুই বলল না হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর।
“আপনাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে বাবলুকে কেন খুঁজছেন, তার সাথে আপনার কী দরকার…মিথ্যে না বলে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন?”
মুচকি হাসলো জেফরি। “না, পারবো না,” তারপর উঠে দাঁড়ালো। “যদি কখনও কোনোদিন ওর সঙ্গে দেখা হয়, বলবেন আমি ওর কাছে চিরকৃতজ্ঞ…আমি শুধু ওকে ধন্যবাদ দিতে এসেছিলাম।”
আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো অমূল্যবাবু।
“কেন ধন্যবাদ দিচ্ছি জানতে চাইলেন না যে?”
“যাকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন সে নিশ্চয় জানে?”
“হুম, জানে।”
“তাহলে অন্য কারোর না জানলেও হবে।”
মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি বেগ, বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল সে।
আনমনেই বারান্দার উপরের দিকে তাকালো অমূল্যবাবু।
সংহার
এক মাস পর…
জানালার সামনে বসে আছে বাস্টার্ড। তার সামনে একটা স্নাইপার রাইফেল।
এখান থেকে বহু দূরে, একটি ভবনের বেলকনির দিকে নিবদ্ধ তার সমস্ত মনোযোগ। ভোর ছয়টা থেকে অপেক্ষা করছে, প্রায় এক ঘণ্টা চলে গেছে এরইমধ্যে কিন্তু যার জন্য অপেক্ষা তার দেখা নেই। এখন সকালের প্রথম ভাগ, প্রায় নির্জন পথঘাট। আরেকটু পরই লোকজনের সমাগম বেড়ে যাবে।
এর আগে কখনও স্নাইপার রাইফেল ব্যবহার করেনি সে। খুব কমই মুখোমুখি গানফাইট করেছে। পারতঃপক্ষে ওগুলো এড়িয়ে গেছে সব সময়। যতোগুলো গানফাইট আর গ্যাং ফাইট করেছে সবগুলোই আন্ডারওয়ার্ল্ডে থাকাকালীন। তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গি সাইলেন্সার-পিস্তল। সেটার অবশ্য কারণ আছে। তার কাজ করার পদ্ধতি ভিন্ন-একা, সবার অলক্ষ্যে, নিঃশব্দে কাজ করে সে।
এখনও সেটাই করছে বহু দূর থেকে একটা স্নাইপার রাইফেল দিয়ে। অবশ্য এই রাইফেলেও সাইলেন্সার লাগানো আছে। এখনও সে একাই কাজটা করতে নেমেছে, তবে তাকে সাহায্য করেছে শুটার সামাদ।
“স্নাইপার দিয়ে করবে?” অবাক হয়েছিল সাবেক শুটার।
লোকটা ভেবেছিল অবসর নিয়েছে সে, এ ধরণের কাজ আর করে না।
“তোমার নিশানা খুব ভালো…” বলেছিল নবাবপুরের আড়াইতলার ঘরে বসে। “…আমার মতোনই ন্যাচারাল শুটার তুমি। কিন্তু স্নাইপার রাইফেল একেবারেই আলাদা জিনিস। এটা শিখতে হয়। অনেক ভালো ট্রেইনার লাগবে তোমার।”
মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল বাস্টার্ড। “আপনার চেয়ে ভালো ট্রেইনার কোথায় পাবো?”
“সময় লাগবে কিন্তু?” তাকে পরখ করার জন্য বলেছিল।
“কতো দিন?”
কাঁধ তুলেছিল স্বভাবজাত শুটার। “এটা ডিপেন্ড করে…ভালোমতো মন দিয়ে প্র্যাকটিস করলেও দুই-আড়াই মাস লাগবে।”
বাস্টার্ড অবশ্য এতটা সময়ের কথা ভাবেনি। যেহেতু সে মোটামুটি সব ধরণের অস্ত্রই চালাতে পারে, জীবনের কোনো না কোনো সময় সেগুলো ব্যবহারও করেছে, ভেবেছিল সামাদের মতো দক্ষ শুটারের কাছ থেকে টিপস পেলে আর অল্প ক-দিন অনুশীলন করলেই হয়ে যাবে।
“কিন্তু সেটা তো সমস্যা না,” গম্ভীর মুখে বলেছিল দীর্ঘদিনের পরিচিত লোকটি। “সমস্যা অন্যখানে।”
“কী সেটা?”
“তার আগে বলো তুমি কতো দূর থেকে শট নিতে চাও?… রেঞ্জটা কতো?”
ঠোঁট উল্টিয়েছিল সে। “একটু বেশি…এই ধরেন এক-দেড় শ’ মিটার?”
ভুরু কপালে উঠে গেছিল শুটারের। “লং রেঞ্জের তাহলে।”
“হুম।”
“রেঞ্জ যতো বাড়ে ততো কঠিন হয়ে যায় কাজটা,” অভিজ্ঞতা থেকে বলেছিল। “অনেক কিছু মাথায় রাখতে হয় তখন।” একটু থেমে আবার বলেছিল, “প্র্যাকটিসটা করবে কোথায়? এরকম জায়গা তো পাওয়া যাবে না।”
গাল চুলকে ছিল বাস্টার্ড। এই সমস্যাটার কথা আগে ভাবেনি। সামাদ বলামাত্রই বুঝতে পারলো এটা বিরাট সমস্যা।
“শুটিং রেঞ্জে প্র্যাকটিস করা যাবে না। বাইরের কারোর জন্য ওটা ম্যানেজ করা অসম্ভব।”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল লোকটার দিকে।
“টার্গেট নিশ্চয়ই আরবান এলাকার?”
“হুম।”
“তাহলে তো অন্যভাবে কাজটা করতে হবে।”
কষ্ট করে আর তাকে খুঁজে বের করতে হয়নি কিভাবে হাতেকলমে প্র্যাকটিস করবে। দু দিন পর সামাদ নিজেই একটা পথ বাতলে দেয়, আর সেটা যেমন অভিনব তেমনি কার্যকরী।
শুটার সামাদের নিজের মহল্লায় দুটো বাড়ি আছে। সাততলা বাড়িটার একটা ফ্লোরে সে নিজে থাকে, বাকিগুলো ভাড়া দেয়। অন্য বাড়িটা ছয় তলার, সবগুলো ফ্লোরেই ভাড়াটিয়ারা থাকে। দুটো ভবনের মাঝে দূরত্ব প্রায় দেড়-দু শ মিটারের মতোই। এর মাঝখানে ছয়-সাত তলার কোনো ভবন নেই। যেগুলো আছে সবই দু পাশে। মাঝেরগুলো দুই, তিন, চার আর পাঁচ তলার ভবন। এক ভবন থেকে আরেক ভবন দেখা যায়। এই সুযোগটা নেয়া যেতে পারে।
কথাটা শুনে অবাক হয়েছিল সে। এটা কি আদৌ সম্ভব?
“সম্ভব যদি রাত তিনটার পর থেকে ভোরের আগ পর্যন্ত করা যায়। ফজরের আজানের ঘণ্টাখানেক আগে পনেরো-বিশ মিনিট প্র্যাকটিস করলেই হবে।”
এরপর ব্যাখ্যা করে বলেছিল কিভাবে কাজটা করা যাবে : ছয়তলা ভবনের ছাদের সিঁড়ি ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা হবে একটা পুরনো ম্যাট্রেস আর তাতে মার্ক করা থাকবে। সাততলার ঘরের জানালা দিয়ে স্নাইপারস্কোপ আর সাইলেন্সার ব্যবহার করে সেই ম্যাট্রেসের উপরে শুটিং প্র্যাকটিস করা যাবে। যেহেতু সাইলেন্সার লাগানো থাকবে কেউ কিছু টের পাবে না।
প্রথম দু দিন সামাদ নিজেও প্র্যাকটিস করবে কারণ অনেকদিন হলো শুটিং করে না লং রেঞ্জে। এভাবে মাসখানেক প্র্যাকটিস করার পর বোঝা যাবে অগ্রগতি কতোটুকু হয়েছে, তারপর যদি দরকার পড়ে আরো কিছুদিন করা যেতে পারে।
যে বাড়ির ছাদে প্র্যাকটিস করবে সেটার সিঁড়ি-ঘরের চাবি থাকবে সামাদের বিশ্বস্ত বোবা ছেলেটার কাছে। ভোরের আযানের পর বোবা ছাদে গিয়ে ম্যাট্রেসটা তুলে নিয়ে রেখে দেবে সিঁড়িঘরের পাশে একটা স্টোররুমে।
কথামতো সামাদ প্রথমে নিজে দু-তিন দিন শুটিং প্র্যাকটিস করে নেয়। যেহেতু সে অভিজ্ঞ শুটার খুব বেশি প্র্যাকটিসের দরকার হয়নি। মাত্র দু দিনই যথেষ্ট ছিল তার জন্য। এরপরই শিডিউল তৈরি করে নেয় কোন কোন দিন প্র্যাকটিস করবে বাস্টার্ড। যেদিন প্র্যাকটিস করতো তার আগের দিন রাত এগারোটার পর সে চলে যেতো সামাদের পুরান ঢাকার বাড়িতে। সাততলার উপরে মেহমানদের জন্য একটা ঘর খালি রেখেছে, সেখান থেকেই রাত সাড়ে ৩টার পর শুরু করতো শুটিং। পনেরো-বিশ মিনিটে দশ- বারো রাউন্ড টার্গেট প্র্যাকটিস করতো প্রতিদিন।
“তুমি তো দেখছি গুরু মারা সাগরেদ!” আট-নয়দিন পর তার হাতের নিশানা দেখে প্রশংসার সুরে বলেছিল সামাদ।
সব মিলিয়ে পনেরো দিনের মতো প্র্যাকটিস করেছে বাস্টার্ড, এরপরই জানায় টার্গেট দেশে এসেছে, বেশি সময় নিলে আবার চলে যেতে পারে, এতেই হয়ে যাবে। শুটার সামাদ একটু ভেবে গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে দেয় তাকে।
“তুমি তো শুটিং কম্পিটিশনে যাচ্ছো না… টার্গেটে হিট করতে পারলেই হলো। সেটা তোমার ভালোই হচ্ছে।”
বাস্টার্ডও জানে তাকে শুধু টার্গেটকে ঘায়েল করলেই হবে, অন্য প্রতিযোগিদের সঙ্গে পয়েন্টের লড়াইতে নামতে হবে না।
শুটার সামাদ তাকে প্র্যাকটিসের আগে দূর পাল্লার শুটিংয়ের উপরে বেশ ভালো দীক্ষাই দিয়েছিল।
“অস্ত্রটা যেদিন থেকে তোমার হাতের অংশ হয়ে উঠবে সেদিন বুঝবে তুমি শুটার হয়ে গেছো।”
কথাটা সত্যি। প্র্যাকটিসের মধ্য দিয়ে অস্ত্রটার সঙ্গে এক ধরণের সখ্যতা গড়ে তুলতে হয়, আপন করে নিতে হয়। সম্ভবত সে অল্প কদিনেই এটা করতে পেরেছে। এই আত্মবিশ্বাস তার আছে, আর আছে বলেই আজ এখানে অপেক্ষা করছে টার্গেটের জন্য।
তিন দিন ধরে কিসিঞ্জার আইসিইউ”তে রয়েছে। জীবনের শেষ প্রান্তে অবস্থান করছে লোকটা। অবস্থার অবনতি হবার আগেই আইনগত কাজগুলো সেরে ফেলেছিল। নিজের সম্পত্তির বিরাট একটি অংশ দিয়ে গেছে অমূল্যবাবুকে।
তবে আজকের টার্গেটটা অমূল্যবাবু কিংবা সে নিজে ঠিক করেনি। কিসিঞ্জার আইসিইউতে যাবার আগে একটা তালিকা দিয়ে গেছে, সেই সঙ্গে এটাও বলে গেছে, টার্গেটকে তারা স্বাধীনভাবে বেছে নিতে পারে বিভিন্নভাবে খোঁজ-খবর নিয়ে। এই টার্গেটটা অবশ্য কিসিঞ্জারের লিস্টে থাকা তৃতীয় ব্যক্তি। প্রথম আর দ্বিতীয়জন বিদেশের মাটিতে আছে বর্তমানে।
এখনকার টার্গেট নিজের ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে এ দেশ থেকে। শক্ত প্রমাণ থাকার পরও সরকার তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীদের সঙ্গে সখ্যতা আছে লোকটার। প্রথমদিকে পত্রিকাগুলো এ নিয়ে একটু আধটু বললেও গত এক বছর ধরে টু শব্দটিও করছে না। তার বিরুদ্ধে লেখার অভিযোগে এক সাংবাদিক আর লেখককে মামলা দিয়ে পুলিশ রিমান্ডে এমন নির্যাতন করা হয়েছে, লেখক বেচারা পরে মরেই যায়। সাংবাদিক প্রাণে বেঁচে গেলেও দেশে থাকতে পারেনি, বিদেশে চলে গেছে।
এই লোকটাও বিদেশে থাকে, মাঝেমধ্যে দেশে আসে। নতুন গড়ে ওঠা একটি আবাসিক এলাকায় চল্লিশ কাঠার প্লট কিনে প্রাসাদোপম বাড়ি বানিয়েছে, বিদেশ থেকে এসে কিছুদিন ধরে সেখানেই বাস করছে। বাড়িটার আশেপাশের সবগুলো প্লটই খালি পড়ে আছে। একটু দূরে কিছু বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে উঠছে ধীরে ধীরে।
এক শত বিশ কি ত্রিশ মিটার দূরে এরকমই একটি নির্মাণাধীন দশ তলার ভবন আছে। কোনো এক কারণে আন্ডার কন্সট্রাকশন ভবনটির কাজ থেমে আছে মাস তিনেক ধরে। মাকে নিয়ে খুলনায় ফিরে যাবার আগে মৃদুল চার- পাঁচদিন রেকি করে গেছে। তার কাছ থেকে সব শোনার পর একদিন নিজে এসে সব দেখেছে বাস্টার্ড। সে নিশ্চিত, কাজটা এখান থেকে অনায়াসে করা যাবে।
আজকের এই টার্গেটের কথা তার ট্রেইনার সামাদ জানে-বিরাট বড় এক কন্ট্রাক্ট পেয়েছে দানশীল একজনের কাছ থেকে। অদ্ভুত সেই লোক, অদ্ভুত তার বাতিক। যদিও সামাদ সেটা বিশ্বাস করেছে কি না নিশ্চিত হতে পারেনি।
সাবেক শুটার তাকে বলেছিল, এই টার্গেট যেখানে আছে আর সে যেখান থেকে শুট করবে, তাতে করে দ্বিতীয় শট নেবার চান্স প্রায় শূন্যের কোঠায়। ম্যাজিক বুলেট হতে হবে-একটা শটেই যেন কুপোকাত হয়—খুবই কঠিন কাজ। গুলিটা মিস হলে টার্গেটের পেছনের দেয়ালে গিয়ে হিট করবে, আর সেটা হলে স্লিপ করার সম্ভাবনা অনেক বেশি। টার্গেটের শরীরে বিদ্ধ হবারও সুযোগ আছে, তবে সেই রিটার্ন শটে টার্গেটের মৃত্যু হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ-যদি না মাথায় লাগে।
কিন্তু বাস্টার্ডের কাছে মনে হয়েছে সে দ্বিতীয় শট নিতে পারবে। টার্গেট এই বেলকনিতে বসে সকালের নাস্তার আগে সিগারেট খেতে খেতে চা পান করে, তখন স্মার্টফোনে কিছু ব্রাউজও করে। এ সময় সর্বোচ্চ দশ-বারো মিনিট থাকে লোকটা। বেলকনির স্লাইডিং ডোরটা বন্ধ করে রাখে সে।
তার ধারণা মিস হয়ে গেলে এই লোক দুয়েক সেকেন্ড হতভম্ব হয়ে থাকবে, তারপর বুঝতে পেরে দ্রুত বেলকনি থেকে চলে যেতে উদ্যত হবে। চেয়ার থেকে উঠে স্লাইডিং ডোরটা খুলে বেডরুমে যাবার আগে আরেকটা শট নিতে পারবে তখন।
প্রতিদিন সকাল সাতটার পর স্বাস্থ্য সচেতন লোকটি ঘুম থেকে উঠে পশ্চিম দিকের পাঁচতলার বেলকনিতে বসে চা খায়-আজকেও সেটা করবে, এরকমই আশা করছে বাস্টার্ড কিন্তু অন্য দিনের তুলনায় লোকটা আজ দেরি করছে। এটা অস্বাভাবিক নয় মোটেও, এই লোক কোনো অফিস করে না, ঘড়ি ধরে ঘুম থেকে ওঠার দরকার নেই তার।
হাতঘড়িতে সময় দেখলো আরো একবার। সাতটা বেজে গেছে আরো আট-দশ মিনিট আগে। এতক্ষণ বসে থাকতে থাকতে পিঠ ব্যথা করছে তার। গভীর করে দম নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। আন্ডার কন্সট্রাকশন ঘরে একটু পায়চারি করলো সে। দূর থেকে খালি চোখেই দেখতে পাবে বেলকনিতে লোকটা এসেছে কি না।
অবশেষে সাতটা একুশ মিনিটে দেখা গেল টার্গেটকে। সঙ্গে সঙ্গে স্নাইপারস্কোপে চোখ রাখলো বাস্টার্ড। হালকা নীল রঙের ট্রাউজার আর সাদা রঙের টি-শার্ট পরে বেলকনিতে এসে বসেছে।
কিন্তু শট নিলো না সে। এখনই কাজের ছেলেটা চা নিয়ে আসবে। তার আগে শট নিলে ছেলেটা এসে দেখে ফেলবে, এই ভবন থেকে নামার আগেই জানাজানি হয়ে যাবে খুন হবার ব্যাপারটা। একটা শোরগোলও তৈরি হবে সম্ভবত।
বাস্টার্ড তার স্নাইপারস্কোপ দিয়ে দেখতে পেলো টার্গেট সিগারেট ধরিয়েছে। মোবাইলফোন হাতে নিয়ে ব্রাউজ করছে একমনে। যথারীতি দুয়েক মিনিট পরই কাজের ছেলেটা এক কাপ চা রেখে গেল বেলকনির কফি টেবিলটার উপরে, যাবার সময় স্লাইডিং দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গেল সে। টার্গেট এখনও ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে।
চায়ের কাপটা হাতে নেবার আগেই শটটা নিতে হবে, নইলে হাত থেকে কাপ পড়ে যাবে, একটা শব্দ হবে, বেডরুমে যে আছে সে শুনে ফেলবে।
স্নাইপারস্কোপে টার্গেটের বুকের বাঁ-পাশটায় বুল্স আই বিদ্ধ করা আছে। গভীর করে দম নিয়ে নিলো বাস্টার্ড, তারপর ধীরে ধীরে নিশ্বাস ছাড়লো-নিশ্বাস ছাড়ার মধ্যেই শটটা নিতে হবে-শুটার সামাদ এমন প্রশিক্ষণই দিয়েছে তাকে।
আস্তে করে ট্রিগারটা চেপে দিলো সে। স্নাইপারস্কোপেই দৃশ্যটা দেখতে পেলো : টার্গেটের ডান কাঁধের পেছনে দেয়ালে বিদ্ধ হয়েছে গুলিটা!
দেয়ালের পেছনে ঘ্যাচাং” করে কোনো শব্দ শুনে চমকে গেছে লোকটা।
দ্রুত দ্বিতীয় শটটা নিতে গেল সে কিন্তু ট্রিগারে চাপ দেবার আগেই দেখতে পেলো টার্গেটের মাথাটা উড়ে গেছে! মুখ থুবড়ে পড়েছে লোকটা।
ট্রিগারটা প্রায় চেপেই দিয়েছিল সে, শেষ মুহূর্তে থমকে যায়। টার্গেট চেয়ার থেকে বেলকনির মেঝেতে পড়ে আছে এখন, তার পেছনের দেয়ালে রক্তের ছটা!
হতভম্ব হয়ে গেল বাস্টার্ড। তারপর দ্রুত রাইফেলটা স্ট্যান্ডসহ একটু পেছনে টেনে নিলো। স্ট্যান্ড থেকে খুলে পাশে রাখা একটা বড় ব্যাগের ভেতরে ভরে নিলো অস্ত্রটা। ঘর থেকে বের হবার আগে বেলকনির দিকে তাকালো সে। এখনও কেউ টের পায়নি।
সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল দ্রুত, আর নামতে নামতেই মাথা দোলালো সে। শুটার সামাদ ঠিকই বলেছে, স্নাইপার রাইফেল ভিন্ন জিনিস। লং-রেঞ্জ শুটিং অল্প ক-দিনের প্র্যাকটিসে আয়ত্তে আসে না।
ভবনের নিচে এসে আশেপাশে তাকালো। কেউ নেই। রাইফেলের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে একটু অপেক্ষা করলো। কিছুক্ষণ পরই দেখতে পেলো নির্জন রাস্তাটা দিয়ে সাদা রঙের একটি প্রাইভেটকার এগিয়ে আসছে তার দিকে, ড্রাইভিং সিটে বসে আছের শুটার সামাদ।
পরিকল্পনা মোতাবেক এই গাড়িটা ভবনের নিচে থাকার কথা ছিল।
মাথা নেড়ে তাকে গাড়িতে ওঠার ইশারা করলো সামাদ।
বাস্টার্ড দরজা খুলে তার পাশের সিটে বসে পড়তেই গাড়িটা চলতে শুরু করলো আবার। “কোন বিল্ডিংয়ে ছিলেন?”
“ডান দিকেরটায়…” গাড়ি চালাতে চালাতে বলল লোকটা।
ভুরু কপালে উঠে গেল তার। “ওটা তো আড়াই শ মিটার দূরে!”
নিঃশব্দে হাসলো সাবেক শুটার।
প্রশংসার অভিব্যক্তি ফুটে উঠল বাস্টার্ডের চোখেমুখে। “আপনি আসলে জানতেন আমি মিস করবো?”
গাড়ি চালাতে চালাতে এক হাতে গাল চুলকালো শুটার। “শিওর ছিলাম না বলতে পারো। ঐ লোকটা এ যাত্রায় বেঁচে গেলে তাকে আর পেতে না, তাই ব্যাকআপে ছিলাম।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো বাস্টার্ড। কথাটা সত্যি। আজকে যদি লোকটা বেঁচে যেতো তাহলে নির্ঘাত চিরতরের জন্য দেশ ছাড়তো।
“আমি কিন্তু সেকেন্ড শটটা নিতে পারতাম।”
মাথা দোলালো সামাদ। “সেকেন্ড শটের সময় টার্গেট স্টেশনারি থাকে না…” গাড়িটা বাঁ-দিকে মোড় নিলো এবার। “তখন শুট করা আরো বেশি টাফ হয়ে যায়।”
“আর এই টাফ কাজটাই আপনি করেছেন।”
আবারো নিঃশব্দে হাসলো সাবেক শুটার। “তবে স্বীকার করতেই হয়, অল্পদিন প্র্যাকটিস করেও দারুণ শট নিয়েছো তুমি…মাত্র তিন-চার ইঞ্চি এদি ওদিক হয়েছে।”
“টার্গেট মিস করেছি, এটাই হলো আসল কথা। কয় ইঞ্চি এদিক ওদিক হয়েছে সেটার কোনো গুরুত্ব নেই।”
“হা-হা-হা,” প্রাণ খোলা হাসি দিলো সামাদ। “হবে, হবে! তোমাকে দিয়ে হবে। বেটার লাক নেক্সট টাইম!”
…