অধ্যায় ৭০
কিসিঞ্জারের মুখে সারাক্ষণ এঁটে থাকা হাসিটা উবে গেল না বলে বাস্টার্ড অবাকই হলো। তার টার্গেট ইউরোপে চলে গেছে আর লোকটা মিটিমিটি হাসছে!
উপভোগ করছে ব্যাপারটা?!
“পারডন মি,” মুখের হাসিটা ধরে রেখেই বলল। “তুমি আবার আমাকে ভুল বুঝো না, বাবলু।”
তার ভুরু কুঁচকে গেল এবার। আলভী যদি কোনোভাবে টের পেয়ে গিয়ে থাকে এখানে সে নিরাপদ নয় তাহলে কিসিঞ্জারই তার জন্য দায়ি। এই লোক নিজেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান আর পাকা খেলোয়াড় মনে করে। এরকমটা যে ভাবে তার বড় প্রমাণ মাস-দেড়েক আগেই পেয়েছে। বেশি খেলতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত তার হাতে নাকাল হয়েছিল।
চোয়াল শক্ত হয়ে গেল বাস্টার্ডের। “হুট করে পোল্যান্ডে চলে গেল কেন?”
কাঁধ তুলল কিসিঞ্জার। “তা তো জানি না,” একটু গাল চুলকে নিলো। “হয়তো ইয়টে মওজ-ফূর্তি করতে করতে বিরক্ত হয়ে গেছে, ভেবেছে সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানো যথেষ্ট হয়েছে, আর না।
আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল বাস্টার্ড। তার মিশনটা যে এভাবে আচমকা শেষ হয়ে যাবে ভাবেনি।
“হয়তো জায়গা বদল করতে চেয়েছে কিংবা আগে থেকেই এরকম প্ল্যান ছিল ওর…কে জানে!”
তাই বলে আরব সাগর থেকে ইউরোপে? মাথা দোললো সে। নিশ্চয়ই টের পেয়ে গেছে!
“বড়লোকদের খেয়াল, বুঝলে? যখন যেটা ইচ্ছে করে সেটাই করে। তাদের তো আর টাকার অভাব নেই।
“তাহলে তো দুয়েক মাসের আগে ফিরে আসবে।”
অবাক হলো কিসিঞ্জার। “আরে না, ওখানে কেউ এতদিন থাকে না। সপ্তাহখানেক থাকতে পারে।”
যারপরনাই অবাক হলো। “এক সপ্তাহের জন্য গেছে? আপনি জানলেন কিভাবে?”
“আমাকে ওর লোক বলেনি কতো দিন থাকবে কিন্তু ওইসব আইল্যান্ডে যারা যায় তারা খুব বেশি দিন থাকে না।”
ভুরু কুঁচকে তাকালো এক সময়কার তওফিক আহমেদ বাবলু। পোল্যান্ডকে এই লোক আইল্যান্ড বলছে! এর ভূগোল জ্ঞান যথেষ্ট খারাপ। “ওখানে গিয়ে থাকলে তো এই মিশন শেষ,” আস্তে করে বলল। “আমার পক্ষে ইউরোপে যাওয়া সম্ভব নয়।”
“হুম। ওখানে গেলেও কিছু করা যাবে বলে মনে হয় না।”
“ইউরোপের এত জায়গা থাকতে পোল্যান্ডে কেন গেল? ওখানে কি ওর বাড়ি আছে?”
কয়েক মুহূর্ত চোখ পিট পিট করে তাকালো কিসিঞ্জার, তারপর কিছু একটা মনে পড়ে গেল যেন। “ওহ্…সরি!” মাথা দোলালো সে। “তুমি ভাবছো ও সত্যি সত্যি ইউরোপে চলে গেছে?”
লোকটার কথা বুঝতে পারলো না বাবলু।
“আমি ভুলেই গেছিলাম তুমি এখানে থাকো না,” একটু থেমে গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো। “ঐ যে…” সমুদ্রের উত্তর-পশ্চিম দিকে আঙুল তুলে দেখালো। “ওখানকার ইউরোপে গেছে।”
বাস্টার্ড সেদিকে ভুরু কুঁচকে তাকালো কিন্তু সমুদ্র আর তার উপরে ভেসে থাকা অসংখ্য বোট-ইয়ট ছাড়া কিছুই দেখতে পেলো না।
“খালি চোখে দেখা যায় না…এখান থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরেই ওটা।” প্রসন্নভাবে তার দিকে তাকালো। “অনেকগুলো ম্যান মেইড আইল্যান্ড…তিন শ”র মতো হবে।”
গুগল করে বাস্টার্ড যতোটুকু জেনেছে, সমুদ্রের বুকে পাম গাছের আকৃতিতে কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়েছে এখানকার শেখ, ওটাই পাম জুমেইরাহ্ নামে সবার কাছে পরিচিত। পরবর্তিতে সৈকতের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে, এখান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ঠিক একই রকম দেখতে আরেকটি কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়েছে পাম জেবেল আলি নামে। এই দ্বীপগুলো টুরিস্ট ডেস্টিনেশন হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু কিসিঞ্জার যে কৃত্রিম দ্বীপের কথা বলছে, সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই।
“বেশি কথা বলতে পারি না, হাঁপিয়ে যাই…” কিসিঞ্জার মলিন হাসি দিয়ে বলল। “ওখানকার একটা আইল্যান্ডের নাম পোল্যান্ড। “দ্য ওয়ার্ল্ড আইল্যান্ড অব দুবাই” লিখে সার্চ দাও গুগলে, সব পেয়ে যাবে।”
ফোনটা বের করে সার্চ দিলো সে। প্রথমেই কিছু ইমেজ দেখালো গুগল : উপর থেকে দেখতে ছোটো ছোটো ডটের মতো তিন শ” দ্বীপ দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্র বানানো হয়েছে। সাতটি মহাদেশের আকৃতি চোখে পড়লো চট করেই।
“অ্যাম্বিশাস প্রজেক্ট, তাই না?” মিটিমিটি হেসে বলল কিসিঞ্জার।
“ওখানে গেছে তাহলে!” হাঁপ ছাড়লো বাস্টার্ড।
“হুম, হার্ট অব দি ইউরোপের পোল্যান্ড আইল্যান্ডে,” চওড়া হাসি দিয়ে বলল লোকটা।
অধ্যায় ৭১
ওইদিন ঘরে ফিরে এসে গুগল নিয়ে মেতে থাকলো বাস্টার্ড। লোকজন যে বলে, যা নেই গুগলে তা নেই ভূগোলে, কথাটা মিথ্যে নয়।
ওয়ার্ল্ড আইল্যান্ড নিয়ে প্রচুর তথ্য আর ইমেজে ঠাসা ইন্টারনেট। দুবাইর শেখের উচ্চাভিলাষী প্রজেক্টগুলোর কথা বিস্তারিতভাবেই আছে।
এই শহরের উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে পারস্য উপসাগর-এটাকে আরব সাগর বলে এখানকার লোকজন। শহরের উপকূলে বেশ কয়েকটি বড় বড় কৃত্রিম দ্বীপ সৃষ্টি করে নানা রকম বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। দামি দামি ভিলা, কটেজ, রিসোর্ট, হোটেলে পূর্ণ সেগুলো। আরো আছে প্রাইভেট ভিলা। কিছু কিছু মিনি আইল্যান্ডের পুরোটাই বিক্রি করে দেয়া হয়েছে
বিখ্যাত দুটো পাম আইল্যান্ডসহ এরকম বেশ কিছু দ্বীপ রয়েছে। তবে উপকূল থেকে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরে, সাগরের বুকে ৩০০টিরও বেশি ছোটো ছোটো দ্বীপ নিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে পৃথিবীর মহাদেশগুলোর আদলে একটা কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ, এটাকেই তারা ওয়ার্ল্ড আইল্যান্ড বলে। উপর থেকে দেখলে মনে হবে কিছু ডট দিয়ে মহাদেশগুলোর মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এই তিন শ” দ্বীপের মধ্যে হাতেম গোণা কয়েকটি দ্বীপে এখন পর্যন্ত রিসোর্ট, হোটেল, পেন্থাউজ আর ভিলা বানানো হয়েছে।
আলভী ওখানকার পোল্যান্ড আইল্যান্ডে গেছে। হাতে গোণা যে কয়টা দ্বীপ বাণিজ্যিকভাবে কাজ করতে শুরু করেছে তার মধ্যে এটা অন্যতম। সেজন্যেই গুগলের ছোটো ভাই ইউটিউবেও ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখেছে বাস্টার্ড। সে জানতো, হোটেল আর রিসোর্টগুলো নিশ্চয়ই বিজ্ঞাপন করবে। ব্রাউজ করে সেটার সত্যতা পেয়ে গেল সে। প্রচুর ভিডিও আপলোড দেয়া আছে ওখানকার রিসোর্ট, ভিলা আর হোটেলগুলোর উপরে। কী কী সুবিধা পাওয়া যাবে, জায়গাটা দেখতে কেমন, সবই বিস্তারিতভাবে দেখানো হয়েছে।
“পোল্যান্ড আইল্যান্ডের কোন হোটেলে কিংবা রিসোর্টে গেছে আলভী, সেটা কি আপনি জানেন?” পরদিন কিসিঞ্জারের সঙ্গে তার বাসার সামনে একটা পার্কে দেখা করে জানতে চাইলো বাস্টার্ড।
মাথা দোলালো অমূল্যবাবুর স্বঘোষিত শিষ্য। “তা জানি না। এটা অবশ্য ঐ লোককে জিজ্ঞেসও করিনি…করলে তো সন্দেহ করতে পারে, তাই না?”
“হুম,” সায় দিলো সে।
“কিন্তু এটা কোনো সমস্যা না,” আশ্বস্ত করে বলল তাকে। “আইল্যান্ডগুলো বেশি বড় না। কয়টা হোটেল আর রিসোর্ট আছে ওখানে? আর কতোজনই বা গেস্ট আছে এই মুহূর্তে, বলো?”
আরো কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা করলো বাস্টার্ড।
“এই প্রজেক্টটা অলরেডি ফেইল করেছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢেলেছে কিন্তু বিক্রি হয়েছে খুব কমই। বেশিরভাগ মিনি আইল্যান্ডগুলো বিরাণ পড়ে আছে। হাতে গোণা কিছু আইল্যান্ড কমার্শিয়ালি চালু হয়েছে কিন্তু কাস্টমার খুব কম…শাহজাহানের ছেলে হয়তো এজন্যেই ওই জায়গাটা বেছে নিয়েছে।”
“তাহলে আলভী ওখানকার কোন হোটেলে আছে সেটা জানা কঠিন কিছু হবে না?”
ভুরু কপালে উঠে গেল কিসিঞ্জারের। “তুমি কি ওখানে গিয়ে কাজটা করতে চাচ্ছো?!”
“হুম,” কোনো রকম দ্বিধা না রেখেই বলল।
গাল চুলকালো অসুস্থ লোকটি। “সেটা কি সম্ভব?”
“আমি যদি ধনী পর্যটক হই তাহলে সম্ভব।”
মিটিমিটি হেসে মাথা দোলালো কিসিঞ্জার। “এক ধনী ব্যাচেলর টুরিস্ট? একটু ফূর্তি-টুর্তি করতে এসেছে…কয়েকটা দিন থাকবে ওয়ার্ল্ড আইল্যান্ডে?”
স্মিত হেসে সায় দিলো বাস্টার্ড।
“তবে বেশ ব্যয়বহুল হবে সেটা।”
“দু-তিন দিনের জন্য কয়েক লাখ খরচ হবে, আমি অলরেডি খোঁজ নিয়েছি।”
“আচ্ছা।”
“যতোটুকু বুঝতে পারছি, ওখানে সিসিক্যাম নামের জিনিসটা একটু কমই আছে। আর সেটার কারণও রয়েছে। ধনীরা একটু বেশিই প্রাইভেসি চায়। যারা এত টাকা খরচ করবে তারা এটা ডিজার্ভও করে।”
হেসে ফেলল কিসিঞ্জার। “তা তো করেই। শত শত চোখ ওদেরকে সারাক্ষণ দেখবে, তা কি হয়?” একটু থেমে আবার বলল, “ভিআইপি, ভিভিআইপি আর তাদের বিতর্কিত সব গেস্ট…কে চাইবে এসবের প্রমাণ রাখতে?” মুখের হাসিটা আরো চওড়া করে বলল, “দুবাইর মেইনল্যান্ডে কিছু রেস্ট্রিকশন থাকলেও ওখানে একেবারেই খুল্লাম খুল্লা কাজকারবার হয়। শুনেছি অনেকেই সেখানে গিয়ে গ্যাম্বলিং খেলে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো বাস্টার্ড। ওয়ার্ল্ড আইল্যান্ডের উপরে একটা আর্টিকেলে সে এটা পড়েছে। “আমি ওখানে যাবো…একটা চান্স নিতে চাচ্ছি।”
মাথা দোলালো ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষটি। “উঁহু! তুমি যাচ্ছো না, “আমি যাচ্ছি!”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো বাবলু, তার চোখেমুখে বিস্ময়।
মিটিমিটি হাসছে কিসিঞ্জার।
অধ্যায় ৭২
এন্ড-অব-লাইফ কেয়ার!
ক্যান্সারে পর্যুদস্ত একজন মানুষ। খুব বেশিদিন বাঁচবে না। শেষ সময়টুকু ভালোমতো কাটাতে চায়, যেতে চায় পছন্দসই জায়গায়। একটু সুন্দর আর নির্জন পরিবেশে থেকে শেষদিকের কষ্টটা ভুলে থাকতে চায় সে।
“আইডিয়াটা কেমন?” জানতে চাইলো কিসিঞ্জার।
লোকটার দিকে চেয়ে রইলো বাস্টার্ড।
“তুমি আমার কেয়ার গিভার, আমার সঙ্গে ওয়ার্ল্ড আইল্যান্ডে এসেছো।”
বুঝতে পেরে আলতো করে সায় দিলো। “এটা কিন্তু রিস্কি কাজ, আপনি এই রিস্ক নিতে চাচ্ছেন কেন?”
হাসতে হাসতে মাথা দোলালো লোকটা। “আমার আবার রিস্ক!” কথাটা বলে সামনের দিকে ঝুঁকলো একটু। “মি. বাবলু…মাই ডিয়ার পার্থিব রায় চৌধুরি, আমার কীসের রিস্ক? আর কয়দিন বাদে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবো, আমার হারানোর কী আছে?”
বাস্টার্ড কিছু বলল না।
গভীর করে শ্বাস নিলো অসুস্থ মানুষটা। “ছোটোবেলায় আমাদের পুরান ঢাকায় এক লোক বলতো, মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো মরে যাওয়া। সেই রিস্কে অলরেডি আমি পড়ে গেছি।” চারপাশে চোখ বুলালো টার্মিনাল স্টেজে থাকা লোকটি। “যখন তোমার হারাবার কিছু থাকবে না তখন তুমি কীসের ভয় পাবে, বাবলু?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো পার্থিব রায় চৌধুরি। সে অবশ্য মনে করে হারাবার ভয় থাকলেই বরং হারানোর ধাক্কা সামলানোটা বেশি কঠিন হয়ে পড়ে। জীবনে কোনো কিছু প্রাপ্তি হবার সঙ্গে সঙ্গে হারানোর ভয়টা চলে আসে কিন্তু সবাই দেখে শুধু প্রাপ্তিটাকে, তার পেছনে চুপিসারে অদৃশ্য অবয়ব নিয়ে হারানোর ভয়টাও যে এসে দাঁড়িয়েছে, সেটা বোঝা যায় সঙ্কটের সময়।
সম্বিত ফিরে পেলো বাস্টার্ড, দেখতে পেলো কিসিঞ্জার তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
“তাহলে তুমি আমার কেয়ার গিভার। আমি এন্ড-অব-লাইফ কেয়ারে আছি, ঠিক আছে?”
“হুম,” আস্তে করে বলল। কিসিঞ্জার যে তাকে নিরাপদে কাজ করার জন্য এমন প্রস্তাব দিয়েছে বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না।
“এখন বলো তোমার পরিকল্পনাটা কী?”
“এখনও কোনো প্ল্যান করিনি।”
ভুরু কপালে উঠে গেল এক সময়ের জাঁদরেল লোকটির।
“সব সময় আপনি পরিকল্পনা করে কাজ করতে পারবেন না,” বলতে শুরু করলো বাবলু। “আপনাকে আগে পরিস্থিতিটার মধ্যে ঢুকে পড়তে হবে, বুঝে নিতে হবে বাতাস কোনদিকে বইছে,” একটু থেমে শেষে যোগ করেলো, “নৌকার পাল তোলার মতো ব্যাপার।”
“ঠিক। বেশিরভাগ সময়ই পরিকল্পনা করার মতো সময়ও আমাদের থাকে না। আবার সময় থাকলেও পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা থাকে না। তোমার কথাটা আমার পছন্দ হয়েছে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো বাস্টার্ড। “ওকে, আপনি যাচ্ছেন আমার সঙ্গে।”
“আহ্! ভুল বললে,” চওড়া হাসি দিলো কিসিঞ্জার। যেন আসন্ন মৃত্যুকে ভুলে থাকার জন্য একটা যুতসই ব্যস্ততা পেয়ে গেছে। “কথাটা হবে, তুমি যাচ্ছো আমার সঙ্গে!”
অধ্যায় ৭৩
একটা ওয়াটার ট্যাক্সিতে করে ওয়ার্ল্ড আইল্যান্ডের উদ্দেশ্য রওনা দিলো কিসিঞ্জার, তার সঙ্গে কেয়ার-গিভার হিসেবে পার্থিব রায় চৌধুরি।
তাদের সঙ্গে মাত্র দুটো লাগেজ। তিন দিনের জন্য রিজার্ভেশন নিয়েছে ওখানকার পোল্যান্ড আইল্যান্ডের ছোট্ট একটা ভিলায়। এরকম বেশ কিছু ভিলা আছে ওখানে।
দ্বীপে নেমে একটুও মনে হলো না এটা আদতে কৃত্রিম দ্বীপ। প্রাকৃতিক সৈকতের মতো বালুকাবেলা, তবে বেশ পরিচ্ছন্ন। সৈকতের পরই পাম – নারকেলসহ বিভিন্ন ধরণের গাছগাছালি দিয়ে দ্বীপের চারপাশটা ঘেরা।
ওখানে দুটো জেটি আছে বোট আর ইয়ট নোঙর করার জন্য। তাদের ওয়াটার ট্যাক্সিটা ভিড়লো পূর্বদিকের জেটিতে, সেখান থেকে একটা পন্টুন ব্রিজ চলে গেছে সৈকত পর্যন্ত। ওয়াটার ট্যাক্সি থেকে নামতেই দুজন রিসেপশনিস্ট তাদেরকে অভ্যর্থনা জানালো। একজন সঙ্গে করে হুইলচেয়ার নিয়ে এসেছে, যেহেতু কিসিঞ্জারের শারীরিক অবস্থার কথা তাদেরকে জানানো হয়েছিল। হাঁটতে পারলেও হুইলচেয়ারে বসে পড়লো সে।
একটা সরু মেঠো পথ চলে গেছে ভিলার দিকে। এ দেশের গ্রামে কিংবা শহরে মাটির তৈরি রাস্তায় কিংবা বীজতলায় যেভাবে ইটের কোণা ব্যবহার করে ত্রিভূজাকৃতির বেড় দেয়া হয়, এখানেও ঠিক সেরকমটা দেখে বাস্টার্ডের মনে হলো কাজটা বাংলাদেশি শ্রমিকেরা করেছে কি না। এখানে প্রচুর এ দেশিয় শ্রমিক কাজ করে, ফলে তার এই ধারণা অমূলক না-ও হতে পারে।
পথে দেখতে পেলো তিন-চারটা ময়ূর এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। গাছগাছালির ফাঁকে একটা হ্যামোকও চোখে পড়লো।
তাদের ভিলাটা সৈকতের ঠিক পরেই। বাংলো-টাইপের ভিলাটার সামনে গ্রামের মতো মাটির একটা উঠানও আছে। একো-ভিলা নামে পরিচিত কাঠের বাড়িটা বেশ ছিমছাম, আধুনিক আর সুন্দর।
ভিলার আরেক পাশ দিয়েও সৈকতে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। সেখানে বড় বড় ছাতা আর তার নিচে কাঠের তৈরি বিচ রিক্লাইনার চেয়ার পাতা। গোড়ালিসমান পানিতে একজোড়া দোলনাও রাখা আছে। ওখান থেকে কাছের দুয়েকটা মিনি আইল্যান্ড দেখা যায়।
ভিলার বাইরের দিকে ছোট্ট একটা সুইমিংপুল আর বারান্দা আছে। তাদের ভিলার গেটে ৩০৩ নাম্বার লেখা। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে বাস্টার্ড জানে, এর মানে এটা তিন শ” তিন নাম্বার ভিলা নয়-তিন নাম্বার ভিলা হবার সম্ভাবনাই বেশি। তবে তার আগে তিন-শূন্য জুড়ে দেয়ার কারণ অন্য কিছু। হয়তো চারদিকের চারটা জোনে বিভক্ত ভিলাগুলো। তারা উঠেছে তিন নাম্বার জোনের তিন নাম্বার ভিলায়।
ভিলার ভেতরে তিনটা বেডরুম, একটা লিভিং। চারপাশে প্রচুর জায়গা। কাঠের তৈরি বলে অন্যরকম আভিজাত্য আছে সবখানে। এটা নিশ্চিত পৃথিবীর সেরা স্থপতিদের দিয়ে এসব ভিলার ডিজাইন করা হয়েছে। ইন্টেরিওরের বেলায়ও একই কথা খাটে I
“টাকা-পয়সার কী অপচয়টা না করেছে এরা!” দুজন রিসেপশনিস্ট তাদেরকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে চলে যাবার পর হুইল চেয়ার থেকে উঠে বলল কিসিঞ্জার। এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি, শুধু দেখে গেছে। “এদের টার্গেটই হলো দুনিয়ার সব ধনী লোকজন। তোমার আমার মতো লোকজন জীবনে একবারের বেশি আসবে না এখানে।”
মুচকি হাসলো বাস্টার্ড। সে যেটা করতে এসেছে, সেটা যদি করতে পারে তাহলে দুবাইকে চিরতরের জন্য বিদায় জানাবে।
“অসহ্য!”
কিসিঞ্জারের দিকে তাকালো।
“নিরিবিলির কথা বলছি,” মিটিমিটি হেসে বলল।
সত্যি বলতে ভিলায় আসার পথে কর্মচারি ছাড়া একজন গেস্ট ও দেখেনি। চারপাশটা অনেক বেশি নির্জন আর বিরাণ। অদ্ভুত এক সৌন্দর্য আছে জায়গাটাতে।
“জন্মেছি পুরান ঢাকার এক চিপা গলিতে, জীবনের বেশিরভাগ সময় তো সেখানেই ছিলাম…এত নির্জন জায়গা, এত কম মানুষজন আমার সহ্য হয় না!”
বাস্টার্ড চুপচাপ শুনে গেল লোকটার আহাজারি। যদিও তার কাছে কোলাহল কিংবা নির্জনতা দুটোই ভালো লাগে-নির্ভর করে সময় আর পরিস্থিতির উপরে। তবে সব সময়ই দ্রুত পরিবেশ-পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে
পারে সে।
“এরকম দ্বীপে আমি খুব ইনসিকিউর ফিল করি,” অসুস্থ লোকটা বলল। “তোমার কি এরকম হয়?”
কাঁধ তুলল বাস্টার্ড। “দ্বীপে কোনো বোট না থাকলে হয়।”
নিঃশব্দ হেসে ফেলল কিসিঞ্জার। “তুমি অনেক বেশি প্র্যাক্টিক্যাল।”
অধ্যায় ৭৪
নায়িকাকে নিয়ে ইয়টে করে আরব সাগরে তিন-চার দিন ফূর্তি করার পরও আলভীর মেজাজ খিটখিটে ছিল কেন সেটা কেউ জানে না।
দেশে সব সময় তার চারপাশে অনেক লোক থাকে। পার্সোনাল অ্যাসিসটেন্ট ছাড়া একটা কাজও করে না। এখানে দুজনের বেশি লোক নেই। আর যে দুজন আছে তারা তার মেজাজ-মর্জি ঠিকঠাক বুঝতে পারে না।
ইয়টে করে প্রমোদবিহারে যাওয়ার পরিকল্পনাটা সে হুট করেই নিয়েছিল, কারণ কয়েক দিন আগে তার মা এসে হাজির হয়েছে দুবাইতে। কেনজানি তার মনে হচ্ছে, মাকে এখানে ডেকে এনেছে তার স্ত্রী। নইলে দুবাইতে এসেই কেন হুকুমের স্বরে বলবে, আগামি মাসে যেন মাহিকে নিয়ে ওমরাহ হজ্ব করে আসে সে!
এরপর যদি তার মা তাকে দিয়ে তওবা পড়ানোরও ব্যবস্থা করে সে অবাক হবে না। কিন্তু চাইলেও মায়ের সঙ্গে রাগারাগি করতে পারে না আলভী। এ কাজ তার বাবার পক্ষেও করা কঠিন। যৌবনের শুরুতে শ্বশুড় বাড়ি থেকে কিছু টাকা নিয়ে ব্যবসা করেছিল তার বাপ, সেই ঋণ সম্ভবত এখনও শোধ হয়নি!
ইয়টে তার সঙ্গে যে চারজন গেস্ট ছিল তারাও এসেছে এই ওয়ার্ল্ড আইল্যান্ডে। আনতারা নামের একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি এই ওয়ার্ল্ড আইল্যান্ডের মালিক। রিল্যাক্স করার পাশাপাশি এখানে রিসোর্ট আর হোটেল ব্যবসা করার ইচ্ছে আছে তার। এই সব আইল্যান্ডে ব্যবসার সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখবে-রথ দেখা আর কলা বেচার মতো ব্যাপার আর কি।
তবে এখানে আসার সবচেয়ে বড় কারণ আসলে অন্যকিছু-আজ প্রায় দশদিন যাবত কোকেন নিতে পারছে না। দুবাইতে এ জিনিস সহজে পাওয়া- ও যায় না। অনেক ঝুঁকি নিয়ে জোগাড় করতে হয় বলে দামও বেশি পড়ে।
ভেবেছিল ইয়টে করে প্রমোদবিহারে গেলে ইচ্ছেমতো কোকেন নিতে পারবে কিন্তু সেটা হয়নি। কয়েক দিন আগে এক জার্মান ব্যবসায়ি অতিরিক্ত কোকেন নিয়ে পানিতে লাফিয়ে পড়েছিল, তাকে আর বাঁচানো যায়নি। এরপর থেকে ওয়াটার পেট্রল জোরদার করা হয়েছে। সন্দেহজনক ইয়ট-পার্টি নজরে পড়লেই তল্লাশী চালায়। এই ভয়ে ইয়টে কোকেন নিয়ে যেতে পারেনি। এটা তো আর বাংলাদেশ না, ধরা পড়লে ফোন করে কিংবা টাকা ঢেলে সহি সালামতে বের হয়ে আসবে।
পরিহাসের হাসি ফুটে উঠল আলভীর ঠোঁটে। তার গেস্টরা ভাবছে ঐ তিন-পয়সার নায়িকাকে ইম্প্রেস করার জন্য এই দ্বীপে এসেছে সে। সত্যিটা হলো এখানে আরামসে কোকেন সেবন করা যাবে!
এখানে জাফর নামে এক বাংলাদেশি বন্ধু আছে তার, শেখ পরিবারের কাছের এক লোকের সঙ্গে ওর ভালো সম্পর্ক, দুবাইতে গোল্ডের ব্যবসা করে। খুবই রিসোর্সফুল একজন মানুষ। জাফরই তাকে বলেছিল ওয়ার্ল্ড আইল্যান্ডের কথা। এখানকার মাত্র কিছু দ্বীপে হোটেল-কটেজ-ভিলা আর রিসোর্ট চালু হয়েছে, বাকিগুলো মেঘনার চরের মতোই বিরাণ
পোল্যান্ড আইল্যান্ডে বড় বড় ভিলা আর প্যালেস রয়েছে, ওগুলো যেমন নিরাপদ তেমনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনির ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। পারতঃপক্ষে কোনো রকম তল্লাশী করা হয় না। এই সুযোগটা নেয় অনেকেই। উদ্দাম সেক্স পার্টি আর ড্রাগস চলে যথেচ্ছভাবে। জাফরই তার পরিচিত এক লোকের মাধ্যমে ভালো পরিমাণের কোকেন পাঠিয়েছে এখানে। তারা উঠেছে প্রায় দশ-বারোটি বেডরুমের বিশাল এক ভিলায়।
নায়িকা খুকুমনি অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস দেখাচ্ছে এখানে আসার পর থেকে যা কিছু দেখছে ফটাফট ছবি তুলে নিচ্ছে। বিরক্তিকর লাগছে তার কাছে। “ওয়াও-মাই গড-ইশ” ছাড়া মুখ দিয়ে আর কিছু বের হয়নি প্রথম দু দিন। এই মেয়েটার সবকিছুই ফেইক মনে হয় তার কাছে। এমনকি শীৎকারগুলো পর্যন্ত! অনেক মেয়ের সঙ্গেই সেক্স করেছে সে কিন্তু কোনো মেয়েই এরকম আহ-উঁহ করেনি। পর্নো ছবির মতো এত বেশি করে যে, চড় দিয়ে মুখটা বন্ধ করে দিতে ইচ্ছে করে।
খুকুমনিকে কড়া করে বলে দেয়া হয়েছে ছবির ফ্রেমে যেন আলভী না থাকে। মেয়েটাকে ফোনে নেট ব্যবহার করতেও দেয়া হয়নি। এখান থেকে বিদায় নেবার সময় ওর ফোন চেক করে দেখা হবে। এসব ব্যাপারে আগে অতোটা সতর্ক ছিল না কিন্তু এখন খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখে এগুলো।
খুকুমনিকে যে কেউ দেখলে আকর্ষিত হবে, আলভীও হয়েছে আর হয়েছে বলেই পনেরো লাখ টাকায় দশদিনের জন্য নিয়ে আসা হয়েছে। এই মেয়েটাকে নিয়ে মিডিয়াগুলো খুব হইচই করে। দুয়েকজন মন্ত্রিও নাকি ভন ভন করে ওর পেছনে। অনেকের কাছ থেকেই শুনেছে এই মেয়ে বিছানায় দুর্দান্ত, সেজন্যেই ভেবেছে একটু পরখ করে দেখবে।
কিন্তু কোকেন ছাড়া এই মেয়েকেও সেভাবে আকর্ষিত করেনি। ইয়টের সময়টা একদম বাজে কেটেছে। চারদিকে সমুদ্র ছাড়া আর কিচ্ছু ছিল না। এদিকে অতিরিক্ত ন্যাকা, নিজেকে দুনিয়ার সেরা সুন্দরি ভাবা বাকপটু এই নায়িকাকে নিয়ে পড়েছিল মহা ফ্যাসাদে। তাকে জাগাতে বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে এই মেয়ে।
সত্যি বলতে, শুধু নারী না, ইতালিয়ান আর স্পেনিশ কুইজিনও বিস্বাদ লেগেছিল তার কাছে। তখনই ঠিক করে, যে করেই হোক কোকেন নিতে হবে, এভাবে আর থাকা সম্ভব নয়। তার মেজাজ, রুচি আর খিদে সবকিছুর বিপর্যয় ঘটে গেছিল কোকেন না নেবার কারণে। জাফর যদি প্যাকেটটা না পাঠাতো তাহলে এই ওয়ার্ল্ড আইল্যান্ডও বিরক্তিকর লাগতো তার কাছে। এখন যে কয়টা দিন আছে ইচ্ছেমতো নিতে পারবে।
থ্রি-কোয়ার্টার আর বিচ-শার্ট পরে বিশাল ভিলা থেকে একা একাই বের হয়ে গেল আলভী। একটু আগে কোকেন নেবার পর তার ইচ্ছে করছে বিচে হাঁটাহাঁটি করতে। কিন্তু পশ্চিম দিকের বিচে নয়, পুবদিকে ভিলার পেছনের সৈকতে চলে এলো সে। এ জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। টুরিস্টের সংখ্যা খুব কম এই আইল্যান্ডে। বেশিরভাগ রিসোর্ট-ভিলা আর হোটেলগুলো খালি পড়ে আছে। এসব দেখে এখানে ব্যবসা করার যে চিন্তাটা ছিল বাদ দেবার কথা ভাবছে এখন। এত কম প্রফিট মার্জিন তার বাড়ির চাকর-বাকরদেরও পোষাবে না।
বিচের একটা রিক্লাইন-চেয়ারের কাছে আসতেই থমকে দাঁড়ালো সে। একটু দূরে, সমুদ্রের উপরে চার-পাঁচটা ভাসমান ঘর দেখতে পেলো। আগ্রহি হয়ে কাছে এগিয়ে গেল আলভী। সানগ্লসটা খুলে ভালো করে দেখলো। প্রথম দেখায় মনে হয়েছিল ছোটোখাটো লঞ্চ কিংবা ইয়ট। জিনিসটা আসলে অন্য কিছু। ভাসমান দোতলা বাড়ি বলে মনে হচ্ছে তার কাছে। তবে সমুদ্রের স্রোতে নড়ছে না সেগুলো।