অধ্যায় ৬৫
আল আমাল স্ট্রিটে ফিরে আসার পর ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছে বাস্টার্ড কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি।
কিসিঞ্জার কেন, অন্য কেউ হলেও তাকে বিশ্বাস করতো না সে। বিশ্বাস হলো একটা সিদ্ধান্ত, আর সেটা নেবার প্রক্রিয়াটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো কিছু না ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়াটা অন্ধবিশ্বাসের মধ্যে পড়ে। তার পক্ষে কাউকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। এ কাজ সে কখনওই করেনি। করেনি বলেই আজো বেঁচে আছে।
আরেকটা গুণ আছে তার যেকোনো ব্যাপারে প্রথমে খারাপটা ভাবে সে। কিসিঞ্জারের বেলায়ও সেটা করলো। পরিস্কার মাথায় পুরো বিষয়টা নিয়ে ভেবে গেল বিছানায় শুয়ে শুয়ে।
কিসিঞ্জারের সাথে তার কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। তারা কেউ কাউকে চিনতোও না। লোকটার নাম পর্যন্ত জানতো না সে। তবে কিসিঞ্জার অবশ্য তার নাম জানতো। এ-ও জানতো সে কী করে। অমূল্যবাবুকে জিম্মি করে তাকে দিয়ে শেষ একটা কাজ করাতে চেয়েছিল এই লোক। কিন্তু বাবুকে দেখে হতবাক হয়ে যায়। ওদিকে তার ভাইকে জিম্মি করার ফলে বেকায়দায় পড়ে যায় সে। শেষ পর্যন্ত রক্তারক্তি ছাড়াই পরিসমাপ্তি ঘটে সেই অধ্যায়ের।
ক্যান্সারে আক্রান্ত এই লোক আর বেশিদিন বাঁচবেও না। সূদূর প্রবাসে একাকী নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যুর দিন গুণছে। তার অন্য কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? চাইলে তাকে এখানে ফাঁসিয়ে দিতে পারে অনায়াসে। আলভীকে জানিয়ে দিতে পারে তার কথা। কিন্তু সেটা করবে বলে মনে হয় না। তাকে ফাঁদে ফেলে এই লোকের কী লাভ? প্রতিশোধ নেবার জন্য করতে পারে? সেটাও যৌক্তিক মনে হচ্ছে না। তার একটা কথা সে বিশ্বাস করেছে-আর যাই হোক সে কৃতঘ্ন নয়।
এসব চিন্তা-ভাবনার পরও শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না। এটা স্পষ্ট অমূল্যবাবুর প্রতি লোকটার আনুগত্য আছে। বাবুকে এই লোক গুরু মানে, সুতরাং তার সঙ্গেই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলো।
হোয়াটসঅ্যাপে কল করলো বাস্টার্ড, যদিও জানে বাবু সব সময় অনলাইনে থাকার লোক নয়। আর সেটাই দেখতে পেলো-অনলাইনে নেই। তবে সে কোনো মেসেজ দিয়ে রাখলো না। বাবু যখন দেখবে তাকে কল করেছিল দেরি না করে কল করবে তাকে।
বাইরে গিয়ে একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট থেকে লাঞ্চ করে এলো বাস্টার্ড, তারপর ঠিক করলো শহরের কিছু জায়গা ঘুরে দেখবে। যেহেতু ঘরে ফিরে গিয়ে কিচ্ছু করার নেই, অগত্যা সেটাই করলো।
সারাটা বিকেল জুমেইরাহ্ বিচে ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটালো সে। দূর থেকে বুরুজ আল খলিফা, বুরুজ আল আরাবসহ আইকনিক কিছু ল্যান্ডমার্ক দেখলো। এই শহর এত বেশি চাকচিক্যময় যে দমবন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় সবকিছুই বেশি বেশি। কিন্তু এই প্রাচুর্যের উৎস অন্যসব আরব দেশের মতো পেট্রোলিয়াম নয়—অনেকের মতো বাস্টার্ডও এটা জানতো না। এখানে আসার আগে ইন্টারনেট থেকে যতোটুকু জেনেছে, এই শেখশাসিত আরব- আমিরাতের জিডিপির মাত্র দশ শতাংশ আসে তেল থেকে। বাণিজ্যই হলো দুবাইর প্রধান আয়ের উৎস। এ বিশ্বের দুটো বৃহৎ বন্দর এবং একটি ব্যস্ততম ইন্টারন্যাশনাল এয়ার কার্গো হাব তাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। টুরিজমও বেশ ভালো ভূমিকা রাখে কিন্তু কোনোভাবেই তেল না।
তথ্যটা জেনে খুবই অবাক হয়েছিল সে। অনেক বছর আগে এখানে যখন প্রথম এসেছিল তখন ইন্টারনেটের তেমন একটা প্রচলন ছিল না। চাইলেও এসব তথ্য জানা যেতো না তখন। সে ধরেই নিয়েছিল অন্যান্য আরবদেশের মতো এরাও তেল বেচে এত শানশওকত করেছে। তার সেই ধারণা এবার বদলে গেছে।
জুমেইরাহ্ পাবলিক বিচে এসে একটা খালি বেঞ্চে বসলো বাস্টার্ড। এখানে স্বল্পবসনা নারী-পুরুষকে দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না এটা মুসলিম দেশ। অবশ্য বেশিরভাগই পশ্চিমা পর্যটক। দুবাই এখন পশ্চিমাসহ সারাবিশ্বের ধনীকশ্রেনির লোকজনের তীর্থস্থান হয়ে উঠেছে। আগের চেয়ে অনেক অনেক বেশি পর্যটক আসে এখানে। এটাও এখানকার আয়ের বড় একটি উৎস।
উত্তর-পশ্চিমে আরব সাগরের চমৎকার দৃশ্য দেখার সময়ই তার ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। পকেট থেকে বের করে দেখলো অমূল্যবাবু হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়েছে।
“আমি অনলাইনে খুব কমই থাকি,” কলটা রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে রাশভারি কণ্ঠে বলল বাবু।
“জানি,” জবাব দিলো বাস্টার্ড।
“বলো…” সরাসরি কাজের কথা জানতে চাইলো।
“কিসিঞ্জারের সঙ্গে দেখা হয়েছে আজকে।”
ও পাশ থেকে কিছু বলল না বাবু।
“বুঝতে পারছি না ওই লোক কিভাবে সব বুঝে ফেলল। আমাকে অবশ্য হেল্প করার অফার দিয়েছে।”
“তুমি কী বললে?”
“এখনও কিছু বলিনি,” একটু থেমে আবার বলল, “ওই লোককে বিশ্বাস করা যায়?”
ও পাশে নিরবতা নেমে এলো।
বাস্টার্ড জানে অমূল্যবাবু এখন ভাবছে ব্যাপারটা নিয়ে। সে-ও অপেক্ষা করলো।
“তুমি সাহায্য নিতে চাও কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছো না তাকে,” কথাটা প্রশ্নের মতো শোনালো না।
“হুম,” ছোট্ট করে বলল সে।
“ও তোমার কোনো ক্ষতি করবে না, শুধু এটুকু বলতে পারি।”
“ঠিক আছে,” ফোনটা রেখে দিলো বাস্টার্ড। অমূল্যবাবুর কথাটার মানে বুঝতে পেরেছে।
অধ্যায় ৬৬
“দুবাইতে!”
জেফরি বেগ কথাটা বললেও নিশ্চিত হতে পারলো না তার অভিনয় কতোটা ভালো হয়েছে। নিজের সম্পর্কে যতোটুকু জানে, অভিনয়টা ভালো হয় না তার।
“হুম,” গম্ভীর মুখে মাথা নাড়লো সাংবাদিক দিলান মামুদ। একটু আগে হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটরের ফ্ল্যাটে এসেছে সে।
“আপনি কোত্থেকে জানলেন এটা?”
“আমার এক বিশ্বস্তসূত্র বলেছে। জার্নালিজমের এথিকসের কারণে তার পরিচয়টা দিতে পারছি না।”
“বুঝতে পেরেছি,” জেফরি বলল সায় দিয়ে। কোনো ভালো সাংবাদিকই তার সোর্সের কথা অন্য কাউকে বলে না।
তবে কথাটা শুনে সে অবাকই হয়েছে। আগে পত্রিকার লোকজনদের গোপন সূত্র, বিশ্বস্ত সূত্র আর নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো নিয়ে তার মধ্যে যারপরনাই সন্দেহ ছিল। সে মনে করতো এগুলো আসলে সাংবাদিকদের মনগড়া কিছু। কিন্তু দিলান মামুদের কথা শুনে বুঝতে পারছে, এরকম সূত্র সত্যি সত্যি আছে। ঠিক একই কথা কায়সারও তাকে বলেছিল। একবার সে ভেবেছিল বাবলুকে মেইল করে দেবে কি না। দিলান মামুদ তাকে যে অ্যানোনিমাস মেইলারের কাছ থেকে পাওয়া খুনির ছবিটা দেখিয়েছিল তখন মেইল অ্যাড্রেসটা চোখে পড়েছিল, আর সেটা তার মনেও ছিল। যদিও পরে এই চিন্তাটা বাদ দেয় সে।
“কয়েক মাস আগে ওখানে বেশ দামি একটা পেন্থাউজ কিনেছে আলভী, ওখানেই উঠেছে সম্ভবত।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর।
“আমার আরেকটা সূত্র কী বলেছে, জানেন?” তারপর নিজেই জবাবটা দিলো, “ঐদিন জাহান সিটিতে যে আরেকজন খুন হয়েছিল, ওই লোকের পরিচয় এখন পর্যন্ত জানা যায়নি, তবে সে জাহান গ্রুপের কোনো এম্প্লয়ি না… দ্যাটস ফর শিওর।”
মনে মনে প্রমাদ গুণলো জেফরি বেগ। এই ঝাণু সাংবাদিক তো আসলেই সাংঘাতিক। “তাহলে সে কে?
কাঁধ তুলল দিলান। “আমি নিশ্চিত জাহান গ্রুপের কোনো পোষা খুনি সে। অ্যানোনিমাস সেন্ডার ঠিকই বলেছে।”
“আপনার কেন এটা মনে হলো?”
“বাকি দুজন ওদের এম্প্লয়ি হলেও এই লোক সেরকম কেউ না। জাহান গ্রুপের মালিকপক্ষ এতো বোকা নয় যে পেশাদার খুনিকে কর্মচারি হিসেবে রাখবে।”
“হুম, তা ঠিক,” সায় না দিয়ে পারলো না জেফরি।
“আরেকটা পয়েন্টের কথা ভুলে গেছেন,” ক্র্যাক্ড নিউজের সর্বেসর্বা বলল। “ওরা লাশটা পর্যন্ত গুম করে ফেলেছে। এ কাজ কিন্তু বাকি দুজনের বেলায় করেনি।”
“ইট ডাজ মেক সেন্স।”
“কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না, ওদের পেছনে লাগলো কে! এরকম শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ওদের আছে জানতাম না। ব্যাপারটা পুরোপুরি মিস্টেরিয়াস।”
প্লিজ, এটা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না! মনে মনে বলল জেফরি বেগ। আনমনেই তার ভুরু কপালে উঠে গেল। সামনে বসা সাংবাদিককে সমীহ করে, এখন সেই সমীহ ভীতিতে পরিণত হয়েছে। এই দিলান মামুদ যে আসলেই জাঁদরেল সাংবাদিক, সে বিষয়ে তার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না কখনওই কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই লোকের বিশ্লেষণী ক্ষমতাও বেশ ভালো। এমনিতেই অনুসন্ধানী সংবাদিকতায় এতটা নাম করেনি।
“আমি শিওর কোনো রাইভাল করেনি। রাইভাল্রা ভালো করেই জানে সরকারের সঙ্গে জাহান গ্রুপের খাতির কেমন। এরকম ঘটনা ঘটালে পাল্টা আঘাতটা কী রকম হতে পারে সেটা ওরা আমার আপনার চেয়ে ভালো বোঝে। কাজটা যে-ই করুক, প্রতিশোধ নেবার জন্য করছে…লাইক, জাহান গ্রুপের কোনো নেমেসিস?”
আবারো সায় না দিয়ে পারলো না জেফরি বেগ। “আপনার কী মনে হয়, কারা করতে পারে এটা?”
ঠোঁট ওল্টালো দিলান মামুদ। “এই মুহূর্তে বলতে পারছি না, তবে আমি কাজ করে যাচ্ছি, আশা করি বের করতে পারবো এটা।”
ওহ্! মনে মনে বল হোমিসাইডের জাঁদরেল ইনভেস্টিগেটর।
অধ্যায় ৬৭
আলভী এখন পেন্থাউজে নেই?!
কৌতুহলি হয়ে উঠল বাস্টার্ড। অমূল্যবাবুর সঙ্গে কথা বলার পর গত রাতে ফোন দিয়েছিল কিসিঞ্জারকে। ওপাশ থেকে কণ্ঠটা শুনে মনে হয়েছিল লোকটা জানতো তাকে ফোন দেবে সে। আজ সকালে জুমেইরাহ্ বিচে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে আবার।
“তাহলে কোথায় আছে?”
“প্রমোদ বিহার করছে,” বলল কিসিঞ্জার। “আরব সাগরের কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
“আরব সাগর?
“ওইটা…” সামনের বিস্তৃত জলরাশির দিকে ইঙ্গিত করলো। “অনেকে পারস্য উপসাগরও বলে।”
“আপনি কী করে জানলেন প্রমোদ বিহারের কথা?”
স্মিত হাসি দিলো। “এখানকার এক গোল্ড ব্যবসায়ির সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, অনেক আগে থেকেই চিনতাম, তার কাছ থেকে জেনেছি, “ সন্দেহ দূর করে দিয়ে বলল। “দুবাইতে আলভীর ঘনিষ্ঠদের একজন ওই লোক। সম্ভবত আলভীও তার ব্যবসার পার্টনার, তবে বেনামে। লোকটা ডামি প্রডিউসার দিয়ে দেশে সিনেমার ব্যবসাও করে। দুবাইতে আলভীর জন্য এক নায়িকাকে নিয়ে এসেছে সে, ওই মেয়েকে নিয়েই এখন ইয়টে করে ঘুরে বেড়াচ্ছে সমুদ্রে। বিতর্কিত নায়িকা খুকুমনি…নামটা শুনেছো নিশ্চয়ই?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো বাস্টার্ড। সত্যি বলতে এই নায়িকার নাম কিছুদিন পর পরই মিডিয়াতে উঠে আসে তার কর্মের কারণে নয়, অপকর্মের জন্য। আর লোকজনও হুমড়ি খেয়ে পড়ে তার এই কাণ্ডকীর্তির খবর গেলার জন্য।
ভাইরাল কুইন!
“কয়েকদিন আগে আলভীর মা-ও চলে এসেছে দুবাইতে…” কিসিঞ্জারের ঠোঁটে বাঁকা হাসি। “…পেন্থাউজেই উঠেছে।”
বাস্টার্ড অবাক হলো না কথাটা শুনে। সোনিয়া নামের মেয়েটাকে আসলে আলভীর মা-ই খুন করিয়েছে। জাহান গ্রুপের দুজন আর সেই খুনি নিহত হবার পর নিশ্চয়ই শাহজাহান করিম তার স্ত্রীর ব্যাপারে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, সেজন্যেই দুবাইতে পাঠিয়ে দিয়েছে।
“ইয়টে কে কে আছে?”
বাস্টার্ডের দিকে স্থিরচোখে তাকালো কিসিঞ্জার। “ঐ গোল্ড ব্যবসায়ি, তার ডামি প্রডিউসার, নায়িকা আর আলভী। দুয়েকজন হেল্পিং হ্যান্ডসহ ইয়টের তিন-চারজন লোক।”
“কতোদিন থাকবে ওখানে?”
কাঁধ তুলল ক্যান্সারে আক্রান্ত লোকটি। “তা জানি না। আরব সাগরে ঘুরে বেড়াচ্ছে…পার্টিকুলার কোথায় আছে সেটাও জানার উপায় নেই,” তারপর জোর দিয়ে বলল, “ওখানে, ওই ইয়টে কিছু করার কথা চিন্তাও কোরো না।”
“কেন?”
“ইয়টের জন্য ওখানে রেস্ট্রিক্টেড জোন আছে, কড়া পেট্রল থাকে… তুমি যেটা করতে চাও সেটা ওখানে করা অসম্ভব।
বাস্টার্ডও বুঝতে পারলো ব্যাপারটা।
“সত্যি বলতে দুবাইর কোন জায়গাতে যে কাজটা করা সম্ভব বুঝতে পারছি না,” তার মুখের হাসি উধাও হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। “দাদা তোমাকে তার সন্তানের মতো দেখে… এখনও সময় আছে, আরেক বার ভেবে দেখো।”
পার্থিব রায় চৌধুরি ওরফে বাবলু চুপ মেরে রইলো।
“দুবাই খুবই কঠিন জায়গা। কাজটা করতে পারলেও এখান থেকে বের হওয়া আরো বেশি কঠিন হয়ে যাবে তোমার জন্য।”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো বাস্টার্ড।
“দুবাইকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে দামি আর ফিউচার সিটি। এখানকার শেখের দাবি দুবাই এ বিশ্বের একমাত্র জিরো-ক্রাইম সিটি। কথাটা সম্ভবত মিথ্যে নয়। এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা পৃথিবীর সেরা। এরকম দক্ষ পুলিশ, কমান্ডো বাহিনি, সার্ভিলেন্স সিস্টেম আর এমার্জেন্সি কুইক রেসপন্স টিম পৃথিবীতে কমই আছে।” একটু থামলো সে। “খুব কম জায়গাই তুমি পাবে যেখানে সিসিক্যাম নেই। ক্রাইম হবার দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে এমার্জেন্সি কুইক রেসপন্স টিম মাঠে নেমে পড়বে, সবগুলো পোর্ট-এয়ারপোর্টে অ্যালার্ট জারি করে দেয়া হবে, বের হওয়াটাও কঠিন হয়ে পড়বে তখন।” বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে গম্ভীর মুখে বলল, “মনে হয় না যে কাজ করতে এসেছো সেটা এখানে করতে পারবে। আমার মনে হয় দেশেই তুমি ভালো সুযোগ পাবে। এখানে তো আমি কোনো স্কোপই দেখছি না। তুমি বরং ফিরে যাও, বাবলু।”
এ কথার কোনো জবাব দিলো না পেশাদার খুনি। কিসিঞ্জার খুব একটা বাড়িয়েও বলেনি। এই আলট্রামডার্ন শহরের সিকিউরিটি ব্যবস্থা দুনিয়াব্যাপী প্রশংসিত
“ভাবছো, তোমাকে নিরুৎসাহিত করছি,” মাথা দোলালো ক্যান্সারে আক্রান্ত লোকটি। “তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, তাই তোমাকে সাহায্য করতে চাই। একা একা দুবাইতে এ কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাও সেটা আমি চাই না। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার গুরু অনেক কষ্ট পাবে…আমিও পাবো।”
“ওরকম সুযোগ না পেলে আমি কাজটা করবো না,” আশ্বস্ত করে বলল বাস্টার্ড। “এটা নিয়ে আমার মধ্যে কোনো তাড়া নেই। আমি বিশ্বাস করি, শিকার না, শিকারীই সুযোগ তৈরি করে দেয়।”
কিসিঞ্জারের মুখে আবারো তার হাসিটা ফিরে এলো। “বাহ্! দারুণ বলেছো তো! কথাটা আমার পছন্দ হয়েছে।”
অধ্যায় ৬৮
ছুটি শেষ হবার বেশ আগেই হোমিসাইডে জয়েন করলো জেফরি বেগ
এ কয়দিন নিজেকে ঘরে বন্দি রেখেছিল, কাজকর্ম থেকে ছিল দূরে। এতদিনে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। শোককে ভুলে থাকার জন্য আসলে ব্যস্ততার বিকল্প নেই। নিরবিচ্ছিন্ন অবসর শোককে আরো বেশি জাঁকিয়ে তোলে।
কাজের যোগ দেবার আগের দিন হোমিসাইডের মহাপরিচালক ফারুক আহমেদকে ফোন করে জানিয়েছিল। সব শুনে ভদ্রলোক বলেছে, জেফরি চাইলে যেকোনো দিন কাজে যোগ দিতে পারে।
অনেকদিন পর হোমিসাইডের হেডকোয়ার্টারে এসে কেমন অচেনা অচেনা লাগলো তার। মেইন গেটের দারোয়ান থেকে সবার চোখেমুখে সহমর্মিতার অভিব্যক্তি দেখতে পেলো সে। আর মনে মনে একটাই কামনা করলো, কেউ যেন এর চেয়ে বেশি কিছু না করে। তার কোনো সহমর্মিতার দরকার নেই। যে ক্ষতি হয়েছে সেটা যেমন তার, কষ্টটাও একান্তই নিজের।
হোমিসাইডের অধস্তনদের সঙ্গে দেখা করার সময়ও খেয়াল করলো তাদের চোখেমুখে চাপা সহমর্মিতা আছে কিন্তু সবাই চেষ্টা করছে স্বাভাবিক আচরণ করার। সম্ভবত জামান তাদেরকে বলে দিয়েছে, কেউ যেন ভুলেও সমবেদনা না জানায়, রেবার মৃত্যু নিয়ে কোনো কথা না বলে।
নিজের অফিসে এসে আরদার্লি ছেলেটাকে এক কাপ কফির অর্ডার দিলো-প্রতিদিন অফিসে এসে যেমনটা করতো ঠিক সেরকম। এটা তার অলিখিত রীতিতে পরিণত হয়েছে।
যে কয়দিন সে ছুটিতে ছিল এই অফিস রুমের দরজা তালা মারা ছিল। তার কাজে যোগ দেবার উপলক্ষ্যে রুমটা ক্লিন করা হয়েছে গতকাল। ক্লিন করার সময় জামান উপস্থিত ছিল, যাতে কোনো মূল্যবান ফাইল বেহাত হয়ে না যায়-জাহান গ্রুপের বিপুল টাকা অনেককেই বিপথগামী করতে পারে। সেজন্যে কোনো ঝুঁকি নেয়নি। সবগুলো ফাইল ঠিকঠাক আছে দেখে স্বস্তি পেলো জেফরি।
কফি আসার পর তাতে চুমুক দিয়ে ভাবতে লাগলো, বাবলু কি দুবাইতে চলে গেছে কি না। তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। কখনও ছিলও না। জাহান গ্রুপের কয়েক জনকে খুন করার পর সে কোথায় আছে, কী করছে জানতে ইচ্ছে করছে খুব।
বাবলুর কাজ করার পদ্ধতি একেবারেই ভিন্ন। যে কাজটা জেফরি বেগের করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়, এই ছেলে স্রেফ কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে জেনে নিতে পারে। খুব কম লোকই তখন মিথ্যে বলার সাহস রাখে। ধোঁকা দেবার তো প্রশ্নই ওঠে না।
ও কি দুবাইতে চলে গেছে?
“স্যার, আসবো?”
সম্বিত ফিরে পেয়ে দরজার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো জামানকে। “আসো,” কফির কাপটা ডেস্কের উপরে রেখে দিলো। “বসো।”
সহকারি ইনভেস্টিগেটর চেয়ারে বসে পড়লো। “অনেক ধুলোবালি জমে গেছিল, ভালো করে ক্লিন করিয়েছি।”
“থ্যাঙ্ক ইউ, জামান।”
“সব ফাইল ঠিক আছে না, স্যার?”
ডেস্কের উপরে রাখা অনেকগুলো ফাইলের দিকে তাকালো জেফরি। “হুম, ঠিক আছে।”
“জাহান গ্রুপের দুই কর্মকর্তার খুনের তদন্তে খুব বেশি আগাতে পারিনি, একদম ক্লুলেস কেস মনে হচ্ছে।”
জেফরি বেগ কিছু বলল না।
“ভিক্টিমের পরিবার আর কর্মস্থলের কেউ কিচ্ছু বলতে পারছে না। ওরা- ও হতবাক। ঐ দুজনের সঙ্গে এমন কারোর শত্রুতা ছিল না যে খুন-খারাবির মতো ঘটনা ঘটবে।”
“শত্রুতা যদি থেকেও থাকে তাহলে তো জনে জনে সেটা জানার কথা নয়,” হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর বলল। “ব্যক্তিগত শত্রুতা থাকলে পরিবার হয়তো জানতো কিন্তু আমার মনে হয় এটা জাহান গ্রুপের সঙ্গে রিলেটেড।”
“ঠিক, স্যার,” সায় দিলো জামান। “আমার তো মনে হয় সোনিয়া মার্ডার কেসটার সঙ্গে এই খুনের সম্পর্ক আছে।”
ভুরু কপালে উঠে গেল জেফরির। “কী রকম?”
“ঐ দুজন হয়তো সোনিয়া মার্ডারের ব্যাপারে এমন কিছু জানতো যেটা খুবই সেন্সেটিভ? ওদেরকে দিয়ে কাজটা করিয়ে তারপর ঝেড়ে ফেলেছে, এমনটা হতে পারে না?”
“হতে পারে,” আস্তে করে বলল জেফরি। “শোনো, এবার কাজের কথায় আসি। এখন থেকে সোনিয়া মার্ডার কেসটা আমাদের ফার্স্ট প্রায়োরিটি হওয়া উচিত। অনেকদিন ধরে ওটা থমকে আছে। আমরা কিন্তু অনেক দূর এগিয়ে গেছি আর সামান্য কিছু কাজ করলেই হয়ে যাবে।”
কথাটা শুনে অবাক হলো জামান। সে অবশ্য জানে না মহাপরিচালক ফারুক আহমেদ হোমমিনিস্টারের সঙ্গে দেখা করে এ ব্যাপারে গ্রিন সিগন্যাল পেয়েছে। “স্যার, একটা কথা বলবো…যদি কিছু মনে না করেন?”
দীর্ঘদিনের সহকারির দিকে স্থিরচোখে তাকালো জেফরি বেগ। “অন্য কেউ বললে কী বলতাম জানো?” তারপর নিজেই বলল, “বলতাম, কিছু মনে করার মতো ঝুঁকি থাকলে কথাটা বলার দরকার নেই।” জামানের হতবিহ্বল চেহারাটা দেখে হেসে ফেলল সে। “জোক্স অ্যাপার্ট…বলো?”
মথা নিচু করে ফেলল জামান। “আবার কী না হয়!”
চোয়াল শক্ত হয়ে গেল হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটরের। “সেই ভয়ে আমরা গুটিয়ে রাখবো নিজেদেরকে?” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা দোলালো। “ক্ষতি যা করার তা তো করেই ফেলেছে, এখন তাদেরকে পরিস্কার একটা মেসেজ দিতে হবে, এসব করে শেষ পর্যন্ত কোনো ফায়দা হবে না।
মুখ তুলে তাকালো জামান।
“তোমার আপু…রেবার মৃত্যুটা বিফলে যেতে পারে না।”
অধ্যায় ৬৯
“আমার সময় শেষ!”
কথাটা খুবই নির্বিকার কণ্ঠে বলল কিসিঞ্জার। কাইট বিচ নামের একটি জায়গায় সমুদ্র সৈকতের পাশে ওয়াকওয়ে আছে, তার পাশে অনেকগুলো স্টিলের বেঞ্চ, সেগুলোর একটাতে বসে আছে, তাদের সামনে আরব সাগর।
“ডাক্তাররা যে সময় বেঁধে দিয়েছিল তার চেয়ে বেশি সময় বেঁচে আছি। বোনাস লাইফ! তবে বুঝতে পারছি খুব বেশি সময় আর নেই, যেকোনো দিন ধরাশায়ি হয়ে যাবো।”
বাস্টার্ড কিছুই বলল না, চুপচাপ শুনে গেল লোকটার কথা।
“জীবনের শেষদিকে এসে দেশের জন্য খুব মায়া হচ্ছে, বুঝলে?” গভীর করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “সব বানচোত আর শুয়োরের বাচ্চারা একজোট হয়ে দেশটাকে শেষ করে দিচ্ছে তারা!”
হঠাৎ লোকটার মুখ থেকে এরকম কথা শুনে অবাক হলো সে। অনুশোচনা নাকি দেশপ্রেম জেগে উঠেছে? নাকি দুটোই?
“আমি নিজেও ঐসব হারামখোরদের সঙ্গে ছিলাম, তাই খুব অনুশোচনা হচ্ছে।”
জবাবটা পেয়ে গেল বাস্টার্ড।
“তুমি এটাকে কী বলবে?” কাঁধ তুলল সে। “আমি নিজেও বুঝতে পারছি না…খুব মায়া হয় আজকাল। অনেক তীব্ৰ মায়া।”
মনোযোগি শ্রোতার মতো লোকটার কথা শুনে গেল পার্থিব রায় চৌধুরি।
“আমার পেছনের জীবনটার দিকে তাকালে আফসোসও হয়। হয়তো অন্যভাবে হতে পারতো সবকিছু। কিন্তু কী আর করা, যা হবার হয়ে গেছে। এখন আর কিচ্ছু করার নেই। আমি আমার জিন্দেগির সফরটা শেষ করে ফেলেছি!”
কয়েক মুহূর্ত তারা কেউ কিচ্ছু বলল না। নির্জন এই জায়গাটা কেমন বিষন্ন লাগছে। একটা আধুনিক শহর, ব্যস্ত মানুষজন, ঢাকার তুলনায় সুনশানই বলা যায়।
“মাঝেমধ্যেই মনে হয়, আসলেই কি কিচ্ছু করার নেই?” কথাটা বলেই বয়সে তার চেয়ে ছোটো সঙ্গির দিকে ফিরে তাকালো।
বাস্টার্ড কী বলবে বুঝতে পারলো না। মানুষ যখন হাহাকার করে, বিলাপ করে তখন তাকে কোনো রকম সান্ত্বনা দিতে পারে না সে। তবে চুপচাপ পাশে বসে থাকতে সমস্যা হয় না। এখন সেটাই করছে।
“বেটার লেট দ্যান নেভার!” গম্ভীর কণ্ঠে বলল কিসিঞ্জার। “এখনও আমার হাতে অল্প কিছু সময় আছে…ভালো কিছু করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট।”
ক্যান্সারে আক্রান্ত লোকটার কথা পুরোপুরি বুঝতে পারলো না সে। অপেক্ষায় থাকলো, আরো কী বলে শোনার জন্য।
“আলভীর মতো খারাপ আর ক্ষতিকর একজন যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে সামান্য হলেও পাপমোচন হবে আমার। কী বলো, হবে না?”
বাস্টার্ড কিছু বলতে যাবে অমনি কিসিঞ্জারের ফোনটা বেজে উঠল।
“এক্সকিউজ মি,” পকেট থেকে ফোনটা বের করলো। ডিসপ্লে দেখে চোখ কুঁচকে তাকালো সে। “মনে হচ্ছে আলভীর কোনো খবর আছে।” কলটা রিসিভ করলো। “হ্যালো, কী অবস্থা?” মাথা নেড়ে সায় দিলো। “কবে গেছে?…ওহ্…ব্যাক করবে কয়দিন পর?… আচ্ছা, ফিরে আসার পর আমাকে একটু জানাবে…আমি আবার বাইরে চলে যাবো,” কলটা শেষ করে বাবলুর দিকে তাকালো। “এই লোক আলভীর খুব ঘনিষ্ঠ, ওকে বলেছিলাম প্রমোদ বিহার থেকে ফিরে এলে আমাকে যেন জানায়।”
অবাক হলো বাস্টার্ড। “আপনি যে এভাবে আলভীর খোঁজ-খবর নিচ্ছেন, ঐ লোক সন্দেহ করবে না?”
কিসিঞ্জারের নিঃশব্দ হাসিটা চওড়া হলো। “মাই ডিয়ার বাবলু, ভুলে গেছো আমি অনেক পুরনো খেলোয়াড়, অতো কাঁচা কাজ আমি করতে পারি?” তৃপ্তির হাসি দিলো এবার। “ওর ঘনিষ্ঠ লোককে বলেছি একটা বিষয় নিয়ে আলভীর সঙ্গে কথা বলতে চাই, সেজন্যে আমার সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দিতে।”
বাস্টার্ডের ভুরু কুঁচকে গেল।
“ডোন্ট ওরি,” আশ্বস্ত করলো তাকে। “ওরা এটাকে তদবির কিংবা কোনো বিজনেস ম্যাটার মনে করবে, অন্য কিছু না। আলভী আর ওর বাপ এখানে এলে অনেকেই দেখা-টেখা করে, বেশিরভাগই বিজনেস রিলেটেড I এরকম অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়াটা স্বাভাবিক।
মাথা নেড়ে সায় দিলো পার্থিব রায় চৌধুরি। দেখে মনে হলো এবার সন্তুষ্ট হতে পেরেছে। “এখন কি তাহলে ফিরে এসেছে ওই লোক?”
মাথা দোলালো কিসিঞ্জার। “না। ওখান থেকে ইউরোপে চলে গেছে!”
মনে মনে আৎকে উঠল পেশাদার খুনি। ইউরোপে!
“পোল্যান্ডে আছে এখন।”
তার বিস্ময়ের সীমা রইলো না। হুট করে আলভী পোল্যান্ডে কেন চলে গেল? তবে কি সে টের পেয়ে গেছে কিছু? বুঝে ফেলেছে?!