কন্ট্রোল – ৬০

অধ্যায় ৬০ 

এমন ঐশ্বর্য আর প্রাচুর্যের মাঝেও যে তার একঘেয়েমি লাগছে তাতে মোটেও অবাক হচ্ছে না। 

এই বিরক্তির কারণ আকাশচুম্বী দামের সুদৃশ্য পেন্থাউজ কিংবা এখন যেখানে বসে আছে সেই প্রশ্বস্ত টেরাস নয়। পঁচাত্তুর তলার উপর থেকে আরব সাগরের অনেকটুকুই দেখতে পাচ্ছে। এই পেন্থাউজের প্রায় সবগুলো টেরাস আর বেডরুম থেকেই আরব সাগর দেখা যায়। আরো দেখা যায় নিচের জুমেইরাহ্ বিচ এবং শত শত সুউচ্চ ভবন। তবে ওগুলোর প্রায় সবই নিচে পড়ে আছে। আশেপাশে এরকম সাতাত্তর তলার ভবন আর দ্বিতীয়টি নেই। 

গত বছর তেত্রিশ মিলিয়ন ডলার দিয়ে এই ট্রিপলেক্স পেন্থাউজটি কিনেছে আলভী। দুবাইর জুমেইরাহ্ বিচের মতো অভিজাত এলাকায় এরকম পেন্থাউজের মালিক বনে যাওয়াতে এক ধরণের গর্ব আছে তার। মাঝেমধ্যেই এখানে চলে আসে সময় কাটাতে কিন্তু এবার এসেছে একেবারেই ভিন্ন কারণে তার বাবা তাকে অনেকটা জোর করে এই অনাকাঙ্খিত ছুটিতে পাঠিয়ে দিয়েছে, সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে তার স্ত্রীকেও। সমস্যাটা আসলে এখানেই! 

মাহির সঙ্গে তার সম্পর্ক অনেকদিন থেকেই ভালো যাচ্ছে না। কেমন গুমোট আর শত্রুভাবাপন্ন। যেন এক ছাদের নিচে দুই প্রতিপক্ষকে অদৃশ্য কেউ বাধ্য করছে থাকতে। 

এই ট্রিপলেক্স পেন্থাউজে মাহি নিচতলায় উঠেছিল, সে উঠেছিল টপফ্লোরে। কিন্তু তিন-চার দিন আগে তার মা আসার পর রীতিমতো বাধ্য করেছে এক ছাদের নিচে থাকতে। আসল সমস্যার শুরু সেখান থেকেই। তারা স্বামী-স্ত্রী একই ফ্লোরে আছে অথচ কেমন গুমোট একটা পরিবেশ। কেউ কারো সঙ্গে পারতঃপক্ষে কথা বলে না। দরকারেও না। যখন বলে বুঝে নিতে হবে না পারতে বলেছে। এক ছাদের নিচে তিন-চার দিন থাকার পর রীতিমতো দম বন্ধ লাগতে শুরু করেছে এখন। তার মা উঠেছে তিয়াত্তুর তলায় কিন্তু দিনে কমপক্ষে দশ বার ওঠা নামা করে প্রাইভেট লিফট দিয়ে। মায়ের সামনে তাদের স্বামী-স্ত্রী দুজনকে অভিনয় করতে হয়। অসহ্যকর আর যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার সেটা। 

সত্যি বলতে স্ত্রীর পাশাপাশি মাকেও এখন তার সহ্য হচ্ছে না। ফারহান ওমর আর আকবর হাসানের খুনের পর থেকে তার সন্দেহ হচ্ছে, সোনিয়াকে সম্ভবত তার মা আর স্ত্রী মিলে খুন করেছে। আকবর হাসান তার মায়ের আত্মীয়, সম্ভবত এ কারণে তার বাবাকেও অন্ধকারে রাখা সম্ভব হয়েছে। 

কিন্তু তার মা হুকুম দিয়ে থাকলেও আসল উদগাতা অবশ্যই মাহি। খুব চালু মাল, দেখলে মনে হবে নরম আর শান্ত একটা মেয়ে, আদতে হিংসুটে আর ভয়ানক রকমেরই জেদি। বিয়ের পর পরই বুঝে গেছিল মায়ের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে ভুল করে ফেলেছে। ছোটোবেলার পাতানো সইয়ের মেয়েকে বউ করে নিয়ে এসেছিল তার মা। এই ব্যাপারটা নিয়ে কখনও মাথা-ই ঘামায়নি—সবই তো নিজের ইচ্ছায় করে, বিয়েটা না হয় মায়ের ইচ্ছাতেই করলো। কিন্তু কে জানতো, বিয়ে এতটা গুরুত্বপূর্ণ আর ভয়াবহ ব্যাপার। 

গ্রিন গ্রুপ এমন কোনো বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয়, তাদের তুলনায় বলতে গেলে নস্যি। এক শ বার কিনতে পারবে ওই বালের গ্রুপকে কিন্তু মাহির উন্নাসিক আর জেদি ভাব দেখলে মনে হবে তারা বুঝি জাহান গ্রুপকে দশ বার কিনতে পারবে! 

তার মা যদি বেঁচে না থাকতো কয়েক কোটি টাকা হাতে ধরিয়ে লাখি মেরে তাড়িয়ে দিতো এই মেয়েকে। মাঝে মধ্যে মাহিকে টেরাসের রেলিং দিয়ে পঁচাত্তুর তলার উপর থেকে ফেলে দিতেও ইচ্ছে করে তার। সোনিয়াকে সরিয়ে দিয়ে কেমন একটা চাপা খুশি বিরাজ করছে তার চোখেমুখে। 

কিন্তু একটা ব্যাপার তার মাথায় ঢুকছে না, সোনিয়া কোথায় থাকতো সেটা তার মা আর স্ত্রী কী করে জানলো? 

চোখের সামনে বিস্তৃত আরব সাগরের দিকে ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। পরিহাসের বিষয় হলো সবাই ভাবছে সোনিয়াকে সে-ই মেরেছে। খুনি ভাবছে তাকে। মুখটা তিক্ততায় ভরে উঠল আলভী করিমের কিন্তু তেত্রিশ মিলিয়ন ডলারের লাক্সারি পেন্থাউজের টেরাসে বসে আর যা-ই করা যাক না কেন, থুতু ফেলা যায় না। 

অথচ সোনিয়াকে নিছক ব্যবহার করেনি সে। শুরুতে ভেবেছিল একটু আধটু ফূর্তি করে ছেড়ে দেবে কিন্তু সেটা আর হয়নি, খুব দ্রুতই মেয়েটার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। ওর কথা বলার ধরণ, অভিমান, হাসি, সব ভালো লাগতো। নেশার মতো টানতো। সত্যিকারের ভালোবাসা সম্ভবত এমনটাই হয়। এর আগে এরকম কোনো কিছুর সঙ্গে তার পরিচয় হয়নি। শানশওকতের মধ্যে জন্ম তার, ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ার সময় বুঝতে পেরেছিল চেহারা-সুরুত কিংবা গায়ের রঙ যা-ই হোক না, ছেলেমেয়ে দুই মহলেই দারুণ চাহিদা আছে তার। তখন থেকেই মেয়েদের সঙ্গে ওভাবে মেলামেশা করতে শুরু করে। কখনও কোনো মেয়ে তাকে বিমুখ করেনি, যাকে চেয়েছে তাকেই পেয়েছে। এমনকি বাজি ধরে অন্যের গার্লফ্রেন্ডকেও বিছানায় নিয়ে গেছে সে। 

কলেজে ওঠার পর নারীমহলে তার খ্যাতি আরো বেড়ে যায়। দামি দামি গিফট দিয়ে আস্তে ধীরে কোনো মেয়েকে বিছানা অবধি নেয়াটাকে জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য মনে করতো। এক সময় তার কাছে নারী মানে বিছানার সঙ্গি হয়ে যায়-কে কতোটা ভালো পারফর্ম করে সেটা দিয়েই বিচার করতো তাদেরকে-অমুকে বেশ ভালো, তমুকে মোটামুটি। আর ও? একদমই পারে না! 

স্ত্রীর কর্কশ আর উন্নাসিক কণ্ঠটা শুনে আলভী ফিরে তাকালো কাচের দরজাটার দিকে। এক হাউজমেইডকে কী নিয়ে যেন ধমকাচ্ছে। 

তিক্ত মুখে আবারো ফিরে তাকালো আরব সাগরের দিকে। তার মা আর স্ত্রীর কোনো ধারণাই নেই কী করেছে তারা! দোজখের দরজা খুলে দিয়েছে! এদের কারণেই আজ তার ঘনিষ্ঠ আর বিশ্বস্ত দুজন লোক কুকুরের মতো মারা পড়েছে। এমনকি যে খুনি তাদের হয়ে কাজ করেছে দীর্ঘদিন ধরে, তাকেও রেহাই দেয়া হয়নি। অবশ্য মঙ্গু খুন হওয়াতে খুশি হয়েছে সে! হারামজাদা সুযোগ পেয়ে সোনিয়ার সঙ্গে খারাপ কাজ করেছিল। মঙ্গু যদি বেঁচে থাকতো নিজ হাতে খুন করতো তাকে। 

সবচেয়ে হতাশাজনক ব্যাপার হলো খুনগুলো কে করেছে কেউ বলতে পারছে না। ঐ জেফরি বেগকে সন্দেহ হয়েছিল শুরুতে কিন্তু সরকারে তাদের ঘনিষ্ঠ লোকজন আছে প্রচুর, তারা জোর দিয়ে বলেছে এর সঙ্গে ঐ অফিসারের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রেমিকাকে হারিয়ে শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, নিজের ফ্ল্যাট থেকে বেরই হয় না। যখন বের হয় তখন সোজা কবরস্তানে গিয়ে দীর্ঘদিনের প্রেমিকার জন্য কান্নাকাটি করে। 

খবরটা শুনে খুব ভালো লেগেছিল তার। হারামজাদা! কপাল ভালো এখনও বেঁচে আছে, প্রেমিকার জন্য অন্তত কান্নাকাটিটা করতে পারছে! তাকে চড় মারার শাস্তি কেমন হতে পারে, সেটা বুঝতে পারছে নিশ্চয়ই। এখন তো প্রেমিকা গেছে, সময় আর সুযোগ পেলে তাকেও দেখে নেবে। 

এই জেফরি বেগ নামের লোকটাকেই মারতে চেয়েছিল সে কিন্তু তার বাবার কড়া হুকুম, ঐ অফিসারের গায়ে যেন ফুলের টোকাটাও না পড়ে। তার কিছু হয়ে গেলে নাকি সামাল দিতে পারবে না। তার বাপ অবশ্য এখনও সামাল দিতে পারছে না। তাদের উপরে এত বড় আঘাত করা হয়েছে, অথচ কে বা কারা করছে সেটা পর্যন্ত বের করতে পারছে না। এত কোটি কোটি টাকা খরচ করে মন্ত্রি-মিনিস্টার আর পলিটিশিয়ান পেলেপুষে কী লাভ হলো তাহলে? সত্যি বলতে মাঝেমধ্যে তার মনে হয়, তাদের কোনো অদৃশ্য প্রতিপক্ষ সুযোগ নিচ্ছে হয়তো। যদিও এ কাজ করার মতো কেউ আছে বলেও মনে করতে পারছে না। 

মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলল আলভী। কতোক্ষণ আর এইসব সৌন্দর্য দেখে দেখে সময় কাটানো যায়! মনে শান্তি না থাকলে সুন্দরও যে অসহ্য লাগতে পারে আগে বোঝেনি। এখানে আসার পর থেকে পঁচাত্তুর তলার উপরে বসে বসে আরব সাগরের সৌন্দর্য দেখছে দিনমান। বেশি বিরক্ত হলে রুফটপে চলে যায়, ওখানে এই বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং তিন শ ষাট ডিগ্রির সুইমিংপুলে সাঁতার কাটে। এছাড়া আর কিছু করার নেই। চরম বিরক্তি চলে এসেছে এরইমধ্যে। এ থেকে বেরোতে হবে। তেত্রিশ মিলিয়ন ডলারের এই পেন্থাউজ তাকে সুখ-শান্তি বাদে আর সবই দিতে পারছে! 

চট করেই একটা ভাবনা চলে এলো মাথায়, পকেট থেকে ফোন বের করে একটা নাম্বারে ডায়াল করলো। 

“ওয়ালাইকুম সালাম…কী অবস্থা?” সুবিশাল আরব সাগরের দিকে ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে বলল ওপাশের জনকে। “…হুম, দুবাইতে আসছি…নতুন যেটা কিনলাম লাস্ট ইয়ারে…হ্যাঁ, ওইখানেই…” একটু থেমে কাচের স্লাইডিং ডোরের দিকে ফিরে তাকালো, নিশ্চিত হয়ে নিলো মাহিকে দেখা যাচ্ছে না। 

“বিরক্ত হইয়া গেছি পুরা…হুম, ব্যবস্থা করো আর ভাল্লাগতাছে না…এইখানে বইস্যা বইস্যা হাঁপায়া গেছি…ওরে ম্যানেজ করতে পারবা?…তাইলে নিয়া আসো… পার্সোনাল অ্যাকাউন্টেন্টরে বইলা দিতাছি আমি…তাড়াতাড়ি চইলা আসো ওইটারে নিয়া।”

ফোনটা রেখে হাঁপ ছাড়লো সে। এই গুমোট আর বিরক্তিকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ পেয়ে গেছে। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। টাকায় কী না হয়! যখন হয় না তখন বুঝে নিতে হবে সমস্যাটা আসলে অন্য কোনোখানে! এতদিনে এইটুকু অন্তত বুঝতে পেরেছে সে। 

অধ্যায় ৬১ 

মোবাইলফোনের যুগে বিদেশের কোনো এয়ারপোর্টে নেমে প্রথমেই যে কাজটা করতে হয় সেটা হলো স্থানীয় একটা টেলিকমের সিম জোগাড় করা। তবে আজকাল বেশিরভাগ অত্যাধুনিক বিমানবন্দরে ফ্রি ওয়াইফাইর সুবিধা থাকায় এটার কোনো দরকার পড়ে না। 

ইমিগ্রেশন পার হয়ে দুবাইর জমকালো এবং আধুনিক এয়ারপোর্ট থেকেই অমূল্যবাবুর দেয়া হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে কল করলো বাস্টার্ড। বাবু বলে দিয়েছে কাশিম নামের একজন তাকে আল আমাল স্ট্রিটের বাড়িতে নিয়ে যাবে। 

“হ্যালো, দাদা… আইস্যা পড়ছেন?” ওপাশ থেকে খাঁটি বাংলায় বলল কণ্ঠটা। 

“হ্যাঁ…এইমাত্র।”

“আমি তিন নম্বর টার্মিনালের বি”তে আছি…ওইদিক দিয়া ঢুইক্যা পড়েন, আমার হাতে আপনের নাম লেখা পেলাকার্ড আছে।” 

সেটাই করলো বাস্টার্ড। সুবিশাল এয়ারপোর্টটি যেমন ব্যস্ত তেমনি জমকালো। অনেকেই, বিশেষ করে যারা প্রথম বারের মতো এসেছে, ইচ্ছেমতো সেলফি তুলে ফেসবুকে-ইনস্টাতে পোস্ট দিতে ব্যস্ত তারা। মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। নানা দেশের নানান ধর্ম আর বর্ণের মানুষজনের দীর্ঘ মিছিলে যোগ দিলো সে-ও। তার সঙ্গে ছোট্ট একটা ব্যাকপ্যাক আর লাগেজ, সেটার হুইল দিয়ে টেনে নিয়ে গেল অন্য অনেকের মতো। অ্যারো সাইনপোস্ট দেখে দেখে থার্ড টার্মিনালের বি”তে চলে আসতে তেমন বেগ পেতে হলো না। এক্সিট লেখা অনেকগুলো গেটের মধ্যে একটা দিয়ে বের হয়েই সামনে অপেক্ষমান লোকজনের দিকে চোখ বোলালো। অনেকের হাতেই প্ল্যাকার্ড, তবে ডান দিকের একজনের হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা : পিআরসি ফ্রম বিডি। হাত তুলে সেদিকে এগিয়ে গেল সে। 

“আদাব দাদা,” সহাস্যে বলল মাঝবয়সি একজন। “আমার নাম কাশিম।” 

লোকটাকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে হাত মেলালো তার সঙ্গে। 

“ওইটা আমারে দেন,” তারপর অপেক্ষা না করেই তার হাত থেকে লাগেজটা নিয়ে নিলো। 

বাইরে পার্কিং এরিয়ায় শত শত গাড়ি অপেক্ষা করছে, সেগুলোর একটার সামনে গিয়ে থামলো তারা। কাশিম সেই গাড়ির বুট খুলে লাগেজটা রেখে দিলো। 

“ড্রাইভার নাই, আমিই গাড়ি চালাই,” হাসিমুখে বলল। “এইখানে গাড়ি ছাড়া অচল, বুঝলেন?” 

ব্যাকপ্যাকটা হাতে নিয়ে নিলো বাস্টার্ড, গাড়ির পেছনের সিটে বসে পড়লো সে। 

“আপনের পেলেন তো লেট করে নাই,” কাশিম গাড়ি চালাতে চালাতে বলল। “…দশ মিনিট আগে আইস্যা পড়ছে।”

“কতোদিন ধরে আছেন এখানে?” সৌজন্যতার বশে জানতে চাইলো।

“চৌদ্দ বছর তো হইবো-ই,” একটু থেমে রিয়ার মিরর দিয়ে তাকিয়ে বলল, “এই পথম আইলেন্‌নি এইহানে?” 

“হ্যাঁ,” মিথ্যেটাই বলল, কারণ তার পাসপোর্ট সেটাই বলছে। যদিও আগের পাসপোর্টে একবার এখানে আসার প্রমাণ ছিল, সেটা অবশ্য এক যুগেরও বেশি আগের ঘটনা। তখনও দুবাই জাঁকজমকপূর্ণ শহর ছিল তবে এখন সেটা মাত্রাতিরিক্ত বলে মনে হচ্ছে। চারপাশে যেদিকেই তাকাচ্ছে, প্রাচুর্যের উৎকট প্রদশর্নী চোখে পড়ছে। 

“তাইলে আপনেরে আমি অনেক জায়গা ঘুরায়া আনুমনে, চিন্তা কইরেন না।” 

মুচকি হাসলো পার্থিব রায় চৌধুরি। এখনও বুঝতে পারছে না এই লোক সি ই এ সিদ্দিকির নাকি সরাসরি অমূল্যবাবুর পরিচিত। 

“আমি জানতাম না কাকার একটা পোলা আছে,” রিয়ার মিরর দিয়ে পেছনে তাকিয়ে বলল কাশিম। 

বাবুকে চেনে এই লোক! 

“বিদেশের স্কুলে পড়ছেন তো তাই দেখি নাই।” 

বিদেশের স্কুলে পড়েছি! মুচকি হাসলো মনে মনে। “কবে থেকে চেনেন বাবুকে?” কথাটা বলার পরই মনে হলো অমূল্যবাবুকে তার বাবা বলা উচিত ছিল। 

“আমি তো তারে ছুটোকাল থিকা চিনি,” তার চোখ অবশ্য সামনের রাস্তার দিকে। “কাকা আমারে রাস্তা থিকা পাইছিল।” 

অবাক হলো বাস্টার্ড। নন্দ তাহলে একা নয়। পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল তার নিজের কথাটাও। তাকেও রাস্তা থেকেই পেয়েছিল বাবু। সে অবশ্য ক্ষুধার তাড়নায় একটা পিস্তল হাতে নিয়ে লোকটার সর্বস্ব ছিনিয়ে নিতে গেছিল। বুঝতে পারলো, বাবু সম্ভবত আরো অনেককেই এভাবে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে এসেছে। 

“আমার নাম কইলাম কাশেম… দুবাইর এরা আমারে কাশিম কইয়া ডাকে তাই সবাই কাশিম কয় এখন।” 

বাস্টার্ড জানে আরবিতে কাশিম উচ্চারণই হবে। 

“কাকায় কইলাম মানুষ না, ফেরেস্তা। আমার খাওয়া-পরা, থাকা, পড়ালেখা সব করাইছে, তার বাদে এই চাকরিটায় ঢুকায়া দিছে।” 

“এইখানে আপনি কী চাকরি করেন?” 

“সিদ্দিক রিয়েল এস্টেটে লেবার সুপারভাইজারের কাম করি।”

বাস্টার্ড বুঝতে পারলো তার অনুমানই ঠিক। 

বাকি সময়টুকু কাশিম কোনো কথা বলল না, পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে গেল। দুবাইতে গাড়ি ড্রাইভ করতে গেলে বাড়তি সতর্ক থাকতে হয়। পান থেকে চুন খসলে মোটা অঙ্কের ফাইন গুণতে হয় এখানে। আগের চেয়ে নিয়ম-কানুন সম্ভবত বেশি কঠিন আর কড়াকড়ি হয়ে গেছে। পথের সবগুলো যানবাহনকেই সুশৃঙ্খলভাবে চলতে দেখলো সে। 

জুমেইরাহ্ বিচসংলগ্ন একটি আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়লো তাদের গাড়িটা। এত বেশি নির্জন আর মানুষজন কম যে, মনে হয় সবাই বুঝি এলাকা ছেড়ে ছুটিতে গেছে। একই রকম লেগেছিল করাচির গুলশান-ই-ইকবাল এলাকাটা দেখে। ঢাকার মতো জনাকীর্ণ শহর থেকে হুট করে এরকম কোথাও চলে এলে একটু বেশিই নিরিবিলি লাগে। তবে সমুদ্র সৈকতের পাশে বলে জুমেইরাহ্ আবাসিক এলাকাটি বেশ খোলামেলা, ভর দুপুরে রোদে চিক চিক করছে সবকিছু। 

এমন একটা শহরে এসেছে সে যেখানে তেমন কোনো সমস্যাই নেই। করাচির সঙ্গে এটাই সবচেয়ে বড় পার্থক্য। কিন্তু এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রায় নিশ্ছিদ্র, লোকে বলে জিরো ক্রাইম সিটি। যে কাজ করতে এসেছে, সেটা কতোটুকু সম্ভব সে জানে না। ব্যাপারটাকে সরেজমিনে খতিয়ে দেখাও বলা যেতে পারে। এই মিশনের বেলায় সে অনেকটাই নির্ভার হলে হলো, না হলে নাই। পর্যটক হয়ে ঘুরে দেখবে কয়েকটা দিন, তারপরই ঠিক করবে আদৌ কিছু করা যাবে কি না। 

অধ্যায় ৬২ 

কাশিম একটুও অবাক হয়নি। দুবাইর নতুন ল্যান্ডমার্ক ভবনটি দেখতে অনেক পর্যটকই আসে আজকাল। 

ঘন্টাখানেক আগে তাকে এই ভবনের সামনে গাড়িতে করে নামিয়ে দিয়ে গেছে সে। তারপর একা একা বিশুদ্ধ পর্যটকের মতো চারপাশটা ঘুরে দেখেছে বাস্টার্ড। 

সাতাত্তুর তলার এই ভবনটির নক্সা বেশ অদ্ভুত। পুরোপুরি চারকোনা একটি আধুনিক স্থাপত্য, মাঝখানে আরেকটি চারকোনা আকৃতির বিশাল কাটআউট আছে-দূর থেকে দেখলে মনে হয় চারকোণা “জিরো”। ভবনের মাঝখানের বিশাল ফাঁকা অংশটিই এটাকে অন্যসব ভবন থেকে আলাদা করেছে। 

এত উঁচু ভবন কাছ থেকে দেখতে গেলে মাথাটা সর্বোচ্চ পেছন দিকে নিয়ে যেতে হয়। আলভীর পেন্থাউজ এই ভবনের পঁচাত্তুর তলার উপরে, এত উপরে ওঠার জন্য এক্সপ্রেস এলিভেটর আছে ওখানে, দুয়েক মিনিটেই পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু আসল সমস্যা অন্য জায়গায় ভবনের সিকিউরিটি। কতো শত সিকিউরিটি পার্সোনাল আছে হিসেব নেই। সিসিক্যামের সংখ্যা যে হাজারেরও উপরে হবে, আন্দাজ করতে পারলো। এই অত্যাধুনিক সিস্টেমের সিকিউরিটি ভেদ করা দুরূহ হবে। সার্ভিলেন্স সিস্টেমও বিরাট বড় বাধা। 

সাতাত্তুর তলার সুরম্য এই ভবনটিতে কয়েক শ” অ্যাপার্টমেন্টের পাশাপাশি অনেকগুলো হোটেল আর রেস্টুরেন্টও আছে। একেবারে টপফ্লোরে আছে বিশাল একটি সুইমিংপুল। এই ভবনের মালিকপক্ষের দাবি এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রুফটপ সুইমিংপুল। হলেও হতে পারে, দুবাই বলে কথা। 

বাস্টার্ড জানে, আলভী তার পেন্থাউজে পুরোপুরি নির্ভার আর নিশ্চিন্তে আছে। এই ফার্নিশড পেন্থাউজের সার্ভিসম্যানদের সবাই ভবনের নিজস্ব কর্মচারি, প্রয়োজন পড়লে তাদেরকে সার্ভিসে নেয়া হয়। আর অ্যাপার্টমেন্টগুলো নিয়মিত দেখভাল করা, ক্লিনিং করার কাজ করে থাকে এখানকার নিজস্ব একটি অফিস। এ যেন অনেকটা হোটেলের মতোই, পার্থক্য কেবল নিজের কেনা রুমগুলো ব্যবহার করে এর গর্বিত মালিকেরা। 

কিন্তু এসব তথ্য কোনো প্রয়োজনে আসবে কি না সে ব্যাপারে তার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এই সুবিশাল ভবনের অ্যাপার্টমেন্টগুলো হোটেল আর রেস্টুরেন্ট থেকে আলাদা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। কেবল এখানকার বাসিন্দাদের যাতায়াতের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা আছে। বাইরে থেকে কেউ সহজে ঢুকতে পারে না। টপফ্লোরে থাকা ব্যয়বহুল পেন্থাউজগুলো আরো বেশি সুরক্ষিত। একটু আগে পঁয়ত্রিশ তলার উপরের একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করে এসেছে, সেই সঙ্গে যতোটুকু সম্ভব আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখেছে বাস্টার্ড। 

পকেট থেকে ফোনটা বের করে অন্য অনেক পর্যটকের মতো কয়েকটা সেল্ফি তুলতে লাগলো সে-কেবলই সন্দেহমুক্ত হবার জন্য। এখানে এসে গাড়ি থামিয়েও কিছু সেল্ফি তুলেছিল, আর তখন কাশিম আগ বাড়িয়ে তার কিছু ছবি তুলে দিয়ে বলেছিল, “হের পরে বৌদিরে নিয়া আসবেন…অনেক ভালো লাগবো তার।” 

বৌদি! মনে মনে হেসেছিল সে। অমূল্যবাবু তার সম্পর্কে না জানি কী কী বলেছে! 

“পৃথিবীটা আসলেই ছোটো!” 

কাছ থেকে একটা কণ্ঠ বলে উঠলে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো বাস্টার্ড, যে দৃশ্যটা দেখতে পেলো সেটা তাকে শুধু অবাকই করলো না ভিরমি খাইয়ে দিলো। মুহূর্তেই একটা চিন্তার উদয় হলো তার মাথায় সম্ভবত তার দুবাই মিশনটি এখানেই শেষ! 

অধ্যায় ৬৩ 

কিসিঞ্জার! 

মাস দেড়েকেরও বেশি আগে এই লোকের সঙ্গে মোকাবেলা হয়েছিল তার, আর সেটা মোটেও সুখকর কিছু ছিল না। শেষে তার হাতে নাকাল হতে হয়েছিল লোকটাকে। সেইসব ঘটনা এখনও টাটকা স্মৃতি হয়ে আছে। তাকে দেখে ভেতরে ভেতরে ভড়কে গেলেও যথারীতি অভিব্যক্তিহীন থাকলো সে। 

“প্রবাদ-প্রবচনগুলো আসলে অভিজ্ঞতা থেকে তৈরি হয়েছে,” মুখে সেই চিরায়ত হাসিটা ধরে রেখে বলল মৃত্যুপথযাত্রি লোকটি। “দুনিয়াটা আসলেই ছোটো…অন্তত মানুষের জন্য।”

বাস্টার্ড কিছুই বলল না, লোকটার দিকে চেয়ে রইলো একদৃষ্টিতে। হাতে একটা লাঠি ব্যবহার করে এখন। স্বাস্থ্য আগের চেয়ে আরো বেশি ভেঙে গেছে। দেখতে বেশ রোগাটেই লাগছে তাকে, চোখদুটোও দেবে গেছে কোটরের ভেতরে। সেই দুচোখে ক্লান্তি। কেবলমাত্র মুখের হাসিটাই অমলিন আছে, এক মুহূর্তের জন্যেও উবে যায় না সেটা। 

“এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম…” উত্তর দিকটা দেখিয়ে বলল। “… হাসপাতাল থেকে…দেখি তুমি ছবি তুলছো এই বিল্ডিংয়ের সামনে। প্রথমে ভেবেছিলাম চোখের ভুল, গাড়িটা থামাতে বললাম ড্রাইভারকে…” লাঠিতে ভর দিয়ে আরেকটু কাছে এগিয়ে এলো। “…পরে বুঝলাম শরীর যতোই খারাপ হোক চোখটা আমার ঠিকই আছে…এখনও।” শেষ শব্দটা জোর দিয়ে বলল চওড়া একটা হাসি দিয়ে। “কেমন আছো, পার্থিব?” 

পরিহাসের হাসি ফুটে উঠল বাস্টার্ডের ঠোঁটে। “ভালো,” ছোট্ট করে জবাব দিলো কিন্তু সৌজন্যতাবশেও জানতে চাইলো না সে কেমন আছে। 

“আমি অবশ্য এখনও বেঁচে আছি, ডাক্তারদের ভুল প্রমাণ করে দিয়ে!” প্রসন্ন হাসি দিয়ে বলল। “কবে আসছো এই জাগতিক পাপের আখড়ায়?” 

ভুরু সামান্য কপালে উঠে গেল বাস্টার্ডের।

“আমার এক কবি বন্ধু বলেছিল কথাটা।” 

“কালকে এসেছি।” 

“আচ্ছা,” মিটিমিটি হাসি দিয়ে বলল কিসিঞ্জার। “আমি ভেবেছিলাম আর কখনও দেখা হবে না তোমার সঙ্গে,” বুক ভরে শ্বাস নিলো। “কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর উনি পরিকল্পনা করেন আরেক…” আকাশের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করলো। “এবার বলো, আমার গুরু কেমন আছেন?” 

“ভালো আছে,” নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল পাসপোর্টে যার নাম পার্থিব রায় চৌধুরি। 

“শুনে ভালো লাগলো,” একটু থেমে গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো I “আমি কিন্তু সব ভুলে গেছি। তুমিও ভুলে যাও।”

লোকটার দিকে স্থিরচোখে তাকালো সে। ঘটনা যা-ই ঘটুক, শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে বড় সড় তিক্ততার ঘটনা ঘটেনি-কিসিঞ্জারের ছোটোভাইকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া ছাড়া। 

“গত সপ্তাহে আমার ভাই জামিন পেয়েছে,” যেন মনের কথা পড়তে পেরে বলল। “কাছেই একটা ক্যাফে আছে… হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে ওখানে গিয়ে একা একা কফি খাই মাঝেমধ্যে…খাবে এক কাপ আমার সঙ্গে?” 

মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। না করাটা দুর্বলতার পরিচয় হবে। 

“তাহলে চলো।” লাঠি হাতে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল কিসিঞ্জার, প্যাসেঞ্জার সিটে বসতেই উবার ড্রাইভারের উদ্দেশ্য বলল, “ব্লা ব্লা দুবাই। “ চওড়া হাসি দিয়ে ফিরে তাকালো পার্থিব রায় চৌধুরির দিকে। “ক”দিন থাকবে এখানে?” 

“উমম, সাত-আট দিন?” সত্যি বলতে সে জানে না কতোদিন থাকবে এই জাগতিক পাপের আখড়ায়। 

“কেমন লাগছে…?” 

কাঁধ তুলল বাস্টার্ড। “খুব বেশি কিছু দেখা হয়নি, মাত্র শুরু করেছি।”

নিঃশব্দে হাসলো কিসিঞ্জার। “এখানে সবকিছু একটু বেশি জাঁকজমক, তাই না?” 

আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। 

“খুব বেশি পরিচিত মানুষজন না থাকলে তিন-চার দিন পরই হাঁপিয়ে উঠবে।” দীর্ঘশ্বাস ফেলল ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষটি। “কিন্তু তোমার একটা সুবিধা আছে, কিছুদিন পর চলে যাবে…আমার সেই সুবিধাও নেই।” 

গাড়িটা থামলো বিশালাকারের একটি প্লাজার সামনে, সেই প্লাজার তিন দিকে অনেকগুলো ভবন। 

“চলো।” 

উবারটা ছেড়ে দিয়ে নেমে পড়লো কিসিঞ্জার, লাঠি হাতে এগিয়ে গেল দুবাই রা রা নামের ক্যাফেতে। বাস্টার্ড কিছুই বলল না, চুপচাপ হাঁটতে লাগলো। এই শহরের পথঘাটের মতো এই ক্যাফের ভেতরেও লোকজনের সংখ্যা বেশ কম। হতে পারে লাঞ্চের আগে বলে কাস্টমার বেশি নেই। লাঞ্চ কিংবা ডিনারের সময় হয়তো বেশিই থাকে। 

সুপরিসর ক্যাফের এককোণে বসলো তারা। “তুমি কিছু খেতে চাইলে খেতে পারো।” 

মাথা দোলালো বাস্টার্ড। “শুধু কফি হলেই হবে…ক্যাফেলাত্তে।” 

“ঠিক আছে,” হাসিমুখে ওয়েটারকে হাত নেড়ে ডাকলো, কাছে চলে এলো তাদের একজন। “টু ক্যাফেলাত্তে।” ছেলেটা চলে যাবার পর টেবিলের বিপরীত দিকে তাকালো। “তুমি মনে হয় এখনও সহজ হতে পারছো না?” 

“আমি ঠিক আছি।” 

নিঃশব্দে হাসলো মৃত্যুপথযাত্রি। “সময়ে সবকিছু বদলে যায়, বুঝেছো?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। 

“তুমি অনেক কম কথা বলো…এটা মনে হয় আগেও বলেছি, তাই না?”

“হুম।” 

কয়েক মুহূর্তের জন্য কিসিঞ্জারের হাসিটা উবে গেল, তারপর গম্ভীর মুখে বলল, “এখানকার সিকিউরিটি অনেক কড়া।” 

বাস্টার্ডের ভুরু সামান্য কুঁচকে গেল। লোকটা এ কথা বলছে কেন হুট করে?

“তুমি এখানকার মিডিয়াতে ক্রাইমের খবর খুব একটা পাবে না। তার মানে এই না একদমই কিছু হয় না… দুনিয়ার সব জায়গাতেই ক্রাইম হয়, কোথাও বেশি কোথাও কম। কিন্তু এখানে ক্রাইম করে পার পাওয়া যায় না।”

“শেখ পরিবার করলেও না?” 

মিটিমিটি হাসলো কিসিঞ্জার। “ওদেরটা বাদ দিয়ে বলেছি…দে আর দ্য মোর ইকুয়াল দ্যান আদাস!” 

বাঁকাহাসি ফুটে উঠল বাস্টার্ডের ঠোঁটে। 

“তুমি হয়তো ভাবছো এইসব কথা কেন বলছি তোমাকে,” একটু থেমে আবার বলল, “আমি প্রিটেন্ড করবো না… সরাসরিই বলি, তুমি যদি এখানে কোনো কাজে এসে থাকো তাহলে ভুল করেছো।”

লোকটার দিকে স্থিরচোখে চেয়ে রইলো সে। এই লোক তার মিশন সম্পর্কে না জানলেও আন্দাজ করতে পারছে। 

“ভয়ের কিছু নেই,” আশ্বস্ত করে বলল কিসিঞ্জার। “অন্তত আমার দিক থেকে। আমি জীবনে অনেক খারাপ কাজ করেছি কিন্তু কখনও অকৃতজ্ঞ হইনি…কৃতঘ্ন হবার তো প্রশ্নই ওঠে না।” 

বাস্টার্ড কী বলবে ভেবে পেলো না। হুট করে কাউকে বিশ্বাস করার মতো লোক সে নয়। আর ক-দিন আগে যার বিরুদ্ধে নেমেছিল তাকে বিশ্বাস করাটা তার পক্ষে খুব কঠিন। 

“তুমি যেভাবে কাজ করো তাতে আমার ছোটো ভাইকে মারারই কথা কিন্তু তার কোনো ক্ষতি করো নাই, সেজন্যে আমি তোমার কাছে ঋণী।” 

এ সময় ওয়েটার ছেলেটা কফি দিয়ে গেল। নিজের কাপটা তুলে নিলো কিসিঞ্জার। আলতো করে চুমুক দিলো কিন্তু চোখ সরালো না বাবলুর উপর থেকে। 

“আপনার কেন মনে হলো আমি এখানে কাজ করতে এসেছি?” জানতে চাইলো সে। 

মুখের হাসিটা ধরে রেখেই বলল, “তোমার সঙ্গে আমি কোনো চালাকি করবো না। এসব করার সময়ও নেই আমার!” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “আমি জানি তুমি কেন এসেছো।” 

ভুরু কুঁচকে গেল বাস্টার্ডের। 

“তোমার কফি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে…প্লিজ,” আন্তরিকভাবেই বলল। 

কফির কাপটা তুলে নিয়ে চুমুক দিলো সে কিন্তু চোখ সরালো না সামনে বসা লোকটার উপর থেকে। 

“আমি সব সময় দেশের খবর রাখি। পত্রিকার অনলাইন ভার্সন পড়ি, ইউটিউবের কিছু নিউজ চ্যানেল, অনলাইন নিউজ পোর্টালও ফলো করি,” একটু থেমে দম নিয়ে নিলো। “জাহান গ্রুপের ওই ছেলেটা… কী যেন নাম…যাই হোক, ও একটা মেয়েকে সম্ভবত মেরে ফেলেছে। মেয়েটার সঙ্গে ওর সম্পর্ক ছিল। এসব খবর এখানকার প্রবাসিরাও জানে ইন্টারনেটের কারণে। হোমিসাইডের মি. বেগ ওই কেসটা ভালোমতোই তদন্ত করছিল, পোস্ট মর্টেমের রিপোর্টটা পাল্টানোর চেষ্টা করেছিল ওরা, হাতেনাতে ধরে ফেলেছে ওদেরকে। দারুণ ট্রিকস করেছিল ঐ ইনভেস্টিগেটর। তারপর একটা নিউজে দেখলাম ওই লোক জাহান গ্রুপের ছেলেটার বিরুদ্ধে মামলা করেছে অ্যাটেম্প টু মার্ডারের…ক-দিন পরই মি. বেগের ফিয়ানসে রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা গেল,” মাথা দোলালো সে। “খুব বেশি কাকতালিয় হয়ে গেল না, কী বলো?” 

আপনার সঙ্গে দেখা হওয়াটাও! মুখে কিছু না বলে কফিতে চুমুক দিয়ে সন্দেহগ্রস্ত চোখে তাকালো বাস্টার্ড। “আলভী যে দুবাইতে এসেছে, এটা আপনি কী করে জানলেন?” 

এবার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো, মুখের হাসিটা এখনও অমলিন। “এক সময়কার ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের অনেকেই এখন দুবাইতে থাকে, ওদের দুয়েকজনের সঙ্গে আলভীর ব্যবসা আছে এখানে। ওরকম একজনের সঙ্গে মাঝেমধ্যে আমার কথাবার্তা হয়।” 

বাস্টার্ডও জানে, দুবাইতে অনেক বাংলাদেশি আছে, তাদের মধ্যে কারো কারো সঙ্গে আলভীর যোগাযোগ থাকাটা অসম্ভব নয়। 

“একটা ইউটিউব চ্যানেল এমন কথাও বলেছে, এর পেছনে আছে জাহান গ্রুপের মালিকের ছেলে।” কফির কাপটা শেষ করে টেবিলের উপরে রাখলো কিসিঞ্জার। “আরো আছে। ঐ ছেলেটা এখানে আসার পর পরই তার খুব ক্লোজ দুজন অ্যাসোসিয়েট খুন হয়ে যায়।” তৃপ্তির হাসি দিলো লোকটা। “তারপর তুমি আজ এখানে! ওর পেন্থাউজটা যে বিল্ডিংয়ে ঠিক সেখানেই! আমার মতো লোকের জন্য দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোটা কি খুব বেশি কঠিন?” 

গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো পেশাদার খুনি। এই লোক জানে সে বিদেশের মাটিতে গিয়েও খুন করেছে এর আগে। তার পক্ষে এমন অনুমান করাটা স্বাভাবিক। 

“তবে আমার একটা হিসেব মিলছে না।” 

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো বাস্টার্ড। 

“জেফরি বেগ তোমাকে কন্ট্রাক্ট করার কথা না! তাহলে কে করলো?” 

কফির কাপটা রেখে হাতঘড়িতে সময় দেখলো বাস্টার্ড। 

“এরকম কিছু হয়ে থাকলে সেটা খুবই অদ্ভুত ঘটনা হবে। বাংলায় যাকে বলে অভূতপূর্ব ঘটনা!” কাঁধ তুলল লোকটা। “কে জানে, সময় আর পরিস্থিতি আমাদেরকে কখন কোথায় এনে দাঁড় করায়!” মিটিমিটি হাসিটা চোখ পর্যন্ত বিস্তৃত হলো। “এই যে তুমি আমি এখানে বসে কফি খাচ্ছি, এটা কি এক-দেড় মাস আগেও ভাবা গেছে?!” 

“কফির জন্য থ্যাঙ্কস…আমি এখন উঠবো।” 

মাথা নেড়ে সায় দিলো কিসিঞ্জার। “আমাকে সময় দেবার জন্য তোমাকেও অনেক থ্যাঙ্কস, পার্থিব রায় চৌধুরি।” আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। “এই ভিনদেশে জীবনের শেষ দিনগুলো আমি একা একা মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছি!” পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে বাড়িয়ে দিলো। “এটা রাখো। যদি মনে করো তোমার কোনো সাহায্য লাগবে, ফোন দিও।” 

বাস্টার্ড কার্ডটা হাতে নিয়ে আর কোনো কথা না বলে ক্যাফে থেকে বের হয়ে গেল। 

অধ্যায় ৬৪ 

ফারুক আহমেদ এর আগে কখনও জেফরি বেগের ফ্ল্যাটে আসেনি। এখন যে এসেছে, সেটা আগের দিন ফোন করে বলেছিল। তার আগে অবশ্য জামান বলেছিল তাদের স্যার আসতে চাইছে, দেখা করতে চাইছে হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটরের সঙ্গে। 

সব শোকই এক সময় স্তিমিত হয়ে আসে, অন্তত বাইরে থেকে সেটাই মনে হয়। ভেতরে ভেতরে প্রিয়জনকে হারানোর দুঃখটা তাতে বিন্দুমাত্রও কমে না, শুধু কমে যায় সেই দুঃখের চোটে বিপর্যস্ততা, অস্থিরতা আর মেনে না নেয়ার অক্ষমতাটুকু। অচিরেই মানুষ স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। এটাই হয়তো মানবজাতির নিজস্ব মেকানিজম। 

জেফরি বেগও অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এলো। তবে এখনও সে কারো কাছ থেকে সমবেদনা চায় না। তার ব্যক্তিগত ক্ষতিটুকু একেবারেই নিজের; সমবেদনা আর সহানুভূতি তাকে বিব্রত করে। এ কারণেই দীর্ঘ একটা সময় নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিল, সহকারি জামান ছাড়া আর কারোর সঙ্গেই দেখা করেনি। ছুটিতে থাকলেও হোমিসাইডে যোগ দিয়ে কাজে ফেরার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে সে। 

ঠিক পাঁচটায় কলিংবেলটা বেজে উঠল। ফারুক আহমেদ সব সময়ই পাঙ্কচুয়াল। ঢাকার কুখ্যাত জ্যামেও এর ব্যত্যয় ঘটে না। 

“কতো দিন পর দেখা হলো!” দরজা খুলতেই প্রসন্ন হাসি দিয়ে জড়িয়ে ধরলো জেফরিকে। কেমন আছো প্রশ্নটা সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেল। 

মলিন হাসি দিয়ে হোমিসাইডের মহাপরিচালককে ভেতরে নিয়ে এলো জেফরি। ড্রইংরুমের সোফায় বসলো দুজনে। “আপনি কেমন আছেন, স্যার?” 

কাঁধ তুলল মহাপরিচালক। “চলছে… বিজনেস অ্যাজ ইউজুয়াল। তারপর যেমনটা হয়, ফারুক আহমেদ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো। হুট করে প্রসঙ্গে চলে আসতে পারে না সে। “হোমমিনিস্টারের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার… আবারো।” 

মাথা দোলালো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। 

“উনি তো আমাকে অবাক করে দিয়েছেন, জেফ।”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো জেফরি। 

“ওদের বিরুদ্ধে যে কেসগুলো আছে সেগুলো চলবে, কোনো রকম ইন্টারফেয়ারেন্স করা হবে না।” 

কথাটা শুনে অবাকই হলো জেফরি। এমনটা হবার কথা নয়। সরকারের উপরের দিককার প্রায় সবার সঙ্গে জাহান গ্রুপের ঘনিষ্ঠতা আছে। এই ভূমিদস্যু ব্যবসায়ি গ্রুপ বিপদে পড়লে কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই তাদেরকে রক্ষা করে তারা। এখন পর্যন্ত সব সরকারণ সেটা করে এসেছে। 

“তুমি মনে হয় হোমমিনিস্টারের কথাটা বিশ্বাস করতে পারছো না?”

“সত্যি বলতে, স্যার…” একটু থামলো সে, দ্বিধাটুকু ঝেড়ে ফেলল। “অস্বীকার করবো না, বিশ্বাস করতে একটু কষ্টই হচ্ছে আমার।” 

“হুম,” দ্বিমত পোষণ করলো না হোমিসাইডের ডিজি। “আমিও পলিটিশিয়ানদেরকে খুব সহজে বিশ্বাস করি না কিন্তু হোমমিনিস্টার যখন মুখে বলেছেন তার তো একটা গুরুত্ব আছেই। আর যাই হোক, তিনি এখন নাক গলাতে দশ বার ভাববেন।” 

জেফরি বেগও বুঝতে পারলো সেটা। মুখে বলারও একটা গুরুত্ব আছে। হয়তো অন্যভাবে নাক গলাতে চাইবে, বাঁধা-বিঘ্ন তৈরি করার চেষ্টা করবে কিন্তু সরাসরি হস্তক্ষেপ করবে না। এটাও কম কীসে? “তাহলে তো ভালোই, স্যার।” 

“শোনো, একটা কথা বলি,” মহাপরিচালক বলল। “জাহান গ্রুপের মতো কেউ বিপদে পড়লে পলিটিশিয়ানরা সুযোগ নেবে। কে জানে, হোমমিনিস্টার হয়তো সেটাই করছেন, এই সুযোগে পকেট ভারি করবেন। কিন্তু আমাদের এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। দেখি না, উনি কথা রাখেন কি না। যদি না রাখেন আমাদের সাধ্যে যতোটুকু কুলায় করবো।” 

“জি, স্যার।” 

“তুমি কিন্তু জয়েন করেই সোনিয়ার কেসটা নিয়ে মুভ করবে, ফারুক আহমেদ বলল। “এত কিছু যে হয়েছে সেটা ঐ কেসটার কারণেই। এখন পর্যন্ত তুমি যে পরিমাণ এভিডেন্স কালেক্ট করেছো, খুব সহজেই কেসটা দাঁড় করানো যাবে। ওটা-ই হবে আমাদের টার্ম কার্ড। জাহান গ্রুপের সবকিছু এক্সপোজড করা যাবে এই একটা কেস দিয়ে। ওরা সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়বে এখানেই।” 

আরো একবার সায় দিলো জেফরি। এ ব্যাপারে তার মনেও কোনো সন্দেহ নেই। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *