কন্ট্রোল – ৫

অধ্যায় ৫ 

মেয়েটার নাম সোনিয়া, পরিবারের লোকজন সনু নামে ডাকে। 

ডাকতো! 

মা-বাবা নেই, পরিবার বলতে এক বড় বোন, বিয়ে করে স্বামীর সঙ্গে থাকে জামালপুরে। সেখান থেকেই এসএসসি আর এইচএসসি পড়ে ঢাকায় চলে আসে সোনিয়া। বড় বোন রানিয়ার ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা করিয়ে বোনকে নিজের পায়ে দাঁড় করাবে। মা-বাবার আদর পায়নি বলে মাতৃস্নেহে বড় করেছে। ঢাকায় এসে একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পরের বছরেই রানিয়ার স্বামী ব্যবসায় বিরাট বড় লোকসানে পড়ে যায়, বাড়তি একজনকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা পাঠানোটা আর সম্ভব হয়নি। কিন্তু সোনিয়া টাকার অভাবে পড়াশোনায় ছেদ ঘটাতে চায়নি। বড় বোনকে সে আশ্বস্ত করেছিল, দুয়েকটা টিউশনি আর টুকটাক জব করে নিজের পড়াশোনা, হোস্টেলে থাকা-খাওয়ার খরচ চালিয়ে নিতে পারবে। সেটাই করে যাচ্ছিল মেয়েটা 

মাত্র কয়েক দিন আগে রানিয়া জানতে পারে তার ছোটো বোন হোস্টেলে থাকে না, বনানীর মতো ব্যয়বহুল এলাকায় ফ্ল্যাট নিয়ে থাকে। আর তার সঙ্গে সম্পর্ক আছে জাহান গ্রুপের সিইও আলভীর। কিন্তু ইদানিং তাদের সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছে না। তার সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ রাখছে না আলভী। মানসিকভাবে সোনিয়া ভেঙে পড়েছে, কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। গত পরশু সোনিয়া তাকে এ-ও বলেছিল, জাহান গ্রুপের লোকজন তাকে হুমকি দিচ্ছে, সম্ভব তাকে প্রাণে মেরে ফেলা হবে! 

সব শুনে রানিয়ার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তার ছোটো বোন এরকম ধনী একজনের খপ্পড়ে কী করে পড়লো বুঝে উঠতে পারেনি। শুধু একটু বুঝতে পারছিল, জাহান গ্রুপের সিইও আলভী তার অল্প বয়সি অসহায় বোনকে যেকোনোভাবেই হোক কব্জায় নিয়ে ব্যবহার করে এখন ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইছে। গতকাল সোনিয়া তাকে ফোন করে এ-ও বলেছিল, ঢাকা ছেড়ে জামালপুরে চলে আসবে সে। তার বোন যেন ঢাকায় এসে তাকে নিয়ে যায়। 

“কাল রাত সাড়ে বারোটার দিকে ও আমারে কল দিছিল, “ রানিয়া বলেছিল কান্নারত অবস্থায়। “আমি অনেক টায়ার্ড ছিলাম…তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ছি…পরে উঠে দেখি সোনিয়া কল দিছে। তখনই আমার মনে কু ডাক দিছিল, সঙ্গে সঙ্গে ওরে কল করছি কিন্তু রিং হইলেও ধরে নাই।” 

এখন ফ্ল্যাটের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে জেফরি বেগ ভাবছে নিজের ছোটো বোনের ঝুলন্ত দেহ দেখে মহিলার কেমন বাজে অনুভূতি হয়েছে। যে বোনকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে, ছোটো থেকে বড় হতে দেখেছে, তাকে নিয়ে কতোই না স্মৃতি জড়িয়ে আছে! এমন আপনজনকে হারানোর বেদনা কতোটা তীব্র আর গভীর হতে পারে, সে ব্যাপারে তার একটু আধটু ধারণা আছে। ফাদার জেফরি হোবার্টের মৃত্যুশয্যায় তার শিয়রে বসে ছিল, চোখের সামনে প্রিয় মানুষটিকে হারাতে দেখেছে। 

“স্যার?” 

পেছনে ফিরে তাকালো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর। এসআই বশির বেলকনির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে! 

“… চলে গেছে।” 

জেফরির নির্দেশে ভিক্টিমের বড় বোনকে আবারো থানায় নিয়ে যাবার জন্য বলে দিয়েছে সে, মহিলা বাদী হয়ে মামলা করবে আর সেই মামলার তদন্ত করবে হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট। এমন মুহূর্তে মহিলাকে আর বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা চিন্তা করেনি। যেটুকু দরকার জেনে নিয়েছে পাশের খালি ঘরটায় বসে। মামলা হোক, পরে আবারো কথা বলবে। 

“ওসিসাহেব খুব ক্ষেপে আছেন,” নিচুকণ্ঠে বলল এসআই। 

কী কারণে ক্ষেপে আছে সে প্রশ্ন আর করলো না জেফরি বেগ। হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের শুরু থেকে আছে, প্রথম প্রথম থানাগুলোর সঙ্গে তাদের খুব লাগতো। প্রায় প্রতিটি থানা-ই অসহযোগিতা করতো। যেন তাদের ভাগে ভাগ বসাতে এসেছে! জেফরি এটা বুঝতে যথেষ্ট বেগ পেতো, ঠিক কী কারণে থানাগুলো হত্যা মামলার তদন্ত করতে না পেরে অসন্তুষ্ট হতো! তাদের তো খুশি হবার কথা ছিল। থানাগুলোতে যে পরিমাণ মামলা হয়, পুলিশ সেগুলো তদন্ত করতে গিয়ে হিমশিম খায়। পর্যাপ্ত পুলিশ আর লোকবলের অভাবে অনেক কেস বছরের পর বছর হিমঘরে পড়ে থাকে, সুরাহা হয় না। সেখানে হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টকে তারা আশীর্বাদ না ভেবে প্রতিপক্ষ কেন ভাবে? 

সময়ের পরিক্রমায় জেফরি বেগ বুঝে যায় এটা আমাদের জাতিগত সেই চিরায়ত অসুখ : “নিজে খেতে না পারলেও অন্যকে দেবো না” মনোভাব। নিজে ভোগ করতে না পারলেও সম্পত্তি আগলে রাখার অনিরাময়যোগ্য ব্যাধি! 

নাকি সঙ্কীর্ণতা? 

তবে স্থানীয় থানার ওসির এখনকার যে মনোভাব সেটা ওরকম কিছু বলে মনে হচ্ছে না। 

“তাকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই,” আশ্বস্ত করে বলল জেফরি। “তার ইন্টারেস্টটা আমি বুঝতে পারছি।” 

এসআই বশির আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলেও কিছু বলার আগে চুপ মেরে গেল, কারণ ওসি এদিকেই আসছে। 

“আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে,” জেফরিকে উদ্দেশ্য করে বলল হাসমত আলী। 

জেফরি বেগ বুঝতে পারলো তাকে স্যার বলাটা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলছে লোকটি। বয়সে তার চেয়ে বড় বলে নাকি তার উপরে রুষ্ট হয়ে আছে, কে জানে! “জি, বলুন।” 

এসআই বশিরের দিকে তাকালো ওসি, সে আস্তে করে বেলকনি থেকে চলে গেল। “ভিক্টিমের বোন কিন্তু প্রথমে আমাদের থানায় আইস্যা রিপোর্ট করছে, আমরা এইটা তদন্ত করতাছি। আমাগো তদন্তে যদি বাইর হয়-” 

জেফরি বেগ হাত তুলে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিলো লোকটাকে। “আমি সবটাই দেখেছি, এটা পরিস্কার হোমিসাইড। আমার চোখে অনেকগুলো প্রাইমারি এভিডেন্সও ধরা পড়েছে।” 

চোখমুখ কুঁচকে গেল ওসির। 

“তার চেয়ে বড় কথা, ভিক্টিমের বড় বোন… 

লিগ্যাল গার্জিয়ান … ঘটনা ঘটার আগেই অভিযোগ করেছে তার বোন নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত।” 

“না, না!” বিস্মিত হবার ভাণ করলো ওসি। “ওই মহিলা বলছে, তার বোন ফোন ধরতাছে না।” 

“সেটা ঢাকায় আসার আগে বলেছে।” 

ওসি আবারো ঢোক গিলল। “আ-আমি তো আছিলাম না অতো রাইতে…ডিউটিতে যে আছিল ওয় ফোন ধরছে।” 

“হুম, কিন্তু ভদ্রমহিলার অভিযোগের ব্যাপারে সে নিশ্চয়ই আপনাকে জানিয়েছে?” 

গাল চুলকালো ওসি হাসমত। “আপনি তো বুঝতে পারতাছেন না, এত দূর থিকা ফোন কইরা রিপোর্ট করলে কি সেইটারে সিরিয়াসলি নেয়া যায়?” 

“কেউ যদি দূর থেকে, অন্য জেলা থেকে ফোন করে বলে তার বোনের জীবন হুমকির মুখে, তাহলে কি সেটা গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন না? সশরীরে এসে রিপোর্ট করতে বলবেন?” 

গভীর করে শ্বাস নিলো ওসি। স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে তেতে উঠেছে ভেতরে ভেতরে। 

“যাই হোক, আমি বুঝি থানায় আপনারা অনেক চাপে থাকেন, লোকবলও কম, সব সময় সব অভিযোগ সঙ্গে সঙ্গে খতিয়ে দেখা যায় না।” 

ওসি বুঝতে পারলো না সে মাথা নেড়ে সায় দেবে কি না। 

“আপনাদের কাজের চাপ কমাতেই সরকার হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট করেছে। হত্যাকাণ্ডের তদন্ত খুবই ঝামেলাপূর্ণ কাজ, সময়ও লাগে প্রচুর। থানাগুলো এ কাজ করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করতে পারবে না ঠিকমতো, কী বলেন?” 

“জ্-জি, স্যার,” একান্ত অনিচ্ছায় বলল হাসমত। “কিন্তু … “ গাল চুলকালো লোকটা। 

“কী?” 

“ঐ মহিলা কী অভিযোগ করছে, আপনার কোনো আইডিয়া আছে?”

“যতোটুকু জানি, জাহান গ্রুপের এক ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন উনি।” 

“জি, স্যার। সিআইপি…ভিভিআইপি…তাদের বিরুদ্ধে তো হুটহাট কেস নেওয়া যায় না।” 

“তারা যদি ক্রাইম করে তাহলে নিতে সমস্যাটা কোথায়?” 

ওসি ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো, কী বলবে বুঝত পারলো না। “শুনুন, মি. হাসমত,” শান্ত কণ্ঠে বলল জেফরি। “এসব নিয়ে আপনি ভাববেন না, কেসটা আমি তদন্ত করছি, ঝড়-ঝাপ্টা সব আমি সামলাবো, আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।” 

ওসির মুখ কালো হয়ে গেল। 

“ভালো কথা, ভিক্টিমের বড় বোন…ভদ্রমহিলা কেস করবেন আপনার থানায়, উনার সঙ্গে হোমিসাইডের একজন থাকবে।” 

আবারো হাসমত সাহেবের ভুরু কুঁচকে গেল। “হোমিসাইডের লোক থাকবো কেন?” 

“কারণ কেসটা শুরু থেকেই হোমিসাইড দেখছে।” 

সাধারণত প্রায় সব কেসই হোমিসাইড তদন্ত করে থাকে স্থানীয় থানার ডাক পেয়ে। এই কেসটা সেদিক থেকে ব্যতিক্রম। এখানে শুরু থেকেই হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর আছে। 

ওসি আর কিছু না বলে তিক্তমুখে চলে গেল। 

অধ্যায় ৬ 

সিলিংফ্যান থেকে নামানো হয়েছে সোনিয়ার মৃতদেহ, এখন রাখা হয়েছে বিছানার উপরে। 

হোমিসাইডের রমিজ লস্কর চলে এসেছে, এসআই বশিরকে নিয়ে সুরুতহাল রিপোর্ট তৈরি করছে সে। তাদের কাছেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে জেফরি বেগ। 

“স্যার,” ল্যাটেক্স গ্লাভ পরতে পরতে রমিজ বলল। “ডান দিকের কলার বোনের উপরে একটা ব্রুজ মার্ক আছে। খুবই হালকা, খালি চোখে সহজে ধরা পড়ে না।” 

মাথা নেড়ে সায় দিলো হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটর। এরকমটা সে আশা করেছিল-ভিক্টিমের শরীরে ধস্তাধস্তির কোনো না কোনো চিহ্ন থাকবেই। “স্ট্র্যাঙ্গুলেইশনের সাইন আছে?” 

“না, স্যার। গলায় এরকম কোনো চিহ্ন নেই। তবে ভিক্টিমের ব্রা-টা…” রমিজ একটু ইতস্তত করলো। “…ওটার ফিতাদুটো সরে আছে একটু।” 

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো জেফরি বেগ। 

“মৃত ভিক্টিমকে ঝোলানোর সময় বগলের নিচটা ধরে তুলেছিল মনে হয়।” 

“মৃত কেন? অজ্ঞান হতে পারে না?” 

মাথা নেড়ে সায় দিলো রমিজ। “তা-ও হতে পারে। যেভাবেই হোক মেয়েটাকে কাবু করতে পেরেছিল খুনি।” 

“পয়জন কিংবা ড্রাগের ইউজ হয়েছে?” 

কাঁধ তুলল অভিজ্ঞ ফরেনসিক এক্সপার্ট। “উড়িয়ে দেয়া যায় না। আই সাসপেক্ট ক্লোরোফর্ম…পোস্ট মর্টেমে অবশ্য কনফার্ম হওয়া যাবে।” 

“হুম।” 

“সিসিক্যাম ফুটেজের কী করবেন, স্যার?” 

“জামানকে ফোন করে বলে দিয়েছি, থানা থেকে এখানে আসার পর সে দেখবে ওটা।” 

রমিজ আবারো মনোযোগ দিলো লাশের দিকে। 

“বশির? এই মেয়েটা কী করতো?” মৃতের দিকে ইঙ্গিত করলো জেফরি। “জব করতো কি?” 

“না, স্যার।” 

“তাহলে এত দামি ফ্ল্যাট কিভাবে মেইনটেন করতো?” 

“জাহান গ্রুপের সিইও”র সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে এটা মেইনটেন করা এমন আর কী!” 

“ওকে, তোমরা কাজ করো, আমি একটু আসছি,” ছেলেটার পিঠ চাপড়ে দিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে গেল জেফরি। সিঁড়ি আর লিফটের সামনেই দেখতে পেলো ফ্ল্যাটের মালেকিন, সেই ভদ্রমহিলা ওসি হাসমতের সঙ্গে কথা বলছে। তাকে দেখে চুপ মেরে গেল দুজনেই। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো আগে থেকেই পরিচিত। “আপনিই তো ফ্ল্যাট ঔনার, তাই না?” 

“হ্যাঁ,” বলল মহিলা। 

“এই ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছিল কে?” 

“কে আবার, সোনিয়া!” 

মহিলা যে বিস্মিত হবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে জেফরির নজরে সেটা এড়ালো না। “তাহলে সোনিয়া-ই ভাড়ার টাকা দিতো?” 

“হুম।” 

“এখানে আপনার ফ্ল্যাট কয়টা?” 

জেফরি হুট করে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাওয়াতে মহিলা একটু অবাক হলো। “তিনটা।” 

“আপনি নিজে থাকেন একটাতে?” 

“না, আমারটা বাদে তিনটা। যেটাতে থাকি ওটা আমার হাজব্যান্ডের নামে, বাকিগুলা আমার।” 

ভুরু কপালে উঠল জেফরির। “আচ্ছা। অন্য ফ্ল্যাটগুলো কোথায়?”

ডান দিকে ইঙ্গিত করলো মহিলা। “এইটা একটা।” 

“আপনি কি ল্যান্ড ঔনার?” 

মাথা নেড়ে সায় দিলো মহিলা। “আমার হাজব্যান্ড…মানে তার বাবার জমি ছিল এটা।” 

“আচ্ছা।” বুঝতে পারলো। মহিলার হাজব্যান্ডের বাবার জমি কিংবা বাড়ি ছিল, পরে ডেভেলপার দিয়ে ডেভেলপ করেছে, নিজেদের মধ্যে ফ্ল্যাটগুলো ভাগ করে নিয়েছে। তারপর যেভাবেই হোক তিনটা ফ্ল্যাট লিখিয়ে নিয়েছে নিজের নামে। “কতো টাকা ভাড়া দিতো এটার?” 

মহিলা একটু ইতস্তত করলো। “আশি হাজার।” 

“সবসহ?” 

“না, ইউটিলিটিজ বাদে।” 

“সব মিলিয়ে কতো পড়তো?” 

নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো মহিলা। “এইট্টি-এইটের মতো।” 

মাথা নেড়ে ওসি হাসমতের দিকে তাকালো। লোকটা আঠার মতো লেগে আছে, সরছেই না। আবারো মহিলার দিকে ফিরলো জেফরি। “ভাড়া নেবার সময় তো মেয়েটা তার এনআইডি দিয়েছিল আপনাকে, তাই না?” 

ঢোক গিলল ফ্ল্যাটের মালিক। 

“ওটা আর ভাড়ার রশিদটা নিয়ে আসুন।” 

মহিলা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো, কী করবে বুঝতে পারছে না। 

“স্যার,” জেফরির বাহুটা ধরে একটু সরিয়ে আনার চেষ্টা করলো ওসি। “এইসব উনারা মেইনটেন করেন না।” 

জেফরি বেগও এটা জানে। শতকরা নব্বই ভাগ ফ্ল্যাট মালিক ভাড়ার রশিদ, ভাড়াটিয়ার পরিচয়পত্র, এসবের ধার ধারে না। কিন্তু বনানীর মতো অভিজাত এলাকার ফ্ল্যাট মালিকেরা এসব মেইনটেন করে থাকে। “এটাও কি উনি একইভাবে ভাড়া দিয়েছেন?” ডান দিকের ফ্ল্যাটটা ইঙ্গিত করে বলল। 

জেফরির এমন কথা শুনে থতমত খেলো ওসি, ফিরে তাকালো মালেকিনের দিকে। মহিলা এখন রীতিমতো হাত কচলাচ্ছে, চোখেমুখে ভড়কে যাবার চিহ্ন। 

“মনে হয়, স্যার,” নিচু কণ্ঠে বলল হাসমত সাহেব। 

“ঠিক আছে,” বলেই ডান দিকের ফ্ল্যাটের দরজার পাশে কলিংবেল টিপলো। পেছন ফিরে দেখতে পেলো ফ্ল্যাটের মালেকিন আর ওসি হাসমত নিজেদের ভড়কে যাওয়া অভিব্যক্তি লুকাতে হিমশিম খাচ্ছে। “কোনো সমস্যা?” 

জেফরির দিকে ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকালো তারা দুজনে। 

“না, না…কোনো সমস্যা না,” ওসি হাসমত বলল। 

পারতঃপক্ষে লোকটা যে তাকে “স্যার” বলা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করছে, বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো। ফ্ল্যাটের দরজা খোলার শব্দে ফিরে তাকালো সে কিন্তু যে মুখটা দেখতে পেলো সেটা মোটেও আশা করেনি। 

অধ্যায় ৭ 

মডেল এবং অভিনেত্রী শায়লা মির্জা! 

ব্ল্যাক রঞ্জুর হাতে নিহত মুনেম সাহেবের গোপন স্ত্রী শায়লা মির্জা ও হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটরকে দেখে ভিরমি খেলো। কী বলবে বুঝতে পারলো না। জেফরি বেগ নিশ্চিত, এই অভিনেত্রী যখন পিপহোলে চোখ রেখেছিল তখন সে পেছন ফিরে কথা বলছিল ওসি আর ফ্ল্যাটের মালেকিনের সঙ্গে, ফলে তার চেহারাটা দেখতে পায়নি, সেজন্যেই দরজা খুলে চমকে গিয়েছে। 

“আপনি এখানে থাকেন?” 

জেফরির প্রশ্নে মাথা নেড়ে সায় দিলো শায়লা মির্জা। “এ-এই তো…কিছুদিন ধরে।” 

ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে আরেকটি মেয়ে চলে এলো দরজার সামনে। একটা স্লিভলেস টি-শার্ট আর ঢোলা ট্রাউজার পরা। 

“কোনো সমস্যা, অফিসার?” জানতে চাইলো মেয়েটি। শায়লা মির্জা আস্তে করে দরজার এক পাশে সরে দাঁড়ালো। 

“একটা ইনকোয়্যারির জন্য নক করেছিলাম।” 

“বলুন, কী জানতে চান?” 

জেফরি বেগ লক্ষ্য করলো দরজার বাইরে ফ্ল্যাটের মালেকিন আর থানার ওসি উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে তাদের দিকে। মেয়েটার চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সামান্য অস্বস্তি বোধ করছে সেজন্যে, অবশ্য জোর করে সেটা চেপে রেখেছে। 

“আমি কি ভেতরে আসতে পারি?” 

“শিওর,” মেয়েটা পুরোপুরি দরজা খুলে দিলো। “আসুন।” 

ওসি আর ফ্ল্যাটের মালেকিনের চোখেমুখে তীর্যক অভিব্যক্তি তৈরি করে ভেতরে ঢুকে পড়লো জেফরি। একে অন্যের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে তাকালো তারা। 

“আপনার নাম?” দরজাটা বন্ধ হতেই হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর জানতে চাইলো। 

“জেসি। এই ফ্ল্যাটটা আসলে আমিই রেন্ট নিয়েছি, ও কিছুদিন আগে উঠেছে…আমার সঙ্গে থাকে এখন।” শায়লা মির্জাকে দেখিয়ে বলল। 

লিভিংরুমের একটা সোফায় বসে পড়লো জেফরি বেগ। “পাশের ফ্ল্যাটে কী হয়েছে, জানেন নিশ্চয়ই?” 

“হুম,” গম্ভীর কণ্ঠে বলল মেয়েটি, দুচোখ অনেকটা অশ্রুসজল হয়ে উঠল, ভীতও মনে হলো কিছুটা। 

“আপনার সঙ্গে পরিচয় ছিল?…কথাবার্তা হতো?” 

“দেখা হলে হাই-হ্যালো হতো, এর বেশি কিছু না।” 

“ঐ ফ্ল্যাটে কে কে আসতো, জানেন?” 

ঠোঁট ওল্টালো মেয়েটি। “বলতে পারবো না। এখানে কেউ কারোর ব্যাপারে মাথা ঘামায় না।”

“রাতে কিংবা ভোরের দিকে অস্বাভাবিক কিছু শুনতে পেয়েছেন?” 

নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো জেসি। “না।” 

কিন্তু জেফরি তার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারলো, এই “না”টার মধ্যে “হ্যাঁ-ও” আছে। “আপনি এই ফ্ল্যাটটা ভাড়া নেবার সময় ফ্ল্যাট-ঔনারকে আপনার এনআইডির কপি দিয়েছিলেন?” 

“হ্যাঁ। ওটা ছাড়া কি আজকাল কেউ ভাড়া দেয়!” 

“ফ্ল্যাটের ভাড়ার রশিদ কি দেয়া হয় আপনাকে?” 

“হ্যাঁ।” 

“সেটা একটু দেখতে পারি?” 

মেয়েটি এবার অবাক হলো। “আমার ভাড়ার রশিদ দেখতে চাইছেন?…কেন?” 

প্রসন্ন হাসি দিলো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর। “আপনার ফ্ল্যাটের ঔনার…ভদ্রমহিলা আমাকে বলেছেন, উনি উনার ভাড়াটিয়াদের এনআইডি রাখেননি, ভাড়ার রশিদও দেন না, তাই আমি খতিয়ে দেখছি। অন্য কোনো ব্যাপার নেই এখানে।” 

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেসি। “…নিয়ে আসছি।” উঠে ভেতরের ঘরে চলে গেল মেয়েটা। 

“আপনি কেমন আছেন?” এবার শায়লা মির্জার দিকে তাকালো জেফরি বেগ। 

“জি, ভালো আছি,” মলিন কণ্ঠে বলল সাবেক অভিনেত্রী। “আপনাকে অনেক অনেক থ্যাঙ্কস।” 

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো জেফরি। 

“মুনেমের খুনিদেরকে ধরার জন্য।” 

“ওহ্। আচ্ছা, আপনি কি কিছু শুনতে পেয়েছিলেন কাল রাতে কিংবা আজকের ভোরের দিকে?… অস্বাভাবিক কিছু?” 

যেন কঠিন একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে, হাত কচলাতে শুরু করলো। মেয়েটা যে অভিনয়ে কাঁচা, আবারো প্রমাণ পেলো জেফরি কিন্তু শায়লা মির্জা কিছু বলার আগেই সেখানে চলে এলো জেসি। 

“এই নিন,” জেফরি বেগের দিকে একটা রশিদ বাড়িয়ে দিলো। “এটা লাস্ট মান্থের।” 

রশিদটা হাতে নিয়ে দেখলো ইনভেস্টিগেটর। কাগজটা কম্পিউটার প্রিন্টের। ভাড়াটিয়ার নামের জায়গায় লেখা “তাজরিন সুলতানা।” 

“ওটা আমার আসল নাম, জেসি আমার ডাক নাম। সার্টিফিকেট আর এনআইডিতে ডাক নাম নেই।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। “ভাড়া লেখা আছে চল্লিশ হাজার, উনি তো আমাকে বললেন পাশেরটা আশি হাজার টাকার মতো?” 

গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো মেয়েটি। “ট্যাক্স ফাঁকি দেবার জন্য রশিদে কম লেখেন কিন্তু উনি উনার নোটবুকে আসল ভাড়াটাই টুকে রাখেন।” 

বুঝতে পারলো জেফরি বেগ। এ দেশে সাধারণ ব্যাপার এটা। “রশিদটা আমি কিছুক্ষণের জন্য নিতে পারি কি?” 

“আপনার কাছে রেখে দিতে পারেন, ওটা আমার দরকার নেই।” 

“থ্যাঙ্কস,” বলে উঠে দাঁড়ালো সে। দরজার বাইরে এসেই টের পেলো রশিদটার উল্টো দিকে একটা ফোন নাম্বার লেখা : দ্রুত কলম দিয়ে লেখা হয়েছে। রশিদটা হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো সে। সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে ওসি আর ফ্ল্যাটের মালেকিন। 

“আপনি তো এই ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়াকে রশিদ দেন, ভাড়া দেবার আগে উনার এনআইডি কপিও রেখেছেন।” 

ফ্ল্যাটের মালেকিন কাচুমাচু খেলো। 

“এই ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে সেটা করেননি কেন?” সোনিয়ারটা ইঙ্গিত করে বলল। 

মহিলা কী বলবে ভেবে পেলো না। 

“আপনি যে নোটবুকে ভাড়ার আসল টাকার হিসেবটা রাখেন সেটা নিয়ে আসুন।” 

“আপনি কী বলতে চাচ্ছেন আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!” ফ্ল্যাটের মালেকিন বিস্মিত হবার ভাণ করলো। 

কিন্তু জেফরি কিছু বলার আগেই দেখতে পেলো সিঁড়ি দিয়ে মহিলার রোগাটে স্বামী ভীতু চোখে নেমে আসছে। “এই যে, আপনি…” লোকটাকে বলল। “আপনার স্ত্রী ভাড়ার হিসেবগুলো যে নোটবুকে টুকে রাখেন সেটা নিয়ে আসুন তো…উনার সঙ্গে এই ফাঁকে কথা বলি আমি।” 

“ওয়েট, অফিসার…নিয়ে আসছি,” লোকটা খুবই দায়িত্ববান মানুষের মতো আচরণ করলো, সিঁড়ি দিয়ে আবার উঠে গেল ব্যস্তসমেত। 

চোখের কোণ দিয়েই জেফরি দেখেছে, স্বামীকে ইশারা করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল মহিলা কিন্তু গোবেচারা লোকটি সেই ইঙ্গিত ধরতে পারেনি। 

“হ্যাঁ, বলুন…এই ফ্ল্যাটের ভাড়ার রশিদ দেন না, ভাড়াটিয়ার এনআইডি কার্ডও রাখেননি… কেন?” 

ওসি হাসমত এতক্ষণ ধরে চুপ করেই আছে, এবারও চুপ মেরে রইলো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে বিশাল চাপের মধ্যে আছে সে। আর চাপটা যে কী, জেফরির বুঝতে অসুবিধা হলো না। 

“হাসমত সাহেব, আপনি থানায় চলে যান,” লোকটাকে বলল এবার। “এখানে আপনার কোনো কাজ নেই।” 

ওসি কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে চুপচাপ চলে গেল সিঁড়ি দিয়ে। লিফটে করে কেন গেল না, জেফরি জানে না। 

“আপনি কিন্তু এখনও বললেন না?” তাড়া দিয়ে বলল মহিলাকে। “আসলে সবারটা রাখি না।” 

“এই ফ্ল্যাটটা যে ভাড়া নিয়েছিল সে তাহলে আপনার পরিচিত?”

“না, না,” আপত্তি জানালো মহিলা। “পরিচিত না।” 

“তাহলে ঐ লোক এনআইডি দিতে চায়নি?” 

ঢোক গিলল মহিলা। 

জেফরি দেখতে পেলো সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে মহিলার স্বামী, তার হাতে একটা নোটবুক। “এই যে, অফিসার।” 

নোটবুকটা হাতে নিয়ে খুলে দেখলো জেফরি বেগ। সোনিয়ার ফ্ল্যাট নাম্বারটা দরজায় লেখা আছে, পাতা উল্টিয়ে সেই ফ্ল্যাট নাম্বারের হিসেবটা বের করলো। “ফারহান ওমর ভাড়া নিয়েছেন?” এই নামটাই লেখা আছে সেখানে। 

ফ্ল্যাট ঔনার হ্যাঁ-না কিছুই বলল না, রীতিমতো হাত কচলাচ্ছে। 

“উনার এনআইডিও রাখেননি?” 

ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো মহিলা। জেফরি বেগ বুঝতে পারছে থানার ওসি চলে যাবার পর থেকে ভদ্রমহিলা কেমন অসহায় বোধ করছে। 

“একজন লোক এসে আপনার কাছে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া চাইলো, আপনি তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে ভাড়া দিয়ে দিলেন…লোকটা আবার নিজে থাকলো না সেখানে, এক মেয়েকে তুলল, সেই মেয়েটার পরিচয়ও জানতে চাইলেন না, এসবের মানে কি?” 

মহিলা যেন কথা খুঁজে পাচ্ছে না অনেকক্ষণ ধরে। মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেগ পেলো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। কড়া করে কিছু বলতে যাবে অমনি তার ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। পকেট থেকে সেটা বের করে দেখলো অপরিচিত একটি নাম্বার। কলটা রিসিভ করলো সে। 

“হ্যালো?” 

“আমি এমপি আবু হাসান বলছি,” ওপাশ থেকে রাশভারি একটা কণ্ঠ বলল। সম্ভবত এইমাত্র ঘুম থেকে জেগে উঠেছে, গলা ফ্যাসফেসে। 

“স্লামালেকুম, স্যার।” জেফরি বেগ বুঝতে পারলো তার এই নাম্বারটা এমপি কীভাবে পেয়েছে-পাশের ফ্ল্যাটে যখন ঢুকেছিল তখনই ওসি হাসমত মহিলাকে নাম্বারটা দিয়ে দিয়েছে আর মহিলা দিয়েছে এই এমপিকে হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর হিসেবে তার ফোন নাম্বার ঢাকার সব থানার কাছেই আছে। 

“রুজানা আমার কাজিন হয়, আপনি ওরে হ্যারাজ কইরেন না, বুঝলেন?” 

চোয়াল শক্ত হয়ে গেল জেফরি বেগের। মহিলার দিকে চকিতে তাকালো সে, নাকের পাটা ফুলে আছে, এতক্ষণ ধরে যে অসহায় ভাবটি ছিল সেটা আমূল পাল্টে গেছে এখন। মনে মনে বাঁকা হাসি দিলো। চাকরি জীবনে এমন ঘটনা এত বেশি ঘটেছে যে মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমস্যা হলো না। এই খেলাটা কীভাবে খেলতে হয় ভালো করেই জানে। “সরি, স্যার? আমি উনাকে কী করছি বললেন?” 

মনে হলো এমপি সাহেব একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। হয়তো কখনও পুলিশের কাছ থেকে এমন পাল্টা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়নি। “না, মানে…” গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করলো। ..শুনলাম আপনি ওরে ইয়ে করছেন…মানে…” কথার খেই হারিয়ে ফেলল এমপি। “বুঝতেই তো পারছেন, আমার কাজিন হয়, বেশি চাপাচাপি কইরেন না।” 

গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো জেফরি। “স্যার, উনি বিরাট বড় অপরাধ করেছেন। এখানে যে মার্ডারটা হয়েছে সেটার সঙ্গে উনি সম্ভবত ইনভলব আছেন।” 

মিসেস রুজানা বিস্ফারিত চোখে তাকালো। 

“…অনেক কিছু লুকাচ্ছেন আমার কাছ থেকে। উনি যদি আমার প্রশ্নের জবাব ঠিকঠাকমতো না দেন তাহলে আমি বাধ্য হবো উনাকে গ্রেফতার করতে, ইন্টেরোগেট করতে। বুঝতে পেরেছেন?” 

ফোনের ওপাশে নিরবতা নেমে এলো কয়েক মুহূর্তের জন্য। রুজানার চোখেমুখে আতঙ্ক ভর করছে এখন। 

“এসব কী বলছেন!” অবশেষে এমপি মহোদয় শব্দ খুঁজে পেলো। “ও তো কেবল ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিয়েছে, এসবের সঙ্গে ও কেন জড়িত থাকবে?!” 

“সেটা তো তদন্ত করলে বের হয়ে আসবে, স্যার,” শান্ত কণ্ঠেই বলল কথাটা। “উনি যদি জড়িত না থাকেন তাহলে সেটাও প্রমাণিত হয়ে যাবে। আপনি এ নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না।” 

আবারো ফোনের ওপাশে নিরবতা নেমে এলো।

“আপনাকে একটা অনুরোধ করবো, স্যার?” 

“হ্যাঁ-হ্যাঁ, শিওর,” এমপি বলল। 

“আপনার কাজিনকে বলে দিন আমার সঙ্গে যেন কো-অপারেট করেন, আমার প্রশ্নের ঠিকঠাক জবাব দেন। সেটা করলে আপাতত উনাকে সন্দেহভাজন কিংবা খুনের সহযোগি হিসেবে গ্রেফতার করবো না আমি।” 

কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে এমপি বলল, “ঠিক আছে।” 

ফোনটা কান থেকে সরিয়ে রুজানার দিকে তাকালো জেফরি বেগ। মহিলা যারপরনাই ভড়কে গেছে। “শুনলেন তো কী বলেছি?” 

ভয়ে ঢোক গিলল মিসেস রুজানা। 

“আমার প্রশ্নের ঠিকঠাক জবাব দেবেন, চুপ করে থাকলে আপনার কাজিন ঐ এমপিসাহেবও আপনাকে রক্ষা করতে পারবে না।”

অমনি পরিবেশের সাথে বেমানান চটকদার রিংটোনটা বেজে উঠল।

“কলটা রিসিভ করুন,” তাড়া দিলো জেফরি। আসলে রিংটোনটা অসহ্য ঠেকছে তার কাছে, বেশিক্ষণ বাজুক চাচ্ছে না। 

তড়িঘড়ি ফোনটা হাতে নিয়ে কল রিসিভ করে কানে চাপালো মহিলা। “প্লামালেকুম, ভাই…জি… জি…” মনোযোগ দিয়ে ওপাশের কথা শুনে গেল। কামড়ে ধরলো নিচের ঠোঁট, কপালে পড়লো চিন্তার ভাঁজ। …বুঝতে পেরেছি…প্লামালেকুম, ভাই।” ফোনটা রেখে গভীর করে দম নিয়ে নিলো। “এখানে না, আমার রুমে আসুন, প্লিজ।” 

অধ্যায় ৮ 

বনানী থানায় ঢোকার পরই জামান বুঝতে পারলো আবহাওয়া অনুকূলে নয়। সকাল সকাল তার বস তাকে ফোন করে বলেছে এখানে চলে আসতে, সম্ভাব্য একটি হোমিসাইডের মামলা করবে ভিক্টিমের বড় বোন। তার হোয়াটসঅ্যাপে ভবনটির লোকেশনও পাঠিয়ে দিয়েছে। এরপর সেখানে গিয়ে সিসিক্যাম ফুটেজগুলো সংগ্রহ করে দেখবে। তবে তার প্রথম কাজ বাদীকে মামলা করার সময় সাহায্য করা। 

ভিক্টিমের বড় বোনকে সে একজন এসআই”র কাছে নিয়ে গেছিল মামলা করার জন্য কিন্তু ওসি হাসমত সেখান থেকে তাদেরকে নিজের রুমে নিয়ে এসেছে। বোঝাই যাচ্ছে ওসি খুব তৎপর। 

“উনার মামলাটা লেখো,” অধীনস্ত এসআইকে নির্দেশ দেবার মতো করে বলল ওসি। 

জামান চুপচাপ মিসেস রানিয়ার পাশে বসে রইলো। 

“আপনি অপঘাতে মৃত্যুর মামলা করবেন,” বাদীকেও অনেকটা আদেশ করার ভঙ্গিতে বলল ওসি। “যেহেতু আপনার বোন সুইসাইড করছে।” 

সোনিয়ার বড় বোন বিস্মিত হলো কথাটা শুনে। তবে সে কিছু বলার আগে মুখ খুলল জামান। 

“এক্সকিউজ মি…এটা যে সুইসাইড তা কিন্তু প্রমাণিত হয়নি এখনও।” 

“আহা, এটা যে মার্ডার সেইটাও তো প্রমাণিত হয় নাই,” ওসি বলল অনেকটা বিরক্ত হয়ে। নিজের থানায় ফিরে অনেকটাই কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠেছে। 

“কিন্তু বাদী কার বিরুদ্ধে কী মামলা করবে সেটা আপনি ডিকটেক্ট করতে পারেন না। উনাকে উনার মতো করে মামলা করতে দিন। তদন্তে বের হয়ে আসবে আসল ঘটনা।” 

ওসি হাসমতের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। জামানের উপস্থিতিটাই মেনে নিতে পারছে না, যেন তার রাজত্বে অযাচিতভাবে ঢুকে পড়েছে। “মামলা দেওয়ার সময় পুলিশ হেল্প করবো না? উল্টাপাল্টা মামলা দিলে কাম হইবো?” 

“সেজন্যেই তো আমি এসেছি উনাকে সাহায্য করতে।” 

বনানী থানার ওসি জামানের দিকে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। মনে হলো কিছু বলবে কিন্তু বলল না। 

“আমার বোনকে খুন করা হয়েছে,” কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল সোনিয়ার বড় বোন রানিয়া। “আমি মামলা করতে চাই।” 

“কে খুন করছে আপনার বোরে?” আগ্রাসিভাবে জানতে চাইলো ওসি।

“আলভী! জাহান গ্রুপের সিইও।” 

আক্ষেপে মাথা দোলালো ওসি হাসমত। “আপনার কাছে এর কোনো প্রমাণ আছে?” 

“আহ” বাধা দিয়ে বলল জামান। “ওসি সাহেব, এটা তো আদালতে প্রমাণিত হবে, আপনি এখনই উনার কাছ থেকে প্রমাণ চাইছেন কেন?” 

বিরক্ত হলো ওসি। “প্রাইমারি কিছু প্রমাণ লাগবো না? চাইলাম আর যার তার নামে মামলা কইরা দিলাম. এইটা হয় নাকি?” 

“উনাকে সবটা বলতে দিন, তারপর না হয় দেখা যাবে উনার কাছে প্রাইমারি কোনো আলামত আছে কি না?” 

জামানের কথায় নিজের রাগ চেপে রাখলো ওসি, লম্বা করে শ্বাস নিলো। “আপনি বলুন,” ভিক্টিমের বড় বোনকে বলল হোমিসাইডের সহকারি ইনভেস্টিগেটর। 

“আলভীর সঙ্গে আমার বোনের সম্পর্ক ছিল প্রায় দেড় বছর ধরে। যে ফ্ল্যাটে ও থাকতো সেটা আলভীই ওকে ভাড়া করে দিয়েছিল…” 

“বিবাহিত একজনের সাথে রিলেশন করলো…আপনি বড় বোন হিসাবে কিছু বলেন নাই তারে?” ওসির চোখমুখ বিকৃত হয়ে গেল। 

ভিক্টিমের বোন চুপ মেরে গেল। বিরক্ত হয়ে জামান তাকালো লোকটার দিকে। চিরায়ত ভিক্টিম রেমিং করার চেষ্টা করছে ওসি। 

“এত কম বয়সি একটা মেয়ে এইরকম বড়লোকের সঙ্গে কেমনে জড়াইলো? আসলেই কোনো সম্পৰ্ক আছিল নাকি অন্য কিছু?!” 

ওসির ইঙ্গিতপূর্ণ কথা শুনে রানিয়ার চোখদুটো ছল ছল করে উঠল। “ওসিসাহেব, প্লিজ,” বলল জামান। “এটা কিন্তু ভিক্টিম ব্লেমিং হয়ে যাচ্ছে…উনাকে উনার কথা বলতে দিন।” 

মুখ বাঁকালো ওসি হাসমত। “পাইছেন একটা ইংরাজি শব্দ ভিক্টিম ব্লেমিং! যেন ভিক্টিমের কোনো দোষ নাই!” 

“ভিক্টিমের দোষ থাকলেও সে ভিক্টিমই,” জোর দিয়ে বলল সহকারি ইনভেস্টিগেটর। রানিয়ার দিকে ফিরে তাকালো এবার। “আপনি বলুন।”

“কিছুদিন ধরে ওদের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। কয়েক দিন আগে ও আমাকে বলেছিল খুব ভয় পাচ্ছে, আশঙ্কা করছিল ওকে সম্ভবত মেরে ফেলা হবে…খানে আর থাকতে চাচ্ছিল না, ঢাকায় এসে নিয়ে যেতে বলেছিল আমাকে।” 

“আপনার বোন বলেছে কে তাকে মেরে ফেলতে চাইতাছে?” ওসি জানতে চাইলো। 

“হুম…আলভীর লোকজন।” 

“আলভী সাহেবের লোকজন!” বাঁকাহাসি দিয়ে বলল ওসি হাসমত। “এখন আবার লোকজন আমদানি করা হইতাছে। 

“ওসি সাহেব,” এবার জামানই বিরক্ত হলো। “প্লিজ, উনাকে আগে সবটা বলতে দিন। আগে শুনি তারপর না হয় প্রশ্ন করবেন?” 

দুই হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করলো ওসি। “ওকে।” 

“আপনি বলুন,” ভিক্টিমের বোনকে অভয় দিয়ে বলল জামান। 

“কাল পৌণে একটার দিকে আমার বোন আমাকে কল দিয়েছিল, ঘুমিয়ে ছিলাম তাই ধরতে পারি নাই। পরে টের পেয়ে ঘুম ভাঙে আমার কিন্তু ওরে আট-দশ বার কল দিলেও ও আর ধরেনি। খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম তাই এই থানায় ফোন দিয়ে ঘটনাটা জানাই।” 

“আপনার বোন কি আলভী সাহেবের কথা বলেছিল নাকি অন্য কারোর কথা?” 

ওসি সোজা হয়ে বসলো। 

“বলেছিল আলভীর লোকজন ওকে মেরে ফেলতে পারে।” 

বাঁকা হাসি দিলো ওসি, কিছু বলতে চাইলেও বলল না। 

“নির্দিষ্ট করে কোনো নাম বলেনি?” 

“না। শুধু বলেছিল বাড়িতে এসে সব বলবে।” তারপরই দু হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়লো। 

অধ্যায় ৯ 

ফ্ল্যাটের মালেকিনের সুসজ্জিত ড্রইংরুমে বসে আছে জেফরি বেগ। তাকে এক কাপ কফি দেওয়া হয়েছে প্রণোদনা হিসেবে। ছোট্ট একটা সৌজন্যতা তাই এটাকে ঘুষ হিসেবে বিবেচনা করছে না। 

মিসেস রুজানা ওয়াশরুমে যাবার কথা বলে একটু সময় নিচ্ছে হয়তো। সমস্যা নেই। এমপিসাহেব অকার্যকর হয়ে গেছে, এখন নিশ্চয়ই পিএমের দ্বারস্থ হবে না! বড়জোর আরেক জাঁদরেল এমপিকে ফোন দেবে। 

একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো তার ভেতর থেকে। এই পেশাগত জীবনে কেবলমাত্র অপরাধীরাই তাদের একমাত্র চ্যালেঞ্জ হবার কথা ছিল কিন্তু আইনের শাসনের বারোটা বাজার কল্যাণে খোদ আইনপ্রণেতারাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। 

কফির কাপটা তুলে নিলো আনমনে কিন্তু চুমুক দিতেই চোখমুখ বিকৃত হয়ে গেল তার। এত বাজে কফি জীবনেও খায়নি। কাপটা সামনের টেবিলে রেখে দিলো। 

রুজানা আহমেদ যখন ফিরে এলো জেফরি বেগ বুঝতে পারলো মহিলা আসলে কেন সময় নিয়েছে-জামা পাল্টে, একটু সেজেগুজে এসেছে। অবশ্যই ঝটপট। তবে চেষ্টা করেছে এই সময়ের মধ্যেই যেন তাকে সুন্দর দেখায়। এই মহিলা তাকে সিডিউস করার চেষ্টা করছে না কি! এমন ভাবনা 

খেলে গেল তার মাথায়। 

“এখন বলুন, এত লুকোছাপা করছেন কেন?” 

মহিলা চেষ্টা করলো চেহারায় করুণ ভাব আনতে, নিজেকে অসহায় দেখাতে। “ইয়ে মানে…” নিজের হাতটা কীভাবে রাখবে বুঝতে পারছে না। একবার হাতের উপরে রাখছে তো পরক্ষণেই বুকের উপর ভাঁজ করছে। 

“বলুন? এই ফারহান ওমর কে, কী করে?” তাড়া দিলো জেফরি বেগ। 

“উ-উনাকে আমি আগে থেকেই চিনি।” 

“অবশ্যই চেনেন, নইলে তো কাজপত্র ছাড়া ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিতেন না।”

মহিলা নিশ্চুপ। 

“উনার পরিচয়টা দিন,” একটু বিরক্ত হয়েই বলল এবার। “উনি কী করেন?” উত্তর না পেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “আপনাকে কি উনি ফোন করে বলে দিয়েছেন উনার পরিচয়টা না দিতে…ভয় দেখিয়েছেন?” 

ঢোক গিলল রুজানা আহমেদ, আস্তে করে মাথা নিচু করে ফেলল। 

“নির্ভয়ে বলুন, আপনার কোনো সমস্যা হবে না। আপনি কিছু না বললেও আমরা উনার পরিচয় বের করে ফেলবো, তখন কিন্তু আপনাকেও সন্দেহ করবো পারপিট্রেটর হিসেবে।” 

ভড়কে গেল মহিলা। সম্ভবত এই ইংরেজি শব্দটা তার সারাউন্ডিংস ভ্যালুজের মধ্যে পড়ে। 

“আপনার জন্য বেস্ট অপশন হচ্ছে ফ্ল্যাটটা যে রেন্ট নিয়েছে তার পরিচয় প্রকাশ করা, এখানে আপনার কোনো দোষ নেই। ওরা চাইলেও আপনাকে কিছু করতে পারবে না। আপনি বলবেন আমার জেরার মুখে বলতে বাধ্য হয়েছেন, নইলে আপনি অ্যারেস্ট হতেন।” 

মনে হলো কথাগুলো কাজে দিয়েছে। মাথা নেড়ে সায় দিলো মহিলা “উ-উনি…জাহান গ্রুপের লোক।” 

মুচকি হাসলো জেফরি বেগ। এটা আগেই বুঝতে পারছিল, এখন পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেল। প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইলো : “ঐ ফ্ল্যাটের কয়টা এক্সট্রা চাবি আছে আপনার কাছে?” 

প্রশ্নটা শুনে থতমত খেলো মিসেস রুজানা। “দ্-দুইটা।” 

“চাবিগুলো নিয়ে আসুন।” 

মহিলা উঠে ভেতরের ঘরে চলে গেল, ফিরে এলো দুই-তিন মিনিট পর। একটা চাবি বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। 

“একটা কেন?” 

“স্-সোনিয়ার কাছে আরেকটা।” আবারো সামান্য তোতলালো মিসেস রুজানা। 

“আপনি না বললেন আপনার কাছে দুটো এক্সট্রা চাবি আছে?”

“ওই তো, ওরটা নিয়া বলছি..” ঢোক গিলল আবারো। “আমি আসলে বুঝতে পারি নাই আপনার প্রশ্নটা।” 

বিরক্ত হলেও সেটা প্রকাশ করলো না জেফরি বেগ। “খুনি সোনিয়ার দরজাটা চাবি দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকেছিল, বুঝতে পেরেছেন?” 

বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলো মহিলা। 

“দরজাটা পুলিশ আপনার কাছ থেকে চাবি নিয়ে খুলেছে, দরজা ভাঙা হয়নি…আপনাকে এরকম একটা স্টেটমেন্টে সাইন করতে হবে।” 

“জি,” ভয়ে ঢোক গিলল রুজানা। 

“আর কারোর কাছে চাবি আছে?” 

মাথা দোলালো ফ্ল্যাটের মালেকিন। “কারো কাছে নাই, খালি আমার কাছে আছে…এইটা।” 

“আপনি যদি জাহান গ্রুপের লোকটাকে বাড়তি কোনো চাবি দিয়ে থাকেন তাহলে কিন্তু তদন্ত শুরু হলে বের হয়ে আসবে, সেক্ষেত্রে এই খুনের মামলায় একজন সহযোগি হিসেবে আপনার নামও চার্জশিটে দেয়া হবে।” 

ভয়ার্ত মুখে হাত কচলালো মহিলা। “বিশ্বাস করেন আমি একটুও মিথ্যা বলতাছি না। প্রত্যেক অ্যালোটিকে দুইটা করে চাবি দেই আমি…একটা বাড়তি…ইন কেইস হারায়া-টারায়া গেলে…” একটু থামলো। “সোনিয়া বাড়তি চাবিটা আমার কাছে ফিরায়ে দিছিল।” 

“কেন?” 

“ও বলল ওর কাছে থাকলে হারায়া যাইতে পারে। আমি যেহেতু এই বিল্ডিংয়েই থাকি, চাবি হারায়া গেলে আমার কাছ থেকে নিবো।”

জেফরি বেগ স্থিরচোখে চেয়ে রইলো মিসেস রুজানার দিকে। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে সে ষাট শতাংশ নিশ্চিত মহিলা সত্যি বলছে। কিন্তু চল্লিশ শতাংশ সন্দেহ রয়েই গেল। 

“এইখানে উঠার পর একবার ও ভিতরে চাবি রাইখ্যা দরজা লক কইরা দিছিল, পরে আমার কাছ থেকে চাবি নিয়া খুলছে।” 

“আচ্ছা,” বলল হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। “এখানে আপনার মোট ফ্ল্যাটের সংখ্যা চারটি…একটাতে তো আপনি থাকেন, বাকি তিনটার মধ্যে দুটোর কথা জানা গেছে, অন্য ফ্ল্যাটটা কোথায়? ওটাও কি ভাড়া দেন?” 

মাথা নেড়ে সায় দিলো রুজানা আহমেদ। “ওইটা দোতলায়…কামারা বিডি ভাড়া নিছে।” 

ভুরু কুঁচকে গেল জেফরি বেগের। “কামারা কী?” 

“কামারা বিডি।” 

“এটা কী জিনিস?” 

“ঐ যে এয়ারবিএনবি আছে না, ওইরকম…লোকাল এয়ারবিএনবি বলতে পারেন।” 

নড়েচড়ে উঠল জেফরি বেগ। এয়ারবিএনবি সম্পর্কে সে জানে— জনপ্ৰিয় রাইড-শেয়ারিং উবারের মতোই, পার্থক্য হলো এরা গাড়ি না অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া দেয় স্বল্পকালীন সময়ের জন্য-অনেকটা হোটেল রুমের মতো। আজকাল এরকম কিছু লোকাল প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে কিন্তু সেগুলোর না আছে আইনগত ভিত্তি না আছে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। তিন মাস আগে এক ব্যবসায়ির হত্যাকাণ্ড তদন্ত করতে গিয়ে প্রথম এরকম ফেসবুক পেজনির্ভর বিডি ট্রাভেলা নামের একটি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পেয়েছিল। 

“এটা আপনি আমাকে আগে বলবেন না!” 

“আপনি তো জানতে চান নাই,” মহিলা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো। 

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। “হুম। ওই কামারা বিডি”র কে ভাড়া নিয়েছে দোতলাটা?” 

“মোকারম সাহেব।” 

“তার এনআইডি”র কপি রেখেছেন নাকি রাখেননি?” 

ঢোক গিলে মাথা নেড়ে সায় দিলো রুজানা। “রাখছি।” 

“সবারটাই তো দেখছি রেখেছেন শুধু সোনিয়ারটা বাদে,” আক্ষেপে 

মাথা দোলালো। “উনার আইডির কপিটা নিয়ে আসুন।” 

ফ্ল্যাটের মালেকিন আবারো চলে গেল ভেতরের ঘরে, 

ফিরে এলো মিনিটখানেক পর। “এই যে,” একটা কাগজ বাড়িয়ে দিলো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটরের দিকে 

কাগজটা হাতে নেবার পর ফ্ল্যাটের মালেকিনের কাছ থেকে মোকারম সাহেবের ফোন নাম্বারটাও নিয়ে বের হয়ে গেল। আর যেতে যেতেই ভাবলো, সম্ভবত এই মহিলা তার ফ্ল্যাটের দামি দরজাটা ভাঙা হবে বলে নিজের কাছে থাকা এক্সট্রা চাবি নিয়ে এসেছিল। খুনের সঙ্গে জড়িত থাকলে এই কাজটা করতো না। 

এই জীবনে অনেক কেসেই রুজানার মতো চরিত্রের দেখা পেয়েছে সে। কোনো কারণে নার্ভাস হয়ে, ঘাবড়ে গিয়ে এমন কিছু করে যে ধন্দের মধ্যে ফেলে দেয়, সন্দেহের উদ্রেক করে কিন্তু শেষে দেখা যায় এরা কেসের সঙ্গে মোটেও জড়িত নয়। এই মহিলাকে সেরকমই মনে হচ্ছে। অবশ্য তদন্ত শেষ না হলে এটা বোঝা যাবে না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *