কন্ট্রোল – ৪৫

অধ্যায় ৪৫ 

দৃশ্যমান শোক কিছুটা কমে এলেও জেফরি বেগের ক্ষোভ আর ক্রোধের মাত্রা একটুও কমলো না। পাশাপাশি হতাশাও গ্রাস করলো তাকে। কিছুই করতে পারছে না, কিছুই যেন করার নেই! নিজেকে অক্ষম ভাবতে যারপরনাই ঘেন্না হলো। 

জামান তাকে জানিয়েছে রেবার পরিবার এখনও জানে না তাদের মেয়ে খুন হয়েছে। নিত্যদিনের অসংখ্য সড়ক দুর্ঘটনার মতো দুভার্গ্যজনক ঘটনা তাদের পরিবারের একজনের সঙ্গেও ঘটে গেছে—এর চেয়ে বেশি কিছু ভাবার অবকাশ তাদের নেই। 

পরিবার বলতে অবশ্য কেউ নেইও এখন! তার বৃদ্ধা মা আর প্রবাসি বড় ভাই। রেবার মা এখন শোকে পাগলপ্রায়, লাইফ সাপোর্টে থাকা স্বামীকে নিয়ে হাসপাতালে পড়ে ছিলেন এ কয়দিন, আজ সেটারও অবসান হয়েছে। একটু আগে জামান জানিয়েছে, ভদ্রলোক শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুশয্যায় নিজের প্রিয় সন্তানের মর্মান্তিক পরিণতির কথা শোনাটা যে কারোর জন্যই মৃত্যুর চেয়েও বেশি পীড়াদায়ক। 

জেফরির এখনও মনে পড়ে প্রথম সাক্ষাতেই তার জন্ম-পরিচয় নিয়ে বিচ্ছিরি ইঙ্গিত করেছিলেন আনজার হোসেন। অনেক কষ্ট পেয়েছিল সে। তবে রেবার মুখের দিকে তাকিয়ে ভুলে গেছিল সবটা। বাবাকে কষ্ট দেবে না বলে মেয়েটা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছিল। জেফরি কখনও বিয়ের জন্য তাড়া দেয়নি তাকে। বাবাকে নিয়ে ক্যান্সারের যুদ্ধ করতেই চলে যায় কয়েকটা বছর। তাতে করে তাদের সম্পর্কটা একটুও ফিকে হয়ে যায়নি। 

জেফরি এখন নিশ্চিত, রেবা যদি তার স্ত্রী-ও হতো এমন ঘটনার পর সে মামলা করতো না। সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু হতো না সেটা। আদালতের বারান্দায় ছোটাছুটি করতে করতে কয়েক বছর চলে যেতো, তারপর দেখা যেতো একরাশ হতাশা উপহার দিয়ে আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়ে গেছে। 

আলভী কাজটা করিয়েছে পেশাদার কাউকে দিয়ে, অবশ্যই মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে। যাকে দিয়ে করিয়েছে তাকে খুঁজে বের করাটাই হবে অসম্ভব কাজ। তদন্ত করতে করতে যদি কোনোভাবে ঐ লোকের ব্যাপারে জানাও যায়, নাগাল পাওয়ার আগেই সরিয়ে ফেলা হবে তাকে-খুনির লাশও পাওয়া যাবে না। 

দাফনের সময় উপস্থিত না থাকলেও সিদ্ধান্ত নিলো রেবার কবরের সামনে গিয়ে কিছুটা সময় কাটিয়ে আসবে মাঝেমধ্যে। এর কারণ ফাদার হোবার্টের একটা কথা মৃত্যুশয্যায় একদিন তার হাত ধরে ফাদার বলেছিলেন, তিনি মারা যাবার পর জেফরি যেন মাঝেমধ্যে তার কবরটা দেখে আসে। 

“আমি কিন্তু টের পাইবো!” যন্ত্রণার মধ্যেও কষ্ট করে হেসে বলেছিলেন। “তুমি ফাঁকি দিতে পারিবা না, জেফ!” 

ফাদারের হাতটা ধরে কথা দিয়েছিল সে। 

“আমি জানি, তুমি দিবা না,” মলিন হাসি দিয়ে বলেছিলেন লোকটা। 

পরে জেফরির এক মনোবিজ্ঞানী বন্ধু তাকে বলেছিল ফাদার কেন এরকম অনুরোধ করেছিলেন সেটা বুঝতে পারছে। নিকটজনকে হারালে যে প্রচন্ড শোকে আক্রান্ত হয় মানুষ, নিয়মিত কবর পরিদর্শন করলে সেই শোক লাঘব হয় দ্রুত। এই একই পরামর্শ নাকি মনোবিজ্ঞানীরা অতিরিক্তি মৃত্যুভয়ে আক্রান্ত মানুষকেও দিয়ে থাকে। 

জেফরি বেগ তাই আজকে হুট করেই চলে এসেছে কবরস্তানে, রেবার কবরের পাশে বসে আছে এখন। তার সামনে কয়েক হাত মাটির নিচে শায়িত আছে মেয়েটা। অথচ খুনি দিব্যি বেঁচে আছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে জমিনের উপর! 

একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো তার ভেতর থেকে। 

একবার রেবা কৃত্রিম আফসোস করে বলেছিল, কেন যে পুলিশের লোকের সাথে প্রেম করতে গেল! এই লোককে বিয়ে করলে তো আমার জীবনটা তেজপাতা হয়ে যাবে। বুঝতে পারছি, আমার কপালে অনেক দুঃখ আছে। নিজের অশ্রু আর সংবরণ করতে পারলো না, ভেতর থেকে ঠেলেঠুলে কান্না বের হতে চাইলো। 

মনে পড়ে গেল অনেকদিন আগে রেবা তাকে ভড়কে দিয়ে বলেছিল তার পিরিয়ড বন্ধ হয়ে গেছে। কথাটা শুনে আৎকে উঠেছিল সে। এরকম তো হবার কথা নয়। মেয়েটা অসহায় কণ্ঠে বলেছিল, সে-ও বুঝতে পারছে না। ফোনের ওপাশ থেকে বলেছিল তার খুব লজ্জা লাগছে। জেফরি তাকে অভয় দিয়ে বলেছিল সে যেন এ নিয়ে চিন্তা না করে। ওরকম কিছু হলে তারা দ্রুত বিয়ে করে ফেলবে। আর তখনই ফোনের ওপাশ থেকে ফিক্ করে চাপা হাসির শব্দ শুনতে পেয়েছিল। 

“বিপদে না পড়লে আপনি আমাকে বিয়ে করবেন না দেখছি,” কৃত্রিম অভিমানে বলেছিল রেবা। “স্টুপিড!” 

জেফরির বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিল রেবা এরকম প্র্যাঙ্ক করেছে তার সঙ্গে, তা-ও আবার তার জন্মদিনের দিন! 

“পেছনে তাকাবেন না!” 

একটা কণ্ঠ তাকে বলল, চমকে উঠল জেফরি বেগ। আর এই কণ্ঠটা তার কাছে চেনা চেনা লাগছে! বাবলু?! টের পেলো তার পেছনেই আছে! 

“আপনাকে সার্ভিলেন্স করা হচ্ছে!” 

অবাক হলো সে। “কারা করছে?” 

“জানি না।” একটু থেমে আবার বলল, “মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে কথা বলুন, ওরা বুঝতে পারবে না।” 

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। 

“আমাকে খুঁজছেন কেন?” 

পেছন ফিরে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে রাখলো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর। “আমি তোমাকে একটা কন্ট্রাক্ট দিতে চাই।” 

বাস্টার্ড টের পেলো তীব্র আবেগে কাঁপছে ইনভেস্টিগেটর। 

“এই কবরে কে শুয়ে আছে, জানো নিশ্চয়ই?” 

“হুম।” 

“ওকে আসলে খুন করা হয়েছে,” দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা। “জাহান গ্রুপের আলভী ঠাণ্ডা মাথায় খুন করিয়েছে রেবাকে। কিন্তু ওকে আমি কোনোদিনও আইনের আওতায় আনতে পারবো না, বিচারের মুখোমুখি করাতে পারবো না।” 

শোকগ্রস্ত লোকটার কথা শুনে গেল বাবলু। 

“সরকার, প্রশাসন, আদালত, সব তাদের পকেটে।” 

বাস্টার্ড এবারও কিছু বলল না। বহুকাল আগেই এসব সত্য সে জেনে গেছিল। নিজেকে আবিষ্কার করেছিল এমন এক জঙ্গলে যেখানে শিকার আর শিকারী হওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই 

“এত কিছু জানার পরও আমি দেখতে চেয়েছিলাম, ওরা কতো দূর পর্যন্ত যেতে পারে। ভেবেছিলাম, আমার কোনো পিছুটান নেই, ওরা বড়জোর আমার ক্ষতি করবে। ভুলেই গেছিলাম রেবার কথা, আমার মনেই ছিল না ওর ক্ষতি করতে পারে কেউ!” 

চুপচাপ শুনে গেল বাস্টার্ড। 

“আমি ভালো করেই জানি, যতো প্রমাণই জোগাড় করি না কেন, তার কিচ্ছু হবে না। ওই খুনির বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা আমার নেই!” নিজের অক্ষমতা জাহির করলো সে। 

কথাটার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারলো না বাবলু। যতোটুকু জানে, সেহান গ্রুপের টাকার পাহাড়ের নিচে সবকিছু চাপা পড়ে যাবে। আগেও তাদের অপরাধের বিচার হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। 

“তাই বলে রেবার হত্যাকারী পার পেয়ে যাবে?” আলতো করে মাথা দোলালো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। “আমি এটা মেনে নিতে পারবো না।” শেষ কথাটা দৃঢ়তার সঙ্গে বলল। 

“আপনি নিশ্চিত এটা হত্যাকাণ্ড… আলভীই করেছে?” 

দুচোখ বন্ধ করে মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। “শতভাগ নিশ্চিত। এখন বলো, কতো টাকা হলে কাজটা করবে তুমি?” 

“কেউ এদিকে আসছে! কথা বলবেন না,” বাস্টার্ড বলল নিচু কণ্ঠে।

জেফরি বেগ চুপ মেরে রইলো, একটু পর টের পেলো তার পেছনে এসে কেউ দাঁড়িয়েছে। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো সে, তারপর ঘুরে দেখলো কাছেই, ওয়াকওয়ে”তে জামান দাঁড়িয়ে আছে। 

কিন্তু বাবলু নেই! 

ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে জেফরি বেগ তার সহকারি জামানকে বলেছিল কবরস্তানে যাচ্ছে, সে-ও যেন চলে আসে। কিন্তু তার মাথায় এটা ঢুকছে না জামান কী করে বাবলুকে দেখতে পেলো না! একটু আগেও তো ছিল ঠিক তার পেছনেই! জামান ওকে সত্যি সত্যি দেখেনি?! অবাক হলো খুব। দেখলে অবশ্যই চেনার কথা। 

নাকি বাবলু এখানে আসেনি! পুরোটাই ওর ডিল্যুশন ছিল? বিভ্ৰম! নিশ্চিত হতে পারলো না। এমন সময় তার ফোনটা বাজলে সম্বিত ফিরে পেলো। ফোনের ডিসপ্লে দেখে বুঝলো দিলান মামুদ ফোন করছে। জামানকে হাত তুলে অপেক্ষা করার ইশারা করলো সে। 

“আপনি কোথায়?” কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলল। 

“বাইরে এসেছি একটু।” 

“ও। শুনুন, এয়ারপোর্টে আমার এক পরিচিত লোক একটু আগে জানালো আলভী তার পরিবার নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে আজ রাতে।” 

“তাই নাকি!” তীব্র হতাশা জেঁকে বসলো জেফরির মধ্যে।

“চার্টার্ড প্লেনে করে যাবে…খুব বেশি মানুষ জানে না।”

“কখন যাবে?” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল। 

“তা জানি না তবে রাতের মধ্যেই যাবে সম্ভবত।” 

নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর। যদিও সে বিমানবন্দরে আলভীর ব্যাপারে কোনো রেড নোটিশ জারি করেনি এখনও তারপরও চাটার্ড প্লেনে করে যাওয়ার কারণ সম্ভবত বাড়তি সতর্কতা। এমনও হতে পারে, পরিবার-পরিজন নিয়ে এভাবেই ভ্রমণ করে তারা। ঘটনা যাই হোক, আলভী দেশের বাইরে পালিয়ে যাচ্ছে আর সেটা তার ভয়ে। 

“আমি অবশ্য এটা আশা করিনি,” বলল জেফরি। “ভেবেছিলাম গভমেন্টের উপর মহলে দৌড়াদৌড়ি করছে, ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে পরিস্থিতিটা।” 

“হুম, আমিও অবাক হয়েছি,” সায় দিয়ে বলল দিলান। “সম্ভবত এই প্রথম জাহান গ্রুপের কেউ অপকর্ম করে দেশ ছাড়ছে। এটাকে আপনি সফলতা হিসেবে দেখতে পারেন কিন্তু?” 

বাঁকা হাসি দিলো জেফরি বেগ। “ঐ লোকটাকে যেদিন শাস্তি দিতে পারবো সেদিন আসবে সত্যিকারের সফলতা।” 

“সেটা ঠিক আছে কিন্তু আপনার ভয়ে যদি সে দুয়েক মাস বাইরে থাকে, এটাকে সফলতা হিসেবে দেখা উচিত। এর আগে তো এমনটা হয়নি। হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নিয়ে নিয়েছে, বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে।” 

“দুয়েক মাস পর কেসগুলো কোল্ড স্টোরেজে চলে যাবে না, আমি এটা নিয়ে কাজ করে যাবো।” 

“হুম…নিউজটা আমি ক্র্যাক্ড করবো আজকেই। এমন স্কুপ নিউজ হাতছাড়া করা যাবে না। আপলোড দেবার আগপর্যন্ত আপনি এটা কারো সঙ্গে শেয়ার করবেন না, প্লিজ।” 

“চিন্তার কোনো কারণ নেই,” জেফরি আশ্বস্ত করলো ফ্রিল্যান্স সাংবাদিককে। “আমি এটা শুনিনি। আগামিকাল সকালে অফিসে গিয়ে আপনার চ্যানেল থেকে জানতে পারবো। ঠিক আছে?” 

“হা-হা-হা,” প্রাণখোলা হাসি দিলো দিলান মামুদ। “আপনি আবার আমাকে ভিউখোর সাংবাদিক ভাববেন না। আ”ম নট অ্যা কন্টেন্ট ক্রিয়েটর। একটা স্কুপ নিউজ দিতে পারলে ভালো লাগে, মনে হয় সত্যিকারের সাংবাদিকতা করছি।” 

“বুঝেছি,” বলল জেফরি। 

অধ্যায় ৪৬ 

কবরস্তান থেকে বের হবার সময় বাস্টার্ড দেখতে পেলো সার্ভিলেন্সে থাকা দুজন গেটের কাছে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। 

বেঁধে রাখা রুমালটা মাথা থেকে খুলে ফেলল সে, এগিয়ে গেল রাস্তার ওপারে বাইকের উপরে বসে সিগারেট খাচ্ছে মৃদুল, তাকে দেখে নেমে পড়লে। সিটের পেছনে রাখা হেলমেটটা পরে বাইকে উঠে স্টার্ট দিলো বাস্টার্ড মৃদুলকে নিয়ে চলে গেল কবরস্তানের সামনে থেকে। 

আজ কতোদিন পর কবরস্তানে এসেছে মনে করতে পারলো না। শেষ বার এসেছিল তার পালক পিতা খুইন্যা বাবুলের কবর জিয়ারত করতে। মাথায় একটা সুতির রুমাল টুপির মতো করে বেঁধে নিয়েছিল তখন। আজকেও সেটা করেছে। তাকে দেখে মনে হয়েছে নিকট কোনো স্বজনের কবর জিয়ারত করতে আসা শোকসন্তপ্ত একজন। 

ঢাকায় প্রচুর ধুলোবালির কারণে অনেকেই মাস্ক পরে, সেই সুযোগটাও নিয়েছিল, সেজন্যেই জেফরি বেগের ঐ সহকারি তাকে খেয়ালই করেনি। 

দু দিন আগেও জেফরি বেগের সঙ্গে জাহান গ্রুপের বিবাদ এবং দুর্ঘটনায় রেবার মৃত্যুর কথা জানতো না সে। বাবুর কাছ থেকে সব শুনে অনলাইনে সার্চ দিয়ে ইউটিউবের একটি নিউজ চ্যানেলের কয়েকটি রিপোর্ট পায়। সাংবাদিকের নাম দেখে ভুরু কপালে উঠে গেছিল তার দিলান মামুদ! বহু বছর আগে এই ক্রাইম-রিপোর্টার কী করে যেন তার কথা জেনে গেছিল, এ নিয়ে পত্রিকায় ছোট্ট একটা রিপোর্টও করেছিল সে। ভাগ্য ভালো, তার আসল নামটা জানতো না সাংবাদিক। 

দিলান মামুদের প্রথম রিপোর্টটা ছিল সোনিয়া নামের এক তরুণীর রহস্যজনক “আত্মহত্যা” নিয়ে। মেয়েটার সঙ্গে জাহান গ্রুপের সিইও আলভীর সম্পর্ক ছিল। অপঘাতে মৃত্যুর সময় গর্ভবতীও ছিল সে। রিপোর্টে বেশ ভালোভাবেই ইঙ্গিত দেয়া আছে, এটা হত্যাকাণ্ড হতে পারে। 

একদিন পর দ্বিতীয় রিপোর্টটাও সোনিয়া হত্যাকাণ্ড নিয়ে তবে সেখানে উঠে এসেছে একটি স্টিঙ্গ অপারেশনের কথা। হোমিসাইডের জেফরি রেগ হাতেনাতে একজন ডাক্তারকে দশ লক্ষ টাকা ঘুষ দেবার সময় জাহান গ্রুপের এক কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছে। তারা চেষ্টা করছিল সোনিয়ার পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে যেন দুটো স্পর্শকাতর তথ্য না আসে সোনিয়া খুন হয়েছে এবং সে মৃত্যুকালে তিন মাসের গর্ভবতী ছিল। 

তৃতীয় রিপোর্টটি ছিল রেবার দুর্ঘটনা নিয়ে। “রহস্যজনক দুর্ঘটনা” নামের রিপোর্টটিতে দিলান মামুদ ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেছে : জাহান গ্রুপের সিইও আলভীর বিরদ্ধে সোনিয়া হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করছে জেফরি বেগ। 

রিপোর্টটি শেষ করা হয়েছে এভাবে : এরকম অবস্থায় হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগের বাগদত্তার রহস্যজনক দুর্ঘটনা এবং অপমৃত্যু অনেক প্রশ্নেরই উদ্রেক করছে। 

রেবার সঙ্গে একবারই দেখা হয়েছিল তার, জেফরি বেগের বাড়িতে। হোমিসাইডের লোকটার সঙ্গে তার প্রথম মোলাকাতের ঘটনাটি মোটেও সুখকর ছিল না। নিজের কব্জায় নেবার পর মেয়েটার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়েছিল সে, ভয়ে থর থর করে কাঁপছিল তার জিম্মি। মৃত্যুভয়ে একদম সিঁটিয়ে গেছিল। অবশ্য রেবাকে মারার কোনো ইচ্ছে তার ছিল না, সবটাই করেছিল জেফরি বেগের সঙ্গে বোঝাপড়া করার জন্য। 

চতুর্থ রিপোর্টটি ছিল আকবর হাসান নামের একজনের জামিন লাভের সংবাদ। এই লোক সোনিয়া নামের মেয়েটির পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট পাল্টে দেবার জন্য ডাক্তারকে ঘুষ দিতে গিয়ে হোমিসাইডের হাতে ধরা পড়েছিল। জাহান গ্রুপ যে তার জামিন পাবার পেছনে কাজ করেছে সেটার ইঙ্গিত দিতে কার্পণ্য করেনি রিপোর্টার। 

একটু আগে মৃদুলকে নিয়ে বাইকে করে জেফরির ফ্ল্যাটের দিকে গিয়েছিল বাস্টার্ড কিন্তু কাছে যেতেই মৃদুল তাকে জানায় ফ্ল্যাটের সামনে দুজন টিকটিকি আছে। অবাক হয়েছিল সে। টিকটিকি চেনার ব্যাপারে মৃদুলের ভালো অভিজ্ঞতা আছে, তার কথাটা বিশ্বাস করেছিল। দূর থেকে দেখেছে সত্যি সত্যি দুজন লোক গল্প করছে নিজের মধ্যে। 

অগত্যা ফিরে যাওয়ার জন্য যেই না বাইকটা স্টার্ট দেবে তখনই দেখে জেফরি বেগ তার অ্যাপার্টমেন্ট ভবন থেকে বের হচ্ছে। টিকটিকি দুজনও সতর্ক হয়ে ওঠে তখন। হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর একটা সিএনজি নিয়ে চলে যায় আজিমপুর কবরস্তানের দিকে। টিকটিকি দুজনও তাকে অনুসরণ করে আরেকটা সিএনজি নিয়ে। বাস্টার্ড ভেবেছিল লোকগুলো সম্ভবত জেফরির ক্ষতি করতে পারে, সেজন্যে ওদেরকে ফলো করে। 

কবরস্তানে আসার পর ঐ দুই লোক নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে জেফরি বেগকে অনুসরণ করে যায়। তাদের থেকে আরেকটু দূরত্ব বজায় রেখে বাস্টার্ড আর মৃদুল দেখতে পায় জেফরি বেগ একটা কবরের সামনে বসে আছে, বুঝতে পারে এটাই রেবার কবর। সার্ভিলেন্স করতে থাকা ঐ দুজন দূর থেকে জেফরি বেগের উপর নজরদারি করতে থাকলে সে দ্রুতই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় : এখানেই কথা বলবে। 

কবরস্তানের বাইরে এক দোকান থেকে মোম আর আগরবাতি নিয়ে মাথায় রুমাল পেঁচিয়ে মুখে মাস্ক লাগিয়ে চলে যায় জেফরি বেগের ঠিক পেছনের কবরটায়। সার্ভিলেন্স করতে থাকা দুজন তাকে একটুও সন্দেহ করেনি। 

কিন্তু কথা বলার এক পর্যায়ে লক্ষ্য করে জেফরি বেগের সহকারি জামান কবরস্তানে ঢুকছে, সঙ্গে সঙ্গে ইনভেস্টিগেটরকে চুপ থাকতে বলে, আস্তে করে সটকে পড়ে ওখান থেকে। এই ছেলে তাকে দেখলে চিনে ফেলতে পারতো। ছেলেটা অবশ্য তাকে খেয়ালই করেনি, তার দৃষ্টি ছিল জেফরি বেগের দিকে। কিন্তু তাকে চিনে ফেললে, হোমিসাইডের লোকটার সঙ্গে কথা বলতে দেখলে গভীর সন্দেহ করতো। 

বাইক চালাতে চালাতে বাস্টার্ড ভাবলো, তার কাছে কোনো তথ্য নেই। একদম তথ্যশূন্য সে। তথ্য জানে এরকম কোনো লোকের খোঁজও জানে না। 

কিন্তু একটু পরই চট করে তার মাথায় একটা ভাবনা খেলে গেল। 

সংবাদপত্র পড়ার সুফল আছে! 

সে অনেকটাই নিশ্চিত, আইডিয়াটা দারুণভাবেই কাজ করবে। 

অধ্যায় ৪৭

কাশেম শফি ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। 

সেই বিকেলে তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে তিন লাখ টাকা ঢুকেছে কিন্তু এখনও নোটিফিকেশন মেসেজ আসেনি। এতক্ষণ তো লাগার কথা নয়। 

হাতঘড়ির দিকে তাকালো। সাতটা বেজে গেছে আরো দশ মিনিট আগে। একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে তার কিন্তু ক্লায়েন্ট এখনও আসছে না। আর মাত্র দশ মিনিট দেখবে তারপর চলে যাবে বাসায়। ঢাকায় অনেক জ্যাম, এই সমস্যা হয়েছিল, সেই সমস্যা হয়েছিল-এরকম অজুহাত শোনার ইচ্ছে তার নেই। 

নিকেতনের এই অফিসে এ সময় দুয়েকজন ক্লায়েন্ট থাকে সব সময়, আজকে অবশ্য নেই। একটু আগে একজনকে বিদায় দেবার পর ফাঁকা হয়ে গেছে। এখন অফিস-বয় ছেলেটা আছে কেবল। বাইরের ঘরে বসে ঝিমুচ্ছে নিশ্চয়ই।

ফোনটা রেখে দিলো। আজকে আর আসবে না, কাল সকাল সকাল পেয়ে যাবে হয়তো। মনে মনে মুচকি হাসলো কাশেম শফি। আজব এক কারণে তার এই সমস্যাটা হয়-প্রতিবার ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলার পর খুব একটা সন্দেহ তৈরি হয় না তার মধ্যে কিন্তু জমা দেবার পরই ঘটে অন্য ঘটনা। যে টাকা জমা দিলো আর তার ডিপোজিটে যে পরিমাণ টাকা আছে সেটার যোগফল ঠিক আছে কি না মিলিয়ে দেখে। 

তার এই সন্দেহের কোনো ভিত্তি নেই। কখনও এভাবে মিলিয়ে দেখার সময় গড়মিল পায়নি, তবুও প্রতিবার এ কাজ করে। কম্পিউটারে ডাটা ইনপুট দেয় যারা তারা তো মানুষই, নাকি? তাদের ভুল হতে পারে না? 

মাঝে মাঝে তার মনে হয় সে কি একটু বেশি সন্দেহ বাতিক হয়ে যাচ্ছে? কিন্তু পরক্ষণেই তার ডিফেন্স ম্যাকানিজম সচল হয়ে ওঠে : সবকিছুকে বিনাপ্রশ্নে মেনে নিলে শুধু ঠকে যেতে হবে। সন্দেহের সিঁড়ি বেয়েই সত্যের দরজায় পৌঁছাতে হয়। 

“স্যার?” 

ছেলেটার ডাকে সম্বিত ফিরে পেলো কাশেম শফি। 

“ক্লায়েন্ট আসছে।” 

হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো ব্যারিস্টার। “ভেতরে পাঠাও।” 

নিজের চেয়ারে একটু ঠিকঠাক হয়ে বসলো শফি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের প্রধান। দরজা খুলে তার সুসজ্জিত অফিসে ঢুকলো এক ভদ্রলোক। লম্বা, একহারা গড়ন আর দেখতে দেবদূতের মতো। ব্যারিস্টার বুঝতে পারলো নির্ঘাত পয়সাওয়ালা কেউ-ই হবে। ওদেরকে দেখলেই চিনতে পারে, একটুও ভুল হয় না। এখন পর্যন্ত কোনো ফকিন্নিকে বড়লোক ভেবে ভুল করেনি সে। 

“স্লামালেকুম,” লোকটা ঘরে ঢুকে আদবের সঙ্গে সালাম দিলো তাকে। “আমি বোধহয় একটু দেরি করে ফেলেছি?” 

স্মিত এবং মাপা হাসি দিলো ব্যারিস্টার। “ইটস ওকে, বসুন।” 

আগন্তুক সামনের একটা চেয়ারে বসে পড়লো। “আমার ফ্লাইটটা একটু লেট করেছিল তাই আসতে দেরি হয়ে গেছে।” 

নিঃশব্দে হাসি দিলো কাশেম শফি। 

“আমার নাম রোমেল চৌধুরি, ছোটোখাটো একটা বিজনেস আছে আমার। একটা আইনি ঝামেলায় পড়েছি…” 

“ওয়েট অ্যা মিনিট,” হাত তুলে তাকে থামালো ব্যারিস্টার। “চা না কফি?” 

“আমি আসলে এয়ারপোর্টে ওয়েট করার সময়ই এক কাপ খেয়েছি।”

আবারো মাপা হাসি দিলো কাশেম শফি। “ঠিক আছে, তাহলে আর সময় নষ্ট না করে বলুন আপনার সমস্যাটার কথা।” 

“একটু সময় দিতে হবে আমাকে, আশা করি বিরক্ত হবেন না?” 

“না না, কোনো সমস্যা নেই,” অভয় দিলো আইনজীবী। ক্লায়েন্ট তার সমস্যার কথা সংক্ষেপে বলবে-এমনটা সে কখনও আশা করে না। এ পেশায় সবটাই শুনতে হয় ধৈর্য ধরে। পনেরো বছরে এই শিক্ষাটা অন্তত হয়েছে তার। 

“থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ,” বিনয়ের সঙ্গে বলল রোমেল চৌধুরি। “কথার মাঝখানে ইন্টারাপশান হলে আমি আবার গুলিয়ে ফেলি। তাছাড়া এই কেসটা একটু সেন্সিটিভ। আপনার ছেলেটাকে একটু বলে দিন, হুট করে যেন কেউ ঢুকে না পড়ে এখানে।” 

“সাধারণত এই সময়ে কেউ আসে না, তবু আমি বলে দিচ্ছি,” ডেস্কের বেলটা বাজালো ব্যারিস্টার কাশেম শফি। 

“স্যার?” কয়েক সেকেন্ড পরই ছেলেটা দরজা খুলে মাথা ঢোকালো।

“কেউ এলে ওয়েট করতে বলবে…ঢুকতে দেবে না, ঠিক আছে?”

“জি, স্যার,” বিরসমুখে বলল ছেলেটা। 

“এবার নিশ্চিন্তে বলুন আপনার সমস্যার কথা,” বহুল চর্চিত আর ব্যবহৃত বাক্যটি বলল : “ডক্টর আর ল-ইয়ারের কাছে কোনো কিছু লুকাতে নেই, জানেনই তো?” 

“জি, অবশ্যই।” 

তারপরই ক্লায়েন্ট লোকটি কোমর থেকে সাইলেন্সার লাগানো একটা পিস্তল বের করে আনলো, এতটাই সহজ আর স্বাভাবিকভঙ্গিতে যে কাশেম শফি কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে আবিষ্কার করলো পিস্তলের মুখে বসে আছে। 

“কোনো কথা বলবেন না!” বাস্টার্ড শীতল কিন্তু শক্তভাবে হুমকিটা দিলো। “আমি যা জানতে চাইবো শুধু তার জবাব দেবেন। আর মনে রাখবেন এই পিস্তল দিয়ে গুলি করলে শব্দ হয় না।” 

মি. শফি পুরোপুরি ভড়কে গেল। এরকম পরিস্থিতিতে সে কখনও পড়েনি। ভেবে পেলো না এভাবে তার রুমে ঢুকে পিস্তল দেখিয়ে কী চাইছে দেবদূতের মতো দেখতে লোকটা! তার অফিসে নগদ টাকা খুব কমই থাকে। সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার হবে হয়তো। এই টাকা নেবার জন্য ধনী ক্লায়েন্ট সেজে আসবে?! 

না। শুধরে দিলো নিজেকে। এর অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। এ কোনো ডাকাত না! আর এই চিন্তাটাই তাকে বিপর্যস্ত করে তুলল। পেশাদার আইনজীবী হিসেবে প্রচুর লোকজন তার উপরে সংক্ষুব্ধ হয়, এই লোক সেরকম কেউ-ই হবে। 

“ভ্-ভাই…ক্-কী চান?” কাশেম শফি সামান্য তোতলালো, টের পেলো সে রীতিমতো কাঁপছে 

“যেটা চাই সেটা দিতে আপনাকে এক টাকাও খরচ করতে হবে না,” শান্ত কণ্ঠে বলল বাস্টার্ড। “ওটা দিয়ে দিলে আপনার কোনো ভয় নেই, পাঁচ মিনিট পরই সব ঠিক হয়ে যাবে।” 

অভয় পেলেও ভয়ে ঢোক গিলল ব্যারিস্টার। তার নিজের লাইসেন্স করা পিস্তল আছে ডেস্কের ড্রয়ারে কিন্তু এই ভয়ঙ্কর শীতল চোখের অস্ত্রধারী লোকটার সামনে ওই জিনিস হাতে নেবার চিন্তাও করছে না। “ব্-বলুন কী…সেটা?” 

“আকবর হাসানের সমস্ত ডিটেইল্স দিন,” অনুরোধ নয়, একেবারে আদেশ করার মতো করে বলল বাস্টার্ড। 

ভুরু কুঁচকে গেল কাশেম শফির। এই লোকের জামিন করিয়েছে সে, তার ডিটেইল্স জানতে চাইছে? আর কিছু না? তা-ও আবার পিস্তল তাক্ করে? ডেস্কের উপরে থাকা অনেকগুলো ফাইলের দিকে তাকালো। 

“বেশি সময় নেবেন না,” তাড়া দিলো বাস্টার্ড। 

“জ্-জি!” আকবর হাসানের ফাইলটা উপরের দিকেই আছে, কম্পিত হাতে খুলে দেখলো। “নাম আকবর হাসান…গ্রাম দক্ষিণ ধামুড়া, শোলক ইউনিয়ন, উজিরপুর- 

“এনআইডি কার্ডের ফটোকপিটা দিন,” কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল রোমেল চৌধুরি ওরফে বাবলু। এখন যেসব কাজেই এনআইডি কার্ড লাগে সেটা জানা আছে তার। 

জোরে জোরে মাথা দোলালো ব্যারিস্টার। “জি।” এনআইডি কার্ডের ফটোকপিটা ক্লিপ থেকে খুলে সামনের দিকে বাড়িয়ে দিলো। 

কপিটা বাঁ-হাতে নিয়ে নিলো সে। “ঢাকায় কোথায় থাকে?… তার ফোন নাম্বার?” 

ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো কাশেম শফি। “এখানে তো ঢাকার কোনো ঠিকানা লেখা নাই, উনার ফোন নাম্বারও আমার কাছে নাই।” 

বাস্টার্ড তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো লোকটার দিকে। খুব ঘাবড়ে আছে ব্যারিস্টার। “আকবর হাসান তো জেলে ছিল, আপনাকে কে ঠিক করেছে তার জন্য?” 

আবারো ঢোক গিলল আইনজীবী ভদ্রলোক। তার নিজের লাইসেন্স করা পিস্তল আছে, সে জানে তার দিকে তাক করে রাখা পিস্তলটার নলে বাড়তি যেটা লাগানো আছে সেটা দিয়ে গুলি করলে কোনো শব্দ হবে না, সেজন্যে ভয়টা বেশি পাচ্ছে। 

“আপনাকে আগেই বলেছি, আমি যেটা চাইবো সেটা দিয়ে দিলে চলে যাবো এখান থেকে,” তাড়া দিয়ে বলল বাস্টার্ড। 

গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো ব্যারিস্টার। “উনার নাম ফারহান ওমর। * ডিটেইল্স?” 

“উনিও একজন ল-ইয়ার…আমার পরিচিত।”

“জাহান গ্রুপে কাজ করে?” 

“জি, লিগ্যাল অ্যাডভাইজার,” একটু থেমে আবার বলল, “উনার ফোন নাম্বারটা…দেখে বলতে হবে।” 

“দেখুন।” 

ডেস্কের উপর থেকে আইফোনটা হাতে তুলে নিলো কাশেম শফি! কন্ট্যাক্ট লিস্ট থেকে নাম্বারটা মুখে মুখে বলল। 

পিস্তলটা বাঁ-হাতে নিয়ে ডানহাতে নিজের ফোনে নাম্বারটা সেভ করে রাখলো বাস্টার্ড। “এবার বলুন, উনি থাকেন কোথায়? ভুলেও বলবেন না আপনি সেটা জানেন না। আপনারা অনেক দিনের পরিচিত, উনার সবই জানেন আপনি।” 

ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো ব্যারিস্টার। এই লোক কে? সরকারি সংস্থার হবার প্রশ্নই ওঠে না। ফারহান ওমর যাদের হয়ে কাজ করে তাদের পেছনে সরকারি লোকজন কখনও লাগবে না। 

“কী হলো?” আবারো তাড়া দিলো। 

“জ্-জি…” ঢোক গিলল ব্যারিস্টার। গুলশানে থাকে…চার নং রোডে…” 

“নং না…ওটাকে নাম্বার বলবেন এখন থেকে, ঠিক আছে?” 

এমন একজনের কাছ থেকে শুদ্ধ বাংলার পরামর্শ পেয়ে অবাক হলো কাশেম শফি। “জি,” জোরে মাথা নাড়লো সে। 

“বাড়ি নাম্বার?” 

“আঠারো।” 

“ফ্ল্যাট?” 

“বি…বি”তে থাকে। 

“ফ্যামিলি নিয়ে?” 

মাথা নেড়ে সায় দিলো। “কিন্তু ওর ফ্যামিলি এখন দেশের বাইরে আছে।” 

গুড। মনে মনে বলল বাস্টার্ড 

কাশেম শফি ভেবে পেলো না ফারহান ওমরের ফ্ল্যাটের খোঁজ করছে কেন এই লোক, তার উদ্দেশ্য কী? 

“আমি যে আপনার কাছে তার খোঁজ করেছি এটা কাউকে বলবেন না, ঠিক আছে?” শীতল চোখে তাকিয়ে বলল। “কাউকে না মানে কাউকে-ই না,” পিস্তলটা নাড়লো সে। “বিয়ে করেছেন?” 

আচমকা এই প্রশ্ন করাতে অবাক হলো মি. শফি। “জি।” 

“এ কথা যদি ফারহান ওমর জানতে পারে তাহলে সে পালাবে। তাকে আমরা ধরতে পারবো না। তখন আপনার পেছনে লাগবো…আপনার স্ত্রী অকালে বিধবা হয়ে যাবে।” ইচ্ছে করেই “আমরা” শব্দটি ব্যবহার করলো। 

ভয়ে আরেকটু কেঁপে উঠল ঘাগু আইনজীবী কাশেম শফি। জীবনে কখনও এরকম সরাসরি হুমকি পায়নি। মাস দুয়েক আগে কুখ্যাত সন্ত্রাসী ব্ল্যাক রঞ্জু তার কাছে চাঁদা চেয়েছিল ফোনে, তখনই প্রথমবার এরকম হুমকি পেয়েছিল। পরে ঐ লোককে টাকা দিতেও মনস্থির করেছিল সে কিন্তু তার আগেই পত্রিকায় খবর বেরোয় সন্ত্রাসী ব্ল্যাক রঞ্জু পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল। 

“আপনার মতো আমিও প্রফেশনাল,” লোকটার দিকে স্থিরচোখে চেয়ে বলল। “যে কাজ হাতে নেই সেটা করতে না পারলে ভীষণ রেগে যাই। এটা আমার রেপুটেশনের ব্যাপার, বুঝেছেন?” 

জোরে জোরে মাথা নেড়ে সায় দিলো ব্যারিস্টার। 

উঠে দাঁড়ালো বাস্টার্ড। “আমি এখন চলে যাবো। আপনি এখান থেকে বের হবেন দশ মিনিট পর। মনে রাখবেন বাইরে আমার লোক আছে।” পিস্তলটা কোমরে গুঁজে বের হয়ে গেল সে। 

হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো কাশেম শফি। ক্লায়েন্ট হিসেবে জাহান গ্রুপ বেশ ভালো। যথাযোগ্য পারিশ্রমিক দিতে কার্পণ্য করে না কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সব ভালোর মতো এখানেও কিছু ঝক্কি আছে। আর সেটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে। 

অধ্যায় ৪৮ 

কাশেম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েসের অফিসে বাস্টার্ড একা যায়নি, তার সঙ্গে ছিল মৃদুল। 

কোনো কারণে দরকার পড়তো ওকে, সেক্ষেত্রে অফিস-বয়কে সামলাতো সে। তবে তার কোনো দরকারণ পড়েনি। ব্যারিস্টার সাহেব একা ছিল আর কাজটাও হয়ে গেছে সহজেই। লোকটা তার অফিসের ভেতরে- বাইরে কোথাও সিসিক্যাম ইন্সটল করেনি। যদি সিসিক্যাম থাকতো তাকে বেশ-ভুষা পাল্টাতে হতো। 

অফিসের বাইরে বাইকটা পার্ক করা আছে, মৃদুলকে নিয়ে উঠে বসলো সেটাতে। নিকেতনের সাত নাম্বার রোড থেকে বাইকটা নিয়ে বের হয়ে গেল সে। 

জেফরি বেগের সঙ্গে দেখা করার পর মনে হয়েছিল এ কাজটা করা সম্ভব হবে না। তার কাছে কোনো তথ্যই নেই। কিচ্ছু নেই। হাজার কোটি টাকার প্রতিষ্ঠান জাহান গ্রুপের সিইও আলভী করিমের নাগাল পাওয়া সহজ নয়। যতোটুকু খোঁজ নিয়েছে, এই লোক একগাদা প্রাইভেট বাহিনি নিয়ে চলাফেরা করে-অনেকটা মন্ত্রি-মিনিস্টারদের মতো। তার ঘনিষ্ঠ লোকজনের নাগাল পাওয়াটাও দুরূহ কাজ। 

কবরস্তান থেকে বের হবার পর বাইকে করে চলে আসার সময়ই আকবর হাসানের নিউজটার কথা মনে পড়ে যায় তার। এই লোক দশ লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে গিয়ে ধরা পড়েছিল হোমিসাইডের হাতে, এখন জামিন পেয়ে জেল থেকে বেরিয়ে এসেছে। 

ভালো রিপোর্টার অনেক খুঁটিনাটি তথ্য দিয়ে থাকে, আপাত দৃষ্টিতে যে তথ্যের কোনো দরকার নেই সেটাও দেয়। দিলান মামুদ সেরকমই একজন সাংবাদিক। রিপোর্টে সে আকবর হাসানের আইনজীবীর কথা উল্লেখ করেছিল—ভদ্রলোককে ফোন করে এই মামলার ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন করতে গেলে ফোন রেখে দেয়। 

কাশেম শফি।

হাইকোর্টের একজন আইনজীবী, জাহান গ্রুপের হয়ে কাজ করে। নিশ্চয়ই হোমড়া চোমড়া কেউই হবে। নামটা একটু অপ্রচলিত। এই নামে খুব বেশি আইনজীবী থাকার কথা নয়। কিন্তু সমস্যাটা হলো, একজনও যদি থেকে থাকে তাকে কোথায় খুঁজবে? হাইকোর্টে গিয়ে হাজার হাজার উকিলের ভিড়ে খোঁজার কথা সে ভাবতেও পারেনি। এরপরই বিষয়টা নিয়ে ভাবতে শুরু করে। সে জানতো, কিছু একটা তার মাথায় আসবেই। 

আর সেটাই হয়েছিল। রাতের বেলায় নিজের বাংলোর বাইরে চেয়ার পেতে বসেছিল, চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল আর ভাবছিল লোকটাকে খুঁজে বের করবে কিভাবে। তখনই চট করে তার মাথায় চিন্তাটা ভর করে, সঙ্গে সঙ্গে ফোন বের করে গুগলে সার্চ করে : কাশেম শফি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট্স। 

এখানকার ল-ফার্মগুলোর বেশিরভাগই আইনজীবীদের নাম দিয়ে নামকরণ করা হয়, সঙ্গে থাকে “অ্যাসোসিয়েট্স” শব্দটি। প্রথম সার্চেই পেয়ে যায় লোকটার সবকিছু। যেমনটা ধারণা করেছিল, এই নামে মাত্র একজন আইনজীবীই পেয়েছে। ছবিসহ তার সম্পর্কিত বেশ কিছু তথ্যও পেয়ে যায় নেটে। নিকেতনে অফিস আছে লোকটার। ঠিকানা এবং ফোন নাম্বার দেয়া ছিল ওয়েব-সাইটে। তবু নিশ্চিত হবার জন্য পরদিন সকালে ফোন করে আইনজীবীর অফিসের ল্যান্ডফোনে। 

“এটা কি কাশেম শফি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট্স?” 

“জি, স্যার,” অল্প বয়সি এক ছেলে জবাব দিয়েছিল। 

“আকবর হাসানের জামিনটা তো উনিই করিয়েছেন, তাই না?” 

“জি, স্যার…উনিই কাশেম শফি।” 

“দুর্দান্ত! আমি ভাবতেই পারিনি এই কেসেও জামিন করাতে পারবেন। এরকম একজন লইয়ার-ই আমি খুঁজছি।” 

“আপনি কে বলছেন, স্যার?” 

“রোমেল, রোমেল চৌধুরি…উনার সঙ্গে একটা কেস নিয়ে আলাপ করতে চাইছিলাম,” বলেছিল বাস্টার্ড। “উনি কখন বসেন অফিসে, কাইন্ডলি একটু বলবেন?” 

“শিওর, স্যার। আপনি চারটা থেকে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে আসতে পারেন…কবে আসতে চাচ্ছেন, বলুন… আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্টটা লিখে রাখি।” 

“আমি চিটাগং আছি বিজনেসের একটা কাজে, আশা করি সাতটার আগে চলে আসতে পারবো।” 

“ঠিক আছে, স্যার। চেষ্টা করবেন এরচেয়ে বেশি দেরি যেন না হয়। ব্যারিস্টার স্যার সাতটার পরই চলে যান।”

“ওকে।” 

তারপরই মৃদুলকে নিয়ে সাতটার একটু আগে চলে আসে এখানে। কিছুক্ষণ আগে ও অফিসে ঢুকেছিল, অফিস বয়ের কাছে জানতে চেয়েছিল রোমেল চৌধুরি স্যার এসেছেন কি না। ছেলেটা বলেছিল তার জন্য কাশেম শফি অপেক্ষা করছে, মৃদুল যেন তার স্যারকে তাড়াতাড়ি চলে আসতে বলে, নইলে ব্যারিস্টার সাহেব বের হয়ে যাবেন। 

এসব কথার সময় মৃদুলের আসল মনোযোগ ছিল অন্য কিছুতে অফিসের ভেতরে কোনো সিসিক্যাম নেই। ভেতরে ক্লায়েন্টও নেই। বাইরে এসে কথাটা জানাতেই বাস্টার্ড ঢুকে পড়ে অফিসে, খুব সহজেই কব্জায় নিয়ে নেয় লোকটাকে। 

এখন বাইকে করে যেতে যেতে ভাবছে পরের কাজটা কিভাবে করবে। দীর্ঘদিন থেকে এরকম কাজ করতে করতে এইসব বিষয় এত অনায়াসে তার মধ্যে চলে আসে যে, মাঝেমধ্যে নিজেও অবাক হয়। 

“এরপর কী, দাদা?” পেছন থেকে মৃদুল জানতে চাইলো। 

“আগে কিছু জিনিসপত্র জোগাড় করতে হবে,” বাইক চালাতে চালাতে জবাব দিলো বাস্টার্ড। 

“আমাকেই করতে হবে?” 

“তুমি ছাড়া আর কেউ পারবে না এটা!” লুকিং গ্লাসে দেখতে পেলো ছেলেটার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মুচকি হাসলো বাস্টার্ড। মানুষ যখন শোনে সে ছাড়া আর কেউ এটা করতে পারবে না, নিজেকে স্পেশাল ভাবে। সঙ্গত কারণেই খুশির ব্যাপার সেটা। 

“কী লাগবো শুধু বলেন?” 

“আগে কিছু খেয়ে নেই…খেতে খেতে বলবো।” 

আবারো মৃদুলের মুখে হাসি দেখা গেল। “দাদা, স্টেক খাবো…অনেকদিন খাই না।” 

“জাত খোয়াতে চাও নাকি?” 

 ফিচকে হাসি দিলো ছেলেটা। “কেউ না জানলে জাত যায় না, দাদা।”

প্রসন্নভাবে হাসলো বাস্টার্ড। 

অধ্যায় ৪৯ 

রাত দশটার মতো বাজে। 

গুলশান চার নাম্বার রোডের লেকের দিকে শেষ অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের সামনে ছাইরঙা একটি মাইক্রোবাস এসে থামলো। 

বিশুদ্ধ আবাসিক এলাকা, তেমন ব্যস্ততা নেই। মানুষজনের আনাগোনাও কম। রাস্তার দু পাশে বেশ কিছু প্রাইভেট কার পার্ক করে রাখা। এগুলো আগত অতিথিদের গাড়ি, অ্যালোটিদের গাড়ি ভবনের ভেতরে পার্কিং এরিয়ায় রাখা হয়। 

ছাইরঙা মাইক্রোবাসের ইনসাইড লাইট বন্ধ, কালচে কাচের মধ্য দিয়ে ভেতরটা দেখার কোনো উপায় নেই কিন্তু ভেতরে যারা আছে তারা সবই দেখতে পাচ্ছে। 

মাত্র দু দিনের মধ্যে সবকিছু জোগাড় করেছে মৃদুল। খুবই করিৎকর্মা ছেলে। তবে তার সবচেয়ে বড় গুণ, দরকারের বাইরে একটাও প্ৰশ্ন না করা। কী করতে এসেছে, ভালো করেই জানে। কেন এসেছে, সেটা নিয়ে কখনওই কৌতুহল দেখায় না। অনেকদিন ধরেই তার সঙ্গে কাজ করছে। শুধু দেশে নয়, কলকাতা পর্যন্ত তারা একসঙ্গে কাজ করেছে। এখন আর সেরকম কাজ-টাজ হয় না, মৃদুল তাই গ্রামের বাড়িতে সারের ডিলারের ব্যবসায় মনোযোগ দিয়েছে। তবে যখনই দরকার পড়ে তাকে ডাকলেই পাওয়া যায়। ইদানিং মায়ের চিকিৎসা করাতে ঢাকাতেই আছে বলে তাকে আর খুলনা থেকে ডেকে আনা হয়নি। 

“সব সময়ই দেরি করে আসে,” ড্রাইভিং সিট থেকে বলল মৃদুল। 

পেছনের সিটে বসে থাকা বাস্টার্ডের দৃষ্টি বাইরের দিকে। পর পর দু দিন সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত রেকি করেছে ছেলেটা, জানে ফারহান ওমর কখন তার ফ্ল্যাটে ফিরে আসে। মৃদুলের আরেকটি বড় গুণ, ধৈর্য ধরে রেকি করতে পারে সে। ঘন্টার পর ঘন্টা এক জায়গায় বসে থাকতে পারে, এক মুহূর্তের জন্যেও তার চোখ সরে না টার্গেটের উপর থেকে। 

বাস্টার্ডের পাশে, সিটের উপরে রাখা আছে ডিবির দুটো ভেস্ট। সে ভেবেছিল, এ দুটো জিনিস জোগাড় করতে একটু বেগ পেতে হবে ছেলেটাকে, সেই তুলনায় মাইক্রোবাসটা জোগাড় করা সহজ হবে। কিন্তু দু দিনের মধ্যেই দুটো ভেস্ট, দুটো নকল ওয়াকিটকি, নকল চাপদাড়ি আর গাড়িটা জোগাড় করে ফেলেছে। কালো রঙের সানক্যাপ আজকে আসার পথে সংগ্রহ করেছে তারা। বাস্টার্ড চেয়েছিল সাদা এবং উজ্জ্বল রঙ বাদে অন্য কোনো রঙের গাড়ি। নীল কিংবা কালো হলেও চলতো। সেদিক থেকে দেখলে ছাইরঙটা বেশি ভালো হয়েছে। রাতের বেলায় এই রঙ চোখে কম ধরা পড়ে। 

ডিবির ভেস্টটা সে দেখেছে-বেশ ভালো মানের। মৃদুল জানিয়েছে এই জিনিস জোগাড় করেছে নাটক-সিনেমার প্রপস সরবরাহ করে এরকম একটি প্রতিষ্ঠান থেকে। 

মাত্র মাসখানেক আগে ঝন্টুরূপী ব্ল্যাক রঞ্জু এরকম ভেস্ট পরা নকল ডিবি পাঠিয়েছিল তাকে তুলে আনতে-কিংবা খুন করতে। সত্যি বলতে সেখান থেকেই “আইডিয়াটা নিয়েছে সে। পরিহাসের হাসি হাসলো। কখনও কখনও আইডিয়ার উৎস খুবই অদ্ভুত জায়গা হতে পারে! 

“এখনও আসে নাই, আমি শিওর,” মৃদুল বলল। “ওই লোক ফ্ল্যাটে যাওয়ার পর বাতি জ্বালায়…” ডান দিকে, রাস্তার উল্টো দিকে তাকালো সে। “এখনও বাতি জ্বলে নাই।” 

মনে মনে ছেলেটাকে প্রশংসা না করে পারলো না বাস্টার্ড। তাকে যা করতে বলা হয় তার চাইতেও বেশি খোঁজ নেয়। 

“মনে হয় রোজই ড্রিঙ্ক করে।” 

মৃদুল রেকি করতে গিয়ে দু দিনই দেখেছে ফারহান ওমর একটু মদ্যপ ছিল। লোকটা রাত এগারোটার পর গাড়ি নিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের সামনে এসে অস্থিরভাবে হর্ন বাজিয়েছিল, দারোয়ান দেরি করতেই রেগেমেগে গ্লাস নামিয়ে ঝাড়ি মারে। ভেতরে ঢোকার পর গাড়িটা পার্ক করতে গিয়েও বিপাকে পড়েছিল লোকটা। বাইরে থেকে সবটাই দেখেছে মৃদুল। 

একটা হর্নের শব্দ রাতের নিস্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করলো। ডান দিকে কালো কাচের ভেতর দিয়ে বাস্টার্ড দেখতে পেলো সাদা ধবধবে একটা টয়োটা ফরচুনার লিজেন্ডার এসে থেমেছে উল্টোদিকের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের সামনে। 

“এই গাড়িটা-ই…” মৃদুল বলল। 

গাড়ির পেছনের সিটে কেউ নেই। দু বার হর্ন বাজতেই দৌড়ে এসে মেইন গেটটা খুলে দিলো দারোয়ান। 

“আজকেও খেয়েছে,” বলল মৃদুল। 

“রেডি হয়ে নাও,” তাড়া দিলো বাস্টার্ড। পাশ থেকে একটা ভেস্ট মৃদুলয়ে দিয়ে অন্যটা সে পরে নিলো। মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক আর কালো রঙের সানক্যাপটা মাথায় দিয়ে রিয়ার-মিররে দেখে নিলো নিজেকে। “ক্যাপটা একটু নিচে নামিয়ে রাখবে… সিসিক্যাম আছে ওখানে।” 

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছেলেটা। নকল চাপদাড়িটা সুন্দরমতো পরে ফেলল। ছয়-সাত মিনিটের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল দুজন। মৃদুলের হাতে নকল ওয়াকিটকি। ত্রিশ-চল্লিশ ফিটের রাস্তাটা পার হয়ে অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের মেইন গেটের সামনে চলে এলো। দারোয়ান লোকটা মাত্র গেট বন্ধ করতে যাবে, তাদেরকে দেখে অবাক হলো। 

“স্লামালেকুম, স্যার,” ভয়ে ঢোক গিলল লোকটা। 

“আমরা ডিবি থেকে আসছি…কাজ আছে এখানে।” 

তাদের দুজনের দিকে তাকালো দারোয়ান। তল্লাশী কিংবা আসামি ধরার জন্য এর আগেও ডিবি-পুলিশ এসেছে এই ভবনে, তবে দীর্ঘ দশ বছরের চাকরি জীবনে মাত্র তিন বার ঘটেছে এমন ঘটনা। তিনতলায় সাব্বির খান নামে বিরোধী দলের এক নেতা থাকতো তখন, দু বারই তাকে ধরতে এসেছিল। সম্ভবত একবার এসেছিল পাঁচতলার ফ্ল্যাটে গৃহকর্মির রহস্যজনক মৃত্যুর পর 

দারোয়ান চুপচাপ মেইন গেটটা খুলে দিলো। 

“গেট লক করবে না,” হুকুমের স্বরে বলল মৃদুল। “আমাদের টিমের আরো লোকজন আসবে।” 

মাথা নেড়ে সায় দিলো দারোয়ান। 

“একটু আগে ফারহান ওমর নামের একজন ঢুকছে না?” 

“জি, স্যার,” ভয়ার্ত চোখেমুখে জবাব দিলো লোকটা 

বাস্টার্ডের দিকে তাকালো মৃদুল। “আমি এখানেই থাকি, স্যার…আপনি ওকে নিয়ে উপরে যান, ব্যাকআপ টিম এলে আমি ওয়াকিটকিতে জানিয়ে দেবো।” 

“আসো,” দারোয়ানকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল ডিবির ভেস্ট পরা বাস্টার্ড। লোকটাকে নিয়ে মাথা নিচু করে সোজা চলে গেল লিফটের দিকে। তাদের দুজনের সঙ্গেই পিস্তল আছে কিন্তু ইচ্ছে করেই সেগুলো বের করেনি। ব্যাপারটাকে সাধারণ রেইড হিসেবে দেখাতে চাইছে দারোয়ানের কাছে। 

“কয় তলায় থাকে ফারহান ওমর?” লিফটের সামনে আসার পর দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করেলো। 

“তিন তলায়…লিফটের দুইয়ে, স্যার।” 

“ভয়ের কিছু নেই,” অভয় দিলো তাকে। “তুমি শুধু বেল বাজিয়ে বলবে দরজা খুলতে…একটা পার্সেল আছে উনার নামে।”

দারোয়ান আবারো ঢোক গিলল। 

“যদি জানতে চায় কীসের পার্সেল, বলবে জানো না। একটু আগে একজন দিয়ে গেছে। ঠিক আছে?” 

“জি, স্যার,” ম্রিয়মান কণ্ঠে বলল লোকটা। 

দারোয়ানকে নিয়ে লিফটের ভেতরে ঢুকে পড়লো বাস্টার্ড। 

“ঐ লোক ডিবি দেখলে সহজে দরজা খুলবে না,” ব্যাখ্যা করলো সে। “হাউকাউ করবে। এত রাতে গ্যাঞ্জাম চাচ্ছি না আমরা।” 

ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো দারোয়ান। 

লিফটটা থামতেই নেমে পড়লো তারা, ডান দিকে “টু-বি” লেখা ফ্ল্যাটের দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে পড়লো। “বেল বাজাও।” 

লোকটা অনিচ্ছায় কলিং বেল বাজালো। পর পর দু বার। ভেতর থেকে দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল। সম্ভবত পিপহোল দিয়ে দারোয়ানকে দেখেছে। 

আলগোছে কোমর থেকে সাইলেন্সার পিস্তলটা বের করে হাতে তুলে নিলো বাস্টার্ড। “তুমি সিঁড়ি দিয়ে নিচে চলে যাও,” চাপা কণ্ঠে বলল দারোয়ানকে। 

বেচারা ভয়ে সিঁড়ির দিকে যেতেই “টু-বি”র দরজাটা খুলে গেল। 

“অ্যাই, তুমি চলে—!” 

কথাটা শেষ করতে পারলো না, দরজার পাশ থেকে উদয় হলো বাস্টার্ড। ডিবির ভেস্ট আর হাতে পিস্তল দেখে ফারহান ওমর যতোটা না ভড়কে গেল তার চেয়ে বেশি অবিশ্বাস ফুটে উঠল চোখেমুখে। 

“হোয়াট দ্য হেল!” 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *