অধ্যায় ৩৫
এর আগেও অনেক বার সহিদুল আখন্দ পিঙ্ক প্যালেসে এসেছে কিন্তু হোমমিনিস্টার হবার পর মাত্র একবারই এসেছিল শাহজাহান করিমের দোয়া নিতে।
একটু আগে ফোন করে জাহান গ্রুপের প্রধানকে মন্ত্রি বলেছে তার সঙ্গে দেখা করতে হবে, জরুরি কিছু কথা আছে আর সেটা ফোনে বলা ঠিক হবে না। ইন্টেলিজেন্সে কেউ কেউ মন্ত্রিদের ফোনকলও টেপ করে বাজারে ছেড়ে দেয়। এই ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।
ফোন করার ত্রিশ মিনিট পরই মন্ত্রির গাড়িটা প্রবেশ করলো পিঙ্ক প্যালেসে। তার সঙ্গে আসা সিকিউরিটির লোকজন বাইরের অভ্যর্থনা কক্ষে থাকলো। শাহজাহান করিম প্যালেসের সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানালো হোমমিনিস্টারকে। চাইলেও চোখেমুখে আন্তরিকতার ছাপ ফুটিয়ে তুলতে পারলো না। দুশ্চিন্তায় তার কপালে ভাঁজ পড়েছে। ভালো করেই জানে, খারাপ কিছু না ঘটলে মন্ত্রি নিজে এখানে চলে আসতো না।
সহিদুল আখন্দকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল শাহজাহান। নিজের রুমে ঢোকার আগে তার পার্সোনাল ম্যানেজার কিংবা কাজের লোকজনকে বাইরে থাকার ইশারা করলো। সেই সাথে বলে দিলো কেউ যেন বিরক্ত না করে।
“কী হইছে, মতি?” ঘরের দরজা লাগাতেই জানতে চাইলো জাহান গ্রুপের কর্ণধার। চামড়ার সোফায় বসলো ভিআইপি মেহমানকে নিয়ে।
“আলভী তো বেশি বাড়াবাড়ি কইরা ফালাইছে, পুরা ডিপার্টমেন্ট চেইত্যা গেছে। একজন পুলিশ অফিসারের লগে এমন কাম করলো কেমনে!”
বুক ভরে শ্বাস নিলো শাহজাহান করিম। “ঘটনা তো ঘইট্যা গেছে, কী আর কমু…খারাপ হইছে, এইটা আমিও মানি কিন্তু তোমার পুলিশ মামলা করবো শুনলাম…ওইটা তুমি আটকাইবা না?”
“হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর মামলা করতে গেলে বাধা দেই কেমনে?” বলল মিনিস্টার। “আমি হইলাম ওই ডিপার্টমেন্টের মন্ত্রি, আমার মুখ থাকবো? আপনার ছেলে এমন কাম করছে আমি তো পুরা চিপায় পইড়্যা গেছি।”
“তাইলে এহন কী হইবো?” কপালে ভাঁজ পড়লো শাহজাহান করিমের।
“চিন্তার কী আছে, মামলা কোর্টে যাইবো, বিচার চলবো,” একটু থামলো মন্ত্রি। “বিচারকগো তো আপনে ম্যানেজ করতে পারবেন, আপনার পকেটেই আছে ওরা!”
“আমার পকেটে তিন-চাইরটা আছে, তোমাগো হাতের মুঠায় আছে সবগুলান।”
“আরে বড় ভাই, আপনে ব্যাপারটা বুঝবার পারতাছেন না।”
“কী বুঝুম আর, সবই তো ক্লিয়ার। তোমাগো নিজের কেস হইলে তো ওগোরে ঠিকই ব্যবহার করতা, আমার ছেলের বেলায় সেইরকম করবা না।”
হোমমিনিস্টার কয়েক মুহূর্ত চুপ মেরে রইলো।
“আমি একটা ঝামেলায় পড়ছি, আমার ফ্যামিলির ঝামেলা…এইটা ম্যানেজ করবা না?”
“ম্যানেজ তো হইবো-ই কিন্তু আপনে যেমনে চাইতাছেন অমনে হইবো না।”
“বুঝলাম না?”
“আপনি আদালত নিয়া ভাবতাছেন…ওইটা তো বহুত পরের ব্যাপার। ওই মাইয়াটার মামলার তদন্ত করতাছে জেফরি বেগ…খুবই ভালো অফিসার, একদম সৎ, এফবিআই”র ট্রেনিং করা, বুঝছেন?”
শাহজাহান করিম চুপ মেরে রইলো। সে এসব কথা শুনতে চাচ্ছে না, শুনতে চাচ্ছে তার ছেলের জন্য হোমমিনিস্টার কী করতে পারবে।
“ও কিন্তু বাইর কইরা ফালাইবো কাজটা কে করছে। আর আপনার ছেলে তার সাথে যা করছে এখন সে এইটারে যুদ্ধ হিসাবে নিবো।”
শাহজাহান করিম আতঙ্কিত বোধ করলো। কাজটা কে করেছে বুঝতে পারছে না। এখনও সত্যিটা জানতে পারেনি। তবে তার মন বলছে আলভীই করেছে। যদি তাই হয় তাহলে তো সর্বনাশ। আরেকটা বিপর্যয় নেমে আসবে।
“কী ভাবতাছেন, বড় ভাই?”
হোমমিনিস্টারের কথায় সম্বিত ফিরে পেলো শাহজাহান করিম। “না, কিছু না…তুমি যেন কী কইতাছিলা?”
“ঐ মাইয়াটার পেটের ভ্রূণের ডিএনএ আছে হোমিসাইডে…ওরা তো আলভীর সাথে ওইটা ম্যাচ করাইবো, যেহেতু সে-ই প্রাইম-সাসপেক্ট।”
বিস্ফারিত চোখে তাকালো শাহজাহান।
“আলভীরে দেশের বাইরে পাঠায়া দেন। ওর নামে আরো কয়েকটা মামলা করবো ঐ অফিসার। মামলা হইলে তো ইন্টেরোগেশন করতে হইবো…আপনার ছেলের যে অবস্থা, ইন্টেরোগেশনে মেজাজ গরম কইরা কী করতে কী করবো আল্লাহই জানে!”
কথাটার সঙ্গে একমত না হয়ে পারলো না আলভীর বাপ। তার ছেলেকে যতোই বোঝানো হোক, চট করেই মাথা বিগড়ে যায়। ছেলেটা তার মতো হয়নি, হয়েছে তার ছোটো মামার মতো। ঐ শালার পুতেও কথায় কথায় চেতে যেতো। তার খেসারতও অবশ্য দিয়েছে। রাগের মাথায় নিজের গর্ভবতী স্ত্রীকে চড় মেরে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছিল, ফলে বাচ্চাটা ভুমিষ্ঠ হবার আগেই স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যায়। শেষ জীবনে একা একা রোগেশোকে ভুগে মারা গেছে। তিন দিন পর তার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন।
“কয়েকটা দিন বাইরে থাকুক, বুঝলেন?”
শাহজাহান করিম ফিরে তাকালো হোমমিনিস্টারের দিকে।
“এই সময়ের মইধ্যে আমি ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে পারুম। ওয় দেশে থাকলে বিপদ। জেফরি ওরে অ্যারেস্ট করতে চাইবো, তখন কি আবার গোলাগুলি করবো আপনার ছেলে? নাকি প্যালেসে খিল মাইরা বইসা থাকবো?”
“হাইকোর্ট থিকা আগাম জামিন নিয়া নিবো, সমস্যা কী?”
গাল চুলকালো মন্ত্রি। “সেইটা না হয় করলেন কিন্তু মামলায় ওরে ইন্টেরোগেশন করবো না? তদন্ত করবো না? ঐ অফিসার কয়েক বার চাইবো ওরে…আলভীর অ্যাসোসিয়েটদেরও চাইবো।”
“নিজের করা মামলায় নিজে ইন্টেরোগেশন করবো?!” বিস্মিত হলো জাহান গ্রুপের অধিকর্তা।
“আরে অন্য মামলাটার কথা বলতাছি,” মিনিস্টার বলল। “ওই মাইয়াটার মার্ডার কেসের কথা ভুইল্যা গেছেন দেখি।”
“ওহ।” বুঝতে পারলো ধনাঢ্য ব্যবসায়ি।
“ওর করা মামলাগুলাও দেখবো ওর আন্ডারে থাকা লোকজন।”
গম্ভীর মুখে তাকালো শাহজাহান।
“প্রাইম মিনিস্টারও খুব রাইগা আছেন আলভীর উপরে, বুঝছেন?”
“প্রাইম মিনিস্টার কেমনে জানলো এইসব?” বিস্মিত হলো জাহান গ্রুপের কর্ণধার। প্রধানমন্ত্রির অফিস কিভাবে কাজ করে সে জানে। প্রাইম মিনিস্টার পত্রিকা পড়ে না, তার প্রেস সেক্রেটারি আছে তিনজন, তাদের একজনের কাজ হলো বিভিন্ন পত্রিকার উল্লেখযোগ্য সংবাদের ক্লিপিংসগুলো দিয়ে একটা ফাইল বানিয়ে ডেস্কে রেখে দেয়া। প্রধানমন্ত্রির ইচ্ছে হলে দেখে নইলে ডেস্কেই পড়ে থাকে। কোনো সংবাদ নিয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে প্রেস সেক্রেটারি ব্রিফ করে।
“আর বইলেন না,” হতাশ কণ্ঠে বলল হোমমিনিস্টার। “উনার অফিসে একজন অ্যাসিসটেন্ট প্রেস সেক্রেটারি আছে, ওয় আবার দিলান মামুদ নামের এক সাংবাদিকের খুব ক্লোজ। প্রাইম মিনিস্টারের ডেস্কে খবরটা তুইল্যা দিছে ঐ সেক্রেটারি, বুঝছেন এইবার?”
চোখমুখ তিক্ততায় ভরে উঠল শাহজাহান করিমের।
“ওরে একটু বুঝায়েন, এইভাবে মেজাজ গরম করলে তো এত বড় প্রতিষ্ঠান সামলাইতে পারবো না। আপনি আর কতোদিন…বয়স হইছে না?”
শাহজাহানও জানে কথাটা সত্য কিন্তু এই সত্য হোমমিনিস্টারের মুখ থেকে শুনতে চায় না। এক শ” ইঁদুর মেরে যদি বিড়াল নসিহত করতে শুরু করে প্রাণীহত্যা মহাপাপ তাহলে কেমন লাগে? কতো গুম-খুনের হোতা এই লোক। কতো মায়ের বুক খালি করেছে। হাজার হাজার মানুষকে রাজনৈতিক কারণে বিনা বিচারে জেলে ভরে রেখেছে। বাকি অন্যায়গুলোর তো কোনো হিসেবও নেই।
“ওর কিছু বাজে অভ্যাসও আছে, ওইটারও ব্যবস্থা কইরেন।”
মিনিস্টারের দিকে চেয়ে রইলো শাহজাহান। ভালো করেই বুঝতে পারলো কী বলতে চাইছে।
“গভমেন্টের অনেক ইন্টেলিজেন্স আছে, এইসব কথা গোপন থাকে না, ভাই। আপনার আরেক ছেলে তো বিদেশে গিয়া এলজিবিটি মুভমেন্টে খুব অ্যাক্টিভ হইয়া আছে…ফেসবুকে পোস্ট দিয়া বেড়ায়। বাপের মানসম্মান কেয়ারই করে না।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে সায় দিলো জাহান গ্রুপের কর্তা। খুব বলতে ইচ্ছে করলো প্রেসিডেন্টের মেয়ের জামাইর পাল্লায় পড়ে যে আলভীর এই বদঅভ্যাস হয়েছে সেটাও নিশ্চয় জানো? কিন্তু কথাটা বলল না। বলতে পারলো না আসলে। এই মুহূর্তে তার পরিবার একটা বিপাকে পড়েছে, এখন বুঝেশুনে কাজ করতে হবে আর কথা বলতে হবে খুব সাবধানে। “ওরে তাইলে বাইরে পাঠায়া দেই?”
“জি, ভাই…দূরে থাকুক কয়েকটা দিন,” একটু থেমে আবার বলল, “কিন্তু কাজটা সহজ হইবো না।”
বুঝতে না পেরে মিনিস্টারের দিকে চেয়ে রইলো শাহজাহান করিম
“ঐ জেফরি বেগ…আপনার আলভী যারে গুলি কইরা মারতে চাইছিল, সে তো এয়ারপোর্টে রেড নোটিশ দিয়া রাখছে।”
“বলো কি!” খুবই অবাক হলো শাহজাহান। ঘটনা এতদূর গড়িয়েছে বুঝতে পারেনি। “তাইলে ক্যামনে বাইরে পাঠামু ওরে?”
আশ্বস্ত করার হাসি দিলো মন্ত্রি। “আমি আছি না, এইটা নিয়া চিন্তা কইরেন না। একটা চার্টার্ড প্লেনের ব্যবস্থা করেন, বাকিটা দেখতাছি।”
আশ্বস্ত হয়ে মাথা নাড়লো শাহজাহান করিম।
“ভাই, আমি তো একটা সমস্যায় পড়ছি…আপনি একটু হেল্প কইরেন আমারে।”
“কী সমস্যা?”
“জানেনই তো, আমার ছোটো ছেলেটা আমেরিকায় থাকে, ও একটা ফ্ল্যাট কিনবো কিন্তু হাতে টাকা-পয়সা তেমন নাই, আপনে আমারে দশ কোটি দিয়েন, খুব উপকার হইবো।”
বানচোদ! মনে মনে গালিটা দিলো শাহজাহান। তার বাড়িতে আসার কারণ আসলে এটাই! এইসব রাজনীতিকেরা শুধু যে লোভি তা নয়, এরা হলো রিক্সাওয়ালাদের মতোন-বৃষ্টির দিনে দ্বিগুণ ভাড়া চায়—মানুষের বিপদকে পুঁজি করে পকেট ভরে। আস্ত একটা রিক্সাওয়ালা! “আচ্ছা, “ আস্তে করে বলল। “তোমার লোক পাঠায়া দিও রোববার, দিয়া দিমুনে… আলভীর ব্যাপারটা দেইখো, বহুত পেরেসানিতে আছি।”
খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠল মন্ত্রি। “ভাই, আপনি একদম টেনশন করবেন না, আলভীরে খালি বাইরে পাঠায়া দেন বাকিটা আমি দেখতাছি।”
“হুম,” গম্ভীর কণ্ঠে বলল শাহজাহান। সেটাই ভালো। ঝড়ের হাত থেকে বাঁচতে হলে জায়গা বদলাতে হয়, ঘর ছাড়তে হয়। ঘরের মায়া করে পড়ে থাকলে ঘর তো যায়-ই, অনেক সময় জীবনও চলে যায়।
অধ্যায় ৩৬
ফারহান ওমর জানতো এমনটাই হবার কথা।
আলভীর মতো উন্নাসিক, মাথা গরম আর নেশাগ্রস্ত কাউকে পড়ে ফেলার জন্য এক সপ্তাহ-ই যথেষ্ট। সেদিক থেকে দেখলে পাঁচ-ছয় বছর অনেক লম্বা সময়। এতদিনে তাকে রগে রগে. শিরায় শিরায় চিনে ফেলেছে। কখন তার কোন মতি হয় সবটাই জানে।
সামনের দিকে তাকালো। রাগে ফুঁসছে আলভী। চড় খেয়ে তার মাথা সেই যে খারাপ হয়েছে এখনও স্বাভাবিক হতে পারেনি। সম্ভবত পাল্টা কিছু না করা পর্যন্ত মাথা ঠিক হবে না। এই অপমান হজম করা তার পক্ষে অসম্ভব। একটু আগে সম্ভবত আবারো কোকেন নিয়েছে।
“ঐ বানচোদটারে শিক্ষা দিতেই হইবো,” দাঁতে দাঁত পিষে বলল আলভী। “না দেওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি নাই, বুঝছেন?”
খুক খুক করে একটু কাশলো লিগ্যাল অ্যাডভাইজার। বিরক্ত হলো জাহান গ্রুপের সিইও। সে জানে, এই লোক যখনই খুক খুক করে কাশে তখনই অপছন্দের কথাটা বলে।
“উনি কয়দিন পর প্রেসিডেন্টের গোল্ড মেডেল পাবেন, স্যার,” আস্তে করে বলল।
কথাটা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো আলভী। “ঐ জোকারটা তো কতোজরে কতো কিছু দেয়! দুই শ” খুনের পুলিশরেও দেয়…ভালো পুলিশ হইলে গভমেন্টের পদক পাইতো না।”
দ্বিমত পোষণ করতে চাইলো ফারহান কিন্তু সতর্ক হয়ে গেল সে। শত হোক মালিকের ছেলে, প্রতিষ্ঠানের সিইও, তাকে চটানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। “কায়সার সাহেব আমাকে বলেছেন, বড় স্যারও স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, ঐ অফিসারের যেন কিছু করা না হয়। আমি সেজন্যেই বলছি, এটা আমার নিজের কথা না।”
“কিন্তু আমারে থাপ্পর মাইরা কেউ পার পাইবো, এইটা হইতে পারে না। কিছু একটা করতেই হইবো।”
ফারহান চুপ মেরে রইলো। এই কোকেন আসক্ত লোককে ঠাণ্ডা মাথায় বোঝানো সম্ভব না।
“ওর সম্পর্কে খোঁজ নেন,” হুকুমের স্বরে বলল এবার। “কই থাকে, কী করে…কে কে আছে…সব। ওর কোনো উইকনেস আছে কি না বাইর করেন।”
“আমি যতো দূর জানি তার বাবা-মা নেই। এক মিশনারি ফাদারের কাছে মানুষ হয়েছে,” ফারহান ওমর বলল। “বিয়ে করেনি এখনও। তার উইকনেস কী সেটা আমি জানি না।”
“বিয়ে যেহেতু করে নাই মাগিবাজি করে।”
আলভীর কথার কী জবাব দেবে লিগ্যাল অ্যাডভাইজার বুঝতে পারলো না। এই লোকের ধারণা মেয়ে মানুষ ছাড়া দুনিয়াতে কোনো পুরুষ থাকতে পারে না। হয়তো কথাটা সত্যি, তাই বলে সবাই তার মতো চাহিদা মেটাবে তা তো নয়। ইচ্ছে থাকলেও অনেকের পক্ষে সুযোগ হয় না। আবার অনেকে নিজের ইচ্ছেটাকে দমিয়েও রাখতে পারে। জেফরি বেগ ঠিক কোন ধরনের তার জানা নেই। যতোটুকু জানে, বেশিরভাগই পত্রিকা পড়ে আর শোনা কথা থেকে।
“চুপ কইরা আছেন কেন?”
আলভীর কথায় ধ্যান ভাঙলো ফারহান ওমরের। “জি, স্যার?”
“গার্লফ্রেন্ডও নাই?”
“আছে, স্যার,” জবাব দিলো। এটাও পত্রিকা পড়ে জেনেছে। কয়েকদিন আগে জেফরি বেগকে নিয়ে একটা ফিচার করেছিল জনপ্রিয় দৈনিক মহাকাল, সেখানে লিখেছিল হোমিসাইডের এই দুদে ইনভেস্টিগেটরের একজন ফিয়ানসে আছে, শিঘ্রই তারা বিয়ে করবে। “কে? কোথায় থাকে, কী করে…খবর নেন,” আলভী বলল।
কিন্তু ফারহান ওমর বুঝতে পারলো না ফিয়ানসের খবর কেন নিতে চাইছে এই লোক। পরমুহূর্তেই অজানা আশঙ্কা দানা বাঁধলো তার মনে। “স্যার, আপনি আসলে ঠিক কী করতে চাচ্ছেন জেফরি বেগের ব্যাপারে?”
“আমার জায়গায় আব্বা যদি থাপ্পড় খাইতো তাইলে কী করতো, জানেন?” চোখমুখ বিকৃত করে বলল আলভী। “মাইরা-কাইটা লাশ ভাসাইয়া দিতো।” জোরে জোরে নিশ্বাস নিলো সে। “প্লেনে কইরা অন্য দেশে চইল্যা যাইতো না।”
শাহজাহান করিম তার ছেলেকে বলে দিয়েছে কয়েক দিনের মধ্যেই দেশ ছাড়তে হবে, বাইরে গিয়ে ছুটি কাটাতে হবে তাকে।
“স্যার অনেক অভিজ্ঞ, অনেক কিছু দেখেছেন জীবনে,” শান্ত কণ্ঠে বলল ফারহান। “উনি জানেন পলিটিশিয়ানরা অনেক সময় ক্ষমতার জন্য, নিজের ইমেজ রক্ষা করার জন্য ঘনিষ্ঠ লোকজনদেরকেও বিপদে ফেলে দেয়।”
আলভীও এটা জানে। দশ-এগারো বছর আগে তার বড় ভাই একটা অনিচ্ছাকৃত খুন করে ফেঁসে যেতে বসেছিল। অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল তার বাবাকে। কিন্তু জেফরি বেগের কিছু না করে দেশ ছাড়তে চাইছে না সে।
“এই মুহূর্তে পরিস্থিতি একটু জটিল,” লিগ্যাল অ্যাডভাইজার বলল। “স্যার সেজন্যেই এটা বলেছেন। আমিও মনে করি স্যার ঠিকই বলেছেন।”
আলভী এটা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো।
“আমি জানি এখন আপনাদের গ্রুপ আর দশ বছর আগের মতো নেই, অনেক বড় হয়ে গেছে। দুয়েকটা ইনসিডেন্ট ধামাচাপা দেওয়া যেতে পারে কিন্তু এই লোকটা পুলিশ, তার কিছু হলে সরকার আপনার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। কী দরকার, খামোখা ঝামেলা করার?”
আলভীর মুখে ক্রুর হাসি ফুটে উঠল। কী করলে এসব উপদেশ পাল্টে যাবে ভালো করেই জানে।
অধ্যায় ৩৭
ডাক্তার এবং আকবর হাসানের রিমান্ড শেষে হোমিসাইড তাদেরকে আদালতে সোপর্দ করে দিয়েছিল, ম্যাজিস্ট্রেট তাদের দুজনের জামিনের আবেদন নাকচ করে দিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিয়েছে। ব্যাপারটা মোটেও অস্বাভাবিক নয় বরং সাধারণ মানুষের বেলায় এমনটাই হবার কথা। অস্বাভাবিক লাগছে এজন্যে যে, এখানে জাহান গ্রুপের একজন লোক রয়েছে। জেফরি বেগ আশা করেছিল জাঁদরেল উকিল দাঁড়াবে লোকটার জন্য। সেখানেই ক্ষান্ত হবে না তারা, ম্যাজিস্ট্রেটকেও প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে।
অবশ্যই দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ প্রণোদনা দিয়ে!
সেরকম কিছু যে হয়নি তার কারণটা অবশ্য হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর বুঝতে পারছে, তবে সহকারি জামান বুঝতে পারছে না। তার ধারণা, জাহান গ্রুপ ঐ লোকটাকে ডাম্প করেছে, তার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার চেষ্টা করছে।
“আমার তা মনে হয় না.” সহকারিকে বলল জেফরি। “এসব কাজ ওরা দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে, ওরা জানে এটা করলে ভবিষ্যতে ওদের হয়ে কেউ হাত নোংরা করবে না।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো জামান। “তাহলে এটা করলো কেন, স্যার?…ক্ষেপে গেছে ঐ লোকের উপরে?”
“আরে না,” এবারও দ্বিমত পোষণ করলো। “ঘটনা আসলে অন্য কিছু,” একটু থেমে আবার বলল, “ওরা সতর্ক হয়ে গেছে।”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো সহকারি ইনভেস্টিগেটর।
“ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ব্রিফকেসভর্তি টাকা নিয়ে সুট-টাই পরা একজনের যাওয়ার কথা…আমি সেরকমই কিছু আশা করেছিলাম কিন্তু ডাক্তারের ঘটনার পর ওরা আর রিস্ক নেয়নি।”
এবার জামান বুঝতে পারলো। “জি, স্যার…সেটাই হবে। ওরা ভেবেছে আমরা হয়তো আবারো ফোন টেপ করে কিংবা ট্র্যাপ করে ধরে ফেলবো।”
“ওয়ান্স বিটেন টোয়াইস শাই!” মুচকি হাসলো জেফরি বেগ। “ওদের দিক থেকে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক।”
“কিন্তু ঐ আকবর হাসান ক্ষেপে যাবে না? তার জন্য জাহান গ্রুপ কিছু করছে না, তাকে জেলে যেতে হচ্ছে?”
“মনে হয় না,” বলল হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। “প্রফেশনাল লোক সে, ভালো করেই জানে ধরা পড়ে জাহান গ্রুপকে বিপদে ফেলে দিয়েছে, এখন তারা একটু দূরত্ব বজায় রাখবে, সময় নেবে।”
“হুম,” গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লো জামান। “তাহলে আমাদের নেক্সট মুভ কী?”
“আমি নিজে মামলা করবো আলভী করিমের বিরুদ্ধে…আজকেই।”
“শুনেছি হোমমিনিস্টার তাদের খুব কাছের লোক, উনি কি আপনাকে মামলা করতে দেবেন?”
মুচকি হাসলো জেফরি। “ফারুক স্যারের সঙ্গে উনার কথা হয়েছে… উনি এখন নিজের ডিপার্টমেন্টের লোকজনের কাছে দিগম্বর হতে যে চাইবেন না সেটা আমিও আন্দাজ করতে পারছিলাম।”
“তাহলে তো জাহান গ্রুপ…আলভী… বিপদেই আছে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি বেগ। “একটা ব্যবসায়িক গ্রুপ রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হতে পারে না। আমি আসলে দেখতে চাই তারা কতো দূর যেতে পারে। বিষয়টা পার্সোনাল না…একদমই না। আমাকে গুলি করেছে, গালাগালি করেছে বলে এটা করছি না। আমি ওদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে দেখাতে চাই ওরা আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না। এরকম একটা নজির সৃষ্টি করার খুব দরকার আছে, জামান।”
সহকারি আরো একবার সায় দিলো কিন্তু কিছু বলার আগেই ফোনের রিং বাজার শব্দ শুনতে পেলো সে।
পকেট থেকে ফোনটা বের করে ডিসপ্লেতে কলার আইডি দেখলো জেফরি বেগ। “এক্সকিউজ মি.” জামানকে বলল সে। তার রুম থেকে চলে গেল ছেলেটা। “হ্যালো? কেমন আছো?”
“ভালো, তুমি কি ব্যস্ত…?” ওপাশ থেকে বলল রেবা।
“না, বলো।”
“আজকে দেখা করতে পারবে?…জরুরি দরকার ছিল।”
অনেকদিন পর রেবার কণ্ঠে এক ধরণের উচ্ছ্বাস টের পেলো। তার বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ার পর থেকে এমনটা খুব কমই হয়েছে। “ঠিক আছে।”
“তাহলে আজকে একসঙ্গে ডিনার করি?”
“ঠিক আছে।”
“কোথায়…কখন আমি তোমাকে একটু পর টেক্সট করে জানিয়ে দিচ্ছি।”
“ওকে।”
“লাভ ইউ!”
“লাভ ইউ টু।” ফোনটা রেখে একটু ভাবলো জেফরি বেগ। ফোনে যেহেতু বলেনি সারপ্রাইজ দেবে সম্ভবত। সেটা কী হতে পারে? রেবা ক-দিন আগে ইউএনএইচসিআর-এ চাকরির জন্য আবেদন করেছিল, সেটা সম্ভবত হয়ে গেছে।
ব্যস্ততার কারণে কয়েক দিন পর দেখা হবে বলে তার বেশ ভালো লাগলো।
অধ্যায় ৩৮
সচরাচর শাহজাহান করিম হোয়াইট প্যালেসে আসে না, যদিও তার পিঙ্ক প্যালেসের পাশেই সেটা।
দুই প্রাসাদে যাতায়াতের জন্য ছোট্ট একটা দরজা আছে দক্ষিণ দিকের সীমানা প্রাচীরে। দরজাটা বানানোর উদ্দেশ্য ছিল সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। ভেবেছিল রোজই আসা যাওয়া হবে কিন্তু সেটা হয়নি।
সন্তান বড় হলে বাপ-মায়ের কাছ থেকে আলগা হয়ে যায়; তার দুই ছেলেও খুব দ্রুত আলগা হয়ে গেছিল। যখন এক বাড়িতে ছিল তখন প্রতিদিনই দেখা হতো। একটা রীতি ছিল বাড়িতে, যে যেখানেই থাকুক সকালের নাস্তাটা একসঙ্গে করবে। তিন তিনটা প্যালেস বানিয়ে সেই রীতির বিনাশ করেছে। মাঝেমধ্যেই ভাবে, বিশাল বড় ভুলই করেছে সে।
বড়টা বহু আগেই বিচ্ছিন্ন আর দূরের মানুষ হয়ে গেছে। ছোটোটার মতো তারও মাথা গরম কিন্তু সেই সঙ্গে ভোঁতাও। কোথায় কোন কথা বলতে হয়, মুখটা কখন খুলতে হয় কিছুই শেখেনি। তার উপরে বাপের সঙ্গে বেয়াদবি করার বদ খাসলত ছিল তার। সেই বেয়াদবির কারণেই তাকে
প্রথমে আলাদা করে দেয়া হয়। বাপের উপরে রাগ করে ব্যবসাতেও ঠিকমতো বসতো না, বসলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করতো। তার দুর্ব্যবহারের কারণে বহু পুরনো কর্মচারি হারিয়েছে।
দশ-এগারো বছর আগে বড় ছেলে আরাফি অনিচ্ছাকৃত একটি খুন করে বেকায়দায় পড়ে গেছিল। বোকাটা যদি ঘটনার পর পরই তাকে জানাতো, সুন্দরমতো সামলাতে পারতো। কয়েক লাখ টাকা খরচ হতো মাত্র। লাশটা পুরোপুরি গায়েব করার ব্যবস্থা করতো। এরকম কাজ করার মতো লোকজন আছে তার কাছে। কিন্তু এসব না করে বোকাটা ছাদ থেকে লাশ ফেলে দেয়। তার বন্ধুবান্ধবও সেরকমই। বুদ্ধিটা নিশ্চয়ই ওরা দিয়েছিল। আরাফির মাথায় ছাদ থেকে ফেলে দেবার বুদ্ধিও বের হতো না, এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত।
সেই ঘটনা ধামাচাপা দিতে কতো কাঠখড়ই না পোড়াতে হয়েছে। সেই সময়কার হোমমিনিস্টারকে নির্বাচনের সময় মোটা অঙ্কের ডোনেশন দিয়েছিল, সম্পর্কও ভালো ছিল কিন্তু তার প্রতিমন্ত্রি, লোকে যাকে আড়ালে আবডালে “সজারু” নামে ডাকতো, সে বাগড়া দিয়ে বসে। শেষ পর্যন্ত ঘটনাটা ধামাচাপা দিতে প্রায় চল্লিশ কোটি টাকা বের হয়ে যায় তার পকেট থেকে। সেজন্যে বড় ছেলেকে সবকিছু থেকে সরিয়ে দিয়ে মাসোহারা দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু এত বড় বিপদ থেকে মুক্ত হবার কিছুদিন পরই জানা যায় তার ছেলের মেয়েমানুষের প্রতি রুচি নেই! কথাটা শোনার পর স্তম্ভিত হয়ে বসে ছিল পাক্কা দুই ঘন্টা।
ছোটোটা এদিক থেকে ভালো। বুদ্ধিসুদ্ধি নেহায়েত কম না। কর্পোরেট কালচারও বোঝে। মাথা একটু গরম, এই যা। মেয়েবাজি যেটা করে সেটাকে দোষের কিছু বলেও মনে করে না। কিন্তু সে নিশ্চিত তার ছেলে প্রেমে পড়ে গেছিল ঐ দুই পয়সার মেয়েটার।
ভাবা যায়? এরকম মেয়েমানুষ ব্যবহার করার পর ছেড়ে দিতে হয়। তাতে আর কতো টাকা লাগে? সামান্যই খরচ হতো কিন্তু তার ছেলে ঐ মেয়ের পেটে বাচ্চা পয়দা করে ফেলেছে!
প্রেমে পড়লে যে পুরুষ মানুষ বোকা হয়ে যায় এটা শাহজাহান করিমও জানে। সে-ও মুশতারি নামের এক বিহারী মেয়ের প্রেমে পড়ে গেছিল। অনেক সতর্ক থাকার পরও তার স্ত্রী কিভাবে যে জেনে গেছিল আজো সেটা তার কাছে এক রহস্যই। এরপর থেকে মেয়েমানুষ ব্যবহারের বেলায় সতর্ক হয়ে ওঠে সে। একবারের বেশি কোনো মেয়েকে ব্যবহার করেনি। অনেক সময় কিছু মেয়ের প্রতি যে আসক্তি তৈরি হয়নি তা নয় কিন্তু সেই প্রলোভন থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পেরেছিল সব সময়।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো শাহজাহান করিমের ভেতর থেকে। প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে আলভীর প্রাইভেট রুমে বসে আছে সে, সিকিউরিটি চিফ কায়সার দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে। নিজের হাতে তৈরি করা সাম্রাজ্যে ছেলেদের দুই পয়সারও অবদান নেই অথচ এই বৃদ্ধ বয়সে এখন তাদের জন্য অপেক্ষা করতে হয়!
পিঙ্ক প্যালেসের ছোটো গেটটা দিয়ে ঢোকার সময় আশা করেছিল ছেলেকে দেখতে পাবে, তার বদলে কায়সার তাকে অভ্যর্থনা জানায়।
নিজের হাতের অরিজিনাল রোলেক্স ঘড়িতে সময় দেখলো সে, যদিও প্রাইভেট রুমের দক্ষিণ দিকের দেয়ালে, তার ঠিক সামনেই বিশাল বড় একটা ঘড়ি আছে। কায়সারের দিকে তাকালো, আলভী দেরি করছে বলে সে-ও বিব্রত মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
একটু জড়োসরো হয়ে ঘরে ঢুকলো আলভী। বোঝাই যাচ্ছে, বাবার মুখেমুখি হতে অনিচ্ছুক।
“স্লামালেকুম, আব্বা। আপনার শরীর ভালো আছে?”
লম্বা করে শ্বাস নিলো শাহজাহান করিম। “হুম, ভালা আছি।”
আলভী তার বাবার মুখোমুখি সোফায় বসে পড়লো, কায়সার আহমেদের দিকে তাকালো সে, ঘর থেকে চলে যেতে উদ্যত হলো সিকিউরিটি চিফ।
“ও থাকুক,” গম্ভীর কণ্ঠে বলল শাহজাহান করিম।
কায়সার আহমেদ আবারো চলে এলো আগের জায়গায়। হাত তুলে তাকে বসার জন্য ইশারা করলো জাহান গ্রুপের মালিক। চুপচাপ পাশের একটা সোফায় বসে পড়লো সে।
“আকবরের ডিভিশনের ব্যবস্থা করছো?”
“জি, আব্বা।”
“কয়েক দিনের মইধ্যে তুমি দেশের বাইরে চইলা যাইবা, সব ব্যবস্থা করা হইছে।”
চুপ মেরে রইলো জাহান গ্রুপের সিইও।
“তুমি আর তোমার পরিবার এক মাসের ছুটি কাটাইবা।”
অবাক হলো আলভী, স্ত্রীকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে না সে। একসঙ্গে ছুটি কাটানোর মতো সম্পর্ক তাদের নেই। এই বিশাল প্যালেসেই তারা আলাদা ফ্লোরে থাকে। সপ্তাহে দুয়েক বার দেখা হয়। আর দেখা হলেও কথা হয় খুব কম।
“মাহি থাকুক, ওর যাওনের কী দরকার?”
চোয়াল শক্ত হয়ে গেল শাহজাহান করিমের। “ওয় গেলে সমস্যা কী?”
বাপের কাছে সেটা বলতে পারছে না বলে চুপ মেরে রইলো।
“তুমি একা গেলে মনে হইবো পলায়া গেছো…বউ থাকলে এইটা ভ্যাকেশন হইবো, বুঝছো?”
গাল চুলকালো আলভী।
“কায়সার, তুমি ওগোরে সহিসালামতে প্লেনে তুইল্যা দিবা। আর এই ব্যাপারটা যেন গোপন থাকে…এইটা খুব জরুরি।”
“জি, স্যার,” সম্ভ্রমের সঙ্গে বলল সিকিউরিটি চিফ
“মন খারাপ করনের কিছু নাই, তোমার পছন্দের জায়গাতেই যাইতাছো,” কথাটা বলে উঠে দাঁড়ালো শাহজাহান করিম।
আলভীও আর কোনো প্রশ্ন না করে উঠে দাঁড়ালো।
অধ্যায় ৩৯
এত কাজের মধ্যেও রেবার জন্য সময় বের করতে হলো জেফরিকে।
হোমিসাইড থেকে ফিরতে একটু দেরি হলো তার। সন্ধ্যা সাতটার পর জামানের বাইকে করে রওনা দিয়েছিল, বনানীতে নিজের ফ্ল্যাটে যখন এলো তখন প্রায় পৌণে আটটা। রেবাকে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিলো, তার একটু দেরি হবে ফ্রেশ হয়ে বের হতে। তাদের দেখা করার কথা আটটায়, গুলশানের রেড হট চিলিতে।
ফ্ল্যাটে পৌঁছেই শাওয়ার নিয়ে নিলো ঝটপট। দ্রুত একটা জিন্স প্যান্ট আর পোলো শার্ট পরে নিলো সে, পায়ে মোকাসিম চাপিয়ে দ্রুত বের হয়ে গেল ফ্ল্যাট থেকে। দোতলায় থাকে বলে লিফট ব্যবহার করে খুব কম সময়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মাথার চুলগুলো আঁচড়ে নিলো হাতের পাঁচ আঙুল ব্যবহার করে। রাস্তায় এসে একটা সিএনজি অটোরিক্সায় উঠে বসলো। ঘড়িতে সময় দেখলো, এতক্ষণে পাঁচ মিনিট দেরি হয়ে গেছে। আশা করলো এইটুকু দেরির জন্য রেবা আজকে মেজাজ খারাপ করবে না। পরিহাসের ব্যাপার হলো জেফরি সব সময় পাঙ্কচুয়াল কিন্তু আজ বাড়ির এত কাছে ডেট করতে গিয়েই দেরি হয়ে গেল।
রেড হট চিলি”র ভেতরে ঢুকে ভালো করে দেখলো, রেবাকে দেখতে না পেয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো রেগেমেগে চলে গেছে কি না। তারপরই বুঝতে পারলো এত অল্প সময় দেরি করার কারণে এমনটা করবে না। সম্ভবত রেবা -ই আজকে দেরি করে ফেলেছে। ঢাকার জ্যামকে মাথায় রাখলে সেটা ঠিকই আছে।
হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো সে। ডান দিকের কর্নারে, কাচের ফ্রেঞ্চ জানালার পাশে একটা কাপল টেবিলে গিয়ে বসলো। ফোন বের করে কল দিলো না কারণ এই অভ্যাসটা তার নেই। কেউ যদি জ্যামে আটকা পড়ে তাকে ফোন দিয়ে তাড়া দেয়াটা এক ধরণের অভদ্রতা। এরমধ্যে ওয়েটার এলে তাকে জানালো পরে অর্ডার করবে।
পাঁচ-সাত মিনিট পরও যখন রেবা এলো না জেফরি পকেট থেকে ফোন বের করে কল দিলো এটা জানাতে সে এসে গেছে, সেই সাথে জেনে নিতে রেবা কতো দূরে আছে এখন। রিং হলেও কলটা ধরলো না। তার মানে জ্যামেই আছে, যানবাহনের শব্দে হয়তো ফোনের রিংটোন শুনতে পায়নি।
আরো দশ মিনিট পরও যখন রেবা এলো না, কলব্যাকও করলো না তখন একটু চিন্তিত হয়ে উঠল। আবারো কল করলো, এবারও একই অবস্থা। এমনটা এর আগে কখনও হয়নি। রেবা যদি জ্যামে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে জানিয়ে দেয়। আজকে দু দু বার তার কল পেয়েও কল ব্যাক করেনি।
ফোনটা টেবিলের উপরেই রাখা, অবশেষে দেখতে পেলো রেবা কল দিয়েছে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো সে। “হ্যালো?…জ্যাম নাকি অনেক?”
“ভাইজান!” একটা পুরুষ কণ্ঠ আর্তনাদ করে বলল ফোনের ওপাশ থেকে।
“কে বলছেন?” নড়েচড়ে উঠল জেফরি বেগ। “রেবা কোথায়?!”
“ভাইজান, আমি আপার ড্রাইভার…আপায় অ্যাকসিডেন্ট করছে… জলদি আসেন ঢাকা মেডিকেলে!”
জেফরি বেগের মনে হলো চারপাশটা দুলে উঠছে।