অধ্যায় ৩০
হোয়াইট প্যালেসের ভেতরে নিজের বিশাল প্রাইভেট রুমে এসে অনেকক্ষণ যাবত অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করে চলেছে আলভী।
লিগ্যাল অ্যাডভাইজার ফারহান ওমর খুব বেশি কথা বলছে না। সে ভালো করেই জানে রেগে গেলে আলভী কী করতে পারে–যাকে তাকে গালি দিয়ে বসে। জাহান গ্রুপের অনেক সিনিয়র আর উঁচু পর্যায়ের কর্মচারিরা পর্যন্ত তার ভয়ে তটস্থ থাকে সব সময়। সে রেগে গেলে চুপ থাকে তারা কী বলতে কী বলবে আলভী তার সব ঝাল মেটাবে তাদের উপরে। আর এটাই দিনকে দিন তাকে উচ্ছৃঙ্খল করে তুলছে। সিইওকে কখনও অনুতপ্ত হতে দেখেনি সে। মাঝেমধ্যে ফারহান ওমর ভাবে, সম্ভবত জাহান গ্রুপের কেউই অনুশোচনা করার ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়নি।
বাপ-মায়েরই যদি এই গুণ না থাকে ছেলেরা কোত্থেকে শিখবে?
“ঐ দুই পয়সার ফকিন্নির পুতেরে আমি কী করুম ওর কোনো আইডিয়া নাই!” রাগে গজ গজ করতে করতে সোফা থেকে উঠে পায়চারি করলো আলভী। “শুয়ারের বাচ্চারে আমি…” কথাটা শেষ করতে পারলো না। থর থর করে কাঁপছে এখনও। ঘরের এককোণে প্রাইভেট বারে গিয়ে একটা বোতল হাতে তুলে নিলো, গ্লাসে কিছুটা ঢেলে পান করলো ঢক ঢক করে। বারের দেয়ালে একটা আয়না আছে, সেটাতে নিজের চেহারা দেখতে পেলো। গালে এখনও আঙুলের দাগ আছে। “মাদারচোদ!” খালি গ্লাসটা ছুঁড়ে মারলেও সেটা আয়নার উপরে না পড়ে পাশের দেয়ালে লেগে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
এ সময় ঘরে ঢুকলো সিকিউরিটি চিফ কায়সার আহমেদ।
“আপনি ওই বানচোদটারে স্যার বললেন কেন?” রেগেমেগে কৈফিয়ত চাইলো আলভী।
“পুলিশে উনি আমার সিনিয়র ছিলেন,” শান্ত কণ্ঠে বলল কায়সার। “তখন তাকে স্যার বলে ডাকতাম।”
চোখমুখ বিকৃত হয়ে গেল জাহান গ্রুপের সিইও”র। “এইজন্যেই ওরে বাঁচাইছেন তাইলে!”
“স্যার, আমি আসলে আপনাকে বাঁচিয়েছি।”
বিস্ফারিত চোখে তাকালো আলভী।
“ওই লোককে মেরে ফেললে বিরাট বড় সমস্যায় পড়ে যেতেন।”
কথাটা পছন্দ হলো না জাহান গ্রুপের কর্ণধারের। নাক সিঁটকালো সে।
“কায়সার সাহেব ঠিকই বলেছেন,” আস্তে করে বলল লিগ্যাল অ্যাডভাইজার। “প্যালেসের ভেতরে এরকম ঘটনা ঘটে গেলে সামাল দেয়া কঠিন হয়ে যেতো।”
আলভী তাচ্ছিল্যভরে হাত নেড়ে উড়িয়ে দিলো কথাটা। “আরে কী বলেন এইসব! ঐ লোক যে এইখানে আসছে তার নাম-নিশানাই রাখতাম না আমি! মাইরা কাইট্টা টুকরা টুকরা কইরা কুত্তা দিয়া খাওয়াইয়া দিতাম!”
লিগ্যাল অ্যাডভাইজার আর সিকিউরিটি চিফ দৃষ্টি বিনিময় করলো। জামাল খাশোগির পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড যে অনেককেই অনুপ্রাণীত করেছে সেটা তারা আগেই বুঝতে পেরেছিল। দু মাস আগে এক ব্যবসায়িকে এখানে ডেকে এনে কঠিনভাবে শাসিয়েছিল আলভী, ফ্লোরে থুতু ফেলে চাটতে বলেছিল লোকটাকে, কথা না শুনলে গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল তাকে। তখন আলভীর হাতে ছিল তার লাইসেন্স করা পিস্তল। ভাগ্য ভালো লোকটা জীবন বাঁচাতে ফ্লোর থেকে থুতু চেটে খেয়েছিল। এই ঘটনার পর কায়সারের পরামর্শে শাহজাহান করিম নির্দেশ দেয় তার ছেলের লাইসেন্স করা পিস্তলটা যেন জব্দ করা হয়। এমন জিনিস তার কাছে থাকলে যে যখন তখন যাকে তাকে মেরে ফেলতে পারে, বুঝতে পেরেছিল জাহান গ্রুপের মালিক।
“উনার সঙ্গে আরেকজন এসেছিল, স্যার,” কায়সার আহমেদ বলল। “রিসেপশন রুমে অপেক্ষা করছিল সেই লোক।”
“তো কী হইছে?!” তেতে উঠল হোয়াইট প্যালেসের মালিক। “একটার জায়গায় দুইটারে ভ্যানিশ কইরা ফালাইতাম। কেউ প্রমাণই করতে পারতো না ওই দুই ফকিন্নির পুত আমার প্যালেসে আসছিল।”
“আজকাল মোবাইলফোন ট্র্যাক করে বের করা যায় এটা।”
আলভী কিছু বলতে গিয়েও বলল না। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো।
“উনি ঠিকই বলেছেন,” তাল মেলালো ফারহান ওমর। “এমনিতেই একটা কেস নিয়ে আমরা পেরেসানিতে আছি, তার উপরে এরকম কিছু ঘটে গেলে বিরাট বড় সমস্যা হয়ে যেতো।”
বারের সামনে থেকে ধীর পায়ে হেঁটে একটা রাজকীয় সিঙ্গেল সোফায় বসলো আলভী। এই সোফায় অন্য কেউ বসে না।
“এখন সিচুয়েশন একটু অন্যরকম,
একটু অন্যরকম,” লিগ্যাল অ্যাডভাইজার বলতে লাগলো। “পত্রিকা আর চ্যানেলগুলো খুব সহজে ম্যানেজ করা যায়, তারা বিজ্ঞাপন হারানোর ভয়ে নিউজ ছাপায় না কিন্তু ছোটো ছোটো নিউজ পোর্টাল আর ইউটিউব চ্যানেলগুলো ম্যানেজ করা ভেরি ডিফিকাল্ট।”
“ডিফিকাল্ট হইবো কেন? আপনারা পারেন না সেইটা বলেন।”
“স্যার, এদের সংখ্যা কতো জানেন?…হাজার হাজার। কয়টাকে ম্যানেজ করবো, বলেন?”
“ওই মেয়েটার সুইসাইড কেস নিয়ে কী করলো দেখেছেন না?” কায়সার আহমেদ বলল এবার। “বড় কোনো পত্রিকা-চ্যানেল খবরটা প্রচার করেনি, কোত্থেকে একটা ইউটিউব চ্যানেল রিপোর্ট করে দিলো…নামও শুনিনি জীবনে।”
মনে মনে বাঁকা হাসি দিলো আলভী। তাতে কোন বালটা ছেঁড়া গেল? তারা কি এইসব নিউজ-ফিউজের কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে? জনগণ একটু চিল্লাফাল্লা করছে ফেসবুকে, দুদিন পর ওরা নিজেরাই ভুলে যাবে কী নিয়ে হাউকাউ করেছিল। ওদেরকে পুছে কোন শালা? সরকারণ তো পুছে না!
“আজকাল ছোটো ছোটো নিউজ পোর্টাল আর ইউটিউব চ্যানেলগুলোই বেশি ভাইরাল করে।”
এসব কথায় একটুও মনোযোগ নেই আলভীর। ভালো করেই জানে, এই মি. লিগ্যাল আর মি. সিকিউরিটি তার অপমানের প্রতিকার করতে পারবে না। তার চতুর বাবা তাকে কন্ট্রোল করার জন্য, তার নাড়িনক্ষত্র জানার জন্য এই দুজনকে জুড়ে দিয়েছে তার সঙ্গে। এরা না বুঝবে তার অপমানের জ্বালা, না করতে পারবে তার উপশম।
জীবনে প্রথম চড়টা খেয়েছে সে, আর সেটা কি না দুই পয়সার এক পুলিশের হাতে! ওই বানচোদটারে উচিত শিক্ষা দিতে না পারলে তার শান্তি নেই। হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে কী লাভ যদি ফালতু সব লোকজন এসে চড়-থাপ্পড় মেরে চলে যায়!
লিগ্যাল আর সিকিউরিটির দিকে তাকালো সে। এখনও ভেজর ভেজর করে যাচ্ছে। তাকে বাচ্চা পোলাপান মনে করে এই দুই পণ্ডিত। যেন সে এসব বোঝে না! সব বুঝতে পারলে কি থাপ্পড়ের প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে যাবে?
তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো জাহান গ্রুপের সিইও। টাকা আর ক্ষমতা থাকলে দুনিয়াতে সবকিছুই করা যায়। তাদের অঢেল টাকা আছে, সেই টাকার কারণে তাদের পায়ের নিচে ক্ষমতা গড়াগড়ি খায়। তারা চাইলে হবে না এমন কিছু এ দেশে আছে? ঐ জেফরি বেগ কি প্রেসিডেন্ট না প্রাইম মিনিস্টার? আরে, এই দেশে তো দুয়েকজন প্রেসিডেন্টকেও মেরে ফেলা হয়েছিল, দুই পয়সার পুলিশ আর এমন কী!
অধ্যায় ৩১
“সর্বনাশ!”
সব শুনে ফারুক আহমেদ বলল। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না আদৌ এরকমটা হওয়া সম্ভব। একটু আগে জেফরি বেগ হোমিসাইডে ফিরে এসে সবটাই বলেছে মহাপরিচালককে।
“এ তো মনস্টার!” হোমিসাইডের ডিজি বলল। তার বিস্ময়ের রেশ কাটতেই চাইছে না। “আমি ভাবতেও পারছি না এরকম করার দুঃসাহস কেউ দেখাতে পারে!”
“কেন ভাবতে পারছেন না, স্যার?” চিফ ইনভেস্টিগেটর বলল। “এর আগে ওর বড় ভাই-ও খুন করে বেঁচে গেছিল।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ফারুক আহমেদ। এটা অবশ্য হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের আগের ঘটনা। তখন এই ডিপার্টমেন্টটা তৈরির প্রক্রিয়া চলছিল। দুয়েকটা পত্রিকায় বেশ বড় করেই এসেছিল খুনের ঘটনাটি। তখনও সবগুলো মিডিয়া নিজেদেরকে জাহান গ্রুপের পদতলে সঁপে দেয়নি, সেটাকে অবশ্য সাংবাদিকতার সাহসি কাজের উদাহরণ হিসেবেও দেখার কারণ নেই। প্রতিপক্ষ ব্যবসায়ি আবুল হাসান আবুলের নিজস্ব দৈনিক উঠেপড়ে লেগেছিল ঐ ঘটনা নিয়ে, বাকিরা পরে বাধ্য হয়ে নিউজ করে।
“ঐ ঘটনায় ওদের কিচ্ছু হয়নি। তখন ওরা যতোটুকু ক্ষমতাবান আর টাকার মালিক ছিল এখন তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি… ধরাকে সরা জ্ঞান করতেই পারে।”
গম্ভীর মুখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মহাপরিচালক ফারুক আহমেদ। “তাই বলে সামান্য একটা জিজ্ঞাসাবাদের সময় নিজের বাড়িতে এই কাণ্ড করবে?!”
“ওদের সিকিউরিটির লোকটা আমাকে কী বলেছে জানেন, স্যার?”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো ডিজি।
“আমাকে আর জামানকে খুন করে কেটে কুটে ভ্যানিশ করে দিতো,” পরিহাসের হাসি হাসলো হোমিসাইডের জেফরি বেগ। “জামাল খাশোগির মতো।”
চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল ফারুক আহমেদের। “নিজেকে ওই ব্যাটা সৌদি প্রিন্স ভাবে নাকি?!”
বাঁকা হাসি দিলো জেফরি। “প্যালেসে যেহেতু থাকে ভাবতেই পারে।”
“স্কাউন্ডেল!” ফারুক আহমেদের ডিকশনারিতে হাতে গোণা কয়েকটি গালিই আছে, তার মধ্যে এই শব্দটি ব্যবহারের নজির খুবই বিরল।
“অবৈধভাবে বিদেশি গানম্যান রেখেছে তারা…আলভী আমাকে গুলি করেছে,” চোয়াল শক্ত হয়ে গেল জেফরির। “এই ঘটনাকে মামুলিভাবে দেখলে আমরা সবাই মামুলি হয়ে যাবো, স্যার।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো হোমিসাইডের মহাপরিচালক। “আই কুডেন্ট মোর এগ্রি উইদ ইউ।” একটু থেমে আবার বলল, “আমাদের তাহলে কী করা উচিত?”
“ওদের জায়গায় অন্য কেউ হলে আমরা যেটা করতাম সেটাই করতে হবে। কেউ না করলে আমি নিজেই করবো সেটা।”
জেফরির দৃঢ় মনোভাবের কথা ফারুক আহমেদের অজানা নয়। দীর্ঘদিন তার অধীনে কাজ করছে, তাকে যতোটুকু চেনার চেনে। তাছাড়া যে ঘটনা ঘটে গেছে সেটাকে হাল্কাভাবে দেখার কোনো অবকাশ নেই। এ ব্যাপারে কিছু একটা করতেই হবে।
“আমি হোমমিনিস্টারের সঙ্গে দেখা করবো, তাকে সব বলবো।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল জেফরি। “সব শোনার পর উনি কী করবেন বলে মনে করেন, স্যার?”
কাঁধ তুলল হোমিসাইডের ডিজি। “উনি কী করবেন সেটা উনি ঠিক করবেন, আমার যেটা করার আমি করবো।
অবাক হয়ে তাকালো জেফরি বেগ। ফারুক আহমেদকে কখনওই এতটা সাহসি লাগেনি তার কাছে। এমন নয় যে মানুষটা ভীতু কিন্তু সব সময়ই ভারসাম্য রক্ষা করে বড়সড় আলোড়ন না তুলে সমস্যা সমাধান করার পক্ষে এই লোক। মহাপরিচালকের কাজই সেটা-নানা চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে যেভাবেই হোক সবকিছু ম্যানেজ করে কাজ করা।
“তুমি কী করতে চাও, জেফ?” সস্নেহে জানতে চাইলো।
“আলভীর বিরুদ্ধে কমপক্ষে তিনটা মামলা করবো,” দৃঢ়তার সঙ্গেই বলল সে। “আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাজে বাধা দেয়া, অ্যাটেম্প টু মার্ডার আর অবৈধভাবে বিদেশি বডিগার্ড রাখা।”
গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে সায় দিলো হোমিসাইডের প্রধান। “আমাদের লিগ্যাল কনসালটেন্টের সঙ্গে কথা বলো, আমি হোমমিনিস্টারের সঙ্গে দেখা করবো যতো দ্রুত সম্ভব।”
“উনার সঙ্গে আপনার মিটিংয়ের জন্য অপেক্ষা করবো, স্যার?”
“একটা দিন অপেক্ষা করো, মিনিস্টারের সঙ্গে দেখা করে আসি আগে।”
জেফরির কাছে মনে হলো ফারুক আহমেদ বেশিরভাগ আমলাদের মতো ক্যারিয়ারিস্ট নয়, সৎসাহস বলে একটা জিনিস তার আছে। সবচাইতে বড় কথা, প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে বটবৃক্ষের মতো ছায়া দেবার গুণটা রয়েছে ভদ্রলোকের।
অধ্যায় ৩২
শাহজাহান করিম রাগে ফুঁসছে। তার পার্সোনাল ডাক্তার একটু আগে প্রেসার কমানোর ওষুধ দিয়ে গেছে কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না, প্রেসার যেন বেড়েই চলছে।
লিগ্যাল অ্যাডভাইজার জানিয়েছে তাকে, তার ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করবে সামান্য এক সরকারি কর্মচারি! কতো বড় আস্পর্ধা ওই লোকের! আবার শুনতে পাচ্ছে সমন জারি করবে গ্রেফতার করার জন্য। লোকটা নাকি আলভীর হোয়াইট প্যালেসে এসেছিল দু পয়সার এক মেয়ের মার্ডার কেস নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য, সেখানে তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডার খবর পেয়েছে সে। একটা গুলিও নাকি হয়েছিল কিন্তু আলভী তাকে বলেছে ভিন্ন কথা। ঐ ইনভেস্টিগেটর মারমুখি আচরণ করলে তার বিদেশি দেহরক্ষি ফাঁকা গুলি করেছিল লোকটাকে নিরন্ত করার জন্য।
ঘরের ভেতরে ফাঁকা গুলি!
সন্দেহ তার প্রথম থেকেই হয়েছিল। ঐ ইনভেস্টিগেটর যতো বড় ত্যাদড়ই হোক না কেন, সুরক্ষিত হোয়াইট প্যালেসে ঢুকে আলভীকে মারতে যাবে? অসম্ভব! তার বিদেশি দেহরক্ষিরা যে এমন কাণ্ড করবে সেটাও বিশ্বাস হচ্ছে না। একা একজন মানুষকে মোকাবেলা করার জন্য গুলি করার দরকার হবে কেন? ঐ দুই রাশান বডিগার্ডকে দেখলে গামা পালোয়ানের কথা মনে পড়ে যায় তার। একেকটা সাড়ে ছয় ফুটের মতো লম্বা, ব্যায়ামবিদদের মতো পেটানো শরীর। সামান্য একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে মোকাবেলা করার জন্য ওদের একজনই তো যথেষ্ট।
ডান দিকের বড় জানালাটা দিয়ে বাইরের সবুজ ঘাসের লনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আলভীর কথা বিশ্বাস হয়নি বলে সিকিউরিটি চিফকে আবারো দেখা করতে বলেছে। এখন তারই অপেক্ষায় বসে আছে পিঙ্ক প্যালেসের বৈঠকখানায়।
“স্লামালেকুম, স্যার।”
ফিরে তাকালো শাহজাহান করিম। কায়সার আহমেদ দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে, কখন ঘরে ঢুকেছে টেরই পায়নি। “আসলে কী হইছে, বলো তো?” সরাসরি জানতে চাইলো। “সত্যিটা বলবা, আলভীর কথা বলবা না।”
“জি, স্যার,” সিকিউরিটি চিফ বলল। “আমি আপনাকে মিথ্যা বলবো না, বিশ্বাস রাখতে পারেন।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো জাহান গ্রুপের কর্ণধার। এই লোককে সে চাকরি দিয়েছে, তার ছেলে না। এর আনুগত্য তার প্রতি-ই থাকবে।
“হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগকে আলভী স্যার গুলি করার চেষ্টা করেছিলেন।”
বিস্ময়ে ভুরু কপালে উঠে গেল শাহজাহান করিমের। “ও পিস্তল পাইলো কইখিকা?”
“বডিগার্ডদের একজনের রাইফেল কেড়ে নিয়ে গুলি করেছেন।”
“হায় খোদা!” অবিশ্বাসে বলে উঠল আলভীর জন্মদাতা। ছেলের কাছ থেকে তার লাইসেন্স করা অস্ত্র আগেই সিজ করেছিল সে। এত মাথা গরম কারোর কাছে অস্ত্র থাকাটা বিপজ্জনক, কখন অঘটন ঘটিয়ে ফেলে ঠিক নেই। “পালোয়ানের মতো বডিগার্ডের কাছ থিকা ওয় কেমনে কাইড়্যা নিলো?”
“স্যার, ওরা আসলে বুঝতে পারে নাই,” সাফাই গাওয়ার সুরে বলল কায়সার। “ওরা তো এরকম সিচুয়েশনে কখনও পড়েনি। আলভী স্যার প্রথমে ওদের একজনকে অর্ডার করেছিল গুলি করার জন্য, ও করেনি, এরপরই মাথা গরম করে ফেলে,” গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো। “এখন উনি যদি কেড়ে নিতে চান ওরা কী করবে…মারামারি করবে উনার সঙ্গে?”
চোখমুখ তিক্ত হয়ে গেল শাহজাহান করিমের। “আলভী আখা চেইতা গেল ক্যান? ওই লোক কী করছে?”
কথাটা বলতে একটু সঙ্কোচ হলো কায়সারের কিন্তু না বলেও উপায় নেই। এক সময় না এক সময় সবই জানতে পারবে তার নিয়োগদাতা। “ওই লোক সোনিয়ার মার্ডার নিয়ে প্রশ্ন করতেই স্যার ক্ষেপে যান।
“এইটাতে রাগার কী আছে? ঐ অ্যাডভাইজার কি ওরে বলে নাই কী করতে হইবো?”
“উনি বেশ সময় নিয়ে বুঝিয়েছিলেন কিন্তু ইনভেস্টিগেটর যখন বলেছে মেয়েটার ভ্রূণ আলভী স্যারের সঙ্গে ম্যাচ করাবে তখন উনি রেগে যান, বের হয়ে যেতে বলেন…এক কথায় দু কথায় মাথা গরম করে ফেলেন স্যার.. মারতে যান এক পর্যায়ে,” একটু থামলো সিকিউরিটি চিফ। “কিন্তু ওই লোক আলভী স্যারের হাতটা ধরে ফেলে…একটা চড় মারে।”
বিস্ময়ে চোখদুটো গোল গোল হয়ে গেল শাহজাহান করিমের। তার ছেলের গালে থাপ্পড় মারার মতো দুঃসাহস দেখিয়েছে সামান্য একজন সরকারি কর্মচারি!
“এরপরই স্যার রেগেমেগে গুলি করার জন্য অর্ডার দেন।”
লম্বা করে শ্বাস নিয়ে নিলো জাহান গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। “বাইনচোদ!”
কায়সার আহমেদ বুঝতে পারলো না গালিটা কাকে দিলো-জেফরি বেগকে নাকি নিজের ছেলেকে।
উদাস চোখে আবারো লনের দিকে তাকালো জাহান গ্রুপের মালিক। “সকাল সকাল ওইসব নিছিল না?”
চোখ পিট পিট করে তাকালো কায়সার আহমেদ। জাহান গ্রুপের সিইও”র এই একটা মাত্র কথাই আছে যেটা তার বাপের কানে তোলেনি সে। এর অবশ্য কারণও আছে। প্রথমত, সে কখনও আলভীকে দেখেনি কোকেন সেবন করতে। তার সামনে কখনওই এটা করেনি। কোকেন আসক্ত তার কিছু হোমড়া চোমড়া বন্ধুবান্ধব আছে, তারা এলে প্রাইভেট রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। বাইরে থেকে আন্দাজ করা যায় ভেতরে কী হচ্ছে কিন্তু সে কথা তার বাপকে গিয়ে বলার ঝুঁকি নেয়নি। দ্বিতীয়ত, আজকের আগে শাহজাহান সাহেব কখনও এই বিষয়ে জানতেও চায়নি তার কাছে। অন্য অনেকের মতো সে-ও ধরে নিয়েছিল আলভীর বাবা এটা জানে না।
“চুপ মাইরা আছো ক্যান, নিছে না?” তাড়া দিলো শাহজাহান করিম।
“স্যার, আমি কখনও নিতে দেখিনি। উনার বন্ধুবান্ধব এলে প্রাইভেট রুমের দরজা বন্ধ করে আড্ডা দেন, কথা বলেন। আমার গার্ডরা তখন বাইরে থাকে। বেডরুমের মতো প্রাইভেট রুমেও কোনো সিসিক্যাম নেই।”
তিক্তমুখে সিকিউরিটি চিফের দিকে তাকালো শাহজাহান। “সারা দুনিয়া জানে, খালি তোমরা জানো না!”
কথাটা অভিযোগের মতো শোনালেও খণ্ডাতে গেল না কায়সার।
“ঐ হারামজাদাটা হইলো সব নষ্টের মূল!” রেগেমেগে বলল।
কায়সার আহমেদ এবারও ঠিক করলো মুখ বন্ধ রাখার। হারামজাদাটাকে সে-ও চেনে-প্রেসিডেন্টের একমাত্র মেয়ের জামাই।
“ওর পাল্লায় পইড়্যা এইসব বাজে নেশা করা শুরু করছে,” আক্ষেপে মাথা দোলালো শাহজাহান।
অধ্যায় ৩৩
হোমমিনিস্টার সহিদ আখন্দ দীর্ঘদিন ধরে একই মন্ত্রণালয় চালাচ্ছে। তার দল এবং সরকারে কর্মরত লোকজন মনে করে এই পদের যোগ্যতম ব্যক্তি সে। তাকে দেখলে মনে হবে আলাভোলা একজন মানুষ কিন্তু ভেতরের লোকটি সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রয়োজনে কঠোর এবং নমনীয় দুটোই হতে পারে। তার সবচেয়ে বড় গুণ, কী ভাবছে সেটা তার অভিব্যক্তি দেখে বোঝা যায় না সহজে।
এ মুহূর্তে হোমিসাইডের মহাপরিচালক ফারুক আহমেদও বুঝতে পারছে না মিনিস্টারের মাথার ভেতরে কী চলছে। আলভীর গুরুতর অপরাধের কথা শোনার পর চুপ মেরে আছে।
বেশ কাঠখড় পুড়িয়ে আজকের এই সাক্ষাতের সময়টা পেয়েছে। হোমমিনিস্টারের পিএসকে যখন জানালো স্যারের সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে দেখা করতে হবে, প্রথমে তাকে বলা হলো, পরে জানানো হবে অ্যাপয়েন্টমেন্টের ডেট। ফারুক আহমেদ তখন বলেছিল এটা আর সব বিষয়ের মতো না, খুবই জরুরি একটা বিষয়, অপেক্ষা করা যাবে না। যতো তাড়াতাড়ি মিনিস্টারকে জানানো যাবে ততই মঙ্গল।
সঙ্গত কারণেই এ কথা শোনার পর পিএস জানতে চেয়েছিল কী ঘটেছে। হোমিসাইডের ডিজি কেবল বলেছে, জাহান গ্রুপের আলভী চিফ ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে আজকে। ব্যাপারটা খুবই গুরুতর, মিনিস্টারকে এখনই না জানালে বড় কোনো ঘটনা ঘটে যাবে। এরপরই পিএস তাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে, দশ মিনিট পর কল ব্যাক করে জানায় সন্ধ্যার পর চলে আসতে।
ফারুক আহমেদ জানে পিএস কেন এতটা তৎপর হয়েছিল। লোকটা হোমিসাইডের জেফরি বেগের বিরাট বড় ভক্ত। কয়েক বছর আগে এই লোকের এক নিকটাত্মীয়ের খুনের ঘটনা তদন্ত করেছিল হোমিসাইড, খুবই দ্রুততার সঙ্গে কেসটার সুরাহা করতে পেরেছিল বলে নিজে হোমিসাইডে এসে জেফরিকে ধন্যবাদ দিয়ে গেছিল।
“এই ছেলেটা, কী আর বলবো…” অনেকক্ষণ পর মুখ খুলল হোমমিনিস্টার। “… দিন দিন তার বাড়াবাড়ি লিমিট ক্রস কইরা যাইতাছে।”
ফারুক আহমেদ মাথা নেড়ে সায় দিলেও কথাটা তাকে খুশি করতে পারলো না। মন্ত্রির কণ্ঠে কেমনজানি নরম সুর আর সেটা আগে থেকেই আন্দাজ করতে পারছিল। তবে আজকে সে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছে, সোজাসাপ্টাভাবে পরিস্কার একটা পদক্ষেপ আশা করছে। সান্ত্বনা বাণী শোনার কোনো ইচ্ছে তার নেই।
“আমাদের চিফ ইনভেস্টিগেটর আলভীর বিরুদ্ধে কেস করবে…” হোমিসাইডের ডিজি বলল। “…তিনটা।”
চোখ কুঁচকে তাকালো মিনিস্টার। “তিনটা ক্যান?”
“অ্যাটেম্প টু মার্ডার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাজে বাধা দেয়া এবং বেআইনিভাবে বিদেশি বডিগার্ড রাখা।
গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে সায় দিলো মন্ত্রি। “বিদেশি বডিগার্ড রাখার আইন নাই সত্য, আবার আইনে নিষেধও নাই, বুঝলেন?”
ফারুক আহমেদ মোটেও বুঝতে পারছে না। আইনে নাই মানে কাজটা করা যাবে না-এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা। উকিলদের মতো মন্ত্রিও যদি আইনের অপব্যাখ্যা দেয় তাহলে কেমনে!
“তারে দুইটা কেস করতে কন,” পরামর্শ দেবার সুরে বলল। “বডিগার্ড রাখার ব্যাপারটা বাদ দিয়া…”
“ঠিক আছে, স্যার,” ফারুক আহমেদ সায় দিলো। বুঝতে পারলো হোমমিনিস্ট্রি থেকে মৌখিক পারমিশান নিয়েই বিদেশি বডিগার্ড রেখেছে।
“আলভীরে যে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেল আপনার ওই জেফরি বেগ, আপনারে এইটা জানাইছিল সে?”
“জি, স্যার।”
“আপনি আমারে জানাইবেন না?” সামান্য বিরক্ত হলো মন্ত্রি। “জানানো তো উচিত ছিল।”
“স্যার, সন্দেহভাজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা তো সাধারণ প্রসিডিউর, আগে কখনও এসব কাজের জন্য জানানোর দরকার পড়েনি। ও যদি অ্যারেস্টের ওয়ারেন্ট ইসু করতো তাহলে আমি অবশ্যই আপনাকে জানাতাম।”
গম্ভীর মুখে মাথা নাড়লো হোমমিনিস্টার।
“জেফরি কিন্তু অভিযুক্ত আসামির মানসম্মান আর সোশ্যাল স্ট্যাটাসের কথা ভেবে হোমিসাইডে ডাকেনি, অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে ওর বাড়িতে গেছিল। উনি তো অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছিলেনই…আমার অফিসার জোর করে বাসায় ঢোকেনি। তারপরও এমন কাজ করলো কীভাবে!”
“হুম। ওই কেসটার কী অবস্থা?”
“স্যার, মেয়েটার বড় বোন আলভীর নামে কেস করেছে, জাহান গ্রুপের এক কর্মকর্তা পোস্ট মর্টেমের ডাক্তারকে দশ লাখ টাকা ঘুষ দিতে গিয়ে আমাদের হাতে ধরা পড়েছে, ইন্টেরোগেশনে ডাক্তার সব স্বীকার করেছে, এরপরই জেফরি জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য…”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল হোমমিনিস্টার।
“স্যার, ওরা অনেক শক্তিশালী সেটা আমিও জানি কিন্তু ওরা তো সরকারের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হতে পারে না। খুন করে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে, তদন্তকারী কর্মকর্তাকে গুলি করবে, এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।”
“টাকা, বুঝলেন…টাকার গরমে মাথা ঠিক থাকে না।”
ফারুক আহমেদ চুপ মেরে রইলো, অপেক্ষা করলো মন্ত্রণালয়ের প্রধান কী সিদ্ধান্ত দেয় তার জন্য।
“ওয় তো ওর বাপরেও মানে না ঠিকমতো। বেয়াদব একটা।”
কে কার বাপকে মানে না তা নিয়ে হোমিসাইডের মহাপরিচালকের কোনো মাথা ব্যথা নেই। এটা ওদের পারিবারিক সমস্যা। সে এখানে এসেছে গুরুতর একটি সমস্যা নিয়ে। “স্যার, কিছু মনে করবেন না, সাবোর্ডিনেটদের কাছে আর ছোটো হতে চাই না।”
স্থিরচোখে তাকালো মন্ত্রি। একটা ভাবনার উদ্রেক হয়েছে তার মনে। বুঝেও না বোঝার ভাণ করলো। “বুঝলাম না?”
“এই ঘটনার সুরাহা না হলে আমি পদত্যাগ করতে বাধ্য হবো। “আরে, আপনিও দেখি অস্থির হইয়া গেলেন!”
“স্যার, এটা অস্থিরতা না, হতাশা। আমার ডিপার্টমেন্টের সবাই ক্ষেপে আছে।”
“আপনার কী মনে হয়, আমি এসব বুঝি না?” আন্তরিকতার সঙ্গে বলল মন্ত্রি। “ওদের কাণ্ডকীর্তির সম্পর্কে খোঁজ রাখি না?” বাঁকা হাসি দিলো। “সব জানি কিন্তু এত বড় একটা গ্রুপ, হাজার হাজার লোক চাকরি করে, দেশের ইকোনমিতে কন্ট্রিবিউট করে, তাই একটু ছাড়-টার দেয় সরকার। এইটারে দুর্বলতা ভাবলে ধরা খাইবো ওরা, বুঝছেন?”
“জি, স্যার।”
“আপনারা যা করতে চান করেন, কোনো সমস্যা নাই। আপনার ডিপার্টমেন্ট তো আমার নিজের ডিপার্টমেন্ট, নিজের গায়ে হাত পড়ছে…আমি বইসা থাকুম, ভাবছেন?”
উদ্বেলিত হয়ে পড়লো হোমিসাইডের ডিজি। “থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।” তার কাছে মনে হলো হোমমিনিস্টার সত্যি সত্যি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের বটবৃক্ষ।
“আপনার ইনভেস্টিগেটরকে বলবেন, তার সাথে যা হইছে খুব খারাপ হইছে, সে যেন আইন মোতাবেক যা করার করে, আইনের বাইরে যেন না যায়, ঠিক আছে?”
“জি, স্যার।” ফারুক আহমেদ, বুঝতে পারলো এই মিটিংটা শেষ। উঠে দাঁড়ালো সে। “তাহলে আসি, স্যার?”
মৌন সম্মতি দিলো হোমমিনিস্টার।
নিঃশব্দে সালাম দিয়ে মন্ত্রির ঘর থেকে বের হয়ে যাবার সময় হোমিসাইডের মহাপরিচালকের গর্বে বুক ফুলে উঠল।
অধ্যায় ৩৪
হোমিসাইডের নিজস্ব লিগ্যাল কনসালটেন্ট আছে, তার সঙ্গে আলাপ করে জেফরি বেগ জেনে নিয়েছে কিভাবে মামলাগুলো করবে। আইনজীবি তাকে একটা খসড়াও করে দিয়েছে, কফিতে চুমুক দিতে দিতে সেটায় চোখ বোলাচ্ছে এখন।
এমন সময় ডেস্কের উপরে রাখা তার মোবাইলফোনটা বেজে উঠলে ফিরে তাকালো সে। ডিসপ্লেতে রেবার নাম্বারটা দেখে কয়েক মুহূর্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না ধরবে কি ধরবে না। যদি না ধরে মেয়েটা ধরে নেবে সে রাগ করে আছে এখনও। কাল রাতে তার ফোন ধরেনি। সকালে উঠে মেসেজ দিয়েছিল “ঘুমিয়ে পড়েছিলাম” লিখে।
কথাটা সত্যি না। কাল রাতে তার ঘুম অনেক দেরিতে এসেছে।
অবশেষে ফোনটা তুলে নিলো। “কী খবর তোমার, কেমন আছো?”
“ভালো। তোমার খবর কী?” ওপাশ থেকে থমথমে কণ্ঠে বলল রেবা। “এই তো, আছি।”
“বাসায়?”
“না. অফিসে…জরুরি কাজ আছে, ওটা শেষ করে যাবো।”
“সোনিয়ার কেসটা নিয়ে?”
অবাক হলো জেফরি বেগ। সোনিয়ার কেসের কথা রেবাকে সে বলেনি এখন পর্যন্ত। “তুমি কিভাবে জানলে?”
“ফেসবুকে দেখলাম…একটা নিউজ পোর্টালের রিপোর্ট…তোমার নামও আছে ওখানে।”
ভুরু কপালে উঠে গেল হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটরের। দিলান মামুদ তাহলে সতি সত্যি ভাইরাল করে দিয়েছে নিউজটা। “ওহ্। আমি তো ভাবলাম দেশের কোনো পত্রিকা আর টিভি চ্যানেলে যেহেতু আসেনি কেউ জানে না এটার কথা।”
“ওটা এখন ভাইরাল, সবাই জানে।”
“দ্যাটস গুড।”
“গুড?” ওপাশ থেকে রেবা অবাকই হলো।
“হ্যাঁ। জাহান গ্রুপ ইনভল্ভ তো…কোনো পত্রিকা বিজ্ঞাপন হারাতে চায় না বলে খবরটা ছাপায়নি।”
“তোমাকে নিয়ে আমার চিন্তা হচ্ছে খুব।”
“কেন?”
“জাহান গ্রুপ অনেক পাওয়ারফুল, তুমি ওদের সিইও”র অ্যাগেইনস্টে তদন্ত করছো, ওরা তো পুলিশ-আদালত কিছুই পরোয়া করে না, সরকারের উপর মহলের সঙ্গে ভালো খাতির আছে।”
“এটা কি নতুন কিছু,” বলল জেফরি। “কতো মোকাবেলা করলাম এগুলো!”
“হুম, তারপরও ভয় হচ্ছে আমার।”
“ভয় পেয়ো না, ওকে?” একটু থেমে আবার বলল, “উনার কী অবস্থা?”
“অনেক কষ্ট পাচ্ছে,” বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলল রেবা। “কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারছি না।”
“কী যে বলো, তোমরা চেষ্টা কম করেছো?” গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো। “আমি একটু সময় করে দেখতে আসবো, ঠিক আছে?”
“হ্যাঁ, এসো…আব্বার উপরে রাগ করে থেকো না। আমার উপরেও না।”
“তোমার উপরে রাগ করলাম কখন?” মুচকি হেসে বলল জেফরি।
“ঐ যে কফি-ইনসিডেন্ট!”
“হা-হা-হা,” প্রাণখোলা হাসি দিলো। “আমি বিরক্ত হয়েছিলাম, ওকে? সেটাও কিছুক্ষণের জন্য।”
“কাল রাতে তো ফোন ধরোনি?” অভিমানের সুরে বলল।
“আরে, দুয়ে দুয়ে চার মেলাবে না…” আশ্বস্ত করে বলল মেয়েটাকে। “কাল আসলেই টায়ার্ড ছিলাম, বিছানায় যেতেই ঘুম এসে পড়েছিল।” সত্যিটা হলো আলভীর এমন কাণ্ড হজমই হচ্ছিল না তার। বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পর আবারো এই বিষয়টা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। কারো সঙ্গে তখন কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না।
“ঠিক আছে, বিশ্বাস করলাম।”
“থ্যাঙ্কস গড!” হালকা চালে বলল জেফরি।
“ওকে, তাহলে রাখি, ফ্রি হলে জানায়ো…দেখা করবো।”
“ওকে।”
“কী হলো, লাভ ইউ বলছো না…কিসিও দিচ্ছো না?”
“সরি, ভুলে গেছিলাম।”
“আজকাল অনেক কিছুই ভুলে যাও।” আবারো অভিমানের সুর।
“সেটা কিন্তু যেখানে সেখানে যার তার সাথে কফি খাওয়ার কারণে না!” এবার মুখ টিপে হেসে ফেলল রেবা। “হুম, বুঝেছি।”
“লাভ ইউ! মমমমউয়া!”
“লাই ইউ টু, জেফ।”
ফোনটা ডেস্কের উপর রাখতেই একটা কণ্ঠ বলে উঠল :
“স্যার?” আরদার্লি ছেলেটা দরজা দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে রেখেছে। “ডিজি স্যার আপনারে ডাকছেন।”
“যাও, আমি আসছি।” সম্ভবত এই ছেলে তার কিসি-পর্বটা দেখেছে এবং শুনেছে। এখন রসিয়ে রসিয়ে বাকি কর্মচারিদেরকে না বললেই হয়। হাতের কাগজটা রেখে উঠে দাঁড়ালো জেফরি বেগ।