কনে হল বিধবা

কনে হল বিধবা

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো নিজেকে দেখল মণিকা। বিধবার বেশে কোনও ত্রুটি নেই। অথচ এই সেদিন বেনারসী পরে শিবমন্দিরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সে। আশা ছিল এই আয়নার সামনে বেনারসী পরেই স্বামীর পাশে দেখবে নিজেকে। কিন্তু…।

মণিকার চোখ শুকনো কেন? জবাব দিল মণিকার মন। বলল–মণিকা তো বেঁচে নেই।

আলমারি থেকে টাকার বাণ্ডিলটা বার করে আনল মণিকা। পাঁচ ভাগ করে রাখল সুটকেসের ওপর। প্রতিটি ভাগে রইল সমান পরিমাণ টাকা। একদৃষ্টে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল পাঁচ থাক টাকার দিকে। বুকের তুফানের ছায়াও পড়ল না চোখের তারায়। কী করে পড়বে? মণিকা তো বেঁচে নেই!

কেবল পাঁচ থাক টাকার প্রতিফলন পাঁচ-পাঁচটি ধিকিধিকি প্রতিজ্ঞাস্বরূপ জ্বলতে লাগল ওর বিশাল দুই চোখে।

বউমা, মণিকার শাশুড়ি ঘরে এলেন। বউমা, আমার কথা রাখো। যেও না।

না, মা, যেতে আমাকে হবেই।

শাশুড়ি আর পীড়াপীড়ি করলেন না। একশো টাকার নোটের একটা তাড়া মণিকাকে দিয়ে বললেন–তপনের সারাজীবনের সঞ্চয়। নাও। মনে রেখো আমার শেষ কথাটা–যেদিন মন চাইবে, সেদিনই ফিরে আসবে।

সুটকেস খুলল মণিকা। পাঁচ থাক টাকা একসঙ্গে করল। শাশুড়ির দেওয়া টাকা রাখল তার ওপর। সুটকে বন্ধ করে বলল–মা, চললাম।

শাশুড়ি এবার কেঁদে ফেললেন।

.

রাস্তায় নেমে এল মণিকা। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সেই ফুটফুটে মেয়েটা। সবুজ ফ্রক উড়ছে জোর হাওয়ায়। বেণীর ডগাটা অস্থিরভাবে কামড়াচ্ছে ছোট ছোট দাঁত দিয়ে।

মণিকাকে দেখেই দৌড়ে এল কাছে–মাসিমা, চলে যাচ্ছেন?

হ্যাঁরে।

আমি সঙ্গে যাব?

আয়।

স্টেশন বেশি দূরে নয়; বড় জংশন; ইলেকট্রিক ট্রেন হরবখৎ যাচ্ছে আসছে। প্ল্যাটফর্মে কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই এল কলকাতাগামী ট্রেন। ফুটফুটে মেয়েটার গাল টিপে দিয়ে একটা ফাস্ট-ক্লাস কামরায় উঠে পড়ল মণিকা।

উল্টোদিকের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে তখন যদি কেউ মণিকার গতিবিধি নজরে রাখত, তাহলে একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়ত। দেখত, মণিকা কামরার একদিকের দরজা দিয়ে ভেতরে উঠল বটে–কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আর একদিনের দরজা দিয়ে নেমে পড়ল রেল লাইনের খোয়র ওপর। সেখান থেকে প্ল্যাটফর্মে উঠে ওভারব্রিজ পেরিয়ে মিশে গেল ভিড়ের মধ্যে।

.

চোদ্দোতলা ফ্ল্যাটবাড়ি; একতলায় মেঝে মুছছিল প্রসাদী। প্রসাদী এ বাড়ির ঝাড়ুদারও বটে, দারোয়ানও বটে। কো-অপারেটিভ হাউসিং স্কিমে তৈরি ফ্ল্যাটবাড়ির সবাইকেই সমান যত্ন করার দায়িত্ব তার।

হলঘরের মোজেক মেঝে মুছছে প্রসাদী। ঘরে আর কেউ নেই। তাই গান ধরেছে গলা ছেড়ে। পুরু লেন্সের সুতো বাঁধা চশমাটা মাঝে মাঝে পিছলে নেমে আসছে নাকের ডগায়। সেই অবস্থাতেই মেরে স্বপ্নেকী রাণীকে ডাকছে তারস্বরে।

আচমকা স্তব্ধ হল রাসভ কণ্ঠ। কারণ, প্রসাদীর অদূরে ভোজবাজীর মতো এসে দাঁড়িয়েছে একটি নারীমূর্তি। আগুনের মতো রূপ তার। অঙ্গ ঘিরে বেনারসীর বাহারে সে-রূপ যেন দাবাগ্নির মতো লেলিহান।

মেয়েটি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে প্রসাদীর দিকে। মুখে কথাটি নেই। কিন্তু বিশাল দুটি চোখে যেন কিসের অনুনয়।

প্রসাদী তার কর্তব্য করল–কাকে খুঁজছেন?

ব্যারিস্টান বারীন বাগচিকে।

উনি তো এখন থাকেন না। কখন থাকেন?

সন্ধের পর। আর সকালের দিকে।

কামরা নম্বর?

পঁয়তাল্লিশ। দশতলার বি ব্লক।

ফোন আছে?

হ্যাঁ।

কত নম্বর?

নম্বর জানতে বারীন বাগচির চিঠির খুপরির সামনে গেল প্রসাদী। তারপর নম্বর বলতে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল, মেয়েটি নেই।

.

সেইদিনই সন্ধ্যের পর বারীন বাগচির টেলিফোনে ভেসে এল নারীকণ্ঠ।

আপনি ব্যারিস্টার বাগচি?

দ্যাটস মি।

মেয়েটি আর কোনও জবাব দিল না। রিসিভার রাখার শব্দ ভেসে এল।

ভুরু কুঁচকে সিগার কামড়ে ধরল বারীন বাগচি। ব্যাপারটা যেন কেমনতর। এই মেয়েটিই কি আজ দুপুরে তার খবরাখবর নিয়ে গেছে প্রসাদীর কাছে?

পরের দিন সকালবেলা আবার টেলিফোন ভেসে এল সেই নারীকণ্ঠ।

বারীন বাগচি?

স্পিকিং।

টুকরো হাসি–আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাই।

কেন?

আলাপ হলেই বুঝবেন।

আজকে আসুন। ফ্ল্যাটে একটা টি-পার্টি দিচ্ছি। সন্ধ্যে ৭টা। আলাপ করার উপযুক্ত সময়।

থ্যাকংস। লাইন কেটে গেল।

.

সারাদিন রহস্যময়ীর কথাগুলো পাক খেল বারীন বাগচির ব্যাচেলার মগজে। রোমান্স? মন্দ কি!

সন্ধে নাগাদ ফ্ল্যাটে যখন টি-এর ফাঁকে ফাঁকে দু-চারটে গেলাসের রঙিন পানীয় বিলি হচ্ছে। ঠিক তখনি একটি আশ্চর্য সুন্দরী মেয়ের দিকে বারীনের দৃষ্টি আকর্ষণ করল তার বন্ধু সঞ্চয়।

বলল–বারীন, মেয়েটাকে কখনো দেখেছি বলে তো মনে হচ্ছে না। তোর নতুন বান্ধবী নাকি? সমানে তোর দিকেই তাকিয়ে আছে।

চকিতে তাকাল বারীন। দেখল, দরজার ঠিক পাশটিতে দাঁড়িয়ে যেন মূর্তিমতী প্রদীপশিখা। মানুষ এত রূপবতীও হয়?

মন্ত্রমুগ্ধের মতো পায়ে পায়ে মেয়েটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল বারীন। হাতের মদের গ্লাস হাতেই রইল। চোখে চোখ লেগে রইল চুম্বকের মতো।

আপনি?

মেয়েটি হাসল। বারীন দেখল, মোনালিসা যেন মূর্ত হল হাসির মধ্যে।

বারীন বলল–আপনি ফোন করেছিলেন?

জবাব দিল না অপরূপা। বিশাল নয়নের চাহনি ফিরল চওড়া বারান্দার দিকে। বারান্দায় আলো-আঁধারি, জাপানি ফানুস আর ক্যাকটাস।

বুঝল বারীন। পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়াল ব্যালকনিতে। একপাশে সেই মেয়েটি। আর একপাশে সঞ্জয়।

জাপানি ফানুসের রামধনু-রশ্মির মধ্যে পরীর মতো চেয়ে আছে মেয়েটি।

বারীন বিস্মিত। বিস্মিত সঞ্জয়ও। বিস্ময়ের মাঝেই হাতের গ্লাস ঠোঁটের কাছে তুলেছিল বারীন। কিন্তু ঠোঁটের সঙ্গে পানীয়র মিলন হওয়ার আগেই হাত থেকে গ্লাসটা টেনে নিল মেয়েটি। নিয়ে গেলাস উপুড় করে ধরল পাশের ক্যাকটাসের টবে।

বলল সঞ্জয়কে–চা আনবেন?

সঞ্জয় বেরিয়ে গেল।

মেয়েটি বলল–হ্যাঁ, আমিই ফোন করেছিলাম। আমিই দেখা করতে এসেছিলাম। আমার নাম মণিকা। আমি বড় একা।

বারীন কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

মণিকা কাশ্মিরী শালটা গা থেকে খুলে মেলে ধরল বারান্দার বাইরে। হাওয়ায় বেশ টান। ঝড়ের টান। হাত থেকে শালটা খসে গিয়ে আটকে গেল হাততিনেক দূরে ঝুলন্ত রেডিও এরিয়ালের কঞ্চিতে।

মণিকা বললে–এনে দেবেন? চোখে অনুনয়।

বারীন ব্যালকনির রেলিং টপকে দাঁড়াল সরু কার্নিশের ওপর। অবাক চাহনি তখনো মণিকার বিশাল চোখের ওপর। তারপর এক হাতে রেলিং ধরে ঘুরে দাঁড়িয়ে যেই আর এক হাত বাড়িয়েছে শালের দিকে, অমনি দু-হাতে তাকে প্রচণ্ড ধাক্কা মারল মণিকা।

রেলিং থেকে হাত খসে গেল বারীনের। দশতলার ব্যালকনি কার্নিশ থেকে দেহটা পাকস্লট খেয়ে আছড়ে পড়ল একতলার লনে।

চেঁচিয়েছিল বারীন, কিন্তু কেউ শুনতে পায়নি। ঘরে তখন জাজ মিউজিকের ধুম পড়েছে।

মণিকা এ-দরজা সে-দরজা দিয়ে উধাও হয়ে গেল। কাশ্মীরী শালটা হাওয়ার টানে এরিয়েল থেকে উড়ে গিয়ে ভেসে গেল নীচতলার একটা বাড়ির ছাদে।

চায়ের ট্রে নিয়ে সঞ্জয় এসে দেখল ব্যালকনি শূন্য।

.

দিনকয়েক পরে।

মঘা দত্ত ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যেতেই রামদাস ঝাড়ন ফেলে আলমারি খুলে বার করল হুইস্কির বোতল। মঘা দত্তর হুইস্কির বোতল। বিপত্নীক মঘার এই এক বদভ্যেস। ফ্ল্যাটে বসে মদ গেলা চাই।

রামদাস তার ফাইফরমাশ খাটে। ঘরদোর সাফ করে। রান্না-বান্নাও করে দেয়। বাবুর দেখাদেখি তারও ইদানীং সখ হয়েছে হুইস্কি গেলার। তাও চুরি করে। মঘা দত্ত বেরিয়ে গেলেই রোজ খাওয়া চাই এক ঢোক। তারপর অবশ্য বেসিন থেকে জল ঢালতে হয় বোতলে। কেননা মঘা ভারি হুঁশিয়ার। হুইস্কির বোতলে রোজ কলম দিয়ে দাগ দিয়ে রাখে। লুকিয়ে-চুরিয়ে রামদাস তবুও হুইস্কি খায়। খেয়ে জল ঢেলে দাগে দাগ মিলিয়ে রাখে।

সেদিনও এক ঢোক গিলল রামদাস। জল মেশালো। বোতলটা আলমারিতে ফিরিয়ে দেওয়ার আগেই দারুণ চমকে উঠল।

খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে এক পরমাসুন্দরী। বিশাল চাহনি রামদাসের ওপর।

বোতলটা তাড়াতাড়ি পেছনে লুকালো রামদাস। বলল–কাকে চাই?

মঘা দত্ত।

নেই।

কখন থাকবেন?

সন্ধের পর।

তোমার নাম?

রামদাস।

বাবুর দেখাশোনা করো?

আজ্ঞে।

বাবুর সময় কাটে কী করে?

আজ্ঞে, সিনেমা দেখে, আড্ডা মেরে, বই পড়ে—

খুব সিনেমা দেখেন?

থিয়েটারও।

ও।

আজ্ঞে, বাবু এলে কি বলব?

হাসল মেয়েটি–পেনসিল আছে? কাগজ আছে। আনো, চিঠি লিখব।

বোতল সামলাতে সামলাতে কাগজ-পেনসিল আনতে পাশের ঘরে গেল রামদাস, ফিরে এসে দেখল মেয়েটি নেই।

.

মঘা দত্ত ফ্ল্যাটে ফিরেই লেটারবক্সে একটা খাম পেল। ভেতরে সবুজ কাগজে দু-লাইন চিঠি আর একটা থিয়েটারের বক্স-টিকিট।

সবুজ কাগজে ল্যাভেন্ডারের সৌরভ। চিঠির দু-লাইনে রোমান্সে ইঙ্গিত।

প্রিয়,
আলাপ করতে চাই। আসছেন তো?

মাথা ঝিমঝিম করে উঠল মেঘা দত্তর। এমন সময়ে রামদাস এল। সেই পরমাসুন্দরীর আবির্ভাব-বৃত্তান্ত রসিয়ে রসিয়ে বলল।

মঘা দত্তর স্থাণুর মতো বসে রইল খাটের ওপর।

.

থিয়েটার-হল।

বক্সে ঢুকে মঘা দেখল, কেউ নেই। এদিকে থিয়েটার শুরু হল বলে। তবে কি ঠাট্টা করল কেউ?

থিয়েটার শুরু হল। আস্তে আস্তে কমে এল মঘার ছটফটানি। মন যখন থিয়েটারের মঞ্চে, ঠিক তখনি বক্সের ছায়ামায়ায় এসে দাঁড়াল সেই মেয়েটি। নাম তার মণিকা।

দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। অনিমেষে চেয়ে রইল মঘার পানে। ভাবলেশহীন চাহনি। তারপর এসে বসল পাশে।

মঘা যেন আইসক্রিমের মতোই গলে গেল। মেয়েটা চেয়ে আছে মঞ্চের দিকে। নিশ্চল তনু।

বলল–আমার নাম মণিকা।

অঃ।

আপনার সঙ্গে অনেক কথা আছে।

অ্যাঁ।

এখানে বলব না।

হোটেলে?

না, আপনার বাড়িতে।

তাই নাকি? এ যে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া। কবে?

কাল। আর কেউ থাকুক আমি চাই না। একটু থেমে, শুধু আপনি আর আমি।

মঘার যেটুকু বাকি ছিল, এবার তাও গেল।

.

মঘা দত্তর ফ্ল্যাটের ধুলো ঝেড়েছে মঘা। সাজিয়েছে। রজনীগন্ধার স্টিক আর বেল-জুইয়ের গন্ধে ঘরে কেমন ফুলশয্যার আমেজ এনেছে।

মঘা নিজেও সেজেছে। বুকে খুশির তুফান।

তুফান ছুটে যেত যদি সেইমুহূর্তে মঘা দত্তর তৃতীয় নয়ন খুলে যেত। এবং সেই তৃতীয় নয়নে ভেসে উঠত সেই শহরেরই একটি দামি হোটেলের কক্ষ।

দেখা যেত, খাটের ওপর একটা গোটা হুইস্কির বোতল নিয়ে বসে মণিকা। এক হাতে একটা ইঞ্জেকশন দেবার সিরিঞ্জ। সিরিঞ্জভর্তি সাদা আরক। চুঁচটা ছিপি ফুঁড়ে বোতলের ভেতর ঢুকিয়ে দিল মণিকা। সাদা আরকটা মিশিয়ে দিল হুইস্কির সঙ্গে।

মঘার ফ্ল্যাটে মণিকা এল ব্যাগের মধ্যে আরকমিশানো বোতল নিয়ে। মঘার প্রথম উচ্ছ্বাস কমতেই ভিজে গলায় বলল–আমি জানি আপনি কী ভালোবাসেন।

কী?

হুইস্কি।

মঘা কাষ্ঠহাসি হাসল।

মণিকা বলল–হুইস্কি আমি খাই না। ভারমুথ ছাড়া কিছু ছুঁই না। কিন্তু আপনি যা ভালোবাসেন তাই দিয়েই শুরু হোক আমাদের প্রথম পরিচয়। ব্যাগ থেকে বেরুলো হুইস্কির বোতল। বিলিতি স্কচ। একশো টাকা এক বোতল। নিন, দু-গেলাস ঢালুন।

মঘার চোখ শামুকের চোখের মতো উদ্ধত হল। মাথায় টাইফুনের ছোঁয়া লাগল। ত্বরিতপদে উঠে গেল বোতল হাতে। ফটাৎ করে খুলল ছিপি। পর দু-গ্লাস খাঁটি (!) স্কচ ঢেলে সোডা পাঞ্চ করে রাখল মণিকার সামনে।

মণিকা আকাঁপা আঙুলে একটা গ্লাস তুলে নিল। আকাঁপা চোখে মঘার পানে চাইল। গ্লাসে গ্লাস ঠেকিয়ে বলল–চিয়ার্স।

গ্লাস শূন্য করে দিল মঘা। মণিকা গ্লাস হাতে রাখল। বলল–আর এক গ্লাস খান। তারপর কথা।

মঘা উঠে গেল গ্লাস ভরতে। সঙ্গে-সঙ্গে রজনীগন্ধার ফুলদানীতে হাতের গ্লাস উপুড় করে ধরল মণিকা।

মঘা ফিরে এসে দেখল শূন্য গ্লাস কোলে নিয়ে বসে মণিকা। বিলোল আঁখিতে কালো ইশারা।

পুরো গ্লাসটা এক ঢোকেই শেষ করল মঘা। মাথার মধ্যে মৃত্যুর ঐক্যতান শুরু হল সেই মুহূর্ত থেকে।

প্রথমে মঘা বোঝেনি। মনে হয়েছিল স্কচের নেশা। তারপর মাথার খোঁচা যখন চোখেও এসে পৌঁছোল, তখন ভাবল জবর স্কচ তো! দু-পেগেই এফেক্ট! তারপর চোখ ঘোলাটে হয়ে এল। বিশ্বসংসার ঝাপসা হয়ে এল। মেঝের ওপর সটান আছড়ে পড়ল মঘা।

মণিকা উঠে দাঁড়াল। মঘার দিকে তাকালো না। গেলাসদুটো নিয়ে বেসিনে ধুয়ে তুলে রাখল। আরকমিশানো হুইস্কির বোতল বেসিনে উপুড় করে ঢেলে দিল। খালি বোতলটা রাখল ব্যাগের মধ্যে।

মঘা তখন পুঁকছে। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে পাশে বসল মণিকা। চেয়ে চেয়ে দেখল, মঘা মরছে; ভয়ানক কষ্ট পাচ্ছে।

বলল–শুনতে পাচ্ছেন?

কাতরে উঠল মঘা।

মণিকা বলল–স্কচে আমি বিষ মিশিয়ে আপনাকে খাইয়েছি। এখুনি মরবেন। আর দেরি নেই। মরবার আগে নিশ্চয় জানতে ইচ্ছে করছে, কেন আপনাকে মারলাম। তাই বলছি। শুনুন, কেন-র উত্তর একবছর আগে একটা শিবমন্দিরের সামনে রয়েছে। নতুন বউ নিয়ে শিবকে প্রণাম করতে গিয়েছিল একজন। মন্দির থেকে বেরোতে না বেরোতেই বিধবা হয়েছিল কনে বউ।

এই পর্যন্ত বলে থামল মণিকা। শোনবার মতো কেউ আর ছিল না ঘরে।

অনেক রাতে রামদাস এসে দেখেছিল মেঝের ওপর মরে কাঠ হয়ে শুয়ে তার বাবু।

.

অন্য একটি শহরতলী।

স্কুল। সবে ছুটি হয়েছে। বাচ্চা মেয়েটার হাত ধরে তার মা রওনা হয়েছে বাড়ির দিকে। মেয়েটি বার বার ফিরে তাকাচ্ছে পেছনে।

কোয়ার্টার এসে গেছে। সামনে খানিকটা সবুজ লন। তারপর দোতলা বাড়ি। হালফ্যাসানি। বোগানভালিয়ার থোকা আর রংবেরঙের ফুল দিয়ে সাজানো চত্বর।

ফটক দিয়ে ঢোকবার সময়ে আবার পেছন ফিরে তাকালো মেয়েটি। স্কুলের উষাদির মতো দেখতে মেয়েটা এখনো আসছে। বেশ দেখতে।

ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালো পিছু নেওয়া মেয়েটি; নাম তার মণিকা।

বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হল না। খেলতে বেরিয়েছে বাচ্চা মেয়েটি। রঙিন প্লাস্টিকের বল নিয়ে ছুটোছুটি করছে সবুজ লনে। একবার ফটক দিয়ে রাস্তায় ঠিকরে গেল বলটা। ধরে ফেলল মণিকা। হাসিমুখে তাকিয়ে রইল বাচ্চা মেয়েটির দিকে। কাছে ডাকল হাত নেড়ে।

ভয় পেল না ছোট্ট মেয়েটি। স্কুলের উষাদির মতোই তো দেখতে। কী সুন্দর হাসি। স্কুল থেকেই তো পেছন পেছন এসেছে।

কাছে গেল মেয়েটা। মণিকা বলটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল–কী নাম তোমার?

ঝুমি।

বাঃ, কী সুন্দর নাম। আমার নাম উষাদি তোমাদের স্কুলে পড়াই।

তোমার নামও উষাদি?

হ্যাঁ গো। তোমার মায়ের নাম কী? শ্রীমতী বনমালা লাহিড়ী। সাবাস। তোমার মামার বাড়ি কোথায়?

অনেকদূর।

কোথায়?

আগরতলায়।

তোমার মামা আছেন?

হ্যাঁ।

আগরতলায় থাকেন?

হ্যাঁ।

কী নাম জানো?

পন্টু মামা।

দাদু আছেন?

হ্যাঁ।

আগরতলায় থাকেন?

হ্যাঁ।

এইসময়ে দোতলার জানলা দিয়ে ডাক দিল ঝুমির মা–ঝুমি, ভেতরে এসো। বল নিয়ে এক দৌড়ে ভেতরে চলে গেল ঝুমি।

.

মণিকা প্লেনে আগরতলা গেল। সেখান থেকে একটা টেলিগ্রাম পাঠালো ঝুমির মা শ্রীমতী বনমালা লাহিড়ীকে।

টেলিগ্রাম হাতে পেয়ে শ্রীমতী বনমালা লাহিড়ী দেখল, ভাই লিখছে বাবার শেষ অবস্থা; এখুনি না এলেই নয়।

কাজেই পরের প্লেনেই আগরতলা রওনা হল ঝুমির মা। ঝুমির বাবার কাছে রেখে গেল ঝুমিকে। ঘরসংসার দেখার জন্যে ঠিকে ঝি, রাঁধুনি তো আছেই। কোনও অসুবিধে হবে না। ঝুমির বাবা অফিস গেলে ঠিকে ঝি-ই সারাদিন বাড়ি আগলাবে-খন।

সেইদিন রাত্রে ঝড় উঠল। দরজার কড়া নড়ল। ঝুমির বাবা ঝুমিকে নিয়ে একতলায় বসেছিল। উঠে এসে দরজা খুলে দিল।

মণিকা ভেতরে ঢুকল। হাওয়ায় উড়ছে ওর কপালের চুল। বুকের আঁচল। ঝুমির বাবা শান্তনু লাহিড়ী বিস্মিত হলেন অপরূপ মহিলার সহজ আচরণে।

মণিকা বলল–ঝুমি কই?

ওই তো।

স্বচ্ছন্দ পায়ে ঝুমির পাশে গিয়ে বসে পড়ল মণিকা। বলল–আমি ঝুমিদের উষাদি। ওদের স্কুলে পড়াই। তাই না ঝুমি? ঝুমি ঘাড় নেড়ে সায় দিল। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম, যাই দেখে যাই।

শান্তনু লাহিড়ী বললে–ভালোই করেছেন। ওর মা গেল বাপের বাড়ি। একা আমি সামলাতে পারছিলাম না।

হেসে উঠল মণিকা-খাওয়া হয়েছে?

না। কিন্তু–

মণিকা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে–কোনও কথা নয়। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। খাইয়ে-দাইয়ে ঝুমিকে ঘুম পাড়িয়ে বাড়ি যাব-খন। একটু থেমে মোনালিসা হাসি হেসে–এ কাজ আমি ভালোবাসি।

শান্তনু লাহিড়ী অপ্রস্তুত হলেন। খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাসও ফেললেন।

রান্নাবান্না করাই ছিল। এটা-সেটা গল্প করতে করতে গ্যাসের উনুনে সব গরম করে নিল মণিকা। এর ফাঁকে পাঁউরুটি কাটা বড় ছরি নিয়ে দরজার পাশের টেলিফোনের তারটা কেটে রাখল। বাপবেটিকে খাওয়াল। নিজে কিছু দাঁতে কাটল না। ঝুমিকে ভুলিয়ে ভালিয়ে দোতলায় নিয়ে গিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। নীচে নেমে এসে দেখল হলঘরের টেবিলে তখনও বসে শান্তনু লাহিড়ী। মুখে পাইপ। চোখে বিস্ময়।

চলে যাচ্ছেন?

হ্যাঁ। আমার কাজ ফুরিয়েছে।

নিস্তব্ধ রাত। বাইরে ঝিঁঝি ডাকছে। শান্তনু লাহিড়ীর রক্তে দোলা লাগল মণিকার বিশাল চোখজোড়ার আয়ত চাহনি দেখে।

পাইপ সরিয়ে শুধু বলল–আপনার মতো মেয়ে আমি দেখিনি।

তাই নাকি? বলে মণিকা হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে শান্তনু লাহিড়ীর পেছনে গেল। ব্যাগ থেকে ছোট্ট পিস্তল বার করল। নলচেটী মুঠোয় ধরে কুঁদো দিয়ে ব্রহ্মতালুতে খুব জোরে চোট মারল। অজ্ঞান হয়ে গেল শান্তনু লাহিড়ী।

ব্যাগ থেকে নাইলন দড়ি বার করল মণিকা। পিছমোড়া করে বাঁধল শান্তনুকে। মুখের মধ্যে বেশ খানিকটা তুলো ঠেসে দিল। তারপর চওড়া স্টিকিং প্লাস্টারের পটি দিয়ে মুখ আটকে দিল।

টানতে টানতে শান্তনুকে নিয়ে এল ছোট্ট রান্নাঘরে। স্টিকিং প্লাস্টারের পটি দিয়ে প্রতিটি বন্ধ জানলার ফাঁক বন্ধ করল। তারপর একটা টুল নিয়ে বসল শান্তনুর পাশে। ব্যাগ থেকে স্মেলিং সল্টের শিশি নিয়ে ধরল নাকের কাছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝাঁঝালো গন্ধে জ্ঞান ফিরে এল শান্তনু লাহিড়ীর। চেঁচাতে পারল না–মুখ বন্ধ। হাত-পা নাড়তে পারল না–দড়ি দিয়ে বাঁধা।

মণিকা বলল–একটু পরেই মারা যাবেন আপনি। আমার নাম উষা নয়। আমি ঝুমির স্কুলে পড়াই না। মিথ্যে টেলিগ্রাম করে আমিই সরিয়েছি ঝুমির মাকে আপনাকে নিজের হাতে মারব বলে। কেন জানেন? একবছর আগে একটা শিবমন্দিরের সামনে একজন গুলি খেয়ে মরেছিল। মনে আছে? নতুন বর। আমি তার নতুন বউ। বিধবা।

শান্তনু লাহিড়ীর চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই দৃশ্য। তিনতলা বাড়ির চিলেকোঠায় বসে ওরা তাসের জুয়ো খেলছিল। মেসবাড়ি। জুয়োর সঙ্গে মদের ব্যবস্থাও রয়েছে। আর রয়েছে শান্তনুর দোনলা বন্দুকটা। ফাঁড়িতে দেখতে চেয়েছিল বন্দুকের চেহারা। নইলে নাকি লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। তাই বন্দুক নিয়ে আসা। ফড়ির কাজ শেষ। এখন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে একটু ফুর্তিতে মত্ত।

চিলেকোঠায় ওরা পাঁচজন ছিল। বারীন, মঘা, শান্তনু, ভৈরব আর কালিদাস। পাঁচজনের কর্মস্থল পাঁচদিকে। দৈবাৎ পাঁচ বন্ধু মিলেছে। তাই এই ফুর্তির আয়োজন।

কে জানত ফুর্তির শেষে এ-ট্র্যাজেডি থাকবে। কেননা, একদান খেলে উঠে জানলায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ভৈরব। হাতে ছিল শান্তনুর দোনলা বন্দুক। নিছক খেয়ালবশেই তাগ করছিল রাস্তার ও পাশে শিবমন্দিরের চুড়োর ত্রিশূলটা। খেলাচ্ছলেই মন্দির দিকে নজর রেখে নলচে নামিয়ে আনছিল চুড়ো বরাবর নীচের দিকে। ত্রিশূলের পর গম্বুজের পলস্তারা। তারপর মন্দিরের চত্বর। ঠিক এই সময়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে এসেছিল নবপরিণী একটি দম্পতি। ভৈরবের নলচের সামনেই এসে পড়ল নতুন ব্রিটি। মাছির সঙ্গে একরেখায় যখন বরের হৃৎপিণ্ড, ঠিক তখুনি শান্তনুর চোখে পড়েছিল জানলায় বন্দুক বাগিয়ে কাকে যেন তাগ করছে ভৈরব। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠে দৌড়ে গিয়েছিল শান্তনু। কেননা সে ছাড়া আর কেউ জানত না বন্দুকে গুলিভরা আছে।

আচমকা শান্তনুর চেঁচানিতে এবং তারপরেই শান্তনুর হেঁচকা টানেতে চমকে গিয়েছিল ভৈরব। এমনই বরাত, সঙ্গে সঙ্গে গুলি বেরিয়ে গিয়েছিল বন্দুক থেকে। এফেঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছিল নতুন বরের হৃৎপিণ্ড।

ওরা আর দাঁড়ায়নি। ফুর্তির ট্র্যাজেডি মাথায় নিয়ে চো-চাঁ চম্পট দিয়েছিল পাঁচ বন্ধু। কে মারা গেল, তা নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি।

মণিকার চোখে জল। বলছিল–আমারও স্বপ্ন ছিল, সংসার করব। এ স্বপ্ন হঠাৎ দেখিনি। ছেলেবেলায় কল্প ছিল আমার খেলার সাথী। সেই কল্প বড় হল। কিশোর হল। তরুণ হল। আমি কিশোরী হলাম। তরুণী হলাম। মন দেওয়ার পালাও গড়ে উঠেছে ধাপে ধাপে। স্বপ্নও দেখেছি তিল তিল করে। সে স্বপ্ন মুহূর্তের মধ্যে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছেন আপনারা–আপনারা পাঁচ বন্ধুতে। কল্প মারা গেল। আমি বেঁচে মরে রইলাম শুধু প্রতিহিংসার জন্যে। এক বছরে অনেক টাকা খরচ করেছি, অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছি। তবে বার করেছি আপনাদের পাঁচজনের নাম আর ধাম। বারীন আর মঘা কল্পর কাছে পৌঁছে গেছে। আপনি এখুনি যাবেন। ভৈরব আর কালিদাসও যাবে কয়েকদিনের মধ্যে।

বলে, মণিকা উঠে দাঁড়াল। গ্যাসের চাবি পুরো খুলে দিল। বাইরে এসে বন্ধ করল পাল্লাদুটো। স্টিকিং প্লাস্টারের পটি দিয়ে টিপে টিপে বন্ধ করল পাল্লার ফাঁক।

যথাসময়ে পুলিশ এসেছিল। ঝুমি বার বার বলেছিল, উষাদি এসেছিল স্কুল থেকে। তারপর বাবা মরে গেছে।

পুলিশ স্কুলে গিয়ে উষাদিকে গ্রেপ্তার করেছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ফোন এল ফাঁড়িতে। একটা নারীকণ্ঠ বললে–উষা দেবী নির্দোষ। ওঁর নাম নিয়ে আমিই খুন করেছি শান্তনু লাহিড়ীকে।

.

পেট্রল পাম্পের পাবলিক ফোন থেকে থানায় ফোন করেছিল মণিকা। রিসিভার রেখেই দৌড়ে এসে উঠেছিল গাঢ় রক্ত-রঙের ক্যাডিলাক গাড়িটায়। ড্রাইভ করেছিল নিজেই। ঘণ্টাতিনেক একটানা গাড়ি চালিয়ে পৌঁছেছিল একটা মোটর মেরামতি কারখানায়। জি. টি. রোডের ওপর গাড়ি দাঁড় করিয়ে হেঁটে হেঁটে পৌঁছেছিল গ্যারেজে।

বেশ বড় কারখানা। ভাঙা-আধভাঙা গাড়ি দাঁড় করানো এলোমেলোভাবে। এঁকেবেঁকে আপিসের দিকে এগুলো মণিকা। তেলকালিমাখা একজন মেক্যানিককে বললে ভৈরবকে ডেকে দিতে।

মণিকা দাঁড়িয়ে রইল। জায়গাটা বেশ নির্জন। মাথার ওপর কাক উড়ছে। আশেপাশে মানুষ নেই। ভাঙা গাড়ির ভিড়ে মণিকাকে দেখা যাচ্ছে না।

মণিকা হ্যান্ডব্যাগ খুলে ক্ষুদে পিস্তলটা বার করল। তুষার শুভ্র ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখল ডান হাত আর হাতে ধরা পিস্তল।

নলচে ফেরানো রইল আপিসের দিকে। ওই পথেই আসবে ভৈরব। ওই তো আসছে। মাথাজোড়া টাক। গাট্টাগোট্টা চেহারা। এ কারখানার মালিক। একাই আসছে।

মণিকা পিস্তল তাগ করল। ট্রিগার টিপতে যাবে–

এমন সময়ে ভৈরবের পেছনে একটা সোরগোল শোনা গেল। পাহাড়প্রমাণ লোহালক্করের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর, দুজন কনস্টেবল এবং একজন তেলচুকচুকে ভদ্রলোক। চেঁচাচ্ছেন ভদ্রলোক–ওই যে…ওই দেখুন…জোচ্চের কোথাকার…অ্যারেস্ট করুন… মেরামতের নাম করে আমার গাড়ি নিয়ে ভাড়া খাটাচ্ছে একবছর ধরে…গাড়ি দিচ্ছে না…চোর… গুন্ডা..বদমাশ…

মণিকা থমকে গেল। ভৈরব ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কনস্টেবল দুজন এসে দাঁড়িয়েছে দুপাশে তারপর পুরো দলটা এগিয়ে চলল বড় রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশভ্যানের দিকে।

মণিকা আর দাঁড়াল না। ফিরে এল ক্যাডিলাকে। সিটে বসে হ্যান্ডব্যাগ থেকে বার করল একটা কাগজ। তাতে লেখা এই কটি নাম :

বারীন

মঘা

শান্তনু

ভৈরব

কালিদাস

বারীন, মঘা আর শান্তনুর নাম তিনটে পেনসিল দিয়ে কাটা। মণিকা জিজ্ঞাসা চিহ্ন বসালো ভৈরব-এর নামের পাশে।

সত্যিই তো! ভৈরব যে এখন হাজতে!

কালিদাস রায় চিত্রশিল্পী। জীবনধর্মী চিত্রাঙ্কনে পারদর্শী। তাই তার নিভৃত স্টুডিওতে মডেলের আনাগোনা চলে সকাল সন্ধ্যায়।

কালিদাস রায় ব্যাচেলার। সুপুরুষ। ধনী। তাই তার মক্কেল হতে রাজি হয় এমন অনেক কন্যা যাদের রূপ আছে, হয়তো রূপাও আছে।

কাজেই সেদিন সন্ধ্যায় কলিংবেল টিপে যে মেয়েটি কালিদাসের স্টুডিওতে পা দিল, তার প্রস্তাব শুনে বিস্মিত হল না কালিদাস। মেয়েটি কাজ চায়। মডেল হতে চায়। ফি খুব কম। ঘন্টায় পাঁচ টাকা।

কালিদাস আপাদমস্তক দেখল মেয়েটির। দেখে রাজি হল। কারণ, এ মেয়ে কেবল রূপসী নয়, রূপকে কীভাবে মেলে ধরতে হয়, তা জানে। উৎসাহের বশে কালিদাস সঙ্গে সঙ্গে তাকে সিটিং দিল। ইজেলে কাগজ আটকে পেনসিলের লম্বা লম্বা টানে ফুটিয়ে তুলল অপরূপার রূপরেখা।

মোহিনী হেসে বিদায় নিল মেয়েটি। নাম তার মণিকা। বলে গেল সে আবার আসবে। কাল সন্ধ্যায় সে হবে ব্যাধের বউ। কালিদাসের ইচ্ছে তাই।

নীচে নেমে এল মণিকা। চাতাল ঘুরে যেই লন পেরোতে যাচ্ছে, এমন সময়ে পাশ দিয়ে হন হন করে বেরিয়ে গেল একটি মূর্তি।

পুরুষ মূর্তি। এক পলকেই মণিকা তাকে চিনেছিল। তাই আর পেছনে না ফিরে সিধে ফটক পেরিয়ে পড়েছিল রাস্তায়।

পুরুষটিও থমকে দাঁড়িয়েছিল। পেছন ফিরে তাকিয়েছিল অপসৃয়মান তন্বীর দিকে। সন্দিগ্ধ চোখে। মেয়েটাকে এত চেনা চেনা ঠেকছে কেন?

সেই মুহূর্তে মনে পড়েনি। পড়লে অনেকগুলি বন্ধুকৃত্য একসাথেই সারতে পারত। কেননা, যুবা পুরুষের নাম সঞ্জয়। বারীন বাগচির বন্ধু। যে বারীন এই সেদিন নিহত হয়েছে, মণিকার হাতে।

এই সঞ্জয়কে দিয়েই চা আনতে পাঠিয়েছিল মণিকা বারীনের মদের গেলাস ক্যাকটাসের টবে উপুড় করে দিয়ে।

.

পরের দিন সন্ধ্যায় কালিদাসের ফ্ল্যাটে এল মণিকা। একটিমাত্র বাঘের চামড়া পাতলা কোমর জড়িয়ে বুকের ওপর দিয়ে ঝুলে রইল কাঁধের ওপর। আর এক কাঁধে তিরভরা তূণ। হাতে ধনুক। ছিলায় তির। ছিলা টান করে ধরা কান পর্যন্ত।

এই পোজে বিভিন্ন কোণ ধরে অনেকগুলি স্কেচ আঁকলো কালিদাস। প্রতিটি স্কেচের মধ্যেই অনুভব করল কামনার স্বাদ। মেয়েটার অনাবৃত কাঁধ, উরু এবং পিঠ ওকে টানতে লাগল চুম্বকের মতো। পাগলের মতো পরের পর স্কেচ এঁকে চলল ও। ক্লান্তি নেই ওর পেনসিল টানার। ক্লান্তি নেই মণিকার অঙ্গেও। সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারানো চলবে না।

এবার ফ্রন্ট পোজে দাঁড়াল মণিকা। তিরের মুখ সিধে ফেরানো কালিদাসের দিকে। কালিদাসের চোখ পর্যায়ক্রমে ঘুরছে ইজেল আর মণিকার ওপর।

এমন সময় সাঁই করে কালিদাসের পাঁজর ছুঁয়ে তির বেরিয়ে গেল–খটাং করে আটকে গেল ওদিকের দেওয়ালে টাঙানো ছবির ফ্রেমে।

ভীষণ চমকে উঠেছিল কালিদাস। আর মণিকা কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়েছিল পাশের টুলের ওপর–আর পারছি না…বড় হাত-পা কাঁপছে।

তবে থাক, সামলে নিয়ে বলল কালিদাস। কাল হবে-খন।

না। ফ্যাকাসে মুখ মণিকার। আজকের মুড কালকে নাও থাকতে পারে। যত রাতই হোক, ছবি শেষ করুন। একটু ব্রান্ডি দেবেন?

একটু কেন, বেশি করেই ব্র্যান্ডি ঢালল কালিদাস। নিজের রক্তেও আগুন ছোটালো ব্র্যান্ডির প্রসাদে। মণিকাকে দুটো আদরের কথা বলার চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু তার আগেই একটা কাণ্ড ঘটল।

জানলার সামনে দাঁড়িয়েছিল মণিকা। দেখল, একতলার লন পেরিয়ে সঞ্জয় আসছে। আসছে কালিদাসের ফ্ল্যাটেই।

মণিকা বলল–আমি যে এখানে আছি, তা আপনার কোনো বন্ধু-বান্ধবকে জানাতে চাই না। আপনার হেল্প চাই।

একশোবার।

আমি বাথরুমে যাচ্ছি। আপনার বন্ধুটি চলে গেলে আমাকে ডাকবেন।

যথাসময়ে সঞ্জয় এল। ইজেল আঁকা মণিকার ছবি দেখে ভুরু কুঁচকে ভাবল অনেকক্ষণ। গত সন্ধ্যায় ছবিটায় রং চড়িয়েছিল কালিদাস। মণিকা যেন মূর্ত হয়ে উঠেছিল সে ছবিতে। এ ছবিটাও চিনি-চিনি মনে হল সঞ্জয়ের। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ল না প্রথম দেখার ঘটনাটা।

ইচ্ছে ছিল কালিদাসের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা মারার। কিন্তু কালিদাস যেন তাকে তাড়াতে পারলেই বাঁচে, এমনি ভাব দেখালো। বিস্মিত হল সঞ্জয়। হয়তো ইজেলের ছবিটা নিয়েই ব্যস্ত শিল্পীবন্ধু, এই ভেবেই আর দাঁড়ালো না সঞ্জয়। মডেলের মেয়েটি কে, এ প্রশ্ন বলি-বলি করেও বলতে পারল না কালিদাসের ঠোঁটে চাবি-দেওয়া ভাব দেখে।

ভাবিত মনে বাড়ি ফিরল সঞ্জয়। মেয়েটা কে? কার ছবি আঁকছে কালিদাস? কেন এত চেনা-চেনা লাগছে ছবিটা? একেই তো গতকাল সন্ধ্যায় কালিদাসের বাড়ি থেকে বেরোতে দেখা গিয়েছিল? চোখে চোখ পড়েছিল, মেয়েটি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে পাশ কাটিয়ে গিয়েছিল–আর ফিরেও তাকায়নি। কিন্তু সঞ্জয়ের কেন জানি মনে হয়েছিল, ফিরে তাকায়নি পাছে সঞ্জয় তাকে চিনে ফেলে তাই। ধরা দিতে চায় না মেয়েটা। কিন্তু কেন? কালিদাস এত রাতে তার ছবি আঁকছে তন্ময় হয়ে কেন? স্কেচ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে মডেলের ছবি। তার মানে, মডেল ঘরের মধ্যেই ছিল। সঞ্জয়কে দেখেই লুকিয়েছে। অথবা কালিদাস লুকিয়ে রেখেছে। কেন এই লুকোচুরি? কে এই রহস্যময়ী? কার প্রভাবে কালিদাসের মতো প্রিয় বন্ধুও এত দূরে সরে যেতে পারে?

ভাবতে ভাবতে মাথা গরম হয়ে গেল সঞ্জয়ের। গলাও শুকিয়ে কাঠ। তাই কুঁজো থেকে গেলাসে জল গড়িয়ে গলায় ঢালল। ঢেলে, গেলাসের তলানিটা অভ্যেসমতো উপুড় করে ধরল পাশে রাখা ক্যাকটাসের টবে।

উপুড় করেই থমকে গেল। স্মৃতির বিদ্যুৎ ঝলসে উঠেছে মাথার মধ্যে। আবার গেলাসটা উপুড় করল সঞ্জয়। আবার! আবার!

এবার মনে পড়েছে। ঠিক এমনি করেই ক্যাকটাসের টবে মদের গেলাস উপুড় করে ধরেছিল অজানা এক সুন্দরী, বারীন বাগচির ফ্ল্যাটে। দিয়ে সঞ্জয়কে বলেছিল চা আনতে। সঞ্জয় চা নিয়ে ফিরে এসে দেখেছিল বারান্দা শূন্য। বহু নীচে পড়ে রক্তাক্ত একটা মাংসপিণ্ড–বারীন বাগচি!

আকাশের বিজলী মানবীরূপে দেখা দিলে যে রূপ হয়, মেয়েটির অঙ্গে সেই রূপ দেখেছিল সঞ্জয়। তাই ভোলা যায়নি। কালিদাস এই মেয়েরই ছবি আঁকছে তন্ময় হয়ে। অন্য ছাঁদে চুল বাঁধার জন্যে চিনি-চিনি করে চিনতে পারেনি সঞ্জয়।

বারীন বাগচির রহস্যজনক আত্মহত্যার (?) পূর্ব মুহূর্তে যে মোহিনীকে দেখা গিয়েছিল–এই সেই কন্যা। বারীনের মৃত্যুর কারণ সে, হয়তো বা হত্যাকারিণীও। কিন্তু কালিদাসের সঙ্গে জুটল কেন মেয়েটা? এত গোপনীয়তাই বা কেন?

হঠাৎ একটা কুৎসিত চিন্তা হুল ফোঁটালো সঞ্জয়ের মগজে। ছিটকে গিয়ে রিসিভার তুলল ও। ডায়াল করল কালিদাসের নাম্বার। কিন্তু ফোন বেজেই গেল। কেউ ধরল না।

কালিদাস কি ঘুমোচ্ছে?

সঞ্জয়ের মাথায় সেই কুৎসিত চিন্তাটা তখনো সমানে হুল ফুটিয়ে চলেছে। কাজেই কিছুক্ষণের মধ্যেই অত রাতেও তাকে দেখা গেল কালিদাসের ফ্ল্যাটের সামনে।

দরজা ভেজানো ছিল। ভেতরে আলো জ্বলছিল। ইজেলের পায়ার কাছে মুখ থুবড়ে পড়েছিল কালিদাস।

একটা তির পিঠের মধ্যে ঢুকে আধখানা বেরিয়েছিল বুক দিয়ে।

পরের দিন।

জেলখানার সামনে এসে ব্রক কষল একটা রক্তরক্তের ক্যাডিলাক। নেমে দাঁড়াল পরমাসুন্দরী একটি তরুণী।

জেল সুপার অবাক হলেন তরুণীকে দেখে। মেয়েটি নাকি ভৈরব সাহার সহোদরা। দাদা হাজতবাস করছে শুনে দেখা করতে এসেছে।

সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। জেলখানার নিয়মকানুন ছার সে মুখের কাছে। কাজেই অচিরেই গরাদের এপাশে এসে দাঁড়াল মণিকা। ওপাশে ভৈরব।

চোখে চোখ রেখে মণিকা বলল–চিনতে পারছেন?

না।

আপনাকে মুক্তি দিতে এসেছি।

বলে, আঁচল ঢাকা পিস্তল থেকে পর পর তিনবার গুলি করল মণিকা। ভৈরব মুক্তি পেল ধরাধাম থেকে।

সেই সঙ্গে মণিকাও। চতুর্থ গুলিটা দিয়ে নিজের মগজ ফুটো করে দিয়ে সে রওনা হল পরপারে স্বামীর কাছে।

* রহস্য পত্রিকায় প্রকাশিত। শারদীয় সংখ্যা, ১৩৭৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *