অনেক বছর আগের কথা।
তলস্তয়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘রেজারেকশন’ অবলম্বনে নির্মিত একটি সিনেমা আমরা দেখেছিলাম। ছবিটি দেখার পর সবারই এক ধরনের চিন্তা এসেছিলো মাথায়। ছবিতে দেখানো হয়েছিল অসম্ভব সাহসী, মহৎ মানুষ আর তাদের ভাগ্যের গল্প। তখন আমাদের জন্য কোনো মহামান্বিত মৃত্যু অপেক্ষা করছিল না, ছিল না কোনো যন্ত্রণা। তাই আমাদের ভাগ্যের বিরুদ্ধে আপ্রাণ লড়াই করে খ্যাতি পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। ছবিটা দেখা শেষ করে আমরা সবচেয়ে কাছের ক্যাফেতে গিয়েছিলাম। ছবি দেখার পর যেসব আধ্যাত্মিক চিন্তা ভাবনা মাথায় এসেছিল, তা এক কাপ কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতেই ভুলে গিয়েছিলাম। তবে ভাগ্য যখন আমাদের মহত্ব অর্জনের সুযোগ দিয়েছিল তখন আত্মিক শক্তি নিয়ে তার মুখোমুখি হওয়ার কথা থাকলেও, আমাদের সেই তরুণ জীবনের দৃঢ় সংকল্প যেন হারিয়ে ফেলেছিলাম ততদিনে। হেরে গিয়েছিলাম তার কাছে।
হয়তো আমাদের কারো কারো জন্য সেই দিন আবার এসেছিল যখন আমরা সেই ছবিটি আবার দেখেছিলাম কিংবা একই ধরনের বা বক্তব্যের ছবি যখন দেখেছিলাম।
ক্যাম্পের একটি মেয়ের কথা মনে পড়ছে এই মুহূর্তে। চোখের সামনেই তাকে মারা যেতে দেখেছি। ক্যাম্পে মৃত্যু ছিল একটি সাধারণ ঘটনা। তবে এই মেয়েটির মারা যাবার কথা ভুলতে পারিনি। ছোট একটি ঘটনা। বললে, দুয়েক কথায় ফুরিয়ে যাবে। তবে তার মৃত্যু আমার কাছে কবিতার মতো সুন্দর মনে হয়েছে।
তরুণীটি জানতো, কয়েকদিনের মধ্যেই সে মারা যাবে। তবে আমি যখন তার সাথে কথা বলছিলাম, তার মাঝে সামান্যতম মৃত্যুর ভয় ছিল না। জ্ঞানের আলোয় সে উদ্ভাসিত।
সে আমাকে বলল, ‘আমি আনন্দিত, ভাগ্য আমাকে এই কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি করেছে। আমার ফেলে আসা দিনগুলো হেসে খেলেই নষ্ট করেছি। মানুষের যে একটি আধ্যাত্মিক জীবন আছে, সে দিকে নজরই দেইনি।’
তার ঘরের জানালার বাইরের একটি জিনিসের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘ঐ গাছটি ছিল আমার নিঃসঙ্গ সময়ের একমাত্র সঙ্গী।’
সে জানালার মধ্য দিয়ে আবার গাছটির দিকে তাকালো। গাছের একটি ডালে দুটো ফুল ফুটেছে।
‘গাছটি ছিল আমার কথা বলার সাথী।’ মেয়েটি বলল আমাকে।
আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম তার কথা শুনে। বুঝতে পারছিলাম না মেয়েটিকে কী বলছে? সে কি প্রলাপ বকছে? সে কি কোনো ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছে?
আমি দ্বিধা নিয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘গাছ কি তোমার সাথে কথা বলতো?’
সে আমাকে অবাক করে দিয়ে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, গাছও আমার সাথে কথা বলতো।
‘গাছ কী বলতো তোমাকে?’
মেয়েটি বলল, ‘গাছ বলতো, আমি এখানে- এখানে আমি। আমি জীবন। অনন্ত জীবন।’
আমরা আগেই বলেছি, কারাগারের বন্দিদের যে মানসিক অবস্থা তাদের চিন্তার উপরই নির্ভর করে। বন্দিদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে বলা যায়, যেসব কয়েদি মানসিক ভাবে, শারীরিক ভাবে ভেঙে পড়েছিল, যাদের অভ্যন্তরীণ সহ্য করার ক্ষমতা কম, তারাই ক্যাম্পে সবচেয়ে দুরবস্থার শিকার হয়েছে।
এখন আরেকটি প্রশ্ন হতে পারে, ‘অভ্যন্তরীণ সহ্য করার ক্ষমতা’ কাকে বলে?
যেসব বন্দি তাদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের কথা লিখেছে বা বলেছে, সেখানে একটি বিষয় স্পষ্ট। কত দিন তাদের এই বন্দি অবস্থায় কাটাতে হবে, তা তারা জানতো না। এই জানতে না পারা বা অনিশ্চিয়তা তাদের সবচেয়ে বেশি হতাশাগ্রস্ত করে তুলেছিল। কবে তাদের মুক্তি দেয়া হবে, এ তথ্যটি কখনোই জানানো হয়নি (আমাদের ক্যাম্পে তো এটা নিয়ে টু শব্দ করার উপায় ছিল না।)
প্রকৃতপক্ষে, ক্যাম্পের জীবন একজন কয়েদির কাছে শুধু অনিশ্চিতই ছিল না, ছিল অন্তহীন। যে জীবনের কখনো শেষ হবে না বলে মনে হতো।
একজন স্বনামধন্য মনোবিজ্ঞানী কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের জীবনকে ‘অস্থায়ী অস্তিত্ব’ বলে চিহ্নিত করেছেন। আমরা উনার কথার সাথে একটু শব্দ যোগ করে বলতে পারি, এটি ‘অন্তহীন সাময়িক অস্তিত্ব।’
ক্যাম্পে যারা নতুন আসতো, তারা ক্যাম্পের পরিবেশ সম্পর্কে কিছুই জানতো না। তবে অন্য ক্যাম্প থেকে যারা ফিরে আসতো, তারা বেশ চুপচাপ থাকতো। আবার কোনো কোনো ক্যাম্প থেকে কেউই ফিরে আসেনি। নতুন ক্যাম্পে আসার পর বন্দিদের মাঝে কিছু পরিবর্তন দেখা দিত। এক অনিশ্চয়তা থেকে নতুন এক অনিশ্চয়তায় এসে পড়তো তারা। এই বন্দিজীবন কবে শেষ হবে, তা কারো পক্ষেই কখনো অনুমান করা সম্ভব ছিল না।
ল্যাটিন শব্দ ফিনিস (finis) এর দুটো অর্থ হয়।
এক. শেষ বা সমাপ্ত।
দুই. কাঙ্ক্ষিত লক্ষে পৌঁছানো।
যখন কোনো ব্যক্তি তার ‘সাময়িক অস্তিত্বে’র শেষ কোথায়, না জানে, তখন তার কাছে সেই সাময়িক জীবনই অনন্ত জীবন বা অনন্ত অস্তিত্ব হয়ে দাঁড়ায়। তার কাছে ভবিষ্যৎ বলে কিছু থাকে না। সাধারণ মানুষ ভবিষ্যৎ জীবনের আশায় বাঁচে কিন্তু তার কাছে বর্তমানের দুঃসহ জীবনই সব। ফলে তার জীবনের পুরো কাঠামোটিই বদলে যায়। জীবনের অন্যান্য দিক লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, তার মধ্যে ক্ষয়িষ্ণুতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একজন বেকার লোকও একই অবস্থার মধ্য দিয়ে যায়। তার অস্তিত্ব তখন তুচ্ছ হয়ে যায়। ভবিষ্যৎ হয়ে উঠে অন্ধকারাচ্ছন্ন। সে কী করবে, না করবে, তার কিছুই ঠিক করতে পারে না। বেকার খনির শ্রমিকদের উপর গবেষণা করে দেখা গেছে, বেকারত্বের সময় তারা অস্বাভাবিক জীবন কাটায়। মানসিক ভারসাম্যের উপরও সেই প্রভাব পড়ে। বন্দিরা ঠিক একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সময় কাটাচ্ছিলেন। ক্যাম্পের প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্ত ছিল অত্যাচারে, অবসাদে ভরা। মনে হতো যা কখনো শেষ হবে না। আবার দীর্ঘসময় যেমন এক সপ্তাহ, মনে হতো খুব তাড়াতাড়ি চলে গেল।
আমি একবার সহবন্দিদের বললাম, একেকটা দিন যেন এক সপ্তাহের চেয়ে বড়। তখন তারা আমার কথায় সম্মতি জানালো। আমাদের সময়গুলো ছিল এমনই বৈপরীত্যে ভরা। প্যারাডক্সিকেল। এই বিষয়গুলো আমাকে টমাস মানের ‘দ্য ম্যাজিক মাউন্টাইন’ এর কথা মনে করিয়ে দিত। এ গল্পে বেশ কিছু মনস্তাত্ত্বিক পয়েন্ট তুলে ধরা হয়েছে। টমাস মান একই মানসিক অবস্থায় থাকা অর্থাৎ স্যানেটোরিয়ামে থাকা কিছু যক্ষ্মারোগীদের নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। এই রোগীরাও জানতো না, তারা কবে সেখান থেকে ছাড়া পাবে। জীবন নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতাও ছিল একই রকম। ভবিষ্যৎশূন্য, লক্ষ্যশূন্য।
একবার এক বন্দি স্টেশন থেকে মার্চ করতে করতে ক্যাম্পে এসেছিল। পরে সে আমাকে বলল, সে যখন দীর্ঘক্ষণ মার্চ করতে করতে ক্যাম্পে আসছিল, তার মনে হচ্ছিল সে নিজেই নিজের জানাজায় অংশগ্রহণ করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে। তার মনে হয়েছিল, তার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সে বিষয়টাকে এমনভাবে নিয়েছিল যে, তার মনে হচ্ছিল, সে মারা গেছে। নানা কারণেই তার এমন মনে হয়েছিল। যেমন- সময়। বন্দি থাকার সময়টাকে অন্তহীন মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কখনো শেষ হবে না। তাছাড়া দুঃসহ ছিল সেই সময়টুকু। দুই: স্থান। একজন বন্দিকে খুবই ছোট্ট জায়গায় থাকতে হতো। কাঁটাতারের বাইরের জীবন তার কাছে অনেক দূরের হয়ে যেত। কোনোভাবেই সেখানে যাওয়া যায় না। রূপকথার জীবনের মতোই সেই জীবন অবাস্তব। কাঁটাতারের বাইরে থাকা লোকজন, নানা ঘটনা বন্দিদের কাছে ভুতুরে মনে হতো। বাইরের জীবন যদি কখনো তাদের চোখে পড়তো, এমন ভাবে তাকিয়ে দেখতো, যেন কোনো মৃতপথ যাত্রী অন্য একটি দুনিয়া দেখতে পাচ্ছে।
একজন মানুষ যখন কোনো আশা দেখতে পায় না, তার কাছে ভবিষ্যৎ যখন দুরাশার নামান্তর হয়ে পড়ে, তখন সে হতাশায় ডুবে যায়। নিজের অতীত জীবনের কথা ভেবে সময় কাটায়। যদিও আমরা আগের এক অধ্যায়ে বর্তমান সময়ের কষ্ট ভুলে থাকার জন্য অতীতের কথা চিন্তার করার কথা বলেছি, তবে সেটা ভিন্ন প্রেক্ষাপট। ওই অবস্থায় অতীতের কথা চিন্তা করা, আর জীবনের প্রতি আশা হারিয়ে অতীতের কথা ভাবা এক নয়। ক্যাম্পের পরিবেশটা এমনই ছিল, যার ফলে ভালো দিকগুলোও চোখে পড়তো না। সব কিছুই অর্থহীন হয়ে পড়েছিল। আমাদের ‘অস্থায়ী অস্তিত্ব’ একটা অবাস্তব ব্যাপার ছিল কিন্তু কয়েদিদের উপরে সে ঠিকই গভীর প্রভাব ফেলেছিল। ক্যাম্পের পরিবেশ এমনভাবেই বন্দিদের গ্রাস করে ফেলেছিল যে, তারা ভুলে গিয়েছিল, এই অবস্থাতেও নিজের আধ্যাত্মিক উন্নতির অনেক সুযোগ আছে। ক্যাম্পের সমস্যাগুলোকে নিজের অভ্যন্তরীণ শক্তির পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করেনি। জীবনকে তারা গুরুত্ব দেয়নি। এর চেয়ে তারা চোখের পাতা বন্ধ করে অতীতের কথা ভাবতে ভালোবাসতো। বলাবাহুল্য জীবন তাদের কাছে অর্থহীন হয়ে গিয়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে, অল্পকিছু লোকই আধ্যাত্মিক উন্নতি করতে পেরেছিল। সামান্য কিছু লোকই জাগতিক ব্যর্থতা এবং মৃত্যু ভয় সত্ত্বেও মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পেরেছিল।
এখানে না এলে কখনোই যা অর্জন করা সম্ভব হতো না। তবে ভীতু কাপুরুষের জন্য বিসমার্কের একটি উক্তি প্রণিধান যোগ্য।
তিনি বলেছেন, ‘জীবন মানে দাঁতের ডাক্তারের কাছে যাওয়া। আপনি হয়তো ভাবছেন, সামনে কতই না কষ্ট অপেক্ষা করছে? অথচ যা ঘটার, ইতোমধ্যে তা ঘটে গেছে।’ এই উক্তি নিয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে, তবে আমাদের ক্যাম্পের অধিকাংশ বন্দি মনে করতো, জীবনের সুর্বণ সময় তারা পেছনে ফেলে এসেছে। যত সুখ, যত আনন্দ- সবই অতীত। তবে এটি ছিল ভুল ধারণা। জীবন অপার সম্ভবনাময়। বাস্তবতা হলো, তাদের সামনে এখনো অনেক সুযোগ রয়েছে। রয়েছে জীবনকে বদলানোর সমূহ সম্ভাবনা। এখন কেউ ইচ্ছে করলে এইসব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে জীবনকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যেতে পারতো, মনের শক্তি দিয়ে জীবনকে বদলাতে পারতো। কেউ আবার এ পথে না হেঁটে চুপচাপ জীবন কাটিয়ে দেয়। ক্যাম্পের অধিকাংশ বন্দিই এই পথ অবলম্বন করেছিল।
সাইকোথেরাপিউটিক বা সাইকোহাইজেনিক পদ্ধতির মাধ্যমে ক্যাম্পের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বন্দির মাঝে লড়াই করার, টিকে থাকার মানসিকতা তৈরি করা যেত। এর ফলে সে ভবিষ্যৎ নিয়েও আশাবাদী হয়ে উঠতে পারতো। সহজাপ্রবৃত্তির মাধ্যমে কোনো কোনো বন্দি নিজের মতো করেই শুরু করেছিল। মানুষের একটি বড় বৈশিষ্ট্য, সে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বাঁচতে পারে। অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার এটি তার কঠিন পরীক্ষা 1 এজন্য অনেক সময় তার মনের বিরুদ্ধেও কাজ করতে হয়।
আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ছে। সেটা এতটাই বেদনার ছিল, মনে পড়লে চোখে পানি এসে পড়ে। ছেঁড়াজুতো পরার ফলে আমার পায়ে ঘা হয়ে গিয়েছিল। সহবন্দিদের সাথে কাজে যাচ্ছি। সংখ্যায় আমরা অনেক। ক্যাম্প থেকে কাজের স্থানে যাওয়ার জন্য কয়েক কিলোমিটার আমাদের হাঁটতে হচ্ছে। ছেঁড়াজুতো, পায়ে ঘা। এজন্য আমি খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছি। প্রচণ্ড শীত। ঠান্ডা বাতাস আমাদের হাড় কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আমার মাথায় নানান ধরনের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ রাতে কী খেতে দেবে? আহা, যদি এক টুকরো সসেজ বেশি পেতাম! তাহলে কি ওটার বদলে এক টুকরো রুটি নেবো? বোনাস হিসেবে সিগারেট পেয়েছিলাম। একটাই অবশিষ্ট আছে। ওটার বিনিময়ে কি আজ রাতে এক পেয়ালা স্যুপ নেবো? ছেঁড়াজুতো ঠিক করার জন্য তার কোথায় পাওয়া যেতে পারে? সময় মতো কি কাজে উপস্থিত হতে পারবো আজকে?
আমাকে কি আজকে আগের দলের সাথেই কাজ করতে দেবে? নাকি নতুন কোনো দলে পাঠিয়ে দেবে? যে দলের ফোরম্যান হবে একটা জল্লাদ। কোনো বুকপিঠ নাই তার। আচ্ছা, একজন কাপোর সাথে খাতির লাগানো যায় কীভাবে? সে হয়তো তখন আমাকে ক্যাম্পেই কোনো কাজ জুটিয়ে দিবে, দীর্ঘপথ মার্চ করতে করতে আমাকে আর এখানে আসতে হবে না।
ক্যাম্পের জীবন এতটাই দুঃসহ হয়ে উঠেছিল যে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা এসব হাবিজাবি চিন্তা আমার মাথায় ঘুরতো। আমি তখন আমার চিন্তাটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলাম। হঠাৎ আমার সামনের সব কিছু বদলে গেল। দেখলাম, আলোয় ঝলমলে একটি বিরাট রুম। আমি বক্তৃতা করার জন্য রোস্টামের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার সামনে প্রচুর দর্শক বসে আসে। তারা খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনছে। আমি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মনস্তাত্ত্বিক দিক নিয়ে বক্তব্য রাখছি। এই মুহূর্তে আমার উপর যে অত্যাচার হচ্ছিল, আমার মানসিক যন্ত্রণা তা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলোচনা করছি। এভাবে আমি নিজেকে ওই যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করেছিলাম। মনে হচ্ছিল, বর্তমানটাই আমার কাছে অতীত। তখন আমি বা আমার সমস্যাগুলো আমার কাছেই মনস্তাত্ত্বিক গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্পিনোজা তার নীতিশাস্ত্রে কী বলেছে? বলেছে, ‘স্পষ্ট এবং সঠিক ধারণা তৈরি হলে আমাদের কষ্টগুলো, ভোগান্তিগুলো আর তেমন যন্ত্রণা দেয় না। অর্থাৎ যে আবেগ আমাদের কষ্ট দিচ্ছে, তা যদি ঠিক মতো বুঝতে পারি, অনুধাবন করতে পারি, তখন কষ্টের মাত্রা অনেক কমে যায় বা কখনো কষ্ট একেবারেই থাকে না।
যে বন্দি তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশা হারিয়ে ফেলেছে, সেই মূলত তার ভবিষ্যতকে ধ্বংস করে ফেলেছে। ভবিষ্যতের উপর বিশ্বাস হারানো ফলে তার যে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা, সেটাও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এভাবে হতাশ হয়ে পড়ার ফলে তার শারীরিক, মানসিক ক্ষয়ও শুরু হয়।
সাধারণত এ সমস্যাগুলো হঠাৎ করেই দেখা দিত। অভিজ্ঞ বন্দিরা এ লক্ষণগুলো ভালোভাবেই চিনত। আমরা সবাই এই মুহূর্তকে ভয় পেতাম। এই ভয় শুধু নিজের জন্যই ছিল না, পরিচিত বন্ধুবান্ধবও যেন এ পরিস্থিতির মুখোমুখি না হয়, তাই কামনা করতাম।
শুরু হতো এভাবে-
কোনো কয়েদি হয়তো সকালে ড্রেস পরতে চাই না, পরিষ্কার হতে চাই না কিংবা প্যারেড গ্রাউন্ডে যেত অস্বীকার করতো। কোনো অনুরোধ, হুমকি-ধামকি সে পাত্তা দিতো না। চুপচাপ শক্ত হয়ে শুয়ে থাকতো। একটুও নড়তো না। ধরলাম, কোনো অসুখের কারণে সে এমন করছে। তখন রোগীদের ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে চাইলেও সে যেতে চাইতো না। সে হাল ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকতো। দেখা যেত নিজের গু-মুতের উপর একই ভাবে শুয়ে আছে। কোনো নড়াচড়া নেই। তখন কেউ আর তাকে বিরক্তও করতো না।
একবার এক নাটকীয় ঘটনা দেখেছিলাম। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিশ্বাস হারানো এবং হাল ছেড়ে দেয়া— এই দুয়ের মাঝে সংযোগ নিয়ে ছিল ঘটনাটা।
মি. ফ. ছিল আমাদের দলের জ্যেষ্ঠ কারারক্ষক। সুরকার এবং গীতিকার হিসেবে তিনি বিখ্যাত ছিলেন।
একদিন তিনি আমাকে বিশ্বাস করে একটি কথা বলেছিলেন। বললেন, ‘আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই, ডাক্তার। আমি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নে দেখলাম, একটা কণ্ঠস্বর আমাকে বলল, আমি যদি কিছু জানতে চাই, তবে আমাকে তা জানানো হবে। কোনো প্ৰশ্নই এড়িয়ে যাওয়া হবে না।
তুমি কি অনুমান করতে পারো, আমি কি জিজ্ঞেস করেছিলাম? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার এ যুদ্ধ কবে শেষ হবে। তুমি কি বুঝতে পারছো, আমি কি বলেছিলাম? আমি মানে আমাদের যুদ্ধ কবে শেষ হবে? কবে এই ক্যাম্প থেকে আমরা মুক্তি পাবো? কবে আমরা মুক্ত হবো এ দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে?’
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কবে দেখেছেন এ স্বপ্ন?’
‘১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।’ সে উত্তর দিয়েছিল।
‘ফেব্রুয়ারি বলতে ফেব্রুয়ারির শেষে, মার্চের শুরু দিকে এ স্বপ্ন দেখেছিলাম।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্বপ্নে কণ্ঠস্বর কী বললো আপনাকে? কবে মুক্তি পাবো আমরা?’
সে ফিসফিস করে আমাকে বলল, ‘মার্চের ত্রিশ তারিখে।’
যখন ফ. আমাকে তার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন, তিনি বিশ্বাস নিয়েই বলেছিলেন। তার ধারণা ছিল, স্বপ্ন সত্যি হবেই।
তবে মার্চের ত্রিশ তারিখ যতই এগিয়ে আসছিল আর আমরা যুদ্ধের যে সমস্ত খবর পেতে লাগলাম, তাতে মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, আমরা কাঙ্ক্ষিত তারিখে মুক্তি পাচ্ছি না।
মার্চের ২৯ তারিখে ফ. খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
হু হু করে বাড়তে লাগলো তার শরীরের তাপমাত্রা। মার্চের ত্রিশ তারিখ, যেদিন স্বপ্ন অনুযায়ী যুদ্ধ শেষ হবার কথা, ক্যাম্প থেকে মুক্ত হবার কথা, সেদিন তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হলো। প্রথমে তিনি প্রলাপ বকতে শুরু করলেন। তারপর জ্ঞান হারালেন। একত্রিশ মার্চ তিনি জাগতিক সব দুঃখ-কষ্টের ঊর্ধ্বে চলে গেলেন। মুক্ত হয়ে গেলেন ক্যাম্প থেকে।
সবাই জানল, তিনি টাইফাস জ্বরে মারা গিয়েছেন।
মানুষের মানসিক, শারীরিক অবস্থার সাথে তার আশা, প্রত্যাশা সাহসের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। মানুষের আশা শেষ হয়ে গেলে, তার প্রত্যাশা পূরণ না হলে, অনেক ভয়ঙ্কর অবস্থা হতে পারে। এমনকি তার মৃত্যুও হতে পারে।
আমার বন্ধু খুব করে বিশ্বাস করেছিল, ত্রিশ তারিখে যুদ্ধ শেষ হবেই। তার স্বপ্ন মিথ্যে হতে পারে না। কিন্তু সে যখন দেখল, বাস্তবে তা হবার সম্ভাবনা নেই। সে ভীষণ ভাবে মুষড়ে পড়ল। হতাশ হয়ে গেল। এই সুযোগে টাইফাস আক্রমণ করে বসলো। তার শরীর বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ গড়ে তুললো না জীবাণুর বিরুদ্ধে। ভবিষ্যতের ব্যাপারে তার ভীষণ আশা ছিল। কিন্তু সে আশা যখন পূর্ণ হলো না, তার বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই মরে গেল। এই সুযোগে অসুখও বাসা বেঁধে বসল তার শরীরে। অবশেষে জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি তার স্বপ্নকে সত্য করে গেলেন।
এই ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে আমাদের ক্যাম্পের প্রধান ডাক্তার উপরিউক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালের বড়দিন থেকে ১৯৪৫ সালের নববর্ষ পর্যন্ত এই কয়েক সপ্তাহে ক্যাম্পে মৃত্যুর সংখ্যা অতীতে সব রেকর্ডকে হার মানিয়েছিল।
শারীরিক পরিশ্রম, খাদ্য ঘাটতি বা অন্য কোনো অসুখ-বিসুখের কারণে এই মৃত্যুর পরিমাণ বাড়েনি। কারণটা ছিল ভিন্ন। অধিকাংশ বন্দির মনে একটি স্বপ্ন ছিল, পরবর্তী বড়দিনের সময় তারা পরিবার পরিজনের পাশে থাকবে। কিন্তু বড়দিন যতই এগিয়ে আসতে লাগলো, যতই তারা বুঝতে পারলো, তাদের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে, পূরণ হবে না, ততই তারা হতাশ হয়ে পড়লো। তারা বেঁচে থাকার ইচ্ছা, সাহস হারিয়ে ফেলল। তাদের শরীরের যে প্রতিরোধ ক্ষমতা, তা একেবারেই ভেঙ্গে গিয়েছিল। ফলে বিপুলসংখ্যক বন্দি মারা যায়।
পূর্বেই বলেছি, ক্যাম্পের মধ্যে মানসিক জোর তৈরি করতে হলে, তাকে স্বপ্ন দেখতে হবে। লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। যে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সে সবকিছু করতে প্রস্তুত থাকবে।
নিৎসে বলেছেন, ‘সে যদি বেঁচে থাকতে চায়, তাহলে সব কিছু সহ্য করেই সে বেঁচে থাকবে।’
সাইকোথেরাপিউটিক এবং সাইকোহাইজেনিক এক্ষেত্রে বন্দিদের পথ নির্দেশনা দিতে পারে। যখনই এদের কোনো সুযোগ আসে, মনে প্রশ্ন জাগে, কেন বাঁচতে হবে? বেঁচে কী লাভ? আসলে এসব যারা ভাবে, তাদের জন্য ধিক্কার। ধিক্কার তাদের জন্য, যাদের জীবনে কোনো লক্ষ্য নেই, উদ্দেশ্য নেই— জীবনকে এগিয়ে নেবার জন্য জোর নেই। যাদের এমন মন মানসিকতা, তার শীঘ্রই হারিয়ে যাবেন। এরপরেও কেউ যদি বলেন, জীবন থেকে আমার পাওয়ার কিছু নেই। তাহলে তাকে আর কী বলা যেতে পারে?
আসলে জীবনের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির একটি মৌলিক পরিবর্তন আনা দরকার। আমাদের নিজেদের শিখতে হয়েছিল, শুধু আমাদেরই নয়, যারা হতাশ হয়ে পড়েছিল, তাদেরও শেখাতে হয়েছিল, ‘আমরা জীবন থেকে কী চাই, সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো, জীবন আমাদের থেকে কী চায়?’
জীবন কী? জীবনের মানে কী? আমাদের এ ধরনের প্রশ্ন করা বন্ধ করতে হবে। এর বদলে ভাবতে হবে, যারা প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টায় এসব চিন্তা করে সময় নষ্ট করেছে, তার বিনিময়ে তারা কী পেয়েছে? তাছাড়া আমাদের শুধু কথা বললেই হবে না, ভাবলেই হবে না, কাজের মধ্য দিয়ে তা প্রমাণ করতে হবে। জীবনের প্রকৃত মানে হলো সমস্যা সঠিক সমাধান খুঁজে বেরা করা। নিজের যা দায়িত্ব, কর্তব্য, তা ঠিকঠাক ভাবে সম্পন্ন করা।
এই কাজ এবং জীবনের অর্থ একেক মানুষের কাছে একেক ভাবে ধরা দেয়। শুধু তাই নয়, প্রতি মুহূর্তে এর অর্থ বদলায়। তাই জীবনের অর্থ কী— এর সার্বজনীন সংজ্ঞা দেয়া এক কথায় অসম্ভব। অসম্ভব স্পষ্ট করে বলা যে, এটাকেই জীবন বলে। তাই বলে ‘জীবন’ কোনো অবাস্তব বস্তু নয়। এটা খুবই বাস্তব এবং প্রকাশিত। যদিও জীবন একেক মানুষের গন্তব্য একেক পথে নির্ধারণ করে। কারো সাথে কারো মিল থাকে না। সবার জন্যই স্বতন্ত্র পথ খোলা থাকে। কারো সাথে কারো অবস্থা, পরিস্থিতি মিলে না। সবাইকে নিজের মতো করে নিজের পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়। কখনো কখনো মানুষ এমন অবস্থার মুখোমুখি হয় যে, নিজের ভাগ্য নিজেকেই তৈরি করে নিতে হয়। অন্য সময় তার এই অবস্থার কথা চিন্তা করে নানান সুযোগ তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ অতীতের শিক্ষাকে সে ভবিষ্যতের জন্য কাজে লাগাতে পারে। কখনো কখনো কষ্টের মধ্যেও ভাগ্যকে সহজ ভাবে গ্রহণ করে নিতে হয়।
প্রতিটি মুহূর্তই আলাদা। তাই প্রতিটি সমস্যায় নতুন করে সমাধান বের করতে হয়।
যখন কোনো মানুষ বুঝতে পারে, তার কপালে দুঃখ ভোগ আছে, তখন সে দুঃখকে ভোগ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। এবং সে একা নিজের মতো করে সে কষ্ট ভোগ করে। সে বুঝতে পাওে, এই পৃথিবীতে কষ্ট বহন করার কেউ নেই। তার কষ্ট তাকেই ভোগ করতে হবে। কেউ তার এই কষ্ট দূর করতে পারবে না। তার বদলে অন্যকেউ কষ্ট ভোগ করতে পারবে না। তার এই যন্ত্রণাভোগ করার মাঝে অনেক সময় সুখ নিহিত থাকতে পারে।
বন্দি হিসেবে আমাদের কাছে এই চিন্তাভাবনাগুলো একেবারে অবাস্তব ছিল না। এই ধরনের চিন্তাভাবনা আমাদের অনেক উপকার করতো। কখনো যদি খুব বেশি হতাশ হয়ে পড়তাম, যদি মনে হতো এই বন্দিজীবন থেকে কখনোই মুক্তি পাবো না, তখন এই চিন্তা আমাদের মনে আশা জাগিয়ে রাখতো। হতাশা থেকে দূরে রাখতো। জীবন কী— এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার বয়স অনেক আগেই পার করে চলে এসেছি। এখন সহজ কথায় সৃষ্টিশীল কিছু করার লক্ষ্যকেই জীবন মনে হয়। আমাদের কাছে এখন জীবন মানে জীবন ও মৃত্যুর একটি সার্কেল। কষ্ট করা। তারপরে সৃষ্টি করা।
একবার আমাদের কাছে দুঃখভোগ করার কারণ প্রকাশিত হলো। তখন থেকে মিথ্যে আশায় বুক বেঁধে ক্যাম্পের কষ্টকে ভুলে থাকতাম। কষ্ট ভোগ করা আমাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমরা কেউ তা থেকে পালাতে চাইনি। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম এর সুফল একদিন আমরা পাবোই। কবি রিলকের ভাষায় বলতে হয়, ‘কত কষ্টের মধ্য দিতে যেতে হবে।’
রিলকে এই ‘কষ্টের মধ্য দিয়ে যাওয়া’কে অনেকে হয়তো পরিবর্তন করে ‘কাজের মধ্য দিয়ে যাওয়া বলবেন।’ আমাদের জন্য এই যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাওয়াটা সহজ ব্যাপার ছিল না। এরজন্য অনেক অশ্রু ঝরাতে হয়েছে। তবে কান্নার জন্য আমরা লজ্জিত নই। কারণ এই কান্নাই সাক্ষ্য দেয়, যন্ত্রণা ভোগ করার মতো সাহস আমাদের ছিল। যদিও খুব কম লোকই সেটি বুঝেছিল। তবে কান্নার কথা স্বীকার করতে কেউ কেউ লজ্জা পায়।
আমার এক সহবন্দিকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কীভাবে তার ফোলা ভালো হয়েছিল। সে কিছুটা লজ্জিত হয়ে স্বীকার করেছিল, “কান্নার মাধ্যমে। যদিও এ ধরনের কাজ করা আমার নীতিবিরুদ্ধ।’
নিজের বা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তখনই ক্যাম্পে সাইকোথেরাপি বা সাইকোহাইজেন প্রক্রিয়া শুরু হয়। নিজেই সাইকোথেরাপিউটিক পদক্ষেপ নেয়া ছিল এক ধরনের জীবন রক্ষাকারী পদ্ধতি। এর ফলে অনেকেই আত্মহত্যার প্রবণতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল। ক্যাম্পের একটি কঠিন নিয়ম ছিল। যদিও কেউ আত্মহত্যা করতে চায়, তাহলে কেউ তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারবে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কেউ হয়তো ফাঁসিতে ঝুলেছে, তখন দড়ি কেটে তাকে নামিয়ে আনা নিষেধ ছিল। তাই এ ধরনের প্রচেষ্টা থেকে লোকদের নিরস্ত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার ছিল।
আত্মহত্যা করবে এমন দুটো লোকের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। তাদের দুজনের মধ্যে অদ্ভুত এক মিল ছিল। তারা দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিল আত্মহত্যা করবেই। তাদের ওই একই কথা- জীবন থেকে পাওয়ার কিছু নেই। দুজনকেই উপলব্ধি করানোর বিষয় ছিল যে, জীবন তাদের কাছ থেকে এখনো অনেক কিছু প্রত্যাশা করে। ভবিষ্যৎ তাদের কাছ থেকে এখনো অনেক কিছু চায়।
পরবর্তী সময় আমরা জানতে পারলাম, একজনের সন্তান আছে। সেই সন্তান অন্য এক দেশে তার ফিরে যাবার জন্য অপেক্ষা করছে।
অন্যজনের বিষয়েও খোঁজ খবর নিলাম।
তার ঘটনাটি কোনো ব্যক্তি নয়, বস্তুর সাথে সম্পর্কিত। এই ব্যক্তি ছিল একজন বিজ্ঞানী। সে বিজ্ঞান বিষয়ক একটি সিরিজ বই লিখছিল, যা তখনো লেখা সম্পূর্ণ হয়নি। তার লেখা অসম্পূর্ণ সিরিজ অন্য কারো দ্বারা সমাপ্ত করা সম্ভব নয়। কারণ বাবার চেয়ে সন্তানকে অন্য লোক কখনোই বেশি ভালোবাসতে পারে না।
এই স্বাতন্ত্রিকতা এবং একাকিত্ব মানুষকে অন্য মানুষ থেকে আলাদা করে। তার অস্তিত্বকে সবার সামনে তুলে ধরে। একজন মানুষ সৃষ্টিশীল কাজের মধ্যদিয়েই অন্যজনের ভালোবাসা পায়। যখন কোনো ব্যক্তি বুঝতে পারে তার মতো আর কেউ নাই, তখন তার মধ্যে একটি দায়িত্ববোধ জাগ্রত হয়। তখন সে চেষ্টা করে সবার কাছে তার অস্তিত্বকে জানান দিতে। যখন কোনো মানুষ বুঝতে পারে, কেউ একজন তার জন্য, শুধু তার জন্যই অপেক্ষা করছে কিংবা তার কাজ, তার সৃষ্টি সম্পূর্ণ করার দ্বিতীয় কেউ নেই, তখন সেই মানুষ কখনোই জীবনকে তুচ্ছ করতে পারে না। তিনি জানেন, তার এই অস্তিত্ব ‘কেন?” এবং ‘কীভাবে’ তাকে রক্ষা করতে হবে।
সম্মিলিত মনোচিকিৎসার সুযোগ ক্যাম্পে স্বাভাবিক ভাবেই সীমাবদ্ধ ছিল।
একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক। একজন জ্যেষ্ঠ কারারক্ষক, যিনি কর্তৃপক্ষের পক্ষে ছিলেন না, তার ন্যায়বিচার এবং উৎসাহব্যঞ্জক আচরণের দ্বারা তাঁর অধীনস্থ বন্দিদের নৈতিক প্রভাব অর্জনের হাজারো সুযোগ ছিল। মুখে বলার চেয়ে কোনো কাজ করে দেখানোর প্রভাব অনেক বেশি। তবে কখনো কথাও বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। বাইরের পরিবেশ, পরিস্থিতির কারণে যখন মন কিছু গ্রহণ করতে উন্মুখ হয়ে থাকে, তখন কথা বিরাট ভূমিকা পালন করে। এই রকম একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। একবার ছাউনিতে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, যার ফলে সবাইকে মনোচিকিৎসা করার প্রয়োজন হয়েছিল।
সেটা ছিল আমার জন্য খুবই খারাপ একটি দিন।
ওইদিন প্যারেডের সময় বেশ কিছু কাজের ঘোষণা দেয়া হয়। এখন থেকে ওই কাজগুলোকে নাশকতা হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। কেউ এই নাশকতামূলক কাজগুলো করলে, ধরা পড়া মাত্র, তাদেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। এরমধ্যে পুরোনো কম্বলের কিছু অংশ কাটা (কম্বলের এই ফালি আমরা পায়ের গোড়ালির নিচে রাখতাম) এবং ছোটখাটো চুরিও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এর কিছুদিন আগেই এক ক্ষুধার্ত বন্দি দোকান ভেঙে ভিতরে ঢুকে আলু চুরি করেছিল। চুরির ঘটনাটি চাপা থাকেনি। প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল। কয়েকজন বন্দি চোরকেও চিহ্নিত করেছিল। যখন কর্তৃপক্ষ চুরির কথা জানলো, তারা ঘোষণা দিল, চোরকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। শুধু তাই নয়, শাস্তিস্বরূপ ক্যাম্পের সব বন্দিদের একদিন খাবার দেয়া হবে না। স্বভাবতই আড়াই হাজার বন্দিকে সেদিন না খেয়ে কাটাতে হয়েছিল।
যেদিন আমাদের উপবাস করতে হয়েছিল, ওইদিন সন্ধ্যার কথা।
আমরা মন খারাপ করে ঘরের মধ্যে চুপচাপ শুয়ে আছি। খুবই কম কথা হচ্ছে। সামান্য শব্দেও চরম বিরক্তি লাগছিল। বাতি নিভে গেলে পরিবেশ আরও খারাপ হয়ে উঠলো।
মেজাজ চূড়ান্ত খারাপ হয়ে আছে।
আমাদের জ্যেষ্ঠ কারারক্ষক ছিল খুবই জ্ঞানী ব্যক্তি। তখন তিনি আমাদের মানসিক অবস্থা নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন।
তিনি আমাদের বেশ কয়েকজন সহবন্দির কথা বললেন, যারা গত কয়েকদিনে মারা গেছে। কেউ অসুস্থতায় মারা গেছে। কেউ আত্মহত্যা করে মরেছে।
তিনি বললেন, তাদের মৃত্যুর আসল কারণ কিন্তু ভিন্ন। তারা মারা গিয়েছেন কারণ তাদের আশা শেষ হয়ে গিয়েছিল। মানুষের যখন কোনো আশা থাকে না, তখন তার বেঁচে থাকার সব ইচ্ছে মরে যায়। তিনি বলতে লাগলেন, এই ভবিষ্যতের প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলছে, এজন্য কিছু করা উচিত। এমন কিছু করা উচিত যেন এখানে যারা আছে, তারা না মনে করে, তাদের ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। তারপর তিনি আমাকে ইঙ্গিত করলেন, এই বিষয়ে কিছু বলার জন্য।
আল্লাহ জানে, আমি তখন সহবন্দিদের মানসিক ভাবে শান্ত করার জন্য মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বা উপদেশ দেবার মেজাজে ছিলাম না। একে প্ৰচণ্ড শীত, তার উপর পেটে ক্ষুধার কারণে আগুন জ্বলছে। শরীর ভীষণ ক্লান্ত। মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। তারপরেও আমি চেষ্টা করলাম, এই ইউনিক সুযোগটা কাজে লাগানোর জন্য। তাদের মানসিকভাবে চাঙ্গা করে তোলাই ছিল তখন প্রধান কাজ।
তাই প্রথমে আমি হালকা কথাবার্তা বলতে লাগলাম।
বললাম, দেখুন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবার পর এটা ষষ্ঠ শীত। আমরা আমাদের অবস্থা যতটা খারাপ ভাবছি, আসলে ততটা খারাপ নয়।’
আমি বলতে লাগলাম, ‘আচ্ছা, আপনারা নিজে নিজে একটু চিন্তা করে দেখুন তো, এখন পর্যন্ত কার কী কী ক্ষতি হয়েছে?’
আমি অনুমান করেছিলাম, বেশির ভাগ লোকজনেরই তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। যে এখনো বেঁচে আছে, তারপক্ষে আশাবাদী হবার কারণ আছে। তার সামনে স্বাস্থ্য, পরিবার, সুখ, পেশাগত দক্ষতা, সামাজিক অবস্থান তৈরি করার এখনো অনেক সুযোগ আছে। সর্বোপরি, আমাদের হাঁড় এখনো ঠিক আছে। ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেয়নি। নিজের পায়ে এখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারি। বরং এখানে আমরা যা যা করছি, ভবিষ্যতে আমাদের জন্য তা সম্পদ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তারপর আমি নিৎসের একটি কথা উদ্ধৃত করলাম, ‘যেটা আমাকে হত্যা করে না, সেটা আমাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।’
এরপর আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে লাগলাম।
বললাম, ‘এই অবস্থায় আমাদের কাছে ভবিষ্যৎ নিরর্থক মনে হতে পারে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখলে, সেটাই স্বাভাবিক। হ্যাঁ, এখান থেকে জীবন নিয়ে ফেরার সম্ভাবনাও খুব কম।’ আমি আরও বললাম, ‘ক্যাম্পে টাইফাস এখনো মহামারী আকারে দেখা দেয়নি। তারপরও বলা যায়, এখানে বিশজনের মধ্যে একজন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আছে। এই হিসাব আপনার আমার সবার জন্যই প্রযোজ্য। হ্যাঁ, তারপরেও বলবো, এ অবস্থাতেও আমাদের হতাশ হবার কিছু নেই। এখনো আশা আছে। যদিও জানি না, আমাদের ভাগ্যে কী আছে? কী ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ভবিষ্যতের কথা বলছি কেন? এক ঘণ্টা পর কী হবে, তাও কেউ জানি না। এমন কি সামনের কয়েকদিনের মধ্যে আশাজাগানিয়া কোনো সামরিক অভিযানের সম্ভাবনাও নেই। তারপরেও বলি, আমাদের চেয়ে কে- ই বা ভালো জানে, ক্যাম্পের এই দুঃসহ অবস্থার মধ্যেও হঠাৎ করেই কারো ভাগ্য খুলে যেতে পারে। হতে পারে কেউ একজন অপ্রত্যাশিত ভাবেই কোনো ভালো দলের সাথে কাজ পেল। তখন সবাই, এমন কি সে নিজেও বলবে না, ভাগ্যের গুণেই এমনটি হয়েছে।’
তবে আমি শুধু ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নিয়েই কথা বলিনি। অতীতের কথাও বলেছি। আহা অতীত। আনন্দে ভরা সোনালি অতীত। বর্তমানের অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনেও উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছিল। সবাই যেন মনে না করে শুধু জ্ঞান দিয়েই যাচ্ছি, তাই আবার একজন কবির কবিতার একটি লাইন বললাম, “তুমি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করবে, তা পৃথিবীর কোনো শক্তিই কেড়ে নিতে পারবে না।’ শুধু অভিজ্ঞতার কথাই বলছি কেন, আমরা যা কিছু করেছি, আমাদের যত চিন্তাভাবনা, এই কষ্ট, যন্ত্রণা, লাঞ্চনা, কিছুই ফেলনা নয়। এগুলো অতীতের মতো আমাদের জীবনে দ্যূতি ছড়াবে, অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমা হবে। আমাদের অস্তিত্বের সাথেই এগুলো যুক্ত হয়ে থাকবে। মনে রাখতে হবে, জীবনের ধন যায় না কিছুই ফেলা।
তারপর জীবনকে কীভাবে অর্থবহ করে তোলা যায়, এ বিষয়ে বললাম। আমি আমার সঙ্গীদেরকে জীবন সম্পর্কে বলছিলাম।
তারা চুপচাপ শুয়ে শুয়ে শুনছিলো। মাঝেমধ্যে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছিল তাদের মাঝ থেকে।
বলতে লাগলাম, ‘কোনো অবস্থাতেই জীবন থেমে থাকে না। জরা, কষ্ট, মৃত্যু— এ সবই জীবনের অন্তর্ভুক্ত।’
এমন সময় ঘরের অন্ধকার কোণে বসে থাকা কয়েকজন মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়া কয়েদিকে বললাম, হাল না ছাড়ার জন্য।
বললাম, আশাহত হবার কিছু নেই। মনে সাহস রেখে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের এই কষ্ট জীবনের একটি অংশ। বললাম, এই দুঃসময়েও কেউ না কেউ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। সে হতে পারে কোনো বন্ধু, স্ত্রী অথবা অন্য কেউ। তারা কেউই চাইবেন না আমরা মনোবল হারিয়ে ফেলি। এমনকি আল্লাহও চাইবেন না আমরা জীবনে পরাজিত হই। তারা চাইবেন, আমরা যেন সাহসিকতার সাথে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করি। যদি মৃত্যু হয়, তাও যেন বীরের মতো হয়।
সবশেষে আমাদের আত্মত্যাগ নিয়ে কথা বললাম। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য কিছু না কিছু ত্যাগ করতেই হয়। পৃথিবীর নিয়মই এই, সাফল্যের জন্য ত্যাগ করতেই হবে। যদিও অনেক সময় এ ত্যাগের কথা কেউ মনে রাখে না। আমি খোলাখুলি ভাবেই কথাগুলো বলেছি। যাদের মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল, তাদের কথাগুলো বুঝতে কষ্ট হয়নি। আমি সবাইকে আমার এক বন্ধুর কথা বলেছিলাম, যে ক্যাম্পে এসেছিলই একটি উদ্দেশ্য নিয়ে। তার ইচ্ছে ছিল, তার মৃত্যুর বিনিময়েও যেন তার পছন্দের মানুষগুলো ভালো থাকে। তার এই ত্যাগ, মৃত্যু সার্থক। অর্থবহ। তার তাদের গভীর তাৎপর্য আছে। সে এমি এমিই মরতে চায়নি। অবশ্য কেউই তা চায় না।
আমার এ কথাগুলোর উদ্দেশ্য ছিল, তারা যেন আমাদের পুরো জীবনের একটি অর্থ খুঁজে পায়। এ কথাগুলো বিশেষ করে সেখানে বসে থাকা হতাশাগ্রস্তদের উদ্দেশ্যে বলা।
দেখলাম, আমার কথাগুলো বেশ ভালোই কাজে দিয়েছে। এমন সময় লাইটগুলো আবার জ্বলে উঠল।
আমি দেখলাম, আমার দুর্ভাগা বন্ধুদের চোখে অশ্রু। তারা আমাকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। তবে স্বীকার করতে বাধা নেই, এই কষ্টের মধ্যে আমার সহবন্দিদের প্রভাবিত করার মতো মানসিক শক্তি আমার ততোটা ছিল না। আমি অনেক সুযোগই তখন হাতছাড়া করেছি।
আমরা এখন বন্দিদের মানসিক প্রতিক্রিয়ার তৃতীয় ধাপে এসে পৌঁছেছি। তৃতীয় ধাপ হলো, মুক্তি পাওয়ার পরে বন্দিদের মানসিক অবস্থা কেমন ছিল?
তার আগে মনোবিজ্ঞানীরা প্রায়ই একটি প্রশ্নের উত্তর স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে জানতে চায়, সেই উত্তর জানা জরুরি। তারা ক্যাম্পের গার্ডদের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চায়। একজন রক্তমাংসে গড়া মানুষ কীভাবে অসংখ্য বন্দিদের সাথে এমন আচরণ করতে পারে? যারাই এ ঘটনা শোনে, হয়তো বিশ্বাসও করে, তারপরেও তাদের মনের দ্বন্দ্ব কাটে না। জানতে চায়, তারা কীভাবে এটা করে? বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়ে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য কিন্তু পয়েন্ট আকারে আলোচনা করা যেতে পারে।
এক.
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা যেতে পারে গার্ডদের মাঝে অনেকেই ছিল স্যাডিস্ট। তাদের মানসিক ধরণই ছিল অত্যাচার করা।
দুই.
যখনই কোনো গার্ডের জন্য লোকের প্রয়োজন হতো তখন এই স্যাডিস্টদের নিয়োগ দেয়া হতো। এরা খুবই হিংস্র হতো।
একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে।
আমরা যখন কাজ করতে বাইরে যেতাম, দেখা যেত দুই তিন ঘণ্টা কাজ করার পর, শীতে একদম জমে যেতাম। হাত-পাগুলো অসাড় হয়ে যেত। তখন গাছের ডালপালা দিয়ে জ্বালানো আগুনে হাত-পা সেঁকে নিতাম আমরা। আগেই এই অনুমতি দেয়া ছিল। তারপরেও কিছু পিশাচ টাইপের ফোরম্যান ছিল, যারা কোনোভাবে আমাদের আগুনের কাছে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারলে আহ্লাদে আটখানা হয়ে যেত। কী যে খুশি হতো তারা। শুধু তাই নয়, আগুনের চুলাকে কখনো কখনো বরফের উপর উল্টে ফেলে দিত। নিভিয়ে ফেলতো আগুন। তখন তাদের চেহারা দেখলে মনে হতো, দুনিয়ায় তাদের মতো খুশি-সুখী আর কেউ নেই।
কোনো এসএস সদস্য যদি কাউকে অপছন্দ করতো, তাহলে সেই এসএস সদস্য তার অপছন্দের বন্দিকে তার পরিচিত কর্মকর্তার কাছে পাঠিয়ে দিতো। বলাবাহুল্য, বন্দিদের নির্যাতন করার ক্ষেত্রে তারা হতো অদ্বিতীয়। এভাবে অপছন্দের লোকদের নির্যাতন করিয়ে তাদের বিকৃত রুচি চরিতার্থ করতো।
তিন.
বছরের পর বছর বন্দিদের উপর এমন অত্যাচার দেখতে দেখতে গার্ডদের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। কেউ কেউ হয়তো এসব কাজ করা থেকে বিরত ছিলেন। কিন্তু তারাও অন্যকে এই কাজ করা থেকে বাধা দেননি।
চার.
এটা অবশ্যই স্বীকার করা উচিত, কোনো কোনো গার্ড আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। আমি যে ক্যাম্প থেকে মুক্ত হয়েছিলাম, ওই ক্যাম্পের কমান্ডারের কথা আমাকে অবশ্যই বলতে হবে। মুক্ত হবার পর ঘটনাটি জানাজানি হয়। আমাদের ক্যাম্পের ডাক্তার, যিনি নিজেও একজন বন্দি ছিলেন, আমি তাকে আগেই থেকেই চিনতাম। তো তিনি নিজের পকেটের টাকা দিয়ে কয়েদিদের জন্য নিকটস্থ শহরের মার্কেট থেকে ওষুধ আনাতেন। আরেকজনের কথা বলি, যিনি আমাদের ক্যাম্পের জ্যেষ্ঠ কারারক্ষী –তিনিও মূলত বন্দিই ছিলেন। পরে কারারক্ষীর দায়িত্ব পান বললে বিশ্বাস করবেন না, তিনি এসএস সদস্যদের চেয়ে নিষ্ঠুর ছিলেন। পান থেকে চুন খসলেই তিনি বন্দিদের ভীষণ মারধোর করতেন। ক্ষমা করতেন না। অথচ ক্যাম্পের কমান্ডার আমার জানা মতে, কাউকেই কখনো শাস্তি দেননি। কারো বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।
এতে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, একজন মানুষ ক্যাম্পে বন্দি, নাকি কর্মকর্তা, তা তার আচরণে বোঝা যায় না। মানবিক দয়া কখন কার কাছ থেকে পাওয়া যাবে, তা আগেই বলা যায় না। এমনও হতে পারে, যাদের ঢালাও ভাবে নিন্দা করলেও কেউ টু শব্দ করবে না, তারাও মানবিক আচরণ দেখাতে পারে। আসলে মানুষের মাঝে ফেরেশতা এবং শয়তান খুব কাছাকাছি বাস করে। তাই অনেক সময় জোর গলায় বলা সম্ভব হয় না, এই লোক ইবলিশ। খারাপ। এই লোক খুবই ভালো। একেবারে ফেরেশতা।
তবে ক্যাম্পের যে পরিবেশ, এই পরিবেশে একজন গার্ড বা ফোরম্যানের বন্দিদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া তাদের বড় মনেরই পরিচয় দেয়। ঠিক একই ভাবে নিজেও বন্দি হয়ে অন্য বন্দিদের উপর অত্যাচার করা তাদের ছোটলোকির পরিচয়ই দেয়। বন্দিরা তাদের সহবন্দিদের কাছে রূঢ় আচরণ পেলে ভীষণ কষ্ট পেতো, তেমনি কারো কাছ থেকে সহানুভূতিশীল আচরণ পেলে খুবই আবেগ তাড়িত হয়ে পড়তো।
একটি ঘটনা আমার স্পষ্ট মনে পড়ে।
একদিন এক ফোরম্যান আমার হাতে এক টুকরো রুটি তুলে দিল। আমি জানতাম, সে সকালের খাবার থেকে এই রুটি বাঁচিয়ে রেখেছিল। আমার কাছে তখন মনে হয়েছিল, এটি সামান্য এক টুকরো রুটি নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। আমার চোখে তখন পানি চলে এসেছিল। তার রুটি দেয়াটা এমন একটা কিছু, যা শুধু মানুষই মানুষকে দিতে পারে। সেদিন তার সে-কথা, মমতাপূর্ণ চাহনি আমার জন্য অনেক বড় এক উপহার ছিল।
এ থেকে বোঝা যায়, পৃথিবীতে দুই ধরনের পুরুষ আছে। ভালো এবং মন্দ। আর তারা সবখানেই আছে। সমাজের সর্বস্তরেই এই দুই ধরনের লোক পাওয়া যাবে। কোনো জায়গার সবাই ভালো নয় আবার কোনো জায়গার সবাই খারাপ নয়। ক্যাম্পের গার্ডদের মাঝেও দুই একজন মানুষ পাওয়া গিয়েছিল।
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের জীবন মানুষের আত্মাকে প্রসারিত করে। তার অনুভূতিকে গভীর করে তোলে। আশ্চর্যের বিষয়, এই গভীরতার ফলে যে মূল্যবোধ তৈরি হয়, সেখানেও ভালো-খারাপ দুটোই আছে। একটি রেখা ভালোকে খারাপ থেকে আলাদা করে রাখে। যা সব মানুষের মধ্যেই একই রকম। যা কি না কোনো বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যেই প্রকাশ পায়। যেমন প্রকাশ পেয়েছিল কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের খোলা আকাশের নিচে।
আমরা শেষ অধ্যায়ে চলে এসেছি। এখানে আমরা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে মুক্ত হওয়া বন্দিদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করবো। ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তাদের মানসিক অবস্থা কেমন হয়েছিল, তা তুলে ধরার চেষ্টা করবো। মুক্ত হবার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গেলে, স্বভাবতই ব্যক্তিগত কথা উঠে আসবে। আসুক। সকাল থেকেই শুরু করি। ক্যাম্পে সাদা পতাকা উত্তোলন করা হলো। আমরা সবাই ভীষণ উত্তেজিত 1 উত্তেজনা সত্ত্বেও মনে হচ্ছিল আমাদের বুক থেকে পাথর নেমে যাচ্ছে। কী এ শান্তি তখন। তবে খুশিতে পাগল হয়ে গিয়ে ছিলাম বললে ভুল হবে। প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে কী হয়েছিল সেদিন?
ক্লান্ত পা আমাদের আস্তে আস্তে ক্যাম্পের গেইটের দিকে নিয়ে গেল। কিছুটা ভয় নিয়ে আমরা আশেপাশে দেখতে লাগলাম। একজন আরেক জনের দিকে এমন ভাবে তাকাচ্ছি, যেন জিজ্ঞেস করছিল, কী হচ্ছে এসব?
তারপর বুকে সাহস নিয়ে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলাম। কেউ আমাদের কিছু বললো না। পেছন থেকে কেউ খেঁকিয়ে উঠলো না কিংবা পিঠের মধ্যে দড়াম করে কিল বা পাছায় লাথি মারলো না।
বললে বিশ্বাস হবে না, গার্ডরা আমাদের দিকে সিগারেট বাড়িয়ে দিল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না তখন। সাধারণ পোশাক পরে তারা যেন আমূল বদলে গিয়েছিল। ক্যাম্প থেকে যে রাস্তা বেরিয়ে গেছে, আমরা সেটি ধরে এগুতে লাগলাম। বেশি দূর যেতে পারলাম না। পা ব্যথায় টনটন করতে লাগল। কিন্তু ক্যাম্পের চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখার লোভ কিছুতেই ছাড়তে পারছিলাম না। স্বাধীন হবার পর এই প্রথম সব কিছু দেখছি। ‘স্বাধীনতা’– এই শব্দটি বারবার নিজেরাই নিজেদেরকে বলে শুনাচ্ছিলাম। তারপরও যেন তৃপ্তি মিটছিল না। আমরা বলতে লাগলাম, এই একটি শব্দের কথা ভেবে আমাদের বছর কেটেছে। কত স্বপ্ন দেখেছি এটাকে নিয়ে। এখন মনে হচ্ছে এর কোনো মূল্য নেই। এর প্রকৃত অর্থ আমরা অনুধাবন করতে পারছি না। আমাদের চেতনাকে ছুঁতে পারছে না এ শব্দ। মনেই হচ্ছে না, আমরা স্বাধীন হয়ে গিয়েছি।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটি মাঠে এসে পৌছালাম।
ফুলে ফুলে ভরা মাঠ।
বুঝতে পারলাম, অনেক আগেই থেকেই এখানে ফুল ফুটে আছে। কিন্তু তারপরও আমদের মানসিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন জাগলো না। ফুলের সৌন্দর্য আমাদের অনুভূতিতে দোলা দিতে ব্যর্থ হলো। যখন নানা রঙের পালকে ভরা একটি মোরগ দেখলাম, প্রথম আমাদের মনে আনন্দের ফুলকি ছুটল। তবে এই আনন্দ এক মুহূর্তের জন্যই স্থায়ী হয়েছিল। এর বেশি নয়। সেই আনন্দের আমাদের পৃথিবীকে বেশিক্ষণ রাঙাতে পারেনি।
সন্ধ্যায় আমরা সবাই ছাউনিতে একত্রিত হলাম। একজন আরেকজনকে গোপনে জিজ্ঞেস করতে লাগলো, ‘আচ্ছা, আমাকে বলতো, তোমরা কোথায় চলে গিয়েছিলে?’
তখন যাকে জিজ্ঞেস করেছিল, সে ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিল, ‘সত্যি বলবো, জানি না।’
আমাদের সবার মানসিক অবস্থা এমনই ছিল। আমরা আক্ষরিক অর্থেই আনন্দিত হবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলাম। শুধু তাই নয়, এই গুণটি ফিরে পেতে অনেক সময় লেগেছিল।
মুক্ত হবার পরে বন্দিদের যে মানসিক পরিবর্তন ঘটেছিল, এটাকে বলে ‘ডিপারসোনালাইজেশন’ অর্থাৎ ব্যক্তিত্বহানি। সব কিছুকে তখন অবাস্তব মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, কোনো স্বপ্ন দেখছি। যা কখনোই পূরণ হবে না। আমরা বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না, সত্য সত্যই আমরা মুক্ত হয়েছি। বিগত বছরগুলোতে আমরা যতবার স্বপ্ন দেখেছি, ততবার সেইসব স্বপ্ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। গুড়ো গুড়ো হয়ে গেছে সব স্বপ্ন, আশা। আমরা স্বপ্ন দেখতাম, খুব তাড়াতাড়ি আমরা স্বাধীনতা পাবো। তখন সবাই পাখির মতো মুক্ত হয়ে যাবো। স্বপ্ন দেখতাম, বাড়ি ফিরে যাবো। বন্ধুরা এসে অভিনন্দন জানাবে। স্ত্রী এসে জড়িয়ে ধরবে। কান্নায় তার চোখ ভরে উঠবে। টেবিলে তার মুখোমুখি বসবো। ক্যাম্পের দুঃসহ জীবনে যা যা ভেবেছি, তা সব খুলে বলবো তাকে। প্রতিদিনই এমন কত স্বপ্ন দেখতাম, দিনের পর দিন চলে যেত এভাবে। কিন্তু যখনই বাঁশির তীক্ষ্ণ সুর এসে আমাদের কানে পৌঁছাতো, আমরা ঝটপট বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তাম। আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন এভাবেই অধরা থেকে যেত। ভেঙেচুড়ে ছারখার হয়ে যেত। তবে সত্য সত্যই যখন স্বাধীন হলাম, স্বপ্নের স্বাধীনতা পেলাম, বিশ্বাসই হচ্ছিল না, আমরা স্বাধীন।
মনের চেয়ে দেহের বাধা কম।
স্বাধীনতা পাবার প্রথম মুহূর্ত থেকেই আমি এর সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছিলাম। এটা শুরু করেছিলাম খাবার মাধ্যমে। আমি ইচ্ছে মতো খেতে লাগলাম। ঘণ্টায় ঘণ্টায় খেতাম। এমনকি দিন পেরিয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত খেয়েছি। কেউ চিন্তাও করতে পারবে না, একজন মানুষ যে কী পরিমাণ খেতে পারে! শুধু আমিই নই, যখন কোনো পাড়া-প্রতিবেশি একজন বন্দিকে দাওয়াত দিত, তখন সে খেতে গিয়ে দৈত্যের মতো খেতো। খাওয়া তার শেষই হতে চাই তো না। খাওয়া শেষ হলে কাপের পর কাপ কফি পান করা চলতো। যখন খাবার দাবাড় গলা পর্যন্ত চলে আসতো, তখন তার খাবার শেষ হতো। কিন্তু তখন শুরু হতো কথা বলা। অনর্গল কথা বলা।
একজন বন্দি এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে যেত। বিগত কয়েক বছর তার মনে যে কথার পাহাড় জমেছিল, এভাবে বলে বলে যেন সে নির্ভার হতো। কেউ তার কথা বলা শুনলে বলবে, থাক, তাকে কথা বলতে দাও। কথা বলতে না পারলে তার পেটের ভাত হজম হবে না। আমি এমন অনেক লোকদের চিনি, অল্প সময়ের মধ্যেই যাদের উপর দিয়ে অনেক চাপ গেছে (উদাহরণস্বরূপ গ্যাসটাপো যাচাই-বাছাইয়ের ঘটনার কথা বলা যেতে পারে)। শেষপর্যন্ত কথা বলার জন্য সবারই জিহ্বা শুধু লকলক করতো তাই নয়, কেউ কেউ অপ্রকৃতস্থ হয়ে গিয়েছিল।
একদিনের ঘটনা।
স্বাধীনতা পাবার অনেক দিন পার হয়ে গেছে। আমি ফুলে ভরা মাঠের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। মাইলের পর মাইল ফুলের বাগান। আমি তার মধ্যে হেঁটে যাচ্ছি। যখন ক্যাম্পের নিকটবর্তী শহরের মার্কেটের কাছাকাছি চলে এসেছি, দেখলাম, আকাশে ঝাঁক বেঁধে পাখি উড়ছে। বহুদূর থেকে আমাদের কানে ভেসে এল তাদের গানের সুমধুর সুর। মাইলের পর মাইল আমি কোনো মানুষের দেখা পাইনি। সেখানে কেউই ছিল না। তবুও বিপুলা পৃথিবী, নীলক্ষা আকাশ, আকাশে পাখির উড়াউড়ি, উল্লাস। আমি দাঁড়ালাম। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম। আকাশের যতটুকু দেখা যায়, ততটুকুর সৌন্দর্য মেখে নিলাম আমার চোখে। আমি মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। সেই মুহূর্তে আমি খুবই অল্পই জানতাম আমাকে। এদিকে বিশ্বের বিপুল আয়োজন। তাকে সম্পূর্ণ জানার প্রশ্নই আসে না। তখন একটা কথাই আমার মনে বাজছিল, এখন যা সবসময়ই বাজে, ‘আমি সংকীর্ণ কারাগার থেকে আল্লাহকে ডেকেছি; তিনি আমাকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে সেই ডাকের উত্তর দিয়েছেন।
আমি হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। ওই অবস্থায় কতক্ষণ ছিলাম, কত হাজার বার আমি এই কথাটি বলেছি— তা এখন আর মনে নেই। তবে আমি এটা হলফ করে বলতে পারি, ওইদিন, ওই ঘণ্টা থেকে আমার নতুন জীবন শুরু হয়েছে। নতুন করে মানুষ হবার জন্যে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেছি।
ক্যাম্পের শেষদিনগুলোতে প্রচণ্ড মানসিক উত্তেজনা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে নিজেকে মানিয়ে নেয়া সহজ ছিল না। অনেক বাধা ছিল এ পথে। যদি কেউ ভেবে থাকে যে, সদ্যমুক্তিপ্রাপ্ত বন্দির কোনো মানুষের সাহায্যের দরকার নেই, তাহলে সেটা হবে অনেক বড় একটা ভুল ধারণা। আমাদের বুঝতে হবে, যে বন্দি এতদিন এত অমানুষিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে নিয়মিত জীবন যাপন করেছে, তার মুক্তির পর বিপদের আশঙ্কা থাকে। যেহেতু তার এই মানসিক পীড়ন থেকে হঠাৎ করে সে মুক্ত হয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের ভাষায় একে মানসিক বাঁক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গোলাবারুদ বহনকারী ড্রাইভার যদি চালকের আসন থেকে হঠাৎ করে উঠে আসে, তাহলে সে স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়বে। কারণ তিনি এতক্ষণ বায়ুমণ্ডলের গতির তালের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ঠিক একই ভাবে কেউ যদি শঙ্কাপূর্ণ জীবন থেকে হঠাৎ মুক্তি লাভ করে, তাহলে সে ওই ড্রাইভারের মতোই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। সেই ঝুঁকি মানসিক বা শারীরিক- দুটোই হতে পারে।
ক্যাম্প থেকে মুক্তি পাওয়া মানুষের মানসিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, সাধারণ জীবনে ফিরে আসার পরও তারা ঠিক মতো স্বাভাবিক হতে পারে না। ক্যাম্পের দুঃসহ জীবন তাদের তাড়া করে চলে। মুক্ত হবার পর তারা ভেবেছিল, স্বাধীন জীবনে তারা যা খুশি তা করতে পারবে, যেমন ইচ্ছে চলতে পারবে। ফলে তাদের জীবনে একটি মাত্র পরিবর্তন আসে। এতদিন তারা ছিল নির্যাতনের শিকার। এখন তারাই হয়ে উঠেছে নির্যাতনকারী। তাদের এই পরিবর্তন অন্যকারো প্ররোচনায় নয়, স্বেচ্ছায় তারা এই ভূমিকা বেছে নেয়। অতীতের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার আলোকে তারা তাদের কর্মকাণ্ড বিচার করে থাকে। বিষয়টি এমন, ওরা তো কত নৃশংস ভাবে অত্যাচার করে, এর তুলনায় আমরা তো কিছুই বলছি না। ওদের তুলনায় আমরা ফেরেশতা। শিশু। এই নিষ্ঠুরতা তাদের কাছে ডালভাত হয়ে গিয়েছিল। একবার আমার বন্ধুর সাথে হেঁটে মাঠ পেরুচ্ছিলাম। আমরা ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছিলাম। একসময় আমরা সবুজ শস্যের ক্ষেতে এসে উপস্থিত হলাম। যেদিকে তাকাই সবুজ আর সবুজ। চোখ জুড়িয়ে যায়। স্বভাবতই আমি ক্ষেতের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম। আমার বন্ধু আমার হাত টেনে ধরল। টানতে টানতে ক্ষেতের মধ্যে নিয়ে এলো। আমার ইচ্ছে ছিল না, ক্ষেতের মধ্যে নেমে কচি ফসলগুলো নষ্ট করার। ওকে নিষেধ করলাম। সে আমার কথা চরম বিরক্ত হলো। বড় বড় চোখ করে তাকালো আমার দিকে। রাগী চাহনি।
চিৎকার করে বলল, ‘একটা কথা বলবি না। আমার কাছ থেকে কি সবকিছু কেড়ে নেয়া হয়নি? আমরা বউ, বাচ্চা গ্যাস চেম্বারে ধুকে ধুকে মরে। তাতে কার কি গেছে? আর তুই আমাকে কয়েকটি ওট গাছের উপর দিয়ে হাঁটতে নিষেধ করছিস!’
এসব মানুষদের ধীরে ধীরে বোঝানো যেতে পারে, তাদের সাথে অন্যায় করা হয়েছে বলেই তাদের কারো সাথে অন্যায় করার অধিকার নেই। তাকেও এই সত্যটুকু অনেক কষ্ট করে বোঝাতে হয়েছিল। নইলে কয়েক হাজার ওট গাছ নষ্ট করার প্রবণতা দিনে দিনে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতো।
আরেকটি দৃশ্য এখনো আমার চোখের সামনে ভাসছে। একজন বন্দি শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে আমার সামনে এসে, নাকের কাছে ঘুষি পাকিয়ে বলেছে, ‘বাড়ি ফেরার দিন এই হাত যদি রক্তে লাল না করি, তাহলে হয়তো এই হাত নিয়ে ফিরে যেতে পারবো না।’
আমি জোর গলায় বলতে চাই, এই কথাগুলো যিনি বলেছিলেন, তিনি মোটেও খারাপ লোক ছিলেন না। ক্যাম্পে বা পরবর্তী জীবনেও তিনি আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলেন।
অত্যাধিক মানসিক চাপের কারণে হঠাৎ হঠাৎ মানুষের স্বাভাবিক আচরণ বদলে যায়। শুধু তাই নয়, আচরণ বদলে যাবার পাশাপাশি আরও দুটো সমস্যা দেখা যায়। আগের জীবনে ফিরে যাবার পরও মনের জ্বালা, হতাশা থেকেই যায়।
নিজের শহরে ফেরার পরেও অনেক কারণে তিক্ততা জন্মাতে পারে। তার ফিরে আসার পর যখন মানুষ দেখা হলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে একই ভাবে সম্বোধন করে, একই প্রশ্ন যখন সে বারবার শুনতে থাকে, স্বভাবতই সে বিরক্ত হয়ে ওঠে। যখন সব জায়গায় তাকে বলা হয়, ‘কী বলো, এগুলো তো কখনো শুনিনি। অথবা, ‘আরে আমরাও অনেক কষ্ট করেছি’ তখন তার মনে হয়, তারা কি আমার সাথে এর চেয়ে ভালো কোনো কথা বলতে পারতো না?
হতাশ হবার অভিজ্ঞতা আলাদা। এখানে কোনো মানুষ নয়, ভাগ্যই তার সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করে। কোনো মানুষ হয়তো ভেবেছিল তার কষ্টের দিন শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু দেখা গেল বাস্তবতা ভিন্ন। দুঃখ- কষ্ট এখানো তাকে অক্টোপাসের মতো ঘিরে রেখেছে।
ক্যাম্পে যখন কাউকে মানসিক ভাবে সাহস জোগানোর প্রয়োজন হতো, তাকে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাতাম। বলতাম, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। কেউ তার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। তিনিও তখন সুদিনের অপেক্ষা করতেন।
মানুষের স্বভাবই এমন। তার স্বপ্নগুলো একদিন সত্য হয়ে ফিরে আসবে, এটা সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। কিন্তু স্বাধীনতা পাবার পর কী হলো? কিছু মানুষ দেখলো, তাদের জন্য কেউই অপেক্ষা করে নেই। সে আবিষ্কার করলো, ক্যাম্পে তাকে যা যা বলে সাহস জোগানো হয়েছিল, কিছুই তার জীবনে ফিরে আসেনি। দুর্ভাগ্য, যখন দেখলো তার স্বপ্নের দিন ঠিকই এলো কিন্তু যা যা ভেবেছিল, চেয়েছিল, তার কিছুই হলো না। বছরে পর বছর ধরে সে স্বপ্ন দেখেছে, ব্যাগব্যাগেজ নিয়ে বাড়ি ফিরবে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডোরবেলে চাপ দেবে। বেজে উঠবে ডোরবেল। সাথে সাথেই খুলে যাবে দরজা। দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয় মানুষ। যেন তার অপেক্ষাতেই সে ছিল। তাই ডোরবেল বেজে উঠার সাথে সাথেই দরজা খুলে দিয়েছে। প্রিয় মানুষটির মুখে মায়াময় হাসি। যে হাসি দেখার জন্য দিনের পর দিন ক্যাম্প নামক দোজখে থেকেও স্বপ্নের জাল বুনেছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। তার জন্য কেউ অপেক্ষা করে নেই। প্রিয় মানুষটি আর কখনো অপেক্ষাও করবে না।
ক্যাম্পে আমরা একজন আরেকজনকে বলতাম, পৃথিবীর কোনো কিছুই এখন আমার দুঃখ দূর করতে পারবে না। আমাদের সুখের কোনো আশা নেই। আমরা সুখের আশায় ছিলাম না। সুখের চিন্তা আমাদের সাহসী করেনি। কিংবা মৃত্যুকে অর্থবহ করে তোলেনি। তারপরেও সত্যের খাতিরে স্বীকার করতে হয়, আমরা দুঃখ চাইনি। আমরা অসুখী হবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। এই হতাশা অল্পসংখ্যক বন্দিকেই শুধু আচ্ছন্ন করেনি, অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, অনেকের মনেই দৃঢ়ভাবে গেড়ে বসেছিল এই হতাশার বীজ। যা থেকে তাদের ফিরিয়ে আনা একজন মনোচিকিৎসকের জন্য খুবই কঠিন কাজ। তবে তা অসম্ভব নয়। তাই তাকে সাহস দেয়া, নতুন করে উদ্দীপনা জোগানো উচিত।
তবে মুক্ত হওয়া বন্দিরা যখন পেছনে ফিরে তাকায়, ক্যাম্পের দিনগুলোর কথা ভাবে, তাদের মাথায় আসে না, কীভাবে তারা এত কিছু সহ্য করেছিলেন। এছাড়া যখন তার মুক্তির দিন এলো, তার কাছে সবই স্বপ্নের মতো সুন্দর মনে হতে লাগলো। ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা তার কাছে মনে হতে লাগল নিছক দুঃস্বপ্ন। দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগার পর বাড়ি ফিরে আসার যে আনন্দ, তার কোনো তুলনাই হয় না। এটা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা। এখন আর কাউকে ভয় পাবার কিছু নেই- একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া।