কনরাট আডেনাওয়ার

কনরাট আডেনাওয়ার

চার্চিল নাকি একদা বলেছিলেন, বিসমার্কের পরবর্তী যুগে জর্মনিতে মাত্র একটি রাষ্ট্রবিদ (স্টেটসম্যান, রাষ্ট্রনির্মাতা) জন্মেছেন– তিনি কটু আডেনাওয়ার।

এ প্রশস্তি আডেনাওয়ারের পক্ষে অবশ্যই আনন্দদায়িনী (এবং আমরাও চার্চিলের সঙ্গে একমত) যদ্যপি এ তথ্যটি সর্বজনবিদিত যে স্বয়ং আডেনাওয়ার ইংরেজ জাতটাকে আদৌ নেকনজরে দেখতেন না।

চার্চিলের মন্তব্যে একটি সুলাঙ্গুলির রূঢ় ইঙ্গিত রয়ে গিয়েছে।

তিনি বলতে চান, বিসমার্ক এবং আডেনাওয়ারের মাঝখানে রাজনীতির (স্টেটসম্যানশিপের) শস্যশ্যামল ভূখণ্ড নেই, আছে সাহারার মরুভূমি। অর্থাৎ বহু বহু বছর ধরে জর্মন দেশে রাষ্ট্রনির্মাতার বড়ই অভাব। বিসমার্কের জন্ম ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে, রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য হন ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে, ও মৃত্যু ১৮৯৮। যদি ধরা হয়, তিনি রাজনীতি সংগ্রামে নামেন ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে তা হলে বলতে হয় প্রায় একশো বছর ধরে জর্মনিতে একমাত্র রাষ্ট্রপিতা ছিলেন বিসমার্কই। জর্মনির মতো চিন্তাশীল তথা শক্তিশালী দেশের পক্ষে এক শতাব্দীতে মাত্র একজন রাষ্ট্রস্রষ্টা– এ যেন অবিশ্বাস্য। জর্মনি না কান্ট, হেগেল, কার্ল মার্কসের দেশ! তাদের পরিকল্পনা কেউই বাস্তবে পরিণত করতে পারল না?

এবং হিটলার?

এর উত্তর সুদীর্ঘ, কিন্তু সংক্ষেপে সারি। যে ডিকটেটারের মৃত্যুকালে তাঁর দেশের অধিকাংশ ভস্মস্তূপে পরিণত, যার সংগ্রামনীতির ফলে লক্ষ লক্ষ সৈন্য দেশে-বিদেশে নিহত হয়েছে; যুদ্ধে বোমারু আক্রমণে আরও লক্ষ লক্ষ আহত রক্তাক্ত নরনারী চিৎকার করছে– তাঁকে নিশ্চয়ই অতিমানব, নরদানব সবই বলা যেতে পারে; শুধু বলা যায় না রাষ্ট্রনির্মাতা, পতন-অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থার যুগযুগ-ধাবিত যাত্রীর চিরসারথি তাঁকে কিছুতেই বলা যায় না।

বিনষ্ট রাষ্ট্রের ভস্মতূপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যে লোক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় তাকে রাষ্ট্রনায়ক, রাষ্ট্রনির্মাতা বলা চলে না।

এমনকি কোনও রাষ্ট্রাদশও তিনি রেখে যেতে পারেননি যেটা ভবিষ্যদ্বংশীয়রা মৃন্ময় করে তুলতে পারে। তার রাষ্ট্রাদর্শ : পররাজ্য জয় করে সে দেশের বর্বর (উটরমেনুষ) জনসাধারণকে দাসস্য দাস রূপে পরিণত করে যে সুপরিকল্পিত পৈশাচিক শোষণ-সংহার পদ্ধতি দর্শনে আন্কল টম পর্যন্ত গোরশয্যায় চক্রাকারে ঘূর্ণায়মান হবেন- আপন দেশের বিলাসব্যসনের জন্য অধিকতর শূকরমাংস, সূক্ষ্মতর চীনাংক, অগণিত স্বতশ্চলশকট সগ্রহ– সাতিশয় বস্তুতান্ত্রিক জড়ত্বের চরম আরাধনা।

এ প্রসঙ্গে তাই বলে নিতে পারি যদিও এটা সর্বশেষের কথা, হিটলার বারো বছরে যে জর্মনিকে বিনাশ করেন, আডেনাওয়ার তার ১৯৪৯-১৯৬৩ ব্যাপী রাজত্ব কালে সেটি পুনর্নির্মাণ করেন। শুধু পুনর্নির্মাণ নয় এবং চৌদ্দ বছরও নয়, আডেনাওয়ার দশ বছরেই জর্মনিতে যে সুখসমৃদ্ধি গড়ে তুললেন সেটা হিটলারের ভস্মস্তূপে দাঁড়িয়ে ১৯৪৫ সালে বাতুলতম আশাবাদীও কল্পনা করতে পারেনি। এবং বলতে কি, এহ বাহ্য, তিনি দিলেন এমন ধন যার উল্লেখ করে খ্রিস্ট একদা বলেছিলেন, শুধু রুটি খেয়েই মানুষ জীবনধারণ করে না। সে কথা পরে হবে, আগেই বলেছি।

***

কলন(১) শহরের নাম বিশ্ববিখ্যাত। আর কিছু না হোক পৃথিবীর সর্বত্রই Eau de Cologne জিনিসটি পাওয়া যায়, এবং আজকের দিনেও দ্য কন পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই নির্মিত হয়। কলন শহর যে কলন-জলের (Eau=Water, de= of, Cologne= Colojne=Koeln) আবিষ্কারক তা-ও নয়, কিন্তু কলনের ও দ্য কলনই এখন পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় কলন-জল।

কলন জর্মনির অন্যতম বৃহৎ নগর। এর গির্জাটি স্থাপত্যশিল্পের অত্যুকৃষ্ট নিদর্শন। গম্ভীর এবং মধুর উভয় রস এই বিরাট গির্জাতে সম্মিলিত হয়েছে। দূর-দূরান্ত হতে গির্জার শিখরদ্বয় পথিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

এ নগরের সর্বাপেক্ষা সম্মানিত ব্যক্তি তার ওবারবুরগারমাইস্টার বা প্রধান লর্ড মেয়ার। কলন শহরের ওপর তার প্রভাব অসীম। বস্তুত তাঁকে কলনের রাজা বললে কিছুমাত্র বাড়িয়ে বলা হয় না। ভাইমারের পূর্ববর্তী যুগে কলনের লর্ড মেয়ার প্রতি পরবে কাইজার কর্তৃক নিমন্ত্রিত হতেন।

১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে আডেনাওয়ারের জন্ম এই কলন শহরে। আইন অধ্যয়ন করার পর তিনি এ শহরের লর্ড মেয়ারের দফতরে ঢোকেন এবং ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে স্বয়ং ওবারবুরগারমাইস্টার নিযুক্ত হন। ১৯৩৩ পর্যন্ত তিনি ওই পদে থেকে তার আপন শহরের সেবা করেন। এরকম একাগ্র সেবা তার পূর্বে বা পরে কোনও মেয়ারই করেননি। ১৯৩৩-এ হিটলার জর্মনির প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েই তাকে সরাসরি ডিসমিস করে দেন।

আডেনাওয়ারের দীর্ঘ একানব্বই বছরের জীবনকে যদি দুই পর্যায়ে ভাগ করা যায় তবে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম পর্যায় সমাপ্ত। দ্বিতীয় পর্যায়ের আরম্ভ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে এবং সমাপ্তি ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে।

জর্মনি, হিটলার তথা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্বন্ধে যাঁদের কৌতূহল আছে তাদের সকলের মনেই প্রশ্ন জাগবে, হিটলার এঁকে ডিসমিস করলেন কেন? নাৎসি আন্দোলন যখন ১৯২৯-৩০ খ্রিস্টাব্দে সর্বসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তখন আডেনাওয়ার তার ওপর কি কোনও প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি।

জীবনের প্রথম পর্যায়ে, অর্থাৎ ১৯৩৩ অবধি আডেনাওয়ার প্রকৃত পলিটিশিয়ান বলতে যা বোঝায় তা ছিলেন না। লর্ড মেয়রের পদ ছাড়াও তিনি কাইজারের রাজত্বে ও পরবর্তী ভাইমার রিপাবলিকে একাধিক সর্বোচ্চ আসন গ্রহণ করেন বটে কিন্তু কখনও রাইসটাগ বা জর্মন পার্লামেন্টের সদস্য হওয়ার জন্য জনসমাজের সম্মুখে প্রার্থী হয়ে দাঁড়াননি। তিনি ক্যাথলিক সেন্টার পার্টির সদস্য ছিলেন বটে এবং সে দলের ওপর তার প্রভাব ছিল প্রচুর কিন্তু সেটা প্রধানত তার অসাধারণ ব্যক্তিত্বের বলে ও প্রখ্যাত কলন শহরের লর্ড মেয়ারের পদমহিমায়। এবং ক্যাথলিক সেন্টার পার্টির প্রতি হিটলারের ছিল ক্রোধ ও ঘৃণা।

কিন্তু ১৯২৯-৩০ থেকে ১৯৩৩ অবধি ক্ষমতালাভের জন্য যখন নাৎসি পার্টি শহরে গ্রামে, রাস্তায় রাস্তায়, মদের দোকানে লড়াই চালাচ্ছে তখন যেসব নাসিবিরোধী রাজনৈতিকদের নাম শোনা যায়, যেমন ফন পাপেন, হুগেনবুর্গ, স্লাইষার, ক্রনিঙ, ট্যালমান, টলার, শ্রোডার– এদের ভেতর আডেনাওয়ারের নাম নেই। ১১৭৪ পৃষ্ঠা জুড়ে শ্রীযুক্ত শাইরার নাৎসি আন্দোলনের উদয়াস্ত সম্বন্ধে যে বিরাট গ্রন্থ লিখেছেন তাতে আডেনাওয়ারের নাম নেই।

অথচ আডেনাওয়ার ছিলেন ধর্মভীরু লোক– হিটলার যে ধর্ম মাত্রকেই এবং বিশেষ করে খ্রিস্টধর্মকে জর্মন টিউটন চরিত্রের সর্বনাশা শত্রুরূপে ঘৃণা করতেন সে তত্ত্ব তিনি কখনও গোপন রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি।২ হিটলারের করাল ছায়া যে ক্যাথলিক গির্জা ক্রমেই ছেয়ে ফেলেছে সেটা আডেনাওয়ারের দৃষ্টি এড়ায়নি।

কিন্তু আডেনাওয়ার ছিলেন ধর্মভীরু, শিক্ষিত, বিদগ্ধ নাগরিক।

একটি উদাহরণ দিলেই যথেষ্ট হবে। কলন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে; নেপোলিয়নের নেতৃত্বে যখন ফরাসি সেনা জর্মনিতে ঢুকল তখন সারা জর্মনির শিক্ষাদীক্ষার ওপর নামল দুর্দিনের অন্ধকার। বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সঙ্গে কলন বিশ্ববিদ্যালয়েরও দরজা বন্ধ হয়ে গেল ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে।

আপ্রাণ চেষ্টা করে, লর্ড মেয়ারের সর্ব প্রভাব সর্ব কর্তৃত্ব বিস্তার করে কাট আডেনাওয়ার ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে কলনে পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেন। ১২৩ বছর পরে।

বন্ শহর কলনের অতি কাছে। বন্-এর বিশ্ববিদ্যালয় বিখ্যাত। আডেনাওয়ার বন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন এবং পরবর্তীকালে তিনি বন্-কলনের পথে র্যোনডরফে তাঁর আবাস নির্মাণ করেন। এখান থেকেই তারও পরবর্তীকালে হিটলারের পতনের পর তিনি মোটরে করে রাজধানী বন্-এ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর কর্তব্য সমাধা করতে যেতেন।

সেই ১৯২৯-৩০ খ্রিস্টাব্দে, বস্তুত প্রায় ষাট বছর ধরে বন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছাত্রদের কাছে তিনি ছিলেন সুপরিচিত।(৩) বন্-এর এত কাছে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খোলাতে বন্-এর কিছুমাত্র দুশ্চিন্তা হয়নি, কারণ বন্ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আড়েনাওয়ারের সখ্য ছিল অবিচল। বস্তুত উত্তর রাইন অঞ্চলের (বন্-কলন-ডুসেড) প্রায় সব রকমের কৃষ্টি আন্দোলন তথা ক্যাথলিক ধর্মজীবন এবং তার প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আডেনাওয়ার তার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ছিলেন।

হিটলারের জন্মভূমি যদিও অস্ট্রিয়ায় তবু তিনি বেভেরিয়ার মুনিক শহর বেছে নিয়েছিলেন তার রাজনৈতিক কর্মকেন্দ্ররূপে। সেখানে বিরাট বিরাট মিটিঙে হিটলার লম্বা লম্বা লেকচার ঝাড়তেন, রাস্তায় রাস্তায় কমুনিস্টদের ঠ্যাঙাবার ব্যবস্থা করাতেন, এমনকি গুমখুন করতেও তাঁর বাধত না– এসব পাঠকমাত্রই জানেন।

বেভেরিয়া প্রদেশের পরেই হিটলারের জনপ্রিয়তা ছিল রাইনের কয়লা ও লোহা ব্যবসার জায়গা রুর অঞ্চলে এবং কলনের পাশে এই উত্তর রাইনের ডুসেলডর্ফ শহরে বিশ্বপ্রপাগান্ডা সরদার ডক্টর গ্যোবেলসের জন্ম। রুরের গা-ঘেঁষে কলন শহর এবং এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় নগর। গ্যোবে স্বভাবতই চাইতেন তার বাড়ির পাশের কলন শহরে যেন প্রভু হিটলারকে উৎকৃষ্ট আসন তৈরি করে দিতে পারেন– হিটলারের কাশী যদি হয় মুনিক তবে কলন হবে বৃন্দাবন।

কিন্তু বাদ সাধতেন আডেনাওয়ার। পূর্বেই বলেছি, ওবারবুরগারুমাইস্টারের ক্ষমতা অসীম। তাই নামমাত্র আইন বাঁচিয়ে তিনি কলন অঞ্চলে এমন সব কলাকৌশল করে রাখতেন যে, হিটলার এমনকি রাইনের ছেলে স্বয়ং গ্যোবেলসও সেখানে সুবিধে করে উঠতে পারতেন না।

নাৎসি পার্টির ক্ষমতা সঞ্চয় করে উদ্দেশ্য সফল করাতে বাধা দিয়েছিল প্রধানত দুইটি সঙ্ : ক্যাথলিক এবং দ্বিতীয়ত প্রটেস্টান যাজক সম্প্রদায়। কিন্তু ক্যাথলিক সম্প্রদায় প্রটেস্টানদের তুলনায় শতগুণে সবদ্ধ এবং পোপকে কেন্দ্র করে তাদের বিশ্বজোড়া প্রতিষ্ঠান। হিটলারও বার বার তার সাঙ্গোপাঙ্গকে বলেছেন, ওই ক্যাথলিকদের সমঝে চল– প্রটেস্টানরা এমনিতেই টুকরো টুকরো হয়ে আছে, তাদের খানখান করা এমন কিছু কঠিন কর্ম নয়।

কলন শহরে পোপের অন্যতম আর্চবিশপের বিরাট প্রতিষ্ঠান। আডেনাওয়ার সেখানে সুপ্রিম লর্ড মেয়ার। ক্যাথলিক রাজনৈতিক দলের ওপর তার প্রচুর প্রভাব– যদিও, পূর্বেই বলেছি, তিনি সে রাজনৈতিক দলের টিকিট নিয়ে ভোটমারে কখনও নামেননি। তাঁর জীবনের প্রথম পর্যায় কেটেছে মনিসিপাল বা করপোরেশন পলিটিসে। ক্যাথলিক সংগঠনের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তিনি নাৎসিদের প্রচারকর্মে বাধা দিলেন কলন তথা উত্তর রাইনের সর্বত্র। অথচ হিটলার তাঁকে ধরা-ছোওয়াতে পান না, কারণ তিনি রাজনৈতিক কোনও দলের নেতা, এমনকি চারআনি সক্রিয় নিষ্ক্রিয় কোনও মেম্বারও নন। তিনি যদি ভোটমারে নামতেন তবে তাকে ভোটে হারিয়ে বিপর্যস্ত করা যেত। নাৎসি ডন কুইন্সট্‌ তলওয়ার হানবার মতো ড্রাগন খুঁজে পায় না পায় উইড় মিল!

গ্যোবেলস্-এর প্রচারকমের একটা প্রধান উর্বরা জমি ছিল স্কুল-কলেজ-ইউনিভারসিটি। কলনের অধিকাংশ স্কুল ক্যাথলিকদের তাঁবেতে সেকুলার ভাইমার রিপাবলিক জর্মনির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সেকুলার করে তুলতে পারেনি কিংবা হয়তো সত্য সত্য তা করতে চায়নি সেখানে আডেনাওয়ারের ধর্মবল অর্থবল দুই-ই রয়েছে। আর ইউনিভারসিটির তো কথাই নেই।

সোয়াশো বছরের হারানো মানিক তার বিশ্ববিদ্যালয় ফের ফিরে পেয়েছে– আডেনাওয়ারের তপস্যায়, তখনও পুরো দশ বছর হয়নি। এটাকে কলনবাসী বাঁচিয়ে রাখবে সর্বপ্রকার কট্টরপন্থীর র‍্যাডিকাল ছোঁয়াচ থেকে। গ্যোবেলস্ কলনের কলেজে কল্কে পেতেন না।

ওদিকে বেকার সমস্যা দিন দিন তার চরম সঙ্কটের দিকে দ্রুতপদে এগিয়ে চলেছে– এবং সবচেয়ে বেশি মার খাচ্ছেন রুর কয়লাখনির শ্রমিকদল। তাই দেখা যায়– হিটলারের খাস পাইলট তার পুস্তকে এর বর্ণনা দিয়েছেন—(৪) হিটলার প্রচারকর্মের জন্য প্লেনে উড়ে যাচ্ছেন রুরের এসে শহরে। পাশেই বিরাট কলন। কিন্তু তিনি সেটি বাদ দিয়ে চলে যাচ্ছেন বন-এর কাছে তার প্রিয় গোডেসবের্গে নামক গগ্রামে (এখন শহর এবং এখানেই পরবর্তী যুগে হিটলার প্রাথমিক কথাবার্তা বলেন চেম্বারলেনের সঙ্গে চেকোস্লোভাকিয়ার সুডেটেন বাবদে)। নিশ্চয়ই হিটলারের এই কলন-বর্জনে প্রতিবারেই গ্যোবেলস লজ্জায় মাথা নিচু করেছেন। তাঁর সান্তনা এইটুকু– এসে তথা রুর তার প্রতিবেশী, সেখানে তিনি প্রতিবারেই হিটলারকে রাজাসনে বসাতেন।

হিটলার চ্যানসেলার হয়েই আডেনাওয়ারকে ডিসমিস করলেন। এটা হবে আমরা জানতুম। কারণ নাৎসিরা বহুদিন ধরে তাঁর নিন্দা-কুৎসা গেয়ে বেড়াচ্ছিল। তার একটা : আডেনাওয়ার তনখা টানেন বিরাট (রিজে)! তার মাইনে ঢের ঢের কম হওয়া উচিত। এবং সবচেয়ে মজার কথা, হিটলার যাঁকে লর্ড মেয়ার করলেন, তিনি তাঁর মাইনে এক পাই তক না কমিয়ে টানতে লাগলেন আডেনাওয়ার যে তনখা নিতেন সেইটেই। এই মহাশয়ের নাম ছিল রিজে (বাঙলায় আমরা বলব বিরাট বাবু)। তখন কলন-বন-এ একটা শিবরামীয় পান চালু হল :- আডেনাওয়ার নিতেন বিরাট তনখা; এখন (মিস্টার) বিরাট নিচ্ছেন আডেনাওয়ার-তনখা!

***

হিটলার কীভাবে জৰ্মনিকে বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন এবং তার অবশ্যম্ভাবী শেষ ফল যে দেশের সর্বনাশ, সে সত্য আডেনাওয়ার দিব্যদৃষ্টি দিয়েই দেখেছিলেন কিন্তু শান্ত-সমাহিত স্বভাব ও আচরণসম্পন্ন আডেনাওয়ার জানতেন, চীনা ঋষি লাওৎসের মতোই জানতেন, জর্মন-নিয়তি রহস্যাবৃত তারই কোনও এক মানববুদ্ধির অগম্য কারণে। জর্মনির উপর দিয়ে যে টরনাডো বন্ধামুক্ত করেছেন, সে যেন;

 লক্ষ লক্ষ উন্মাদ পরান বহির্গত বন্দিশালা হতে
মহাবৃক্ষ সমূলে উপাড়ি ফুৎকারে উড়ায়ে চলে পথে

তার সামনে দাঁড়ালে সেটাকে বন্ধ করা তো দূরের কথা, তিনিও মহাশূন্যে বিলীন হবেন। এটা ফরাসি সম্রাটের আপ্রে মোয়া ল্য দেলুজ (আমি মরে যাওয়ার পর বন্যা) নয়, এটা দেলুজ পুর শাক আ ল্যাসতা (বন্যা এখনই, এবং সবাইকে নিয়ে যাবে ভাসিয়ে, কহাঁ কহা মুলুকে!)

বরঞ্চ বন্যার পর ফের ঘরবাড়ি তুলতে হবে, খেতখামার করতে হবে– শিবের তাণ্ডব শেষ হলে অন্নপূর্ণার আবাহন।

পরাজয় যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল বুদ্ধিভ্রষ্টের ন্যায় হিটলার ততই অবিচারে, নির্বিচারে শক্ৰজন, নিরপেক্ষজন, এমনকি মিত্ৰজনকেও মরণ-থানায় (কন্‌সেট্রেশন ক্যাপে) পাঠাতে লাগলেন–হ্যাঁ, ইব্রাহিম তাঁর প্রিয় পুত্রকে, আগামেন তাঁর প্রিয় কন্যা এফিগেনিয়েকে দেবতার তুষ্টির জন্য বলি দিয়েছিলেন কিন্তু আডেনাওয়ারের অদৃষ্টে মরণ-থানার দুর্দৈব লেখা ছিল না। যুদ্ধের শেষের দিকে তাকে কিছুদিন কারাগারে, পরে তার আপন গৃহে নজরবন্দি করা হয়েছিল মাত্র। কিন্তু তিনি শক্ৰমিত্রনির্বিশেষে এতই অসংখ্য জনের উপকার করেছিলেন, যে তাঁরা কলাকৌশলে ছলে (হিটলারকে) বলে আডেনাওয়ারকে কারামুক্ত করেন।

সাঙ্গ হয়েছে রণ,
অনেক যুঝিয়া অনেক খুঁজিয়া শেষ হল আয়োজন
The fight is ended!
Cries of loss bewilder the sky

১৯৪৫ সালের মে মাসে প্রথম সপ্তাহে জর্মনি বে-এক্তেয়ার আত্মসমর্পণ করল। ওই বছরেই জুলাই মাসে প্রখ্যাত ইংরেজ লেখক স্টিভ স্পেন্ডারকে ব্রিটিশ সরকার পাঠাল জর্মনিতে, সেখানকার ঝড়তিপড়তি ইনটেলেছুঁয়েলদের চিন্তাধারা সম্বন্ধে খবর নিতে। সে-কর্ম সমাধান করে তারই বিবরণী তিনি প্রকাশ করেন ইয়োরোপিয়ান উইটনিস নামক পুস্তকে।(৫)

বীভত্স বই। কলনের রাস্তার পর রাস্তা, দু দিকে একটিমাত্র বাড়ি নেই–ধ্বংসপ, ভগ্ন্যুপ। তার তলায় এখনও হাজার হাজার মড়া পচছে গলছে। শহর-জোড়া দুর্গন্ধ থেকে নিষ্কৃতির উপায় নেই। একরকম ক্ষুদে সবুজ পোকা এইসব হাজার-পচা লাশ থেকে জন্ম নিয়েছে এবং শহরময় এমনই ঘন স্তরে ছেয়ে আছে যেন মনে হয় লন্ডনের ধুয়াশা। হাত দিয়ে মুখের সামনে থেকে তাড়াতে গেলে মুখে লেগে গিয়ে পিছলে আঠার মতো চোখেমুখে সেঁটে যায়।

লড়াইয়ের শুরুতে কলনে বাস করত প্রায় আট লক্ষ লোক। তারা ক-হাজার বাড়ি, ভিলা ফ্ল্যাটে বাস করত তার হিসাব স্পেন্ডার দেননি। শুধু বলেছেন, মাত্র তিনশো খানা(!) তখনও বাসের উপযোগী। Actually there are a few habitable buildings left in Cologne, Three hundred in all (!)

এ শহর তথা গোটা দেশের আর আর শহর গড়ে তুলবে কে, কারা?

দুষ্ট হোক শিষ্ট হোক, যেসব নাৎসি একদা নরওয়ে থেকে ইটালি, অতলান্তিক থেকে ককেশাস পর্যন্ত অধিকার করেছিল তারা কৃতবিদ্য, করিল্কর্মা ও অভিজ্ঞ নির্মাণ-ধ্বংস উভয় কর্মেই সিদ্ধহস্ত। তাদের কিছু মারা গেছে, অধিকাংশ মিত্রশক্তির শিবিরে শিবিরে বন্দি, কিছু পলাতক, অনেকে আন্ডারগ্রাউন্ড।

হিটলারের বৈরীপক্ষের অধিকাংশ অন্যলোকে। হিটলার তার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। আডেনাওয়ার গোত্রের নির্মাণতৎপর নেতা অতিশয় বিরল–মুষ্টিমেয়।

আডেনাওয়ার ভগ্নস্তূপের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন। একদা চার্চিল যে রকম লন্ডনের ভাঙাচোরার মাঝখানে দাঁড়িয়েছিলেন। যদিও সে বিনাশ কলনের সহস্রাংশও ছিল না।

এখানে আমাকে একটি দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিতে হবে। এটি পড়ে নিলে আডেনাওয়ারের চরিত্রগুণটি পাঠকের সামনে স্পষ্ট রেখায় ধরা দেবে। বিশেষত স্পেনডারের মতো লোক যখন এ ছবিটি এঁকেছেন।

দু দফে অনুবাদ করে লাভ নেই, এবং বিবেচনা করি এ প্রবন্ধের পাঠক অন্তত আমার চেয়ে ভালো ইংরেজি জানেন।

এটা যুদ্ধবিরতির দু তিন মাস পরের কথা। স্পেন্ডার বলেছেন :

Adenauer is a prominent Catholic in the Rheinland, who was Mayor of Cologne before Hitler came to power. It is now with a special personal emotion that he takes up the restoration of that Cologne which was a broken trayload of crokery when it was taken out of his hands. When he was last Lord Mayor he was in his fifties, he is now a man of seventy. He has an energetic, though some what insignificant appearance; a long lean oval face, almost no hair, small blue active eyes, a little button nose and a reddish complexion. He looks remarkably young and he has the quietly confident manner of a successful and attentive young man.

There are two aspects of reconstruction which we consider of equal importance, he said, one, the material rebuilding of the city. But just as important is the creation of a new spiritual life. You cant have failed to notice that the Nazis have laid German culture just as flat as the ruins of the Rheinland and the Ruhr. Fifteen years of Nazi rule have left Germany a spiritual desert, and perhaps it is more necessary to draw attention to this than to the physical ruins, for the spiritual devastation is not so apparent. There is hunger and thirst now for spiritual values in Germany. This is especially true of Cologne because here, in the past, we have had such a significant spiritual life and activity. Here it is possible today to do a great deal. Only the best should be our aim. We should have in Cologne the best education, the best books, the best newspapers, the best music.

The point Adenauer came back to again and again–his whole position rested on it was that the Germans were really starving spiritually, and that it was therefore of the utmost importance to give their minds and souls same food.

এ বই যখন আমি পড়ি তখনও আমরা স্বাধীনতা পাইনি।

সে দুর্দিনে কি কেউ কল্পনা করতে পেরেছিল, দশ-বারো বছর যেতে না যেতেই তিনি কলন তথা সারা জর্মনিতে এমন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, শিল্পোন্নতি, আত্মচর্চা ও ধর্মজীবনে নবজাগরণ এনে দেবেন, যে হিটলার তার গৌরবের মধ্যগগনেও সুদ্ধমাত্র সাংসারিক দিক দিয়েও এতখানি উন্নতি করতে পারেননি?

কেউ কল্পনা করতে পারবে না, এ তত্ত্বটা আডেনাওয়ার জানতেন বলেই স্পেন্ডারকে বিদায় নেবার বেলা তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, The imagination has to be provided for.

কবিগুরুর কথা মনে পড়ে, স্বদেশী আন্দোলনের সময় ও পরবর্তী অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি বারবার বলেছেন, আত্মার দিকটা অবহেলা করো না। অধিকাংশ রাজনীতিকরা তখন মুচকি হেসে বলতেন, আগে তো ইংরেজকে খেদাই।

ইংরেজ তো বহুকাল হল গেছে। তবে?

 আসলে আমাদের imagination, চরিত্র, আত্মা দেউলে।

এর পরের ঘটনাবলি হালে কাগজে কাগজে বেরিয়েছে। সেগুলো সংক্ষেপে সারি।

যুদ্ধশেষের পরই মার্কিন সেনাপতি আডেনাওয়ারকে কলনের লর্ড মেয়ার করে দিল। কিছুদিনের মধ্যেই পূর্বের চুক্তি অনুযায়ী মার্কিনরা কলন ইংরেজের হাতে দিয়ে সরে পড়ল। যে ইংরেজ সেনাপতির হাতে কলনের ভার পড়ল তিনি ছিলেন একটি আস্ত গণ্ডমূর্খ গাড়োল। আডেনাওয়ারকে নগর পুনর্নির্মাণ বাবদে এমন সব সর্বনেশে অবাস্তব জঙ্গিলাটী অর্ডার দিতে লাগলেন যে, পরাজিত জর্মনির নগণ্য সরদার আডেনাওয়ার বিজয়মদেমত্ত প্রভুর আদেশ পালন করতে কিছুতেই সম্মত হলেন না। এই নয়া হিটলার তখন তাকে স্রেফ ডিসমিস করে দিলেন। বিবেচনা করি সিপাহিবিদ্রোহের আমল হলে তাকে বাহাদুর শার মতো বাকি জীবন জেলে কাটাতে হত!

অনেকের বিশ্বাস, এই যে আডেনাওয়ার ইংরেজের ওপর চটে গেলেন তার পর তিনি জর্মনির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ গড়তে লাগলেন মার্কিন ও ফরাসির সঙ্গে বন্ধুত্ব করে– ইংরেজিতে যাকে বলে কাট হিম ডেড, ইংরেজকে তিনি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গেলেন।

জর্মনির নব সংবিধান নির্মাণের জন্য যে বৈঠক বসল বছর তিন পরে ১৯৪৮ সালে, তিনি হলেন তার প্রেসিডেন্ট। ১৯৪৯-এ যে নবীন রাষ্ট্র নির্মিত হল তার প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন আডেনাওয়ার। কিন্তু তখন বিশ্ববাসীর মনে প্রশ্ন, জর্মনির জন্মবৈরী ফ্রান্স কি এ রাষ্ট্রকে স্বাধীন সার্বভৌম রাজ্যরূপে স্বীকার করবে?

আডেনাওয়ার আজীবন ফ্রান্সের প্রতি ভ্ৰাতৃভাব পোষণ করতেন। তিনি হাত এগিয়ে দিলেন ফ্রান্সের দিকে। যে-ফ্রান্স চিরকাল জর্মনিকে অবিশ্বাস করেছে সে পর্যন্ত বুঝে গেল যুগের পরিবর্তন হয়েছে। দম্ভী দ্য গল আলিঙ্গন করলেন বৃদ্ধ আডেনাওয়ারকে। ইংরেজ মর্মাহত হল। জর্মনি-ফরাসিকে বিভক্ত রেখে অস্ত্রসগ্রহার্থে দু দলকে লড়িয়ে দিয়ে, সে দাবড়াত ইয়োরোপময়।

জর্মনি ইয়োরোপ-আমেরিকার জাতিসমাজে আসন পেল।

যে জর্মন জনসাধারণকে বিশ্বজন নরাধম দানব বলে ধরে নিয়েছিল তারা দ্রজনরূপে স্বীকৃত হল।

পশ্চিম ইয়োরোপ তথা আমেরিকা যে-সব অর্থনৈতিক, সামরিক, রাজনৈতিক সন্ধিচুক্তি তৈরি করছিল তার সর্বোচ্চ স্তরের সবকটিতেই জর্মনি আসন পেল।

এবং আমরা যারা এ-দেশে বাস্তুহারা সমস্যা নিয়ে উদভ্রান্ত– অবিশ্বাস্য বলে মনে করি যে, আডেনাওয়ারের নেতৃত্বে পশ্চিম জর্মনি স্থান করে দিল তার আপন শহরে শহরে গ্রামে গ্রামে, পূর্ব জর্মনি থেকে আগত এক কোটি বিশ লক্ষ বাস্তুহারাকে তাদের জীবনমানে ও পশ্চিম জর্মনির জীবনমানে আজ আর এতটুকু পার্থক্য নেই, আমি স্বচক্ষে ১৯৫৮ এবং পুনরায় ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে দেখে এসেছি। কোনও লক্ষ্মীছাড়া দণ্ডকারণ্যে গিয়ে বাস্তুহারাদের বাস্তুভিটে-ঘুঘু-রূপ ধারণ করতে হয়নি।

এবং বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়, এই আপাতদৃষ্টিতে নৈরাশ্যপূর্ণ গুরুভার আডেনাওয়ার এগিয়ে গিয়ে আপন স্কন্ধে তুলে নিলেন তাঁর জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ে, রাষ্ট্রজনকরূপে, তেয়াত্তর বছর বয়সে।

এ যুগকে সমসাময়িক জর্মন ইতিহাসে বলা হয়, আডেনাওয়ার অ্যারা আডেনাওয়ার যুগ।

এবং এ যুগের এখনও শেষ হয়নি। বিসমার্ককে বিতাড়িত করার পর কাইজার তার রাজনীতি সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিলেন, ৮৭ বছর বয়সে বৃদ্ধ(?) অবসর গ্রহণ করার পর যে দুজন চ্যানসেলার পর পর নিযুক্ত হলেন তারাও বৃদ্ধের কর্মাদর্শ কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করে চলেছেন।(৬)

অবসর গ্রহণের পর তিনি বৃহৎ তিন খণ্ডে লেখেন তাঁর জীবনস্মৃতি। তৃতীয় খণ্ড প্রেসে পাঠানোর কয়েক সপ্তাহ পর তিনি গত হন।

মৃত্যুর আট দিন পূর্ব পর্যন্ত তাঁর কর্মক্ষমতা অটুট ছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিজিংগার আডেনাওয়ারের শোকসভাতে বলেন, কয়েক দিন পূর্বেও তিনি র্যোনডর গ্রামে যান, বৃদ্ধের কাছ থেকে পথনির্দেশ গ্রহণ করতে। এই শেষ দর্শনের সময় তিনি কিজিংগারকে বিভক্ত জৰ্মনি সম্বন্ধে দুঃখ প্রকাশ করেন। শেষ কথা বলেন, আজ যে ধুলো আর কুয়াশাতে পৃথিবী ঢাকা সেটা যখন পরিষ্কার হবে তখন যেন কেউ না বলে, আমি আমার কর্তব্য করিনি।

***

বিশ্বজন সম্পূর্ণ একমত যে :

১. আনোওয়ার পদদলিত জৰ্মনিকে লুপ্ত-আত্মসম্মানবোধ এনে দেন ও ইউরোমেরিকার রাষ্ট্রসমাজে তার জন্য গৌরবের আসন নির্মাণ করেন,

২. চিরবৈরী ফ্রান্সের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন,

 ৩. এক কোটি বিশ লক্ষ বাস্তুহারাকে পরিপূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন।

 তিনি মাত্র একটি আশা সফল করতে পারেননিঃ

 দ্বিখণ্ডিত জৰ্মনিকে একত্র করতে পারেননি।

***

এস্থলে আমি শুধু দুটি বিষয় উল্লেখ করব :

 হ্যার ভাইমার স্বৰ্গত আডেনাওয়ারের উত্তম জীবনী লিখেছেন। আর পাঁচখানা বিদেশি বইয়ের মতো এটিও আমার পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব হয়নি বিদেশি মুদ্রা ও বিদেশি পুস্তক-বিক্রেতাদের কৃপায়।

জর্মন বেতার এই উৎকৃষ্ট পুস্তক থেকে একাধিক অনুচ্ছেদ পড়ে শোনায়।

তারই একটিতে আছে, আডেনাওয়ারের পুত্র উক্ত লেখককে বলেন, আমার পিতার মাথার ওপর যখন সমস্ত জৰ্মনির দায়িত্ব তখন আমার মা গত হন। সঙ্গে সঙ্গে পিতা তাঁর দৈনন্দিন রুটিন আমূল পরিবর্তন করে দিলেন, যাতে করে আমরা আরও বেশি সময় ধরে তাঁর সঙ্গলাভ করতে পারি। এর পর থেকে কোথাও সফরে গেলে আমাদের জন্য প্রতিটিবার সওগাৎ আনতে কখনও তার ভুল হত না।

আডেনাওয়ার আপন দেশকে বঞ্চিত করেননি, পরিবারের প্রিয়জনকেও বঞ্চিত করেননি।

যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা স্বার্থপরতা তথা আত্মম্ভরিতার বিকৃত রূপ ধারণ করে সে কখনওই কোনও প্রকারের ত্যাগ বরণ করতে পারে না, কিন্তু যে উচ্চাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আদর্শবাদ অঙ্গাঙ্গী বিজড়িত সেখানে প্রকৃত মহাপুরুষ সামান্য শিশুটির দাবির মূল্যও দিতে জানেন। রাজকার্য, সমাজসেবা, রাষ্ট্রের আহ্বান– এসব গালভরা কথার দোহাই দিয়ে যারা শিশু, বৃদ্ধ, আতুর-অকর্মণ্য জনকে অবহেলা করে তাদের আদর্শবাদ-এর অস্থিমজ্জা তাদের আপন স্বার্থপরতার উচ্চাকাঙ্ক্ষা দিয়ে গঠিত।

শিষ্যসমাবৃত হয়ে প্রভু যিশু ইহজীবনের উচ্চতর আদর্শ, পরজীবনের চরম কাম্য নিয়ে যখন আলোচনা করছেন, উপদেশ দিচ্ছেন, তখনও তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি যে, শিশুরা তাঁর কাছে আসতে চায়। আদেশ দিলেন– শিশুদের আসতে দাও আমার কাছে।

শিষ্যেরা যিশুকে জিগ্যেস করলেন, Who is the greatest in the Kingdom of heaven?

And Jesus called a little child unto him, and set him in the midst of them.

***

হিটলারের আত্মহত্যার কাহিনী আমি অন্যত্র লিখেছি। তার আত্মহত্যার পর কী হয়েছিল সেটা তার চেয়ে কিছুমাত্র কম বিস্ময়জনক ও কৌতূহলোদ্দীপক নয়, বিশেষত নরদানব মারটিন বরমান তার সঙ্গে বিজড়িত আছেন বলে। কিন্তু সে কাহিনী ভিন্ন এবং এখানেও আমি মাত্র সেইটুকুরই সংক্ষিপ্ত উল্লেখ করব, যেটুকু আডেনাওয়ারের ব্যক্তিত্ব হৃদয়ঙ্গম করার জন্য নিতান্তই প্রয়োজন।

হিটলার যে সময়ে আত্মহত্যা করেন (বেলা ১৫.৩০/৪৫, ৩০ এপ্রিল ১৯৪৫), সে সময়ে রুশবাহিনী মাত্র কয়েকশো গজ দূরে তার বাসভবনের চতুর্দিকে বৃহ নির্মাণ করেছে। এ ব্যুহ ভেদ করে মার্কিন অধিকৃত অঞ্চলে পৌঁছাবার চেষ্টা করেন তার নিতান্ত অন্তরঙ্গ সাঙ্গোপাঙ্গ এবং কর্মচারীবৃন্দ যাঁরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করেননি। এঁদের ভেতর ছিলেন। সেক্রেটারি বরমান, দুই মহিলা স্টেনো, পাচিকা, খাসচাকর লিঙে, দেহরক্ষী-দল, সার্সন, শোফার ইত্যাদি ইত্যাদি। এঁদের অন্যতম হিটলারের খাস পাইলট বাওর-সৈন্যবাহিনীতে তার র‍্যাঙ্ক ছিল জেনারেলের। ইনি পালাবার সময় শুধু যে ধরা পড়েন তাই নয়, মেশিনগানের গুলিতে একখানা পা এমনই জখম হয় যে পরে সেটা কেটে ফেলতে হয়।

দীর্ঘ দশটি বছর রাশার খ্যাত-কুখ্যাত বহু প্রকারের জেল, সেল, বন্দি-শিবিরে অবর্ণনীয় কষ্টযন্ত্রণা ভোগ করার পর ইনি মুক্তি পান। পূর্বেই বলেছি দেশে ফিরে একখানা বই লেখেন যার নাম, হিটলারজ পাইলট। পূর্ণ দশটি বছর বাওর এবং অন্যান্য জর্মন বন্দিরা কী নিদারুণ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরতে সক্ষম হন তার বর্ণনা দেবার মতো কল্পনাশক্তি, স্পর্শকাতরতা, কলমের জোর আমার কিছুই নেই। যে নিপীড়নে মানুষ হাঙ্গার স্ট্রাইক করে, ছুটে গিয়ে দেয়ালে মাথা ঠুকে আত্মহত্যার চেষ্টা দেয় তার বর্ণনা দিয়েছেন বাওর। আমার কাছে যেটা নিদারুণতম বলে মনে হয় সেটা পরিপূর্ণ নৈরাশ্যের তমিস্র অন্তহীন রজনী– এ বন্দিদশা থেকে ইহজন্মে আমার মুক্তি নেই।

এবং আমার মনে হয়, তার চেয়েও কষ্টের বিকৃত ভান ত্রাসের বিকট ভঙ্গি যদি কিছু থাকে তবে সেটাও ওই অন্ধকারে ছলনার ভূমিকা! কী সে ছলনা? মাঝে মাঝে খবর গুজব রটে বন্দিদের হয়তো-বা মুক্তি দেওয়া হবে। আলেয়ার আলো দপ করে জ্বলে ওঠে ক্ষণতরে– আবার আবার সেই সুদীর্ঘ নিরস্ত্র অমানিশা।

জর্মনিতে চিরকালই দুটি দল। একদল পূর্বপন্থী রাশার সঙ্গে মৈত্রী কামনা করে। আডেনাওয়ার পশ্চিমপন্থী, রুশবৈরী। বিশেষত যে রুশ হাজার হাজার যুদ্ধবন্দি জর্মনদের দশ বছর পরেও কিছুতেই মুক্তি দেবে না।

রুশ ঘোড়া-বিককিরির ব্যবসা করতে চায়। যুদ্ধবন্দি বাওর ইত্যাদি ঘোড়ার বদলে সে চায় আডেনাওয়ার কর্তৃক রুশকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিদান, এবং পূর্ব জর্মনিকেও সে পশ্চিম জর্মনির সঙ্গে সম্মিলিত হতে দেবে না। হয়তো এটা অন্যায় নয়। হিটলার রুশ দেশে যা করে গেছেন তার বদলে এ তো সামান্যই। কিন্তু আডেনাওয়ার তো আর হিটলারের প্রিয় পুত্র যুবরাজ প্রিন্স অব্ ওয়েলস্ রূপে পিতার সিংহাসনে বসেননি যে, হিটলারের সর্ব অপকর্মের জন্য তার মূল্য দেবেন। বরং হিটলার তাঁকে করেছিলেন লাঞ্ছিত, অপমানিত, কারারুদ্ধ।

এবং তার চেয়েও বক্র পরিহাস- যে নাৎসি পার্টির মারফত তিনি আডেনাওয়ারকে কারারুদ্ধ করেছিলেন সেই পার্টিরই বহু গণ্যমান্য সদস্য, জাঁদরেল, অ্যাডমিরাল, হিটলারের আপন বয়স্যসখা রয়েছে এই যুদ্ধবন্দিদের ভেতর! আডেনাওয়ারকে নতিস্বীকার করতে হবে এদেরও মুক্তির জন্য। এবারে শুনুন বাওর কী বলেছেন :

But the-then the much-abused (অর্থাৎ নাৎসি কর্তৃক অপমানিত– লেখক) : Adenauer came to Moscow, and our camp was wild with rumours. Our hopes rocketed from zero to feverpoint-and then fell back again. This latter was when Bulganin publicly proclaimed that we were the scum of the earth, and that our crimes had robbed us of all human semblance. We cautiously but closely followed the course of Adenaures hard-fought negotiations, and we could sense that even the Russians respected the determination and integrity of the old man. (বৃদ্ধ সাদরে বলা হল- লেখক)

সৃষ্টিকর্তার লীলা বোঝে কে? একদিন সত্য সত্যই খবর এল বাওরাদি অনেকেই মুক্তিলাভ করবেন। একদল বন্দি যাবেন মস্কো থেকে পশ্চিম জর্মনির মুনিক যেখানে বাওরের মা-বউ আছেন। এ মুক্তির যাত্রার বর্ণনা দিতে গিয়ে বার বলেছেন, The memory of that journey is like a film that keeps breaking off. fola 17010 Mars foose দিয়ে ট্রেন যাবার সময় উল্লাসে উত্তেজিত জনতা ছুটে আসছে ট্রেনের দিকে, বাচ্চাদের হাতে রঙিন ফানুসের ভেতর জ্বলন্ত মোমবাতি, গির্জায় গির্জায় চলেছে অবিরত হর্ষোল্লাসের ঘণ্টাধ্বনি। নার্সরা ছুটে আসছে খাবার নিয়ে

থাক। আমার কলমফ অতি সাধারণ; এসবের সার্থক বর্ণনা দিতে পারেন যাদের লেখনী অসাধারণ, কিংবা বাওরের মতো লোক যারা লেখক নন কিন্তু অভিজ্ঞতাটা আছে।

এবং এর করুণ দিকটা বাওর চেপে গেছেন। যেসব পিতা-মাতা-জায়া এসেছিল আপন আত্মজনের প্রত্যাশায়– যদিও তাদের বলা হয়েছে যে, সেসব আত্মজনের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত, কিংবা মুক্তি পাবে কি না স্থির নেই– এবং যারা ফিরেছে তাদের নাম উচ্চকণ্ঠে পড়া শেষ হয়ে গেলে যখন বুঝল তাদের আত্মজন ফেরেনি, তখন—

***

আডেনাওয়ারের কীর্তিকলাপ একদিন হয়তো বিশ্বজন ভুলে যাবে, কিন্তু বহু বহু জর্মন পরিবার কি বংশপরম্পরায় স্মরণে আনবে না, কে তাদের পিতা, পিতামহ, বা প্রপিতামহকে একদা ফিরিয়ে এনেছিল তার বিস্মৃতপ্রায় সুখী নীড়ে, দারাপুত্র পিতামাতার মাঝখানে? যার অবশ্যম্ভাবী গোর ছিল সুদূর সাইবেরিয়ার অন্তহীন তুষারান্তরণের নিম্নে, সে কার দৈববলে হঠাৎ একদিন ফিরে এসে মুছে দিল জননীজায়ার আঁখিবারি!

[জুন, ১৯৬৭।]

———–

১. এখানে রোমান জাত একটা কলোনি স্থাপন করে ও নেরোর (যিনি রোম পুড়িয়েছিলেন) মা, মহারানি (Colonia) Claudia Ara Agrippinesis-এর (Colony) Colonia নাম দেয়। এই Colonia থেকে ফরাসি ইংরেজি Cologne, জর্মনে Koeln.

২. হিটলারের বিশ্বাস ছিল, ইহুদি ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত নির্বীর্য কাপুরুষের আশ্রয়স্থল খ্রিস্টধর্ম ইয়োরোপের সর্বনাশ করেছে, এবং এ ধর্ম ইয়োরোপে ছড়ানোর পিছনে রয়েছে ইহুদিদেরই (!) এক অভিনব কৌশল। আবার হিটলার মনে করতেন খ্রিস্টজন্মের পূর্বে যেসব রোমান সৈন্য প্যালেস্টাইনে মোতায়েন ছিল খ্রিস্ট তাদেরই কোনও একজনের জারজ সন্তান।

৩. ওই সময়ে আমি বন্ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করি ও আডেনাওয়ারের খ্যাতি-প্রতিপত্তি সম্বন্ধে সতীর্থদের কাছ থেকে বহু প্রশস্তি শুনতে পাই। তার সম্বন্ধে যেসব সংবাদ খবরের কাগজে ও লোকমুখে এসে পৌঁছত সেগুলো ১৯৩৩ পর্যন্ত যাচাই করে নেওয়া যেত। ওই বছরে হিটলার ক্ষমতা গ্রহণ করার ফলে প্রেসের স্বাধীনতা লোপ পায়। কাজেই যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত হিটলার-বৈরীদের সম্বন্ধে কোনও পাকা খবর পাওয়া যেত না। যুদ্ধের পর শ্রীযুক্ত ভাইমার আডেনাওয়ার সম্বন্ধে একখানি প্রামাণিক গ্রন্থ লেখেন। সেখানা জোগাড় করতে পারিনি বলে আমার জানা তথ্য ও তত্ত্ব যাচাই করে নিতে পারছিনে। বিশেষ করে ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৫ পর্যন্ত আডেনাওয়ার গোপনে নাৎসিদের বিরুদ্ধে কী কী করেছিলেন সেসব খবর নিশ্চয়ই এই বইয়ে আছে। আডেনাওয়ারের মৃত্যুর পর থেকে কলন রেডিও মাঝে মাঝে ওই বই থেকে কিছু কিছু পড়ে শোনায়। এ প্রবন্ধে আমি তার সাহায্য নিয়েছি।

৪. বাত্তর, হিটলারজ পাইলট।

৫. Stephen Spender, European Witness; ১৯৪৬ মাসখানেক পূর্বে যখন কেলেঙ্কারি কেচ্ছা বেরুল যে মারকিন গুপ্তচর বিভাগ Encounter কাগজকে গোপনে অর্থ সাহায্য করে, তখন তিনি কাগজের সম্পাদকপদ ত্যাগ করেন।

৬. জর্মনগণ বৃদ্ধ আডেনাওয়ারকে ভক্তি ও ভালোবাসাসহ ডাকনাম দেয় ড্যার আলটে, (ওল্ড ম্যান), তার পরের চ্যানসেলারকে সহাস্যে ডাকনাম দেয়, ড্যার ডিকে (ফ্যাট ম্যান)।

৭. আডেনাওয়ার গত হন ভারতীয় সময় অনুযায়ী বিকেল ৫.৫১ মিনিটে। যে জর্মন বেতার ভারতের জন্য প্রোগ্রাম দেয় সেটি আডেনাওয়ারের প্রিয় কলনেই অবস্থিত সে ভারতের প্রোগ্রাম আরম্ভ করে বিকেল ৬.৫০ মিনিটে। আমি তখনই খবরটা শুনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এর পর, পরপর কয়েকদিন সন্ধ্যায় কালবৈশাখীর দরুন হয় বিজলি বন্ধ হয়ে যায় বলে, নয় রিসেপশন খারাপ ছিল বলে বকে, গার্সটেনমায়ার তথা চ্যানসেলার কিজিংগারের বক্তৃতা ভালো করে বোঝা যায়নি। ২৫ এপ্রিল গোরের দিনও আবহাওয়া খারাপ ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *