কদাকার হাঁস-ছানার কথা
তখন পাড়াগাঁয়ে কি সুন্দর সময় ! গ্রীষ্মকাল, গম পেকে হলুদ, যবের রঙ সবুজ, সবুজ মাঠের ধারে খড়ের গাদা, লাল লম্বা ঠ্যাং নিয়ে সারস চার দিকে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে আর বিড়, বিড়, করে মায়ের কাছে শেখা মিশরী বুলি ঝাড়ছে! খেত মাঠ ঘিরে ঘন বন। পাড়াগাঁ কি যে সুন্দর। একটা প্রকাণ্ড পুরনো বাড়ির উপর উষুম-উষুম রোদ পড়েছে, বাড়ির চারধারে গভীর খাল। বাড়ির দেয়াল থেকে জলের কিনারা পর্যন্ত বড়ো-বড়ো পাতা নিয়ে বুনো ঝোপ এমনি উঁচু হয়ে উঠেছে যে তার মধ্যে একটা ছোটো ছেলে খাড়া হয়ে দাঁড়ালেও ঠাওর হয় না।
কি জঙ্গল জায়গাটাতে, যেন ঘন বনের মধ্যিখানটি ! এদিকে কেউ বড়ো-একটা আসে না, সেইজন্যই একটা হাঁস বেছে বেছে এইখানে বাসা বেঁধেছিল। এখন সে ডিমে বসে তা দিচ্ছিল, কিন্তু প্রথম প্রথম যে ফুর্তি লাগছিল, এখন আর সেরকম লাগছে না, কাঁহাতক এক জায়গায় এতক্ষণ ঠায় বসে থাকা যায় ! দেখা করতেও বড়ো একটা কেউ আসে না, ছাই ! ওর সঙ্গে গল্প না করে বরং সবাই মজা করে খালে-বিলে সাতরে বেড়াচ্ছে ! শেষপর্যন্ত ডিমগুলো সত্যি ফুটল। একটার পর একটা ক্ষুদে মুণ্ডু দেখা দিল। হাঁস বলল, “প্যাক-প্যাক ” অমনি বাচ্চাগুলো যেমন তেমন করে উঠে পড়ে, সবুজ পাতার নীচে থেকে উকি মেরে দেখতে লাগল !
একটা বাচ্চ বলল, “আরি বাপ! পৃথিবীটা কী বড়ো!” মা-হাস বলল, “এইটুকু দেখেই পৃথিবী ভাবলি নাকি ? আরে, এ বাগানের ওধারের সীমানার ওপারে অনেক দূর পর্যন্ত, একেবারে পাদ্রীর মাঠ অবধি পৃথিবীটা ছড়িয়ে আছে! অবিশ্যি আমি নিজে অদ্দূর যাই নি। ওরে, তোরা সবাই আছিস তো ?”
বলেই হাঁস উঠে পড়ল। “কই, না তো, সবাই তো হেথা নেই। সবার বড়ো ডিমটাই যে বাসায় রইল ! কি জ্বালা ? এ আর কত দিন চলবে, বাপু । আমি তো একেবারে ছাপিয়ে উঠলাম।” এই বলে মা-হাঁস আবার গিয়ে বাসায় উঠল। বুড়ি-হাঁস দেখা করতে এসে বলল, “কিগো, চলছে কেমন ?” মা-হাস বলল, “এই একটা ডিমের জন্যেই যা দেরি হচ্ছে ; এ যে আর ফোটেই না । কিন্তু অন্য বাচ্চাগুলোকে যদি একবার দেখতে! জন্মে কখনো আমি এমন সুন্দর হাসের ছানা দেখি নি!”
বুড়ি-হাঁস বলল, “ওটা নির্বাৎ পেরুর ডিম। আমি নিজে একবার ঐরকম ঠকেছিলাম ; তার পর বাচ্চাগুলোকে নিয়ে সে যে কি ঝামেলা ! জলে যেতে ভয় পেত ! হাজার চেষ্টা করেও কিছুতেই জলের ধার কাছে নিয়ে যেতে পারতাম না। কত ডাকাডাকি বকবকি করতাম, কোনো ফল হত না। দেখি তো একবার ডিমটাকে। হু, যা বলেছি ! ও পেরুর ডিম না হয়ে যায় না! ওটা থাক্ গে, তুমি বরং অন্যগুলোকে সাঁতার শেখাও।”
মা-হাঁস বলল, “আরেকটু বসেই দেখি-না, এমনিতেই এত দিন ঠায় বসে আছি, ফসল-কাটার শেষ পর্যন্তই না হয় এখানে কাটালাম!”
“যা ইচ্ছা কর । তাতে আর আমার কি!” এই বলে বুড়িহাঁস হেলেদুলে চলে গেল। শেষপর্যন্ত বড়ো ডিমটা ফুটল। বাচ্চাটা ‘চ্চিক, চ্চিক’ শব্দ করে খোলার ভিতর থেকে গড়িয়ে বেরিয়ে এল। কিন্তু মাগো ! কি মস্ত আর কি কদাকার দেখতে ! মা-হাস তার দিকে তাকিয়ে রইল। শেষটা বলল, “এটা কি ষণ্ডা-গুণ্ড রে বাবা ! অন্যগুলোর একটাও তো একটুও এমন ধারা নয়। তবে কি এটা একটা পেরুর পুরুষ-বাচ্চা নাকি ? বেশ, একটু বাদেই দেখা যাবে। তবে জলে ওকে নামতেই হবে ; নিজের হাতে ঠেলেটুলে নামাতে হয় তো তাই সই।”
পরদিন চমৎকার দিন করেছিল ; সমস্ত সবুজ পাতার উপর নরম গরম রোদ। এমন সময় মা-হাঁস সব কটা ছানাপোনা নিয়ে খালের দিকে চলল। সেখানে পৌঁছেই টুপ করে মা জলে
নামল। তার পর প্যাঁক-প্যাঁক করে ডাক দিতেই, বাচ্চাগুলোও একটার পর একটা জলে ঝাপ দিল। প্রথমে মাথাগুলো জলের নীচে তলিয়ে গেল, তার পরেই আবার ভেসে উঠল, সবাই দিব্যি সহজে সাঁতার দিতে লাগল। সব কটা বাচ্চাই, কদাকার ছাই রঙেরটাও । মা-হাঁস বলল, “মোটেই পেরু নয় ; আহা ! একবার খালি তাকিয়ে দেখতে হয় বাছার কি চমৎকার ঠ্যাং নাড়ার ঢঙ, কেমন সোজা হয়ে ভাসা ! এটা আমার নিজের ছানা, ভালো করে নজর দিলে বোঝা যায় যে দেখতেও খাসা ! প্যাঁক-প্যাঁক! আয় আমার সঙ্গে, তোদের দুনিয়া দেখাই চল। কিন্তু কাছে কাছে থাকিস বাছারা, নয়তো কে কোথায় মাড়িয়ে দেবে ; তাছাড়া বেড়াল সম্বন্ধে সাবধান!”
যে উঠোনে পাতি-হাসঁরা থাকত, ওরা সেখানে গিয়ে পৌছল। গিয়ে দেখে কি-না একটা বান-মাছের কাঁটা নিয়ে দুই পরিবারে ঝগড়া বেধেছে। সেটাকে শেষে বেড়ালে নিল।
মা-হাঁস নিজেও মাছ-পোড়া ভালোবাসত, ঠোঁট মুছে সে বলল, “দেখলি তো বাছারা, এই হল দুনিয়ার দস্তুর। এখন পা চালা দিকি, ঐ যে হোথা বুড়ি-হাঁস, ওকে নমো করিস । এখানে যত পাখি দেখছিল, ও-ই হল সবার সেরা, হিম্পানী বংশ ওদের, তাইতে অমন হোমরা-চোমরা চেহারা, অমন আদবকায়দা। ওর ঠ্যাঙে কেমন লাল ন্যাকড়া বাধা দেখেছিস ? সবাই বলে ঐটে নাকি ভারি সুন্দর, ওর চাইতে বড়ো সম্মান হাঁসজগতে আর হয় না।”
উঠোনের অন্য হাসরা ওদের দিকে চেয়ে থেকে, জোরে জোরে বলাবলি করতে লাগল, “ঐ দেখ, আরেক গুষ্টি এলেন । যেন এখানে এমনিতেই যথেষ্ট লোক নেই ! আরে ছি ! ছি:! ঐটা কি কদাকার গো । ওটাকে থাকতে দেব না।” যেই-না বলা, অমনি একটা হাঁস সেই বাচ্চাটার দিকে তেড়ে গিয়ে, দিল তার গলায় এক কামড়। মা-হাঁস বলল, “ওকে কিছু বল না, ও কারো কোনো ক্ষতি করছে না।”
“তা হতে পারে, কিন্তু ব্যাটা বেজায় বড়ো আর দেখতে কি অদ্ভুত ” ঠ্যাঙে লাল ন্যাকড়া বাধা বুড়ি-হাঁস বলল, “ঐটে বাদে মা-লক্ষীর ছেলেমেয়েরা সবাই ভালো দেখতে, ঐটে তেমন সুবিধার হয় নি। ওটাকে আরেকবার ডিম থেকে ফুটিয়ে তুলতে পারলে বেশ হত ।”
মা-হাঁস বলল, “দেখতে সুন্দর নয় সে কথা ঠিক, কিন্তু বড়ো লক্ষী ছেলে, অন্যগুলোর মতোই সাঁতার কাটতে পারে, বরং ওদের চেয়েও ভালো কাটে । মনে হয় সময়কালে ও-ও অন্যদের মতোই হয়ে উঠবে, তখন হয়তো আরো ছোটো দেখাবে।” এই বলে মা বাচ্চাটার গলা চুলকিয়ে দিল, সারা গায়ে ঠোঁট বুলিয়ে দিল। তার পর আবার বলল, “তা ছাড়া ও হল পুরুষ-বাচ্চা, আমার বিশ্বাস ওর গায়ে খুব জোর হবে, কাজেই গায়ের জোরেই দিব্যি চালিয়ে নেবে।”
বুড়ি-হাঁস বলল, “বাঃ, অন্যগুলি তো ভারি সুন্দর। এসো, এখানে গুছিয়ে বস আর মাছের মুড়োটুড়ো পেলে, আমাকে দিতে পার।”
কাজেকাজেই ওরা বেশ গুছিয়ে বসল। কিন্তু ঐ যে বেচারা সবার শেষে ডিম থেকে ফুটে বেরিয়েছিল আর দেখতে বেজায় কদাকার ছিল, তাকে সমস্ত হাঁস মুরগিরা কামড়িয়ে, ঠুকরিয়ে, জ্বালিয়ে খেত। এদিকে পেরুদের দলের পাণ্ডা, জন্মেইছিল ঘোড়সওয়ারদের মতো পায়ের গোড়ালিতে কাঁটা পরে, সে তো পাল-তোলা জাহাজের মতো ফুলে ফেঁপে, রাগে মুখ লাল করে, বাচ্চাটার দিকে গটমট করে এগিয়ে এল। সে বেচারা কি যে করবে ভেবেই পেল না ; তার চেহারাটা এত বিত্র বলে সে এমনিতেই বেজায় অপ্রস্তুত !
এইভাবে তো প্রথম দিনটি কাটল ; তার পর থেকে দিনে দিনে অবস্থা আরো খারাপ হতে লাগল। ভাইবোনরাও ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করত, খালি খালি বলত, “ওরে বিটকেল ! তোকে বেড়ালে নেয় না কেন !” মা পর্যন্ত বলত, “বাছা, তুই যদি দূরে কোথাও চলে যেতিস্, তবেই যেন ভালো হত !”
হাঁসরা ওকে কামড়াত, মুরগিরা ঠোকরাত, যে মেয়েটা ওদের খাবার দিত, সে ওকে লাথি মারত। বেচারা ছুটে বেড়ার ঝোপে গিয়ে ঢুকল ; সেখানকার ছোটাে পাখিরা ওকে দেখে ভয়েই আধমরা ! হাঁসের ছানা ভাবল, ‘এর কারণ, আমি বড়ো বিশ্রী দেখতে ? এই মনে করে সে ছুটছে তো ছুটছে। শেষটা একটা মস্ত জলা জায়গাতে এসে পৌছল। সেখানে কতগুলো বুনো হাঁস থাকত। সেইখানেই সে সারারাত পড়ে রইল, শরীরে কি যে ক্লান্তি, কোথাও এতটুকু আরাম নেই। সকালে বুনো হাঁসরা উঠে পড়েই তাদের নতুন সঙ্গীটিকে দেখতে পেল। তারা জানতে চাইল, “বলি, তুমি কে ?” হাঁসছানা তাদের সঙ্গে যতটা পারে ভদ্রভাবেই কথা বলল।
ওরা বলল, “তুমি সত্যিই বড়ো কদাকার হে, অবিশ্যি তাতে আমাদের কিছু এসে যায় না, যদি-না আমাদের বাড়ির মেয়ে বিয়ে করতে চাও।”
হাঁস বেচারা বিয়ে-থার কথা কখনো ভাবেও নি। তার একমাত্র ইচ্ছা ঐখানে নল-খাগড়ার মধ্যে পড়ে থাকবে আর বিলের জল খাবে। তাই সে রইল পুরো দুটি দিন। তৃতীয় দিন দুটি ছাই রঙের বুনো হাঁস এসে উপস্থিত। তারা খুব বেশি দিন ডিম ফুটে বেরোয় নি, কাজেই বড়ো বেয়াদব।
তারা বলল,“ওরে ব্যাটা শোন, তোর চেহারাটি এমনি হতকুচ্ছিৎ যে তোকে আমাদের বেড়ে পছন্দ! আসবি নাকি আমাদের সঙ্গে ? কাছেই আরেকটা বিল আছে, সেখানে কয়েকটা লক্ষী মিষ্টি বুনো হাঁস থাকে। যেখানে যত হাঁস হিশ্শ্ হিশ্শ্ করে ডাক ছাড়ে, তাদের সক্কলের মধ্যে ওদের চেয়ে সুন্দর আরেকটি বার কর দিকনি! এবার তোর কপাল খুলে যাবে রে, ব্যাট, তা কুচ্ছিৎ হোস্, আর যাই হোস্!”
ঠিক সেই সময় দুম করে একটা বন্দুকের শব্দ হল আর দুটো হাঁসই মরে পা ছড়িয়ে নল-খাগড়ার বনের মধ্যে পড়ল। দুম্ করে আবার বন্দুকের শব্দ হল, এক ঝাঁক বুনো হাঁস অমনি জল ছেড়ে উঠে পড়ল। তার পরেই আবার বন্দুকের আওয়াজ । সেদিন শিকারীদের মস্ত এক দল বেরিয়েছিল। চারধারে এখানে ওখানে শিকারীরা লুকিয়ে বসেছিল ; কেউ কেউ আবার গাছেও চড়েছিল। গাছগুলোর ডালপালা লম্বা হয়ে বিলের জলের উপরে দুলছিল। এক পাল কুকুর কাদার মধ্যে নেমে, চারদিকে নল-খাগড়ার বন ভেঙে, নুইয়ে, জল ছিটিয়ে, পাখি খুজে বেড়াচ্ছিল। হাঁসের ছানা বেচারি তো ভয়েই আধমরা ! ডানার তলায় মুণ্ডু লুকোবে ভেবে যেই না মাথা ঘুরিয়েছে, অমনি একটা হিংস্র চেহারার কুকুর তার একেবারে কাছে এসে দাঁড়াল ! কুকুরটার এতখানি জিব বেরিয়ে আছে, দু চোখ যেন আগুনের ভাটা ! হাঁসের ছানাকে দেখেই সে তো প্রকাণ্ড বড়ো এক হা করল, দুই পাটি এই ধারাল সাদা দাঁত দেখা গেল আর তার পরেই জল ছপ ছপ, করতে করতে কুকুরটা চলে গেল! হাঁসের বাচ্চাকে কিচ্ছু বলল না!
ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে হাসের ছানা বলল, “বাবা । ভাগ্যিস আমি এমনি কদাকার যে কুকুরেও আমাকে খায় না।”
নল-খাগড়ার বনে বন্দুক ছোঁড়া চলতে লাগল, বাচ্চ হাঁস চুপ করে শুয়েই রইল। বেলা পড়ে যাবার আগে গুলির শব্দ থামল না ; থামলে পরও বেচারা নড়বার-চড়বার সাহস পেল না। কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করবার পর সে চার দিকে একবার তাকিয়ে দেখেই, জলা জায়গাটা ছেড়ে প্রাণপণে ছুট লাগাল । সেকি দৌড়, খেতের উপর দিয়ে, মাঠের মধ্যে দিয়ে, যদিও এমনি জোরে বাতাস বইছিল যে তার মুখে দেীড়নোই একটা কঠিন ব্যাপার !
বিকেলের দিকে হাঁসের ছানা ভাঙাচোরা ছোটো একটা কুঁড়েঘরের সামনে পৌছল, সেটার বড়োই দুরবস্থা ; যেন কোন দিকে হেলে পড়বে ভেবে না পেয়ে, কোনোমতে খাড়া হয়ে আছে। হাঁস দেখল দরজার একটা কব্জা কোথায় উড়ে গেছে আর পাল্লাটা এমনি ট্যারা হয়ে ঝুলে আছে যে, দরজার আর দেয়ালের মাঝখানে একটু ফাক দেখা যাচ্ছে। তার মধ্যে দিয়ে একটা বাচ্চা হাঁস বেশ গলে যেতে পারে। এদিকে বাইরে ঝড়ের ঘনঘটা ক্রমেই বেড়ে চলেছে দেখে, সে গুড়িশুড়ি মেরে ঘরের ভিতরে সেঁদিয়ে গেল ।
ঐ ঘরে তার হুলো-বেড়াল আর মুরগি নিয়ে এক বুড়ি থাকত। বেড়ালটাকে বুড়ি বলত তার ছেলে ; সে পিঠ ফুলো করে গলার মধ্যে গরর-গরর শব্দ করতে পারত। মুরগিটার ঠ্যাংগুলো বেজায় বেঁটে, তাই বুড়ি তার নাম দিয়েছিল ‘ঠ্যাং-নাটা খুকু’। মুরগি খুব ভালো ডিম দিত আর বুড়িও তাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসত । ঘরে নতুন অতিথি দেখে পরদিন সকালে বেড়াল ম্যাওম্যাও ডাক ছাড়ল আর মুরগিও কঁক-কঁক করতে লাগল। চার দিকে তাকিয়ে, বুড়ি বলল, “আবার কি হল ?” বুড়ি চোখে
ভালো দেখত না, বাচ্চা-হাঁসকে দেখে মনে করল বুঝি মস্ত মোটা হাঁস, পথ হারিয়ে চলে এসেছে। তাই বুড়ি বলল, “বাঃ, বড় দাঁও মারা গেল ! ওটা যদি ছেলে হাঁস না হয় তো দিব্যি হাঁসের ডিম খাওয়া যাবে! দেখাই যাক-না।” কাজেই তিন সপ্তাহ ধরে হাঁসকে পরখ করা হল, কিন্তু ডিম-টিম দেখা গেল না।
এখন হয়েছে কি, ঐ বেড়ালটাই ছিল ও-বাড়ির কর্তা আর মুরগি ছিল গিন্নি। কিছু বলতে হলে তারা সর্বদাই বলত, “আমরা
আর পৃথিবীটা হেনা-তেনা,” কারণ তাদের ধারণা ছিল যে, তারা নিজেরা শুধু যে অর্ধেক পৃথিবী তাই নয়, ওদের অর্ধেকটাই বেশি ভালো! বাচ্চা-হাঁস ভাবত এ বিষয়ে কারো কারো অন্য মতও থাকতে পারে, কিন্তু মুরগি সে কথা মানবে কেন ? মুরগি জিজ্ঞাসা করল, “এই ডিম পাড়তে পারিস্ ?” “না।” “তা হলে মুখে কুলুপ দে!” বেড়াল বলল, “পিঠ কুলো করতে পারিস্ ? গরর গরর শব্দ করতে পারিস্ ?” “না।” “বেশ, তা হলে গুরুজনরা যখন কিছু বলেন, তখন মতামতের কথা তুলবি নে!” কাজেই হাঁসের ছানা আর কি করে, রেগেমেগে এক কোণে একাঁ বসে রইল। সে যাই হোক, হঠাৎ তার খোলা হাওয়া আর ঝকঝকে রোদের কথা মনে পড়ে গেল। আর মনে পড়তেই আবার জলে সাঁতরে বেড়াবার জন্য এমনি প্রবল ইচ্ছা হল যে, কথাটা মুরগিকে না বলে পারল না।
মুরগি বলল, “তোর হয়েছেটা কি ? কাজকর্ম নেই কি-না, তাই যতসব বাজে খেয়াল পুষছিস। হয় ডিম পাড়, নয় তো গরর-গরর শব্দ কর, তা হলেই ও-সব ভুলে যাবি।” বাচ্চা-হাঁস বলল, “কিন্তু সাঁতার কাটতে কি ভালোই যে লাগে । জলের তলায় ডুব দিলে, মাথার ওপর যখন দু পাশের জল আবার একসঙ্গে মিলে যায়, তখন কি ভালোই-না লাগে।” মুরগি বলল, “বলিহারি তোর ভালোলাগার ছিরি । আমার মতে তুই একটা পাগল ! আমার কথা নাহয় বাদ দিলি, বেড়ালকেই জিজ্ঞাসা করে দেখনা, ওর মতো বুদ্ধিমান জানোয়ার তো কোথাও দেখি নি, ওকেই জিজ্ঞেস কর সাঁতার কাটতে, কি জলের তলায় ডুব দিতে, ওর ভালো লাগে কি না । না হয় গিন্নিমাকেই শুধোস্, তার চেয়ে তো কারো বেশি বুদ্ধি নেই।
তুই কি সত্যি ভাবিস যে সাঁতার কাটলে, কিম্বা মাথার ওপর দুপাশের জল একসঙ্গে মিললে, তাঁর খুব মজা লাগবে ?”
বাচ্চা-হাঁস বলল, “তুমি আমার কথাটা ঠিক বুঝতে পার নি।” “কি বললি ? না, তা বুঝব কেন ! তবে কি তুই ভাবিস্ যে বেড়ালের চেয়ে, কিম্বা গিন্নিমার চেয়ে—আমার কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম—তোর বেশি বুদ্ধি ? ও-সব কথাকে মনেও স্থান দিস না, বাছা, বরং যে দয়া পাচ্ছিস, তার জন্য কৃতজ্ঞ থাক্। একটা গরম ঘরে জায়গা পাচ্ছিস আর এমন সব লোকের সঙ্গে মেশবার সুযোগ পাচ্ছিস্ না, যাদের কাছ থেকে কিছু শেখা যায় ?
কিন্তু তুই এমনি আহাম্মুক যে তোর সঙ্গে মেশাই দায়! বিশ্বাস কর, তোর ভালো মনে করেই বলছি। অপ্রিয় সত্য বলি বটে, কিন্তু তাই দিয়েই তো প্রকৃত বন্ধু চেনা যায়। এবার আয় দিকিনি, একবার একটু কষ্ট করে হয় গরর গরর শব্দ করতে, নয়তো ডিম পাড়তে শেখ।” হাঁসের ছানা বলল, “ভাবছি আবার দুনিয়া দেখতে বেরিয়ে পড়ি।”
মুরগি বলল, “তাই যা-না।”
কাজেই বাচ্চা-হাঁস বেরিয়ে পড়ল। কখনো সে জলের উপরে সাঁতার কাটত, কখনো জলের নীচে ডুব দিত, কিন্তু বেচারা এমনি কদাকার দেখতে যে, সব জন্তু-জানোয়ার ওর পাশ কাটিয়ে চলে যেত। এমনি করে হেমন্তকাল এল, গাছের পাতা হলদে হল, পাটকিলে হল, তার পর হাওয়ায় উড়ে গেল, বাতাস তাদের নাচিয়ে ফিরতে লাগল। হাওয়াটা বেজায় ঠাণ্ডা হল ; মেঘগুলো শিলের আর বরফের বোঝায় ভারি হয়ে উঠল ; ঝোপের উপর দাঁড়কাক বসে হেঁড়ে গলায় ডাকতে লাগল। বাচ্চা-হাঁস বেচারির কোথাও একটু আরাম পাবার জো রইল না।
একদিন সন্ধেবেলায়, ঠিক সূর্য ডোবার সময়, ঝোপঝাড়ের মধ্যে থেকে এক ঝাঁক বড়ো-বড়ো পাখি আকাশে উড়ল। হাঁসের ছানা এমন সুন্দর জিনিস আর কখনো দেখে নি। পাখিগুলোর পাখনা ছিল ধবধবে সাদা, লম্বা পাতলা গলা। ওরা হল রাজহাঁস।
অদ্ভুত একটা ডাক ছেড়ে, দীর্ঘ সুন্দর ডানা মেলে, এ দিকের ঠাণ্ডা জায়গা ছেড়ে, ওরা সমুদ্রের ওপারের গরম দেশে উড়ে চলে গেল। কত উঁচু দিয়ে উড়ে গেল ওরা, কী বিষম উঁচু দিয়ে। বিশ্রী দেখতে বাচ্চা-হাঁসটার মনের ভাবও কেমন অদ্ভুত হয়ে গেল। গম-পেষার কলের চাকার মতে, জলের উপর পাক খেয়ে সে কেবল ঘুরতে লাগল আর গলা লম্বা করে, তারা যেদিকে গেছে সেদিকে দেখতে লাগল আর তার গলার
ভিতর থেকে, এমনি জোরে একটা অদ্ভুত আওয়াজ বেরিয়ে এল যে তাই শুনে নিজেরই ভয় ধরে গেল ! আহা, ওরা সব পাখির সেরা পাখি, ওদের কথা হাঁসের ছানা কিছুতেই ভুলতে পারছিল না। কী সুখী ওরা ! বাচ্চা-হাঁস ওদের নামও জানত না, কোথায় ওরা যাচ্ছে তাও জানত না। তবু তাদের এমন ভালো লাগল, যেমন আর কখনো কাউকে লাগে নি। একটুও হিংসা হল না ; অমন রূপ যে তার নিজের কখনো হতে পারে, এ কথা সে ধারণাও করতে পারত না। উঠোনের সেই হাঁসর যদি তাকে থাকতে দিত, তা হলে সে খুশি হয়ে সেখানেই থেকে যেত।
তার পর শীত এল, সে যে কি ঠাণ্ডা, কি ঠাণ্ডা ! বাচ্চা হাঁসকে কেবল চরকি দিয়ে সাঁতরে বেড়াতে হত, যাতে তার চারদিকের জল না জমে যায়। তবু রোজ রাতে দেখত বরফের মাঝখানে খোলা জলের জায়গাটুকু ক্রমেই ছোটো হয়ে আসছে। প্রাণপণে তাকে ঠ্যাং ছুড়তে হত, নইলে ওর চারপাশের সব জলটাই জমে বরফ হয়ে যাবে। শেষটা একেবারে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে, শীতে জমে আড়ষ্ট হয়ে, বরফের উপর বেচারা শুয়ে পড়ল ।
পরদিন ভোরে ঐ পথ দিয়ে যাবার সময়, একজন চাষী ওকে ওভাবে দেখতে পেয়ে, নিজের পায়ের কাঠের জুতো দিয়ে বরফ ভেঙে টুকরো টুকরো করে, হাঁসের ছানাকে তুলে ঘরে নিয়ে এসে, তার বৌয়ের কাছে দিল।
দেখতে দেখতে বাচ্চা-হাঁস সুস্থ হয়ে উঠল। চাষীর ছেলেমেয়ের তো ওর সঙ্গে খেলা করার ভারি ইচ্ছা ; কিন্তু হাঁস ভাবল ওরা বুঝি ওকে জ্বালাতন করতে এসেছে তাই ভয়ের চোটে এক লাফে সে দুধের বালতির মধ্যে গিয়ে পড়ল। সব দুধ পড়ে গিয়ে ঘর ভেসে গেল। চাষীর বৌ চেঁচিয়ে, হাততালি দিয়ে উঠল। হাঁস তখন সেখান থেকে ধড়ফড় করে মাখনের গামলায় ঢুকল, তার পর সেখান থেকে উঠে ময়দার পিপেতে পড়েই, আবার বেরিয়ে এল।
তখন বৌ চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে তাকে চিমটের বাড়ি মারার চেষ্টা করতে লাগল। ছেলেমেয়েও রেষারেষি করে হাঁস ধরবার চেষ্টা করতে লাগল। তাদের সে কী হাসি আর চ্যাঁচামেচি ! ভাগ্যিস দরজাটা খোলা ছিল, ছুটে বেরিয়ে এসে হাঁস ঝোপঝাড়ের ভিতর ঢুকে নতুন পড়া নরম বরফের উপর যেন স্বপ্নের ঘোরে শুয়ে পড়ল।
ঐ শীতকালে হাঁসের ছানাকে যে কত অসুবিধা কত কষ্ট সইতে হয়েছিল, সে কথা বলতে গেলে বড়োই দুঃখের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। শেষে একদিন সে একটা বিলের ধারে নলখাগড়ার ঝোপের মধ্যে শুয়ে ছিল। এমন সময় টের পেল আবার রোদে গরমের আমেজ লেগেছে, লার্ক পাখিরা গান গাইছে, সুন্দরী বসন্তকাল আবার ফিরে এসেছে। তখন বাচ্চা হাঁস আবার ডানা ঝাপটাতে লাগল। আগের চাইতে এখন ডানায় কত বেশি জোর হয়েছে ; সেই ডানায় ভর করে হাঁস তাড়াতাড়ি সাঁতরিয়ে চলল আর কিছু টের পাবার আগেই দেখল যে একটা মস্ত বাগানের ধারে এসে পৌছেছে। সেখানে আপেল গাছ ফুলে ভরে আছে, লতাগাছ খালের জলের উপর দীর্ঘ সবুজ ডালপালা ঝুলিয়ে দিয়েছে, চারদিক তার ফুলের হুগন্ধে ম-ম করছে। সেখানকার সব কিছু সুন্দর, বসন্তকালের নতুন প্রাণে কেমন ভরপুর। কুঞ্জের মধ্যে থেকে তিনটি সুন্দর সাদা রাজহাঁস বেরিয়ে এল। কি সগর্বে তারা পাখনার বাহার দেখাতে লাগল আর আলতোভাবে জলের উপর সাঁতরে বেড়াতে লাগল।
হাঁসের বাচ্চা সেই অপরূপ প্রাণীদের চিনতে পারল, অদ্ভুত এটা কি দুঃখে তার মন ভরে উঠল। সে বলল, “রাজার মতো পাখি, ওদের কাছে উড়ে যাব নাকি ! আমার মতো একটা কদাকার পাখি ওদের কাছে গেলে, আম্পর্ধা দেখে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে ; কিন্তু তাতে কিই-বাএসে যায়। হাঁসের কামড়, মুরগির ঠোক্কর, যে মেয়েটা পাখিদের খাবার দেয় তার লাথি খাওয়া, তার পর শীতকালে এত কষ্ট পাওয়ার চাইতে, ওদের হাতে মরাই ভালো।”
এই ভেবে সে উড়ে জলে নেমে, সেই সুন্দর পাখিগুলোর দিকে সাঁতরিয়ে চলল। তারাও ওকে দেখতে পেয়ে, তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল। হাঁসের ছানা বেচারা বলল, “আমাকে শুধু মেরে ফেল।” বলে মাথা নিচু করে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু জলের মধ্যে এ কি দেখছে সে ! দেখছে নিজের ছায়া, কিন্তু সে তো একটা মোটা, কদাকার, ছাই রঙের পাখির ছায়া নয়, রাজহাঁসের ছায়া।
রাজহাঁসের ডিম ফুটে যে পাখি বেরিয়েছে, সে পাতিহাঁসের উঠোনে জন্মালেও কিছু এসে যায় না।
বড়ো রাজহাঁসরা ওর চারদিকে সাঁতরিয়ে বেড়াতে লাগল, ওর গায়ে ঠোঁট বুলিয়ে দিতে লাগল। ওর মনে আনন্দ আর ধরে না ।
বাগানের মধ্যে কয়েকটি ছোটো-ছোটো ছেলেমেয়ে ছুটোছুটি করছিল। তারা শস্যের দানা আর রুটি ছুড়ে ছুড়ে জলে ফেলল। তার পর সবার ছোটোটি বলে উঠল, “আরে, একটা নতুন হাঁস যে !” অন্যরাও চেঁচিয়ে উঠল, “আরে, তাইতো, একটা নতুন রাজহাঁস এসেছে যে ” আনন্দে হাততালি দিয়ে তারা মা-বাবাকে কথাটা বলবার জন্য ঘরের মধ্যে চলে গেল । তার পর জলে আরো রুটি আর কেক ফেলা হল। সবাই বলল, “নতুন রাজহাঁসটাই সবচেয়ে ভালো, কত কম বয়স, কি সুন্দর দেখতে!” বুড়ো রাঁজহাসরা এসে ওর সামনে মাথা নিচু করল। ছোটো রাজহাঁস লজ্জা পেয়ে, ডানার মধ্যে মাথা গুঁজল। তার বড়ো আনন্দ হচ্ছিল, কিন্তু তাই বলে অহংকার হচ্ছিল না। মন যাদের ভালো হয়, তারা কখনো অহংকার করে না।
তার মনে পড়ে গেল আগে সবাই তাকে যেমন টিটকিরি দিত আর তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করত; এখন শুনল সবাই বলছে যেখানে যত সুন্দর পাখি আছে, তার মধ্যে ও-ই নাকি সবচাইতে সুন্দর। লতাগাছগুলি তার দিকে ডালপালা নামিয়ে দিল, সূর্য তার নরম-গরম উজ্জ্বল রোদ দিতে লাগল। হাঁস তার পালক ঝাড়ল, সুন্দর সরু গলাটি লম্বা করল আর মনের খুশিতে বলে উঠল, “যখন আমি একটা কদাকার হাঁসের ছানা ছিলাম, সবাই আমাকে ঘেন্না করত ; তখন কি স্বপ্নেও এত সুখের কথা ভাবতে পারতাম !”