কদাকার কেস
সল্টলেক স্টেডিয়ামের সামনে দিয়ে যে নতুন রাস্তাটা সোজা উত্তর দিকে চলে গেছে, সেই রাস্তা বরাবর করুণাময়ী স্টেট পর্যন্ত গেলে মাঝে অনেকগুলো সারকেল পড়ে চার রাস্তার মোড়ে।
থারড সারকেলটায় রোজ বিকেলবেলা একা গিয়ে বসে ইন্দ্রনাথ। বৃদ্ধ বায়ুসেবীরা এদিকে ততটা ভিড় করেন না। চারদিকে ফাঁকা মাঠ। এখানে ওখানে দু-একটা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। আর বছরকয়েকের মধ্যে এখানে আর এভাবে হু-হুঁ করে বাতাস বইবে না, জায়গাটা আর এরকম নির্জন থাকবে না।
শুধু একজন এসে রোজ বসে ইন্দ্রনাথের অদুরে। চাপাগলায় প্রায় ফিসফিসানি স্বরে এক লাইনের একটা গানই গায় প্রতিদিন। উদাস চোখে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে হঠাৎ ফিসফিস করে তান ধরে আপন মনে।
তারা আসছে…তারা আসছে…রোজ রাতে তারা আসছে…আসছে…আসছে…আসছে।
শেষের দিকের আসছে শব্দ তিনটে যেন খাদের মধ্যে নামতে নামতে হারিয়ে যায় গলার মধ্যে।
গায়কের বয়স বেশি নয়। বড় জোর পঁচিশ। চেহারা সাধারণ, পোশাকও সাধারণ। উচ্চতা মাঝারি। গায়ের রং না ময়লা, না ফরসা। চোখমুখের মধ্যে এমন কোনও বৈশিষ্ট্য নেই যে মনে দাগ কেটে যায়।
দাগ কেটে যায় শুধু তার ওই চাপাগলার গানটা। একই গান। একই সুর। কিছুক্ষণ অন্তর একইভাবে গাওয়া। সন্ধে ঘনিয়ে এলে একইভাবে আস্তে-আস্তে হাঁটতে-হাঁটতে আর গাইতে গাইতে চলে যায় দূরের নতুন ফ্ল্যাট বাড়িগুলোর দিকে। নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় হু-হুঁ বাতাস বয়ে আনে অদ্ভুত শব্দগুলো চাপা হাহাকারের মতো?
তারা আসছে…তারা আসছে..রোজ রাতে তারা আসছে…আসছে…আসছে… আসছে।
একদিন উঠে গিয়ে তার পাশে বসল ইন্দ্রনাথ। সে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালে ইন্দ্রনাথের দিকে। চোখের চাহনি সুস্থ মানুষের চাহনির মতো নয়। পাগল। সন্দেহ নেই।
নরম গলায় বললে ইন্দ্রনাথ, গানটার মানে কী?
মানে শুনতে হলে একটা কেস শুনতে হবে খুবই কদাকার কেস, আস্তে-আস্তে থেমে থেমে বললে সে।
আমি শুনব। বললে ইন্দ্রনাথ।
তখন সে বলল কদাকার কেসের কদর্য কাহিনি। এবং তা লোমহর্ষকও বটে!
.
ললিতা ঘাড় বেঁকিয়ে বললে, রমেশ, এখন কী করবে?
গ্রানাইট কঠিন চোখে রমেশ বললে, তুমি যা চাও, তাই হবে।
তুমি খ্রিস্টান, আমি হিন্দু। তোমার বাবা বড়লোক, আমার বাবা গরিব মাস্টার। তা সত্ত্বেও বিয়ে করবে?
এখনও সন্দেহ আছে?
কিন্তু আমি তো তোমাকে বলেছি, আমার বিয়েতে শাঁখ বাজবে, উলুধ্বনি হবে, নিজের হাতে সিঁদুর টেনে দেবে সিঁথিতে। কিন্তু তোমার বাবা
চায় বিয়ে হবে গির্জেতে।
যদি আমি তা না করি।
আইনের পথে যাবে বাবা। সম্পত্তিচ্যুত হব, বাড়ির দরজা চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে যাবে। কাগজে কাগজে লিগ্যাল নোটিশ ছাপা হবে।
তা সত্ত্বেও চাও হিন্দুমতে হোক বিয়ে?
তোমার এই সেন্টিমেন্ট বাবার সম্পত্তির চেয়ে অনেক বেশি দামি আমার কাছে।
রমেশ, আর এক বছর কাটিয়ে দিলেই মাস্টারস ডিগ্রি পেয়ে যাব দুজনে।
একটা ডিগ্রির লোভে আমাদের জীবন থেকে একটা বছরকেও আমি হারাতে চাই না, ললিতা।
বেশ, তবে তাই হোক।
হ্যাঁ। ঠিক তাই হবে। তোমার কোনও ইচ্ছেই অপূর্ণ রাখব না আমি।
অদৃষ্টের অট্টহাসি শোনা গিয়েছিল তখন অন্তরালে–শুনতে পায়নি দুজনের কেউই।
.
রমেশ, বিয়ে তো হল। পথের ফকির হলে। কলেজ ছাড়লাম। পকেটে মাত্র পাঁচশো টাকা। এবার?
শুরু হোক অদৃষ্টের সঙ্গে পাঞ্জা কষা। ব্যাচেলরস ডিগ্রিটা যখন আছে, টিচারের চাকরি একটা পাবেই।
রমেশ, আমার বাবা সারা জীবন মাস্টারি করেছে। সংসারের অভাব কোনওদিনই ঘোচাতে পারেনি। ও লাইনে আমি যাব না।
তবে কী করবে?
কেরানির কাজ।
পেয়ে গেছ মনে হচ্ছে?
এই তো অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। এবার বল, তুমি কী করবে?
ব্যাবসা।
চাকরি করবে না?
জীবনেও না। বাবার এত টাকা ব্যাবসা করে। আমিও যাব সেই পথে।
মাত্র পাঁচশো টাকা পুঁজি নিয়ে?
ওর চাইতেও বড় পুঁজি যে আমার আছে, তা তো তুমি জানো ললিতা?
জানি, জানি, জানি। পুরুষের সব চাইতে বড় পুঁজি তার সাহস, তার উদ্যম–তা তোমার আছে। আর আছে ব্যক্তিত্ব, আছে স্মার্টনেস–তুমি পারবে, রমেশ, তুমি পারবে, কিন্তু ব্যাবসাটা কীসের?
পাইকারি বাজার থেকে মাল কিনে বাড়ি-বাড়ি ডেলিভারি দেব। টেন পারসেন্ট প্রফিটই যথেষ্ট। পাঁচশো টাকা পুঁজি নিয়ে–
এর বেশি হয় না। বেশ, আমি রইলাম চাকরি নিয়ে তুমি ভাগ্য ফেরাও বাণিজ্য করে। দেখা যাক কী আছে অদৃষ্টে।
আবার অট্টহেসে উঠেছিল অদৃষ্ট। এবারও তা শুনতে পায়নি দুজনের কেউই।
.
রমেশ, সত্যিই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুললে। দু-বছরেই ডেলিভারি ভ্যান!
নিজেই চালাব। অর্ডার সাপ্লাই বিজনেসে ভ্যানটা খুবই দরকার।
বলেছিলাম না তোমাকে, উদ্যোগী পুরুষেরই সহায় হয় ভাগ্য।
অদৃষ্টকে তো তৈরি করে নেওয়া যায় পুরুষকার দিয়ে, তাই নয় কি ললিতা?
আবার বিপুল রবে অট্টহেসে উঠেছিল অদৃষ্ট–না, শুনতে পায়নি কেউই।
রমেশ, আজ আমাদের পঞ্চম বিবাহ বার্ষিকী।
আর আজকের দিনেই উদ্বোধন হবে আমার নতুন ব্যাবসার বিলডিং আর ব্রিজ কনস্ট্রাকসন।
হিন্দি ফিল্মের কাহিনির মতো অলীক মনে হচ্ছে। তাই না রমেশ? মাত্র পাঁচশো টাকা পুঁজি নিয়ে পাঁচ বছরেই সল্টলেকে বাড়ি, গাড়ি—
এইবার তোমার শেষ সাধটা পূর্ণ করা দরকার, ললিতা। এবার আর না বলতে পারবে না।
আসলে সাধটা তোমার নিজেরই। বাবা হওয়ার ইচ্ছে হয়েছে বললেই হয়।
কার না হয়, ললিতা? যে আসবে, সে ছেলেই তোক কি মেয়েই হোক–তার চোখ যদি তোমার মতো সুন্দর না হয়–
আর তার হাইট যদি তোমার মতো ছফুট না হয়—
সর্বনাশ ললিতা, ছফুট হাইটের মেয়ের বর জুটবে না যে।
রমেশ, যে পৌরুষ দিয়ে এই বিপুল সম্পত্তি অর্জন করেছ, সেই পৌরুষ দিয়েই তুমি আমাকে ছেলেই উপহার দেবে–মেয়ে নয়।
অট্টহেসে উঠেছিল দীর্ঘদেহী, অত্যন্ত সুপুরুষ, প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী রমেশ। তাই সম্ভবত শুনতে পায়নি অদৃষ্টের অট্টহাসি!
.
অত ভেঙে পড়লে কি চলে রমেশ?
যে পুরুষ বউকে সন্তান উপহার দিতে পারে না, তার ভেঙে পড়াই তো স্বাভাবিক, ললিতা।
ইউরোপ আমেরিকার ডাক্তাররা তোমার শরীরের হরমোন ঘাটতি মিটিয়ে দিতে পারবে। চল, সেখানেই যাই। আমিও যাব।
কিছু হবে কি?
চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করাই পুরুষের ধর্ম। তুমি না পুরুষ?
আমি?
রমেশ, তোমার ওই হতাশ হাসি আমার বুক ভেঙে দিচ্ছে–দেখাই যাক না অদৃষ্টে কী আছে?
অদৃষ্ট স্বয়ং তা জানতেন বইকি। তাই এবার আর তিনি অট্টহাস্য করলেন না। কেবল মুচকি হাসলেন।
তাবড়-বড় ডাক্তারদের দোরে ঘুরে মুখ চুন করে ফিরে এলে স্বামী-স্ত্রী। রমেশের ঔরসে ললিতার মা হওয়ার সম্ভবনা নেই একেবারেই।
.
লিলিতা, একটা কথা বলব?
অমনভাবে বলছ কেন? না ঘুমিয়ে চোখমুখের অবস্থাটা কী করেছ আয়নায় গিয়ে দেখে এসো।
আগে কথাটা বলি–
তোমার কোনও কথা এখন শুনতে চাই না। এতবড় কারবারের দিকে একেবারেই নজর দিচ্ছ না। আকাশপাতাল চিন্তা করে সমস্যার সমাধান তো হবে না। অদৃষ্টে যা আছে, তা মেনে নেওয়াই ভালো।
অদৃষ্ট?…হ্যাঁ, অদৃষ্টই বটে! এই প্রথম অদৃষ্টের কাছে হার মানলাম আমি। কিন্তু সমস্যার সমাধান একটা আছে।
কী শুনি?
রাগ করবে না তো?
কোন কালে করেছি?
ললিতা…ব্যাপারটা ডেলিকেট…মানে, আমার কোনও আপত্তি নেই…তোমার সবচেয়ে বড় সাধপূরণ করার জন্যে আমি সবকিছুই মেনে নিতে পারি। আমি বলছিলাম…আমি বলছিলাম…
বল না? অত কিন্তু কিন্তু করছ কেন?
তুমি…তুমি…
কী হল? ফ্যাকাশে মেরে গেলে যে?
তুমি…আর কাউকে দিয়ে…মানে, এরকম নজির তো সমাজে আছে…
ছিঃ! রমেশ! ছিঃ! এত নোংরা সমাধানটা তোমার মাথায় এল কী করে?
নোংরা!
কদর্য! অত্যন্ত কদর্য! ভবিষ্যতে আর এ নিয়ে কোনও কথা আমাকে বলবে না।
শোন ললিতা, এখন তোমার বয়স ঊনচল্লিশ–এখনও সময় আছে।
চল্লিশ থেকেই শুরু হোক তোমার নতুন জীবন আমাদের দুজনের ছোট্ট সংসারে নাই বা এল তৃতীয় জন? সেই হোক আমাদের–
কিন্তু–
আর কোনও কথা নয়। কারবারের মধ্যে ডুবে যাও—
তোমার শেষ সাধটা–
শিকেয় তোলা থাক।যাও, দয়া করে নিজে গাড়ি ড্রাইভ আর কোরো না। দু-দুটো অ্যাকসিডেন্ট থেকে বেঁচ্ছে। যার মাথার ঠিক নেই–তার হাতে স্টিয়ারিং যেন না থাকে–
আমার কথাটা—
আবার ওই কদর্য কথা?
.
মেমসাব।
কী হয়েছে, রামলোচন? অমন করছ কেন? সাব কোথায়?
হাসপাতালে?
আবার অ্যাকসিডেন্ট? কে ড্রাইভ করছিল?
সাব নিজেই। আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে—
চল যাই।
মেমসাব।
অমন করে চেয়ে আছ কেন? কী হয়েছে, রামলোচন? কী হয়েছে? বল কী হয়েছে?
সাব আর বেঁচে নেই।
চল্লিশেই জীবন ফুরিয়ে গেল জীবনযুদ্ধে জয়ী রমেশের নতুন করে নতুন জীবন শুরু করার আগেই।
কৌতূহলী অদৃষ্ট কি সরে গেলেন?
তাই কি হয়? ললিতার অদৃষ্ট লিখন ফলিয়ে যেতে হবে না?
.
সেক্রেটারিবাবু এসেছেন মেমসাব।
ভেতরে নিয়ে এসো।আসুন মিঃ চৌধুরী। সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই–অফিসে সেটা সম্ভব নয়। এই একবছর বিজনেস চালিয়েছি আপনার সাহায্য নিয়েই নইলে পারতাম না।
এটা আপনার বিনয়, মিসেস দত্ত। মিস্টার দত্তর চাইতে আপনি কোনও অংশে কম যান না, তা হাতেনাতে দেখিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু এখন আমি ক্লান্ত। খুব একা। আপনি রমেশের বন্ধু। আমারও। তাই আপনার কাছেই মন খুলে কথা বলা যায়। আপনি জানেন নিশ্চয়, রমেশের মৃত্যুর পর আমার কাছে বিয়ের অফার পাঠিয়েছিল অনেকে?
জানি। আবার বিয়ের বয়স তো আপনার পেরিয়ে যায়নি। যৌবনকেও, এক্সকিউজ মি ফর মাই ফ্র্যাঙ্কনেস, আপনি টিকিয়ে রেখেছেন। নিঃসঙ্গতা একটা অভিশাপ তা সত্ত্বেও ফিরিয়ে দিয়েছেন সবাইকে।
কারণ, একলা থাকাটাই আমার সয়ে গেছে। রমেশের জায়গায় আর কারও আসার দরকার নেই। যাক সে কথা, আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি একটা বড় রকমের সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য।
বলুন।
আমি কারবার বেচে দেব। আপনি খদ্দের দেখুন।
সেকী! চালু কারবার, এত গুডউইল–
ভালো দর এখনই পাওয়া যাবে। অনেক ভেবে এই ডিসিশন নিয়েছি আমি। এর আর নড়চড় হবে না। আপনি ব্যবস্থা করুন।
বেশ তাই হোক।
.
মিসেস দত্ত, বিজনেস তো বিক্রি করে দিলেন, বাড়িটাকে দুভাগ করছেন কেন?
ভাড়াটে বসাব বলে।
ভাড়াটে! টাকার অভাব তো আপনার নেই।
মিঃ চৌধুরী, আপনি সেদিন বলে গেছিলেন না নিঃসঙ্গতা একটা অভিশাপ? হাড়ে হাড়ে তা ফিল করছি। আপনি বন্ধু মানুষ। সবই জানেন। কফি পার্টি, কিটি ক্লাব, মিক্সড ক্লাব, সোস্যাল সারভিস, লাইব্রেরি-বই–কোনও কিছুই আমার এই ফাঁকা জীবনটাকে ভরিয়ে তুলতে পারছে না। বিজ্ঞাপন লাইনেও কিছুদিন মন ঠেলে দিলাম–মন ভরল না। তাই–
ভাড়াটে বসাবেন। কিন্তু যেচে উৎপাতকে ডেকে আনা হবে না?
বিজ্ঞাপনের জবাব এসেছে অনেক। উৎপাতের ভয়ে কাউকে বেছে নিতে পারছি না। আপনার পরামর্শ চাই সেই কারণেই। কীরকম ভাড়াটে হলে উৎপাত থাকবে না, অথচ নিঃসঙ্গতা ঘুচবে– বলতে পারেন?
নিতান্তই যদি ভাড়াটে বসাতে চান কথাবার্তা বলে নিঃসঙ্গতা ঘুচোনোর জন্যে, তাহলে বলব রিটায়ারড ফ্যামিলি রাখুন। এমন ফ্যামিলি যাদের ছেলেপুলে নেই।
ঠিক বলেছেন। এরকম একটা ফ্যামিলি নিজেই এসেছিল সেদিন। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস মালকানি। ননবেঙ্গলি কিন্তু অত্যন্ত ভদ্র। নিঃসন্তান।
মালকানি। মিসেস কি খুব মোটা? দেখতে শুনতে মোটেই ভালো নয়।
আপনি চেনেন?
খুব ভালোভাবে চিনি। সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের বড় অফিসার ছিলেন। আমাদের অনেক অর্ডার পাইয়ে দিয়েছেন। কিন্তু–
কীসের কিন্তু—
ওঁর স্ত্রী সম্বন্ধে অনেক রকম কথা শুনেছি তো!
কীরকম কথা বলুন তো?
মিসেস মালকানির ছেলেপুলে না হওয়ার কারণটা আপনাদের ক্ষেত্রে যা হয়েছে, ঠিক তার উলটো। কিছু মনে করবেন না খোলাখুলি কথা বলছি বলে।
না, না, বলুন আপনি। সবই জানা দরকার।
তাহলে আরও কিছু জানিয়ে রাখি। যেহেতু রাবেয়া মালকানির গর্ভে কোনওদিনই সন্তান আসবে না তাই…
বলুন?
তাই উনি একটু উচ্ছঙ্খল প্রকৃতির। মানে…
থাক, কারওর চাহিদা বেশি থাকে। রাবেয়া যে পন্থায় সুখে থাকতে চায়, তাতে আমার অসুখী হওয়ার কোনও কারণ নেই। মিঃ মালকানি লোক কীরকম?
অত্যন্ত অনেস্ট। ক্লাব নিয়েই সময় কাটিয়ে দেন। নিষ্কলঙ্ক চরিত্র।
তাহলে এই ফ্যামিলিকেই ভাড়া দেব। আপনার হেল্প পাব তো?
চিরকাল পাবেন।
.
কিন্তু এমন সব ঘটনা ঘটতে লাগল মালকানি দম্পতিকে বাড়ি ভাড়া দেওয়ার পর থেকে যে বিশেষ সেই ঘটনাগুলো মস্ত প্রহেলিকা হয়ে দাঁড়াল রমেশের প্রিয় বন্ধু বিপুল চৌধুরীর কাছে।
ললিতা যে বড় একা, এই কথা শোনার পর থেকেই বিপুল চৌধুরী প্রায় আসত তার কাছে। কোম্পানির মালিক এখন অন্য ব্যক্তি, কিন্তু ললিতার সঙ্গে বন্ধুত্বে ছেদ পড়েনি। সময় পেলেই সন্ধে নাগাদ এসে চা-কফি খেত আর গল্প করত।
একদিন বললে ললিতা, মিঃ চৌধুরী, আপনি ভূত মানেন?
হেসে বললে বিপুল চৌধুরী, একেবারেই না।
কিন্তু আমি ইদানীং প্রায় রাতে ছায়ার মতো কাকে যেন ঘুরতে দেখি আমার ঘরে। আলো জ্বাললেই আর তাকে দেখতে পাই না। দরজাও দেখি বন্ধ রয়েছে ভেতর থেকে।
আপনার মনের ভুল। এক কাজ করতে পারেন।
কী?
আপনার মেড সারভেন্টটার কী যেন নাম?
মেরী। কেন বলুন তো?
ওকে এনে ঘরে শোয়াতে পারেন। হাসছেন কেন?
মেরীর চরিত্রটা আপনি জানেন না বলে। সন্ধের পর ওর ঘরে নাগর আসে–থাকে তো সারভেন্ট কোয়ার্টারে। সব্বাই জানে।
রাত্রে?
প্রায় সারা রাত চলে এই কাণ্ড। হাড় জ্বালিয়ে খেল আমার। মালকানিদের ওই যে ছোকরা চাকরটা আছে। দেখেছেন তো?
মাসুদ?
হ্যাঁ। মেরীর নাগর।
আপনি কিছু বলেন না?
বলে কোনও লাভ নেই। কারণ, রাবেয়া সম্বন্ধে আপনি যা বলেছিলেন, তা অক্ষরে-অক্ষরে সত্যি। তবে রুচিটা যে এত নীচে নামতে পারে, সেটাই ভাবা যায় না। মাসুদ শুধু মেরীর নয়…রাবেয়ারও।
বলছেন কি!
এ বাড়ির সব্বাই জানে। মিঃ মালকানিই বোধহয় জানেন না।
জানেন নিশ্চয়। কিছু করার নেই বলেই ক্লাব নিয়ে পড়ে থাকেন। আচ্ছা, একটা কথা জিগ্যেস করব?
আপনি যে ছায়ামূর্তিকে মাঝে-মাঝে ঘরের মধ্যে দেখেন, তাকে দেখতে কীরকম বলুন তো?
স্পষ্ট দেখতে পাই না। তবে খুব মোটা।
অনেকটা রাবেয়ার মতো দেখতে কী?
রাবেয়ার মতো..তা…হ্যাঁ…প্রায়ই তাই। কিন্তু রাবেয়া আসবে কী করে বন্ধ ঘরে?
আসে ওর সূক্ষ্ম শরীর!
সূক্ষ্ম শরীর! কী বলছেন বুঝছি না।
রাবেয়া মালকানির এই অলৌকিক ক্ষমতাটার কথা আগে আপনাকে বলিনি বিশ্বাস করবেন বলে। কোনও ভাড়াবাড়িতেই টিকতে পারেনি এই কারণেই। সূক্ষ্ম শরীরে রাত্রে অন্যের ঘরে গিয়ে সেক্স দেখা ওর একটা অত্যন্ত কদর্য অভ্যেস।
অসম্ভব।
এ ক্ষমতা অনেকেরই আছে, মিসেস দত্ত। রাবেয়ারও আছে। কিন্তু আপনি একা থাকেন, আপনার ঘরে রাত্রে ঘুরঘুর করে কেন সূক্ষ্ম শরীরে–এটাই একটা রহস্য।
নিন, নিন, কফি খানসারাদিন খেটে মাথা গরম হয়েছে আপনার।
সেইদিন রাত্রেই খুন হয়ে গেল ললিতা।
.
ভোরবেলা দুধের লাইন দিয়ে বোতল নিয়ে এসে ললিতাকে ডেকে তোলা মণিরামের বিশ বছরের অভ্যেস। সেদিন হাঁকডাক দরজায় ধাক্কা মেরেও কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে ঠেলে খুলেছিল পাল্লা।
পরক্ষণেই তার বিকট চিৎকারে চমকে উঠেছিল বাড়ির সকলে। ছুটতে ছুটতে এসে দেখেছিল, খাটে পড়ে ললিতার নগ্ন দেহ। ব্রা পড়ে আছে মেঝেতে। ব্লাউজটা ঠেসে ঢোকানো মুখে। সায়ার দড়ি দিয়ে হাত আর পা বাঁধা।
ঘর লণ্ডভণ্ড। দেরাজ তছনছ। স্টিল আলমারি খোলা–ভেতরকার সিক্রেট চেম্বার থেকে জড়োয়া গয়নার বাক্স উধাও। এমনকী ললিতার কান থেকে হিরের দুল আর টেবিল থেকে সোনার হাতঘড়িও নিপাত্তা।
পুলিশ এল। ঘণ্টাচারেক লাগল সবাইকে জেরা করতে, হারানো জিনিসপত্রের ফর্দ বানাতে, মৃতদেহের ফটো নিতে, নানা জায়গায় পাউডার ছড়িয়ে আঙুলের ছাপ তুলতে এবং কিছু বস্তু ফোরেনসিক পরীক্ষার জন্যে বাছাই করতে। সবশেষে মৃতদেহ মুড়ে পাঠিয়ে দেওয়া হল পোস্টমর্টেম করার জন্যে।
জেরার ফলে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু জানা গেল না। মণিরাম আর মাসুদ দুজনেই একসঙ্গে রোজ ভোরবেলা দুধের লাইন দেয়। সেদিন মণিরাম একাই দুধ এনেছে। তার চিৎকার শুনে মিঃ মালকানি দৌড়ে এসেছেন। একটু পরে এসেছেন রাবেয়া। রাত একটায় ক্লাব থেকে ফিরেছিলেন মিস্টার মালকানি। বাড়ি ফিরেই অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম ভাঙে মণিরামের চিৎকারে। রাবেয়া তখন ছিল রান্নাঘরে। মাসুদ যে সেদিন দুধ আনতে যায়নি, একথা জানা গেল মণিরামের কাছেই। তার আগে পর্যন্ত রাবেয়া মালকানি কেন বলল না মাসুদ দুধ এনে দেয়নি রোজ সকালের মতো– ভেবে পেল না অফিসার। সে যে বাড়িতেই নেই, একথাটাও প্রকাশ পেল পুলিশ অফিসার যখন তাকে ডেকে পাঠাল জেরা করার জন্যে। মেরীকে জেরা করে জানা গেল সে গেছিল নাইট শোতে সিনেমা দেখতে।
মাসুদকে আর পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি জহরতের বাক্স।
একটা রহস্যই কেবল ধাঁধা হয়ে রইল অফিসারের কাছে। জহরতের বাক্স যে গোপন চেম্বারে থাকত, সেটা খোলবার বিশেষ তালাটার সংখ্যাগুলো ললিতা ছাড়া কেউ জানত না। তা সত্ত্বেও তালা খুলল কে?
ললিতা নিজে নয়তো? ফোরেনসিক রিপোর্টেও প্রকাশ পেল, মৃত্যুর আগে সহবাস করেছিল। ললিতা। কার সঙ্গে?
তারপর তার হাত-পা সায়ার দড়ি দিয়ে বেঁধে, মুখে ব্লাউজ ঢুকিয়ে, মারা হয়েছে গলা টিপে। মাসুদের হাতে জহরতের বাক্স তুলে দেওয়ার পরই কি মৃত্যু এসেছিল এইভাবে?
বিপুল চৌধুরী সবই জানল যথাসময়ে। বুঝলও অনেক কিছু। কিন্তু মুখ খুলল না।
কাহিনি শেষ করে আবার চাপাগলায় ফিসফিস করে সেই গানটা গেয়ে উঠল পাগলটা, তারা আসছে…তারা আসছে..রোজ রাতে তারা আসছে..আসছে..আসছে…। …রাতের অন্ধকারে হুহু হাওয়ায় বুকফাটা হাহাকারের মতো শব্দগুলো ভেসে গেল বাতাসে।
ইন্দ্রনাথ বললে, জহরতের বাক্সর তালা খোলার সিক্রেট নাম্বার জেনেছিল রাবেয়া সূক্ষ্ম শরীরে রোজ রাতে ঘরে আসত ওই জন্যেই।
ঠিক কথা। বললে পাগলটা।
মাসুদের কাছে রাবেয়াই জানিয়ে দিয়েছিল সিক্রেট নাম্বারটা।
তাও ঠিক।
ললিতাকে আগে খুন করেছিল মাসুদ–পরে ধর্ষণ করেছিল ব্যাপারটাকে কদর্যভাবে সাজানোর জন্যে। ফোরেনসিক রিপোর্টেও নিশ্চয় তা প্রকাশ পেয়েছে।
পেয়েছিল। খুনিকে ধরতে না পেরে অফিসার তা চেপে গেছিল।
কিন্তু মাসুদ, কারা আসছে রোজ রাতে তোমার কাছে…তা তো বললে না?
রাবেয়ার সূক্ষ্ম শরীর–এখনও সে চায় আমাকে। জহরতের বখরা পেয়েও খুশি নয়।
আর একজন?
লিলিতার প্রেতাত্মা।
কেন?
চোখে চোখ চাইল মাসুদ। অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করছে দুই চোখ।
কেন? কেন? কেন? আমি নিজেই জানি না কেন? কী চায় সে? জহরত ফেরত চায় না– তবে? রাবেয়া যা চায়, তাই কি? চোখেমুখে তাই কি অমন মিনতি ফুটিয়ে তোলে? কিন্তু কেন? কেন? কেন? সব তো শেষ হয়ে গেছে–আবার কেন চাই সেই কদাকার–
উঠে দাঁড়াল মাসুদ। আস্তে-আস্তে দূর হতে দূরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল তার মূর্তি। চাপাগলায় গানটা কিন্তু লেগে রইল ইন্দ্রনাথের কানে।
তারা আসছে…তারা আসছে…রোজ রাতে তারা আসছে…আসছে…আসছে…।
*পরিবর্তন পত্রিকায় প্রকাশিত (শারদীয় সংখ্যা)।