কথা
অর্কর বাঁ দিকের বুকের কাছটা কেঁপে উঠল। প্রথমে অল্প, তারপর মাঝারি ধরনের দু’বার ঝাঁকুনি দিয়ে থমকে দাঁড়াল। অর্ক বুকে হাত দিয়ে মুখ তুলে তাকাল। কেউ বুঝতে পারেনি তো? পারলে সর্বনাশ। তবে মনে হয় না পেরেছে। সারি সারি টেবিলে কাজ চলছে নিঃশব্দে।
ছাব্বিশ বছরের তরতাজা যুবকের বুক কাঁপা ভাল লক্ষণ নয়। দুশ্চিন্তা হয়। হার্টের কিছু হল না তো? তবে অর্কর দুশ্চিন্তা হল না, তার হল বিরক্তি। বিরক্তিতে তার ভুরু দুটো কুঁচকে গেল। কারণ, এই কম্পন হার্টের নয়, কম্পন তার মোবাইল ফোনের। শার্টের পকেটে ফোন রাখা আছে ভাইব্রেট মোডে। ফোন এলে আওয়াজ হয় না, শুধু কাঁপে। এই সময় কেঁপে ওঠার অর্থ উৎসা তাকে ফোন করছে। এখন একবার করে থেমেছে, উত্তর না দিলে বারবার করতে থাকবে। এটাই তার স্বভাব। জবাব না পাওয়া পর্যন্ত ঘনঘন ফোন করে। মনে হয়, বড় ধরনের কোনও বিপদে পড়েছে।
অথচ আজও অর্ক বেরোনোর সময় স্ত্রীকে পইপই করে বলে এসেছিল, ‘আমাকে ফোন করবে না, উৎসা।’
উৎসা সোফায় পা গুটিয়ে বসে পত্রিকা পড়ছিল। সাজগোজের পত্রিকা। বিয়ের পর থেকে গত সাত মাস প্রতিদিন সকালেই সে অনেকটা সময় মনোযোগ দিয়ে সাজগোজের পত্রিকা পড়ে। এক-এক দিন এক-একটা বিষয়। কোনওদিন চুল, কোনওদিন হাত, কোনওদিন ঠোঁট। আজ পড়ছিল চোখের পাতা। চোখের পাতা কীভাবে দীর্ঘক্ষণ ভেজা ভেজা রাখা যায় তার পরামর্শ। যিনি পরামর্শ দিয়েছেন তিনি রসিকমানুষ। লেখার শুরুতেই বলেছেন, ‘মেয়েদের চোখ ভেজা রাখার সহজ ও শর্টকাট উপায় হল কান্না। কাঁদলে আপনার চোখ থাকবে গভীর, নরম আর মায়াময়। মনে রাখবেন, লজ্জা যেমন নারীর ভূষণ, কান্না তেমন নারী-চোখের অলংকার। এই সহজ কাজটাও যাঁরা পারবেন না তাঁদের জন্য বলি…।’
স্বামীর কথা শুনে উৎসা পত্রিকা থেকে মুখ তুলে বলল, ‘কেন? ফোন করব না কেন?’
অর্ক শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল, ‘আমাদের এখানে মোবাইল অ্যালাউড নয়। বাইরে জমা রেখে ঢুকতে হয়।’
উৎসা ফিক করে হেসে বলল, ‘কেন, অ্যালাউড নয় কেন? এটা কি স্কুল?’
রেগে যেতে গিয়েও অর্ক নিজেকে সামলায়। বিয়ের এত অল্প দিনের মধ্যে স্ত্রীর ওপর রেগে যাওয়া ঠিক নয়। তবে বেশি দিন পরেও সে উৎসার ওপর রাগতে পারবে না। কারণ, উৎসা শুধু সুন্দরী নয়, সে একজন নরম স্বভাবের মেয়ে। নরম স্বভাবের মেয়ের ওপর রাগ করা কঠিন। অর্ক শান্ত গলায় বলল, ‘না, স্কুল নয় উৎসা, ল্যাবরেটরি। আর সেই ল্যাবরেটরিতে আমাদের কাজ হল শব্দ নিয়ে। সাউন্ড। এই সময় বাইরের অন্য সাউন্ড ঠিক নয়। তোমাকে তো কথাটা বলেছি।’
রাত্রিবাসের ওপর ড্রেসিংগাউন জড়িয়ে আছে উৎসা। ভারী সুন্দর গাউন। এই ধরনের সুন্দর পোশাকের মজা হল, এরা যেমন শরীর ঢাকতে পারে, তেমন দেখাতেও পারে। সরাসরি দেখায় না, ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেয়। উৎসার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তার মেদহীন পাতলা শরীরের সব ক’টা চড়াই-উতরাই বোঝা যাচ্ছে। অর্ক চোখ সরিয়ে নিল। এই শরীর তাকে যে কত বার বিপদে ফেলেছে। ইতিমধ্যেই তার তিন দিন লেট হয়ে গেছে। অফিসের গাড়ি এসে নীচে হর্ন বাজিয়েছে, তবু অর্ক জুতো টাই খুলেছে। স্বামীর আদরে উৎসা কখনও ‘না’ বলে না। তবে জুতো টাই পরে খাটে উঠতে দেবে না কিছুতেই।
উৎসা একটা হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙল। বলল, ‘কাল তো আমার ফোন ধরেছিলে, আজ কেন পারবে না?’
‘কাল আমি একটা অন্যায় কাজ করেছিলাম উৎসা। মোবাইলটাকে লুকিয়ে শার্টের পকেটে রেখেছিলাম। ভাইব্রেট মোড়ে। তুমি কল করতে বেরিয়ে বাথরুমে চলে যাই।’
উৎসা হিরের মতো উজ্জ্বল দাঁতের সারি সাজিয়ে হাসল। বলল, ‘আজও তাই করবে। বাথরুমে চলে যাবে। তারপর আমরা দু’জনে গল্প করব। খুব ইন্টারেস্টিং হবে। আমি বেডরুমে তুমি বাথরুমে। বেডরুম টু বাথরুম কথা হবে।’
উৎসার এই উচ্ছলতা চমৎকার। অর্কর কানে বাজে সারাক্ষণ। এমনকী রাতে ঘুমের মধ্যেও বাজে। তবু অর্ক গম্ভীর হওয়ার ভান করল। বলল, ‘অন্যায় কাজ রোজ করা যায় না।’
উৎসা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আদুরে গলায় বলল, ‘আমার সঙ্গে গল্প করাটা তুমি অন্যায় কাজ বলছ?’
অর্ক হাত ছড়িয়ে বলল, ‘উফ, গল্প করাটা অন্যায় বলিনি, ল্যাবরেটরিতে মোবাইল নিয়ে টোকাটাকে অনায় বলেছি। তা ছাড়া ওখানে যে-কোনও ধরনের সাউন্ড ওয়েভ চট করে ধরা পড়ে যায়। আমার মোবাইলের ভাইব্রেশনই বলো, তোমার কথাই বলো। ‘কথা ধরার মেশিন আছে আমাদের।’
উৎসা তার বড় বড় ছেলেমানুষি চোখ দুটো আরও বড় করে বলল, ‘কথা ধরা! তোমরা কি ফোন ট্যাপ করো? বাপ রে!’
অর্ক হেসে ফেলল। বলল, না, না, ফোন ট্যাপ করব কেন? আমাদের কাজটা তার থেকেও অনেক কমপ্লিকেটেড, জটিল। জট পাকানো কথার জট খুলি আমরা।’
উৎসা কৌতুকভরা চোখে বলল, ‘ওমা! হাউ ফানি! সে আবার কী! কথা আবার জট পাকায় কী গো? কথা কি মাথার চুল, যে সাবান, শ্যাম্পু দিয়ে জট ছাড়াবে?’
নীচ থেকে গাড়ির হর্ন ভেসে আসে। অফিসের গাড়ি একটা বিচ্ছিরি জিনিস। তার সময়ে চলতে হয়। অর্কর মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে অফিসের গাড়ি বাদ দিয়ে নিজের গাড়ি নিয়ে বেরোয়। সেটা সম্ভব নয়। বিয়ের পর থেকে ওই গাড়ি উৎসার। তার বাপের বাড়ি, শপিং মল, বান্ধবীদের সঙ্গে সিনেমা যাওয়া আছে।
তবে প্রোগ্রাম আগে থেকে কিছু ঠিক থাকে না। উৎসার মতে হুটহাট বেরোনোয় আসল মজা। শপিংও তখন অ্যাডভেঞ্চারের মতো মনে হয়। অর্ক দ্রুত হাতে জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে বলে, ‘জটের গল্প তোমাকে ফিরে এসে বুঝিয়ে বলব উৎসা। এখন চলি, গাড়ি ডাকছে। আজ আর ফোন কোরো না ডার্লিং। আমি কিন্তু ফোন নিয়ে ল্যাবে ঢুকছি না, এ বলে গেলাম।’
কিছু মেয়ের সৌন্দর্য হয় নদীর মতো তরতরে। কিছু মেয়ের সৌন্দর্য দিঘির মতো শান্ত। উৎসার সৌন্দর্য হল সমুদ্রের সৌন্দর্য। সে শরীরে নানা ধরনের ঢেউ তুলতে জানে। এখনও তুলল। বুকে পেটে তরঙ্গ তুলে উঠে দাঁড়াল। স্বামীর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে বলল, ‘ফ্ল্যাটে একা থাকি। দুপুরে যদি দস্যু আসে? এসে আমাকে মুখ বেঁধে… হি হি। তা হলেও ফোন করব না?’
অর্ক ভেবেছিল, সত্যি মোবাইলটা বাইরে জমা রেখে ল্যাবরেটরিতে ঢুকবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে উৎসার কল্পিত ‘দস্যু’র কথা মনে পড়ে গেল। ছেলেমানুষির মনে পড়া। তবু পড়ল। বিয়ের পর পর ছেলেমানুষি বেশ লাগে। সে ভাইব্রেট মোড চালু করে মোবাইল লুকোল বুক পকেটে। অ্যাপ্রন পরল। শুধু অ্যাপ্রন নয়, এখানে হাতে রবারের স্বচ্ছ গ্লাভস পরতে হয়। নাক, মুখ ঢাকতে হয় কাপড়ে। মাথায় টুপির মতো প্লাস্টিক কভার। হঠাৎ দেখলে মনে হবে অপারেশন থিয়েটারের সার্জেন। ঘটনা যদিও তা নয়। ঘরের টেবিলগুলোতে নানা ধরনের আধুনিক আর জটিল যন্ত্রপাতি সাজানো। ল্যাপটপ, সাউন্ড বক্স, হেড ফোন, সাউন্ড এডিটিং সিস্টেম থেকে শুরু করে অচেনা, অজানা অনেক কিছু। প্রথম দিন এসে অর্কর মতো ছেলেও ঘাবড়ে গিয়েছিল।
শুধু যন্ত্র নয়, কাজও ঘাবড়ে দেওয়ার মতো। গত মাসে কোম্পানির নতুন রিসার্চ উইং-এ যখন তাকে বদলি করা হয়, অর্ক বেশ অবাকই হয়েছিল। প্রফেসর সোহম তালুকদার তাকে অ্যাসাইনমেন্ট বুঝিয়ে বললেন। অর্ক অবাক হয়ে বলল, ‘বলেন কী স্যর! এরকমও হয়!’
প্রফেসর তালুকদার মৃদু হেসে বললেন, ‘আগে হত না। সমস্যাটা ছিল শুধু বিদেশের। এখন আমাদের এখানেও হচ্ছে।’
সোহম তালুকদার শিক্ষিত মানুষ। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু বছর পড়ে এবং পড়িয়ে দেশে ফিরেছেন। শব্দের প্রকৃতি এবং রহস্য নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে তাঁর। এখানে এসে উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিয়েছেন নামকরা কর্পোরেট হাউসে। তারাও মাথায় করে রেখেছে। তাঁর কথা মতো বিপুল খরচ করে ল্যাবরেটরি তৈরি করে দিয়েছে।
অর্ক অবাক গলায় বলল, ‘এখানে কেন এই সমস্যা শুরু হল স্যার?’
সোহম তালুকদার বললেন, ‘কেন হল এখনও ধরা যায়নি। ধরার চেষ্টা চলছে। সম্ভবত কথা বেড়ে যাওয়ার কারণে এই সমস্যা।’
‘কথা বেড়ে গেছে!’
পক্ককেশের সৌম্যদর্শন সোহম অল্প হাসলেন। বললেন, ‘বাঃ, বাড়েনি? পথে, বাসে, ট্রামে, গাড়িতে, বাড়িতে দেখছি শুধু কথা আর কথা। হাতে হাতে মোবাইল। বিরামহীন, অন্তহীন কথা চলছে তো চলছেই। যদি গোনা যেত তা হলে হয়তো দেখতে সেকেন্ডে কথার সংখ্যা কয়েক কোটি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ক’বছর আগেও এই দৃশ্য দেখা যেত না। বাতাসের যে তরঙ্গগুলো দিয়ে কথারা যাতায়াত করছে তাদেরও তো একটা ক্ষমতা আছে। খুব সহজ ভাবেই ধরো না, একটা রাস্তায় যদি হঠাৎ গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যায়, তখন তো ট্রাফিক জ্যাম হবেই। এখানেও তাই হচ্ছে। কথারা জট পাকিয়ে যাচ্ছে। আমরা এ প্রান্তে যা বলছি, সবটা অন্য প্রান্তে যাচ্ছে না। মাঝখানে জট পাকিয়ে থাকছে।’
‘জট পাকিয়ে থাকছে!’ অর্কর বিস্ময় বাড়তে থাকে।
‘থাকবে না? একটা ওয়েভ, আর একটার ঘাড়ে চেপে বসেছে। আমরা বাইরে থেকে বুঝতে পারছি না। যে শুনছে সে ভাবছে সবটাই শুনলাম, আবার উলটো দিকেও এক কাণ্ড। যে বলছে, সে-ও ভাবছে সবটা বলতে পেরেছি। মাঝপথের খবর কে রাখে? আমাদের চেষ্টা হবে মাঝপথের এই জটগুলো খুঁজে বের করা এবং সেগুলো খোলা।’
অর্ক খানিকটা ঘোরের মধ্যে বলে, ‘এটা কি সম্ভব স্যর?’
‘জানি না, তবে চেষ্টা করতে হবে। প্রথম পর্যায় আমরা অ্যান্টেনা দিয়ে জট পাকানো শব্দ তরঙ্গগুলোকে ধরতে চেষ্টা করব। সেগুলো আলাদা করে আবার ছেড়ে দেওয়া যায় কি না, সেটা পরের চিন্তা। আগে তো জট ছাড়াই।’
অর্ক নিজের মনেই বলল, ‘ইন্টারেস্টিং। হাইলি ইন্টারেস্টিং।’
প্রফেসর তালুকদার বললেন, ‘পৃথিবীর অনেক দেশেই এটা নিয়ে কাজ চলছে। এখানে এটাই প্রথম। যেহেতু কাজটা অন্যের কথা নিয়ে, তাই সকলেই বিষয়টা গোপন রাখে। নেটে বা জার্নাল ঘাঁটলে পাবে না। আমরাও গোপন রাখব। বাইরে থেকে যন্ত্র আনিয়েছি, সফটওয়্যার আনিয়েছি। কথা ছাড়ানোর সফটওয়্যার। অর্ক, তোমার ফাইল খুলে দেখলাম, তুমি ফিজিক্সের স্টুডেন্ট ছিলে। রেজাল্টও খুব ভাল। আমার ইচ্ছে, তুমি ম্যানেজমেন্ট ছেড়ে এই কাজে শিফট করো।’
অর্ক সোজা হয়ে বসে বলল, ‘অবশ্যই করব স্যার। এরকম একটা কাজে থাকব না? আমার স্যার ম্যানেজমেন্টের থেকে ফিজিক্সেই বেশি ইন্টারেস্ট। নেহাত কেরিয়ার…।’
ভারী হেডফোনটা কানে ঠিক করে নিয়ে অর্ক টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ল। ল্যাপটপে হাত দিয়ে প্রোগ্রাম চালু করল। পরদায় ভেসে উঠল ছায়ার মতো আবছা কালো একটা পিণ্ড। উলের বল যেন! উলগুলো একটা আর একটার ঘাড়ে চেপে, জড়িয়ে পেঁচিয়ে আছে। ছায়ার বলটা পরদায় অল্প অল্প কাঁপছে। ‘সাউন্ড’অপশনে গিয়ে দু’বার মাউস ক্লিক করতেই অর্কর হেডফোনে হট্টগোল শুরু হয়। হাজার কথা জড়িয়ে থাকার হট্টগোল। বাজারের মতো। কোনও কথাই আলাদা করে বোঝার উপায় নেই। সবাই নিজের মতো আলাদা হতে চাইছে, পারছে না। না পেরে জালে জড়িয়ে পড়া জন্তুর মতো ছটফট করছে।
বুকের কাছে আবার কাঁপুনি। মুহূর্তের জন্য অর্ক ভেবেছিল পকেটে হাত দিয়ে ফোনের সুইচ বন্ধ করে দেবে। ‘দস্যু’র কথা মনে পড়ল। সত্যি তো ফ্ল্যাটে মেয়েটা একা থাকে। আজকাল খবরের কাগজে রোজই কিছু না কিছু বেরোচ্ছে। চুরি, ডাকাতি, মুখ বেঁধে ধর্ষণ। হেডফোন টেবিলের ওপর খুলে রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল অর্ক। পাশের টেবিলের রঞ্জন মুখ তুলে তাকাল। অর্ক বাঁ হাত তুলে কড়ে আঙুল দেখায়। বাথরুম। কাচের দরজা ঠেলে ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে সরে আসে করিডরের আড়ালে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে নম্বর টেপে।
‘কী হয়েছে উৎসা?’
‘অনেক কিছু হয়েছে, তোমার জন্য মন কেমন হয়েছে।’
উৎসার হাসি ও কথায় স্বস্তি পেল অর্ক। যাক বাবা, সব ঠিক আছে। তবু বানানো বিরক্ত গলায় সে বলল, ‘উফ তোমাকে এত করে বললাম না ফোন করবে না? তার পরেও…।’
উৎসা বিরক্তি গ্রাহ্য করল না। হাসি হাসি গলায় বলল, ‘অ্যাই, আজ কী কী কথার জট ছাড়ালে গো?’
অর্ক বুঝতে পারল উৎসার সঙ্গে কথা বলতে তার খারাপ লাগছে না, বরং ভালই লাগছে। সে গলা নামিয়ে বলল, ‘এগুলো গোপন বিষয়। একজনের কথা অন্য কাউকে বলা যায়? ছিঃ। আমাদের কাজের এথিক্স আছে, প্রফেসর রাগ করবেন।’
‘আমি কি অন্য কেউ?’ উৎসার গলায় অভিমান। মনে হচ্ছে এখুনি কেঁদে ফেলবে।
অর্ক তাড়াতাড়ি বলল, ‘যা বাবাঃ, আমি কি সে কথা বলেছি? দেখো কাণ্ড! তুমি অন্য হতে যাবে কেন?’
‘যাও, কিচ্ছু বলতে হবে না, অন্যের কথা নয়, নিজের কথা নয়, কিচ্ছু নয়।’
অর্ক আরও সরে আসে। কাচে ঢাকা বিশাল জানলার সামনে দাঁড়ায়। দশ তলা নীচে সেক্টর ফাইভের পিচের রাস্তা দুপুরের রোদে লিকলিকে চাবুকের মতো এঁকেবেঁকে পড়ে আছে। গাড়ি ছুটছে, মানুষ ছুটছে। এত ওপর থেকে শুধু দৃশ্য আছে, গতি আছে, শব্দ নেই। যেন সায়লেন্ট মুভি। স্ত্রীর হাসিতে স্বস্তি পেয়েছিল, অভিমানে গর্ব বোধ হল অর্কর— যতই হোক অভিমান তো তার ওপরই। সে হেসে ফিসফিস করে বলল, ‘ঠিক আছে বাবা বলছি বলছি। অমন দুমদাম রাগ করো কেন উৎসা? তুমি রাগলে সারাদিন কাজ করব কী করে বলো তো?’
উৎসা গলা থেকে অভিমান সরিয়ে বলল, ‘ভুল করবে। শাস্তি হবে, বেশ হবে।’
‘সকাল থেকে এখন পর্যন্ত একটা জট খুলেছি। এমন কিছু নয়, সাধারণ কথা সব। ছেলে, মেয়ে, ধেড়ে বুড়ো সবার গলাই আছে। যেমন ধরো, আজ যেতে পারলাম না দাদা, অফিসে আটকে পড়েছি ভাই, বাজার করে ফিরবে গো, পলিটিকাল সায়েন্সের নোটস আনবি কিন্তু। আরও আছে। শেয়ার মার্কেটের বিড, মাল্টিপ্লেক্সের টিকিট বুকিং, নেতাদের হুমকি, লেট করার জন্য বসের ধ্যাতানি, রাজ্যের হাবিজাবি।’
উৎসা নিচু গলায় বলল, ‘অ্যাই, প্রেমের কথা কিছু পেয়েছ?’
অর্ক করিডরের দিকে তাকিয়ে, ডান হাত দিয়ে মোবাইল ঢাকল। হেসে বলল, ‘আজ নয়, কাল পেয়েছি। তবে কথা নয়, ওনলি আওয়াজ। চুমুর আওয়াজ। এইরকম…। এখন ছাড়লাম। আর নয়। বস আসছে এদিকে।’
উৎসাকে কিছু বলতে না দিয়ে হাসতে হাসতে ফোনের সুইচ বন্ধ করল অর্ক। খুব মজা হয়েছে একটা। হাসতে হাসতেই ফিরে গেল সে নিজের টেবিলে। সত্যি কি প্রেমের কিছু পাওয়া যাবে না? পেলে বেশ হয়। ফিরে গিয়ে উৎসাকে জমিয়ে গল্প করা যাবে। বিয়ের পর সন্ধেবেলা বাইরে বেরোনো একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে অর্ক। বন্ধুবান্ধব, ক্লাব, আড্ড—সব। এমনকী কামারডাঙায় বাবার ওখানেও যেতে ইচ্ছে করে না। যাব যাব করেও তিনটে রবিবার যাওয়া হয়নি। ছুটির দিন উৎসাকে ছাড়তে মন চায় না। কথাটা মাথায় আসতে লজ্জা পেল অর্ক। কাপড়ে ঢাকা লাজুক মুখে হেডফোনের ভলিউম বাড়িয়ে দেয় সে। একটা কিছু পেতে হবে। হাবিজাবি নয়, জমজমাট কিছু। পাওয়া কি যাবে?
পাওয়া গেল একেবারে শেষ পর্যায়ে। সন্ধের মুখে মুখে। ল্যাপটপের পরদায় ভেসে বেড়ানো কালো বল তখন জট ছাড়িয়ে ফিকে হয়ে এসেছে। শুধু একটা-দুটো গিঁটে সমস্যা। সেই সমস্যা কাটতে হেডফোনে বেজে উঠল অর্কর। রিনরিনে নারীকণ্ঠ— ‘কখন আসবে? না, না, একটা নয়, দুটো… লাঞ্চের পর আমি ন্যাপ নিই জানো না?… দূর বোকা, ও তখন কোথায়?… ল্যাবরেটরিতে… হি হি… দস্যু একটা… ফাঁকা ফ্ল্যাটে এসে যদি আমার মুখ বেঁধেছ… হি হি…।’
অর্কর বুক কেঁপে উঠল। এই গলা, এই হাসি তার চেনা!
আনন্দবাজার পত্রিকা, রবিবাসরীয় ২ নভেম্বর ২০০৮