দ্বিতীয় খণ্ড (অসম্পূর্ণ)

কথারম্ভ

কথারম্ভ

তাশকন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম ভিত্তিস্থাপন

সোবিয়েৎ ইউনিয়নে বর্তমান উজবেকিস্তান রিপাবলিকের রাজধানী তাশকন্দ শহরে ১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবর তারিখে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম ভিত্তিস্থাপন হয়েছিল। এই কাজের সহিত আমার প্রত্যক্ষ কোনো সংযোগ না থাকলেও পরবর্তী সময়ে এর প্রভাব ভারতের ভিতরে আমার ও আমার সহকর্মীদের উপরে পড়েছিল। আমার কথা তাই আমি এখান থেকেই শুরু করব। যে-ঘটনা আগে ঘটেছিল তার কথা আগেই বলা উচিত।

অনেকেই ভাবেন, কোনো কোনো ঘটনা না ঘটলেই বড় ভালো হতো। হয়তো তাই। কিন্তু ঘটনাগুলি ঘটে যাওয়ার পরে সে-সবের কথা লিখে রাখার কাজ যাঁরা নেন তাঁরা হয়ে পড়েন বড় নিরুপায়। সত্য সত্য যা ঘটেছে তাই শুধু তাঁরা লিখতে পারেন। ভালো লাগা-না-লাগার কথা এখানে ওঠে না, ইতিহাসের মর্যাদা রক্ষা করেই তাঁদের কাজে এগিয়ে যেতে হয়।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ভিত্তি প্রথম ১৯২০ সালে বিদেশে স্থাপিত হয়েছিল এবং এই ভিত্তিস্থাপনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়। পরে ১৯২৯ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের অন্যান্য সংগঠন হতে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। তাঁর এই বহিষ্কারের কথা আমরা পরে আলোচনা করব। তাঁর কাজে বিচ্যুতি না ঘটলে তিনি কখনও বহিষ্কৃত হতেন না। তা সত্ত্বেও, তিনি যে ভারতে কমিউস্টি পার্টি স্থাপনের প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন একথা অস্বীকার করার উপায় আমাদের নেই।

মানবেন্দ্রনাথ রায়ের পরিচয়

মানবেন্দ্রনাথ রায়ের আসল নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তাঁর এই নাম এখন একেবারেই মুছে গেছে, যদিও এই নামেই তিনি এই শতাব্দীর পার্টির সভ্য ছিলেন। এই অনুশীলন পার্টি কিন্তু পরবর্তীকালে ঢাকার অনুশীলন পার্টি নয়। ব্যারিস্টার মিস্টার পি মিত্রের নেতৃত্বে সারা বাঙলার জন্যে, (সারা ভারতের জন্যেও হয়তো বলা চলে প্রথম যে অনুশীলন পার্টি গঠিত হয়েছিল তারই সভ্য ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়। সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা বরাবর অস্ত্রাভাবে ভুগেছেন। তাঁর আত্মকথা হতে আমরা জানতে পারছি যে অস্ত্রের সন্ধানেই তিনি ১৯১৫ সালে তাঁর দলের নেতা যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের নিকট হতে বিদায় নিয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন। জাপানে ও চীনে তিনি ঘুরেছিলেন, তারপরে পৌঁছেছিলেন আমেরিকার কালিফোর্নিয়া স্টেটে। এই স্টেটের পালো আলটে নামক ছোট শহরে স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। তাঁর বিপ্লবী জীবনের সহকর্মী ডাক্তার যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়ের ছোট ভাই, সুবিখ্যাত লেখক ধনগোপাল মুখোপাধ্যায় তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। মনে হয় তাঁরই খোঁজে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এখানে এসেছিলেন। তাঁর আসার কথা কাগজে ছাপা হয়ে গিয়েছিল। তিনি ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবী তো ছিলেনই, সেই হিসাবেই তিনি ভারত জার্মান ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। আমেরিকায়ও পুলিস যে তাঁর খোঁজখবর নিবেন এটা তো জানা কথাই। এই কারণে ধনগোপাল মুখোপাধ্যায় স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই তাঁর নূতন নামকরণ করে দিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য নামটি সেই থেকে চিরকালের জন্য মুছে গেল।

এভেলিন ট্রেটের সহিত মানবেন্দ্রনাথের প্রথম পরিচয়

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যামপাসেই কুমারী এভেলিন ট্রেন্ট (Evelyn Trent) নাম্মী একজন উচ্চশিক্ষিতা (স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গ্রেজুয়েট) আমেরিকান মেয়ের সঙ্গে মানবেন্দ্রনাথের প্রথম পরিচয় হয়। তাঁরা পরস্পরের প্রতি আকৃষ্টও হন। পালো আলটো হতে মানবেন্দ্রনাথ নিউ ইয়র্কের পথে রওয়ানা হয়ে গেলেন। এভেলিনও তাঁর সঙ্গে গেলেন। একটি কথা শুধু ডাক্তার চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তীই[৪] লিখেছেন এবং তাঁর লেখা আরও দু’এজন উদ্ধৃত করেছেন। কথাটা হচ্ছে এই। এভেলিনের পিতা যখন এভেলিনের মানবেন্দ্রনাথের সঙ্গ চলে যাওয়ার খবর পেলেন তখন তিনি অত্যন্ত চটে গিয়ে পুলিসকে এই বলে টেলিগ্রাম করে দিলেন যে মানবেন্দ্রনাথ তাঁর মেয়ে এভেলিনকে ফুসলিয়ে নিয়ে গেছেন। তাতে আমেরিকান পুলিস তাঁদের পথে আটকিয়ে জেলে নিয়ে গেলেন। পিতার এই ব্যবহারে এভেলিন স্তম্ভিত ও মর্মাহত হলেন। তিনি বললেন, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার মতো যথেষ্ট বয়স তাঁর হয়েছে, মানবেন্দ্রনাথ রায়কে তিনি বিয়ে করবেন। ওই অবস্থাতেই তাঁরা বিয়ে রেজিষ্ট্রি করলেন এবং পুলিস তাঁদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন। নিউ ইয়র্কে গিয়েও রায় খুব স্বস্তিতে ছিলেন না। পুলিসের তাড়া খেয়ে নব বিবাহিত পত্নী এভেলিনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি মেকশিকোতে চলে গেলেন। রায় বঙ্গদেশের সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের মধ্যে একজন বিখ্যাত মেক্‌শিকোতে চলে গেলেন। রায় বঙ্গদেশের সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের মধ্যে একজন বিখ্যাত কর্মী ছিলেন। ভারতের ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীদের মধ্যে একজন বিখ্যাত কর্মী ছিলেন। ভারতের ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীদের সহিত প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে জার্মান সাম্রাজ্যবাদী গবর্নমেন্টের একটা সমঝতা হয়েছিল। তাতে স্থির হয়েছিল যে জার্মানী এই বিপ্লবীদের প্রচুর পরিমাণে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য করবেন এবং বিপ্লবীরা ভারতের ভিতরে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিরাট ও ব্যাপক অভ্যুত্থান করবেন। এই ইন্দো-জার্মান ষড়যন্ত্রের পূর্বদেশীয় কাজের সহিত নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, অর্থাৎ মানবেন্দ্রনাথ রায় বিশেষভাবে সংসৃষ্ট ছিলেন। তিনিই ব্যাটাভিয়ার (এখনকার জাকার্তায়) গিয়ে তখনকার জার্মান দূতের সঙ্গে সব কিছু ব্যবস্থা ক’রে দেশে ফিরেছিলেন। ওপরে আমি যে তাঁর বিদেশে যাওয়ার কথা লিখেছি সেটা ছিল তাঁর দ্বিতীয় যাত্রা। বাঙলার বিপ্লবী অন্দোলনে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের এইরকম বিশিষ্ট মর্যাদা ছিল বলেই মেকশিকো যাওয়ার পরেও তিনি ওখানকার জার্মান দূতাবাস হতে একটা মোটা টাকা পেয়ে গিয়েছিলেন। এম এন রায় যদি মেক্‌শিকোতে পালিয়ে না যেতেন তবে তিনি সানফ্রানসিসকোতে অনুষ্ঠিত ইন্দো-জার্মান ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার আসামী হতেন। মেকশিকোতে তিনি ১৯১৭ সালের গ্রীষ্মকালে পৌঁছেছিলেন। তখনও রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লব ঘটেনি।

[4. ডাক্তার চন্দ্রকান্ত স্যানফ্রানসিসকো ইন্দো-জার্মান ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার আসামী ছিলেন (১৯১৭-১৮)। ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীরা তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখতেন।]

এম এন রায় সোশ্যালিস্ট চিন্তাধারার প্রতি আকৃষ্ট হলেন

মেক্‌শিকোতে পৌছানোর পরে এম এন রায়ের চিন্তাধারায় ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে লাগলো। বাঙলার বিখ্যাত সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী কর্মী সোশ্যালিস্ট চিন্তাধারার দিকে ঝুঁকলেন। এর পেছনে তাঁর স্ত্রী এভেলিনের প্রভাব ছিল কিনা সে সম্বন্ধে তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় কিছু বলেননি। কিন্তু অনেকেই মনে করেন যে এভেলিনের প্রভাবেই তিনি সোশালিস্ট চিন্তাধারার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। যাই হোক, সোশ্যালিস্ট পার্টিতে তিনি যোগ দিয়েছিলেন এবং পরে তার সেক্রেটারীও তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

মাইকেল বরোদিনের সঙ্গে এম এন রায়ের পরিচয়

এম এন রায় সব নিয়ে আড়াই বছর মেক্‌শিকোতে ছিলেন। ১৯১৯ সালের গ্রীষ্মকালে এই মেক্‌শিকোতেই রুশ কমিউনিস্ট নেতা মাইকেল বরোদিনের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকার ঘটে। এর আগে অন্য কোনো কমিউনিস্ট নেতার সহিত তাঁর কখনও দেখা হয়নি। একটা বিপদে পড়ে বরোদিনকে মেক্‌শিকোতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। সেই সময়ে এম এন রায় তাঁকে নিজের বাড়ীতে থাকতে দিয়েছিলেন এবং আর্থিক সাহায্যও করেছিলেন তাঁকে। তাছাড়া, ওয়াশিংটনে যে সোবিয়েৎ ট্রেড ডেলিগেশন ছিল সেই ডেলিগেশনকেও বরোদিন এম এন রায়ের কাছ থেকে নিয়ে মেক্‌শিকো হতে টাকা পাঠিয়েছিলেন। তাঁরা দেশের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছিলেন, আর এম এন রায়ের হাতে ছিল জার্মানী হতে পাওয়া মোটা টাকা।

মেকশিকোর কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা

মাইকেল বরোদিনের কাছেই মানবেন্দ্রনাথ রায় মার্কসীয় দর্শনের প্রথম শিক্ষালাভ করেন। তাঁর স্মৃতিকথায় তিনি একথা অকপটে স্বীকার করেছেন। ১৯১৯ সালেই বরোদিনের সম্মতিতে (উপদেশও বলা চলে) এবং রায়ের বিশেষ উদ্যোগে মেক্‌শিকোর কমিউনিস্ট পার্টি স্থাপিত হয়। আসলে একটি প্রস্তাব গ্রহণের ভিতর দিয়ে সোশ্যালিস্ট পার্টিই কমিউনিস্ট পার্টি হয়ে গিয়েছিল। এম এন রায় দাবী করেন যে সোবিয়েৎ ইউনিয়নের বাইরে সমস্ত দুনিয়ায় তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত মেক্‌শিকোর কমিউনিস্ট পার্টিই প্রথমে কমিউনিস্ট পার্টি।

রায় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসে প্রতিনিধি

মাইকেল বরোদিন মেক্‌শিকোতে আটকা পড়েছিলেন বটে, কিন্তু তিনি মস্কোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি মানবেন্দ্রনাথ রায় সম্বন্ধে সমস্ত খবর মস্কোকে জানিয়েছিলেন। পরে মেকশিকোর কমিউনিস্ট পার্টি স্থাপিত হওয়ার রিপোর্টও তিনি মস্কোতে পাঠিয়েছিলেন। ১৯২০ সালের ১৯ শে জুলাই হতে ৭ই আগস্ট পর্যন্ত কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন হওয়া স্থির হয়েছিল। বরোদিন মস্কো হতে উপদেশ পেলেন যে মেক্‌শিকোর কমিউনিস্ট পার্টি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসে যেন তাঁদের প্রতিনিধি পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। বরোদিনের মারফতে এম এন রায়ও এই দ্বিতীয় কংগ্রেসে নিমন্ত্রিত হন। তা সত্ত্বেও শুধু ব্যক্তি হিসাবে রায় মস্কোর পথে যাত্রা করেননি। যাওয়ার আগে মেক্‌শিকোর কমিউনিস্ট পার্টির তরফ হতে তিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে, একটি কথা মনে রাখা ভালো। কেবল মেক্‌শিকোর কাজের জন্যেই যে এম এন রায় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসে বিশেষভাবে নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন তা ভাবলে ভুল করা হবে। সেখানে যে তাঁর এত আদর ও কদর হয়েছিল তার আসল কারণ ছিল, তিনি একজন ভারতীয় এবং মার্কসবাদী। স্থির হয়েছিল যে দ্বিতীয় কংগ্রেসে লেনিনের ঔপনিবেশিক নিবন্ধাবলী (Preliminary Draft of Some Theses on the national and colonical Questions for the Second Congress of the Communist International By N. Lenin) উপস্থাপিত, আলোচিত ও গৃহীত হবে। কাজেই, তাতে একজন ভারতীয় মার্কসবাদীর উপস্থিতির মূল্য ছিল খুবই বেশী।

মানবেন্দ্রনাথ রায় সস্ত্রীক মস্কো রওয়ানা হয়েছিলেন স্পেন ও বার্লিনের পথে। বার্লিনে তাঁদের বেশ কয়েকদিন থাকতে হয়েছিল। তাতে তাঁর নির্বাসিত ভারতীয় ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুবিধা ঘটে। তাছাড়া, জার্মান মার্কসবাদীদের সঙ্গে আলোচনা করে অনেক কিছু বোঝারও সুযোগ পান তিনি।

বার্লিনে অবনীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সহিত রায়ের পরিচয়

বার্লিনে অদ্ভুতভাবে অবনীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সহিত মানবেন্দ্রনাথের পরিচয় হয়। তিনি ইন্দোনেশিয়া হতে ডক্টর শাহীর নাম ধারণ করে ইউরোপে এসেছিলেন। হল্যান্ডের বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা ও বিশিষ্ট ইঞ্জিনীয়ার রুটগের্সের (Rutgers) নামে অবনী মুখার্জি ইন্দোনেশিয়া হতে পত্র নিয়ে এসেছিলেন। রুটগের্স কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের গোপন ওয়েস্ট ইউরোপীয়ান ব্যুরোর সভ্য ছিলেন। তিনিই আবার পত্র দিয়ে এম এন রায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্যে মুখার্জিকে বার্লিনে পাঠিয়েছিলেন। আশ্চর্য হতে হয় এই কারণে যে মুখার্জি কলকাতার সুকিয়া স্ট্রীটের লোক,-সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টির সভ্য ছিলেন বলে দাবী করতেন তিনি, এম এন রায়ের সমসাময়িক লোকও ছিলেন তিনি,-তবুও রায় ও তাঁর মধ্যে আগে হতে কোনও পরিচয় ছিল না!

এম এন রায়ের নিকটে অবনী মুখার্জি যে আত্ম-পরিচয় দিয়েছিলেন তা হচ্ছে এই। তাঁর নাম অবনী মুখার্জি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে তিনি জার্মানীতে পড়তে গিয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ আরম্ভ হওয়া মাত্রই তিনি সে দেশ ত্যাগ করতে সমর্থ হন। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের ভিতর দিয়ে ভ্রমণ করতে করতে ১৯১৬ সালে তিনি জাপানে পৌঁছান এবং পরের বছরের (অর্থাৎ ১৯১৭ সালের) মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি সে দেশে থেকে যান। এই সময়ে রাসবিহারী বসুর সাহায্যে তিনি বানারসের শিবপ্রসাদ গুপ্তের সঙ্গে দেশের দিকে রওয়ানা হওয়ার সুযোগ পেয়ে যান। অবনী মুখার্জির বর্ণিত কাহিনী অনুসারে রাসবিহারী বসুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিবপ্রসাদ গুপ্ত জাপানে এসেছিলেন এবং রাসবিহারীর নিকট হতে বিশেষ বার্তা ও গোপনে বৈপ্লবিক কাজের জন্য টাকা নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন। তাঁরা উভয়ে গিরেফতার হয়ে সিঙ্গাপুরে বন্দী হলেন। অল্পদিনের ভিতরে শিবপ্রসাদ গুপ্তকে মুক্তি দিয়ে দেশে যেতে দেওয়া হলো, আর অবনী মুখার্জি ভয়াবহ প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে থাকলেন। মাঝে মাঝে তাঁর ওপরে মারধোরও চলতে লাগল। অবশেষে পুলিসের মনে প্রত্যয় জন্মাল যে অবনী মুখার্জির বিপ্লবী আন্দোলনের সহিত কোন সংস্রব নেই। তার পরে তাঁকে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে দেওয়া হয়। এভাবে খানিকটা স্বাধীনতা পাওয়ায় তিনি একটা জেলে নৌকার সাহায্যে একদিন সরে পড়লেন। এই নৌকা তাঁকে একখানি চীনা জাহাজে (Chinese junk) চড়িয়ে দেয়। সেই জাহাজে তাঁকে জাকার্তায় পৌছিয়ে দিল। সেখানে তিনি মালয়রূপে পরিচিত হওয়ার জন্যে ডক্টর শাহীর নাম ধারণ করলেন। ওই দেশের কিছু সংখ্যক বিপ্লবীদের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ হলো। তাঁরা রুশ বিপ্লবের কথা শুনেছিলেন এবং কমিউনিজমের বাণীর দ্বারা উদ্বুদ্ধও হয়েছিলেন। এই বাণী মুখার্জিকেও এত প্রভাবিত করল যে তিনি স্বদেশে ফেরার কথা ভুলে গেলেন এবং বিপ্লবের দেশে পৌছবার উদ্দেশ্যে দুঃসাহসিক ভ্রমণের জন্যে প্রস্তুত হলেন একটি ডাচ জাহাজে স্টুয়ার্ডের চাকরী নিয়ে। হল্যান্ডে তিনি রুটগের্সের (Rutgers) সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর নামে তিনি জাবার তাঁদের উভয়ের এক বন্ধুর নিকট হতে পরিচয়পত্র এনেছিলেন। [৫]

[5. M.N. Roy’s MEMORIS, Page 296]

এম এন রায় নিজেই বলছেন, মুখার্জির কাহিনী বিশ্বাসযোগ্য নয়। তার ভিতর যে ফাঁকগুলি ছিল সেগুলি ভর্তি করে নেওয়া মোটেই সহজ ছিল না। তবুও…তবুও কিনা রায় এই প্রথম একজন ভারতীয় কমিউনিস্টকে দেখলেন, যাঁকে দলে টানার লোভ তিনি কিছুতেই সংবরণ করতে পারলেন না। এম এন রায় আর অবনী মুখার্জি সমসাময়িক লোক। রায় যদি মুখার্জিকে কঠোরভাবে প্রশ্ন করতেন তা হলেই ধরা পড়ে যেত কত অনর্গল মিথ্যা কথা মুখার্জি তাঁর নিকটে বলে গেলেন।

১৯২২-২৩ সালের ঘটনার বিবৃতিতে আমি যখন পৌঁছে যাব তখন আমি এই অবনী মুখার্জির সম্বন্ধে সুবিস্তৃত আলোচনা করব।

রায় বলছেন প্রথম পরিচয়ের পরে তিনি অবনী মুখার্জিকে হল্যান্ডে ফিরে গিয়ে আপাতত সেখানেই থাকার উপদেশ দিলেন। হল্যান্ড হতে ভারতবর্ষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা তিনি মুখার্জিকে করতে বললেন। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন শেষ হলে তার সিদ্ধান্ত ইত্যাদি নিয়ে মুখার্জিকে ভারতবর্ষে যেতে হতে পারে একথাও রায় তাঁকে বলে রাখলেন। মুখার্জি অবশ্য মস্কো যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই রায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কাজেই বড় হতাশ হয়ে তিনি হল্যান্ডে ফিরে গেলেন।

মস্কো পৌঁছানোর ক’দিন পরে মানবেন্দ্রনাথ একদিন অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেলেন যে অবনী মুখার্জি ভারতের ‘ম্যানডেট’ নিয়ে মস্কো এসে হাজির! এই ‘ম্যানডেট’ তিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ওয়েস্ট ইউরোপীয়ান ব্যুরো হতে এনেছিলেন। এবারেও তিনি রুটগের্সের নিকট হতে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের নামে একখানি পত্র নিয়ে এসেছিলেন। এই পত্রে তিনি লিখেছিলেন যে ডক্টর শাহীরের (অবনী মুখার্জির) মস্কো যাওয়ার অদম্য বাসনা। ব্যুরো তাঁকে নিরাশ করতে চায়নি। আর, কংগ্রেসে এশিয়ার প্রতিনিধির সংখ্যা যত বেশী হয় ততই তো ভালো।

অবস্থা এখন এই দাঁড়ালো যে দ্বিতীয় কংগ্রেসে মানবেন্দ্রনাথ রায় ছিলেন মেক্‌শিকোর কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি, আর অবনীনাথ মুখার্জি (ডক্টর শাহীর ) ছিলেন ভারতের একমাত্র প্রতিনিধি। তবে, মুখার্জির আলোচনায় যোগ দেওয়ার অধিকারই শুধু ছিল, ভোট দেওয়ার অধিকার তাঁর ছিল না।

অবনী মুখার্জি বিপদের সম্মুখীন

দ্বিতীয় কংগ্রেসের পূর্বক্ষণে মুখার্জি এক বিপদের সম্মুখীন হলেন। রাশিয়াতে যারাই আসতেন চেকা গোয়েন্দা পুলিস) তাঁদের গতিবিধির ওপরে কড়া নজর রাখতেন। তাঁরা রিপোর্ট করলেন, জাহাজ হতে নামার পরে পেট্রোগ্রাডে এবং মস্কোতে আসার পরে মস্কোতেও অবনী মুখার্জি অভিজাত পরিবারে যাতায়াত করেছেন। এই অভিজাত পরিবারের লোকেরা বরাবর বিপ্লবের বিরুদ্ধে ছিলেন। একজন বিদেশী এসে যে অভিজাত পরিবারে যাতায়াত আরম্ভ করলেন এটা খুবই সন্দেহজনক ব্যাপার। মানবেন্দ্রনাথ এই ব’লে রেহাই পেয়ে গেলেন যে তিনি বার্লিনেই অবনী মুখার্জিকে প্রথম দেখেছেন, তার আগে তিনি মুখার্জির সম্বন্ধে কিছুই জানতেন না। অবনী মুখার্জি রায়কে জানালেন যে অভিজাতরা ভারতের সম্বন্ধে খুবই দরদী বলে তিনি তাঁদের বাড়ী গিয়েছেন। চেকা কিন্তু তাঁকে তখনই গিরেফ্ফার করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু লেনিন বাধা দিলেন। বললেন, কংগ্রেসের পূর্বক্ষণে একজন ভারতীয়কে গিরেস্তার করলে তার আন্তর্জাতিক প্ৰতিক্ৰিয়া ভালো হবে না। অবনী মুখার্জি এবারের মতো বেঁচে গেলেন।

রায়ের তুর্কিস্তান যাত্রা

এখানে আমি শুধু মানবেন্দ্রনাথ রায় ও অবনী মুখার্জির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছি। রায়ের স্মৃতিকথা হতেই আমি এই পরিচয়ের উপাদান নিয়েছি। রায়ের স্মৃতিকথা হতে উপাদান না নিয়েও তাঁর সম্বন্ধে কিছু বলা যেত। কিন্তু আমাদের দেশের বৈপ্লবিক ঘটনাসমূহের বর্ণনায় ছাপার অক্ষরে অবনী মুখার্জির অভ্যুদয় এক বিস্ময়কর ব্যাপার। কোথা থেকে তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছে, কিভাবে হয়েছে তা বাঙলার সে যুগের বিপ্লবীরা কিছুই জানেন না। আমার এই স্মৃতিকথায় তাঁর সম্বন্ধে যে পরে বিশদ আলোচনা হবে সে কথা আমি আগে বলেছি। মুখার্জি রায়কে যা বলেছেন, কিংবা মুখার্জি বলেছেন ব’লে রায় যা পেশ করেছেন আমি শুধু সেই কথাগুলিই তুলে দিয়েছি। একটা কথা শুধু আমি এখানে বলে রাখছি। মানবেন্দ্রনাথ রায়দের তুর্কিস্থান যাওয়ার পরে কোনও সময়ে অবনী মুখার্জি রোজা ফিটিংগোফ নাম্নী একজন রুশীয় মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। মনে হয় মস্কোতেই তাঁর সঙ্গে অবনী মুখার্জির প্রথম পরিচয় হয়েছিল। রোজা ফিটিংগোফ মানবেন্দ্রনাথদের একই ট্রেনে অনুবাদিকার কাজ নিয়ে তাশকন্দ গিয়েছিলেন।

১৯২০ সালের ১৯ শে জুলাই হতে ৭ই আগস্ট পর্যন্ত কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন হয়েছিল। তার পরে ওই বছরেরই ১লা সেপ্টেম্বর হতে ৮ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাকুতে প্রাচ্য দেশীয় জনগণের কংগ্রেসের (The Baku Congress of the Peoples of the East) অধিবেশন হয়েছিল। এই কংগ্রেসে মানবেন্দ্রনাথ রায় যোগ দেননি, তাতে যোগ দেওয়ার জন্য অবনী মুখার্জিকে পাঠানো হয়েছিল। বাকু হতেই মুখার্জি তাশকন্দে গিয়েছিলেন।

কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসে এম এন রায় একসেকিউটিব কমিটির সভ্য নির্বাচিত হননি। একসেকিউটিব কমিটি তার প্রথম মিটিং-এ মিলিত হয়ে পাঁচ জনের একটি সার্কমিটি গঠন করেন এবং এই সার্-কমিটির নাম দেওয়া হয় “স্মল ব্যুরো”। এই কমিটির বৈঠক অবিরাম চলতে থাকবে। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের নীতিনির্ধারণও এই কমিটিই করবে ব’লে স্থির হয়। এম. এন. রায় এই কমিটিরও সভ্য নির্বাচিত হননি। তিনি বলছেন তিনি ইচ্ছা করেই একসেকিউটিব সভ্য নির্বাচিত হননি। আর, সর্বক্ষমতাসম্পন্ন স্থলে ব্যুরো’তে পরে তাঁকে কো-অপ্ট করা হয়েছিল। তিনি সেন্ট্রাল এসিয়াটিক ব্যুরোর তিনজন সভ্যের একজন নিযুক্ত হয়েছিলেন। এই ব্যুরোর সংক্ষেপে তুর্ক বুরোও বলা হতো। এই ব্যুরোর অন্য দু’জন সভ্য ছিলেন যথাক্রমে সকোলনিকোব ও সফারোব। সকোলনিকোব সেন্ট্রাল এশিয়ার তুর্ক ফ্রন্টে রেড আর্মির কমান্ডার ছিলেন। তিনি সেন্ট্রাল সোবিয়েৎ গবর্নমেন্টের দ্বারা নিয়োজিত তুর্কিস্তান কমিশনের চেয়ারম্যানও ছিলেন। সফারোব বলশেভিক পার্টির ( সোবিয়েৎ দেশের কমিউনিস্ট পার্টির) সেন্ট্রাল কমিটির প্রতিনিধি ছিলেন। চেকার তরফ হতে পিটার সঙ্গে ছিলেন। অসামরিক প্রশাসনিক কাজের চার্জে ছিলেন কাগানোভিচ্। তুর্কিস্তান সোবিয়েতের সেন্ট্রাল এক্সেকিউটিব কমিটির প্রেসিডেন্ট রহীম বাবায়ে সঙ্গে ছিলেন।

কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসের শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সকোলনিকোব ও সফারোব তুর্কিস্তানে চলে গেলেন। এম. এন. রায়ের রওয়ানা হতে কিছু বিলম্ব হলো। কারণ, তাঁর সোবিয়েৎ দূত (ambassador) হিসাবে আফগানিস্তানে যাওয়ার প্রশ্নের তখনও চূড়ান্ত মীমাংসা হয়নি; ভারতের বিপ্লব আন্দোলনকে কিভাবে সাহায্য করতে হবে তার উপায়ও তখন নির্ধারিত হয়নি। রায় বলেছেন :

[“ I had no intention of leavingMOSCOW without being amply provided with the sinews of war-material to make a revolution. I had failed in a similarattempt in the Far East. Then the Germans duped us. This time i Wanted to succeed. The Russian Bolshevics were reliable allies.”][6]

(M. N. Roy’s Memories, Page 395 )

[6. এম. এন. রায়ের মতে ভারতে অস্ত্র পাঠানেরা ব্যাপারে জার্মানরা duped অর্থা, প্রতারণা করেছিলেন। আসলে অস্ত্র তাঁরা পাঠাননি। (লেখক)]

অনুবাদ। “যথেষ্ট পরিমাণে যুদ্ধোপকরণ না নিয়ে অর্থাৎ যে সব উপাদানের দ্বারা বিপ্লব করা যায় সে সব না নিয়ে আমার মস্কো ত্যাগ করার কোনো ইচ্ছা ছিল না। দূর প্রাচ্যে ওইরকম প্রচেষ্টা করতে গিয়ে আমি অকৃতকার্য হয়েছিলেম। তখন জার্মানরা আমাদের প্রতারণা করেছিলেন। এবারে আমি কৃতকার্য হতে চেয়েছিলেম। রাশিয়ার বলশেভিকরা ছিলেন বিশ্বস্ত বন্ধু।”

(এম. এন রায়ের “স্মৃতিকথা” ৩৯৫ পৃষ্ঠা)

শেষ পর্যন্ত আফগান সরকার মানবেন্দ্রনাথ রায়কে আফগানিস্তানের সোবিয়েৎ দূত (ambassador) নিযুক্তিকরণে রাজী হলেন না। অতএব, রায় দু’খানা ট্রেনভর্তি অস্ত্রশস্ত্র, সাঁজোয়া গাড়ী, এয়ারোপ্লেনের খোলা অংশসমূহ, রসদ, ধন-ভাণ্ডার, সৈন্য, বিভিন্ন বিষয়ে যুদ্ধবিদ্যার শিক্ষাদাতা প্রভৃতি সঙ্গে নিয়ে তুর্কিস্তানের পথে রওয়ানা হলেন। কোন্ তারিখে তিনি রওয়ানা হয়েছিলেন এবং তাশকন্দ পৌঁছতে তাঁর কদিন লেগেছিল তার কোনো উল্লেখ তাঁর স্মৃতিকথায় নেই। সন-তারিখ সম্বন্ধে তিনি একেবারেই নির্বিকার। তবে, তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর জন্যে ট্রেনে যে স্যালুনের ব্যবস্থা হয়েছিল সে-কথার উল্লেখ করতে তিনি ভুলেননি। স্ত্রীর কথা অবশ্য তিনি বলেননি। কিন্তু আমরা জানি যে তাঁর প্রথমা স্ত্রী এভেলিন ট্রেন্ট্ তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তাঁদের ট্রেন কিছু বিলম্বে তাশকন্দে পৌছেছিল। মনে হয় তাঁদের সাত হতে দশ দিন লেগে গিয়েছিল।

এম. এন. রায় লিখেছেন, যে-সকল মুহাজির (আত্ম নির্বাসিত) যুবক ভারতবর্ষ হতে আসছিলেন তাঁদের নিয়ে তুর্কিস্তানে তিনি একটি ভারতীয় মুক্তিফৌজ (Liberation Army) গঠন করতে চেয়েছিলেন। আফগান সরকারের নিকট হতে এই অনুমতি চাওয়া হয়েছিল যে অস্ত্রশস্ত্র সহ ভারতীয় মুক্তিফৌজকে আফগানিস্তানের ভিতর দিয়ে ভারত সীমান্তে যেতে দেওয়া হোক। সেখানে পৌঁছে তাঁরা ভারতের ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন।

আফগানিস্তানের সরকার জানালেন, আপনাদের প্রস্তাব অতি উত্তম। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই একান্তই করা উচিত। তবে, আপনারা আপনাদের অস্ত্রশস্ত্রগুলি আমাদের নিকট রেখে দিয়ে আগে খালি হাতে ভারত সীমান্তে পৌঁছে যান। আপনারা সীমান্তে পৌঁছে গিয়েছেন এ খবর আমাদের নিকটে পৌঁছানোর পরে আমরাই অস্ত্রশস্ত্রগুলি আপনাদের নিকটে পৌঁছিয়ে দেব। এখানেই এম. এন. রায়ের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেল। আমি অবাক হয়ে ভাবছি কি ক’রে এমন একটি প্রস্তাব আফগানিস্তানের গবর্নমেন্টের নিকটে করা হয়েছিল। কোনো স্বাধীন দেশ কি এই রকম একটি প্রস্তাবে কখনও রাজী হতে পারেন? নিশ্চয়ই যে-সব জায়গা হতে মঞ্জুরী পাওয়ার কথা সে সব জায়গায় মঞ্জুরী না পেলে এম. এন. রায় একাজে অগ্রসর হতে পারতেন না। কিন্তু লেনিন সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। রায় বলছেন, লেনিন বলেছিলেন, “they ( Brithis) would bombard Amanullah’s citadel with silver and gold bullets” অর্থাৎ “সোনা-চাঁদির গুলিবর্ষণ করে ব্রিটিশ আমানুল্লার দুর্গ চূর্ণ করে দেবে।”

মোট কথা, এত সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে এম. এন. রায় বৃথাই তাশকন্দে গিয়েছিলেন। ভারতের মুক্তিফৌজ তো গঠিত হলোই না, মুহাজির (আত্মনির্বাসিত) যুবকদের সৈনিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য তাশকন্দে যে মিলিটারি স্কুলটি স্থাপিত হয়েছিল তাও তুলে দিতে হলো। ভারতের এক সময়কার গবর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় লর্ড কর্জন তখন ব্রিটেনের বৈদেশিক মন্ত্রী ছিলেন। তিনি বললেন তাশকন্দের এই মিলিটারি স্কুলটি ভারতের বিরুদ্ধে একটা গভীর ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। কাজেই, স্কুলটি এখনই তুলে দিতে হবে। না দিলে ব্রিটেনের সঙ্গে সোবিয়েতের যে বাণিজ্যচুক্তি হয়েছে তা এখনই বাতিল হয়ে যাবে। চারদিক হতে দীর্ঘকাল অবরুদ্ধ হয়ে থাকা সোবিয়েতের পক্ষে এইরকম একটি বাণিজ্য চুক্তির প্রয়োজন ছিল। তা ছাড়া, ভারতীয় মুক্তিফৌজ যখন গঠিত হলো না, অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে ভারত সীমান্তে যাওয়ার আশাই যখন বিলীন হয়ে গেল, তখন তাশকন্দের মিলিটারি স্কুলের সার্থকতাও আর থাকল না। স্কুলটি তুলে দেওয়াই স্থির হলো।

মিলিটারি স্কুলে রাজনৈতিক শিক্ষাও দেওয়া হচ্ছিল। মুহাজিরদের ভিতরে যাঁরা শিক্ষিত ছিলেন তাঁরা জটিল অস্ত্রশস্ত্রের শিক্ষায় এত দ্রুত সুদক্ষ হয়ে উঠেছিলেন যে তাতে রুশ-শিক্ষকেরা পর্যন্ত আশ্চর্য হয়েছিলেন। শিক্ষিতদের মধ্যে ক’জন এয়ারোপ্লেনের শিক্ষাও লাভ করেছিলেন। এয়ারোপ্লেনের যুদ্ধের রেওয়াজ তখনও ভালোভাবে চালু হয়নি। তবুও তাঁদের মধ্যে ক’জন এয়ারোপ্লেনের শিক্ষাও লাভ করেছিলেন। এম. এন. রায় বলেছেন তাঁদের দু’জনে সুদক্ষ হয়ে রেড আর্মি ইউনিটে চলে গিয়েছিলেন।

“প্রবাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন” নামে আমার একখানি পুস্তক আছে। এই পুস্তকের ইংরেজি তর্জমার নাম “The Communist Party of India And Its Formation Abroad”। ১৯২২-২৩ সালের মস্কো কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার দণ্ডিত আসামী, ভোপালের কমরেড রফীক আমদের জবানিতে আমি একদল মুহাজির যুবকের কঠোর অভিজ্ঞতার কথা এই পুস্তকে বর্ণনা করেছি। তুর্কমেন প্রতিবিপ্লবীদের দ্বারা গিরোর হয়ে এই যুবকেরা প্রাণ হারাতে বসেছিলেন। লাল-ফৌজের আগমনে তাঁরা বেঁচে যান। তুর্কমেনিস্তানের কির্কির দুর্গে থাকাকালে মুহাজিরদের ভিতরে একমাত্র এই যুবকেরাই অস্ত্রধারণ ক’রে মুসলিম প্রতিবিপ্লবীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। পরে ভারতের প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টিতে এঁদের মধ্যে হতেই যুবকেরা বেশী সংখ্যায় যোগ দিয়েছিলেন। মনে রাখতে হবে যে তাশকন্দে যে সকল ভারতীয় মুহাজির (আত্ম-নির্বাসিত) যুবক জড়ো হয়েছিলেন তাঁদের ভিতরে ওপরে বর্ণিত যুবকেরাও ছিলেন। বুখারার আমীরের একটি মস্ত বড় বাড়ীতে তাঁদের থাকতে দেওয়া হয়েছিল। এই বাড়ীটির নাম দেওয়া হয়েছিল “ইন্ডিয়া হাউস”। তখন তাশকন্দের বাজারেও অনেক ভারতীয় ছিলেন। তাঁদের ভিতরে ব্রিটিশের চরেরাও ছিল। “ইন্ডিয়া হাউসে”র মুহাজিরদের ভিতরেও দু’-চারজন, হয়তো আরও বেশী, ব্রিটিশ চর না থাকার কথা নয়। এই “ইন্ডিয়া হাউসে”ই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সূচনা হয়েছিল।

পার্টির সূচনা – এম. এন. রায়ের কথা

এম. এন রায় বলছেন মুহাজিরদের ভিতরে শিক্ষিতরা সংখ্যাল্প ছিলেন। তাঁদের নিয়েই তাঁর কাজ শুরু হয়েছিল। তিনি লিখেছেন :

“My preliminary efforts with the educated minority produced greater results than I expected and wanted Most of them transferred their fanatical allegiaance form Islam it Communism. I had not spoken to them at all about Communism. I only told them that dirving the Brithis out of India would be no revolution, if it was succeeded by replacing foreign exploiters by ntive ones. I had to explain the social significance of a revolution: that, to be worhtwhile, a revolution should liberate the toiling masses of India from their present echonomic positon. Instinctively idealists, they readily agreed with my opinion and jumped to the conclusion that, if the revoluiton was to liberate the toiling masses, it would have to be a communist revolution. I was surprised when some of them approached me with the proposal that they wanted to join the Communist party. Others enquired why we should not found the Communist Party of India there and then. Their enthusiasm was very well meant. Although some of them had a utiliatarian motive, I could no discourage them.

“Presently, they were reinforced by the arrival of a small group which called itself Communists already at Kabul. It was led by an old greybearded Maulana, Abdur Rab, and a South Indian Hindu named Achaarya. On their arrival, they were accommodated in the emigrants’ house and expected to have special attention and privileges owing to their professed political faith. I would havge welocmed the advent of even a few clever and convinced communists to help me deal with a rather diffult situation. But after some conversation I discovered that Abdur Rab Was in Impostor, and Acharya was an anarchist, if he was anaything. But the educated minority of the earlier emigrants were easily influenced by abdur Rab and Acharya, who fanned their Communist Fanaticism.

“The result of new crisis in the emigrants’ house was that some of the inmaates began talking about Communis openly and went to the extent of making disparaging remarks about their fanatical past, which was still a present with most of the others. Occasionally, it came to fierce altercations and even exchange of blows, To maintain order and to protect the minority, we had to post some armed gurds near the house. One the other hand, the minority, which proposed the formation of an Indian Communist Party, was reinforced by the Abdur Rab-Acharya group and on the latter’s instigation, sent a delegation to the Truk-Bureau of the Communist International to plead their case. I tried to argue with them that there was no hurry. They should wait until they returned to India. There was no sense in a few emigrant individuals calling themselves the Communist Party. They were evidently disappointed, and I apprehended that the experience might dishearten them. I needed their help to manage the refractory majority of emigrants. the Idea of turning them out wiht the offer of employment was not practical. So I agreed with the proposal of the formation of a Communist Party, knowing fully well that it would be a nominal thing, although it could function as a nuceleus of a real Communist Party to be organbised eventually. An intelligent and fairly educated young man named Mohammaad Safiq [Shafiq], who had come from kabul with the Acharya group, was elected sectretary of the party.”

(M. N. Roy’s Memories, Allied Publishers, Pp 464-65)

বাঙলা তরজমা

“এই অল্প সংখ্যক মুহাজির যুবকের ভিতরে ইস্লাম সম্বন্ধে যতটা উন্মাদনা ছিল ঠিক ততটাই উন্মাদনা তাঁদের ভিতরে এসে গেল কমিউনিজম্ সম্বন্ধেও। আমি তঁঅদের সঙ্গে কমিউনিজম সম্বন্ধে কোনো কথাই বলিনি। আমি তাঁদের শুধু বলেছিলেম যে ব্রিটিশকে ভারতবর্ষ হতে তাড়াবার পরে যদি ব্রিটিশের জায়গায় দেশীয় শোষকেরা ক্ষমতা দখল করে নেয় তবে তা বিপ্লব বলে পরিগণিত হবে না। বিপ্লবের সামাজিক অর্থ বর্তমান আর্থিক অবস্থা হতে মুক্ত করতে পারলেই শুধু বিপ্লব সার্থক হবে। এই যুবকেরা সত্বঃই আদর্শবাদী তো ছিলেনই, তাঁরা সঙ্গে সঙ্গেই আমার কথা মেনে নিলেন এবং তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে যদি শ্রমজীবী জানগণকে মুক্ত করাই বিপ্লবের মানে হয় তবে তো তাকে কমিউনিস্ট বিপ্লবই হতে হবে। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম তখন যখন এই যুবকদের ভিতর হতে ক’জন এসে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা আমায় জানালেন। অন্যরা জানতে চাইলেন, ‘কেন আমরা এখনই এখানে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি স্থাপন করব না?’ তাঁদের এই উৎসাহের পেছনে কোনো মন্দ অভিপ্রায় ছিল না, যদিও কেউ কেউ সুযোগসন্ধানী ছিলেন। আমি তাঁদের নিরুৎসাহ করতে পারিনি।

“সেই সময়ে কাবুল হতে একটি ছোট্ট দল এসে পড়ায় যুবকদের পার্টি গঠনের দাবী আরও জোরদার হয়ে পড়ল। এই ছোট্ট দলের লোকেরা কাবুলেই নিজেদের কমিউনিস্ট বলে ঘোষণা করেছিলেন। তাঁদের নেতা একজন সাদা দাড়িওয়ালা মাওলানা ছিলেন। তাঁর নাম আবদুর রব। আর একজন দক্ষিণ ভারতের হিন্দু, নাম আচার্য। তাঁদের মুহাজিরদের জন্যে নির্দিষ্ট বাড়ীতেই থাকতে দেওয়া হলো। আগে হতে তাঁরা নিজেদের কমিউনিস্ট বলে ঘোষণা করার কারণে তাঁদের সুখ-সুবিধার প্রতি বিশেষ নজরও দেওয়া হলো। সামান্য ক’জন হলেও, দৃঢ়বিশ্বাসী বিচক্ষণ কমিউনিস্টদের আগমন আমার নিকটে সুস্বাগত ছিল। তা হলে যে সকল অসুবিধার ভিতর দিয়ে আমায় কাজ করতে হচ্ছিল সে কাজে আমি অনেক সাহায্য পেতে পারতাম। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে আলাপ- আলোচনা ক’রে বুঝলাম আবদুর রব একজন প্রতারক (impostor) আর, আচার্য ছিলেন একজন এনার্কিষ্ট ( নৈরাজ্যবাদী)। এর বেশী তাঁকে আর কিছু বলা যায় না। সংখ্যাল্প মুহাজির যুবকদের আবদুর রব আর আচার্য সহজেই আকর্ষণ করতে পারলেন। এই দুই ব্যক্তি যুবকদের ভিতরকার কমিউনিস্ট উন্মাদনাকে উস্কাতে লাগলেন।

“ফল এই দাঁড়াল যে মুহাজিরদের বাড়ীতে কেউ কেউ কমিউনিজম নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা শুরু করে দিলেন। তাঁরা তাঁদের ধর্মোন্মাদনা অতীত সম্বন্ধে অবজ্ঞাসূচক মন্তব্যও প্রকাশ করতে লাগলেন। ধর্মোন্মাদনা সংখ্যাল্পদের ভিতরে ‘অতীত’ হয়ে গেলেও অন্যদের ভিতরে তা ছিল ‘বর্তমান’। সময় সময় কঠোর ভাষায় তর্কাতর্কি তো হতোই, মারামারিও হয়ে যেত। সংখ্যাল্পদের বাঁচাবার জন্যে ও শৃঙ্খলা রক্ষার উদ্দেশ্যে ইন্ডিয়া হাউসের সম্মুখে সশস্ত্র প্রহরী পর্যন্ত মোতায়েন করতে হলো। পক্ষান্তরে সংখ্যাল্প মুহাজিররা, যাঁরা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি স্থাপন করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, আব্দুর রব-আচার্য গ্রুপের দ্বারা তাঁরা শক্তিশালী হলেন। এই গ্রুপেরই উস্কানিতে তাঁদের একদল প্রতিনিধি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের তুর্কিস্তান ব্যুরোর নিকটে হাজির হয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি স্থাপন করার দাবী পেশ করলেন। আমি তাঁদের বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে এত তাড়াহুড়া করার কি দরকার আছে? ভারতবর্ষে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত তাঁদের অপেক্ষা করা উচিত। ক’জন মাত্র মুহাজির এগিয়ে এসে নিজেদের কমিউনিস্ট পার্টি বলে ঘোষণা করে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। একথা শুনে তাঁরা হতাশ হয়ে পড়লেন। আমি ভয় পেলাম যে এই অভিজ্ঞতা তাঁদের মন ভেঙে দিতে পারে। সংখ্যাধিক মুহাজিরদের পরিচালনা করার জন্যে আমার সংখ্যাল্পদের সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। তাঁদের চাকরী দেওয়া হবে এই কথা জানিয়ে তাঁদের অনুরোধ নাকচ করলেও তা কার্যকরী হতো না। কাজেই, আমি কমিউনিস্ট পার্টি স্থাপন করার প্রস্তাবে সম্মত হলাম। আমি জানতাম এই পার্টি নামেই শুধু পার্টি হবে, যদিও আমি এত জানতাম যে ভারতের ভবিষ্যৎ কমিউনিস্ট পার্টির অঙ্কুরের কাজ এই পার্টি করতে পারবে। মুহম্মদ শফীক পার্টির সেক্রেটারি নির্বাচিত হলেন। তিনি শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান যুবক ছিলেন, আচার্য গ্রুপের সঙ্গে কাবুল হতে এসেছিলেন।” (“এম. এন. রায়ের স্মৃতিকথা”, ইংরেজি, এলাইড পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ৪৬৪ ও ৪৬৫ পৃষ্ঠা)

তাশকন্দে পার্টির গোড়া পত্তনে রায় আসলে যা করেছিলেন

এম. এন. রায়ের মূল ইংরেজি লেখা আমি ওপরে তুলে দিয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে তার বাঙলা তর্জমা দিতেও আমি ভুলে যাইনি। তা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে ১৯২০ সালে তাশকন্দে-আসা মুহাজির (আত্ম-নির্বাসিত) যুবকেরা তাশকন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ভিত্তি স্থাপনে এম. এন. রায়কে বাধ্য করেছিলেন। তাঁর স্মৃতিকথা পড়ে এই ধারণাই আমাদের মনে বদ্ধমুল হয়ে থাকত। যে সকল মুহাজির তাশকন্দে ও মস্কোতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে সকলে বেঁচে নেই। যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁদের মধ্যে চেষ্টা করলে আমরা এখন শুধু ভোপালের কমরেড রফীক আহমদকে পেতে পারি। তাঁরও বয়স আজ (১৯৬৭) সত্তর বছর। অন্য যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁরা পাকিস্তানের অধিবাসী। পাকিস্তান আজ আমাদের নিকট শুধু বিদেশ নয়-দূর বিদেশ।

একথা আমি কখনও বলব না যে তাশকন্দে মুহাজির যুবকেরা মানবেন্দ্ৰনাথ রায়কে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি স্থাপন করার কথা কোন দিন বলেননি। কিন্তু এখন আমরা প্রমাণ পেয়েছি যে তাশকন্দে পার্টি স্থাপন করা সম্বন্ধে রায় যা লিখেছেন, কাজে কিন্তু তিনি তা করেননি। তার বিপরীত কাজই তিনি সেখানে করেছিলেন। তাশকন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি স্থাপন করার প্রকৃত উদ্যোগ এম. এন. রায় নিজেই গ্রহণ করেছিলেকন, মুহাজির যুবকেরা নয়।

তাশকন্দে ডক্টর দেবেন্দ্র কৌশিকের আবিষ্কার

ডক্টর দেবেন্দ্র কৌশিক (এম এ পি এইচ-ডি) কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস শাস্ত্রের রীডার। তিনি ভারতের আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইতিহাসে ডক্টরেট লাভ করার পরে সোবিয়ে দেশের উজবেকিস্তানের লেনিন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেনিনের জাতিসত্তা বিষয়ক প্রশ্ন নিয়ে (“The Leninist Nationalist Policy in Central Asia”) গবেষণা করে লেনিন বিশ্ববিদ্যালয় হতেও ডক্টরেট পেয়েছেন। এই উপলক্ষে তাঁকে তিন বছর কাল তাশকন্দে থাকতে হয়েছিল। তিনি আমায় বলেছেন যে, তাশকন্দেই তিনি প্রথম আমার পুস্তক “প্রবাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন”[৭] পড়েন। তা থেকে তাঁর মনে মুহাজিরদের থাকার জায়গাগুলি দেখার বাসনা জাগে। ভারতীয় মুহাজিরদের সময়ের কোনো কাগজপত্র পাওয়া যায় কিনা তারও অনুসন্ধান তিনি করতে থাকেন। এই অনুসন্ধানের ফলে তিনি উজবেকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির মুহাফিজখানায় (Archives ) একটি নথি পেয়ে যান (F.60, ed. NO 724, L. 1-4) এফ ৬০, এড নম্বর ৭২৪, এল, ১-৪ নম্বরের এই নথিটি মুহাফিজ সাহেব নিজেই ডক্টর কৌশিককে খুঁজে বার করে দিয়েছিলেন। এই নথির ভিতরে ডক্টর কৌশিক ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকটি মূল্যবান দলীল আবিষ্কার করেন। আমার মনে হয় এত মূল্যবান দলীল যে তিনি পেয়ে যাবেন সে কথা আগে তিনি চিন্তাও করতে পারেননি নিম্নলিখিত দলীলগুলি ওপরে উল্লেখ করা নথিতে ছিল :

(১) তাশকন্দের যে সভায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রথম স্থাপিত হয়েছিল তার অতি সংক্ষিপ্ত কার্য-বিবরণী (Minutes);

(২) নব গঠিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পরবর্তী একটি সভার সংক্ষিপ্ত কার্য বিবরণী (Minutes);

(৩) তাশকন্দে যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি স্থাপিত হয়েছে তার খবর দিয়ে তুর্কিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিকে লেখা একখানা পত্ৰ।

(১৯২০ সালে এই পার্টির নাম তুর্কিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি ছিল। তখনও ভিন্ন ভিন্ন নামের রিপাবলিকগুলি তুর্কিস্তানে গঠিত হয়নি।)

[7. The Communist Party of India and its Formation Abroad, National Book Agency Private Limited Kolkata – 73, Bengali, 1961, English 1962.]

ডক্টর কৌশিকের পাওয়া তিনটি দলীলই আমি নীচে তুলে দিলাম :

1

“Formed the Indian Communist Party in Tashkent on Oct. 17, 1920 with the following members :

1. M.N. Roy

2. Evelina Trent Roy

3. A. Mukherjee

4. Rosa Fittingof

5. Mohd. Ali (Ahmed Hasan )

6. Mohd. Shafiq Siddiqui and

7. Acharya, M. Prativadi Bayankar

The period of probation for Candidate members would be three months. Mohd. Shafiq is elected Secretary.

The Indian Communist party adopts the prinicpales proclaimed by the Third International and undertaakes to work out a programme adapted to the indian Condition.

(sd.) President: M. Acharya

(sd.) M. N. Roy, Secretary”

2

Further, in the Party Archives, Tashkent, are given the minutes of a subsequent meeting held on December 15, 1920. It reads as follows:

“Resolved to admit abdul qadir Sehraai, Masud Ali Shaah Kazi and akbaar shah as candidate members.

An Executive Committee of Roy, Shafiq and Acharya is elected.”

3

Also preserved among the documents is a communication sent by roy to the Central Committee of the Communist Party of Turkestan. It has been signed by roy as the Secretary concerned. (The Russian term is otvestvenny secretar’). There is another signature also thereupon which is illegible. Roy signed in bold letters in Russian in red ink. It read as under :

“This is to state that the Communist Party of India has been organized here. It is working in conformity with the principles of the Third International under the political guidance of the Turkestan Bureau of the Comintern.”

বাঙলা অনুবাদ

(১)

“নিম্নলিখিত সভ্যগণকে নিয়ে [আজ] ১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবর তারিখে তাশকন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হলো :

(১) এম. এন. রায়

(২) এভেলিনা ট্রেন্ট রায়

(৩) এ মুখার্জি

(৪) রোজা ফিটিংগোফ

(৫) মুহম্মদ আলী (আদ হাসান)

(৬) মুহম্মদ শফীক সিদ্দিকী এবং

(৭) এম. প্রতিবাদী বায়াঙ্কর আচার্য

প্রার্থী সভ্য থাকার মেয়াদ হবে তিন মাস। মুহম্মদ শফীক সেক্রেটারী নির্বাচিত হলেন।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি থার্ড ইন্টারন্যাশনালের বিঘোষিত নীতির

অনুসরণ করবে এবং ভারতের অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে একটা প্রোগ্রামও রচনা করবে।

(স্বাক্ষর) সভাপতি : এম আচার্য

(স্বাক্ষর) এম. এন. রায়, সেক্রেটারী।”

(২)

তাশকন্দে উজবেকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির মুহাফিজখানায় (Archives) একই নথিতে (ফাইলে) ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পরবর্তী একটি সভার অতি সংক্ষিপ্ত কার্যবিবরণীও পাওয়া গিয়েছে। এই সভা মিলিত হয়েছিল ১৯২০ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৫ই তারিখে। তাতে দুটি প্রস্তাব গৃহীত হয় :

“সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো যে আবদুল কাদির সের্রাই, মউদ আলি শাহ্ কাজী ও আকবর শাহ্ পার্টির প্রার্থী সভ্য হলেন।

“রায়, শফীক ও আচার্যকে নিয়ে পার্টির একটি কার্যকরী কমিটি (Executive Committee) নির্বাচিত হলো।”

(৩)

উজবেকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির মুহাফিজখানায় (Archives ) তুর্কিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির সেন্ট্রাল কমিটিকে লেখা রায়ের একখানা পত্রও পাওয়া গিয়েছে। এই পত্রে কোনও তারিখ নেই। রায় তাতে বড় রুশ হরফে লাল কালিতে নিজের নাম সই করেছেন। তিনি নিজেকে বলেছেন সংসৃষ্ট সেক্রেটারী (Otvestvenny Secretaar) এই পত্রে আরও একটি দস্তখৎ আছে। তা অস্পষ্ট এতে লেখা আছে :

“এতদ্বারা জানানো হচ্ছে যে এখানে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করা হয়েছে। থার্ড ইন্টারন্যাশনালের নীতি মেনে এবং কমিনটার্নের তুর্কিস্তান ব্যুরোর রাজনীতিক পরিচালনায় পার্টি কাজ করছে।”

১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবর তারিখে যে সাতজন সভ্যকে নিয়ে তাশকন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রথম স্থাপিত হয়েছিল তাঁদের ভিতরে একজনও ১৯২০ সালে তুর্কিস্তানে-আসা ভারতের মুহাজির যুবক ছিলেন না। অথচ, মানবেন্দ্রনাথ লিখেছেন যে তাঁদেরই জেদাজেদির বশে তিনি একাজে এগিয়ে এসেছিলেন। এই সাতজন সভ্যের ভিতরে এভেলিনা ট্রেন্ট রায় মানবেন্দ্রনাথের আমেরিকান স্ত্রী এবং প্রথমা স্ত্রী। রোজা ফিটিংগোফ অবনী মুখার্জির রুশীয় স্ত্রী। মুহম্মদ আলী লাহোরের মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন। সেই অবস্থায় ১৯১৫ সালে তিনি ভারত ত্যাগ করেছিলেন। তা ছাড়া অনেক আগে হতেই তিনি, নিজেকে কমিউনিস্ট বলে ঘোষণা করেছিলেন। মুহম্মদ শফীকও ১৯২০ সালে মুহাজির ছিলেন না। তিনি ১৯১৯ সালে ভারত ছেড়েছিলেন এবং রাজনীতিক কারণে ছেড়েছিলেন। আচার্য ১৯০৮ সালে ভারতবর্ষ ত্যাগ করেছিলেন। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ওফে মানবেন্দ্রনাথ রায় ও অবনী মুখার্জি ভারতবর্ষ ছেড়েছিলেন ১৯১৫ সালে।

রায় যখন তাঁর স্মৃতিকথা লিখেছিলেন তখন তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে তাশকন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি স্থাপন বিষয়ক সংক্ষিপ্ত কার্যবিবরণীগুলি (Minutes) উজবেকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির মুহাফিজখানায় লুকিয়ে আছে এবং ডক্টর দেবেন্দ্র কৌশিক নামক এক ব্যক্তি সেগুলি একদিন আবিষ্কার করবেন। গরজ বড় বালাই। তারই তাগিদে এম এন রায়কে তাশকন্দে পার্টি প্রতিষ্ঠার কাজে অগ্রসর হতে হয়েছিল। মেকশিকোর কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিরূপে তিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি একজন ভারতীয় ছিলেন বলেই কংগ্রেসে তাঁর সব রকমের আদর-কদর হয়েছিল। কংগ্রেসের পরেও তিনি প্রাচ্য দেশের, বিশেষ করে ভারতে কাজের ভার পেয়েছিলেন। অদূর ভবিষ্যতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও তখন ছিল না। আর মেকশিকো তো তিনি চিরদিনের জন্যে ছেড়ে এসেছিলেন। তিনি নানা জায়গায় লিখেছেন যে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ভিতরে তিনি নিজেই নিজের প্রতিনিধি ছিলেন। কারণ, লেনিন তাঁকে নিমন্ত্রণ করে মস্কো আনিয়েছিলেন। রায়ের এসব কথা শূন্যগর্ভ আত্মম্ভরিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। মাইকেল বরোদিনের রিপোর্টের ভিত্তিতে লেনিন তাঁকে মস্কোতে ডেকেছিলেন একথা সত্য। কিন্তু তিনি শূন্য হাতে মস্কো আসেননি। তাঁর মুরুব্বি বরোদিনের পরামর্শে তিনি মেক্‌শিকোর সদ্যগঠিত কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি হয়ে এসেছিলেন। এ সব কথা তাঁর স্মৃতিকথায় লেখা আছে। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ভিতরে কোনো না কোনো কমিউনিস্ট পার্টির (নাম কমিউনিস্ট পার্টি নাও হতে পারে) প্রতিনিধিরাই শুধু পদ-মর্যাদার কাজে নিয়োজিত হতে পারতেন। একথা বরোদিন তাঁকে মেক্‌শিকোতেই বুঝিয়েছিলেন। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে তৃতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন ঘনিয়ে আসছিল। তাই এম এন রায়কে বাধ্য হয়েই তাশকন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ভিত্তি স্থাপন করতে হয়েছিল। তা না হলে তৃতীয় কংগ্রেসের সময়ে কোথায় দাঁড়াতেন তিনি? কার প্রতিনিধি হতেন?

কিন্তু একথা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিনে যে কেন প্রথম সাতজন সভ্যের ভিতরে একজনও ১৯২০ সালে মুহাজির থাকলেন না? এই মুহাজিররাই তো তাশকন্দে কিংবা পরে মস্কোতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য হওয়ার সম্ভাব্য লোক ছিলেন। সেই সময়ে তাঁরাই ছিলেন রায়ের নিকটে অভাবনীয় সৌভাগ্যস্বরূপ একথা বললে অত্যুক্তি করা হয় না। ১৯২০ সালের ১৫ই ডিসেম্বর তারিখের একটি পার্টি সভায় ১৯২০ সালের মুহাজিরদের ভিতর হতে তিনজনকে প্রার্থী সভ্যরূপে গ্রহণ করা হয়েছিল। এই তিনজনের দুজন, আব্দুল কাদির সেহরাই [খান] ও মসউদ আলী শাহ্ আবার ছিল সন্দেহভাজন ব্যক্তি।

আবদুর রব ও আচার্য কে?

তাশকন্দেই মৌলবী আবদুর রব ও এম প্রতিবাদী বায়াঙ্কার আচার্যের সঙ্গে এম এন রায়ের সম্পর্ক খারাপ হয়েছিল। রায় তাঁর স্মৃতিকথায় মৌলবী আবদুর রবকে “প্রতারক” (Impostor) ও আচার্যকে “এনার্কিস্ট” বলে বাতিল করে দিয়েছেন। তাঁদের যৎসামান্য পরিচয় এখানে দেওয়া দরকার। মৌলবী আবদুর রব সম্ভবত পেশোয়ার জিলার লোক। কারণ তাঁকে আবদুর রব পেশোয়ারীও বলা হয়। যতটা জানতে পেরেছি, তিনি একজন বহু ভাষাবিৎ, সুবক্তা পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের অধীন উচ্চ কর্মচারী ছিলেন। তাঁর এই চাকরী হয়তো কূটনৈতিক বিভাগে ছিল। তাঁরই সংগৃহীত মাল-মসলা একত্র করে মাক্রান একটি দুরধিগম্য স্থান ছিল। একবার যিনি মাক্রানে গিয়েছেন তার কষ্টকর অভিজ্ঞতা তাঁর মনে দুঃস্বপ্নের মতো বরাবর জাগরূক থেকেছে। এই গেজেটিয়ারের ভূমিকায় লেখা হয়েছে :

“In the present work an endeavour has been made to collate whatever published information is available and to supplement it with material gleaned from the country itself. For the purpose one of our Gazetteer assistants Maulavi Abdur Rab, was deputed to Makran, Where he sepent 14 months investigating actual conditions in situ during 1903-4, and I am indebtd to him for the local material included in this work.”

(Belchistan Distric Gazetter Series, Vol VII MAKAN by R. Hughes Buller, I.C.S (Bombay 1906, p iv)

১৯০৩-৪ সালে মৌলবী আবদুর রব যে চৌদ্দ মাস মাকরানে থেকে মাকরান গেজেটীয়ারের জন্যে স্থানীয়ভাবে মাল-মসলা জোগাড় করেছেন তার জন্যে গেজেটীয়ারের সম্পাদক মিস্টার আর হিউজেস্ বুলার, আই সি এস তাঁর নিকটে ঋণ স্বীকার করেছেন।

এর পরের ক’বছর কোথায় কোথায় কি কি কাজে মৌলবী আবদুর রব নিযুক্ত ছিলেন তা আমি জানিনে। ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের “অপ্রকাশিত রাজনৈতিক ইতিহাস (১৯৫৩)’ হতে জানা যায় যে ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার সময়ে তিনি বাগদাদের ব্রিটিশ দূতাবাসে উচ্চ কর্মচারী ছিলেন। তুর্কিরা জার্মানীর পক্ষে এবং ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যোগ দেওয়ার ইংরেজরা বাগদাদের দূতাবাস তুলে দিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার সময়ে কিন্তু তাঁরা মৌলবী আব্দুর রবকে এই ভরোসায় পেছনে রেখে গেলেন যে মুসলমান হওয়ার সুযোগ নিয়ে তিনি পেছন হতে ইংরেজদের সংবাদ সরবরাহ করবেন। আবদুর রব অবশ্য তা করলেন না। তিনি সোজাসুজি তুর্কিদের পক্ষে অতএব জার্মানীর পক্ষেও যোগ দিলেন। আমার মনে হয় জীবনে এই প্রথম আবদুর রব ব্রিটিশ- বিরোধী রাজনীতিতে নিজেকে জড়ালেন। যুদ্ধের পরে তাঁকে আঙ্গোরায়, আফগানিস্তানে এবং ১৯১৯ সালে সোবিয়েৎ দেশেও দেখা যায়।

এখন আমি দক্ষিণ ভারতের আচার্যের কথা কিছু বলি। আমাদের দেশের পুলিস রিপোর্টে তাঁর নাম লেখা আছে ম্যান্ডারাম পার্থসারথি তিরুমালাই আচার্য (Mandayam Parthasarathi Tirumalai Acharya)। কিন্তু ১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবর তারিখে পার্টির সভায় তিনি নিজের হাতে নাম সই করেছেন এম. প্রতিবাদী বায়াঙ্কার আচার্য (M. Prativadi Bayankar Acharya)। আচার্যরা আসলে মহীশূরের বাশিন্দা ছিলেন। তবে, তাঁর পরিবারের লোকেরা বহু বৎসর হতে মাদ্রাসে বাস ইখতিয়ার করেছিলেন। দেশে ছাত্রজীবনে তিনি কোনো বৈপ্লবিক দলের সংস্রবে এসেছিলেন কিনা তা আমি জানিনে। ১৯০৮ সালে সম্ভবত পড়াশুনা করার উদ্দেশ্যে লন্ডনে গিয়ে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তখন তিনি বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সহকর্মী হয়েছিলেন। ফরাসী দেশেও তিনি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে একত্রে এনার্কো কমিউনিস্ট পার্টির সংস্রবে এসেছিলেন। তিনি ইউরোপ ও আমেরিকায় ঘুরেছেন। আবদুর রবের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় ও বন্ধুত্ব যতটা আন্দাজ করা যায় প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে হয়েছিল। তাঁদের একত্রে আফগানিস্তানে দেখা গেছে। এম. এন. রায় রুশ দেশে যাওয়ার অনেক আগে ১৯১৯ সালে তাঁরা সে দেশে গিয়েছেন। ১৯১৯ সালেই তাঁরা লেনিনের সঙ্গে দেখাও করেছেন।

এম. এন. রায় কেন আচার্যকে এনার্কিস্ট বলেছিলেন তা সহজেই বোঝা যায়। ১৯২০ সালে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসের সময়ে মস্কোতে আচার্য হয়তো নিজেই রায়কে বলে থাকবেন যে ইউরোপে তিনি এনার্কিস্টদের সংস্রবে এসেছিলেন। কিংবা অন্য কেউ রায়কে এ খবর দিয়ে থাকবেন। কিন্তু তিনি আব্দুর রবকে কেন প্রতারক বলেই বাতিল করে দিয়েছেন সে সম্বন্ধে কোনো কথাই তিনি তাঁর লেখায় প্রকাশ করেননি। একজন লোককে প্রতারক বলার আগে তিনি কোথায় কি প্রতারণা করেছেন তার কিছু আভাস অন্তত দেওয়া উচিত ছিল। শুনেছি আচার্য সোবিয়েৎ দেশে হতমান হয়েও একজন রুশ বিবী সঙ্গে নিয়ে জার্মানীতে ফিরেছিলেন। তখন আবার তিনি তাঁর পুরনো নৈরাজ্যবাদের দিকে ঝুঁকেছিলেন। ‘এনার্কো সিন্ডিকালিস্ট’ ও ‘ফোর্থ ইন্টারন্যাশনালের সভ্য বলে তিনি তখন নিজের পরিচয় দিতেন। এ জন্যেই কি মহীশুরে ও দক্ষিণ ভারতের কোনো কোনো স্থানে ‘ফোর্থ ইন্টারন্যাশনালের’ নাম শোনা যায়? শেষ জীবনে আচার্য দেশে ফিরেছিলেন, বোম্বেতে থাকতেন এবং শুনেছি এখন (১৯৬৭) তিনি আর বেঁচে নেই।

১৯২০ সালে তাশকন্দে ও পরে সম্ভবত মস্কোতেও মুহাজিরদের ভিতরে আচার্য ও আবদুর রবের নাম একত্রে উচ্চারিত হতো। দেখা যাচ্ছে যে তাঁদের এই বন্ধুত্বে চিড় ধরেছিল। মানবেন্দ্রনাথ রায় এনার্কিস্ট বলে আচার্যকে বাতিল করে দিয়েছিলেন। আবার দেখা গেল, আচার্যকে সঙ্গে নিয়েই তিনি তাশকন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম ভিত্তি স্থাপন করলেন। তাতে আব্দুর রব নেই। তার মানে আবদুর রবের বন্ধন হতে রায় অন্তত সাময়িকভাবে আচার্যকে মুক্ত করেছিলেন। রায়ের চরিত্র সত্য সত্যই অধীত হওয়ার দাবি রাখে।

আবদুর রবের চরিত্রও অধীত হওয়া প্রয়োজন। কাগজ-পত্র পড়ে আমি যতটা বুঝেছি তাতে তিনি ধর্মোন্মাদ ছিলেন না। একজন ঝানু খিলাফৎ ওয়ালাও ছিলেন না তিনি। ভোপালের রফীক আমদের জবানিতে শোনা তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত আমি আমার “প্রবাসে ভারতের কমিউনিস্ট পর্টি গঠন” নামক পুস্তকে লিখেছিল। তাঁর মুখে যত কথা শুনেছি তার সব কথাই লিখে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাতে লেখাটা অনেক বড় হয়ে যেত। সেই সময়ে তিনি আবদুর রব সম্বন্ধেও অনেক কথা বলেছিলেন। সে সব কথা আমি খুব কম লিখেছি, লিখিনি বললেও চলে। তা ছাড়া, আবদুর রব সম্বন্ধে অনেক কথা তিনিও জানতেন না। হালে (১৯৬৭) রফীক আহমদ ভোপাল হতে আবার আমায় আবদুর রবের কথা লিখেছেন। এখন ভাবছি রফীক আমদের দেওয়া আবদুর রবের বিষয়ে কিছু বৃত্তান্ত এখানে দেওয়া দরকার। রফীক আহমদরা ১৯২০ সালের ১লা মে কিংবা তার কাছাকাছি সময়ে কাবুলে পৌঁছেছিলেন। সেই সময়ে মৌলবী আবদুর রব ও আচার্য সেখানে ছিলেন। রফীক আহমদ বলছেন :

“রুশ দূতাবাসের একটি হলঘরে দক্ষিণ ভারতের আচার্য ও মৌলবী আবদুর রবের সঙ্গে আমাদের দেখা হলো। চা ও কেক খাওয়ার পরে তাঁর সঙ্গে আমাদের কথা শুরু হয়। মৌলবী আবদুর রব বললেন তিন-চার মাস আগে তাঁরা রুশ হতে কাবুলে এসেছেন। কাবুলের অবস্থা হচ্ছে এই যে, বাদশাহ্ আমানুল্লাহ্ যে- কোনো মূল্যের পরিবর্তে ব্রিটিশের সঙ্গে সন্ধি করতে চান। এই কারণে নিরাশ হয়েই তার সঙ্গীদের নিয়ে তিনি রুশে চলে যাচ্ছেন। এই সঙ্গীরা ছিলেন কিছু সংখ্যক ভারতীয়। তিনি বললেন, সে দেশে বিপ্লব হয়ে গেছে। বিপ্লবী সরকার আমাদের সব রকমের কাজে সাহায্য করবেন ও সুযোগ দিবেন। তখন একথাও আবদুর রব বলেছিলেন যে রুশ হতে কেউ যদি আনাতোলিয়ায় যেতে চান তারও ব্যবস্থা করা হবে। পরে দেখা গেছে যে এ সুযোগ সোবিয়েৎ গবর্নমেন্ট বরাবর ভারতীয় মুহাজিরদের দিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা আনাতোলিয়ায় প্রবেশ করার অনুমতি কখনও পাননি। আমাদের মধ্য হতে যাঁরা আবদুর রবের সঙ্গ রুশে যেতে চান তিনি তাঁদের নাম চাইলেন। বললেন, পরের দিন তিনি আবার বাদশাহের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। তখন তাঁর কাছ হতে তিনি অনুমতি নিয় নিবেন। রফীক আহমদ সহ’ ক’জন ওখানেই তাঁদের নাম লিখে দিয়েছিলেন। পরের দিন মুহম্মদ আকবর খান (?), মুহম্মদ আকবর শাহ, সুলতান মুহম্মদ ও গওহর রহমান খানের সঙ্গে যখন মৌলবী আবদুর রবের দেখা হয়েছিল তখন তিনি তাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন যে বাদশাহ্ আমানুল্লাহ্ মুহাজিরদের রুশে যাওয়ার অনুমতি দিবেন না। এর মধ্যে তিনি বোধ হয় বাদশাহের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আবদুর রব ভারতীয় মুহাজিরদের তখন এই উপদেশ দিয়েছিলেন যে তাঁদের সকলে আনাতোলিয়া যাওয়ার প্রার্থনা করে বাদশাহের নিকটে দরখাস্ত করুন। মুহাজিররা তাই করেছিলেন, আবদুর রব মুহাজিরদের বলেছিলেন, ‘আপনারা ধীরেসুস্থে পরে আসুন। আমি আপনাদের জন্যে তাশকন্দে অপেক্ষা করতে থাকব।’ এরপরে আবদুর রব ধরলেন তাশকন্দের পথ, আর আমরা গেলাম জবলুস্ সিরাজে। পোশাক তৈয়ার করাবার জন্যে তিনি কয়েকজনকে তিন পাউণ্ড হিসাবে সাহায্য করেছিলেন।”

এই থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে আবদুর রব গোঁড়া খিলাফৎওয়ালা একেবারেই ছিলেন না। তিনি মুহাজিরদের আনাতোলিয়া যাওয়ার উৎসাহ না দিয়ে বিপ্লবের দেশ রুশে যাওয়ার জন্যেই উৎসাহিত করেছেন। তাঁর মত ও পথ কি ছল? তিনি নিজেকে কমিউনিস্ট বলে ঘোষণা করতেন। তাই যদি তিনি ছিলেন তবে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেন না কেন? তাঁর মতে তাশকন্দে গঠিত কমিউনিস্ট পার্টি যদি প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি না হয়ে থাকে তবে তাতে যোগ দিয়ে তিনি তাকে প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টিরূপে গড়ে তুলতে পারতেন। তাঁরও অনুগামীর সংখ্যা কম ছিল না। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের অনেক আগে হতে তিনি রুশ দেশে যাতায়াত করেছেন। রায়ের ওদেশে আসার অনেক আগে তিনি লেনিনের সঙ্গে দেখা করেছেন। কিন্তু তাঁর কাজের কি প্রভাব ভারতের রাজনীতিতে পড়েছিল তা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিনে।

ডক্টর দেবেন্দ্র কৌশিক উজ্‌বেকিস্তানে থাকার সময়ে পুরনো দিনের স্থানীয় খবরের কাগজগুলি হতে যে সব তথ্য সংগ্রহ করেছেন [৮] তাতে আছে যে কাবুল হতে ভারতীয় বিপ্লবীদের একটি ছোট দল ১৯১৯ সালের মার্চ মাসে তাশকন্দে পৌছেছিলেন। ডক্টর কৌশিকের সংগৃহীত তথ্য হতে তিনি বলছেন যে এই দরের নেতৃত্বে ছিলেন আবদুর রব। কিন্তু ব্রিটিশ গোয়েন্দা অফিসার কর্নেল বেইলী (Col. Bailey) তখন তাশকন্দে ছিলেন। তাঁর “মিশন টু তাশকেন্ট” (“Mission to Tashkent”) নামক পুস্তকে তিনি লিখেছেন যে এই দলের নেতা বরাকাতুল্লাহ্ ছিলেন। ডক্টর কৌশিক অবশ্য একথাও তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের আনুষ্ঠানিক প্রথম কংগ্রেসের অধিবেশন হয়েছিল ১৯১৯ সালে ২রা মার্চ হতে ৬ই মার্চ পর্যন্ত। কাজেই এটা বোঝা যাচ্ছে যে বরাকাতুল্লাহ্ আর আবদুর রবেরা সোবিয়েৎ গবর্নমেন্টেরই অতিথি তখন হতেন, কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের নয়। আবদুর রব খুব সুবক্তা ছিলেন। তার ওপরে, তিনি তুর্কি ভাষায় বক্তৃতা দিতে পারতেন। এই জন্য তিনি তাশকন্দের বাশিন্দাদের নিকটে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। ডক্টর কৌশিকের লেখা পড়ে বোঝা যাচ্ছে যে তাশকন্দের পুরানো লোকেরা এখনও আবদুর রবকে স্মরণ করেন।

[8. LINK (English Weekly) Delhi, January 26, 19”, P. 72]

পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে আবদুর রব কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বপ্রিয় লোক ছিলেন। তাশকন্দে মানবেন্দ্রনাথ রায়কে দেখে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। নেতৃত্ব যে রায়ের হাতেই চলে গেছে এটা তিনি সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে নিয়েছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত নেতৃত্ব অপেক্ষা যে বিপ্লবী পার্টি বড় এই সাংগঠনিক তত্ত্ব তাঁর মনকে স্পর্শ করতে পারেনি। মুহাজিরদের নিয়ে তিনি তাঁর নিজের দল গড়তে লাগলেন। যদিও তিনি নিজেকে কমিউনিস্ট বলে ঘোষণা করেছিলেন তবুও তাঁর পকেটে “ভারতীয় বিপ্লবীদের সমিতি” (Association of Indian Revolutionaries) নামে অপর একটি সংগঠন ও ছিল। ডক্টর ভূপেন্দনাথ দত্ত যে এই সংগঠনকে “ভারতীয় ন্যাশনালিস্ট সমিতি” নামে উল্লেখ করেছেন তা সম্পূর্ণ ভুল। মস্কোতে আবদুর রব মুহাজিরদের নিয়ে তার আলাদা পার্টি গড়ছিলেন। পরে পেশোয়ারে ফিরে এসে কিছু সংখ্যক মুহাজির যুবক পুলিসের নিকটে নানান রকম বিবৃতিতে বলেছেন, তাঁদের মধ্যে কে কে আবদুর রবের দলে ছিলেন, আর কে কে ছিলেন রায়ের দলে, অর্থাৎ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে। তাশকন্দে থাকতে থাকতেই দক্ষিণ ভারতীয় আচার্যের সঙ্গে রায়ের ঝগড়া আরম্ভ হয়েছিল। তিনি (রায়) প্রস্তাব করেছিলেন যে আচার্য দেশে ফিরে গিয়ে গা-ঢাকা দিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন গড়ে তুলতে থাকুন। ১৯০৮ সালে যিনি ভারত ত্যাগ করে বিদেশে নির্বাসিতদের দলভুক্ত হয়েছিলেন তাঁর পক্ষে এভাবে দেশে ফিরে কাজ করা সম্ভব ছিল না। আচার্য ভাবলেন তাঁকে অপদস্থ করার জন্যেই রায় এ ধরনের প্রস্তাব তুলেছেন। আচার্য পালটা প্রস্তাব কররেন যে রায় কমিউনিস্ট পার্টিতে থাকার উপযুক্ত নন। তাঁর নাম পার্টি হতে কেটে দেওয়া হোক। তুর্কিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি এ ঝগড়া মেটাবার চেষ্টা করার কথা বলে দিলেন। মস্কোর সিদ্ধান্ত আচার্যের বিরুদ্ধে গিয়েছিল। তার পরে আচার্য আবার আবদুর রবের দলে ভিড়েছিলেন। পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত “মস্কো ষড়যন্ত্র মোকাদ্দমা”র (১৯২২-২৩) কাগজ-পত্রে পাওয়া যাচ্ছে যে আবদুর রব শেষ পর্যন্ত আমেরিকান রিলিফ মিশনের হয়ে কাজ করছিলেন।[৯] সোবিয়েৎ গবর্নমেন্ট ও কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল তাঁর এ কাজের সমর্থন করেননি। সুতরাং সোবিয়েৎ দেশে হতমান হয়ে তিনিও জার্মানী গিয়েছিলেন। রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ ৩০-৮-১৯৬৭ তারিখে আমায় লিখেছেন, মৌলবী রবের তুর্কি স্ত্রী ছিলেন। তাই কোনো তুর্কি অফিশিয়েলের অনুরোধে তাঁকে স্তাম্বুল যেতে দেওয়া হয়েছিল। তিনি নিশ্চয় তুর্কিতেই মরেছেন। রাজা শুধু শুনেছেন যে মৌলবী রব আর বেঁচে নেই।

[9. ১৯২১ সালের জুলাই মাসে ম্যাক্সিম গোর্কি আমেরিকান রিলিফ এডমিনিস্ট্রেশনের (A.R.A) চেয়ারম্যান হার্বার্ট হুবারকে অনুরোধ জানালে তিনি সাহায্য করতে রাজী হন। সোবিয়েৎ কর্তৃপক্ষ এবং আমেরিকান রিলিফ এডমিনিস্ট্রেশনের মধ্যে কাজ চালাবার একটি পদ্ধতি স্থির হয়ে যায়। অন্যান্য ইউরোপীয় দাতব্য সংগঠনও সাহায্য করেছিলেন। সবচেয়ে বেশী সাহায্য এ. আর. এ. যখন বিতরণ করেছিলেনর (মার্চ, ১৯২১) তখন দৈনিক প্রাপকের সংখ্যা শিশু ও বয়স্কতে মিলিয়ে এক কোটিতে উঠেছিল। (এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, ঊনবিংশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭১৪, কলম ২)]

মুহম্মদ আকবর খান তাঁর এক মুলাকতকারীকে বলেছেন যে তাশকন্দে “ইন্ডিয়া হাউসে” বাস করার সময়ে আবদুর রব পেশাওয়ারীর সহিত তাঁর দিনের পর দিন আলোচনা হয়েছে। তাতে তিনি বুঝেছিলেন:

(১) ইস্লামে তাঁর বিশ্বাস তখনও রয়েছে;

(২) তিনি আনওয়ার পাশার লোক।

ভারতের প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল

মানবেন্দ্রনাথ রায়ের প্রেরণায় একাধিক দলে বিভক্ত হয়ে যে-সব মুহাজির যুবক মস্কো এসেছিলেন তাঁরা নবগঠিত “শ্রমজীবী প্রাচ্যের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়” (“Communist University of the Toiling East”) স্থাপিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাতে ভর্তি হয়েছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ২১ শে এপ্রিল তারিখে। মস্কো আসার পরে এই যুবকদের ভিতর হতে অনেকেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। এই সময়ে (১৯২১) ভারতের এই প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বারা স্বীকৃতও হয়। খুব অল্প সংখ্যক সভ্য নিয়ে অন্য দেশের কমিউনিস্ট পার্টিও যে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল তার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। প্ৰায় পঞ্চাশজন সভ্যের বারোজন প্রতিনিধি নিয়ে ১৯২১ সালের ১লা জুলাই তারিখে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেসের অধিবেশন হয়েছিল। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধিও তার স্বীকৃত এই পার্টির কংগ্রেসে উপস্থিত ছিলেন।

আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে এমন সভ্যরাও ছিলেন (হয়তো এখনও আছেন) যাঁরা প্রবাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হওয়ার কথা বিশ্বাস করতেন না। আর যাঁরা পার্টি গঠিত হওয়ার কথাই মানবেনই না, তাঁরা প্রবাসী পার্টির কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সহিত সংযুক্ত হওয়ার কথা মানবেন কি করে?

ভারতের কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সহিত সংযুক্ত হওয়ার কথা মানবেন কি করে?

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির এই সকল সভ্যের মন হতে তখনও জাতীয়তাবাদের ঘোর কাটেনি। ঊনিশ শ’ বিশের দশকের পার্টির প্রথম সভ্যদের মধ্যে শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গ বিদেশে পার্টি গঠিত হওয়ার কথা স্বীকার করতে বটে, কিন্তু সেই পার্টি যে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের অঙ্গীভূত ছিল এই কথা সেও মানত না। আমার “প্রবাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন” নামক পুস্তক প্রকাশিত হওয়ার পরে সে আমাকে তার এই লিখিত অভিমত জানিয়েছিল।

ভারতে প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টি যে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সহিত সংযুক্ত হয়েছিল এবং ১৯২১ সালেই হয়েছিল সেই সম্বন্ধে আমি কিছু কিছু তথ্য ও প্রমাণ এখানে উপস্থিত করছি :

[এক]

কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের অনুরোধে পশ্চিম ইউরোপ হতে বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কয়েকজন জাতীয়তাবাদী ভারতীয় বিপ্লবী মস্কো এসেছিলেন। তাঁদের নাম :

(১) বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়

(২) ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (তখনও ডক্টর হননি)

(৩) বীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত

(৪) সৈয়দ আবদুর ওয়াহিদ

(৫) অধ্যাপক পান্ডুরঙ্গ খানখোজে

(৬) হেরম্বলাল গুপ্ত

(৭) গুলাম আম্বিয়া খান লুহানী

(৮) আগনেশ স্মেডলি

(৯) নলিনী গুপ্ত

শেষেক্তো তিনজন ছাড়া আর সকলে প্রথম মহাযুদ্ধের সময় সাম্রাজ্যবাদী জার্মানীর সহিত একটা সমঝোতা করেছিলেন। তার শর্ত ছিল এই যে সাম্রাজ্যবাদী জার্মানী ভারতীয় বিপ্লবীদিগকে প্রচুর অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করবেন, আর তাই দিয়ে ভারতীয় বিপ্লবীরা জার্মানীর শত্রু ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষে ব্যাপক অভ্যুত্থান ঘটাবেন। সাম্রাজ্যবাদী জার্মান ভারতীয় বিপ্লবীদিগকে অর্থ সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু সেই সাহায্য সুপ্রচুর ছিল কিনা তা আমার জানা নেই। তবে, অস্ত্র সাহায্য যে জার্মানী দিতে পারেনি এটা সত্য কথা। ভারতীয় বিপ্লবীরা বিদেশে যে জার্মানীর নিকট হতে অর্থ সাহায্য পেয়েছিলেন তার জন্যে তাঁরা জার্মানীর নিকটে কৃতজ্ঞ ছিলেন। রাজা মহেন্দ্র প্রতাপের আত্মকথা হতে জানা যায় যে কাইজারের গবর্নমেন্টের পতনের পরও ভারতীয় বিপ্লবীরা জার্মান গবর্নমেন্টের নিকট হতে সাহায্য পেয়েছেন।

যাই হোক, এই ভারতীয় বিপ্লবীরা কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সহিত কথাবার্তা চালাবার জন্যে বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মস্কো গেলেন। ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবী হিসাবে চট্টোপাধ্যায় চাইতেন না যে ভারতে তখন কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হোক। আশ্চর্য এই, নিজে কিন্তু তিনি তখন এনর্কিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বারা নিয়োজিত একটি কমিশনের সামনে তিনি এই প্রস্তাব তুলে ধরলেন যে একটা ‘ রেভোলিউশনারী বোর্ড’ গঠন করে তার মারফতে ভারতের কাজ চালানো হোক। কমিউনিস্ট পার্টি গড়তে হয় তো ইংরেজকে তাড়ানোর পরে গড়া হবে। চট্টোপাধ্যায় সুশিক্ষিত পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু মনে হচ্ছে তিনি খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারতেন না। তাই, তিনি তাঁর কথা কমিশনের নিকটে গুলাম আম্বিয়া খান লুহানীকে দিয়ে পেশ করিয়েছিলেন। লুহানী ছিলেন একজন সিদ্ধ বক্তা ও সুলেখক।

সকলকে ব্যাপারটা বোঝাবার জন্যে এতক্ষণ আমি শুধু একটা ভূমিকা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। এবারে ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের ভাষায় আমি আসল কথাটা বলি।

“এই স্থলে বক্তব্য যে কিছুদিন পূর্বেই হঠাৎ প্রাতঃকালে মস্কোর একটি কাগজে প্রকাশিত হইল যে, একটি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হইয়াছে এবং তাহা আন্তর্জাতিক দ্বারা স্বীকৃত হইয়াছে (affiliated)। এই কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য কাহারা?-সস্ত্রীক রায়, সস্ত্রীক মুখোপাধ্যায় এবং মুহাজিরিন তরুণেরা। দ্বিতীয় কমিশন বসিবার পূর্বেই কোন এক মিটিং-এ লুহানী এই পার্টিকে উপলক্ষ্য করিয়া বলিয়াছিলেন, ‘It is a bogus paryt’ (ইহা একটি মেকি দল)। পুনরায় কমিশনের দ্বিতীয় অধিবেশনে তাঁহাদের থিসিস্ পাঠ করিবার কালে লুহানী বলিয়াছিলেন, ‘তৃতীয় আন্তর্জাতিক হইতে এই পার্টির নাম খারিজ করা হউক’ এবং তাহাদের পরিকল্পিত রেভোলিউশনারী বোর্ড-এর মধ্য দিয়ে ভারতীয় বিপ্লব আন্দোলনে সাহায্য করা হউক।”[১০] (মোটা হরফ আমার)।

[10. অপ্রকাশিত রাজনীতিক ইতিহাস নতুন সংস্করণ, এপ্রিল, ১৯৫৩]

এই উদ্ধৃতি হতে প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে যে ওই সময়ে ‘ভারতের প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টি’ কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সহিত সংযুক্ত হয়েছিল। লক্ষ্য করবার বিষয় যে গুলাম আম্বিয়া খান লুহানী কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের আয়োজিত একটি কমিশনের সামনে দাঁড়িয়েই বার্লিন হতে আসা ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীদের দাবী পেশ করেছিলেন।

ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের লেখায় সন ও তারিখের কোন বালাই নেই। ১৯২১ সালের প্রথম দিকে তাঁরা মস্কো এসেছিলেন একথা বোঝা যায়। অধ্যাপক খানখোজেকে ধন্যবাদ, তিনি অন্ততঃ লিখেছেন যে মস্কোতে তাঁরা তিন মাস ছিলেন। সব মিলিয়ে এটা বোঝা যায় যে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের তৃতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন আরম্ভ হওয়ার আগেই তাঁরা সোবিয়েৎ দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। এই তৃতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন ১৯২১ সালের ২২শে জুন তারিখে আরম্ভ হয়েছিল, আর শেষ হয়েছিল ১২ ই জুলাই তারিখে।

ডক্টর দত্ত আরও একটি কথা বলছেন যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করা সম্বন্ধে সৈয়দ আবদুল ওয়াহিদ, বীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ও তিনি তাদের দলের নেতা বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সহমত ছিলেন না। তাঁর মত ছিল এই যে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করার অধিকার একমাত্র তাঁদেরই। এই বিষয়ে দেশে তারা চিঠি-পত্র লিখেছেন। মুহাজির তরুণেরা আবার কোথাকার কে যে বিদেশে এসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করবেন? কিন্তু দেশের ভিতরে অনেক অনুসন্ধান করেও আমরা জানতে পারিনি যে তিনি কাদের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার জন্যে পত্র লিখেছিলেন। তিনি নিজে এই সম্বন্ধে আমাদের কোনো দিন কিছু বলেননি, কিছু লিখেও যাননি তাঁর পুস্তকে। ১৯২৫ সালে তিনি দেশে ফিরেছিলেন, আর মৃত্যুবরণ করেছেন ১৯৬৯ সালে। দীর্ঘ সময়।

আগনেশ স্মেডলি একজন ভারত বন্ধু আমেরিকান নারী ছিলেন। মতে তিনিও ছিলেন এনার্কিস্ট। কিছুদিনের জন্যে তিনি বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে বিয়েও করেছিলেন। নলিনী গুপ্তের পরিচয় এখানে দেওয়ার দরকার নেই। পরে তার সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা আমি করব।

ভারতের প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টির কাজ জার্মানীতেও প্রসারিত হয়েছিল। জার্মানী হতেই ১৯২২ সালের ১৫ই মে তারিখে পার্টির প্রথম পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তার নাম ছিল “দি ভ্যানগার্ড অফ দি ইন্ডিয়ান ইন্ডেপেন্ডেন্স” (ভারতীয় স্বাধীনতার অগ্রসেনা) বলা বাহুল্য, আমাদের পার্টির এই প্রথম পাক্ষিক পত্রিকাখানি ইংরেজি ভাষাতেই প্রকাশিত হয়েছিল। এর পরিচালনায় মূলতঃ মানবেন্দ্রনাথ রায় ও তাঁর আমেরিকান প্রথমা স্ত্রী এভেলিন ট্রেন্ট রায় ছিলেন। ভারতের কাগজে প্রবন্ধ লেখার সময়ে এভেলিন রায় কোন কোনো সময়ে নিজের শান্তিদেবী নামও ব্যবহার করতেন। আমাদের দেওয়া বিভিন্ন ঠিকানায় কাগজের প্যাকেটগুলি ডাকে আসত। আমরা কাগজগুলি বিভিন্ন লোকের মধ্যে বেঁটে দিতাম। কলকাতায় কোনো কোনো লোকের চিঠির বাক্সেও আমরা তা ঢুকিয়ে দিয়ে আসতাম। কোনো কোনো ঠিকানায় আবার শুধু একখানা কাগজ আসত। এগুলির আসা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ছিল। কাগজে লেখা থাকত না যে তা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র এবং এই পার্টি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের অংশ বিশেষ। যখন আমরা দেখতে পেলাম যে “ভ্যানগার্ড অব দি ইন্ডিয়ান ইন্ডেপেন্ডস” পুলিসের নিকটে বড় বেশী জানাজানি হয়ে গেছে এবং কোনো কোনো ঠিকানার প্যাকেটগুলি পুলিস আটকাতেও আরম্ভ করেছে, তখন আমি মানবেন্দ্রনাথ রায়কে পত্র লিখে জানালাম যে “এবারে কাগজের নাম পরিবর্তন করুন। তাতে হয় তো কিছু সুবিধা হতে পারে।” অন্য প্রদেশ হতে আরও কেউ এ কথা লিখেছিলেন কিনা তা আমি জানিনে, কিন্তু মানবেন্দ্রনাথ আমার পত্রোত্তরে জানিয়েছিলেন যে কাগজের নামের পরিবর্তন তিনি করবেন। তার পরেই কাগজের নাম হলো “এডভান্স গার্ড” (“অগ্রসর সেনা”)। “এড্‌ভান্স গার্ডে” ও লেখা থাকত না যে তা “ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র” ইত্যাদি। কিছুকাল পরে দেখা গেল যে “এডভান্স গার্ডের” ও আগেকার অবস্থা হয়েছে। তখন স্থির করা হলো যে আগেকার নামে ফিরে যাওয়া হোক। কিন্তু দেখা গেল যে ইতোমধ্যে ডক্টর দত্তরা, অর্থাৎ মস্কো হতে জার্মানীতে ফিরে-আসা ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীরা আমাদের প্রথম নামের অর্ধেক অধিকার করে বসেছেন। অধ্যাপাক বিনয়কুমার সরকারের সম্পাদানয়া তাঁরা “ইন্ডিয়ান ইন্ডেপেন্ডেন্স” (“ভারতীয় স্বাধীনতা”) নামে একখানা কাগজ বার করে দিয়েছেন।

“ভ্যানগার্ড অফ দি ইন্ডিয়ান ইন্ডেপেন্ডেন্স” ও “এভান্স গাড” পরিচালনা করার ভিতর দিয়ে এক বছর কেটে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সংখ্যা শুধু “দি ভ্যানগার্ড” নামেই ১৯২৩ সালের ১৫ই মে তারিখে প্রকাশিত হলো এবার আর কোনো ঘোরপ্যাচের ব্যাপার থাকল না,-পরিষ্কার ভাষায় লিখে দেওয়া হলো যে “দি ভ্যানগার্ড” ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের অঙ্গীভূত। এই সম্বন্ধে কারুর মনে যেন কোনও সন্দেহ না থাকতে পারে তার জন্যে “ভ্যানগার্ডের” দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সংখ্যায় (১৫ই মে, ১৯২৩) প্রথম পৃষ্ঠায় ফটোস্টাট কপি গ্রহণ করে তার ব্লক আমি এখানে ছেপে দিলাম। কাগজখানির দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণ করা উপলক্ষে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের একজেকিউটিব কমিটির তরফ হতে তার প্রেসিডিয়াম যে বাণী পাঠিয়েছিলেন সেই বাণীও এই প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে এর চেয়েও অকাট্য প্রমাণ আর কি থাকতে পারে?

“ভ্যানগার্ডের এই সংখ্যাটি ও তার পরবর্তী সংখ্যাগুলি আমি কখনও দেখিনি। কারণ, ১৯২৩ সালের ১৭ই মে তারিখে গিরেফতার হয়ে আমি জেলে চলে গিয়েছিলেম। কিন্তু শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে ও সচ্চিদানন্দ বিষ্ণু ঘাটে তখন বাইরে ছিল। তারা ১৯২৩ সালের ১৫ই মে তারিখের “ভ্যানগার্ড” ও তার পরবর্তী সংখ্যাগুলি দেখেছে ও পড়েছে। ডাঙ্গে ১৯২৪ সালের মার্চ মাসের আগে গিরেফতার হয়নি। ১৯২৪ সাল হতেই অর্থাৎ ডাঙ্গের গিরেফতারের পর হতে ঘাটে পার্টিতে সক্রিয় হয়েছিল। তা সত্ত্বেও তারা ভুল তথ্য সরবরাহ করেছে এবং সেই তথ্যের ওপরে নির্ভর করেই ভারতের দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্টরা ১৯৬৬ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে পার্টির চত্বারিংশ বার্ষিকী পালন করেছেন। তাঁরা ১৯২৫ সালের ডিসেম্বর মাসের কানপুর কমিউনিস্ট কনফারেন্সকেই পার্টি প্রতিষ্ঠার সময় বলে গণ্য করেছেন।

শুরু হতেই “ভ্যানগার্ড” প্রভৃতি জার্মানীতে ছাপা হয়েছে। তবুও ভারতের নানা শহরের নাম তাতে ছাপা হতো। এই সঙ্গে মুদ্রিত ব্লকে বোম্বে, কলকাতা ও মাদ্রাজের নাম ছাপা হয়েছে। লাহোরের নাম তো ছাপা হতোই, যতটা মনে পড়ছে কানপুরের নামও কোনো না কোনো সময়ে ছাপা হয়ে থাকবে। এই সকল শহরের সহিত আমাদের অল্প-বিস্তর সংযোগ ছিল।

[তিন]

১৯২৬ সালের ২২শে নভেম্বর হতে ১২ই ডিসেম্বর পর্যন্ত মস্কোতে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের বিখ্যাত সপ্তম প্লেনামের অধিবেশন হয়েছিল। ১৯২৭ সালে এই প্লেনামের শর্টহ্যান্ড রিপোর্ট রুশ ভাষায় রাশিয়াতে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়। তার রুশ ভাষায় নাম দেওয়া হয়েছে Puti Mirovoi revoliutsii, অর্থাৎ বিশ্ববিপ্লব। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম খণ্ডের অষ্টম পৃষ্ঠা হতে বিবরণ সংগ্রহ করে আমেরিকার স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবার্ট সি. নর্থ ও জেনিয়া জে. ইউদিন [১১] তাঁদের সম্পাদিত M.N. Roy’s MISSION TO CHINA : Communist Kuomintang Split of 1927 (এম. এন. রায়ের চীনের মিশন : কমিউনিস্ট কুওমিন্‌টাঙের মধ্যে ১৯২৭ সালের ভাঙাভাঙি) নামক গ্রন্থে লিখেছেনঃ

“During the first Session of the Seventh Plenum, November 22, 1926, Roy as the representative of the Communist Party of India had been elected to the Presidium of the Comintern and to the Chinese Commission.” P 43.

“সপ্তম প্লেনামের প্রথম দিনের বৈঠকেই রায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তরফ হতে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডিয়ামের সভ্য ও চীন সম্পর্কিত কমিশনের সভ্য নির্বাচিত হলেন।”

[11. Rober C. North and Xenia J. Eudin]

এখানে অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় লিখিত হয়েছে যে রায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তরফ হতেই কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনারের প্রেসিডিয়ামের ও চাইনীজ কমিশনের সভ্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই কমিউনিস্ট পার্টি ভারতের প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টি। ভারতের ভিতর হতে ১৯২৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সংযুক্তিকরণের জন্যে কোনো দরখাস্ত কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দরে পাঠানো হয়নি।

[চার]

১৯২৭ সালের ৩০শে ডিসেম্বর তারিখে এম. এন. রায় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডিয়ামের তরফ হতে যে-দীর্ঘ পত্রখানা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির এবং ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্টস্ পার্টির দুই বিভিন্ন সেনট্রাল

কমিটিকে মস্কো হতে লিখেছিলেন এবং যে-পত্রখানা ভারতে ‘এসেমব্লি লেটার’ নামে খ্যাত হয়েছিল, তাতে লেখা ছিল যে প্রত্যেক কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সহিত সংযুক্ত হওয়া অপরিহার্য। কিন্তু ভারত হতে কমিউনিস্ট পার্টি কখনও কমিন্‌টার্নের সহিত সংযুক্ত হওয়ার জন্যে আবেদন করেনি। কাজেই, “এতদিন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল ভারতের প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টির সংযুক্তিকরণকে ভিত্তি করে কাজ চালিয়েছে”। (Up till now Communist International has acted upon the affiliation of the Emigrant Section of the Communist Party of India.”)

এখন প্রমাণিত হয়ে গেল যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোরবর তারিখে সোবিয়েৎ ইউনিয়নের বর্তমান উজবেকিস্তান রিপাবলিকের রাজধানী তাশকন্দ নগরে স্থাপিত হয়েছিল।

অখণ্ডনীয়রূপে এও প্রমাণ হয়ে গেল যে ভারতের প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সহিত সংযুক্ত হয়েছিল।

মানবেন্দ্রনাথ রায় তাঁর ‘স্মৃতিকথা’য় লিখেছেন (৩০১ পৃষ্ঠা) “To challenge my represntaviveness was pointless. I did not claim to represent anybody but myself, and held my position in the International as an individual” অর্থা “আমার প্রতিনিধিত্বের বিরুদ্ধে কথা তোলার কোনো মানে হয় না। নিজের ছাড়া অন্য কারুর প্রতিনিধিত্ব আমি দাবী করিনি এবং ইন্টারন্যাশনালের ভিতরে আমার পদাধিকার ব্যক্তি হিসাবেই।” উপরে যে-সব প্রমাণ আমি উপস্থিত করেছি, আর “এম. এন. রায়স্ মিশন টু চায়না” গ্রন্থ ও রায়ের পত্র হতে যে উদ্ধৃতি আমি তুলে দিয়েছি এই সব মিলিয়ে প্রমাণ করে দিচ্ছে যে তাঁর দম্ভোক্তি সম্পূর্ণ মিথ্যা। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসে তিনি মেকশিকোর কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তারপরে বরাবর তিনি ভারতের প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিত্ব করেছেন। বিভিন্ন দেশের পার্টিসমূহের প্রতিনিধিরাই শুধু কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ভিতরে পদাধিকারী হতে পারতেন। সেভেন্‌থ প্লেনামের অধিবেশনে এম. এন. রায় যেমন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিরূপেই ইন্টারন্যাশনালের একজেকিউটিবের প্রেসিডিয়ামের সভ্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ঠিক সেই রকমই স্তালিন,

বিশ্ব বিপ্লবের পথ

কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের কার্য-নির্বাহ কমিটির সপ্তম বর্ধিত পেলাম।

২২শে নভেম্বর হতে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯২৬ শর্টহ্যান্ডে লিখিত বিবরণী

প্ৰথম খণ্ড

আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও প্রোলেতারিয়ান (সর্বহারা) বিপ্লব-ইংল্যান্ড সম্পর্কিত প্রশ্ন-চীন বিপ্লবের বিকাশের পথ-ট্রাস্টিকরণ, পুর্নবিন্যাস ও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে আমাদের সমস্যা

১৯২৭

স্টেট পাবলিশিং হাউস * মস্কো লেনিন গ্ৰাদ

প্রথম অধিবেশন

কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল দীর্ঘজীবী হোক!
আমাদের বাস্তব লক্ষ্য বিশ্ব সর্বহারা
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!! (করতালি)
সংবর্ধনা শেষে সভাপতিমন্ডলী (প্রেসিডিয়াম)
নির্বাচন আরম্ভ করেন।

প্রেসিডিয়াম নির্বাচন

সর্বসম্মতিক্রমে প্রেসিডিয়ামে নিম্নলিখিত কমরেডগণ নির্বাচিত হলেন : বুখারিন, স্তালিন ও মানুইস্কি (সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক), তা-ৎসিন-সিয়ান (চীনের কমিউনিস্ট পার্টি), ক্লারা ৎসেকিন (জার্মানীর কমিউনিস্ট পার্টি), কাতাইয়ামা (জাপানের কমিউনিস্ট পার্টি) রায় (ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি), কুশিনেন (ফিনল্যান্ডের কমিউনিস্ট পার্টি) বেয়ারনার (ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি), মাদঝি (ইটালীর কমিউনিস্ট পার্টি), ইলেক চেকোস্লাভাকিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি), বগুৎস্কি ( পোলান্ডের কমিউনিস্ট পার্টি), বার্চ বিটেলম্যান (আমেরিকার কমিউনিস্ট পার্টি), ফুরুবোটেন (নরওয়ের কমিউনিস্ট পার্টি), লমি নাদ্‌জে ( কে আই এম.), থেলমান রেমেলে (জার্মানীর কমিউনিস্ট পার্টি), গ্যালাকার ( গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টি), কলারভ (বুলগারিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি), সিমাউন (ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি), বকভিচ্ (যুগোস্লাভিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি)।

নিম্নলিখিত সভ্যদের নিয়ে সেক্রেটারিয়েট গঠিত হলো :

এম্বের-দ্রো, মর্ফি, এরকলি, গেকে ক্রেমে, রোল, পিয়াৎনিকি, প্ৰেত্ৰভ, কর্নব্লুম পেপের, দিমিত্রভ্।

*****

বুখারিন ও মানুইস্কিও (Manuilsky) সোবিয়েৎ ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির তরফ থেকে প্রেসিডিয়ামের সভ্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেদিন যদি লেনিন বেঁচে থাকতেন তাঁকেও ওই ভাবেই নির্বাচিত হতে হতো।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভ্য কারা?

আশা করি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ভবিষ্যৎ ইতিহাস রচনার পক্ষে আমি কতকগুলি কথা পরিষ্কার করতে পেরেছি। কিন্তু এই তথ্যগুলি খোলাসা হওয়ায় আমাদের কয়েকজনকে যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভ্য বলা হয়, আমার মতে আমাদের সেই দাবীর তেমন কোনো জোর আর থাকছে না। তাশকন্দে ও মস্কোতে ১৯২০-২১ সালে যাঁরা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন তাঁরাই পার্টির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা সভ্য। একথা আমরা কিছুতেই ভুলে যেতে পারি না যে ভারতের প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টি ১৯২১ সালে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বারা স্বীকৃত হয়েছিল। প্রবাসী পার্টির কিছু সংখ্যক সভ্য অনেক দুঃখ-কষ্টের ভিতর দিয়ে ভারতে এসে জেল খাটার পরেও পার্টির কাজ ছেড়ে দেননি। তাঁরা আমাদের সঙ্গেই কাজ করেছেন। তাঁদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পরে ইচ্ছে করলেই আমরা আমাদের পার্টিকে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সহিত সংযুক্ত পার্টি বলে ধরে নিতে পারতেম, কিন্তু সেদিন এ কথা আমাদের মনে আসেনি।

১৯২১ সালের শেষের দিকে কিছু কিছু নড়াচড়া আমরাও আরম্ভ করেছিলেম। ১৯২২ সালে তো আমরা যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে উঠেছি, আর ১৯২৩ সালে আমাদের বন্দীজীবনও আরম্ভ হয়ে গেছে। সকলেই জানেন ভারতের বিপ্লবী কর্মীদের পক্ষে বন্দীজীবনের সম্মুখীন হওয়া ছিল একটা অবধারিত ব্যাপার। এ সব সত্ত্বেও আমরা কি দাবী করতে পারি যে আমরা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভ্য? আমি কিন্তু এ দাবী করার পক্ষে মনে খুব জোর পাইনে। তবে, আমরা যে পার্টি গড়ে তোলার পথ পরিষ্কারক সে দাবী অবশ্য আমরা করতে পারি।

মুহম্মদ শফীকের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

আগে আমি বলেছি যে মুহম্মদ শফীক ভারতের প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সেক্রেটারী নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার মানে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিরই প্রথম সেক্রেটারী হয়েছিলেন। কারণ, ১৯২০-২১ সালে ভারতের ভিতরে কোনো কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়নি। এটা খুব স্বাভাবিক যে সকলেই জানতে চাইবেন এই মুহম্মদ শফীক কে? তাঁর সম্বন্ধে সামান্য কিছুও যদি আমি এখানে বলি তবে আমায় পুলিসের গোপন রিপোর্টের ও আদালতের নথিপত্রের সাহায্য গ্রহণ করতে হবে। শফীকের সঙ্গে কখনও আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। কাজেই, আমার বিবরণ মূলতঃ আমি পুলিসের রিপোর্ট ও আদালতের কাগজপত্র হতেই সংগ্রহ করেছি।

মুহম্মদ শফীক পেশোয়ার জিলার নৌশহরা তীলের অন্তর্গত আকোরার বাসিন্দা। ১৯১৯ সালে তিনি পেশোয়ারের ইরিগেশন অফিসে ক্লার্কের কাজ করতেন। ১৯২৪ সালের ৪ঠা এপ্রিল তারিখে পেশোয়ারের দায়রা জজ মিস্টার জর্জ কনোর (MR. George Connor) শফীকের বিরুদ্ধে চালিত মোকদ্দমার যে রায় শুনিয়েছিলেন তাতে তিনি বলেছিলেন, ১৯১৯ সালের মে মাসে ভারতের রাওলাট এক্ট বিরোধেী আন্দোলনের সময়ে শফীক তাঁর চাকরীস্থলে কোনো খবর না দিয়েই কাবুরে চলে যান। ১৯১৯ সালের এই মে মাসেই আবার আফাগনিস্তান ব্রিটিশ ভারতবর্ষকে আক্রমণ করেছিল। এই যুদ্ধের (তৃতীয় আফগান যুদ্ধের ফলেই আফগানিস্তান পরিপূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে। কাবুলে তিনি নিশ্চয়ই একজন মুহাজির (আত্মনির্বাসিত ব্যক্তি) ছিলেন, কিন্তু মনে রাখতে হবে যে তিনি ১৯২০ সালের মুহাজির ছিলেন না। তাঁর যাওয়ার সময়ে ভারতে হিজরৎ (নির্বাসন) আন্দোলন শুরুই হয়নি। ১৯২০ সালের হিজরৎ আন্দোলন খিলাফৎ আন্দোলন হতে উদ্ভুত হয়েছিল, শুধু মুসলমানরাই এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, আর রাওলাট এক্ট বিরোধী আন্দোলন ছিল জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলেরই রাজনীতিক আন্দোলন। ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল তারিখ অমৃতসরের জালিয়ানওলাবাগে যে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছিল তারও কারণ উদ্ভুত হয়েছিল রাওলাট এক্ট বিরোধী আন্দোলন হতেই। ভারতের ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট নির্মমভাবে এই আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছিল।

দায়রা জজ তাঁর রায়ে বলেছেন, “শফীক কাবুলে যাওয়া মাত্রই বোঝা গেল যে কেন তিনি সেখানে গেছেন, কেননা কাবুলে যে বলশেভিক চরেরা ছিলেন সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর সঙ্গে তাঁদের সংযোগ স্থাপিত হয়ে গেল” (His intention in going there [Kabul] was soon made apparent for he at once got into touch with Bolshevik agents who were then at Kabul”). জজের কথা যদি সত্য হয় তবে হয় তো শফীক কাবুলে যাওয়ার আগেই বলশেভিকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন।

গিরোর হওয়ার পরে শফীক পেশোয়ারের এডিশন্যাল ম্যাজিস্ট্রেট খান মুহম্মদ খানের নিকট ১৯২৩ সালের ১০ই ডিসেম্বর তারিখে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেটের নিকটে এইরূপ বিবৃতি দেওয়া খুবই দুর্বলতার পরিচায়ক। কিন্তু শফীক তা দিয়েছিলেন। এ জাতীয় বিবৃতিতে কেউ পুরোপুরি সত্য কথা বলেন না, অনেক কথা আবার বানিয়েও বলেন। বিবৃত কথাগুলির ভিতর হতে আসল কথাগুলিকে চেষ্টা করে বুঝে নিতে হয়। শফীক বলেছেন, কাবুলেই তাঁর সঙ্গে রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ, আবদুর রব ও আচার্যের সঙ্গে দেখা হয়। তাঁরা সবে রাশিয়া হতে ফিরেছিলেন। কাবুলে তখন যে সকল মুহাজির ছিলেন তাঁদের লক্ষ্য করে আবদুর রব কিংবা আবদুর রব ও আচার্য বললেন যে রুশ সরকার ভারতীয় মুহাজিরদের শ্রদ্ধার চোখে দেখেন এবং তাঁদের সাহায্যও করেন। শোনা মাত্রই শফীক মজার ই-শরীফের পথে রুশ দেশে রওয়ানা হয়ে গেলেন। তাঁর সঙ্গে চলেছিলেন আদ হাসান, কোহাটের আবদুল মজীদ ও মুহম্মদ সাদিক। আহমদ হাসান সম্ভবত মুহম্মদ আলী ওর্ফে খুশী মুহম্মদ। শফীকের বিবৃতি হতে এটা বোঝা যায় যে কাবুলে ভারতীয় মুহাজিরদের ভিতরে দলাদলি ছিল। শফীক নিজে ছিলেন মাওলানা ওবায়দুল্লাহ্ সিদ্ধীর দরে। তিনি যখন রুশে রওয়ানা হচ্ছিলেন তখন তিনি দেখে গিয়েছিলেন যে মৌলবী আবদুর রব অতি ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত স্বার্থ নিয়ে মাওলানা ওবায়দুল্লাহর সঙ্গে ঝগড়ায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। আবদুর রবের পরেকার কাজকর্ম হতেও বোঝা গেছে যে দলাদলিপ্রিয় ঝগড়াটে ব্যক্তিই ছিলেন তিনি। শফীকেরা নিরাপদে তাশকন্দে পৌছেছিলেন। মনে হয় ১৯১৯ সালের শেষাশেষিতে কোনো এক সময় তিনি তাশকন্দে পৌঁছেছিলেন। সেখানে কাজ না করে তো শুধু বসে থাকা যায় না। তাই তাঁরা “জমীনদার” নাম দিয়ে উর্দু ও পার্সী ভাষায় একখানি কাগজ বার করলেন। (পাঞ্জাবে ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে “জমীনদার” মানে কৃষক)। এই কাগজের এক সংখ্যাই শুধু বার হয়েছিল। ম্যাজিস্ট্রেটের নিকটে বিবৃতি দেওয়ার সময়ে শফীক হয় তো ভেবেছিলেন যে “জমীনদারে”র ওই একটি মাত্র সংখ্যা নিশ্চয়ই ভারতে পৌঁছায়নি। তাই তিনি বলেছিলেন যে ইসলামীয় ভিত্তির উপরেই “জমীনদার” বার করা হয়েছিল। কিন্তু কাগজখানি শফীকের মোকদ্দমায় শুধু আদালতের এক্‌জিবিট ছিল না, একজিবিট নম্বর দুই ছিল। জজ তাঁর রায়ে এই কাগজ হতে বহু উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তাতে ইসলামীয় ভিত্তির কোন পরিচয় নেই। শফীক সম্ভবত নিজের অপরাধ কমাবার জন্যে এই ইসলামীয় ভিত্তির কথা বলে থাকবেন। শফীকদের তাশকন্দে আসার কয়েক মাস পরে, (শফীক তিন মাস বলেছেন, কিন্তু সেটা হিসাবে মিলছে না) আবদুর রব ও প্রতিবাদী আচার্য ত্রিশজন মুহাজিরকে সঙ্গে নিয়ে তাশকন্দে আসেন। তখন ১৯২০ সালের সাধারণ হিজরৎ আন্দোলন ভারতে শুরু হয়ে গিয়েছিল।

কিছু দিন পরে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনারের দ্বিতীয় কংগ্রেসে (১৯২০ সালের ১৯ শে জুলাই হতে ৭ই আগস্ট পর্যন্ত) যোগ দেওয়ার জন্যে নিমন্ত্রণ আসে। অপরাধের ভার লাঘব হবে ভেবে শফীক বলেছেন যে সোবিয়েৎ গবর্নমেন্টের তরফ হতে তাঁদের মস্কো যাওয়ার জন্যে হুকুম জারী হয়। তাশকন্দেও দলাদলি শুরু হয়ে গিয়েছিল। শফীক বলেছেন, “আবদুর রবের বিপ্লবী সমিতির তরফ হতে এই উপলক্ষে মস্কো গেলেন আচার্য, আর আমাদের গ্রুপের তরফ হতে গেলাম আমি”। এই “আমাদের গ্রুপ” কথার অর্থ বোধ হয় আবদুর রবের বিরুদ্ধপক্ষ। মস্কোতে মানবেন্দ্রনাথ রায় ও অবনী মুখার্জির সঙ্গে শফীকের প্রথম পরিচয় হয়। কংগ্রেসে রায়, মুখার্জি ও আচার্য ছিলেন প্রতিনিধি, আর শফীক পেয়েছিলেন একখানি দর্শকের টিকেট। দর্শকের টিকেটের কথাটা শফীক নিজের অপরাধ লাঘব করার জন্যে বলেছিলেন, না, সত্য সত্যই তিনি দর্শক হয়েছিলেন তা আমার পক্ষে বলা শক্ত। তবে, শুধু রায়েরই আলোচনায় যোগ দেওয়া ও ভোট দেওয়ার অধিকার ছিল। অন্য ভারতীয় প্রতিনিধিরা কেবল আলোচনায় যোগ দিতে পারতেন।

একটি কথা আমার নিকট বড়ই আশ্চর্য ঠেকছে। মানবেন্দ্রনাথ রায় তাঁর স্মৃতিকথায় প্রতিবাদী আচার্য ও শফীকের কথা গোপন করে গেলেন কেন? কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসে প্রতিবাদী আচার্য ও মুহম্মদ শফীকও যে যোগ দিয়েছিলেন একথা রায় কি করে ভুলে যেতে পারেন? বৈপ্লবিক জীবনে এমন একটি যোগাযোগের ব্যাপারে কেউ কখনও ভুলে যেতে পারেন বলে আমার বিশ্বাস নেই। রায় লিখেছেন, এটাকে অদ্ভুত ঘটনা বলতে হবে যে কমিন্‌টার্নের দ্বিতীয় কংগ্রেসে তিনি ছিলেন মেকশিকোর প্রতিনিধি, আর অবনী মুখার্জি ছিলেন ভারতীয় প্রতিনিধি, যদিও মুখার্জির ভোট দেওয়ার অধিকার ছিল না। এখানে প্রতিবাদী আচার্য ও শফীকের নাম একান্তভাবে উল্লেখ্য ছিল। রায় তা করেননি।

মস্কোতে “প্রাচ্য শ্রমজীবী জনগণের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে” যে সকল ভারতীয় মুহাজির যুবক ভর্তি হয়েছিলেন তাঁদের দেশে ফেরৎ পাঠানোর কথা যখন ওঠে তখন প্রথমে নানাভাবে পাসপোর্ট সংগ্রহের চেষ্টা চলে। এই চেষ্টায় যাঁরা সফল হলেন না তাঁরা দুর্গম-দুর্লঙ্ঘ্য পামির ও হিন্দুকুশ অতিক্রম করে ভারতে পৌঁছেছিলেন। পেশোয়ারের মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার কাগজপত্র হতে জানা যায় যে এই ব্যাপারে মুহম্মদ শফীক বড় ভাগ্যবান ছিলেন। (আমরা এতদিন যে মোকদ্দমাকে বলা হয়েছে)। শফীকের জন্যে ভুয়ো ব্রিটিশ পাসপোর্ট সংগৃহীত হয়েছিল। সেই পাসপোর্টের সাহায্যে তিনি হল্যান্ডের কোনো একটি পোর্ট হতে সমুদ্র পথে ভারতে এসেছিলেন। মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার রাজসাক্ষী ফিদা আশলী জাহিদ বলছে, সে তার মিলিটারি স্কুলের রুশ শিক্ষকের কাছে শুনেছে যে শফীক ইউরোপ হতে লাহোরে গিয়েছিল। কিন্তু ধরা পড়ার ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে কাবুল চলে গেছেন। আবদুল কাদির সেহরাই (খান) বলেছেন, শফীক গোপনে কয়েকবার ভারত যাতায়াত করেছেন। আরও একটি মন্তব্য আছে যে ১৯২১ সালের নভেম্বর মাসে ভুয়ো ব্রিটিশ পাসপোর্টের সাহায্যে হল্যান্ডের একটি পোর্ট হতে সমুদ্রপথে শফীক ভারতে গিয়েছিলেন, কিন্তু ধরা পড়ার ভয়ে কাবুলে চলে যান। মনে হয় এই খবরটাই সঠিক। ১৯২২ সালের আগস্ট মাসের ১৯ শে তারিখে কাবুল হতে এম এন রায়কে লেখা এক পত্রে “এস্” (“S”) নামক এক ব্যক্তির নামোল্লেখ আছে। এই “এস” সম্ভবত শফীক। পত্রে লেখা হয়েছে, “এস” পত্রলেখককে এ জি’র (আফগান গবর্নমেন্টের) হাতে সঁপে দিতে চাইছে। এই পত্রলেখক কি মুহম্মদ আলী ছিলেন? সব কথা সত্য হলে বলতে হবে যে শফীকের পতন ঘটেছিল।

পরের খবর এই যে ১৯২২ সালের শেষাশেষিতে আফগান গবর্নমেন্ট যখন ভারতীয় বিপ্লবীদের আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যেতে বললেন তখন শফীককেও আফগানিস্তান ছাড়তে হলো। অন্য অনেকে মস্কো চলে গেলেন, কিন্তু শফীকের মস্কো ফেরার মুখ আর ছিল না। তিনি সীস্তানে গিয়ে ব্রিটিশ কন্‌সালের নিকট এই আবেদন জানিয়ে আত্মসমর্পণ করলেন যে তাঁকে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। বুঝতে পারছেন শফীক কেন সীস্তানে গিয়ে আত্মসমর্পণ করলেন। আজকার সীস্তান একটা বড় প্রদেশ নয়। তার তিন ভাগের দু ভাগ আবার আফগানিস্তানে, আর বাকী এক ভাগ ইরানে। যাই হোক, ভারতীয় সীমান্তে পৌঁছানো মাত্রই শফীককে গিরেফতার করা হলো। পেশোয়ারে তাঁর বিরুদ্ধে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ১২১-এ ধারা অনুসারে আর একটি কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা হলো। ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসের ৪ঠা তারিখে পেশোয়ারের দায়রা জর্জ মিস্টার জর্জ কনোর (George Connor) শফীককে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলেন।

শওকত উসমানীর সংস্রবে মুহম্মদ শফীকের কথা আমাকে আরও একবার বলতে হবে।

শ্রমজীবী প্রাচ্যের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

উল্লিখিত বিশ্ববিদ্যালয়ের আর একটি নাম স্তালিন বিশ্ববিদ্যালয়।

“As the Commissar of Nationalities and recognised authority on the problems of revolution in the Eastern Countries, Stalin, Was to be something like the Chancellor of the projected University, which was actually named after him” অর্থাৎ “জাতিসত্তাসমূহের কমিসার এবং প্রাচ্য দেশগুলির বৈপ্লবিক সমস্যাসমূহের সর্বস্বীকৃত বিশেষজ্ঞরূপে স্তালিন পরিকল্পিত বিশ্ববিদ্যালয়ের চান্সেলার বা এমন কিছু একটা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কাৰ্যত তাঁর নামেই বিশ্ববিদ্যালয়টির নামকরণ হলো।” (M.N. Roy’s Memoirs, Page – 536)

লেনিন ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে জীবিত ও কর্মক্ষম ছিলেন। এটা লক্ষ্য করার বিষয় যে এই সময়েই “শ্রমজীবী প্রাচ্যের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে”র নামের সঙ্গে স্তালিনের নামও জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। আরও বিশেষভাবে দেখা প্রয়োজন যে ওই সময়ে স্তালিন সোবিয়েৎ ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারিও নির্বাচিত হননি। এই কথাগুলি আমি এই কারণে বলছি যে ক্রুশব যখন সোবিয়েত ইউনিয়নে হঠাৎ ক্ষমতায় আসীন হলেন তখন স্তালিনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রচারের ঝড় বইতে লাগল। তাতে বেসামাল হয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দু’ একজন নেতৃস্থানীয় সভ্য বলে উঠলেন, – “তাইতো! এখন তো দেখতে পাচ্ছি, লেনিন স্তালিনকে বিশ্বাসই করতেন না।” অথচ, তখনকার সোবিয়েৎ দেশের ইতিহাসে স্তালিনের সঙ্গে পরামর্শ না করে প্রাচ্য সম্বন্ধে লেনিন কিছুই করতেন না। “শ্রমজীবী প্রাচ্যের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে”র নামকরণ যে স্তালিনের নামে করা হয়েছিল এটা তারই প্রমাণ।

শ্রমজীবী প্রাচ্যের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান সোবিয়েৎ ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত প্রাচ্যের ছাত্ররা তো কমিউনিজমের অ-আ-ক-খ শিখেছেনই, সোবিয়ে‍ ইউনিয়নের বাইরের অনেক দেশের ছাত্ররাও সেখানে কমিউনিজম শিখেছেনে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির বর্তমান নেতাদের ভিতরেও অনেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত। কিন্তু তাঁদের নাম আমি এখানে সঠিকভাবে লিখতে পারব না। “অমৃতবাজার পত্রিকা’য় প্রকাশিত এম. এন. রায়ের একটি লেখায় আমি পড়েছি যে “ডেমক্রাটিক রিপাবলিক অফ ভিয়েনাম”-এর প্রেসিডেন্ট হো-চি-মিনও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।

পেশোয়ারে ফিরে আসার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় ছাত্ররা তাঁদের প্রিন্সিপালের নাম বলেছেন বরিদা। কিন্তু বরিদা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিন্সিপাল ছিলেন, না, ডিরেক্টর তা বোঝা মুশকিল। আমরা ডিরেক্টর পদের নাম পেয়েছি, প্রিন্সিপাল পদের নাম কোথাও পাইনি।

রাশিয়ার “প্রাচ্য কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়” (“Russia’s University of Oriental Communism”) শীর্ষক এ.সি. ফ্রিম্যান (A.C Freeman) লিখিত একটি প্রবন্ধ ১৯২৩ সালের এপ্রিল মাসের “ সোবিয়েৎ রাশিয়া পিকটোরিয়াল” (Soviet Russia Pictorial) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এটা ফ্রেন্ড্স অব সোবিয়েৎ রাশিয়া” সমিতির মাসিক মুখপত্র। ২০১, ওয়েস্ট থার্টিন্থ স্ট্রীট, নিউ ইয়র্ক হতে সম্পাদিত হতো। ফ্রিম্যান লিখেছেন :

“শ্রমজীবী প্রাচ্যের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়” (“Communist University of the Toiling East.”) একটি বৃহৎ সাদা বাড়ীর প্রবেশ পথে (entrance) এই লেখাটি বড় বড় হরফে লেখা হয়েছে। স্থানটি মস্কোর পুশকিন মনুমেন্টের সন্নিকটে। নয়ন তৃপ্তিকর পোশাক পরিহিত লোকেরা এই বাড়ীর ভিতরে ঢুকছিলেন ও বাড়ী হতে বার হচ্ছিলেন। উঁচু কালো পশমী হ্যাট পরিহিত তুর্কমেনরা তাঁদের ভিতরে ছিলেন, কারুকার্য খচিত টুপি পরা বুখারার দর্জিরা, ভোল্গা আর ক্রিমিয়ার বাদামচোখা তাতারেরাও ছিলেন, ছিলেন ককেসাসের পার্বত্য মুসলমানেরা, আরও ছিলেন ভারত, চীন, জাপান ও কোরিয়ার রাজনীতিক আশ্রিতরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হতে অনেক ভাবতে পারেন যে মূলত সমগ্র এশিয়ায় বৈপ্লবিক অসন্তোষ ছড়ানোই তার কাজ। তা কিন্তু নয়। বৈপ্লবিক অসন্তোষ ছড়ানো নিশ্চয় তার কাজের একটি দিক হলেও,-চীন, জাপান, ভারত, পারস্য ও তুর্কির মতো দেশগুলির বিদেশী ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সুপারিশেই ভর্তি করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এই আশা পোষণ করা হয়েছে যে এই ছাত্ররা তাঁদের আপন আপন দেশে ফিরে যাবেন এবং কমিউনিস্ট ভাবধারার বিজয়ের জন্যে কাজ করতে থাকবেন।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-হওয়া ছাত্রদের ভিতরে বিদেশী ছাত্রদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। যে-সকল প্রাচ্য ছাত্র-ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসের ভিড়ে যোগ দেন এবং তাঁদের শয়নাগারের জন্য যে সব বাড়ী নেওয়া হয়েছে সেই সব বাড়ীতে বাস করেন, তাঁদের খুব বেশীর ভাগই হচ্ছেন সোবিয়েৎ রিপালিকগুলির বিশাল ফেডারেশনের পূর্ব ও দক্ষিণ প্রদেশসমূহের বাশিন্দা। সোবিয়েৎ গবর্নমেন্ট যে এই বিশাল ফেডারেশনের পূর্ব ও দক্ষিণ প্রদেশসমূহের বাশিন্দা। সোবিয়েৎ গবর্নমেন্ট যে এই বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছেন তার প্রধান উদ্দেশ্য পেশাদার বিপ্লবী সৃষ্টি করা নয়, পশ্চাদপদ ও আদিম ধ্যান-ধারণাযুক্ত রিপাবলিকগুলির জন্যে এর ভিতর দিয়ে গবর্নমেন্ট অনেক সব রাজনীতিক ও অর্থনীতিক নেতা গড়ে তুলতে চাইছেন। খুব বেশীর ভাগ ছাত্র মুসলিম দেশসমূহ হতে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন বটে, কিন্তু তাদের মধ্যে প্যানইস্লামিজম (মুসলিম বিশ্বভ্রাত্রীয়তা) কিংবা অন্য কোনো ধার্মিক বা জাতীয়তাবাদী প্রবণতা বাড়াবার চেষ্টা হয় না। কেন না, জাতিগত (racial) ও ধার্মিক উৎকটতার ভিতর দিয়ে ইউরোপ ও এশিয়ার বিস্তীর্ণ ইলাকাগুলিতে ছড়ানো মুসলিম ট্রাইবগুলিকে একত্র করলে তা থেকে রুশরাই দুঃখ পাবেন অনেক বেশী। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষা দেওয়া হয় তার চরিত্র যেন আন্তর্জাতিক হয় তার ওপরে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ডিরেক্টর বিশেষভাবে জোর দিতে থাকেন।

এই ডিরেক্টর বললেন, “আমরা মনে করি, জাতীয়তাবাদী মনোবৃত্তির প্রদর্শন আমাদের ছাত্রদের পক্ষে মারাত্মক ধরনের অনুপযুক্ততার পরিচায়ক। অবশ্য সোবিয়েৎ রাশিয়ার সীমানার বাইরে থেকে যে ছাত্ররা আসেন তাঁদের আমরা শিক্ষা দিই যে তাঁদের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নিশ্চয় সংগ্রাম করতে হবে- সে সাম্রাজ্যবাদ দেশের ভিতরের বা বাইরের যাই হোক না কেন। কিন্তু, এই সংগ্ৰাম আন্তর্জাতিক কমিউনিজমের নামে লড়তে হবে। এই বিশ্বাস নিয়ে লড়তে হবে যে প্রত্যেক জাতির আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার আছে, তবে জাতিগত (racial) আবেদন আর ধর্মীয় কুসংস্কার ও উন্মাদনার ভিতর দিয়ে নয়”।

ডিরেক্টরকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “ পঠন-পাঠনের কি ব্যবস্থা করা হয়েছে?”

তিনি বললেন “প্রবেশিকা ও গ্রেজুয়েট স্তরের পাঠ্য বিষয় স্থির করার সময়ে আমাদের খুবই নমনীয় হতে হয়েছে। আমার সন্দেহ আছে যে দুনিয়ার অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের পূর্ব শিক্ষার স্তরে এত বিভেদ আছে কিনা। আমাদের এখানে প্রায়ই ককেসাস কিংবা ক্রিমিয়ার গ্রাম হতে মুসলিম কৃষকেরা আসেন। তাঁরা জীবনে না দেখেছেন কোনো কারখানা, না দেখেছেন কোন বৃহৎ নগর। কোনো রকমে তাঁরা পড়তে ও লিখতে পারেন। বিজ্ঞান ও সাহিত্য সম্বন্ধে তাঁদের এতটুকুও ধারণা নেই। এর সঙ্গে সঙ্গে চীন ভারত ও জাপান হতে আসা আমাদের এমন রাজনীতিক আশ্রয় প্রার্থীরাও (refugees) আছেন যাঁরা অক্সফোর্ড ও হাইডেলবের্গের ডিগ্রী ধারণ করেন। ছাত্রদের নানা স্তরের মানসিক প্রস্তুতির প্রতি নজর রেখে আমাদের নানা রকম পাঠক্রম স্থির করতে হয়েছে। রাশিয়ার ইউরোপীয় ও এশীয় অংশসমূহের আদিম ও পশ্চাৎপদ ইলাকাগুলি হতে যে- সকল ছাত্র এসেছেন তাঁদের আমরা ইতিহাস বিজ্ঞান ও সাহিত্যে ভালো সাধারণ শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করি এবং তার সঙ্গে সঙ্গে মার্কসীয় সোশ্যালিজমের মূল নীতিগুলিরও শিক্ষা দেওয়া হয়। আমাদের শিক্ষকেরা অনেক স্থানীয় বুলিতে কথা বলতে পারেন। তার উপরে, ছাত্ররা খুব তাড়াতাড়ি রুশ ভাষাও শিক্ষা করে নেন।”

“বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্য কি?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

ডিরেক্টর উত্তর দিলেন, “ সোবিয়েৎ রাশিয়ার শ্রেষ্ঠ চিন্তাগুলি প্রাচ্য জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। আমাদের উদ্দেশ্য দু’রকমে তার পথ খুঁজে পায়। আমরা সাম্রাজ্যবাদী নয়। কিপলিং অর্থে শ্বেত জাতির বোঝার কথা আমরা বলি না। এই কারণে সোবিয়েৎ রিপাবলিকের ভিতরকাল প্রাচ্য জনসাধারণকে শাসন করার জন্যে আমরা রুশীয়দের শিক্ষা দিই না। আমরা বিশ্বাস করি যে এই সকল লোক নিজেরা নিজেদের শাসন করবেন। এই জন্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার জন্যে আমরা তাঁদের যুবকদের উৎসাহ দিয়ে থাকি। এখানে এসে তাঁরা নিজেদের আপন আপন সম্প্রদায়ের (Communities) নেতৃত্বে বিরত হওয়ার উপযুক্ত ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক শিক্ষা দু-ই লাভ করেন। আমাদের ছাত্র সংগ্রহের ইলাকাগুলি ক্রিমিয়া, ককেসাস, তুর্কিস্তান, বুখারা, ভোল্গার তীরবর্তী তাতার রিপাবলিক সর্বদাই সংস্কৃতিগতভাবে পশ্চাৎপদ থেকেছে; অল্প সংখ্যক শিক্ষিত লোকও এসব ইলাকার সংস্কৃতিকে উচ্চতর স্তরে পরিণত করার জন্যে খামিরের কাজ করতে পারেন।

“আমরা নিজেরা যখন সাম্রাজ্যবাদী নয়, স্বভাবতই আমরা চাইতে পারি না যে অন্য কোনো দেশেও সাম্রাজ্যবাদের প্রতিষ্ঠা হোক। বিদেশী প্রাচ্য ছাত্ররা যাঁরা আমাদের বিদ্যালয়ে আসেন, প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে তাঁদের সংগ্রাম করতে শেখানো হয়,-তা সেই প্রতিক্রিয়া বিদেশী নিষ্ঠুর শাসন কিংবা দেশীয় স্থিতিশীলতা যাই হোক না কেন।”

আমাকে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করতে দেওয়া হয়েছিল। আমি যেমন ক্লাস রুমগুলি দেখেছি, তেমনই দেখেছি ছাত্রদের শয়নাগারগুলিও। সর্বত্র একই বৈষম্য-একদিকে উৎসাহী বুদ্ধিজীবী, উচ্চাশা, অন্যদিকে সাজসরঞ্জামের অল্পতা যা প্রায়ই আজকের রাশিয়াতে পরিলক্ষিত হয়। ক্লাস-রুমগুলি সরঞ্জামশূন্য, আবার সেগুলিতে ভিড়ের বাড়াবাড়ি। ফিজিক্স ও কেমিস্ত্রী শিক্ষা দেওয়ার পক্ষে যন্ত্রপাতি করুণভাবে কম। কিন্তু মনে হলো যে ছাত্ররা যাঁদের ভিতরে এশিয়ার প্রায় সব দেশেরই প্রতিনিধিরা রয়েছেন, সকল অসুবিধা সত্ত্বেও শেখার জন্যে আগ্রহশীল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ভিতরে মেয়েদের সংখ্যা দেখে আমি সবচেয়ে বেশী আশ্চর্য হয়েছি। তাঁরা তাঁদের প্রাচ্যের অভ্যাস ও চিন্তাই শুধু ছাড়েননি, খুলেছেন তাঁদের অবগুন্ঠনও।

পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান শিখিয়ে এবং মার্কসীয় রাজনীতিক ও অর্থনীতিক থিয়োরীতে পারদর্শী করে হাজার হাজার ছাত্রকে আদিম পিতৃপ্রধান জাতিগুলির, যাঁদের জীবন প্রধানত : কুর্আনের অনুশাসনে শাসিত, মধ্যে ছেড়ে দিলে তার পরিণাম কি দাঁড়াবে? এর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কিছু বলা কঠিন; কিন্তু যে-পরীক্ষা চলেছে তার ভিতরে অনেক সব চিত্তাকর্ষক সম্ভাবনাও লুকিয়ে রয়েছে। যদি সব কিছু বিফল না হয়ে যায়, তবে শ্রমজীবী প্রাচ্যের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ সমাপ্তকারী ছাত্ররা ( গ্রেজুয়েটেরা) এশিয়াটিক রাশিয়ার, ককেসাসের, নিকট ও মধ্য প্রাচ্যের প্রতিবেশী দেশসমূহের ভবিষ্যৎ রাজনীতিক জীবনে যে বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করবেন তার সম্ভাবনা আছে। (Soviet Russia Pictorial : New York, April, 1923)

এ.সি. ফিম্যানের প্রবন্ধটি আমি এখানে এই কারণে তুলে দিলাম যে তা থেকে সকলে “শ্রমজীবী প্রাচ্যের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়” সম্বন্ধে মনে একটা ধারণা করে নিতে পারবেন। ফ্রিম্যানের পরিচয় আমরা জানিনে। তবে, তিনি আমেরিকান। সোবিয়েৎ সূহৃদ সমিতির আন্দোলনের সঙ্গে যে তিনি যুক্ত ছিলেন তা বোঝা যায়। কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন কিনা তা বোঝা মুশকিল। খুব সম্ভবত ছিলেন না।

এম. এন. রায়ের ভুল বিবৃতির সংশোধন

বিদেশে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার কথা শেষ করার সময়ে এখানে তেমন প্রাসঙ্গিক না হলেও আমি একটি কথা পরিষ্কার করে দিতে চাই। একথা আমি আগেও বলেছি। তবুও আরও একবার বলে দিচ্ছি। রায় তাঁর স্মৃতিকথার ৪৬৪ পৃষ্ঠায় বলেছেন তাঁর তাশকন্দে যাওয়ার অনেক পরে আবদুর রব ও আচার্যদের কাবুল হতে তাশকন্দে এসেছিলেন। ৪৬৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন মুহম্মদ শফীক আচার্যদের সঙ্গে কাবুল হতে তাশকন্দে এসেছিলেন। এই বিবরণ ভুল। আবদুর রব ও আচার্য রাশিয়া হতে কাবুলে ফিরে গিয়েছিলেন। আবার কাবুল হতে তাঁরা তাশকন্দ ফিরেছিলেন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন আরম্ভ হওয়ার অনেক আগে। শফীক আরও কয়েকমাস আগে তাশকন্দে এসেছিলেন। তাশকন্দ হতেই প্রতিবাদী আচার্য ও শফীক কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসে যোগদান করার জন্য মস্কো গিয়েছিলেন। তাঁদের দু’জনই কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। এম. এন. রায় নিজেই লিখেছেন যে কংগ্রেসে শেষ হওয়ার বেশ কয়েকদিন পরে স্পেশাল ট্রেন যোগে সদলে তাঁরা তাশকন্দের পথে যাত্রা করেছিলেন। তাঁর একই ট্রেনে আচার্য আর শফীকও তাশকন্দ গিয়েছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *