৫
সতীনাথ-শ্যামল-উৎপলা-আলপনা এই চারজনের সঙ্গে নেহাতই নগণ্য কারণে হঠাৎ সম্পর্ক ছেদ করছিল এইচ এম ভি। তখন ফিল্ম থেকে সরাসরি গ্রামোফোনের ডিস্ক রেকর্ডে ফিল্মের গান পরিবেশন করার মেশিন এসে গেছে। সে ভাবেই কাজ হচ্ছে। তবু এইচ. এম. ভি. ওদের গান বাদ দেবার জন্য প্রযোজকদের আলাদা খরচা জুগিয়ে অন্য শিল্পীদের দিয়ে গান রেকর্ড করতে লাগলেন। সতীনাথ-উৎপলা ছবিতে খুবই কম গাইত। বেশি গাইত শ্যামল আর আলপনা। শ্যামলের গানগুলো গাওয়ানো হতে লাগল মানবেন্দ্রকে দিয়ে, আর আলপনার গানগুলো ইলা বসুকে। নচিকেতা ঘোষের মতো সুরকারও ছবির গানের গ্রামোফোন রেকর্ড বার করার জন্য ছবিতে শ্যামল মিত্রের গাওয়া বিখ্যাত গান ‘পুতুল নেবে গো পুতুল’ গ্রামোফোন রেকর্ডে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে মানবের অনিচ্ছা সত্ত্বেও গাওয়াতে বাধ্য হলেন। ওদের গান বন্ধ। রেকর্ডের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ। ইতিমধ্যে পুজোর গানের সময় এসে গেল। তখন পুজোর গান একটা বিরাট ব্যাপার ছিল। শেষে সদালাপী পরোপকারী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের মধ্যস্থতায় একটা মিটমাটের মধ্যে এসে গেল বিবাদী শিল্পীরা।
সবাই আবার এইচ. এম. ভি-তে ফিরে এল। ফিরল না শুধু একজন। সে আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়। গানের জগৎ ছেড়ে দিয়ে পদ্মপুকুরের শ্রীধর মুখোপাধ্যায়কে বিয়ে করে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে সাংসারিক জগতে দিন কাটাতে লাগল। এতে সাহেব এইচ. এম. ভি. কোম্পানির কী ক্ষতি হল জানি না, কিন্তু বাংলা গান হারাল একজন সত্যিকারের সুকণ্ঠী এবং সাবলীল ভঙ্গিমার গায়িকা অনবদ্য এক কণ্ঠশিল্পীকে।
কাজী নজরুল ইসলামের পর যদি বাংলা গানের বাণিজ্যিক সাফল্যের খতিয়ান নেওয়া হয় তা হলে সর্বাগ্রে আসা উচিত কমল দাশগুপ্তের নাম। সে যুগে হিট আধুনিক গানের সুরকার বললেই বোঝাত কমল দাশগুপ্ত। উনি যে এইচ. এম. ভি-কে কত ব্যবসা দিয়েছেন তার হিসাব করা দুঃসাধ্য।
কিন্তু তখনকার বিদেশি সাহেব মালিকানার এই এইচ. এম. ভি-ই কমলদা যখন অসুস্থ হয়ে তেমন কাজ করতে পারছিলেন না তখন নির্মমভাবে সম্পর্কছেদ করতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেনি। ওখানেই একদিন শুনলাম, কমলদা নাকি এইচ. এম. ভি.-কে গানের জন্য অনুরোধ করেছেন। ওঁরা অনুগ্রহ করে শিল্পী দিয়েছেন তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর গায়ত্রী বসুকে—গীতিকার দিয়েছেন আমাকে।
‘শেষ উত্তর’, ‘যোগাযোগ’ ‘গরমিল’ ‘নন্দিতা’ ‘জবার’-এর কমল দাশগুপ্ত আমার কাছে ছিল স্বপ্ন। আমি আনন্দে তুলে নিলাম কলম। তখন কমলদা আর্থিক দুরবস্থায়। গানের ‘সিটিং’ করার তেমন জায়গা নেই। আগের দিনের প্রকৃত স্রষ্টা শিল্পী কমলদা চিরদিনই এইচ. এম. ভি.-তে ওঁর নির্দিষ্ট ঘরে সুরসাধনা নিয়ে থাকতেন। এবারেও তাই চাইলেন। তাই ব্যবস্থাও হল। কিন্তু কমলদা কিছুতেই বিকেল চারটে-সাড়ে চারটের আগে ওখানে আসতে পারতেন না। তখন ঠিক পাঁচটায়, সাহেবি কায়দায় তখনকার এইচ এম ভি.-র দরজা বন্ধ হত। হয়তো ওঁদের স্বর্ণসময়ে ওঁর জন্য কোনও সময়ের বিধিনিষেধ থাকত না। সেই অভ্যাসেই কমলদা দেরি করে এসে গান নিয়ে বসতেন। ঘড়ির কাঁটায় হারমোনিয়াম ছেড়ে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এসে বসতেন, এইচ. এম. ভি.-র অফিসের সদর দরজার সিঁড়ির পাশের রকে। হারমোনিয়াম নেই। সন্ধ্যা হয়ে আসত তেমন আলোও পেতেন না। শুধু আমার গানের কাগজটা চোখের সামনে তুলে ধরে মনে মনে সুর করতেন আর গানের পঙক্তির মাথায় মাথায় লিখে রাখতেন শর্টহ্যান্ড স্বরলিপি। (ওঁদের সময় টেপরেকর্ডার তো ছিল না।) আমার চোখ ফেটে জল আসত। জগন্ময় মিত্র, গৌরী, কেদার, ধনঞ্জয়, হেমন্তকুমার, যূথিকা রায়, সত্য চৌধুরীর অজস্র গান হিট করানো কমল দাশগুপ্ত ভাগ্যের পরিহাসে এইচ. এম. ভি.-র ‘রকে’। যতক্ষণ না উনি বলতেন—চলরে পুলক—ততক্ষণ আমি বসে থাকতাম।
তখন কমলদা বিয়ে করেছেন। ফিরোজা বউদিকে (বিখ্যাত শিল্পী ফিরোজা বেগম) নিয়ে থাকতেন হেদুয়া অঞ্চলে। ওখানেই একদিন দুঃখ করে আমায় বলেলেন—রেকর্ড দুটো তেমন চলল না রে।
বললাম—কী করে চলবে বলুন? ওইভাবে কী গান হয়?
বললেন—তুই আসিস। তোর গান সুর করে রাখব। মাঝে মাঝে যেতাম। রেকর্ড না হওয়া সে সব অনেক গানেরই উল্লেখ করছিলেন সেদিন ফিরোজা ভাবী।
কমলদাকে এরপর পেয়েছিলাম মেগাফোন রেকর্ডে। তখন অনেকটা সুস্থ। বেচু দত্তকে দিয়ে আমার একটা গান রেকর্ডে গাইয়েছিলেন। রেডিয়োতে খুব শুনতাম সে গানটা। ‘দুজনের কূজনের ছন্দে’।
এরপর কমলদা দুটো বাংলা ছবি করেছিলেন। ‘জংলী মেয়ে’ আর ‘আধুনিকা। দুটো ছবিতেই গান লেখার জন্য ডেকেছিলেন আমাকে। আমার সৌভাগ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার দুটো ছবিই সমাপ্ত হয়েও মুক্তিলাভ করেনি।
‘আধুনিকা’ ছবির সময়কার একটা ঘটনায় শ্রদ্ধেয় কমলদার উপদেশ আমি আজও মেনে চলি! ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োর মালিকপক্ষ ছবিটা প্রযোজনা করেছিলেন। অসীমকুমার আর অনিতা গুহ ছিলেন নায়ক-নায়িকা। বিনয় ব্যানার্জি ছিলেন পরিচালক—আর বিধায়ক ভট্টাচার্য কাহিনী ও চিত্রনাট্যকার। যেদিন গেলাম সেদিন ওঁরা প্রত্যেকেই ওখানে অফিসে উপস্থিত ছিলেন। একটা কনট্র্যাক্ট ফর্ম দিয়ে এক অবাঙালি ভদ্রলোক বললেন—সই করুন। লাম্প সাম্ টাকার কনট্র্যাক্ট, পার সঙ কনট্র্যাক্ট নয়।
এ ধরনের চুক্তিপত্রে আগেও সই করেছি। কিন্তু এ চুক্তিপত্রে লেখা আছে ‘অ্যাজ মেনি সঙস আর রিকোয়ার্ড’। অর্থাৎ ওঁদের যতখুশি গান আমায় ওই সর্বসাকুল্য অর্থে রচনা করে দিতে হবে! স্বভাবতই বললাম—এ চুক্তিপত্রে আমি সই করব না। ওই পঙক্তিটি বাদ দিন।
ওঁরা রাজি হলেন না। ওঁদের ছবিতে কাজ করতে গেলে ওই চুক্তিতেই সই করতে হবে নইলে ওঁরা আমায় নেবেন না।
বিধায়কদা আমায় পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে বললেন—চিত্রনাট্য তো আমার, যে ক’টা গান তোকে বলা হয়েছে তার বেশি একটাও গান থাকবে না। পরিচালক বিনয়দাও সায় দিলেন। আর গান বাড়াবার জায়গা কোথায়? কমলদা খালি ধীরকণ্ঠে বললেন—তুই থাকলে আমার খুব সুবিধে হয়। ছবিটা নে!
বিধায়কদা আবার বললেন—নে, সই করে অ্যাডভান্স টাকা নিয়ে বউমার জন্য মিষ্টি কিনে একটু সকাল-সকাল বাড়ি চলে যাস। রাত করিসনি। অগত্যা সই করে দিলাম।
‘আধুনিকা’ ছবির গান রেকর্ড হয়ে গেল। সন্ধ্যা, শ্যামল এরা গান গাইল। সুন্দর সুর করলেন কমলদা। সুটিং প্রায় শেষ! একদিন শুনলাম মুম্বই-এর রূপ কে শোরী (‘এক থি লেড়কী’র পরিচালক। যাঁর ছবির গান ‘লারে লাপ্পা লারে লাপ্পা’ সারা ভারত তোলপাড় করেছিল) এ ছবির ফাইনাল সুপারভিশন করছেন। হঠাৎ একদিন শোরী সাহেব আমায় লোক মারফত ডাকলেন। নির্দিষ্ট সময়ে গেলাম। আলাপ হল মুম্বই-এর একজন বিখ্যাত বাণিজ্যিক পরিচালকের সঙ্গে। কিন্তু দেখলাম বিনয়দাও নেই। শুধু বসে আছেন কমলদা। খুব আনন্দ হল এই ভেবে যে রূপ কে শোরী সাহেব নতুন আর একটা বাংলা ছবি করছেন।
কিন্তু মুহূর্তেই ভুল ভাঙল। তা নয় এই আধুনিকা’-তেই মুম্বইতে ভাষায় উনি কিছু ‘মশালা’ ঢোকাচ্ছেন। দুটো টিপিক্যাল হিন্দি মার্কা ছবির সিচুয়েশন আমায় দিলেন। নোট করলাম। এবার প্রযোজককে বললাম—আমার পেমেন্টের কী হবে?
অবাঙালি ভদ্রলোক ড্রয়ার খুলে আমার কনট্র্যাক্টটি বের করে আমায় দেখালেন অ্যাজ মেনি সঙস আর রিকোয়ার্ড! ভীষণ রাগ হল!
কোথায় বিধায়কদা? কোথায় বিনয়দা?
শুনলাম ওঁরা দুজনেই ছবির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে চলে গেছেন।
নেমে এলাম ওঁদের চৌরঙ্গির দোতলার অফিস থেকে।
কমলদাকে শুধু বলে আসতে হল অমুক তারিখে অমুক সময়ে আসব।
বাড়ি এসে হঠাৎ দুর্বুদ্ধি এল। চুক্তি অনুযায়ী গান আমি লিখতে বাধ্য—কিন্তু কেমন গান লিখব তা তো লেখা নেই।
তৎক্ষণাৎ যা মাথায় এল তা-ই নিয়েই লিখে ফেললাম আজে বাজে দুটো গান। নির্দিষ্ট সময় আবার ওঁদের অফিসে উপস্থিত হলাম।
পঞ্জাবি পরিচালক। ওঁর সহকারিও তাই। দুজনে কেউ-ই বাংলা বোঝেন না। প্রযোজক অল্পবিস্তর বাংলা বুঝলেও সাহিত্য মোটেই বোঝেন না।
পড়ে শোনালাম গান। ওঁরা ‘ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে’ করে মাথা নাড়তে লাগলেন। গান অ্যাপ্রুভড। যাক, বাঁচা গেল।
কমলদাও রেকর্ডিং ডেট মোটামুটি স্থির করে নিয়ে আমায় বললেন—চল, আমরা বসি।
মনে আছে, কমলদা আমায় নিয়ে এলেন উত্তর কলকাতার হর্তুকী বাগানে ওঁর বোনের বাড়ি। জানতেন কচুরি খেতে ভালবাসি। খাওয়ালেন, নিজেও খেলেন।
তারপর হেসে বললেন—পুলক, একী লিখেছিস? একি তোর লেখা? এ গান যখন রেকর্ড হয়ে বেরুবে তখন কেউ কি জানবে ‘আধুনিকা’র প্রযোজক তোকে ঠকিয়েছে? বাড়তি পয়সা না দিয়ে কাজ করিয়েছে? সবাই বলবে যা-তা লিখেছে পুলক। এমন ধরনের কনট্র্যাক্ট আর কখনও সই করিসনি। কিন্তু এবার যখন করেছিস তোকে যারা ভালবাসে তাদের ঠকাসনি। এ জগতে ভাল কাজটাই সব, পয়সা পাওয়াটা সব নয়।
এক আলো ঝলমল নতুন দিগন্ত দেখতে পেলাম। এ কথা শোনার পর ওঁকে আর প্রণাম না করে থাকতে পারিনি। বুঝলাম এই নিষ্ঠার জন্যই উনি সেই ‘দম্পতি’ ‘আলেয়া’ ‘চন্দ্রশেখর’ ইত্যাদি দিয়ে পরের পর ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন।
কমলদা বললেন—জানিস, আমরা যখন রেকর্ডে ঢুকেছি তখন প্রতি টাইটেল পিছু সাহেব কোম্পানি আমাদের পাঁচ টাকা করে দিত। আমার ঘাড়ে বিরাট সংসারের দায়িত্ব। সারাদিন অন্তত চারটে টাইটেল না-করে বাড়ি ফিরতে পারতাম না। সংসার চালাতে হবে তো? এইচ. এম. ভি. কলম্বিয়া তো ছিলই—ওদের ‘টুইন’ লেবেলেও দিনের পর দিন কাজ করে গেছি। কিন্তু বিশ্বাস কর কোনও দিনও কাজে ফাঁকি দিয়ে নিজেকে ঠকাইনি। আবার চোখে জল এসে গিয়েছিল। ও গান দুটো ছিঁড়ে ফেলে নতুন করে লিখলাম দুজনার মনের মতো দুটো গান।
সে দুটোই রেকর্ড হল ‘আধুনিকা’ ছবিতে। আলপনা গাইল গান দুটো!
পরপর ব্যাঙ্ক ফেল হওয়ায় সর্বস্ব খুইয়ে যখন এ হেন মানুষ দিন কাটাচ্ছেন কেউ এগিয়ে আসেননি ওঁর কাছে। হিন্দি ‘জবাব’ ‘চন্দ্রশেখর’ ‘কৃষ্ণলীলা’র পর শুনেছি মুম্বই-তে গিয়ে হিন্দি ছবি করার জন্য এক প্রযোজক ‘ব্ল্যাঙ্ক চেক’-ও ওঁর দিকে এগিয়ে দিয়েছিলেন।
কমলদা সেই বিনীত হাসি হেসে বলেছিলেন—
কলকাতায় রেকর্ড করলে করব, বিদেশে যেতে পারব না। কেন, এখান থেকে কি নিউ থিয়েটার্সের হিন্দি গান হিট হয়নি?
কলকাতা ছাড়েননি কমলদা।
সেই কমল দাশগুপ্তই শুধুমাত্র জীবন ধারণের জন্য চলে গেলেন বাংলাদেশ ঢাকায়। পতিব্রতা স্ত্রী ফিরোজা বেগম ওখানে নিয়ে গিয়ে পরম যত্নে সেবায় ওঁর পাশে ছিলেন ওঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
এত বড় সুরকারের এই নিঃশব্দে ওপার বাংলায় চলে যাওয়া কোনও বিখ্যাত পত্রিকায় এক পঙক্তিও সংবাদ হল না।
৬
একটা গান আমাদের ছোট বেলায় খুবই জনপ্রিয় ছিল। আজও সে গানের আকর্ষণ এতটুকুও কমেনি। গানটি রবীন মজুমদারের গাওয়া—আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ যদি নাইবা জ্বলে’। এই গানটির সুরকার ছিলেন রবীন চট্টোপাধ্যায়। এক অদ্ভুত মানুষ ছিলেন উনি। আমার সঙ্গে যোগাযোগের কথা বলার আগে এই ‘আঁধার ঘরের প্রদীপের’ একটা নিদারুণ ঘটনার কথা না-বলে থাকতে পারছি না।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এই সুকণ্ঠ রোমান্টিক নায়ক-গায়ক রবীন মজুমদার খুবই আর্থিক দুরবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলেন। সেইসময় একটি সংস্থা কলামন্দিরে একটি সংগীতানুষ্ঠানে রবিদাকে সংবর্ধনা ও কিছু অর্থ উপহারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ওঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন ওখানে। আমিও নিমন্ত্রিত ছিলাম। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের পর আমরা মঞ্চ থেকে নেমে সামনের সারিতে কিছুক্ষণের জন্য বসে ছিলাম। রবিদার পাশের সিটেই বসেছিলাম আমি। এক গায়িকা গাইতে বসে রবিদার সামনেই রবিদার ওই বিখ্যাত গান ‘আঁধার ঘরের প্রদীপ’ গাইতে লাগলেন। সুরে ব্যঞ্জনায় অভিব্যক্তিতে সে গান রবিদার গাওয়া আসল গানটির ধারে কাছে পৌঁছতে পারছিল না। আড়চোখে দেখছিলাম রবিদাকে। কী এক অস্থিরতায় ছটফট করে উঠছিলেন উনি। এক-এক বার আমার হাতটা চেপেও ধরছিলেন। আমার মনে হচ্ছিল—রবিদার যদি যৌবনকালের সেই অপূৰ্ব কণ্ঠ থাকত তা হলে রবিদা-ই ওঁর অভিনীত নীরেন লাহিড়ী পরিচালিত রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুর দেওয়া বিখ্যাত ‘নিরুদ্দেশ’ ছবির সিকোয়েন্সের মতো এখন-ই মঞ্চে লাফিয়ে উঠে গায়িকার কাছ থেকে মাইকটা ছিনিয়ে নিয়ে গেয়ে উঠতেন—আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ যদি নাইবা জ্বলে’। গানটা শেষ হতেই আর এক মুহূর্ত বসেননি রবিদা। সোজা বেরিয়ে গিয়েছিলেন অডিটোরিয়াম’ থেকে।
রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুর আমার ছেলেবেলা থেকেই অদ্ভুত ভাল লাগত। বাংলা গানে সার্থক মেলোডির বেশ একটা নতুন জোয়ার এনেছিলেন। ওঁর সুরের ‘সাতনম্বর বাড়ি, ‘সমাপিকা’ ‘লালুভুলু’ বিদুষী ভার্যা’ ‘সাগরিকা’ ‘স্বপ্ন সাধনা’ ‘অগ্নিশিখা’ ‘জয়া’ ইত্যাদি ছবির গান সব সংগীত প্রেমিক প্রেমিকাদেরই মনে আছে।
কমার্শিয়াল আর্টিস্ট সত্যজিৎ রায়ের পথেই কমার্শিয়াল আর্টিস্ট রাজেন তরফদার এলেন ছবি করতে। করলেন অসাধারণ ছবি ‘গঙ্গা’। তারপরের ছবি ওঁর ‘অগ্নিশিখা’। সুরকার নিলেন রবীন চট্টোপাধ্যায়—আর গীতিকার আমাকে।
সদাহাস্যময় সহৃদয় মানুষ ছিলেন এই রাজেনদা। ওঁর প্রায় প্রতিটি ছবিতেই আমাকে নিয়েছিলেন। সম্ভবত ‘আকাশছোঁয়া’ ছবিতে শুধু রবীন্দ্রনাথের গান ছিল। আমায় হাসতে হাসতে বলতেন যে—লিখে দেব—রবীন্দ্রনাথের গান নিলাম বলেই পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান রাখা গেল না।
এই ‘অগ্নিশিখা’ ছবিতেই রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার প্রথম কাজ। তখন ‘হিন্দ’ সিনেমার কাছের ক্যালকাটা অর্কেস্ট্রা নেই। রবিদা তখন ধর্মতলার সুরশ্রী অর্কেস্ট্রায় চারতলায় উঠে রোজ সন্ধ্যাবেলায় গান নিয়ে বসতেন। এখন যেমন অর্কেস্ট্রা রেকর্ড করা থাকে তারপর কণ্ঠশিল্পীরা দু লাইন করে গান শিখে কোনওমতে গলা থেকে গান উদ্গীরণ করে মোটা টাকা পকেটে পুরে গাড়িতে উঠেই ভুলে যান—কী গাইলেন! তখন তা ছিল না। গভীর মনোযোগে এক একটা গান দুদিন-তিনদিন ধরে ওঁরা রিহার্সাল করে রেকর্ড করতেন। ওই সুরশ্রী ‘অর্কেস্ট্রা’তে বাজনাদাররাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাজানোর রিহার্সাল করে তবে স্টুডিয়ো যেতেন।
রবিদা পাখি পড়ানোর মতো গান তোলাতেন—শেখাতেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে। মনের মতো গাইতে পারলে সন্ধ্যার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন—সন্ধ্যা, তুমি ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় গায়িকা। আমার নিজের ধারণা, রবীন চট্টোপাধ্যায় না থাকলে সন্ধ্যার বিকাশ এতটা হত না। ‘পথে হল দেরী’ ‘সবাই উপরে’র সন্ধ্যার গানগুলো এত ভাল হয়েছিল শুধু রবিদার সুরে নয়—আশ্চর্য শেখানোর গুণেও। কিন্তু একটা অদ্ভুত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল ওঁর। উনি কাউকে হয়তো পাঁচটার সময় ডাকলেন—কিন্তু নিজে ও সময়ে উপস্থিত না-ও থাকতে পারতেন। কিন্তু যাঁকে ডেকেছেন তাঁকে ঠিক সময়ে উপস্থিত হতেই হবে। নিজে দেরি করে এসে যদি শুনতেন তিনি ঠিক সময়ে আসেননি তা হলে অগ্নিশর্মা হয়ে যেতেন।
হেমন্তদা আমাদের প্রায়ই হাসতে হাসতে বলতেন—ররিদার রেকর্ডিং যদি দুটোয় থাকে আমি দেড়টায় হাজির হয়ে যাই—যদিও জানি অন্য কারও গানে না হলেও আমার গানে রবিদা দুটোর জায়গায় ঠিক তিনটেয় আসবেন!
আর একটা জিনিস রবিদার ছিল—সেটা হচ্ছে গান উনি গীতিকারকে কাছে বসিয়ে নিজের চাহিদামতো লিখিয়ে নিতেন। ছবির পরিচালক হয়তো নিজের চাহিদামতো কোনও গান গীতিকারকে দিয়ে লেখালেন—কিন্তু খুব কমক্ষেত্রেই সে গানটি সুর করতেন উনি। ওই গানের ভাবধারাটি বজায় রেখে ওঁর সামনে গীতিকারকে আবার লিখতে হত। প্রণব রায়, গৌরীপ্রসন্ন, আমি সবাই দিনের পর দিন তা-ই করেছি। এর জন্য আমাদের কোনও কুঁড়েমি বা বিরক্তি হত না। আমরা জানতাম ওটাই রবিদার কাজের স্বভাব!
‘জয়া’ ছবির স্ক্রিপ্ট, পরিচালক চিত্ত বসু আমাকে আর রবিদাকে একসঙ্গে শুনিয়েছিলেন। স্টুডিয়োতে স্ক্রিপ্ট শুনিয়ে চিত্তদা আমায় বললেন—তুমি ভবানীপুরে (ওঁর বাড়ি এসো। আমার সামনে গান লিখবে।
রবিদা বললেন—পুলক, তা-ই কর। ওঁর মনের মতো করে লিখে দে। তারপর আমরা বসব।
আমি জানতাম, একবার চিত্তদার কাছে লিখে ওই গান-ই আবার রবিদার কাছে লিখতে হবে। এই মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে গেলাম ভবানীপুরে। একসময়ে লেখা শেষ হল জয়ার বিখ্যাত গানগুলো। চিত্তদা খুব খুশি।
চিত্তদা আমায় বললেন—এই গানগুলোই রাখতে বোলো রবিকে। কিছু অদল-বদল কোরো না। হুবহু এই গানগুলোই আমার চাই।
আঁতকে উঠলাম! আমি বলতে পারব না। আপনি গানগুলো কাউকে দিয়ে রবিদার কাছে পাঠিয়ে দিন।
আমি পড়লাম মহা বিপদে। জানতাম, রবিদা সে গানগুলো নিয়ে আবার আমাকে দিয়ে নতুন করে লেখাবেন।
সারারাত অস্বস্তিতে ঘুমাতে পারলাম না। রবিদা ডাকলে আমি ওখানে গিয়ে কী বলব? আবার লিখলে চিত্তদা অসন্তুষ্ট হবেন, না-লিখলে ক্ষেপে যাবেন রবিদা। ওই সময়েই হয়তো মান্না দের গাওয়া অনেক পরের একটি গানের আইডিয়া আমার মাথায় এসেছিল-—আমি কাকে খুশি করি বলো?’ মনে মনে ইষ্টদেবতাকে ডাকতে লাগলাম!
পরের দিন, মুম্বই থেকে মান্না দের ফোন এল—আপনার কথামতো লতাজির ডেট নিয়েছি অমুক তারিখে। আপনারা পারলে আজকেই না-হলে কাল-ই বম্বেতে চলে আসুন। বন্ধুবর শৈলেন মুখার্জির সুরে ‘দোলনা’ ছবির আমার লেখা— ‘আমার কথা শিশির ধোয়া হাস্নুহানার কলি’ গানটির জন্য লতাজির কাছ থেকে ডেট নিতে মান্নাদাকে আমি-ই অনুরোধ করেছিলাম। উনি ‘ডেট’ পেয়ে আমাদের ডাকলেন।
পরের দিনই আমরা মুম্বই চলে গেলাম। বেঁচে গেলাম রবিদার বকুনির হাত থেকে। যাবার সময় শুধু চিত্তদাকে বলে গেলাম আপনি তো বলেছেন—একটা গানও অ্যাতোটুকু বদলাবার প্রয়োজন নেই, তা হলে আপনি আমায় বম্বে যাবার ছুটি দিন আমি যাই! আপনার কাছ থেকে গান নিয়ে রবিদা সুরে বসে যান।
চিত্তদা বললেন—হ্যাঁ। তা-ই হবে তুমি যাও। ফিরে এসেই কিন্তু আমায় ফোন কোরো।
বুকের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ‘জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না’ শুনতে শুনতে মুম্বই-এর কাজ সারছি। ওখানেও আর একটা অভিজ্ঞতা আমার জন্য অপেক্ষমাণ ছিল। সেটা পরে বলব—এখন বলি ফিরে এসে চিত্তদাকে ফোন করার ঘটনা।
মুম্বই থেকে ফিরতেই বাড়িতে শুনলাম রবিদা যথারীতি আমায় ডেকেছেন ‘জয়া’র গান এদিক-ওদিক করার জন্য। শুনেছেন আমি মুম্বইতে। আশঙ্কায় দুরুদুরু বক্ষে চিত্তদাকে ফোন করতেই বললেন—তুমি আজকেই রবির সঙ্গে দেখা করো, পরশুই গান রেকর্ডিং। রবি ‘ফায়ার’ হয়েছিল—আমি ম্যানেজ করেছি। তুমি আরও ম্যানেজ করো।
তৎক্ষণাৎ রবিদার বাড়ি গেলাম। রবিদা পাশের জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন—এখন-ই হেমন্তকে গান তোলাতে টোপাবাবুর বাড়ি যাচ্ছি হরিশ মুখার্জি রোডে। তুমি ইচ্ছে করলে আমার গাড়িতে উঠতে পারো—গাড়িতে জায়গা আছে।
হেমন্তদাকে প্রথমেই তোলালেন জয়ার, আমার অত্যন্ত প্রিয় গানটি—’নবমী নিশিরে-তোর দয়া নাইরে।’ তারপর তোলালেন—’কেন যেতে গেলে যাওয়া যায় না? ‘ হেমন্তদা গান তুলে চলে গেলেন অন্য কী কাজে। রবিদা কিন্তু উঠলেন না। গাড়িতে বা এখানে আমার সঙ্গে একটাও কথা বলেননি। আমি কিন্তু বসে আছি। আমার মুখে কোনও আওয়াজ নেই।
রবিদা আর এক কাপ চা চাইলেন। চুমুক দিয়ে বললেন—টোপাবাবু, বাকি গান দুটো শুনুন।
টোপাদা বললেন—কাল-ই তো চারটে গান-ই শুনেছি সুরশ্রীতে। সুন্দর সুর হয়েছে। —তবুও আর একবার শুনুন-ই না।
বুঝলাম রবিদার রাগ পড়ে এসেছে। আমার গান লেখায় সন্তুষ্ট হয়েই আমাকেই গানগুলো শোনাতে চাইছেন—টোপাদাকে নয়।
রবিদা প্রথমে শোনালেন—’পানকৌড়ি পানকৌড়ি ডাঙায় এসো না।’
মুগ্ধ হলাম। তারপরই কী এক ভাবে রূপান্তরিত হয়ে শোনালেন—’হরে কৃষ্ণ নাম দিল প্রিয় বলরাম-অষ্টোত্তর শতনাম পেল নারায়ণ।’
এ গানের প্রশংসা জানাবার ভাষা আমার এল না। আমি তখনও নিশ্চুপ।
টোপাদা বললেন—পুলক, চমৎকার রিফ্রেন লাইনটা’ ওই ‘অষ্টোত্তর শত নাম পেল নারায়ণ টা লিখেছে——দারুণ দাঁড় করিয়েছে!
রবিদা প্রতিবাদ করলেন—ও কথাটা কালই সুরশ্রীতে আপনাদের আমিই তো বললাম।
আবার নতুন করে বলছেন কেন?
রবিদা হঠাৎ হাত জোড় করে আমার দিকে ফিরে বলে উঠলেন—ও ভাই বোম্বাইবাসী, সুর পছন্দ হয়েছে তো? আমার চাকরিটা থাকবে তো?
৭
আমার চোখে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য এক স্বতন্ত্র সত্তা। এমন একজন পরোপকারী ও হৃদয়বান শিল্পী আমি সংগীত জগতে খুব একটা দেখিনি। কত মানুষকে যে উনি হাতে ধরে এখানে নিয়ে এসেছেন, বলে শেষ করা যায় না।
ওঁর কলেজ স্ট্রিটের হোটেল বাড়িতে অনেকেরই একটা সুন্দর আড্ডার জায়গা ছিল। আমার আত্মীয় ও বন্ধু রতু মুখোপাধ্যায় ওখানের ওই আড্ডার নিয়মিত মেম্বার ছিল। আমিও অবশ্য মাঝেমধ্যে ওখানে যেতাম। একদিন রতু বললে, ধনঞ্জয়দা আমার সুরে এবারে পুজোর গান করবেন বলেছেন। তুমি গান নিয়ে চলো।
রতু তখন সম্পূর্ণ নবাগত। ও কারও সহকারীও ছিল না—সাংগীতিক পরিচয়ও কিছু নেই। সুর করাটা ছিল ওর নেশা। নিশ্চিত হলাম আমি—যখন ধনঞ্জয় বাবু বলেছেন তখন রতুর জন্য এইচ এম ভি-র দরজা খুলে যাবেই। উনি না থাকলে সনৎ সিংহ, পান্নালাল, মৃণাল চক্রবর্তী এমনকী ওঁর দাদা সুরকার প্রফুল্ল ভট্টাচার্যও সুযোগ পেতেন না। ধনঞ্জয়বাবু পান মুখে পুরে লাল ঠোঁট একটু খুলে আমায় বললেন—জানি, অবাক হবেন। হ্যাঁ পুজোর গান-ই করব আপনার বন্ধুর সুরে। সুযোগ যদি দিতেই হয় ভালভাবেই দেওয়া দরকার। প্রথমেই বেছে নিলেন উনি আমার খাতা থেকে ‘চামেলি মেলো না আঁখি, কেদারা রাগে সুর করতে বললেন রতুকে। খুব একরোখা লোক ছিলেন ধনঞ্জয়বাবু। সামান্য কারণে এক কথায় রেডিয়োর প্রোগ্রাম বর্জন করে দিয়েছিলেন বছরের পর বছর ধরে। তখনকার দিনে রেডিয়ো বর্জন করা একটা দুঃসাহসিক কাজ। সতীনাথ-শ্যামল উৎপলা-আলপনার রেকর্ডের ঝগড়া উনিই মিটিয়ে ছিলেন। অন্য কোনও নামী শিল্পী নয়। এতে ওঁর ব্যক্তিগত লাভ ছিল না কিছুই শুধু পরোপকারের আনন্দটুকু ছাড়া।
সংগীতমহলে তখন প্রায়-ই আলোচনা হত—কে বেশি বড়—হেমন্ত না ধনঞ্জয়। কিছু কিছু আলোচনা ওঁর কানেও পৌঁছুত। উনি কিন্তু মনে মনে হেমন্তদারই ফ্যান ছিলেন। যদি কেউ চাটুকারি প্রবৃত্তিতে ওঁকে বলতেন—আপনার যদি ভুলে যাও মোরে জানাব না অভিমান’, কিংবা ‘রাধে ভুল করে তুই’ গানটা কি হেমন্তদা গাইতে পারতেন? ভীষণ রেগে যেতেন। চেঁচিয়ে বলতেন—’কথা কোয়োনাকো শুধু শোনো’ ‘কিতনা দুখ ভুলায়ে’ও আমি গাইতে পারব না। হেমন্তবাবু হেমন্তবাবু-ই।
একবার অনেক ভেবে চিন্তে রেকর্ড করলেন—’দুটো মিষ্টি কথা শুনতে এলাম’। রেডিয়োতে গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ও গান সুপার হিট হয়ে গেল। রেকর্ড বেরুবার বেশ কিছু দিন বাদে ধনঞ্জয়বাবুর সঙ্গে আমার দেখা। বললাম আপনার এবারের গান তো সুপার হিট!
ধনঞ্জয়বাবু হেসে ঘাড় নামিয়ে বললেন—সুপারহিট কোথায়। এক লম্বু দুর্দান্ত গাইয়ে ‘হুম্ হুম্ না-হুম্ হুম না’ করে সবাইকে কাত করে দিয়ে গেল। ধনঞ্জয়বাবুর ‘রাণী রাসমণি’তে গাওয়া ‘গয়া গঙ্গা’ ইত্যাদি শ্যামাসংগীত জনপ্রিয় হয়েছিল। রেকর্ড কোম্পানি বারবার ওঁকে অনুরোধ করেছিল শ্যামাসংগীত গাইবার জন্য। উনি করেননি। বলতেন-—ওটা তো পান্না গাইছেই। আবার আমায় কেন? পাছে ভাইয়ের কোনও ক্ষতি হয় তাই নিস্পৃহ থাকতেন ধনঞ্জয়বাবু।
‘সাগরে উঠল কী ঢেউ’ গান গেয়ে নচিকেতা ঘোষের এ জগতে প্রবেশ। তারপর গান গাওয়া ছেড়ে হয়ে গেলেন সুরকার। আগেই বলেছি ওঁর সুরে আমার লেখা প্রথম গানটির কথা-ও আমার ‘চন্দ্রমল্লিকা বুঝি চন্দ্ৰ দেখেছে।’
এই নচিকেতার সুরে আমি অজস্র গান লিখেছি। তার পঁচানব্বই ভাগ কিন্তু কথার ওপর সুর বসানো। সুধীন দাশগুপ্তের ঠিক উল্টো।
সপ্তাহে দু-তিন দিন সকালে আমরা গান নিয়ে বসতাম। সে গান কোন ছবিতে হবে কোন শিল্পী গাইবে কিছুই ভাবতাম না। শুধু সৃষ্টির আনন্দে ভরপুর থাকতাম আমরা দুজন। যখন কোনও শিল্পীর তাগিদ আসত আমরা ওর মধ্যে থেকে বেছে দিতাম গান। সন্ধ্যা মুখার্জির ‘নেব না সোনার চাঁপা কনক চাঁপা ফেলে’ ‘দিন নেই ক্ষণ নেই’, প্রতিমা ব্যানার্জির-’মেঘলা ভাঙা রোদ উঠেছে, সতীনাথের—সূর্যমুখী আর সূর্য দেখবে না’, ইলা বসুর ‘ওই কোকিল শোনায়।’ ‘অ্যাতো কাছে পেয়েছি তোমায়’। শ্যামল মিত্রের— ‘ওই রাত পোহালো’, উৎপলা সেনের ‘কিংশুক ভারী হিংসুক’, ললিতা ধর চৌধুরীর প্রথম রেকর্ড ‘ওই লাল গোলাপটা দাওনা আমায় দাও না’, দ্বিজেন মুখার্জির আবার দুজনে দেখা—কুতুবের মিনারে।’ সবিতা চৌধুরীর প্রথম রেকর্ড ‘ডাগর ডাগর নয়ন মেলে টগর মনি’ প্রভৃতি বহু গান এভাবেই রেকর্ড হয়েছিল।
সুরসৃষ্টির একটা নেশা ছিল নচিকেতা ঘোষের। আর ছিল গীতিকারের কাছ থেকে ভাল গান আদায় করার বুদ্ধি। গৌরীপ্রসন্ন ওঁর খুবই প্রিয় গীতিকার ছিলেন। কিন্তু আমাকেও দারুণ পছন্দ করতেন। অনেক পরে বুঝেছিলাম দুজনকে লড়িয়ে দিয়ে দুজনের কাছ থেকে সত্যিকারের ভাল গান আদায় করে নেবার এ একটা অভিনব টেকনিক। একদিন দশ-পনেরো বার আমাকে গেয়ে শোনালেন গৌরীবাবুর লেখা ‘মালতী ভ্রমরে করে ওই কানাকানি।’ পরদিন-ই সকালে আমি লিখে ফেললাম—’বেঁধোনা ফুল মালা ডোরে/ কানু প্রেম গেঁথে নিও মালা করে।’ একদিন আমাকে বার তিনেক গেয়ে শোনালেন গৌরীবাবুর রোমান্টিক লেখা—সূর্য ডোবার পালা আসে যদি আসুক, বেশ তো।’ তখন-ই আমি লিখে ফেললাম—‘এক বৈশাখে দেখা হল দুজনার’। আমার জীবনের একটা সেরা রোমান্টিক গান। আজকে উনি শোনালেন ওঁর ভিন্নধর্মী গান ‘মানুষ খুন হলে পরে’—পরদিন আমি লিখে দিলাম—এমন একটা ঝিনুক খুঁজে পেলাম না যাতে মুক্তো আছে।’ গৌরীবাবু বলতেন, জানেন, নচিকেতার হাতে একটা দাঁড়িপাল্লা আছে ও তার একদিকে একবার আমায় চাপায় আর একবার অন্যদিকে আপনাকে
গৌরীবাবু ছিলেন আমার মামার সহপাঠী। স্বভাবতই আমার থেকে বয়সে অনেক বড়। যখনই আমাদের দুজনার তুলনামূলক কোনও আলোচনা কোথাও শুনতেন—অমনি হাসতে হাসতে বলতেন—আমি পুলকের আগে জন্মেছি আগে গান লিখেছি আগে স্বীকৃতি পেয়েছি। তা ছাড়া দ্যাখো ইংরিজিতে আগে ‘জি’ পরে ‘পি’, বাংলাতেও আগে ‘গ’ পরে ‘প’ সুতরাং পুলক আমাকে টপকে যেতে পারবে না কিছুতেই।
এ কথাটার জের টেনেই সেবার ওঁর স্মৃতিসভায় বলেছিলাম—উনি শুধু আগে আসেননি স্নাতক হয়েছেন আমার আগে। আমি পরে। গাড়ি কিনেছেন আমার আগে— আমি পরে। বিয়ে করেছেন আমার আগে—আমি পরে। পৃথিবী থেকে চলেও গেলেন আমার আগে, আমি ওঁকে কিছুতেই হারাতে পারলাম না।
আবার নচিকেতা ঘোষের কথায় আসি। গান সৃষ্টির একটা আশ্চর্য ‘প্যাশান’ ছিল ওঁর। নিজেই বলতেন—রোজ সকালে তোমাদের যেমন গরম তাজা টাটকা চা না হলে চলে না—আমারও তেমনি একটা টাটকা তাজা গানে চুমুক না দিতে পারলে মনটা ছটফট করে।
একদিন সকালে ফোন করলেন—ও পুলক, কোনও গান নেই। আমি হারমোনিয়াম নিয়ে বসে আছি। শ্যাম (ওঁর তবলচি) শুধু শুধু তবলা পেটাচ্ছে। হয় এখনি এসো-না হয় টেলিফোনেই একটা গানের ‘মুখড়া’ দাও।
আমার কাছেও কোনও গান ছিল না। জিজ্ঞাসা করলাম—কী ধরনের গান তৈরির মুড এখন?
তখন সবে ওঁর প্রথমা স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে।
উনি নিজেই আমাকে বলে ফেলেছেন ওঁর মনের অনেক গভীর নিবিড় কথা। অকপটে স্বীকারও করেছেন ওঁদের সম্পর্কের অনেক কিছু।
হঠাৎ মাথায় এল ওই ব্যাপারটাই! টেলিফোনেই বললাম—লিখে নিন, দুটো লাইন। কাল-পরশু একদিন গিয়ে গানটা শেষ করব। লিখুন ‘ক’ ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালবাসবে/পথের কাঁটায় পায়ে রক্ত না ঝরালে কী করে এখানে তুমি আসবে?’
নচিবাবু আমার ‘এক্সটেম্পোর’ বলা কথাগুলোর জবাব দিলেন প্রায় এক মিনিট পরে। শুধু বললেন—আবার বলো। আবার বললাম। শুনে টেলিফোন লাইনটা কেটে দিলেন। কী একটা কাজ নিয়ে সবে তখন বসেছি। আবার টেলিফোন। এবার অন্য ধরনের কণ্ঠস্বর! এক্ষুনি চলে এসো। আমি তোমার গাড়ির পেট্রোলের দাম দেব। ব্যাপারটা ভীষণ জরুরি।
অগত্যা তখনই সালকিয়া থেকে ছুটতে হল পাইকপাড়ায়। ওঁর তখনকার বাড়িতে। শুনলাম মুখড়ার সুর। লিখলাম অন্তরা। বেলা দুটোয় শেষ হল গানটা। অনেক পরে মান্নাদা ওটা রেকর্ড করেছিলেন। ঠিক এইভাবেই নচিবাবু তখন ভবানীপুরে, তখন একদিন সকালে ছুটতে হয়েছিল আমাকে। মুখড়া দিয়ে বিপদে পড়েছিলাম— আমার ভালবাসার রাজপ্রাসাদে/নিশুতি রাত গুমরে কাঁদে’। এ গানটাও পড়ন্ত দুপুরে শেষ হয়েছিল। এবং এটাও রেকর্ড করেন মান্নাদা। অবশ্য পরবর্তীকালে। আগেই বলেছি আমাদের গান তৈরি থাকত। সময়মতো সেগুলো দেওয়া হত—ঠিক ওই বিশেষ গানটির উপযোগী বিশেষ শিল্পীকে।
সেবার নির্মলা মিশ্রের পুজোর গান করার ভার এল আমাদের ওপর। নির্মলাকে দেওয়া ঠিক করা হল—’এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না’ এবং উল্টো পিঠে আরও
একটি—খুব-ই গভীর ভাবের ‘স্লো রিদমের’ (বড় তালের) গান। নির্মলা এল গান তুলতে। শুনে বিরস মুখে বললে-—দেখুন, আপনারা তো ফাংশানে যান না—আমরা ফাংশানে গান করি। রিদম না হলে আজকাল কোনও গান-ই হিট করে না। দুটো গানের একটাও জমবে না। গান দুটো চেঞ্জ করে দিন।
তর্কে না-গিয়ে আমরা বললাম—ঠিক আছে—নতুন গান তৈরি করে আমরা খবর দেব।
চলে গেল নির্মলা। বললাম—নচিবাবু, আমি কিন্তু নতুন গান লিখছি না। আপনি অন্য কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নিন।
নচিবাবুও বললেন—পাগল নাকি? এ গান ও যদি না গায়, তা হলে আমি ওর ট্রেনিংই করব না।
সপ্তাহ দুয়েক কেটে গেছে। আবার নচিবাবুর টেলিফোন: পুলক, নির্মলা আমার মা-কে ধরেছে। মা আমায় ওর গান করতে বলছে। মাকে ফেরাই কী করে? তুমি যা হোক কিছু একটা করো। অগত্যা আমাকেও রাজি হতে হল। তবে শর্ত দিলাম—’এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না—’ গাইতেই হবে—উল্টো পিঠের গানটা বদলে দেব।
আরও বললাম—নির্মলাকে ডাকুন, ওর সামনেও যেমন রিদম-এ বলবে—তেমন গান বানানো হবে।
‘এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না’টা বাধ্য হয়ে তুলল নির্মলা। উল্টো পিঠের গানটা ঠিক ও যেমন বলল—তেমনিভাবে বানালাম আমরা। ও গানটা শিখে আনন্দে প্রায় নাচতে নাচতে বাড়ি চলে গেল। বলে গেল—একদম মনের মতো গান পেয়েছি।
দুঃখের বিষয়, ‘এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না’-টাই জমল অর্থাৎ হিট করল—উল্টো পিঠের গানটা কেউই জানে না—আমার মনে হয়, নির্মলারও মনে নেই।
নচিবাবুর সুরে ‘ছুটির ফাঁদে’ ছবির কাহিনীকার সমরেশ বসুর ইচ্ছে হল উনিই ‘ছুটির ফাঁদে’র গানগুলোও লিখবেন। নচিবাবু আমায় জানালেন—আমি তো মুশকিলে পড়ে গেলাম। উনি হয়তো গীতিকবিতা লিখে দেবেন। কিন্তু ফিল্মের গান — সিচুয়েশনের গান—সুরের সঙ্গে না-লিখতে পারলে গান জমাব কী করে? সিটিঙে তুমি একটু এসো— সমরেশবাবুকে হেল্প কোরো। গেলাম—দুদিন সকালে। সমরেশবাবু ওঁর উপন্যাস লেখার সময় নষ্ট করে গান নিয়ে বসলেন। কিন্তু সুরের ওপর লেখার ব্যাপারটা বুঝতেই পারলেন না। অনেক চেষ্টায় কোনও রকমে খাড়া করা হল— আমি এখন সিক’ গানটি। তারপরে সমরেশবাবু হাসতে হাসতে আমায় বললেন—আমার শখ মিটেছে। বাকি গানগুলো আপনি লিখুন। আমার লেখা ‘ছুটির ফাঁদে’-র নদীর যেমন ঝর্না আছে’, ‘এখানে তীর ছোঁড়ে তীরন্দাজ’, ‘মুশকিল আসান’ গানগুলো দারুণ পছন্দ হয়েছিল সমরেশবাবুর। উনি এখন নেই, কিন্তু ওঁর সেই ভাললাগাটুকু আজও আমার সঙ্গে আছে।
‘স্ত্রী’ ছবির সময় বেশ একটা ঘটনা ঘটেছিল। এক সন্ধ্যায় আমরা গান বানিয়ে পরিচালক সলিল দত্তের বাড়ি গেলাম। সবাই গান শুনলেন। গান ‘অ্যাপ্রুভ’ হয়ে গেল। আমরা রাতের খাওয়া শেষে ‘একটু বেশি রাতেই’ সলিলের বাড়ি থেকে বেরুলাম! নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিলাম। গভীর রাতের রেড রোড ধরে আসতে আসতে বার বার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলাম। সেদিন গাড়িতে যদি কেউ থাকত হয়তো ভয় পেয়ে যেত। মনে হচ্ছিল—একটা গান আর সকলের ভাল লাগলেও আমার ভাল লাগছে না। আমি ও গানটা হয়তো আরও ভাল লিখতে পারব। আমি বোধহয় নিজেকে ফাঁকি দিচ্ছি!
বাড়িতে এসে আমাদের সাবেকি বসতবাড়ি ‘সালকিয়া হাউস’-কে গভীর রাতে ভিন্ন চোখে দেখলাম। মনে হল, এ বাড়ির ঝাড়লণ্ঠনেও দুঃখের দীর্ঘশ্বাস। কেমন যেন করুণা এল ইঁট-মার্বেলে বন্দি এ বাড়ির বাসিন্দাদের প্রতিও। অত রাতেই আমার শোবার ঘরের টেবিলে বসে লিখে ফেললাম—’খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার এই তোমাদের পৃথিবী।’
৮
সেদিন রাতে ঘুমোতে পারিনি। ওই গানটা নিয়ে মনের মধ্যে যে খুঁতখুঁত ভাব ছিল সেটা কিছুতেই যাচ্ছে না। অতএব, সাত সকালে হাজির হয়ে গেলাম সলিলের কাঁকুলিয়ার বাড়িতে। ও ঘুম চোখে দরজা খুলল। আমাকে দেখে চমকে গেল।
সরাসরি বললাম—কালকের ও গানটা দারুণ সুর হলেও আমার ঠিক পছন্দ হয়নি। ওটা আরও ভাল করা যায়। লিখে এনেছি। তুমি শোনো।
সলিল গরম চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল—বেশ তো, শোনাও।
পড়ে শোনালাম—’খিড়কি থেকে’ গানটা।
সলিল মানল এটা ও গানটার থেকে অনেক ভাল। পরেই একটু স্তিমিতভাবে বলল—কিন্তু আগের গানের ওই সুরে এই কথাগুলো বসানো যাবে তো? এবার অসহায় হয়ে গেলাম আমি। না, তা যাবে না। নতুন করে সুর করতে হবে। তবে আমি নচিবাবুকে জানি—উনি সাদরে গ্রহণ করবেন এ গান।
সলিল বললে—তা হলে আর ভাবনা নেই। তুমি ওকে দিয়ে এসো গানটা।
বললাম—অসম্ভব। অত খেটে ও সুর করেছে। কাল সবাই শুনে খুশি হয়েছে। এখন যদি বদলাতে বলি—তা হলে প্রথম রাগের ধাক্কাটা পড়বে আমার ওপর। আমি দিতে যেতে পারব না। তুমি, তোমার এই গানটাই বেশি পছন্দ হয়েছে—এ কথাটা চিঠিতে লিখে প্রোডাকশানের লোক দিয়ে নচিবাবুর কাছে পাঠিয়ে দাও।
ঠিক আমি যা আশা করেছিলাম তা-ই হল। নচিবাবু টেলিফোনে আমায় ওঁর ভঙ্গিতে বললেন—অ্যাতোদিন এ লেখাটা কোন খড়ের গাদায় পুরে রেখেছিলে? একটা ধেড়ে ইঁদুর বুঝি খড়ের গাদা থেকে এ কাগজটা মুখে করে নিয়ে এল।
মনে আছে ‘ধন্যি মেয়ে’র ‘যা যা বেহায়া পাখি যা না’ গানটা সুরের সঙ্গে লেখা শেষ হতেই ইমোশানে আমার গালে একটা চুমু খেয়েছিলেন নচিবাবু। যখন মাধুরী চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম রেকর্ড করার জন্য ‘অলি অমন করে নয়’ আর ‘তোমায় আমায় প্রথম দেখা গানের প্রথম কলিতে’ ওঁকে পড়ে শোনালাম—-তখন গান দুটো শুনেই বললেন—পুলক, নিশ্চই এখন তোমার ক্ষিধে পেয়েছে, তোমাকে আমি খাওয়াব। তাই তো কী খাওয়াই বলো তো? আমিও ইমোশানে উৎসুক হয়ে ভাবছি—কী খাবার আসে? শামাবাজারের পাঁচ মাথার মোড়ের পাঞ্জাবির দোকানের ‘ডেভিল’—না ‘কাটলেট?’
নচিবাবু কাজের লোককে চেঁচিয়ে বললেন—এই— পুলকের জন্য ছ’টা সরের নাডু এনে দে তো?
যেদিন ‘ফরিয়াদ’ ছবির ‘নাচ আছে গান আছে/রূপের তুফান আছে’ আর ‘এ আমার বুক ভরানো ছোট্ট একটা চিঠি’ শেষ হল লেখা—আমায় নিয়ে গিয়ে খাওয়ালেন উজ্জ্বলা সিনেমার ডালমুট—নিজে খেলেন মুঠো মুঠো, পাগলের মতো। যেদিন ‘ছিন্নপত্র’ ছবির ‘তোমাকে স্বপ্নে দেখেও সুখ / তোমাকে সামনে দেখেও সুখ’ লিখলাম বললেন— চলো–আমারা দুজনে কোথাও ‘অসভ্য’ করে আসি। বলেই হা-হা করে হাসতে লাগলেন।
আর একবার উনি তখন দীর্ঘ কয়েক বছর নিষ্ফল মুম্বই-এ বাস করে কলকাতায় ফিরে এসেছেন—আরতি মুখার্জির পুজোর গান নিয়ে আমরা বসেছি — শোনালেন মুম্বইতে বানানো একটা হিন্দি গান—আজা—ও মেরি’ ইত্যাদি। সুরটা দারুণ ভাল লাগল। লিখে ফেললাম—’লজ্জা—মরি মরি এ কী লজ্জা’। দারুণ জমে গেল গানটা। উল্টো পিঠটা কী করি? বললাম—কাল সকালে গান লিখে নিয়ে আসব। সারাদিন ভাবি।
আমাদের বাড়ি গঙ্গার ধারে আহিরিটোলা ঘাটের ঠিক অপর পাড়ে বাঁধাঘাটের কাছেই। মধ্যে ফেরি-স্টিমার চলে। সেদিন গাড়ি ছিল না। স্টিমার পেরিয়ে বাড়ি আসব ঠিক করে গঙ্গার ঘাটে দাঁড়ালাম। আহিরিটোলায় স্টিমার ঘাটের পাশেই স্নানের ঘাট। হঠাৎ নজরে পড়ল—একটা লেখা—সাবধান, গভীর জল!
স্টিমারে এ পারে আসতে পাঁচ মিনিট লাগে। ওরই মধ্যে মনে মনে আমার লেখা হয়ে গেল—’জলে নেবো না—আর থৈ পাবে না/থৈ থৈ করে নদী এখন যে বরষা’ পরদিন সকালে ও গানটা পেয়েই তৎক্ষণাৎ অপূর্ব সুর করে ফেললেন নচিবাবু। করেই বললেন—চলো, এখন পার্ক স্ট্রিটে যাই। ওখানে খাওয়া দাওয়া করব। যা-খুশি খাব, তুমি বাধা দেবে না। এমন সব অজস্র ঘটনা রয়েছে আমার সঙ্গে ওঁর আমার কাজের। এইসব আশ্চর্য লোক এখন এ জগতে নেই, বুকটা খাঁ খাঁ করে। সত্যি, এখন কাজের সে আনন্দই নেই—সব-ই মেকানিক্যাল—সব-ই ফর্মাল।
আর একজন গায়ক-সুরকারের প্রকৃত মূল্যায়ন আজও হয়নি। তিনি অখিলবন্ধু ঘোষ। সেবার এক বড় কম্পিটিশানে মেয়েদের মধ্যে প্রথমা হয়েছিল আরতি মুখার্জি আর পুরুষ বিভাগে গানে প্রথম হয়েছিলেন নির্মলকুমার। স্কটিশ চার্চ কলেজে আমার থেকে দু ইয়ারের সিনিয়র ছিলেন নির্মলদা। নির্মলদা অখিলবন্ধুর কাছে গান শিখতেন। একদিন সন্ধ্যায় আমায় নিয়ে গেলেন ওখানে। (এই নির্মলদাই আমাকে দিয়ে জীবনে একটা দুঃসাহসিক কাজ করিয়ে নিয়েছিলেন। ‘কোহিনুর’ রেকর্ডে আমার শুধু কথায় নয় সুরেও গেয়েছিলেন দুটো গান!) সেদিন যখন ভবানীপুরের টার্ফ রোডে অখিলবন্ধুর বাড়ি পৌঁছুলুম তখন আলো ঝলমল করছে গোটা ভবানীপুর। একালের সহজলভ্য লোডশেডিং তখন কারও কষ্টকল্পনাতেও আসত না। কিন্তু অখিলবন্ধুর বাড়ি অন্ধকার। ঢুকতে ঢুকতে নির্মলদা বিড়বিড় করে বললেন—আজও অখিলদার ইলেকট্রিকের বিলটা দিয়ে আসার সময় হল না। একটা ঘরে ঢুকে মাদুরে বসলাম আমরা। ঘরটা ধূপের গন্ধে আর সিগারেটের ধোঁয়ায় ভর্তি। একটা মোটা মোমবাতি জ্বলছে। কেদারা রাগে একটা উচ্চাঙ্গ গীতি গাইছেন শিল্পী। একজন তবলা বাজাচ্ছেন। শুনছেন অনেক ছাত্র এবং অন্যান্য শ্রোতা।
গান শেষ হতেই উপস্থিত সবাই ‘সাধু সাধু’ বলে উঠলেন। হেসে প্রত্যেককে প্রত্যাভিবাদন জানিয়ে শিল্পী বললেন—এই যে নির্মল, কখন এলে?
নির্মলদা বললেন অনেকক্ষণ। এ হচ্ছে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। খুব ভাল গান লিখছে। অখিলবন্ধু তৎক্ষণাৎ হারমোনিয়মটায় আবার ওই কেদারা-রাগ বাজিয়ে বললেন—লিখুন তো একটা গান। ‘কেদারা’ দিয়ে শুরু করব পরে আনব ‘বসন্ত’ বা ‘বাহার’। আইডিয়াটা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। লিখুন—লিখুন— চুপ করে বসে আছেন কেন? কাল বালিগঞ্জে মুম্বই থেকে অশোককুমার ফাংশান করতে আসবেন। উনি নিজে আমায় ডেকেছেন ওখানে। এ গানটা গাইব। এক ঘর ভর্তি লোক। ধোঁয়ায় ভর্তি ঘর। টিমটিমে আলো। লিখে ফেললাম— আজি চাঁদিনী রাতি গো/মালাখানি গাঁথি গো/ফিরে যেও না/যেও না’
বালিগঞ্জের অনুষ্ঠানে ও গানটা গাইলেন অখিলবন্ধু। গান শেষে মঞ্চে উঠে এক বাঙালি গায়ক-শিল্পীকে গোলাপফুল দিয়ে অভিবাদন জানালেন আর এক বাঙালি নায়ক-শিল্পী অশোককুমার।
আগেই বলেছি ‘লাক’ বা যোগাযোগ বা আমাদের সাংগীতিক পরিভাষায় ‘টিউনিঙ’। ওই রাতের ঘটনা থেকেই আমার সঙ্গে সেই ‘টিউনিঙটি হয়ে গেল অখিলবন্ধু ঘোষের। এই টিউনিঙের ফলেই প্রথম গান থেকেই অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়—ভূপেন হাজারিকা—হেমন্ত মুখোপাধ্যায়—মান্না দে–রতু মুখোপাধ্যায়-নচিকেতা ঘোষ সুধীন দাশগুপ্ত—গোপেন মল্লিক—রাজেন সরকার—অরূপ—প্রণয় -বাবুল বোস—মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় —-অজয় দাশ এবং আজকের বিখ্যাত বাপি লাহিড়ি ইত্যাদি অনেক সুরকারের সঙ্গেই আমি বহু জনপ্রিয় সুপারহিট গান বাঁধতে পেরেছি।
যতদূর স্মরণে আসছে অখিলবন্ধু ঘোষ প্রথম আমার গান রেকর্ড করেন মুম্বাই থেকে লেখা পোস্টকার্ডে পাঠানো একটি গান। গানটি লিখে নিয়ে গিয়েছিলাম শচীন দেব বর্মণের জন্য। শচীনদা অনিবার্য কারণবশত সে গানটি রেকর্ড করতে পারেননি (এই অনিবার্য কারণটা ভারী মজার ব্যাপার—পরে শোনাব) কিন্তু গানটি আমার কাছে শুনেছিলেন। শুনেই বাঙাল ভাষায় বলেছিলেন—দারুণ গান। যে গাইবে ‘সুপার হিট’ করবে। তখনই উদ্দীপনায় হাতের কাছে একটা পোস্টকার্ড পেয়ে মুম্বই থেকে গানটি লিখে পাঠিয়ে ছিলাম অখিলবন্ধুর কলকাতার ঠিকানায়। গানটিও দয়াল বিচার করো—দাও না তারে ফাঁসি/আমায় গুণ করেছে/আমায় খুন করেছে ও বাঁশি।’
এই গানটিরই আর এক রূপান্তর নির্বিবাদে আমায় হজম করতে হয়েছিল বাংলাদেশে—ঢাকায়। বাংলাদেশের অভিনেত্রী রোজিনার প্রযোজক স্বামী ঢালী সাহেব চমৎকার মানুষ। আমার বিশেষ পরিচিত বন্ধু। ওঁর বাংলা দেশের ছবি ‘কুঁচবরণ কন্যা’ এখানেও নতুন করে তৈরি করেছিল আমার নিজের ছোট ভাইয়ের থেকেও কাছের স্বজন ‘টোটন’(গৌতম সিংহ রায়) আর ‘টনি’। টোটন এখানে নতুন সুরে ‘মিউজিক ট্রাক করা’ ‘কুঁচবরণ কন্যা’র গানগুলো ঢাকার দুই অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন আর এন্ড্রুকি শোর-কে দিয়ে প্লে-ব্যাক করানোর জন্য আমায় নিয়ে গেল ঢাকায়। বলাবাহুল্য, গান লিখেছিলাম আমি। ঢাকার ‘এলভিস স্টুডিয়ো’তে গান ডাবিং করার সময় সাবিনা আর এন্ড্রুর গান গাওয়ার যে পরিচয় পেয়েছিলাম—তা আজও ভুলিনি। দুজনেরই গলার অসাধারণ রেঞ্জ, চমৎকার গায়কী। আমায় মুগ্ধ করে দিয়েছিল ও দুজন শিল্পী।
স্বভাবতই সেবার আমরা ঢালী সাহেবের আতিথ্য নিয়েছিলাম। ওখানেই এক দিন ঢালী সাহেব আমাদের বাজিয়ে শোনাল ওর আগেকার এক সুপারহিট ছবি ‘রাধাকৃষ্ণ’র কয়েকটি সুপারহিট গান। শুনে দেখি আমার ও দয়াল বিচার করো’ গানটির কথাগুলো দিব্যি না-বলে ব্যবহার করা হয়েছে একটি গানে। ব্যাপারটা হাসতে হাসতে জানালাম ঢালী সাহেবকে। ও সহজ সরল মানুষ। এ সবের কিছুই জানত না। আমায় শুধু বলল—যাঃ। তা হলে কী হবে?
বললাম—কী আর হবে? অঢেল খাবার তো খাওয়াচ্ছ—ওই গানটার ‘অনারে’আমি আর টোটন না হয় এখানকার খাঁটি ঘিয়ের দু প্লেট করে ‘চিকেন বিরিয়ানি’ বেশি করে খাব। মনে আসছে আমার লেখা অখিলবন্ধু ঘোষের দরদী কন্ঠে গাওয়া বহু বহু গানের কথা। ‘তোমার ভুবনে ফুলের মেলা আমি কাঁদি সাহারায়’। ‘ঐ যাঃ আমি বলতে ভুলে গেছি/ও যেন বাঁশি না বাজায়/’ ‘না হয় মন দিতেই তুমি পারো না/তাই বলে যে মন পাবে না/ কেন এমন ধারণা?’ ‘আমি কথা দিলে কথা রাখি’ ‘সেদিন চাঁদের আলো চেয়েছিল জানতে ওর চেয়ে সুন্দর কেউ আছে কি/আমি তোমার কথা বলেছি।’ ‘কবে আছি কবে নেই।’ ‘সারাটি জীবন কী যে পেলাম’’কেন তুমি বদলে গেছো’ ‘যে তোমায় সাধু সাজায়’ ‘যেন কিছু মনে কোরো না/কেউ যদি কিছু বলে’ ইত্যাদি।
সন্ধ্যা মুখার্জির বড়দাকে অনুরোধ করাতে আমার কথায় সন্ধ্যা গেয়েছিল— অখিলবন্ধুর সুরে দুটো গান -—যমুনা কিনারে রাত আঁধারে’ ‘আমার মনে নেই মন কী হবে আমার’। শেষের গানটি আমার খুবই প্রিয়।
এইচ. এম. ভি. আমার স্মরণীয় আধুনিক গান নিয়ে যে ক্যাসেটটি বার করেছে—তাতে দিয়েছি গানটি। এই অখিলবন্ধুরই একটা অদ্ভুত ব্যাপার আমি লক্ষ করেছিলাম। সেটাই এবার বলি। মেগাফোনের কর্ণধার কমল ঘোষ আমার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একদিন আমায় বলল—পুলক, এবার একটু চেঞ্জ করো, অখিল তো বরাবরই নিজের সুরে গাইছে, এবার অন্য কোনও সুরকারের সঙ্গে লেখো। প্রস্তাবটা মনে হল সুফল দেবে। কিন্তু অখিলবন্ধুর একটা বিশেষ ধারা বা টাইপ’ আছে। ওর গান বানাবে কে? কিছুকাল আগে সন্তোষ মুখোপাধ্যায়ের দুটো পুজোর গান লিখেছিলাম—’রিম্ ঝিম্ ধ্বনি শুনি কার পায়’ এবং ‘এ কী কথা আমি লাজে মরি’। মাথায় এল সন্তোষদার নাম।
কমল বলল—খুব ভাল ভেবেছিস—তুই সন্তোষদার সঙ্গে বসে যা, আমি অখিলকে বলে রাখছি।
গান তৈরি হল। গান তুলতে এলেন অখিলবন্ধু। আশ্চর্য কিছুতেই গান তুলতে পারলেন না। দুদিন-তিনদিন ধরে রীতিমতো কসরত করে রেকর্ড করলেন সে গান। অন্যের সুরে বাঁধা পড়ে হারিয়ে গেল শিল্পীর দরদী কন্ঠের মুক্ত আবেগের ওঠানামা। স্বভাবতই ‘ফ্লপ’ করল রেকর্ডটা।
একদিন রাতে বাড়িতে বেশ আরামে ঘুমোচ্ছি। শোবার ঘরের দরজায় মৃদু মৃদু ধাক্কা শুনতে পেলাম। চমকে উঠে দেখি ঘড়িতে রাত তিনটে।
দরজা খুলতেই আমাদের পুরানো দারোয়ান গলা নামিয়ে হিন্দিতে বলল—দুজন বাবু আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। এত রাত্রে দুজন বাবু? পাশের ঘরে বাবা ঘুমোচ্ছেন। অতি সন্তর্পণে পা ফেলে ফেলে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।
চোখে পড়ল দু জন বাবু—বাবলি সরকার আর শ্যামল মিত্র।
৯
হেমন্তদা যে কথাটা বারবার বলতেন—আমিও চিরদিন তারই প্রতিধ্বনি করে গেছি। কথাটা হচ্ছে ‘ভাগ্য’ অর্থাৎ ‘লাক’। শ্যামল মিত্রর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল খুবই অন্তরঙ্গ। আমার লেখা ওর গাওয়া অজস্র সুপারহিট গান আছে—কিন্তু ওর সুরে আমার একটাও গান হিট করেনি। অথচ আমরা দুজনে কাজ করেছি প্রচুর ছবিতে—প্রচুর রেকর্ডে।
বন্ধুত্ব কেমন ধরনের ছিল সেটারই একটা ঘটনার আগে উল্লেখ করি। সেদিন রাত তিনটেতে শ্যামল আর বাবলি সরকারকে আমার সালকিয়ার বাড়িতে দেখে মনে হয়েছিল নিশ্চয়ই ওরা কারও মৃত্যু সংবাদ নিয়ে এসেছে। তখন এখনকার মতো ‘সারা রাত্রব্যাপী বিরাট বিচিত্রানুষ্ঠানে রাত বারোটা অবধি কোনওরকমে দু-তিনজন শিল্পীকে দিয়ে বাংলা গান গাইয়েই অমুক কণ্ঠ অমুক কণ্ঠীরা বেসুরো ব্যান্ডপার্টির সঙ্গে ‘রিভার্ব মাইক’ দিয়ে বেসুরো গান নৃত্যসহযোগে শোনাবার সাহস পেত না। বা একটা গান শেষ হতেই হাততালি পেয়ে শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে ‘থ্যাঙ্ক ইয়ু’ ‘থ্যাঙ্ক ইয়ু’ বলে নিজেদের বিদেশি বিদেশিনী জাহির করার উৎসাহই পেত না বা শ্রোতারাও প্যান্টের সঙ্গে হাওয়াই চপ্পল পরে এভাবে গানের সঙ্গে শিস দিয়ে নাচত না! তখন সারা রাত্রই হত বাংলা গান। হেমন্তদা অনুষ্ঠানে থাকলে রাত ভোরে দরাজ গলায় গাইতেন—
‘যখন ভাঙল মিলন মেলা’। মান্নাদা থাকলে সদ্য ওঠা ভোরের আলোয় ‘লাগা চুনুরি মে দাগ’ গেয়ে আসর মাত করে অনুষ্ঠান শেষ করতেন।
সেই সময়েই সম্ভবত বালি বা উত্তরপাড়ার কোনও এক বিচিত্রানুষ্ঠানে রাত আড়াইটেতে গান শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমার বাড়ির কাছে এসেই শ্যামলের মনে হয়েছে আমার কথা। ঢুকে পড়েছে বাড়িতে। বাবলিদাকে বলেছে রাত জেগে আসরে পুলকের গান গাইছি আর পুলক বেশ আরামে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। ডাকো পুলককে?
বৈঠকখানায় বসালুম দুজনকে। শ্যামল জানত উত্তমকুমার বিশ্বজিৎ আর শ্যামলকে আমার বাবা ভীষণ ভাল বাসতেন। কোনওরকমে যদি শোনেন শ্যামল এসেছে এখনি হাজির হয়ে যাবেন বাবা।
শ্যামল গলা নামিয়ে বললে—মেসোমশাই আসবেন না তো?
বললাম—না। আমাদের দারোয়ান বুদ্ধিমান। তাই রাত্রিতে ‘বেল’ বাজায়নি। নিজে ওপরে এসে দরজায় টোকা দিয়েছে।
শ্যামল নিশ্চিন্তে একটা সিগারেট ধরাল। বলল, প্রোগ্রাম হয়ে গেল। এক্ষুনি বাড়ি যেতে মন চাইল না। তা-ই তোর কাছে এলাম। আলো ফুটলে তোদের পাড়ার গরম জিলিপি আর চা খেয়ে বাড়ি যাব। এই ছিল তখনকার কণ্ঠশিল্পী আর গীতিকারের সম্পর্ক। আজকের শিল্পীরা হয়তো এটা কল্পনাই করতে পারবে না।
মনে আছে, উত্তমের ‘ভ্রান্তিবিলাস’ ছবি হচ্ছে। পুজোর কয়েকদিন পরেই গান রেকর্ডিং। মহাসপ্তমীর রাতেই শ্যামল বাংলার বাইরে তিন-চার দিন ফাংশান করতে চলে যাবে। এসেই রেকর্ড করবে সন্ধ্যা মুখার্জির দুটো গান। সেইমতো রেকর্ডিং ডেটও নেওয়া হয়ে গেছে। আমি সন্ধ্যার জন্য তুমি কি সে তুমি নও’ আর ‘এতো ভোরে যেওনা গো জাগেনি সজনী’ গান দুটি লিখে উত্তমকে দিয়ে অ্যাপ্রুভ করিয়ে নিয়েছি। শ্যামলেরও খুব পছন্দ হয়েছে। শ্যামল বলেছে চমৎকার ছন্দ আছে, ভাল সুর হবে।
মহাষষ্ঠীর দুপুর নাগাদ শ্যামলের ফোন এল। আজকে গান দুটো নিয়ে বসেছি। গানের কথা সুরের খাতিরে একটু অদল বদল করতে হবে। তুই কাল সকালে একটু কষ্ট করে আয়। বলতে হল—কাল মহাসপ্তমী, আমাদের বাড়িতে দুর্গাপুজো। কী করে যাব? তা ছাড়া, উত্তম আসবে, তুই-ও চলে আয় না।
শ্যামল অনুরোধ করলে—প্লিজ একটু আয়। কাল রাতেই যে আমি বাইরে চলে যাব। নোটেশ্যান দিয়ে যেতে চাই। আধঘণ্টায় তোকে ছেড়ে দেব।
শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করলাম: পুজোর ভিড়ে আমি গাড়িই চালাতে পারব না। ও শুনে বললে—ট্যাক্সি করে চলে আয়। একটু সকাল সকাল আয়। আমরা গান দুটো শেষ করে আমার গাড়িতে উত্তম আর গৌরীকে ভবানীপুর থেকে তুলে নিয়ে একসঙ্গে সবাই তোর সালকিয়ার বাড়িতে অঞ্জলি দেব। মহাসপ্তমীর প্রসাদ খেয়ে আসব।
ঠিক হেমন্তদার মতো, শ্যামলও কখনও কোনওদিন পরচর্চা করত না। কথার দামও ছিল ওর অসাধারণ। পরিচালক প্রফুল্ল চক্রবর্তী উত্তমকে নিয়ে ‘সখের চোর’ ছবি তৈরি করছে। একদিন শ্যামল আর আমি একসঙ্গে উত্তমের বাড়ি এসে পড়েছি। উত্তম আমাকে দেখেই বললে—মামা, (আমায় চিরকাল ‘মামা’ বলেই ডাকত।) তোমার কথাই ভাবছিলাম। প্রফুল্লদাকে বলেছি, সখের চোর-এ তুমি গান লিখবে আর শ্যামল সুর করবে। কী শ্যামল ভাল হল না ব্যাপারটা? শ্যামল বললে—নিশ্চয়ই। সিচুয়েশন পেলেই আমি পুলকের সঙ্গে বসে যাব।
প্রফুল্লদার বাড়িতে টেলিফোন ছিল না। এক দিন শ্যামল ফোন করল, অমুক দিন বিকেল পাঁচটায় প্রফুল্লদা সিচুয়েশন বোঝাবেন। প্রফুল্লদার বাড়ি ছিল বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছে। নির্দিষ্ট দিনে ওঁর বাড়ির কাছে এসে দেখি তখন মাত্র চারটে বাজে, পাঁচটা বাজতে এখনও পাক্কা একঘণ্টা বাকি।
আমাদের বন্ধু স্থানীয় রমেন ঘোষের গড়িয়াহাটের ‘নিরালা’ রেস্টুরেন্টে একঘণ্টা সময় কাটিয়ে ঠিক পাঁচটায় ওখানে যাবার মনস্থ করলাম।
নিরালায় ঢুকে দেখি ‘বড়দা’ (সন্ধ্যা মুখার্জির বড় ভাই রবীন মুখোপাধ্যায়) আর এক গীতিকার বসে আছেন। বড়দা উচ্ছ্বসিত হয়ে আমায় ডাকলেন: আরে, পুলকবাবু যে! এ সময়ে এ পাড়ায় কোথায় চললেন? গানের জগতের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ের খোঁজ নেওয়া ছিল বড়দার বহুদিনের অভ্যাস।
বললাম—এই এ পাড়ায় একটু কাজ আছে। তা-ই এসেছি। একটু চা-টা খেয়ে তারপর যাব।
বড়দা তক্ষুনি বললেন—আমি খাওয়াচ্ছি। সঙ্গে একটা চিকেন কাটলেট অর্ডার দিয়ে ডাকলেন ওঁদের টেবিলে। বসালেন ওঁর-ই পাশে।
অদ্ভুত স্পষ্ট বক্তা মানুষ ছিলেন এই বড়দা। প্রচুর কথা বলতেন। আগেই বলেছি উনি না-থাকলে সবসময় সকলের সঙ্গে ওভাবে নিবিড় যোগাযোগ না-রাখলে সন্ধ্যা মুখার্জি হয়তো এত বড় হওয়ার সুযোগই পেতেন না।
বড়দা নিয়মিত সপ্তাহে একদিন রাত এগারোটা নাগাদ আমায় ফোন করতেন। টেলিফোনে জমাতেন আড্ডা। অক্লান্তভাবে কথা বলে যেতেন। তখন টেলিফোন ইলেকট্রনিক্স হয়নি। ঘনঘন শুনতে হত না এই ‘বিপ’ ‘বিপ’ (লাইন কেটে দিন—লাইন কেটে দিন)। এক-একদিন কথা ফুরিয়ে গেলে রাত বারোটার পরে বলতেন আচ্ছা গুড় নাইট। এক-একদিন কিছুতেই কথা শেষ করতে চাইতেন না। বলেই যেতেন। ঘুমে আমার চোখ জুড়িয়ে আসত। আমি আবিষ্কার করেছিলাম একটা মহান অস্ত্র। ঘড়িতে যখন দেখতাম রাত সাড়ে বারোটা তখন সেটা প্রয়োগ করতাম। হঠাৎ বলতাম, ওহো। এতক্ষণ কথা বলছি, অথচ একটা জরুরি কথা বলতেই ভুলে গেছি।
বড়দা হয়তো ভাবতেন—সন্ধ্যার কোনও জরুরি প্লে-ব্যাকের কথা। উপদেশ দিতেন, বলছি না সব সময় পকেটে একটা ছোট ডায়রি রাখবেন। এই তো ভুলে যাচ্ছিলেন। যা হোক, বলুন কী ব্যাপার?
বলতাম: আজই সকালে আমার দুজন আত্মীয় চুঁচুড়া কলেজের দুজন ছাত্র এসেছিল। ওরা সন্ধ্যার ডেট চায়। সন্ধ্যাকে দিয়ে ফাংশন করবে।
মন্ত্রের মতো কাজ হত। ফাংশান শুনলেই ও বড়দা হয়ে যেতেন অন্য বড়দা। সঙ্গে সঙ্গে বলতেন—কাল সকালে ফোন করবেন। আজ গুড নাইট। কেটে দিতেন টেলিফোনটা।
আমি নিশ্বাস ফেলে এক গেলাস ঠাণ্ডা জল ঢকঢক করে খেয়ে শুয়ে পড়তাম।
যা হোক, আবার ‘নিরালা’ রেস্টুরেন্টে ফিরে আসি। বড়দা আর ওই গীতিকারও আমার সঙ্গে কাটলেট আর চা খেলেন। অনেক গল্প হল। হাত ঘড়িতে দেখলাম প্রায় পৌনে পাঁচটা। এবার উঠতে হয়!
বড়দা আর ওই গীতিকারকে নমস্কার জানিয়ে উঠে পড়লাম।
গীতিকার বললেন—আমি একটু থাকি, ছটায় প্রফুল্ল চক্রবর্তীর বাড়িতে যেতে হবে ‘সখের চোর’-এর গানের সিচুয়েশন বুঝতে। শ্যামল ওখানে থাকবে।
‘নিরালা’ থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে মনে হল পৃথিবীটা দুলছে। শ্যামল তা হলে স্রেফ একটা আইওয়াশ করাবার জন্য আমায় প্রফুল্লদার বাড়িতে ডাকল। পাঁচটার সময় প্রফুল্লদার কাছ থেকে সিচুয়েশন বুঝে নিয়ে ছটায় অন্য গীতিকারকে দিয়ে গান লেখাবে? উত্তমকে বলবে—পুলক ঠিক সিচুয়েশন মতো লিখতে পারল না তাই বাধ্য হয়ে অন্য গীতিকারকে নিতে হল?
জানতাম, বুঝতাম, আমাদের গানের জগৎ নানা নোংরা রাজনীতিতে ভর্তি। এ-ও একটা তার-ই নতুন চাল। ঠিক করলাম, শুধু শুধু অপমানিত হতে প্রফুল্লদার বাড়িতে যাব না। বাড়ি ফিরে যাই। পর মুহূর্তেই মনের জোর করলাম—দেখাই যাক না খেলাটা। না হয় এখান থেকে সোজা চলে যাব উত্তমের বাড়ি। আগে থেকেই উত্তমকে ঘটনাটা কোন দিকে গড়াতে পারে জানিয়ে রাখব। বুকে সাহস সঞ্চয় করে এলাম প্রফুল্লদার বাড়ি। প্রফুল্লদা ঘড়ি দেখলেন পাঁচটা পাঁচ।
বললেন—শ্যামল এখনও আসেনি। এলে জমিয়ে চা খেয়ে কাজ শুরু করব।
শ্যামল এসে গেল। চা খাওয়া হল। প্রফুল্লদা স্ক্রিপ্টের ফাইলটা খুলতে গেলেন।
তখনই মরিয়া হয়ে বললাম: দাঁড়ান! শ্যামল কি অমুক গীতিকারকে ‘সখের চোর’-এর গান লিখতে ছ’টার সময় ডেকেছে?
শ্যামল আকাশ থেকে পড়ল—কী আবোল তাবোল বকছিস?
বললাম—মোটেই আবোল তাবোল নয়, এইমাত্র নিরালায় ওই গীতিকারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। উনি বললেন।
শ্যামল আশ্বস্ত করল আমাকে। ও চিরদিনই সব জায়গায় যখন-তখন কারণে-অকারণে এই রাজনীতি করে থাকে। তোর সঙ্গেও করেছে। আমি উত্তমের সামনে তোকে কথা দিয়েছি। তুই-ই গান লিখবি। আর কেউ নয়। দরকার হলে ছবিটাই ছেড়ে দেব আমি। জীবনে কথা দিয়ে কোনও কথার নড়চড় আমি কখনও করিনি, করবও না। তুই ঠাণ্ডা মাথায় গান লেখ। এমন লেখ যাতে উত্তম আমার আর প্রফুল্লদার মুখ থাকে। ওসব বাজে কথায় কান দিয়ে একদম মনোযোগ নষ্ট করিস না।
‘সখের চোর’-এ আমিই গান লিখেছিলাম।
শ্যামলের কণ্ঠে উত্তমের ঠোঁটে আমার লেখা ‘আমার ছন্দে ভরা ছোট্ট তরী যায় ভেসে’—অনেকেরই প্রশংসা কুড়িয়েছিল।
এ রকম ঘটনা শ্যামলের গান নিয়ে আমার জীবনে আবার ঘটেছিল। ছবির নাম—‘অন্য মাটি অন্য রং’।
পুরীতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ভোরবেলায় হাওড়া স্টেশনে নামতেই দেখি প্ল্যাটফর্মে বাংলা ছবির একজন বিশিষ্ট প্রোডাকশান ম্যানেজার। ভাবলাম, উনি হয়তো কাউকে নিতে এসেছেন। লোকের ভিড়ে আমাকে দেখেননি। আমিই সৌজন্যমুলক আচরণ করলাম—এই যে কেমন আছেন? কে নামছে ট্রেন থেকে?
ভদ্রলোক আমার কাছে দৌড়ে এসে বললেন—আপনার জন্যই স্টেশনে এসেছি। কাল রাতে বাড়িতে ফোন করেছিলাম। মা বললেন—আজই পুরী থেকে ফিরছেন। চলুন চলুন—আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। খুব দরকার।
অবাক হলাম-কোথায় যাব?
উনি বললেন—স্টুডিয়োতে। গান রেকর্ডিং। ন’টায় মিউজিশিয়ান আসছে। দশটায় আসবেন শ্যামল মিত্র। সুরের নোটেশ্যান দেওয়া হয়ে গেছে, শুধু গান লেখা হয়নি। চলুন চলুন।
বললাম, আগে খুলে বলুন ব্যাপারটা। শুনলাম, এক গীতিকারের গানে সুর দিয়ে আজকে রেকর্ড করতে যাচ্ছিলেন সুরকার হৃদয় কুশারি। কাল সন্ধ্যায় কী কারণে সুরকারের সঙ্গে গণ্ডগোল বেঁধে যায় ওই গীতিকারের। ওঁকে ওঁর প্রাপ্য অর্থ পুরোপুরি মিটিয়ে দিয়ে আমাকে দিয়ে গান লেখানোর সম্মতি পত্রে সই করিয়ে নেন প্রযোজক। সুতরাং এখনই স্টুডিয়োতে পৌঁছে ওই সুরের ওপর আমায় গান লিখে দিতে হবে।
আমার আপত্তি থাকার কথা নয়। আজকে গান রেকর্ডিং না হলে ওঁদের খুবই লোকসান হবে। সেট লেগে গেছে। বাধ্য হয়ে বাড়িতে লাগেজগুলো রেখে স্নানটা সেরে জামা কাপড় বদলে তখনই ছুটতে হল টালিগঞ্জ।
হৃদয় কুশারি মিউজিশিয়ানদের নিয়ে সুরের রিহার্সাল করতে লাগলেন। শুনতে শুনতে ওঁদের ছবির সিচুয়েশন মতো লিখে ফেললাম গান। শ্যামল সুন্দর গাইল—’তুমি মানুষকে দিয়েছিলে প্রেম/বিনিময়ে সে দিল হেলা/শুধু স্বার্থের এই সংসার/প্রভু এ কী তোমার খেলা’। গানটি রীতিমতো হিট করেছিল।
অকালে অনেক দুঃখ—অনেক নৈরাশ্য নিয়ে চলে গেল এই শ্যামল। রবীন্দ্রসদনে ওকে শেষ দেখতে দেখতে মনে হল—ও যেন আমাকে শুনিয়েই আমার একটা গান গাইছে—আমি তোমার কাছেই ফিরে আসব/তোমায় আবার ভালবাসব/ তুমি কি ডাকবে মোরে/চেনা সে নামটি ধরে?’
জানি না, শ্যামল আবার কবে ফিরে আসবে? কোথায় আবার আমাদের দেখা হবে!