৭০
যতদিন বাংলা ছবি বেঁচে থাকবে ততদিন যে দুজন শিল্পী অমর হয়ে থাকবেন তাঁরা হলেন উত্তম-সুচিত্রা। আগে ছবির টাইটেলে উত্তম-সুচিত্রা থাকত। পরে সেটা বদলে গিয়ে হয়েছিল সুচিত্রা-উত্তম। সে যাই হোক, দুজনেরই প্রতিভার আলোতে চিরদিনই প্রজ্জ্বল থাকবে বাংলা চিত্রজগৎ। জানি না বাংলা সিনেমাতে ওঁদের ছাড়িয়ে আর কেউ কোনওদিন আসতে পারবেন কি না।
সুচিত্রা সেনের যে ছবিতে আমি প্রথম কাজ করি, সেই ছবির পরিচালক ছিলেন নারায়ণচন্দ্র ঘোষ। যতদূর স্মরণে আসছে নারায়ণবাবুর ছবির সেটেই (ছবিটির নাম মনে আসছে না) মিসেস সেনের সঙ্গে আমার পরিচয়। বোধহয় দুদিন শুটিং-এর পরই ছবিটি অনিবার্য কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এবং অনেক পরে যখন আবার শুটিং শুরু হল তখন সুচিত্রা সেন আর ও ছবিতে অভিনয় করেননি। করেছিলেন অন্য নায়িকা
সুচিত্রা সেন অভিনীত অনেক ছবিতেই গান লেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তার মধ্যে যেসব গানের ঘটনাগুলো আমার মনে আসছে, সেইগুলো নিয়েই শুরু করি। ফরিয়াদ’ ছবির ‘নাচ আছে গান আছে’ এই গানটি ওই ছবির সুরকার নচিকেতা ঘোষ ওঁকে গেয়ে শোনাবার পরই মিসেস সেন আমায় বলেছিলেন, অপূর্ব লিখেছেন পুলকবাবু।
এই অভিনন্দনটি আজও আমার স্মৃতি ভাণ্ডারে অক্ষয় সম্পদ হয়ে আছে। গানটির মধ্যিখানে একটি দারুণ নাটকীয়তার প্রয়োজন ছিল। একটি লাইনে লেখা হয়েছিল ‘আমি হাসি/শুধু হাসি’। এর পরেই থাকবে সুরের ওপরেই গায়িকার একটি মর্মান্তিক হাসি। এবং সেই হাসিটি রূপান্তরিত হয়ে যাবে কান্নায়। অর্থাৎ হাসতে হাসতে গায়িকাকে কেঁদে ফেলতে হবে গানের সুরের ওপরই। অত্যন্ত কঠিন এই কাজটি কীভাবে মুম্বই-তে আশা ভোঁসলেকে দিয়ে করানো যাবে, এটা যখন আমরা চিন্তা করছিলাম, তখন ম্যাডাম অর্থাৎ সুচিত্রা সেন বললেন, দারুণ হবে ব্যাপারটা। আসুন আমি হেল্প করছি। টেপ রেকর্ডারটা চালাতে বললেন উনি। নচিবাবু গাইতে গাইতে ‘আমি হাসি/শুধু হাসি’ এই পর্যন্ত গাওয়ার পরেই উনি ইশারায় নচিবাবুকে থামিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে কেঁদে উঠে দেখিয়ে দিলেন এই অভিব্যক্তিটি কেমন হবে। সেই অসাধারণ অভিনয়কে টেপে রেকর্ড করে নচিবাবু মুম্বই-তে নিয়ে গেলেন। আশাজি টেপটি শুনেই বুঝলেন, কী জিনিস আমরা চাইছি। উনিও বিরাট শিল্পী। হাসতে হাসতে কেঁদে উঠে গেয়ে দিলেন সেই অংশটি। জানি না বাংলা ছবি আর কখনও সেই সুচিত্রা সেন আর সেই আশা ভোঁসলেকে ফিরে পাবে কিনা। তবে আমরা যে কিছু একটা করতে পেরেছিলাম সেটা আমরা ভুলব কেমন করে?
সুচিত্রা সেন কীভাবে চরিত্রের মধ্যে কত নিষ্ঠায় ডুবে যেতেন তার প্রমাণ পেয়েছিলাম এই গান যখন টেকনিসিয়ান স্টুডিয়োতে পিকচারাইজড হয় সেই দিন। উনি আমার কাছে কথা আদায় করে নিয়েছিলেন এই গানের শুটিং-এর দিন আমি স্টুডিয়োর ফ্লোরে থাকব। আমার যদি কোনও সাজেশন থাকে তা বিনা দ্বিধায় ওঁকে জানাব।
ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু উনি ভোলেননি। তাই শুটিং-এর সময় ঠিক হতেই ওঁর কাছ থেকে ফোন এল, আমি যাতে ফ্লোরে হাজির থাকি।
মুশকিলে পড়ে গেলাম আমি। আমার সেই দিনই অন্য আর একটি ছবির সিটিং-এর জন্য সময় দেওয়া ছিল। ওঁকে অনুরোধ করলাম। বললাম, আমি স্টুডিয়োতে যাব। তবে একটু দেরি হবে। আমার অবস্থাটা বুঝলেন ম্যাডাম। বললেন, ঠিক আছে। কিন্তু ওই সময়ের একটুও দেরিতে নয়। ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে বোধ হয় সে দিন টেকনিসিয়ান স্টুডিয়োতে পৌঁছেছিলাম। ফ্লোরের দরজাটা বন্ধ ছিল। কারণ খুবই স্বল্পবাসে এক ক্যাবারে নতর্কীর ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন ম্যাডাম। নিতান্ত প্রয়োজনীয় ব্যক্তি ছাড়া অন্য কোনও লোকের সে দিন ফ্লোরে ঢোকার অনুমতি ছিল না। আমি ফ্লোরের বন্ধ দরজার কাছে আসতেই খুলে গেল দরজা। চমকে দেখি সবেগে ফ্লোর থেকে বেরিয়ে আসছেন উনি। চোখেমুখে উষ্মা, ক্রোধ, জ্বালা। হতচকিত আমায় দেখে বললেন, আসুন আমার সঙ্গে।
উনি ফ্লোরের সামনের মাঠ পেরিয়ে ওঁর নিজস্ব মেক-আপ রুমের দিকে দৌড়ে চললেন। যে জায়গাটা এখন পাতাল রেলের কল্যাণে ভাঙা পড়েছে। হারিয়ে গেছে সুচিত্রা সেনের সেই বিখ্যাত মেক-আপ রুম এবং বিশ্রাম কক্ষটি।
আমি ওঁর পিছু পিছু ছুটলাম। আমার পেছনে ছুটতে লাগল প্রোডাকশনের একটি লোক। হাতে একটা চাদর নিয়ে। দেখলাম স্বল্পবসনা ম্যাডামের হুঁশই নেই নিজের পোশাক সম্পর্কে। ফ্লোরের বাইরের মাঠে কত লোকজন। উনি সবার চোখের সামনে দিয়ে সেই সাজেতেই ছুটে গিয়ে ঢুকলেন ওঁর মেক-আপ রুমে। ঢুকলাম আমিও। পেছনের প্রোডাকশন বয়টি চাদরটা ছুড়ে দিল ঘরের ভেতরে। মিসেস সেন দড়াম করে মেক-আপ রুমের দরজাটি বন্ধ করে দিলেন। ভেতরে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে দেখলাম এক অনন্য সুচিত্রা সেনকে। তখনও বাংলা ছবিতে নাচের দৃশ্যে কোনও ক্যামেরা ও এডিটিং জানা সম্পূর্ণ টেকনিক্যাল কোরিওগ্রাফার কেউ আসেনি।
আজকাল যেমন নাচের দৃশ্য গ্রহণের সময় চিত্রপরিচালকরা চেয়ারের ওপর বসে থাকেন। আর কোরিওগ্রাফার শট টেক করেন। ওঁরাই নাচের দৃশ্যটি এডিট করে দেন। বাংলা ছবিতে আগে এমন ছিল না। নৃত্যশিক্ষক অবশ্য একজন থাকতেন। তিনি নাচের কায়দাকানুন, মুদ্রা, অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি দেখিয়ে দিতেন। আর চিত্রপরিচালকই গ্রহণ করতেন নাচের দৃশ্যটি। এই প্রসঙ্গে মনে আসছে ‘কাল তুমি আলেয়া’ ছবিতে আমার লেখা এবং আশাজির গাওয়া ‘একটু বেশি রাতে…’ গানটি টেক করেছিলেন ওই ছবির পরিচালক নয়, ওই ছবির সুরকার ও প্রথম কোরিওগ্রাফার নায়ক, উত্তমকুমার।
যাই হোক নৃত্যশিক্ষকের শেখানো ‘ফরিয়াদ’ ছবির নাচ গানের দৃশ্যগুলি তখনকার রেওয়াজ মতো টেক করছিলেন ওই ছবির চিত্রপরিচালক। আমরা মনে হল যে কোনও কারণেই হোক ম্যাডামের সেদিনের টেকিংটি মনঃপুত হয়নি। উনি হাঁফাতে হাঁফাতে আমায় বললেন, জানেন ওঁরা খালি সেটের ছবি তুলছেন। কোথায় ক্লোজ শট? আপনি লিখেছেন ‘চোখের এই জল শুধু চেয়োনা/একে যায় না কেনা’। আমি আমার চোখের তারায় এই গানের এই হাসি আর কান্না একসঙ্গে নিখুঁত করে দেখাব বলে কতদিন সাধনা করেছি। আর তা দেখাবার কোনও স্কোপ নেই? (আমার এই ঘটনাটা লিখতে লিখতে দীর্ঘশ্বাস পড়ছে। আজকে বাংলার অভিনেত্রীরা যেমন এ ধরনের গানও পান না। আবার তেমনই এমন গান পেলেও এ ধরনের অভিব্যক্তি ফোটানোর সাধনা কতটুকু করেন তা আমার জানা নেই।) এবার ম্যাডাম উঠে দাঁড়ালেন। ফেলে রাখা চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বললেন, আপনি এত সুন্দর একটা গান লিখেছেন, নচিবাবু এত ভাল সুর করেছেন, আশাজি এমন চমৎকার গেয়েছেন, এ আমি কিছুতেই নষ্ট হতে দেব না। আমি চললাম। আজ প্যাক-আপ। কথা শেষ করেই মেক-আপ রুমের ভেতর থেকে বন্ধ করা দরজার ছিটকিনিটা একটানে খুলেই বেরিয়ে গেলেন ম্যাডাম।
আমিও সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। উনি সোজা উঠে গিয়ে বসলেন ওঁর গাড়িতে। চলে গেল গাড়ি।
ম্যাডাম, আপনি যদি এ লেখা পড়েন তা হলে নিশ্চয় মনে পড়ছে সেই দিনের ঘটনাটা। আমি তখন যেমন আপনার অপূর্ব নিষ্ঠাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলাম, আজ লিখতে বসে আবার নতুন করে সেই শ্রদ্ধা জানালাম।
ম্যাডাম তো চলে গেলেন। আমি পড়লাম বিপদে। ইউনিটের অনেকেই আমাকে ঘিরে ধরে প্রশ্ন করতে লাগলেন, কী বললেন উনি? আমি কী বলব, কী উত্তর করব ভেবে না পেয়ে, আমিও ওঁদের এড়িয়ে উঠে পড়লাম আমার গাড়িতে। তাড়াতাড়ি স্টুডিয়ো ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।
প্রযোজক পক্ষ ওঁর কাছে গিয়ে ওঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পরের দিনই নিয়ে এলেন ফ্লোরে। এবং ওঁর কথামতোই ক্লোজ শট দিয়ে ওই গানটির বিশেষ লাইনগুলো চিত্রায়িত হল। যাঁরা এই ছবিটি দেখেছেন, নিশ্চয় মনে রেখেছেন তাঁর অসাধারণ অভিনয়ের কথা। এবার এই ঘটনাটি জেনে সবাই বুঝতে পারবেন কেন সুচিত্রা অবিস্মরণীয়।
ওই ছবিতে আমার আর একটি গান আশাজির গাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ডেট সমস্যা দেখা দেওয়ায় আরতি মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে গাওয়ানো হয়েছিল। আরতিও দুর্দান্ত গেয়েছিল গানটি, ‘সে আমার বুকভরানো ছোট্ট একটা চিঠি’। ম্যাডাম রেকর্ডিং করে আনা এই গানটি শুনেই মুখ তুলে তাকালেন। ভাবলাম হয়তো বিরূপ কিছু বলবেন। কিন্তু শুনে বললেন, চমৎকার গেয়েছেন আরতি মুখোপাধ্যায়। আমি গানের কথার ওপর সঠিক অ্যাকটিং চাই। গান, যিনিই গান আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমি যে গানে অ্যাকটিং করব তার ব্লুপ্রিন্টটাই নিখুঁত না হলে, তবে তাকে আমার অভিনয় দিয়ে মনের মতো করে সাজিয়ে গুজিয়ে বানাব কী করে? একজন শিল্পীর এই কথাতেই বোঝা যায়, উনি কোন জাতের শিল্পী এবং কত বড় শিল্পী।
আর একটা ঘটনা মনে আসছে। প্রযোজক অজয় দত্ত যখন আমার কাহিনী ‘রাগ অনুরাগ’ নিয়ে ছবি করবেন ঠিক করলেন, তখন বিভিন্ন নামের মধ্যে ওঁরা পরিচালক হিসাবে বেছে নিলেন দীনেন গুপ্তের নাম। দীনেনবাবু প্রযোজক অজয় বসুর হয়ে আমার কাহিনী অবলম্বনে ‘প্রান্তরেখা’ ছবিটি করেছিলেন। সুতরাং আমাদের মানসিকতার মেলবন্ধন ছিলই। এই জন্য দীনেন গুপ্তকে ধরতে আমি ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি ‘দেবী চৌধুরানী’-র শুটিং চলছে। সেদিনই মানবেন্দ্ৰ মুখোপাধ্যায়ের সুরে সন্ধ্যার গাওয়া এবং আমার লেখা ‘চেয়োনা ও চোখে চেয়ো না’ গানটির পিকচারাইজেশন করছেন সুচিত্রা সেনকে দিয়ে। শটের ব্রেকে দীনেনবাবুকে আমার আসার কারণটা বললাম। ম্যাডাম জানতে পেরে হাসতে হাসতে ঠাট্টা করে বললেন, কী দীনেনবাবু আমি আছি তো? উত্তরে আমি বললাম, আপনি থাকলে তো ধন্য হয়ে যাব। যাই হোক কথাবার্তার দিন ঠিক করে চা খেতে খেতে শুটিং দেখতে লাগলাম। দেখলাম ম্যাডামের সেই অপূর্ব দুটো চোখের জাদু। গানে যা লিখেছিলাম তাকে বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়ে কীভাবে প্রাণবন্ত করে দিচ্ছেন এক একটি শট। বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। যাবার সময় ওঁকে বলে চলে আসতে যাচ্ছি আবার সেই স্বভাবসিদ্ধ রসিকতা করলেন উনি। বললেন, খোকাবাবু, (দীনেনবাবুর ডাক নাম) পুলকবাবুর আমার কাছে থাকতে ভাল লাগছে না। কার কাছে যাচ্ছেন জেনে নিন তো?
তৎক্ষণাৎ ওঁর কাছে গিয়ে বললাম, আপনারা কাজ করছেন। আমার শুধু শুধু থাকার কী দরকার? উত্তরে সিরিয়াসলি বললেন, বা, কেমন হচ্ছে বলবেন তো?
বললাম, একটা কথাই মনে আসছে। একসেলেন্ট! উনি বললেন, ব্যাস্। আর কোনও কথা নেই? এটা শুনে লাভ কী? বলুন কোথায় ভুল, কোথায় ত্রুটি।
এবার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আমি ওসব বলতে পারব না। ও সব বলবেন পত্রিকার সমালোচকরা। এ কথা শুনে সেই অপূর্ব ভঙ্গিতে মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, দিলেন তো মেজাজটা খারাপ করে? আমি বিব্রত হয়ে বললাম, আমি অমনি বললাম। কিছু মনে করবেন না। ম্যাডাম বললেন, তা হলে বসুন। দেখুন আপনার গানের পিকচারাইজেশন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সুচিত্রা সেন ‘দেবী চৌধুরানী’ হয়ে গেলেন।
৭১
সুচিত্রা সেন অর্থাৎ আমাদের ম্যাডামকে নিয়ে আরও টুকরো টুকরো স্মৃতি মনে আসছে। তখন সলিল সেন তৈরি করছিলেন হার মানা হার ছবি। ওই ছবির সময় দেখা হতেই বললেন, ভাল লিখেছেন, আকাশ নতুন বাতাস নতুন/সবই তোমার জন্য। সুধীনবাবু সুরও করেছেন ভাল। বাকি সব গানই তো উত্তুর (উত্তমকে ওই নামেই ডাকতেন)। আমার আর গান কোথায়? কেন লেখেননি আমার জন্য আর কোনও গান
কথাটা শুনেই চমকে উঠলাম। তৎক্ষণাৎ ম্যাডাম নিজেই স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে বললেন, না, আমার এই চরিত্রে আর গান মানাত না। ঠিক করেছেন সলিলবাবু।
আলো আমার আলো ছবির ‘এই এত আলো এত আকাশ’ গানটা তৈরি হওয়ার পর ম্যাডামের সঙ্গে দেখা হতেই বলেছিলাম, পানুদা (পরিচালক পিনাকী মুখোপাধ্যায়) বললেন একই গাড়িতে আপনি আর উত্তমকুমার পাশাপাশি যেতে যেতে গানটা গাইবেন। অথচ গানটা হবে শুধু পুরুষ কণ্ঠে? আমার ধারণা এটা ডুয়েট হলে গানটা আরও জমবে।
কথা শুনে হেসে উঠলেন ম্যাডাম। আমায় আশ্বস্ত করে বললেন, ওটা উত্তম একাই গাইবে। আমি পাশে থাকব। ক্যামেরার একই ফ্রেমে দু জনকে দেখা যাবে। অথচ আমি গাইব না। কিন্তু দেখবেন শুধু এক্সপ্রেশনে গানটা ডুয়েট গান করে দিতে পারি কি না।
যাঁরা এই ছবি দেখেছেন তাঁদের সবাইকেই মানতে হবে কী ধরনের অভিনয় দিয়ে একটা নতুন ধরনের গান করে দিয়েছিলেন ম্যাডাম এই ‘এত আলো এত আকাশ’ কে। অবশ্য গান পিকচারাইজেশন এবং শট টেকিংয়ে পরিচালক পিনাকীবাবুর অনবদ্য কর্মকুশলতার কথাও স্বীকার্য। মিসেস সেন আর পানুদার এই যোগাযোগটিও স্মরণীয়। কিন্তু এই গানেরই আর একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। পবিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সুরে মান্না দের কণ্ঠে আমার এই গানটি রেকর্ডিং হওয়ার পর একদিন উত্তমের সঙ্গে দেখা। কথায় কথায় আলো আমার আলো ছবির প্রসঙ্গ উঠতেই উত্তম বলল, মামা, আমি গানটি শুনেছি। গানটা ভাল হয়েছে। কিন্তু আমি লিপ দেব না।
কথাটা শুনে অস্ফুট স্বরে শুধু বললাম, সে কী?
দৃঢ় কণ্ঠে উত্তম বলল, না, আমার যা চরিত্র তাতে ও গান মানায় না। কথাটা বলেই উত্তম অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল।
গানটা সুপারহিট হবে এ বিশ্বাস আমার ছিল। কিন্তু ছবিতে যদি গানটা না-ই থাকে তবে হিট ফ্লপের প্রশ্নই তো আসে না।
একেবারে মুষড়ে পড়লাম আমি। সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য জানি না, কদিন বাদেই দেখা হয়ে গেল ম্যাডামের সঙ্গে। দেখা হতেই বললাম উত্তমের কথাটা। সেই ভুবনমোহিনী হাসি হেসে সুচিত্রা সেন বললেন, একটুও টেনশন করবেন না। আমি ওকে রাজি করাবই। গান পিকচারাইজেশন হয়ে গেলেই আপনাকে খবর দেব প্রোজেকশন দেখে যাবেন।
উত্তম যে রাজি হয়েছিল তার প্রমাণ তো আজও সবাই পাচ্ছেন, যারা দেখেছেন এই আলো আমার আলো ছবিটি। এই সুচিত্রা সেনের আবার বিস্ময়কর স্বাতন্ত্র্যও আমি দেখেছি। যেদিন উত্তম আমায় সপ্তপদী-র প্রোজেকশন দেখতে ইন্ডিয়া ফিল্ম ল্যাবরেটরির প্রোজেকশন রুমে ডাকল সেদিনই নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োতে ঢুকেই মুখোমুখি হয়েছিলাম ম্যাডামের সঙ্গে। শুভেচ্ছা বিনিময় হয়েছিল। আমরা অনেকেই প্রোজেকশন রুমে ঢুকলাম। উত্তমও ঢুকল। শুধু এলেন না ম্যাডাম। উত্তম ছবির প্রোজেকশন শুরু করতে নির্দেশ দিয়ে দিল। ফিস ফিস করে উত্তমকে বললাম, ম্যাডাম এখনও আসেননি তো? একটু দেরি করো।
উত্তম হেসে বলল, না। উনি সব্বার সঙ্গে বসে এ-ছবি দেখবেন না। উনি পরে প্রোজেকশন দেখবেন একেবারে একা। কেউই ওখানে থাকবে না। নিজেকে উপলব্ধি করবেন, কে বেশি স্বাভাবিক রিনা ব্রাউন না সুচিত্রা সেন।
মনে পড়ছে এই সপ্তপদী-র ওথেলো অংশটির কথা। আমার ধারণা কোনও বাংলা ছবিতে, শুধু বাংলা ছবি কেন কোনও ভারতীয় ছবিতেও ওথেলোর মতো এত বড় ইংরেজি সংলাপের দৃশ্য আজ পর্যন্ত সম্ভবত আসেনি। কেউই সাহস করেননি এমনধারা করতে। আজকাল যেমন হিন্দি-বাংলা বা ওড়িশি-বাংলা ছবি হামেশাই হচ্ছে। তেমনই আজ থেকে বহুদিন আগে মধু বসু করেছিলেন সাধনা বসুকে নিয়ে ইংরাজি-বাংলা ছবি কোর্ট ডান্সার ও রাজনর্তকী। ওই কোর্ট ডান্সারকে পুরোপুরি ইংরেজি ছবিই বলা যায়। এখনও মনে পড়ে সবে ইংরেজি অক্ষর চিনে বানান করে পড়তে শেখা এই আমি, কর্তাদাদুর সদ্য কেনা হামবার গাড়িতে চড়ে ইডেন গার্ডেন থেকে ফিরছিলাম। ওখানে তখন বিকালে গোরাদের ব্যান্ড বাজনা হত। সেই বাজনা শুনে ফেরবার পথে মেট্রো সিনেমার ব্যালকনিতে কোর্ট ডান্সার এই ইংরেজি কথাটি পড়ে কর্তাদাদুকে শুনিয়ে অবাক করে দিয়েছিলাম।
যাই হোক, সপ্তপদী যখন হয় তখনও প্রযোজক পরিবেশক এবং চিরাচরিত ফিল্মের একটা বাণিজ্যিক বাজার ছিল।
পরিচালক অজয় কর বা উত্তমকুমারকে কেউই কিন্তু একবারও বলেননি অত বড় ইংরেজি দৃশ্য দেবেন না। মফস্বলে বা গ্রাম বাংলায় কেউ বুঝবে না। কেটে ফেলে দিতে হবে। সেই সময় গানের ব্যাপারেও আজকের মতো কোনও তথাকথিত কর্তৃপক্ষের কাছে আমাকে বা আমাদের শুনতে হত না, দাদা, দোহাই, গানের এই অংশটি বদলে দিন। আজকাল যাঁরা সিনেমা দেখেন তাঁরা বুঝবেন না।
সত্যিই মাঝে মাঝে কেমন যেন সব গুলিয়ে যায়। আজকের চিত্রমোদীরা কি শিক্ষায়, কি সাংস্কৃতিক রুচিতে দু-তিন দশক আগের মানুষদের থেকে কী পিছিয়ে গেছেন। এই সপ্তপদী-র ওথেলো দৃশ্যটিকে প্রাণবন্ত করার জন্য আমি দেখেছি উত্তমের কী পরিশ্রম। নামী-অনামী কত শেক্সপিয়ারের নাটক করা এবং পড়ানো মানুষের ইংরেজি অভিনয়, উচ্চারণের অভিব্যক্তি দিনরাত চর্চা করত উত্তম। শেষটায় হাতের কাছে উৎপল দত্তকে পেয়ে যেন নির্ভরতা খুঁজে পেল। সেই সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ টিমের সময়কার ওথেলোর উৎপল দত্ত ডেসডিমোনার অভিনেত্রীটি অভিনীত টেপের ওপর উত্তমকে দিনের পর দিন যে অনুশীলন করতে আমি দেখেছি তা আজও আমার কাছে বিস্ময়! দৃশ্যটি প্রাণবন্ত হয়েছিল উত্তম-সুচিত্রার অভিনয়ের গুণে। তখনকার পরিশ্রমী উত্তমকে আমি তাই বলেছিলাম, তোমার চাল-চলন দেখে কবি সত্যেন দত্তের সবার আমি ছাত্র কবিতাটি মনে পড়ে যাচ্ছে।
উত্তরে উত্তম সেই ছোটি সি মুলাকাত ছবির নাচের দৃশ্য গ্রহণের সময় যেমন বলেছিল বৈজয়ন্তীমালা একজন নামী ডান্সার, আমি কি ডান্সার না কি? ওর সঙ্গে নাচতে হলে আমায় তো বেশি পরিশ্রম করতেই হবে। এবার ঠিক তেমন করেই বলল, শেক্সপিয়ারের ড্রামা আমি স্টেজে দেখেছি। ওদের দেশের সিনেমায় অনেক দেখেছি শেক্সপিয়ারের নাটকের ফিল্ম। কিন্তু অভিনয় তো কখনও করিনি। তাই আমাকে তো একটু বেশি করে ধ্যান দিয়ে পরিশ্রম করে লড়তে হবেই।
এখন এ সব ঘটনা ভাবলেই মনে হয় সেই অধ্যবসায়ও কি হারিয়ে গেল আমাদের? উত্তম প্রসঙ্গে আরও একটা ঘটনার কথা মনে আসছে। প্রায়ই যেমন সান্ধ্য মজলিশ জমাতে উত্তমের কাছে হাজির হতাম। সেদিন ঠিক তেমনই হাজির হলাম। উত্তম তখন কোথাও যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠছে। আমি বললাম, তা হলে আজ আসি। আর একদিন আসব।
উত্তম কিন্তু আমায় ছাড়ল না। জোর করে ধরে নিয়ে গেল আমাদেরই পরিচিত একজনের বাড়িতে। সেখানে গল্প-গুজব সেরে যখন উঠলাম তখন বেশ গভীর রাত। যেহেতু আমার গাড়ি রাখা ছিল উত্তমের বাড়ির সামনেই তাই আবার আমায় উত্তমের গাড়িতে চেপে উত্তমের বাড়িতেই ফিরতে হল। ওর বাড়িতে এসে যখন আমার গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি তখন বেশ আদেশের সুরে ও আমায় বলল, মামা, আমার সঙ্গে এসো, কথা আছে।
ঘরে ঢুকে বললাম, ওরা সব গেল কোথায়?
উত্তরে বলল, ওরা আজ কেউ নেই। আমি একা। সেজন্যই তো তোমায় ডাকলাম তোমার গাড়ি এখানে থাকুক। তুমি বাড়িতে ফোন করে দাও আজ এখানে থাকবে।
অতটা বোকা আমি নই। ওরা থাকলেও কতবার উত্তমের বাড়িতে আমি থেকেছি। উত্তম ভেবে নিয়েছে, গভীর রাতের কলকাতায় একা গাড়ি চালিয়ে বাড়ি যেতে নিশ্চয় আমার কোনও অসুবিধা হবে। তবু ওই যে বলল কথা আছে। ওই আকর্ষণেই বাড়িতে ফোন করে দিলাম, ফিরছি না। আর উত্তমের কাছে থাকছি এই কথা বললেই বাড়িতে আমার সাত খুন মাপ। এবারও তাই হল। (উত্তম এই ব্যাপারটা জানত। সেজন্য হাসতে হাসতে আমার মাকে এবং বউকে বলেছিল মামার কথা বিশ্বাস করবেন না। আমার সঙ্গে কথা বলে যাচাই করে নেবেন। মামা আমার কাছে থাকছে না অন্য কোথাও। )
যাই হোক, উত্তম একটা পাজামা বার করে দিয়ে বলল, মামা, এবার শুয়ে পড়া যাক।
আমি বললাম, কী কথা আছে বললে যে?
তৎক্ষণাৎ হয়তো ব্যাপারটা ওর মনে পড়ে গেল। আমরা আলোচনায় বসে গেলাম। আলোচ্য বিষয় ছিল যতদূর মনে পড়ছে লভ ইন দ্য আফটারনুন ছবিটার গল্প নিয়ে। যেটা সমরেশ বসুর জাদু কলমে হয়েছিল বিকেলে ভোরের ফুল। পরিচালক ছিলেন পীযূষ বসু। সংগীত ছিল হেমন্তদার। গীতিকার ছিলাম আমি। আলোচনা করতে করতে হঠাৎ ঘড়িতে দেখি অনেক রাত হয়ে গেছে। অতএব আর দেরি না করে তখনই শুয়ে পড়লাম আমরা। পরদিন ঘুম ভাঙল আমার সকাল এগারোটায়। ধড়মড় করে উঠে বসলাম। কাজের লোক এসে বলল, উঠেছেন? আপনাকে চা দি?
আমি বললাম, হ্যাঁ দাও। কিন্তু উত্তম কোথায়?
কাজের লোকটি বলল, উনি তো সকালে উঠে ময়দানে হেঁটে এসে স্নান করে ব্রেকফাস্ট সেরে স্টুডিয়োতে চলে গেছেন। বেশ রাগ করেই বললাম, আমায় ডাকলে না। উত্তরে কাজের লোকটি বিনীতভাবে বলল, আপনি ঘুমোচ্ছিলেন। সাহেব যে আপনার ঘুম ভাঙাতে বারণ করে গেলেন।
তৎক্ষণাৎ নিজের প্রতি ধিক্কার এল। সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি আমরা একসঙ্গে ছিলাম। একই শ্রান্তি আমাদের দু জনেরই ছিল। অথচ আমি একা পড়ে পড়ে ঘুমোলাম। আর উত্তম ঠিক সময় উঠে, সব কাজ সেরে চলে গেল শুটিং করতে। ও উত্তমকুমার হবে না তো আমি উত্তমকুমার হব?
৭২
উত্তম ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই চলে যেত ময়দানে হাঁটতে। এর ফলে ওর শরীর এবং মন তরতাজা থাকত। এইভাবে প্রাতঃভ্রমণ করার সময় একবার দারুণ বিপদের মধ্যে পড়ে যায় উত্তম। সেই সময় সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে চলছিল দারুণ রাজনৈতিক অস্থিরতা। একদিন সকালে ময়দানে হাঁটার সময় উত্তমের চোখে পড়ে গেল সেই মর্মান্তিক দৃশ্য। ওই দৃশ্যটি দেখে হাত পা ঠাণ্ডা হওয়ার উপক্রম হল উত্তমের। দুষ্কৃতীরা উত্তমকে চিনতে পেরেছিল কি না জানি না, তারা কিন্তু উত্তমের সামনে এসে নির্বিকারভাবে বলেছিল, আমরা কোনওদিন আমাদের কাজের সাক্ষ্যপ্রমাণ রাখি না। সব ঝেড়ে মুছে সাফ করে দিই। আপনি বলেই ছেড়ে দিলাম। তবে একটা কথা, যদি আমাদের কোনও বিপদ হয়, তা হলে কিন্তু আমরা আপনাকে ছেড়ে দেব না। কথাটা মনে রাখবেন।
রীতিমতো ভয় পেয়ে গিয়েছিল উত্তম। ওর মনে হয়েছিল, কলকাতায় থাকা ঠিক হবে না। অন্য কোনও সূত্রে খবর পেয়েও যদি ওদের কারও কিছু ঘটে যায় তার জন্যও ওরা তাকেই দায়ী করবে। অতএব রিস্ক নিয়ে কলকাতায় না থেকে কোথাও পালিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে উত্তম ঠিক করে। কালবিলম্ব না করে সেইদিনই উত্তম চলে গিয়েছিল কলকাতা ছেড়ে এলাহাবাদে।
উত্তমের এলাহাবাদে চলে যাওয়াটা কলকাতায় সবার কাছে অজ্ঞাত থাকলেও এলাহাবাদে কিন্তু অচিরেই জানাজানি হয়ে গেল। ওকে চিনে ফেলেছিল ওর কিছু অনুরাগী। তারপর যা হয়। লোকমুখে ক্রমশ সেই বার্তা রটে গেল। এ খবর এসে পৌঁছে গেল কলকাতায়। ডেট না পাওয়া পরিচালক জগন্নাথ বসু, রেডি স্ক্রিপ্ট নিয়ে হাজির হলেন এলাহাবাদে। প্রযোজক অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করলেন উত্তমকে। তাঁরা বোঝালেন, যতদিন এলাহাবাদে থাকবেন ততদিনই শুটিং হবে। আবার অন্য কোথাও গিয়েও যদি শুটিং করতে চান তাতেও তাঁদের আপত্তি নেই। কিন্তু উত্তম মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙে পড়ায় মনস্থির করে উঠতে পারল না। হতাশ হয়ে ফিরে আসেন তাঁরা।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে আর একটি ডেট না পাওয়ার ঘটনা। পরিচালক বাসু ভট্টাচার্য উত্তমকে নিয়ে একটি ছবি করার পরিকল্পনা করে উড়ে আসেন সেই মুম্বই থেকে কলকাতায়। কলকাতা বিমানবন্দর থেকে সোজা চলে আসেন উত্তমের বাড়ি। আমার সামনেই উনি উত্তমকে একটা অদ্ভুত ধরনের প্রস্তাব দেন। বাসুবাবু উত্তমকে বললেন, ডেট বলতে যা বোঝায় সে-সব আমার লাগবে না। আপনি আপনার সময়মতো যেদিন খুশি কাজ করবেন। কোনও ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে আপনাকে যেতে হবে না।
উত্তম বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বাসুবাবুর কথা শুনে। বাসুবাবু বলে চললেন তাঁর পরিকল্পনার কথা। আমার গল্পটি একটি বাড়ির মধ্যেকার ঘটনা। সবটাই ইনডোরে শুটিং হবে। আমি একটা বাড়ি ভাড়া করে ইউনিটের সবাইকে নিয়ে অন্যান্য শিল্পীদের শুটিং সেরে আপনার প্রতীক্ষায় থাকব। যেদিন আপনার সিডিউলড ছবির শুটিং একটু তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে, অন্য কোথাও যাবার থাকবে না, সেদিন আপনি আমাদের কাছে চলে আসবেন। কয়েক ঘণ্টা আপনার শট টেক করব।
উত্তম বলল, কিছুই বুঝছি না। একটু খুলে বলুন
বাসবাবু বললেন, আমার গল্পের সবটাই আপনাকে ঘিরে। ছবির সবটুকু জুড়েই থাকবে আপনার অভিনয়। ছবিতে থাকবে হাতে গোনা কয়েকটি চরিত্র। আপনার সঙ্গে কো-আর্টিস্ট থাকছে না বললেই চলে। প্রয়োজন হলে আমাদের মধ্য থেকে কেউ তা সেরে নিতে পারবেন। এমনকী নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য অনামী হলেও প্রতিভাসম্পন্না এক অভিনেত্রীও আমাদের সঙ্গে থাকবেন। আপনি কেবল সিডিউলড ছবির শুটিং করতে করতে যখন বুঝবেন তখনই একটা খবর পাঠাবেন, আমি আসছি বলে। আমরা রেডি থাকব।
সমস্ত পরিকল্পনাটা শুনে উত্তম খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আমার দিকে একচোখ বুজে আর একটি চোখকে লক্ষ্মীট্যারা করে মায়ামৃগ ছবির সেই উক্তিটি করে উঠল হরিবোল।
বাসবাবুর উত্তমকে নিয়ে এই ছবিটি না হলেও বাসুবাবুর ভাবনাকে সাধুবাদ না জানিয়ে পারছি না। দুঃখ হয় একটা ভিন্ন স্বাদের বাংলা ছবি দর্শকরা দেখতে পেলেন না।
একক অভিনয়ের প্রসঙ্গে আমার একজনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। তাঁর নাম বাণী মুখোপাধ্যায়।
ছোটবেলায় আমার মামার বাড়ির উঠোনে তাঁর একক অভিনয় দেখেছিলাম সীতা নাটকে। কখনও রাম, কখনও সীতা কখনও অন্য কোনও ভূমিকায় তিনি একাই অভিনয় করে যাচ্ছিলেন। শুধু তাই নয়, রিলিফ দেবার জন্য হনুমানের ভূমিকাতেও তিনি অভিনয় করেছিলেন। একা এতগুলো ভূমিকায় অভিনয় করা ছাড়াও মেক-আপ, ড্রেস সবই তিনি নিজেই করেছিলেন। কী অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন তিনি। যাঁরা পুরনো দিনের যাত্রা থিয়েটারের খবর রাখেন, তাঁরা নিশ্চয় আমার সঙ্গে একমত হবেন, বাণীবাবুই প্রথম একক অভিনয়ের মাধ্যমে একটা বড় নাটককে দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছিলেন।
বাণীবাবুর সীতা যাঁরা দেখেছেন তাঁরাও সম্ভবত আমার সঙ্গে একমত হবেন। উত্তমের প্রসঙ্গ ছেড়ে এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। আমার খুবই কাছের মানুষ তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায়ই আমাকে একজন সুরকারের কথা বলত। তাঁকে কিছু গান দিতে প্রায়ই অনুরোধ করত। তরুণের সঙ্গে দেখা হলেই অনুরোধ-উপরোধ করত ওই সুরকারের জন্য। একদিন বিরক্ত হয়েই বললাম, ঠিক আছে, একদিন তাঁকে আমার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ো, দেখব।
এর কিছুদিন পরে একটি ছেলে সকালে এসে হাজির আমার বাড়িতে। নমস্কার করে বললেন, আমার নাম মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তরুণদা নিশ্চয় আমার কথা বলেছেন? তরুণদা একটা চিঠিও দিয়েছেন আপনাকে দেবার জন্য—বলেই চিঠিটি আমায় দিলেন। এরপর ওর সঙ্গে সম্পর্কটা তুমি হয়ে গেল। বললাম, দুটি গান দিচ্ছি, সুর করে শুনিয়ে যেয়ো। ভাল লাগলে পরে আরও গান দেব।
এর কিছুদিন পর এসে গান দুটি গেয়ে শোনাল। খুব ভাল সুর। মনকে দোলা দেবার মতো সুর। বললাম, মৃণাল তোমার যখনই প্রয়োজন হবে, আমার কাছে আসবে। আমি তোমায় গান দেব। কোনওরকম দ্বিধা দ্বন্দ্ব রাখবে না।
এই গান দুটি বেশ কয়েকজন শিল্পী আকাশবাণীর অনুষ্ঠানে গাইলেন। শ্রোতাদের ভাল লাগতে লাগল। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার। মৃণালই এর পর হঠাৎ বেপাত্তা হয়ে গেল।
আমার লেখা ঝাউকুটির উপন্যাসটি একটি সিনেমা ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হবার পর পরিচালক স্বদেশ সরকার ওই উপন্যাসের চিত্ররূপ দিতে মনস্থ করেন। একদিন স্বদেশবাবু এক প্রযোজককে নিয়ে আমার সঙ্গে বসলেন। কথাবার্তা সব পাকা হয়ে গেল। ঝাউকুটির নামটি পরিবর্তন করে রাখা হল হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ। গান লেখার দায়িত্বও দেওয়া হল আমাকে। বললাম, গান তো লিখব। কিন্তু সুর করবেন কে?
স্বদেশবাবুই বললেন, মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় হলে কেমন হয়? কে একজন বললেন, আলো আঁধারে ছবিতে মৃণাল ভাল সুর করেছেন। স্বদেশবাবু আবার বললেন, মৃণাল খুব ভাল সুর করেছে। কিছু গান শুনেছি, আমার তো ভাল লেগেছে। দেখুন না চেষ্টা করে।
সিটিং-এ বসে বুঝতে পারলাম মৃণাল কত পরিণত হয়েছে।
গানগুলোর সুর করল খুবই ভাল। তবে ছবি না চললেও মান্না দে, আরতি মুখোপাধ্যায় প্রমুখর গাওয়া গান কিন্তু হিট করে গেল। মৃণাল আর আমি এর পর করি সৌমিত্র-আরতি ভট্টাচার্য অভিনীত নন্দিতা ছবি। নন্দিতা ছবির একটি গান সন্ধ্যা মুখার্জির গাওয়া, যেদিনের সূর্য এসে/ তোমার চোখে/নতুন আলো ধরে/আমায় রাখো সেদিন করে। অবশ্যই উল্লেখ্য!
নন্দিতা ছবিতে সুরারোপ করার পর মৃণাল সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পেল সলিল দত্তের হিরে মানিক ছবিটির। ওই ছবিটির সংগীত নিয়ে সিটিং করার সময় আমার একটা প্রস্তাব শুনে মৃণাল চমকে উঠল। আমার দিকে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। আমার প্রস্তাব ছিল একটা সিচুয়েশনের গান নিয়ে। আমি বলেছিলাম, মৃণাল এই সিচুয়েশনে যে গানটা লিখব, সেই গানে তোমার একটা কাজ কমে যাবে। তোমাকে ওই গানের জন্য সুর করতে হবে না।
মৃণাল ঘাবড়ে গিয়ে বলল, তা কী করে হয়? আপনি কি আবৃত্তি করাতে চান?
ওর অবস্থা দেখে আমার হাসি পেয়ে গেল। হেসেই বললাম, ঘাবড়াচ্ছো কেন? আগে সবটা শোন।
বলুন।
টিভিতে একটা নাটকে তোমার গান শুনলাম। গানটার কথায় কোনও অ্যাপিল না থাকলেও সুর কিন্তু খুবই ভাল হয়েছে। ভাবছি ওই সুরের ওপর কথা লিখে দেব। আমার ধারণা গানটি হিট করবেই। হলও তাই। শুধু হিট নয়, সুপারহিট। গানটি ছিল—এই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে ঠিক/পৌঁছে যাবো।
৭৩
এবার অন্য প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। একদিন আমার বাড়িতে ফোন করলেন পরিচালক মনোজ ঘোষ। ফোনে আমাকে পেয়েই অসহায়ের মতো বললেন, দাদা, আমি দারুণ বিপদে পড়েছি। আপনি ছাড়া আর কেউ উদ্ধার করতে পারবে না।
বললাম, বিপদটা কী? সেটা আগে বলো।
মনোজবাবু বললেন, হেমন্তদা অসুস্থ। বলেছেন এক মাস কোনও ছবিতে কাজ করতে পারবেন না। আমি যে ছবিটা করছি সেটা মিউজিক্যাল ছবি। শুধু তাই নয়, শিল্পীদের ডেট নেওয়া হয়ে গিয়েছে। শুটিং ডেটও পাকা। অথচ গানের…।
মনোজবাবুকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, কী ছবি করছেন?
তুমি কত সুন্দর।
গল্পের জিস্টটা একটু বলবেন?
মনোজবাবু সংক্ষেপে গল্পের বিষয়টা বলার পর বললাম, অল্প নামী কোনও সুরকার হলে চলবে?
উনি বললেন, দাদা, আপনি যাকে ভাল বুঝবেন তাকেই নেব।
মৃণালের নাম করতে উনি রাজি হয়ে গেলেন।
মনোজবাবুকে নিয়ে যখন মৃণালের বাড়িতে পৌঁছলাম, তখন মৃণাল গানের ক্লাস করতে ব্যস্ত। তখন ও শেখাচ্ছে ‘তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে/আমার মরণ-যাত্রা যেদিন যাবে’ গানটি। আমাদের দেখেই গান গাওয়া থামিয়ে দিতে মনোজবাবু বললেন, থামলেন কেন চালিয়ে যান। ভাল লাগছে।
মৃণাল হাসতে হাসতে বলল, পড়ে থাকা গান। এদের শিখিয়ে দিচ্ছি। পুলকদারই লেখা। পড়ে থাকা গান মানে? সেটা আবার কী ধরনের গান? মনোজ জানতে চাইল।
তখন আমিই বললাম, গানটা একবার পুজোর জন্য মান্না দে-র জন্য তৈরি হয়। মান্নাদার খুবই পছন্দ হয়। কিন্তু রেকর্ড করার সময় গানটা বাদ দিয়ে দেন। তিনি মরণ যাত্রার গান করবেন না। সেই গানটি রিজেক্ট হয়ে পড়ে রয়েছে।
মনোজবাবু গানটি পুরো শোনার পর বললেন, আমার ছবিতে এই গানটি লাগাব।
তুমি কত সুন্দর ছবিতে মৃণালের অসাধারণ সুরে সৃষ্ট গানগুলি শুধু সুপারহিট ই হয়নি, এখনও শুনলে মনে দোলা দেয়। সুরের এমনই বৈশিষ্ট্য। গানগুলো যদিও আমারই লেখা। তবে এই ছবিটি আর একবার প্রমাণ করে দিল ছবি না চললেও গান জনপ্রিয় হতে পারে।
জগজিৎ সিংহ-চিত্রা সিংহ জুটির চিত্রার প্রথম বাংলা ছবিতে গানের জগতে প্রবেশ ঘটে ‘সন্ধ্যাপ্রদীপ’ ছবিতে।
চিত্রা আসলে কলকাতারই মেয়ে। টালিগঞ্জে থাকতেন চিত্রা সোম। আমার স্ত্রীর স্কুলের সহপাঠিনী উনি।
যথাসময়ে বিবাহ হয়। কন্যা সন্তানের জননীও হন। কিন্তু সেই বিবাহ বিচ্ছেদ করে বিবাহ করেন জগজিৎকে। জগজিতের জন্যই ওর হিন্দি গজল জগতে প্রতিষ্ঠা। এইচ. এম. ভি. থেকে চিত্রার প্রথম বাংলা আধুনিক গানের এল পি প্রকাশিত হয় সতীনাথ মুখোপাধ্যায় এবং জগজিৎ সিংহের সুরে। ওখানেও গীতিকার ছিলাম আমি।
সন্ধ্যা প্রদীপ ছবিতে মৃণালের সুরে আমার লেখা আমি তোমার চিরদিনের গান দিয়ে বাংলা ছবির গানের জগতে আত্মপ্রকাশ করা চিত্রা গানটি রেকর্ড করেই আমাকে ঝাঁঝের সঙ্গেই শুনিয়ে দিল, বাংলা ছবিতে মারাঠি ফিমেল সিঙ্গার ছেড়ে আবার বাঙালি সিঙ্গারদের দিকে নজর দেওয়ার জন্য আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।
এই চিত্রাই একদিন মুম্বই-তে আমাকে ফোন করল। বলল, কলকাতায় ফোন করেছিলাম। শুনলাম, আপনি মুম্বই-তে। আমার নেকস্ট এল পি র সব গান আপনি যদি লিখে দেন।
বললাম, জগজিৎ গাইবে তো?
চিত্রা বলল, নিশ্চয়। ওকে আমি বাংলা উচ্চারণ শিখিয়ে নেব। খুশি তো আপনি?
খুশি হলেও কম মেহনত করতে হল না জগজিৎকে নিয়ে।
অবাঙালি জগজিৎকে পাখি পড়ানোর মতো করে বাংলা শিখিয়ে গান গাওয়াল চিত্রা।
বেশ কিছুদিন বাদে এইচ. এম. ভি. আমাকে ডেকে পাঠাল মুম্বই-তে। ওদের প্রস্তাব শুনে আমি চমকে উঠলাম।
জগজিৎকে দিয়ে এইচ এম ভি বাংলা গানের রেকর্ড করাতে চায় আমার লেখা কথায়।
চমকে ওঠার কারণও ছিল। জগজিৎ-চিত্রা কিছুদিন ধরেই গান ছেড়ে নিজেদের গৃহবন্দি করে রেখেছে। পথ দুর্ঘটনায় সন্তানের মৃত্যুর পর এরা শোকে ভেঙে পড়েছে। এরা আবার রেকর্ড করবে তো?
মুম্বই-তে এদের গানের ঘরে ঢুকতে জগজিৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে রইলেন বেশ কিছু সময়। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, দাদা, যে গেছে তাকে তো আর ফিরে পাব না। আমাদের বেঁচে থাকতে হবে কাজের মধ্য দিয়ে। জানি কোনওদিনই ওকে ভোলা যাবে না। তবুও কাজের মধ্যে দিয়ে ওকে ভুলে থাকার চেষ্টা করতে হবে।
বলেই কেঁদে ফেলেন। পরে জগজিতের গাওয়া তৃষ্ণা ক্যাসেটটি প্রকাশিত হয়েছিল। যার বহু গান এখন জনে জনে রিমেক করছেন। ওই ক্যাসেট এবং সি. ডি.র একটি গান ছিল—’নদীতে তুফান এলে/কূল ভেঙে যায়/সহজেই তা দ্যাখা যায়। মুম্বই-তে যখন জগজিতের সঙ্গে তৃষ্ণা-র গান লিখছি তখন কলকাতার অন্য এক রেকর্ড কোম্পানির এক অধিকর্তা এসে জগজিৎকে বললেন—তালাত মামুদের গাওয়া বাংলা গানগুলো রিমেক করে দিন। জগজিৎ রাগ এবং বিরক্তির সঙ্গে বললেন—আপনারা মানুষ! যে-শিল্পী এখনও জীবিত, আমি তার গান রিমেক করব? কেন পুলকদা আছেন, আমি আছি, নতুন গান করুন।
এমন কথা আমি আর কোনও শিল্পীর মুখে শুনিনি। আমার অতি প্রিয় এবং অনেক কাছের মান্না দে-ও জীবিত জগন্ময় মিত্রের মেনেছি গো হার মেনেছি গেয়ে যে একটা অনৈতিক কাজ করেছেন—এটা আমি ওঁকে স্পষ্ট জানিয়েছিলাম।
জবাবে মান্নাদা বলেছিলেন—আমি দুঃখিত। আমি এ দিকটা ভাবিনি।
লতা মঙ্গেশকর হেমন্তদার রানার রিমেক করেছিলেন হেমন্তদার অনুমতি নিয়ে। হেমন্তদাও পঙ্কজ মল্লিকের সুরে রবীন্দ্রনাথের দিনের শেষে ঘুমের দেশে রিমেক করেছিলেন পঙ্কজ মল্লিকের অনুমোদন পাওয়ার পর। লতাজি সেবার সলিল চৌধুরীর আর যেসব গান করেছিলেন সেগুলো যে শচীন গুপ্ত ইত্যাদির গাওয়া রিমেক গান তা ওঁর অজ্ঞাত ছিল। লতাজি নিজে আমাকে বলেছিলেন—এমন জানলে এ গানগুলো আমি কিছুতেই গাইতাম না। বিশেষ করে তাঁদের গান—যাঁরা এখনও জীবিত!
এই ঘটনার পর একরকম অভিমান করেই লতাজি আর সলিল চৌধুরীর কোনও গান রেকর্ড করেননি।
‘রিমেক’ নিয়ে আজকাল কথা উঠছে—রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুলের গান, অতুলপ্রসাদ ইত্যাদির গান তো রিমেক হচ্ছে সেখানে আপত্তি উঠছে না। আধুনিক গানের বেলায় আপত্তির কারণ কী?
আমার মতে আপত্তির এটাই কারণ—রবীন্দ্র-নজরুলের গান সবটাই ওঁদের নিজস্ব। ওই রিমেকে ওঁরাই সর্বস্ব। কিন্তু রেকর্ডের আধুনিক গান—গীতিকার, সুরকার ও সেই প্রথম কণ্ঠদান করা শিল্পীর যোগফলের সৃষ্টি। তাই প্রথম শিল্পীকে সরিয়ে অন্য শিল্পী যখন সে গান রেকর্ড করেন শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের ধান্দায় বর্জন করে ফেলেন নতুন গান গাওয়ার শেষ ইচ্ছেটুকুও। তখনই মনে হয় বাংলা গান আর নতুন সৃষ্টির প্রয়োজন কী। তাই সত্যই থেমে যাচ্ছে ভালো বাংলা গান সৃষ্টির আগ্রহ। অফিসের ঠাণ্ডা ঘরে বিভিন্ন কোম্পানির নামী দামি ম্যানেজারদের আজকাল আর ওই পরের ধনে পোদ্দারি করা ছাড়া কোনও কাজ আছে কি? ওঁরা অনুমাত্র ভাবছেন না—সিন্দুকে জমানো টাকা নিয়মিত খরচে শূন্য হয়ে যেতে বাধ্য। তা ছাড়া কোনও রিমেক শিল্পী নিজস্ব কোনও আইডেন্টিফিকেশান আনতে পেরেছেন কি—যাতে আগেকার মতো এককথায় চেনা যায়। এই বিশেষ গানটি একমাত্র ওঁর। এ ব্যাপারে আমি অবশ্যই রিমেক শিল্পী ইন্দ্রনীল সেনের নাম করব। যে গত ১৯৯৮ সালের পুজোয় আমার লেখা ‘বৃষ্টির দিনে’ অ্যালবামটি নিজের সুরে গেয়ে শোনাবার সাহস দেখিয়েছে। ইন্দ্রনীলের মা মীরা সেন আমার কলেজের সহপাঠিনী। কিন্তু ইন্দ্ৰনীল-আমি দারুণ বন্ধু। ওই ক্যাসেটের ‘ছোট্ট খুকু পায়ে পায়ে সারা ঘুরে ঘুরে চলে যে’ আমার নাতনি ম্যাডামকে নিয়ে লেখা আমার এই গানটি আমার চোখে জল আনে।
আবার মৃণালের প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। একদিন রমেশপ্রসাদজি দুঃখ করে বললেন, আপনার গান আর সংলাপ নিয়ে আমার নাগপঞ্চমী ছবি এত হিট করল। অথচ দেখুন গান কীভাবে সুপার ফ্লপ করে গেল। এর কারণ কী মশাই?
বললাম, যেহেতু সংগীত পরিচালক ছিলেন একজন অবাঙালি। মনে হয়, বাঙালি সেন্টিমেন্টটা তিনি ঠিক ধরতে পারেননি। রমেশজি পরের ছবি সন্ধ্যাতারা -তে তাই নিলেন দুই বাঙালিকে। একজন পরিচালক প্রভাত রায় অন্যজন সংগীত পরিচালক মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে। মৃণালকে ডেকে প্রভাত তাঁর ছবিতে কী ধরনের গান চান, সে সম্পর্কে ধারণা দিতে রোজার ক্যাসেট একটা দিলেন মৃণালের হাতে।
মৃণাল করল কী রোজার সুরটাই বসিয়ে দিল সন্ধ্যাতারা’র গানে। গান শুনে আমি চমকে উঠলাম। বললাম, কী করেছ মৃণাল। প্রভাত তো রোজার সুর চায়নি। চেয়েছে স্টাইলটা। তুমি কম্প্রোমাইজ না করে যদি প্রভাতকে বুঝিয়ে বলো তাতে তোমারই লাভ হবে। কিন্তু মৃণাল সে পথে না যাওয়াতে নিজেরই ক্ষতি করে ফেলল।
সুখেন দাশ অভিনেতা হিসাবে পরিচিতি পাওয়ায়, ওর একটা প্রতিভা কিন্তু ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে। সুখেন গানও গাইত দারুণ।
স্টারে অভিনীত নাটকে নিজের চরিত্রের আমার লেখা গানগুলি ও নিজেই গাইত। সব থেকে মজার ব্যাপার, ছবিতে সুখেনকে লিপ দিতে হত অন্যের কণ্ঠের গানে। এই সুখেন একদিন পরিচালক হয়ে গেল।
একদিন সুখেনের সঙ্গে দেখা হতেই বলল, পুলকদা, আপনাকেই আমার খুবই দরকার। কালকে একবার আমাদের বাড়িতে আসুন না। ছোড়দার সঙ্গে আলাপ হবে এবং কাজের কথাও হবে।
পরের দিন ওদের বাড়ি গেলাম। পরিচয় হল ওর ছোড়দা সংগীত পরিচালক অজয় দাশের সঙ্গে। কথা হল পরবর্তী ছবি অচেনা অতিথি নিয়ে। সিচুয়েশন বোঝানোর পর অজয় বসল হারমোনিয়াম নিয়ে সুর শোনাতে। বুঝলাম আমাকে এই সুরের ওপরই কথা বসাতে হবে। সুর শোনাতে শোনাতে এক সময় হারমোনিয়াম থামিয়ে অজয় বলে উঠল, এখানটায় বড্ড বেশি সলিল চৌধুরী হয়ে যাচ্ছে না? দাঁড়ান, বদলে দি। এই একটি ঘটনা অজয়ের সম্পর্কে আমায় একটা ভাল ধারণা গড়ে দিল। এই অচেনা অতিথি ছবি থেকেই আমার আর অজয়ের মধ্যে বোঝাপড়ার একটা ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। অচেনা অতিথির দুটি উল্লেখ্য গান মান্নাদের কণ্ঠে ছিল (১) অনেক দিন তো কেটে গেলো ভেবে ভেবে (২) তুমি আমার দস্যি মনের।
অজয় সুরের ব্যাপারে খুবই খুঁতখুঁতে ছিল। সুর যতক্ষণ না পছন্দ হচ্ছে ততক্ষণ পাল্টে পাল্টে যেত। সিংহদুয়ার ছবিতে আরতির গাওয়া ‘বেঁধেছি প্রাণের ডোরে’ গানটির সুর অজয়ের মনঃপূত না হওয়ায় বার বার পাল্টাতে চেয়েছিল। শেষে সুর পাল্টানো সম্ভব না হওয়ায়, যন্ত্রানুষঙ্গে অন্য ধারা এনে কিছু একটা করতে চেয়েছিল। কিন্তু সিচুয়েশনের সঙ্গে বেমানান হয়ে যাচ্ছে এই বলে সুখেন তা নাকচ করে দেয়। অজয় মোটেই খুশি হয়নি। বলল, গান হয়তো হিট করবে। কিন্তু আমি স্যাটিসফায়েড হতে পারলাম না।
এই সিংহদুয়ার ছবি প্রসঙ্গে আরও একটা মজার ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ছবির গান তৈরির জন্য আমাকে এবং অজয়কে রিজ কন্টিনেন্টাল হোটেলে নিয়ে গিয়ে গানের সিচুয়েশন বুঝিয়ে দিয়ে সুখেন চলে গেল। বলে গেল, আমার জন্য অপেক্ষা করবেন না। সময় মতো খেয়ে নেবেন।
সুখেন যখন ফিরল তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। বললাম, এত রাত করলে? সুখেন বলল, সব বলব। আগে গানগুলো শুনি। গান শোনার পর খুব খুশি। বলল, এবার শুনুন আমার রাত হওয়ার কারণটা। আপনাদের যখন এই হোটেলে নিয়ে এলাম তখন আমার পকেটে রয়েছে মাত্র পঞ্চান্ন টাকা। বিল মেটাতে গেলে অনেক টাকার প্রয়োজন। পরিবেশকদের পাড়ায় ঘুরে ঘুরে এই টাকা জোগাড় করতে হল বলেই রাত হয়ে গেল।
৭৪
অজয় আর আমার পরবর্তী ছবি ‘টুসি’। ও ছবির ‘কেউ জানে না চাঁদের কণা/আছে কোথায়’ গানটি বেশ জনপ্রিয় হল। এই সময়েই আমাদের ‘সুনয়নী’ ছবিতে অজয়, রাজকুমার চক্রবর্তী নামে একটি নতুন ছেলেকে দিয়ে প্লে-ব্যাক করাল। সবাই চমকে উঠল তার গান শুনে। গানটি ছিল, সুন্দর কাকে বলে পৃথিবী কি গেছে ভুলে।’ কিন্তু আশ্চর্য দুঃখের ব্যাপার, সুরেলা কণ্ঠের এই ছেলেটি কিছুদিন চিত্রজগতে গায়ক ও অভিনেতা হিসেবে আনাগোনা করে কোথায় হারিয়ে গেল, কেউ জানে না। এরপর আমাদের স্মরণীয় ছবি ‘রাজনন্দিনী’ ও ‘পারাবত প্রিয়া’। ‘পারাবত প্রিয়া’ ছবিটির প্রযোজকের পক্ষে দিলীপ পাল রোজই বিভিন্ন সুরশিল্পীর নাম করতেন আমাকে। কিছুতেই মনঃস্থির করতে পারতেন না কাকে নেবেন। একদিন সকালে ওঁর ফোন আসতেই আমি বললাম, আপনি বাড়ি থাকুন আমি আসছি। ওঁকে নিয়ে আর কোনও কথা না-বাড়িয়ে সোজা হাজির হলাম অজয়ের বৌবাজারের বাড়িতে। সেদিনই ফাইনাল হল অজয়। তার পরদিনই আমরা বানালাম—আশাজির জন্য ‘বৃষ্টি থামার শেষে’, কিশোরদার জন্য ‘অনেক জমানো ব্যথা বেদনা’ ইত্যাদি গান।
‘মিলন তিথি’ ছবিতে আমার গানে অজয় ওর সুরের সুযোগ দিল আর একটি নতুন কণ্ঠশিল্পী পরিমল ভট্টাচার্যকে। অজয় আমাদের ‘আহুতি’ ছবিতে সুযোগ দিল শিবাজী চট্টোপাধ্যায়কে। অজয় সে সময় বহু নতুন কণ্ঠশিল্পীকে সুযোগ দিয়েছিল ছবির গানে। কিন্তু সময় বদলে যেতে লাগল। অজয়ের সুরে আমার কথায় পরপর হিট হতে লাগল কিশোরদার গাওয়া গান। ‘প্রতিশোধ’-এর—আজ মিলন তিথির পূর্ণিমা চাঁদ’, ‘হয়তো আমাকে কারও মনে নেই।’ ‘জীবন-মরণ’-এর—’ওপারে থাকবো আমি তুমি রইবে এপারে’। ‘দাদামণি’র—’এইতো এসেছি আমি/তোমার দাদামণি’। ‘মিলন তিথি’র ‘সুখেও কেঁদে ওঠে মন’। পাপপুণ্যের ‘ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কী?’ এবং ‘অভিমান’, ‘দেনা পাওনা’ ইত্যাদি ছবির গানগুলো নিশ্চয়ই সব সংগীতপ্রিয়দেরই বহুদিন স্মরণে থাকবে। কিন্তু মুশকিল হল এই যে—এ সব গানগুলির পরপর সাফল্যের পর আমাদের সামনে এমন একটা সময় এসে গেল যে, নতুন শিল্পীকে গান দিতে আমরা সাহস দেখালেও প্রযোজক-পরিচালক তাতে আপত্তি করতে লাগলেন। সবাই চাইতে লাগলেন কিশোরদাকে—না পেলে মুম্বই-এর অন্য যে কোনও কণ্ঠ। অবশ্য এর পেছনে অনেক যথার্থ সত্যও লুকিয়ে আছে। ‘আমি যে কে তোমার তুমি তা বুঝে নাও’ গানটি ‘অনুরাগের ছোঁয়া’ ছবির আগে হুবহু একই সুরে, একটি একটি করে দুটি রেকর্ড দুজন পরিচিত কণ্ঠশিল্পীই অন্য কথায় রেকর্ড করেছিলেন। দুটি রেকর্ডই সুপার ফ্লপ হল। কিন্তু কিশোরদা যেই গাইলেন ওই গানটি অমনি সেটি সুপারহিট হয়ে গেল। আজকাল যে সব রিমেক শিল্পীরা বলেন-আমরা ভাল গান পাই না, তাই পুরনো গানই গাই। তাঁদের মধ্যেই দুজন শিল্পীই তো গেয়েছিলেন ওই দুটি তথাকথিত ‘ভাল গান, তা হলে ওঁদের গাওয়া সে গান চলল না কেন? অথচ কিশোরদা গাইতেই যে সেটি হিট হয়ে গেল এটা তো ঐতিহাসিক সত্য। এখন যে শিল্পীরা আগে ওই গানটি গেয়ে অকৃতকার্য হয়েছিলেন, তাঁরা যদি আমি যে কে তোমার’ রিমেক করেন, তখন সেটা জনপ্রিয় হলে তাঁদের বলতে আটকাবে কি, আমরা ভাল সুর পাই না বলেই রিমেক করি? আসলে রিমেকের মধ্যেই যে পুরনো শিল্পীর গাওয়া গানগুলিই শ্রোতারা শোনেন, এটাই বা ওঁদের বোঝাবে কে?
আমি সংগীত জগতে আসার পর প্রথম দিকে গানও লিখতাম সুরও করতাম। বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে মোট দশটি গান গ্রামোফোন রেকর্ডও হয়েছিল আমার সুরে। পরে সেটা পুরোপুরি ছেড়ে দিই। রয়ে যাই শুধুই গীতিকার। শ্যামল গুপ্তও কণ্ঠশিল্পী হয়ে গ্রামোফোন রেকর্ড পর্যন্ত করেছিলেন, কিন্তু উনিও গান গাওয়া ছেড়ে শুধু গীতিকারই রয়ে গেলেন। এ দিকে সলিল রায়চৌধুরীর দেখাদেখি এখানে প্রায় সব সুরকারই— লিখতে পারুন আর না পারুন—যখন তখন গান লিখতে শুরু করলেন। যেহেতু নিজের সুরে যে কোনও কথাই নিজে ‘অ্যাডজাস্ট’ করে নেওয়া সম্ভব, তাই তাঁদের কিছু ‘আবাল-তাবোল’ কথাও হিট হয়ে গেল। কিন্তু তাঁরা যে আদৌ গীতিকার নন তার প্রমাণ, তাঁরা নিজের সুরে ছাড়া আলাদা কোনও সুরকারের সুরে কোনও গান লিখে সার্থকতা দেখাতে পেরেছেন কি? যাক, এটা তো হল যুক্তিতর্কের কথা। ঘটনার কথা এই, মাঝে মাঝে আমার এই সব ভাল সুরকারদের অপটু রচনা, শুধু সুরের গুণে বেশ জনপ্রিয় হয়ে যাচ্ছে দেখে ভারী রাগ হত এবং হিংসাও হত। মনে হত কবে গীতিকাররাও সুরকার হয়ে এর বদলা নেবেন? বোধ হয় মনে মনে দিন গুনছিলাম। হঠাৎ এসে গেলেন আনন্দ মুখোপাধ্যায়। গীতিকার থেকে হয়ে গেলেন সুরকার। অনেক গান রেকর্ড করল। খুব আনন্দ হল আমার ওর এই আগমনটায়। মনে মনে ওকে সুস্বাগতমও জানিয়ে ফেললাম। তার কিছুদিনের মধ্যেই আনন্দর সুরে লিখলাম অনেকগুলি ছবির গান। যে সব গান মূলত গীতিকার আনন্দ অনায়াসে নিজেই লিখতে পারত। কিন্তু লিখল না শুধু নিজেকে আরও ছড়িয়ে দেবার মনস্কতায়।
আমার গান লেখায় ওর সুর দেওয়া ছবিগুলির মধ্যে উল্লেখ্য ‘স্বামী-স্ত্রী’, ‘অভি’, ‘লাল পাহাড়ী’ ইত্যাদি। আর একজন সংগীত পরিচালকের কথা এই প্রসঙ্গে মনে আসছে— সে হল অধীর বাগচি। অনিল বাগচির পুত্র এই অধীর বাগচিকে আমিই এইচ. এম. ভি.-র এ. সি. সেন সাহেবকে রাজি করিয়ে ছিলাম ওদের ওখানে কণ্ঠশিল্পী করে নিতে। মান্নাদার সুরে আমার লেখা দুটি গান গেয়ে সংগীত জগতে প্রবেশ করেছিল অধীর। (১) চাঁদ বিনা সারা রাত’, (২) ‘যখন গানের মুখ মনে আসে না।’ অধীর বাগচিকে সুরকার হিসেবে প্রথম পেলাম, যতদূর স্মরণে আসছে ডি এস সুলতনিয়ার ‘এই করেছো ভালো ছবিতে। পরের যোগাযোগ চিত্র পরিচালক সুশীল মুখোপাধ্যায় মারফত। ছবিটির নাম সম্ভবত ছিল ‘বড়ো ভাই’। তারপরই সুশীলবাবু করলেন তারাশঙ্করের ‘দুই পুরুষ’। ওই ছবিতে মান্না দে গাইলেন আমার কথায় আর অধীরের সুরে (১) আমি সুখী কতো সুখী কেউ জানে না’ (২) ‘বেহাগ যদি না হয় রাজি’। ভীষণ আদৃত হয়েছিল গান দুটি।
আর একজন গায়িকা, যার নাম জয়ন্তী সেন—সে কিন্তু জীবনে আমার বহু গান গেয়েছে। হেমন্তদার সুরে গেয়েছে ‘রজনী’ ইত্যাদি অনেক হিট ছবিতে। হেমন্তদার সুরেই তার গাওয়া আমার কথার হিট আধুনিক গান ‘আকাশ রামধনু রঙ মেখে।’ আজও গেয়ে চলেছে সে নিরলস অধ্যাবসায়ে। তার সাফল্য কামনা করি।