কথায় কথায় রাত হয়ে যায় – ৬০

৬০

প্রাপ্তবয়স্ক শিল্পীর মতো নমস্কার জানিয়ে চেয়ারে বসল আদিত্য। অ্যাটাচি খুলে একটা খাতা আর কলম বার করল। ঠিক ওর বাবার মতোই বলল, বলুন দাদা কী গান? লিখে নি। আমি বলে চললাম গানটা। আমি লক্ষ করলাম ও লেফট হ্যান্ডার। বাঁ হাতে লিখে নিতে লাগল গানটা। তারপর বাবুল বোসের কাছে সুরটা তুলে নিল। এবার আমি ওকে ‘রাজা রানি বাদশা’র এই বিশেষ সিচুয়েশনটা বোঝাতে লাগলাম। ও বড়দের মতো মনযোগ দিয়ে সব শুনে গেল। তারপরে কানে মিউজিক ট্র্যাকের হেডফোনটা লাগিয়ে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে গাইতে লাগল। শিখে নিতে লাগল নিখুঁত উচ্চারণ আর যথার্থ অভিব্যক্তি। একটু ভুল হতেই প্রাপ্তবয়স্ক শিল্পীদের মতোই সেই গানের সুরে গেয়ে উঠল গলতি হো গিয়া। মাফ কর দাদা।

উদিত বলেছিল ওর ছেলে ‘জেম বয়’। আমিও তাই উপলব্ধি করলাম। জানি না, বড় হলে এই রত্নেই পালিশ লেগে লেগে তা কতটা উজ্জ্বল হবে। বা কতটা ক্ষয়ে যাবে। তবে এখনও পর্যন্ত এই রত্ন সন্তানের যে ঝলমলে ঝকমকে ছটা আছে, আলোর দ্যুতি আছে এবং তা যে চোখ মন ধাঁধিয়ে দেয় এ সত্য আমি অস্বীকার করতে পারছি না।

আগে বাংলাদেশের কথা বলছিলাম। এবার আবার বাংলাদেশের কথাই বলি। এই সেদিন গিয়েছিলাম ঢাকায়। ওখানে নামী হোটেল পূর্বাণীতে ছিলাম। কাজ শেষ হতেই প্রতিবারের মতো মাল্টিমোড গ্রুপের আবদুল আওয়াল মিন্টুকে ফোন করলাম। মিন্টু সাহেব ঢাকার এক বিলিওনিয়র। ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান। সাগর পাড়ি দেওয়া অনেকগুলো মালবাহী জাহাজের মালিক। ঢাকার বিখ্যাত চাইনিজ রেস্টুরেন্ট পাণ্ডা গার্ডেনেরও অংশীদার। যেখানে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে, প্রায় দোতলা সমান উঁচু চাইনিজ ‘দাদু’ পুতুলটি দেখে আমি আর মান্না দে প্রায় একসঙ্গে ভির্মি খেয়েছিলাম কয়েক বছর আগে। আরও কত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যে উনি যুক্ত তা বোধহয় নিজের ডায়েরি না দেখে চট করে বলতে পারবেন না। উনি এবং ওঁর স্ত্রী বেগম নাসরিন দুজনেই আমার লেখা গানের দারুণ অনুরাগী। ওঁদের বাড়িতে এবং ওঁদের প্রত্যেকটি গাড়িতে রয়েছে আমার লেখা মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায় আর জগজিৎ সিংহের গাওয়া প্রায় সব কটি গান। যে গানগুলো আমার সংগ্রহেও নেই। .

একটা কথা মুক্ত কণ্ঠে বলতে পারি, গীতিকার হিসাবে আমাকে ওপার বাংলা যে ভালবাসা যে আপ্যায়ন যে সমাদর দেন তা ভূ-ভারতে আর অন্য কোথাও পাই না।

মালয়েশিয়ার একটি গাড়ির বাংলাদেশের একমাত্র এজেন্ট এই মিন্টু সাহেব। তা সেই মিন্টু সাহেবকে ফোন করতেই উনি বললেন, দাদা, এখনই চলে আসুন আমার গেস্ট হাউসে। ঢাকার সব থেকে পশ এলাকা গুলশনের বাসিন্দা মিন্টু সাহেব। ওঁর আহ্বান এড়াতে পারলাম না। হোটেল থেকে চেক আউট করে চলে এলাম ওখানে। ওঁরা বললেন, আপনাকে আর বউদিকে তো আমরা কয়েক বছর আগে আপনাদের জমিদারি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডুর আবুতারাফে’ ঘুরিয়ে এনেছি। এবার চলুন কক্সবাজার। ওখান থেকে যাব আপনাদের বিখ্যাত নায়ক ও খলনায়ক ধীরাজ ভট্টাচার্য-এর টেকনাফে।

ধীরাজবাবুর লেখা আত্মজীবনী ‘যখন পুলিশ ছিলাম’। বইটি তখন শুধু নয় এখনও চট্টগ্রাম অঞ্চলের পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব বয়সি প্রায় প্রতিটি শিক্ষিত বাঙালির ঘরে ঘরে। আমি আমতা আমতা করে বললাম, আমার যে পরশু প্রসেনজিতের ছবির গানের সিটিং। মুম্বই থেকে ওর মিউজিক ডিরেক্টর যে কলকাতায় আসছেন। প্রসেনজিৎ আমায় বার বার ফোন করছে। মিন্টু বললেন, দাদা, আমি আর কী বলব। গান লেখা তো আছেই। আমার কাছে নেপাল থেকে দুজন গেস্ট এসেছেন। তাঁরা আর আপনি চলুন ওখান থেকে সেন্ট মার্টিন আইল্যান্ড হয়ে আরাকান পাহাড়ের সামনে দিয়ে বর্মা মুলুকের তীরেও একটু ঘুরে আসব।

এবার আর আমাকে ঠেকায় কে? কলকাতার বাড়িতে ফোন করে দিলাম। পরদিন সকালেই চললাম পাঁচটি বিদেশি বিলাসবহুল গাড়ির একটি কনভয়ে চট্টগ্রাম অভিমুখে। চট্টগ্রামে আমি সস্ত্রীক আগেও এসেছি। সস্ত্রীক থেকেছি চট্টগ্রামের নামী ও দামি ফাইভ স্টার হোটেলে ‘অগ্রবাদ’-এ, যে বার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে চট্টগ্রামের টিভি ও বেতারের জনপ্রিয় গায়িকা স্বপন লালা আমার গান রেকর্ড করে। সেই চট্টগ্রামে এসে মনে পড়তে লাগল, এবার যাব ধীরাজ ভট্টাচার্যের সেই জায়গায়, টেকনাফে-যেখানে উনি পুলিশের চাকুরিতে অনেকগুলো দিন কাটিয়ে গেছেন। ভাবতে লাগলাম আত্মজীবনী কজন লিখেছেন? চিত্র বা গানের জগতের? মনে এল অহীন্দ্র চৌধুরীর নাম। ওঁর লেখা ‘নিজেরে হারায়ে খুঁজি’। পণ্ডিত রবিশঙ্করের ‘রাগ অনুরাগ, শুনেছি রবিশঙ্করের টেপে বলে যাওয়া কথার হুবহু অনুলিখন। পণ্ডিতজির এই ‘রাগ অনুরাগ’ সম্পর্কে অনেকেই অভিমত দিয়েছেন, এমন স্পষ্ট কথা বলা এমন ভাবে অকপটে সত্যকে প্রকাশ করা, এমন আত্মকথা খুব কমই আছে। জীবনের যা যা অনেকেই গোপন করেন বা করতেন, উনি তা করেননি। খোলাখুলি বলে গেছেন। আর যে সব আত্মকথা পড়েছি সবই একের জবানিতে অন্যের রচনা। যেগুলো এক হাত থেকে অন্য হাতে ঘোরানোতে বেশ কিছুটা নিষ্প্রভ হয়ে যেতে বাধ্য।

ধীরাজ ভট্টাচার্য নিজেই লিখেছেন নিজের কথা। হলিউডের বিখ্যাত কৌতুক অভিনেতা বব হোপের একটি আত্মজীবনীমূলক রচনা পড়েছিলাম। যার পঙক্তি ছিল ‘মাই ফাদার ওয়াজ এ ম্যাজিসিয়ান, অ্যান্ড আই অ্যাম হিজ ফার্স্ট ম্যাজিক’।

ধীরাজবাবুর ‘যখন পুলিশ ছিলাম’। এবং ‘যখন নায়ক ছিলাম’ দুটি রচনাতেই এই সরল সহজ বাস্তব স্বীকৃতি।

কক্সবাজারে রাত কাটিয়ে পরদিন আমরা কক্সবাজারের নামী হোটেল সাইমান হোটেলের মালিক মুজ্জেম হোসেন সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে চললাম নাফ নদীর উপকূলে টেকনাফের দিকে। অবশ্য এখানে বলা দরকার পৃথিবীর সব থেকে লম্বা সাগর সৈকত কক্সবাজারের ভিজে বালির হার্ড বিচ দিয়ে জিপ গাড়িতে করে বেশ কয়েক কিলোমিটার ঘুরেছিলাম। ওখানেই হিম ছড়ির এক ঝর্নার ধারে হঠাৎ দেখা হল আমাদের কলকাতার শিল্পী শতাব্দী রায়ের সঙ্গে। শতাব্দী ওখানে তখন শুটিং করছিল।

যাই হোক কক্সবাজারে শুনলাম ওখানে ‘ধীরাজ স্মৃতি সমাজ’ বলে একটা সংস্থা আছে। কলকাতায় এমন একটাও আছে কি?

আরাকান পর্বতমালার ছায়া ঝরানো নাফ নদীর ধারে টেকনাফের একটা হোটেলে আমরা নামলাম। সহযাত্রী মুজ্জেম হোসেন সাহেবের কথাবার্তায় বুঝলাম, উনি বাংলা ছায়াচিত্রের অনেক খবরই রাখেন। ধীরাজ ভট্টাচার্যের সেই রোহাঙ্গি নামের আরাকানি প্রেমিকা যে কুয়ো থেকে জল তুলতেন সেটিও মুজ্জেম সাহেব দেখালেন। ধীরাজবাবুর জীবনের প্রথম প্রণয় ওই জল তোলা থেকে শুরু। রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্যে, কুয়ার জলদানের জল পানের সঙ্গে সঙ্গে প্রথম প্রেমের উপলব্ধির সূত্রপাত তেমনই একটি কুয়া আমার মনকে গভীর অতলে ডুবিয়ে দিল। এখনও এখানকার মানুষ সেই প্রেমকে ভোলেননি। সম্মানে ও ভালবাসায় সেই অসফল প্রেমকে মনে রেখেছেন।

ওই কুয়া দেখতে দেখতে আমারই লেখা ‘মন্দিরা’ ছবির একটি গান মনে পড়ল। গানটি গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর, সুরকার বাপি লাহিড়ি। গানটির বাণী ছিল ‘সব লাল পাথরই তো/চুনি হতে পারে না। সব প্রেম মিলনের/মালা পেতে পারে না’। আমি এ গান যখন লিখি তখন ধীরাজবাবুর অসফল প্রেমের কথা আমার মনে ছিল না। এবং ওই কুয়াও আমি দেখিনি। তবুও লিখে ফেলেছিলাম। যাই হোক, ওখানকারই জলের ঘাট থেকে উঠেছিলাম মটোর বোটে। অথৈ অকূল সমুদ্রের মধ্য দিয়ে সেই বোটে করে মিন্টু সাহেবের তদারকিতে এক সময় পৌঁছেছিলাম—বর্মার তীরে। ছোট্ট একটা দ্বীপ সেন্ট মার্টিন আইল্যান্ড, ওখানে পা দিয়েই শুনলাম খুব কম ভারতীয়ই এই নির্জন দ্বীপে এসেছেন। এখানে অবশ্য বাংলাদেশের প্রচুর ছবির শুটিং হয়। বহু দুরের আরাকান পর্বতমালার কোলে এই সুন্দর ছোট্ট দ্বীপটি আমার স্মৃতিতে চিরদিনই অমর হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশে সবই বাংলা, হিন্দি নেই—এটা আমায় মুগ্ধ করত। কলকাতায় সবই তো প্রায় হিন্দি, বাংলা আর কতটুকু? এই বৈষম্য আমার বুকে আঘাত করত। বেশ কিছুদিন আগে বাংলাদেশ টি ভির একটা লাইভ অনুষ্ঠানে আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে ইন্টারভিউ দিতে দিতে বলেছিলাম ‘এপার পদ্মা ওপার গঙ্গা/ বাংলা ভাষার দেশ। ওখানে শুধুই কাঙালি রয়েছে বাঙালি নিরুদ্দেশ।’ কিন্তু এখন আর সেদিন নেই। এই প্রজন্মের সকলে ঘরে ঘরে শুনছেন টিভিতে হিন্দি অনুষ্ঠান। দুঃখ পেলাম। একুশে ফেব্রুয়ারির বাঙালিও এখন ক্রমশ বদলে যাচ্ছেন। হারিয়ে যাচ্ছে বাংলা ভাষার গর্ব। এই নিয়ে ঢাকার এক প্রতাপশালী বিত্তবানের বাড়িতে ডিনার খেতে খেতে আক্ষেপ করছিলাম। ভদ্রলোক হাসতে হাসতে বললেন, স্যাটালাইটকে কী করে আটকাব দাদা?

আমি বললাম, কেন? ওদের অনুষ্ঠান না দেখলেই তো ওটা আটকানো যায়। চেন্নাইয়ের তামিলভাষীরা, হায়দ্রাবাদের তেলেগুভাষীরা ওদের স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া কোনও হিন্দি অনুষ্ঠান এখনও দেখেন না। হয় ইংরাজি না হয় শুধু নিজেদেরই অনুষ্ঠান দেখেন। চেন্নাইতে এবং হায়দ্রাবাদে অনেকের ঘরেই টিভি দেখতে গিয়ে আমি এর প্রমাণ পেয়েছি।

কথাটা শুনে ঢাকার বাঙালি ভদ্রলোক পানপাত্রে দীর্ঘ চুমুক দিয়ে সোজা হয়ে উঠে বসে গভীর প্রত্যয়ে বলে উঠলেন, মাদ্রাজ হায়দ্রাবাদ যখন পারছে তা হলে আমরা পারব না কেন? আমরা আমাদের টিভিতে হয় শুধু ইংরাজি অনুষ্ঠান দেখব, না হয় শুধু দেখব আমাদের বাংলা অনুষ্ঠান।

আমাদের কথার মাঝখানেই ভদ্রলোকের জিনস আর ব্যাগি শার্ট পরা তরুণী কন্যা ছুটে এসে ঘরের টিভিটা চালিয়ে দিল।

পর্দায় ফুটে উঠল একটা বেসরকারি চ্যানেলে হিন্দি অনুষ্ঠান। অর্থাৎ ফিল্মি নাচা গানা। সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রের প্রবল যন্ত্রণা।

ভদ্রলোক মুহূর্তে সব ভুলে ওই অনুষ্ঠান পরম আনন্দেই উপভোগ করতে লাগলেন। আমার শুধু মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল এবং মনে মনেই বললাম, হ্যাঁ, এপার-ওপার দুই বাংলার বাঙালিই আজ একই সূত্রে বাঁধা পড়তে চলেছে। অন্তত স্যাটেলাইটে দেওয়া এই অভূতপূর্ব হিন্দি অনুষ্ঠানের মায়াডোরে।

১৯৪৭-এ দেশ ভাগ হওয়ার কিছু পর ঢাকায় যখন ফিল্ম স্টুডিয়ো তৈরি হতে লাগল, ওখান থেকেই বানানো শুরু হল বাংলা ছবি। তখন এখানকার টালিগঞ্জের ছোটখাটো ভূমিকায় অভিনয় করা অনেক শিল্পীই নতুন সুযোগ পেয়ে প্রমাণ করে দিলেন ওঁদের কুশলতা। সেই সময় আমার এখানকার পরিচিত সুরকার ও গায়ক বন্ধু ঢাকায় চলে যান এবং ওঁর সুরের গানগুলো পর পর হিট হতে থাকে। আমার সেই বন্ধুর নাম সত্য সাহা। সেই থেকে ঢাকায় গেলেই ওঁর বাড়িতে আমার আড্ডার আসর জমে। যতদিন ঢাকায় যেতে পারব ততদিনই চলবে এই আসর। এখন এখানকার বেশ কিছু ছবিও উনি করেছেন যাতে আমি গান লিখেছি।

সেই সত্যই কিছুদিন আগেই কলকাতায় এসে আমাকে দিয়ে ওর জীবনের শেষ বাংলা ছবির গান লিখিয়ে রেকর্ড করে হঠাৎ চলে গেল পৃথিবী ছেড়ে। ও-ছবির পরিচালক নারায়ণ বাবু ওকে এয়ারপোর্টে ছাড়তে এসে, নিয়ে যেতে বাধ্য হলেন রুবি হসপিটালে। সত্য নেই, ভাবতে পারি না।

কলকাতা থেকে আরও একজন সুরশিল্পী ঢাকায় গিয়ে খুবই প্রতিষ্ঠা পান। তিনি তখনকার নামকরা নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রী জয়শ্রী সেনের স্বামী কৃতী গিটারিস্ট সমর দাশ। আমার স্মৃতিতে সমর দাশ নামটাই মনে আসছে।

এ ছাড়া ঢাকায় আমি আর যাঁদের সুরে কাজ করেছি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আলাউদ্দিন আলি। আলাউদ্দিন ভাইয়ের সুরে রুনা লায়লার ‘বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িতে…’ এবং ‘সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী…’ এই গান দু বাংলাতেই সুপারহিট। সম্প্রতি আর একজন সুরকারের গান লিখে খুবই আনন্দ পেলাম, তাঁর নাম মহম্মদ আনোয়ার জাহান নান্টু।

ঢাকায় তৈরি আর যে সব ছবিতে আমার গান লেখার কথা স্মরণে আসছে তার মধ্যে প্রথমেই আসে চিত্র সম্পাদক ও পরিচালক আওকাত হোসেনের নাম। ওঁর ‘বন্ধু আমার’ ছবির গান আমাকে দিয়েই লেখান। এ ছাড়াও আওকাত ভাইয়ের অন্য দুটি ছবি ‘আশিফ প্রিয়া’ এবং ‘উচিত শিক্ষা’ এই সব ছবির গানও লিখি।

৬১

আজ এই লেখাটা শুরু করতে গিয়েই মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। কিছুদিন আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন আমার এক প্রিয়জন। হিন্দি গানের বিখ্যাত গীতিকার ইন্দিবর। ইন্দিবরের সঙ্গে কবে কোথায় প্রথম আলাপ হয়েছিল তা আজ আর মনে নেই। তবে মুম্বই-এর জুহু ভিলে পার্লেতে বাপি লাহিড়ির ‘লাহিড়ি হাউসে’ আমাদের প্রায়ই আড্ডা জমত। আমি যেতাম বাপি লাহিড়ির বাংলা গান লিখতে। উনি আসতেন হিন্দি গান লিখতে। বাপি ঠাট্টা করে ওঁকে ডাকত ‘কবিরাজ’ বলে। ইন্দিবর বলতেন, পুলকব্জিকে কী নামে ডাকো?

বাপির পিতা অপরেশ লাহিড়ি হাসতে হাসতে জবাব দিতেন, কেন? ‘কবিবর।

মনে আছে বাপির মিউজিক রুমে আমি যখন এক সিটিং-এ লতাজির জন্য লিখলাম ‘আমার তুমি’ ছবির গান ‘বলছি তোমার কানে কানে’ আর পঙ্কজ উধাসের জন্য ‘সে কেন আমাকে বুঝল না।’

খবর পেলাম ড্রইং রুমে ইন্দরজি এসেছেন। তৎক্ষণাৎ বললাম, বাপি ওঁকে ভেতরে ডাকো। ইন্দবরজি এলেন। গান শুনলেন। বাপি হিন্দিতে মানে বুঝিয়ে দিল। এরপর বাপিই বলল, শুনুন। কবিরাজ কালকে কী গান লিখেছে। বাপি হিন্দিতে গাইল। তারপর বাংলায় বুঝিয়ে দিল তার অর্থ।

সরল সহজ স্বচ্ছন্দ অভিব্যক্তিতে ভরা ইন্দরজির গান আমায় ভীষণ আকর্ষণ করত। গান শুনে জড়িয়ে ধরলাম ওঁর হাত। উনিও আমার গান সম্পর্কে ওঁর মুগ্ধতা প্রকাশ করলেন ওই একই ভাবে—উত্তপ্ত স্পর্শে।

বাপির ডাইনিং টেবিলে পাশাপাশি বসে আমি, ইন্দবরজি আর বাপি কতদিন যে আনন্দের সঙ্গে ভোজন পর্ব সমাধা করেছি তাই ইয়ত্তা নেই। কতবার এমনও হয়েছে সন্ধ্যায় ইন্দরজির সিটিং, রাতে আমার সিটিং। আমি যখন বাপির মিউজিক রুম থেকে বেরিয়েছি তখনও দেখি ইন্দিবরজি, বাপির ড্রইং রুমে বসে অপরেশদা আর বাপির স্ত্রী চিত্রাণীর সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। অপরেশদা বলেছেন, পুলক, কবিরাজ তোমাকে তোমার হোটেলে ওঁর গাড়িতে ছেড়ে আসবে বলে এখনও বসে আছেন।

ধন্যবাদ জানিয়ে ওঁর গাড়িতে উঠেছি। গাড়ি চালাতে চালাতে ইন্দিবরজি বলেছেন, চলুন আমার বাড়িতে ডিনার খেয়ে ফিরবেন। অবশ্য আইটেম খুব সামান্য। ওঁর বাড়িতে গিয়ে দেখেছি ঘরভর্তি বই। বেশির ভাগই হিন্দি লোকগীতির সংকলন। ভজন গানের সংকলনও চোখে পড়ল।

দীর্ঘদিন উনি একাই স্ত্রী ছাড়া জীবন কাটিয়েছেন। স্ত্রী ওঁকে ছেড়ে আলাদা থাকতেন। এই আলাদা থাকার দুঃখ নিয়ে বেশ কিছু গানও লিখেছেন। অতএব ঘর সংসারের টান অত প্রবল ছিল না। প্রবল ছিল পড়া, লেখা আর মদিরার প্রতি আসক্তি। আমি ওঁর কাছে প্রায়ই শুনতাম না জানা না শোনা কতসব হিন্দি লোকগীতি। মাঝে মাঝে সুর দিয়ে গেয়েও শোনাতেন। যেখানটার মানে বুঝতাম না সেখানটার মানে জিজ্ঞেস করলেই ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে বুঝিয়ে দিতেন তার অর্থ। আমি শোনাতাম রবীন্দ্রনাথের গান ইংরাজিতে বুঝিয়ে দিতাম অর্থ। একদিন রবীন্দ্রনাথের ‘জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না। হায় ভীরু প্রেম হায় রে’ এই গানটা শোনাতেই বললেন, আরে এটা তো অলরেডি হিন্দি গানে লাগানো হয়ে গেছে। কথাটা শেষ করেই উনি গেয়ে উঠলেন ‘তেরে মেরে ইতনা প্যায়ার। লেকিন কিসে লাগতা হ্যায় ডর’ (আমার হিন্দি অনুলিপি ভুল হলে পাঠক পাঠিকারা মার্জনা করবেন)।

হঠাৎ একদিন খোলাখুলি আমায় বললেন, শুনেছি বিলিতি কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রভাব রবীন্দ্রনাথের অনেক গানে আছে? আমার এ ব্যাপারে কিছুই পড়াশোনা নেই। পুলকজি, আপনি দু-একটা উদাহরণ দিতে পারবেন?

আমি বললাম, যতটা শোনেন, ঠিক ততটা প্রভাব নেই। তবে কিছু নিশ্চয় আছে। যেমন ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘কাম দ্য ওয়াইল্ড ওয়েদার/কাম স্লিট্ অর স্নো/উই উইল স্ট্যান্ড বাই ইচ আদার/হাউ এভার ইট ব্লো।’ এটার ভাবনাতেই লেখা হয়েছিল ‘পাড়ি দিতে নদী/ হান্স ভাঙে যদি/ছিন্ন পালের কাছি/মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব/তুমি আছ আমি আছি।’

এই গানটা শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে গেলেন ইন্দিবরঞ্জি। পুরো কবিতাটি আমার কাছ থেকে যতবার শুনলেন ততবারই পানপাত্রে চুমুক দিয়ে বলে উঠলেন, টেগোর ইজ গ্রেট। পুলকজি আপনার কত সৌভাগ্য আপনি টেগোরের লেখাকে সোজাসুজি শোনেন। সোজাসুজি বোঝেন। আমাদের মতো অনুবাদের বাঁকা রাস্তায় শুনতে হয় না।

সদাহাস্যময় এই মানুষটিকে দেখেছি আনন্দে আর দুঃখে কোনও রূপান্তর নেই। একই স্মিত হাসি ওঁর চোখে মুখে। যতদূর স্মরণে আসছে মাস কয়েক আগে বাপির বাড়িতেই আমাদের শেষ দেখা। শেষ জীবনে অনেকগুলো বছর উনি একা কাটিয়ে গেলেন। কাজ অবশ্য প্রায় শেষ পর্যন্ত করে গেছেন। কিন্তু সুখ শান্তি কতটা পেয়েছেন আমি জানি না। তবু ওই বন্ধুবৎসল হাসিমুখের মানুষটি ছাড়া আমার ভবিষ্যতের মুম্বই প্রবাসের দিনগুলো যে তেমন আনন্দের হবে না, এ আমার কান্না ভেজা ঝাপসা চোখেও আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

আবার সেই পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কলকাতায় বসেই পরিচালক স্বপন সাহার মধ্যস্থতায় ঢাকায় আর একটি ছবির জন্য গান লিখলাম। সেই ছবির নাম ‘টার্জন কন্যা’। সুরকার এখানকার অনুপম দত্ত। ঢাকার আর একজন নামী প্রযোজক ও পরিচালক মইনুর হুসেন আমার খুবই ঘনিষ্ঠ। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার আজ পর্যন্ত ওঁর কোনও ছবিতেই আমার গান লেখার সুযোগ হয়নি।

ঢাকার আর এক পরিচালক একবার আমায় খুব অবাক করে দিয়েছিলেন। ঢাকার স্টুডিয়োতেই শুটিং দেখতে দেখতে গল্প করছিলাম। বলছিলাম, দেখুন না ভাই, প্রযোজক ঢালী সাহেবের সুপারহিট ছবি ‘রাধাকৃষ্ণ’-তে আমার লেখা ‘ও দয়াল বিচার কর’ গানটি প্রায় হুবহু ব্যবহার করা হয়েছে আমার অজান্তে। এখানকার ‘ফাদার’-এ আমার লেখা ‘আয় খুকু আয়’, গানটি ব্যবহার করা হয়েছে। এটাতেও অনুমতি নেওয়া হয়নি। ব্যাপারটা খুবই দুঃখের। সেদিন আমার সঙ্গে বসে আর যাঁরা গল্প করছিলেন, তাঁরা সকলেই আমার কথাটা মেনে নিলেন। এর কিছুদিন বাদেই ঢাকার এক চিত্র পরিচালক, নাম সম্ভবত আফতার কবীর আমায় ফোন করলেন। ‘দাদা, আপনার সেদিনের কথাটা আমার বুকে বেজেছে। আপনি আমার ছবিতে গান লিখুন।’ সত্যি এ ব্যবহার ভোলবার নয়। ঢাকার সিনেমা জগতের যে সব মানুষের ঐকান্তিক আত্মীয়তা পেয়েছি, তাঁদের মধ্যে প্রথমেই আসছে চিত্র নায়ক ও পরিচালক আলমগিরের নাম। অমন সহজ, সরল, মিশুকে মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। ওঁর স্ত্রী খোসনূর কবি ও গীতিকার। ওঁর অনেক গদ্য রচনাও আমি পড়েছি। মনে আছে একবার আমাকে সস্ত্রীক আলমগির নিয়ে গিয়েছিলেন ওঁদের উত্তরা মডেল টাউনের ‘তসবির’ নামে সুন্দর বাড়িটাতে। তসবির ওঁদের ছেলের নাম। ছেলের নামেই বাড়ির নাম। আর দুই মেয়ে তাদের নাম আঁখি আর তুলতুল। আলমগির এখানে ও কলকাতাতেও ছবি পরিচালনা এবং অভিনয় করেছেন। এপার ওপার দুপারেই ওঁর যথেষ্ট সুনাম। ওঁদের বড় মেয়ে আঁখি চমৎকার গান গায়। আঁখি ওর প্রথম ক্যাসেটের জন্য আমায় বলল, আঙ্কেল আমার ক্যাসেটে তোমার গান চাই। ওঁর অনুরোধ এড়ানো বড় কঠিন। আমি ক্যাসেটের জন্য গান লিখে দিলাম। ক্যাসেট রিলিজের সময়ও ঢাকায় ওদের নতুন বাড়িতে উপস্থিত ছিলাম। যে আঁখির গানের ব্যাপারে আলমগির খুবই আগ্রহী ছিল সেই আঁখির ক্যাসেট রিলিজে ওর বাবা আলমগিরকে অনুপস্থিত দেখলাম।

তসবির ওঁদের আর নেই। ধুয়ে মুছে গেছে ছবির সব রং। নিয়তির খেলায় ভেঙে গেছে খোসনূর-আলমগিরের সুখের সংসার। আমার স্ত্রীর চোখে খোসনূর আর আলমগির ছিল সব থেকে সুখী দম্পতি। আমি জানি আলমগির যখন বিদেশে চিকিৎসার জন্য ছিলেন তখন খোসনূর প্রায় প্রতিদিনই ওখানে ফোন করতেন। আর খোসনূর যখন লন্ডনে, আলমগির তখন কলকাতায় আমার সামনেই ওঁকে ঘন ঘন ফোন করতেন লন্ডনে। কিন্তু অত সুখ ওঁদের আর সইল না। আলমগিরের জীবনে এসে গেল বিখ্যাত গায়িকা রুণা লায়লা। খোসনূর একা হয়ে পড়লেন। সেই জন্যই কি না জানি না খোসনূর নতুন গদ্য গ্রন্থটির নাম দিয়েছেন ‘একান্ত নিঃসঙ্গতা’। আমি জানি আধুনিক জীবনে এমন ঘটনা অনেক ঘটে। সবই মেনে নিতে হয়। তবুও কেন জানিনা ‘তসবির’-এর সেই দিনগুলোর কথা আজও সোনার অক্ষরে মনে লেখা রয়েছে।

খোসনূর প্রায়ই কবিতায় চিঠি লেখেন আমায়। ওঁর অনেক কবিতাই আমার ভাল লেগেছে। তবে একটা কবিতাতে উনি লিখেছিলেন ‘দরজা যতই বন্ধ কর/আসব শব্দ হয়ে। অনুভবের কাগজ ছুঁয়ে/লেখার ছন্দ হয়ে/যখন তখন লিখব চিঠি/ অনুরাগে উষ্ণ প্রীতি/ভেঙেচুরে হাজার রীতি/মিষ্টি স্মৃতি দস্যি কথায়/দুঃখে স্তব্ধ হয়ে।’ এই কবিতাটি ভুলতে পারি না।

এবার উত্তরা মডেল টাউনেই ওঁর নতুন বাড়িতে দেখলাম উনি দেওয়ালে বড় বড় করে লিখে রেখেছেন ‘ভাগ্যে যা আছে তা ভাবব না/নেই সুখ এই কথা মানব না।’

ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়েই জীবনের গতি। পুরনো সূর্য ডুবে যাবে উঠবে নতুন সূর্য। কেউ হয়তো নতুন সূর্যের সোনালি আলোয় প্রাণ ভরে দেখবে নতুন দিনকে। কেউ হয়তো ফেলে আসা দিনের কিছু অনুরাগ, কিছু রং তুলে রাখবে মনের মণিকোঠায়। কে কোন দলে জানি না।

আমি রুণা লায়লার গানের দারুণ অনুরাগী। আমার অনেক গান আশ্চর্য অভিব্যক্তিতে গেয়েছে ও। আলমগিরও আমার অত্যন্ত কাছের মানুষ। আমি দুজনার সুখী জীবন কামনা করি!

আবার প্রসঙ্গান্তরে যাই। অপরেশ লাহিড়ির প্রথম গান আমি শুনি ‘তুমি নাই চাঁদও নাই/রয়েছে যে খোলা স্মৃতির দুয়ার’। কুন্দনলাল সায়গলের মতো ভারী মিষ্টি গলা, আমার সেই উত্তর কৈশোরের দিনগুলো মাতিয়ে রাখত। যতদূর জানি রেকর্ডটির প্রিলিউড মিউজিকে গিটার বাজিয়েছিলেন বিখ্যাত সুজিত নাথ। কলকাতায় গিটার জনপ্রিয় করার মূলে এই মানুষটির অবদান সর্বাধিক। ওঁরই সার্থক শিষ্য, কাজী নজরুল ইসলামের পুত্র বিখ্যাত গিটার বাদক কাজী অনিরুদ্ধ। যাকে আমরা ‘নিনি’ বলে ডাকতাম। কাজী সাহেবের আর এক পুত্র ছিলেন বিখ্যাত আবৃত্তিকার। তাঁর নাম কাজী সব্যসাচী। সব্যসাচীর ডাক নাম ছিল ‘সানি’, কাজী নজরুল এক ছেলের নাম দিয়েছিলেন ‘সানি’ আর এক ছেলের নাম দিয়েছিলেন ‘নিনি’। অপূর্ব সুন্দর দুটি ডাক নাম

সলিল চৌধুরীও মেয়েদের নাম দিয়েছেন ‘অন্তরা’ ‘সঞ্চারী’। সুরকার অনল চট্টোপাধ্যায় ছেলের নাম দিয়েছেন ইমনকল্যাণ চট্টোপাধ্যায়। যে এখন চিত্র পরিচালক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে চলছে। সুরকার অজয় দাস ওঁর কন্যার নাম দিয়েছেন ঠুংরি। গিটারিস্ট সুজিত নাথের ছায়ায় গড়ে ওঠা আর এক গিটারিস্ট আমার খুবই ঘনিষ্ঠ। তাঁর নাম বটুক নন্দী। ওঁর সুরে আমি কিছু গানও রচনা করেছি। ওঁর পুত্র নীলাঞ্জন নন্দী, যার সঙ্গে সুরকার অসীমা মুখোপাধ্যায়ের (ভট্টাচার্য) মেয়ে পম্পির বিয়ে হয়েছে। নীলাঞ্জনও সুরকার ও যন্ত্রশিল্পী। ওর সুরে পলিডোরের এল পি রেকর্ডের ‘সাহেব’ নাটকে আমি গান লিখে খুবই খুশি হয়েছিলাম।

অপরেশ লাহিড়ির আর একটি সুপারহিট গানের কথা মনে আসছে। গানটি ছিল ‘ভালবাসা যদি অপরাধ হয়। আমি অপরাধী তবে।’ এই গানটি প্রসঙ্গে অপরেশদা একদিন আমায় একটা গল্প শুনিয়েছিলেন। একদিন উনি দেশপ্রিয় পার্কের এক রাজনৈতিক সভায় হাজির হয়েছিলেন। দেশ তখন পরাধীন। এক নামী নেতার ভাষণে শুনেছিলেন তিনি সোচ্চার কণ্ঠে বলছেন ‘দেশকে ভালবাসা যদি অপরাধ হয় তাহলে আমি অপরাধী।’

সমবেত জনতা বিরাট করতালি দিয়ে সেই ভাষণটি গ্রহণ করেছিলেন। সেদিন কিংবা তার পরদিনই অপরেশদা ওই গানটি রচনা করালেন এক গীতিকারকে দিয়ে। সেই সময় অপরেশদার প্রতিটি গানই জনপ্রিয় হত। যতদূর স্মরণে আসছে অনুপম ঘটক সুরারোপিত ‘তুলসীদাস’ ছবিতেও অপরেশদার একটি ব্যতিক্রমী গান ছিল। নিউ থিয়েটার্সের রাঁইচাদ বড়ালের খুবই কাছের লোক ছিলেন উনি। কিন্তু শুধু নিজেকে নিয়েই মত্ত থাকেননি কোনও দিনই। অন্যেরও উপকার করে গেছেন। রাইচাঁদ বড়ালের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে। প্রথম জীবনে উনি যোগ দেন মেগাফোন রেকর্ডে। মেগাফোনের কর্ণধার মেগা ঘোষ অর্থাৎ আজকের কমল ঘোষের জ্যাঠামশাই অন্ধ জে. এন. ঘোষের খুবই প্রিয় পাত্র ছিলেন অপরেশদা। জে. এন. ঘোষের মেগাফোন রেকর্ডে প্রতিটি রেকর্ডে নাম্বার থাকত জে এন জি দিয়ে। যেমন জে এন জি ফাইভ সিকস্, জে এন জি থ্রি জিরো ওয়ান এই রকম। অপরেশদা ওখানেও অনেক নতুন শিল্পীকে দিয়ে গান করাতে রাজি করিয়েছিলেন মেগা ঘোষকে দিয়ে। ওখানেই অপরেশদার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বাঁশরী চক্রবর্তীর। উনিও তখন মেগাফোনেরই শিল্পী।

৬২

বাঁশরীদির কণ্ঠের ভিন্নতা সহজেই আকৃষ্ট করে অপরেশদাকে। ক্রমশ দুজনে দুজনকে ভালবেসে ফেলেন। শুনেছি অপরেশ লাহিড়ি আর বাঁশরী চক্রবর্তীর শুভ বিবাহ জে. এন. ঘোষ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দেন। হ্যারিসন রোডের দিলখুশা কেবিনের উল্টো দিকের ওই মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানিতে যাঁরাই যেতেন তাঁদের কাউকে কিন্তু দিলখুশার খাবার খাইয়ে দিলখুশ না করে, ওখান থেকে বার হতে দিতেন না মেগা ঘোষ।

ওই বাড়িতেই বেশ কিছুদিন কাটিয়ে গেছেন মেগাফোনের সব থেকে সেরা শিল্পী কাননদেবী। এখন মুম্বই-এর জুহু ভিলে পার্লে স্কিমের বাড়ির অলিন্দে কবে কখন একবার দেখা দেবেন অমিতাভ বচ্চন তার জন্য যেমন প্রতিদিনই অমিতাভ ভক্তরা রাস্তায় হাপিত্যেশ করে দাঁড়িয়ে থাকেন, ঠিক তেমনি তখন হ্যারিসন রোডে দাঁড়িয়ে থাকতেন কানন ভক্তরা। কবে কখন উনি বারান্দায় আসবেন, কখন গাড়িতে উঠে স্টুডিয়োতে যাবেন, ওঁরা চোখ ভরে দেখবেন।

যাই হোক, অপরেশ লাহিড়ি শঙ্কর জয়কিষেণের ‘বাদশাহ’ ছবিতে হিন্দি গান গেয়ে মাতিয়ে দিয়েছিলেন মুম্বই। তখন মুম্বই-তে সায়গল কন্ঠের ভীষণ কদর। গান গেয়ে মুম্বই-তে জনপ্রিয়তা পেলেও, মুম্বই-তে বেশি দিন থাকতে না পেরে ফিরে এলেন কলকাতাতে। এখানে এসে এরপর শুরু হয় অপরেশদার নতুন ভূমিকা। গায়ক অপরেশ লাহিড়ি হয়ে যান সুরকার অপরেশ লাহিড়ি। ইতিমধ্যে বাঁশরী বউদি যেমন রাগাশ্রয়ী গানেই ক্রমশ বেশি সার্থক হয়ে উঠতে লাগলেন, তেমনি অপরেশদা ফোক গানে বেশি পারদর্শিতা প্রমাণ করতে লাগলেন।

ভূপেন হাজারিকা যে সময় পরিচালক হয়ে অহমিয়া ভাষায় ‘এরাবটের সুর’ ছবি করেন। প্রায় সেই সময়েই অপরেশদাও ছবি করেন ‘ও আমার দেশের মাটি’। দুটি ছবিরই বিষয়বস্তু ছিল ফোক সঙ। একটি অহমিয়া অন্যটি বাংলা। ‘ও আমার দেশের মাটি’-তেই লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে অপরেশদা গাওয়ান ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’।

বাংলা মাটির এই গানটির অভিব্যক্তি লতা মঙ্গেশকর সারা পৃথিবীর মাটির কানে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

অপরেশদাই পীযূষ বসুর ‘সুভাষচন্দ্র’ ছবিতে, লতাজিকে দিয়ে গাওয়ান বাংলার সেই বিখ্যাত গান ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’। লতাজির কণ্ঠের এই গান শুনে অনেকেরই চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। এই গানটি রেকর্ডে প্রকাশিত হওয়ার আগে স্বয়ং লতাজি এক সন্ধ্যায় নিজের ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে আমায় কথায় কথায় বলেছিলেন, অপরেশদা কা গানা বহুত চলে গা।

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী জন্য আপনার এই ধারণা হল?

লতাজি বললেন, গানটিতে একমাত্র একটা তারের যন্ত্রের বাজনা ছাড়া কোনও বাদ্যযন্ত্রই নেই।

আমি বুঝলাম অগুন্তি বাজনাদারের বাজনার সঙ্গে প্রতিদিন গান গেয়ে গেয়ে ক্লান্ত লতাজি একটা নতুনত্বের আস্বাদ পেয়ে একথাটা বললেন। কিন্তু উনি তৎক্ষণাৎ আমার মনের ভাবটা বুঝতে পেরে বলে উঠলেন, না না। আসলে গানই যে সব, বাজনা নিমিত্ত মাত্র, এটা অপরেশদা প্রমাণ করে দিয়েছেন।

লতাজির গাওয়া অপরেশদার সংগীত পরিচালনায় এই ‘একবার বিদায় দে মা’ গানটি শুনে আজকের অনেক নামী দামি মিউজিক অ্যারেঞ্জাররা মুখে না হলেও মনে মনে নিশ্চয়ই মানবেন লতাজির এই উক্তির যথার্থতা। অপরেশদার অনেক আধুনিক গানই আমি লিখেছি মেগাফোন ছেড়ে এইচ. এম. ভি.-তে যোগ দেওয়ার পরে। এবং আবার পরবর্তীকালে এইচ.এম. ভি. ছেড়ে মেগাফোনে যোগ দেওয়ার পর। তার মধ্যে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে ‘এই পৃথিবী/ভরা সাহেব বিবি’ এবং ভূপেন হাজারিকার সুরে ‘জলের জাহাজ জল কেটে যায়…’ ও ‘থাক থাক পিছু ডাক…’ আমার খুবই প্রিয়।

অপরেশদার সুরে সিনেমায় যতদুর মনে পড়ছে প্রথম গান লিখি ‘অজানা কাহিনী’-তে। এইভাবে দিন কেটে যাচ্ছিল। ইতিমধ্যে, যে বাপির জন্মদিনে প্রতি বছরই অপরেশদার টালিগঞ্জের বাড়িতে আমি, উত্তম এবং আরও অনেকে খুব হই হল্লা করতাম, যে ছোট্ট বেলাতেই নামী তবলিয়া শাস্তা প্রসাদের কাছে নাড়া বেঁধেছিল যে, ছোট ছোট দুটো হাতে লহরার বোলতরঙ্গ ফুটিয়ে আসরের পর আসর মাত করে দিত, সেই বাপি বড় হয়ে উঠল।

একদিন অপরেশদার ফোন পেলাম, পুলক একটা ছবির গান লিখতে হবে। এসো। স্বভাবতই জিজ্ঞাসা করলাম, কার ছবি অপরেশদা? পরিচালকই বা কে?

উত্তরে শুনলাম, সে সব এখানে এসে শুনো। এখন শুধু শুনে নাও, অপরেশ লাহিড়ি মিউজিক ডিরেক্টর নয়। এই ছবির মিউজিক ডিরেক্টর তোমার লেখার মুগ্ধ ভক্ত বাপি, বাপি লাহিড়ি।

যথাসময়ে হাজির হলাম অপরেশদার বাড়িতে।

দেখি বাপি সুর করে প্রস্তুত হয়ে বসে আছে। ওই সুরের উপর লিখতে হবে আমায় গান।

অপরেশদা ছবির গল্পটি শোনালেন। খুবই নতুনত্ব লাগল গল্পটি। ছবির কী নাম ঠিক ছিল আজ আর মনে আসছে না। তবে এই গল্পটিরই হিন্দি ভার্সান করেছিলেন আর. ডি. বনশল তাঁর প্রথম হিন্দি ছবি ‘ঝুক গয়া আসমান’ নামে। সিচুয়েশন বুঝে সুর শুনলাম বাপির। বাপি হারমোনিয়াম বাজিয়ে শোনাল। চমকে উঠলাম। যে সব সুরকারের অসাধারণ হারমোনিয়াম বাজনা আমি শুনেছি, তাঁদের মধ্যে প্রথমেই মনে পড়ে সুধীন দাশগুপ্ত ও সলিল চৌধুরীর নাম। আর একজন জাদু জানা বাদ্যযন্ত্রীর আঙুলের ছোঁয়ায় হারমোনিয়াম যে কীভাবে বাজতে পারে তা উপলব্ধি করেছি ভি. বালসারার হারমোনিয়াম বাজনা শুনে। অবশ্য বারকতক সৌভাগ্য হয়েছিল ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের মনমাতানো হারমোনিয়াম শোনার। কিন্তু বাপির হারমোনিয়াম শুনলাম একেবারে ভিন্ন ধর্মী। ওর গলার গানের সুরকে অপরূপ সৌন্দর্যে সাজিয়ে দিয়েছিল ওর সেদিনের হারমোনিয়াম বাজানো।

আমি গান রচনা করলাম। বাপি তো আত্মহারা। অপরেশদা বাঁশরী বউদি প্রত্যেকেই দারুণ খুশি। সেদিনই ওখানে ভূরিভোজ সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে স্থির সিদ্ধান্তে এসে গেলাম। আজ যাকে অঙ্কুর দেখে এলাম, আগামী দিনে সে যে এক বিশাল বনস্পতি হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু বাপির সে গান রেকর্ডিং হয়নি। হয়নি সেই বাংলা ছবিটিও। পরবর্তীকালে বাপি সংগীত পরিচালনার সুযোগ পেল ‘দাদু’ ছবিতে। অবশ্য বাপি এককভাবে ওই ছবির সংগীত পরিচালনা করেনি। সঙ্গে ছিল আরও কেউ কেউ। সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা, তখনকার কলকাতার বাসিন্দা বাপি সুদূর মুম্বই গিয়ে লতাজিকে অনুরোধ উপরোধ করে অল্প পারিশ্রমিকে রেকর্ড করে আনে লতাজির গাওয়া গান ‘আমি প্রদীপের নিচে পড়ে থাকা/এক অন্ধকার’। এই গানটি প্রযোজক রঞ্জিতমল কাঙ্কারিয়া এবং পরিচালক অজিত গঙ্গোপাধ্যায় দুজনেই শুনে তৎক্ষণাৎ নাকচ করে দেন। গানটির কথা ঠিক রেখে, নতুন করে সুর করানো হয় কালীপদ সেনকে দিয়ে। আরতি মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে গানটি কলকাতায় রেকর্ড করা হয়। কালীপদ সেনের সুরটিই ছিল ‘দাদু’ ছবির অভিনেত্রীর ঠোঁটে। অনেকেরই ধারণা ছবির জগতের পথগুলো ফুল দিয়ে ছাওয়া। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। সে পথ ভঙ্গুর। অজস্র কাঁটার জ্বালায় ভরা। অনেকের মতো বাপির জীবনে তার উজ্জ্বল প্রমাণ আছে। তবু নিষ্ঠা, যোগ্যতা, একাগ্রতা আর সৌভাগ্য বাপির জীবনের লড়াইকে থামতে দেয়নি। বলিষ্ঠ পদক্ষেপের সব বাধা তুচ্ছ করে সে তো সাফল্যের স্বর্ণ তোরণেই পৌঁছে গেল। ইতিহাস তো এদের কথাই মনে রাখবে। এই বোধ এবং বিশ্বাস আমার মর্মে ছিল বলেই বোধহয় মান্নাদার একটি গানে লিখতে পেরেছিলাম—’পথের কাঁটায় পায়ে/রক্ত না ঝরালে/কী করে এখানে তুমি আসবে?’ এরপর ‘জনতার আদালত’ ছবি করতে করতে অপরেশদা সপরিবারে চলে গেলেন মুম্বই। এবার মুম্বই-তে অপরেশদার ভিন্ন ভূমিকা। সুরকার নয়, নেপথ্য গায়ক ও নয়, শুধু বাপির প্রোমোটার। চিত্র জগতে অনেকেরই কেউ কেউ ‘গড ফাদার’ থাকেন। কিন্তু অপরেশ লাহিড়ি, বাপি লাহিড়ির প্রকৃত অর্থেই শুধু ফাদার’ নন—’গড ফাদার’ ঈশ্বরতুল্য জনক। মুম্বই-এর সেই স্ট্রাগলিংয়ের দিনগুলোতে বাপিকে দুহাতে আগলে ঘুরেছেন উনি প্রযোজকদের দরজায় দরজায়। কিন্তু খুব অল্প আয়াসেই সুদিন পেয়ে গেছেন উনি। শুনেছি ফিল্মালয়ের শশধর মুখোপাধ্যায়, বাপির ওই হারমোনিয়াম বাজনা শুনেই ছবিতে সুযোগ দিয়েছেন। নাম হয়েছে বাপির। তারপরেই অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এসে গেছে সেই গানটি ‘বোম্বাইসে আয়া মেরা দোস্ত, দোস্তকো সালাম করো।’ এই গানটার জন্য বাপি কেবল সুরকারই নয়, গায়ক হিসাবে রাতারাতি প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে।

তারপর খুব দ্রুত পট বদলে গেছে। সান্তাক্রুজের লাভলি গেস্ট হাউসে সেই ছোট ঘর ছেড়ে বাপি চলে গেছে সান্তাক্রুজেরই অন্য একটা ফ্ল্যাটে। তারপর জুহুর সমুদ্র তীরে ট্রিটোনে। আর এখন জুহু ভিলে পার্লে মার্বেল মোড়া বিরাট লাহিড়ি হাউস।

মুম্বই-পুনে রোডের কারজাতে সুন্দর ফার্ম হাউসের মালিকানাও পেয়েছে বাপি পেয়ে গেছে সাফল্যের আরও অনেক ফসল। কিন্তু বাপির সম্পর্কে একটা কথা বলতেই হয়, কোনও দিন মা-বাবা পরিবারকে এড়িয়ে কোথাও সরে যায়নি।

পারিবারিক জীবনে বাপি তাই বেশ খুশি। পর্যাপ্ত সাফল্য এবং অর্থে অনেক মানুষ‍ই ভেসে যায়, বাপি কিন্তু ভাসেনি, নিজেকে স্থির রেখেছে। হয়তো সুন্দরী মন্দাকিনী অথবা গায়িকা নায়িকা সলমা আগাকে, বাপির সঙ্গে জড়িয়ে কখনও কিছু গুঞ্জন উঠেছে কিন্তু তা শুধু ওই গুঞ্জনই থেকে গিয়েছে। তাতে সত্যের ভাগ খুবই কম।

বাপি, তার কাজ, তার বাবা মা স্ত্রী সন্তানদের এড়িয়ে থাকার অবকাশই পায়নি জীবনে। চায়ওনি কখনও। বিদেশে বেড়াতে যাবার সময় মা-বাবা স্ত্রী পুত্র কন্যাকে নিয়ে গেছে। তেমনি জলসার অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছে সপরিবারে। এমন দৃষ্টান্ত চিত্র জগতে খুব বেশি নেই।

বাপি বিয়ে করেছে হাওড়ার লবণ গোলার এক কর্ণধার শ্রীযুক্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্যা, অল্প বয়সি নাম করা গায়িকা চন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়ের বোন চিত্রাণীকে। হাওড়ার প্রখ্যাত সেন্ট অ্যাগনেস কনভেন্ট স্কুলের কৃতী ছাত্রী রূপবতী চিত্রাণী বাংলা ছবিতে অভিনয়ও করেছে। চিত্রাণীকে ভালবেসে বিয়ে করে সুখী জীবনযাপন করছে বাপি।

বাপির শ্বশুর, ওঁর গায়িকা কন্যা চন্দ্রাণী মুখ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে এইচ. এম. ভি.-তে রেকর্ড করিয়েছেন সলিল চৌধুরীর সুরে। চন্দ্রাণীর গান আমি প্রথম লিখি ডি. এস. সুলতানিয়ার ‘এই করেছো ভাল’ ছবিতে অধীর বাগচির সুরে। ছবিটিতে একাধিক গান ছিল চন্দ্রাণীর। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘কত দিন এমনি চলে যাবে’। তারপর লিখলাম হেমন্তদার সুরে ওর রেকর্ডের দুটো গান তার মধ্যে ‘সেই শান্ত ছায়ায় ঘেরা…’। এরপর চন্দ্রাণীর বাবা বদলি হয়ে চলে গেলেন মুম্বই-এর লবণ গোলায়। ওখানে ওদের বাড়িতে থেকে লিখেছিলাম চন্দ্রাণীর জন্য ঊষা খান্নার সুরে দুটি গান। তারপর বাপি যখন ওদের আত্মীয় হয়ে গেল তখন চন্দ্রাণীর বাবা আমায় মুম্বই-তে ডাকলেন, বাপি আর চন্দ্রাণীর গান লিখতে। তখন ই. পি. রেকর্ডের যুগ। বাপির সুরে চারটি গান লিখেছিলেন সেবার। দুটি বাপির দুটি চন্দ্রাণীর। বাপির একটি উল্লেখযোগ্য গান ছিল ‘স্বপ্ন মহলে’ আর চন্দ্রাণীর উল্লেখ্য গানটি হল ‘চুরি করে আমার মন’। এই গান চারটি আমার লেখা বাপির সুরে প্রথম রেকর্ড।

৬৩

সুখেন দাশের সহকারী তপন ভট্টাচার্য আমাকে হঠাৎ ধরে নিয়ে এল মুম্বই-তে। মুম্বই-তে এসে জানলাম ওর ছবির সংগীত পরিচালক বাপি লাহিড়ি। মুম্বই-তে নামের ইংরাজি অক্ষর গুণে একরকম ভাগ্য পরীক্ষা চালু রয়েছে। সেই অক্ষরের গুনতিকে একটু বাড়িয়ে ভাগ্য পরীক্ষায় দুর্দান্ত সাফল্যে উত্তীর্ণ বাপি লাহিড়ি তখন বাপ্পি লাহিড়ি হয়ে পরপর ছবির গান হিট করাচ্ছে। সেই বাপ্পির সঙ্গে গান লিখতে বসে দেখলাম, অত হিট হলেও বাপির সেই আগের বাঙালি মেজাজ আর কৌলিন্যের ঘরানা একটুও পাল্টায়নি। আশাজি ও কিশোরদাকে দিয়ে রেকর্ড করা হল সেই ছবির কয়েকটি গান। তার মধ্যে কিশোরদার গাওয়া একটি গানের মুখড়া আমায় দিয়েছিল বাপি। সেটি ছিল ‘আমি শালা আজ রাতে..।’ অনিবার্য কারণে ছবিটি বন্ধ হয়ে গেলেও কিশোরদার এই গানের মুখড়াটি মনে রেখেছিলেন বেশ কিছুদিন। আমায় দেখলেই আমার গানটির কথাগুলো একটু অদল বদল করে গেয়ে উঠতেন ‘আমি শালা আজ রাতে/গৌরাঙ্গের ভজনা করিব হে।’

এরপর বাপি আর আমার যোগাযোগ সুজিত গুহ পরিচালিত দিলীপ পালের ‘অমরসঙ্গী’ ছবিতে। ওই ছবির প্রতিটি গান বিশেষ করে বাপি আর আশাজির গাওয়া ‘আমার ইচ্ছে করছে ভালবাসতে’ এবং কিশোরদা আর আশাজির গাওয়া ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’ দারুণ হিট করে। ওয়ার্ল্ড কাপের উদ্বোধনে ইডেন গার্ডেনে সারা পৃথিবীকে সে গান গেয়ে শুনিয়ে দিয়ে আশাজি আমাদের দারুণ সম্মানিত করেছেন। এরপর বাপি আর আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেল। পর পর গান জনপ্রিয় হতে লাগল আমাদের।

এর পর যে উল্লেখ্য গান দু’টির কথা মনে আসছে সে-দুটি শচীন অধিকারীর ‘চোখের আলোয়’ ছবির—তার একটি ছিল আশাজির গাওয়া ‘আর কত রাত একা থাকব’ এবং অন্যটি বাপি ও আশাজির গাওয়া ‘ওই শোনো/পাখিও বলছে কথা।’। রিতা তরফদারের, প্রভাত রায় পরিচালিত ‘অনুতাপ’ ছবির গানগুলোও খুব জমেছিল—শানুর গাওয়া— ‘দুষ্মন্ত রাজা যদি হতাম আমি’ খুবই জনপ্রিয় গান। বাপির সুরে আমার সব গান উল্লেখ করতে গেলে অনেক পাতা ভরে যাবে সে লেখায়। তবে আমরা বহু ধরনের সার্থক গান করেছি এটা নিশ্চয়ই জোর গলায় বলতে পারি। যেমন করেছি আমার তুমি’ ছবিতে লতাজির গাওয়া ‘বলছি তোমায় কানে কানে/আমার তুমি’। ‘মন্দিরা’ ছবিতে লতাজির—‘সব লাল পাথর-ই তো চুনি হতে পারে।’ ‘অন্তরের ভালবাসা’ ছবির লতাজির ‘তোমার আমার ভালবাসা’ ‘আশা ও ভালবাসা’ ছবির কিশোরদার ‘আমায় ফুলের বাগান দিয়ে নিয়ে যেও না।’ ‘নয়ন মণি’ ছবির আশাজি ও বাপির ‘তুমি আমার নয়ন গো’ ইত্যাদি অনেক ছবির গভীর ভাবের গান আবার ছবির সিচুয়েশন অনুযায়ী হাল্কা গানও করেছি অনেক। তার মধ্যে উল্লেখ্য—‘বলিদান’ ছবির ঊষা উত্তুপের ‘প্রেম জেগেছে আমার মনে—উরি উরি বাবা/’কী দারুণ’, ‘বদনাম’ ছবির অলকা ইয়াগনিকের ‘ঝাল লেগেছে ঝাল লেগেছে/ঝালে মরে যাই’। ‘রক্তলেখা’ ছবির কবিতা কৃষ্ণমূর্তির কণ্ঠে—মেয়ে পকেটমারের গান—’কারও পকেট বড়/কারও পকেট ছোট/ কেউ লম্বা বেশি/কেউ একটু খাটো/ আমি বলি সবাই সাবধান/ আমি কোলকাতার রসগোল্লা’ ইত্যাদি।

তবু কেন জানি না, সব গান ছাপিয়ে আমার কানে বাজে বাপির সুরে আমার লেখা প্রভাত রায়ের ‘লাঠি’ ছবিতে শানুর গাওয়া গানটি ‘সুখের সে দেশে/কবে কোন দিনে/ কে কখন যাব কে জানে।’

আমার কথায় বাপির সুরে বাপির নিজের গাওয়া প্রচুর আধুনিক গানও আছে। তার মধ্যেও আমরা দুটি দিকই বজায় রেখেছি। যেমন করেছি ‘কখনও দেখেছি খোলা জানলায়…’, অথবা ‘কেউ গায়ক হয়ে যায়…’, আবার করেছি ‘আজকের প্রেম ওয়ান ডে ক্রিকেট’। আবার লিখেছি ‘আমে দুধে মিশে গেল’।

তরুণ মজুমদারের ‘কথা ছিল’ ছবির শেষ গানটি রেকর্ডিং করে বাপি আমায় বলল, পুলকদা, এবার আপনারা আমায় ধুতি পরিয়ে ছাড়লেন।

উত্তরে বলেছিলাম, তুমি তো বাঙালি। ধুতি তো বাঙালির জাতীয় পরিধান। তুমি যে কত খাঁটি বাঙালি তা তোমার সুর দেওয়া ‘কথা ছিল’ ছবির কয়েকটি গানই প্রমাণ করবে। তরুণ মজুমদার যখন বহুদিনের সঙ্গী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে অনিবার্য কারণে ছেড়ে রাহুল দেববর্মণকে দিয়ে ‘আপন আমার আপন’ ছবির সুর করালেন এবং আরও ছবিতে ভি. বালসারা প্রমুখ সুরশিল্পীকে নিলেন ‘সজনি গো সজনি’ ছবিতে। সেই সময় ওই সব ছবির গান লিখতে লিখতে তরুণ মজুমদারকে অনুরোধ করেছিলাম, ওঁর পরের কোনও একটা ছবিতে বাপিকে নিতে। তনুবাবু জানতে চাইলেন, হঠাৎ বাপিকে কেন নিতে বলছেন?

উত্তরে বলেছিলাম, আমার ধারণা আপনার ছবিতে বাপির একটা সুন্দর ব্রেক হবে। তখন বাপির ‘ব্রেক ডান্সার’ সুপার হিট। তনুবাবু সম্ভবত সেই দিকটা ইঙ্গিত করেই হাসতে হাসতে বলেছিলেন, বাপির আর কী ব্রেকের প্রয়োজন?

তবুও ব্যাপারটা নিশ্চয় তনুবাবুর ভাবনাতে ছিল। তাই ‘কথা ছিল’ ছবিতে বাপিকে নিয়ে নিলেন। উনি জানতেন বাপিকে দিয়ে কী ধরনের বাংলা গান করলে তা ভাল গান হবে। বাঙালি বাপি যে বিরাট বাঙালি প্রেমিক তার পরিচয়ও অনেক আগেই দিয়ে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে প্রকৃত গুণী অথচ দৃকভ্রান্ত কিছু বাঙালি তরুণ প্রতিভাধর বাদ্যযন্ত্রীকে কলকাতা থেকে মুম্বই-তে নিয়ে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিয়ে, ওর অর্কেস্ট্রায় দিনের পর দিন সুযোগ দিয়ে ওদের অনেককেই সংগীত জগতে প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছে। এর জন্য ওকে বাহবা দিতেই হয়। আজকের মুম্বই-এ অনেক প্রতিষ্ঠিত বাঙালি বাজনদারকে বাপিই সুযোগ দিয়ে প্রতিষ্ঠার পথ করে দিয়েছে। এদের মধ্যে টাবুন সূত্রধর, সমীর, পিন্টু, মধু ইত্যাদির নাম অবশ্যই উল্লেখ্য। বাপির সাজপোশাক, গায়ের গয়নাগাটি দেখে যাঁরা সমালোচনা করেন, তাঁরা কিন্তু বাপির এদিকটা দেখেন না, এটাই দুঃখের।

বাংলা ছবির বাণিজ্যিক গান বানানোর বাপির ক্ষমতা যে কতটা, বাঙালি শ্রোতামাত্রই তা জানেন। ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ ছবির গানগুলোর কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য।

কিছুদিন আগে মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী যখন সল্ট লেক স্টেডিয়ামে গণনাট্য সংঘের উৎসবের জন্য বাপির সুরে একটি উদ্বোধনী গান রচনা করার জন্য আমায় মুম্বই যেতে অনুরোধ করলেন, আমি তৎক্ষণাৎ সুভাষবাবুর কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। তবুও একটা কথা আমি একান্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, সাধারণ বাঙালিরা বাপির এই বিরাট সাফল্যকে যেভাবে অন্তর দিয়ে গ্রহণ করেছেন, বাঙালি সংগীতমহল কিন্তু সেই সাফল্যকে তেমনভাবে গ্রহণ করেননি। এর কারণ বিশ্লেষণ করে আমি অবশ্য ঈর্ষাকাতরতা ছাড়া আর কিছু খুঁজে পাইনি।

অপরেশদার সুরে গান লিখেছি অনেক, বাপির সুরে গান লিখেছি অজস্র। এখন বাপির ছেলে বাপ্পা লাহিড়ি দুর্দান্ত রিদিম বাজাচ্ছে দারুণ সুরও করছে। মুম্বই-এর অনেক নামী শিল্পীই সেই সব হিন্দি গান রেকর্ড করেছেন। আমি শুধু অপেক্ষা করছি কবে বাপ্পার সুরে গান লিখে, তিন প্রজন্মের সঙ্গী হয়ে থাকতে পারব।

আমার ভগ্নিপতি প্রযোজক সরোজ মুখোপাধ্যায়ের কথা আমি এর আগেও বলেছি। আমার শেষ কৈশোরেই চিত্র জগতের প্রতি আমার অতিরিক্ত আকর্ষণ দেখে এবং আমার বিভিন্ন গান ও গল্প পড়ে হয়তো মনে প্রাণে চাইতেন আমিও চিত্রজগতে আসি। পড়াশোনা শেষ করে ওঁর কাজে সহায়তা করি। সেইজন্যেই আমার স্কুল ছুটি থাকলেই হাজির হয়ে যেতে পারতাম ওঁর অফিসে, ওঁর নিজস্ব চেম্বারে। ওই বয়সেই অনেক বার স্টুডিয়োতে গেছি। প্রজেকশন দেখেছি। ওঁরই সঙ্গে ডি. কে. অর্থাৎ দেবকীকুমার বসুর বাড়িতে প্রথম যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। তখন উনি সরোজদার প্রযোজনায় ‘অলকানন্দা’ ছবির চিত্রনাট্য লিখছেন।

মনে হল আমার সঙ্গে কথা বলে দেবকীবাবু বেশ খুশি হলেন। ওই অল্প বয়সে আমাকে স্টুডিয়োতে দেখে অনেকেই খুব সঙ্গত কারণেই, আমার পড়াশোনার ক্ষতি হবে এই আশঙ্কায় মনে মনে অখুশি হলেও মুখে হাসি ফুটিয়ে বলতেন হ্যাঁ, একেবারে শিকড় থেকে জেনে নাও ফিল্ম লাইনটা কেমন?

আমি তখন মনের কথা আর মুখের কথার পার্থক্যটা বুঝতে পারতাম না। তাই ওঁদের কথাতে প্রচুর উৎসাহ পেতাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে, একবার রাধা ফিল্ম স্টুডিয়োতে সরোজদা বিখ্যাত নট অহীন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় করাতেই আমি ওঁকে প্রণাম করেছিলাম। উনি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছিলেন, সরোজ, এই বয়সে ওকে স্টুডিয়োতে নিয়ে আসছ কেন? ওকে ভাল করে পড়াশোনা করতে দাও।

কথাটা শুনে মনে মনে আহত হলেও নতুন করে বুঝেছিলাম পড়াশোনার কতটা প্রয়োজন। তবুও কলেজ জীবনে যখন গীতিকার হয়ে গেছি এবং মাঝে মাঝে রাত করে বাড়ি ফিরছি তখন আত্মীয়স্বজন মহলেও এ ব্যাপারটা নিয়ে স্বাভাবিক কারণে সমালোচনা শুরু হল। আমার বাবা, আগেই বলেছি নির্বাক যুগের ‘শ্রীকান্ত’ সহ বহু ছবির নায়ক এবং শান্তিনিকেতনের শিল্পগুরু অসিত হালদারের শিষ্য, আমার পড়াশোনার ব্যাপারে কোনও খোঁজ-খবরই রাখতেন না। কলেজের মাইনে বা অন্যান্য খরচ চাইলেই দিয়ে দিতেন। এবং মাঝে মাঝে বলতেন, সুশীলকে (পরিচালক সুশীল মজুমদার) আর হীরেনবাবুকে (হীরেন বসু) শান্তিনিকেতনে গেলে, শান্তিদেব ঘোষের সঙ্গে দেখা হলে তোমরা আমার কথা বোলো। তারপরে রং তুলি নিয়ে ছবি আঁকার জন্য মগ্ন হয়ে যেতেন। কিন্তু আমার উপর কড়া নজর রাখতেন সিস্টোফোন সাউন্ড স্টুডিয়োর মালিক এবং বিখ্যাত শব্দযন্ত্রবিদ, বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র, আমহার্স্ট স্ট্রিটের বামাদাস চট্টোপাধ্যায়ের ভ্রাতুষ্পুত্রী বেলমতীদেবী। মা আমার ঘরে লেখার সময়, লেখাপড়া করার সময় মাঝে মাঝে আসতেন। বলতেন, অমুকদি আমায় বলেছেন, হ্যাঁরে, তোর ছেলে সকাল দশটায় কলেজ করতে গিয়ে রাত্রি দশটায় নাকি মাঝে মাঝে বাড়ি আসে? আজকাল অতক্ষণ ধরে কলেজ হয় নাকি?

প্রায়ই আমাকে মায়ের পা ছুঁয়ে বলতে হত, মা, আমি যা কিছুই করি না কেন তুমি বাধা দিয়ো না। আমি তোমায় কথা দিচ্ছি পরীক্ষার ফল ভাল হবেই। ভগবানের কৃপায় আর আমার মা-বাবার আশীর্বাদে পরীক্ষার ফল ভালই হত। নিজেই চমকে যেতাম ফল দেখে।

কলেজের মাস্টারমশাইরা বলতেন, তুমি নোটগুলো মুখস্থ লেখ না, নিজের ভাষায় লেখ। সে জন্যই নম্বর পাও। আসল কথা কী জানো আমরা নম্বর দিতে চাই কিন্তু নম্বর দেওয়ার অবকাশ পাই না।

যাক এ প্রসঙ্গ ছেড়ে আগের কথাতেই ফিরে আসি।

সরোজদার সঙ্গে গিয়েছিলাম ওঁর ‘অলকানন্দা’ ছবির মিউজিক ডিরেক্টর ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্রের উত্তর কলকাতার বাড়িতে ওই ছবির গান শুনতে। ধীরেনবাবু তখন নজরুলের শাওন আসিল ফিরে’, ‘ভোরের ঝিলের জলে’ ইত্যাদি গানে পাগল করে দিয়েছেন সংগীত জগৎকে। উনি তখন সুরকারের নতুন ভূমিকায় উপস্থিত। কাননদেবীর নতুন ছবিতেও সুর দিচ্ছেন।

হাওড়া নিবাসী দেবকীবাবুর সহকারী পরিচালক রতন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ‘অলকানন্দা’ ছবির চিত্রপরিচালক। এটিই স্বাধীনভাবে ওঁর প্রথম চিত্রপরিচালনা দেবকীবাবুর অনুরোধেই সরোজদা এই মানুষটিকে পরিচালক হিসাবে নিয়েছিলেন। ধীরেনবাবুর বাড়িতে সেদিন রতনবাবুও হাজির ছিলেন। ধীরেনবাবু শোনালেন ওঁর সুর করা ‘অলকানন্দা’ ছবির একটি গান ‘সব হারানোর অতল দরিয়ায়/ভাসিয়ে দে রে তরী এবার।’

সরোজদা শুনেই আমার দিকে ফিরে বললেন, পুলক, তুমি তো খুব গান বোঝো। গানটা দারুণ সুর হয়েছে না?

সেই সময় ধীরেনবাবুর গাওয়া নজরুলগীতি আমার মনে সবসময় বিরাজ করছে। তাই চট করে বলে ফেললাম, গানটা যদি ধীরেনবাবু নিজে গান তা হলে আরও ভাল হবে।

কে একজন বললেন, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য গাইলে চমৎকার হবে। রতনদা আমতা আমতা করে বললেন, আমাদের হাওড়ার বাড়ির কাছেই লক্ষ্মণ দাশ লেনের একটি ছেলে আমায় খুব ধরেছে। তার গান একবার শুনে দেখুন না। ছেলেটির নাম তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়। মনে হয় ধীরেনবাবুর গানের কোনও অমর্যাদা করবে না তরুণ।

সরোজদা কিন্তু যতদিন ছবি করেছেন, ছবির গানের ব্যাপারে আমার কথাতে সায় দিয়ে এসেছেন। আমি ধীরেনবাবুর নাম বলেছি শুনেই হয়তো উনি বললেন, তরুণবাবুকে বলবেন ওঁকে অন্য ছবিতে গাওয়াব। কিন্তু এই গানটি গাইবেন ধীরেন মিত্র। অন্য কেউ নয়। এটাই চূড়ান্ত। এবার মেয়েদের গানগুলো শুনি।

৬৪

এই ঘটনার দু-চার দিন বাদেই একদিন একজন বিনয়ী মানুষ আমার বাড়িতে এলেন। আমাদের বৈঠকখানায় বাবার আঁকা তেল রঙের সাজানো ছবিগুলি দেখে মুগ্ধ হয়ে বললেন, আপনিও আঁকেন?

কাজের লোককে চা দিতে বলে আমি বললাম, আঁকতাম। এখন আর আঁকি না। এই বয়সে একটা ব্যাপার মনে গেঁথে গেছে, জ্যাক অফ অল ট্রেডস হয়ে গেলে কোনও বিষয়ে মাস্টার হওয়া খুবই কষ্টকর। রবীন্দ্রনাথের মতো প্রতিভা আর কজনের আছে বলুন? ভদ্রলোক আমার কথা মেনে নিলেন। বললেন, আমিও তাই চাকরিবাকরি ছেড়ে শুধু গান নিয়েই থাকতে চাই। আপনি একটু সরোজদাকে বলুন না, যাতে ওঁর ‘অলকানন্দা’ ছবির গানটি আমায় দেন।

মুহূর্তে বুঝে নিলাম এই সেই রতনদার তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বললাম, আপনিই তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়?

উনি বললেন, হ্যাঁ। শুনুন না আমার গান। কথাটা শেষ করে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে সামনে রাখা বাবার বিরাট অর্গানটার ডালা খুলে পায়ে বেলো করতে করতে গান শোনাতে শুরু করলেন। পর পর চার-পাঁচটি গান গেয়ে থামলেন।

ততক্ষণে চা এসে গেছে। চায়ে চুমুক দিয়ে তরুণবাবু বললেন, আপনিও গানটান করেন নাকি?

বললাম, না তবে নিভৃতে গান লেখার সাধনা করে যাচ্ছি। ব্যাপারটা কেউ জানে না একমাত্র সরোজদা ছাড়া।

তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় তৎক্ষণাৎ আমার হাতটা ধরে বললেন, ব্যস, আমরা তা হলে একই গোত্রের, অবশ্যই শাণ্ডিল্য। আপনিও বন্দ্যোপাধ্যায় আমিও বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি গায়ক আপনি গীতিকার। বয়সে হয়তো আমি আপনার থেকে বেশ কিছু বড় হব। তাতে কী। আসুন আমরা বন্ধু হয়ে যাই। আপনি আজ্ঞে তুলে দিয়ে আমরা দুই হাওড়াবাসী এক হয়ে যাই।

এই হল তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়ের ঘটনা। বন্ধুত্ব পাতালে কী হবে, তরুণ কিন্তু তখনও ছাড়েনি তার প্রথম প্লে-ব্যাক গাওয়ার আবেদন। বুঝিয়ে বললাম, ব্যস্ত হয়ে লাভ নেই। ও গানটা ধীরেনবাবুই গান। সরোজদা যখন কথা দিয়েছেন তখন ভবিষ্যতে ওঁর ছবিতে তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান থাকবে। তবে যোগাযোগটা যেন বজায় থাকে।

আমার কথাটা লুফে নিয়ে সেদিন তরুণ বলেছিল, অবশ্যই। আউট অফ সাইট আউট অভ মাইন্ড এ-কথাটা আমি জানি। যোগাযোগ রেখেছিল তরুণ। ‘অলকানন্দা’র ওই গানটা ছিল এক বিরাট নাটকীয় মুহূর্তের গান। রতনদা বললেন, প্রচুর পড়াশোনা করে অনেকেই একটু মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। এ ধরনের একটি মানুষ সাজিয়ে ছবিতে তরুণের ঠোঁটে গানটা দেব। ধীরেন মিত্রের গাওয়া ওই গানটি পর্দায় ঠোঁট নেড়ে অভিনয় করে পরবর্তীকালে জনপ্রিয় গায়ক তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম প্রবেশ করল গানের জগতে। তারপর তরুণ এইচ. এম. ভি-তে যোগদান করল। রেকর্ডে শুনলাম ওর গান তুমি শোন না কি আজও আমি ডাকি তোমারে’। তারপর বহু আধুনিক গান হিট হল ওর।

আমি তখন কলেজের ছাত্র। ফিল্মে আমার গান তো হিট হয়ে গিয়েছিল। মনে তাই একটু ভরসা এসে গেল। সেই সময় একটু আধটু সুর করার বাসনাও মনে বোধহয় হয়েছিল। আমার সুর করা সেই সব গান নিয়মিত গাইত রেডিয়োতে। আমাদের স্কটিশচার্চ কলেজের সব অনুষ্ঠানেই তরুণ বাঁধাধরা শিল্পী ছিল। আমার সহপাঠী ছাত্রছাত্রীদের দাবিতে শুধু গাড়ি ভাড়া নিয়ে গান শোনাত।

এরপর এল তরুণের জীবনে আসল ব্রেক। সরোজদা ওঁর কথা রেখেছিলেন। রামচন্দ্র পাল সুর সংযোজিত ওঁর ‘মর্যাদা’ ছবিতে তরুণকে গান গাইয়েছিলেন। উত্তমকুমারের ঠোঁটে আমার লেখা গান সবাইকে শোনাল তরুণ। উত্তমকুমারের প্রথম প্লে-ব্যাক শিল্পী হল এই তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপরে এসেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, ভূপেন হাজারিকা, মান্না দে এবং কিশোরকুমার। এই ছবিতেই সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ও জীবনে প্রথম প্লে-ব্যাক করেন। এই তরুণই আমায় হঠাৎ ধরে নিয়ে গেল অনুপম ঘটকের বাড়ি। তখন ও গ্রামোফোন রেকর্ডের জন্য গান তুলছিল অনুপমদার কাছে। গানটি ছিল ‘কবে বসন্ত আসিবে’। অনুপমদাকে তরুণ অনুরোধ করল আমার গান নিতে। অনুপমদা ওঁর সেই দরাজ কণ্ঠে আমায় বলেছিলেন, লাফ দিয়ে যখন পড়েছেন, জায়গা একটা পাবেনই।

সরোজদার ‘অনুরাগ’ ছবিতে সতীনাথ মুখোপাধ্যায় প্রথম সংগীত পরিচালক হন। এই ছবিতে আমার লেখা গান গাইয়েছিল সেই তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে।

দেবনারায়ণ গুপ্ত অর্থাৎ দেবুদা আমায় খুবই স্নেহ করতেন। সেই দেবুদা আমায় হঠাৎ একদিন বললেন, পুলক, আমরা এবার শরৎচন্দ্রের ‘পরিণীতা’ গল্পটি মঞ্চস্থ করছি। কিন্তু ভাবছি বাউলের ভূমিকাটি তোমার বন্ধু তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেব। ওর বেশ নাম হয়েছে। গানটা জমাবেও ভাল।

আমি কথাটা লুফে নিয়ে বললাম, বাউলের শুধু তো গান নয়, কিছু সংলাপ কিছু অভিনয় তো থাকবে? তরুণ কিন্তু ভাল অভিনেতা, দারুণ করবে।

আমার কথায় দেবুদা খুশি হয়ে বললেন, তুমি ওকে খবর দাও। আমার সঙ্গে যেন খুব তাড়াতাড়ি দেখা করে। এই স্টার থিয়েটারে!

এবার আমি হঠাৎ মুষড়ে পড়লাম। বৃহস্পতিবারটা না হয় হল। কিন্তু শনি, রবিবার? শনি, রবিবারই তো ওর ফাংশন। ওখানেই তো ওর আসল রোজগার।

দেবুদা হাসলেন। আমায়, বললেন, আমি কি ওদিকটা ভাবিনি। ফাংশন তো রাতে হয়। ওর ভূমিকা সাড়ে সাতটা থেকে পৌনে আটটাতেই শেষ হয়ে যাবে। তারপর ও যত খুশি ফাংশন করুক। সারারাত্রিব্যাপী বিরাট বিচিত্রানুষ্ঠান’ থেকে ওকে সরিয়ে আনছে কে?

তরুণ ‘পরিণীতা’ নাটকে নিয়মিত অভিনয় করে গান গেয়ে নাট্য মোদীদের মন ভরাতে পেরেছিল ওর যোগ্যতা দিয়ে। এরপর আর একটি ঘটনার কথা মনে আসছে। তারু মুখোপাধ্যায়ের ‘রামধাক্কা’ ছবিতে মান্না দে-কে প্রথম বাংলা ছবির সুরকার হিসাবে আমি রাজি করিয়েছিলাম। মান্না দে সানন্দে সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু একটাই শর্ত রেখেছিলেন গান রেকর্ডিং হবে মুম্বই-তে। এবং হিন্দি ছবির যে নামী শিল্পী ওই ছবির নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করবেন তাঁর গান গাইবেন লতা মঙ্গেশকর। তারুবাবু এককথায় রাজি হয়েছিলেন। হঠাৎ তরুণ একদিন আমাদের কাছে এসে হাজির। সোজাসুজি বলল, আমি একটা গান গাইব।

বললাম নায়কের গান গাইছেন ছবির সুরকার মান্না দে। নায়িকার গান গাইছেন লতাজি। আর গানের সিচুয়েশন কোথায়?

নাছোড় তরুণকে শান্ত করলেন তারুবাবু। বললেন, বেশ, একটা বাউল অঙ্গের গানের নতুন সিচুয়েশন তৈরি করছি। সেখানে আপনি গাইবেন। কিন্তু গান রেকর্ডিং হবে মুম্বই-তে। ওখানে প্রোডিউসর কেন আপনাকে নিয়ে যাবেন? কেনই বা হোটেলে থাকার খরচা দেবেন?

তরুণ বলল, আমি নিজের খরচায় মুম্বই যাব! আর পুলক তো যাবেই। পুলকের সঙ্গে এক হোটেলে একই রুমে থাকব। তা হলে আর আপত্তি কীসে?

সত্যি আর আপত্তি রইল না। আমরা সদলে মুম্বই মেলে উঠে বসলাম। তরুণ আমার সঙ্গে দাদারের সমুদ্রের ধারে একটা হোটেলে রইল।

আমাদের সঙ্গে তরুণকে দেখে মান্নাদা অবাক। তারুবাবু বললেন, আর একটা সিচুয়েশন বার করতে হল। পুলক গানও লিখে এনেছে। আপনার সুর করতে লাগবে তিন মিনিট।

মান্নাদা বললেন, আমার কিন্তু চটজলদি সুর আসে না। অনেক ভেবেচিন্তে তারপর সুর করি। বলছেন যখন তখন দেখি চেষ্টা করে।

অনিচ্ছুকভাবেই হারমোনিয়াম নিয়ে বসলেন মান্নাদা। এবং অবাক কাণ্ড চটজলদি চমৎকার সুরও করে ফেললেন। তরুণ বম্বে ল্যাবরেটরিতে জীবনে প্রথম শর্মাজির রেকর্ডিং-এ গাইল আমার লেখা গান ‘হার জিতের এই খেলাতে/জীবনটারে মেলাতে’।

‘রামধাক্কা’-য় লতাজির দুটো গান ছিল। আর ছিল মান্না দে-র দুটো গান। ছবিটি বেশ কিছুদিন বন্ধ হয়ে পড়ে থেকে হঠাৎ মুক্তিলাভের সুযোগ পেল। তরুণ তখন ভবানীপুরে চলে গেছে; হঠাৎ একদিন আমার বাড়িতে এসে বলল, চল, দমদমে এ সি সেনের কাছে আমরা যাই।

সেই সময় এইচ. এম. ভি-র এ. আর ম্যানেজার গায়ক সন্তোষ সেনগুপ্ত ‘আর সময় ‘নেই’ বলে এই ছবির গান এইচ. এম. ভি-তে নিতে চাইছেন না। তরুণ বলল, এ সি সেন তোমার কথা শোনেন, তুমি বললে কাজ হবে।

অগত্যা দমদমে গেলাম। এবং আমার কথায় কাজও হল। কিন্তু পুরোপুরি নয়, খানিকটা। মি. সেন বললেন, আমরা এই লাস্ট মোমেন্টে একটি রেকর্ড অর্থাৎ দুটি গান বার করতে পারি। তার বেশি নয়।

আমার সঙ্গে পাঁচটি গানের স্পুল। সুযোগ মাত্র দুটি গানের। কাকে রেখে কাকে ফেলি। বললাম, আপনি বাছুন।

মি. সেন বললেন, অত সময় নেই। আপনি বেছে নিন। তরুণ সঙ্গে রয়েছে। অবশ্যই এটা বিরাট একটা অবলিগেশন। অগত্যা তরুণের গানটি রেখে ও পিঠের জন্য রাখলাম লতাজির ‘দেখ না আমায় আয়না’। বাদ দিতে হল লতাজির গাওয়া আর একটি চমৎকার গান। ‘আকাশে বাতাসে আমার ছুটি’ আমাদের দুর্ভাগ্য ওই গান রেকর্ডে শুনতে পেল না সত্যিকারের সংগীতপ্রেমী মানুষ, শুনতে পেল না মান্নাদার দুখানা দারুণ গান। অকপটে বলছি, সেদিন তরুণ সঙ্গে না থাকলে আমি রাখতাম লতাজিরই দুটি গান।

‘রামধাক্কা’ ছবিটি ফ্লপ করল। ছবিটির দুটি মাত্র গান একটি রেকর্ডে প্রকাশিত হল। রেকর্ডের মাধ্যমে দুটি গানই সুপারহিট। সেদিন দমদমে আমার সঙ্গে তরুণের থাকাটাই তরুণের ভাগ্য।

এই তরুণই পরবর্তীকালে আমায় বললে-যাত্রায় বড় প্রশান্ত খুব ভাল সুর করছে—ওকে দিয়ে এবার পুজোর গান করব। সুপারহিট হল ওর সে-বারের একটি গান— ‘আলতা পায়ের আলতো ছোঁয়া পড়েছে/আল দিয়ে কে গেছে কোথায় জানি না’।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *