৫০
আমি যখন প্রথম সাবিত্রীদিকে দেখি তখন উনি রাইচাঁদ বড়ালের তত্ত্বাবধানে অক্রুর দত্ত লেনে হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানির স্টুডিয়োতে রেকর্ড করছিলেন। প্রয়াত হিমাংশু দত্তের বিখ্যাত বিদেশি ‘রেমোনা’ সুরের স্টাইলে ‘বনের কুহু কেকা সনে/মনের বেণু বীণা গায়’ গানটির অনুলিপিতে ‘তোমারই মুখ পানে চাহি/আমারই পাখি গান গায়’। গানটি মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম আমি। সেখানেও ওঁকে প্রণাম করি। ওঁর আর একটি গান আমার বিশেষ প্রিয় ‘আমার বসন্ত যে যায়।’ সাবিত্রী ঘোষের বাংলা আধুনিক হিট গানের সংখ্যা বেশ বড়। দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক আগে এবং পরে বাংলা সংগীতজগতে একটা অন্য ধরনের গান সংযোজিত হচ্ছিল।
সত্য চৌধুরী গেয়েছিলেন মোহিনী চৌধুরীর কথায় কমল দাশগুপ্তের সুরে ‘পৃথিবী আমারে চায়’। তারপর ‘জেগে আছি একা/জেগে আছি কারাগারে’ এবং ‘আজ যত দূরে চাই/আছে শুধু এক/ক্ষুধিত জনতা প্রেম নাই প্রিয়া নাই’ রেকর্ডের গায়ক শ্যামল গুপ্ত তখন গীতিকার হয়ে জগন্ময় মিত্রের জন্য লিখলেন দেশাত্মবোধক গান ‘অন্তবিহীন নহেতো অন্ধকার’, এবং ‘প্রণাম তোমায় হে নিৰ্ভয় প্রাণ।’ এ প্রসঙ্গে একটু অন্য কথা সেরে নিই। একদিন শ্যামল গুপ্তকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, রেকর্ডের গান গাওয়া ছেড়ে দিয়ে গীতিকার হয়ে গেলেন কেন? চমৎকার উত্তর দিয়েছিলেন উনি। বলেছিলেন, দেখলাম আমার চেয়ে অনেকেই ভাল গান করেন। কিন্তু অনেকেই আমার থেকে ভাল লেখেন না। সে জন্য। যাই হোক, সেই সময় সাবিত্রী ঘোষ গেয়েছিলেন, অনুপম ঘটকের সুরে অপূর্ব একটি গান ‘কাঙালের অশ্রুতে যে রক্ত ঝরে/ও ভগবান দেখেও তুমি দেখ না।’
এই সাবিত্রী ঘোষের গান লিখতে পরবর্তীকালে ওই হিন্দুস্থান থেকে আহ্বান পেয়েছিলাম। ভি. বালসারার সুরে আমার দুটি গান তৈরি হল। তার একটি এখনও ভুলিনি। যেমন, ‘না হয় ভুলেই যেও।’ কিন্তু আজও জানি না, কেন সে গান অনুমোদিত হওয়া সত্ত্বেও সাবিত্রীদির কণ্ঠে রেকর্ড করা হল না। সাবিত্রীদি এখন নিশ্চিন্তে অবসর জীবনযাপন করছেন। প্রায়ই ফোন করেন। ওঁর ফোন এলে সব কাজ ফেলে সে ফোন ধরি। নানা গল্প করেন। দারুণ ভাল লাগে।
আমরা ছোটবেলায় হিন্দি বা বাংলা ফিল্মের যে গান শুনতাম তখন কিন্তু পর্দায় নেপথ্য শিল্পীদের নাম দেখানোর রেওয়াজ ছিল না। রেকর্ডেও থাকত না শিল্পীদের নাম। ফিল্মের যে সব নায়ক নায়িকা বা পার্শ্বচরিত্রাভিনেতা বা অভিনেত্রী যাদের মুখে গান থাকত, ছবির কাহিনীতে তাদের যে নাম, গ্রামাফোন রেকর্ডেও সে নাম মুদ্রিত হত। যেমন ‘রেখার গান’, ‘সীমার গান’ ইত্যাদি।
যে সব শিল্পীরা স্বকণ্ঠে গান গাইতেন তাঁদের নাম অবশ্য রেকর্ডে সব সময় লেখা থাকত। কারণ তাঁরা ছিলেন বিশেষ রেকর্ড কোম্পানির চুক্তিবদ্ধ শিল্পী। যেমন অসিতবরণ, রবীন মজুমদার, কে এল সায়গল, পঙ্কজ মল্লিক, কাননদেবী, সুরাইয়া, খুরশিদ, অশোককুমার প্রমুখ। তখন যে ছায়াচিত্র শিল্পী গান গাইতে জানতেন না, তাঁদের জনপ্রিয়তার যোগ্যতা বেশ কম বলেই গণ্য করা হত। বাংলা ছবিতে অনেক পুরুষ শিল্পীরা গান গাইতে জানলেও অনেক মহিলা শিল্পীই গান গাইতে পারতেন না। সে জন্য তাঁদের কণ্ঠে দেওয়া হত অন্য শিল্পীর গান। প্রযোজকরা কিন্তু সে সব শিল্পীদের নাম পর্দায় বা রেকর্ডে দিতেন না। ওঁদের আশঙ্কা ছিল এই সব শিল্পীরা যে নিজের কণ্ঠে গাইছেন না এটা জানতে পারলে দর্শকরা সেগুলো একটা বিরাট মাইনাস পয়েন্ট হিসাবে গণ্য করবেন। ছবির বক্স অফিস মার খাবে।
গানের প্রেফারেন্স ছিল তখন সর্বাধিক। কে এল সায়গল মোটেই সুদর্শন ছিলেন না কিন্তু গানের গুণে ওঁকে প্রথমেই দেওয়া হয়েছিল নায়কের সুযোগ। শুনেছি প্রমথেশ বড়ুয়া সাহেব নাকি রবীন মজুমদারের গান শুনেই ছায়াচিত্রে সুযোগ দেন। রেডিয়োর তবলা বাদক অসিতবরণও নিউ থিয়েটার্সের এক নম্বর হিরো হয়ে গেলেন কারণ ওঁর গান কর্তৃপক্ষের ভাল লেগেছিল বলে।
মেয়েদের ক্ষেত্রে এমন অনেক উদাহরণ আছে। যেমন বিনতা বসু, যিনি খুব একটা সুদর্শন না হয়েও নিউ থিয়েটার্সের ‘উদয়ের পথে’ ছবির নায়িকা হয়েছিলেন, প্রধানত চমৎকার গানের গলার গুণে। পরবর্তীকালে উনি উদয়ের পথে’-র কাহিনীকার জ্যোতির্ময় রায়কে বিয়ে করে বিনতা রায় হন। শুনেছি সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী বিজয়া রায়ও সুন্দর গানের জন্য নায়িকা নির্বাচিত হন ‘শেষরক্ষা’ ছবিতে। তখনকার বিজয়া দাশের গাওয়া রবীন্দ্রনাথের ‘আমায় বাঁধবে যদি’ গানটি এখনও আমার কানে বাজে।
ছায়াচিত্রে রবীন মজুমদারের প্রচুর গান সুপারহিট। উনি আধুনিক গানেও সার্থকতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তারমধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য, রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে হীরেন বসুর রচনায় আমার আঁধার ধরের প্রদীপ যদি নাই বা জ্বলে’। রবীন চট্টোপাধ্যায়েরই সুরে কমল ঘোষের রচনায় ‘তারে চিনি চিনি’ এবং ‘এ রাঙা গোধূলি হলে অবসান’ এক সময়ে হিট গান ছিল। গায়ক রবীন মজুমদার প্রায় শেষ জীবনে নচিকেতা ঘোষের সুরে আমার লেখা ‘এই তো এলাম শঙ্খ নদীর তীরে’ এবং ‘আমার নানা রংয়ের দিনগুলি’ গান দুটি রেকর্ড করে গেছেন। এ আমার পরম সৌভাগ্য। নচিকেতা ঘোষ ডাক্তার ছিলেন। রবিদাকে প্রায় মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন উনি। আটকে রেখেছিলেন শ্যামবাজারের বাড়ির ওই চিলেকোঠার ঘরে। মনে আছে সেদিন বিকালে রেকর্ডং ছিল রবিদার। আমার লেখা উনি গাইবেন। নচিবাবু আমায় বলেছিলেন, পুলক তুমি ভোরবেলায় রবিদাকে গাড়িতে তুলে নেবে। রবিদার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে সারাদিন। একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করবে। তুমিই ওঁকে স্টুডিয়োতে নিয়ে আসবে। একমুহূর্তও অসতর্ক হবে না। একটুও যেন বেসামাল না হয় রবিদা।
রবিদার গাওয়া ‘গরমিল’ ছবির ‘এই কি গো শেষ দান’, ‘সমাধান’, ছবির ‘দেখা হল কোন লগনে’, ‘যোগাযোগ’ ছবির ‘এই জীবনের যতই মধুর ভুলগুলি’, ‘নন্দিতা’ ছবির ‘কী যেন কহিতে চায়।’ প্রণব রায় ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা কমল দাশগুপ্ত এবং রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ওই সব গান, শুধু আমার কেন একসময় সব বাঙালিরই কণ্ঠস্থ ছিল।
এ ছাড়া ‘নারীর রূপ’ ‘শাপমুক্তি’, ‘নিরুদ্দেশ’ এই ছবিগুলির গান খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। (বাংলা ‘নিরুদ্দেশ’ ছবির কাহিনীর সঙ্গে পরবর্তীকালের সুপারহিট হিন্দি ছবি ‘ইয়াঁদো কি বরাত’ ছবির মিল সাঙ্ঘাতিক।) সুতরাং রবিদার প্রতি আমার দারুণ শ্রদ্ধা ছিল। আমি তখন প্রতি সপ্তাহে বোধহয় দুদিন নিয়ম করে শুনতাম রবিদার গাওয়া প্রেমেন্দ্র মিত্রের গান ‘বালুকা বেলায় মিছে/কী গড়িস খেলাঘর।’
সে জন্য মহা উৎসাহে সাত সকালে রবিদাকে তুলে নিয়ে ঘুরতে লাগলাম। রবিদাই আমায় বললেন, পুলক এসেছ যখন, চলো তোমায় অমুক প্রযোজকের কাছে নিয়ে যাই। যাতে ওঁর ছবিতে তুমি গান লেখ সে ব্যবস্থা করে আসি।
রবিদাকে সামলাতে এসে আমিই পেয়ে গেলাম ওঁর কাছ থেকে অনেক উপহার। দুপুরবেলাতে আমরা একসঙ্গে খেলাম। সম্ভবত পাঁচটাতে রেকর্ডিং ছিল। আমরা দমদম স্টুডিয়োর দিকে যাচ্ছি। রবিদা এক জায়গায় হঠাৎ গাড়িটা থামাতে বললেন। থামালাম। আমাকে গাড়িতে অপেক্ষা করতে বলে উনি ‘এখনই আসছি’ এইটুকু বলে তাড়াতাড়ি নেমে গেলেন।
কিন্তু যখন ফিরে এলেন তখন বুঝলাম, সারাদিন বালুকাবেলায় আমি মিছেই খেলাঘর রচনা করে এসেছি। মহাসাগরের ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে আমার সব কিছু। রবিদা খুব অল্প কথা বলতেন। এবার যেন আরও নিশ্চুপ হয়ে গম্ভীর কণ্ঠে শুধু বললেন, চলো।
নচিকেতা ঘোষের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। স্টুডিয়োতে রবিদাকে এভাবে দেখে উনি আমাকেই দোষারোপ করবেন, রবিদাকে নয়। দমদমের গেটে নেমেই রবিদা নচিকেতাবাবুকে সামনে দেখে বললেন, চল নচি, আমি রেডি। গান আমার মুখস্থ। মোটেই দেরি হবে না।
নচিকেতা শুধু বললেন, আসুন রবিদা। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, পুলক, পারলে না, রবিদাকে সামলাতে? কথাটা শুনে একটু যেন বিরক্ত হয়ে রবিদা বলে উঠলেন, সায়গল সাহেব কোন গানটা না খেয়ে রেকর্ড করেছিলেন বল তো নচি? ও সব তোদের ভুল ধারণা। পুলক ফাটিয়ে দিয়েছে। তুই ফাটিয়ে দিয়েছিস। দেখা যাক আমি কী করি।
রবিদা সবসময় ভাল কিছু করাকে বলতেন ‘ফাটিয়ে দেওয়া’। আমার কোনও গান ভাল লাগলে বলে উঠতেন, পুলক, তুমি তো ফাটিয়ে দিয়েছ।
নচিবাবুর সঙ্গে কথা শেষ করেই এবার হিরোর ভঙ্গিমায় হেঁটে গিয়ে সোজা মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন হিরো রবীন মজুমদার। আমরা অবশ্য প্রার্থিত রবিদার কণ্ঠস্বরটি পেলাম না।
পরবর্তীকালে সুখেন দাশের ‘সিংহদুয়ার’ ছবিতে অজয় দাশের সুরে গান লিখলাম ১। ‘বেঁধেছি প্রাণের ডোরে’ ২। ‘গলা ছেড়ে গান গেয়ে যাই’, ৩। ‘ও মন থাকতে সময়’, 81 ‘তোর চোখ মুছে ফেল’ ইত্যাদি। এই ছবিতে রবীন মজুমদার বাউলকাকার ভূমিকায় অভিনয় করবেন ঠিক হল। এদিকে সুখেন বলল, এই ছবিতে সব পুরুষ চরিত্রের লিপে সব গানই মান্না দে গাইবেন। শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় থেকে রবীন মজুমদার পর্যন্ত। আমি চমকে উঠে বললাম, কী বলছ সুখেন? রবীন মজুমদারের ঠোঁটে গাইবেন মান্না দে?
সুখেন বলল, আমি রবিদাকে বলে নিয়েছি। রবিদা মান্না দের নাম শুনে সানন্দে মত দিয়েছেন।
আমার কিন্তু অস্বস্তি হচ্ছিল। আমি নিজে এ ব্যাপারটা নিয়ে রবিদার সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম। রবিদার চোখে একটু জল চিকচিক করে উঠলেও হাসি মুখে বললেন, আরে, আমি কি আর তোমাদের সেই রোমান্টিক হিরো রবীন মজুমদার আছি না কি? চেহারা বদলে গেছে। এখন ভাল গান আর গাইতে পারি না। ভালই হবে। তুমি আমার জন্য বেশ ফাটিয়ে দিয়ে লিখেছ তো?
গান রেকর্ড হয়ে গেল। পিকচারাইজেশনও হয়ে গেল। ‘সিংহদুয়ার’-এর মুক্তির দিন এগিয়ে এল। আমার বুকটা ছম ছম করতে লাগল। রবিদার লিপে মান্না দের গান লোকে হয়তো যা তা বলবে।
মনে পড়ে গেল আমাদের কলেজ জীবনে উৎপল দত্তের প্রথম ছবি ‘মাইকেল মধুসূদন’-এর কথা।
নামী পরিচালক মধু বসু, মাইকেলের মুখে প্রণব রায়ের লেখা গান দিয়েছিলেন ‘মোর কথার ফুল বনে তুমি যে মধু ঋতু/তুমি যে আমার কবিতা’। তখনকার বিখ্যাত ‘অচলপত্র’ পত্রিকার সম্পাদক দীপ্তেন সান্যাল বলেছিলেন, মাইকেল মধুসূদন কেন প্রণব রায়ের লেখা গান গাইলেন? রবীন্দ্রনাথের লেখা গান কেন গাওয়ালেন না মধু বসু? তা হলে পরিবেশটা আরও জমজমাট হত। অদ্ভুত রসিকতার সূক্ষ্ম কষাঘাত করতে পারতেন এই দীপ্তেন সান্যাল। কিন্তু আমার প্রিয় দীপ্তেন-সান্যাল ছাড়া আর কেউই এ ব্যাপারে কিছু বলেননি। লোকেরা হাসিমুখে মেনে নিয়েছিলেন। এবং হেমন্তদার গাওয়া এই গানটি জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ‘সিংহদুয়ার’ মুক্তির পরেও দেখলাম রবীন মজুমদারের মুখে আমার তৈরি মান্না দে’র গান লোকেরা সুন্দরভাবে মেনে নিলেন। হিট হয়ে গেল মান্নাদার গাওয়া ওই গানগুলো। লোকেরা কত দ্রুত ভুলে যান, কীভাবে অনেক কিছু মেনে নেন, ভাবলে সত্যি বিস্ময় লাগে।
৫১
ইতিপূর্বে গানের জগতের অনেককে নিয়েই আলোচনা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে এমন কয়েকজনের কথাও ছিল, যাঁরা জ্যোতিষচর্চা করে আনন্দ পেতেন। এই গোষ্ঠীর আর একজনের নাম হঠাৎ মনে এল, তিনি সংগীতশিল্পী ও সুরকার সরোজ কুশারী। প্রতিবন্ধী এই সুরকার গানের জগতে অনেকেরই ছক দেখেছেন। আমিও তার মধ্যে একজন।
সরোজ কুশারী সুরারোপিত ‘জন্মান্তর’ ছবির গান সে সময় খুবই হিট করেছিল। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘তোমারই এ পৃথিবীতে ফিরে ফিরে আসি’ এখনও আগের দিনের অনেকেরই মনে পড়ছে। ওঁর সুরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের দুটি আধুনিক গানও রেকর্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। গান দুটি আমারই লেখা। একটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল, ‘হাতে কোনও কাজ নেই/ টেবিলেতে একরাশ বই’। অন্য গানটি ছিল ‘ঘুম নামে গাছের পাতায়’।
যাই হোক, আবার সেই রবিদার কথায় আসি। অনেক কষ্টে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটালেও মুখের হাসিটি শেষ পর্যন্ত অমলিন ছিল রবিদার। রবিদার সাহচর্যে যাঁরা এসেছেন তাঁরা, তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসার আস্বাদ পেয়েছেন। আমি সেই ভালবাসা পেয়েছি বলেই তারাশঙ্করের কবি চিত্রের সেই অসাধারণ গানটি যখন তখন শুনতে পাই ‘এই খেদ মোর জীবনে/ভালবেসে মিটিল না সাধ/জীবন এত ছোট কেনে?’
অসিতবরণের গাওয়া এবং পঙ্কজ মল্লিকের সুরে ও প্রণব রায়ের লেখায় নিউ থিয়েটার্সের ‘কাশীনাথ’ ছবির গান খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। ‘জানি গো জানি/ এই গহন রাতে তুমি ডেকেছ মোরে’। ওই ছবিতেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী বেলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে গাওয়া ওঁদের সুপারহিট দ্বৈত সংগীতটি ছিল ‘মোর মালঞ্চে ডাকল কুহু কুহু’। ওই ছবিতে বেলা বউদির একক কণ্ঠের সুপারহিট গান ‘ও বনের পাখি’। এ ছাড়াও অসিতবরণ ও বেলা মুখোপাধ্যায়ের দ্বৈত কণ্ঠে আর একটি গানও হিট ‘এবার তবে করব শুরু’।
তখনকার রেওয়াজ অনুযায়ী সম্ভবত রেকর্ড বা পর্দায় বেলা মুখোপাধ্যায়ের নাম ছিল না। তাই এখনকার মতো কোনও মিডিয়া ওই সুপারহিট গানের গায়িকার পিছনে ধাওয়া করেননি। বেলা মুখোপাধ্যায় এর আগেও গেয়েছিলেন প্রমোদ গঙ্গোপাধ্যায় অভিনীত শরৎচন্দ্রের ‘পরিণীতা’ ছবিতে। ওই ছবিতে রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে একটি হিট গান ‘বলতে মানা/ কাজের কথা দূর থেকে বলতে মানা’।
সম্ভবত সে গানের ক্রেডিট টাইটেলে গায়িকা হিসাবে রেকর্ডে বা পর্দায় ওঁর নাম ছিল না। বেলা মুখোপাধ্যায় রেকর্ডে আধুনিক গান অনেক গেয়েছিলেন। কিন্তু হেমন্তদার সুরের ‘স্বপ্নের আঙ্গিনায়/এক রাজারকুমার এসেছিল’ এই গানটি ছাড়া কোনও গানই তেমন হিট করেনি। আমার ব্যক্তিগত পর্যালোচনায় দেখতে পাই ‘ও বনের পাখি’-র মতো সুপার ডুপার হিট গানের গায়িকা বেলা মুখোপাধ্যায় কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ঘরণী হওয়ার পর থেকেই, অমন সুরশিল্পীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থাকা সত্ত্বেও দিনের পর দিন নিষ্প্রভ হয়ে গেছেন। পরবর্তী জীবনে গায়িকা বেলা মুখোপাধ্যায় হয়ে গেছেন, আদর্শ ঘরণী বেলা মুখোপাধ্যায়। যদিও হেমন্তদা শ্রাবন্তী মজুমদারের কণ্ঠে আমার রচনা ‘আয় খুকু আয়’ এবং এবং অসীমা মুখোপাধ্যায়ের (ভট্টাচার্য) সঙ্গে আমার লেখা ‘স্বপ্নের দেশ’ রেকর্ড করার পর আমাকে দিয়ে বেলাবউদির সঙ্গে গাইবেন বলে লিখিয়েছিলেন ‘অনেক দীর্ঘ পথ এক সাথে পার হয়ে এলাম’। কিন্তু সে গান কেন রেকর্ড হল না তা আমার জানা নেই। হেমন্তদার পুরনো টেপ খুঁজলে হয়তো সে গান আজও খুঁজে পাওয়া যাবে।
আবার অসিতবরণ প্রসঙ্গে আসি। অসিতবরণ একদা তাঁর গানে সারা ভারতবর্ষ কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। রাইচাঁদ বড়ালের সুরে হিন্দি ‘ওয়াপাস’ ছবিতে হিম কোচুয়ান/হম কোচুয়ান/হম কোচুয়ান/পেয়ারে’ গানটি একদিন পথে ঘাটে ঘুরত।
অনেক ছবিতে অনেক হিট গান গেয়ে কিন্তু এই গায়ক নায়ক হিন্দুস্থান রেকর্ডে গেয়েছেন অনেক আধুনিক গান এবং অনেক শ্যামাসংগীত। কিন্তু খুব একটা জমাতে পারেননি। বেসিক গান ওঁর খুব হিট নেই। অসিতবরণ অর্থাৎ কালোদার জীবনেও ঘটল ওই ধরনের ঘটনা। অন্য কোনও গান আমার মনে আসছে না তবে আমার লেখা গানে ‘বিলম্বিত লয়’ ছবিতে সংগীত শিক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন কালোদা।
ছবিতে ছিল উনি সুপ্রিয়াকে গান শেখাচ্ছেন। গানটি আমারই লেখা ‘বেঁধো না ফুল মালা ডোরে’। মান্না দে আর আরতি মুখোপাধ্যায়ের দ্বৈত গীতি। যেদিন গান পিকচারাইজেশন হয় সেদিন স্টুডিয়োতে আমি ছিলাম। কালোদাকে একটু নিরিবিলিতে পেয়ে বলেছিলাম, কালোদা, কিছু মনে করবেন না। এটা একটু ক্লাসিকাল অঙ্গের গান ছিল বলেই মান্না দেকে দিয়ে সুরকার নচিকেতা ঘোষ, পরিচালক সরোজ দে, আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে গাইয়েছি। নইলে আপনার লিপে অন্যের গান! আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে কালোদা হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, দূর দূর। কবে আমি গান ছেড়ে দিয়েছি। আর মান্নাবাবু তো দারুণ গেয়েছেন এ গান। এককালে তো গান গাইতাম। তাই ওঁকে ধন্যবাদ দিতে দিতেই ওঁর গানে ঠোঁট মেলাচ্ছি।
কালোদা গান গাইতেন বলেই ছবির পরিচালক সরোজ দে ওঁকে ওই সংগীত শিক্ষকের ভূমিকাটা দিয়েছিলেন। আমি দেখছিলাম অসিতবরণের অভিনয়। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না উনি স্বকণ্ঠে গান গাইতে পারছিলেন না সেটা ভুলে হাসি মুখেই অন্যের গানে লিপ দিচ্ছিলেন। সেটা ওঁর অভিনয়! নাকি যে চরিত্রটি অভিনয় করছিলেন সেটাই অভিনয়! বড় অভিনয় কোনটা?
অসিতবরণ উত্তমকুমার অভিনীত ‘দুটি মন’ ছবিতেও ঠিক এইভাবে আমার লেখা দুটি গানে লিপ দিয়েছিলেন। দুটি গানই গেয়েছিলেন মান্না দে আর সুর দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। দুটি গানই খুব জনপ্রিয় হয়। একটি গান ছিল ‘জাগো নতুন প্ৰভাত জাগো/সময় হলো’। অন্যটি ছিল—’কেন ব্যথা দাও/তাও বুঝি না’।
এবার কিন্তু অন্য একটা ঘটনার কথা মনে আসছে, সেটা খুবই দুঃখের। রবীন মজুমদার এবং অসিতবরণ দুজনেই গায়ক অভিনেতা। অনিবার্য কারণে ওঁরা গান গাওয়া ছেড়ে দিয়ে অভিনয় করেই সারাজীবন কাটিয়ে গেছেন। কিন্তু রাগপ্রধান গায়ক প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি ‘টুলি’ ছবিতে প্লে-ব্যাক করে তোলপাড় করে দিয়েছিলেন সংগীতজগৎ, ওঁকে যেদিন স্টুডিয়োতে দেখলাম আমার লেখা গান ‘ভেবে কে আর ভাব করেছে/ভাব করে স্বভাবে’ এই গানটির পিকচারাইজেশন করছেন সেদিন বিস্মিতই হয়েছিলাম। আশু বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘নিশিকন্যা’ ছবির জন্য গানটি লিখেছিলাম। সুধীন দাশগুপ্তের সুরে গেয়েছিলেন সেই মান্না দে। শুটিং চলার সময় সবাই প্রসূনবাবুকে চমৎকার লিপ দেওয়ার জন্য বাহবা দিচ্ছিলেন। আমি কিন্তু দিইনি।
প্রসূনবাবুর মতো বিশাল এক কণ্ঠশিল্পী, যিনি কোনওকালেও অভিনেতা নন, কেন তিনি মান্না দে-র গাওয়া এই গানটিতে লিপ দিচ্ছেন তার কোনও কারণ বা সদুত্তর সেদিন খুঁজে পাইনি। আজও সেই কারণ আমার অজ্ঞাত।
একটু আগে বলছিলাম তখন ছবির গানের রেকর্ডে বা পর্দায় নেপথ্য গায়ক গায়িকাদের নাম না দেওয়ার জন্য যাঁরা আধুনিক গানে হিট তাঁরা ছাড়া কত শিল্পী যে অকালে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছেন তার ঠিকানা নেই। এ প্রসঙ্গে চারজন শিল্পীর নাম মনে আসছে ১। অণিমা দাশগুপ্ত ২। তৃপ্তি সিংহ ৩। কল্যাণী দাশ ৪। অণিমা ঘোষ। ‘শেষ উত্তর’ ছবির ‘আমি বনফুল গো’ বা ‘যদি আপনার মনে মাধুরী মিশায়ে’ কিংবা ‘তুফান মেল যায়’ ইত্যাদি হিট গান মনে এলেই যে কোনও মানুষের মনে পড়বে গানগুলি গেয়েছেন কাননদেবী। কিন্তু কেউই বাকি হিট গানগুলি মনে করেও বলতে পারবেন না এসব গানের গায়িকা কে? বিভিন্ন ছবির গান থেকে আমিই প্রশ্ন রাখছি। বলুন তো সেই সারা দেশ মাতানো ‘হৃদয় আমার হারালো/বুঝি হারালো হারালো’-র গায়িকা কে? কারও স্মরণে আসবে না অণিমা দাশগুপ্তের নাম। অথবা যদি জানতে চাই তুমি দুঃখ দিতে ভালোবাসো/তাইতো নিলাম দুঃখের ব্রত’-র গায়িকা কে?
অনেকেই ঠিক উত্তর দিতে পারবেন না। অনেকেই বলতে পারবেন না কমল দাশগুপ্তের সুরে ‘দোলে পিয়ালশাখে ঝুলোনা’-র গায়িকার নাম। যে গানকে অনুলিপি করে পরবর্তীকালে বানানো হয়েছিল ‘দেয়া নেয়া’ ছবিতে ‘দোলে দোদুল দোলে ঝুলনা’ ক’জন জানেন বিখ্যাত গান ‘ভালবাসা এল জীবনে/ তাই তারে ভালবাসিরে’ এই গানের গায়িকার নাম? অথবা শৈলজারঞ্জনের শহর থেকে দূরে’ ছবির ও পরদেশি কোকিলা’-র গায়িকা অণিমা ঘোষের নাম?
অনেকেই জানেন না কমল দাশগুপ্তের সুরে প্রণব রায়ের কথায় ‘মোর অনেক দিনের আশা’ অথবা ‘দম্পতি’ ছবির ‘কী যেন কহিতে চায়’ অথবা ‘গরমিল’ ছবির ‘এল হারানো দিনের সেই/চৈতি রাতি’ ইত্যাদি দ্বৈত সংগীতগুলিতে রবীন মজুমদারের সঙ্গে মহিলা কণ্ঠটি কার?
অপরিচয়ের অন্ধকারেই আলোককণ্ঠী অণিমা দাশগুপ্তের মতো শিল্পীরা জীবনযাপন করলেন।
সুন্দরী নায়িকা সুমিত্রাদেবীর প্রথম অভিনীত হিট ছবি শৈলজানন্দের কাহিনী নিয়ে ‘সন্ধি’-তে একটি গান ছিল ‘কোন অজানার ঢেউ এসে লাগল’। এই গানের জন্য বি এফ জে পুরস্কার পেয়েছিলেন সুরকার অনিল বাগচি। কিন্তু কজন জানেন সেই অপূর্ব গানটির গায়িকার নাম? সত্যি এ এক আশ্চর্য ভাগ্যের পরিহাস। এঁদের সত্যিকারের যোগ্যতা থাকলেও এখনকার বাংলা গানের বেশ কিছু অযোগ্য শিল্পীদের তুলনায় কি অর্থে, কি নামে চিরদিনই ছোট হয়ে রইলেন। তথাকথিত এ পাড়া ও পাড়া ফাংশনের মঞ্চে কবার ওঠবার আমন্ত্রণ পেলেন ওঁরা?
৫২
আমার এই লেখায় ইতিপূর্বে অনেকবারই বলেছি এবং আবারও বলছি আমি অনেকদিন থেকেই শচীন দেববর্মণের ভক্ত ছিলাম এবং আজও আছি। উনি যখন মুম্বই গিয়ে ছবিতে সুর করতে লাগলেন তখন সামসাদ, নূরজাহান প্রমুখের খুবই নামডাক। এ ভি এম-এর বৈজয়ন্তীমালা অভিনীত ‘বাহার’ ছবির ‘কসুর আপ কা/হুজুর আপ কা’, ‘দুনিয়াকা মজা লে লো’, ‘সাঁইয়া দিল মে আনা রে’ এই ধরনের সুপারহিট গানে ওঁরাই কণ্ঠ দিতেন।
যতদূর মনে পড়ছে লতাজিকে দিয়ে আশ্চর্য মেলোডি সৃষ্টি করলেন শচীনদা এরপরেই ‘ঠাণ্ডি হাওয়া’ গান দিয়ে। এ গানের নেপথ্য কাহিনী শুনেছি—শচীনদা প্রথম দিকে মুম্বই-তে ঠিক ততটা বাণিজ্যিক সাফল্য পাচ্ছিলেন না যতটা সবাই আশা করেছিল।
তখন বড় বড় সুরকারদের মিউজিক রুম থাকত ফিল্মি স্টুডিয়োতে। চেন্নাইতে অর্থাৎ মাদ্রাজে অবশ্য দেখেছি কিছু নামীদামি সুরকারদের আজও ফিল্ম স্টুডিয়োতে মিউজিক রুম আছে। শুধু মিউজিক রুম নয়, ইলিয়া রাজা সহ কিছু সুরকারের রয়েছে আলাদা রেকর্ডিং থিয়েটার। যেখানে শুধু ওঁদেরই গান রেকর্ডিং করা হয়, অন্য কারও নয়। তার সামনে রয়েছে সুরকারের নির্দিষ্ট পার্কিং প্লেস। এমনটি মুম্বই-তেও দেখিনি।
শচীনদার আমলের যে সময়ের কথা বলছি তখন মুম্বই-এর মতো এরকম মিউজিক রুম নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োতেও ছিল। একদিন মুম্বই-তে স্টুডিয়োর মিউজিক রুমে অসময়ে এসে গিয়েছিলেন শচীনদা। হঠাৎ দেখলেন ওঁর স্টুডিয়োর কাজের লোকটি আপন মনে গাইছে নৌসাদের ‘রতন’ ছবির গান ‘যব তুমহে চলে পরদেশ’। শচীনদার সাড়া পেতেই ছেলেটি ওর গান গাওয়ার জন্য শচীনদার পায়ে ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করল। শচীনদা ওকে চা আনতে বলে এক অদ্ভুত সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। ওঁর মিউজিক রুমে ছেলেটি নৌসাদের গান গাইছে কেন? রোজ কত নতুন গান উনি সৃষ্টি করে চলেছেন, ছেলেটি রোজই শুনছে। সেই সব গানের এক দু’ লাইন তো গাইতে পারত, কিন্তু ও তা গায়নি। কেন গায়নি?
নিশ্চয় সে গান ওর মনকে স্পর্শ করতে পারেনি। যে গান ওর ভাল লেগেছে ছেলেটি তাই গেয়েছে। যে গান ওর ভাল লাগেনি তা গায়নি, তা হলে রোজ ওঁর বাদ্যযন্ত্রীরা, সহযোগীরা যে গানকে তারিফ দিয়ে আসছেন তা আসলে জনসাধারণের তারিফ নয়। কিছু বিদগ্ধ মানুষ অথবা কিছু স্তাবকের তারিফ।
শচীনদা নিজে বলেছিলেন, তার পরেই আমার চক্ষু খুইল্যা গেল ভাই। আমি কারও কথা শুনলাম না। নতুন রাস্তায় গান বানাইতে লাগলাম।
তারপরেই শচীনদার ‘বাহার’ ইত্যাদি জনপ্রিয় ছবির গানের সৃষ্টি। সারা দেশের সাধারণ মানুষ মুগ্ধ হয়ে গেল সে সব গান শুনে। শচীনদার মতে সেই ছেলেটি ওঁর বরে বসে অন্যের গান না গাইলে ওঁর সত্যিকারের চেতনা আসত না।
ওই মিউজিক রুমের আর একটি ঘটনা-
লতাজির বিখ্যাত মেলোডি ঠাণ্ডি হাওয়ার সৃষ্টি।
একদিন হঠাৎ মিউজিক রুমে সবার আগে উনি এসে পড়লেন। ঘরে চা জল দেওয়ার জন্য আরও একটি ছেলে ছিল। সেই ছেলেটি পিয়ানোটার রিডে আঙুল বোলাচ্ছিল।
আপন মনে পিয়ানো নিয়ে খেলা করছে কিশোর ছেলেটি। শচীনদা তার পিছন থেকে মুগ্ধ বিস্ময়ে সেই সুরটি শুনতে লাগলেন। সেই সুরটির নোটেশন মনে মনে মুখস্থ করে লিখে নিয়ে বললেন, এই তুই আবার বাজা!
ছেলেটি চমকে উঠে পিয়ানোর সামনের টুল থেকে নেমে উপুড় হয়ে পড়ল শচীনদার পায়ে। সাহেব কসুর মাপ করে দিন। শচীনদা ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ছেলেটিকে বলেছিলেন, তোকে তো মাপ করে দিলামই, কিন্তু তুই যে আমাকে কী দিয়ে গেলি তা তুই নিজেই জানিস না।
ওই চা দেওয়া ছেলেটির খালি মিউজিক রুমে পিয়ানো রিডে ছেলেমানুষি এলোমেলো বাজনার সুরের মুখড়া নিয়েই তৈরি হয়েছিল ঠাণ্ডি হাওয়া’-র মতো বিখ্যাত হিট গান। যে সুরের তুলনা আজও এদেশের সংগীতজগতে চট করে খুঁজে বার করা মুশকিল। ওই গানের এই নেপথ্য কাহিনীটি আমায় শুনিয়েছিলেন স্বয়ং শচীন দেববর্মণ।
এর পরেই শুনলাম ‘বাজি’ ছবির গান। গীতা রায়ের গাওয়া শচীনদার সুরে ‘তগদীর সে বিগড়ি হুয়ে…’। আমি ছাত্রজীবনে যার সুপারহিট ভার্সান করেছিলাম ‘স্বপ্নেরই লগ্নে কে/স্বপন রাঙালে।’ স্নিগ্ধ সুরেলা ব্যঞ্জনাময় মধুর কণ্ঠস্বর ছিল গীতা রায়ের। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম ওঁর গান। ওই ‘বাজী’ ছবিতেই শচীন দেববর্মণ ওঁকে পাশাপাশি গাওয়ালেন অপূর্ব মেলোডি রোমান্টিক গান ‘আজিকে রাত পিয়া/দিল না তোড়ো।’
এদেশের গানের জগতে আর সব মহিলা শিল্পীদের নাম স্তিমিত হয়ে এলেও এখনও জ্বল জ্বল করে জ্বলছে দুটি নাম, লতা মঙ্গেশকর এবং গীতা রায়।
গীতাদির নিজের মুখেই একদিন শুনেছিলাম, বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার ইদিলপুর গ্রামে এক জমিদার বংশে উনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাড়িতে সংগীতের সমাদর ছিল। ছোটবেলাতেই গীতাদির গানের অনুরাগ দেখে মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকেই ওঁকে কলকাতার হরেন্দ্রনাথ নন্দীর কাছে গান শেখানো শুরু করেন ওঁর অভিভাবকেরা। ১৯৪১ সালে ওঁর দাদারা যখন মুম্বই-তে নিজেদের কাজের জন্য চলে আসেন, উনিও তখন ওঁদের সঙ্গে চলে আসেন মুম্বই-তে। ১৯৪৬ সালে মাত্র পনেরো বছর বয়সে উনি হিন্দি ছবিতে প্লে-ব্যাক করেন। তারপর থেকে সম্ভবত ওঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
গীতা রায়ের অপূর্ব দুটি চোখ আর শ্যামলা সৌন্দর্য দেখে অনেকেই ওঁকে ছবিতে অভিনয়ের জন্য অফার দিয়েছিলেন। লতা মঙ্গেশকর প্রথম জীবনে ছায়াচিত্রে অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু গায়িকা গীতা রায়, নায়িকা হয়েছিলেন অনেক পরে, যখন উনি গুরু দত্তকে বিয়ে করে গীতা দত্ত হয়েছিলেন। ছবিটি ছিল গুরু দত্ত পরিচালিত বাংলা ছবি ‘গৌরী’। ওই ছবিটির জন্য শচীন দেববর্মণ বানিয়েছিলেন ‘বাঁশী শুনে আর কাজ নাই।’ কিন্তু খেয়ালি গুরু দত্ত ছবিটি অনেকটা শুটিং করে হঠাৎ বন্ধ করে দিলেন। বললেন, না, ঠিক জমছে না।
পরবর্তীকালে গীতাদি অজয় বিশ্বাসের ‘প্রথম প্রেম’ ছবিতে অভিনয় করেন।
এখন চুপি চুপি একটা কথা বলছি। দোহাই আপনাদের, আপনারা কথাটা পাঁচ কান করবেন না। গীতা রায়ের সঙ্গে মান্না দে-র নাম জড়িয়ে বেশ একটা রোমান্টিক মিষ্টি মধুর গুঞ্জন তখনকার মুম্বই-তে কিছুদিন যত্রতত্র শোনা গিয়েছিল। একদিন এ প্রসঙ্গে স্বয়ং মান্না দেকে ওঁর আনন্দম’ বাংলোর বারান্দায় বসে আড্ডা মারতে মারতে একটু মেজাজে পেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। মান্নাদা প্রথমটায় একটু হেসে উঠেছিলেন। তারপর প্রিয়তমা পত্নীর নিজের হাতের বানানো বাগানের লনটার চারপাশে বিভিন্ন গোলাপফুলের গাছগুলির দিকে তাকিয়ে থেকে একটা নিশ্বাস ফেলে উনি বলে উঠেছিলেন, প্রথম যৌবনে সবারই এসব একটু আধটু হয়ে থাকে। অস্বীকার করছি না আমাদেরও হয়তো কিছুটা হয়েছিল। আপনারও যে হয়েছিল সে তো সেই প্রথম দিন আপনার গানের ভাষা দেখে মনে মনে বুঝেছিলাম। তা না হলে লিখতে পারতেন ‘দরদি গো কী চেয়েছি আর কী যে পেলাম, ‘এই তো সেদিন তুমি আমারে বোঝালে’, ‘তুমি নিজের মুখে বললে যে দিন’ কিংবা ‘ক’ ফোঁটা চোখের জল ফেলেছো যে’ নাকি আমিই গাইতে পারতাম ও সব গান? এর একটু পরে শিশুর মতো সরল হাসিতে উচ্ছল হয়ে উঠেছিলেন মান্না দে। এরপরই প্রসঙ্গ ঘুরে গেল।
বন্ধুবর সুধীন দাশগুপ্তকে কলকাতা থেকে মুম্বইতে নিয়ে গিয়েছিলেন গুরু দত্ত। মূলত গীতা দত্তেরই সার্টিফিকেটে। মাস মাহিনাতে কাজ করতেন সুধীনবাবু গুরু দত্ত ফিল্মসে। সুর করতেন। প্রতীক্ষা করতেন কবে রেকর্ডিং হবে।
কিন্তু খেয়ালি গুরু দত্তের রোজই গানের সিচুয়েশন পাল্টাত। রেকর্ডিং আর হত না। সুধীনবাবু একবার হঠাৎ কলকাতায় উড়ে এলেন। দেখা হল আমাদের। হাসতে হাসতে বললেন, সপ্তাহে তিনদিন রাত একটাতে গুরু দত্তের কাছ থেকে গাড়ি আসে। যেতে হয় ওখানে। পৌঁছলেই গুরু দত্ত বলেন, আসুন সুধীনবাবু। এখনই গীতা রাঁধল খিচুড়িটা। খেয়ে দেখলাম অপূর্ব। বাঙালি না হলে খিচুড়ির মর্ম কে বুঝবে। তাই আপনাকে ডাকলাম। আমি কিন্তু অবাঙালি হলেও এই খিচুড়ির খুব ভক্ত। কালকেও এক ঘটনা ঘটল। ভরপেট ডিনার খেয়ে শুয়ে পড়লেও আবার ঘুম থেকে উঠে ওখানে গিয়ে গীতাদির রান্না খেতে হল সুধীনবাবুকে। চলল পানাহার। কথায় কথায় কয়েকটি বাংলা হিট ছবির গল্প শুনলেন গুরুজি সুধীন বাবুর কাছ থেকে। তারপরেই শেষ রাতে বললেন, সুধীনবাবু, প্লিজ কালকেই চলে যান, কলকাতায় খোঁজখবর করুন ওই গল্পের হিন্দি রাইটটা খালি আছে কি না। সে জন্য আবার কলকাতায় এসেছি। ফিরে গিয়ে হয়তো শুনব এর থেকে আরও একটা ভাল গল্প পেয়ে গেছেন স্থানীয় মারাঠি সাহিত্য থেকে।
গীতাদি এইচ. এম. ভি. রেকর্ডে আমার লেখা বেশ কিছু আধুনিক বাংলা গান গেয়েছেন বিনোদ চট্টোপাধ্যায় এবং কানু ঘোষের সুরে। ছায়াছবিতেও বিভিন্ন সুরকারের সুরে উনি আমার গান গেয়েছেন। শুধু আমার গান কেন গীতাজির গাওয়া যে গানই শুনেছি, মনে হয়েছে উনি একটা নিজস্ব ঘরানা একটা নিজস্ব স্টাইল। অবশ্য সব দিকপাল কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যেই এই গুণটি আছে। গীতাদি যখন সাফল্যের তুঙ্গে তখন লতা মঙ্গেশকর নয় গীতাদির স্টাইল অনুসরণ করেই গানের জগতে পদার্পণ করেছেন আশা ভোঁসলে। ক্যাবারে অঙ্গের আবেদনপূর্ণ গান বা একান্ত আপন ভালবাসার গানে গীতাদি ছিলেন অদ্বিতীয়া।
মনে আছে ‘হারানো সুর’ ছবির সিটিং হয়েছিল ভবানীপুরে আমার বড়দির বাড়িতে। ওখানে প্রযোজক-নায়ক উত্তম, পরিচালক অজয় কর এঁরা ছিলেন। সুরকার হেমন্তদা তখন মুম্বই-তে ভীষণ ব্যস্ত। কলকাতায় দিন গুনে ঘড়ি ধরে আসতেন। সে সময় ‘হারানো সুর’ ছবির সুর করার দায়িত্ব তিনি নিয়েছিলেন। হেমন্তদা গেয়ে শোনালেন তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার।’
উপস্থিত শ্রোতাদের অভিব্যক্তি দেখে মনে হল কারও সে গান পছন্দ হয়নি। হেমন্তদা হারমোনিয়াম বন্ধ করে ঘড়ি দেখলেন। বললেন, আমার ফ্লাইটের সময় হয়ে গেছে। বলো উত্তম ঠিক আছে তো উত্তম শুধু বলল, বাঃ!
হেমন্তদা বললেন, তা হলে এ গানটা মুম্বই-তেই রেকর্ড করছি। মিনু কর্তাকের স্টুডিয়োতে ইকো চেম্বার রেকর্ডিং এসে গেছে। কলকাতায় ইকো তো নেই। ওখানে খুব ভাল হবে।
সবাই সায় দিলেন।
এবার হেমন্তদা বললেন, গাইবে কিন্তু গীতা।
সবাই সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল, সুচিত্রা সেনের লিপে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নয় গীতা দত্ত? হেমন্তদা বললেন, এ গানটা গীতার মতো ভারতবর্ষে কেউই গাইতে পারবে না। কথাটা বলেই হেমন্তদা ঘর থেকে চলে গেলেন।
উনি চলে যেতে সবাই আলোচনায় বসলেন। বোঝা গেল গানটি সত্যি কারও পছন্দ হয়নি। এবং গায়িকা গীতা দত্তকেও নয়। শেষটায় উত্তম বলল, শুনেই দেখি না গানটা কেমন দাঁড়ায়। ভাল না লাগলে একটা রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে দেব। কিন্তু সে গান যে শেষ পর্যন্ত কেমন দাঁড়াল তা কি আর বলার প্রযোজন আছে? গানের জগতে গীতাদির এই গান আজও ইতিহাস। হেমস্তদার সার্থক দূরদৃষ্টিতে, এই একটি গানেই শ্রোতাদের হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন গীতাদি।
পরবর্তীকালে গীতাদির গাওয়া এ ধরনের গানগুলো আজও তো সবাই মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনছেন। গীতাদির গান রি-মেক করে আজকে যে সব শিল্পী প্রশংসা পাচ্ছেন, তাঁরা ভেবে দেখছেন না এই গানে গীতাদির ছায়াটুকু আছে। এই ছায়াতেই তৃপ্তি। কায়াতো আজ ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কথায় আছে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে না। কিন্তু আজকের শ্রোতাদের ঘোলেই তৃপ্তি জুটছে। বিভিন্ন ক্যাসেট কোম্পানিতে খোঁজ করলেই দেখা যাবে তার কপি করা গানের ক্যাসেটের বিক্রি কত বেশি।
৫৩
‘হারানো সুর’ ছবির প্রসঙ্গে একটা কথা আপনাদের জানাতে ইচ্ছা করছে। কথাটা হয়তো অনেকেই জানেন। তবু আবার বলি। ‘হারানো সুর’ ছবির অন্তিম দৃশ্যে উত্তমের মুখে ‘রমা’ ডাকটি কিন্তু হেমন্তদার কণ্ঠে, উত্তমের নয়। ঘটনাটা হল মুম্বইতে এই ছবির কিছু টেকনিকাল কাজ করার সময় পরিচালক অজয় কর এবং হেমন্তদা দুজনেরই মনে হল, ওই রমা ডাকটি ইকোর মাধ্যমে হলে নাট্যরস আরও জমবে। কিন্তু তখন ওই মুম্বই-তে উত্তমকে কোথায় পাবেন? তাই হেমন্তদাকে দিয়েই ওই ইকোর মাধ্যমে ডাকটা রেকর্ড করা হল। কারণ আগেই বলেছি কলকাতায় তখন ইকো মেশিন আসেনি।
যাক আবার গীতাদির প্রসঙ্গে আসি। গুরু দত্তকেই মন প্রাণ সর্বস্ব দিয়ে ভাল বেসেছিলেন গীতাদি। ওঁর জন্য অনেক কিছুই মেনে নিয়েছিলেন। আমার ধারণা, গুরু দত্তের কাছেই গীতাদি গুরু দত্তের বিখ্যাত ছবি ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর জীবনযাপন করতে শুরু করেন। তার প্রমাণ পেয়েছিলাম আমাদের পাড়ার ক্লাবের জলসায় ওঁকে গাওয়াবার জন্য যখন মুম্বই গিয়ে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি। টেলিফোনে কথা বলে নিয়ে হেমন্তদাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম ওঁর বাড়ি। সঙ্গে অগ্রিমের সব টাকাটা ছিল না। তাই হেমন্তদাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া। হেমন্তদা যেন বলেন, আমি আছি গীতা। তুমি পেমেন্টের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থেকো। গীতাদির ভাই মুকুল রায়ের বাড়িতে, মুকুলবাবু ও গীতাদির সঙ্গে সব পাকাপাকি হয়ে গেল। ওঁরা শুধু বললেন, আমাদের সালকিয়ার অনুষ্ঠানের পরদিনই ওঁরা হায়দ্রাবাদের অনুষ্ঠানে যাবেন। সুতরাং পরদিন হায়দ্রাবাদ ফ্লাইটের সময় অনুযায়ী আমাদের, ওঁদের কলকাতা এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতে হবে। এই দায়িত্বটা আমাকে নিতে হবে।
আমি বললাম নিশ্চয়। এ তো আমাদের কর্তব্য, আমাদের ভদ্রতা।
হেমন্তদা আমাদের সামনেই বেশ জোর দিয়েই বলে ফেললেন, না পুলক, তথাকথিত কোনও ছেলে টেলে নয়, তুমি নিজে সকালে গ্রান্ড হোটেলে যাবে। মুকুল আর গীতাকে নিয়ে তুমি নিজে ছেড়ে আসবে দমদমে।
হেমন্তদা কেন ও কথাটা তখন অত জোর দিয়ে বললেন, সেটা বুঝেছিলাম আমাদের জলসার পরদিন সকালে গ্রান্ড হোটেলে গীতাদিকে গাড়িতে তুলতে গিয়ে। তখনকার ঘটনাটা একটু বাদে বলব। এখন একটু অন্য কথা বলি।
হেমন্তদা আর মান্নাদার জয়গান তো আমি যখন তখন গাই। এই ফাঁকে আবার একটু গেয়ে নিই। সেবার আমাদের পাড়ার ক্লাবের রজত জয়ন্তী উৎসব ছিল। তখনকার ভাষায় সারারাত্রিব্যাপী বিচিত্রানুষ্ঠান। কলকাতাতেই হেমন্তদা আর সন্ধ্যার সঙ্গে কথাবার্তা ফাইনাল হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় আরও অনেক শিল্পী। হেমন্তদার পারিশ্রমিক হেমন্তদার কথামতোই ধার্য হয়েছিল। এরপর সভ্যদের উৎসাহে ওখানে এলেন মুকেশ, মান্না দে, তালাত মাহমুদ। এরপর আবার মুম্বই-তে গিয়ে ঠিক করতে হল গীতাদিকে। বলতে দ্বিধা নেই গীতাদির পারিশ্রমিক হেমন্তদার থেকে একটু বেশিই ছিল। যখন গীতাদির সঙ্গে আমার পাকাপাকি কথা হল, তখন টাকার অঙ্কটা পরিষ্কার জেনে গেলেন হেমন্তদা। ওঁর গাড়িতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে হেমন্তদা শুধু একবার হাসতে হাসতে বললেন, কী পুলক। আমার বেলাতে কি পুরনোটাই থাকবে?
আমি অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে বললাম, বলুন কী হবে? আমি ক্লাবকে বলব।
হেমন্তদা বললেন, না, এখন আর এটা ভাল দেখায় না। কিন্তু মনে রেখো গান লিখতে লিখতে যখন পাড়ার ফাংশনের দায়িত্ব নিয়েছ, তখন সব থেকে আগে দায়িত্ব নিতে হবে তোমার গীতাদিকে ফেরত পাঠানো। তবে তুমি নিশ্চিন্ত থেকো, গীতাকে কলকাতায় পাঠাবার দায়িত্বটা আমি নিলাম। আমি তখন কলকাতায় থাকলেও আমার লোক ওকে ঠিক সময় সান্তাক্রুজে ছেড়ে আসবে।
প্রায় সব কণ্ঠশিল্পীই কোনও অনুষ্ঠানে সম্মতি দেবার আগে জেনে নেন আর কে কে আছেন। হেমন্তদা কখনওই এ সব জিজ্ঞাসাই করতেন না। শুধু ঠিক করে নিতেন নিজের পারিশ্রমিক আর কটা নাগাদ কোন সময়ে ওঁকে গাইতে হবে, ব্যস।
এমন মানুষ ছিলেন বলেই গীতাদিকে আমি অনেক বেশি দিচ্ছি জেনেও ক্ষোভ তো করলেনই না, বরং ওঁর দিক থেকে গভীর সহযোগিতা পাওয়া গেল। সত্যি এমন বড় মাপের ভদ্র মানুষ পৃথিবীতে খুব কম এসেছেন।
আমাদের বিচিত্রানুষ্ঠানে সাজিয়ে রেখেছিলাম, গভীর রাতে হেমন্তদার পরে গীতাদি গাইবেন। হেমন্তদা ওঁর অপূর্ব কণ্ঠের গান শেষ করে দর্শকদের সঙ্গে সামনের সারিতে বসে গেলেন। কিন্তু আমি দেখেছি সব জায়গাতেই ওঁর গান হয়ে গেলেই উনি চলে যেতেন। কিন্তু এক্ষেত্রে রয়ে গেলেন। ভাবলাম হয়তো গীতাদির প্রোগ্রাম শুনতে ইচ্ছে হয়েছে তাই থেকে গেলেন। কিন্তু আসল কারণটা বুঝলাম একটু পরে। গীতাদি প্রথম গানটা দারুণ গাইলেন। পরেরটাও ভাল। তার পরের গানটা শুনেই লক্ষ করলাম আমার পাশে বসা হেমন্তদা যেন একটু অস্বস্তির মধ্যে রয়েছেন। পরের গানটা গীতাদি বাছলেন খুবই রোমান্টিক একটি হিন্দি লোরি স্টাইলের গান। ওই সেই স্বভাব-প্রসিদ্ধ সুন্দর কণ্ঠে ঘুম ঘুম মাদকতা দিয়ে সেই গানটি এমন স্বাভাবিক অভিব্যক্তি দিয়ে পরিবেশন করতে লাগলেন যে শ্রোতাদের মনে হল, উনি সত্যি যেন গাইতে গাইতে ঘুমিয়ে পড়ছেন। মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছেন। আবার যেন আচমকা ঘুম ভেঙে গান ধরছেন। এই গানটি শেষ হতেই, আমাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ হেমন্তদা বিনা ঘোষণায় বিনা পূর্ব প্রস্তুতিতে সোজা উঠে এলেন মঞ্চে। নিজেই ঘোষণা করলেন এবার আমার আর গীতার ডুয়েট গান। অনুষ্ঠানে ডুয়েট গানের কোনও কথাই ছিল না। এই হঠাৎ প্রাপ্তিতে সমবেত শ্রোতারা হাততালিতে ভরিয়ে দিলেন অনুষ্ঠানস্থল। গীতাদি গাইতে গাইতে যে ঘুমিয়ে পড়ছেন এটা যে গানের অভিনয় নয় সত্যিকারের ঘুমের ঘটনা, সেটা কিন্তু আমিও বুঝিনি। মুহূর্তে বুঝেছিলেন হেমন্তদা। এমন কিছু হতে পারে এই আশঙ্কাতেই গীতাদির খুবই ঘনিষ্ঠ হেমন্তদা ওঁর অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলেও থেকে গিয়েছিলেন। গীতাদির সেই গান যে চার্লি চ্যাপলিনের ‘লাইম লাইট’-এর সেই আহত ক্লাউনের যন্ত্রণার অভিব্যক্তি, তৎক্ষণাৎ এটা আমি হৃদয়ঙ্গম করলাম। আর দেখলাম হেমন্তদাকে। কীভাবে একজন শিল্পী আর একজন শিল্পীকে অসম্মান আর লোক জানাজানির গঞ্জনা থেকে বাঁচিয়ে দিলেন। পরে এই নিয়ে কথা বলেছি হেমন্তদার সঙ্গে। উনি বেশি কথা বলেননি। শুধু বলেছিলেন, গীতা এখন সে গীতা নেই। বদলে গেছে। এখন ওর গানটাই শুধু শোনো। অন্য কিছুর আলোচনায় থেকো না।
সেদিন রাতে পর পর চার-পাঁচটা ডুয়েট গান গেয়ে গেলেন হেমন্তদা ও গীতাদি। বলা যায় হেমন্তদাই গাইয়ে নিলেন গীতাদিকে। হেমন্তদার কন্ঠের সঙ্গে ঢাকা বা চাপা পড়ে গেল গীতাদির নেশাতুর স্টাইলে গাওয়া মদির কণ্ঠস্বরের সব কিছু ভুল ত্রুটি। অনুষ্ঠান শেষে সবাই অজস্র করতালিতে অভিনন্দন জানালেন শিল্পীদের। হাততালি আমিও দিলাম। তবে সবটা হেমন্তদাকে উদ্দেশ করে। এবার বাড়ি যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠলেন হেমন্তদা। যাওয়ার বেলায় বলে গেলেন, পুলক, কাল গীতাকে প্লেনে তুলে দিয়ো।
পর দিন সকালে যথাসময়ে হোটেলে গিয়ে দেখি গীতাদির ঘরের দরজাতে ঝুলছে ‘প্লিজ, ডোন্ট ডিসটার্ব!’
ঘড়ি দেখলাম, এখনও যদি না ওঠেন তবে দমদমে পৌঁছবেন কী করে? তখনও ভি আই পি রোড হয়নি। যশোর রোড ধরে যেতে হত এয়ারপোর্টে। নীচে নেমে এলাম। রিসেপশনে বললাম, একটু টেলিফোনে ডেকে দিন। প্লেন ধরতে হবে যে। ওঁরা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আমাদের বলেছেন কোনও টেলিফোন না দিতে। ওঁর আদেশ উপেক্ষা করে আমরা কী করে ফোন দিই। উনি যদি আমাদের নামে কমপ্লেন করে দেন। তা হলে তো আমাদের চাকুরি থাকবে না।
অগত্যা আবার আমি ওপরে গেলাম। ঘড়ি দেখে অধৈর্য হয়ে দরজাতে ঘুষি মারতে লাগলাম। কোনও ফলই হল না। আমার হাতের ধাক্কায় শুধু জোরে জোরে দুলতে লাগল দরজাতে ঝোলানো ‘প্লিজ ডোন্ট ডিসটার্ব’ বোর্ডটা।
আবার নেমে এলাম। কী করি ভেবে পাচ্ছি না। হঠাৎ মনে এল আমার এক পরিচিত জন এয়ারপোর্টে বড় পোস্টে কাজ করে। তাকে বলে রাখি। উনি হয়তো টিকিট দুটো (গীতাদি ও মুকুল রায়ের) রিফান্ড সবটা পেতে সাহায্য করতে পারেন। ওঁকে ফোন করলাম। ভাগ্যক্রমে পেয়েও গেলাম। বললাম, আমার অবস্থাটা। গীতা দত্ত যাবেন। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি পৌঁছতে চেষ্টা করছি। আপনি একটু কাছাকাছি থাকবেন।
আবার ওপরে গেলাম। আবার দরজাতে ঘুষি। একজন বেয়ারা ওখান দিয়ে যাচ্ছিল, আমার আচরণ দেখে আমাকে রীতিমতো ধমক দিয়ে বলল, এ কী করছেন? পাশের ঘরের লোকেরা কমপ্লেন করবেন যে?
আমার হাতে ব্যথা লাগছিল। ওর কথায় কর্ণপাত না করে ওকে টিপস দিয়ে বললাম, আমাকে হেল্প করো ভাই।
ওদের এ সব অভ্যাস থাকাটা স্বাভাবিক। ও দরজাটার বিশেষ একটা জায়গায় আঘাত করতে লাগল। দু-চারবার আঘাতের পরই খুলে গেল দরজা। সে দিন মনে হল চাক্ষুষ দেখলাম আলিবাবার চিচিং ফাঁক। বন্ধ দরজা খোলার এত স্বস্তি জীবনে আর কখনও পাইনি। দেখলাম ঘুম জড়ানো চোখে সামনে দাঁড়িয়ে মুকুল রায়। মুকুল রায় হাই তুলে বললেন, ও, আপনি এসে গেছেন? কিন্তু গীতু তো এখনও ওঠেনি। ও তো ভেতরের ঘরে এখনও ঘুমুচ্ছে।
বাইরে তখনও সেই বেয়ারাটা দাঁড়িয়েছিল। আমি উৎকণ্ঠায় কাঁপছিলাম। ওকেই বলে বসলাম, ভাই, রুম সার্ভিসকে বলে দাও দুকাপ হট কফি। যাতে এখনই ঘুম ভাঙে। এবার একটু কড়া গলায় মুকুল রায়কে বলতে হল, গীতাদিকে ডাকুন। ফ্লাইট মিস করবেন যে? কিন্তু ওঁর তখনও যেন কোনও গা দেখলাম না। এদিকে আমার কানে তখন বেজে চলেছে হেমন্তদার নির্দেশ, পুলক, তুমি কিন্তু নিজে গীতাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবে।’ দরজায় পর্দা ঢাকা ভেতরের ঘরটাতে গীতাদি ছিলেন। আমি সব সভ্যতা ভদ্রতা ভুলে রীতিমতো চেঁচিয়ে বলে উঠলাম, গীতাদি উঠুন। কফি এসে গেছে। আর দেরি করলে ফ্লাইট মিস করবেন। আপনার হায়দ্রাবাদের ফাংশনে আগুন জ্বলবে।
আমার চেঁচামেচিতে কাজ হল। তখনই চোখ ভর্তি ঘুম নিয়ে পর্দা সরিয়ে আমার সামনে দাঁড়ালেন গীতাদি। এক চিলতে হাসি দিয়ে বললেন, গুড মর্নিং। ক’টা বাজে? বলতে হল, অনেক বেজে গেছে। এই যে কফি এসে গেছে। নিন তৈরি হয়ে নিন। আমি নীচে যাচ্ছি। আপনার চেক আউটের ব্যবস্থাগুলো সেরে নি।
কিন্তু গীতাদি গীতাদিই। আমার ওই টেনশনের মধ্যেই দেখলাম ওঁর সেই চিরন্তন মমতাময়ী নারীর রূপ। কপালের ওপর ঝুলে পড়া চুলগুলো আঙুলে সরিয়ে বললেন, না। এমনি যাওয়া হবে না। কফি খেয়ে যান। ভুলে গেলেন এটা ওঁর মুম্বই-এর বাড়ি নয়। কলকাতার হোটেল। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই জেনে গাল জিভ পুড়িয়ে গরম কফি কোনও রকমে গলায় ঢেলে মুকুলবাবু গীতাদিকে আবার তাগাদা দিয়ে এক দৌড়ে নীচে নেমে গেলাম।
নীচে থেকে দু-চার বার তাগাদা দেওয়ার পর অবশেষে গীতাদি নামলেন লাগেজ সমেত। গাড়িতে উঠে বসা হল। গাড়ি যখন ছাড়তে যাচ্ছে সেই সময় গীতাদি বললেন, এই যাঃ। আমার একটা ছোট হ্যান্ডব্যাগ ফেলে এসেছি। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ওঁর করুণা হল কিনা জানি না, বললেন, না, তেমন কিছু জিনিস নেই। এই টুকিটাকি রুমাল-টুমাল। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, চিন্তা করবেন না। আপনাকে দমদমে ছেড়ে আবার আসব হোটেলে। ওদের ওখানে নিশ্চয় জমা থাকবে। ওটা নিয়ে গিয়ে হেমন্তদাকে দিয়ে দেব। উনি বোম্বে ফিরেই আপনাকে পৌঁছে দেবেন।
শ্যামবাজার পেরিয়ে কত জোরে যে দমদম পৌঁছে ছিলাম তা ভাষায় বর্ণনা করতে গেলে এখন আমার বুক ধড়ফড় করে। এয়ারপোর্টে ঢুকতেই, সবার সামনেই আমার সেই পরিচিত ব্যক্তিটি আমাকে গালমন্দ করতে লাগল। আমি বলে রাখলেও সব জিনিসেরই তো একটা সীমা আছে। প্লেন বোধহয় ছেড়ে গেল। দাঁড়াও। ফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলে আমায় বলল, আর একটু দেরি হলেই সিঁড়িটা সরিয়ে নিত। গীতা দত্ত যেতে পারেন, কিন্তু ওঁর লাগেজ যাবে না। গীতাদি ওই কথা শুনে অপরূপ চোখ দুটি মেলে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন। ও ব্যস্ত হয়ে শুধু বলল, যা যা দরকার বাক্স খুলে হাতে করে নিয়ে নিন। পুলক আপনার বাক্স পরে বুক করে মুম্বইতে পাঠিয়ে দেবে।
বাক্স খুলে প্রয়োজনীয় সমস্ত জামা কাপড় নিয়ে নিলেন গীতাদি আর মুকুল রায়। হঠাৎ মুকুলকে দেখে আমার পরিচিত অফিসারটি বলল, উনিও যাবেন নাকি? তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, তুমি তো শুধু গীতা দত্তর নাম বলেছিলে। সঙ্গে যে আর একজন আছেন তা তো বলনি। মুশকিলে ফেললে আমাকে। দেখি কী করা যায়!
আবার শুরু হল আর এক ঝামেলা। তবুও সে বিপদটা আমরা পার হয়ে গেলাম। তখন এখনকার মতো সিকিউরিটির এত কড়াকড়ি ছিল না। পড়ে রইল গীতাদির লাগেজ।
এয়ারপোর্টের ওই উচ্চপদস্থ অফিসার, আমি, গীতাদি আর মুকুল রায় ছুটলাম রানওয়ের কাছে। পাইলট দেখলেন কি দেখলেন না জানি না, আমি ছুটতে ছুটতে পাইলটের উদ্দেশে দু হাত জোড় করে অনুনয় বিনয় করতে লাগলাম। দ্রুত সিঁড়িতে উঠতে উঠতে গীতাদির হাতের শাড়ি জামা নীচের কংক্রিটের মেঝের ওপর পড়ে গেল। ওখানকার লোকেরা তৎক্ষণাৎ তুলে নিয়ে সিঁড়িতে উঠে গেল। শেষটায় স্বচক্ষে দেখলাম গীতাদি মুকুল রায় দুজনেই প্লেনের ভেতরে ঢুকে গেলেন। বন্ধ হয়ে গেল প্লেনের দরজা। এবার সিঁড়ি সরিয়ে নেওয়া শুরু হবে। তখনই দমদমে আমার উপকারী অফিসার বন্ধুটির হুঁশ এল। আমায় দেখে বলল, আরে তুমি এখানে? এই রানওয়েতে এলে কী করে! তাড়াতাড়ি চলে যাও, আমি আসছি।
আবার প্রায় দৌড়ে লাউঞ্জে এসে হাঁপাতে লাগলাম। এদিকে তখন আর এক কাণ্ড। আর একজন দেরি করা যাত্রীকে এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেননি প্লেনে ওঠবার জন্য। তিনি রীতিমতো হই হট্টগোল শুরু করে দিয়েছেন। বলছেন, ফিল্মের নামেই সব লাল ঝোল পড়ে আপনাদের। ফিল্মের লোকেরা সব সময় ভি আই পি হয়ে যায়, আর বাকি লোকেরা বুঝি সব ভেড়া ছাগল, ইত্যাদি ইত্যাদি সব নানা কথা। আমি ওই চেঁচামেচি শুনতে শুনতে গীতাদির সুটকেস দুটো এক জায়গায় সরিয়ে রাখতে লাগলাম। দেখি দুটো বাক্সই খোলা। গীতাদি চাবি দেওয়ার সময়টুকুও পাননি। একটা সুটকেসের খোলা ডালা থেকে সোনার চুড়ি, কাঁকন ও আরও কিছু গয়না আমার চোখে পড়ল। বাক্স দুটো ভাল করে বন্ধ করে মনস্থির করলাম, এগুলো প্লেনে পাঠাব না। হেমন্তদার হাত দিয়েই ওই হোটেলে ছেড়ে আসা গীতাদির আর একটা ছোট হ্যান্ডব্যাগের সঙ্গে পাঠিয়ে দেব মুম্বই-তে।
ইতিমধ্যে আমার পরিচিত ব্যক্তিটি রানওয়ে থেকে ফিরে এসেছে। মড়া পুড়িয়ে বাড়িতে ঢুকলে যেমন আবার নতুন করে আর এক দফা কান্নার রোল ওঠে, প্লেনে না উঠতে পারা যাত্রীটি ওকে দেখেই আবার সজোরে ওঁর অভিযোগ জানাতে লাগলেন। আমার বন্ধু অফিসারটি ওঁকে নিমেষে থামিয়ে দিল একটি কথায়। বলল, গীতা দত্তর প্রিভিয়াস ইনফরমেশন ছিল। উনি আগে খবর পাঠিয়েছিলেন। আপনি যদি তা পাঠাতেন, তা হলে নিশ্চয় আপনার কেসটা আমরা বিবেচনা করতাম। এরপর ও আমায় ডাকল, পুলক, আমার ঘরে এসো, কফি খেয়ে যাবে।
একজনকে বাক্স দুটোর ওপর নজর রাখতে বলে ও আমায় ওর ঘরে নিয়ে যেতে যেতে বলতে লাগল, যে চেঁচামেচি করছে সে হয়তো কোটিপতি। কিন্তু অমন কোটিপতি সারা ভারতে অজস্র আছে। কিন্তু গীতা দত্ত আছেন সারা ভারতে কেবল একটাই। ওঁর জন্য কিছু করতে পেরে আমি নিজেকে খুব ধন্য মনে করছি। কী পুলক, কিছু ভুল বলেছি? আমার ওই পরিচিত পদস্থ অফিসারটি এখন কোথায় আছে জানি না। আমার এ লেখা ও পড়েছে কি না তাও জানি না। যদি কখনও এ লেখা চোখে পড়ে তাই ওকে এক শিল্পীকে সম্মান জানানোর জন্য আমার পক্ষ থেকে অজস্র ধন্যবাদ জানাই।
ভবানীপুরে শান্তুদার বাড়িতে, গীতাদির খোলা বাক্স পেয়ে আর সব শুনে হেমন্তদা শুধু বললেন, আমি এটা আন্দাজ করেছিলাম বলেই তোমায় এয়ারপোর্টে যেতে বলেছিলাম।
গুরু দত্তের আত্মহত্যার পর থেকেই, গীতাদিও যেন দিনে দিনে ধীরে ধীরে আত্মহননের দিকে এগিয়ে চললেন। এ বিষয়ে অনেক কথা আমাদের কানে আসতে লাগল। কিন্তু কিছু তো করার নেই। এটাই ওঁর অদৃষ্ট। কোনও কিছুতেই আর মন বসাতে পারলেন না। মাঝে মাঝে প্লে-ব্যাক করতেন। অনুষ্ঠানও করতেন। কিন্তু সবই যেন এলোমেলো পরিকল্পনাহীন।
৫৪
বন্ধুবর বারীন ধরের পর পর তিন-চার দিনের অনুষ্ঠানের জন্য সেবার সপ্তাহখানেক থাকবেন বলে গীতাদি কলকাতায় এলেন। বিনোদ চট্টোপাধ্যায়ের সুরে আমার লেখা ‘হৃদয় আমার কিছু যদি বলে’ এবং ‘শুধু একবার বলে যাও’ গানদুটি রেকর্ড করার পর, গীতাদি আমার লেখা কানুরঞ্জন ঘোষের সুরে শেষবারের মতো দুটি গান রেকর্ড করেছিলেন সম্ভবত ১৯৬৪ সালে। গান দুটি ছিল ‘কবে কোন তারা জ্বলা’ এবং ‘তোমার আসার পথ চেয়ে।
গীতাদির কলকাতায় আসার খবর পেয়ে রতু মুখোপাধ্যায়ের সুরে নতুন আধুনিক গান রেকর্ড করার জন্য রতুকে নিয়ে গেলাম হোটেলে। গীতাদি এক কথায় রাজি হলেন। খুব খুশি হয়ে আমার লেখা ও রতুর সুরে গান তুললেন ‘স্বপ্ন স্বপ্ন সব কিছু আজ লাগছে।
হোটেল থেকেই এইচ. এম. ভি-কে ফোন করলাম গীতাদি রেকর্ড করতে রাজি। দু-তিন দিন আছেন। আমাদের গান তৈরি। আপনারা একটা ডেট দিন। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এইচ. এম. ভি. তৎক্ষণাৎ নির্মমভাবে জানিয়ে দিলেন, না। গীতা দত্তের বাংলা গানে আমরা ইন্টারেস্টেড নই।
রেকর্ডিং বন্ধ হয়ে গেল। গীতাদিকে মিথ্যা বলতে হল এখন পনেরো দিন এইচ. এম. ভি.-র স্টুডিয়োর ডেট নেই। পরে যখন আসবেন, একটু আগে থেকে জানিয়ে এলে ব্যবস্থা করে রাখব। রতু, আমি একসঙ্গে গীতাদির ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
করিডোরে দেখা হল সদ্য আইন পাশ করা সুদর্শন এক উকিল বন্ধুর সঙ্গে। আমার কাছে যেই শুনল আমি গীতাদির কাছ থেকে আসছি, তখনই আমায় অনুনয় বিনয় করতে লাগল, গীতা দত্তের গান আমার দারুণ লাগে। আমার সঙ্গে একটু আলাপ করিয়ে দাও।
রতু চলে গেল। অগত্যা ওকে নিয়ে আবার এলাম গীতাদির ঘরে। সেদিন সন্ধ্যায় গীতাদির অনুষ্ঠান ছিল না। নব্য উকিলটি কথাবার্তা ভীষণ ভাল বলে, জমে উঠল আড্ডা। সময় কেটে যেতে লাগল। যতবার উঠতে চাই ততবারই গীতাদি উঠতে দেন না। শেষটাতে বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হল, গীতাদি মাফ করবেন। আমাকে উঠতেই হবে। উকিল বন্ধু বলল, তা হলে আমিও উঠি।
গীতাদি আমায় বললেন, আমিও একটু ঘুরে আসি। জীবনের সব কিছুই যেন বদলে গেছে। কোনও কিছুতেই একঘেয়েমি আমার ভাল লাগে না। হোটেলের এই বন্ধ ঘরটাতে যেন আমার দম আটকে আসছে।
আমার গাড়িতে উঠলেন গীতাদি। গঙ্গার ধারে খানিকটা ঘুরলাম। গীতাদি হঠাৎ আমায় বললেন, আপনি তো ভাই ঘোরতর সংসারী। বউ আছে। শুনেছি ছেলেও হয়েছে। এবার উকিল বন্ধুটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কে কে আছে ভাই?
বন্ধু বলল, মা নেই। বাবা আছেন। বোনেরা আছে। আর আছে ছোট্ট একটা ভাই। গীতাদি বললেন, চলো, তোমার বাড়ি যাই।
অগত্যা যেতে হল। ওরা তো গীতাদিকে বাড়িতে পেয়ে স্বর্গ হাতে পেল। স্বাভাবিকভাবেই আদর আপ্যায়ন চলল। রাত বাড়তে লাগল। বললাম, গীতাদি চলুন এবার হোটেলে নামিয়ে দিয়ে যাই। বারীন ধর হয়তো এতক্ষণ হোটেলে ছটফট করছে। গীতাদি ওঠেনই না। হঠাৎ আমায় বললেন, রাত বেশি মনে হলে কোলের ছেলে মায়ের কাছে ফিরে যাক। আমি আজ এখানেই থাকব।
চমকে উঠলাম। এখানে থাকবেন? বউবাজারের এই সরু বাঁকা রায় স্ট্রিটের একতলার এই ছোট বাড়িতে? না, গীতাদি। চলুন আপনাকে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে আসি।
গীতাদি বললেন, না যাব না। ওদের এই ছোট্ট ঘরটা আমার দারুণ পছন্দ হয়েছে। কত দিন কত কাল এই ধরনের পুরোপুরি বাঙালির ঘরে থাকিনি। পুলকবাবু দোহাই। আমাকে এখানে থাকতে দিন। আমি আজ খুব পরিতৃপ্তিতে রাত কাটাব। অনুনয়ে ভেঙে পড়লেন গীতাদি। অগত্যা চলে এলাম। বন্ধুকে আড়ালে বললাম, কিছু অসুবিধা হলেই আমায় ফোন করবে। চলে আসব। বাড়ির ছোট্ট সদর দরজাটি আটকালেন গীতাদি। বললেন, কথা দিতে হবে। কেউ যেন না জানে আমি এখানে আছি। এমনকী বারীন ধরও যেন না জানে। কিন্তু গীতাদিকে দেওয়া সে কথা আমি রাখতে পারিনি। বাঁকা রায় স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে এসে সোজা চলে এলাম হোটেলে। যা ভেবেছিলাম দেখলাম ঠিক তাই। দেখি বারীন ধর অস্থির হয়ে ঘোরাফেরা করছে।
খুলে বললাম সব কিছু। দিলাম ওকে বাঁকা রায় স্ট্রিটের ঠিকানা। বললাম, কিছুতেই বলবে না আমিই তোমাকে ঠিকানাটা দিয়েছি। বারীন শুধু বললে, তুমি যখন হোটেলে এলে ওঁর ঘরে তখন কে ছিল? আমি বললাম, কেউই তো ছিল না। গীতাদি তো একাই ছিলেন। বারীন বললে, তা হলে বোধহয় তখনি ওরা গেছে। ‘ওরা’ যে কারা তা আমি আজও জানি না। শুধু বারীনের সঙ্গে লিফটে নামতে নামতে শুনলাম বারীন আপনমনেই বলছে, না, কতবড় একজন শিল্পী যে ভবিষ্যতে জন্মাবে না, তাকে আর সুস্থ করা যাবে না।
সত্যিই সুস্থ করা গেল না শিল্পীকে। এইভাবে এলোমেলো বিশৃঙ্খল জীবন কাটিয়ে চলে গেলেন একদিন। জীবনে অর্থ, যশ, মান-সম্মান, প্রতিপত্তি সবই উনি পর্যাপ্ত পরিমাণে পেলেন। কিন্তু বোধহয় পেলেন না বুকভরা সুখ আর শান্তি। এ হয়তো বিধাতারই ভাগ্য লিখন। এমনধারা কিছু যে হবে তা ওঁর অবচেতন মন আগেই জেনে গিয়েছিল। তাই অমন প্রাণঢালা অভিব্যক্তিতে গাইতে পেরেছিলেন, শচীমাতা গো, আমি চার যুগে হই জনম দুঃখিনী’।
জানি না চলে যাওয়ার সময় কাকে কী অভিযোগ জানালেন। জানালেন কার কাছে কী অভিযোগ কিংবা অভিমান। আমার কানে শুধু বাজতে লাগল ওঁর গাওয়া আমার লেখা একটি গান ‘শুধু একবার বলে যাও/যদি তুমি চলে যাও/কোন আশা বুকে নিয়ে থাকব’।
একজন যায় আর একজন আসে। এই হয়তো পৃথিবীর নিয়ম। তবু একজন চলে না গেলে আর একজন যে আসতে পারতেন না, তার প্রমাণ তিন-তিনবার পাওয়া গিয়েছে সংগীত জগতে। গীতা দত্ত চলে যেতেই পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়ে উঠলেন আশা ভোঁসলে, তার আগে নয়। কিশোরকুমার চলে যেতেই মানুষ চিনল কুমার শানুকে, তার আগে নয়। আর মহম্মদ রফি চলে যেতেই মানুষ জানল মহম্মদ আজিজকে (মুন্না), তার আগে নয়।