৪০
একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। একটা সংগীতানুষ্ঠানে বিশিষ্ট কমেডিয়ান জহর রায়ের সঙ্গে আমার দেখা হল। আমায় দেখেই জহর রায় বলল, এই যে পুলক, তোমায় খুঁজছিলাম। আমরা একটা ছবি করছি। ছবিটার নাম ‘আলেয়ার আলো’। তোমায় তার জন্য গান লিখতে হবে। মঙ্গল চক্রবর্তী পরিচালক। আর তোমার ফেবারিট গোপেন মল্লিক সংগীত পরিচালক। সময় করে কাল সকালের দিকে আমার মির্জাপুরের মেস বাড়িতে এসো। ওদের ডাকলেই ওরা আসবে। আমরা গান নিয়ে আলোচনা করব। স্ক্রিপ্টটা তোমায় শোনাব।
আমি বললাম, ঠিক সময় হাজির হব। তুমি ওদের খবর দাও জহরদা।
সেই সময় ফাংশনে চলছিল উৎপলা-সতীনাথের অনুষ্ঠান। ওরা দ্বৈত গান দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করত। তখন গাইছিল আমারই গান ‘এ বেজায় ভারি শহর। গাড়ির বহর…’। গান খুবই জমে গিয়েছিল। গান শেষ করে দুজনেই মঞ্চ থেকে নেমে এল। জহরদাকে দেখেই উৎপলাদি জিজ্ঞেস করল, এই যে জহর, কেমন লাগল আমাদের গান?
জহরদা উৎপলা-সতীনাথের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে অম্লান বদনে বলল, মোটামুটি।
জহর রায়ে রসিকতাবোধ ছিল সর্বজন পরিচিত। উৎপলা-সতীনাথ কেউই রোগা ছিল না। সেই কথাটাই মজা করে অপূর্বভাবে বলল জহরদা।
আর একবার কলকাতার কাছাকাছিই একজনের বাড়িতে আমরা সবাই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছি। আমি, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর জহর রায় ছিলাম একটি গাড়িতে। গৃহস্বামী আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। পানাহারের সুব্যবস্থা ছিল। জহরদা বসে গেল। গৃহস্বামী ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে আমাদের আলাপ করিয়ে দিলেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই গায়ের রং বেশ কৃষ্ণবর্ণ। এমন সময় জহরদা এক প্লেট চানাচুরের কথা বলল। গৃহস্বামী ওঁর ছেলের নাম ধরে ডেকে বললেন, এই এখুনি এক প্লেট চানাচুর দিয়ে যা
ছেলেটি এল। গৃহস্বামী গদগদ কণ্ঠে বললেন, আমার ছেলে। ক্লাস ফাইভে পড়ে। ভাল গান গায়, নাচে, ফুটবল খেলে ইত্যাদি ইত্যাদি।
জহরদা ও সব শুনছিলই না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছিল ধবধবে ফরসা ছেলেটিকে। গৃহস্বামী, ওঁর স্ত্রী এবং ছেলে অন্যান্য অতিথিদের অভ্যর্থনার জন্য অন্য ঘরে চলে যেতেই জহরদা একমুঠো চানাচুর মুখে পুরে এক চুমুকে অনেকটা মদিরা গলায় ঢেলে বলল, পুলক, তরুণ তোমরা দেখলে তো। বাবা মা দুজনেই কুচকুচে কালো অথচ ছেলেটা ওরকম ধবধবে ফরসা হল কেমন করে?
তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় এদিক ওদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বললে, এর প্রকৃত কারণ একমাত্র ওই ভদ্রলোকের স্ত্রীই বলতে পারবেন। জহরদা শব্দ করে হেসে উঠে তরুণকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, ধুস, তোদের একটুও বুদ্ধি নেই। তোরা গানের শিল্পী হয়েছিস একটুও জ্ঞান-বিজ্ঞান শিখিসনি। এরপর পরম দার্শনিকের ভঙ্গিমায় জহরদা বলল, শ্লেট আর পেন্সিল দুটোই কালো কুচকুচে হয়। অথচ কালো শ্লেটে কালো পেন্সিলের দাগ দাও দেখবে ধবধবে ফরসা লেখা। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। পাটনার জহর রায় প্রসঙ্গ শেষ করল ‘জয় বাবা বজরঙ্গবলী জয়’ বলে।
প্রযোজকদের অংশীদার জহর রায়ের ‘আলেয়ার আলো’ ছবির একটি গান জহরদার খুব পছন্দ ছিল। যথেষ্ট পড়াশুনা ছিল জহরদার। মেস বাড়ির ঘরটা ঠাসা ছিল নানারকম বইতে। মেঝেতেও বই-এর পাহাড়। বই সরিয়ে বসতাম আমরা। ওই ছবিতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘তুমি নিজেই আকাশে জমো/নিজেই ঝরো ওগো বৃষ্টি’। আমার লেখা এ গানটা শুনেই জহরদা চেঁচিয়ে বলে উঠল, পুলক, আজ সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে তুমিও পার্টনার হবে।
ওখানেই জহরদা এক জলসার উদ্যোক্তাকে সরাসরি বলেছিলেন, তোমাদের জলসা ক্যানসেল হচ্ছে তার জন্য আমি কেন অ্যাডভান্সের টাকা ফেরত দেব। উদ্যোক্তা ছেলেটি মুখ কাঁচুমাচু করে তাকাল। জহরদা উঠে গিয়ে একটু টুথপেস্ট নিয়ে এসে ছেলেটির হাতে দিয়ে বলল, এটা টেপো। ছেলেটি টিপল। বেরিয়ে গেল খানিকটা পেস্ট। জহরদা বলল, এবার এটা ভিতরে ঢোকাও তো। ছেলেটি বলল, অসম্ভব। কেউই এটা পারবে না। জহরদাও বলল, তাই। কেউ পারবে না অ্যাডভান্সটা ফেরত নিতে। অতএব চা খেয়ে বাড়ি যাও।
ওই ছবির সুরকার গোপেন মল্লিক সম্পর্কেও অনেক তথ্যও আজও অনেকেরই অজানা। গোপেনদা যেমন সতীনাথের প্রথম গানের সুর করেছিলেন তেমনি করেছিলেন আরও অনেকেরই গান। সেই সময় এইচ. এম. ভি.-র একটি কম দামি রেকর্ড ছিল যার নাম ছিল টুইন রেকর্ড। এই টুইন রেকর্ডে কিন্তু অনেক বিখ্যাত গানের জন্ম হয়েছিল। যেমন মিস লাইটের গাওয়া আমার পিতৃবন্ধু হীরেন বসুর কথা এবং সুরে ‘শেফালি তোমার আঁচলখানি/বিছাও শারদ প্রাতে’। এই টুইন রেকর্ডে গোপেনদার সুরে প্রণব রায়ের রচনা ‘হে বলাকা দূরের যাত্রী…’ প্রকাশ মাত্রই হিট হয়েছিল। ও গানের গায়ক ছিলেন রীতেন চৌধুরি। রীতেন চৌধুরি আর কেউ নন বিখ্যাত সত্য চৌধুরীর ছদ্মনাম। সত্য চৌধুরীকে আজ কেউ আর মনে রাখেন না এটা খুবই দুঃখের। সত্যি, ওঁর প্রকৃত মূল্যায়ন আজও হয়নি। ওঁরই গাওয়া গোপেনদার সুরে আরও একটি বিখ্যাত গান ‘ভাল যদি লেগে থাকে/আমার এ গান খানি…’। খুবই জনপ্রিয় ছিল।
গোপেনদার সুরে সত্যদার আর একটি গান ‘তোমারে যে গান শোনাব’ বেশ কিছু দিন কলকাতা বেতারের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘অনুরোধের আসর’-এর সিগনেচার টিউন হিসাবে প্রথম পক্তি বাজানো হত। অনেকেরই সে কথা নিশ্চয় স্মরণে আছে। সত্যদার সব থেকে সুপারহিট গান কমল দাশগুপ্তের সুরে এবং মোহিনী চৌধুরির রচনায় ‘পৃথিবী আমারে চায়…’ এ গানের জাদুমন্ত্রে সলিল চৌধুরী পর্যন্ত দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন। উনি লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে নিজের রচনা রেকর্ড করিয়েছিলেন আর নয় গুন গুন গুঞ্জন…’ ‘ওগো সাথী মোর/খোলো বাহু ডোর/পৃথিবী যে তোমারে চায়।’ বাংলা গানের এমন অনুলিপি খুবই দুষ্প্রাপ্য।
সত্য চৌধুরীর আরও দুটি অসাধারণ গান কমল দাশগুপ্তেরই সুরে। একটি প্রণব রায়ের রচনা ‘যেথা গান থেমে যায়….’ আর একটি মোহিনী চৌধুরির লেখা ‘জেগে আছি একা জেগে আছি কারাগারে’।
দেশকে ভালবাসার অপরাধে কারাবন্দি একটি মানুষের এই মর্মবেদনার বিষয় নিয়ে প্রেমের গান আজও কেউ লেখেননি। মোহিনী চৌধুরী এখানে সত্যিই অদ্বিতীয়। সবাই মোহিনী চৌধুরীর ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে…’ গানটির জয়গান করেন। কিন্তু কেন এ ধরনের আরও দু-একটি গানের কথা উল্লেখ করেন না, আমি ভেবে পাই না। সত্য চৌধুরীর গাওয়া আর একটি বিখ্যাত রেকর্ড কাজী নজরুলের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু…’। ওই সময়টায় সত্যদা কৃষ্ণচন্দ্রের মতো ভাব আর রস এনে গেয়েছিলেন গানটি। সেই গান ঘরে ঘরে আদৃত ছিল।
অজয় ভট্টাচার্য, শৈলেন রায়, প্রণব রায়, মোহিনী চৌধুরি, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, শ্যামল গুপ্ত এবং আমি সবাই ছায়াচিত্রের গল্প লিখেছি চিত্রনাট্যও লিখেছি। কিন্তু ছায়াচিত্রের পরিচালক হয়েছেন গীতিকারদের মধ্যে অজয় ভট্টাচার্য, প্রণব রায় ও মোহিনী চৌধুরি।
‘না’, ‘প্রশ্ন’ ‘ঘুম’, ‘রাতের অন্ধকার’ ইত্যাদি ছবিতে আমি অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থাতেই শ্রীতারাশঙ্কর, নারায়ণ ঘোষ ও চন্দ্রশেখর বসুর সহকারী পরিচালক হিসাবে হাতেনাতে চিত্রপরিচালনার কাজও শিখেছিলাম। পরবর্তীকালে চিত্রপরিচালনার সুযোগও পেয়েছিলাম। কিন্তু ওই প্রস্তাবে সায় দিইনি। স্বয়ং সুচিত্রা সেন, আমায় অসীম পাল মারফত আমার লেখা একটি উপন্যাসের চিত্রনাট্য চেয়েছিলেন, যদি আমি পরিচালনা করতে রাজি হই তবেই। কিন্তু ‘জ্যাক অফ অল ট্রেডস…’ আমি হতে চাইনি। ভয় পেয়েছিলাম। অজয় ভট্টাচার্যের ‘অশোক’, ‘ছদ্মবেশী’ সুপার ডুপার হিট। প্রণব রায়ের ‘মন্দির’ অবশ্য তেমন চলেনি তবুও এটি স্মরণীয় এ কারণে যে এই ‘মন্দির’ ছবিতে এবং প্রণব রায় পরিচালিত আরও একটি ছবি ‘রাঙামাটিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন গায়ক সত্য চৌধুরী। এর সুরশিল্পী ছিলেন সম্ভবত কমল দাশগুপ্ত। এর একটি গান আমি আজও ভুলিনি। গানটি ছিল প্রণব রায়েরই রচনা ‘এ মহাক্ষুধার শ্মশানে আজি’। কী করে জানি না সত্য চৌধুরী হঠাৎ হারিয়ে গেলেন। মানুষ খুব দ্রুত ভুলে গেল এই অসাধারণ শিল্পীকে।
শেষ বয়সে গায়ক সত্য চৌধুরী, বেতারে ঘোষকের ভূমিকায় কিছুদিন কাজ করেছিলেন। এক দিন ঘোষণা করেছিলেন এবারে…শিল্পীর রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠান। গান দুটি রচনা করেছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। এ জন্য আমায় অজস্র টেলিফোন পেতে হয়েছিল। স্বয়ং রেডিয়ো অধিকর্তা আমায় ফোন করেছিলেন এ ধরনের ঘোষণা আমি শুনেছি কি না। আমি শুনেছিলাম তবুও সত্যদার স্বার্থে মিথ্যা বলতে হয়েছিল। বলেছিলাম, না আমি শুনিনি। তখন টেপে আজকের মতো কোনও কাজ হত না। তাই কোনও রেকর্ড মিলল না। তাই রেহাই পেলেন কণ্ঠশিল্পী সত্য চৌধুরী। একবার আমার ভাগ্নে সুশীল চক্রবর্তীর সঙ্গে আমাদের বাড়ি এসেছিলেন উনি। আমার বাবাকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। বাবা আমাদের নিয়ে এখানে বাঁধাঘাট থেকে একটা নৌকো ভাড়া করে গিয়েছিলেন দক্ষিণেশ্বর। গঙ্গা দিয়ে যেতে যেতে সারাক্ষণ গান গেয়ে গিয়েছিলেন সত্যদা। আমায় হয়তো তখন থেকেই ভীষণ ভালবেসে ফেলেছিলেন সত্যদা। দুঃখের কথা, আমার একটা গানও রেকর্ডে গাইতে পারেননি উনি। আমি যখন গানের জগতে প্রতিষ্ঠা পেলাম তখন উনি এ জগৎ ছেড়ে চলে গেছেন বেতারে ঘোষকের কাজে। একেবারে অন্য ভূমিকায়। গায়ক থেকে নায়ক, নায়ক থেকে ঘোষক
তারপর আর কেউই ওঁর খবর রাখল না। আশ্চর্য উদাসীন আমরা।
শিল্পীর এই উত্থান, এই পতন সবই মহাকালের হাতের সুতোয়। কেউ জানে না, কে কখন উঠবে কে কখন তলিয়ে যাবে। তবু সবাই আসে শিল্পী হতে। বুকে আশা আকাঙ্ক্ষা আর চোখে স্বপ্ন। আমি বহু আসা-যাওয়ার নীরব সাক্ষী। মনে পড়ছে কি সেই মেয়েটিকে? খুব চটকদারি চেহারা ছিল। ভালবাসত একটু সাজগোজ করে থাকতে। কলকাতায় তখন বিচিত্রানুষ্ঠানে, পান্না কাওয়াল এনেছিলেন কাওয়ালি গানের বন্যা। শ্রোতারা শুধু হিন্দি নয়, পান্নাবাবুর বাংলা কাওয়ালি গানও রাতের পর রাত, অনুষ্ঠানের পর অনুষ্ঠানে মুগ্ধ হয়ে শুনত। সংগীত জগতে পদার্পণ করেছিল সে তার মধ্যেই। তার মুখেই আমি প্রথম শুনি সেই সময়কার খুবই লোকপ্রিয় গান, যে গানটির রেকর্ড না হয়েও শুধু অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানে সুপার হিট হয়ে গিয়েছিল। সেই যে— ‘বাঁশির যে কথা প্রকাশ হল না/আমি যে বেদনা তার’। তখন মানিকতলা অঞ্চলের এক সংগীত সাধক আপন মনে গান রচনা করতেন, সুর করতেন এবং শেখাতেন। ওঁর নাম ছিল লক্ষ্মণ হাজরা। ওঁরই সৃষ্টি এই গানটি। ওঁর সুর করা অনেক গানই তখন জনপ্রিয় ছিল। ‘আজ নিশিভোরে/ডাকে পাপিয়া পিয়া পিয়া বোলে’ তখন বোম্বে থেকে সদ্য আগত ‘নাল’ ও ‘ঢোলকি’র সঙ্গে ওই গানটি গেয়ে একটি কিশোরী মেয়ে মাত করে দিত আসরের পর আসর। এবার সেই মেয়েটিকে আপনাদের মনে পড়ছে তো? হ্যাঁ, ওর নাম ইলা বসু। বিশিষ্ট প্রেস ফটোগ্রাফার অশোক বসুর স্ত্রী। তার তরুণী কন্যার অকাল প্রয়াণে, ওর শোক সহ্য করতে না পেরে হঠাৎ পৃথিবী থেকে চলে গেল ইলা বসু। এই ক’বছরের ব্যবধানে ওকে আমরা ভুলতে বসেছি। ইলা বসুর গান আমার কিন্তু দারুণ ভাল লাগত। প্রথম ও আমার গান গায় দেবনারায়ণ গুপ্ত পরিচালিত ও খগেন দাশগুপ্ত সুরারোপিত ‘স্বপ্ন ও সমাধি’ ছবিতে। পুজোর রেকর্ডেও নচিকেতা ঘোষের সুরে আমার গান হয়েছে। ওই রেকর্ডটিতে আমার একটি গান লেখার পেছনে, একটা সুন্দর ঘটনা আছে।
৪১
আমার এক বন্ধু প্রচুর পড়াশোনা নিয়ে মেতে থাকত। অনেকগুলো ভাষাও জানত। চেক ভাষাটাও ওর জানা ছিল। একদিন সন্ধ্যাবেলায়, ওর বাড়িতে ওর পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটিয়েই আমি আড্ডা দিচ্ছি। ও হঠাৎ বলল, লিখছিস তো বাংলা গান। ‘থট’-তো সব উর্দু না হয় ইংরাজি নয়তো পুরনো বাংলা গান থেকে নিস। চেক ভাষার একটা কবিতা বলছি শোন। এটা নিয়ে গান লেখ, সুপারহিট হবে। বলে ও একটা চেক কবিতা বাংলাতে অনুবাদ করে আমায় শোনাতে লাগল। ‘ওই লাল ফুলগুলো কী সুন্দর/আকাশটা লাল হয়ে গেছে।/মনে হচ্ছে আকাশটাকে কেউ খুন করে গেছে। ঝরে পড়ছে লাল রক্ত।’
ধ্যাত, আকাশকে কখনও খুন করা যায় নাকি? আকাশের বুক চিরে কখনও লাল রক্ত ঝরে পড়তে পারে? আশ্চর্য, একটা কবিতাকে সুন্দর করতে হলে কত মিথ্যা কথা বলতে হয়।
চেক কবিতাটির ভাবার্থ শুনেই বন্ধুবরকে দুপ্যাকেট সিগারেটের দাম দিয়ে ওখানে লিখে ফেললাম ‘ওই কোকিল শোনায় চৈতি হাওয়ার কথকতা। ওই সবুজ পান্না পরেছে শ্যামল বনলতা। তবু তাই কি কখনও হয়? কোকিল কখনও কথা কয়?/লতা কি পান্না পরে রয়?/আহা গানের লিপিকা সুন্দর করে/কতনা মধুর মিছে কথা।’ নচিকেতা ঘোষের সুরে ইলা বসুর কণ্ঠে আমার এই গানটি সেবার পুজোর একটা হিট গান হয়ে গেল। ওরই উল্টোপিঠে লিখেছিলাম—এতো কাছে পেয়েছি তোমায়/ এতো ছবি নয়ন কোনায়/এতো পাখি গীতালি শোনায়/এতো সুখ মোর সইবে কি!’
ইলা বসুর দুটি সুপার হিট গান নিশ্চয় মনে পড়ছে। দুটিই ছিল শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের সুর। একটি রাখালিয়া সুর আনে মৃদু সমীরণ’, অন্যটি ‘কত রাজপথ জনপথ ঘুরেছি’। যখন আলপনা শ্যামলকে নিয়ে এইচ. এম. ভি.-তে খুব গণ্ডগোল তখন পুরুষ কণ্ঠে এবং মহিলা কন্ঠে মানবেন্দ্র ও ইলা বসুকে দিয়ে ছায়াছবির গানগুলো এইচ. এম. ভি. নতুন করে রেকর্ড করে প্রকাশ করত। যদিও মানবেন্দ্র আর ইলা দুজনেই এতে খুশি ছিল না। তবুও তখনকার গানের জগতে প্রায় মনোপলি এইচ. এম. ভি.-কে কেউ চটাতে সাহল করত না।
সেই সময় আমি ভি বালসারার জীবনে প্রথম বাংলা ছবিতে সুর দেওয়া ‘রাতের অন্ধকারে’ ছবির গান লিখছি। আগেই বলেছি যে ছবিতে আশা ভোঁসলে কলকাতায় এসে টেকনিসিয়ান স্টুডিয়োতে বিখ্যাত শব্দযন্ত্রী সত্যেন চট্টোপাধ্যায়ের সাউন্ড ট্রাকে জীবনে প্রথম বাংলা গান রেকর্ড করেছিলেন। শব্দযন্ত্রটি সেট করা ছিল ভ্যান গাড়িতে। সৌভাগ্যক্রমে আশাজির জীবনে প্রথম বাংলা গান আমিই লিখেছিলাম। ওই ছবিতে অনেক গান ছিল। বাকি গানগুলো আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়ার কথা। খবরটা শুনতে পেয়ে এইচ. এম. ভি.-র পবিত্র মিত্র আমায় জানালেন, আলপনা গাইলে আমরা রেকর্ড করব না। ওই ছবিতে হেমন্তদাও মুম্বই থেকে কলকাতায় এসে, আমার লেখা গান গেয়েছিলেন। রেকর্ড প্রকাশ না হওয়ার আশঙ্কায় অগত্যা বাকি গানগুলো ইলা বসুকে দিয়ে গাওয়ানো ঠিক হল। ইলা বসু পপ ঢঙের গান এবং রোমান্টিক গান দুটোই ভাল গাইল। প্রযোজক পক্ষ স্বভাবতই খুব খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন, জানতামই না এ মেয়েটি এত ভাল কমার্শিয়াল গান গায়। আর একবার, পুজোর জন্য নচিকেতা ঘোষের শ্যামবাজারের বাড়িতে গভীর রাত পর্যন্ত সিটিং করে ইলার দুখানি গান আমরা তৈরি করেছিলাম। একটি ছিল আর ডেকো না/ও কালো কোকিল তুমি আর কেঁদো না’। অন্য গানটি একটি বিখ্যাত বিদেশি লিম্বো রকের স্টাইলে গান। অপূর্ব সুর করেছিলেন নচিকেতা ঘোষ।
আর একবার পুজোয় ইলার গানে সুর দিয়েছিল শ্যামল মিত্র। গান লিখেছিলাম আমি। সেটিও খুব জনপ্রিয়। ‘ছোট্ট করে বলতে গেলে গল্প সে/কথা আমার অল্প যে’। এরপর আরও বহু রেকর্ডে বহু ছবিতে ইলার গান লিখেছিলাম। তার মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য একবার পুজোর গান। আমার লেখা গানে সুর করেছিলেন রবীন চট্টোপাধ্যায়। গানের একপিঠে ছিল ‘কথা কইতে জানা নয়ন আমার ছিল’। উল্টো পিঠের গানটির বেলায় রবিদা আমায় বললেন, দেখ, ইলা আসরে ঠুমরি, গজল, কাওয়ালি দারুণ গায়। এই ধারণাটা মাথায় নিয়ে একটা গান লেখ তো, সুর করি।
তৎক্ষণাৎ বুঝে নিলাম, রবিদা কী বলতে চাইছেন। ওঁর চাহিদা বুঝে লিখে ফেললাম ‘গান ফুরানো জলসাঘরে’। ইলা বসুর এই গানটি আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। শুধু বার বার মনে হয় ইলা গান ফুরানোর জলসাঘরে আমাদের মতো মানুষদের সঙ্গে আরও কিছু বছর থেকে গেলে হয়তো লাভ হত আমাদেরই।
ইলা বসুর দুটি দ্বৈত গান নিশ্চয় অনেকেরই মনে আছে। একটি ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবিতে হেমন্তদার সঙ্গে আর একটি কিশোরদার সঙ্গে ‘সবরমতী’ ছবিতে। তখনকার স্বাভাবিক নিয়মেই, হেমন্তদার গান রেকর্ড হয়েছিল কলকাতায়। কিন্তু উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল তখন কিশোরদার গানও রেকর্ড করা হয়েছিল কলকাতাতেই। একটা জলসা উপলক্ষে কিশোরদা তখন কলকাতায়, সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে নিয়েছিলেন এই ছবির সুরকার গোপেন মল্লিক। খেয়ালি কিশোরদা এক কথায় রাজিও হয়েছিলেন কলকাতায় রেকর্ড করতে। সেই সময়টায় কিশোরদা কলকাতায় এলেই দক্ষিণ কলকাতার এক হোটেলে উঠতেন। ওই হোটেলের সবুজ ঘাসের লনটা এখনকার থেকে আরও বড় ছিল। মুম্বইয়ের অনেকেই এই লনটার আকর্ষণে ওই হোটেলটা পছন্দ করতেন। এমনকী মান্না দেও যখন স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতায় আসতেন, তখন তিনিও উত্তর কলকাতার পৈতৃষ্ণ বাড়ি ছেড়ে মাঝে মাঝে উঠতেন ওই হোটেলেই। একবার কিশোরদা কলকাতায় হঠাৎ এসেছেন খবর পেয়ে, ওঁকে দিয়ে গান করাবার দুরাশায় (দুরাশা বললাম এই কারণেই যে সেই সময় কিশোরদাকে দিয়ে গান করানো দারুণ সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল) হাজির হলাম ওই হোটেলে। তখন সবে সন্ধে নেমেছে। চমৎকার হাওয়া বইছে। বেশ মন মাতানো পরিবেশ। কিশোরদার দরজার সামনে এসে দেখলাম সেখানে ঝুলছে ‘প্লিজ ডোন্ট ডিসটার্ব’। মনটা ভেঙে গেল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। চেনাপরিচিত এক বেয়ারা আমার খুব কাছে এসে গলা নামিয়ে বললে, কিশোরদা হোটেলেই আছেন। লনে বেড়াচ্ছেন। বলবেন না যেন আমরা বলেছি। বলবেন হোটেলের এদিকটায় এসে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল।
আমি বললাম পাগল। এও আবার কেউ বলে নাকি। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। আমি কালবিলম্ব না করে দোতলা থেকে নামলাম সোজা লনে। দেখি আবছা আলো আঁধারিতে কিশোরদা খুব দ্রুত হাঁটছেন। চট করে কেউ বুঝতেই পারবেন না, উনি আর কেউ নন কিশোরকুমার। যাই হোক আমি চিনে ফেললাম। ধরে ফেললাম ওঁকে। পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম, কিশোরদা আমাকে দেখে শুধু বললেন, এই যে পুলকবাবু, কখন এলেন। আর কোনও কথা নয়। কিশোরদার সঙ্গে হোটেলের লনটায় দুপাক ঘুরতেই আমার অবস্থা কাহিল। রীতিমতো হাঁফাতে লাগলাম আমি। তবুও কাজের খাতিরে ঘুরতে হল। হাঁফাতে হাঁফাতে বললাম, কিশোরদা, আপনি মুম্বইতে বললেন কলকাতায় গিয়ে বাংলা গান নিয়ে বসবেন। তাই এসেছি। কিশোরদা আমার দিকে না চেয়েই সেই একই গতিতে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, নতুন গানের সুর চাইছেন তো?.শুনুন নতুন সুর। এ একবারে লেটেস্ট। ঠিক এই রকমই মুখড়া চাই। শুনে নিন। বলেই গলায় কোনও সুর না দিয়ে আবৃত্তির ভঙ্গিতে বলতে লাগলেন, ‘ইনকাম ট্যাক্স, ইনকাম ট্যাক্স, ইনকাম ট্যাক্স, ইনকাম ট্যাক্স…’
আজকে হলে হয়তো এই মুখড়া দিয়ে গান বানাতে পারতাম। এই প্রজন্ম তাকে র্যাপ বলে তা আনন্দে লুফে নিতে পারত। সুপারহিট গান। কিন্তু তখন তো এ সব আমার মগজে আসেনি। আমি বোকার হাসি হেসে বললাম, তা হলে পরে দেখা করব।
কিশোরদা কোনও উত্তর দিলেন না। আরও একবার ঘুরে গিয়ে বলতে লাগলেন সেই একই কথা, ইনকাম ট্যাক্স, ইনকাম ট্যাক্স…’।
আমি শুনেছি ইনকাম ট্যাক্স থেকে বাঁচবার জন্যই নাকি কিশোরদা ‘লুকোচুরি’ ছবি তৈরি করেছিলেন। ভেবেছিলেন, যা খুশি করে ছবি বানাব। ছবি ফ্লপ করবে। লস হবে। বাঁচবে আমার ইনকাম ট্যাক্স
‘লুকোচুরি’ ছবি কলকাতায় মুক্তি পেতেই মুম্বইতে যখন ফোন গেল, ছবি সুপারহিট হয়ে যাবে, কিশোরদা তখন ফ্লোরে শুটিং করছিলেন। ম্যাটিনি শোর রেজাল্ট শুনেই তিনি ধপাস করে শুয়ে পড়লেন স্টুডিয়োর মেঝেতে। চেঁচিয়ে বললেন, পানি। ঢক ঢক করে এক গ্লাস জল খেয়ে বললেন, আবার ইনকাম ট্যাক্স।
এই ‘লুকোচুরি’-র শুটিংয়েই একদিন ইচ্ছে করে কিশোরদা স্টুডিয়োতে এলেন না। শুটিং বন্ধ রইল। ওঁকে যখন সে কথা জানানো হল শুনে বললেন, প্রডিউসরকে টাইট দিতে কী যে আরাম লাগে কী বলব। ওঁকে বোঝানো হল, এটা বাইরের প্রডিউসরের ছবি নয়। আপনার নিজের ছবি ‘লুকোচুরি’। আপনি, আপনাকেই টাইট দিয়েছেন। কথাটা শুনে কিশোরদা সাধকের ভঙ্গিতে দম বন্ধ করে বসে রইলেন।
আমার যতদূর স্মরণে আছে বিখ্যাত সুরকার ও গায়ক শচীন গুপ্তের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন অভিনেতা বিপিন গুপ্ত। বিপিন গুপ্তের ছেলে রবি গুপ্তের মাধ্যমে মুম্বইতে কিশোরদার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। কিশোরদা তখন কেবলমাত্র নিজের অভিনীত চরিত্রেই প্লে-ব্যাক করেন। রাহুল দেববর্মণ তখনও ওঁকে আনতে পারেননি অন্য শিল্পীদের নেপথ্য গায়ক হিসাবে। মুম্বইয়ের একটা স্টুডিয়োতে সেই রবির সঙ্গে দেখা। রবি নিয়ে গেল সে দিনের চিত্রাভিনেতা কিশোরদার সঙ্গে আলাপ করাতে। তখন শুটিংয়ের বিরতি। কিশোরদা, মেকআপ করা অবস্থাতেই, একপাশে চুপচাপ বসে আছেন। রবিকে দেখেই বলে উঠলেন, এই যে রবি ঠাকুর, তোমার গান আমার দারুণ ভাল লাগে। বলেই গাইতে লাগলেন ‘এদিন আজি কোন ঘরে গো/খুলে দিল দ্বার’। আমি শুনলাম কিশোরদার কণ্ঠ আর কে এল সায়গলের কণ্ঠ একেবারে একাকার। কোনও পার্থক্য ধরা পড়ল না।
এবার কিশোরদা আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। রবি সঙ্গে সঙ্গে বলল, কলকাতার গান-লেখক পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। কিশোরদা বললেন, ও হো, মান্নাদার কাছ শুনেছি আপনার নাম। আপনি নাকি ফাটাফাটি প্রেম সংগীত লেখেন? ও সব আমার আসেটাসে না। এই বলেই গলায় ইয়র্সিং করে একলাইন একটা হিন্দি গান গেয়ে বললেন, কী জানেন পুলকবাবু। আমি ভাগলপুর ছাগলপুরে জন্মালে কী হবে, একেবারে গাঁইয়া বনে গেছি।
প্রথম দিন থেকে উনি আমায় প্রায় মুড এলে ‘পুলক’ না বলে ‘পোলাও’ বলে ডাকতেন। আমার ধারণা, যেহেতু কিশোরদা খুবই ভোজন রসিক ছিলেন তাই সব সময় খাবারের নামগুলো ওঁর জিভের ডগায় থাকত।
আমি বললাম, কে বললে আপনি গাঁইয়া বনেছেন? দারুণ তো গাইলেন দুলাইনের রবীন্দ্রসংগীত। সেদিন বোধহয় দারুণ মুডে ছিলেন কিশোরকুমার। আমার কথাটা শুনেই বললেন, ও গান আমার কেন খারাপ হবে? সামনে বসা রবি গুপ্তকে দেখিয়ে বললেন, ও যে ওই রবি ঠাকুরের গান। সায়গলের গাওয়া রবি ঠাকুরের সব গান আমার মুখস্থ। একটুও ভুল হয় না। এই মুখস্থ বিদ্যেটা যদি স্কুলে কাজে লাগাতে পারতাম তা হলে আজ আর আমায় এ রং টং মেখে বসতে হত না। আঃ! দিব্যি আরামসে অফিসার বনে গিয়ে অফিসের ঠাণ্ডা ঘরে নাক ডাকিয়ে ঘুমাতে পারতাম। হল না পোলাওবাবু, তা হল না। এরপর ওপরের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন, সবই ওই ভদ্রলোকের হাত যশ। ওই সময় সহকারী পরিচালক এসে ডাকলেন। বললেন, দাদা লাইট রেডি।
কিশোরদা গাইতে গাইতেই উঠে দাঁড়ালেন ‘আমি তোমায় যত/শুনিয়েছিলাম গান’।
আমি দুচোখ বুজে শুনতে লাগলাম। আমার মনে হল কে এল সায়গল আবার যেন জীবন্ত হয়ে ফিরে এসেছেন। আমি যেন ওঁরই গান শুনছি।
৪২
কিশোরকুমারের সঙ্গে এখানে ওখানে অনেক বারই আমার দেখা হয়েছে। কিন্তু মনে রাখবার মতো দেখা হল সেবার, কিশোরদা যখন অভিনয় ছেড়ে পুরোপুরি প্লে-ব্যাক আর্টিস্ট হয়ে গেছেন। সেইসময় কিশোরদা একদিন আমায় বললেন, পোলাওবাবু ওই ‘এক যে ছিল রাজপুত্তুর’ গানটার মিউজিক ডিরেক্টর বীরেশ্বর সেন—আমি কিশোরদাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, সেন নয় সরকার।
কিশোরদা বললেন, ওই হল। উনি চমৎকারভাবে ইংরাজি ‘ওভার দ্য ওয়েভস’ টিউন থেকে না বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন। বাঙালি একটা দারুণ কথা ব্যবহার করে চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড় ধরা’। জবাব নেই বাঙালির। আপনি মিউজিক ডিরেক্টরকে আমার কনগ্র্যাচুলেশন জানাবেন। এবার আমি বললাম, আপনিও কিন্তু গানগুলো দারুণ গেয়েছেন। আর ওই যে একটা গান ‘কী দারুণ দেখতে’ গানটা তো শুধু আপনার ইন্ট্রোডাকশনে ‘আ-হা’-তে সুপারহিট। কিশোরদা জবাবে বললেন, গাইবার সময় আমি কী ভাবলাম জানেন, ভাবলাম আমি যেন (কিশোরদা ইচ্ছে করেই তালব্য শ’কে দত্ত ‘স’ করে উচ্চারণ করে বললেন) স্যাম্বাজারের সসিবাবু হয়ে বসে আছি, স্যামবাজারের একটা রকে। সামনে দিয়ে এক ঝাঁক মেয়ে কলেজ যাচ্ছে। একটা মেয়েকে দারুণ লাগল। দেখেই বলে উঠলাম ‘আহা! কী দারুণ দেখতে/চোখ দুটো টানা টানা।’
আমি বললাম, কিশোরদা আপনার গান এত প্রাণবন্ত হয় কেন জানেন? আপনি তো প্রথমে একজন অভিনেতা, তারপর একজন গায়ক, তাই। গানের কথা যদি সুর ভরা প্রাণের কথা না হয়, তা কি কোনওদিন শুনতে ভাল লাগে? সুরেলা অভিনয়ই তো আধুনিক গানের সর্বস্ব।
একটু চুপ করে থেকে কিশোরদা বললেন, আমি কিন্তু ও সব সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা-র কিছুই জানি না। গান শিখেছি স্রেফ রেডিয়ো আর রেকর্ড শুনে। আমার কোনও গুরু নেই। কারও কাছে আমি নাড়াটারা বাঁধিনি। আমার গুরু ওই রেডিয়ো আর রেকর্ডের আর্টিস্টরাই। যিনি ভাল গান করেন আমি তারই চেলা। তবে সায়গলসাহেব হলেন আমার গুরু গুরু মহাগুরু।
এরপর কিশোরদা আমার মুখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললেন, কী? চা তো হল এবার একটা সিগারেট চলবে না কি? সবাই তো বলে চায়ের পর সিগারেট নাকি দারুণ জমে। আমি চমকে উঠলাম। সিগারেট? আপনি তো সিগারেট ছোঁন না। এই বাড়িতে, এই গৌরীকুঞ্জে, হঠাৎ সিগারেট এল কী করে? কিশোরদা হেসে বললেন, আমার নয়, আমার সেক্রেটারি-কাম-ড্রাইভার আবদুলের স্টক। ওকে এক মক্কেল দিয়ে গেছে আমেরিকান সিগারেট। আমি বলছি, ও আপনাকে দেবে। আমি বললাম, মাফ করবেন। আমিও আপনারই মতো সিগারেট খাই না।
সিগারেট আর মদিরা সারাজীবনে স্পর্শ করেননি কিশোরদা। মাকে ভীষণ ভালবাসতেন উনি। শুনেছি মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা ছিল ওঁর। আর একজন বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ছিলেন এই গোত্রের, তিনি মহঃ রফি। রফি সাহেবও জীবনে কখনও মদ্যপান করেননি এবং সিগারেট খাননি।
এরপর উল্লেখযোগ্য বিষয় হল রত্না চট্টোপাধ্যায় প্রযোজিত ‘প্রতিশোধ’ ছবির সময়কার ঘটনা। আগে এই প্রযোজিকা অর্থাৎ রত্না যথার্থই ‘কাজল নয়না হরিণী’ ছিলেন। তাই ওঁকে নিয়ে লিখেছিলাম ‘মন নিয়ে’ ছবির হিট গান ‘ওগো কাজল নয়না হরিণী’। এবার মওকা মতো ওঁরই প্রযোজিত কোনও ছবিতে ওই মুখড়ার একটা সুপারহিট গান লিখব। মুখড়াটা হবে ‘ওগো খপিস নয়না বাঘিনী’। সে কথা এখন থাক।
‘প্রতিশোধ’ ছবির পরিচালক ছিল সুখেন দাশ। সংগীত পরিচালক ছিল অজয় দাশ। মান্না দে-র ‘কি বিষের ছোবল দিলি’, আর অরুন্ধতীর ‘ভায়ের কপালে দিলাম ফোঁটা’ এই গান দুটিতে সুর হয়ে যাওয়ার পর আমাদের আরও দুটি গান ছিল যেমন ‘হয়তো আমাকে কারও মনে নেই’ এবং ‘আজ মিলন তিথির পূর্ণিমা চাঁদ’। এ গান দুটির জন্য প্রযোজিকা আর পরিবেশক প্রণব বসুকে অনুরোধ করলাম কিশোরকুমারকে দিয়ে গাওয়াতে। আগেই বলেছি তখন কিশোরকুমারকে দিয়ে গাওয়ানোটা ছিল একটা বিরাট ব্যাপার। প্রথমত ওঁর কাছে সবাই তখন নিষ্প্রভ। এমনকী মহঃ রফি পর্যন্ত। কিশোরকুমারের জয়জয়কার তখন সর্বত্র। একে উনি ব্যস্ত। তার ওপর খেয়ালি। ওঁর সময় আর মেজাজ খুঁজে পাওয়া তখন একটা বিরল সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল। আমাদের সবার অনুরোধে প্রযোজিকা এবং পরিবেশক রাজি হলেন। কন্ডিশন হল আমাকেও মুম্বই যেতে হবে। টেলিফোনে কিশোরদার একটা ডেট নিয়ে, আমরা শুভযাত্রা করলাম মুম্বইতে দুর্গা নাম জপতে জপতে। অবশ্যই যাওয়ার আগে আবদুলকে ফোন করে জানানো হল অমুক দিন আমরা যাচ্ছি।
মুম্বইতে পৌঁছে ফোন করা হল কিশোরদাকে, আমরা এসে গেছি। ফোন ধরল আবদুল। যথারীতি গম্ভীর গলায় বলল, উনি তো এখানে নেই। বাঙ্গালোরে চলে গেছেন। পনেরোদিন পর ফিরবেন। তখন ফোন করবেন।
কথা শেষ করে লাইনটা কেটে দিল। স্বাভাবিকভাবেই সবারই মুখ শুকিয়ে গেল। হঠাৎ একটা আলোর ইশারা দেখতে পেলাম আমি। রত্নাকে বললাম, আপনি ফোন করুন তো। মহিলা কণ্ঠ শুনলে আবদুল একটু বদলিয়ে যায়। ডাকুন ওকে আজকের ডিনারে।
মন্ত্রের মতো কাজ হল। আবদুল যথাসময়ে এসে গেল ডিনারে। তখনই কথা হল। আমরা তো কলকাতা থেকে আপনার ডেট নিয়ে আসছি। তা হলে আবার বাঙ্গালোরটা ঢুকছে কী করে? উত্তরে আবদুল জানাল, কিশোরকুমারের বাঙ্গালোর আর লতাজির কোলাপুর, মুম্বইতে যখন তখন ঢুকে পড়ে। ও সব ভেবে লাভ নেই। ধরে নিন, কিশোরদা বাঙ্গালোর গেছেন। তবে পনেরো দিন না করে ফেরাটা আমি দু দিনে করে দেব। দু দিন বাদে গানের অ্যাডভান্স নয় পুরো টাকাটা নিয়ে আপনারা অমুক সময়ে গৌরীকুঞ্জে আসুন। আর হ্যাঁ, গান দুটোর টেপও সঙ্গে আনবেন। কিশোরদার পছন্দ হলেই তবে গাইবেন।
এরপর ডিনার খেয়ে আবদুল চলে গেল। আমাদেরও দুর্ভাবনা অনেকটা ঘুচল। জমজমাট হয়ে উঠল সে রাতের মজলিশ। ওখানেই কিশোরদার দুর্বলতার একটা টিপস দিলাম। বললাম, যে করেই হোক একদম কড়কড়ে নতুন টাকা নিয়ে যেতে হবে।
পরদিন মুম্বইতে, সব রকম সোর্স কাজে লাগিয়ে, জোগাড় করা হল চকচকে নোটের বান্ডিল। দেখে বুঝলাম, এবার আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন। লোকমুখে শুনেছি কিশোরদা নাকি কৈশোরে টাকা পয়সা একদম হাতে পেতেন না। বোধহয় সেই কারণে পরবর্তীকালে অর্থ উপার্জন তাই একটা নেশাতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। টাকা ছাড়া এক পাও নড়তেন না। পুরো পারিশ্রমিকটি আগে না পেলে, কোনওদিনই কারও রেকর্ডিং-এ আসতেন না। সে যত বড় প্রোডিউসরই হোক আর যত বড় মিউজিক ডিরেক্টরই হোক। কাউকে কোনওদিন তোয়াক্কা করেননি কিশোরকুমার।
নির্দিষ্ট দিনে গৌরীকুঞ্জে যাওয়া গেল। গৌরীকুঞ্জের বাইরের গেটে একটা ছোট ফোঁকর আছে। ওকে ঠিক জানালা বলা যায় না। ওখানে গিয়ে ডাকাডাকি করলে দারোয়ান মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করত, আপনি কে? কী পরিচয়? কেন এসেছেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সব জেনে নিয়ে ওই ফোকরের জানালাটি বন্ধ করে ভেতরে চলে যেত। ভেতরে ঢোকার অনুমোদন এলে বড় গেটটা একটু ফাঁক করে দিত। ভেতরে ঢুকেই মনে হত এটা একটা ছোটখাটো স্থায়ী স্টুডিয়ো। এপাশে ফুল বাগান। ওদিকটায় একটা ছোট্ট নদীর মতো। তার ওপরে ব্রিজ। অন্যদিকে খড়ের চালাঘর। তার ভেতরে ইলেকট্রিকের বাল্ব লাগানো কেরোসিনের হ্যারিকেন ঝুলছে। আর একদিকে টার্জেনের বাড়ির মতো একটা কাঠ আর গাছের পাতার ছোট বাড়ি। কিশোরদা খুশি মতো একদিন, এক এক জায়গায় বসতেন। প্রথম যে গৌরীকুঞ্জের ভেতরে ঢুকবে তারই একটু ধাঁধা লেগে যাবে। তবে ওই দারোয়ানের আনুকুল্য, গৃহস্বামীর অনুমোদন আর ছেড়ে রাখা দুটো ডোভারম্যান কুকুরকে না সরানো পর্যন্ত কারও গৌরীকুঞ্জের ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। তারপর একটু এগিয়ে এলে বাড়ি। কার্পেটে মোড়া ড্রইংরুম। ড্রইংরুমে কিশোরদার প্রিয়জনদের ছবি, আর বিরাট ছবি কুন্দনলাল সায়গলের।
আমি কিশোরদার মুখোমুখি হয়েই বললাম, কিশোরদা বাঙ্গালোর থেকে কবে ফিরলেন?
আবদুলের ইশারা বোধহয় উনি লক্ষ করেননি। তাই বলে উঠলেন, বাঙ্গালোর তো গিয়েছিলাম মাসখানেক আগে। এখন তো এখানেই আছি।
আমাদের অভিজ্ঞ পরিবেশক, এ ব্যাপারে আর কথা বাড়াতে না দিয়ে নতুন নোটের বান্ডিল তুলে দিলেন কিশোরদার হাতে। কিশোরদা কিন্তু নোটগুলো গুনলেন না। নোটের বান্ডিলটা নাকের সামনে নিয়ে গিয়ে শুকলেন। তারপর নির্বিকারভাবে বললেন, নতুন কারেন্সি নোটের গন্ধটা আমার কাছে এক্সেলেন্ট লাগে। এ গন্ধটা আর কোনও কিছুতেই পাই না। কথাটা বললেন কিন্তু গম্ভীরভাবে।
মেহবুব স্টুডিয়োতে রেকর্ডিং হয়েছিল ‘প্রতিশোধ’ ছবির গান। যতদূর মনে পড়ে তখন চিফ রেকর্ডিস্ট ছিলেন বিখ্যাত রবীন চট্টোপাধ্যায়। তখন যিনি ওঁর সহকারী ছিলেন তিনি আজকের মেহবুব স্টুডিয়োর চিফ রেকর্ডিস্ট অভি ঠাকুর। বিখ্যাত বাদ্যযন্ত্রশিল্পী দক্ষিণামোহন ঠাকুরের পুত্র।
মেহবুবের রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে এসে রত্নাকে চুপি চুপি বললাম, একদিনে কিশোরদাকে দিয়ে দুখানা গান করানো খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু যে করেই হোক আমাদের তা করিয়ে নিতেই হবে। নইলে কবে কোন মাসে আবার ডেট পাওয়া যাবে তা স্বয়ং ভগবানও বলতে পারবেন না।
রত্নাকে একটু নিরিবিলিতে সরিয়ে এনে বললাম, প্রথম গানটা রেকর্ড হয়ে গেলে (তখন ট্র্যাক রেকর্ডিং ছিল না) সবাই যখন মশগুল হয়ে গানটা শুনবেন আর কিশোরদাকে বাহবা দেবেন, সেই ফাঁকে কিশোরদা খুঁজে দেখবেন মেহবুবের দুটো সিঁড়ির কোনটা ফাঁকা। যেটা ফাঁকা পাবেন সেই সিঁড়িটা দিয়ে নেমে গিয়ে সোজা পালিয়ে যাবেন। আর ধরতে পারবেন না ওঁকে। তাই প্রথম গানটা যখন সবাই শুনবেন, আমরা দু জনের কেউই তা শুনব না। একটা সিঁড়ি পাহারা দেব আমি আর অন্যটা পাহারা দেবেন আপনি। ব্যাপারটা কাউকে বলবেন না। শুধু আমাদের মধ্যে ব্যাপারটা সীমাবদ্ধ থাক। কিশোরদার কানে পৌঁছে গেলে, উনি পালাবার কী যে ফন্দি বার করবেন, কেউ তা ভাবতে পারবে না।
প্রথম রেকর্ডিং হল ‘হয়তো আমাকে কারও মনে নেই’। কিশোরদা প্রথমে আমার কাছেই বাংলা কথাগুলো শুনে নিয়ে, একটা কাগজে হিন্দিতে লিখে নিলেন পুরো গানটা। বাংলা উচ্চারণগুলো আমার কাছে ঠিক করে নিলেন। অজয়ের কাছ থেকে তুলে নিলেন গানটা। বুঝতে পারলাম, অগ্রিম গানের ক্যাসেট দেওয়াই সার। কিশোরদা এক লাইনও শোনেননি। অর্কেস্ট্রার রিহার্সাল ফাইনাল হওয়ার পর ডাইরেক্ট টেক করতে রেকর্ডিং বুথে ঢুকলেন কিশোরদা। ঢুকে কিন্তু একটা লাইনও গাইলেন না। এদিকে ওদিকে কাকে যেন খুঁজতে লাগলেন। এদিকে বাজনা বেজেই চলেছে। কিশোরদা নীরব। হঠাৎ সেখানে এল সেক্রেটারি আবদুল। আবদুল থামস আপের ভঙ্গিতে বুড়ো আঙুলটা তুলে দেখাতেই সরব হয়ে গেলেন কিশোরদা। গাইতে লাগলেন ‘হয়তো আমাকে কারও মনে নেই।’
আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমার মতো কিশোরদার কাছের মানুষও, আগে এ-ব্যাপারটা জানতাম না। জেনেছিলাম এই ঘটনার পরে।
কিশোরদা রোজই বহু পার্টির কাছ থেকে পুরো টাকা অগ্রিম নিচ্ছেন। তার সব হিসেব থাকত আবদুলের কাছে। গানের সময় কিশোরদা মনে করতে পারতেন না কে পুরো টাকা দিয়েছে, কে দেয়নি। তাই আবদুল ঠিক রেকর্ড করার পূর্ব মুহূর্তেই কিশোরদাকে ওই সাংকেতিক চিহ্ন থামস আপ দেখাতেন। ওই চিহ্ন দেখে কিশোরদা নিশ্চিন্ত মনে রেকর্ডিং-এ ওই কণ্ঠস্বর দিতেন।
প্রথম গানটা রেকর্ড হয়ে গেল। সবাই শুনতে লাগল। আমি এসে দাঁড়ালাম মেহবুবের কাঠের সিঁড়ির মুখে কিশোরদাকে ধরব বলে। কিশোরদা পালাবার জন্য সিঁড়িতে এলেন না। যাক ফাঁড়া কেটে গেল। খুশি মনে থিয়েটারে ঢুকতেই আমাকে দেখে রত্না হেসে গড়িয়ে পড়লেন। আমি বললাম, কী হল? রত্না হাসতে হাসতে বললেন, ওই সিঁড়ি দিয়ে কিশোরদা পালাচ্ছিলেন। একেবারে হাতেনাতে ধরেছি। বলছিলেন, জল খেতে যাব। আবদুলকে বলেছি গাড়ি থেকে জল এনে দিতে।
দ্বিতীয় গান মানে ‘মিলনতিথির পূর্ণিমা চাঁদ’ রেকর্ড করার জন্য আর্টিস্ট বুথে ঢুকে গম্ভীরভাবে বললেন, পোলাওবাবু এ আপনারই কাজ। না হলে ভদ্রমহিলা কী করে জানবেন আমি ওই সিঁড়ি দিয়ে কেটে পড়ব? গানটা শেখানো শেষ হতে দেখলাম ওঁর রাগটা কেটে গেছে।
বললেন, গানটা আপনি দারুণ লিখেছেন। একেবারে তাল মিছরির মতো মিষ্টি।
‘মিলনতিথির পূর্ণিমা চাঁদ’ গানটির দ্বিতীয় পঙক্তিতে ছিল ‘অনেক দিনের হারানো সুখ পেলাম যে আবার’। কিন্তু কিশোরদা রিহার্সালে গাইতে লাগলেন, ‘অনেক দিনের হারানো সুর পেলাম যে আবার’। রেকর্ডিং মাইক দিয়ে যতবার বলি ওটা ‘সুর’ নয় ‘সুখ’ হবে, কিশোরদা ততবারই ‘সুরটাই বলে বসেন। শেষে বুথে ঢুকে গিয়ে বললাম, ওটা হবে হারানো সুখ। কিশোরদা গানের কাগজে সেটা লিখে নিলেন। তারপর হাসতে হাসতে বললেন, উত্তমকুমারের ‘হারানো সুর’ দেখে ওই সুরটাই মুখে এসে যাচ্ছিল। আপনি উত্তমকুমারকে আমার কনগ্র্যাচুলেশন জানাবেন।
৪৩
কিশোরদাকে নিয়ে কথা শুরু করলে সে আর শেষ হওয়ার নয়। এবার কলকাতার একটা ঘটনা বলি। এই কলকাতায় কিশোরদাকে দেখলাম নতুন রূপে। লোকমুখে কত কী কথা শুনেছিলাম। শুনেছিলাম কিশোরকুমার, রুমা গঙ্গোপাধ্যায়ের বিবাহ বিচ্ছেদের পর রুমাদেবী নাকি কিশোরদার ফিয়াট গাড়িটা নিয়ে এবং সুটকেশ ভর্তি নোটের তাড়া নিয়ে কলকাতায় এসে উঠেছিলেন। এরকম কত আজগুবি রটনা। কলকাতায় এসে রুমাদেবী মুদিয়ালির যে ফ্ল্যাটে উঠেছিলেন, সেই ফ্ল্যাটে আমি আর ভূপেন হাজারিকা গিয়েছিলাম রুমাদেবীকে দিয়ে প্রথম আধুনিক গান রেকর্ডের জন্য গান তোলাতে। লোকমুখে শুনেছিলাম রুমাদেবী বিয়ে করছেন অরূপ গুহঠাকুরতাকে। এবং রুমাদেবীর টাকায় তৈরি হচ্ছে বাংলা ছবি ‘বেনারসী’। তারপর সত্যিই ওঁদের বিয়ে হল। রুমাদেবী চলে গেলেন অরূপ গুহঠাকুরতার বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়িতে। স্বভাবতই ওইসব রটনা শুনে ধারণা হয়েছিল রুমাদেবী আর কিশোরদার সম্পর্ক খুব তিক্ত। কিশোরদা তখন বিয়ে করেছেন মধুবালাকে।
যাই হোক সেবার আমাদের পাড়ার ক্লাবের জলসায় রুমাদেবীকে শিল্পী হিসেবে নিয়েছিলাম। সেদিন আমি গিয়েছিলাম পারিশ্রমিকটা রুমাদেবীর হাতে পৌঁছে দিতে। নীচেই অরূপবাবুর সঙ্গে দেখা। ঘনিষ্ঠ আলাপ ছিল আমাদের মধ্যে। আমি বললাম, রুমাদেবী আছেন তো?
অরূপবাবু বললেন, হ্যাঁ। আপনার টেলিফোন পেয়ে অপেক্ষা করছে। সিঁড়ি দিয়ে সোজা চলে যান ওপরে।
আমি ওপরে গেলাম। রুমাদেবীর দরজায় টোকা দিলাম। রুমাদেবী নিজেই দরজা খুলে দিলেন। আমি ঘরের ভেতরে এসে অবাক! দেখি ঘরে বসে আছেন কিশোরদা। চমকে উঠতে হল। এমনটি দেখব ভাবতে পারিনি। আসলে কিশোরদা পৃথিবীতে সবথেকে ভালবাসতেন ওঁর প্রথম সন্তান, রুমাদেবীর পুত্র অমিতকুমারকে। ছোট অমিত তখন থাকত রুমাদেবীর কাছে। পড়াশোনা করত কলকাতাতেই পাঠভবনে। শুধু অমিতকে দেখতে, ওর খোঁজ-খবর নিতেই যখন তখন কিশোরদা চলে আসতেন কলকাতায়। সেদিন কিশোরকুমারের মধ্যে একটা নতুন রূপ আমার চোখে ধরা পড়ল। গায়ক, অভিনেতা, পরিচালক, এসব নয়। আমি দেখলাম পিতা কিশোরকুমারকে। ছেলেকে দেখবার জন্য তিনি নির্দ্বিধায় চলে এসেছেন প্রাক্তন স্ত্রীর বাড়িতে।
এরকম আর একটা ঘটনা দেখেছিলাম উত্তমকুমারের ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে। সেদিন সন্ধ্যায় ওখানে গিয়ে দেখি, উত্তম-সুপ্রিয়ার সঙ্গে আড্ডায় মশগুল সুপ্রিয়ার প্রাক্তন স্বামী বিশু চৌধুরী। বিশু চৌধুরীর সঙ্গে আমার যথেষ্ট পরিচয় ছিল। উনি আমাকে আন্তরিকভাবেই সহাস্য মুখে বসতে বললেন। উত্তম আমায় বলল, মামা (উত্তম আমাকে মামা বলত। সুপ্রিয়া আমাকে এখনও মামা-ই বলে) আজ রাতটা থেকে যাও। অনেকদিন বাদে জমিয়ে আজ আড্ডা হবে।
সুপ্রিয়াকে উত্তম বলল, বেণু, মামাকে আমার একটা ধুতি দাও। আর বিশুবাবুও থাকবেন, ওঁকে আমার একটা পায়জামা দাও। আমি অবাক হয়ে এক পলকের জন্য উত্তমের দিকে তাকিয়ে রইলাম শুধু। তারপরই এগিয়ে গেলাম বাড়িতে ফোন করে আমার রাত্রিবাসের কথা জানাতে।
সেবার সম্ভবত সুজিত গুহের ‘দাদামণি’ ছবিতে আমার লেখা কিশোরদার কণ্ঠে ‘এই তো এসেছি আমি/তোমার দাদামণি’ গানটা করতে সুরকার অজয় দাশ মুম্বই যাবে ঠিক হল। আমি অন্য কী একটা কাজে ব্যস্ত থাকায় বললাম, আমি পরে যাব। তখনই এসে গেল দীপ্তি পাল। ওঁদের প্রোডাকসনসের প্রথম ছবির পরিচালক দীপরঞ্জন বসুর পরিচালনায় ‘পারাবত প্রিয়া’ ছবিতে গান লেখার জন্য। প্রযোজক দিলীপ পাল চিত্রনাট্য শোনালেন। চিত্রনাট্য শোনাবার পর আজ এক সংগীত পরিচালকের নাম বলেন, পরের দিন আবার অন্য এক সংগীত পরিচালকের নাম বলেন। শেষ পর্যন্ত উনি সংগীত পরিচালক নিলেন বেহালাবাদক দিলীপ রায়কে। যথাসময়ে দিলীপ রায়ের সুরে ছবির একটা গান আমি লিখেও ফেললাম। সে গানটি কলকাতাতে রেকর্ড হয়ে গেল। গাইল অমিতকুমার। তারপরই দিলীপ পালের সঙ্গে দিলীপ রায়ের বোধহয় মতানৈক্য হল। উনি আমায় জানালেন দিলীপবাবুকে দিয়ে বাকি গান আর করাব না। করবেন ‘অমুক’ মিউজিক ডিরেক্টর। পরদিন আর এক মিউজিক ডিরেক্টরের নাম করে বললেন, আসুন আজ ওঁর সঙ্গে ফাইনাল করব। গেলাম ওঁর বাড়ি। গাড়িতে উঠেই বললেন, আচ্ছা অমুককে নিলে কেমন হয়? আমি কোনও উত্তর না দিয়ে ড্রাইভারকে সোজা যেতে বললাম বৌবাজার। অজয় দাশ তখন বৌবাজারে থাকত।
দিলীপবাবু আমার অনুরোধে অজয় দাশকে নিলেন ‘পারাবত প্রিয়া’ ছবির সংগীত পরিচালক হিসাবে। ‘পারাবত প্রিয়া’র গান আমি অজয়ের সঙ্গে বসে তৈরি করেছিলাম রাসবিহারী রোডের বাণীচক্রের চারতলায় বসে। আমরা তিনটে গান বানিয়েছিলাম। ঠিক হল, একটি গাইবেন আরতি মুখোপাধ্যায়। আর একটি গান গাইবেন আশা ভোঁসলে। আর তিন নম্বর গানটি গাইবেন কিশোরকুমার। কিশোরদার গানটি ছিল ‘অনেক জমানো ব্যথা বেদনা/কী করে গান হল জানি না’। অজয় দাশকে বললাম, ভালই হল, তুমি তো আমাদের ‘দাদামণি’র গান করতে মুম্বইতে যাচ্ছই তখনই কিশোরদার একটা ডেট নিয়ে আমায় ফোন করো। দিলীপবাবু, দীপ্তিদেবী, আমরা হাজির হয়ে যাব।
যথাসময়ে আমরা হাজির হলাম। ‘পারাবত প্রিয়া’-র রেকর্ডিং-এর সময় কিশোরদাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার লেখা ‘দাদামণি’র গান কেমন লাগল। কিশোরদা ভ্রু কুঁচকে বললেন, দাদামণি আবার নতুন গান গেয়েছেন নাকি? শুনিনি তো! বুঝলাম ‘দাদামণি ‘ কথাটা বলতে উনি বুঝেছেন ওঁর অগ্রজ অশোককুমারকে। আমি সেটা বুঝে নিয়ে বললাম, না না। দাদামণি ছবির গানের কথা বলছি। কিশোরদা বললেন, ও তাই বলুন। বেশ ভাল।
এই দাদামণিকে নিয়ে কিশোরদার দারুণ একটা কাহিনী আছে। একবার দাদামণি অর্থাৎ অশোককুমারের খুবই পরিচিত এক প্রযোজক, কিশোরদাকে একটা ডেট এবং কম টাকার পারিশ্রমিকের জন্য দাদামণিকে অনুরোধ উপরোধ করেন। দাদামণি জানতেন কিশোরকুমার ওঁর কথায় একটা ডেট খুব তাড়াতাড়ি দিয়ে দেবেন। কিন্তু টাকা পয়সা? পারিশ্রমিকের বেলায়, কিশোরদা যে অনড় অটল সেটা চিত্র জগতের সবারই জানা ছিল। তাই দাদামণি এ ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি হলেন না। কিন্তু প্রযোজক কিছুতেই শুনবেন না। একেবারে নাছোড়বান্দা। অগত্যা দাদামণি বাধ্য হয়ে ভদ্রলোককে বললেন, আচ্ছা আমি কিশোরকে হাফ প্রাইসে গাইবার জন্য বলব। ভদ্রলোক তাতে মহাখুশি।
অনতিবিলম্বে কিশোরদার সেক্রেটারি আবদুল দিয়ে দিলেন কিশোরদার একটি মহামূল্যবান ডেট। নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে কিশোরদা গান গাইতে ঢুকলেন স্কোরিং থিয়েটারে। প্রযোজক ভদ্রলোক সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। গর্বে আনন্দে উনি আর কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না।
কিশোরদা সংগীত পরিচালকের কাছ থেকে গান তুললেন। রিহার্সাল করলেন। রেকর্ডিং শুরু হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে অভ্যাসমতো আবদুলের আঙুলের দিকে তাকালেন। দেখলেন থামস আপের আঙুল সবটা ওঠেনি। অর্ধেকটা উঠেছে। তার মানে গানের টাকা আবদুল পেয়েছে অর্ধেক। কিশোরদা তো নির্দ্বিধায় গান গাওয়া শুরু করলেন। প্রযোজক ভদ্রলোক দুহাত জোড় করে মুম্বইয়ের জাগ্রত দেবতা, সিদ্ধি বিনায়ক গণেশকে প্রণাম ও সেরে ফেললেন। ফাইনাল টেক শুরু হল। অপূর্ব গাইলেন কিশোরদা, কিন্তু ও কী! সবাই সবিস্ময়ে দেখলেন, কিশোরদা অর্ধেকটা গান গেয়ে গান বন্ধ করে দিয়েছেন। হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে গেল স্কোরিং থিয়েটার। কাউকে কিছু বলার বা প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে কিশোরদা বলে উঠলেন, আমার গান শেষ। আমি অর্ধেকটা গেয়েছি। বাকিটা গাইবেন দাদামণি।
এই ছিলেন কিশোরকুমার। এখন আবার ফিরে আসি ‘পারাবত প্রিয়া’-র ওই ‘অনেক জমানো ব্যথা বেদনা’ গানের প্রসঙ্গে। যথারীতি আমার কাছ থেকে গান লিখে নিলেন কিশোরদা। সুর তুললেন অজয়ের কাছে। কিন্তু গাইবার সময় গাইতে লাগলেন অনেক/জমানো ব্যথা বেদনা’। অর্থাৎ ‘অনেক’-এর পর ছেদ তারপর আবার জমানো ব্যথা বেদনা। অজয় আর আমি দুজনেই আপত্তি জানাতে ঢুকে পড়লাম রেকর্ডিং বুথে। বললাম, না। অনেক জমানো ব্যথা বেদনা একসঙ্গে বলতে হবে।
কিশোরদা তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন, কেন? আমি তো গেয়েছি, ‘এক দিন/পাখি উড়ে…’। অজয় দাশ একগাল হেসে স্মার্টলি জবাব দিল, ও গানটা সুপারহিট হলেও ও গানের পাখিটা উড়িষ্যার পাখি হয়ে গেছে।
আমি বললাম, ঠিক তাই। আপনি তো গেয়েছেন ‘এ মুকন্দর/কা সিকন্দর’। পারফেক্ট স্ক্যানিং-এ যা হওয়া উচিত ছিল ‘এ মুকন্দর কা/সিকন্দর’। এবং এটাও হয়তো সুপারহিট।
এবার কিশোরদা হেসে ফেললেন। আমি বললাম, লাভ কী? রবীন্দ্রনাথের বাংলা গানের দেশে শুধু শুধু স্ক্যানিং-এর এই ভুলটা রেখে
কিশোরদা মেনে নিলেন। সামনে ঝোলানো গানের কাগজটাতে একটা আঁচড় কাটলেন। রেকর্ডিং শুরু হওয়ার আগে কিশোরদা আর একটা রিহার্সাল চাইলেন। আবার গাইলেন গানটা। আমি তখনও বুথের ভেতরে দাঁড়িয়ে। সুরের কী একটা ভুল হতে, অজয় রেকর্ডিং মেশিনের কাছ থেকে মাইক্রোফোনে সেটা গেয়ে দেখিয়ে দিল সেটা কেমন হবে। কিশোরদা বলে উঠলেন, বার বার এ জায়গাটাতে আমার ভুল হচ্ছে। দাঁড়ান। লিখে নি।
কিশোরদা আমার কলমটা চেয়ে নিয়ে গানের কথার উপর সেটা লিখে নিলেন। মুহূর্তে অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম আমি। কিশোরদা একদিন বলেছিলেন, গান শুধু গাইতে জানি। গানের ও-সব গ্রামার ট্রামার, ওই সব সারে গামা টামা আমি কিছুই জানি না।
অথচ আমি স্বচক্ষে দেখছি কিশোরদা হুবহু মান্নাদার মতো গানের কথার ওপর শর্টহ্যান্ড স্বরলিপি লিখে রাখলেন। কিশোরদা তা হলে মুম্বইয়ের চলতি কথায় ছুপা রুস্তাম। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম। কিশোরদা আমার দিকে তাকিয়েই একমুখ হেসে বলে উঠলেন, না না। আমি ওসব শর্ট হ্যান্ড নোটেশন ফোটেশন জানি না। ওসব মান্নাদা জানেন। আমি শুধু লিখে নিলাম। আপনার এই ব্যথা বেদনার শেষ লাইনটাতে ‘বুঝেও কেন বুঝল না সে/কী আমার শুভ কামনা।’ এই ‘শুভ কামনা’-য় আমার গলাটা কেমন ঘুরবে, এই দেখুন কোনও নোটেশন আমি লিখিনি, শুধু শুধু কামনা’ শব্দটার নীচে একটা গোল দাগ টেনে দিয়েছি। আমি ভাই ও-সব ব্যাকরণ শিখিনি কোনওদিন। দেখলাম গানের কাগজে মান্নাদা যেমনভাবে স্বরলিপির আঁচড় দেন, কিশোরদাও তেমনি আঁচড় দিয়েছেন। তবে সেগুলো ওঁর নিজস্ব আঁকিবুকি। সেবার গানের কাগজটা আনতে পারিনি। পরের বার দীপ্তি পালের অনুরাগের ছোঁয়া’ ছবির ‘আমি যে কে তোমার’ গানের সময় শ্রীমতি দীপ্তি পাল ওই গানের কাগজটা নিয়ে এসেছিলেন।
এবার মনে আসছে ‘জীবন মরণ’ ছবির সময়কার ঘটনা। অজয়ের সুরে আমার লেখা গান (১) ওপারে থাকব আমি তুমি রইবে এপারে’ (২) আমার এ কণ্ঠ ভরে/বাজে গো যে সুর বাহার’ ইত্যাদি গান শুনে সবাইকে চা খাইয়ে দিলেন।
কিশোরদাও ছিলেন খানিকটা শচীনদেব বর্মণের মতো। খুব বেশি আপনজন না ভাবলে চট করে কাউকে চা খাওয়াবার খরচাটা করতেন না। কিশোরদা নিজেও খুব খেতে ভালবাসতেন। বিশেষ করে বাঙালি রান্না। একবার কমল ঘোষের বালিগঞ্জের বাড়িতে কিশোরদা নিমন্ত্রণে এসেছিলেন। বন্ধুবর কমল ঘোষও খেতে এবং খাওয়াতে ভালবাসতেন। কিশোরদার জন্য অনেকগুলো বাঙালি পদের রান্না হল। তার মধ্যে ছিল কিশোরদার অতি প্রিয় মাগুর মাছ। খেতে বসে বিশাল পর্ব দেখে কিশোরদা একটু থমকে গেলেন। কমল বলল, না না, কিশোরদা। খাওয়াতে জোর করব না। যেটা পারবেন, যতটা পারবেন, তাই খাবেন। বাকিটা পড়ে থাকবে। কিশোরদা বেশ রাগত চোখে কমলের দিকে তাকালেন। ওইভাবে তাকিয়ে থেকে বললেন, পড়ে থাকবে মানে? কিচ্ছু পড়ে থাকবে না। কিচ্ছু পড়ে থাকতে দেব না। ভারতবর্ষে খাবার নষ্ট করা মহা পাপ। এই পাপ আমাদের করা উচিত নয়।
৪৪
কিশোরদাকে নিয়ে বলতে শুরু করলে সে বলা সহজে শেষ হওয়ার নয়। এবার শুনুন ‘মিলন তিথি’ ছবির সময়কার ঘটনা। কিছুদিন আগেই আমি অন্য একটা কাজে মুম্বই গিয়েছিলাম। কিশোরদার তো গানের জন্য ডেট নেওয়া হয়েই গিয়েছিল। তবুও ভাবলাম আর একবার ঝালিয়ে নিই। বলে যাই, আমরা সদলবলে অমুক তারিখে আসছি। দারুণ দাঁড়িয়েছে ‘মিলন তিথির’ গান, আপনার ভাল লাগবে।
সকালে ফোন করলাম। ও প্রান্ত থেকে মহিলা কণ্ঠে প্রশ্ন এল, আপনি কে?
আমি নাম বললাম।
মহিলা বললেন, দাদা এখন ফরেনে। ভারতবর্ষের বাইরে। ফিরতে দেরি হবে।
স্বাভাবিকভাবেই মনটা ভেঙে গেল। তা হলে আমার গানের রেকর্ডিংটা কি হবে না। অন্য কেউ গাইলে এ গান যে মোটেই দাঁড়াবে না। কী করা যায়?
ভাগ্যের ওপর ব্যাপারটা ছেড়ে দিয়ে আবার বিকেলবেলা কিশোরদাকে ফোন করলাম। এবার খুব ভারী গলায় চোস্ত উর্দুতে প্রশ্ন এল, আপনি কে?
আমি নাম বললাম।
এবার উত্তর এল, উনি এখন ব্যাঙ্গালোরে। কবে ফিরবেন বলতে পারছি না।
প্রথমবার শুনলাম ফরেন। আর এবার শুনলাম ব্যাঙ্গালোর। মনের মধ্যে খটকা লাগলেও মেনে নিতে হল। সত্যি হয়তো কিশোরদা ‘মিলন তিথি’ রেকর্ডিং-এর সময় মুম্বইতে থাকবেন না।
ঘটনাচক্রে সেই সন্ধ্যাতেই বাপি লাহিড়ির সঙ্গে একটা বিশেষ প্রয়োজনে দেখা করতে গেলাম সানি স্টুডিয়োতে। গিয়ে দেখি বাপি লাহিড়ির কী একটা হিন্দি ছবির রেকর্ডিং চলছে। গায়ক আর কেউ নন স্বয়ং কিশোরকুমার। আনন্দ উচ্ছ্বাসে উদ্ভাসিত হয়ে গেল আমার মন। কিশোরদাকে একটু ফ্রি পেতেই বললাম, আজ দু-দুবার আপনাকে বাড়িতে ফোন করেছি। একজন বললেন, আপনি ফরেনে। আর একজন বললেন, আপনি ব্যাঙ্গালোরে। অথচ আপনি তো এখানেই রয়েছেন।
আমি দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। কিশোরদা অম্লানবদনে বললেন, দুবারই আমি ফোন ধরেছিলাম। দুবারই শুনেছিলাম আপনার নাম। কিন্তু টেলিফোনে তো ছবি দেখা যায় না। কী করে জানব আপনিই আসল পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়? আচ্ছা বলুন তো, কোনও রামহরি সমাদ্দার বা আপনার বাড়ির রাস্তা শ্রীরাম ঢ্যাং রোডের কোনও জড়ভরত ঢ্যাংও তো পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় নাম বলে ফোনটা করতে পারেন। আমি কি এতই বোকা। ওইসব দু নম্বরিদের সঙ্গে কথা কইব?
আমি তখন বাধ্য হয়ে কিশোরদাকে বললাম, তা হলে আপনার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলব কেমন করে?
কিশোরদা গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন, আবদুল ফোন ধরলে কোনও ব্যাপার নেই। কিন্তু ব্যাপারটা আমি নিজে ধরলে। আচ্ছা একটা ‘কোড’ আপনাকে আমি বলে দিচ্ছি। এদিক থেকে হ্যালো শুনলেই আপনি টেলিফোনের মাউথপিসে তিনবার হাততালির আওয়াজ দেবেন। তা হলেই বুঝব আপনিই সত্যিকারের পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।
যাই হোক, যথাসময়ে কিশোরদা গাইলেন আমার লেখা এবং অজয় দাশের সুর দেওয়া ‘মিলন তিথি’ ছবির গান। ওই ছবিতে কিশোরদা কেমন অপূর্ব গেয়েছিলেন তা আপনারা সকলেই জানেন। এ ছবিতে আশা ভোঁসলে এবং আরতি ছাড়াও কলকাতার একটি নতুন ছেলে বেশ ভাল গেয়েছিল।
ছেলেটির নাম পরিমল ভট্টাচার্য। গানটি ছিল ‘চেনাতে কি আর দেরি লাগে— ঝিকমিকে হীরে ফুল কোনটি? মোর বোনটি’ পরিমলের গানটা হিট করেছিল ঠিকই কিন্তু কেন জানি না ও আর তেমন সুযোগ পেল না।
হেমন্তদা যেমন বলতেন সবই উপরওয়ালার হাত। হয়তো তাই।
সেদিন কিশোরদাকে নিয়ে আরও একটি ঘটনার কথা শোনাল বাপি লাহিড়ি। বাপির সুরে একটি হিন্দি ছবিতে কিশোরদা গান গাইবেন ঠিক হল। প্রযোজক মাদ্রাজের। ওই প্রযোজকের আগের ছবিতেও কিশোরদা গান গেয়েছেন। ওই প্রযোজক ভদ্রলোক বাপিকে বললেন, কিশোরদার টাকাটা আমি একটু কমিয়ে ম্যানেজ করে নেব। আমার সঙ্গে ওঁর দারুণ টার্মস। উনি নিশ্চয় সস্তায় করবেন।
রেকর্ডিং-এর দিন যখন বাপি দেখল সময় গড়িয়ে যাচ্ছে অথচ কিশোরদা আসছেন না তখন প্রযোজক কিশোরদাকে ফোন করে শুনতে পেলেন কিশোরদা মুম্বইতে নেই। প্রযোজক মশাই বুঝলেন এটা কিশোরদার তথাকথিত একটা বাংলা ‘গুল’। উনি আর কালবিলম্ব না করে গাড়ি নিয়ে হাজির হয়ে গেলেন কিশোরদার বাড়ি গৌরীকুঞ্জে। ঘটনাচক্রে তখনই কিশোরদাকে নিয়ে আবদুলের গাড়ি গেট দিয়ে বার হচ্ছিল। দুটো গাড়িতে মুখোমুখি দেখা। ভদ্রলোক গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে চেঁচিয়ে উঠলেন, নমস্কার কিশোরকুমারজি। কিশোরদা গাড়ির ভেতর থেকে জবাব দিলেন, জি সাব, আমি কিশোরকুমার নই, অনুপকুমার।
এবার উপায়ান্তর না দেখে বাকি পুরো টাকাটা আবদুলের হাতে দিয়ে দিলেন প্রযোজক ভদ্রলোক। আবদুল গুনে নিয়ে যথারীতি আঙুলের মুদ্রায় ‘থামস আপ’ করল। কিশোরদা সংকেত দেখে নিয়ে ভদ্রলোককে বললেন, দেখুন পি সি সরকার মশাই, কী কাণ্ডটা করলেন। আমি এখন আর অনুপকুমার নই। আমি কিশোরকুমার। চলুন রেকর্ডিং থিয়েটারে।
এরপর আমার যে গান কিশোরদার কণ্ঠে খুবই জনপ্রিয়, সেটি হল মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে ‘সন্ধ্যাপ্রদীপ’ ছবির গান। ওই ছবিতে আমি অনুপ জলোটাকে প্রথম বাংলা গান গাইতে রাজি করিয়েছিলাম। গানটি ছিল—’হে মহাদ্যুতিং দিবাকর/সর্ব পাপ তাপ হর!
কিশোরদার গানটি লেখার সময় ওই ছবির চিত্রনাট্যকার অঞ্জন চৌধুরী আমায় বলেছিল, এ গানটি লিখতে আপনার গান আপনাকেই চুরি করতে হবে। অঞ্জনের কথা শুনে আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। অঞ্জন পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়ে আমায় বলল, আপনার লেখা মান্নাদার ওই গানটি তুমি অনেক যত্ন করে আমায় দুঃখ দিতে চেয়েছো/ দিতে পারনি’-র মতোই একটা গান লিখে দিতে হবে। আমি লিখেছিলাম ‘মুখেতে বললে তুমি যে কথা/ সেকথাই শেষ কথা কি…’
ওই ছবিতে আরও একটি রেকর্ড, চিত্রা সিংহের প্রথম বাংলা প্লে-ব্যাক। চিত্রা-জগজিৎকে নিয়ে পরে অনেক কথা বলব।
এই ছবিতে চিত্রার গানটি ছিল ‘আমি তোমার চিরদিনের’। অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটিয়ে আমার অনেক গানই কিশোরদা গেয়েছেন। কিন্তু এখন মনে আসছে আমার লেখা ওই সুপার ডুপার হিট গানটির কথা ‘চিরদিনই তুমি যে আমার/যুগে যুগে আমি তোমারই…’। ‘অমরসঙ্গী’ ছবিতে বাপি লাহিড়ির সুরে কিশোরদার মতো ও গানটি আশা ভোঁসলেও গেয়েছেন। উনি এখনও ও গানটি ভুলতে পারেননি। তাই বোধহয় এবারে ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, ইডেনের স্টেডিয়ামে আমার ওই বাংলা গান সারা পৃথিবীকে শুনিয়ে দিলেন আশা। এজন্য ও গানের গীতিকার হিসাবে নিশ্চয়ই আমি ধন্য। ‘অমরসঙ্গী’র ওই গানটা গাওয়ার পর কিশোরদা আমার কানের কাছে মুখটা নামিয়ে এনে বলেছিলেন, নিশ্চয়ই খুব লভ টভ করেন। নইলে এমন লভ সঙ লিখলেন কী করে।
অজয় দাশের সুর করা, কিশোরদার আমার আরও কিছু প্রিয় গানের কথা এখন মনে পড়ছে। যেমন ‘দেনা-পাওনা’ ছবির ‘তুমি স্বর্গের দেশ থেকে পাঠানো একটা ফুল’। ‘অভিমান’ ছবির ‘দুজনাতে লেখা গান’, ‘পাপ-পুণ্য’ ছবির ‘ভালবাসা ছাড়া আর আছে কি’। এ গানটি লিখেছিলাম একজন নামী শিল্পীর পুজোর গান হিসেবে। শিল্পীর এটি অপছন্দ হওয়াতে এই ছবিতে লাগিয়ে দিলাম। এ গানটি লিখেও কিশোরদার কাছ থেকে আমি এক নম্বর প্রেমিকের অলিখিত সার্টিফিকেট পেয়েছিলাম। বাপির সুরে আশা ভালবাসা’ ছবিতে কিশোরদার জন্য দুটি গান লিখেছিলাম। ওতে একটি গান ছিল ‘নটবর নাগর তুমি/আর করোনা মস্করা’। আর একটি গান ছিল ‘আমায় ফুলের বাগান দিয়ে নিয়ে যেও না’। এ গানটি গাইবার সময় আমি এক বিপর্যন্ত কিশোরকুমারকে দেখেছিলাম।
রেকর্ডিং-এর সময় কিছুতেই ঠিকভাবে গাইতে পারছিলেন না কিশোরদা। প্রায় দু ঘণ্টা ওভারটাইম হয়ে গেল। তবুও গানটা হল না। আমরা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। শেষটায় কিশোরদা বললেন, বাপি আমি পারব না। গানটা দারুণ। নষ্ট করে লাভ নেই। তুই নিজেই গেয়ে দে।
বাপি বলল, তা হতে পারে না কিশোরমামা। কালকে আমারই রেকর্ডিং ডেট আছে। কাল আবার আপনি ট্রাই করবেন।
হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। বাপিকে বললাম, তুমি বরং মিউজিকট্র্যাকের উপরেই এ গানটা গেয়ে দাও। কিশোরদা বাড়িতে যাওয়ার সময় গাড়িতে শুনুন। বাড়িতে গিয়ে আবার শুনুন। ঠিক গলায় বসে যাবে গানটা। কিশোরদা সায় দিয়ে বললেন, তাই করে দে বাপি। তারপর বিড়বিড় করে নিজের মনেই বলতে লাগলেন, কেন এমন হল কে জানে। দেখা যাক কাল কী হয়!
পরের দিনই দুর্দান্তভাবে গেয়ে দিলেন সেই গানটি। আমি দেখলাম বিজয়ী বীরের অভিব্যক্তিতে রেকর্ডিং রুমে দাঁড়িয়ে গানটি শুনছেন কিশোরদা। সে সময়টা কিশোরদা শুধু পঞ্চমের গানের জন্য, জুহু থেকে অনেক দূরে তারদেও-র ফিল্ম সেন্টার স্টুডিয়োতে যেতেন। নইলে বান্দ্রা পেরিয়ে মুম্বইতে যেতে চাইতেন না কিশোরদা। কী একটা রেকর্ডিং-এ কোথাও স্টুডিয়ো পাওয়া যাচ্ছিল না। কিশোরদাকে বলা হল এইচ. এম. ভি. স্টুডিয়োতে রেকর্ডিং করবেন? কোলাবায় দারুণ স্টুডিয়ো বানিয়েছেন ওরা
কথাটা শুনেই ভ্রূ কোঁচকালেন কিশোরদা। বললেন, কোলাবা? না না, অতদূরে আমি যেতে পারব না। আমার অসুবিধা হবে।
প্রযোজক পক্ষ অনুনয় করলেন, কী আর অসুবিধা হবে। আমাদের গাড়িতে উঠবেন আর সোজা স্টুডিয়োতে গিয়ে নামবেন।
বিরক্ত কণ্ঠে কিশোরদা বললেন, অসুবিধা হবে না মানে? আমার বাড়ি এই জুহু তারা থেকে দাড়ি কামিয়ে গাড়িতে উঠে যখন এইচ. এম. ভি.-তে নামব তখন দেখব আমার আবার দাড়ি গজিয়ে গেছে।
কিশোরদার আরও দুটো উল্লেখযোগ্য গান আমি লিখেছিলাম ‘দোলন চাঁপা’ ছবিতে কানু ভট্টাচার্যের সুরে আমারও তো গান ছিল/সাধ ছিল মনে’ আর গৌতম বসুর সুরে ‘হীরক জয়ন্তী’ ছবিতে বহু দূর থেকে এ কথা/দিতে এলাম উপহার’।
আরও অনেক গান লিখেছি কিশোরদার জন্য। এই মূহুর্তে সেসব ঘটনা মনে আসছে না। মনে এলে অবশ্যই বলব।
এখন বলি, আমার লেখা যে গানটি গেয়ে কিশোরদা সংগীত জগতে বিশাল আলোড়ন তুলেছিলেন আর আমার লেখা গানটি শুনে, আমারই চোখ দিয়ে টস টস করে জল পড়েছিল। সে গানটি ‘তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে/আমার মরণ যাত্রা যে দিন যাবে’। এ গানটিও আমি লিখেছিলাম আর একজন বিশিষ্ট শিল্পীর পুজোর গানের জন্য। উনি মরণ যাত্রা নিয়ে গানটি গাইতে অনিচ্ছা জানালেন। গানটির সুর করেছিল মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি ভবিষ্যতে কোথাও গানটি লাগিয়ে দেব মনস্থ করে ওই বিশিষ্ট শিল্পীকে অন্য একটা গান দিয়ে দিই।
‘তুমি কত সুন্দর’ ছবির গান লেখার সময় পরিচালক মনোজবাবুর সঙ্গে সিটিং চলছিল। উনি মৃণালের মুখে এই গানটি শুনে তৎক্ষণাৎ ওঁর নির্মীয়মাণ ছবির জন্য চাইলেন। আমি বলেছিলাম, গানটা আমি দিতে পারি যদি কিশোরদাকে দিয়ে গাওয়ানো হয়। উনি তৎক্ষণাৎ সম্মতি জানালেন। ওই গানটি গাওয়ার পর কিশোরদা আমাকে বলেছিলেন, কী পোলাওবাবু একেবারে আমার মরণ যাত্রা করে দিলেন?
উত্তরে মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল, দেখবেন। সুপার ডুপার হিট হবে গানটা। দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি কিশোরদা নিজের মৃত্যু দিয়ে আমার সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য করে দেবেন।
এরপরও একটা মর্মান্তিক ঘটনা আছে। সেদিন অন্য আর এক ছবির ডেট নিয়ে কলকাতায় ফিরেছিলাম। বলেছিলাম, কলকাতায় গিয়ে প্রযোজকের সঙ্গে ফাইনাল করে আপনাকে ডেটটি কনফার্ম করব টেলিফোনে। ওই মাউথপিসে তিনবার হাততালির শব্দ করে। যথাসময়ে ফোন করেছিলাম। যিনি ধরলেন, তিনি আমায় বললেন, ও তো চলা গিয়া।
আমি আমার হিন্দিতে বললাম, আমি কলকাতা থেকে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় বলছি। কিশোরদা এলে বলবেন ওই তারিখটা কনফার্মড, আমরা মুম্বই আসছি।
এবার আর একজন ভদ্রলোকের গলা পেলাম। তিনি পরিষ্কার বাংলায় বললেন, কিশোরদা খানিকক্ষণ আগেই দেহ রেখেছেন।
আমি চমকে উঠলাম। ফোনটা রেখে দিলাম। হঠাৎ মনে হল রং নাম্বার হয়নি তো। কেউ মিথ্যে কথা বলছে না তো।
তৎক্ষণাৎ ফোন করলাম বাপি লাহিড়ির স্ত্রী চিত্রাণীর বড় বোন গায়িকা চন্দ্রানী মুখোপাধ্যায়কে। চন্দ্রানী আমার ফোনটা ধরেই বলল, চলে গেলেন কিশোরবাবু। আমরা এখনই ওখান থেকে আসছি। কে যে কী করে! অমিত তো ফরেনে। বাপি ওখানে থাকবে বলেছে।
আমি বোধহয় কলকাতার প্রথম মানুষ যে দুঃসংবাদটি প্রথম শুনেছিলাম। এই মুহূর্তে আর কিছু লিখতে পারছি না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।