কথায় কথায় রাত হয়ে যায় – ৩০

৩০

আর সব থেকে বেশি সময় নিয়ে যে সুপারহিট গানটি আমি লিখেছি সেটি হল শঙ্খবেলা’ ছবির গান ‘আমি আগন্তুক আমি বার্তা দিলাম’। ছবির পরিচালক কালুদা আমায় বলেছিলেন, পার্টিতে মদ্যপান করে নায়ক গান গাইলেই হয় সে দার্শনিক হয়ে যায় নইলে হয়ে যায় হাসির স্যাটায়ার করা এক ধরনের কমেডি সিঙ্গার। দুটোই আমি চাই না। একটা নতুন কিছু লিখুন।

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই কথাটা শুনেই চোখে অন্ধকার দেখেছিলাম। তবুও আমার সেই অসম্ভব মনের জোরে মোকাবিলা করতে চেয়েছিলাম ব্যাপারটা। একদিন দুদিন করতে করতে যখন প্রায় ন’দিন ধরে সুধীনবাবুর বাড়িতে ওঁর মিউজিক রুমে যাতায়াত করেও আমি কিছুতেই লিখে উঠতে পারছিলাম না কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা। সেরকম সময়ে হঠাৎ আমাদের সিটিং-এ এলেন কালুদা আর জয়ন্ত ভট্টাচার্য। আশ্চর্য, ওঁরা আসতেই হয়ে গেল গান। লিখে ফেললাম ‘আমি আগন্তুক আমি বার্তা দিলাম।’ মনে হল আমার দু হাতের মুঠোতে ধরে ফেলেছি পৃথিবীর যত আলো, যত খুশি যত আনন্দ। পরের গানটি আমার বাড়িতে মাঝরাতে লিখেছিলাম। ‘কে প্রথম চেয়ে দেখেছি/ কে প্রথম কাছে এসেছি/ কিছুতেই পাই না ভেবে/ কে প্রথম ভালবেসেছি/ তুমি না আমি।’

পরদিন টেলিফোনে গানটা দিয়ে দিলাম সুধীনবাবুকে। গানটা লিখে নিয়ে ও প্রান্ত থেকে সুধীনবাবু শুধু বললেন, বেশ জমবে মনে হচ্ছে। আর একটি সিচুয়েশনে দুটি গান লিখে নিয়ে হাজির হলাম সুধীনবাবুর সিঁথির বাড়িতে। দুটো গানই এগিয়ে দিয়ে বললাম, যেটা সুর করতে সুবিধা হয় সেটা বেছে নিন। দুটোই পরিচালককে দেখিয়েছি। ওঁদের সবার সমান পছন্দ। সুধীনবাবু বেছে নিলেন একটি গান অন্যটি আমায় ফেরত দিলেন। অভ্যাসমতো পকেটে পুরে নিলাম সেই গানটি। আমি কিছু বলার আগেই সম্ভবত স্প্যানিশ গিটার বাজাতে বাজাতে আমাকে শোনালেন, ‘কে প্রথম চেয়ে দেখেছি’ গানটি। মুগ্ধ হয়ে শুনলাম। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল অপূর্ব। এবার নতুন নেওয়া গানটি নিয়ে বসলেন হারমোনিয়ামের সামনে। বার কতক মনে মনে পড়লেন তারপর সেই তুলনাহীন হারমোনিয়াম বাজানো সুরের সঙ্গে শোনালেন আমার লেখা নতুন গানটি আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব/ হারিয়ে যাব আমি তোমার সাথে/ সেই অঙ্গীকারের রাখী পরিয়ে দিতে/ কিছু সময় রেখো তোমার হাতে। ‘

সেই সুর এত সাবলীল এত স্পনটেনিয়াস যে এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হল না সুধীনবাবু এই মাত্র এই গানটিতে সুর বসাতে বসাতে গানটি আমায় শোনাচ্ছেন। গানটি যেন ওঁর বহু দিনের জানা, বহু দিনের সুর করা। লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া এই গানটি আমার লেখা আমার প্রিয় গানগুলির মধ্যে একটি অন্যতম প্রিয় গান।

আমার ভগ্নীপতি সরোজ মুখোপাধ্যায় খুব দার্জিলিং-এর ভক্ত ছিলেন। উনি সময় পেলেই ছুটতেন ওই শৈলনগরীতে। দিদিও সঙ্গে থাকতেন, আমাকেও বার কয়েক সঙ্গে নিয়ে গেছেন। সরোজদা সেই সময়েই ওঁর প্রথম ছবি প্রযোজনা করেন। ছবির নাম ‘অলকানন্দা’। গল্প ও চিত্রনাট্য দেবকী বসুর। এই ছবিতেই তখনকার গ্র্যান্ড হোটেলে বাঙালি রিসেপশনিস্ট সুদর্শন শীতল দাশ বটব্যালকে নায়কের ভূমিকায় প্রথম সুযোগ দেন। ওঁর ধর্মতলার অফিস বাড়িতে আমার ছিল অবারিত দ্বার। আমি তখন স্কুলে পড়ি। একদিন আমার সামনেই সরোজদার চেম্বারে এলেন শীতল দাশ বটব্যাল। চেহারা দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। সরোজদা বললেন, সব ঠিক আছে তবে ওই নামটি চলবে না। তৎক্ষণাৎ নামটি পরিবর্তিত করে রাখা হল প্রদীপকুমার। প্রদীপকুমার খুব খুশি হয়েই রাজি হলেন। আগেই বলেছি এই সরোজদাই ওঁর একটি ছবি ‘কামনা’-র তখনকার বিফল নায়ক উত্তমকুমারকে আমাদের একান্ত অনুরোধে সুযোগ দেন ওঁর পরবর্তী ছবি ‘মর্যাদা’য় অরূপকুমার নামে। সে নামকরণও উত্তম হাসিমুখে মেনে নেয়। সে ছবিও অবশ্য চলেনি। স্মৃতিরেখা বিশ্বাস ছিলেন ওই ছবির নায়িকা। এই ‘মর্যাদা’ ছবির শুটিং দেখতে এসে এম পি প্রোডাকশনসের ‘অগ্রদূত’-এর বিমল ঘোষ (বিখ্যাত পরিচালক অগ্রগামীর সরোজ দে অর্থাৎ কালুদার মামা) উত্তমকে দেখে পছন্দ হয়। ওখানেই কথাবার্তা পাকা হয়ে যায়। তারপরই এম পি-তে মাস মাহিনাতে নিযুক্ত হয় উত্তমকুমার। ওঁদের ‘সহযাত্রী ও ফ্লপ হয়। তখন উত্তমকুমারকে প্রায়ই ভাগ্যের পরিহাসে অসিতবরণ ইত্যাদি শিল্পীর ক্যামেরার ডামি পুরুষ হয়ে মাস মাহিনা নিতে হত। যাই হোক ‘অলকানন্দা’ ছবির আউটডোর শুটিং হবার কথা ছিল দার্জিলিং-এ। পরে অবশ্য আউটডোর হয় শিলং-এ। দার্জিলিং-এ আউটডোর লোকেশন দেখার সময় আমিও ওঁদের সঙ্গে গেলাম। দার্জিলিং—এ ওই জিমখানা ক্লাবে শুনেছিলাম পৃথিবী বিখ্যাত গায়ক টনি ব্রেন্টের অপূর্ব গান। মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হয় আমাদের মুকেশ সাহেব বোধহয় এই কণ্ঠস্বরটা জেনে অথবা না জেনে অনুসরণ করেছিলেন। ওখানেই সেবার আলাপ হয় অল্পবয়স্ক এক বাঙালি শ্রোতার সঙ্গে তার নাম সুধীন দাশগুপ্ত। বছর কয়েক পরে দিদির সঙ্গে আবার দার্জিলিং—এ গিয়ে একটা দোকানে দেখলাম ওই ভদ্রলোককে। উনি তখন নব্য যুবক। ওই পাথরের গয়নার দোকানের উনি সেলসম্যান। উনি পাথর ভাল চিনতে জানলেও আমায় চিনতে পেরেছিলেন কি না জানি না। তবে আমি চিনতে পেরেছিলাম।

আমি পূর্ব পরিচয়ের কথা জানালাম। উনি বললেন, আমি তো দার্জিলিং-এ থাকি। আমার বাবার চাকরি তো এখানেই। আমিও এই গয়নার দোকানে কাজ করি। সময় পেলেই আমার এক নেপালি বন্ধুর বাড়ি যাই। যখন তখন পিয়ানো বাজাই। গিটার বাজাই। আর শুনি লেটেস্ট সব বিদেশের রেকর্ডের গান। আসুন না আজ বিকালে আড্ডা জমবে।

তখন কিন্তু আমার জীবনের প্রথম গান রেকর্ডিং হয়ে গেছে ‘অভিমান’ ছবিতে। ছবিটি অবশ্য তখনও মুক্তি পায়নি। সুধীনবাবুকে বললাম। অবশ্যই যাব। আমারও মজ্জায় গান। ইতিমধ্যে রেকর্ড হয়ে গেছে আমার লেখা কিছু গান। সুধীনবাবুর সেদিনকার বাজনা শুনে মনে হয়েছিল কে কার অলঙ্কার? বাজনা না সুধীন দাশগুপ্ত? যদিও সে দিনের অনেক পরে উনি সুর করেছিলেন সতীনাথের গাওয়া অন্য এক গীতিকারের রচিত বিখ্যাত গান ‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন কে কার অলঙ্কার।’ গানের কথায় অবশ্যই ছিল মোহিতলাল মজুমদারের একটি কবিতার প্রত্যক্ষ প্রভাব। এই নিয়ে তখনকার এইচ. এম. ভি.-র বিপক্ষে আদালতে মামলা ওঠার উপক্রম হয়েছিল। বেশ কিছু মোটা টাকা খেসারত দিয়ে এইচ. এম. ভি.-কে সেই অভিযোগ মেটাতে হয়েছিল।

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি হাসির নক্সার রচয়িতা গীতিকার পবিত্র মিত্রের বিরুদ্ধেও একটি পত্রিকার পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রেও এইচ. এম. ভি.—কে মোটা টাকা খেসারত দিয়ে সেই অভিযোগ মেটাতে হয়েছিল। দু’টি ক্ষেত্রেই গীতিকারদের উপর এইচ. এম. ভি. কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি। অথচ কঠোর শাস্তি পেলেন আর একবার অন্য এক গীতিকার। যিনি সেবার পুজোয় নচিকেতা ঘোষের সুরে তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান লিখেছিলেন ‘ওগো আমার কোকিল কালো মেয়ে’।

এই গানটি ছিল অন্য একজনের কবিতার প্রায় অনুলিপি। এ ক্ষেত্রেও মোটা টাকা খেসারত দিয়ে রেকর্ডটি বাতিল করলেন এইচ. এম. ভি.। এবং হুকুম দিলেন ওই বিশেষ গীতিকার যেন এইচ. এম. ভি.-র চৌকাঠ না পেরোয়। যেহেতু ওই গীতিকারের তেমন কোনও আত্মীয়স্বজন এইচ. এম. ভি.-তে বড় পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন না তাই চোখের জল ফেলতে ফেলতে ওঁকে এই হুকুমনামা মেনে নিতে হয়েছিল। ক্ষমা চাওয়ায় কোনও ফল হয়নি। যদিও এ ধরনের অপরাধ অবশ্যই অমার্জনীয়। তবুও আমরা ওঁর অজান্তেই ওঁর পিছনে দাঁড়িয়েছিলাম। তবুও টলাতে পারিনি পি কে সেনের মনোভাব। এর বেশ কয়েক বছর পরে আমরা অনেকে অনুরোধ করে করে ওই বাতিল গীতিকারকে এইচ. এম. ভি.—তে পুনঃপ্রবেশ করাতে পারি। তখন অবশ্য এইচ. এম. ভি.-র ম্যানেজমেন্ট বদলে গেছে। তা না হলে তাও হত কি না সন্দেহ আছে।

‘ওগো আমার কোকিল কালো মেয়ে’ গানটি বাতিল হবার খবর এবং কারণ আমার গোচরে সর্বাগ্রে এল এই জন্যে যে তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন এইচ. এম. ভি.-র খুব ভাল সেলার। ওর রেকর্ড বাতিল মানে কোম্পানির বাণিজ্যিক স্বার্থে বড় আঘাত। কয়েক দিনের মধ্যে প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কোম্পানি আমাকে দিয়ে লেখাল ‘আঁখি ছল ছলিয়া/ কেন গেলে চলিয়া’। নিখিল চট্টোপাধ্যায়ের সুরে তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া দুটি গানের একটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। গান দুটি আজ সকালে লেখা হল, সন্ধ্যায় সুর করা হল। পরের দিন রিহার্সাল হল। তার পরের দিন রেকর্ডিং। আর রেকর্ডিং-এর দু দিন পরেই রেকর্ড বাজারে এসে গেল। এমন ঘটনা আমার গানের জীবনে আর ঘটেনি।

যাই হোক দার্জিলিং-এর পর সুধীন দাশগুপ্তের সঙ্গে আবার দেখা হয় কলকাতাতেই। এন্টালির তখনকার সেই বিখ্যাত বাৎসরিক সংগীতানুষ্ঠানে। আমি তখন নিমন্ত্রিত শ্রোতা। উনি তখন কণ্ঠশিল্পী। মনে আছে গেয়েছিলেন ‘ওই উজ্জ্বল দিন/ ডাকে স্বপ্ন রঙিন’, তারপর ‘নীল আকাশের ওই কোলে/ কান্না হাসির ঢেউ তোলে।’ ভাল লেগেছিল ওঁর গাওয়ার ধরনটি। সে রাতের গাওয়া ওঁর কোনও গানই তখন রেকর্ড হয়নি। অনুষ্ঠানের পর আবার নতুন করে আলাপ করলাম। বললেন, এখন তো দার্জিলিং-এ থাকি না। থাকি এখানে, কলকাতাতেই। তবে বেশ কিছুটা দুরে সিঁথিতে। ওই নীল আকাশের ওই কোলে’ গানটি শুনে আমি সুধীনবাবুকে পুরোপুরি বুঝে নিলাম। উনি সত্যিই সুরসৃষ্টি করতে জানেন। কারণ বিখ্যাত একটি বিদেশি গান ‘ইস্তাম্বুল ইস্তাম্বুল’ থেকে ওই গানটি উনি সৃষ্টি করেছিলেন। ওই গানটি টু-ফোর বিটে ছিল। উনি বাংলা গানকে বানিয়েছিলেন সিক্স এইট বিটে। অর্থাৎ মোটামুটি কাহারবা থেকে দাদরায়। কিন্তু এই রূপান্তরে ঝলমল করে উঠেছিল একটি গান। একটি নতুন গান। এখানেই কৃতিত্ব ওঁর। আজীবন উনি, আমার ধারণা এই পথেই সার্থক পথ পরিক্রমা করে গেছেন। ঠিক তেমনি একটি বিদেশি গানের সুরে ‘আই এ্যাম এ জলি গুড ফেলা’-র স্টাইল অনুসরণ করে সুধীনবাবু সুর করেছিলেন ‘আকাশ এত মেঘলা/ যেওয়া না কো একলা…’। সতীনাথের গাওয়া এই গানটি এখনও অনেকের স্মরণে আছে।

ওর সঙ্গে আবার দেখা ওই সিঁথির কাছে এম পি স্টুডিওতে। বন্ধুবর জয়ন্ত ভট্টাচার্য ওঁর সঙ্গে আলাপ করাতে যাচ্ছিল। আমরা দুজনেই বললাম আমরা দুজনকেই চিনি। আমি সুধীনবাবুকে বললাম, আপনি তো দার্জিলিং-এ প্রায় জহুরির বিদ্যা অর্জন করেছেন। কিন্তু আমার ও বিদ্যা নেই। সোজাসুজি একটা ইনটিউশন বা ধারণায় বলতে পারি আমি আজ জহুরি হয়েছি একটা জহরকে চিনতে পেরেছি।

৩১

অগ্রগামীর সরোজ দে অর্থাৎ কালুদা একদিন কথায় কথায় আমায় বলেছিলেন, আমরা প্রথম ছবি করি ‘সাগরিকা’। ছবি সুপারহিট, মিউজিকও সুপারহিট। পরের ছবি ‘শিল্পী’ তারও মিউজিক সুপারহিট। দুটো ছবিরই সফল সুরকার রবীন চট্টোপাধ্যায়। তবে এখনকার ‘ডাক হরকরা’ ছবিতে সুরকার নিয়েছি সুধীনবাবুকে। কেন জানেন?

আমাকে নেতিবাচক ঘাড় দোলাতে হল। কালুদা বললেন, সুধীনবাবুর অসম্ভব আত্মবিশ্বাস। উনি সোজাসুজি এসে বললেন, আমায় সুর করতে দিন। আমি ভাল কাজ করতে পারবই পারব। ব্যাস, এটুকুই যথেষ্ট। আর কারও রেফারেন্স, কারও সার্টিফিকেট আমি নিইনি।

এবার আমার বলার পালা। হাসতে হাসতে আমি বলেছিলাম এক-ই কথা, এক জহুরিকে চিনে নিলেন আর এক জহুরি।

‘ডাক হরকরা’ ছবির গানগুলো কেউ কোনও দিন ভুলতে পারবে? এরপর সুধীনবাবু সুর করলেন কালুদার ছবি ‘কান্না’, ‘নিশীথে’ এবং ‘হেডমাস্টার’। তারপর এল ‘শঙ্খবেলা’। যার গান লেখার দায়িত্ব হাসিমুখে প্রচুর আত্মবিশ্বাসে কালুদা আমায় দিয়েছিলেন। সুধীনবাবু এরপর সুর করেছিলেন মঞ্জু দে-র ‘অভিশপ্ত চম্বল’ ছবিতে। এই ছবির পর থেকে সুধীনবাবুর সুরে গান গাইবার জন্য আশাজি প্রায় অপরিহার্য হয়ে উঠলেন। এরপর ইন্দর সেনের প্রথম ছবি ‘প্রথম কদম ফুল’-এ আশাজি গাইলেন ‘কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে’। ওই ছবিতে মান্না দের জন্য আমি লিখেছিলাম ‘আমি শ্রীশ্রীভজহরি মান্না’। এই গানটির প্রসঙ্গে একটি বিষয় জানানোর আন্তরিক তাগিদ অনুভব করছি। দুই মে সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিন। আমার জন্মদিনও ওই দুই মে। উনি ছিলেন আমার এক আত্মীয়ের সহপাঠী। আমার থেকে বয়সে অনেক বড়। প্রত্যেক বছর দুই মে আমি ওঁকে টেলিফোনে প্রণাম জানাতাম। উনি প্রত্যেকবারই বলতেন, এ বছর যেন ভজহরি মান্নার মতো আর একটা গান পাই।

বিনীতভাবে জানাতাম, ওটার স্টাইল তো আপনার পিতৃদেবের কাছ থেকে নেওয়া। উনি বলতেন, তাতে কী। দারুণ গান ওটা। তারপর উনি আমার জন্মদিনের শুভ কামনা জানাতেন যা ছিল আমার কাছে আশীর্বাদ।

এরপর সুধীনবাবু আর আমি প্রচুর ছবিতে একসঙ্গে কাজ করি। প্রথমেই মনে পড়ছে মঞ্জু দে-র ‘সজারুর কাঁটা’, ছবির গানের ব্যাপার। ‘শঙ্খবেলা’ আর ‘সজারুর কাঁটা’-তে আমার লেখার ওপর সুর করেছিলেন উনি। এরপর সারা জীবনে একটি গানও কিন্তু আমার লেখার ওপর আর সুর করেননি। ওঁর সুরের ওপর আমাকে গান লিখতে হত।। ‘সজারুর কাঁটা’ ছবিটা না চললেও গানটা চলেছিল সাংঘাতিক। পরিচালিকা মঞ্জু দে আমায় সিচুয়েশন বোঝাবার সময় উল্লেখ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘যার অদৃষ্টে যা জুটেছে সেই আমাদের ভাল’ ঠিক এই ধরনের একটি গান চাই। আমি লিখেছিলাম ‘বিধাতার এই জগতে/এই তো মুখবন্ধ/কারও কারও কপাল ভাল/কারও কপাল মন্দ’। মান্না দের কণ্ঠে সুপারহিট হয়েছিল এই গানটি। আর একটি গান ছিল হেমন্তদার কণ্ঠে।

হেমন্তদা আর ডি বর্মণের মতোই সুধীনবাবুর ‘গুড বুকে’ ছিলেন না। খুবই কম সংখ্যক গান হেমন্তদা গেয়েছেন সুধীনবাবুর সুরে। সুধীনবাবুর প্রিয়তম পুরুষকণ্ঠ ছিলেন কিশোরকুমার, তারপর মান্না দে, তারপর শ্যামল মিত্র। এ প্রসঙ্গে পরে আবার কিছু কথা বলব।

এদিকে মঞ্জু দে-র খুবই প্রিয় শিল্পী ছিলেন হেমন্তদা। সম্ভবত সেই কারণেই সুধীনবাবু আগে থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন হেমন্তদাকে গাওয়ানোর ব্যাপারে।

হেমন্তদার গানটি লিখেছিলাম, ‘সময় কখন যে থমকে দাঁড়ালো/ কালবোশেখীর মাসে/কি যে করে মন জানে না এখন/ঝড়ের পূর্বাভাসে। অপূর্ব সুর করেছিলেন উনি। এ গানটিও খুবই প্রশংসিত হয়েছিল।

এরপর আমি সুধীনবাবুর সুরের ঝড়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালাম ইন্দর সেনের ‘পিকনিক’ ছবির সময়। উনি তখন সিঁথি ছেড়ে চলে এসেছেন আমাদের সবাইর সুবিধাজনক জায়গায় দক্ষিণের যতীন দাস রোডে। সেদিনকার কালবোশেখের মাসে আমি সুধীনবাবুর সুরের ওপর লিখে ফেললাম মান্নাদার জন্য ‘কাশ্মীরে নয় শিলঙেও নয়/আন্দামান কি রাঁচিতেও নয়/আরও যে সুন্দর/আকাশ প্রান্তর।’ কিন্তু থমকে গেলাম আর একটি গানে যেটি গিয়েছিলেন আশা ভোঁসলে। ‘কেন সর্বনাশের নেশা ধরিয়ে তুমি এলে না যে।’ এর মুখড়া পার হয়ে অন্তরায় এসে সুধীনবাবুকে আমায় বলতে হল, হয় সুর বদল করুন। না হয় আমাকে মুক্তি দিন। আমি লিখতে পারব না।

উনি কেন জানি না আমার ওপর খুবই আস্থা রাখতেন। একান্ত মরমিয়া বন্ধুর মতো বললেন, আপনিই পারবেন। কিছুই বদলাবার প্রয়োজন নেই। সঙ্গে গাড়ি তো রয়েছে। আপনার যতই রাত হোক ক্ষতি কী। আমরা আরও সময় নিলাম। আপনি আরও একটু ধ্যান দিন। আমি বললাম, অসম্ভব। আপনি তো গাইছেন শুধু মিটার টুং তা-না-না-না আবার আর একটা ওই সমান ওজনের টুং তা রা না না না, ভাব ভাবনা অর্থ কবিতা অবাঙালি নেপথ্য গায়িকার উচ্চারণ, পরিবেশ ফিল্মের সিচুয়েশন মিলিয়ে কী লিখব আমি। কিছুই মাথায় আসছে না।

আমার কথাটা শুনে সুধীনবাবু বললেন, দাঁড়ান।

কথাটা বলেই ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। একটু পরে ফিরে এসে বললেন, ব্যাস। এবার নিশ্চিন্ত। আপনার বাড়িতে ফোন করে এলাম। আপনি আজ বাড়ি ফিরছেন না। এখানেই থাকছেন। এবার মন দিয়ে শুনুন আর লিখুন।

সুধীনবাবু হয়তো ঠিকই ধরেছিলেন। মনে হয়তো টেনশন ছিল। কী করে মাঝরাতে নিজে গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনা না ঘটিয়ে বাড়ি ফিরব। এবার কিন্তু শুনেই লিখে ফেললাম ওই গানের অন্তরাটা। ওঁর টুং তা-না-না-না গুলো আমারই কলমে হয়ে গেল ‘দিন এসে এসে/যায় ফিরে ফিরে/চোখ চেয়েই যে থাকে/মন সারাবেলা/সেই পথে পথে/কান পেতে রাখে/সব হারানোর পথে নেমে কি/পথ চাওয়া আর সাজে/মরি লাজে/বুকে বাজে।’

হারানো সে সব কথা আমি শুনি। চোখের সামনে দেখি। যখনই বাড়ি ফেরার পথে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে গাড়ি থামিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। চোখের উপর ভেসে যায় কত মেঘ, ঝরে যায় কত আলো। ক্রমশ কত আলো অন্ধকার হয়ে যায়। এখন জ্বলে ওঠে বড় বড় হ্যালোজেন। আগে জ্বলত গ্যাসের বাতি। একজন লোক ছুটতে ছুটতে যেত একটা লাঠির মাথায় আগুন জ্বালিয়ে। পর পর গ্যাসের বাতিগুলো জ্বলে উঠত দপ দপ করে। আমার স্মৃতিতে আলো ঝলমল করা সে সব দিনগুলো আজও স্পষ্ট দেখি আগে যেমন দেখতাম। পুরনো সেই দিনের কথা আজও ভোলা যায় না। অন্তত আমি পারি না ভুলতে। আগেকার দিন আর এখনকার দিনের আকাশ পাতাল পার্থক্য থাকলেও এখনও অহরহ বুকে বাজে সেই বিখ্যাত গানের আকুতি ‘তবু মনে রেখ’।

৩২

সুধীনবাবুর প্রসঙ্গে আরও একটু কথা বলে নিই। কলকাতার মহিলা কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে সুধীনবাবুর সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন আরতি মুখোপাধ্যায়। যদিও দমদমের আরতি গান শিখত শ্যামবাজারের সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। তবুও সিঁথির সুধীন দাশগুপ্তের সংস্পর্শে না এলে আরতির এমন বিকাশ হত না বলেই আমার নিজের ধারণা। সুধীনবাবুর যতীন দাস রোডের বাড়িতেই আমি লিখেছি পুজোর জন্য আরতির সেই বিখ্যাত গান অনড় অটল সুধীনবাবুর সুরের মিটারে। গান দুটি ছিল (১) ‘যদি আকাশ হত আঁখি/ তুমি হতে রাতের পাখি’, (২) ‘না বলে এসেছি/তা বলে ভেব না/না বলে বিদায় নেব।’

এরপর সুধীনবাবু চলে এলেন ডোভার রোডের বহুতল বাড়িতে নিজের ফ্ল্যাটে। ওর গ্যারেজটা খালিই ছিল। ওখানে আমার গাড়ি রেখে কত রাত যে বাড়ি ফিরিনি তার ইয়ত্তা নেই। তখন সুধীনবাবুর হাতে অজস্র ছবি।

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের গান কী অজ্ঞাত কারণে জানি না উনি খুব একটা পছন্দ করতেন না। আঙুলে গোনা যায় এমন সামান্য কয়েকটি ওঁর লেখা গান সুধীনবাবু সারা জীবনে সুর করেছেন। সে জন্য ওঁর প্রায় সব ছবিতেই থাকতাম আমি। আমার হাতে আবার অন্যান্য মিউজিক ডিরেক্টররাও ছিলেন। এ দিকে সুধীনবাবু বাণীচক্রে নিয়মিত ক্লাস নিতেন। বাড়িতেও অনেক ছাত্রী। সুতরাং রাত জাগা ছাড়া কাজ শেষ করার উপায় ছিল না আমাদের দুজনেরই।

আমাদের এখানে মাঝে মাঝে এসে হাজির হত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়। ব্যস, সব কিছু তুলে রেখে দিয়ে শুরু হত আমাদের অনর্গল আড্ডা, হাসি, গান আর তামাসা। ওখানেই বিখ্যাত ছবি ‘হংসরাজ’-এর গানের জন্ম। ‘হংসরাজ’ ছবির পরিচালক অজিত গাঙ্গুলিকেও আমরা একটা রাত বাড়ি ফিরতে দিইনি। বাউলাঙ্গের এই সব অতি জনপ্রিয় গানগুলোর কোনওটাই কিন্তু আমার লেখার ওপর সুর করা নয়। সবই সুরের ওপর আমি লিখেছি। যেমন (১) শহরটার এই গোলক ধাঁধায় আঁধার হল মন’। (২) ‘ও দিদিমণি গানের রানি’। সব কটা গানই কিন্তু দারুণ গেয়েছিল আরতি। অমিতকুমার তখন সম্ভবত কলকাতার পাঠভবনের ছাত্র। অমিত গেয়েছিল ‘চিৎকার চেঁচামেচি মাথাব্যথা/এই নিয়ে হল কলকাতা।’ আর গেয়েছিল শ্যামশ্রী মজুমদার নামে একটি নতুন মেয়ে। ওর গান ছিল ‘টিয়া টিয়া টিয়া/অজ পাড়াগাঁয়ে থাকে।’ ওখানেই একদিন রাত সাড়ে তিনটেতে যখন সুধীনবাবু আমাকে ওঁর মিউজিক রুমে শোয়ার ব্যবস্থা করে নিজে শুতে গেলেন। তার খানিক পরেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি এসেছিল। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলে বুঝতে পারিনি। খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টি ভেজা ঠাণ্ডা হাওয়া আসছিল আমার ঘরে। হঠাৎ ঘুম ভাঙল। সুধীনবাবু তখন অতি সন্তর্পণে একটা চাদর এনে আমার গায়ে দিয়ে দিচ্ছিলেন। ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে চারটে। এই ছিল আমাদের আন্তরিক সম্পর্ক।

ওইখানেই লিখেছিলাম ‘জীবন সৈকতে’ ছবির গান। আর লিখেছিলাম দীনেন গুপ্তের ‘সঙ্গিনী’ ছবির গানও। আরতির গাওয়া সেই গানটি ছিল ‘এই বৃষ্টিতে কে ভিজবে সে এস না।’ যেটা পিকচারাইজেশন হয়েছিল ঐতিহাসিক প্রিন্সেপ ঘাটে। যেটি দ্বিতীয় সেতুর জন্য ভাঙা পড়েছে।

ওই ছবিরই আর একটি গান যা সুধীনবাবুর সুরে হেমন্তদা গেয়েছিলেন। গানটি ছিল ‘একটু বাতাস ছিল/কখন যে হয়ে গেল ঝড়/নিজেদের কাছে আজ/নিজেরাই হলাম যে পর।’ আমার অনুরোধেই সুধীনবাবু হেমন্তদাকে দিয়ে গানটি গাইয়ে ছিলেন।

মুম্বইতে সুধীনবাবুর সঙ্গে বাংলা গান রেকর্ড করতে আমি একবারই গিয়েছিলাম। সেটা ‘শঙ্খবেলা’ ছবির সময়। যেহেতু আমি মান্নাদাকে টেলিফোনে বলেছিলাম লতাজির একটা তারিখের জন্য। মান্নাদা তাই লতাজির তারিখ ঠিক করে আমাকেও মুম্বইতে নিয়ে আসার জন্য প্রযোজক পক্ষকে জানিয়ে ছিলেন। প্রথমে ‘গলি থেকে রাজপথ’, তারপর ‘শঙ্খবেলা’। এরপর আর কোনও ছবিতেই লতাজি সুধীনবাবুর সুরে গেয়েছেন কি না মনে আসছে না। তবে আশা ভোঁসলে অনেক গেয়েছেন। আমার লেখা প্রচুর গান উনি আশাজির কণ্ঠে মুম্বইতে রেকর্ড করিয়েছেন। তার তারিফও পেয়েছেন মান্নাদার কাছ থেকে। আমি আগেই বলেছি সুধীনবাবুর ফার্স্ট চয়েস ছিলেন কিশোরকুমার। শঙ্খবেলা’ ছবিতে উনি উত্তমের লিপে মান্না দেকে চাননি—চেয়েছিলেন কিশোরদাকে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, যতদূর মনে হয়, একবারও উনি কিশোরদাকে দিয়ে ওঁর সুরে বাংলা গান গাওয়াতে পারেননি।

‘পিকনিক’ ছবির ‘একদিন দল বেঁধে ক’জনে মিলে’ গানটি কিশোরদাকে দিয়ে গাওয়াবার জন্য উনি বেশ কিছুদিন মুম্বইয়ের হোটেলে মিথ্যে সময় নষ্ট করেছেন। কিন্তু কিশোরদাকে পাওয়া যায়নি।

এই ‘পিকনিক’ ছবিতে গান গাওয়াবার জন্য সুধীনবাবু যখন মুম্বইতে কিশোরদার ডেটের জন্য অপেক্ষা করছেন তখন অন্য একটা কাজে আমিও মুম্বইতে ছিলাম। ব্যাপারটা জানতে পেরে এক দিন সরাসরি কিশোরদাকে বলেছিলাম, দিয়ে দিন না একটা ডেট। কতক্ষণেরই বা ব্যাপার।

কিশোর যথারীতি ওঁর ড্রাইভার কাম সেক্রেটারি আবদুলের দিকে তাকালেন, আবদুল শুধু মুচকি হাসল। কেন হাসল তাও বুঝলাম না। কিশোরদা আমাকে বললেন, কী পুলকবাবু। পোলাও খাবেন? আমি বুঝে গেলাম সুধীনবাবুর ভাগ্য মন্দ। অথচ কতবার কিশোরদাকে বাংলা গানের জন্য অনুরোধ করেছি উনি কথা রেখেছেন। কিন্তু সুধীনবাবুর গান গাননি। এর যে কী কারণ আজও তা আমার কাছে অজ্ঞাত। কিশোরকুমার এবং সুধীন দাশগুপ্ত দুজনেই আজ প্রয়াত। ঠিক জানি না এর কারণ কী? জানি না কিশোরদা সুধীনবাবুর সুরে জীবনে একটাও গান গেয়েছেন কি না। যাই হোক কিশোরকুমারকে না পেয়ে ‘পিকনিক’ ছবির ওই গানটা শেষ পর্যন্ত মান্নাদাকে দিয়েই মুম্বইতে রেকর্ড করাতে হল।

একদিন সন্ধ্যায় সুধীনবাবুর বাড়ির কাছ দিয়ে যেতে যেতে সুধীনবাবুর বাড়িতে হাজির হলাম। এমন ঘটনা অবশ্য প্রায়ই ঘটত। এমনভাবেই তৈরি হত অনেক নতুন গান। উনি ছাত্র-ছাত্রীদের সে সব গান শেখাতেন। কিছু কিছু আধুনিক গানের লেবেল এঁটে রেকর্ডও প্রকাশ হত।

সেদিন সন্ধ্যায় গিয়ে দেখি বাড়িতে কেউ নেই। উনি একা। কী ব্যাপার? উত্তরে শুনলাম বাড়ির সবাই কোথায় নিমন্ত্রণে গেছেন। উনি যাননি। এইমাত্র গানের ক্লাস শেষ করেছেন।

মিউজিক রুমে ওঁর একটা সেতার থাকত। সেতারটা দেখতাম। কোনওদিন বাজাতে শুনিনি। সেদিন হঠাৎ তুলে নিলেন সেতারটা। বাজাতে লাগলেন। অবাক হয়ে শুনতে লাগলাম। মাঝ পথে হঠাৎ ওঁকে থামিয়ে বললাম, রাখুন সেতারটা। যে সুরটা বাজালেন আমার দারুণ লাগল। আমার এখন ভীষণ মুড। ধরুন হারমোনিয়াম। এখন‍ই গান লিখব।

সুধীনবাবু বললেন, ধুর! এ আবার সুর নাকি? মামুলি ব্যাপার। যা মনে আসছিল বাজাচ্ছিলাম। আমি অধৈর্য হয়ে বলে উঠলাম, না না, সময় নষ্ট নয়। বাজান হারমোনিয়াম। অগত্যা উনি হারমোনিয়ামে হাত দিলেন। তৎক্ষণাৎ লিখে ফেলতে পেরেছিলাম ‘এত বড় আকাশটাকে ভরলে জোছনায়/ওগো চাঁদ এ রাতে আজ তোমায় বোঝা দায়।’

বোধহয় পনেরো কুড়ি মিনিটের মধ্যেই সমস্ত গানটা বানানো হয়ে গেল। এমনকী একটা সঞ্চারীও আমরা যোগ করলাম। এই গানটা পরে অরুন্ধতী হোমচৌধুরী এইচ. এম. ভি.-তে রেকর্ড করেন। আমি প্রায়ই এ গানটার উদাহরণ দিয়ে সুধীনবাবুকে বলতাম, এ রকম কত সুরই তো আপনি মামুলি বলে ফেলে দেন। কিন্তু সে কথা আমি মানতে সবসময় রাজি নই। এ ভাবেই আমরা সৃষ্টি করেছিলাম শিপ্রা বসুর বিখ্যাত গান ‘এই জন্মে যদি মরণ হয় কোনও দিন/মরি যেন ভালবাসাতে।’ মনে পড়ছে দীনেন গুপ্তর ‘বসন্ত বিলাপ’ ছবির গান লেখার সময়ের ঘটনা। ছবিটিতে আমাদের চারটে গান ছিল। চারটেই হিট হয়। আরতির গলায় এক চড়েতেই ঠাণ্ডা/ধেড়ে খোকাদের পাণ্ডা।’ আরতির আরও একটি গান ‘আমি মিস ক্যালকাটা।’ মান্নাদার গলায় ‘আগুন লেগেছে লেগেছে আগুন’ এবং আরতি আর সুজাতার গলায় ‘ও শ্যাম যখন তখন/খেলোনা খেলা অমন।’

প্রথম গানটি অর্থাৎ ‘এক চড়েতেই ঠাণ্ডা’ ওটি কিন্তু ছবির স্ক্রিপ্টে ছিল না। সিচুয়েশনটা ঠিক করে দিলেন সুধীনবাবু। আমরা সবাই তাতে সায় দিয়েছিলাম। মান্নাদার ‘আগুন লেগেছে আগুন’ গানটি আমরা করেছিলাম মান্নাদারই ‘লাগা চুনারি মে দাগ’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়। ভারতবর্ষে তারানা গাইতে মান্নাদা প্রায় অদ্বিতীয়। মান্নাদার এই ক্ষমতাটাকে আমরা কাজে লাগিয়ে ছিলাম।

সলিল চৌধুরীও একবার তাই করেছিলেন। ‘মর্জিনা আবদল্লা’-তে ‘বাজে গো বীণা’ গানটিতে। গানগুলো রেকর্ডিং হয়েছিল কলকাতাতেই, মুম্বইতে নয়। কী ভাল রেকর্ডিং হত তখন এখানে।

এবার মনে পড়ছে আমার নিজের কাহিনীর ছবি ‘প্রান্ত রেখা’-র কথা। এই ছবিরও পরিচালক ছিলেন দীনেন গুপ্ত। যাতে মান্নাদার হিট গান লিখেছিলাম—যে কদিন আকাশ দিয়ে/দল বেঁধে যায় হাঁস/ যে কদিন শিমুল তলায় দাঁড়ায় ফাগুন মাস। ‘

এই প্রসঙ্গে মনে এল ‘অপরাজিতা’ ছবিতে আমার লেখা এবং আরতির গাওয়া একটা গানের কথা। গানটি ছিল ‘একটি মেয়ের স্বপ্ন ছিল কেউ তা মানে না। হাসতে গিয়ে কাঁদলো কত কেউ তা জানে না।’ ছবিটা একেবারেই চলেনি। কিন্তু এ গানটা জনপ্রিয় হয়েছিল। বাকি গানগুলো কিন্তু আমার মনে নেই। নিশ্চয় সে গানগুলোতে আমার কিছু খামতি ছিল।

‘তিন ভুবনের পারে’ ছবিতে আরতির জন্য লিখেছিলাম ‘কোনও এক চেনা পথে/যেতে যেতে একদিন/পথ বলে অরণ্যে যাব।’ গানটি লেখা শেষ হতেই সুধীনবাবু বললেন, আজ থাক। কাল একটা এক্সপেরিমেন্টাল গান নিয়ে আপনার সঙ্গে বসব। সুধীনবাবুর মুখে এ কথা শুনে আমি তো সারা রাত ভাল করে ঘুমাতেই পারলাম না। পরদিন সকালে আর কিছু লেখা হল না।

কেবল ঘড়ি দেখছি কখন সুধীনবাবুর বাড়ি যাবার সময় আসবে।

যথাসময়ে হাজির হলাম। সুধীনবাবু বললেন, এখন তো ‘সাউন্ড অন সাউন্ড’এখানেও রেকর্ডিং করা যাচ্ছে। ওটাই কাজে লাগালে হয় না? এমন একটা বিষয় নিয়ে গান লিখুন যাতে প্রমাণ করা যায় শুধু স্টার্ট দিতে নয়, শুধু গিমিক দিতে নয়। এই বিশেষ যান্ত্রিক মিক্সিং-এর খেলাটা যেন মনে হয় অনিবার্য। সেরকম ভাবে গানটি লিখুন।

ব্যপারটা আমি বুঝে নিলাম। বললাম, যেমন সত্যজিৎ বাবু টেপের স্পিড পরিবর্তন করে ‘গুগা বাবা’তে ভূতের কণ্ঠ তৈরি করেছেন। শুনে মনে হয়েছিল ভূতের গলাটা বোধহয় এই রকম। সত্যিকারের ভূতরা বোধহয় এই স্বরেতে গান করে কথা কয়। এটা একেবারেই সত্যজিৎবাবুর গিমিক বা স্টান্টবাজি নয়। এটা ওঁর সার্থক চিন্তা।

সুধীনবাবু বললেন, ঠিক এই রকমই আসুন আমরা কিছু করি। এখন ভাবি সে সময় একটা গানের জন্য সুরকাররা কত ভাবতেন। এখনকার মতো কোনও রকমে একটা গান খাড়া করেই কাজ শেষ করতেন না। আমি সুধীনবাবুর ওই চিন্তাটা যাতে সার্থক হয় তার জন্য লিখে ফেললাম ‘দূরে দূরে/কাছে কাছে/এখানে ওখানে/ কে ডাকে আমায়।’ প্রথম ‘দূরে দূরে’র পর প্রতিধ্বনি হয়েছিল—দূরে দূরে’। প্রথম ‘কাছে কাছের পর প্রতিধ্বনি হয়েছিল ‘কাছে কাছে’—যাঁরা শুনেছেন—নিশ্চয়ই তাঁদের মনে পড়ছে!

এই কলকাতার টেকনিসিয়ান্স স্টুডিয়োতেই শব্দযন্ত্রী সত্যেন চট্টোপাধ্যায় গানটি অপূর্ব রেকর্ডিং করেছিলেন। আর তেমনই সুন্দর গেয়েছিল আরতি। গানটিতে লিপ দিয়েছিল তনুজা। গান শুনে তনুজা আমায় বলেছিল, এ ধরনের টেকনিকের গান ভারতবর্ষে প্রথম শুনলাম। যাঁরা এ গান শুনেছেন তাঁরাও আশা করি তনুজার সঙ্গে একমত হবেন।

৩৩

সুধীনবাবু কলকাতায় এসে গানের জগতে যোগ দিয়েছিলেন কমল দাশগুপ্তের সহকারী সুরকার হিসেবে। কমল দাশগুপ্তের কথা ভাবলেই মনে হয় ওঁর প্রাপ্য সম্মান আমরা কি ওঁকে আজ পর্যন্ত দিয়েছি? সুধীনবাবু আমাকে প্রায়ই বলতেন, অমন ‘মিউজিক্যাল ট্যালেন্ট’ সত্যিই বিরল। কিন্তু এইচ. এম. ভি. কি তাই বলেন বা মনে করেন?

এইচ. এম. ভি.-র বাংলা আধুনিক গান এবং ছবির গানের আসল ভিত যাঁদের রক্তে তৈরি সেই রক্তদানের কতটুকু প্রতিদান এরা দিয়েছেন? ফিরোজা বেগমকে দিয়ে যূথিকা রায় ও বীণা চৌধুরীর অনেক গান গাইয়ে এইচ. এম. ভি. ফিরোজা বেগমকে শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু ওগুলো যে কমল দাশগুপ্তের গান তা কি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে?

শ্রোতারা চিনেছেন ফিরোজা বেগমকে কমল দাশগুপ্তকে নয়। ‘ডাউন মেমরি লেন’—এ ওঁর কিছু গান ঢুকিয়ে ওঁরা বাণিজ্য করেছেন কিন্তু ওই লেনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে যে কমল দাশগুপ্ত তা কি কোনও দিন কোনও শ্রোতা বুঝতে পেরেছেন।

কাজী নজরুলের লেখা কত গান কমল দাশগুপ্ত সুর করেছেন। টোটাল নজরুলগীতি বলতে আমরা যা বুঝি নিশ্চয় সে গানগুলো তা নয়। এ ব্যাপারে একটু গবেষণামূলক কাজ করে গীতিকার কাজী নজরুল এবং সুরকার কমল দাশগুপ্তের পৃথক পরিচয়ে গানের একটি এল পি বা ফোরপ্যাক ক্যাসেটও প্রকাশ করা যায়। এইচ. এম. ভি. তা পারেন।

কমল দাশগুপ্তের শেষ জীবনে ওঁর কিছু ছবিতে গান লেখার এবং ছবির বাইরে আধুনিক গান লেখার সুযোগ আমি পেয়েছি। লক্ষ করতাম কমলদা কোনও দিনও তবলা নিয়ে বা তখনকার চলতি মেট্রোনাম যন্ত্র নিয়ে সুর করতেন না। গানের কথাগুলো আমার মুখে একাধিকবার শুনতেন। তারপর গানের কাগজটা একেবারে চোখের তারার কাছে এনে দেখতেন। মনে মনে গাইতেন। তারপর যেটুকু সুর হল সেটুকু শুধু হারমোনিয়াম বাজিয়ে একবার স্বকন্ঠে গাইতেন। তারপরই গানের কথার মাথায় লিখে রাখতেন এক বিচিত্র আঁকিবুকি। যার নাম ছিল শর্টহ্যান্ড স্বরলিপি। তখনকার প্রায় সব রেগুলার মিউজিক ডিরেক্টররাই এবং অনেক বাদ্যযন্ত্র শিল্পীরাও এটা শিখতেন এবং ব্যবহার করতেন। তখন তো আর টেপ রেকর্ডারের ব্যবহার শুরু হয়নি। সুতরাং এই শিক্ষাটা তখন ছিল খুবই প্রয়োজনের।

মান্না দে অবশ্য এই টেপ রেকর্ডারের যুগেও ওঁর প্রতিটি গানের কথার উপর আজও লিখে রাখেন এই শর্টহ্যান্ড স্বরলিপি। কমল দাশগুপ্তের একদা সহকারী সুধীন দাশগুপ্তকেও কখনও দেখিনি তবলিয়া নিয়ে গানের সুর করতে। শুধু হারমোনিয়ামই ছিল ওঁর যথেষ্ট।

আমি যাঁদের সুরে গান লিখেছি বা আজও লিখে চলেছি সেই সব সুরকারদের মধ্যে সুর করার সময় অনেকেই সঙ্গতকার নেন না। আমি অন্তত নিতে দেখিনি। যেমন রামচন্দ্র পাল, দক্ষিণামোহন ঠাকুর, খগেন দাশগুপ্ত, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, রাজেন সরকার, গোপেন মল্লিক, শৈলেশ রায়, কালীপদ সেন, মান্না দে, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, দিলীপ রায়, পবিত্র চট্টোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূপেন হাজারিকা, দুনিচাঁদ বড়াল, উত্তমকুমার, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, উস্তাদ আলি আকবর খান, আনন্দশঙ্কর এরকম আরও অনেক নাম করা যায়।

আলি আকবর অবশ্য মাঝে মধ্যে সরোদও বাজিয়ে গেছেন গানের সুর করার সময়। আমি সে সুরের ওপরই গান লিখেছি। রবিশঙ্করও মাঝে মাঝে হারমোনিয়াম সরিয়ে রেখে সেতার বাজিয়েছেন। গান লিখেছি সেই সেতারের সুরের উপরে। আনন্দশঙ্কর কেবল সেতারই বাজিয়ে গেছেন। গানের কথা লিখেছি সেতার শুনে শুনে। আবার ঠিক তার বিপরীতটাও লিখেছি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরের সঙ্গে গান লিখতে বসে। তবলচি ছাড়া হেমন্তদা গানের সুর করতে বসেছেন এটা কোনও দিনও আমার কষ্টকল্পনাতেও আসবে না।

নচিকেতা ঘোষ এবং ওঁর সুযোগ্য পুত্র সুপর্ণকান্তিও তাই। নচিকেতা ঘোষ অবশ্য দুদিনের দুটি ঘটনায় এর ব্যতিক্রম ঘটিয়েছেন। দুবারই তবলচি আসার যখন সময় নয় সেই অসময়েই আমার পকেট থেকে হঠাৎ উদ্ধার করেছেন লিখে রাখা দুটি গান। এবং গান দুটো ওঁর এত ভাল লেগে গেছে যে প্রাণের আবেগকে সংবরণ করতে না পেরে শোবার ঘরের খাটের ওপরেই হারমোনিয়াম তুলে নিয়ে তবলা সঙ্গত ছাড়াই সুর করেছেন আমার লেখা মানবেন্দ্রের বিখ্যাত গান ‘ও আমার চন্দ্রমল্লিকা বুঝি চন্দ্ৰ দেখেছে’। দ্বিতীয় ঘটনা ঘটেছিল আরতি মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে সেই গানটির সময় ‘এক বৈশাখে দেখা হল দু’জনায়’।

আমার দেখা রবীন চট্টোপাধ্যায়ও তবলিয়া রাধাকান্ত নন্দীর তবলা না শুনে কোনও গান সুর করেননি।

শ্যামল মিত্রও ওইভাবে সুর করতেন। এবং মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ও। আর মুম্বইয়ের অরূপ-প্রণয় আর জগজিৎ সিং ছাড়া রাহুল দেববর্মণ, বাপি লাহিড়ি, যতীন-ললিত গায়িকা হেমলতার অগ্রজ বিনোদ ভাট, রবীন্দ্র জৈন, ঊষা খান্না, বাবুল বোস, উত্তম সিং এবং নৌশাদ সাহেবদের সঙ্গে গান লিখতে বসে শুধু একাধিক তবলা ঢোল নয়, একাধিক গিটার, পারকারসান ইত্যাদি রিদম ছাড়া কারও কোনও সিটিং-এ আমি গান লিখিনি।

মাদ্রাজের রমেশ আইয়ার, বিখ্যাত ভি বি কৃষ্ণমুর্তিও কোনও সঙ্গতকার নেন না। বাজিয়ে যান শুধু কি-বোর্ড। ওঁর সুরে আমি লিখেছি বাংলা গান। ওড়িশার অনেক দ্বিভাষিক ছবিতে আমি গান লিখেছি। ভুবনেশ্বরের প্রফুল্ল কর, তাঁর

সঙ্গে যে কটি ছবিতে আমি গান লিখেছি সব কটি ছবির গান লেখার সময় হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছেন আমার সঙ্গে।

আবার ভুবনেশ্বরের প্রশান্ত নন্দা বাজিয়ে গেছেন টেপকরা ভায়োলিন ও আনুষঙ্গিক বাদ্যযন্ত্র। তার ওপরেই গান লিখতে হয়েছে।

কটকের অক্ষয় মহান্তি এবং বাসুদেব রথ হারমোনিয়াম এবং সঙ্গতকার নিয়েই গান লিখিয়েছেন আমায়।

উটিতে মিঠুনের মনার্ক হোটেল মিঠুনের ‘ভাগ্যদেবতা’ ছবির গান লিখতে গিয়ে সুরকার হিসাবে পেলাম বাঙালি দুই ভাইকে। লন্ডনের এক অনুষ্ঠানে মিঠুন এদের আবিষ্কার করেন। মধু বর্মণ আর গোপাল বর্মণ। উটির সিটিং-এ একভাই গিটার বাজাল। আর এক ভাই বাজাল ঢোল। ওদের গলার ডামি ওয়ার্ডের ওপর কথা বসালাম আমি। গান কেমন দাঁড়াচ্ছে নিজের গলায় আমার কথাগুলো গেয়ে চলল মিঠুন। বাংলা গান পাগল মিঠুন প্রতিটি সিটিং-এ নিজে হাজির থেকেছে। গলা মিলিয়ে গেয়ে গেছে গান। এর জন্য ওর অন্য হিন্দি ছবির শুটিং আটকে যাচ্ছে মিঠুন তার পরোয়াই করেনি। ভাগ্যদেবতার গানগুলো লেখা শেষ হলে আবেগে অস্থির মিঠুন সঙ্গে সঙ্গে ডিমান্ড লাইনে কলকাতায় আমার স্ত্রীকে ফোন করে জানিয়ে ফেললে, বউদি দাদা কী কাণ্ডটা ঘটিয়ে ফেলেছেন। আপনি কালকেই চলে আসুন উটিতে। এসেই নিজে শুনে যান।

বউদি অবশ্য ঘরসংসার আর আদরের নাতনি প্রতীতিকে ছেড়ে উটিতে যেতে পারেননি। তবে বুঝতে পেরেছেন বাঙালি মিঠুনের নিশ্চয় কোনও বাঙালিয়ানা গর্বে বুক ভরে গেছে।

এমন ঘটনা এর আগেও মিঠুন ঘটিয়েছে। মিঠুন তখন উটিতে নয় থাকত মুম্বইতে। হঠাৎ আমায় ফোন করে পরের দিন উড়িয়ে নিয়ে এল মুম্বইতে। বললে, এবার পুজোয় বাংলা গানের ক্যাসেট করব। মুম্বইয়ের বাঙালি সুরকার বাবুল বোস সুর করবে। গান লিখুন। সিটিং-এ এসে মিঠুন হঠাৎ বললে, প্রধানমন্ত্রিত্বটা না হয় ছেড়েই দিলাম। আজ পর্যন্ত একজন বাঙালি কি রাষ্ট্রপতি হয়েছেন? কেন বাঙালির কারও কি সে যোগ্যতা নেই?

যেখানে গীতিকার, সুরকার এবং শিল্পী তিনজনেই বাঙালি সেখানে বাঙালিয়ানা নিয়ে গান তৈরি করুন। আমি বাংলার বুকের গানই গাইব ক্যাসেটে।

গানগুলো কী করে লিখেছিলাম আমি জানি না। তবে তিনটি গানই আমার বুকে খোদাই করে লেখা হয়ে গিয়েছে। ওদের ভুলব না কোনও দিন। প্রথম গানটি ‘বাঙালি কাঙালি নয়/জীবন রসের কারবারি’। দ্বিতীয় গান ‘বাঙালির গড়া এই বাংলা/শস্য সবুজ চির শ্যামলা।’ তৃতীয় গানটি ‘শুধু একটি শহীদ ক্ষুদিরাম’। এই শেষের গানটা মিঠুন মেদিনীপুরের এক অনুষ্ঠানে গেয়েছিল। ওর সেই আবেগ আপ্লুত গান আজও ঘুম না হওয়া গভীর রাতে আমার কানে ভেসে আসে। মিঠুনের এই বাঙালি দরদী মনের পরিচয় সেবারই পেয়েছিলাম যখন ৮০% বাঙালি কর্মচারী নিয়ে উটিতে ওর নিজস্ব ফাইভস্টার হোটেল ‘দ্য মনার্ক’ খুলল। একবার ওই হোটেল থেকে আমায় ওর গাড়িতে করে নিয়ে গিয়েছিল অনেক দূরের পাহাড় জঙ্গল ঘেরা মাইসোর রোডে ওর নিজস্ব রিসর্টে। নীলগিরি পাহাড়ের মধ্যে বোক্কাপুরাম মাসিনাগুড্ডি ঠিকানার দ্য মনার্ক সাফারি পার্কে এসে সত্যি চোখ জুড়ানো প্রাকৃতিক পরিবেশে আহিরিটোলার গৌরাঙ্গ অর্থাৎ মিঠুন চক্রবর্তীর ম্যাজিক দেখে কথা হারিয়ে ফেলেছিলাম। যাতে বন্যজন্তুরা রিসর্টে ঢুকে না পড়ে সেইজন্য বিরাট পার্কটিকে স্বল্প ভোল্টেজের বিদ্যুৎবাহি তার দিয়ে ঘিরে রেখেছে মিঠুন। ও আমায় ঘোরাতে ঘোরাতে টারজনের বাড়ির মতো গাছের ওপরে রীতিমতো ফাইভস্টার হোটেলের অনেকগুলো কটেজরুম দেখাতে লাগল। নিয়ে গেল ওখানকার ঘোড়ার আস্তাবলে। চকলেট, সাদা, কালো অনেকগুলো ঘোড়া পর্যটকদের জন্য আস্তাবলে মজুত ছিল। মিঠুন চেঁচিয়ে ডাকল চ-ম-পা। চম্পা ঘোড়াটি উত্তর করল চিহি চিহি। যেন বলল, ভাল আছি ভাল আছি। আবার আরেকটির নাম ধরে ডাকল। সাড়া দিল সেও। জিজ্ঞাসা করলাম, কুকুরগুলো কি মুম্বইতেই রইল? মিঠুন উত্তর দিল, হ্যাঁ, মা বাবাকে পাহারা দিচ্ছে।

ওখানকার মতামতের খাতায় প্রচুর বিদেশি পর্যটকদের লেখা পড়লাম। সকলেরই প্রায় একই উক্তি ‘ওয়ান অব দ্য বেস্ট রিসর্টস ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’। মিঠুন ওখানকার তরু বাঙালি ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বলে উঠল, এর আগেও আমি বাঙালি ম্যানেজার রেখেছিলাম। সে আমার সর্বনাশ করে পালিয়ে গেছে।আমি আবার বাঙালি রেখেছি। আমি জানি এও আমার সর্বনাশ করে পালাবে। তবুও আবার বাঙালি ম্যানেজারই রাখব।

কথায় কথায় কোথা থেকে কোথায় চলে গিয়েছিলাম। এবার আবার ফিরে আসি সুধীন দাশগুপ্তের কথায়। ওঁর যতীন দাস রোডের বাড়ির সামনে একদিন আমি এসে দাঁড়ালাম। প্রচণ্ড গরমের সন্ধ্যা। উদ্দেশ্য গান লেখা নয়। ওঁর বাড়িতে সন্ধ্যায় স্নান করে ফ্রেশ হওয়া। উনি বাড়িই ছিলেন। আমার গাড়ির শব্দটা ওঁর চেনা হয়ে গিয়েছিল। গাড়ি থেকে নামতেই জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললেন, আরে, আসুন আসুন।

ঘরের ভিতরে ঢুকে আমার আগমনের আসল উদ্দেশ্যটা জানালাম। আমি স্নান করে পাউডার টাউডার মেখে ঢুকলাম ওঁর দেড়তলার মিউজিক রুমে। বললেন, আশ্চর্য টেলিপ্যাথি। আপনার কথায় ভাবছিলাম।

সুধীনবাবু আমায় একটা সুর শোনালেন। অবশ্যই বিদেশি ঘরানায় কিন্তু বুক ভরানো স্বদেশি মেলোডিতে ভরপুর। আমিও তৎক্ষণাৎ লিখে ফেললাম ‘আমি তার ঠিকানা রাখিনি/ছবিও আঁকিনি।

গানটি শেষ হতে যথারীতি উনি বললেন, কিশোরকুমার দারুণ গাইবেন। কোনও উত্তর করলাম না। শুধু বললাম, আধুনিক গান তো। রেকর্ডের উল্টোপিঠটা বানান। উনি বললেন, আজ থাক পরে।

নাছোড় আমার পাল্লায় পড়ে আবার ধরলেন হারমোনিয়াম। অবশ্য অন্য লয়ে অন্য তালে। লিখলাম ‘কথায় কথায় যে রাত হয়ে যায়/কী কথা রাখলে বাকি।’ সুধীনবাবু কিন্তু কোনও গানই টেপ করে রাখতেন না। আশ্চর্য স্মরণশক্তি ছিল ওঁর। দুমাস আগে বানানো একটা গান দুমাস পরে গাইলেও একটুও সুরের বিচ্যুতি হত না ওঁর। গান দুটি শেষ হতেই বললাম, কিশোরদার খেয়ালিপনার পেছনে দৌড়ে লাভ নেই। গান দুটি ভাল হয়েছে। আমি মান্নাদাকে অনুরোধ করব এবার পুজোয় এই গান দুটি যাতে উনি রেকর্ড করেন। মান্নাদা আমার অনুরোধ রেখেছিলেন। সেবার পুজোর রেকর্ডে গেয়েছিলেন ওই গান দুটি। এখনও সবাই তা শুনছেন।

৩৪

‘তিন ভুবনের পারে’ ছবির পর পরিচালক আশুতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় বিখ্যাত ব্লু অ্যাঞ্জেল-এর ট্রিটমেন্ট দিয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে ‘নিশিকন্যা’ ছবি বানান। কিন্তু যেহেতু বিভূতিভূষণের কাহিনী সেইহেতু ব্লু অ্যাঞ্জেল-এর আসল নাটকটাই ওখানে দিলেন না। যদি বিভূতিবাবুর গল্পের পরিবর্তন দর্শকরা সমালোচনা করেন এই আশঙ্কায়। আমি বললাম, তারাশঙ্করের ‘সপ্তপদী’-ও ছবিতে বদল হয়ে সুপারহিট হল। তোমার তা হলে আপত্তি কীসের?

আশুতোষ বলল, তারাশঙ্করবাবু জীবিত ছিলেন। কিন্তু বিভূতিবাবু নেই। ওঁর অনুমতি ছাড়া কোনও পরিবর্তন আমি করতে পারব না। নীতিগতভাবে ব্যাপারটা অবশ্য আদর্শ। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে নয়। তাই মিঠু মুখার্জি এবং সৌমিত্র চ্যাটার্জি অভিনীত ‘নিশিকন্যা’ ফ্লপ হয়ে গেল। কিন্তু ফ্লপ হল না সুধীনবাবুর সুর করা আমার গান। আশাজির গাওয়া ‘বেলাবেলি আসতে যদি বধুয়া এই ঘরে, লোকের কথায় কান দিয়ো না, পীরিতির পসরা নিয়ে তাকেই খুঁজে মরি।’ এ ছাড়া আশাজি আর রুমা গুহঠাকুরতার গাওয়া ‘ভেঙে যাবে ঠুনকো কাচের চুড়ি যে।’ আর মান্নাদার ‘ভেবে কে আর ভাব করে হে।’ এইসব গান নিয়ে পলিডর রেকর্ডের বাংলা ছবির গানের জন্ম হয়েছিল।

ইতিমধ্যে সুধীনবাবুর এমন অবস্থা হয়েছিল যে গুণমুগ্ধ মানুষ আত্মীয়স্বজন আর প্রযোজকদের আসা-যাওয়ার জ্বালায় অস্থির হয়ে পড়েছিলেন উনি। গানের সুর সৃষ্টির সময়ই দিতে পারছিলেন না সুধীনবাবু। অথচ উনি যথার্থ ভদ্রলোক ছিলেন। বাড়িতে থেকে বাড়ি নেই একথা কাউকে বলতে পারতেন না। সেই সময় আমাদের গোপন সিটিং-এর জায়গা ছিল আরতি মুখার্জির হিন্দুস্থান রোডের বাড়ি। যেখান সুধীনবাবু ছাড়া আর কেউ থাকত না। কেউই জানত না আমাদের এই অজ্ঞাতবাসের ঠিকানা। ওখানেই সৃষ্টি হয়েছিল শমিত ভঞ্জের ‘জবান’ ছবির গান। এই ছবিতে শত্রুঘ্ন, অমিতাভ, ধর্মেন্দ্র এই সব মুম্বইয়ের নায়করা ছিলেন। ওঁদের ছিল গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স। ওই ‘জবান’ ছবিতে মান্নাদার একটি গান ‘যদি প্রেম করি তুমি আমি’।

ওখানে বসেই পরিমল ভট্টাচার্যের ছবির সুর হয়েছিল এবং উত্তম-সুচিত্রার হার মানা হার’ ছবির গানও ওখানেই তৈরি। ও ছবির গান সুর করার জন্য প্রযোজকপক্ষ মান্না দে-কে প্রচুর অনুরোধ করেছিল। কিন্তু মান্নাদা রাজি হননি। তিনি ছবির কাজটি পাইয়ে দিয়েছিলেন সুধীন দাশগুপ্তকে। ওখানে ওই আরতির বাড়িতে একদিন পড়ন্ত বিকেলে পৌঁছে শুনলাম সুধীনবাবুর আসতে আজ একটু দেরি হবে। আমায় অপেক্ষা করতে বলেছেন। অগত্যা আরতির সঙ্গে বসে গল্প করতে করতে সময় কাটাচ্ছিলাম। পশ্চিমের জানালা দিয়ে গোধূলির রঙিন আলো আরতির চোখে-মুখে লাগছিল। আরতি একটু ভিন্ন আরতি হয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। বলল, পুলকদা আমার ভাল লাগছে না, কিছুই ভাল লাগছে না। আমি চমকে উঠে বললাম, সে কী! তুমি তো এখন এখানকার সবথেকে জনপ্রিয় গায়িকা। তোমার অ্যাচিভমেন্ট তো সাঙ্ঘাতিক। তোমার আবার কীসের দুঃখ। চোখের তারায় একটা আলোর দ্যুতি ঝিলিক দিল আরতির। এটা আনন্দ না কান্নার বুঝলাম না। ও বলল, না পুলকদা, না। সে আমি কিছুতেই খোলাখুলি বলতে পারব না। বোঝাতে পারব না। আপনি তো সবারই মনের কথা বোঝেন। গানে তাই তো লেখেন। সবারই মনের সঙ্গে মিলে যায় বলেই তো আপনার গান এত হিট হয়। সেই আপনি বুঝছেন না। তখন সত্যিই বুঝিনি কী চায় আরতি? অন্য ঘর? অন্য সংসার? অন্য স্বামী? না কি একটি সন্তান? সব মেয়েরাই তো যুগে যুগে এইসবই কামনা করে।

এ ঘটনা কাউকে কোনওদিন বলতে পারিনি। আজ বহুদিন বাদে বলে ফেললাম। জানি না বলা উচিত হল কি না। সেই নির্জন কক্ষে পরিচিত এক আরতি মুখার্জির চেহারায় আমি দেখেছিলাম অচেনা-অজানা আশ্চর্য আর এক আরতি মুখার্জিকে। কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। ধরতে পারিনি ওর কথার অর্থ। বুঝতে পারিনি ওর চোখের চাউনির আসল মানে। এসবই আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছিল বেশ কয়েকবছর পর। আরতি মুখার্জি-সুবীর হাজরার বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনায়।

ওই ‘হার মানা হার’ ছবিতে আরতির ওখানে বসেই লিখেছিলাম আমি যেন তারই আলো হতে পারি।’ সুধীনবাবুর সুরে গানটি গেয়েছিল আরতি। পর্দায় এ গানটি শোনা গিয়েছিল সুচিত্রার ঠোঁটে। ওই ছবিরই গান উত্তমকুমারের ঠোঁটে মান্নাদার গাওয়া গানটি লিখেছিলাম ‘এসেছি আমি এসেছি।’ আরতির গলায় আর একটি গান ছিল ‘এই আকাশ নতুন বাতাস নতুন সবই তোমার জন্য’।

তখনও ভাবিনি আরতির অন্বেষণ সার্থক হবে। আরতি প্রসঙ্গে আর একটি ব্যাপার উল্লেখযোগ্য। আজকাল বহু কপি সিঙ্গারই আরতির বহু গান গেয়ে শোনান। এমনকী ক্যাসেটেও। কিন্তু একজনও কি আমার লেখা এবং নচিকেতা ঘোষের সুর করা ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবির গান ‘যা যা বেহায়া পাখি যা না’ গানটি গাইতে সাহস করেন। এখানেই আরতি অনন্যা অদ্বিতীয়া। ঠিক তেমনি যে সন্ধ্যা মুখার্জি বড়ে গোলাম আলির সামনে খেয়াল গাইবার যোগ্যতা রাখেন সেই সন্ধ্যার ‘সপ্তপদী’ ছবিতে ‘না, না, তুমি। না না তুমি বল’ এই সুরের অভিনয়ের অভিব্যক্তিটি ভাষায় প্রকাশ করতে পেরেছেন কি কোনও একজন সন্ধ্যার কপি সিঙ্গার। এখানেই সন্ধ্যা অনন্যা, অদ্বিতীয়া।

এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি, ঠিকানাটা অবশ্য মুম্বইয়ের জুহু সেন্টুর হোটেলের একটি সুসজ্জিত ঘর। সময় ১৯৯৬-এর ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যরাত। চম্পক জৈনের ভেনাস রেকর্ডের গজল শিল্পী তালাত আজিজের একটি ক্যাসেট রিলিজের বিশাল পার্টি। ওখানেই মুম্বইয়ের সৌরীন বড়াল আমায় প্রশ্ন করলেন, দাদা বলুন তো কোন বিখ্যাত কৌতুক গায়কের পল্লী অঙ্গের আধুনিক বাংলা গান হাস্যরসে নয়, আস্তরিক মানবিক পরিবেশনাতেই সুপারহিট?

প্রশ্নটা শুনেই ওই সুন্দর পানাহারের মজলিশেও কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ মন চলে গেল টালিগঞ্জের নিউ থিয়েটার্সে। বললাম, ‘বিরাজ বৌ’ ছবিতে রাইচাঁদ বড়ালের সুরে কমিক গানের বিখ্যাত শিল্পী রঞ্জিত রায়ের কণ্ঠে একটি গান ছিল। গানটা হচ্ছে ‘এই না জলের আরশিতে তুই দেখতে পেলি কারে/তাই বুঝি তুই চার ফেলেছিস ধরবি বলে তারে’ খুব সম্ভব গানটি প্রণব রায়ের রচনা।

আমি জিতে গেলাম। এবার ওখানে উপস্থিত হুগলির গলরগাছা নিবাসী উত্তমের খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তনের খোকাবাবুর বিখ্যাত অভিনেতা জহর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন করলেন, বলুন তো রাইবাবুর সুরে উৎপলা সেন কোন ছবিতে পল্লীগীতি গেয়েছেন? আমি বললাম, বিমল রায়ের ‘অঞ্জন গড়’ ছবিতে গানটি ছিল ‘পরাণ বধুয়ারে।

এই সে দিন নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়ো থেকে পায়ে হেঁটে আসছিলাম। টালিগঞ্জের নানুবাবুর বাজারের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালাম। একটা মটরবাইক তীব্র আওয়াজ করতে করতে চলে গেল। ঠিক এইখানটায় যেখানে তখনও ভাল বাঁধানো রাস্তা হয়নি। ট্রাম ডিপো পর্যন্তই তখন শহরতলির শেষ ছিল। সেখানেই এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে মানসচক্ষে দেখলাম প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলে গেল একটা মটরবাইক। মটরবাইকটা এখানে এসেই জার্ক খেল। ছিটকে পড়লেন পেছনের এক আরোহী। ভাগ্য ভাল ওঁর আঘাত নিতান্ত মামুলি ছিল। কিন্তু উনি যে পড়ে গেছেন সেটা বুঝতেই পারলেন না মটরবাইক চালক। আমি জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই কলকাতায় ভীতিপ্রদ মটরবাইক চালাতে দেখেছি সাধারণ তিনটি শ্রেণীকে। এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্জেন্ট, দুই অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশানের মেম্বারের বন্ধ হয়ে যাওয়া গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ানো মটর মেকানিক, তিন ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির যন্ত্রবিদ। দু-একজন ডাকাবুকো বাঙালি এরপর ক্রমে ক্রমে মটরবাইক চালাতে শুরু করেন। জীবনে আমি প্রথম মটরবাইক চাপি রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে। সঙ্গে গাড়ি ছিল না। অথচ প্রয়োজন ছিল খুব তাড়াতাড়ি গড়িয়াহাট যাওয়ার। রীতিমতো ধমক খেয়ে ইষ্টনাম জপতে জপতে উঠেছিলাম ওই ভয়াভয় যন্ত্রটিতে। পেছনে বসে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। সামনের চালক মানুষটিকে লজ্জা শরম ভুলে রীতিমতো জড়িয়ে ধরে বসেছিলাম। চালকটি কে ছিল জানেন? উনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী কণ্ঠশিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস অর্থাৎ জর্জদা। জর্জদা ধমক দিয়ে আমার পৌরুষকে জাগিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আজকাল মেয়েরা চাপছে আর তুমি পারবে না? পরে আরও কয়েকবার জর্জদার বাইকের পেছনে উঠেছি। আর ভেবেছি কই আর কোনও কণ্ঠশিল্পী তো এই যানটি ব্যবহার করেননি।

সব দিক থেকেই জর্জদা ছিলেন তুলনাহীন।

নিউ থিয়েটার্সে পঙ্কজ মল্লিকের ছায়াসঙ্গী বিমলভূষণ কিছুদিন আগে আমায় বলেছিলেন কুন্দনলাল সায়গল মটোরবাইক চালিয়েছেন। একদিন পঙ্কজবাবুর সঙ্গে গাড়ি ছিল না। সায়গল সাহেব ওঁকে বললেন, চলো, আজ আমার নতুন মটরবাইকে তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আমি যতীন দাস রোডে ফিরব। সায়গল সাহেব আর মদিরা যেন মেড ফর ইচ আদার। উনি প্রায় সর্বক্ষণই সেই রসে সিক্ত থাকতেন। পঙ্কজবাবু সেই ভয়ে ওঁর সঙ্গে যেতে চাইলেন না। সায়গল সাহেব নাকি বলেছিলেন, পঞ্জাবে মেয়েরা বাইক চালাচ্ছে আর তুমি পিছনে চাপতে ভয় পাচ্ছ? তখন বাধ্য হয়ে উঠেছিলেন পঙ্কজবাবু। ওই চণ্ডী ঘোষ রোডে নানুবাবু বাজারের ঠিক সামনে পঙ্কজ মল্লিককে ফেলে সজোরে চলে গিয়েছিলেন কে এল সায়গল। বাড়ি গিয়ে হুঁশ হল কোথায় গেল পঙ্কজ মল্লিক? তখন তো টেলিফোনের এত সুবিধা ছিল না। তাই পরদিন নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োতে এসে সায়গল সাহেব পঙ্কজবাবুকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, পঙ্কজ কাল কখন তুমি নেমে গেলে? পঙ্কজবাবু বলেছিলেন, নেমে যাইনি। পড়ে গিয়েছিলাম। এই দেখ হাতে পায়ে কাটা ছড়ার দাগ। খুব বেঁচে গেছি হাত পা ভাঙেনি। সায়গল সাহেব সব শুনে হাসিমুখে গুনগুন করে গেয়েছিলেন, ‘প্রেমের পুজায় এইতো লভিনু ফল।’

সেদিনের আড্ডায় বিমলভূষণ আরও একটি দারুণ ঘটনার কথা বলেছিলেন। যে ঘটনাটি আপনাদের সকলকে শোনানোর লোভ সংবরণ করতে পারছি না।

বেতারের ১৯২৬ সালে ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি ৬ নং টেম্পল স্ট্রিটের টপ ফ্লোর থেকে ১৯৩০ সালে উঠে এল গার্স্টিন প্লেসে। নামকরণ হল ইন্ডিয়ান ট্রেড ব্রডকাস্টিং সার্ভিস। ১৯৩৯ সালে সায়গল সাহেব তখনকার দিনে সারা ভারতের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক ৪০০ টাকা নিয়ে রাস পূর্ণিমা অনুষ্ঠান করেছিলেন। ওইখানেই এক রাতে সায়গল সাহেব প্রিয় শ্রোতাদের জন্য পরিবেশন করেন ছায়াছবির বিখ্যাত গান ‘এ গান তোমার শেষ করে দাও/নতুন সুরে বাঁধ বীণাখানি।’ সেই অলৌকিক কণ্ঠের লাইভ ব্রডকাস্ট আমি শুনেছি মনে মনে। রবীন্দ্রনাথের ‘কোথায় আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা/মনে মনে’ ঠিক সেই ভাবেই আমি শুনেছি এই গান। বিমলবাবুর কাছেই কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে একটা ঘটনা শুনেছি। তখনকার এইচ. এম. ভি.-র অফিস ছিল চিৎপুরের গরানহাটায় ‘বিষ্ণু ভবন’-এ।

তখনকার টপ আর্টিস্টে’র মেয়েদের তালিকায় ছিলেন—আশ্চর্যময়ী দাসী, আঙুরবালা, ইন্দুবালা ইত্যাদিরা। সুদূর ঝরিয়া থেকে এসে তখন এক আশ্চর্য সুকণ্ঠী শিল্পী এইচ.এম.ভি.-তে যোগদান করেন। ওঁর পদবি কী হবে, যখন ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছেন না কেউ, শুনেছি তখন স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলামই নাকি ওঁর পদবি ঠিক করে দেন— ‘ঝরিয়া’। ‘কমলা দাসী’ হয়ে যান বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ‘কমলা ঝরিয়া’। বাসস্থানের নামে শিল্পীর পরিচিতি সম্ভবত বাংলাগানের জগতে আর কারও নেই। তখনকার অধিকর্তা ছিলেন হেম সোম। হেম সোম ছিলেন রেবা সোমের পিতা। যিনি সে সময় রেকর্ডে ‘নন্দদুলাল আয়রে আয়/ গোঠের বেলা যায়’ গেয়ে আলোড়ন তুলেছিলেন। কাজী সাহেব তখন দিন রাত এইচ. এম. ভি.-তে বসেই গান লিখতেন সুর করতেন। হঠাৎ একদিন নিখোঁজ—বেপাত্তা। হঠাৎ করেই একদিন আবার এইচ এম ভি অফিসে ফিরে আসেন। তাঁকে দেখে হেম সোম সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলেন?

কাজী সাহেব উত্তর করলেন, গিয়েছিলাম গুরুদেবের কাছে শান্তিনিকেতনে। কথায় কথায় গুরুদেব কী বললেন জানো? বললেন, তোমাদের মন্টু নাকি আজকাল খুবই হাস্যাস্পদ হচ্ছে। (মন্টু অর্থাৎ গায়ক সুরকার গীতিকার দিলীপ কুমার রায়, দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের সুযোগ্য পুত্র। ওঁরই ছাত্রী উমা বসুর ডাক নাম ছিল হাসি। ওঁদের অ্যাফেয়ারটা শান্তিনিকেতনে গুরুদেবের কানেও পৌঁছে গিয়েছিল। উনি তাই কাজী সাহেবকে ‘হাসি’র ব্যাপারে বলেছিলেন হাস্যাস্পদ)। কাজী সাহেব হো হো করে দিলখোলা হাসতে লাগলেন, বললেন, শুনলে তো গুরুদেব কেমন হাসিকে হাস্যাস্পদ করে দিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *