২০
আমার স্মৃতি ভাণ্ডারে জমা আছে আরও অনেক ঘটনা। লতাজির আরও অজস্র কথা—কিশোরদার আরও অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাপার। ওগুলো পরে বলব—এবার বলি—কলকাতার বেতারকেন্দ্র যখন গার্স্টিন প্লেস থেকে উঠে এল ইডেন গার্ডেনে তখন থেকেই বেতারের আর একটি স্বর্ণযুগ শুরু হয়। এখানেই তখন নিয়মিত কর্মী হয়ে যোগদান করেন সংগীতে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, ভি. জি. যোগ, দক্ষিণামোহন ঠাকুর প্রভৃতিরা। সাহিত্যের দিকটায় প্রেমেন্দ্র মিত্র, ছোটদের আসরে লীলা মজুমদার ইত্যাদি অসামান্যরা। মধ্যে বিমান ঘোষ ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছিলেন দিল্লি কেন্দ্রে, ওখান থেকে উনিও আবার চলে আসেন কলকাতায়। নাটকে বীরেন ভদ্র তো ছিলেনই, গানের দিকে তখন উপদেষ্টা হিসাবে এলেন বিখ্যাত রাইচাঁদ বড়াল। এখনও তাঁর গিলে করা পাঞ্জাবি আর কোঁচানো ধুতি পরা ধবধবে ফর্সা সৌম্যকান্তি রূপ আমার চোখে ভাসে। জ্ঞানবাবু শুরু করলেন রম্যগীতি। আলি আকবর, রবিশঙ্কর, ভি. বি. কৃষ্ণমূর্তি, নিখিল ঘোষ সবাই নিয়মিত সুরসৃষ্টি করতে লাগলেন রম্যগীতিতে।
লীলা মজুমদার, ঊষা দেবীর ‘শিশুমহলে’ তখন আমি প্রচুর সংগীতালেখ্য লিখেছিলাম। ছোটদের লেখা লিখতে আমি বরাবরই আনন্দ পেয়েছি, এখনও পাই। তখনই ‘জলসা’ পত্রিকায় প্রকাশিত বড়দের জন্য লেখা আমার একটি কাহিনীর বেতার নাট্যরূপ দেন অগ্নিমিত্র। কাহিনীর নাম দিয়েছিলাম ‘জল ভরা মেঘ’। তাতে অভিনয় করেছিলেন শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র প্রমুখরা। বেতারে শুক্রবারের নাটকে তার টেপ কয়েকবারই শুনেছিলাম! বেতারের নাট্য আসরে জানি না সেই ‘টেপ’ এখনও আছে কি না।
ইচ্ছে ছিল রাইচাঁদ বড়ালের (আর. সি. বড়াল) সুরে গান লেখার। কিন্তু রাইবাবু তখন গানে সুর করা থেকে সরে এসেছেন। নিয়েছেন পরিদর্শকের দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাই ওই বেতারের তখনকার রম্যগীতির জন্য বেতার কর্তৃপক্ষের অনুরোধমতো গান লিখতে গেলাম রাইচাঁদ বড়ালের ভ্রাতুষ্পুত্র দুনিচাঁদ বড়ালের কাছে। সে সময় দুনিবাবুর সহকারী ছিলেন জনপ্রিয় কার্তিক বসন্তের অগ্রজ সুগায়ক বলরাম দাশ।
দুনিবাবুর সুরে অনেক গান লিখেছিলাম তখন। প্রথম গানটাই ছিল শ্যামল মিত্রের গাওয়া—’কতোটুকু তুমি জানো/তোমায় দিয়েছি কী যে তোমায় কাঁদাতে কেন বারে বার আমিই কেঁদেছি নিজে/তার কতোটুকু তুমি জানো?’ পরের গানটি ছিল মানবেন্দ্রর গাওয়া—-—আমায় তুমি জড়িয়ে দিলে বন্ধনে/মালাতে নয় দুই নয়নের ক্রন্দনে’। এরপরের গানটি ছিল—শ্যামল মিত্রেরই গাওয়া—যেতে যেতে যদি সে গো ফিরে চায়।’ তারপরই নির্মলা মিশ্রের গাওয়া-’পাখি আজ গাইবে কী গান পায়না ভেবে/কী সুরে সে ফাগুনকে আজ রাঙিয়ে দেবে?’ স্বয়ং আর. সি. বড়ালের তত্ত্বাবধানে রেকর্ড করা ডি. সি. বড়ালের সে-সব গানগুলো আমার কাছে আজও তুলনাবিহীন।
দুনিবাবু তারপর এইচ. এম. ভি.-তেও কাজ করেছিলেন। সেখানেও ছিলাম আমি, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য প্রথম রেকর্ডটি করেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার গ্রামোফোন রেকর্ডের গানগুলো তেমন চলল না। তবুও বলতে বাধ্য হব—প্রকৃত বড় মাপের সংগীত পরিচালকের সমস্ত গুণ থাকা সত্ত্বেও কেন যে বাংলা সংগীতজগৎ তাঁকে তেমন করে কাছে টেনে নিল না, তার কারণ আমি আজও খুঁজে পাই না। দুনিচাঁদ বড়াল বোধহয় অভিমানেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন।
জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সুরেও রম্যগীতিতে আমি প্রচুর গান লিখেছি। তার মধ্যে একটি গান আমার বিশেষ প্রিয়। সে গানটি গেয়েছিলেন তখনকার বেতারের উচ্চপদস্থ কর্মী সুধীন চট্টোপাধ্যায়।
গানটি হল—’এ-গান আমার শোনে সবাই/কী কথা সে কয় বোঝে ক’জন?/আঁখিতে সবার মায়া ভরাই/কে খোঁজে এ-চোখে কত স্বপন?’ সুধীনবাবুর গাওয়া—’ভুলে যেও ভুলে যেও মোর গান/এ-শুধু আমার শেষ মিনতি এতো নয় অভিমান –একদিন সবাই চলতে-ফিরতে গুনগুন করত।
এই সুধীন চট্টোপাধ্যায়েরই সুযোগ্য পুত্র আজকের জনপ্রিয় শিল্পী সুমন চট্টোপাধ্যায়। যতদূর মনে পড়ছে—সুমন চট্টোপাধ্যায় তখন কি তার কিছু পরে —কলকাতা বেতারে নিয়মিত সুন্দর সুন্দর অনুষ্ঠান করত।
রম্যগীতির প্রসঙ্গে তখনকার কলকাতা বেতারের একটা প্রশংসনীয় ব্যাপার উল্লেখ করতেই হয়—তা হল মুম্বই-এর কোনও প্লে-ব্যাক শিল্পীকে দিয়ে কলকাতা বেতারের কোনও গান গাওয়ানোর কোনও প্রয়োজনই তখন ওঁরা অনুভব করেননি। এর পরবর্তীকালেও মুম্বই-এর বাঙালি শিল্পী মান্না দে-র প্রথম রম্যগীতির ‘সবুজ সংকেত’ আদায় করতে আমি তখনকার স্টেশন ডিরেক্টরকে বারবার অনুরোধ করেছিলাম। তবে কাজ হয়েছিল।
আজকালকার প্রায় সব বাংলা ছবিতেই মুম্বই-এর শিল্পীরা গান করেন। তার পেছনে চিত্রপ্রযোজকদের নিশ্চয়ই বিশেষ কোনও বাণিজ্যিক স্বার্থ থাকতে পারে। কিন্তু আশ্চর্য হলাম এবং দুঃখ পেলাম তখন, যখন ১৯৯৪-এর শিলিগুড়ি ও কলকাতা বেতারের পুজোর বাংলা গান বেতার কর্তৃপক্ষ রেকর্ড করালেন কিছু বাঙালি শিল্পীদের সঙ্গে মাদ্রাজের বানী জয়রাম—মুম্বই-এর হরিহরণ, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, অনুরাধা পড়োয়াল, অনুপমা প্রমুখের বাংলা গান। মুম্বই-এর শিল্পীদের শিলিগুড়ি বা কলকাতা বেতারের বাংলা পুজোর গান গাওয়ানোর অন্তরালে এখানকার অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের বেতার কর্তৃপক্ষের কী বাণিজ্যিক স্বার্থ থাকতে পারে তা আমার মাথায় আসে না। তাঁদেরই তো উচিত নতুন নতুন গুণী শিল্পীদের সুযোগ দিয়ে বাংলা গানের আসরে তুলে ধরা। যাঁরা বাণিজ্যিক বাধায় গানের জগতে পা ফেলতে পারছেন না তাঁদের হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। মুম্বই বেতার কেন্দ্র শিলিগুড়ি বা কলকাতা বেতার কেন্দ্রের একজন শিল্পীকে দিয়েও গণেশ পুজো উপলক্ষে কোনও একটা ‘গণপতি বন্দনার’ গানও মুম্বইতে নিয়ে গিয়ে গাইয়েছেন কি? আশ্চর্য আমরা বাঙালি।
এবার অন্য কথায় আসি। জ্ঞান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তখন কলের গানে ঘরে ঘরেই একটি গান বাজতে শুনতাম। ব্যতিক্রমী কণ্ঠস্বরে একটি পল্লীগীতি ‘ডাকলে কোকিল রোজ বিহনে…’। যতদূর জানি এটাই কুমার শচীন দেববর্মণের প্রথম রেকর্ড এবং প্রথম রেকর্ডটিই সুপারহিট। এরপরে উনি রেকর্ড করলেন ‘নিশীথে যাইও ফুলবনেরে ভ্রমরা…’। সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরীর কাছে শুনেছিলাম গানটি পুব বাংলার এক গ্রাম্য কবি শেখ ভানুর রচনা। গানটির প্রথম অন্তরায় ছিল জ্বালায়ে দিলের বাতি। জেগে রব সারারাতি গো। কুমার শচীন দেববর্মণ যখন গানটি রেকর্ড করেন তখন কবি জসিমউদ্দিন ‘দিল’ শব্দটি বদলে করে দেন ‘জ্বালায়ে চান্দের বাতি/জেগে রব সারারাতি গো।’ এই রেকর্ডটির পরে ‘নতুন ফাগুন যবে’ ‘প্রেমের সমাধি তীরে’, ‘আমি ছিনু একা’ ইত্যাদি অজস্র হিট গান তখন খুব শুনতাম। শচীন দেববর্মণ ছিলেন সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী। হিমাংশু দত্তের সুর দেওয়া অজয় ভট্টাচার্যের লেখা ‘আলোছায়া দোলা উতলা ফাগুনে, ‘যদি দক্ষিণা পবন আসিয়া ফিরেগো দ্বারে’, ‘মম মন্দিরে এলে কে তুমি’, এই রকম কিছু গান ছাড়া ওঁর নিজের গাওয়া অনবদ্য সব বাংলা নন-ফিল্মি গানের অধিকাংশই ওঁর নিজের সুর। কিন্তু ওঁর সুরে অন্য কোনও শিল্পী নন-ফিল্মি গান গেয়েছেন কিনা স্মরণে আসছে না। উনি নিজে অবশ্য অন্য সুরকারের সুরে বাংলা ছবিতেও গান গেয়েছেন একথা মনে আসছে। সুরসাগর হিমাংশু দত্তের সুরে সে যুগের সুপারহিট ছবি ‘জীবন সঙ্গিনী’তে গেয়েছিলেন অজয় ভট্টাচার্যের লেখা দুটি গান ১। জনম দুখিনী সীতা/লাঞ্ছিতা তুমি চির বঞ্চিতা’ ২। ‘কে যেন কাঁদিছে আকাশ ভুবনময়…
শচীন দেববর্মণ প্রচুর বাংলা ছবিতেও সংগীত পরিচালনা করেছেন। সেখানে গেয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন শিল্পীরা। কিন্তু শচীন দেবের নন ফিল্মি গান যেমন প্রকাশ হওয়া মাত্র সুপারহিট হয়েছে বাংলা ফিল্মের গান তেমন হয়নি। এ এক অবাক করা সত্য। বাংলা ‘ছদ্মবেশী’, ‘জজ সাহেবের নাতনী’ এমন দু-একটি ছবি ছাড়া কোনও ছবির গানই তেমন হিট করেনি। ‘জজ সাহেবের নাতনী’ ছবিতেই উনি সুযোগ দেন বিমলভূষণকে। বিমলভূষণের গাওয়া ‘বড় নষ্টামি দুষ্টামি করে চাঁদরে…’ অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল।
শচীনদা বৃহত্তর সাফল্যের সন্ধানে চলে গেলেন মুম্বই। কিন্তু বাংলা ছাড়লেও বাংলা গানকে ছাড়েননি। মুম্বই-তে অনিল বিশ্বাস, রামচন্দ্র পাল-এর পর সংগীত জগতে আসা এই বাঙালি সুরকার এস ডি বর্মণ রাতারাতি কাঁপিয়ে দিলেন মুম্বই ফিল্ম জগৎকে। ইতিমধ্যে কৃষ্ণচন্দ্র দেও মুম্বই-তে এলেন। সঙ্গে নিয়ে এলেন সহকারী হিসাবে কাজ করার জন্য ওঁর ভাইপো মান্না দেকে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যের ওপর একটি হিন্দি ছবিতে গান গাইবার জন্য কে সি দে কলকাতা থেকে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যকে মুম্বই নিয়ে গিয়ে গান গাওয়ালেন। কিন্তু কিছু হিন্দি ছবি করার পরে কে সি দে দেখলেন স্বাস্থ্য এবং ভাগ্য ওঁর প্রতিবন্ধকতা করছে। উনি ফিরে এলেন কলকাতায়। মান্না দে কিন্তু ফিরলেন না। রয়ে গেলেন মুম্বই-তে এস ডি বর্মণের সহকারী হয়ে।
২১
মান্না দেকে প্রবাসে পায়ের নীচে একটু মাটির সন্ধান করতে কী কষ্ট করতে হয়েছে মান্নাদা তা অকপটে আমায় বলেছেন। যখন পায়ের নীচে মাটি পেয়ে গেছেন তখনও চলেছে এই স্ট্রাগল। চোখের কোণে জলের রেখা এনে আমায় বলেছেন, জানেন তালাশ’ ছবির ‘তেরি নয়না তালাশ করকে…’ এই গানটা তুলতে গেছি শচীনদার মিউজিক রুমে। ওখানে পরিচালক এলেন গান শুনতে। শচীনদা আমাকে বললেন, মানা তুই গেয়ে শোনা (শচীনদা মান্নাদাকে আজীবন মানা বলে ডেকে এসেছেন)। পরিচালক মান্নাদার সামনেই বলে উঠেছেন, মান্না দে গাইবেন নাকি? মুকেশ কী হল? শচীনদা জবাব দিয়েছেন, মুকেশ এ গান গাইতে পারবে না? পরিচালক শচীনদাকে সোজাসুজি বললেন, এমন গান কেন বানালেন যা মুকেশ গাইতে পারবে না? শচীনদা তখন ওঁর নিজস্ব স্টাইলে হিন্দিতে উত্তর দিলেন, তালাশ ছবি যদি এস ডি বর্মণ করে তবে এই গানের সুরটাই থাকবে। আর গাইবে মানাই। তোমার অপছন্দ হলে তুমি অন্য মিউজিক ডিরেক্টর নাও। শচীনদা একরকম জোর করেই ও গানটি মান্না দেকে দিয়ে গাইয়েছিলেন এবং সবাই জানেন তার ফল কেমন হয়েছিল। পরিচালক মশাই সিলভার জুবিলিতে বলেছিলেন, এস ডি বর্মণ সাব আপনি আমাদের দাদা। আপনি চিরদিনের দাদা।
সবাই ওঁকে দাদা মানত। মুম্বই-তে হেমন্তদা যথারীতি হাসতে হাসতে আমাদের বলতেন, যাচ্ছি শচীনদার গান তুলতে। কিন্তু কে গাইবে কেউ জানে না। মান্নাবাবু, তালাত, মুকেশ, রফি সবাই গান তুলবেন। যাঁর কণ্ঠে এই বিশেষ গানটি ওঁর পছন্দ হবে সেই শেষ পর্যন্ত রেকর্ড করবেন। এ রকম ব্যাপার তখনকার মুম্বই-এর সব শিল্পীরাই হাসিমুখে মেনে নিতেন। কারও কোনও অনুযোগ ছিল না দাদার প্রতি। এহেন এস ডি বর্মণকে দিয়ে আমার লেখা গান গাওয়ানোর জন্য ধরলাম সহৃদয় সুশীলদাকে। আজকের সংগীত জগতের সবার প্রিয় ‘মেলডি’-র দুলাল চক্রবর্তীর পিতা সুশীল চক্রবর্তী ছিলেন শচীনদার খুবই কাছের মানুষ। শচীনদা মুম্বই থেকে যখন মাঝে মাঝে কলকাতায় আসতেন তখনও নিয়মিত ঘড়ি ধরা সময়ে ওই মেলডির পুরনো বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে গল্পগুজব করতেন। ওখানেই আমি প্রথম দেখি শচীনদার কলকাতার পুরনো সহকারী সুরশিল্পী কালীপদ সেনকে।
যাই হোক, সুশীলদার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম, খোঁজ নিতাম কবে শচীনদা আসবেন। একসময় আমার ভাগ্য প্রসন্ন হল। সুশীলদা বললেন, ওমুক তারিখে সকালে ঠিক ওমুক সময়ে তুমি এসো। কর্তা কিন্তু খুবই টাইমের মানুষ। দেরি কোরো না। গেলাম। সুশীলদা আলাপ করালেন। আমি প্রণাম করলাম। শচীনদা বললেন, ওহো তুমি পুলক। মানা আমার কাছে তোমার খুবই সুনাম করে। খুব কম কথা বলতেন শচীনদা। এইটুকু বলেই চুপ করে গেলেন। সুশীলদা ধরিয়ে দিলেন পুলক গান নিয়ে কলকাতার বাড়িতে কবে যাবে। তখন কে একজন বললেন (বিষয়টা ঠিক মনে নেই, ধরা যাক) জানেন কর্তা কাল দেশপ্রিয় পার্কের ট্রাম থেকে নামতে গিয়ে দেখি একটা পাগলা ষাঁড় ছুটে আসছে। একেবারে আমার সামনে। শচীনদার চোখ তখন ঘড়ির দিকে চলে গেছে। তিনি বলে উঠলেন, চল রে ভাই।
ব্যাস, তৎক্ষণাৎ উঠে পড়লেন তিনি। শুনলেনই না আর কোনও কথা। এমনই টাইমের মানুষ ছিলেন শচীনদা।
নির্দিষ্ট দিনে এবং সময়ে পকেটে গান নিয়ে গেলাম শচীনদার কলকাতার বাড়ি সাউথ এন্ড পার্কে। ঘরে বসলাম। ওদিকের দরজায় হয়তো বউদি উঁকি দিয়েছিলেন। শচীনদা আমাকে ওঁর নিজস্ব ভঙ্গি আর ভাষায় বললেন, চা খাবা নাকি ভাই? অ্যাত বেলায় খাবা? তারপর আমায় কিছু বলার অবকাশটুকু না দিয়ে বললেন, না না অ্যাত বেলায় চার প্রয়োজন নেই।
এবার আমাকে হারমোনিয়ামটা দেখিয়ে বললেন, শোনাও। আমতা আমতা করে আমি বললাম, আপনি ভুল করছেন। আমি গান গাই না, গান লিখি।
শচীনদা বললেন, হ হ শোনাও। আবার আঙুল দিয়ে দেখালেন হারমোনিয়ামটা। এরকম বার কয়েক হবার পর ছোটবেলায় বাবার কাছে অরগান বাজাতে শেখা আমি মরিয়া হয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে কী একটা গান গেয়ে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে দিলেন উনি। বললেন, ব্যস ব্যস আর নয়। তোমার হবেরে ভাই তোমার হবে। আমি এতক্ষণ তোমার পরীক্ষা নিচ্ছিলাম তোমার সুরবোধ কেমন। ভাল গান লিখতে হলে তোমাকে গান জানতেই হবে। বম্বের সব রাইটাররাই রীতিমতো গাইতে জানেন। ওঁরা যখন ওঁদের লেখা গান মিউজিক ডিরেক্টরকে দেন সে গানটা নিজের সুরে গেয়ে শুনিয়ে তবে দেন। তুমিও যদি সেটা করতে পার কেউ তোমাকে রুখতে পারবে না ভাই।
শচীনদার এ কথা যে কত খাঁটি তার প্রমাণ পেয়েছিলাম কিছুদিন পরেই। রেকর্ডিং-এ কিশোরকুমার অনুপস্থিত হওয়ায় ছবির একটি ডুয়েট গান লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে গাইতে দ্বিধা করেননি সে ছবির বিখ্যাত গীতিকার আনন্দ বক্সি। কাঁচ কা গুড়িয়া ছবিতে সম্ভবত একটা একক গানও গেয়েছিলেন আনন্দ বক্সি। এখনকার নামী মহিলা গীতিকার মায়া গোবিন্দকেও দেখেছি ওঁদের দেশওয়ালি গান গেয়ে গেয়ে শুনিয়ে সুরকারদের দিতে। অনেক সময়ই সুরকারও সেই সুরটি প্রয়োগ করেছেন সেই গানে। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুম্বই-এর খ্যাতনামা গীতিকার ইন্দিবরও ওঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে খাওয়াতে কত নতুন নতুন হিন্দি গান শুনিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। আমিও আমার গলাতে গেয়ে অনেক নতুন নতুন বাংলা গান শুনিয়েছি।
যাই হোক, শচীনদার কাছ থেকে আমি কথা আদায় করে নিলাম উনি আমার গান গাইবেন। বললেন, পুজোর গানের জন্য ঠিক ওমুক মাসে ওমুক তারিখে আমাকে মুম্বই-তে যেতে। আমিও তারিখটা সঙ্গে সঙ্গে একটা কাগজে লিখে পকেটে পুরলাম।
মুম্বই-এ থাকার কিছুদিন পরেই লক্ষ করেছিলাম শচীনদার গাওয়া বাংলা আধুনিক গানের সুরের স্টাইলও খুব বদলে গেছে। অবশ্য হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি ছাড়ার আগেই তার ইঙ্গিত পেয়েছিলাম। মোহিনী চৌধুরীর লেখা ‘হায় কী যে করি এ মন নিয়া’ এবং ‘এই চৈতি সন্ধ্যা যায় বৃথা…’। মোহিনী চৌধুরীর লেখা আরও দুটি গান, একটি গেয়েছিলেন বউদি অর্থাৎ মীরা দেববর্মণ ‘আজ দোল দিল কে আমার হিয়ায়’ অন্যটি শচীনদার সঙ্গে বউদির দ্বৈতসংগীত ‘ওই গায় যে পাপিয়া গায় কোয়েলা গায়’। এরপর শচীনদা এইচ. এম. ভি.-তে গাইলেন মোহিনী চৌধুরীর লেখা আরও দুটি গান ‘ভুলায় আমায় দু’দিন’ এবং ‘কে আমাকে আজও পিছু ডাকে’। এর পরেই রবি গুহমজুমদারের লেখা বিখ্যাত গান ‘মন দিল না বধু/মন নিল যে শুধু/আমি কী নিয়ে থাকি — থেকে শচীনদা ভিন্নতর হয়ে গেলেন।
২২
দিন কেটে যাচ্ছিল। হাতের কাছে বাংলা গানের গীতিকার না পেয়ে বউদি মীরা দেববর্মণই লিখতে লাগলেন শচীনদার বাংলা আধুনিক গান। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় ‘শোন গো দক্ষিণ হাওয়া প্রেম করেছি আমি’, ‘রূপে বর্ণে ছন্দে ছন্দে জীবন জাগালে তুমি’—ইত্যাদি গান। এদিকে আমারও সময় এসে গেল শচীনদার দেওয়া তারিখে মুম্বই যাওয়ার। নির্দিষ্ট তারিখে লিংকিন রোডে শচীনদার ‘জেট’ বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। শচীনদা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি বিনীতভাবে বললাম, আপনি তো এই সময়েই এখানে আসতে বলেছিলেন। শচীনদা বোধহয় আমার ব্যাপারটা ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি বললেন, হ হ, তুমি বসো।
ঘরে আরও লোকজন ছিলেন। এক ভদ্রলোক আমার সামনেই তার হাতের ছোট টিনের সুটকেশ খুলে ওঁকে দেখালেন নোটের গোছা। শচীনদা ওঁর ভঙ্গিতে বললেন, তুম জিতনা রূপাইয়া দেখাও হাম তুমারা পিকচার নেহি করেঙ্গা। ওই ভদ্রলোকের অনেক কাকুতি-মিনতি উপেক্ষা করে শচীনদা তাকে বিদায় দিলেন।
ঘরের মধ্যে বসা অন্য এক ভদ্রলোক বললেন, দাদা, সাত সকালে এতগুলো টাকা ছেড়ে দিলেন? উনি বললেন, কুয়া জান? পাতকুয়া? পাতকুয়া থেকে একসঙ্গে সব জল তুলে নিলে কুয়া শুকিয়ে যায়। কুয়াতে জল জমবার সময় দিতে হয়। মিউজিক ডিরেকশনও তাই। টাকার লোভে একগাদা ছবিতে কাজ করলে আমি ফুরিয়ে যাব। আমার ইয়ারলি কোটা আছে। তার বেশি আমি কাজ করি না। আমার এ বছরের কোটা কমপ্লিট। যে যত টাকাই দিক এ বছরে আর আমি ছবি করব না।
শচীনদা ওঁর এই উক্তির প্রমাণ রেখে গেছেন। কত নামী দামি সুরকার হইহই করে ছবি করেন। তারপর নিঃশব্দে কবে কখন সরে যান কেউ তার খবর রাখে না। কিন্তু এস ডি বর্মণ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ওঁর ডিমান্ড রেখে গেছেন। ফুরিয়ে গিয়ে নিঃশব্দে প্রস্থান করেননি। দিয়ে গেছেন নিত্য নতুন সুরের স্টাইল।
সেদিন নিজের বাড়িতে শচীনদা চা খাওয়ালেন। ঘরের লোকদের বিদায় দিয়ে বললেন, কী গান লিখেছ শোনাও। প্রথম গানটি শুনেই বললেন, এ গানটি যে গাইবে সুপারহিট হয়ে যাবে। কিন্তু ভাই আমি রেকর্ড করতে পারব না। চমকে উঠে বললাম, সে কী! শচীনদা বললেন, না পুলক হোমফ্রন্টে গণ্ডগোল ভাল না। তোমার বউদি গান লিখেছেন। আমি বানিয়ে ফেলেছি। তবে তোমায় আমি ফেরাব না। এখনই পঞ্চম আসবে। পঞ্চম দারুণ গাইছে। ওকে দিয়ে তোমার গান রেকর্ড করাব। (পঞ্চম তখন থাকত প্রথমা স্ত্রী রীতা পটেলের সঙ্গে সান্তাক্রুজের কাছে একটা সুন্দর বাড়িতে)।
বসে রইলাম। বসে বসেই ভাবতে লাগলাম স্বয়ং শচীন দেববর্মণ যখন বলেছেন গানটা সুপারহিট হবে তখন নিশ্চয় আমার গানটায় কিছু একটা আছে। কিন্তু কাকে দি। হঠাৎ মাথায় এল অখিলবন্ধু ঘোষের নাম। সেদিনই মুম্বই থেকে একটা পোস্টকার্ডে গানটা পাঠিয়ে ছিলাম কলকাতায়। অখিলবন্ধু নিজের সুরে গেয়েছিলেন সেই গান ‘ও দয়াল বিচার করো। দাওনা তারে ফাঁসি/ আমায় গুণ করেছে। আমায় খুন করেছে ও বাঁশি…’।
শচীনদার ভবিষ্যৎবাণী বা আশীর্বাদ অক্ষরে অক্ষরে ফলেছিল। সত্যি সুপারহিট হল সে গান। যা হোক, পঞ্চম আসছে না। সময় কাটাবার জন্য বললাম, বউদির কী গান রেকর্ড করছেন একটু শোনাবেন?
হারমোনিয়ামটা নিলেন উনি। একটু বাজিয়ে বললেন, না থাক। এখনও রেকর্ড হয়নি। আমি অনুরোধ করলাম, রেকর্ড নাই বা হল। আপনার নতুন গান শুনতে দারুণ ইচ্ছে করছে।
শচীনদা বললেন, তবে একটু শোনো। কথাটা বলেই আমার দিকে সোজা তাকিয়ে বলে উঠলেন, তুমি আবার মেরে দেবে না তো ভাই? এখনও রেকর্ড হয় নাই। আমার সুর আমার গানের আইডিয়া কেউ মেরে দিলে বুকে বড্ড ব্যথা লাগে। শচীনদা কখনও কাউকে রেকর্ড না হওয়া কোনও গান শোনাতে চাইতেন না।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে একবার আমার সঙ্গে আমার সুরকার বন্ধু সুধীন দাশগুপ্ত গিয়েছিলেন শচীনদার বাড়িতে। সুধীনবাবুর অনেক অনুরোধে উপরোধে অনেক বাহানা দেখিয়ে আমাকে রীতিমতো অবাক করে দিয়ে হারমোনিয়ামের সামনে বসলেন শচীনদা। সুধীনবাবু নিশ্চয় আত্মগর্বে গর্বিত হয়ে ভাবলেন একটা অসাধারণ ব্যতিক্রমী ব্যাপার উনি ঘটাতে পারলেন। শচীনদা হারমোনিয়ামটা খুললেন। তারপর হঠাৎ একটা বেসুরো ‘ডিসকর্ড’ সুর বাজিয়েই বিরক্তিতে বলে উঠলেন, ধাস! না সুধীন হবে না। বেসুরো হারমোনিয়ামটা আমার মেজাজটাই নষ্ট করে দিল। হারমোনিয়ামটা সরিয়ে দিয়ে উঠে পড়লেন শচীনদা। আর আমি মনে মনে হেসে গড়িয়ে পড়লাম।
যাই হোক, আবার আমি ফিরে আসি সেদিনের ঘটনায়। আমি নিশ্চয় সৌভাগ্যবান আমায় একটু শোনালেন ওঁর রেকর্ড না হওয়া নতুন গান। শুনলাম এক অপূর্ব সুর, অপূর্ব কথা, অপূর্ব গানের পূর্বাভাষ। শচীনদা গান থামিয়ে বললেন, বলরে ভাই জমবে তো? এ কিন্তু ‘আমি ছিনু একা বাসর জাগায়ে’ নয় এ ভিন্ন গান। ‘আমি ছিনু একা’ সপ্তাহে চারটে বানাতে পারি। কিন্তু এ গান বানাতে লাগে চার চারটি মাস। কর্মাশিয়াল গান বানানো ভারী শক্তরে ভাই। মনে রাখবে তোমার বায়ার সতেরো থেকে সাতাশ, তাদের পছন্দ হলে তবে তোমার রেকর্ড কিনে বাড়ি যায়। তারপর তাদের বাপ-মায়েরা শোনে। সে গান পপুলার হয়।
এমন সময় পঞ্চম ঘরে ঢুকল। ওকে চিনতাম অনেক আগে থেকে। ওর তখন ‘পড়োশন’, ‘ভূতবাংলা’ ছবির গান হিট করে গেছে। আমায় দেখেই বললে, আরে কবে এলেন? শচীনদা বললেন, পুলক দারুণ মডার্ন গান লেখে। আর তুমি তো মডার্ন গানে দারুণ সুর করো। রেকর্ড করো পুলকের গান।
পঞ্চম বলে উঠল, কী যে বলেন ড্যাডি। আপনি আমাদের থেকে অনেক অনেক মডার্ন। কিন্তু বাংলা গান আমার আসে না। ও আমি গাইতেও পারব না। সুর করতেও পারব না।
শচীনদা বললেন, পুলক এখন তুমি বাড়ি যাও ভাই। কাল সকালে পঞ্চমের বাড়ি এসো। আমি মর্নিং ওয়ার্ক সেরে ওর বাড়িতে আসব।
পরদিন সকালে গেলাম পঞ্চমের বাড়িতে। পঞ্চম-রীতা বিশাল প্রাতঃরাশ দিয়ে আমায় অভ্যর্থনা জানাল। ঠিক সময় শচীনদা এসে গেলেন। এসেই বললেন, তোমরা সিটিং শুরু করো। আমি লতাকে বলেছি। লতা তোমার সুরে পুলকের কথায় গাইবে এবারের পুজোর গান। আর এটাই হবে আর ডি বর্মণের প্রথম বাংলা গান।
অগত্যা পঞ্চম আমায় বলল, আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি। অমুক সময় কলকাতায় আসছি। ইতিমধ্যে কিছু সুর আমি বানিয়ে রাখছি। আপনাকে নিয়ে কলকাতায় সিটিং-এ বসব।
অসাধারণ সুরকার আর ডি বর্মণের বাংলা গানের প্রথম গীতিকার আমি এ নিশ্চয় আমার সৌভাগ্য। যথা সময়ে পঞ্চম কলকাতায় এল। গেলাম ওই সাউথ এণ্ড পার্কের বাড়িতে। পঞ্চম বলল, আমি খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। একেবারে খেয়েদেয়ে যাবেন। দেখলাম এলাহি খাবারদাবারের আয়োজন। শচীনদার ঠিক উল্টো। পঞ্চম সুর শোনাতে শুরু করল। মনে আছে পর পর আটটা সুর শুনিয়েই পঞ্চম বলল, যে দুটো আপনার ভাল লাগে লিখুন।
আমি তো বাঁশ বনে ডোমকানা। বললাম, আটটা সুরেই কথা বসাব। পঞ্চম হেসে উঠল। এখন আমরা ক্যাসেটের যতই বদনাম করি তখন যদি আজকের মতো ব্যবস্থা থাকত তা হলে আটটি গানের অমর ক্যাসেট জন্ম নিতে পারত। যাই হোক, লটারি করে দুটো গান বেছে নিলাম। মনে পড়ল ভূপেন হাজারিকার সুরে কী একটা ছবির জন্য লতার নাম দিয়ে লিখেছিলাম ‘পরশ পেলেই ঘুমিয়ে পড়ি আমি লজ্জাবতী লতা’। অনিবার্য কারণে ও গানটা রেকর্ড হয়নি। কিন্তু লতাজি শুনেছিলেন। আমায় হাসতে হাসতে বলেওছিলেন, আমার নাম দিয়ে লেখা গানটা আমি শুনেছি। ভাল লেগেছে।
তৎক্ষণাৎ মাথায় এসে গেল এই লতার নাম দিয়েই পঞ্চমের একটা গান লিখি। লিখেছিলাম ‘আমার মালতী লতা/কী আবেশে দোলে/আমি সে কথা জানি না/আমায় কে যে দেবে বলে’। উল্টো পিঠে লিখেছিলাম ‘আমি বলি তোমায় দূরে থাক/তুমি কথা রাখো না’।
আবার বলি আমি সৌভাগ্যবান। আর ডি বর্মণের প্রথম বাংলা গানের গীতিকার হতে পেরেছি বলে। আর যে রেকর্ডে কণ্ঠ দিয়েছিলেন অদ্বিতীয়া লতা মঙ্গেশকর।
এর কিছুদিন বাদেই ঊষা খান্নার সুরে চন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়ের জন্য বাংলা গান লিখতে মুম্বইতে এলাম। তখন রোজ সকালে পঞ্চমের রেকর্ড না হওয়া বাকি সুরগুলোর ওপর কথা বসাতাম। পঞ্চম কিন্তু তখনও বাংলা গানের ওপর ততটা মন বসাতে পারেনি। প্রত্যেকটি সুরই হিন্দিতে লাগাল এবং গানগুলো সুপারহিটও হল। আর একবার একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। মুম্বই-এর রাস্তায় শচীনদার বাড়ির সামনে দিয়ে আসছি। ওপরের বারান্দায় দাঁড়ানো শচীনদার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। দেখা করতে গেলাম। শচীনদা জিজ্ঞেস করলেন, কবে এলে? কার কাজে?
আমি উত্তর দিলাম, মান্না দের সুরে এইচ. এম. ভি.-র জন্য আশা ভোঁসলের পুজোর গান লিখতে।
শচীনদার বোধহয় তখন কোনও নতুন গানের সিটিং ছিল। আমাদের কথার মধ্যেই ঘরটায় অনেকে এসে গেলেন।
শচীনদা বললেন, কী গান লিখলে?
আমি বললাম, ‘আমি খাতার পাতায় চেয়েছিলাম/একটি তোমার সই গো/তুমি চোখের পাতায় লিখে দিলে/আমি হলাম তোমার সই গো’। গানটা শুনেই বাঙালি যাঁরা ছিলেন সবাই একসঙ্গে তারিফ করলেন। অবাঙালিরা বলে উঠলেন কেয়া মতলব? ওখানে আনন্দ বক্সিও ছিলেন। বাঙালিরা হিন্দিতে অবাঙালিদের গানের অর্থটি বুঝিতে দিতেই তারাও তারিফ করল। শচীনদা বললেন, কলকাতায় ফেরার দিন আমার সঙ্গে দেখা করে যাও।
ফেরার দিন দেখা করতে গেলাম। সেদিনও সিটিং ছিল। অনেকেই আসতে লাগলেন। তখন শচীনদার কী একটা গান বিবিধ ভারতীতে শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। বললাম সে কথাটা। শুনেই ওঁর সেই ব্যতিক্রমী হাসিটি হাসতে লাগলেন। বললেন, বিবিধ ভারতীতে আমার গান শুনলে? অদ্ভুত ব্যাপার। ওরা পয়সা চায়। আমি পয়সা দি না। তাই ওরা আমার গান বাজাতেই চায় না।
এরপর প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে বললেন, শুনেছি তুমি নাকি গল্পও লেখ? তোমার যদি কোনও ফিফটি ফিফটি গল্প থাকে আমায় দাও। দেব আনন্দকে শোনাব। ও আমায় খুবই মানে।
অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, ফিফটি ফিফটি গল্প সেটা কেমন?
শচীনদা যেন একটু অসন্তুষ্ট হলেন। বললেন, সিনেমায় কাজ করছ আর ফিফটি ফিফটি বোঝ না। হিরো হিরোইনদের সমান প্রেফারেন্স। কে একজন বললেন, রিহার্সালটা শুনে যান। আমি বসে গেলাম। রিহার্সাল শুনলাম ‘কোরা কাগজ থা মন মেরা/লিখ দিয়া নাম উসনে তেরা’/ আমি দুঃখ পাইনি। বরং উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলাম। যে বিষয়টা ব্যক্ত করতে আমার লেগেছিল এতগুলো কথা ( আমি খাতার পাতায় চেয়েছিলাম একটি তোমার সই গো/তুমি চোখের পাতায় লিখে দিলে আমি হলাম তোমার সই গো।) সেই ভাবটি আনন্দ বক্সি ব্যক্ত করেছেন কত কম কথায়, কত বেশি ঠাস বুনুনিতে। আনন্দ বক্সি তখন ওখানে ছিলেন না। ওঁকে আমার অজস্র প্রশংসা জানিয়ে একটা চিঠি লিখে রেখে এসেছিলাম।
২৩
শচীনদা প্রসঙ্গে আরও একটু বলি। সত্যি এক ভিন্নতর মানুষ ছিলেন এই এস ডি বর্মণ। কখনও কোনও কাজে কিছুতেই কম্প্রোমাইজ করতেন না। মান্নাদার কাছে গল্প শুনেছি বোম্বেতেই একবার কী একটা রেকর্ডিং-এ ওঁর রিদিম কিছুতেই পছন্দ হচ্ছিল না। তখন কী রিদম উনি চান সে কথা মিউজিশিয়ানদের বোঝাতে স্কোরিং থিয়েটারের মধ্যেই উনি আদ্দির পাঞ্জাবিটা খুলে ফেলে চেঁচিয়ে বলে উঠেছিলেন, এই দেখো, আমি বগল বাজাচ্ছি। শুনে নাও ঠিক এই আওয়াজ, এই চটাং চটাং আওয়াজ এই রিদমই আমি চাই।
মান্নাদার কাছে আরও শুনেছি তখন পঞ্চম কাজ করছে এস ডি বমর্ণের অ্যারেঞ্জার হিসাবে। একটা রেকর্ডিং-এ অ্যারেঞ্জমেন্টের কাজ হচ্ছে তো হচ্ছেই। বেশ কিছুক্ষণ পর শচীনদা অধৈর্য হয়ে পড়ে বলে উঠেছিলেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও, আমি আগে গানটা টেক করেনি। তারপর তোমরা ও সবগুলো করো।
সত্যিকারের সৃজনশীল সুরকাররা দেশি-বিদেশি অজস্র সুর আহরণ করে তারপর নিজস্ব ভাবধারায় সেই সুর গানের কথার মাধ্যমে যুগে যুগে পরিবেশন করে এসেছেন। গীতিকারদেরও অনেকে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ভাষা সাহিত্যের ভাব-ভাবনা নিয়ে নিজের ভাষায় নতুন রূপে সেগুলো প্রকাশ করে এসেছেন। অবশ্যই প্রকৃত সৃজনশীল সুরকার বা গীতিকারদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটা স্বতন্ত্র প্রতিভা থাকে। সেই নিজস্ব মৌলিক ভাব-ভাবনা, ধ্যান-ধারণার স্পর্শ প্রতিটি সৃষ্টিতেই পাওয়া যায়। যার ফলে মাঝে মাঝে এক কথায় বলে দেওয়া সম্ভব হয় এটা অমুকের সুর বা অমুকের কথা। হিন্দি ‘আরাধনা’ সুপারহিট হওয়ার পর একদিন শচীনদাকে বলতে শুনেছিলাম, আমার ‘মেরি স্বপ্ন কে রানি কভি আয়েগি তু’ গানটা যারা বলছে আমি বিদেশি ট্যাকিলা থেকে নিয়েছি তাদের বলে দিয়ো হ্যাঁ, সুরটা আমি অনুসরণ করেছি—অনুকরণ নয়। তবে সেটা ট্যাকিলা নয়। পূর্ব বাংলার কুমিল্লার নৌকো বাইচের গান থেকে। আমি বাঙালি, আমার বাংলায় অজস্র সম্পদ ছড়ানো আছে। আমি সব আগে সেটাই তো নেব। মুম্বই-এর এক সুপ্রতিষ্ঠিত এবং খ্যাতনামা চিত্র প্রযোজক যখন তাঁর হিন্দি ‘ফাগুন’ ছবিতে পুব বাংলার বহু বছরের পুরনো যাত্রাপালা ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’র একটি গানের সুর লাগিয়েছেন ‘এক পরদেশি মেরা দিল লেগায়া’ গানটিতে তখন খুশিই হয়েছিলেন পুব বাংলার বাঙালি এস ডি বর্মণ।
শচীনদার কাছে যাবার যতটুকু সৌভাগ্য আমার হয়েছিল তাতে বুঝেছিলাম এমন প্রতিভার সাক্ষাৎ বোধহয় আর আমরা পাব না। একদিন মুম্বই-তে ঘুরতে ঘুরতে শক্তি সামন্তের নটরাজ স্টুডিয়োতে হাজির হয়েছিলাম। শক্তিদা ওঁর স্টুডিয়োর প্রজেকশন থিয়েটারে শোনালেন ওঁর তখনকার নির্মীয়মাণ ‘অনুসন্ধান’ ছবির দুখানা গান। ‘ফুল কলিগো ফুল কলি’ আর ‘ফেঁসে গেছে কালিরামের ঢোল’ মুগ্ধ হয়েছিলাম গান দুটি শুনে আর তার চিত্রায়ণ দেখে। শক্তিদাকে বলেছিলাম, দারুণ। পঞ্চমকে আমার কংগ্রাচুলেশন দেবেন।
শুনে শক্তিদা একটু হাসলেন বললেন, ও দুটো ওর সুর কোথায়। পুব বাংলার নিজস্ব ঘরানায় বানানো শচীন দেববর্মণের সুর। অবশ্য, আমি পঞ্চমকে ওই সুর দুটো লাগাতে বলেছিলাম। বাবার সম্পত্তি ছেলে তো পাবেই। আমি কথাটা ঠিক অনুধাবন করতে পারলাম না। শক্তিদা বললেন, শোনেননি শচীনদার বিখ্যাত সুর ‘সুন্দরী গো সুন্দরী/দল বেঁধে আয় গান ধরি’ এটা থেকেই ‘ফুল কলিগো ফুল কলি/বল রে এটা কোন গলি’। আর ‘শুনি তাকদুম তাকদুম বাজে/বাজে ভাঙা ঢোল/ওমন যা ভুলে যা কি হারালি/ভোলরে ব্যথা ভোল’ এই সুরটাতেই ‘বল হরি বোল হরি বোল/ফেসে গেছে ফেসে গেছে কালিরামের ঢোল’। এই দুটো সুরের ফারাক কোথায়?
আমার মনে পড়ে গেল এই শক্তিদারই ‘অমানুষ’ ছবিতে কে এল সায়গলের বাঁধিনু মিছে ঘর/ভুলেরি বালু চরে’ অনুসরণ করে হয়েছিল ‘কী আশায় বাঁধি খেলাঘর বেদনার বালুচরে।’ একদিন মুম্বই-তেই কী একটা রেকর্ডিং-এর ফাঁকে কথায় কথায় কে যেন বললেন, শচীনদা ওঁর গানে ওঁর দেওয়া কাজ ছাড়া কণ্ঠশিল্পীর বাড়তি কোনও কাজ একেবারেই পছন্দ করতেন না। বলতেন, কালোয়াতি করছ কেন? কালোয়াতি চাই না।
আর একদিন কে যেন বললেন হিমাংশু দত্ত বিখ্যাত হয়েছেন বিদেশি ‘রেমোনা’ সুরটা লাগিয়ে। ‘বনের কুহু কেকা সনে/মনের বেণু বীনা গায়’ বা ওই যে ‘বন্ধন হারা ওই বন্ধুর পথ/নিদ্রিত অজগর যক্ষের প্রায়।’ রেমোনার স্টাইলটাই হচ্ছে প্রথম পক্তি থেকে দ্বিতীয় পক্তি একটু চড়ায় উঠবে তৃতীয় পঙক্তিটি উঠবে আরও চড়ায়। চতুর্থ পঙক্তিটি নেমে আসবে খাদে। পূর্ণ হবে একটি স্তবক।
মনে আছে আমি মন্তব্য করেছিলাম রেমোনার স্টাইলটি একটি অমর স্টাইল। বন্ধুবর সুধীন দাশগুপ্ত শঙ্খবেলা’ ছবিতে আমার ‘কে প্রথম চেয়ে দেখেছি’ গানটিতে এই স্টাইল লাগিয়েছিলেন। এবং সেটি হিমাংশু দত্তের সময়ের অনেক পরে রিলিজ হয়েও সুপারহিট।
আর একদিনের কথা মনে পড়ছে মুম্বই-তেই শচীনদার সামনেই শচীনদার কাছের মানুষদের মধ্যে কে যেন বলে উঠেছিলেন সলিল চৌধুরী কিন্তু দারুণ কায়দা করে দুটো বিখ্যাত বিদেশি গানকে বাংলায় কাজে লাগিয়েছেন। একটা ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ/হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ’ সুর নিয়ে ‘ক্লান্তি নামে গো/রাত্রি নামে গো’। বিখ্যাত গায়ক প্যাট বুনের টেকনিক গানের সুর নিয়ে দুরন্ত ঘূর্ণি তাই লেগেছে পাক/এই দুনিয়া ঘোরে বন বন বন। ‘ ধরা ছোঁয়ার উপায় নেই।
স্বল্পভাষী শচীন দেববর্মণ এতক্ষণ একটাও কথা বলেননি। কিন্তু ওই আলোচনাটা থামিয়ে দিয়েছিলেন একটা মারাত্মক কথা বলে। বলেছিলেন, ওই যে বললে কায়দা করে লাগানো। ওই কায়দাটা হচ্ছে আসল জিনিস। রবি ঠাকুর করেছেন। ডি এল রায়, কাজী সাহেব সবাই করেছেন। আমিও করেছি। গুরু দত্তর ‘পিয়াসা’ ছবিতে যে গানটা হেমন্তকে দিয়ে গাইয়েছিলাম। ‘যানে হো ক্যায়সে / লোগসে জিনকে /প্যায়ার তো প্যায়ার মিলা/হামনেতো যব কালিয়া মাঙ্গি/কাঁটাকো হার মিলা’। এই সেকেন্ড লাইনটা যে আমাদের ন্যাশানাল সঙের ‘পাঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মারাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ’–আমি বলার আগে কেউ কোনও দিন বুঝতে পেরেছিল কি? ও সব কথা ছাড়ান দাও। চলরে ভাই—বলেই ওখান থেকে উঠে পড়েছিলেন সংগীত জগতের এক তুলনাহীন সংগীতব্যক্তিত্ব।
আর ডি বর্মণ অর্থাৎ পঞ্চমের সঙ্গে কাজ করতে করতে ক্রমশ লক্ষ করতে লাগলাম ও সন্ধেবেলা কেমন যেন নিয়মিত ‘অস্থির পঞ্চম’ হয়ে যেতে লাগল। গানের জগতে বিরাট সাফল্যের সুখ ছাড়া ও বোধহয় মানসিক সুখ কোনও দিনই পায়নি। রীতা পটেলের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর পঞ্চমের একটা বন্ধুচক্র ওকে এমনভাবে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ধরল যে ও সেই বন্ধন থেকে কিছুতেই নিজেকে ছাড়িয়ে আনতে পারল না। আশা ভোঁসলেকে বিয়ে করার পর মনে হয়েছিল এবার হয়তো পঞ্চম স্বস্তি পাবে। কিন্তু পেয়েছিল কি? ওকে জড়িয়ে থাকা বন্ধুদের কবল থেকে ও যখন মুক্তি পেল তখন বোধ হয় অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। থাক এ সব কথা। জীবনের শেষ ক’বছর মনে হয় সবাই ওকে এক্সপ্লয়েট করেছে।
মুম্বই-এর প্রযোজকের ব্যাপারগুলো জানি না। কিন্তু কলকাতার ব্যাপারগুলো জানি। একদিন গান নিয়ে ওর সান্তাক্রুজের বাড়িতে বসেছি। দুর্ধর্ষ পঞ্চম হারমোনিয়াম একটু বাজিয়েই বলে ফেলল, ধ্যাৎ, যেটাই বাজাই মনে হয় এ সুরটা হয়ে গেছে। জোর করে সুর করা যায় না। স্পনটেনিয়াস ব্যাপারটা হচ্ছে না। আমি একটা ধুন বানিয়ে কাল ঠিক এই সময়ে আপনার সঙ্গে বসব। ভদ্রতায়, আতিথ্যে এবং সময়নিষ্ঠায় পঞ্চম অদ্বিতীয় ছিল। আগেই বলেছি তখন পঞ্চমের জীবনের শেষের দিক। তখন ওর একটাও ছবির গান আগের মতো হিট করছে না। তবুও কাজ-পাগল পঞ্চম কাজ করে যাচ্ছে।
মুম্বই-এর এক নামী রেকর্ড কোম্পানির মালিক ও চিত্র প্রযোজকের তথাকথিত ‘মিউজিক ব্যাঙ্ক’-এর পর্যন্ত গান রেকর্ড করতে দ্বিধা করেনি পঞ্চম। যে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলতে ওর থেকে নিচু শ্রেণীর সংগীত পরিচালকও সম্মতি দেয়নি। পঞ্চমের জীবিত অবস্থাতে কিছুদিন পরে অন্য সুরকারের নাম নিয়ে বাজারে বেরিয়েছে তার কিছু রেকর্ড করা সে সব গান। হিটও করেছে। সংগীতজগতের যাঁরা এ ব্যাপারটা জেনেছেন তাঁদের কেউ কেউ বলেছেন আর ডি বর্মণের নাম থাকলে হয়তো হিট করত না। ভাগ্যের কী নিষ্ঠুর পরিহাস। এই সময়েই বাপি লাহিড়িকে নিয়ে কাজ করা সুপারহিট গান পাওয়া কলকাতার এক প্রযোজক-পরিচালক গোষ্ঠীর সঙ্গে হঠাৎ বাপির কিছু অমিল হয়। ওরা পঞ্চমকে দিয়ে তাই পর পর বাংলা ছবি বানাতে লাগলেন। কিন্তু একটা ছবিরও গান জনপ্রিয় হল না। সেই সময়টাতে অন্য এক প্রযোজকের বাংলা ছবির গান লিখতে পঞ্চমের কাছে এসেছিলাম। সুরের মিটার নিতে নিতে পঞ্চমকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, লতাজিকে দিয়ে গাইয়েও তোমার কলকাতার একটা গানও হিট করছে না এ সম্বন্ধে তুমি কী বলবে?
তৎক্ষণাৎ উত্তর পেয়েছিলাম, ওরা ছবিতে গানের সিচুয়েশনই বানাতে জানেন না। আমি গান বানাব কী করে? তার ওপর কলকাতায় যেমন বিয়ের পদ্য লেখা হয় কলকাতার নামী দামি চিত্রনাট্যকার কাহিনীকার প্রযোজক পরিচালক তেমন সব ছন্দের গান নিজে লিখে নিয়ে হাজির হন। ওঁকে বা ওঁর দলকে ফেরাই কেমন করে? কী করে ও সব গান হিট করবে? কোনও নতুন স্ক্যানিং, নতুন ছন্দই আমি বার করতে পারি না। সেই একঘেয়ে সিক্স এইট বা টু ফোর (দাদরা বা কাহারবা) করতে হয়। আর মিটার? ইউ মিন গানের মিটার? ওঁদের কাছে গানের মিটার আর কিলোমিটার এক। কোনও তফাত নেই। পঞ্চমকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, তা হলে গান করছ কেন? শুধু শুধু বদনাম হচ্ছে। তোমাকে ভালবাসি বলেই কথাগুলো বললাম। কিছু মনে কোরো না।
পঞ্চম উত্তর দিয়েছিল, আগে এত ব্যস্ত থাকতাম যে আমার গান আমি নিজেই ভাল করে শোনার সময় পেতাম না। এখন এই সুযোগটা পাচ্ছি। এটাই আমার আনন্দ। এই আনন্দের জন্যই এখনও জেনে শুনে ও সব গানের সুর করে যাচ্ছি।
উত্তরটা শুনে অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়েছিলাম।
২৪
আমার প্রিয় পঞ্চম সম্পর্কে আরও অনেক কথা মনে পড়ছে। মনে আছে একবার কী একটা ছবির গানে অনিবার্য কারণে বাজেট একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত মিউজিশিয়ানদের দোষেই ‘ওভার টাইম’ হয়ে যায়। তাতেই বাজেট বাড়ে।
পরের দিনই আবার রেকর্ডিং ছিল। রাত্রে প্রযোজক-পরিচালক দুজনেই হোটেলে আমায় বললেন, পুলকবাবু টাকায় তো টান পড়বে। আমরা তো বেশি কিছু আনিনি। তৎক্ষণাৎ হোটেলের বাইরে থেকে পঞ্চমকে ফোন করে ব্যাপারটা খুলে বললাম। এও বললাম একটা কাজ করলে হয় না? যদি মিউজিশিয়ান একটু কমিয়ে দেওয়া যায় তা হলেই তো বাজেটটা ঠিক থাকে। ও প্রান্ত থেকে পঞ্চম বলল, ও সব ভাবার প্রয়োজন নেই। ও আমি ম্যানেজ করব।
পরদিন রেকর্ডিং-এ এসে দেখলাম একটা মিউজিশিয়ানও কমায়নি পঞ্চম। ঠিক আগের তালিকা মতোই বাদ্যযন্ত্রীরা হাজির। বুঝে নিতে দেরি হল না শিল্পী পঞ্চম স্ৰষ্টা পঞ্চম, বণিক পঞ্চম, বাণিজ্যিক পঞ্চমকে এক্সপ্লয়েট করেছে। নিজের পকেট থেকে দিয়েছে সেই পেমেন্ট। তবুও নিজের সৃষ্টির এতটুকু অঙ্গহানি করতে দেয়নি।
পঞ্চমকে নিয়ে আরও একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। সেবার মুম্বই থেকে ভেনাস ক্যাসেটের চম্পক জৈনের ফোন পেলাম, দাদা, ওমুক তারিখ বোম্বেতে আসুন। পঞ্চমদার বাড়ির কাছে ‘লিংকওয়ে’ হোটেলে থাকবেন। এবার পুজোয় আশাজি আর অমিতের ক্যাসেট করব। এক একদিকে এক একজনের দুটো করে সোলো আর দুটো করে ডুয়েট।
ফোনেই জিজ্ঞাসা করলাম, আশাজি রাজি? চম্পক বলল, আশার বাড়িতে বসে কথা হয়েছে। উনি রাজি। অমিতও এক কথায় মত দিয়েছে। আর পঞ্চমদা সুর বানিয়ে ফেলেছেন। আপনি এসে শুধু লিখে দেবেন।
ইভনিং ফ্লাইটটা দমদম থেকে উঠতেই দেখলাম চাঁদের আলোয় আকাশটা ঝলমল করছে। আমার জানলায় পূর্ণিমার পূর্ণ আলো। পঞ্চমের কথা মনে হতে লাগল। নিশ্চয় কিছু অসাধারণ সুর বানিয়ে ফেলেছে। ভাবছি শুধু ভাবছি।
কিছুক্ষণ পর এক অল্পবয়সি বিমান সেবিকা আমার খাবারের খালি ট্রেটা নিয়ে গিয়েই আবার ফিরে এলেন। বুঝিনি উনি বাঙালি। একটা অটোগ্রাফের খাতা আমার দিকে এগিয়ে বললেন, প্লিজ কিছু লিখে দেবেন।
বার বার পঞ্চমের কথা আমার মনে পড়ছিল। জানলা দিয়ে আবার দেখলাম রুপালি জ্যোৎস্নায় ঝলমল করা চাঁদটাকে। তার দু পাশে দু টুকরো সাদা মেঘ। আমি লিখে দিলাম সাদা দুটো মেঘ যেন দুখানা ডানা/চাঁদকে করেছে আজ রুপালি পরী/এমন রাতে/যারা শুনছে না গান/যারা করছে না পান/তাদের আমি করুণা করি।
মেয়েটি রূপসী, লেখাটা পড়ে গালে টোল ফেলে একটু হেসে বলে গেল, ‘সরি, ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসকে একটু ক্ষমা করবেন। নমস্কার।
পরদিন মেরিল্যান্ডস-এ এসেই পঞ্চমকে ঘটনাটা বললাম। শুনেই পঞ্চম বলল, আবার বলুন তো গানটা।
পঞ্চম ছোট ছোট বাঁধানো খাতায় নিজের হাতে সব গানই লিখে নিত। এটাও লিখে নিল। তবলা ও অন্যান্য রিদম প্লেয়ারদের বলল বাজাতে। ঘরে রাখা স্টিরিও স্পিকারে গমগম করে উঠল পঞ্চমের কণ্ঠস্বর। ওর সেক্রেটারি ভরতজি কানে হেড ফোন দিয়ে বড় কমার্শিয়াল টেপে রেকর্ড করতে লাগল পঞ্চমের সদ্য রচিত নতুন গানের সুর। ভরতের কাজই ছিল সিটিং-এর সব কিছু রেকর্ড করা। পরে প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলো খুঁজে বার করা। অপূর্ব মেজাজে, অপূর্ব সুরে মাইক্রোফোনের সামনে আমার গানটা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গেয়ে যেতে লাগল রাহুল দেববর্মণ। আর আমি তাকিয়ায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে আত্মহারা হয়ে শুনতে লাগলাম।
ওদিকটাতে দু-চারজন রিদম প্লেয়ার, একজন গিটারিস্ট আর পঞ্চমের পেছনে চালচিত্রের মতো শচীন দেববর্মণের বিরাট একটি ফটোগ্রাফ। রেকর্ড করেই পঞ্চম বলল, এবার আমি পরের গানটা সুর দেব। লিখতে হবে। আটটা গান তো ক্যাসেটে থাকবে। আমরা কিন্তু ষোলোটা গান বানাব। তারপর বাছব আটটা গান। সেই আটটা গানই বের হবে ক্যাসেটে।
তথাস্তু। পরপর সিটিং করে আমরা তৈরি করলাম ষোলোটা দারুণ গান। অবশ্য রোজই পঞ্চম রাত আটটার আগেই উশখুশ করতে করতে বলত, এবার আমাদের ছুটি।
আমরা বাছাই করা আটটি গান হাতে নিয়ে শুনতে ডাকলাম চম্পক জৈন আর আশাজিকে। আমাকে একটু আগেই ডেকেছিল পঞ্চম। গানগুলো আবার আমাকে শুনিয়ে ঝালিয়ে নিল ও। আমি বললাম, অমিত আসবে তো? পঞ্চম বলল, না, সকালে গৌরীকুঞ্জ গিয়েছিলাম, অমিত গান শুনে পাগলা হয়ে গেছে। তুলেও দিয়েছি দুটো গান।
যথাসময়ে চম্পক আর আশাজি এলেন। গান শুনে দুজনেই আমাদের খুব তারিফ করলেন। পঞ্চম আশাজিকে জিজ্ঞাসা করল, কাল তা হলে তোমার সেক্রেটারির কাছ থেকে ফোনে জেনে নেব কবে তোমার ডেট পাওয়া যাবে।
আশাজি হঠাৎ চম্পকের দিকে ফিরে বললেন, কিন্তু অমিতের সঙ্গে আমি ডুয়েট গাইব না। ফিল্মে গাইতে পারি। তবে নন ফিল্মি গানে নয়। নন ফিল্মি গান পঞ্চম ছাড়া আমি কারও সঙ্গে গাইব না।
আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, তা হলে তো খুবই ভাল হয়। ডুয়েট গানগুলো আরও লাইফ পাবে।
পঞ্চম বলল, না, আমার গলা ভাল নেই। আমি গাইতে পারব না।
চম্পক জৈন গম্ভীর গলায় বলল, কিন্তু দিদি, আমি তো আপনাকে জিজ্ঞাসা করেই অমিতের সঙ্গে কথা বলেছি।
আশাজি কোনও উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। যাবার আগে বললেন, পঞ্চম, আমি পেডার রোডে যাচ্ছি। চম্পক রাজি হলে ফোন করো।
আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে আশাজি চলে গেলেন।
আশাজি যাবার পর চম্পকও উঠে পড়ল, এবং বলল, না এ হতে পারে না আমি অমিতকে কথা দিয়েছি। চলুন দাদা আপনাকে হোটেলে পৌঁছে দি। ওখানে গিয়ে আপনার এয়ার টিকিট, হোটেল বিল, রেমুনারেশন সব ঠিক করে ফেলব।
আমি হোটেলে এসে আমার গানের জন্য কোনও রেমুনারেশনই নিলাম না। নিলেই গানগুলো ভেনাসে আটকে থাকবে। কথাটা চম্পককে বুঝিয়ে বলতেই চম্পক এককথায় কথাটা মেনে নিল। চম্পক সত্যি আমায় সম্মান করে তাই নাছোড় চম্পক আমার কাছ থেকে গানের কোনও রাইট না নিয়েও একটা সম্মান দক্ষিণার প্যাকেট হোটেলের টেবিলে রেখে দিয়ে গেল।
মারা যাবার মাসখানেক আগেও পঞ্চমের সঙ্গে মুম্বই-তে দেখা হয়েছে। পঞ্চম বলেছে, ও গানগুলো একটা আলাদা খাতায় ভাল করে লিখে রেখেছি। পর পর রেকর্ড করব, পর পর হিট করবে। পঞ্চম চলে যাবার পর ওই গানের টেপগুলো কোথায় আছে সে কথা আশাজির কাছে অনেকবার জানতে চেয়েছি। উনি বলেছেন পঞ্চমের সেক্রেটারি ভরতের কাছে। ভরত বলেছে আশাজির কাছে। শুধু ও গানগুলো নয় কলকাতার জগদীশের প্রযোজনায় হরনাথ চক্রবর্তীর ‘গুণ্ডা’ ছবির রেকর্ড না হওয়া আমাদের বানানো ভাল কিছু গান আর এরকমই আমার লেখা কত গান যাতে পঞ্চম সুর দিয়েছিল কিন্তু রেকর্ড হয়নি সে গানগুলো কোথায় আছে কার কাছে আছে এখনও তা জানা হল না। কে বলতে পারে ওর মধ্যেই আরও একটা ‘নাইনটিন ফরটি টু আ লভ স্টোরি’-র মতো অসাধারণ গান নেই?
পঞ্চমের জীবিত অবস্থাতেই যদি ওর সুরে রেকর্ড করা গান অন্য সুরকারদের নামে মার্কেটে বের হতে পারে তা হলে এখন ওর মৃত্যুর পর যে কোনও মিউজিক ব্যাঙ্কের বেনামি ভল্টে গচ্ছিত রাখা ওর সুর করা গানের ওই টেপগুলো, যে কোনও দিন অন্য মিউজিক ডিরেক্টরের নামের লেবেল বুকে এঁটে যে কোনও ভাষার গান হয়ে বাজারে আসতে পারে। ওই গানগুলি মার্কেটে টপ সেলার হওয়া অসম্ভব নয়।
কিশোরকুমার যখন চিত্রাভিনেতা ছিলেন তখন নিজের ভূমিকার গান নিজেই গাইতেন। কোনও দিন কারও জন্য প্লে-ব্যাক করেননি। কিন্তু অভিনেতা কিশোরকুমার যখন নিষ্প্রভ হয়ে এলেন তখন পঞ্চমই ওঁকে জোর করে অন্যের প্লে-ব্যাক করাতে রাজি করাল। এ কথা বলতে বাধা নেই এস ডি বর্মণের ক্যাম্প থেকেই কিশোরদা হয়ে উঠলেন পরিপূর্ণ গায়ক। শচীনদা হেমন্তদাকে দিয়ে প্রচুর ছবিতে গান গাইয়েছেন। কিন্তু পঞ্চম তেমন কোনও ছবিতে হেমন্তদাকে দিয়ে প্লে-ব্যাক করিয়েছে কিনা মনে করতে পারছি না।
ভাগ্যের পরিহাসে যখন হেমন্তদার গীতাঞ্জলি পিকচার্সের ছবিগুলো পর পর ফ্লপ হতে লাগল তখন হেমন্তদার মুখে খেদোক্তি শুনেছিলাম সোজা তিরুপতিতে গিয়ে পুজো দিয়ে ছবি শুরু করলাম। সে ছবিও ফ্লপ।
শরৎচন্দ্রের ‘মেজদিদি’-র মতো গল্পে মীনাকুমারীকে দিয়ে অভিনয় করিয়ে বানালাম ‘মেজলিদিদি’ তাও চলল না। এবারের ছবিতে তাই আমি মিউজিক করছি না। পঞ্চমকে নিয়েছি মিউজিক করতে। তোমার কাছে স্বীকার করতে দুঃখ নেই পুলক। আমার মিউজিক থাকলে এখন আমার ছবির সার্কিটই বিক্রি হবে না।
পঞ্চম হেমন্তদার গীতাঞ্জলি পিকচার্সের ব্যানারের ছবিতে তাই মিউজিকও করেছিল। কিন্তু এত সুরেলা পঞ্চমের একটা বেসুরো উক্তি আজও আমার কানে বাজে। ও একদিন কথায় কথায় সরাসরি আমাকে বলে ফেলেছিল, হেমন্তকুমার শুভ লার্ন ফ্রম কিশোরকুমার হাউ টু সিঙ।