১০
অনেক পথ পেরিয়ে এসেছি। তবু থেমে থাকতে পারিনি। শুধু চলেছি আর চলেছি। মাঝে মাঝে স্মৃতির আয়নায় মুখ দেখি। কত মুখ—কত সুন্দর—কত কুৎসিত। সবাইকে সুন্দর দেখতে চেষ্টা করি। চোখের দেখায় কত রূপ বদলে যায়। মনে পড়ছে গোপেন মল্লিকের কথা। গোপেনদা প্রথম জীবনে ছিলেন বিখ্যাত সুরকার কমল দাশগুপ্তের সহকারী। তারপর ওই সাহেবি গ্রামোফোন কোম্পানিতেই ফ্রিলান্স সুরকার হন। বহু গান ওঁর হিট। সতীনাথ মুখার্জি ওঁর গান রেকর্ড করেই সংগীতজগতে প্রবেশ করেন। এই গোপেনদারও কোনওদিন সঠিক মূল্যায়ন হল না। কিছুদিন গোপেনদা চিত্র প্রযোজকও হয়েছিলেন। বিখ্যাত পরিচালক সুশীল মজুমদারও আর এক অংশীদার যাঁর পদবিটা ইংরেজি এম অক্ষর দিয়ে শুরু ছিল। এই তিনজনে অর্থাৎ এঁর ‘এম’ মল্লিকের ‘এম’, মজুমদারের ‘এম’ নিয়ে ওঁদের ব্যানার ছিল—’থ্রি এম্ প্রোডাকশান্স’। যা হোক, আমার সঙ্গে গোপেনদার প্রথম যোগাযোগ পাঁচু বসাকের (জয়দ্রথের) ‘অগ্নি বন্যা’ ছবি থেকে
গোপেনদার সঙ্গে কাজ করে দেখলাম উনি আগে থেকে গানের সুর দেওয়ার রীতিমতো বিরোধী। উনি চান লেখা। ওঁর কাছে গান লেখা সত্যিই এক প্রাণান্তকর পরিশ্রম ছিল। মাঝে মাঝে বিরক্তি ধরত। মনে হত, দুর, ইনি অবুঝ। কী যে চান নিজেই জানেন না। ছেড়ে দিই ওঁর কাজ। কিন্তু অ্যাতো সুন্দর আন্তরিক ব্যবহার ছিল ওঁর, পরমুহূর্তে সব বিরক্তি জুড়িয়ে যেত। কিন্তু আমার আজকের মতোই তখনও বিশ্বাস ছিল গান আবেগের সৃষ্টি, অত আচার বিচার বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে গান লেখা উচিত নয়। তাই উত্তমকুমারের মতো শিল্পী অভিনীত হিট ছবি ‘জীবনমৃত্যু’-তে গোপেনদা আর আমার গান তেমন জমেনি সন্ধ্যা মুখার্জি আর মান্না দে গাওয়া সত্ত্বেও। গানটি ছিল—’কোনও কথা না বলে/গান গাওয়ার ছলে।’
‘অগ্নি বন্যার’ গানগুলোও তেমন জমল না। এরপর আমরা মিলিত হলাম মঙ্গল চক্রবর্তীর ‘দিনান্তের আলো’ ছবিতে। এ ছবিতেই লক্ষ করলাম গতানুগতিক বাংলা গানের চেয়ে একটু এদিক ওদিক করে লেখা গানেই ওঁর সুর করার আগ্রহ বেশি। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই লিখে ফেললাম—’সাবাস আমার হাওয়াই গাড়ি’। ‘বাংলায় যাকে বলে ভালবাসা হিন্দিতে তার-ই নাম মোহব্বৎ।’
চমৎকার সুর করলেন গোপেনদা। মান্নাদা দারুণ গাইলেন। সুপার হিট। মান্নাদা মুম্বই-তেও এ গানটা অনেককেই গেয়ে শুনিয়েছিলেন। শুনিয়ে ছিলেন অনেক নামী সংগীত পরিচালকের বাঙালি পত্নীকেও।
হয়তো তাই কিছুদিন বাদেই মুম্বই-এর এক গানে শুনতে পেলাম—সে গানের অনুলিপি—’আংরেজী মে কতে হ্যায় আই লাভ ইয়ু/গুজরাটি মে কহতে হ্যায় প্রেম করো ছু।’
গোপেনদার সঙ্গে এরপর আমার উল্লেখযোগ্য ছবি ‘আশিতে আসিও না’। ছবিতে ঘটনা ছিল দৈবযোগে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়স কমে গেছে। উত্তমকুমারের ভঙ্গিতে ভানুদা পত্নী রুমা গুহঠাকুরতাকে পাশে বসিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে দ্বৈত সংগীত গাইছেন। দৈব শক্তিতে স্বামীরই বয়স কমেছে স্ত্রীর নয়। ভানুদার গলায় লিখেছিলাম— ‘তুমি আকাশ এখনি যদি হতে/আমি বলাকার মতো পাখা মেলতাম।’ রুমা গুহঠাকুরতার মুখে এর উত্তরে লিখেছিলাম—’ময়দা যদি হতে তুমি/জলখাবারের লুচি বেলতাম।’
গানটি পেয়ে পরিচালক পাঁচু বসাক আর গোপেনদা একরকম লাফিয়ে উঠেছিলেন। গোপেনদা বললেন পুরুষ অংশটা একটু রোমান্টিক আধুনিক স্টাইলে করব। তবে স্ত্রীর অংশটায় লাগিয়ে দেব ‘কে বিদেশী মন উদাসী/বাঁশের বাঁশী বাজাও বসি’ সুরটা। দারুণ জমে যাবে গান। সত্যিই দারুণ জমে গেল। ছবিটায় প্রথমে ঠিক ছিল রুমা গুহঠাকুরতার ভূমিকাটি সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় করবেন। কিন্তু অনিবার্য কারণে সাবিত্রী দেবী কাজটা নিলেন না। তার আগেই মান্না দে আর নির্মলা মিশ্রকে দিয়ে গানটা রেকর্ড করা হয়ে গিয়েছিল। সাবিত্রীর জায়গায় যখন রুমা এলেন, তখন রুমা দেবী বললেন আমি নিজে গান করি, অন্যের গাওয়া গানে ‘লিপ’ দেব না। তখন এখনকার মতো ‘ট্রাক সিস্টেম’ হয়নি। তাই গানটা মান্না দে আর রুমা দেবীকে দিয়ে আবার টেক করতে হয়েছিল। ছবিতে ছিল রুমার গাওয়া গানটাই। গ্রামোফোন রেকর্ডে ছিল নির্মলার গাওয়া গানটা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য—রুমা দেবীর সঙ্গে মান্না দের গানটি রিটেকের সময় স্টুডিয়ো, প্রতিটি বাজনদার—প্রত্যেকেই আবার পয়সা নিয়েছিলেন—কিন্তু মান্না দে পেমেন্ট নিতে অস্বীকার করেছিলেন।
আগেই বলেছি এই ধরনের গানে গোপেনদার ‘ন্যাক্টা’ আমি ধরে ফেলেছি। তাই ডি. এম. পালের উত্তমকুমার অভিনীত ছবি ‘তিন অধ্যায়’-তে গোপেনদার সুরে আর মান্নাদার গাওয়ার জন্য লিখেছিলাম ‘দাদা লড়ে যাও/ঝোপ ঝাড় বুঝে/ঠিক তাল খুঁজে…. কোপ দাও।’ আর ‘ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না বঁধু প্লিজ ডোন্ট টাচ্।’ তিন অধ্যায়ে অবশ্য আমার আর একটি গানও খুব ভাল সুর করেছিলেন গোপেনদা। সেটা ‘তোমার ভুবনে তুমি আলোর প্রভাত দিয়েছো।’ গেয়েছিল প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রচুর ছবিতে সুর দিয়েছিলেন গোপেনদা। গোপেনদার হাতে থাকত চামড়ার একটা ব্যাগ। সেটাই ছিল ওঁর মোবাইল অফিস। ওখানেই থাকত ট্যাক্সের নোটিস। আমাদের গান। অনেক দরকারি চিঠিপত্র, আবার বউদির হাতে তৈরি ঘরে কাটানো ছানার ছোট বাক্সটাও। বলতাম—ওটা এবার একটু খালি করুন না। উত্তর করতেন দাঁড়াও সবে ন’মাস হয়েছে, দশ মাসে পৌঁছোক।
এই গোপেনদাও কয়েক বছর আগে চলে গেলেন। আশ্চর্য আমাদের সংগীতজগৎ। মিউজিশিয়ানরা রেট বাড়াবার জন্য ঘন ঘন অ্যাতো মিটিং করেন। কিন্তু গোপেনদার একটা স্মরণসভা করারও প্রয়োজন মনে করলেন না কেউ-ই
মুকেশ আর মান্না দে ছিলেন খুবই অন্তরঙ্গ বন্ধু, ঠিক ‘গানের জগতেই নয় ‘প্রাণের জগতেও। মুকেশের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন মান্নাদা মুম্বইতেই। দুজনেই রাজকাপুরের ‘লিপে’ গান গাইতেন। আর কে ফিল্মস্-এর ‘বরসাত’ থেকে শুরু করে ‘মেরা নাম জোকার’ পর্যন্ত এ ধারাটা বহমান।
খুব সাদাসিধে সরল হাসিখুশি আর মিশুকে মানুষ ছিলেন মুকেশ। রেকর্ডিং-এর আগে এক গেলাস গরম জলে নুন মিশিয়ে দিয়ে সবায়ের সামনেই গলায় ঘড়ঘড় শব্দ তুলে গলা পরিষ্কার করে নিতেন। কখনও কখনও রেকর্ডিং বুথেই নতুন শিক্ষার্থীর মতো হারমোনিয়াম বাজিয়ে ‘সা’ ‘রে’ ‘গা’ ‘মা’ বলে গলা ছেড়ে গলা সেধে গান রেকর্ডিং করতেন।
কেন জানি না প্রথম দিন থেকেই আমাকে ‘দাদা’ বলে ডাকতে শুরু করেন মুকেশ। প্রায়ই বলতেন দাদা, আমার ‘বাঙ্গালি গানা’ ভীষণ পছন্দ, আমিও বাংলা গান গাইব। একটু চেষ্টা করুন না?
ওর অনুরোধে ওর দাদা হয়ে ‘দাদাগিরি’ ফলাতে গিয়ে হোঁচট খেলাম এইচ. এম. ভি-তে। তখনকার অধিকর্তা পি. কে. সেন আমার প্রস্তাবটা শুনে চিন্তিত মুখে বললেন : আপনার কি ধারণা মুকেশের বাংলা গান চলবে?
প্রশ্নটার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল—কেমন চলবে জানি না, তবে একটা ‘স্টান্ট’ তো হবেই।
সেন সাহেব মুচকি হাসলেন; স্টান্ট? শুধু স্টান্টের জন্য আমরা কারও রেকর্ড করি না। সরি।
সন সাহেবের ওই ‘সরি’ কথাটাই ভাবিনি কিছুদিন পরে অ্যাতো কাজে লাগবে।
তখন প্রাণপণে চেষ্টা করছি প্রথম সুযোগেই মুকেশকে দিয়ে অন্তত বাংলা ছবিতে একটা বাংলা গান গাওয়াবই। অতবড় জনপ্রিয় শিল্পীর ওইটুকু অনুরোধ আমি যে-করে হোক রাখবই। কিন্তু কিছুতেই সুযোগ পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ পেয়ে গেলাম সেই কাঙ্ক্ষিত সুযোগ। পরিচালক দিলীপ বসু; বিশ্বজিৎ, সন্ধ্যা রায়কে নিয়ে ‘সরি ম্যাডাম’ ছবিতে গান লেখার জন্য আমায় ডাকলেন।
প্রথম সিচুয়েশনটাই ছিল ‘টাইটেল সঙ’। বিশ্বজিতের মুখে গান। প্রথম সুযোগটাই কাজে লাগালাম। সেন সাহেবের ওই ‘সরি’ কথাটার রেশ তুলেই লিখে ফেললাম সরি ম্যাডাম সরি/সরি মিস্টার সরি।
দিল্লির মানুষ ভেদ পাল ছিলেন ‘সরি ম্যাডামের’ সুরকার। সুর করা শেষ হতেই কাউকে কিছু বলার অপেক্ষা না রেখে বলে উঠলাম-ভেদ পালজি, গানটা মুকেশ জিকে দিয়ে গাওয়ান না?
ভেদ পাল সঙ্গে সঙ্গে বললেন—দারুণ আইডিয়া! মুকেশ তো দিল্লিরই লোক। আমার বিশেষ বন্ধু। তা-ই হবে।
‘সরি ম্যাডাম সরি’ রেকর্ডটা ভীষণ বাণিজ্যিক সাফল্য লাভ করল। তখন এইচ. এম. ভি বিক্রির খতিয়ান দেখিয়ে প্রতি মাসে ‘ভয়েস’ নামে একটা পুস্তিকা প্রকাশ করত। তাতে ‘বেস্ট সেলার’ হিসাবে প্রথমেই জ্বল জ্বল করতে লাগল আমার লেখা মুকেশের প্রথম বাংলা গান ওই ‘সরি ম্যাডাম সরি’।
এর কিছুকাল পরেই রিটায়ার করে গেলেন পি. কে. সেন। ওঁর জায়গায় এলেন এ সি. সেন। পবিত্রদাকে অন্য চেয়ারে বসানো হল— পবিত্রদার চেয়ারে বসলেন সন্তোষ সেনগুপ্ত। এ. সি. সেন আমার এইচ. এম. ভি. স্টুডিয়োতে ‘অভিমান’ ছবির গান রেকর্ড করার সময় থেকেই চেনা। তখন অবশ্য উনি অন্য চেয়ারে। মুকেশকে দিয়ে বাংলা আধুনিক গান রেকর্ড করার জেদ আমার থেকেই গিয়েছিল। একবার কী একটা জলসায় মুকেশ এখানে গাইতে আসছেন শুনলাম। শুনেই সেন সাহেবকে রেকর্ডের প্রস্তাব করলাম। উনি সানন্দে সম্মতি দিলেন। ফোন করলাম মুকেশকে মুম্বই-তে। উনিও তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলেন।
রতু মুখোপাধ্যায়ের সুরে আমার দুটো গান—’ওগো আবার নতুন করে/ভুলে যাওয়া নাম ধরে ডেকো না’ এবং ‘দেহেরি পিঞ্জরে প্রাণ পাখি কাঁদে’ নির্দিষ্ট তারিখে দমদমে রেকর্ড করতে এলেন মুকেশ। আজও ভুলিনি, সেদিন আমাদের একেবারে ভি. আই. পি. ট্রিটমেন্ট দিয়েছিল এইচ. এম. ভি
কিন্তু মুকেশ কিছুতেই শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ করতে পারলেন না। সারাদিন চেষ্টা করে বিকেলে হতাশ হয়ে উঠে পড়লেন শিল্পী। নৈরাশ্যে মুখ শুকিয়ে গেল রতুর। হঠাৎ একজনের নাম মনে এল। তিনি মান্না দে।
মুকেশকে বললাম—আপনি বম্বের এইচ. এম. ভি. স্টুডিয়োতে ‘ডেট’ নিন। আমি মান্নাদাকে অনুরোধ করব। মান্নাদা আপনাকে দু-চার দিন রিহার্সাল করিয়ে বাংলা রপ্ত করিয়ে রেকর্ড করাবেন। সেন সাহেব বম্বে অফিসে ‘ইনস্ট্রাকশন’ পাঠিয়ে দেবেন।
হাসি ফুটল সবাইয়ের মুখে।
সত্যিকারের শিল্পী মন মান্নাদার। শুনেই বললেন—মুকেশ আমার বন্ধু, আপনিই তাই। রতুবাবুও প্রায় বন্ধু হয়েই গেছেন। আপনাদের জন্য এটুকু করতে পারব না? বিনা পারিশ্রমিকে দামি সময় নষ্ট করে—নিজের গাড়ির পেট্রল পুড়িয়ে ওঁর বাসস্থান থেকে অত দূরে মুম্বই-এর এইচ. এম. ভি-র স্টুডিয়োতে গিয়ে শুধু বন্ধুদের ভালবেসে গান দুটো রেকর্ড করিয়ে দিলেন মান্নাদা।
সেবার আমি বা রতু কেউ-ই মুম্বই যাইনি।
শুধু মুকেশই নয় মুকেশের ছেলে নীতীন মুকেশও ভাল গান গায়। ও আবার ঋষি মুখার্জির ইউনিটে কাজও করেছে। চমৎকার বাংলা বলে। ওর বাবার মতো বাংলা কথা আটকায় না একটুও। গলাটাও হুবহু মুকেশের মতো।
মুম্বই-এর এইচ. এম. ভি-র দুবে সাহেব সেবার মুম্বই-তে আমায় বললেন নীতীনকে দিয়ে মুকেশের রাজকাপুরের লিপের কিছু ‘সুপারহিট’ গান বাংলা ভার্সান করলে কেমন হয়? ভাল লাগল প্রোজেক্টটা। ‘আমার নাম রাজু’ ক্যাসেটটা তারই স্বর্ণ ফসল। এর পরেই হালফিল করেছি ওকে দিয়ে আরও একটা ওই ধরনের অ্যালবাম—’আওয়ারা হুঁ’। খুবই ভাল গেয়েছে নীতীন।
মুম্বই চলে গিয়েছিলাম—
আবার ফিরে আসি কলকাতায়।
ফিরে যাই বেশ কয়েক বছর আগে। চলে যাই—উত্তমের ময়রা স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে।
সেদিন ওখানে গিয়ে দেখি বসে আছে বন্ধুবর প্রযোজক দেবেশ ঘোষ। জমে উঠেছে সন্ধ্যার আসর। উত্তম হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শুরু করল। চমৎকার গাইত উত্তম। বহু চেষ্টা করেও ওকে দিয়ে একটাও গানের রেকর্ড করাতে পারলাম না। এটা আমার একরকম ‘ডিফিট’। কেন যে ও রেকর্ডে গান গাইল না আজও তার কারণ খুঁজে পাইনি। সেদিন রাতে একটা গান গাওয়া শেষ করে উত্তম যখন টয়লেটে; তখন হঠাৎ দেবেশকে জিজ্ঞেস করলাম—তোমার নতুন ছবি ‘কাল তুমি আলেয়া’র গান আমাকে দিয়ে লেখাবে বললে, কিন্তু ছবির মিউজিক ডিরেক্টর কে?
দেবেশ বললে—মিউজিক ডিরেক্টর? তাই তো!… বলেই দেবেশ দৌড়ে চলে গেল উত্তমের বন্ধ টয়লেটের দরজার সামনে। রীতিমতো দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে চ্যাঁচাতে লাগল এই উত্তম, তুই আমার ‘কাল তুমি আলেয়া’র মিউজিক ডিরেক্টর-তুই আমার ‘কাল তুমি আলেয়া’র মিউজিক ডিরেক্টর। যতক্ষণ না ‘হ্যাঁ’ বলবি ততক্ষণ দরজায় ধাক্কা দিয়ে যাব।
ভেতর থেকে কী উত্তর এল আমি শুনতে পেলাম না। কিন্তু দেখলাম, যেন এক সময় আশ্বস্ত হয়েই দেবেশ আমার পাশের সোফাটায় ধপ্ করে বসে পড়ল।
১১
‘কাল তুমি আলেয়া’য় মহানায়ক উত্তমকুমার হল সংগীত পরিচালক। ইতিমধ্যে জীবনে বহু ভূমিকায় ও এসেছে—কিন্তু এই ওর প্রথম সংগীত পরিচালকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। সেদিন রাতে দেবেশ ঘোষের আর্জিতে সম্মতি দিলেও চট করে সে ভূমিকাটি মেনে নেয়নি উত্তম। ওখান থেকে ফেরার সময় তাই যখন জিজ্ঞাসা করলাম-—তা হলে কবে ‘মিউজিক সিটিং’ করবে? উত্তম সেই অসাধারণ হাসিটি হেসে বললে— আমি তোমায় খবর দেব।
তৎক্ষণাৎ দেবেশ বললে—খবর আবার কী দিবি? পরশু রবিবার। সকালে এখানে ‘স্ক্রিপ্ট’ নিয়ে আসছি। তুই তো স্ক্রিপ্ট শুনেছিস—মামাকে সিচুয়েশনগুলো বুঝিয়ে দিবি। ব্যস।
এবারও সেই অসাধারণ হাসিটি হাসল উত্তম। তবে মুখে কিছু বলল না। রবিবার হাজির হলাম ওখানে। দেখলাম আমার আগেই এসে গেছে দেবেশ। গানের সিচুয়েশন নিয়ে আলোচনা হল। শুনলাম, গোটা ছবিতে তিনটি মাত্র গান। একটা বাইজির। আর একটা নিচু ধরনের কলগার্লের। আর একটা ব্যাকগ্রাউন্ড সঙ্
চমৎকার সিচুয়েশন সেটার তবে সেটা নাকি প্রচলিত সুরে ও কথায় হবে। অর্থাৎ তৃতীয় লোভনীয় গানটিতে আমার আর উত্তমের কারও কিছু করার নেই।
উত্তমকে জিজ্ঞাসা করলাম—কী ভাবে সুর করবে তুমি? সুরের ওপর লেখাবে না কথার ওপর সুর করবে?
উত্তম একেবারে প্রফেশনাল সুরকারের ভঙ্গিতে জবাব দিলে—দুটোই। দুরকম ভাবেই করে দেখব—যেটা ভাল দাঁড়ায়। যা হোক পরের সিটিঙের সময় ঠিক করে চলে এলাম ওখান থেকে। একটা নির্ধারিত তারিখে দুটো গান লিখে নিয়ে আবার হাজির হলাম উত্তমের ফ্ল্যাটে। দেখা যাক ও কোনটা আগে করে-সুরের ওপর লেখা, না কথার ওপর সুর?
উত্তম আমায় একটু অপেক্ষা করতে বলে পাশের ঘরে অন্য এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে গেল। তিনি কাজ শেষ করে চলে গেলেন—আবার আর একজন এলেন। আমি বসে বসে ঘড়ি দেখছি। সে ভদ্রলোক চলে যেতে নড়েচড়ে বসলাম। কিন্তু বৃথাই। আর দুজন ভদ্রলোক এলেন। ওঁরাও চলে গেলেন। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক বাদে উত্তম এ ঘরে এসে বললে—মামা, বলো কী ব্যাপার? বললাম—’কাল তুমি আলেয়া’র গান লিখে নিয়ে এসেছি দেখবে? কথার ওপর সুর করবে-না, সুর দেবে আমি লিখব? আবার হাসল উত্তম : তোমার কি মাথা খারাপ? আমি মিউজিক ডিরেক্টর হব? দেবেশকে অনেক সময় অনেক কিছুই বলতে হয়। আমার ‘ছোটি সি মুলাকাত’-এর আবার ডেট পড়েছে বম্বেতে। আমি এখন আমার প্রোডাকশান ভাবছি। তুমি শুধু শুধু কষ্ট করে এলে, সরি। চলে এলাম বাড়ি। পরের দিনই দেবেশের ফোন : উত্তম গান নিয়ে বসেছিল? খুলে বললাম সব কিছু।
দেবেশ বললে—আচ্ছা ঘণ্টাখানেক বাদে আমি তোমায় আবার ফোন করছি।
আবার দেবেশের ফোন : কাল সকালেই সিটিং। একটুও দেরি না করে চলে যাবে।
পরের দিন আবার এতটা পথ ড্রাইভ করে গেলাম। আবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। উত্তম সোজাসুজি বললে ও মিউজিক ডিরেক্টর হতে পারবে না।
দু দিন বাদেই আবার দেবেশ ফোন করতেই বললাম—এবার যে দিনটা ঠিক করবে সেদিন তুমি-ও উপস্থিত থাকবে।
নির্ধারিত তারিখে আবার ফিরে আসতে হবে জেনেও ওখানে গেলাম।
দেখলাম দেবেশ হাজির। উত্তম আমার দিকে চেয়ে সেই অপূর্ব হাসিটি চোখেমুখে ফুটিয়ে তুলল।
দেবেশ বললে—কই, গান পড়ো।
বললাম—দাঁড়াও। হারমোনিয়ামটা বার করুক। উত্তমের স্কেল-চেঞ্জ হারমোনিয়ামটা এনে দিল কাজের লোক।
দেবেশ বললে—এই, মাদুর পাত। মাদুরে না বসে গান গাওয়ার মেজাজই পায় না উত্তম।
তাই হল। মেঝেতে মাদুর পাতা হল। মাদুরে রাখা হল হারমোনিয়াম।
না-ছেড়ে দেবেশের দিকে একবার তির্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই উত্তম সোফা থেকে নেমে বসল ঘরের মেঝেতে মাদুরে হারমোনিয়ামের সামনে।
জয় দুর্গা বলে দেবেশ আর আমিও সোফা ছেড়ে মেঝেতে বসলাম।
উত্তম গান চাইল। ওকে প্রথম দিয়েছিলাম—’একটু বেশি রাতে/মনের মানুষ ফিরল ঘরে’।
গানটা বারকতক পড়ে নিয়ে উত্তম সুর করল ‘একটু বেশি রাতে’।
মুগ্ধ হয়ে গেলাম গানের সুরের অ্যাপ্রোচ দেখে। ছবির সিচুয়েশনটা পুরোপুরি সার্থক হয়ে উঠল ওর সুর সংযোজনায়। উত্তম গাইতে লাগল। বিভোর হয়ে গাইতে লাগল। ও যে কত বড় ‘অল রাউন্ডার’ শিল্পী সেদিন মর্মে মর্মে অনুভব করেছিলাম।
টেপরেকর্ডারে টেপ করে নিতে বললাম গানটা। নইলে পরে সুরটা ভুলে যেতে পারে উত্তম।
টেপ হয়ে গেল। শুনলাম। নতুন করে ভাল লাগল।
দেবেশ একগাল হেসে বলে উঠল দেখলে তো আমি আসতেই কাজ হয়ে গেল। তোরা কেউ-ই কর্মের নোস। ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম—সত্যিই আমরা অকর্মণ্য। পরের গানটার জন্য পরে আবার একটা তারিখ নিজের থেকেই বলল উত্তম।
বুঝলাম, ও বেশ একটা আত্মবিশ্বাস আর মেজাজ পেয়ে গেছে।
সেদিন উত্তম সুর করলে আমার বহু যত্নে লেখা—’পাঁতা কেটে চুল বেঁধে কে টায়রা পরেছে/কে খোঁপার পাশে পাশ চিরুনি বাহার করেছে’। দেবেশ দারুণ খুশি। বললে— মামা দারুণ লিখেছে। আজ আমি তোদের খাওয়াব।
সঙ্গে সঙ্গে বললাম—খাওয়াবে তো বলছ। কিন্তু উত্তমকে ওই ব্যাকগ্রাউন্ড সিচুয়েশনটা দাও। নইলে সুরশিল্পী উত্তমকে লোকে ঠিকমতো বুঝবে কেন?
উত্তম বললেনা, না, ওটা প্রচলিত গান-ই থাক। আমার সুরে এ-দুটো গান-ই ভাল। ব্যাকগ্রাউন্ড সিচুয়েশনের গানটা আমি লিখে নিয়ে গিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সেটা ওর দিকে বাড়িয়ে বললাম—দারুণ মুড়ে রয়েছ তুমি। কতক্ষণই বা লাগবে তোমার সুর করতে। চেষ্টা করো না একটু।
এ গানটাও হারমোনিয়ামের সামনে রেখে যথারীতি বারকতক মনে মনে পড়তে লাগল উত্তম। হারমোনিয়ামে একটা কর্ড’ চেপে ধরে বারকতক’বেলো’ করল ওটা। তারপর বলল—শোনো তো মামা—সলিলদার ‘আজারে আজা নিদিয়া তু আজা’ গানটার সুরের একটু স্টাইল নিয়ে গানটা করলে দারুণ জমে যাবে মনে হচ্ছে। উত্তম গাইতে লাগল—যাই চলে যাই—আমায় খুঁজো না তুমি/বন্ধু বুঝো না ভুল/কাল সে আলেয়া শুধু/আমি সে-আলোর ঝরা ফুল/আমি যাই চলে যাই/যাই চলে যাই।’
চমৎকার দাঁড়িয়ে গেল গানটা।
এবার আমার বলার পালা। উত্তমকে বলেছিলাম—দেখলে তো কেমন অপূর্ব একটা গান করে ফেললে। তোমার দ্বারা অসম্ভব কী? তুমি ইচ্ছে করলে কী না করতে পার?
গান তো তৈরি হল। কিন্তু রেকর্ডিং হবে কোথায়? গাইবেই বা কারা?
উত্তম বলল—’ছোটি সি মুলাকাত’-এর শুটিংয়ের জন্য আমি তো বম্বে যাচ্ছিই। দেবেশ, তুইও তো বম্বেতে আসছিস। সব ঠিকঠাক করে পুলকমামা আর শৈলেশদাকে (অ্যারেঞ্জার শৈলেশ রায়) বম্বেতে পাঠিয়ে দে। বম্বেতেই গান রেকর্ডিং করব।
কিন্তু গাইবে কে কে?
উত্তমই বললে—লতাজি দারুণ গান করেন। কিন্তু ‘কাল তুমি আলেয়া’র এই ধরনের ‘টিপিক্যাল’ মেয়ের গান দুটো আশা ভোসলে ছাড়া আর কাউকে আমি ভাবতে পারছি না। আর ছেলের গানটি গাইবেন হেমন্তদা।
‘কাল তুমি আলেয়া’র পরিবেশক নারায়ণবাবুদের কিন্তু এটা পছন্দ হল না। নারায়ণবাবু হাতের মুঠিতে সিগারেট ধরে একটু টান দিয়েই বললেন—না, না। একটা গান লতাজিকে দিয়ে গাওয়ান। লতাজির একটা গান চাই-ই।
উত্তম মুম্বই চলে গেল। দেবেশ আমায় বললে—একটা গান লতাজিকে দিয়ে গাওয়াবার চেষ্টা করবি মুম্বই-তে।
দেবেশও একদিন চলে গেল মুম্বই-তে।
আমরা যেদিন যাব সেদিনও নারায়ণবাবুদের ফোন এল—যাতে একটা গান লতাজি গান।
আমরা মুম্বই-তে পৌঁছে উত্তমের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। উত্তম তখন ‘ছোটি সি মুলাকাত পেয়ার হো গায়ি’ গানটি রিহার্সাল করছে। বলছে—আমার ধ্যান-জ্ঞান এখন গান নয়, নাচ। বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গে আমায় নাচতে হবে। উনি একজন বিখ্যাত নাচিয়ে, আমি ওঁর সঙ্গে নাচে পারব কেন? তাই আমায় প্রচণ্ড পরিশ্রম করে নাচ রপ্ত করতে হচ্ছে।
দেবেশ চুপি চুপি বললে—লতাজির সঙ্গে কথা হয়েছে?
আমি কিছু বলার আগেই উত্তম বললে—মামা, আশাজিকে একটু বুঝিয়ে বলো। সারাদিন আমি নাচ আর ফিল্ম নিয়ে ব্যস্ত। একদিন রাতের দিকে যেন গান শেখাবার সময় দেন।
ওখান থেকে চলে আসার সময় আড়ালে ডেকে দেবেশ আমায় আবার লতাজির কথা মনে করিয়ে দিল।
পরদিন সকালে গেলাম পেডার রোডের ‘প্রভুকুঞ্জে’। লতাজি আর আশাজি দু বোন পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকেন। ও দিকের বারান্দায় একটা দরজা আছে—যা দিয়ে দুজনেই যখন খুশি যাওয়া-আসা করতে পারেন।
আশাজিকে বললাম—উত্তমের সুরে গান। উত্তমের খুবই ভক্ত আশাজি, তৎক্ষণাৎ গাইতে রাজি হয়ে গেলেন। বললাম রাতে গান তোলাতে আসবে, রাতে রেকর্ডিং। তাতেও রাজি হলেন আশাজি।
ওখান থেকে বিদায় নিয়ে লতাজির কাছে গেলাম। মাথায় বুদ্ধি এল—’রাতে গান তোলাবে, রাতে রেকর্ডিং হবে—তা ছাড়া একটা ‘কলগার্ল’ আর একটা ‘বাইজি’র গান লতাজি গাইতে রাজি-ই হবেন না। স্বাভাবিকভাবেই আশাজিরই দুটি গান থাকবে। আমার সাপ-ও মরবে লাঠিও ভাঙবে না।
লতাজিকে বললাম আমার বক্তব্য। রাতে রেকর্ডিং, বাইজির গান। শুনেই লতাজি বললেন, কে গাইবে?
বললাম—আশাজির নাম।
উত্তরে কিছু বললেন না লতাজি। শুধু একটু হেসে বললেন—উত্তমকুমার সুর করেছেন? নিশ্চয়ই ভাল করেছেন।
বললাম—খুব-ই ভাল করেছে। কিন্তু ও ধরনের গান তো আপনি গাইবেন না। আপনি তো একদিন আমায় বলেছিলেন—রাজকাপুর সাহেব ‘সঙ্গম’ ছবিতে ‘কা করো রাম মুঝে বুঢড়া মিল্ গয়া’ গানটি একটি অল্পবয়সি মেয়ের মুখে দেবেন বলে আপনাকে গাইয়েছিলেন। আপনিও তাই গেয়েছিলেন এক সরলা কিশোরীর অভিব্যক্তিতে। পরে সিচুয়েশন বদলে যখন ওটা ক্যাবারে নর্তকীর সাজে বৈজয়ন্তীমালার মুখে দিলেন— আপনি তাই শুনে অভিমান করে ‘সঙ্গম’-এর প্রিমিয়ারে যাননি।
লতাজি শুধু বললেন—আপনার দেখছি সব মনে আছে?
১২
যা হোক সময়মতো একদিন রাতের দিকে উত্তমের নাচের মহড়া শেষ হতে উত্তম আর আমরা এলাম আশাজির বাড়ি। দুজনেই দুজনের পরিচিত। উত্তম আশাজিকে বললে—এইমাত্র আপনার আর রফি সাহেবের গাওয়া আমার ছবির ‘ছোটি সি মুলাকাত পেয়ার হো গায়ি’ গানটির নাচের রিহার্সাল করে এলাম। আপনি দারুণ গেয়েছেন গানটা। আশাজি ফ্যালফ্যাল করে উত্তমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছুতেই মনে করতে পারলেন না গানটা। (এ ব্যাপারটা আমি অসাধারণ স্মৃতিশক্তিসম্পন্না একমাত্র লতা মঙ্গেশকর ছাড়া ভারতবর্ষের প্রায় প্রতিটি নামী শিল্পীর-ই ক্ষেত্রে দেখেছি। ওঁরা গান রেকর্ডিং-এর পর প্রায় ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ ভুলে যান গান। যে গানটি হিট হয়, সেটি রেকর্ড বা ক্যাসেট থেকে আবার নতুন করে শিখে পরিবেশন করেন জলসায়।) যা হোক, আশাজি প্রথমে শিখলেন-’পাতা কেটে চুল বেঁধেছে’ গানটি-পরে তুললেন ‘একটু বেশি রাতে’। উত্তম বললে—-রেকর্ডিং-এর দিন আমার শুটিং। শুটিং শেষ করে দাদারে ‘বম্বে ল্যাব’-এ আসতে কিন্তু আমার দশটা বেজে যাবে।
আশাজি তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন—বেশ তো ‘একটু বেশি রাতে’ না হয় আমি ‘একটু বেশি রাতেই’ গাইব।
এ সব কথার মাঝেই ওদিকের বারান্দা থেকে একজন আমায় ডেকে বললেন—দিদি আপনাকে ডাকছেন।
দিদি মানে লতাজি। বাইরের দরজা দিয়ে গেলাম ওঁর কাছে। লতাজি বললেন—আমি একবার বারান্দায় গিয়েছিলাম—শুনতে পেলাম উত্তমের শেষ গানটা। চমৎকার করেছে কিন্তু।
দেঁতো হাসি হাসলাম-আপনার ভাল লেগেছে?
লতাজি উত্তর করলেন—নিশ্চয়ই! ভালকে ভাল বলব না কেন? সত্যি ট্যালেন্ট আছে উত্তমের। গানের কথাটা কী?
বললাম—’একটু বেশি রাতে।’
সুরটা একবার শুনেই সংগীত সম্রাজ্ঞী তুলে নিয়ে ছিলেন। কথাটা পেয়েই গেয়ে উঠলেন ‘সাইন্ লাইনটা অর্থাৎ ‘মুখড়া’টা। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। এবার যদি লতাজি বলেন গানটা আমি গাই—তা হলে কী উপায় হবে? তবুও বিনয় গদ্গদ কণ্ঠে বললাম— চমৎকার লাগছে আপনার গলায়। এবার ছুড়ে দিলাম আমার ব্রহ্মাস্ত্র। কিন্তু রাত বারোটায় তো রেকর্ডিং। তার আগে উত্তমের ফিল্মের শুটিং। শুটিং শেষ না করে তো ও আসতেই পারবে না। আপনার বাড়ির কফিটা দারুণ হয়, একটু কফি খাওয়ান।
লতাজি আমায় কফি দিতে বলে অন্য কথায় চলে গেলেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ‘কাল তুমি আলেয়া’য় শুধু গানের সুর নয় গানের পিক্চারাইজেশানটা করে ছিল উত্তম। এখন যেমন ডান্স ডিরেক্টররা গান পিক্চারাইজ করেন—ফাইট কম্পোজাররা মারামারির ছবি তোলান—ছবির পরিচালক সিগারেট খেতে খেতে আরাম কেদারায় বসে তা শুধু অবলোকন করেন। আমার মনে হয় বাংলা ছবিতে উত্তম-ই প্রথম সেটা চালু করে। ছবির পরিচালককে দর্শকের ভূমিকায় রেখে আশা ভোঁসলের রাত বারোটায় গাওয়া ‘একটু বেশি রাতে’ চিত্রায়িত করেছিল উত্তম নিজেই। কাজটা কেমন হয়েছিল—যাঁরা ও ছবি দেখেছেন নিশ্চয়ই মনে রেখেছেন। উত্তম জীবনে মাত্র আর একটি ছবির সংগীত পরিচালক হয়েছিল। সে ছবির নাম ‘সব্যসাচী’। তাতেও আমাকে দিয়ে গান লিখিয়েছিল। কিন্তু উত্তম কত বড় গায়ক ছিল—তার যেমন কোনও রেকর্ড রাখা যায়নি—তেমনি উত্তম কত বড় অঙ্কনশিল্পী ছিল তারও কোনও রেকর্ড নেই। সরস্বতী পুজোর সময় ভবানীপুরে আমাদের মরশুমী ক্লাবে বা লক্ষ্মীপুজোর সময় ওর বাড়িতে ওর দেওয়া আলপনা যাঁরা দেখেছেন—নিশ্চয়ই তাঁদের তা মনে আছে।
উত্তমের আর একটা দিকও কেউ জানল না। ও কত চমৎকার সাঁতার কাটত। ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় উত্তমকুমার, টেনিস খেলোয়াড় উত্তমকুমার—টেবিল টেনিস খেলোয়াড় উত্তমকুমারকে অনেকেই দেখেছেন কিন্তু সাঁতারু উত্তমকে আমাদের মতো ঘনিষ্ঠ ছাড়া খুব কম জন-ই দেখেছেন। উত্তম একদিন হঠাৎ বললে-আমাদের ‘মরশুমী ক্লাব’ ভার্সেস ‘টেকনিসিয়ান্স স্টুডিয়ো’ একটা ফ্রেন্ডলি ফুটবল ম্যাচ আয়োজন করছি। মরশুমীতে সেদিন আমি ছাড়া শ্যামল মিত্র, সুরকার রতু মুখোপাধ্যায় আর সম্ভবত ভূপেন হাজারিকাও উপস্থিত ছিল। সবাই হই হই করে উঠল। অর্থাৎ সংসদে প্রস্তাব বিনা বাধায় গৃহীত হল।
উত্তম বলল—আমরা সবাই খেলব। আমার দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল—মামা, তোমাকেও খেলতে হবে।
মুখ শুকিয়ে গেল আমার। অস্ফুট স্বর বের হল–অ্যাঁ, আমি?
খেলার ব্যাপারে সব সময়ই সিরিয়াস শ্যামল।
কানে কানে ফিসফিস করে বললে—ঘাবড়াচ্ছিস কেন? ফ্রেন্ডলি ম্যাচ তো। যতক্ষণ পারবি খেলবি। তারপর উঠে আসবি।
সম্ভবত মহমেডান স্পোর্টিং গ্রাউন্ডে এক রবিবার সকালে খেলা হয়েছিল। সবাই শর্টস অর্থাৎ হাফপ্যান্ট পরে মাঠে নামলাম—আমিও তাই।
আমাদের উত্তম, শ্যামল, ভূপেন হাজারিকা মাথায় রুমাল বেঁধে রতু, সুনীল চক্রবর্তী, সুধীর মুখার্জী (মাস্তদা) এবং আমি ইত্যাদি সবাই তখন ফুটবল প্লেয়ার। ওদিকে দেবেশ ঘোষ, সত্যেন চট্টোপাধ্যায়, টেকনিসিয়ান্স স্টুডিয়োর আরও অনেকে।
উত্তম আমাদের ক্যাপ্টেন। খেলা আরম্ভ হল। শ্যামল, উত্তম, রতু সুনীল বেশ ভালই খেলা জানত। চমৎকার খেলে চলল। আমিও ওদের সঙ্গে অহেতুক দৌড়োদৌড়ি করতে লাগলাম। একবার আমার কাছে বল এল। মেরে দিলাম একটা শট। বল কোথায় দেখতে পাচ্ছি না। উত্তম পাশেই ছিল। বুঝতে পেরে হো-হো করে হেসে আমায় বললে—মামা, ওই যে বল। স্কাইং হয়ে গেছে।
আমার ফুটবল খেলায় এ ঘটনাটা বহুদিন ধরে বহু জায়গায় বলেছে উত্তম, আর হেসে লুটিয়ে পড়েছে।
সেদিন কিন্তু আমরা এক গোলে জিতেছিলাম। উত্তমের একটা ‘গ্লু’ শ্যামল চমৎকারভাবে এগিয়ে দিল মাথায় রুমাল বাঁধা রতু মুখোপাধ্যায়কে। রতু বলটা ঢুকিয়ে দিল জালে। রবিবার সকালে ময়দানের খেলার মাঠের পথচলতি মানুষেরা উত্তমকে দেখে ভিড় করে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল খেলা। এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগল ক্যামেরা—শুটিংয়ের অন্যান্য সাজসরঞ্জাম। কারণ, ওই দর্শকরা ভেবেছিল বুঝি শুটিং হচ্ছে। কিছুই খুঁজে না পেয়ে অবাক হল শুধু। সেদিন আমরা গঙ্গার ধার থেকে ইলিশ মাছ কিনে ভবানীপুরে ‘মরশুমী’ ক্লাবে ফিরলাম।
তখনই বোধহয় মনে মনে লিখে ফেলেছিলাম— সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল।’ যে গানটা পরে সবাই শুনেছিল নচিকেতা ঘোষের সুরে মান্না দের কণ্ঠে উত্তমেরই ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবিতে।
এ সব দিনগুলো কোথায় গেল? আজও তো রয়েছে অনেক নায়ক, অনেক কণ্ঠশিল্পী, অনেক গীতিকার—কিন্তু কোথায় সেই প্রাণপ্রাচুর্য? শুধু এইখানেই শেষ নয়। তখন ময়দানে মোহনবাগান মাঠে মোহনবাগান সাপোর্টার আমি, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, পরিচালক ও অভিনেতা দিলীপ মুখোপাধ্যায়, অভিনেত্রী অনুভা গুপ্তা প্রতিটি বড় খেলায় নিয়মিত হাজির থাকতাম। মাঝে মাঝে নচিকেতা ঘোষ, ‘উল্টোরথ’ পত্রিকার প্রসাদ সিংহ, গিরিন সিংহ-ও আসতেন। মোহনবাগান গোল করলে আনন্দে আমি কী করতাম জানি না, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য দু হাত তুলে লাফাতেন, নচিকেতা ঘোষ একসঙ্গে দুটো সিগারেট ধরিয়ে ফেলতেন, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় ওই লম্বা শরীর নিয়ে পেছনের বেঞ্চির সারিতে চিতপাত হয়ে পড়ে যেতেন। আর প্রসাদদা এলোপাতাড়ি ওঁর পাশের অচেনা-অজানা লোকের পিঠে কিল মেরে যেতেন।
মনে আছে, একবার মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের খেলায় ইস্টবেঙ্গলের একটা গোল কী কারণে যেন রেফারি বাতিল করে দিয়েছিলেন। খেলার শেষে আমি আর দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় পাশাপাশি আসছি গাড়িতে উঠব বলে—ওদিকের ইস্টবেঙ্গল ব্লক থেকে তখনই বের হয়েছে ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। মানবকে দেখে আমরা দুজনেই এগিয়ে গেলাম (সেবার মোহনবাগান-ই জিতে ছিল)। ভুরু কুঁচকে মানব কট্টর বাঙাল ভাষায় বলে উঠল—কে ডা তোমরা? তোমাদের চিনি না!
শুধু কলকাতাতেই নয় রোভার্স খেলার সময় মুম্বইতে থাকলে মোহনবাগানের খেলার দিনে ক্লাব কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ‘ডে স্লিপ’ নিয়ে উপস্থিত হতাম ‘কুপারেজ’-এ। দেখতাম—আমার আগেই হাজির হয়ে গেছেন—আর এক মোহনবাগান সাপোর্টার মান্না দে। ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার হলেও বাংলার টিমকে সমর্থন করবার জন্য আসতেন শচীন দেববর্মণ আর রাহুল দেববর্মণ। মোহনবাগান জিতলে প্লেয়ারদের গেস্ট হাউসে গিয়ে উৎফুল্ল মান্না দে গান শুনিয়ে আসতেন। সে সব দিন নেই। আছে শুধু দীর্ঘশ্বাস। জানি না, এ দীর্ঘশ্বাসের মূল্য কতটা?
একদিন সকালে কলকাতার বাড়িতে চা খেতে খেতে খবরের কাগজের পাতা ওল্টাচ্ছি, টেলিফোন এল বন্ধু মেগাফোনের কমল ঘোষের। কমল বললেন—এই বেগম আখতার কলকাতায় এসেছেন, উঠেছেন ব্রডওয়ে হোটেলে। তুই যে বলেছিলি বেগম আখতারকে দিয়ে বাংলা গান করলে দারুণ হবে—ওঁকে বাংলা গান গাওয়ানোর চেষ্টা করবি? যাবি ওঁর কাছে?
কমল ঘোষ—অপুত্রক দৃষ্টিহীন বিখ্যাত মেগা ঘোষের ভাইপো। তাঁর মেগাফোন রেকর্ডের বাঁধা আর্টিস্টদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কাননদেবী, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, রবীন মজুমদার ও আখতারী বাই। পরবর্তীকালেও তিনি প্রথম রেকর্ডের সুযোগ দেন— অপরেশ লাহিড়ি, বাঁশরী লাহিড়ি, সনৎ সিংহ, নচিকেতা ঘোষ, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি বিখ্যাতদের। যাঁরা প্রথমে ‘এরিয়ান্সে’ খেলে পরে ‘মোহনবাগানে’ (এইচ এম ভি যোগ দেন। বন্ধু কমলের কাছে গল্প শুনেছি—একদিন কাননদেবীর রিহার্সালে কমল কোঁচানো ধুতি-পাঞ্জাবি পরে গায়ে একটু সুগন্ধি ছড়িয়ে মেগাফোনের হ্যারিসন রোডের রিহার্সাল রুমে গাজির হয়। জ্যাঠামশাই চোখে না দেখতে পেলেও বুঝতে পারলেন কমল এসেছে।
শুধু বললেন—
‘কমল, আয়, বোস!’
তারপর রিহার্সাল ব্রেকে যখন চা এল তখন কমলকে হুকুম করলেন—’না, বেয়ারা নয়, কমল তুই সব্বাইকে চা-টা দিয়ে আয়।’ ওই ফ্যান্সিবাবু সাজের কমল ঘরভর্তি বাজনদার, তাদের খিদমতগার সবাইকে নিজের হাতে চা পরিবেশন করে কাননদেবীকেও চা দিয়ে প্রণাম করে ঘরের এককোণে বসে ছিল। যা হোক, ব্রডওয়ে হোটেলে নির্দিষ্ট সময়ে মুখোমুখি হলাম এক কিংবদন্তি শিল্পী, সংগীত সম্রাজ্ঞী বেগম আখতারের সঙ্গে।
১৩
ভগবানের আশীর্বাদে জীবনে প্রথম আমার লেখা গান গেয়ে যত শিল্পী সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন, মনে হয়, বিগত দিনের প্রণব রায়ের লেখা গান ছাড়া আর কোনও গীতিকারের গান গেয়ে কেউ তা পারেননি।
আজকের নামী শিল্পী অলকা ইয়াগনিক যখন কলকাতায় নিউ আলিপুরে থাকত— তখন কিশোরী ফ্রকপরা অলকা জীবনে প্রথম গেয়েছিল আমার লেখা বাংলা গান —– কনক মুখার্জির ছবি—’এই তো সংসার’ গানটি ছিল ‘নয়ন তারার ঘুগনী দানা।’
কবিতা কৃষ্ণমূর্তিও জীবনে প্রথম এইচ. এম. ভি.-র একটি ই. পি. ডিস্কে গাইল আমার লেখা চারটি বাংলা গান মান্না দের সুরে। তারমধ্যে একটি গান—’পলাশের দেশে/একা একা এসে’ আমি এখনও মাঝে মাঝে বাজিয়ে শুনি।
লতা মঙ্গেশকরের কনিষ্ঠা ভগিনী ঊষা মঙ্গেশকরেরও প্রথম বাংলা গান আমি লিখি স্বয়ং লতাজির অনুরোধমতো, সুর করেন দক্ষিণামোহন ঠাকুর। ‘আমায় বাহারী সেই ঝুমকো এনে দেরে’ এবং ‘বুঝি না এ ভালবাসায়’। প্রখ্যাত শিল্পী সুমন কল্যাণপুরের প্রথম বাংলা গান আমারই রচনা। মণিহার ছবিতে হেমন্তদার সুরে—দূরে থেকো না এসো কাছে এসো।’
সুমন কল্যাণপুরের প্রথম দুটি বাংলা আধুনিক গানেরও গীতিকার আমি। এইচ. এম. ভি.-র একটি সেভেন্টি এইট রেকর্ডে গান দুটি ছিল। এক পিঠে ছিল—দুরাশার বালুচরে একা একা’। অপর পিঠে ছিল—মনে করো আমি নেই বসন্ত এসে গেছে।’ রতু মুখোপাধ্যায়ের সুরের এই গান দুটিও মান্নাদা মুম্বই-এর এক স্টুডিয়োতে সুমন কল্যাণপুরকে দিয়ে রেকর্ড করিয়ে দিয়েছিলেন শুধু মাত্র আমাদের নিবিড় বন্ধুত্বের খাতিরে।
অনিল বাগচীর পুত্র অধীর বাগচী নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি। স্বয়ং অনিলদা যেটা করেননি, আমি অধীরের জন্য সেটা করিয়ে দিয়েছিলাম। এইচ. এম. ভি.-কে রাজি করিয়েছিলাম অধীরের গানের রেকর্ডিং-এ। ওঁদের শর্ত আমার কথা আর মান্নাদার সুর। রীতিমতো চোর পুলিশ খেলে মান্নাদাকে দিয়ে সুর করিয়েছিলাম— চাঁদ বিনা সারা রাত বেশতো গো কেটে যায়’ এবং ‘যখনি গানের মুখ মনে আসে না’। অধীর জীবনে প্রথম সে গান দুটি রেকর্ডে গেয়েছিল।
বোধহয় আগেই বলেছি ঊষা উত্তুপের প্রথম বাংলা গানও আমার রচনা। সুর করেছিল অজিত ঘোষ। এইচ. এম. ভি.-তে প্রকাশিত ওর একটি গান ‘মন কৃষ্ণ বলে’ ক্যালেন্ডারের ছবিতে পর্যন্ত স্থান পেয়েছিল। চিত্রা সিং-জগজিৎ সিং-এর প্রথম বাংলা গানের রচয়িতাও আমি। অনুপ জালোটারও তাই। ও প্রথম বাংলা গান গায় ‘সন্ধ্যা প্রদীপ’ ছবিতে মৃণাল ব্যানার্জির সুরে-’হে মহাদ্যুতিং দিবাকর সর্বপাপ তাপ হরো। উদিত নারায়ণ জীবনে প্রথম বাংলা গান গায় আমার লেখা ‘মনে মনে’ ছবিতে কানু ভট্টাচার্যের সুরে। দীপা নারায়ণ গায় বাবুল বসুর সুরে। বাণী জয়রামও প্রথম বাংলা গান গায় আমার লেখা। ওয়াই. এস. মুলকির সুরে। শ্রাবন্তী মজুমদার গায় ভি. বালসারার সুরে। কুমার শানুরও প্রথম বাংলা গান আমার, তার সুরকার দিলীপ রায়। অধুনা রোজা খ্যাত মাদ্রাজের ‘চিত্রা’, সেই বিখ্যাত গায়িকাও প্রথম বাংলা গান গায় আমারই রচনা—‘নাগ পঞ্চমী’ ছবিতে, সুরকার প্রফুল্ল করের সুরে। এই প্রথম রেকর্ড করার নেশাতেই সেবার মেগাফোনের কমল ঘোষের সঙ্গে বেগম আখতারের হোটেলের ঘরে ঢুকলাম আমি। সেদিনই প্রথম ওঁকে দেখলাম। প্রথম আলাপ হল ওই কিংবদন্তি শিল্পীর সঙ্গে। তখন যৌবন প্রায় পেরিয়ে গেছে ওঁর, কিন্তু সুর্মাপরা ডাগর চোখের চাউনি -—আর জর্দা কিমাম খাওয়া ঠোঁটের হাসিটি দেখে বুঝলাম ওঁর অন্তরের যৌবন তখনও পর্যাপ্ত। তাই অত সুন্দর গান ওই বয়সেও গেয়ে চলেছেন।
কমল বলল ওদের মেগাফোনের গাওয়া অনেক হিট গান থেকে দুটো হিট গান বাংলা ভার্সান করতে। বেগম কিন্তু বললেন ওঁর এইচ. এম. ভি.-র ‘কোই না মানে গুলশান্ গুলশান’ গানটির সুরেই প্রথম বাংলা গান গাইবেন।
শিল্পী ঘরের মেঝেতে পাতা কার্পেটে হারমোনিয়ামের সামনে বসলেন। ওঁর সঙ্গে ছিলেন এক অল্পবয়সি গায়িকা (নাম মনে নেই)।
বেগম হারমোনিয়ামটির একটা দিক কোলের ওপরে রাখলেন অন্য দিকটা রইল মাটিতে। সেই অপূর্ব কণ্ঠে একটু আলাপ করলেন। প্রথমেই আমার সারা শরীর ঝিম্ ঝিম্ করে উঠল। সামনা সামনি ওঁর গান শুনতে পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করেছিলাম সেদিন।
এবার গাইলেন-’গুল শান্ গুল শান্।’ আমার চোখ পড়ল ওঁর হাতের আঙুলে ঝলমল করছে একখণ্ড বহুমূল্যবান হিরে। তার দ্যুতি ছিটকে পড়ছে ওঁর হারমোনিয়াম বাজানো হাতের আঙুলের নড়াচড়ায়।
বুঝতে পেরে উনি হাসলেন—বললেন —–নিজাম সাহেবের উপহার।
কমল আমার কানে কানে বাংলায় বললে—নিজাম সাহেব ওঁর গানের আত্মহারা ভক্ত ছিলেন।
বারকতক ‘গুলশান গুলশান’ শুনিয়ে একটা ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেট প্যাকেট কমল আর আমার দিকে এগিয়ে দিলেন বেগম। আমি কমল দুজনেই সিগারেট খাই না। ধন্যবাদ জানালাম শুধু।
বেগম নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে সুখটান দিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে সঙ্গিনীকে বললেন—গাও গুলশান গুলশান। সঙ্গিনী গেয়ে চলল। উর্দু জানি না আমি, যত দূর মনে হচ্ছে গানটা ছিল—’কোই না মানে গুলশান গুলশান’ (কথা ভুল হলে ক্ষমা করবেন)। আমি মিটার মিলিয়ে লিখলাম ‘একী আনন্দে দোলে এ-জীবন’!
উনি কথাটার মানে জানতে চাইলেন। আমার হিন্দিতে বুঝিয়ে দিলাম আমি। খুশি হয়ে গাইতে লাগলেন সুর মিলিয়ে।
অনেক প্রচেষ্টায় গোটা পঙক্তিটি বাংলায় প্রায় সঠিক উচ্চারণ করে গেয়ে চললেন। কিন্তু আটকে গেলেন ওই ‘দোলে’ কথাটায়। যতবারই ‘দোলে’ বলতে বলি ততবারই উনি বলেন ‘ডোলে’! ‘দোলে’ বলতে পারেন না। এই ‘দোলে’ আর ‘ডোলে’ নিয়ে যখন ‘ডামাডোল’ চলছে ঘরে ঢুকলেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। জ্ঞানদা আর আমরা দুপক্ষই খুশি হয়ে অভিবাদন প্রত্যাভিবাদন জানালাম।
জ্ঞানদাকে হঠাৎ ওখানে পেয়ে আমি বেঁচে গেলাম। আমি লিখতে লাগলাম—আর উনিই শেখাতে লাগলেন বেগমকে। সেই সুরের মিড়-গমকে মুর্ছনা এখনও আমার রক্তে বাজে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আইনগত কারণে বেগম আখতার মেগাফোনে বাংলা গান রেকর্ড করতে পারলেন না। এমনকী আমার ওই ‘একী আনন্দে দোলে এ-জীবন’ গানটা ও নয়। ওই সময়কার লেখা ওই গানটা এবং অন্যান্য কয়েকটি গান জ্ঞানদা মেগাফোনেই রেকর্ড করালেন ওঁর সুগায়িকা পত্নী ললিতা ঘোষকে দিয়ে। চমৎকার গেয়েছিলেন উনি। অবশ্য বেগম আখতারকে আমার লেখা গান জ্ঞানদাই করালেন এইচ. এম. ভি.-তে। অপুর্ব সুর, অপূর্ব গাওয়া সেই গানটি হল ‘ফিরায়ে দিওনা মোরে শূন্য হাতে/ কুঞ্জে এখনও কুহু কুজনে মাতে’।
আমার স্মৃতির সমুদ্রের ঢেউগুলো বড় এলোমেলো। কে কখন আসে ঠিক করা যায় না। একের পর এক শুধু আসে শুধু আসে। কিন্তু ওদের সঠিক পরম্পরা নির্ধারণ করতে পারি না!
রাজেন সরকার ছিলেন এক দক্ষ ক্ল্যারিওনেট শিল্পী। তখন যে কোনও অর্কেস্ট্রায় ক্ল্যারিওনেট থাকতই। রাজেনদা, টোপাদা (অমর দত্ত) কয়েকজন মিলে গড়ে তুলেছিলেন সুরশ্রী অর্কেস্ট্রা। এখন যেমন একজন সংগীত পরিচালক তাঁর অ্যারেঞ্জারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে সাধারণত ওই অ্যারেঞ্জারের গোষ্ঠীর যন্ত্রশিল্পীদের দিয়ে গান রেকর্ড করেন এবং ইচ্ছেমতো ওই গোষ্ঠীর বাইরেও যে কোনও স্বতন্ত্র যন্ত্রসংগীত শিল্পীকে নিতে পারেন তখন এ-নিয়ম ছিল না। একজন চিত্র প্রযোজক সংগীত পরিচালকদের সঙ্গে পরামর্শ করে চুক্তি করতেন একটা ‘অর্কেস্ট্রা’ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। ওঁদের দলে যে সব যন্ত্রশিল্পী থাকতেন ওঁদের দিয়েই গান রেকর্ড হত। আমার মনে হয় তখনকার নিয়মটাই ভাল ছিল। বিভিন্ন অর্কেস্ট্রার মধ্যে একটা স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা থাকত। তার ফলে যন্ত্রসংগীত শিল্পীরা দক্ষতার লড়াই করতে করতে অনেক উঁচুতে উঠে যেতেন।
যা হোক, রাজেনদা হঠাৎ সংগীত পরিচালক হয়ে গেলেন। যদিও তিনি জীবনে কোনও দিনই ওই ক্ল্যারিওনেটটাকে পরিত্যাগ করেননি। রাজেনদা ‘ঢুলি’ ছবিতে সুর দিয়ে একটা আলোড়ন তুলে ফেলেছিলেন সংগীত জগতে। ঢুলি ছবিতেই উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় রাতারাতি সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে গেলেন। আর এক লহমায় জনপ্রিয়তার শিখরে উঠে গেলেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর একজন সেই অনন্যা শিল্পী যূথিকা রায় যাঁকে কেউ কোনও দিন প্লে-ব্যাকে গান গাওয়াতে পারেননি— রাজেনদা সেই অসাধ্য সাধনটি করে ফেললেন। প্রথম প্লে-ব্যাকে গাইলেন কমল দাশগুপ্ত ও প্রণব রায়ের গানের সেই বিখ্যাত ‘ভোরের যুথিকা’-যূথিকা রায়। ঢুলির পর পরপর অনেক ছবি করে গেলেন রাজেনদা। কিন্তু পরের ছবিগুলোতে ক্রমশ ওঁর সেই ‘ঢুলি’র খ্যাতিটা কিছুটা কমে এল।
সেই সময়েই পরিচালক পিনাকী মুখোপাধ্যায় অর্থাৎ পানুদার সঙ্গে আমার শুভযোগ। পানুদা হেনরি ফন্ডা অভিনীত আলফ্রেড হিচককের সম্ভবত ‘রঙ্গ-ম্যান’ ছবিটি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে বানাতে এলেন ‘অশান্ত ঘূর্ণি’। প্রথম দিনের আলাপ থেকে আজ অবধি পানুদা আমায় এইভাবে কাছে রেখেছেন। অনেক আলোচনা করেছেন—অনেক তর্ক ঝগড়া করেছেন—অনেক অনেক ভালবেসেছেন। ওঁর বিভিন্ন ছবিতে বিভিন্ন সংগীত পরিচালক নিয়েছেন কিন্তু গীতিকার আমাকে আজ অবধি বদল করেননি। পানুদার ছবিতে গান মানেই আমার রচিত গান। নিতান্ত বাধ্য হয়ে হাতে গোনা দু-একটা ক্ষেত্রে হয়তো এর ব্যতিক্রম হয়েছে।
পানুদা শোনালেন অশান্ত ঘূর্ণির চিত্রনাট্য। বললেন সংগীত পরিচালক রাজেন সরকার। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই আমি একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। এ ধরনের ওয়েস্টার্ন স্টাইলের ভিন্নধর্মী ছবিতে রাজেনদার মিউজিক?
পানুদা বললেন—তুমি তো এ ধরনের গান কেমন হওয়া উচিত ভালই জানো—দরকার হলে রাজেনদাকে একটু সাহায্য কোরো।
সিটিং করতে গেলাম রাজেনদার তখনকার হেদুয়া অঞ্চলের বাড়িতে। ওখানেই পেয়ে গেলাম রাজেনদার বড় ছেলে রীতেশকে যে এখন অধ্যাপক। দেখলাম মডার্ন মিউজিক সম্বন্ধে ওর ধারণা খুবই স্পষ্ট। ও হল রাজেনদার সুযোগ্য সহকারী।
আমাদের প্রথম গান তৈরি হল—’আমার নতুন গানের জন্মতিথি এল—বাঁশি বাজো বীণা বাজো’। পানুদা শুনতে এসে বলেছিলেন—ভাবিনি এমন ‘ভাল’ একটা গান পাব। আমার ছবির সিচুয়েশনটা আরও উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। হেমন্তদার কণ্ঠে সে গান নিশ্চয়ই সংগীত রসিকরা শুনেছেন। আটকাল আর একটি গানে। পানুদা বললেন—রাজেনদা, আমার ‘ইট’ গান চাই। একদম আজকের গানের সুর। আমরা গান তৈরি করে পানুদাকে খবর দেব বললাম। পানুদা চলে গেলেন।
রাজেনদার বড় ছেলে বললে — পুলককাকা কী করা যায় বলুন তো?
প্রশ্নটা ওর একার নয়, রাজেনদা, আমার সকলেরই। অন্ধকারে আমরা হাতড়াচ্ছি। রাজেনদা অনেক সুর শোনাচ্ছেন পছন্দ হচ্ছে না।
হঠাৎ একটা আলোর ঝলক দেখতে পেলাম। বললাম—রীতেশ তুমি একদিন তোমাদের ছেলেবেলার ‘বয়েজ স্কাউট’-এর কী একটা গান আমায় শোনাচ্ছিলে ওটা আর একবার গাও তো।
ও তৎক্ষণাৎ গেয়ে শোনাল ‘ গুংগাং গুলি গুলি আচা গুংগাং গো’।
ব্যাস, রাস্তা পেয়ে গেলাম। হুবহু ওই মিটারে লিখে ফেললাম—’লজ্জায় থরো থরো দৃষ্টি মিষ্টি গো সন্ধ্যায় ঝরো ঝরো বৃষ্টি মিষ্টি গো।’ মানবেন্দ্রর কন্ঠে সে গানটিও সুপারহিট হয়ে গেল। পিনাকী মুখোপাধ্যায়ের ‘মহাশ্বেতা’ ছবির সময়ও এই ধরনেরই ঘটনা ঘটল।
১৪
পুতুল নাচের ওপর পানুদা একটা গানের সিচুয়েশন করেছিলেন। পুতুল নাচ বলতে আমরা গ্রামের মেলায় যে ধরনের পুতুল নাচ দেখি—ঠিক সে ধরনের পুতুল নাচ নয়। এ রীতিমতো আধুনিক পুতুল নাচ। আমার মনে আছে—ডালহৌসি স্কোয়ারে এর অসাধারণ পুতুল নাচ স্রষ্টা রঘুনাথ গোস্বামীর কাছে গেলাম পানুদা রাজেনদা আর আমি। ওখানে অনেক অনেক ‘আইটেম’ দেখে ছিলাম। তার মধ্যে বেছে নিয়েছিলাম একটা আইটেম যেটা গল্পের সঙ্গে মিলবে। গান তৈরি হয়ে গেলে সেই গানের কথামতো কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে নতুন করে রঘুনাথবাবু আইটেমটি বানাবেন—এটাই ঠিক হল।
রাজেনদা খুব খেতে ভালবাসতেন—ভালবাসতেন খাওয়াতেও। রাজেনদার সিটিং মানেই ‘ভুরি ভোজ’–আমি একপায়ে খাড়া।
বসলাম গান নিয়ে। গান আর হয় না। শুধু খাওয়াই হয়। শুধু খাওয়াই হয়। দুদিন কেটে গেল। তৃতীয় দিনের দিন আবার ওর ছেলের কাছে ওর স্কুলে শেখা একটা ছোটদের ওয়েস্টার্ন গান শুনলাম। শুনতেই কাজ হয়ে গেল। লিখে ফেললাম— রাতদুপুরে শুরু হল সা রে গা মা পা’। শেয়াল-কুমির ইত্যাদি জন্তুদের নিয়ে গান। ঢুলির রাজেনদা ক্রমশ নতুন হয়ে আত্মপ্রকাশ করতে লাগলেন।
রাজেনদা সব সময়েই হাসিমুখে থাকতেন। খুব মিশুকে মানুষ ছিলেন। রাজেনদার একটা ঘটনা না-বলে পারছি না। রাজেনদা তখন বিখ্যাত দেবকী বসুর ছবিতে কাজ করছিলেন। দেবকীবাবু খুবই সময় মেনে চলতেন। যেদিন দেবকীবাবুর সঙ্গে রাজেনদার ‘সিটিং’, সেদিনই তিনি ক্ল্যারিওনেট বাজানোর একটা মোটা টাকার আমন্ত্রণ পেয়ে গেলেন। রাজেনদা জানতেন—দেবকীবাবুকে বললে উনি ছাড়বেন না। ক্ল্যারিওনেট বাজানোর ‘ক্ষেপ’টা চলে যাবে। তাই সেদিনটা না-বলে ডুব মেরে দিলেন রাজেনদা।
পরদিন সকালেই উনি হাজির হলেন দেবকীবাবুর বাড়ি। স্বভাবতই দেবকীবাবু একটু বিরূপ হলেন। রাজেনদা বললেন—হঠাৎ শরীরটা এমন খারাপ হয়ে গেল। ডাক্তার ডাকতে হল।
দেবকীবাবু অর্থাৎ ডি. কে. বি.-র শরীরে ‘বাত’ ছিল। উনি হুইল চেয়ারও ব্যবহার করতেন। বললেন—সব কাজ ফেলে রেখে অপেক্ষা করলাম। জানেন তো আমার ‘বাত’ নিয়ে কাজ করার কত অসুবিধে।
রাজেনদা বিনীত হয়ে বললেন—স্যার বলছি তো আমার হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল। আমার কথা কেন বিশ্বাস করছেন না? ডি. কে. বি. আবার বললেন—একটা ডেট মিস করা দারুণ ঝঞ্ঝাট। আমার কত কাজ। তার ওপর আমার ‘বাত’। রাজেনদা বললেন—স্যার, মানছি অন্যায় হয়েছে। কী করব, শরীর খারাপ হল। ডি. কে. বি. রাজেনদাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন—সত্যি রাজেনবাবু, বুঝছেন না আমার ‘বাত’। রাজেনদা ডি. কে. বি.-র মুখে বোধহয় বারবার ‘বাত’ কথাটা শুনে অধৈর্য হয়ে গিয়েছিলেন। বলে ফেললেন—স্যার, আপনারই বাত’, আমার কি ‘বাত্ কে বাত্’? এ ঘটনাটা মনে পড়লে আজও ছেলে মানুষের মতো হেসে উঠি আমি। রাজেনদার সুরে অরবিন্দ মুখার্জীর (ঢুলুদা) ‘নতুন জীবন’ একটা স্মরণীয় ছবি। ‘নতুন জীবন’-এ চারটি গান ছিল। ঢুলুদা তিনটি গান আমায় লিখতে বললেন, আর একটি গান বললেন রবীন্দ্রসংগীত রাখবেন।
প্রযোজক কার্তিক বর্মণ নির্ভেজাল ব্যবসায়ী লোক। উনি আমায় বললেন—না, না, মায়ের ইচ্ছায় চারটে গানই তুমি লেখো। নইলে রেকর্ড বের হবে কী করে? একটা গান ‘কমন’ করে রাখলে রেকর্ড মার খায়। তোমরা চারটে গানই তৈরি করো। আমি ঢুলুকে অনুরোধ করব।
রাজেনদা আর আমি বানালাম চারটি গান। ও ছবির চারটি গান-ই সুপারহিট হয়েছিল। (১) সন্ধ্যার কণ্ঠে ‘আমি তোমারে ভালোবেসেছি। (২) হেমন্তদার কণ্ঠে—আমি গান শোনাবো একটি আশা নিয়ে (৩) হেমন্তদারই কণ্ঠে—লাজবতী নূপুরের রিনি ঝিনি ঝিনি। (৪) অর্থাৎ এর পরের গানটি ছিল রবীন্দ্রসংগীত। ঢুলুদা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘স্বপন পারের ডাক শুনেছি/ জেগে তাই তো ভাবি’ এ গানটি রাখবেন। গানটির সিচুয়েশন আমার জানা। রবীন্দ্রনাথের গানটি পাওয়ায় বুঝে নিতে একটুও অসুবিধে হল না ঠিক কী ধরনের গান ঢুলুদা চান।
আমি লিখে ফেললাম—এমন আমি ঘর বেঁধেছি/আহারে যার ঠিকানা নাই’।
পরিবেশক হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাগবাজারের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া আর গান শোনানোর ‘প্রোগ্রাম’ ঠিক করা ছিল।
রাজেনদার গলা ছোট থেকেই ভাল ছিল না। ভাঙা ভাঙা গলায় গান শোনালে কেউ কিছু বুঝতে পারবে না জেনেই রাজেনদার ছেলে প্রযোজকদের গান শোনাত। (প্রায় রাজেনদার মতোই ভাঙা গলা ছিল সুরশিল্পী অনিল বাগচীর। বিখ্যাত তবলিয়া রাধাকান্ত নন্দী হলেন সেই রাধাকান্ত —যাঁকে নিয়ে ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ছবিতে গান বানানো হয়েছিল—’শশীকান্ত, তুমিই দেখছি আসরটাকে করবে মাটি।’
‘রাধাকান্ত’কে আইন বাঁচিয়ে করা হয়েছিল ‘শশীকান্ত’। যা হোক, এই রাধাকান্ত নন্দী রাজেনদা আর অনিলদার কাল্পনিক ঝগড়া নিয়ে একটা হাসির নক্সা বানিয়ে ফেলেছিলেন। রাধাকান্তবাবু মুড পেলেই, অবশ্যই ওঁদের আড়ালে, এই নক্সাটি দুই সুরকারের গলা প্রায় হুবহু নকল ‘ করে আমাদের শোনাতেন। সে হেমন্তদা-মান্নাদা-শ্যামল-সন্ধ্যা হোক বা যেই হোক, যেই শুনত হেসে লুটিয়ে পড়ত। সত্যি অমন গুণী রসিক তবলিয়া, অমন আমুদে মানুষও আজ আমাদের মধ্যে নেই।)
যা হোক, আবার আগের কথায় আসি। নতুন জীবনের তিনটি গান শুনে সবাই তারিফ করলেন। ঢুলুদা বললেন—খুব ভাল। এই ‘খুব ভাল।’ কথাটা বলা ঢুলুদার চিরকালের অভ্যাস।
নতুন জীবনের চতুর্থ গানটি’স্বপন পারের ডাক শুনেছি’র জায়গায় আমার ‘এমন আমি ঘর বেঁধেছি/আহারে যার ঠিকানা নাই/স্বপনের সিঁড়ি দিয়ে/যেখানে পৌঁছে আমি যাই’—গানটি শুনেই উপস্থিত সকলে হই হই করে সাধুবাদ দিলেন। কার্তিকদা বোধহয় আগে থেকেই রেকর্ডের রয়্যালটির জন্যই গানটি বদলাতে চাইছেন—এটা বলে বুঝিয়ে ঢুলুদাকে রাজি করিয়ে রেখেছিলেন। তাই ঢুলুদা এই আধুনিক গানের কোনও প্রতিবাদ করলেন না—শুধু একটু গম্ভীর গলায় অভিমত দিলেন—’খুব ভাল’। ইন্ডিয়া ফিল্ম ল্যাবরেটরির স্কোরিং-এ শব্দযন্ত্রী শ্যামসুন্দর ঘোষের রেকর্ডিং-এ হেমন্তদা যখন ‘এমন আমি ঘর বেঁধেছি’ গানটি রেকর্ড করলেন সেদিনও ঢুলুদা রেকর্ডিং শুনে অমনি একটু গম্ভীর গলায় বলেছিলেন—খুব ভাল।
‘নতুন জীবন’ মুক্তির পর যখন ছবি এবং গান দুই-ই সুপারহিট হয়ে গেল তখন আবার শুনতে পেলাম ঢুলুদার কণ্ঠে সেই ‘খুব ভাল’। তবে এটা আর গাম্ভীর্যে নয়, উচ্ছ্বাসে ভরা।
রাজেনদার আর আমার যোগফলে পরবর্তী সুপারহিট ছবি ‘বালুচরী’। এ ছবিতেও চারটি গান ছিল এবং প্রত্যেকটিই সুপারহিট। ছবির পরিচালক অজিত গাঙ্গুলি তখন গানের সিচুয়েশনের দিকে খুবই নজর দিতেন। সে কারণেই ওঁর ছবির গান সহজেই জনপ্রিয় হতে পারত! এই ছবিতে ছিল হেমন্তদার (১) ‘আজও হৃদয় আমার পথ চেয়ে দিন গোনে’ (২) হেমন্তদারই ‘আজ হিসাব মিলাতে গিয়ে দেখি’ (৩) শ্যামল মিত্রের— ‘আমি তোমার কাছেই ফিরে আসবো’ (৪) সন্ধ্যার কণ্ঠে আরও কিছু রাত তুমি জাগতে যদি’।
অজিত গাঙ্গুলির আমার ওপর খুবই ভরসা বা বিশ্বাস ছিল। জানি না, আজও আছে কি না। উনি প্রথম তিনটি গান শুনেছিলেন। চতুর্থ গানটি তখনও বানানো হয়নি। তখন উনি অন্য ছবি নিয়ে ব্যস্ত। আমায় বললেন—এই তো সিচুয়েশন—জন্মদিনের পার্টির গান, ও আপনি বানিয়ে ফেলুন। আমি একেবারে সুরসুদ্ধ রেকর্ডিং-এ শুনব।
জন্মদিনের মামুলি সিচুয়েশনে তথাকথিত গান কোনওদিনই জনপ্রিয় হয় না। তা ছাড়া, আমি আজীবন বিশ্বাস করে এসেছি গানে কথায় বা সুরে কোনও চমক বা ‘নতুনত্ব’ না থাকলে কিছুতেই সেটা ‘হিট’ করে না। তাই যে গান বানালাম জানতাম সে গান শুনে ওঁই গাঁই করবেন অজিতবাবু। তবু আমি জেনেশুনে ভুল করব না বলেই রাজেনদার সুরের ওপর লিখে ফেললাম—’আরো কিছু রাত তুমি জাগতে যদি/ দেখতো গো সব তারা জ্বলছে/কী যে মিষ্টি কথা চাঁদ বলতে জানে/তুমি শুনতে পেলে না’–যা ভয় করছিলাম, ঠিক তাই-ই হল। অজিতবাবুরও প্রায় রাজেনদার মতোই কণ্ঠস্বর। উনি গলা চড়িয়ে বললেন—একী এ যে হোটেলের গান!
আমি অধোবদনে নিরুত্তর। রাজেনদা অল্প কথায় সারলেন।
আমি জানি না যা-বলবার পুলককে বলো।
এগিয়ে এলেন সেই কার্তিক বর্মণ। উনি এই ছবিরও প্রযোজক ছিলেন। বললেন অজিত, ওটা মানিয়ে নাও। গানটা সুপারহিট করবে। মায়ের ইচ্ছায় মোটা রয়্যালটি আসবে রেকর্ড থেকে।
তৎক্ষণাৎ অজিতবাবু কিন্তু মানলেন এ যুক্তি। বললেন—গানটা সত্যিই জমেছে। আমি সিচুয়েশনটা কিন্তু বদলে দেব।
কার্তিকদা হাসতে হাসতে বললেন—মায়ের ইচ্ছায় পুলক গানটা দারুণ লিখে ফেলেছে। সিচুয়েশন যা-খুশি বদলাও এ গানটা বদলানো চলবে না।
সম্পূর্ণ ভিন্ন সিচুয়েশনে অজিত গাঙ্গুলি গানটি লাগিয়েছিলেন। সুপারহিট হল— আরো কিছু রাত তুমি জাগতে যদি’ রাজেনদার আর আমার এরপরের উল্লেখযোগ্য ছবি ‘মুক্তিস্নান’। ‘মুক্তিস্নান’ ছবিতে কিন্তু বেশ একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল। এই ছবিরও প্রযোজক ছিলেন কার্তিক বর্মণ এবং পরিচালক ছিলেন অজিত গাঙ্গুলি। আমরা ছবির সিচুয়েশন পেয়ে গান বানালাম। ওঁরা বললেন গান শুনবেন ফিল্ম সার্ভিস-এর দোতলার ঘরে।
সেইমতো নির্দিষ্ট সময়ে আমরা টালিগঞ্জে হাজির হলাম। কিন্তু একটা গানও কার্তিকবাবু বা অজিতবাবু কারওর-ই পছন্দ হল না। কিন্তু আমি অনেক অভিজ্ঞতায় আজীবন দেখেছি—যখন কোনও গান একাধিক শ্রোতার অপছন্দ হয়—তখন সে গানে নিশ্চয়ই কোনও সত্যিকারের খামতি থাকে। যাঁরা গান বানান তাঁরা তো শিল্পী (গীতিকার বা সুরকার) তাঁরা আগে নিজের পছন্দ হয়েছে বলেই তো সে গান পরিচালক-প্রযোজককে শোনাতে আসেন। তাই চট করে কোনও গান বাতিল করে দিতে অস্বীকার করেন। আমি হেমন্তদাকে অনেকবার দেখেছি একটা গানে দু-তিনটি সুর করে রাখতেন। উনি বলতেন—প্রত্যেকটিই তো আমার সৃষ্টি। যেটা খুশি প্রযোজকরা পছন্দ করুন না—আমার তাতে কী এল গেল?
হেমন্তদার কাছে বহু শিক্ষা পেয়েছি।
এই সুন্দর শিক্ষাটাও মনেপ্রাণে রেখে দিয়েছি।
তাই রাজেনদার গান বাতিলের স্বাভাবিক অতৃপ্তিটা আমি সেই শিক্ষার স্পোর্টসম্যান স্পিরিট দিয়ে ধুয়ে মুছে দিয়ে বললাম—-রাজেনদা মন খারাপ করবেন না। আসুন নতুন গান তৈরি করি।
ওঁদের সামনেই তৎক্ষণাৎ লিখলাম— সুরের আসর থেকে মন নিয়ে এসেছি/ফুলের বাসর ঘরে বন্ধু’। রাজেনদাও তৎক্ষণাৎ সুর করে ফেললেন। জানতাম এ গান হেমন্তদার কণ্ঠে ‘সুপারহিট’ হবে। হলও তাই।
সেদিন খুব ‘মুড’ পেয়ে গিয়েছিলাম আমরা। ওখানেই থেমে থাকিনি। লিখে ফেলেছিলাম ‘দরদিয়া গো, যে তোমায় এতো জানায় সে-কেন জানায় না/কাউকে মন দিয়ে মন ফিরিয়ে নেওয়া মানায় না।’
গানটা অপূর্ব গেয়েছিল সন্ধ্যা।
মুক্তিস্নানের গান সুপারহিট হওয়া সত্ত্বেও অজ্ঞাত কারণে কার্তিক বর্মণ ওঁর পরের ছবিতে সুধীন দাশগুপ্তকে নিলেন, আমাকে অবশ্য গীতিকার রেখেছিলেন। কিন্তু রাজেনদা মুখ ফুটে কাউকে কিছু না বললেও মনে মনে ভেঙে পড়েছিলেন। নিজেকে গুটিয়ে নিলেন তারপর থেকেই। এই হল স্রষ্টা শিল্পীর ভাগ্য! কখন যে আলো কখন অন্ধকার কেই-ই তা বলতে পারে না।
আগেই বলেছি—সময়টাকে আমার স্মৃতি ঠিকমতো পরপর সাজাতে পারে না। এবার তাই বলছি—সেদিনের কথা যেদিন সকালে উত্তম-জায়া গৌরী আমায় ফোন করল—মামা, এক্ষুনি ভবানীপুরে চলে এসো। ও (উত্তম) বলল—বিধায়কদা (ভট্টচার্য) ভ্রান্তিবিলাসের স্ক্রিপ্ট শোনাতে আসছেন। তুমি গানের সিচুয়েশনগুলো শুনে নেবে। শ্যামলদাও (মিত্র) আসছেন গান নিয়েও আলোচনা হবে। আর দুপুরে এখানে ইলিশ মাছ আর খিচুড়ি খেয়ে যাবে।