৭৫
নতুন নতুন সুরশিল্পী আমার জীবনে অনেক এসেছে। তাদের নাম বলে শেষ করা যাবে না। অরূপ-প্রণয়ের পর নতুন যারা আমায় বিশেষ নাড়া দিয়েছে তাদের মধ্যে মনে আসছে শুভ নন্দী আর আবীর মুখার্জির নাম। শুভ নন্দীর সুরে ভারতীয় রাগ-রাগিণীর প্রয়োগ আমায় খুবই আকৃষ্ট করে। মনে আসছে দেবজিৎ আর দেবজিৎ মিশ্রের নাম। অশোক ভদ্র, গৌতম বসু, অনুপম দত্তের সঙ্গেও আমি বেশ কিছু ছবির গান লিখেছি। জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সুরেও আমি অনেক ভাল গান লেখার সুযোগ পেয়েছি ও তার সদ্ব্যবহার করেছি। এখনই আর একজনের নাম মনে আসছে তিনি নবীন চট্টোপাধ্যায়। আমার লেখা কবিতা কৃষ্ণমূর্তির ‘পূজারিণী’ অ্যালবামে তিনি দারুণ সুর করেছেন। আমি বারবার শুনি—’আমার মনটা শুধুই ভরে থাকুক /আঁচল থাকুক শূন্য ফাঁকা/আমি পূজারিণী সাজবো না মার/প্রণামীতে লুটতে টাকা!’ পরে যাদের নাম মনে আসবে আবার জানাব।
বেতারের বিজ্ঞাপনের ‘জিংগিল’ গানে যে-কণ্ঠটি তখন খুব শোনা যেত তার নাম শ্রাবন্তী মজুমদার। শ্রাবন্তী ওই কর্নেল বোসের ‘লিভিং সাউন্ডে’ আমায় ধরে নিয়ে যায়। তখন বিবিধ ভারতীতে দুপুরের ‘আলিবাবা’ খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। লিখতাম আমি। বলত কাজী সব্যসাচী আর শ্রাবন্তী। ওখানের বিজ্ঞাপনে আমার সুপার হিট নাম্বারটি ‘সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম/বোরোলিন’ সুর ভি বালসারার। আর তারপরই উল্লেখ্য ‘মাথার ঘনচুল যখন মরুভূমি হয়ে যায়’, সুর সুধীন দাশগুপ্তের।
শ্রাবন্তীর জীবনের পঁচানব্বই ভাগ বাংলা গান আমার লেখা। বালসারার সুরে না এখন নয়’, ‘মধুপুরে পাশের বাড়িতে’, ‘আমার চার বছরের বড়ো দিদি’, ‘একুশটা মুরগিতে মিঠুদের গোয়ালে’। নচিকেতা ঘোষের সুরে ‘কপালে আগুন জ্বলে না’, ‘আমি একটা ছোট্ট বাগান করেছি’ ইত্যাদি বহু গান আছে যা নিয়ে অভিনন্দনও পেয়েছি, আবার পেয়েছি বহু বিরূপ সমালোচনাও।
শ্রাবন্তী কিন্তু সব সময়েই নতুন নতুন বিষয়বস্তুর গান করতে চাইত। এমনকী বিশ্ববন্দিতা গায়িকা ‘ম্যাডোনা’র গাওয়া অনেক গানও বাংলা ভাষান্তর করে ‘হ্যালো মাই লাভ’ নামের বাংলা অ্যালবামে আমি এইচ. এম. ভি.-তে লিখেছি ওর জন্য। এখন ও লন্ডনে থাকে। মাঝে মাঝে হঠাৎ উড়ে আসে। এখনও আমাকে নিয়মিত লিখতে হয় ওর জন্য বহু পরীক্ষামূলক গান। বিখ্যাত অনু মালিকের সুরে আমি ওর জন্য বাংলা গান লিখেছি, আবার মহেন্দ্র কাপুর আর ওর কণ্ঠের দ্বৈত গানও লিখেছি। সত্যিকারের এক ব্যতিক্রমী শিল্পী শ্রাবন্তী।
তরুণ মজুমদারের ‘স্মৃতিটুকু থাক’ আমার দারুণ ভাল লেগেছিল। মনে হয়েছিল এঁরা ক্রমশ অনেক বড় হবেন। তখন ওঁদের নাম ছিল এক গোষ্ঠীবদ্ধ পরিচালকের নাম— ‘যাত্রিক’। ছবিটি দেখেই মনে হয়েছিল—-বাংলায় আর একজন সত্যিকারের কৃতী পরিচালক এলেন। কতকগুলি ভাল ছবির পর তরুণবাবু আলাদা হয়ে নিজের নামেই করলেন ‘পলাতক’। মুগ্ধ হয়ে ছিলাম ছবিটি দেখে। হেমন্তদার কাছে জানলাম, তরুণবাবুও সত্যজিৎ রায়, রাজেন তরফদারের মতো প্রথমে বিজ্ঞাপনে কাজ করতেন।
পরবর্তীকালে জেনেছিলাম, দেবকী বসুর ‘পথিক’ ছবির সংবাদপত্রে ওই বিখ্যাত চলমান বিজ্ঞাপনটি ওঁরই করা। প্রথম দিন, চার দিকের বর্ডারের মধ্যে কিছুই লেখা আঁকা নেই, শুধুই সাদা কাগজ। পরদিন একটি পায়ের সামনের আঙুলের ছাপের একটু ছবি। পরদিন আর একটু। এমনি করে কয়েকটা দিন ধরে একটি পদচিহ্নের ছবি সম্পূর্ণ প্রকাশ হয়ে আবার সামনের দিকে দিনে দিনে এগিয়ে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া। সিনেমার এত অভিনব বিজ্ঞাপন আমি এজীবনে খুবই কম দেখেছি। পরিচালক হয়ে কত নতুন শিল্পীকে তিনি এনেছেন। অনুপকুমারকে বানিয়েছেন ‘সিঙ্গিং হিরো’, মৌসুমিকে এনেছেন। মহুয়াকে এনেছেন, তাপস পালকে এনেছেন, দেবশ্রীকে পূর্ণতা দিয়েছেন—এগুলো তো সবাই জানে। কে ওঁর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন মনে নেই।
আমি ওঁর ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ ছবিটি দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। একদিন স্টুডিয়োতে বলেই ফেললাম-এবার আপনার ছবিতে গান লিখব। হঠাৎ আমার একথা শুনে তরুণবাবু গলা নামিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন—আপনি কেন বলবেন? সময় হলে আমিই আপনাকে বলব। এমন উত্তর শুনলে স্বাভাবিক ভাবেই কারও আর কিছু করার থাকে না। ব্যাপারটা সময়ের ওপরই ছেড়ে দিলাম এবং ভুলেও গেলাম। হঠাৎ একদিন হেমন্তদার ফোন পেলাম, ‘পুলক’ তনুবাবু (তরুণবাবুর ডাক নাম) তোমায় খুঁজছেন। ওঁর সঙ্গে দেখা করো। কাল বিলম্ব না করে দেখা করলাম। পেলাম ‘ফুলেশ্বরী’র গানের সিচুয়েশন।
প্রথমেই বললেন, ঝুমুর দলের মেয়ের গানটি লিখতে এবং আর একটি ছেলের গানে তার জবাব লিখতে।
হেমন্তদা আমার দিকে চেয়ে হাসলেন, বুঝেছি, তুমি কী বলবে? না, তনুবাবু সুরের ওপর গান লেখা চান না। তুমি ওঁকে লেখা গান দেবে। তারপর আমি তাতে সুর বসাব। ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে লিখে ফেললাম—’শুনুন শুনুন বাবুমশাই/আজকে আমি গল্প শোনাই’ এবং ‘যেও না দাঁড়াও বন্ধু/আরো বল কুকথা।’
হেমন্তদা অপূর্ব সুর করে যেদিন গান দুটি শোনালেন, বিশেষ করে ওঁর অমৃত কণ্ঠের জন্য নির্দিষ্ট ‘যেওনা দাঁড়াও বন্ধু’—শুনে আমি চুপচাপ স্থাণুবৎ বেশ কিছুক্ষণ বসে ছিলাম। তারপর দিনের পর দিন চলল তনুবাবুর সঙ্গে ‘ফুলেশ্বরী’র অন্যান্য গান লেখা এবং তা কীভাবে কতটা ভাল হয় তাই নিয়ে আলাপ আলোচনা।
একদিন তনুবাবু বললেন, ‘ফুলেশ্বরী, ফুলেশ্বরী ফুলের মতো নাম’ গানটি আমাকে লিখতে। বলেই বললেন—গানটি মুকুলবাবু লিখেছেন। গানটি ভাল লেখা। কিন্তু আমার ছবির সিচুয়েশনের সঙ্গে ঠিক যাচ্ছে না। আপনি নতুন করে লিখুন। স্বভাবতই আমি ইতস্তত করতে লাগলাম। তনুবাবু আশ্বাস দিলেন, না, না, আপনি দ্বিধা করবেন না। মুকুলবাবু খুবই উদারচেতা মানুষ। ওঁকে আমি বলে নেব।
তনুবাবুর মনের যা ভাবনা ছিল—এই গানে কী কী ছবি উনি দেখাবেন—সেই সব ‘শট’ অনুযায়ী আমি লিখতে লাগলাম গান। স্বভাবতই মুকুলবাবুর কথা বদলে গেল। কিন্তু ওঁর লেখা একটা অপূর্ব গানের পঙক্তি আমার বুকের মধ্যে কী যেন আলোড়ন তুলতে লাগল। কিছুতেই ও কথাটির কোনও বিকল্প আমি লিখতে পারলাম না। পঙক্তিটি ছিল—’অনেক সুখে আজকে আমার চোখে এল জল’। সোজাসুজি তনুবাবুকে বললাম, ওঁর লেখার কিছু অংশ আমি রেখে দিচ্ছি। আপনি এটা মেনে নিন। তনুবাবু হাসলেন—বেশ তাই হবে। আমি আবার বললাম, আমার আর একটি শর্ত আছে, গানটিতে দুজন গীতিকারের নাম দিতে হবে। আর আমায় দেবেন গোটা গানের অর্ধেক পারিশ্রমিক। আজকে যাঁরা ডুয়েট গান করেন, তাঁরা সবাই কিন্তু গোটা গানেরই পারিশ্রমিক নেন, কেউই অর্ধেক নেন না। আমার এই শর্তকে নিশ্চয়ই তাঁরা পাগলামি বলবেন।
‘সংসার সীমান্তে’ ছবিতে তনুবাবু আমায় সিচুয়েশন দিলেন—নদীর ওপর গান। কিন্তু গানটি পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় করতে হবে। তা হলেই নৌকার গান তৎক্ষণাৎ ‘আইডেন্টিফাইড’ হবে। ও ছবিতে একটি গান ছিল, চোর জামাইকে নিয়ে পতিতাপল্লীর উৎসব। পতিতারা স্থানীয় এবং পূর্বাঞ্চলীয় ভাষায় গাইবেন। সেটা আমি প্রচলিত মুখড়া দিয়ে ‘ও সাধের জামাইগো/তুমি কেন নাগর হইলে না’ লিখলাম। রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে গানটির রিহার্সাল শুনতে শুনতে তনুবাবু শুধু আমার কাছ থেকে গানের কাগজটা চেয়ে নিয়ে, আমার গানেরই ‘নাগর’ শব্দটি কেটে নিঃশব্দে লিখে দিলেন ‘ভাতার’। আমিও কাগজটি নিঃশব্দেই হেমন্তদাকে দিলাম। হেমন্তদা পড়ে শুধু একটু মুচকি হাসলেন। যাক, ওটা তো ম্যানেজ হল, অন্য গান নিয়ে কী করি? বিশেষ করে ওই নৌকার — সুজন কাণ্ডারী?’ আমি যে পূর্ববঙ্গীয় কথ্য ভাষা মোটেই জানি না। সারারাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে সকাল হতেই বুদ্ধি এল। আরে, এ আর বেশি শক্ত কাজ কী? কলকাতার কথ্যভাষাতেই গানটা লিখি, তারপর তথাকথিত বাঙাল ভাষা জানা কাউকে দিয়ে সেটা সাজিয়ে নিলেই তো হবে। চলে গেলাম লোকগীতি গায়ক দীনেন চৌধুরীর ডেরায়। দীনেন হাসিমুখে সাহায্য করতে লাগল। লিখে ফেললাম—’সুজন কাণ্ডারী/আমার এ নি নিয়া দিবা সাত সাগরে পাড়ি?’ হেমন্তদা তাঁর সেই মায়াভরা কণ্ঠে আর সুরে গেয়ে দিলেন গানটি।
তরুণবাবুর ছবির গানের সময় হেমন্তদা বলতেন,—পুলক, এই কটাদিন অন্য কোনও কাজ নিয়ো না। আমিও অন্য কারও কাজ কখনও নিই না। হেমন্তদা তনুবাবুর ছবিতে সবচেয়ে বেশি মনোনিবেশ করতেন যেহেতু তনুবাবু ওঁর ছবিতে গানকে একটা অন্যতম বিষয় বলে মনে করেন। তরুণ মজুমদারের ছবির গান ভাল হওয়ার প্রধান কারণ উনি গানের সিচুয়েশনের ওপর ভীষণ নজর দেন এবং কী ধরনের গানের সুর হবে তাও মনে মনে চিন্তা করে রাখেন। আমরা যখন কাজ করতাম, উনি মাঝে মাঝে গেয়ে উঠে ওঁর মনের চাহিদাটি আমাদের জানিয়ে দিতেন।
ঠিক এইভাবে গান গেয়ে গান বোঝানো আরও কিছু পরিচালককে আমি পেয়েছি। তাঁদের আর একজন আর এক অসাধারণ কৃতী মানুষ—তপন সিংহ। কে এল সায়গলের মতো দরাজ ‘বেস ভয়েসে’ ওঁকেও দেখেছি, যতদিন উনি নিজেকে সংগীত পরিচালক হিসেবে প্রকাশ করেননি ততদিন গানের সিটিঙে সংগীত পরিচালকের সঙ্গে গান গাইতে। বেশ সুরেলা কণ্ঠস্বরই তখন ছিল তাঁর।
একটা ঘটনা মনে পড়ছে। ওঁর সংগীতের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বলাই সেনের ‘কেদার রাজা’ ছবিতে আমার লেখা হেমন্তদার গাওয়া—দিয়ে গেছি সবি/তবু দিলে ফাঁকি’ গানটি সায়গল সাহেবের ঢঙে ওঁর কণ্ঠে শুনে আমি ওঁকে অনুরোধ করে ফেলেছিলাম, আপনিই গেয়ে দিন। কিন্তু উনি হেসে উঠেছিলেন, আমার অনুরোধ রাখেননি।
একদিন কথায় কথায় তপনবাবু আমায় বলে ছিলেন— জানেন পুলকবাবু, প্রথম জীবনে আমি তো শব্দযন্ত্রী ছিলাম। তাই, শুধু গান নয় গানের যন্ত্রানুষঙ্গও আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনতে শিখেছিলাম। আজও নিউ থিয়েটার্সের প্রচুর গানের যন্ত্রানুষঙ্গও আমার কণ্ঠস্থ।
আগেই বলেছি তনুবাবুর ছবিতে আগে কথা পরে সুর এটাই সর্বদা প্রযোজ্য হয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রমও আছে। ‘ভালবাসা ভালবাসা’ ছবিটিতে ‘খোঁপার ওই গোলাপ দিয়ে’, ‘এই ছন্দ, এই আনন্দ’ ইত্যাদি গানগুলো এমনকী ইংরেজি গানটিও আমার লেখার ওপরই সুর করেছিলেন হেমন্তদা, কিন্তু ‘যতো ভাবনা ছিলো/যতো স্বপ্ন ছিলো’ গানটি আমি সুরের ওপর লিখেছিলাম। ওই সিচুয়েশনে যে গানই লিখছিলাম তনুবাবুর পছন্দ হচ্ছিল না। বুঝলাম—উনি যে কোনও কারণেই হোক, আমার কথার ভেতরকার সুরটা অনুধাবন করতে পারছেন না। আমি ওঁর, অনুমতি নিয়ে এই একটা গান সুরের ওপর লিখেছিলাম। বলেছিলাম—যদি অপছন্দ হয় আবার নতুন করে লিখব। হেমন্তদার সুরের ওপর লেখা ওই গানটি হেমন্তদার গলায় শুনেই তনুবাবু খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে উঠেছিলেন, আমি ঠিক এটাই চাইছিলাম। একেই বলে ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং। একজন পরিচালক ও সুরকার গীতিকারের মানসিক মেলবন্ধন না থাকলে আমার ধারণা, ভাল গান জন্মলাভ করতে পারে না।
তনুবাবু আমাকে গানের সিচুয়েশন দিতেন সমস্ত খুঁটিনাটি লিখে। প্রায় ছবি এঁকে এঁকে। ‘পরশমণি’ ছবিতে সেইমতোই আমি লিখেছিলাম—যায় যে বেলা যায় এবার আমি যাই/জীবন মরণ দিয়ে আঁকা এই ছবিটি ছাড়া/আমার নেবার কিছুই নাই।’ গানটি গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর।
হেমন্তদার সুরে এটাই ওঁর জীবনের শেষ গান। তরুণ মজুমদারের ছবি মানেই হেমন্তদার সুর। হেমন্তদার অবর্তমানে ‘সজনী গো সজনী’ ছবির গানের কাজের সময় দিশাহারা হয়ে তনুবাবু হাসতে হাসতে বলে ফেলেছিলেন—চলুন, আমি আপনি ওপরে গিয়ে হেমন্তবাবুকে দিয়ে গানগুলো করে নিয়ে আসি। যদিও ওটা হাসিরই কথা, কিন্তু আমি ওই হাসির আড়ালে অন্য কিছু দেখেছিলাম।
তনুবাবু যখনই চিত্রনাট্য শোনান ইউনিটের প্রত্যেককেই ডাকেন। ‘দাদার কীর্তি’-র সময়ও যথারীতি তাই হয়েছিল। চিত্রনাট্য শোনার পর সবাই উচ্ছ্বসিত হয়ে চলে গেলেন। কিন্তু আমি বসে রইলাম। তনুবাবু হঠাৎ আমাকে লক্ষ করে বললেন—কী ব্যাপার, পুলকবাবু কিছু বলবেন? বললাম, হ্যাঁ। উনি একটু সময় নিয়ে বাইরে ঘুরে এসে আবার ঘরে ঢুকে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন –বলুন। বললাম—দাদার কীর্তির গানের সিচুয়েশন সম্বন্ধে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু সবচেয়ে ভাল সিচুয়েশন রবীন্দ্রসংগীতের। তনুবাবু হেসে বললেন—বেশ তো। অন্যান্য সব গানগুলোই তো আপনি লিখছেন। ব্রহ্মসংগীতটাও লিখুন। সবাই জানেন আমি লিখেছিলাম—’এসো প্রাণ ভরণ দৈন্য হরণ হে/মহা বিশ্বভূপ পরম শরণ হে।’ যে গানটি এক প্রাচীনা ‘সেলিব্রিটি’ টি ভি-র এক বিশেষ অনুষ্ঠানে অনুরুদ্ধ হয়ে, রবীন্দ্রসংগীত বলে গলা কাঁপিয়ে দু লাইন ভুল করে গেয়েছিলেন।
যা হোক, যেখানটায় ‘চরণ ধরিতে দিওগো আমারে’ গানটি ছিল, সেই অসাধারণ সিচুয়েশনটির ব্যাপারে কথা তুলতেই উনি বললেন—ওখানটায় রবীন্দ্রনাথের গান দিয়েছি জেনারেশান বোঝাতে। অর্থাৎ মা যে গানটা গাইতেন, ছেলেও সে গানটা গাইবে। আপনার গানে জেনারেশান বোঝা যাবে কী করে? বলেছিলাম—ছেলে চরণ ধরিতে দিওগো আমারে গাইলেই এটা যে ওর মা-ও গাইত, প্রমাণ হবে কী করে? প্রকৃত শিল্প-স্রষ্টা তরুণ মজুমদার আমার এ-কথায় কিছুক্ষণ নীরব থেকে কী যেন ভাবতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ বললেন—পিয়ানোটা একটু বাজিয়ে নিয়ে ছেলে যদি বলে—‘আমার মা গাইতেন, তা হলে কেমন হয়? আমার মুখ থেকে শুধু বেরিয়ে গেল—অপূর্ব।
ভালোবাসা ভালোবাসা’ ছবির রেকর্ডিং-এর সময় আর একটা স্মরণীয় ঘটনা ঘটেছিল। ও ছবির পুরুষ কণ্ঠের সব কটি গান-ই হেমন্তদা স্বকণ্ঠে রেকর্ড করেছিলেন। শেষ রেকর্ডিং-এর পর হেমন্তদার সঙ্গে আমি যখন চলে যাচ্ছি— তনুবাবু পিছু ডাকলেন—পুলকবাবু, খুব তাড়া আছে কি? আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে।
হেমন্তদা চলে গেলেন। অগত্যা আমি রয়ে গেলাম। তনুবাবু আমায় নিরিবিলিতে বললেন-হেমন্তবাবু যদিও অসাধারণ গেয়েছেন, তবু আমার অল্পবয়সি নায়কের কণ্ঠে এ গলা ঠিক মানাবে না। আজকাল তো অনেক হেমন্ত কণ্ঠ বেরিয়েছে, এদের মধ্যে তরুণ কণ্ঠের কাউকে গাওয়ালে কেমন হয়? ধন্ধে পড়লাম। হেমন্তদার গাওয়া গান অন্য কেউ ডাবিং করবেন, ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল। তনুবাবু বললেন—জানি ব্যাপারটা খুবই ডেলিকেট, কিন্তু ছবির স্বার্থে আপনার অভিমত বলুন? বললাম—এই মুহূর্তে দুজনের নাম মনে আসছে। হাওড়ার নির্মল আর বিরাটির শিবাজী চট্টোপাধ্যায়। ইতিমধ্যেই শিবাজী একটি ছবিতে আমার গান গেয়েছে, ভালই গেয়েছে। তনুবাবু বললেন-আপনার কথা মতো ও যদি ভালই গেয়ে থাকে, তা হলে যদি কিছু মনে না করেন, হেমন্তবাবুকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়ে শিবাজীকে ওঁর কাছে গান তোলাতে পাঠিয়ে দিন। হেমন্তবাবু কিছুদিন ধরে ওঁকে রিহার্সাল করিয়ে ঠিক ওঁরই মতো করে তৈরি করুন, তারপর আমরা ‘ডাবিং’ করব। মনে আছে, সব শুনে আমি শুধু বলেছিলাম—মাফ করবেন। আমি হেমন্তদাকে বলতে পারব না। আপনাকে আমি শিবাজীর টেলিফোন নম্বর দিয়ে দিচ্ছি—তৎক্ষণাৎ আমাকে থামিয়ে দিয়ে তনুবাবু বলেছিলেন—সরি। আমার ভুল হয়েছিল। আমিই ওঁকে বলব। মহৎ শিল্পের স্বার্থে প্রকৃত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, হাসিমুখে নিজের গাওয়া গানগুলোকে আবার অতি যত্নে অনেক অধ্যবসায়ে শিবাজি চট্টোপাধ্যায়কে শিখিয়ে পড়িয়ে গাইয়ে ছিলেন। গানের জগতে এমন প্রাণ অনুদানের দৃষ্টান্ত একমাত্র মান্না দে-র―তাঁর নিজের গাওয়ার জন্য তৈরি করা রেকর্ডিং ডেট নেওয়া আমার লেখা গান—আমার বলার কিছু ছিলো না’ আমারই অনুরোধে হৈমন্তী শুক্লাকে, নিঃস্বার্থে অনুদান দেওয়ার ঘটনাটি ছাড়া, বোধ হয় আর কেউ কোথাও খুঁজে পাবেন না। এভাবেই শিবাজীর অনুপ্রবেশ ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’য়। এই আগমনটি হেমন্তদার বহুকথিত সবার উপরে ভাগ্য—এই সত্যটাই প্রমাণ করে। আমার এও মনে হয়, হেমন্তদার মতো গান শেখানোর যত্ন অন্য কোনও সুরকারের কাছ থেকে আর কখনও পায়নি বলেই শিবাজীও উত্তর জীবনে বহু ছবিতে গান গেয়েও, কোনও গানই ভালোবাসা ভালোবাসা’র পর্যায়ে আনতে পারেনি।
যাতে ওঁর ছবির গানের মর্মে প্রবেশ করতে পারি সেইজন্য প্রতিটি ছবিরই পুরো চিত্রনাট্য আমাকে আর হেমন্তদাকে আবার আলাদা করে শুনিয়েছেন তনুবাবু। বিশেষ করে ‘গণদেবতা’ ছবির হেমন্তদা ও আরতির গাওয়া ওলো সই দেখে যারে দেখে যা’ মান্নাদা’র গাওয়া ‘লাথি খেয়ে আর কতো কাল মরবি তোরা?’ এবং শিপ্রা বসুর গাওয়া— ‘ভাল ছিল শিশুবেলা/যৈবন ক্যানে আনিলে’ গানগুলির সময়। অক্লান্তভাবে বারবার সিচুয়েশন বুঝিয়েছেন তনুবাবু। শহর থেকে দুরে’, ‘কথা ছিল’, ‘খেলার পুতুল’ অভিমানে অনুরাগে’ (মুক্তিলাভ করেনি) এমনকী আমার মাত্র দুখানি গান আর বাকি সব রবীন্দ্রসংগীতের ছবি ‘পথ ভোলা’তেও তাই। এঁদের মতো আরও কিছু পরিচালককে যদি পরবর্তীকালে বাংলা ছবি পেত, তা হলে তার গান দিন দিনে আরও উন্নততর হতে পারত।
এখন হেমন্তদা নেই। ‘সজনী গো সজনী’র চিত্রনাট্য আমায় আলাদা ভাবে শুনিয়ে তনুবাবু হঠাৎ বললেন—আমি ভাবছি এ ছবিতে পাঁচজন সংগীতপরিচালক নেব— কেমন হয় ব্যাপারটা? বললাম, হিট ছবি ‘অসমাপ্ত’ এবং পরিচালক অজিত গাঙ্গুলির কয়েকটি ছবিতে এর নজির আছে। আপত্তি কীসের?
পাঁচজন সুরকারের একজন হল কানু ভট্টাচার্য। ওর সুরে অনেক ছবিতে আমি গান লিখেছি। তাদের মধ্যে উল্লেখ্য হল ‘বন্দিনী’ ‘মনে মনে’ ‘পুনর্মিলন’, ‘দোলনচাঁপা’ ও ‘কুচবরণ কন্যা’। ‘দোলনচাঁপা’ ছবির কিশোরদার গাওয়া ‘আমারও তো সাধ ছিলো’ ও অনুপ জালোটার গাওয়া ‘গোপালকে দড়ি বেঁধে রাখিস নে’ খুবই জনপ্ৰিয়।
একদিন আমার পাড়ার (সালকিয়ার) বাঁধাঘাট থেকে ওপারে আহিরিটোলা যাবার জন্য গঙ্গার বুকে ফেরি স্টিমারে যাচ্ছি—স্টিমার ছাড়তেই একজন ভিখারি গান ধরল— ‘গোপালকে দড়ি বেঁধে রাখিস নে’, গান শেষে সবাইয়ের কাছে পয়সা নিয়ে সে আমার কাছে আমার লেখা গানের জন্যও পয়সা চাইল। এক মুহূর্ত নিশ্চুপ থেকে অনেক আত্মতৃপ্তিতেই আমিও ওকে পয়সা দিলাম। যা হোক, বেশ কিছু ছবিতে কাজ করে হঠাৎ মুম্বইবাসী হয়ে গেল কানু ভট্টাচার্য।
এখন অবধি আমাদের শেষ কাজ ডি.এস. সুলতানিয়ার সদ্য সমাপ্ত ছবিটি। কানু ভট্টাচার্য বাংলা ছবি ছেড়ে আজও মুম্বই-তে। ওখানে আমি ওর সাফল্য কামনা করি।
বাবুল বসু ছিল এখানে বাদ্যযন্ত্রী। হঠাৎ ও-ও একদিন চলে গেল মুম্বই-তে। কাজ নিল গানের সুর করা। কারণ অকারণের আলো-আঁধারের জীবন বাবুলের। তবুও হার মানেনি। আজও অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে। ওরই সুরে আমি লিখেছিলাম কুমার শানুর ‘অমরশিল্পী তুমি কিশোর কুমার’। ‘আশিকী’ ছবির অনেক আগেই সে গান মুক্তিলাভ করে। প্রথম জন্ম হয় কুমার শানুর। বাবুলের সুরে আমি বহু বাংলা গান লিখেছি, আজও লিখে চলেছি। শানু, অলকা, দেবাশীষ, উদিত নারায়ণ, দীপা নারায়ণ, অভিজিৎ, কল্লোল ব্যানার্জী ইত্যাদি অনেকেরই গাওয়া আমাদের বাংলা গান খুবই লোকপ্ৰিয়
মিঠুন চক্রবর্তীর বাংলা আধুনিক গানের ক্যাসেটের সব গানই বাবুল বসুর সুর করা। তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখ্য ‘কলকাতার রকে আড্ডা মেরেছি’ এবং ‘শুধু একটি শহীদ ক্ষুদিরাম’ ও ‘বাঙালির গড়া এই বাংলা/আজ কেন হয়ে গেল কাংলা?’
‘অমর শিল্পী তুমি কিশোরকুমার’-এর মতো বাবুল আর আমার ‘মন মানে না’ ছবির গানও গোল্ড ডিস্ক জয় করেছে। বাবুল আর আমার বেশ কিছু বাংলা ছবি রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখ্য চিরঞ্জিৎ পরিচালিত ‘মায়ের দুধের দাম’। স্বপন সাহার পরিচালনায় ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’। তুষার মজুমদারের ‘মধুর মিলন’ ও অমিতাভ (গুণ) পরিচালিত দেবশ্রী রায়ের ছবি ‘দেবাঞ্জলি’, আমার চিত্রনাট্যের, হরনাথ চক্রবর্তীর পরিচালনায় দু-বাংলার যৌথ প্রযোজনায় ‘রাজা-রাণী-বাদশা’। সুখের বিষয়, বাবুল এখন মুম্বই-এর নামী প্রযোজক সেলিমের (রাণী অভিনীত) হিন্দি ছবিতে সুর করছে।
দিল্লির অরূপ আর মুম্বইয়ের প্রণয় দুজনেই এখন মুম্বই-তে। শানু ওদের আবিষ্কার করে, টি সিরিজে প্রথম আমার গান অনুরাধা পড়োয়ালের সঙ্গে পুজোয় রেকর্ড করে। শচীন দেববর্মণের মুম্বই-এর খুবই প্রিয় তবলিয়া সুদর্শন অধিকারীর পুত্র প্রণয়। অরূপ-প্রণয় গোষ্ঠীর সঙ্গে আমি বেশ কিছু আধুনিক গান এবং প্রভাত রায়ের ‘দুরন্তপ্রেম’ ছবির গান করেছি। তবে ওদের সঙ্গে আমার সবচেয়ে সফল কাজ কুমার শানুর তিনটি ক্যাসেট ‘সুরের রজনীগন্ধা’, ‘প্রিয়তমা মনে রেখো’ ও ‘সোনার মেয়ে’।
ওরা সুরের ওপর গান লেখানোরই পক্ষপাতী। শানুর গানে প্রতিবারই শানু নিজেই সিটিং করেছে। ও-ই গেয়ে গেছে আমি লিখে গেছি। সেইজন্য আমার লিখতে খুবই সুবিধা হয়েছে। প্রিয়তমা মনে রেখো’ও এইভাবে লিখেছি।
দেশ বিদেশের গান শোনা আমার একটা হবি। একটা বিদেশি গান শুনেছিলাম ‘কালিফোর্নিয়া ও মাই ডার্লিং’। গানটি ভীষণ ভাল লেগেছিল কী ভাবে ওই গানের বিষয়টা অবচেতন মনে রয়ে গিয়েছিল জানি না। আবেগের জোয়ারে অরূপ-প্রণয়ের-দেওয়া সুরের ওপর লিখে ফেলেছিলাম অনেক দেখেছি তবু/এ-সবুজ বাংলাকে/সাধ হয় দেখি যে আবার/তোমার মতন এতো/অপরূপ সুন্দর/কাউকে তো দেখিনিগো আর/প্রিয়তমা মনে রেখো/অনুপমা মনে রেখো।’ শানুর বাড়িতে ওর স্ত্রী কালী এবং অরূপ-প্রণয় সবাই উচ্ছ্বসিত হল গান শুনে। আমি কলকাতায় ফিরে এলাম। মুম্বই থেকে ফোন এল দারুণ রেকর্ডিং হয়েছে মনটা খুবই খুশি-খুশি। মান্নাদার একটা গান লিখেছিলাম—’মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যায়/মনে হয়।’ সত্যিই একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। আর মনে হল—দেশকে সবাই ‘মা’ বলেছেন। বাংলাকে নিয়ে যত গান শুনেছি সবই ‘ও আমার বাংলা মাগো’ ইত্যাদি। কিন্তু আমি আমার অবচেতন মনের ‘কালিফোর্নিয়া/ও মাই ডার্লিং’-এর প্রভাবে লিখে ফেললাম—’প্রিয়তমা মনে রেখো’। জানি না এ গানের কী হাল হবে। কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই, এইচ.এম.ভি-তে আমার সই সাবুদ হয়ে গেছে। গান প্রকাশিত হতে মাত্র কদিন দেরি। ওই মাত্র কদিন কীভাবে আমি কাটিয়েছিলাম বলে বোঝাতে পারব না। কিন্তু জানি না, আমার রাশিচক্রে কোন গ্রহ কোথায় ছিল—কোন নক্ষত্রের কী আলোকপাত হয়েছিল। ক্যাসেট রিলিজ হওয়ার পর দেখলাম যে ব্যাপারটায় আমি ভয় পাচ্ছিলাম, সেটাই ও গানটার প্রকৃত ‘প্লাস-পয়েন্ট’ হয়ে গেল। সুপার-ডুপার হিট হয়ে গেল আমার বাংলাদেশকে নিয়ে লেখা—’প্রিয়তমা মনে রেখো। ক্যাসেটটি আমায় উপহার দিল এইচ. এম. ভি.-র সর্বভারতীয় শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। অনেক না-ঘুমানো রাত কাটাবার পর পেলাম গভীর ঘুমের সুন্দর প্রশান্তি।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর মান্না দে আমার গানের জীবনের দুটি স্তম্ভ। আমার বয়সে বড় ভাগ্নে ভবানীপুরের সুশীল চক্রবর্তীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ছোটবেলায় মনে আছে হঠাৎ হঠাৎ দু বন্ধু আমাদের বাড়িতে আসতেন। হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে গান গাইতেন। সেই কবে শোনা পঙ্কজ মল্লিকের প্রভাব-লাগা হেমন্তদার কণ্ঠের সেই ‘তোমার চোখের চাওয়া’ এখনও আমার কানে বাজছে। আমার হাফ প্যান্ট পরা বয়সে আমাদের সালকিয়ার বাড়িতে ওঁর গাওয়া ‘পরদেশী কোথা যাও/থামোগো হেথায়’ আর শেষ কৈশোরে শোনা ‘মোর সুন্দরের অভিসারে’ এখনও আমি শুনতে পাই। তখন উনিই বলেছিলেন, দ্যাখ সুশীল, শৈলেশ দা (শৈলেশ দত্তগুপ্ত) কী সুন্দর সুর করেছেন।
আমার থেকে বয়সে বড় ভাগ্নে সুশীলকে আমিই মামা বলতাম মনে পড়ছে। সুশীল মামার বিয়ের দু-চারদিন পরেই বড়দির বাড়িতে ওর কিছু শিল্পী বন্ধুকে নিয়ে এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে হেমন্তদা গান গাইলেন আর ভাগ্নে বাজালেন তবলা। আমরা শুনছি গান। দরজার এক কোণে বসে আছে নব্য যুবক উত্তম। ও তখন শুধু পাড়ায় শখের যাত্রা করে। সিনেমার হিরো তখন ওর কাছে দুঃস্বপ্ন। কয়েকটি গানের পর বললেন—এবার শোন
একটা রবীন্দ্রসংগীত। শুনেই ভাগ্নে বলল—তা হলে কি আর তবলা বাজাব। হেমন্তদা ভ্রু কুঁচকে বললেন—বাজা দেখি এই গানটার সঙ্গে। বলেই গান ধরলেন—’কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’—প্রায় পুরো ‘অ্যালিফে’র পর যেই এল ‘কালো? তা সে যতোই কালো হোক’ মেতে উঠল ঘরভর্তি সমস্ত শ্রোতা। হেমন্তদা বুঝিয়ে দিলেন, তিনি আধুনিক আর রবীন্দ্র সংগীতের দু নৌকায় পা দিয়ে নদী কেন, সমুদ্র পাড়ি দেবার ক্ষমতা রাখেন। অনুষ্ঠানে এক-একজন শিল্পীরা আজকাল যেমন পুরো একঘণ্টা দেড়ঘণ্টা গান গেয়ে শোনান, তখন সে রেওয়াজ ছিল না। সংগীতানুষ্ঠানে এক-একজন গাইতেন পাঁচটি কি ছটি গান। আর সঙ্গে থাকত শুধু তবলা। কেবলমাত্র মুম্বই-এর শিল্পীরা কলকাতায় কোনও অনুষ্ঠান করতে এলে, বিভিন্ন বাজনা নিয়ে রেকর্ডের মতো গান পরিবেশন করতেন। তখনকার শ্রোতারা কিন্তু এ সব গানে খুব সন্তুষ্টি পেতেন না। মনে আছে আগেকার ইন্ডোর স্টেডিয়ামে একটা অনুষ্ঠানে লতা মঙ্গেশকর আর সন্ধ্যা মুখার্জি দুজনেই অংশগ্রহণ করেছিলেন। লতাজি যথারীতি অর্কেস্ট্রা নিয়ে গাইলেন। সন্ধ্যা মুখার্জি গাইলেন শুধু রাধাকান্ত নন্দীকে নিয়ে নিজেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে। ইতিহাস সাক্ষী, ওঁর বাদ্যযন্ত্রহীন অনুষ্ঠানে শুধু কণ্ঠমাধুর্যের পরিবেশনায়—’গানে মোর ইন্দ্রধনু’ সেদিন মুম্বই-এর সমস্ত শিল্পীর সংগীতানুষ্ঠানকে ম্লান করে দিয়েছিল। মান্না দে কলকাতার হলেও মূলত মুম্বই-এর শিল্পী। মুম্বই-তে নাম করার পর উনি প্রথম প্রথম যখন কলকাতায় আসতেন, শুধু হারমোনিয়াম আর তবলা নিয়েই কলকাতার শিল্পীদের স্টাইলেই অনুষ্ঠান করতেন। এরপর যখন নিয়মিত আসা শুরু করলেন তখন তবলার সঙ্গে একটা অ্যাকোর্ডিয়ান, একটা স্প্যানিশ গিটার, একটা পারকারশান, আর একটা স্পেশাল রিদম নিয়ে নিলেন—অনুষ্ঠানের শ্রোতারা এতে হয়তো একটু ভিন্ন আস্বাদ পেলেন যেহেতু উনি বাংলার সঙ্গে হিন্দি গানও গাইতেন। এইভাবেই কলকাতার সংগীতানুষ্ঠানে প্রবেশ করল গানের সঙ্গে বাজনা। পরবর্তীকালে যা অনেক ক্ষেত্রেই ‘গান-বাজনা’ না হয়ে ‘বাজনা-গান’ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
তবু মান্নাদা, হেমন্তদার অনুষ্ঠানে বাজনার পরিমিতিটা যে কোনও শ্রোতারই চোখ-কান এড়াল না।
হেমন্তদাকে আমি আমাদের স্কটিশ চার্চ কলেজের সরস্বতী পুজোর পর (যে পুজো কলেজের বাইরে হত) একটা অনুষ্ঠানের জন্য আমন্ত্রণ জানালাম। উনি রাজি হলেন, বললেন আমি পঞ্চাশ টাকা করে নিই তুমি চল্লিশ দিয়ো। আমি ওটা পঁয়ত্রিশ টাকায় নামিয়ে ছিলাম। উনি বললেন—আমার ওই দিন মেডিকেল কলেজে অনুষ্ঠান আছে। ওখানে এসো। ওখান থেকে তোমার সঙ্গে যাব। অনুষ্ঠানের দিন আমায় খবর পাঠালেন, আমার প্রেসিডেন্সি কলেজেও অনুষ্ঠান হচ্ছে। তুমি অমুক সময়ে সেখানে এসো। মনে আছে, গিয়েছিলাম মেডিকেল কলেজেই। দু জায়গাতেই উনি শুধু তবলার সঙ্গে ছ-সাতটি গান গাইলেন। আমাদের কলেজেও তাই। ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ’ তখন সদ্য প্রকাশিত। কত সহজে তিন জায়গার ছাত্র মহলে প্রচার হয়ে গেল সেই গান। আর পারিশ্রমিকের কথাই যদি ওঠে তা হলে বলি, যেহেতু আমি ফাংশন করাতাম, আমি জানি তখন সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক নিতেন দুজন শিল্পী, একজন পঙ্কজ মল্লিক আর একজন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। ওঁদের রেট ছিল একশো টাকা!
হেমন্তদা আমার প্রথম গান করেন, মুম্বই-এর রামচন্দ্র পালের সুরে প্রদীপকুমারের ঠোঁটে ‘অপবাদ’ ছবিতে। আমি তখন কলেজে থার্ড ইয়ারের ছাত্র। তারপর হেমন্তদা চলে গেলেন মুম্বই-তে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সুপারহিট হল ‘নাগিন’। কলকাতায় এলেই দেখা করতে যেতাম। মুম্বইতে গেলেও দেখতাম, সবসময় পরে আছেন ওই হাত গোটানো সাদা শার্ট, ধুতি আর চপ্পল।
পরে কলকাতারও আরও ছবিতে আমার আরও গান গাইলেন, কিন্তু আধুনিক গানের যোগাযোগ হচ্ছিল না। শেষকালে এসে গেল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ভবানীপুরে সান্তুদার বাড়িতে অনেক কিন্তু কিন্তু করে হেমন্তদাকে বললাম—এবার আপনি আমার দুটো আধুনিক গান আপনার সুরে রেকর্ড করুন। হেমন্তদা আমার মুখের দিকে একটু তাকিয়ে বললেন—আরে, তুমি তো কোনও দিন বলোনি? গান আছে সঙ্গে? পকেটে নতুন লেখা চার-পাঁচটা গান ছিল। প্রথমেই শোনালাম—’ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না/ও বাতাস আঁখি মেলো না/আমার প্রিয় লজ্জা পেতে পারে/আহা কাছে এসেও ফিরে যেতে পারে’। এইটুকু শুনেই হেমন্তদা আমায় থামিয়ে দিলেন। ব্যাস, ব্যাস, আর শোনাতে হবে না। আমি এখনই অমুক জায়গায় যাব। একটুও সময় নেই। মনটা খারাপ হয়ে গেল। তা হলে কি হেমন্তদার গানটা পছন্দ হয়নি? বোধ হয় তাই! উনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন—এই গানটা আর এর উল্টো পিঠে তোমার পছন্দমতো যে কোনও একটা গান আমায় মুম্বই-তে পাঠিয়ে দাও। আমি পরের বার এখানে এসে রেকর্ড করব। আমি যেন সেই প্রচলিত উপমা–আকাশের চাঁদ পেলাম। উল্টো পিঠের জন্য লিখেছিলাম—কতো রাগিণীর ভুল ভাঙাতে/বাঁশি ভরে গেছে আঘাতে’। দুটো গান-ই হেমন্তদার পরশমণির ছোঁয়ায় খাঁটি সোনা হয়ে গেল।
এর বছর কতক পরে ঠিক পুজোর পরেই মুম্বই গিয়েছিলাম। এখানকার এইচ.এম.ভি. ওখানের দুজন শিল্পীর গান করার জন্য আমায় চিঠি দিয়েছিলেন। সেবার পুজোর আগেই হেমন্তদা প্রথম বিদেশ গিয়েছিলেন। পুজোয় এইচ. এম. ভি. প্রকাশ করতে পারেননি তাঁর নতুন কোনও গান। শুনলাম এইচ. এম. ভি. ঠিক করেছেন হেমন্তদা কলকাতায় এলেই রেকর্ড করবেন। সুধীন দাশগুপ্তের সুরে প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা ‘সাগর থেকে ফেরা’। মুম্বই-তে ক্রশ ময়দানে সেবার বাংলার বন্যাত্রাণের অর্থ সংগ্রহের জন্য সলিল চৌধুরী একটা চ্যারিটি অনুষ্ঠান করেছিলেন। সেদিন সন্ধ্যায়, সব শিল্পীদের সঙ্গে ওখানে দেখা হবে জেনে আমিও হাজির হয়েছিলাম। মুম্বই-এর খোলা অনুষ্ঠান মানে মোটেই সারারাত্রিব্যাপী বিচিত্রানুষ্ঠান নয়। সন্ধ্যায় নির্দিষ্ট সময়ে শুরু আর বড় জোর রাত এগারোটায় শেষ। পরদিন অনেক শ্রোতারই অফিস, কাছারি আছে। কলকাতার মতো কেউ অফিস কামাই করবেন না-বা অফিসে বসে ঢুলবেন না। এ ব্যাপারে মুম্বই খুবই আদৰ্শ।
রাত বাড়ছে, আমি উশখুশ করছি—ঘোষণামতো কখন লতাজি আসবেন। সম্ভবত মুকেশব্জি গাইছিলেন, ওঁর গান শেষ হতেই সলিলদা স্টেজে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছিলতা হঠাৎ অসুস্থা হয়ে গেছে। তাই আজ আর এখানে গাইতে পারবে না। আমাদের শেষ শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বুকটা ধ্বক করে উঠল। এখনই হয়তো কাদা ছোড়াছুড়ি হবে—নইলে চেয়ার ভাঙাভাঙি। কিন্তু কিছুই হল না। অবাক বিস্ময়ে শুধু দেখলাম—বেশ কিছু লোক হেমন্তদার দুটি তিনটি গান শুনেই অনুষ্ঠান মণ্ডপ থেকে চলে যেতে লাগলেন। হেমন্তদাও বেশি গান গাননি। ওঁর অনুষ্ঠান শেষ হতে ওঁর সঙ্গে দেখা করলাম। খুশি হয়ে বললেন-আরে পুলক? কবে এলে? কোথায় আছ? কাল সকালে কী করছ? আমার ঠিকানা পেয়ে বললেন—সকালে গাড়ি পাঠিয়ে দেব, চলে এসো—আমার রেকর্ডের গান লিখতে হবে।
এইচ. এম. ভি-র বোম্বাই স্টুডিয়োতে এখনই রেকর্ড করব। পুজোয় গান হয়নি। জানুয়ারিতে নতুন গান চাই-ই। পরদিন সকালে ওঁর গাড়িতে ওঁর গীতাঞ্জলিতে যেতে যেতে আমায় কিন্তু দুটি দুশ্চিন্তা প্রবল পীড়া দিতে লাগল। প্রথমটি—গৌরীপ্রসন্ন তখন মুম্বইতে। শুনেছিলাম উনি নাকি সেবার হেমন্তদার বাড়িতেই সস্ত্রীক উঠেছেন। উনি হাতের এত কাছে থাকতে হেমন্তদা আমায় ডাকছেন কেন? দ্বিতীয়টি হল—এইচ. এম. ভি. ‘সাগর থেকে ফেরা’র রেকর্ডিং করার স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমার গান হয়তো অনেক অনেক পরে প্রকাশ করবেন। হেমন্তদার গানের পুজোর যে-গ্যাপটা রয়েছে— সেটা হয়তো আমার বরাতে জুটবে না। এ সব ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম হেমন্তদার গীতাঞ্জলির পেছন দিকের গ্রাউন্ড ফ্লোরের মিউজিক রুমে। ওঁকে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলাম—গৌরীবাবু তো এখানেই আছেন। উনি কোথায়? হেমন্তদা বললেন—ও গেছে সুবীর সেনের বাড়িতে।
হেমন্তদার বরাবরের অভ্যাস, তবলার তাল ছাড়া কোনও গান সুর করতে পারেন না। সেদিন ওঁর তবলিয়া অনুপস্থিত থাকাতে কিশোরপুত্র বাবু (জয়ন্ত)কে ডাকলেন। ও ঢোল বাজাতে লাগল। উনি সুর দিলেন। আমি লিখলাম— জানি না কখন তুমি আমার চোখে স্বপ্নের মায়া দিলে/পলকেই হৃদয় নিলে’। লেখা শুনে হেমন্তদা খুশি হলেন। পরের লাইনটা লিখতে যাব এমন সময় ঘরে ঢুকল ওঁর পোষা অ্যালসেশিয়ান কুকুরটি। বাবু বললে—ইউ, গেট আউট। ও ভ্রূক্ষেপ না করে আমাদের মধ্যে পরিষ্কার কার্পেটে নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে পড়ল। হেমন্তদা আমার দিকে চেয়ে একটু মুচকি হেসে হারমোনিয়ামের রিডে যত রকম বেসুরো ডিসকর্ড পর্দা আছে বাজাতে লাগলেন। এক অদ্ভুত অস্বস্তিতে ছটফট করতে লাগল কুকুরটি। বেসুর ওই বাজনা শুনে শুনে শেষমেশ তিতিবিরক্ত হয়ে দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বাড়ির সুর শুনে দিন কাটানো কুকুরটি। আমি এইচ. এম. ভি-র কুকুরের মতো এই কুকুরটিরও দুটি খাড়া কানের তারিফ না করে পারলাম না। যা হোক, পরের গানটি ছিল আমার সঙ্গে থাকা একটি লেখা গান। হেমন্তদা গানটি বার তিনেক পড়ে নিয়ে বাবুকে (জয়ন্ত) ‘টু-ফোর’ রিদম্ বাজাতে বলে সুর দিয়ে গাইতে লাগলেন—’কোনওদিন বলাকারা অতো দূরে যেতো কি/ওই আকাশ না-ডাকলে?’ গান দুটি তৈরি হয়ে গেলে আমি, আমার দ্বিতীয় আশঙ্কার কথাটি হেমন্তদাকে জানালাম। উনি বললেন—আমি দু-তিনদিনের মধ্যেই রেকর্ড করছি। আর ‘সাগর থেকে ফেরা’ আমি অবশ্যই কলকাতা গিয়েই রেকর্ড করব—কিন্তু তোমার গান দুটোই আগে বেরোবে। হেমন্তদা তাঁর কথা রেখেছিলেন। ওই গান দুটিই আগে প্রকাশিত হল। কিন্তু একটা প্রশ্নের জবাব আমি আজ পর্যন্ত খুঁজে পাইনি। গৌরীবাবু সেবার ওঁর হাতের কাছে থাকতেও, উনি নিজে থেকে কেন আমাকে ডেকে সেবার ওই দুটি গান লেখালেন?
৭৬
হেমন্তদার সম্বন্ধে আমার কথা বলা বোধহয় কোনও দিনই ফুরোবে না। যেটা হঠাৎ মনে আসছে –এখন সেটাই বলি। ‘মণিহার’ ছবির গান নিয়ে আমরা টেপাদার (অমর দত্তর) বাড়ি সিটিং করছি। রয়েছেন পরিচালক প্রযোজক অনেকেই।
গানের সিচুয়েশন হল—নায়ক-নায়িকা দার্জিলিং চলেছেন পাহাড়ি পথে, হঠাৎ গাড়ির টায়ার ফেটে গেল। চাকা বদলাতে একটু সময় তো লাগবেই। নায়িকার পিতা বললেন—মা, আমরা চুপচাপ বসে কী করব? তুই একটা গান শোনা। নায়িকার এই গানেই নায়কের মনে প্রথম অনুরাগের ছোঁয়া লাগবে। এক্ষেত্রে নায়িকা নিশ্চয়ই আজকালকার তথাকথিত ছবির মতো কোনও ‘ডাইরেক্ট’ প্রেমের গান গাইতে পারবেন না। তাই ঠিক হল প্রকৃতির ওপর গান লিখতে হবে।
তখন বিখ্যাত বেহালাবাদক ভি. জি. যোগের বেহালা বাদনে অনেক ‘সিগনেচার টিউন’ রেডিয়োতে খুবই জনপ্রিয় ছিল। রেডিয়োর অধিবেশন শুরু হবার আগের বেহালার সেই সব সুর নিশ্চয়ই এখনও অনেকেরই মনে আছে!
হেমন্তদা আর আমার আগেই আলোচনা হয়েছিল, ভি. জি. সাহেবের তখনকার রেডিয়োর ‘সংবাদ বিচিত্রা’র ‘সিগনেচার টিউন’-এর সেই অপূর্ব বেহালা বাদনের সুরের স্টাইলে এই গানটা সৃষ্টি করা হবে।
হেমন্তদা সেই স্টাইলেই সুর দিলেন। আশ্চর্য ব্যাপার। তৎক্ষণাৎ সেই সুরের ওপর আমি লিখে ফেললাম—’নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থপাখিরা/বুঝিবা পথ ভুলে যায়।’ পরের পঙক্তিটাও একই সুরে ভিন্ন কথা লিখলাম।
ঘরভর্তি সবাই খুশি হলেন। হেমন্তদা এবার ‘অন্তরা’ দিলেন। আমি লিখতে যাচ্ছিলাম, উনি বললেন—না। ‘ ডামি বোলে’ অর্থাৎ ‘আবোল তাবোল’ কথায় গানের সুরের মিটারটা নিয়ে নাও। তারপর দু-দুটো দিন বাড়িতে বসে মন দিয়ে লিখে অমুক তারিখে এই সময়ে এখানে এসো। এঁরাও আসবেন, শুনে নেবেন। এঁদের পছন্দ হলে রেকর্ড করব। তাই করলাম। ধরে নিলাম সুরটা ডামি বোলে’। চা-টা খেয়ে ওঁরা সবাই উঠে পড়লেন। আমিও উঠতে যাচ্ছি। হেমন্তদা বললেন, তুমি যেয়ো না, আমি তোমাদের ওদিকেই যাব। একসঙ্গে বের হব। এঁরা চলে যেতেই হেমন্তদা আবার হারমোনিয়াম নিয়ে বললেন—পুলক, আজকে তোমার দারুণ মুড। আমিও খুব মুডে আছি। লেখো। এখনই গান শেষ হয়ে যাবে। সত্যই তাই হল।
কী যেন একটা ভাব ও কথার জোয়ারে আমি ভেসে গেলাম। লিখে ফেললাম-’দূর আকাশের উদাস মেঘের দেশে/ওই গোধূলির রঙিন সোহাগ মেশে’ ইত্যাদি। গোটা গানটা বানাতে আমাদের সর্বসাকুল্যে সময় লেগেছিল বোধহয় পনেরো মিনিট। গানের কাগজটা ওঁকে এগিয়ে দিতে গেলাম। হেসে বললেন—না, তোমার কাছে থাক। সুরটা আমি টেপ করে রেখেছি। তুমি অমুক তারিখে প্রডিউসারদের সামনে এটা দেবে। আমি এ লেখাটা প্রথম পেলাম—এই অ্যাকটিং করে যাব। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। হেমন্তদা আবার হেসে বললেন—আমি এক্ষুনি সুর করলাম, তুমি এক্ষুনি লিখলে। এ গানে কেউ সন্তুষ্ট হয় নাকি? ওঁরা চাইবেন—আমরা দু-তিন ধরে গলদঘর্ম পরিশ্রম না-করে যদি কোনও গান বানাই সেটা একেবারে ফাঁকিবাজি।
নির্দিষ্ট দিনে আমরা হেমন্তদার চিত্রনাট্য অনুযায়ীই অ্যাকটিং করলাম এবং সুপারহিট হল ‘নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থপাখিরা’।
পরবর্তী জীবনেও দেখেছি হেমন্তদা কখনও কোনও গান নিয়ে অহেতুক রগড়া-রগড়ি করেননি। ওঁর মতে প্রাণের আবেগে যেটা সৃষ্টি, সেটাই আসল গান—কোনও কেরামতিতে নয়। এটাই দেখেছিলাম ‘বাঘিনী’ ছবিতে, হেমন্তদার সুরে আমার লেখা মান্নাদার কণ্ঠের ‘ও কোকিলা তোরে শুধাই রে’ গান রেকর্ডিং-এর সময়। দ্বিতীয় ‘টেক’টি শুনেই হেমন্তদা বললেন—মান্নাবাবু ‘ও-কে’! চমৎকার। আর গাইতে হবে না। মান্নাদা বলে উঠলেন—’ও-কে’ কী মশাই? আমার এখনও গলাই গরম হল না। রেকর্ডিং চেম্বার থেকে হেমন্তদা বললেন-’তা হলে আবার টেক করুন। সম্ভবত পর পর দশটি টেক হয়েছিল গানটির। হেমন্তদা আমায় পাশ থেকে বলেছিলেন, দেখো পুলক, সব ক’টা টেক আলাদা করে শোনার পর মান্নাবাবুই বলবেন সেকেন্ড-টেকটাই রাখুন। অবাক হলাম। মান্নাদা ঠিক তাই বলেছিলেন। সেকেন্ড টেকটাই প্রিন্ট হয়েছিল।
এত নিষ্ঠা, এত অধ্যবসায়, এত ধৈর্য, সময় জ্ঞান, আমি খুব কম শিল্পীরই দেখেছি। সুভাষদা (কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়) আমায় বলেছিলেন—তখন ওঁর বন্ধু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটা হারমোনিয়ামও ছিল না। সুভাষদার ছিল। হেমন্তদা মুখ্যত ওই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইবার জন্য ওঁদের বাড়িতে নিয়মিত আসতেন। ওঁর প্রথম রেডিয়ো প্রোগ্রামে, তখনকার একটা জানা গানের সুরের ওপরই কথা লিখে দেন সুভাষদা।
হেমন্তদা একদিন কথায় কথায় আমাকে বলেছিলেন, জানো পুলক। যখন ফিল্মালয়ে মাস-মাহিনায় কাজ করছি তখন শশধর মুখার্জির ‘নাগিন’ ছবির ‘ও জিন্দেগিকে দেনে ওয়ালে/জিন্দেগিকে লেনে ওয়ালে’ গানটি পেয়েই আমি সুর করে শোনালাম মুখার্জি সাহেবকে। আমার ধারণা ছিল সুরটা লুফে নেবেন উনি। কিন্তু শুনে বললেন—কিচ্ছু হয়নি। তোমাকে কলকাতার টিকিট কিনে দিচ্ছি। ফিরে যাও। কিন্তু ফিরে যাব বলে তো বম্বেতে আসিনি। তাই হাসি মুখে আবার নতুন করে সুর করলাম। আবার অপছন্দ হল। আবার করলাম, আবার অপছন্দ। এভাবে উনিশটি সুর শোনানোর পর মুখার্জি সাহেব বললেন—হেমন্ত তোমার প্রথম সুরটাই নাগিনে থাকবে। আমার ওটা ভাল লেগেছিল—আমি এতদিন দেখছিলাম—তুমি এর চেয়ে ভাল কিছু করতে পারো কি না! হেমন্তদার এই অধ্যবসায় তো যে কোনও মানুষের আদর্শ হওয়া উচিত।
হেমন্তদার অসাধারণ নাট্যবোধ আমি বহু ক্ষেত্রে দেখেছি। মনে আছে, প্রথম শীতের এক ডিসেম্বরের বিকেলে মাসখানেক পরে হেমন্তদার কলকাতার বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। ইচ্ছে হল, একবার ওঁর সঙ্গে দেখা করে যাই।
ওঁর ঘরে ঢুকেই দেখলাম, সন্ধ্যায় বোধহয় কোনও জলসায় উনি যাবেন, তাই ওঁর প্রিয় তবলিয়া মাস্তান (গায়িকা ডক্টর অঞ্জলি মুখোপাধ্যায়ের ভাই) ওখানে বসে আছে। আমাকে দেখেই হেমন্তদা বললেন—কী ব্যাপার পুলক, অনেক দিন পাত্তা নেই? আজকেই ভাবছিলাম তোমায় খবর দেব। আগামী পুজোর গানগুলো তৈরি করে দেবে তো। অবাক হলাম। এই তো সবে ডিসেম্বর। আগামী বছরের পুজোর সেপ্টেম্বরের গান এখনই তৈরি করে রাখবেন?
হেসে বললেন—নতুন বছর পড়লেই সবাই আমার কাছ থেকে ও বছরের পুজোর গানের ‘প্রতিশ্রুতি’ আদায় করে রাখতে চাইবেন। আমি কোন গীতিকার, কোন সুরকারকে ফেরাব বলো তো? সবাই তো আমার চেনাজানা। তাই আমার গান তৈরি থাকলে ওঁদের সোজা সত্যি কথায় বলতে পারব, আমার গান রেডি হয়ে গেছে, আপনারা আমায় ক্ষমা করুন।
এবার মাস্তানকে বললেন— মাস্তান ঠেকা বাজাও।
আমাকে অগ্রজের আদেশের ভঙ্গিমাতেই বললেন—পুলক, নাও লেখো। মাঝে মাঝে তুমি যে কোথায় ডুব মারো? ওঃ, কতদিন পরে তুমি আজ এলে বলো তো? কতোদিন পরে এলে/একটু বোসো/তোমায় অনেক কথা বলার ছিলো/যদি শোনো। গানটি সেই মুহূর্তে আমি লিখতে পেরেছিলাম। আর একটি গানের বেলায়, সেদিন বিকেলে ওঁর লেকের দিকের বারান্দায় বসে দুজনে চা খাচ্ছি। বললেন, কী ধরনের গান বানানো যায় বলো তো? বলেই নিজেই আবার বলে উঠলেন——ওই যে লেক থেকে স্নান সেরে ভিজে কাপড়ে জল ঝরাতে ঝরাতে যে মেয়েটি গাছগাছালির ছায়া মাড়িয়ে তার বাসায় ফিরে যাচ্ছে—ওকে নিয়ে লিখতে পারো? হেমন্তদা প্রথম জীবনে অনেক গল্প লিখেছেন। কিছু ‘দেশ’ পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছিল। ওঁর সাহিত্য বোধ দারুণ। সুতরাং ভাবতে বসে গেলাম। হেমন্তদা হারমোনিয়াম ধরলেন। পেলাম সকালের সুর। কিন্তু তখন বিকেল। তাই লিখে ফেললাম—’সেদিন তোমায় দেখেছিলাম ভোরবেলায়/তুমি ভোরের বেলা হয়ে দাঁড়িয়েছিলে/কৃষ্ণচূড়ার ওই ফুলভরা গাছটার নীচে/আমি কৃষ্ণচূড়ার ওই স্বপ্নকে/আহা দু চোখ ভরে দেখে গেলাম।’
এমন অজস্র ঘটনা আছে। কিছু শোনাই।
আমার কাহিনীর ‘রাগ-অনুরাগ’ ছবির সুরকার ছিলেন হেমন্তদাই। আমিই প্রযোজক-পরিচালককে নিয়ে ওঁর কাছে গিয়েছিলাম। মুখে মুখে আমার গল্পটি শুনিয়ে ছিলাম। বললাম ছবিতে আটখানি গান। সাতটা গান আপনার, আর একটা গান লতা মঙ্গেশকরের। সেই হাসি দিয়ে উত্তর করলেন—তোমার তো লতা না হলে মন ভরবে না। ওঁকে বোঝালাম—গল্পের মূল ব্যাপারটা হচ্ছে গায়ক-নায়ক জানত না নায়িকার অসাধারণ গানের গলা। আচমকা সেই গান শুনেই প্রথম নায়িকার প্রেমে পড়বে নায়ক সুতরাং নায়কের থেকে বেশি ভালো সিংগার আমার প্রয়োজন। শিশুর মতো সরল হাসিতে হেসে উঠলেন হেমন্তদা। দেখছ? পুলক আজ আমার সামনেই বলে ফেলল লতা আমার থেকে ভাল গায়। আমি কি তা জানি না। বেশ লতাই হবে।
অনিবার্য কারণে ছবিটির প্রোগ্রাম দু মাসের জন্য পেছিয়ে যায়। ইতিমধ্যে আমরা আরও অনেক গান নিয়ে বসেছি। একদিন কোনও এক মহিলা শিল্পীর রেকর্ডের গান লিখছি। সবে মুখড়া টা হয়েছে—এবার অন্তরা হবে— হেমন্তদা বললেন -থাক, পুলক। অন্য সুর দিচ্ছি, অন্য গান লেখো। স্বভাবতই মনটা ভেঙে গেল। আপনার পছন্দ হল না, হেমন্তদা? উনি হাসলেন। না, না, তোমার ছবির গল্পের ওই সিচুয়েশনে এটা সঠিক হবে। এটা নন-ফিল্ম রেকর্ডে নয়—ওখানে লাগাব। চমকে উঠলাম আমি। আমার কাহিনী আমার তৈরি সিচুয়েশন। এই নিয়ে কতবার ভেবেছি আমি। অথচ আমার মাথায় ব্যাপারটা আসেনি? হেমন্তদা ‘স্ক্রিপ্টটাও শোনেননি। শুধু আমার মুখে গল্পের ছোট ‘জিস্ট’ শুনেছেন। তাতেই বলে দিলেন এ গান ওখানে লাগিও? এত অসাধারণ চিন্তাশক্তি, নাট্যবোধ হেমন্তদার? তৎক্ষণাৎ খাতা কলম ছুড়ে ফেলে ওঁকে প্রণাম করেছিলাম।
‘রাগ-অনুরাগ’-এর সেই সুপারহিট গানটি হল—ওই গাছের পাতায় / রোদের ঝিকিমিকি/আমায় চমকে দাও/চমকে দাও।’
ওই ছবিরই আর একটি গানের সময় বেশ মজার ঘটনা ঘটেছিল। সেদিন সকালে হেমন্তদার ‘সিটিং’-এ গেছি। যেতেই উনি যথারীতি বললেন—কী ধরনের গান করা যায় বলো তো? আমি একটু ইতস্তত করে বললাম —পটদীপ করলে কেমন হয়?
–‘পটদীপ?’
হেমন্তদা আবার সেই হাসিটি হেসে উঠলেন। অপ্রস্তুত আমাকে প্রশ্ন করলেন—কাল সন্ধ্যাটা বুঝি মান্নাবাবুর সঙ্গে কাটিয়েছ?
মান্নাদা তখন কলকাতায় ছিলেন। সত্যিই কাল সন্ধ্যায় ওঁর বাড়িতে উনি পটদীপ রাগের বিভিন্ন গান আমায় শুনিয়েছিলেন। আমার মাথায় তাই পটদীপ ঘুরছিল। হেমন্তদা এবার ওঁর পাশে বসা সহকারী ও আজীবনের বন্ধু সমরেশ রায়কে বললেন—নাও পুলকের কথাই রাখো। একটু পটদীপ আমায় শোনাও।
সমরেশদা শোনাতে শুরু করলেন। একটু শুনেই ওঁকে থামিয়ে দিয়ে হেমন্তদা সুর দিলেন। লিখে ফেললাম—’সেই দুটি চোখ/আছে কোথায়/কে বলে দেবে আমায়?’
আর একটা ঘটনা বলি—ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর খবর শুনেই আমি তখনকার ই. পি. রেকর্ডের যুগের প্রথামতো চারখানা শ্রদ্ধাঞ্জলির গান লিখে হেমন্তদার কাছে হাজির হয়েছিলাম। হেমন্তদা গানগুলি মন দিয়ে পড়ে বললেন—চমৎকার লিখেছ পুলক। কিন্তু এগুলো অন্য কাউকে দাও। আমি রেকর্ড করতে পারব না। কারও মৃত্যু নিয়ে ব্যবসা করাটা আমি চিরদিন অপছন্দ করি। ভাবতাম, গান্ধীজির মৃত্যুর পর ধনঞ্জয়বাবুর ‘কে বলে গান্ধী নাই’, শচীন দেববর্মণের ‘গুণ ধাম আমাদের গান্ধীজি’ ইত্যাদি বহু শিল্পীর বহু গান আমরা শুনে থাকলেও কেন হেমন্তদার কণ্ঠে এ-ধরনের কোনও গান শুনিনি? মুহূর্তে কারণটা পরিষ্কার হয়ে গেল। ইন্দিরা গান্ধীজির মৃত্যুকে নিয়ে লেখা সে গান বহু শিল্পী আমার কাছে চেয়েছেন, আমি কিন্তু পত্রিকায় প্রকাশ করা ছাড়া কাউকেই রেকর্ড করতে দিইনি। হেমন্তদার প্রয়াণের সময় আমি ছিলাম মুম্বই-তে। ওখানকার অনেক কোম্পানি আমাকে দিয়ে ওঁর ওপর শ্রদ্ধাঞ্জলি লিখতে বলেছিলেন। আমি লিখিনি। একটি বড় কোম্পানি আমায় বলেছিলেন, ওঁরা হেমন্ত কন্যা রানুকে দিয়ে বাবার ওপর গান গাওয়াবেন—আমি যেন লিখি। আমায় অভাবিত অর্থের প্রলোভনও ওঁরা দেখিয়েছিলেন—আমি রাজি হইনি। উপরন্তু রানুকেও বলেছিলাম, হেমন্তদার ওই মনোভাবটা। রানু জানত না। শুনে রানুও মোটা অর্থপ্রাপ্তিকে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
আর একটা ঘটনা মনে আসছে। হেমন্তদার মতো ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় চলতে আমি গানের জগতে কাউকে দেখিনি। যখন শঙ্খবেলা’য় ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ গানটা প্রকাশ হল। তখন আমার একজন মহিলা ফ্যান বা অনুরাগীর আবেগ-ভেজা কণ্ঠের ফোন পেলাম। এমন রোমান্টিক গান নাকি উনি কখনও শোনেননি। বললাম, নাম কী? কত নম্বর থেকে বলছেন?
খুব সপ্রতিভ সম্ভ্রম জড়ানো তরুণী কণ্ঠ সেটা এড়িয়ে গেলেন। বললেন, এরকম আরও লিখুন। আবার ফোন করব। কেটে দিলেন উনি লাইনটা। এরপর আমার আর একটা কী রোমান্টিক গান হিট হতেই সত্যিই আবার তাঁর ফোন পেলাম। একই অভিনন্দন দিলেন, কিন্তু বললেন না নাম ঠিকানা-টেলিফোন নম্বর। এমনই ভাবে চলতে লাগল মাঝে মাঝে টেলিফোন আসা। যখন আমার বিলম্বিত লয়’ ছবির ‘এক বৈশাখে দেখা হল দুজনায়/জষ্টিতে হলো পরিচয়’ গানটি প্রকাশিত হল, তখন উনি ফোনে বললেন আজ বিকেলে ঠিক সাড়ে পাঁচটায় আমি এলগিন রোডের এই জায়গায়, এত নম্বর বাড়ির সামনে এই রঙের শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে থাকব, আপনি আসুন! আপনাকে দেব আমার লাগানো গোলাপ গাছের প্রথম ফোটা গোলাপ। আমিও উৎসাহের গলায় বেশ খানিকটা ‘বেস’ দিয়ে বললাম—-আমরা কিন্তু কোথাও চা খাব, না বললে চলবে না।
ফোনের লাইনের ওধার থেকে শুনলাম শুধু এক অপূর্ব কাচভাঙা হাসি। আচ্ছা আসুন তো। আনন্দে আত্মহারা আমি নিজেই আমার গাড়িটা সযত্নে ধোয়া মোছা করে ঝকঝকে করে তুলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইলাম। ফোন বাজল। হেমন্তদার গলা। পুলক, আজ বিকেলে কী করছ? নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বললাম—বলুন। বললেন—ঠিক পাঁচটায় আমার কাছে আসতে পারবে? প্রতিমার (বন্দ্যোপাধ্যায়ের) পুজোর গান দুটো তৈরি করে ফেলব। ঢোঁক গিলে বললাম—সাড়ে সাতটা নাগাদ হয় না? বললেন—না, ওই সময়ে আমার অন্য কাজ আছে। তোমায় আমি ঠিক সাড়ে সাতটায় ঘড়ি মিলিয়ে ছেড়ে দেব। এবার মরিয়া হয়ে বললাম-কাল হয় না? বললেন, কাল যে আমি বোম্বে চলে যাব। ফিরে এসেই রেকর্ডিং করব। ডেট নেওয়া হয়ে গেছে। তুমি কি আজ খুব ব্যস্ত? তা হলে অন্য কাউকে ডেকে নেব? তাড়াতাড়ি বললাম, না, না, ঠিক পাঁচটায় আপনার কাছে পৌঁছে যাচ্ছি। সারা রাস্তা গাড়ি চালাতে চালাতে গানের মুখড়া ভেবে হেমন্তদার বাড়িতে ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটায় হাজির হয়ে লিখেছিলাম—বড়ো সাধ জাগে/একবার তোমায় দেখি/কত দিন দেখিনি তোমায়।’ আমি ধরেই নিয়েছিলাম, আমার অনুরাগী মহিলাটি আর জীবনে আমায় ফোন করবেন না। করেনও নি। আজ আমার লেখা পড়ে যদি আমার সেদিনের সময় না-রাখার আসল কারণ জেনে রাগ-অভিমান ভাঙতে পারেন, সেই আশাতেই নিজেই মনে মনে গাইছি বড় সাধ জাগে/একবার তোমায় দেখি।’
মান্নাদে-র জন্মদিন ১ মে। আমার জন্মদিন ২ মে। আগে সুর, পরে কথা। মান্না দে-কে নিয়ে আমার বলা কোনওদিনই শেষ হবে না। যতটুকু না-বললে নয়, এখন ততটুকুই বলি।
গান লেখার ঘটনা কিন্তু মান্নাদের সঙ্গে আমার সবচেয়ে বেশি। যেদিন আমার পোস্টে পাঠানো দুটি গান ‘জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই’ এবং ‘আমার না-যদি থাকে সুর/তোমার আছে….এরই নাম প্রেম’ উনি রেকর্ড করলেন সেদিনই আমি ওঁর প্রেমে পড়ে গেলাম। নামে বা চিঠির মাধ্যম ছাড়া তখনও আমরা কেউ কারও পরিচিত নই।
গান রেকর্ড হবার কিছুদিন বাদেই আমি সেবার মুম্বই গিয়ে, সোজা হাজির হয়ে গেলাম ওঁর তখনকার ভিলে পার্লের ফ্ল্যাটে। উনি অপরিচিত আমাকে দেখে বেশ উষ্মার সঙ্গেই প্রশ্ন করলেন—আপনি কে? কী চান? নাম বললাম। জড়িয়ে ধরে আমায় ভেতরে নিয়ে গেলেন। এই বন্ধনডোর আমাদের চিরকালের অমরবন্ধন হয়ে গেল।
ওঁর গানের যে ঘটনাটি সবচেয়ে আগে মনে আসছে, সেটা দিয়েই শুরু করি। সেবার ওঁকে দমদম এয়ারপোর্ট থেকে আনতে গেছি। আমার গাড়িতে ওঁর বাড়িতে আসার পথে, উনি আমার পাশে বসে বাঁ হাতে গাড়ির ছাদে ঠেকা দিতে দিতে গান ধরলেন—‘বিন্দিয়া লাগে মোরি ছোড়দে’ গোছের একটা হিন্দি সংগীত। (হিন্দি ভুল হলে ক্ষমা করবেন) বললেন, একেবারে কাকার (কৃষ্ণচন্দ্র দে) ঠুংরি ঘরানায় গানটা বানিয়ে কালই রেকর্ড করেছি। কেমন লাগছে? বললাম—দারুণ।
উনি গেয়ে চলেছেন আপন মনে। আমি কিন্তু ভাবছি এই সুরে একটা বাংলা গান বানাব। মনে মনে তাই ওই সুরে কথা বসাচ্ছি। শ্যামবাজারের কাছাকাছি এসেই বললাম—গান তো ‘ললিতা গো/ওকে আজ চলে যেতে বল না/ও ঘাটে জল আনিতে যাবো না যাবো না/ও সখি অন্য ঘাটে চল না।’ মান্নাদা গেয়ে উঠলেন। শুনলাম চমৎকার বসে গেছে গানের কথাগুলো।
আমাদের আর তর সইল না। এক্ষুনি গানটা শেষ করা চাই। আমার পরিচিত শ্যামবাজারের মোড়ের ‘বাণীচক্রে’ এসে ওঁদের অনুরোধ করলাম, একটা হারমোনিয়ামওয়ালা ঘর চাই। পেয়ে গেলাম ঘর। শেষ হয়ে গেল গান। মান্নাদা ওঁর মদন ঘোষ লেনের বাড়িতে ঢুকলেন একটা সুপারহিট বাংলা গান সঙ্গে নিয়ে
আর একবার ওঁর বান্দ্রার ফ্ল্যাটে গেছি। সেদিন ওখানে কেউ নেই। উনি একা। বললেন—আমি রান্না করছি। খেয়ে যাবেন। জিজ্ঞেস করলেন—কী রাঁধছেন? বললেন—হয়ে গেলে বলব। ঝাল রাঁধতে গিয়ে যদি অম্বল রেঁধে ফেলি—শুধু শুধু আমার বদনাম হবে। উনি চলে গেলেন কিচেনে, আমি ওঁর ড্রয়িংরুমে বসে লিখে ফেললাম—’আমি শ্রীশ্রীভজহরি মান্না/ইস্তাম্বুল গিয়ে/প্যারিস কাবুল গিয়ে/ শিখেছি দারুণ এই রান্না।’
সেবার ইভনিং ফ্লাইটে মুম্বই যাচ্ছি। সেদিন ঝলমলে পূর্ণ চাঁদের রাত। জানালা দিয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছি। এমন সময় এক অপরূপা তন্বী তরুণী বিমানসেবিকা আমার খাবার নিয়ে এলেন। মেয়েটিকে দেখলাম আর সদ্য ওঠা চাঁদটাকে দেখলাম। খাবারের ন্যাপকিনেই লিখেছিলাম—’ও চাঁদ সামলে রাখো জ্যোছনাকে/কারও নজর লাগতে পারে।’ আর একবার মান্নাদার সঙ্গে বউদির হঠাৎ একটু মান-অভিমানের পালা শুরু হয়। তারপর কাজী নজরুলের গানের আদলে ‘বউ মান করেছে চলে গেছে/বাপের বাড়ি/আড়ি/আড়ি/আড়ি/হয়ে গেলো দুজনের’।
কিন্তু আজীবন ‘সিঙ্গল-ওম্যান ম্যান’ মান্নাদা, স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনও মেয়ের দিকে আড়চোখেও তাকাননি কোনও দিন। যেই ওদিক থেকে ঝড়ের একটু পূর্বাভাস পেয়েছেন—অমনি সে বয়সে ছোট হলেও তাকে দিদি বলে সম্বোধন করতে শুরু করে দিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই উনি বউদির বিরহে জগৎকে অন্ধকার দেখলেন। লিখে ফেললাম সেই ঘটনায় তুমি অনেক যত্ন করে/আমায় দুঃখ দিতে চেয়েছো/দিতে পারোনি।’
শুনেছি কবিরা নাকি ক্রান্তদর্শী হন। আমি ওঁদের জীবনে এমন ঘটনা ঘটবে, এই বিরহের অন্ধকার ফুরিয়ে যাবে, সোনালি সুখের দিন আসবে হয়তো আগেই ক্রান্তদর্শনে বুঝেছিলাম। তাই লিখেছিলাম ‘সেই তো আবার কাছে এলে/ এতো দিন দূরে থেকে/বলো না কী সুখ তুমি পেলে?’
আর একবার আমরা দুজনে আসছি বিহারের সিন্ধ্রি থেকে। ধানবাদে আমার এক আত্মীয় (শ্যালিকা-পতি) তখন কয়লাখনির ম্যানেজার। ওঁর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে হল। মান্নাদা বললেন—আপনার আত্মীয় যখন নিশ্চয়ই আমার ওখানে যেতে আপত্তি নেই। কিন্তু এবারই আপনার কাছ থেকে পুজোর গান নিয়ে আমি বম্বে যাব। ভাবুন। গান ভাবুন।
যাই হোক, ধানবাদে ওই বাড়ির দরজায় এসে আমরা দাঁড়ালাম। মান্নাদা গাড়িতে রইলেন। ফটকের কাছের ‘কলিংবেলটা আমি বাজালাম। একটি সদ্যস্নাতা তরুণী বেরিয়ে এসে বলল—আপনি বাড়ি ভুল করেছেন। মুখার্জি সাহেবের বাংলো ওইটা। মেয়েটি কমলকলি আঙুলের তর্জনীটি তুলে বাড়িটা দেখাল!
ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে এসেই বলেছিলাম, মান্নাদা, আপনার পুজোর গান লিখে ফেলেছি, শুনুন। ও কেন এত সুন্দরী হলো/অমনি করে ফিরে তাকালো/দেখেতো আমি মুগ্ধ হবোই/আমি তো মানুষ! ‘
একটা পার্টিতে হঠাৎ দেখলাম, মেঝেতে পড়ে আছে একটা জড়োয়ার ঝুমকো। কুড়িয়ে নিয়ে বললাম—মেয়েরা সবাই কানে হাত দিন। কার ঝুমকো খুলে পড়ে গেছে। এক সুন্দরী কানে হাত দিয়ে এগিয়ে এসে চাইলেন। দিয়ে দিলাম। মনে মনে তখনই লিখলাম—’জড়োয়ার ঝুমকো থেকে/একটা মোতি খসে পড়েছে।’
মান্নাদার গানে আছে এমন ধারা অজস্র ঘটনা। সবাই বললেন, অনেককে নিয়ে তো গান লিখলেন। এবার লিখুন নিজের সহধর্মিণীকে নিয়ে। তাও লিখেছিলাম। ‘এ নদী এমন নদী/জল চাই একটু যদি/দু হাত ভরে উষ্ণ বালুই দেয় আমাকে।’ মান্নাদা সে গানটাও সুপারহিট করে দিলেন।
একদিন পার্ক সার্কাস-এর ক্রিমেটোরিয়ামের সামনে দিয়ে যাচ্ছি—হঠাৎ মনে হল প্রণাম রেখে যাই মাইকেল মধুসূদনের ওই ‘দাঁড়াও পথিকবর’-এ। ওখানে অন্যান্য সমাধিও চোখে পড়ল। কারও কারও মাথায় বহুদিনের শুকনো ফুল। হঠাৎ একটি সমাধিবেদির ওপরে দেখলাম একটি গাছের ডাল এমনভাবে রয়েছে—ওখানের ফুল আপনিই ঝরে পড়বে ওই বেদিতে। ওই বিষয় নিয়েই লিখলাম—যে সমাধি বেদিটার ঠিক ওপরে/ফুলন্ত গাছটা পড়েছে নুয়ে/ওখানে যে রয়েছে শুয়ে/তার ভাগ্যকে আমি ঈর্ষা করি।’
বিষয়টা শুনেই মান্নাদা আগ্রহী হয়ে গেলেন। রেকর্ড করলেন মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে। এবং হিট করল গানটি।
আর একদিন মান্নাদার গানের ঘরে বসে আছি। রবীন্দ্রভক্ত উনি শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথের ঋতুসংগীত। শুনতে শুনতেই মাথায় এল প্রকৃতিকে চালচিত্র করে প্রিয়াকে সামনে রেখে ছয় ঋতুর ছয়টি গান লিখব। বোধহয় পরদিনই লিখে ফেললাম ‘সারা বছরের গান’।
গ্রীষ্ম—’প্রখর দারুণ অতি দীর্ঘ দগ্ধদিন।’ বর্ষা—’গহন মেঘের ছায়া ঘনায়।’ শরৎ— ‘স্বপনে বাজে গো বাঁশি!’ হেমন্ত—’জ্বালাও আকাশ প্রদীপ।’ শীত—না না যেও না/ও শেষ পাতাগো শাখায় তুমি থাকো।’ বসন্ত—’কে তুমি তন্দ্রা হরণী?’
মান্নাদা নিজের সুরে রেকর্ড করলেন গানগুলো। দুঃখের বিষয়, সুরকার মান্নাদার মূল্যায়ন আজও হয়নি। উনিও নিজের সুর করা অনেক গান অনিবার্য কারণে ওঁর অনুজ ভ্রাতার নাম দিয়েছেন। এইচ. এম. ভি-তে গাওয়া সুরকার অনুজ ভ্রাতার নাম বসানো অনেক গান ওঁর জামাতা জ্ঞানবাবাজীবনের প্যারামাউন্ট ক্যাসেটে আবার সুরকার হিসাবে নিজেরই নাম বসিয়েছেন। পরবর্তী কালে যে কোনও সংগীত গবেষকই এ-ব্যাপারে বিভ্রমে পড়বেন, এ তো অবশ্যম্ভাবী।
মান্নাদা কিন্তু বাংলা ছবিতেও সংগীত পরিচালনা করেছেন। যেমন ‘রামধাক্কা’। লতাজির গাওয়া ‘দেখো না আমায় ওগো আয়না’ (যেটা লতাজি এখনও আমাকে মাঝে মাঝে বলেন ‘আয়নাওয়ালা গানা) তা ছাড়া ‘ললিতা’, ‘শেষ পৃষ্ঠায় দেখুন’, ‘বাবুমশাই’ ইত্যাদি।
মান্নাদার অনেক গান লিখে আমায় বহু মানুষের বহু প্রশ্ন শুনতে হয়েছে। ‘সে-আমার ছোটবোন’ লেখার পর শুনতে হয়েছে। কার ছোট বোন ক্যান্সারে মারা গেছেন, মান্নাদার না আমার?
‘সারাজীবনের গান’-এর অ্যালবামের মৃত্যু বিষয়ক গানটি—আমায় চিনতে কেন পারছ না মা/সবই গেলে ভুলে?’ শুনে আমার মা আমাকে বলেছিলেন, আমি বেঁচে থাকতে এ গান কেন তুই লিখলি? আমায় মিথ্যে বলতে হয়েছে, বিষয়টা মান্নাদা দিয়েছেন আমি শুধু লিখে গেছি। মান্নাদে-ও ওঁর মায়ের একই প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, পুলকবাবু লিখে দিয়েছেন—আমি গেয়ে গেছি মাত্ৰ।
একবার মান্নাদাকে বম্বেতে ফোন করার জরুরি দরকার। তখন এস. টি.ডি. ছিল না। ছিল শুধু ট্রাঙ্ককল। কিছুতেই লাইন পাচ্ছি না। শেষকালে মহিলা অপরারেটরকে বিনীতভাবে বললাম, এটা মান্নাদে-র নাম্বার, খুব দরকার। দয়া করে দিয়ে দিন। ভদ্রমহিলা জবাব দিলেন—কোন মান্নাদে, যিনি বিখ্যাত গায়ক?
এবার আমায় প্রশ্ন করলেন—আপনি কে? নাম বললাম। বললেন, আগে বলবেন তো। ফোনটা রাখুন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে পেয়ে গেলাম লাইন। কথা হয়ে গেল। আবার টেলিফোন বাজল। পেলাম সেই মহিলা অপারেটারের কণ্ঠ। উনি জানতে চাইলেন—আপনার লেখা মান্নাদে-র গাওয়া তুমি নিজের মুখে বললে যেদিন/সবই তোমার অভিনয়’ গানটি কোনও বাস্তব ঘটনাকে নিয়ে লেখা, না নিছক কবি-কল্পনা? গম্ভীর কণ্ঠে বললাম, ধরুন, যদি বাস্তব ঘটনাই হয়, তা হলে? জবাব দিলেন—যাঁকে নিয়ে লিখেছেন, উনি এ গানটি শুনেছেন?
বললাম—শুনে থাকবেন, খুবই হিটগান। তবে আমি নিজে তাঁকে কখনও শোনাইনি। এবার বেশ রাগের সঙ্গেই ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন—এ গান শোনার পরও আপনার কাছে উনি ক্ষমা চাননি? কেটে দিলেন লাইনটা।
টেলিফোনে আমাকে সমবেদনা জানানো ওঁর কণ্ঠস্বর আজ পর্যন্ত আর শুনিনি।
‘আমায় একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি/ আমি অনাহূত একজন/অনেক দোষেতে দোষী।’ গানটি যত দিন যাচ্ছে তত বুঝতে পারছি, এ গান শ্রোতাদের মনের কোন তন্ত্রীতে রণন তুলেছে। যেখানে যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে—পাচ্ছি এ গানের প্রশংসার উত্তপ্ত আন্তরিকতা। কত টেলিফোন—কত চিঠি তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু এ গান কেন লিখলাম—কেন এই ভার আমার মাথায় এল আমার অন্তর্যামী ছাড়া সে কথা কেউ জানে না। আজ প্রথমেই সে ঘটনাটা বলছি। ১৯৯৬-এর পুজোর ক্যাসেটে এইচ এম ভি-র জন্য মান্না দে-র অ্যালবাম করেছিলাম ‘আমি দেখেছি। আমাদের দুজনার দেখা সেই কলকাতার হারানো দিনের নষ্টালজিয়ার গীতিরূপ। যখন সবুজ রঙের দুপুরে সস্তা ভাড়ার ট্রাম চলত। চলত হাওড়া শিয়ালদহ—মার্টিন কোম্পানির লাইট ট্রেন। ‘চোঙাওয়ালা কলের গান’—এমন এক-একটি বিষয় নিয়ে করেছিলাম আটটি গানের পুরো অ্যালবাম। বিদগ্ধ শ্রোতা ও সমালোচকের অনেক প্রশংসাও পেয়েছিলাম। কিন্তু যাকে আমরা ক্যাসেটের মেজর বায়ার বলি, কেন জানি না সেই আঠারো থেকে আঠাশ বয়সি শ্রোতাদের ধরতে পারলাম না। তখন থেকেই চিন্তা হতে লাগল আগামী বছরে অর্থাৎ ১৯৯৭-তে মান্নাদার জন্য কী ধরনের অ্যালবাম বানাই! ‘আমি দেখেছি’ ক্যাসেটটির পাবলিসিটি মান্নাদার মনোমতো হয়নি বলে এইচ.এম.ভি-র ওপর মনে মনে ক্ষুব্ধ ছিলেন মান্নাদা। গাথানি রেকর্ডস-এর শশী গাথানি এই সুযোগটা কাজে লাগালেন। মান্নাদাকে সরাসরি বললেন—এবার আমাদের সঙ্গে কাজ করুন। পালবিসিটির ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দিন। যথারীতি মান্নাদা, আমার সঙ্গে আলোচনা করে গাথানিতে অ্যালবাম বানাতে রাজি হলেন ওই একটি প্রধান শর্তে।
এর পর আমার চিন্তা কী গান করি? এর কিছুদিন আগেই ভুবনেশ্বর গিয়েছিলাম একটি তখনকার নির্মীয়মান উড়িয়া-বাংলা ছবির—মাদ্রাজের বিখ্যাত প্রযোজক ও পরিচালক রামানারায়ণের, সম্ভবত ‘নাগ জ্যোতি’ ছবির বাংলা সংলাপ ও গান রচনা করতে। যার সুরকার ছিলেন ওড়িশার নামী সংগীত পরিচালক প্রফুল্ল কর।
মনে আছে, উঠেছিলাম ভুবনেশ্বর হোটেলে। কাজ শুরু করার আগে ধর্মভীরু আমি বার হলাম মন্দিরে প্রণাম করতে। সেই সময়েই দেখলাম এক মন্দিরে বেশি ভিড়। বোধহয় কোনও বিশেষ পুজোর তিথি-টিথি থাকবে। ঠিক করলাম এখানেই প্রণাম করে লেখা শুরু করি। কিন্তু এত ভিড় যে চত্বরে ওঠারও জায়গা নেই। এদিকে পুজোর আরতি আরম্ভ হব হব হয়ে গেছে। এই পরিবেশেই মনে এল— ‘আমায় একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি/আমি অনাহূত একজন/অনেক দোষেতে দোষী।’
ওখানে প্রণাম সেরে এসে, হোটেলে আমার ঘরে ঢুকেই লিখে ফেললাম পুরো গানটি। গানটি আমার গানের খাতায় লেখা পড়েই ছিল।
হঠাৎ অন্ধকারে আলো দেখলাম। এই গানের বিষয়বস্তু নিয়ে মান্নাদার নতুন আটটি গান করলে কেমন হয়। যার নাম হবে ‘মা আমার মা’। বসে গেলাম। রচনা করে ফেললাম আরও কয়েকটি গান। এ-গানগুলো সব মায়ের উদ্দেশে আমার প্রণাম। মন্দিরের মা, ঠাকুর ঘরের মা আর আমার জন্মদাত্রী মায়ের কোনও পার্থক্য আমি রাখলাম না! মা হলেন চিরকালের মা, যে কোনও ধর্মের মা—যে কোনও রক্তের মা। যে মায়ের উদ্দেশেই আমি লিখতে পেরেছিলাম—’মার মমতার কী ক্ষমতা’! ব্যাপারটা বললাম মান্নাদাকে। উনি কিন্তু তেমনভাবে সাড়া দিলেন না। উনি সম্ভবত ভেবে নিলেন, তথাকথিত ধর্মসংগীত এবং এই তথাকথিত ধর্মসংগীতে একবার সাফল্য পেলে তার থেকে মুক্তি পাওয়া খুবই কষ্টের। এ ভাবনাটা অন্তত ওঁর পক্ষে দোষের নয়। প্রথম জীবনে মুম্বই-এর হিন্দি ছবিতে মান্নাদা কিছু নারদের গান বা রামভক্ত ভগবান হনুমানের কণ্ঠে গান গেয়েছিলেন। সে সব গান হিট হওয়ার ফলে, কেউ-ই তখন সাধারণ রোমান্টিক গানে প্লে-ব্যাক করতে ওকে ডাকত না। বহু কষ্টে এই ভক্তিগীতির ছাপটি উনি কাটাতে পেরেছেন। আমার স্থির বিশ্বাস হল নিশ্চয়ই এরই জন্য উনি এই অ্যালবামটির প্রতি নারাজ। আমি যতবারই এই গানের প্রস্তাব নিয়ে ওঁর কাছে এগিয়ে আসি ততবারই উনি ছলে-অছিলায় সে প্রস্তাব এড়িয়ে চলে যেতে লাগলেন। শেষে একদিন মুম্বইতে ওঁর ‘আনন্দন’ বাসগৃহে ডিনার খাবার আগে আড্ডা মারতে মারতে, ওঁর মুড বুঝে পকেট থেকে গানের কথাগুলো বার করলাম। ওঁকে শোনালাম প্রতিটি গান অবাক হয়ে দেখলাম, শিল্পী মান্নাদে চোখের জলে ভাসতে প্রতিটি গান মন দিয়ে শুনলেন। বললাম—এ তো তথাকথিত ভক্তিমূলক গান নয়, এক ব্যতিক্রমী মাতৃসংগীত। আরও বললাম—আপনি তো আমার লেখা প্রচুর মাতৃসংগীত গেয়েছেন, যেমন—’মা মা গো মা/আমি এলাম তোমার কোলে’, ‘তুমি যে মা সব চেয়ে আপন’, ‘আমি হারিয়েছি মোর ছোট্ট বেলা/হারাইনি তো মাকে।’ ‘আমায় চিনতে কেন পারছে না মা/সবই গেলে ভুলে?’ আমার থামিয়ে দিয়ে অশ্রু রুদ্ধ কণ্ঠে মান্নাদা বললেন, হ্যাঁ, আপনার লেখা এই ধরনের প্রতিটি গানই আমার অন্তরে গেঁথে আছে পুলকবাবু। আমি আমার মাকে আমার বাবার থেকে বেশি ভালবাসতাম—আপনিও বোধহয় তাই। আমি এই অ্যালবাম করব। আমারও তখন আবেগে বাগরুদ্ধ হয়ে এসেছিল। বলেছিলাম—আমি মায়ের কোলের ছেলে। আমার ওপর মায়ের প্রভাব তাই এত বেশি!
কিন্তু তখন ১৯৯৭-এর সম্ভবত আগস্ট মাস। পুজোর গানের সময় পেরিয়ে গেছে। মান্নাদা বললেন—এ বছর তা হলে থাক। ভালগানের কোনও সময়ের পরিধি নেই। যখন প্রকাশিত হবে তখনই তা আদৃত হবে। আমি এটা আর বছর অর্থাৎ ১৯৯৮ সালের পুজোর জন্য করব। চার-পাঁচ মাস ধরে শুধু গাইব আর গাইব। আপনি সুরকারের সঙ্গে বসে যান। বললাম—আপনিই সুর করুন। বললেন—না। এই সাবজেক্টে আমি আর একটা ডিফারেন্ট ব্রেন চাইছি। তখন আমরা নির্বাচন করলাম সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কিন্তু অনিবার্য কারণে উনি সরে গেলেন। এবার আমরা বসে গেলাম মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। মৃণাল গানের সুর করে রাখতে লাগল। যখনই মান্নাদা কলকাতায় আসতেন তখনই বসত আমাদের এই অ্যালবামের গান নিয়ে মহড়া। আমি যখনই মুম্বাই যেতাম তখনই মান্নাদা বলে উঠতেন, আচ্ছা, এ গানটা না করে সেদিন আপনি যে আর একটা গান শোনালেন সেটা করলে কেমন হয়? কথাটা শেষ করেই আবার বলে ফেলতেন—আহা পুলকবাবু কী লিখেছেন—’যখন এমন হয়/জীবনটা মনে হয় ব্যর্থ আবর্জনা/ভাবি গঙ্গায় ঝাঁপ দিই রেলের লাইনে মাথা রাখি/ কে যেন হঠাৎ বলে আয় কোলে আয়/আমি তো আছি ভুললি তা কি? মা, সে কি তুমি?’ আর মৃণাল দারুণ সুর করেছে, বলেই, কিছুটা গেয়েই হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে গান থামিয়ে দিতেন।
এই ভাবে সুদীর্ঘ অনুশীলনের পর যখন বেহালার অডিও সেন্টার স্টুডিয়োতে গান রেকর্ড করতে এলেন, তখনও কতবার যে গাইতে গাইতে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে উনি থেমে গিয়েছিলেন—তার ইয়ত্তা নেই। যা হোক, রেকর্ডিং শেষ করে উনি একটা ক্যাসেটের কপি নিয়ে ফিরে গেলেন মুম্বইতে। বলে গেলেন, ওখানে একমনে নিরিবিলিতে গান শুনে আমার মতামত টেলিফোনে জানাব। যথারীতি টেলিফোন এল।
শশীভাইকে বললেন—আর একটা রেকর্ডিং ডেট নিন। আমি কিছু কিছু অংশ আবার রিটেক করব। সেবার কলকাতায় এলেন কোনও জলসা বা অন্য কিছু কাজের জন্য নয়—শুধু মাত্র ‘মা আমার মা’-র কিছু কিছু গানের, কিছু কিছু অংশ ‘রিডাব’ করার জন্য।
এই অধ্যবসায়, এই একাগ্রতা, এই একনিষ্ঠতার জন্যই বোধ হয় ‘মা আমার মা’ মায়ের আশীর্বাদ পেল। আমার কথা, মৃণালের সুর, মান্নাদার কণ্ঠ—আমি যা আশঙ্কা করছিলাম—তাকে ধুলিসাৎ করে দিয়ে শুধু বয়োজ্যেষ্ঠ নয়—আমরা যাকে সেই ‘মেজর বায়ার’ বলি অর্থাৎ সেই আঠারো থেকে আঠাশ বছরের শ্রোতাদেরও আগ্রহ জাগাল, জাগাল এক অপূর্ব আত্মসচেতনতার উম্মাদনা। তথাকথিত হিন্দি সিনেমার সুরের আধুনিক বাংলা গান বা হিন্দি ফিল্মের গানের ভার্সানের বাংলা গান—কিংবা ‘রিমেক ছেড়ে দিয়ে, সবাই অন্তর দিয়ে গ্রহণ করল নতুন এক চিরকালের মায়ের গান। বুঝল, সত্যিই ‘আমি দুচোখ দিয়ে ভুবন দেখি/মায়ের দেখা পাই না/আমি হাজার গান তো গেয়ে শোনাই/মায়ের গান গাই না।’
সেদিন অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায় আমায় ফোন করে অভিনন্দন জানালেন। শুধু আমাকে নয়, সুরকার মৃণাল বন্দোপাধ্যায়কেও জানালেন আন্তরিক শুভেচ্ছা। আর এই অ্যালবামের মান্না দের প্রসঙ্গে শুধু বললেন— পুলকবাবু, একটা কথা মুক্তকণ্ঠে বলতে ইচ্ছে করছে—এ প্রজন্মের এখানকার কণ্ঠশিল্পীরা, প্রত্যেকে এখনও বছর দুই, এই বয়সের মান্না দে’র কাছে তালিম নিক—কেমন করে গান গাইতে হয়। তারপর তারা যেন মাইকের সামনে দাঁড়ায়।
হয়তো আমাকে বলা অভিজিৎবাবুর এই উক্তি সবাইকে শুনিয়ে দেওয়ায় (সব নয়) কিছু কিছু এখানকার এ প্রজন্মের গায়ক-গায়িকারা অসন্তুষ্ট হবেন, তবু আমি এ কথাটা শুনিয়ে দিলাম এই জন্যে, আরও যারা ভবিষ্যতের শিল্পী গানের জগতে আসছেন বা আসতে চাইছেন তাঁরা যেন মান্না দে’র এই আদর্শে দীক্ষিত হয়ে নিজেদের প্রকৃত শিল্পী করে মা সরস্বতীর আরাধনা করতে পারেন।
আমি সর্বত্র একটা কথা বলে এসেছি—‘হেমন্ত মুখার্জি ইজ বরন্, মান্না দে ইজ মেড।’ এটা চরম সত্য কথা।
কৃষ্ণচন্দ্র দে’র সঙ্গে মুম্বই গিয়ে রয়ে গেলেন ওখানে। একটা মেসবাড়ির মতো ঘরে থেকে বিভিন্ন নামী সুরকারের সহকারী হিসেবে জীবনের লড়াই শুরু করে দিলেন। কত প্রতিবন্ধকতা, কত নিষ্ঠুর ছলনা-কপটতার মধ্যে দিয়ে গায়ক মান্না দে একটা একটা পাথর ফেলে নিজের উত্তরণের রাস্তা বানিয়ে নিয়েছেন, তা বলতে গেলে এখনও তাঁর চোখে জল চিকমিক করে ওঠে। তবে একটা কথা, মান্না দে মানেই আনন্দ।
ওঁর কাছে যে ভালবাসা আমি পেয়েছি তা শোধ করা আমার পক্ষে কোনও জন্মেই সম্ভব নয়। সম্ভব নয় মান্না দে সম্বন্ধে কথা বলার কোনও প্রান্ত রেখায় দাঁড়ানো।
অনেক কথা বললাম। আমারই লেখা ওঁরই গানের মুখড়া ‘কথায় কথায়’ দিয়ে শুরু করেছিলাম এই লেখা। সময় সুযোগ পেলে অবশ্যই আবার নতুন কিছু লিখব। কিন্তু এখন বারবার মনে হচ্ছে, কত কথা বললাম, জানি না কত কথা বাকি রইল! শুনতে পাচ্ছি মান্নাদা এখন আমার গানটি গাইছেন ‘কথায়-কথায় রাত হয়ে যায়/কী কথা রাখলে বাকি?’
***