৬৫
একবার পুজোর গানের জন্য তরুণ হঠাৎ এসে বলল, চলো, বোম্বাই যাই। রাহুল দেববর্মণের সুরে পুজোর গান গাইব।
আমি বললাম, পঞ্চম এখন খুবই ব্যস্ত। বাংলা গান নিয়ে বসতেই পারবে না। ও শুনল না। বলল, তুমি আমি দুজনে ধরলেই কাজ হবে। তুমি যাবে কি না বলো?
বাধ্য হয়ে যেতে হল। তরুণ একেবারে নিশ্চিন্ত ছিল ওর গান হবেই। তখন মহারাষ্ট্রের রেভিনিউ স্ট্যাম্প আলাদা ছিল। ওখানে গিয়ে পেমেন্টের রশিদের জন্য প্রথমেই কিনে ফেলল অনেকগুলো রেভিনিউ স্ট্যাম্প। গেলাম পঞ্চমের বাড়িতে। পঞ্চমকে আড়াল করে রাখতেন ওর এক বন্ধু বাংলা গানের গীতিকার স্বপন চক্রবর্তী। স্বপনবাবুকে ডিঙিয়ে তখন পঞ্চমের কাছে পৌঁছনো সত্যিই দুঃসাধ্য। আমার লেখা এবং লতাজির গাওয়া ‘আমার মালতী লতা’ এবং ‘আমি বলি তোমায়’ এই দুটি গানের মাধ্যমেই তো পঞ্চমের বাংলা গানের জগতে প্রথম পদক্ষেপ। তাই হয়তো সেবার পঞ্চমের কাছে পৌঁছতে পেরেছিলাম।
পঞ্চম তরুণকে বুঝিয়ে বলল, আমি আপনার গানের ফ্যান। কিন্তু এখন তো আমার হাতে সময় নেই। দু-তিন মাস আগে থেকে না বললে আমার সময় বার করা অসম্ভব।
তরুণ বলল, আমি এক মাস অপেক্ষা করব। দু-তিন মাস বাদে হলে তো পুজো পেরিয়ে যাবে।
স্বপনবাবু পঞ্চমের ডায়েরি খুলে দেখালেন দু-তিন মাস পর্যন্ত কোনও ডেট নেই। কলকাতায় ফিরে এসেই তরুণ বলল, আমি এবার তা হলে নিজের সুরে গান করব। তুমি আমার বাড়িতে সিটিং করো। আজকের মুম্বই-এর ব্যস্ত অ্যারেঞ্জার খোকন চৌধুরীকে নিয়ে আমি, তরুণ আর তরুণের স্ত্রী বসলাম সিটিং-এ। তৈরি হল ‘ও সোলেমান সোলেমান’। তরুণের গানের সিটিং-এ কী কথা কী সুর তার চূড়ান্ত অনুমোদনের কাজটি করতেন তরুণের পত্নী মীরাদেবী। এমনও হয়েছে রাতের অধিবেশনে কথা সুর সবার ভাল লাগলেও পরদিন সকালে মীরাদেবী একবার ভুল করেও যদি বলতেন, না তেমন হয়নি তা হলে আবার নতুন করে আমাদের অধিবেশন করতে হত। কেবলমাত্র দুবার এর ব্যতিক্রম দেখেছিলাম।
একবার মান্না দে’র সুরে তরুণের পুজোর গান ‘আমার মনকে নিয়ে…’ এবং সুধীন দাশগুপ্তের সুরে ‘জঙ্গলে ঝড় এল…। গানগুলো আমারই লেখা ছিল। এই দুবার দেখেছিলাম মীরাদেবী কোনও মতামত প্রকাশ্যে দেননি। সোজাসুজি অনুমোদন করেছিলেন। একবার মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে তরুণের পুজোর গান লিখেছিলাম। এক পিঠে ছিল ‘এক দিন তো আমরা সবাই চলে যাব’ অন্য পিঠে ছিল ‘প্রেম তো কথার কথা নয়’। গানটা নিয়ে মৃণাল আর আমি যখন হিমশিম খাচ্ছি, কিছুতেই ওকে ভাল লাগাতে পারছি না, তখন মীরাদেবীর একটা বেফাঁস উক্তিতে ওঁর এই মানসিকতাটির আসল কারণ যে এক ধরনের কমপ্লেক্স, তা মুহূর্তে আমার কাছে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। উনি কথা প্রসঙ্গে বলে ফেলেছিলেন, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় আপনার যত পুরনো বন্ধুই হোক, মান্না দে-কে আপনি যে গান লিখে দেন তরুণকে তা লিখে দেন না। কথাটা শুনে চমকে উঠেছিলাম আমি। বন্ধুপত্নীকে কিছুতেই বোঝাতে পারিনি, মান্না দে’র গলায় যে গান ভাল লাগবে তরুণের গলায় তা ভাল লাগতে পারে না। একই সময়ে আমি মান্না দে-কে লিখে দিয়েছি, ‘যখন কেউ আমাকে পাগল বলে’, আর হেমন্তদার জন্য লিখেছি ‘কতদিন পরে এলে একটু বসো। দুটো গানই সুপারহিট। কিন্তু হেমন্তদাকে যদি দিতাম যখন কেউ আমাকে পাগল বলে’ এবং মান্নাদাকে ‘কত দিন পরে এলে’ তবে দুটো গানই তো মার খেত। আমার এই যুক্তি তখনকার মতো মেনে নিলেও কোনওদিনই এই কথাটা আন্তরিকভাবে মেনে নেননি উনি।
তরুণ আবার সব কাজেই স্ত্রীর পরামর্শ নিত। ব্যাপার দেখে এক এক সময় আমার রাগও হত, আবার এক এক সময় মুগ্ধও হয়ে যেতাম।
তরুণ হঠাৎ একদিন আমায় নিয়ে গেল ওর ভবানীপুরের বাড়ির ছাদের ওপর। বেশ খোশ মেজাজেই বলল, দেখ, আমার বউ এখন রীতিমতো ব্যবসা করছে। তোর ভাইয়ের মতো। অ্যালসেশিয়ান কুকুরের বাচ্চার ব্যবসা।
তারপর হাসতে হাসতে আরও বলল, শ্যামল মিত্ররা দিনকতক জুতোর ব্যবসা করেছিল। দেখা যাক আমাদের ব্যবসা কতদিন থাকে।
তরুণের শাশুড়ি হঠাৎ এক দিন নিরুদ্দেশ হয়ে যান। ওঁকে আর ফিরে পাওয়া যায়নি। আশ্চর্যের ব্যাপার তরুণের ভাগ্যেও তাই হল। জীবনের অপরাহ্ন বেলায় হঠাৎ এক দিন নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন তরুণের প্রিয়তমা মীরাদেবী। ওঁকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। এই আঘাতটা সহ্য করতে পারেনি তরুণ। আমি লক্ষ করতাম মাঝে মাঝে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলত তরুণ।
কবি শৈলেন রায় যে তরুণের জন্য ‘কত কথা প্রাণে জাগে’ এই গান লেখার পর আমার সামনে ওকে বলেছিলেন, তরুণ তোর কী সুন্দর নাম রে। কোনও দিনও তুই বৃদ্ধ হবি না। চিরকাল তরুণ থাকবি। তোর নাতিও তোকে ডাকবে তরুণ দাদু’ বলে।
এ হেন চিরতরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি বার্ধক্যের হতাশায় দিন কাটাতে দেখেছি। স্ত্রীর বিরহে তরুণ এভাবেই মুখের হাসির অন্তরালে গোপনে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতে ফেলতে এক দিন আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আমার কানে বাজতে লাগল আমারই লেখা ওর গান ‘একদিন তো আমরা সবাই চলে যাব’। তরুণের একটি কন্যা। দারুণ হাত দেখে। খুবই নাম যশ।
তরুণের ছেলে শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়। আগে তরুণের সঙ্গে গিটার বাজাত। তরুণের পুত্র সন্তান এই একটি। এখন ও গান গাইছে। বেশ ভালই গাইছে। আমি চাই ওর বাবার মতো বড় হয়ে উঠুক। তরুণের নাম রাখুক।
আগেই বলেছি গীতিকার স্বপন চক্রবর্তী পঞ্চমকে প্রায় আগলে রাখতেন। ক্রমশ সেই স্বপন চক্রবর্তী গীতিকার থেকে সুরকার হয়ে গেলেন। আমায় একদিন নিজের কথা শোনাতে শোনাতে স্বপনবাবু বলেছিলেন, জানেন একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া গানপাগল এই আমি মুম্বই-তে এসে দেখা পেলাম পঞ্চমের। ব্যস, দুজনের দারুণ জমে গেল। রয়ে গেলাম এখানেই। আমি জানি অনেকেই বলেন, আমি নাকি অন্য গীতিকারদের পঞ্চমের কাছে আসতে দিই না। কথাটা যে সত্য নয় তার প্রমাণ হল গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, মুকুল দত্ত, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় তা হলে পঞ্চমের গান লিখলেন কী করে? আসলে আমি পঞ্চমের হঠাৎ আসা সুরগুলো কথা দিয়ে ধরে রাখি। সেগুলো যাতে হারিয়ে না যায়। এর বাইরে আর কিছু নয়। যাতে সত্যিকারের গীতিকারদের আমার এই এলোমেলো কথাগুলোর ওপর নতুন ভাল গান লেখার সুবিধা হয়। এটাই আসল কারণ। জানেনই তো পঞ্চম কেমন ব্যস্ত। হঠাৎ বাংলা গানের দরকার হলে তৎক্ষণাৎ আপনাদের কোথায় পাব? তাই পঞ্চম আমার লেখা গানগুলোই মাঝে মাঝে রেকর্ড করে দেয়। আশ্চর্যের ব্যাপার, পঞ্চমের দারুণ সুরে আর আশাজির অসাধারণ গাওয়ার গুণে সেই গানগুলো সুপারহিট হয়ে যায়। আমি তো সেখানে নগণ্য।
আমি বললাম, নগণ্য কী বলছেন? আপনার ‘এনে দে রেশমি চুড়ি’ গানটার মধ্যে একটা চমৎকার ছবি আছে। আমি দারুণ পছন্দ করি।
স্বপনবাবু বললেন, ব্যক্তিগতভাবে আপনি আমায় পছন্দ করেন বলে হয়তো এ-কথাটা বললেন। কিন্তু আমি জানি কলকাতার অনেক গীতিকারই আমায় পছন্দ করেন না।
বিনয়ী স্বপন চক্রবর্তী আমায় আরও বললেন, এইবার তাই আমি সুরকার হব মনস্থ করেছি। সুরকার ও গীতিকার স্বপন চক্রবর্তীর যে সুপারহিট গানটির কথা মনে আসছে সেটি হল ‘মোহনার দিকে’ ছবিতে আশাজির গাওয়া ‘আছে গৌর নিতাই নদিয়াতে’।
সুরকার হওয়ার জন্য সম্ভবত পঞ্চমের সঙ্গে একটু অমিল হল স্বপনবাবুর। দুজনের সম্পর্কের মধ্যে একটা ফাটলও ধরল। সেই কারণে স্বপনবাবু মুম্বই-এর সান্তক্রুজের ফ্ল্যাট বিক্রি করে চলে এলেন কলকাতায়। সল্টলেকে কিনলেন ফ্ল্যাট।
কলকাতায় এসে কিন্তু একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন উনি। সম্পূর্ণ বর্জন করেছিলেন’ পানীয়। পঞ্চম সারা জীবনে যেটা পারল না। উনি দুর্দান্ত মনের জোরে অনায়াসে সেটা করে ফেললেন। আমি যখন কলকাতায় ওঁকে প্রথম দেখলাম, দেখেই চমকে উঠেছিলাম। ধারণাই করতে পারিনি এমনটি স্বপন চক্রবর্তী কোনওদিন হবেন।
রামকৃষ্ণের অভিনয় করার পর থেকে যেমন মিঠুন চক্রবর্তী আজ পর্যন্ত সুরা স্পর্শ করছে না। সম্পূর্ণ বর্জন করেছে। এবং শাকাহারী হয়ে গেছে। স্বপন চক্রবর্তীও কেন জানি না কোনও কারণে তেমন হয়ে গেলেন।
হঠাৎ একদিন এই স্বপনবাবুর টেলিফোন পেলাম। উনি বললেন, আমি সুকান্ত রায়ের (অভিনেতা দিলীপ রায়ের ভাইপো) নতুন ছবি ‘সর্বজয়া’-তে সংগীত পরিচালনা করছি। আমি কিন্তু একটা গানও লিখছি না। সব গান লিখতে হবে আপনাকে।
সুঅভিনেত্রী কল্যাণী মণ্ডলের স্বামী তরুণ সুদর্শন চিত্র পরিচালক সুকান্তর আগের ছবিতেও আমি গান লিখেছিলাম। স্বপনবাবুর কাছেই জানলাম, আমার নাম বলাতে উনি সানন্দে সম্মতি দিয়েছেন। টেলিফোনেই স্বপনবাবুকে বললাম, ধন্যবাদ। আমি খুব খুশি। কিন্তু আপনি লিখছেন না কেন?
উত্তরে সেই পুরনো কথাটা উনি বললেন, মুম্বই-তে আপনাকে চাইলে কোথায় পাব? কিন্তু এখন সে সমস্যা নেই। এখন তো কলকাতায় আছি। এবার থেকে আমার সব ছবিতে আপনাকে গান লিখতে হবে। এ কথা যেন কোনও দিনও নড়চড় না হয়।
‘সর্বজয়া’ ছবিতে স্বপনবাবুর সঙ্গে গান লিখতে লিখতে বুঝেছিলাম স্বপনবাবুরও সুরের ওপর এবং স্ক্যানিং-এর ওপর অর্থাৎ গান বিভাজনের ওপর দারুণ দখল। মনে হচ্ছে, সত্যিই আমি সৌভাগ্যবান। গীতিকার সুরকার সলিল চৌধুরীর গান (কবিতায় গান নয়) যেমন আমি ছাড়া অন্য কোনও গীতিকার কখনও লেখেননি। তেমনি গীতিকার সুরকার স্বপন চক্রবর্তীর গানও আমি ছাড়া অন্য কোনও গীতিকার লিখতে পারেননি। আমি যখন স্বপনবাবুর পরবর্তী আহ্বানের জন্য অপেক্ষা করছি তখনই খবর পেলাম হঠাৎ চলে গেলেন এই চিরকুমার মানুষটি পৃথিবীর সব বন্ধন কাটিয়ে।
সেদিন নামী চিত্রপরিচালক বীরেশ চট্টোপাধ্যায়ের চিত্রনাট্যকার অনিমেষের সঙ্গে ওঁর ব্যাপারে কথা হচ্ছিল। স্বপনবাবু অনিমেষের আপন মামা। অনিমেষ সখেদেই বলছিল, মামার জন্য কেউ কিছু করল না। আপনি অন্তত কিছু করুন। স্বপন চক্রবর্তীকে শ্রদ্ধা জানানো ছাড়া আমি আর কী করতে পারি। কত প্রতিভা তো এমন করে ধীরে ধীরে স্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়।
বাংলা গানের শিল্পীদের সর্বকালের সেরা তালিকায় যাঁরা থাকবেন তাঁদের মধ্যে প্রথম সারির শিল্পী হলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। আমার জীবনের প্রথম গানটি ‘অভিমান’ ছবিতে গেয়েছিলেন এই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সেই জন্য কিনা জানি না ওঁর গান শুধু আমার নয় আমার মায়েরও খুব প্রিয় ছিল। ওঁর গাওয়া আমার লেখা, ‘হরেকৃষ্ণ নাম দিল/প্রিয় বলরাম’ গানটি আমার মা যখন তখন গ্রামোফোনে শুনতে চাইতেন। যখন থেকে ওঁর সঙ্গে আলাপ তখন থেকেই দেখেছি ওঁর সঙ্গে আছেন ওঁর বড়দা রবীন মুখোপাধ্যায়। গানের ব্যাপারে কম্প্রোমাইজ ওঁরা কোনওদিনই করেননি। যতদুর স্মরণে আসছে সন্ধ্যা আমার লেখা প্রথম ননফিল্মি আধুনিক গান করেন নচিকেতা ঘোষের সুরে। গান দুটি ছিল ‘দিন নেই ক্ষণ নেই’ এবং ‘নেব না সোনার চাঁপা’। কোনও রকম ভণিতা ছাড়াই উনি আমায় বলেছিলেন দারুণ দুটি গান লিখেছেন। এমন আরও লিখুন গাইব। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কথা বলতে গেলে বলে শেষ করা যাবে না।
৬৬
সন্ধ্যা অনেক বড় মাপের শিল্পী। সেই ‘অঞ্জনগড়’ ছবিতে রাইচাঁদ বড়ালের সুরে ‘গুন গুন গুন গুন মোর গান’ এবং বেসিক আধুনিক গান ‘তোমার আকাশে জাগে চাঁদের আলো’— থেকে পরপর শুধু জয়ের ইতিহাস। এ সব কথা অনেকেই জানেন তাই সেই সব কথা এখানে না বলে যে সব ঘটনার সাক্ষী আমি ছাড়া খুব কম মানুষই আছেন সেই সব ঘটনার কথাই বলব।
এইচ. এম. ভি-র তখন গান নির্বাচন করতেন পি কে সেন। উনি শিল্পীদের তালিকা দেখে ঠিক করতেন কোন সুরকার কার গান সুর করবেন, কোন গীতিকার কার গান লিখবেন। শিল্পীরা জানতেনই না কারা তাঁর গান তৈরি করছেন। গান তৈরি হলে মি. সেন রিহার্সাল রুমে এসে শুনতেন। শুনে পবিত্র মিত্রের সঙ্গে আলোচনা করে অনুমোদন করতেন সে গান। তাঁর অনুমোদিত গানই প্রায় সব শিল্পীরা গাইতে বাধ্য থাকতেন। ওঁদের গান সম্পর্কে কিছু বলার কোনও অধিকারই থাকত না। এইচ. এম. ভি-র চুক্তিবদ্ধ প্রত্যেক শিল্পীকেই এই নির্দেশ মানতে হত। তখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রেকর্ড বছরে তিনবার হত। উনিও হাসিমুখে সেই নির্দেশ মানতেন, তবে একটু বুদ্ধি খাটিয়ে। অর্থাৎ একবার ওঁদের কথা মতো গান রেকর্ড করতেন, পরের-বার নিজের ইচ্ছে মতো। কর্তৃপক্ষ তাতে আপত্তি করতেন না। আমি তখন পবিত্র মিত্রের ইচ্ছের তালিকায় ছিলাম না। ছিলাম হেমন্তদার আন্তরিক ইচ্ছার তালিকায়। সেই ভাবেই হেমন্তদা পি কে সেনের আমলে রেকর্ড করেছেন আমার লেখা একাধিক গান। আমার লেখা ‘কোনও দিন বলাকারা’ এবং ‘জানি না কখন তুমি/আমার চোখে’ গান দুটি রেকর্ডিং করার সময় হেমন্তদার ইচ্ছে আর পবিত্র মিত্রের নির্দেশ এই দুয়ের মধ্যে দারুণ সংঘাত হয়েছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে আবার যখন বলব তখন সেই কাহিনী শোনাব।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ও এইভাবে এইচ. এম. ভি-র সঙ্গে মানিয়ে চলতে চাইতেন। কিন্তু সবসময়ে তা পারতেন না। পবিত্র মিত্রের কাছের যে সব শিল্পীরা ছিলেন তাঁরা এটাকে কিছুতেই সহ্য করতে পারতেন না। সব সময় পি কে সেন আর পবিত্রদাকে বলতেন। ওঁরা বলতেন, তা কেন হবে? ওঁরা এইচ. এম. ভি-র চুক্তিবদ্ধ শিল্পী। এইচ. এম. ভি যা বলবে তাই ওঁদের করতে হবে। ক্রমাগত এইভাবে বলাতে স্বাভাবিকভাবে ওঁরা একটু কঠোর হয়ে পড়েছিলেন। গোলমাল বাধল এই সময়েই সন্ধ্যার গান নিয়ে। সেবার সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় চাইলেন এবার ওঁর গান লিখবেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুর করবেন রবীন চট্টোপাধ্যায়, আর রেকর্ডে তবলা সংগত করবেন এইচ. এম. ভি-র মাইনে করা তবলিয়া নয়, বাইরের ফ্রিল্যান্স তবলিয়া রাধাকান্ত নন্দী। এইচ. এম. ভি. এই প্রস্তাব মানলেন না। আগেই বলেছি গানের ব্যাপারে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কোনও কম্প্রোমাইজ কখনও করেননি। উনিও তাই জোর দিয়ে বললেন, আপনারা যে সুরকার এবং গীতিকারের নাম বলছেন অস্বীকার করছি না, তাঁরা সবাই গুণী, কিন্তু আমি যাদের বেছে নিয়েছি তাঁরা আমার কাছে বেশি পছন্দের। ওঁদের গান না হলে আমি রেকর্ড করব না। রেকর্ডিং বন্ধ রাখলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। কেউই ওঁর সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারলেন না। তখনই আর একটা ঘটনা ঘটল। এম. পি. প্রোডাকসনসের উত্তম-সুপ্রিয়া অভিনীত ‘উত্তরায়ণ’ ছবিতে নায়িকা সুপ্রিয়ার ঠোঁটে শৈলেন রায়ের লেখা ‘মহুয়া বুঝি বা ডাকে’ গানটি ছিল। তখনকার পবিত্র মিত্র এবং পি কে সেনের খুবই কাছের এক মহিলা কণ্ঠশিল্পীকে দিয়ে ওই ছবির সুরকার রবীন চট্টোপাধ্যায় তিন-চার দিন ধরে ওই গানটির রিহার্সাল করিয়ে স্টুডিয়োতে নিয়ে গেলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় গানটি উনি আশানুরূপভাবে গাইতে পারলেন না। কারও পছন্দ হল না গানটি। শিল্পীকে ওঁরা যথাযথ পারিশ্রমিক দিয়ে বাধ্য হয়ে ফিরিয়ে দিলেন। তখনই আহ্বান জানানো হল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, রবীন চট্টোপাধ্যায়কে দারুণভাবে বুঝতেন। অনায়াসে গানটি তুলে নিয়ে চমৎকারভাবে গেয়ে দিলেন।
এইবার গ্রামোফোন রেকর্ড বার করার জন্য যখন এইচ. এম. ভি ‘উত্তরায়ণ’-এর এই গানটি শুনলেন, তখন ওই আগের ঘটনার কথা মনে রেখে অম্লানবদনে বললেন, গানটির সুর ভাল হয়নি। আমরা রেকর্ড করতে পারব না। তখন এখনকার মতো নিয়ম ছিল না। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী যে শিল্পী যে কোম্পানির সেই কোম্পানি ছাড়া অন্য কোথাও সেই শিল্পীর সিনেমার গানও প্রকাশিত হতে পারত না। তাই অগ্রদূতের হিট ছবি ‘উত্তরায়ণ’-এর গান গ্রামোফোন রেকর্ডে প্রকাশিত হল না। তখনকার মনোপলি প্রতিষ্ঠান এইচ. এম. ভি-র কিছু কর্তাব্যক্তির এ হেন আচরণে।
এই ব্যবহারটি কিন্তু সহ্য করতে পারেননি রবিদা। যাই হোক সুদীর্ঘ দিন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এইচ. এম. ভি-তে রেকর্ডিং বন্ধ রাখার পর স্বভাবতই ডিলারদের চাপে একটু বিব্রত হয়ে পড়লেন পি কে সেন। এদিকে অনুরাগীদের অনুরোধে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ব্যাপারটা মেনে নিলেন। সহজে মানেননি। তখনকার এক নামকরা মন্ত্রীকে এসে মধ্যস্থতা করতে হয়েছিল। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে এইচ. এম. ভি-তে রেকর্ড করতে রাজি করালেন ওই মন্ত্রী। শর্ত রইল একটাই। প্রথম রেকর্ডটার গান অবশ্যই লিখবেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুর দেবেন রবীন চট্টোপাধ্যায়। আর এইচ. এম. ভি-র যন্ত্রর সঙ্গে আমন্ত্রিত সংগতকার হিসাবে থাকবেন রাধাকান্ত নন্দী। রাধাকান্ত নন্দীর পারিশ্রমিক এইচ. এম. ভি দেবেন না, দেবেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নিজেই। ওই রেকর্ডটি থেকে শুরু হল এইচ. এম. ভি-র বাঁধা মাইনের এবং বাদ্যযন্ত্রের বাজেটের বাইরে যে কোনও বাদ্যযন্ত্রীকে রেকর্ডিং-এ নেওয়া যেতে পারে যদি সেই সেই বাদ্যযন্ত্রীর পারিশ্রমিক শিল্পী নিজে দিয়ে দেন। এখন বহু রেকর্ডিং প্রতিষ্ঠান হয়েছে, কিন্তু প্রায় সর্বত্রই সেই রেওয়াজটি এখনও চলছে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের অনমনীয় ব্যক্তিত্ব থেকেই এদেশে এই জিনিসটির সূত্রপাত।
যথাসময়ে রবিদার সঙ্গে আমি সন্ধ্যার নতুন গান লিখতে বসলাম। আমরা সিটিং করলাম মেগাফোনের কমল ঘোষের বালিগঞ্জের টেমপোরারি স্টুডিয়োতে। শুনেছিলাম কমল ওখানে ভাল একটা স্টুডিয়ো বানাবে। কিন্তু সেটা আর কমল বানায়নি। যাই হোক সেদিন রবিদা সিটিং-এ বসার সময় বললেন, শেষটায় আমরাই জিতলাম। আয় পুলক, তোকে একটা দারুণ সুর দিচ্ছি। দারুণ একটা রোমান্টিক গান লেখ।
কথাটা বলেই রবিদা সেই ‘উত্তরায়ণ’ ছবিতে সন্ধ্যার গাওয়া এবং রেকর্ড না হওয়া ‘মহুয়া বুঝি বা ডাকে’ গানটি হারমোনিয়ামে বাজিয়ে শোনাতে লাগলেন। আর রাধাকান্ত নন্দী তাঁর অপূর্ব হাতের ছোঁয়ায় তবলায় ঠেকা বাজাতে লাগলেন। ব্যাপারটা সবই আমি জানতাম। বুঝলাম, রবিদা এইচ. এম. ভি-র সেই গান প্রত্যাখানের যে জ্বালা তারই প্রতিশোধ নিতে চলেছেন। আমার আর কী করার আছে। আমিও রবিদার সুরের উপর লিখতে লাগলাম ‘মানসী সেজেছি আমি/মরমিয়া তুমি সাজবে’। আমার এখনও স্মরণে আছে ওই গানটি লেখার সময়ে কী প্রয়োজনে রবিদাকে খুঁজতে প্রণব রায় সেখানে হঠাৎ এসেছিলেন। রবিদা বললেন, পুলক থামিস না। প্রণববাবু এসে গেছেন। তোকে উৎসাহ দেবেন। লিখে যা।
সেদিনটা আমার ভাগ্য খুবই সুপ্রসন্ন ছিল। প্রণবদার সামনেই আমি সমস্ত গানটা লিখলাম। শুনে খুবই তারিফ করলেন প্রণবদা। ওঁকে প্রণাম করতেই উনি আমার মাথা ছুঁয়ে আশীর্বাদ করলেন।
‘সেই মানসী সেজেছি আমি’ প্রকাশ করতে বাধ্য হলেন এইচ. এম. ভি-র কর্তাব্যক্তিরা। তখনকার অধিকর্তারা বলতে পারলেন না গানের সুর ভাল হয়নি। এর সমস্ত কৃতিত্বই কিন্তু সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের।
‘উত্তর ফাল্গুনী’ ছবিটি উত্তমকুমারের প্রতিষ্ঠানের পতাকাতেই হয়েছিল। ‘উত্তর ফাল্গুনী’-তে যখন শুনলাম ওই সব অসাধারণ সিচুয়েশনে শুধু হিন্দি গানই থাকছে, তখন উত্তমকে খোলাখুলি বললাম, উত্তম, তোমার মতো মানুষ এমন একটা ভুল করছ। গানগুলো সিনেমাতে সবাই শুনবে। হয়তো ভীষণ ভালও লাগবে। কিন্তু সিনেমার বাইরে সে গান কিছুতেই হিট করবে না। আমার অভিজ্ঞতায় এবং সমীক্ষায় দেখেছি বাংলা ছবিতে কোনও দিনও হিন্দি গান তেমন হিট করেনি।
উত্তম হাসল। বলল, চিন্তা কোরো না মামা। অপূর্ব গান বানিয়েছেন রবীন চট্টোপাধ্যায়। গাইবেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। রেকর্ডিং-এর দিন স্টুডিয়োতে এসে শুনে যেয়ো।
উত্তম যে ছবিতে দেখত আমাকে দিয়ে গান লেখালে সুফল হবে তখনই সেখানে আমায়ে পাঠিয়ে দিত। এমনি একটা ছবিতে প্রযোজকের কাছে আমায় পাঠিয়ে দেওয়ার পর যখন আমি নিশ্চিত হয়ে আছি তখন হঠাৎ লোকমুখে শুনলাম অন্য গীতিকার নাকি ওখানে কাজ করবেন। স্বভাবতই বিচলিত হয়ে উত্তমের কাছে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। উত্তম সেই প্রযোজককে সঙ্গে সঙ্গে একটা চিঠি লিখে দিয়েছিল। সেই চিঠিটি এখনও আমার কাছে আছে।
যাই হোক, উত্তম নিশ্চয় মনে করেছিল আমি ওই ‘উত্তর ফাল্গুনী’ ছবিতে গান লিখতে চাই বলে ও সব কথা বলেছি। আমি সেটা বুঝিয়ে বললাম। বললাম, পরিবেশ বোঝাতে একটা হিন্দি গান দাও না। পরে দাও বাংলা গান, সুপারহিট করবে তোমাদের সিচুয়েশনে সুচিত্রা সেনের লিপে। উত্তম আমার সে-কথা রাখতে পারেনি। স্টুডিয়োতে গিয়েছিলাম। অপূর্ব গাইলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ব্যাপারটা বলেছিলাম ওর বড়দা রবীন মুখোপাধ্যায়কে। উনি বললেন, বললেন না কেন ওঁদের? উত্তরে একই কথা বললাম, এঁরা হয়তো ভাবছেন আমি গান লিখতে চাইছি বলেই এ-কথা বলছি।
‘মণিহার’ ছবিতে সুমন কল্যাণপুরের গাওয়া ‘দূরে থেক না/এস কাছে এস’ এই গানটি আমি লিখেছিলাম। কিন্তু গোড়াতে ওখানে একটা হিন্দি গান থাকার কথা ছিল। তখনও আমি আমার ভাবনার ব্যাপারটা ওঁদের বলতেই সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তৎক্ষণাৎ আমার কথায় সায় দিয়ে তৈরি করা হিন্দি গানটা বাতিল করে দিয়ে আমাকে দিয়ে নতুন করে লিখিয়েছিলেন বাংলা গান। পরবর্তীকালে এমন ঘটনা অনেক ঘটেছে। কেউ আমার কথা শুনেছেন, কেউ শোনেননি। যেমন ‘বিলম্বিত লয়’ ছবিতে আমি বার বার বলা সত্ত্বেও একটি হিন্দি গান (হয়তো চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে) রাখা হল। কিন্তু ‘বিলম্বিত লয়’, ছবির সব কটি বাংলা গানই হিট করল। অথচ সরোজ দের চমৎকার চলচ্চিত্রায়ণ সত্ত্বেও গুলজারের লেখা মান্না দে ও আরতির গাওয়া হিন্দি গানটি একেবারেই চলল না। ‘বিলম্বিত লয়’ হিন্দি ছবি হলে গানটি সুপারহিট করত। ‘উত্তর ফাল্গুনী’র হিন্দি গান সম্পর্কে এত কথা বলার একটি মাত্র কারণ, সেটি হল খুব কম লোকের বাড়িতেই হয়তো ওই গানের রেকর্ডগুলো আছে। কিন্তু অনেক লোকই আজ আর স্মরণ করতে পারছেন না সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কী অসাধারণ গেয়েছিলেন ওই গানগুলি। আমাদের দুর্ভাগ্য সেই গানগুলি যোগ্য সমাদর পেল না।
৬৭
কিছুদিন আগের একটি ঘটনার কথা বলি। একটি ছবির জন্য আমি একটি গান লিখলাম একজন উঠতি সুরকারের জন্য। যদিও সে এখন প্রচুর ছবি করছে। গান তৈরি হওয়ার পর মনে হল, এ গানটি যদি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গান তা হলে গানটিকে প্রকৃত মর্যাদা দেওয়া হবে। প্রযোজক পরিচালকরা সবাই আমার প্রস্তাবে সানন্দে সম্মতি দিলেন। ওঁরা আমাকে অনুরোধ করলেন, সন্ধ্যাদি তো আজকাল খুব একটা গাইতে চান না। আপনি যদি একটু বলে দেন। আমি বললাম, ওঁর গাইবার মতো গান এখন খুব একটা তৈরি হচ্ছে কি? ওঁর দোষটা কোথায়? দেখি অনুরোধ করে যদি রাজি হন।
তখনই আমি ফোন করে ওঁকে রাজি করালাম। এবার নির্দিষ্ট দিনে ওই সংগীত পরিচালক ভদ্রলোক একবুক আনন্দ নিয়ে এখনকার নিয়মমতো গান তোলাতে গেলেন। এখনকার নিয়ম মানে একটা ক্যাসেটে গানটি গেয়ে ওঁকে দেবেন। আর ওই ক্যাসেট বাজিয়ে গান তোলানো হবে।
সন্ধ্যাদেবী যেই শুনলেন ক্যাসেট থেকে গান তুলতে হবে অমনি আমায় ফোন করলেন, পুলকবাবু; আপনি কি জানেন না যে, আমি ক্যাসেট থেকে গান তুলে কোনও সুরকারের সুরে গান রেকর্ড করি না। ওঁকে গেয়ে গেয়ে গান শেখাতে বলুন। আমি সন্ধ্যাদেবীকে বোঝালাম, ও আপনার সামনে গান গাইতে হয়তো ভয় পাচ্ছে।
উনি বললেন, ভয়ের কী আছে। সব মিউজিক ডিরেক্টরই কি তেমন গাইতে পারেন? ওঁরা ওঁদের গলাতেই বোঝাতে পারেন ঠিক কী ধরনের গানটি ওঁরা চাইছেন। আমি কি আপনার লেখা গান, গাইতে না জানা রাজেন সরকারের কাছ থেকে তুলিনি? তুলিনি রতু মুখোপাধ্যায়ের গান? সুরকার যেই হোন, যাঁর গান গাইছি, আগে সম্পূর্ণভাবে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে মিশে যাব। তারপরে রেকর্ড করব। আপনি তো সবই জানেন। তবু এই ছেলেটিকে ক্যাসেট দিয়ে পাঠালেন কেন? আমি বললাম, বিশ্বাস করুন। আমি ভাবিনি উনি ক্যাসেট করে নিয়ে যাবেন। আজকাল তো কোনও শিল্পীই গান তুলতে সময় দেন না। উনি সেইজন্যই এমনটি করেছেন।
উত্তরে উনি বললেন, গান শেখবার সময়টাই তো গান গাইবার আগের জিনিস। গলায় পুরোপুরি গানটা বসে গেলে তবেই তো সেটা আমরা গেয়ে শোনাতে পারি। তার জন্যে সময় লাগে লাগুক না।
এবার আমি বললাম, ঠিক একই কথা বলেন মান্না দে-ও। আমার ধারণা আজকের গানের জগতে শুধু আপনারা দুজন এই ধরনের পারফেকশনালিস্ট। মিউজিক ট্র্যাক আগে তৈরি হওয়ার সুবিধায় মুম্বই-তেও দেখছি আজকাল লতাজি আর আশাজি ছাড়া অন্য সবাই দুলাইন করে গান তুলে দুলাইন গান রেকর্ড করেন। ওই দুলাইন গাওয়া হয়ে গেলে, পরে আবার দুলাইন তোলেন। তারপর আবার দুলাইন গান। এমনিভাবেই পনেরো-কুড়ি মিনিটেই একটা গান গেয়ে রেকর্ড করে দেন। সেইভাবেই পনেরো-কুড়ি মিনিট করে গেয়ে রেকর্ড করে যান সারাদিন প্রায় রোজ সাত-আটটা গান। হিসাব করলে সারা মাসে এইভাবে গাওয়া অনেকগুলো গানের মধ্যে মাঝে মাঝে দুখানা গান হিট করে। এই দুখানা হিট গানই ওঁদের অনুপ্রেরণা দেয়, হয়তো আত্মবিশ্বাস দেয়। পরের মাসে আবার রোজ পনেরো-কুড়ি মিনিটে ওইভাবে গান গেয়ে গেয়ে সাত-আটটা গান রেকর্ড করেন। এই তথাকথিত ‘কমপিউটারাইজড সিংগিং’-এ হয়তো কিছু গান সুপার হিটও করে। কিন্তু সুন্দর চিরন্তন গান হয় খুবই কম। যার জন্য হিন্দি ছবিতেও যথার্থ ভাল গান খুঁজতে হলে যে কোনও শ্রোতাকেই আজ থেকে পনেরো-কুড়ি বছর পিছিয়ে যেতে হবে।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আমার মতে বাংলাতে এখনও আদর্শ। তাই উনি ওই সুরকারকে প্রায় দুঘণ্টা সময় দিয়ে ভাল করে গান তুলে, সে গান বাড়িতে রেওয়াজ করে গেয়ে গলায় বসিয়ে তবেই অন্য আর একটা নির্দিষ্ট দিনে রেকর্ড করলেন। আমার এ কথা শুনে মুচকি হেসে অনেকেই হয়তো বলবেন, আপনার কি ধারণা ওভাবে অত সময় নষ্ট করে গান তুলে গান গাইলেই কি গান হিট করবে? আমি তাঁদের সবিনয়ে বলব, হিট বা ফ্লপ সবটাই ভাগ্যের ব্যাপার। তবে একটা কথা তো ঠিকই, যে গান সৃষ্টি হল সেখানে তো কোনও ফাঁকি নেই। তা পুরোপুরি নিষ্ঠায় একাগ্রতায় জন্ম নেওয়া একটি গান। জনসাধারণ সেটা গ্রহণ করুন বা না করুন, স্রষ্টাদের ভাবে-ভাবনায় যা ছিল এ তো তারই স্বপ্নের বাস্তব প্রতিমূর্তি। এই সঙ্গে আর একটা কথা মানতে হবে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নিজেকে ধরে রাখতে জানেন। কলকাতার সন্ধ্যাদেবী আর মুম্বই-এর লতা মঙ্গেশকর ছাড়া যে কোনও শিল্পীকেই টাকার অঙ্কের হেরফেরে জলসাতে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু লতাজি বা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে পাওয়া সম্ভব নয়। অকপটে বলছি টাকার লোভে এই শিল্পী কোনও দিনও লালায়িত নন। আঙুল গোনা অনুষ্ঠান উনি সারা বছরে করেন। ইচ্ছে করলে আজকালকার তথাকথিত শিল্পীদের মতো সপ্তাহে ছ’টি অনুষ্ঠান করে গলা খারাপ করে প্রচুর অর্থ উনি রোজগার করতে পারতেন। কিন্তু উনি তা করেননি।
আমি এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা উল্লেখ না করে থাকতে পারছি না। বেশ কিছুদিন আগে যখন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং সুচিত্রা সেনের স্বর্ণযুগ, তখন আমাদের সালকিয়ার পাড়ার একটি ক্লাবের হয়ে আমি একটি সংগীতানুষ্ঠান করতাম প্রতি বছর। সে বারের অনুষ্ঠানে আমি সন্ধ্যাদেবীকে গাইবার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। উনি আমাকে সানন্দে সম্মতি দিয়েছিলেন। ঠিক সেই সময় আমাদের পাড়ারই আর একটি ক্লাব, তারাও একটি বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করেন। তাঁরাও চান সন্ধ্যাদেবীকে। প্রচুর প্রভাবশালী এক ব্যক্তিকে দিয়ে সন্ধ্যাদেবীকে অনুরোধ করান। সন্ধ্যাদেবী কিন্তু রাজি হননি। উনি বলেছিলেন দুদিনের ব্যবধানে, একই জায়গায় দুটি ক্লাবের অনুষ্ঠান উনি করতে পারবেন না। ওই ক্লাবের উদ্যোক্তারা সন্ধ্যাদেবীকে জানান, অন্য সব শিল্পীই দুটি জায়গাতেই গান গাইতে রাজি হয়েছেন। তা হলে আপনার আপত্তি কীসে?
সন্ধ্যাদেবী বলেছিলেন, আপত্তি নৈতিকতার। টাকার লোভে এ ধরনের কাজ করে কিছুতেই নিজেকে সস্তা করতে পারব না।
ওরা তখন বিশ্ববিখ্যাত বড়ে গোলাম আলিকে দিয়ে সন্ধ্যাদেবীকে ওই ক্লাবের হয়ে গাইতে অনুরোধ করেছিলেন। সন্ধ্যাদেবী ওঁকেও সবিনয়ে বুঝিয়েছিলেন ওঁর আদর্শের কথা। প্রচুর টাকা এবং প্রচুর প্রভাবে যখন কাজ হল না তখন ওই ক্লাবের আয়োজকরা আমার কাছে এসে টাকার লোভ দেখিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সন্ধ্যাকে ছেড়ে দিন। আমি নারাজ জেনে বলেছিলেন, ধরুন সন্ধ্যার গাড়ি যদি হাওড়া ব্রিজে আপনার অনুষ্ঠানে আসার পথে ভাঙচুর হয় তা হলে আপনি দায়ি থাকবেন।
আমি এতে ভয় পাইনি। থানা পুলিশে আমার প্রভাব খাটাইনি। শুধু সন্ধ্যাদেবীকে জানিয়ে দিয়েছিলাম ব্যাপারটা। সন্ধ্যাদেবী এবং ওঁর বড়দা আমায় জানিয়েছিলেন প্রয়োজনে, আমরা পায়ে হেঁটেও আপনার অনুষ্ঠানে যাব। ও সব চোখ রাঙানিকে আমরা ভয় পাই না।
এখন সেই সব পুরনো দিনের স্মৃতিকথা লিখতে বসে ভাবছি, আজকের যুগে এমন নৈতিকতার আদর্শে জীবন কাটানো শিল্পী কি আমরা খুঁজে পাব। হয়তো এমন শিল্পী এখনও আছেন যাঁর খবর আমরা রাখি না।
এই সন্ধ্যাদেবীই ঘটনাচক্রে কোনও কারণে আঘাত পেয়ে, সেবার পুজোয় নিজেই সুরকার হয়ে গেয়েছিলেন নিজের সুরে নিজের গান। যে গান লিখেছিলেন ওঁর স্বামী শ্যামল গুপ্ত। জীবনের এক অপরূপ উপলব্ধি আমি খুঁজে পেয়েছিলাম সেই গানে ‘বড় দেরিতে তুমি বুঝলে/কেউ নিজেকে ছাড়া ভাবে না।
তবুও ক্ষমায় সহনশীলতায় এই অনন্যা শিল্পী মাথা উঁচু করে রয়ে গেছেন—নুয়ে পড়েননি।
তাই আমেরিকায় অনুষ্ঠান করতে গিয়ে ওঁর কন্যা ঝিনুকের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে নতুন করে রেকর্ড করেছিলেন, আমার লেখা আমারই অতি প্রিয় একটি গান ‘তুমি আমার মা/আমি তোমার মেয়ে’। কলকাতায় এসেই এ ঘটনা জানিয়েছিলেন আমাকে। এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন, আপনি তো সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বহু গান লিখেছেন, তার মধ্যে আপনার সব থেকে প্রিয় প্রথম চারটি গান সাজিয়ে দিন। প্রত্যেককেই আমি বলি, ওঁর গাওয়া সব গানই আমার প্রিয়। তবু চাইছেন যখন, তখন বলছি, আমার প্রিয় প্রথম তিনটি গানই কিন্তু রাজেন সরকারের সুর দেওয়া।
এবার শুনুন, ১। ‘আমি তোমারে ভালবেসেছি/চিরসাথী হয়ে এসেছি’, ২। ‘দরদিয়া গো/যে তোমায় এত জানায়’, ৩। ‘আরও কিছু রাত/ তুমি জাগতে যদি’, ৪। ‘আমার মনে নেই মন/কী হবে আমার’।
শেষের গানটি সুর করেছিলেন অখিলবন্ধু ঘোষ। উল্টো পিঠে ছিল ‘যমুনা কিনারে’। সেবার অখিলবন্ধুর পুজোর গান একটু তাড়াতাড়ি লিখে রেকর্ড করিয়েছিলাম। তার মধ্যে একটি গান ‘যেন কিছু মনে কোরো না’। এই গানটি সম্বন্ধে ওঁদের বলেছিলাম, গানটি অখিলবন্ধু দারুণ সুর করে গেয়েছেন। সন্ধ্যাদেবীর বড়দা রবীনবাবু গানটা শুনে এমনই নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে, মেগাফোনে রেকর্ড করা সেই গানটা কিছু লাভ দিয়ে সমস্ত খরচ দিয়ে রাইট কিনে নিতে চাইলেন। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে সন্ধ্যাদেবীর সেবারের উল্লিখিত গানগুলি লিখেছিলাম। আগেই বলেছি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় সম্বন্ধে আমি অন্তত বলে শেষ করতে পারব না। তাই এখন থামছি। পরে আবার বলব।
৬৮
অন্য সমস্ত লেখাকে থামিয়ে যে লেখা আজ আমার কলমে সবার আগে এসে পড়ছে, তা হল সেই মানুষটির কথা। যে মানুষটি দিনের আলোয় মন্দিরে পুজো দিয়ে বেরোবার মুখেই একদল আততায়ীর অতর্কিত আক্রমণের শিকার হলেন। আততায়ীর গুলিতে অল্পক্ষণের মধ্যেই তাঁর শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গেল।
ভগবান বলে সত্যিই যদি কিছু থাকেন, নিশ্চয় তাঁর চোখে পড়েছে এই সমস্ত ঘটনা। এই জঘন্য অপরাধকে নিন্দা করার কোনও ভাষা নেই। দিল্লিতে যখন ফলের রস বিক্রি করতেন গুলশন কুমার, তখন তাঁকে দেখিনি, তাঁর কথাও শুনিনি। তাঁর কথা প্রথম শুনলাম এইচ. এম. ভি-র দমদমে এক অফিসারের ঘরে। কী কারণে ওঁর ঘরে ঢুকেছিলাম মনে নেই। শুধু মনে আছে অফিসার ভদ্রলোকটির টেবিলে দুটি ক্যাসেট সাজানো ছিল। কথায় কথায় উনি ক্যাসেট দুটি আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, বলুন তো, কোনটা আসল কোনটা নকল?
বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে আমাকে বলতে হয়েছিল, দুটোই তো এক। কী সব জামাই ঠকানো ধাঁধার প্রশ্ন করছেন? উনি দৃঢ়ভাবে বললেন, না। এটা নকল। এর ‘ইনলে’-র কাগজটা একটু অন্য। এটার দাম আমাদের থেকে বাজারে অনেক কম। এটা জাল ক্যাসেট। আমি বললাম, যেভাবে ডিস্ক রেকর্ড বাজারে নকশা আঁকা জ্যাকেট কভারে বা সাদা জ্যাকেট কভার পরে দুনম্বরি হয়ে বিক্রি হত, এটা তো অনেকটা সেই গোত্রেরই।
অফিসার ভদ্রলোক হাসতে হাসতে বললেন, সেটা ছিল পুকুর চুরি। আর এটা মহাসাগর লুণ্ঠন। এর প্রধান নায়ক হলেন দিল্লির এক ফলের রস ব্যবসায়ী। তিনি এখন ক্যাসেটের ব্যবসা করছেন। তাঁর নাম গুলশন কুমার। কিন্তু কোনও প্রমাণ নেই। উনি ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অস্বীকার করছি না, ক্যাসেটের ব্যবসা অর্থাৎ গানের জগতে গুলশন কুমারের পদক্ষেপ এইভাবে হলেও অচিরেই গুলশন স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ করেছিলেন তাঁর অসাধারণ দূরদৃষ্টিতে, সাংগঠনিক শক্তিতে এবং অবশ্যই অনন্য উদ্ভাবনী ক্ষমতায়। এ দেশে এইচ. এম. ভি. যাঁকে দেখে প্রথম বিব্রত হয়েছিলেন, তা হল গুলশনের এই ‘টি সিরিজ’ যা পরবর্তীকালে নাম পাল্টে হল ‘সুপার ক্যাসেট’।
এই ‘টি সিরিজ’ কী এক অসাধারণ জাদুমন্ত্রে নিজের ব্যবসা ছোট্ট চারাগাছ থেকে বিরাট মহীরুহ করে তুলল। আমার সঙ্গে এ হেন গুলশন কুমারের পরিচয় কিন্তু বেশ কিছুদিন পরে। শানু ভট্টাচার্যের তরঙ্গ ক্যাসেটের অ্যালবামের গানগুলি লিখে কেন জানি না আমার মনে হয়েছিল, এই নতুন শিল্পী যদি সত্যিকারের সুযোগ এবং মার্কেটিং পায়, কেউ একে আটকাতে পারবে না। প্রথমে একটা বড় কোম্পানিকে অনুরোধ জানিয়েছিলাম ক্যাসেটটি প্রকাশ করার জন্য। কিন্তু ওঁরা আমার অনুরোধ রাখেননি। বলেছিলেন—এমন নকল কিশোরকণ্ঠ কলকাতার অলিতে গলিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কী দেখলেন ওঁর মধ্যে? বলেছিলাম একটা সতেজ রস, যেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না— উপলব্ধির ব্যাপার। ওঁরা তখন বেয়ারাকে আমাকে আর এক কাপ কফি দিতে বললেন। ওঁদের শুনিয়ে এসেছিলাম ইতিহাস নিজেকেই বার বার একইভাবে প্রকাশ করে। আপনারাই তো এক দিন কে এল সায়গল, শচীন দেববর্মণকে গ্রহণ করেননি। আজ আবার আর একজনকে প্রত্যাখ্যান করলেন।
একবুক উষ্মা নিয়ে পথে নামতেই সে দিন হঠাৎ দেখা হয়ে গেল সাহা ইলেকট্রনিক্সের বি এম সাহার সঙ্গে। আমার খুবই পরিচিত মানুষ। উনি তখন কলকাতায় গুলশন কুমারের ডান হাত। ওঁকে ব্যাপারটা বললাম। শুনে উনিই যোগাযোগ করলেন দিল্লিতে। গুলশন কুমারের জহুরি চোখ। তৎক্ষণাৎ চিনে নিলেন শানু ভট্টাচার্যকে।
শানু ভট্টাচার্য তরঙ্গ ক্যাসেটে ‘শানু ভট্টাচার্য’ থাকলেও যেই উনি অ্যালবাম স্বকর্ণে শুনে বুঝলেন ওর সম্ভাবনা অপরিসীম, তখনই ওকে কুমার শানু করে নিয়ে এলেন সর্বভারতীয় গানের আসরে। দিলেন ওঁর অফিসের কাছেই একটা সিঙ্গল রুম ফ্ল্যাট। রয়ালটির টাকায় পরিশোধযোগ্য একটি মারুতি ৮০০। শুধু তাই নয়, তখন মুম্বই-তেও টেলিফোন সহজলভ্য ছিল না বলে ফ্ল্যাটের প্রায় লাগোয়া ওঁর একটি অফিসের টেলিফোন যথেচ্ছ ব্যবহারের অনুমতিও দিলেন।
সুদূর নিউবম্বে এবং মুম্বই-এর অনেক অগম্য স্থানে স্বল্প ভাড়ায় থাকা, রেস্তোরাঁর মাতালদের সামনে তথাকথিত ফিল্মি গান গাওয়া শানু ভট্টাচার্য গুলশনের প্রোমোটিংয়ে হয়ে গেলেন কুমার শানু।
শুধু শানু নয়, গুলশন কুমার অনুরাধা পড়োয়ালকেও সামনের সারিতে এনে দিয়েছিলেন। সুযোগ দিয়েছিলেন অলকা ইয়াগনিককেও। টেলিফিল্ম বানানোর ব্যাপারটা সম্ভবত ওঁর মস্তিষ্কেই প্রথম আসে। দুটি টেলিফিল্ম একসঙ্গেই শুরু করলেন। একটি ‘জিনে তেরি গোলি মে’ আর একটির নাম সম্ভবত ‘লাল দুপাট্টা মলমল’—এই জাতীয় নাম। উনি প্রথমেই গান রেকর্ডিং করলেন এবং ক্যাসেট ছেড়ে দিলেন বাজারে। দুটিতেই সুযোগ দিলেন দুজন তরুণ সুরকারকে। প্রথমটিতে কলকাতার বাবুল বসুকে, এবং দ্বিতীয়টিতে আনন্দ-মিলিন্দকে। এই আনন্দ-মিলিন্দ তখনও বিখ্যাত হননি। বাবুলের দুর্ভাগ্য ‘জিনে তেরি গোলি মে’ গোল্ড ডিস্ক অর্জন করলেও গুলশন অজ্ঞাত কারণে ছবিটি বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু দ্বিতীয়টি প্রকাশিত হল। সহজেই পায়ের নীচে মাটি খুঁজে পেলেন আনন্দ-মিলিন্দ।
গুলশনের সঙ্গে আমার মুখোমুখি আলাপ যখন ওঁর প্রতিষ্ঠানের হয়ে কুমার শানুর জন্য পুজোর গান রচনা করার অনুরোধ এল। তখন কিশোরকুমার সদ্য প্রয়াত। আমার বুকের মধ্যে অহরহ একটা বিয়োগযন্ত্রণা। শানু তখন ছিল অনেকটাই কিশোরকুমারের কপি কণ্ঠ। হঠাৎ আমার মাথায় এল কিশোরদার ওপর গান লিখলে কেমন হয়! লিখেছিলাম আমাদের সকলের আন্তরিক শ্রদ্ধার্ঘ ‘অমর শিল্পী তুমি কিশোরকুমার’। আর একটি গান শানুর ব্যক্তিগত ভাবাবেগ ‘তুমি যদি থাকতে’। বাবুল বসুর অপূর্ব সুরে ক্যাসেটটির প্রতিটি গানই সুপারহিট হল। এই ‘অমর শিল্পী’ গানের কৃতিত্বেই ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল শানুর নাম।
তার আগেই অবশ্য মুম্বই-তে আমার সঙ্গে গুলশনের আলাপ। তখন উনি দিল্লিতেই বেশির ভাগ সময় থাকতেন। বাংলা বুঝতেন না মোটেই। কার কাছে যেন গান দুটির মতলব জেনে প্রথম আলাপেই আমায় নমস্কার জানিয়ে বলেছিলেন, আমি ঠিক এই ধরনের গানই খুঁজছিলাম। আপনার আর আমার চিন্তার ওয়েভ লেন্থ একেবারেই এক। দেখবেন রেজাল্ট খুব ভাল হবে। তখনই ওঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, তা হলে শানুর জন্যই পুরোপুরি একটা অ্যালবাম কেন করলেন না? ক্যাসেটের এক পিঠে কেন লিখলাম ওর চারটি গান আর অন্য পিঠে লিখলাম অলকা ইয়াগনিকের চারটি গান? উত্তরে গুলশন বলেছিলেন, একই শিল্পীর কণ্ঠে আটটা নতুন গান শ্রোতাদের শুনতে ভাল লাগে না। পুরনো চেনা হিট গানের ব্যাপার আলাদা। সেজন্যে আমি প্রতিটি বাংলা ক্যাসেটেই এক পিঠে একজন পুরুষ অন্য পিঠে একজন মহিলা শিল্পীকে বেছে নিয়েছি। এবার আমি ওঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, আমি তো আপনার প্রতিষ্ঠানের হয়ে শানু, মুন্না, অলকা সবার জন্য চারটি করে গান লিখেছি। কিন্তু অনুরাধা পড়োয়ালের বেলায় আটটি গান কেন লিখলাম?
ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে মুচকে হাসলেন গুলশন কুমার। বললেন, অনুরাধার আটটি গান মোটেই একটি ক্যাসেটে থাকবে না। থাকবে দুটো আলাদা ক্যাসেটে। ছিলও তাই। দুটি আলাদা ক্যাসেটেই প্রকাশিত হয়েছিল অনুরাধার চারখানি করে আটটি গান।
গুলশনের অসাধারণ বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিকে আমি আবিষ্কার করতে পেরেছিলাম ওঁর সঙ্গে প্রথম আলাপে। পরবর্তীকালে মুম্বই-এর প্রতিটি ক্যাসেট কোম্পানি, দুজন শিল্পীর শুধু আলাদা গান নয়, ডুয়েট গান দিয়েও বাংলা ক্যাসেট প্রকাশ করা শুরু করলেন। ঠিক সেই সময় না হলেও অধুনা এইচ. এম. ভি-কে গুলশনের দেখানো এই রাস্তাতেই পা ফেলতে দেখা গিয়েছে।
তবুও একটা ব্যাপার সবাই জানেন, অনুরাধা পড়োয়ালের ওপর ওঁর পক্ষপাতিত্ব দিনের পর দিন প্রকট হয়ে এল। যার ফলে প্রথমেই অলকা সরে এল ওখান থেকে। বেশ কিছুদিন বাদে অসহ্য হয়ে শানুও চলে গেল। শানু চলে যেতেই, গুলশন শানুর জায়গায় কলকাতার সুপ্রিয় বড়ালকে বাবুল সুপ্রিয় নাম দিয়ে হাজির করলেন বাজারে। সেই সঙ্গে নিয়ে এলেন সনু নিগমকে।
পুরুষ শিল্পীর অন্বেষণে গুলশনের ‘টি সিরিজ’ বা ‘সুপার ক্যাসেট’ আজ পর্যন্ত কোনওদিন শ্রান্তি দেখায়নি।
মুম্বইতে আমার, শেষ দেখার দিন আমায় বলেছিলেন, এবার আমাদের তৈরি সি ডি আমি বাজারে ছাড়ছি। সবচেয়ে অল্প দামে। দেখে নেবেন পুলকবাবু তার কোয়ালিটি কী হয়। অডিওর গান পিকচারাইজ করে ভিডিও ক্যাসেটে প্রকাশ করাতেও, আমি যতদূর জানি গুলশন কুমারই প্রথম পথ প্রদর্শক।
সেবার মুম্বই-তে শুনলাম অমিতাভ বচ্চনের রুগ্ন শিল্প ‘বিগ বি’ উনি কিনে নিয়েছেন। এ ব্যাপারে কংগ্রাচুলেশন জানাতে গিয়ে কথায় কথায় আন্দাজ করেছিলাম, অমিতাভকে নিয়ে ছবি বানানোরও বাসনা রয়েছে তাঁর।
ধার্মিক গুলশনের মুম্বই-এর গোল্ডেন চ্যারিয়টের সামনে দাঁড়ালেই, যে কোনও লোকেরই চোখে পড়বে প্রায় তিন তলার সমান বিরাট ঠাকুরের মূর্তি। একটা স্টুডিয়ো তার অফিসের সামনে অত বড় ঠাকুরের মূর্তি কেউ কখনও দেখেছেন কি? তা ছাড়া একতলায় মা কালীর বিগ্রহ তো আছেই।
বৈষ্ণোদেবীর মাতার মন্দিরের সামনে প্রতিদিন বহু মানুষকে যে গুলশনের পয়সায় মায়ের পূজার ভোগ আহার করানো হয়, সে খবর তো সবাই রাখেন।
চেন্নাইতে প্রসাদ স্টুডিয়োর রেকর্ডিং থিয়েটারে যে মাল্টি চ্যানেল বৃহত্তম চওড়া টেপের রেকর্ডিং মেশিন দেখে চমকে উঠেছিলাম, ঠিক সেইরকম মেশিনই দেখেছিলাম গুলশনের গোল্ডেন চ্যারিয়টে। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বাইরের কোনও ফিল্ম প্রতিষ্ঠানকেও তো এই স্টুডিয়ো ভাড়া দিতে পারেন? জবাব শুনতে হয়েছিল, আমাদের কাজ শেষ করারই ডেট পাচ্ছি না, অন্যদের দেব কী করে? কেন মুম্বই-এর খারেতে আমাদের সুদীপ স্টুডিয়ো রয়েছে। সেটা আমরা তো অন্য প্রতিষ্ঠানেদের ভাড়া দিই।
গুলশনের প্রতিটি নতুন দিন যেন ছিল ওঁর নতুন সাফল্যের একটি ধাপ। ভক্ত গুলশনকে হয়তো ভগবানই প্রকৃত আশীর্বাদ দিয়েছিলেন। তাই এত দ্রুত এই উত্তরণ। সেদিন দুপুরেই সংবাদ মাধ্যমের কাছ থেকে টেলিফোনে শুনতে হল গুলশন আর আমাদের মধ্যে নেই। চলে গেছে অকালে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে। তাঁর মৃতদেহের হাতে রয়েছে পূজার প্রসাদ। ভক্তের ভগবান অনেক দিয়েও কেন হঠাৎ এভাবে নিজের কাছে ডেকে নিলেন তার কারণ আমি জানি না। আমার কানে শুধু বাজছে গুলশনের আন্তরিক আমন্ত্রণ, দাদা, আমার নিউদিল্লির গেস্ট হাউসে একবারও কিন্তু আপনি এলেন না। কবে আসবেন?
৬৯
চিনতাম গায়ক ও সংগীত শিক্ষক পশুপতি ভট্টাচার্য মহাশয়কে।
চিনতাম না, জানতাম না ওঁরই এক ছেলে তপন ভট্টাচার্য ভাল গান করে, আর এক ছেলে শানু ভট্টাচার্য ভাল তবলা বাজায়। ব্যাপারটা শুনেছিলাম অনেক পরে। দেখেছিলাম এই শানু ভট্টাচার্যকেই একদিন বসুশ্রী সিনেমায়। জলসায় যে কোনও মূল্যে একটা সুযোগের জন্য বসে আছে। কে একজন বললেন, ও তো তবলা বাজায়, গান আবার শিখল কবে? আর একজন জবাব দিলে—গান তো ওর রক্তে—ওর পিতৃদেব তো পশুপতি ভট্টাচার্য।
তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। একদিন ফোন পেলাম দিলীপ রায়ের। আমাদের এই সিনেমার জগতে অনেক দিলীপ রায় আছেন। ওঁরা অনেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত। অনেকেই আমায় মাঝে মাঝে ফোন করেন। তাই বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করতে হল—কোন দিলীপ রায়? উত্তর পেলাম বেহালার দিলীপ রায়।
দিলীপবাবু বললেন, আপনি তো ভাল নতুন শিল্পী হলে ক্যাসেটে গান লিখবেন বলে কথা দিয়েছেন, এবার পেয়েছি একটি ছেলেকে। হুবহু কিশোরকুমার। সেই সময়টায় গানের জগতের পুরুষ বিভাগে কিশোরকুমারের কাছে আর সবাই এককথায় কুপোকাত, সুতরাং ছিটেফোঁটা সত্যিকারের কিশোরকুমার হলেও সম্ভাবনা প্রবল এটা বুঝে নিতে দেরি হল না। রাজি হয়ে গেলাম। দিলীপবাবু বললেন, কিন্তু পারিশ্রমিকটা একটু কম করতে হবে। ছেলেটি মুম্বই-তে একটা হোটেলে গান গাইত। থাকত নিউমুম্বই-তে। দারুণ স্ট্রাগলিং-এর মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে এখন। মুম্বই-তে হোটেলের কী একটা গণ্ডগোলে চলে এসেছে কলকাতায়। কিন্তু অন্য জীবিকা বলতে তো কিছু নেই। ও গান গেয়ে জীবন ধারণ করতে চায়। তাই যে করে হোক প্রকাশ করতে চায় একটা বাংলা গানের ক্যাসেট। আপনার লেখা গানের। ওর সমস্ত রেকর্ডিং-এর টাকাটা ওর বন্ধুবান্ধবরা জোগাড় করেছে। বাজেট খুবই কম!
রাজি হয়ে গেলাম গান লিখতে। সুন্দর সুর দিলেন দিলীপবাবু। ক্যাসেটের ডাবিং মিক্সিং হয়ে গেলে দিলীপবাবুকে বললাম, চারখানা গান কিন্তু দারুণ গেয়েছে শানু ভট্টাচার্য। হোক কিশোরকুমারের স্টাইল। তবে দেখবেন, ও ঠিক ওই রাস্তায় ঢুকে পরে নিজের স্বতন্ত্র রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়েরও জীবনের গোড়ার দিকের রেকর্ডে ‘তোমারই চোখের চাওয়া/মিলালো প্রাণেরই মাঝে’ পুরোপুরি পঙ্কজ মল্লিকের স্টাইলে গাওয়া। কিশোরকুমারের শুরুই তো কে এল সায়গলের স্টাইলে। তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, সুবীর সেন এঁরা আবার সবাই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রাস্তায় হেঁটে যে যার নিজের ঘর স্থাপন করতে পেরেছেন। দেখবেন দিলীপবাবু, শানুও তাই পারবে। সাফল্য পেলেই ও কিশোরকুমার থেকে সরে আসবে নিজস্ব কোনও ভঙ্গিমায়।
যা হোক, অন্য রেকর্ড কোম্পানি প্রত্যাখ্যাত শানু, বলছে দ্বিধা নেই, মূলত আমারই অনুরোধে বি এম সাহা মারফত, সাহা ইলেকট্রনিক্স-এর মাধ্যমে, যোগাযোগ করল দিল্লির প্রতিষ্ঠান গুলশন কুমারের টি সিরিজ অর্থাৎ সুপার ক্যাসেটের সঙ্গে। আমিও সাহা ইলেকট্রনিক্সকে এই ক্যাসেটটির নিশ্চিত সাফল্য সম্বন্ধে জোর গলায় ভবিষ্যদ্বাণী করলাম। গুলশন কুমার ক্যাসেটটি শুনেই শানুর জীবনের ওই প্রথম ক্যাসেটটি প্রকাশ করলেন। আগেই বলেছি ক্যাসেটটির নাম ছিল ‘তরঙ্গ’। তরঙ্গ’ ক্যাসেটটি সাফল্যের পরেই গুলশন শানুকে দিয়ে কিশোরকুমারের গাওয়া অনেকগুলো হিট হিন্দি ছবির গান নতুন করে গাওয়ালেন সুপার ক্যাসেটে ‘ইয়াদোঁ’ নাম দিয়ে। কিন্তু হিন্দি গান দিয়ে সর্বভারতীয় গানের জগতে ওকে আনতে গিয়ে প্রথমেই বললেন, ওই শানু ভট্টাচার্য নামটা ওর চলবে না। ওটা আমি করে দিলাম ‘কুমার শানু’, শানুও হাসি মুখে সেটা মেনে নিল। সিঁথির শানু ভট্টাচার্য রাতারাতি হয়ে গেল মুম্বই-এর কুমার শানু। ফুলপ্যাক ক্যাসেটে কিশোরকুমারের বড় ছবি আর এক কোণে নজরে না পড়া ছোট ছোট করে ইংরেজিতে লেখা সাঙ্ বাই কুমার শানু’ লেখা ওই ‘ইয়াদোঁ’ ক্যাসেটগুলো প্রকাশিত হল। অদ্ভুত বাণিজ্যিক দৃষ্টি গুলশনের।
শানুর অভাবনীয় বাণিজ্যিক সাফল্য এলেও তবু তখনও কিন্তু শ্রোতারা কেউ চিনতে পারেনি শানুকে। কিশোরদার ছবি দেওয়া ‘ইয়াদোঁ’ ক্যাসেটটি সবাই মনে করেছিল কিশোরকুমারই গেয়েছেন। ওটা যে একটা দ্বিতীয় কণ্ঠ কারও তা বোধগম্য হয়নি। শানু তখন সংগীত পরিচালক, প্রযোজকদের দরজায় দরজায় প্লে-ব্যাকের আর্জি নিয়ে ঘুরতে লাগল। সেই সময়েই হঠাৎ মারা গেলেন কিশোরকুমার। কিশোরকুমারের অনুপস্থিতিতে শঙ্কিত বিপর্যস্ত মুম্বই চিত্রজগৎ। আমি তখন মুম্বই-তে ছিলাম। কলকাতায় আমার বাড়িতে ফোন করে ঠিকানা নিয়ে আমার মুম্বই-এর হোটেলে হাজির হল সুপার ক্যাসেটের বিভাগীয় অধিকর্তা রাজ বিনোট এবং সংগীত পরিচালক বাবুল বোস। রাজ বিনোট সরাসরি বললেন-আমরা আটটি বাংলা ক্যাসেট করছি। আপনাকে লিখতে হবে চৌষট্টিটি বাংলা গান। শিউরে উঠে বললাম, অসম্ভব। রাজ বিনোট সাহেব তখন অলকা ইয়াগনিক, অনুরাধা পড়োয়াল, দেবাশিস দাশগুপ্তকে নিয়ে তিনটি ক্যাসেট—অর্থাৎ চব্বিশটি গান রচনা করাতে আমাকে রাজি করালেন। তারপর হঠাৎ বললেন, আপনার আর্টিস্ট কুমার শানুর গানও আপনাকে করতে হবে। কুমার শানু? সে আবার কে? জবাব দিল বাবুল বোস, তরঙ্গ ক্যাসেটের শানু ভট্টাচার্য তো এখন কুমার শানু। এ খবরটা তখন আমি জানতাম না। তবু শানুর নামটা শোনামাত্রই আমার কাছে শানু আর কিশোরকুমার একটা একই সুরেলা তরঙ্গের মতো মনে হল। তৎক্ষণাৎ স্থির করলাম কিশোরকুমারের একটা শ্রদ্ধার্ঘ্য্য এই কিশোর কণ্ঠকে দিয়ে গাওয়ালে দারুণ হয়। গভীর আত্মপ্রত্যয়ে রাজ বিনোট ও বাবুল বোসকে বললাম—আমি কুমার শানুর গান লিখব। এবং আমার ধারণা, ক্যাসেট সুপার হিট হবে। হলও তাই। শানুর কণ্ঠে আমার ‘অমর শিল্পী তুমি কিশোরকুমার তোমাকে জানাই প্রণাম’ রাতারাতি এক প্রায় অজ্ঞাত অপরিচিত শিল্পীকে তুলে দিল জনপ্রিয়তার প্রায় উচ্চতম শিখরে। বাংলা গানের একটা রেকর্ড বিক্রির দৃষ্টান্ত হল এই ক্যাসেটটি। হিন্দি গানে নয়, শানুর প্রথম প্রতিষ্ঠা কিন্তু এই বাংলা গান দিয়ে। যেখানে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা ছিল না—’সাঙ বাই কুমার শানু’–লেখা ছিল বড় বড় অক্ষরে কুমার শানুর নাম। ক্যাসেটটিতে কিশোরকুমারের ছবির সঙ্গে শানুরও ছবি ছিল। ওই বাংলা ‘অমর শিল্পী’ই কিন্তু আলোড়ন তুলল সারা দেশের সংগীত মহলে। সবাই জেনে গেল এসে গেছে কুমার শানু।
‘আশিকী’ মুক্তি পেল ‘অমর শিল্পী’র অনেক পরে। এ কথা অবশ্য অনস্বীকার্য হিন্দি ভাষার সুবিধায় ‘আশিকী’-ই শানুকে এনে দিল সর্বভারতীয় স্বীকৃতি। তাই শানু ওর নতুন বাড়ির নাম রাখল ‘আশিকী’। আমার স্বপ্ন সফল হল। নিউমুম্বই-এর স্ট্রাগল করা শানু ভট্টাচার্য, নর্থ মুম্বই-এর ‘পশ’ জায়গায় কুমার শানু হয়ে পেয়ে গেল নতুন ঠিকানা। কলকাতার যে রেকর্ড কোম্পানি তখন শানুকে বাতিল করেছিল, ওরা আমায় ফোনে অনুরোধ করল শানুকে ওদের ওখানে এনে দেবার জন্যে। বলেছিলাম— গুলশন কুমার একটা ‘ছোট ফ্ল্যাট’ আর একটা মারুতি দিয়েছেন। আপনারা একটা ‘বাংলো’ আর একটা মার্সেডিজ দিন নিশ্চয়ই শানুকে এনে দেব। এর পর আজ পর্যন্ত প্রতি বছরের পুজোতেই লিখে এসেছি ওর জন্য গান। সুপার হিট হয়েছে ‘সুরের রজনী গন্ধা’, ‘প্রিয়তমা মনে রেখো’, ‘সোনার মেয়ে’, ‘আমার ভালবাসা’ ইত্যাদি ক্যাসেট। অজস্র বাংলা ছবিতেও লিখেছি ওর গান। আমার লেখা ওর ছবির গানগুলোর মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় বাপি লাহিড়ির সুর করা অনিল গাঙ্গুলির ‘বলিদান ছবির’—মানুষ যে আজ আর নেই তো মানুষ / দুনিয়াটা শুধু স্বার্থের/পর আজ ভাই বোন/সংসার পরিজন/সবাই নিজের নিজের’।
‘আশিকী’র পর থেকেই কিশোরকুমার থেকে সরে এসে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে গান গাওয়ার নিজস্ব স্টাইল, নিজস্ব সত্তা। শানু আজ একটা ইন্সটিটিউশান’। সারা ভারতের এই প্রজন্মের তরুণ গায়করা কপি করছে ওকে। আজ মুক্ত কণ্ঠে বলা যায়— কিশোরকুমারের থেকে শানুর কপি সিঙ্গারের সংখ্যা এ দেশে অনেক অনেক বেশি। শানু আরও সফল হোক, আরও বড় হোক এই কামনাই করি।