৫৫
এবারে নতুন কথা বলার আগে একজন অসাধারণ সংগীতগুণী মানুষের বিয়োগ ব্যথার কথা বার বার মনে আসছে। আমি সেই অদ্বিতীয় জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কথাই বলছি। উনি যখন চলে গেলেন সেইসময় আমি ছিলাম মুম্বই-তে। দুঃখে মনটা ভারী হয়ে আসছে একবার ওঁকে শেষ বারের মতো দেখতে পেলাম না বলে। উনি নেই খবরটা আমি শুনলাম মুম্বই থেকে কলকাতায় ফিরে দমদম এয়ারপোর্টে। খবরটা দিলেন এক অপরিচিত ভদ্রলোক। তিনি হয়তো আমায় চেনেন। খবরটা শুনে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম। মুম্বই-তে বাংলা সংবাদপত্র সকালের দিকে পেতাম না। যে সব পেতাম তাও ভাল করে পড়ার সময় পাইনি। কিন্তু ছিলাম তো মুম্বই-এর সংগীতমহলে। কেউ একজনও আমাকে এই সংবাদের কথা জানাতে পারেননি। ওঁরা ভুলে গেছে, নীতীন বসুর ‘বিচার’ ছবির সেই ব্যতিক্রমী সুরকার জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষকে। আমরা ছোটবেলায় যে গান মন ভরে শুনেছি হিন্দিতে ‘মুঝে লাগি লগন’—যার বাংলাটা ছিল ‘বধু খোল দুয়ার’। এ এক অদ্ভুত হৃদয়হীন জায়গা মুম্বই। বছর কয়েক আগে সানি রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে আমার লেখা একটি বাংলা গান রেকর্ডিং হচ্ছিল। স্বভাবতই ওখানে আমি হাজির ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম, অতীত দিনের প্রখ্যাত সুরশিল্পী শ্রীরামচন্দ্র কোনও কারণে থিয়েটারে ঢুকলেন। আশ্চর্য কেউ ওঁকে চিনলেন না। আমার সঙ্গে বেশ কিছুদিন আগে কোথায় যেন একবার আলাপ হয়েছিল। আমি একবার দেখাতেই চিনলাম। কেউ ওঁকে বসবার জন্য চেয়ার ছাড়লেন না দেখে আমি উঠে দাঁড়িয়ে ওঁকে বসতে বললাম আমার চেয়ারটাতে, প্রবীণ সুরশিল্পী আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে বসলেন। উনি আমাকে চেনেননি, চেনার কথাও নয়। আমি পরিচয় দিলাম। বললাম, আপনার সঙ্গে আগেই আলাপ হয়েছিল। হাসিমুখে আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন। আমার আচরণ দেখার পর, ওখানকার উপস্থিত লোকেরা ওঁর কাছে এগিয়ে এলেন। হাসিমুখে কথা বললেন। তা না হলে হয়তো শ্রীরামচন্দ্রজিকে আত্মপরিচয় দিয়ে কাজ সারতে হত। যেহেতু এখন আর শ্রীরামচন্দ্র কোনও কাজ করছেন না অতএব কোনও চিত্রপরিচালক, সুরকার, বাদ্যযন্ত্রী, শব্দযন্ত্রী কারও ওঁকে আর চেনার প্রয়োজন নেই। এরকমই অর্থ এবং আত্মসর্বস্ব মুম্বইয়ের চিত্রজগতে।
মুম্বই-তে যিনি যখন হিট তখন তাঁর পায়ে পড়তেও কেউ কুণ্ঠা করেন না। যেই তিনি ভাগ্যের বিপর্যয়ে ফ্লপ তখন আর কেউই তাঁর দিকে ফিরেও তাকান না। একদা কেউ কৃতী ছিলেন। অনেক কিছু দিয়েছেন চিত্র জগৎকে। তাতে কী? এখন তো বিশেষভাবে তিনি বাণিজ্যিক জগতে নেই। অতএব তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক রাখা এমনকী মনে রাখাও তাঁরা সময়ের অপব্যয় মনে করেন। এমনকী নির্মম হাসি হাসতে হাসতেও সোজাসুজি বলেন, কলকাতায় কাজ কম, সময় বেশি। তাই আপনারা ও সব করতে পারেন। আমরা পারি না।
সুরকার কালীপদ সেন ‘মেজদিদি’ ‘রাত্রি’ ছাড়া কোনও ছবির গান হিট করাতে না পারলেও আজীবন কিছু না কিছু ছবির কাজ পেয়েছেন। ওঁর দুঃসময়ে টেকনিসিয়ান্স স্টুডিয়োর বন্ধুরা ওঁর বাসস্থানের জন্য স্টুডিয়োতে একটি ঘর দিয়েছেন। সেইসঙ্গে নিয়মিত আহারের ব্যবস্থা। মহা বিত্তবান মুম্বই-তে এমন একটা দৃষ্টান্ত কেউ কোনওদিন দেখাতে পারবেন কি?
ও সব কথা ছেড়ে জ্ঞানদার কথাতে আসি। জ্ঞানদা নেই ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। আমার কত গান জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ সুর করেছেন। ওঁর স্ত্রী ললিতা ঘোষের রেকর্ডের কত গান আমি লিখেছি। লিখেছি বেগম আখতারের বিখ্যাত গান ‘ফিরায়ে দিয়ো না মোরে শূন্য হাতে’। বেতারের রম্যগীতির কত অজস্র গান। জ্ঞানদার মহৎ প্রাণের অনেক উদাহরণও পেয়েছি। একবার সুর করার জন্য জ্ঞানদাকে আমি একটা গান দিয়েছিলাম। গানটা ছিল আমায় তুমি জড়িয়ে দিলে বন্ধনে/মালাতে নয়, দুই নয়নের ক্রন্দনে’। রেডিয়োর স্টুডিয়োতে গানটি পড়েই বললেন, চমৎকার লিখেছেন গানটি। সামনের পিয়ানোটাই একটু বাজিয়ে নিলেন। সহযোগী দক্ষিণামোহন ঠাকুরকে ডাকলেন। দক্ষিণাদাও বললেন, বাঃ পুলক। চমৎকার!
তারপরেই কিন্তু জ্ঞানদা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠলেন, না। আমি করব না। এটা দুনিচাঁদ বড়াল করুক। উনি সত্যিকারের ভাল গান খুঁজছেন। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় এ গানটা দারুণ গাইবেন। সত্যি সেই জ্ঞানদা চলে গেলেন। ‘আমায় উনি জড়িয়ে গেলেন বন্ধনে/অনেক দিনের সুখের স্মৃতির ক্রন্দনে।
এই সরল এবং সংগীত-পণ্ডিত মানুষটিকে আমি আমার প্রণাম জানাই।
এবার আসি অন্য প্রসঙ্গে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যখন তখন বলতেন, ভাগ্য ছাড়া কিছুই হয় না। আমার মতো অনেকেই হয়তো এই কথাটা স্বীকার করবেন। আমি আজীবন দেখেছি যোগ্যতা এবং সৌভাগ্য যাঁদের আছে বা ছিল তাঁরা ঠিকই বড় হয়ে উঠেছেন। আমার দেখা এবং আমার জানা এমন অনেক প্রতিভাই ছিল এবং আছে, অনেকটা ভাগ্যের বঞ্চনাতেই তাঁরা তেমন বিকশিত হতে পারেননি। এটা অবশ্য আমার ধারণা। এই তালিকায় প্রচুর নাম মনে আসছে। প্রথমেই মনে আসছে হেমন্তদার ভাই অমল মুখোপাধ্যায়ের কথা। অমল তেমন বড় মাপের গায়ক না হলেও সুরকার হিসাবে ছিল দারুণ ভাল। হেমন্তদা নিজে এ কথাটা মানতেন। কোনও নতুন সুরকার যদি হেমন্তদাকে কিছু করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতেন তখন হেমন্তদা হাসিমুখে বলে দিতেন, আমার ভাই অমল এত ভাল সুর করছে জেনেও আমি তার জন্য কিছু করতে পারছি না। আপনার জন্য আমি কী করব?
উত্তমের ভাই তরুণকুমারের খুবই বন্ধু ছিল অমল। ওঁরা যখন ‘অবাক পৃথিবী’ ছবি করল তখন সেই ছবির সংগীত পরিচালনার সুযোগ দিল অমলকে। মনে পড়ছে ওই ছবির আমার লেখা হেমন্তদার গাওয়া উত্তমের ঠোঁটে দুখানা গান ‘সুর্পণখার নাক কাটা যায়’ এবং ‘এক যে ছিল দুষ্টু ছেলে’। গান দুটি খুবই হিট করেছিল।
এরপর অমল সুযোগ পেল সুশীল মজুমদার পরিচালিত উত্তম সুচিত্রার ‘হসপিটাল’ ছবিতে। পরে অবশ্য অন্য কারণে ওই ছবিতে উত্তম অভিনয় করেনি। করেছিলেন অশোককুমার। কিন্তু উত্তম সুচিত্রাকে নিয়েই খুব ধুমধামের সঙ্গে মহরত হয়েছিল। এই ছবিতে গীতা দত্তর গাওয়া ‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়’ গানটি অমলের সুরে সুপার ডুপার হিট হল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এরপরে তেমন উল্লখযোগ্য ছবি পেল না অমল। আমি ওর সঙ্গে পরে যে সব ছবিতে কাজ করেছি তার মধ্যে মনে আসছে পরিচালক কনক মুখোপাধ্যায়ের ছবি। ছবিটির নাম সম্ভবত ‘এই তো সংসার’। এই ছবিতে এখনকার ভারতখ্যাত আর তখনকার কলকাতার নিউ আলিপুরের বাসিন্দা কিশোরী অলকা ইয়াগনিকের, বাংলা গানেই প্রথম প্লে-ব্যাক করা। তারপর রমাপ্রসাদ চক্রবর্তী পরিচালিত ‘রেঞ্জার সাহেব’ ছবিতে কাজ করেছিলাম। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘ও পাখি আজ তুই যাসনে উড়ে’ এই গানটিও বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। তবুও কিন্তু অমলকে তেমনভাবে ছবিতে সংগীত পরিচালনার জন্য কেউ ডাকল না। নিজের সুরে অমলের গাওয়া রেকর্ডে কিছু বেসিক গানও জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। আমার খুবই প্রিয় ওর গাওয়া চুপ চুপ লক্ষ্মীটি/শুনবে যদি গল্পটি’। কেন অমল যোগ্যতা প্রমাণ করেও নিষ্প্রভ হয়ে গেল তার কারণ খুঁজে হতাশ হয়ে ওই ওপরের দিকে আঙুল তুলে বলতে হবে, সব ওই ওপরওয়ালার ইচ্ছে।
আর একজনের নাম মনে আসছে সে সুধীন সরকার। প্রকৃত গায়কের সমস্ত গুণ থাকা সত্ত্বেও এবং নীতা সেনের সুরে গাওয়া, কিছু গান হিট করার পরও কেউ তাকে তেমন সুযোগ দিলেন না। আমার ধারণা সুধীন সরকার প্রকৃত সুযোগ পেলে এখনও নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারবেন।
আপনাদের মনে আছে কি, জলসা শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে গাড়ির দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান গায়ক মলয় মুখোপাধ্যায়। ওই দুর্ঘটনার জেরেই কিছু দিন পর প্রাণ হারান মূকাভিনয়ের পথিকৃৎ অরুণাভ মজুমদার।
ওরই অনুজ দীপক মজুমদার। সত্যিকারের সুরুচিসম্পন্ন অনেক সংগীতানুষ্ঠানেই গান গেয়ে উনি নিয়মিত অজস্র সমঝদার শ্রোতাদের অনাবিল আনন্দ দিয়ে আসছেন।
দীপকের গান শুনে তারিফ করছেন অনেকেই। সমাদরে নিয়ে যাচ্ছেন নতুন সংগীতানুষ্ঠানে। এই চলছে দিনের পর দিন। সত্যিকারের রসসমৃদ্ধ গানের পরিবেশন করার ক্ষমতার প্রমাণ পাচ্ছেন প্রচুর সুধীজন। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউই কোনও ক্যাসেট প্রতিষ্ঠানে অথবা ছায়াছবির নেপথ্য গানে ওকে আহ্বান জানাচ্ছেন না। একে ভাগ্য ছাড়া আর কী বলবেন।
আর একজন সংগীতশিল্পী নীলাঞ্জন রায়। নীলরোহিত নামে যিনি গান করেন। চমৎকার ভরাট গলা। শ্রোতাদের মুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখেন। তাঁরও তো সেই একই অবস্থা।
এমনই আর একজনের নাম দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। একটি কলেজের অধ্যাপক হয়েও গান রচনা, গানের সুর করা এবং গান গাওয়াতে বহুদিন মনোনিবেশ করে আসছেন। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কথা এবং সুরে, ওঁর গাওয়া রেকর্ডের একটি গান আমার দারুণ প্রিয়, ‘যে আকাশে নামে বাদল’। উনি কিছু ভাল গানও রচনা করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের সুরে, দ্বিজেনবাবুরই গাওয়া ‘যদি বলি তোমার দু চোখ’ এবং দীপঙ্করের সুরে রচনায় মান্না দের গাওয়া ‘জবাব চেও না এই প্রশ্নের। এরপর দীপঙ্করকে পেয়েছিলাম আর এক উজ্জল ভূমিকায়। ওরই বন্ধু তখন শুনেছিলাম প্রযোজনার এক অংশীদার অভিনেতা অসীম বর্মণের এবং অসীমা ভট্টাচার্যের ‘বাঘবন্দি খেলা’ ছবিতে। পীযূষ বসু পরিচালিত এই ছবিটির সংগীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। গান লিখেছিলাম আমি। এই ছবির দুটি গানই সুপারহিট হয়েছিল। একটি ছিল হেমন্তদার গাওয়া, ‘আয় আয় আসমানী কবুতর, অন্য গানটি মান্নাদার গাওয়া, টুকরো হাসির তোল ফোয়ারা’। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এরপর দীপঙ্কর যতদুর স্মরণে আসছে আর কোনও ছায়াছবিতে সুযোগ পাননি। কেন পাননি তার উত্তর ওপরওয়ালারাই জানেন।
আবার আমার শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের নাম মনে আসছে। শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের কাছে গান শিখতেন অসীমা ভট্টাচার্য। শৈলেনের বাড়িতেই এঁদের সঙ্গে আমার আলাপ। একদিন এঁদের যোধপুর পার্কের বাড়িতে কথা প্রসঙ্গে অসীমার আগের স্বামী দিলীপবাবু আমায় বললেন, শৈলেনবাবুর সুরে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় বারে বারে কে যেন ডাকে আমারে’, ইলা বসুর ‘কত রাজপথ জনপথ’, আপনার লেখা আলপনা মুখোপাধ্যায়ের (বন্দ্যোপাধায়) যদি তোমার জীবনে সাথী না হয়ে’ গায়ত্রী বসুর ‘আজ মালঞ্চে মৌসুমী হাওয়া লাগল’, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তোমার দীপের আলোতে নয়’, শৈলেনবাবুরই গাওয়া ‘কি তুমি দেখ বল আমার চোখে’—এমন অজস্র ভাল ভাল গান আছে। অথচ ফিল্মে ওঁর কোনও সুর নেই কেন? সম্ভবত অসীমা দেবী উত্তর করলেন, কোনও ছবিতে চান্স পাননি তাই।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ দিলীপবাবু বলেছিলেন, আমি যদি ছবি করি আর আমিই যদি শৈলেনবাবুকে চান্স দিই? এইভাবেই তনুজা অভিনীত ‘দোলনা’ ছবির সূচনা। যে ছবিতে, আমার লেখা লতা মুঙ্গেশকরের গাওয়া ‘আমার কথা শিশির ধোয়া… গানটিতে অপূর্ব সুর করেছিল শৈলেন। তারপর দিলীপবাবুর যোগাযোগে, আরও কিছু ছবিতে সুর করেছিল শৈলেন। ঠিক কী কারণে জানি না পরের ছবি ‘চৌরঙ্গী’ থেকে সরে এলেন শৈলেন। অসীমা ভট্টাচার্য নিজেই হলেন সুরকার। ‘চৌরঙ্গী’ ছবি আগে পরিচালনা করার কথা ছিল অগ্রগামী গোষ্টীর সরোজ দে’র। মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন উত্তমকুমার। সমস্ত শিল্পী নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ সরোজবাবুর সঙ্গে অনিবার্য কারণে বনিবনা হল না দিলীপবাবুর। উত্তমকুমারের মধ্যস্থতায় সে ছবি ছেড়ে দিলেন অগ্রগামী। এবার পরিচালক হয়ে এলেন পিনাকী মুখোপাধ্যায়।
এই ঘটনার পর ওই ছবির অন্তরঙ্গ কার মুখে যেন শুনেছিলাম, বাংলা সিনেমা আর্টিস্টদের তুমি চেনো না। জেনে রেখো, উত্তমকুমার অবশ্য থাকছেনই কিন্তু উত্তম ছাড়া অগ্রগামী নির্বাচিত অন্য কোনও শিল্পী পানুদার এই ছবিতে অভিনয় করবেন না বলে ঘোষণা করেছেন। অন্য শিল্পীদের নিয়ে ‘চৌরঙ্গী’-র কাজ করতে হবে পানুদাকে।
৫৬
শেষ পর্যন্ত দেখা গেল একমাত্র মাধবী মুখোপাধ্যায় ছাড়া, সব শিল্পীই অগ্রগামী অর্থাৎ কালোদাকে, কোনও না কোনও অজুহাত দেখিয়ে এবং ভদ্রতা বজায় রেখে অনুমতি নিয়েই পানুদার ছবিতে হাসিমুখে কাজ করলেন। যাই হোক ‘চৌরঙ্গী’ ছবিতে চমৎকার সুর করেছিলেন অসীমা ভট্টাচার্য। হেমন্তদার গাওয়া ‘কাছে রবে/জানি কোনও দিনই হবে না সুদূর’ এবং মান্নাদার গাওয়া বড় একা লাগে এই আঁধারে’ দু’টি গানই খুব জনপ্রিয় গান। পরে অসীমাদেবী করলেন ‘মেমসাহেব’। এর গান কিন্তু তেমন জমল না। তারপর অনেক ছবিতে সুর করলেন অসীমাদেবী। প্রথমেই মনে আসছে ‘শুভরজনী’ ছবিতে আমার লেখা মান্না দে-র গাওয়া ঈশ্বর বললেন…….’ গানটির কথা। এ ছাড়া আর যে সব ছবিতে ওঁর গান লিখেছিলাম তার মধ্যে ‘ফুলশয্যা’ ছবির গান আমার খুবই প্রিয়। বিশেষ করে তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও পিন্টু ভট্টাচার্যের গাওয়া ‘সাত সাতশো মেয়ে দেখে একে এনেছি ঘরে’ এবং দীনেন গুপ্তের ‘আজকের নায়ক’ ছবির গানগুলির মধ্যে দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় ও আরতি মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘যদি আমার এ-মন আমি না হারাতাম’। এই ছবিতেই সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের প্রথম অভিনয়। এরপরেই দিলীপ ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয় এবং অভিনেতা পার্থ মুখোপাধ্যায়কে বিবাহ করেন অসীমাদেবী। সেই সময় উনি যোগ দিলেন কলকাতার বেতারে। স্বভাবতই গানের অন্য বাণিজ্যিক জগত্টায় উনি আর বেশি সময় দিতে পারলেন না। তবু মনে আছে ওঁর পরের কিছু কিছু ছবিতে আমি গান লিখেছিলাম। আধুনিক গানে ওঁর স্মরণীয় সৃষ্টি আমার লেখা মান্নাদার গাওয়া দুঃখ আমার তোমায় যে আমি ভালবেসেছি’ এবং ‘গোলাপে কাঁটা বলে।
এই অসীমাদেবীর চমৎকার সুরেই হেমন্তদার আধুনিক গানের প্রথম এল পি রেকর্ডে আমি লিখেছিলাম আমার একটি অতি প্রিয় রচনা ‘যখন জমেছে মেঘ আকাশে’। বেতারে মাসের গানে এবং রম্যগীতিতে উনিই প্রথম মান্না দেকে দিয়ে গান গাইয়েছিলেন। সৌভাগ্যবশত সেই গানগুলির গীতিকার ছিলাম আমি।
গায়িকা অসীমাদেবী আমার লেখা অনেক গান গেয়েছেন। তবুও বলতে দুঃখ লাগছে, অজ্ঞাত কারণে অসময়েই নিষ্প্রভ হয়ে গেলেন উনি। ওঁর পূর্ণ প্রত্যাবর্তন কামনা করছি।
জয়ন্ত বসু পরিচালিত ‘পুনর্মিলন’ ছবিতে আমার লেখা একটি গান ছিল। কানু ভট্টাচার্যের সুরে গানটি গেয়েছিলেন অনুপ জলোটা। গানটি হচ্ছে ‘কার ভাগ্যে কী আছে তা/কে বলিতে পারে’? এ সব কথা মনে পড়লেই আমার কানে এই গানটি বাজতে থাকে।
এবার একেবারে অন্য প্রসঙ্গে আসি। হঠাৎ শুনতে পেলাম মুনমুন সেনের রাগী কণ্ঠস্বর। তাপস পালকে বলছে মুনমুন ‘কলেজ যাচ্ছি। হাতে বই খাতা। তাতেও নিস্তার নেই? ভগবান না হয় একটু সুন্দরী করেই আমায় পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তা বলে কি সবাইকে পাগল হয়ে যেতে হবে নাকি?’
ও কথায় কর্ণপাত না করে তাপস পাল হিন্দির ‘শ্বশুরাল’ ছবির ‘তেরি প্যায়ারে প্যায়ারে সুরত কো’-র সুরের ওপর বাংলা গান গেয়ে উঠল ‘তোমার পাগল করা ওই রূপেতে/নজর না কারও লাগে/টিপ কপালে দাও’।
গানটি শুনে স্বভাবতই মুনমুন প্রচণ্ড উষ্মায় ফেটে পড়ল, ‘ইউ নটি’। তাপস ম্যানেজ মাস্টার।
মুনমুনকে ঠাণ্ডা করতে বলল, ‘আহা হা। রাগ করবেন না। এটা আমার হবি, অন্তাক্ষরি খেলার একটা লেটেস্ট অ্যাপ্রোচ।’
মুহূর্তে মুনমুন গলে জল। সেও অবাক হয়ে বলল, ইজ ইট? এটা তো আমারও হবি। বেশ, এখনই অন্তাক্ষরি খেলা শুরু হোক। আপনি তো শুরু করেছেন ‘টিপ কপালে দাও’ দিয়ে। অর্থাৎ আমাকে ও দিয়ে শুরু করতে হবে এই তো। মুনমুন গাইল হিন্দি ‘জিস দেশমে গঙ্গা বহতি হ্যায়’ ছবির ‘ও বসন্তী পবন পাগল’-এর সুরে বাংলা গান ‘এ বসন্তের পবন পাগল।’
এভাবেই বিভিন্ন গানের আদান প্রদানে জমে উঠল ওদের খেলা। এই অন্তাক্ষরি খেলতে খেলতে খেলার শেষ দিকে মুনমুন তাপস একসময় বুঝল আজকের এই খেলায় কেউ হারেনি কেউ জেতেনি। কী করে যেন ওরা দুজনে একাকার হয়ে গেছে। তাই ক্লাইমেক্সটা শেষ করল হিন্দি ছবি ‘চলতি কা নাম গাড়ি’-র দ্বৈতগীতি ‘হাল ক্যায়সা হ্যায় জনাব কা’-র সুরের ওপর বাংলায় দ্বৈতগীতি গেয়ে মিলে গেল যদি মনটা’।
এইচ. এম. ভি. ক্যাসেটে আমার রচনা ও পরিচালনায় সে বার পুজোয় সম্পূর্ণ নতুন ধরনের অভিনব একটা ব্যাপার করেছিলাম তা হল এই অন্তাক্ষরি গীতিনাট্য। যার নাম দিয়েছিলাম ‘খেলতে খেলতে’। এইচ. এম. ভি. কর্তৃপক্ষ আমায় অনুরোধ করেছিলেন হিন্দির বাংলা ভার্সান গান দিয়ে একটা অন্তাক্ষরি ক্যাসেট বানাতে। তখন দু-একটা হিন্দি ছবিতে অস্তাক্ষরি খুবই হিট হয়েছিল। এমনকী তরুণ মজুমদারের ‘সজনী গো সজনী’ ছবিতেও এই ধরনের একটি অন্তাক্ষরি গানের আসর আমাকে বানাতে হয়েছিল। বুঝলাম, ওদের অনুপ্রেরণার কারণ এইটাই। আমি বললাম, ক্যাসেটে অন্তাক্ষরি করে কী হবে? একজন জিতবে একজন হেরে যাবে এই তো? প্রথমবার শুনলে শ্রোতারা হয়তো মজা পাবেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার শোনার আকর্ষণ আর থাকবে কেন? ওঁরা জেনেই যাবেন কে জিতবে কে হারবে। তার থেকে একটা গীতিনাট্য বানাই যার মধ্যে একটা গল্প থাকবে।
ওঁরা আমার প্রস্তাব তৎক্ষণাৎ সানন্দে অনুমোদন করলেন। লেখা শোনানোর পর বললাম ‘খেলতে খেলতে’ গীতিনাট্যের নায়ক-নায়িকা হোক তাপস পাল আর মুনমুন সেন। ওঁরা রাজি হলেন।
আমি বললাম গায়ক গায়িকা কিন্তু আমার চাই কুমার শানু আর অলকা ইয়াগনিক। ওঁরা বললেন, শানু তো এইচ. এম. ভি-তে আপনার লেখা পুজোর গান করছেনই, অন্য শিল্পী নিন।
এই মুহূর্তে সঠিক মনে পড়ছে না, সেই বছর শানু অরূপ-প্রণয়ের সুরে আমার লেখা ক্যাসেট ‘সুরের রজনীগন্ধা’ করেছিল? না কি করেছিল আমার লেখা ‘প্রিয়তমা মনে রেখ’? কিন্তু গায়ক গায়িকা নির্বাচনের ভারটা ওঁদের ওপর ছেড়ে দিতেই ওঁরা যাঁদের নাম বললেন তা আমার পছন্দ হল না। তখন গভীর আত্মবিশ্বাসে বলেছিলাম, যদি শানু অলকা না পাই তা হলে নেব নাম না করা নতুন শিল্পী। এরই ফলে বাবুল সুপ্রিয় ও কেয়া আচারিয়ার এইচ. এম. ভি. ক্যাসেট ঘটল প্রথম আত্মপ্রকাশ। আমার এই ‘খেলতে খেলতে’ অস্তাক্ষরি গীতিনাট্যের সব গানগুলো গেয়েছিল ওরা দুজনে। যতদূর জানি বাবুলের পিতামহ ছিলেন আগের যুগের একজন গীতিকার এবং সুরকার। নাম সম্ভবত নির্মলকুমার বড়াল। মূলত আমারই অনুপ্রেরণাতে নামী ব্যাঙ্কের দামি চাকরি ছেড়ে মুম্বই-তে স্ট্রাগল করতে শুরু করল। বলতে দ্বিধা নেই, ও নামী হয়েছে কিন্তু গানের আইডেনটিটি এখনও আসেনি। আমি সাগ্রহে তার জন্য অপেক্ষা করছি।
তবে একদিন বাবুল আমায় মারাত্মক একটা কথা বলেছিল। সেটাই সম্ভবত ওর এখনও লাইম লাইটে না আসার কারণ। আমায় দুঃখ করে ও জানাল, আপনি আমায় বার বার বলছেন এক বিখ্যাত গায়কের কপি কণ্ঠ না হতে। আমি তো প্রাণপণে ওই অক্টোপাসের হাত থেকে মুক্তি চাইছি। কিন্তু সুরকারেরা আমায় মুক্তি দিচ্ছেন কই? ওই শিল্পীর সঙ্গে যখন নাদিম শ্রাবণের মনোমালিন্য হয়েছিল ওঁরা আমায় দিয়ে গান গাওয়াচ্ছিলেন। যে গানটাই আমি নিজস্বভাবে গাইতে গেছি, ওঁরা বলেছেন—না। তোমাকে ওরই কপি কণ্ঠ হয়ে গাইতে হবে। প্রযোজকরা তোমায় নিতে রাজি হয়েছেন, তুমি হুবহু ওই কণ্ঠের ধ্বনিটা আনতে পার বলেই। যদি তা না পার তোমার গান থাকবে না। অন্য শিল্পী ডাব করে দেবে। নিজের অস্তিত্ব বাঁচাতে এবং অত বড় সুরকারদের না চটাতে বাধ্য হয়ে আমাকে ওই শিল্পীর অনুকরণ করতে হয়েছে। বলুন তো এতে আমার কী অপরাধ?
বাবুলের ব্যাপারে একটা মজার ঘটনা বলি। বাবুল যখন আমার অনুপ্রেরণায় ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে মুম্বই-তে স্ট্রাগল করবে মনস্থ করল, তখন বাবুলের পিতৃদেব ওই ব্যাঙ্কেরই বড় অফিসার। একদিন আমার বাড়ি এলেন, অনুযোগ করলেন—আমিই নাকি ওর মাথা খাচ্ছি। আমি শুধু বলেছিলাম—মাথা ঠাণ্ডা করে অপেক্ষা করুন। সেবার বাবুলের মুম্বই-এর বিলাসবহুল লখনওয়ালার ফ্ল্যাটে দেখি উনি রয়েছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ছুটিতে বেড়াতে? উত্তর দিলে বাবুল, না, না। বাবাতো ব্যাঙ্ক থেকে ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট নিয়েছেন। প্রায়ই মুম্বই আসেন। বললাম, কী মশাই, আমি আপনার ছেলের মাথা খেয়েছি তো? ভদ্রলোক উত্তরের কথা খুঁজে পেলেন না। শুধু হাসলেন।
কেয়া আচারিয়ার কাহিনী একটু ভিন্ন। ও মুম্বই-তে বেশ কিছুদিন স্ট্রাগল করল। বাপি লাহিড়ি, লক্ষ্মীকান্ত প্যারেলাল প্রমুখ অনেক খ্যাতনামা সুরকারের সুরে প্লে-ব্যাক করল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হিট হল না সে সব গান। ইতিমধ্যে ও বিয়ে করল। সন্তানের জননী হল। সংসারের টানেই ফিরে আসতে হল কলকাতায়। বাবুল বোস, মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপম দত্ত চন্দন রায়চৌধুরী প্রমুখ সুরকারের বিভিন্ন হিন্দি বাংলা ওড়িশি ছবিতে এখন নিয়মিত গান গেয়ে চলেছে কেয়া। কিন্তু বাবুলের মতো কেয়ারও এখনও সে সাফল্য আসেনি। আমি কেয়ার শুভদিনের প্রতীক্ষায় দিন গুনছি।
আগেকার লোকেদের কাছে গল্প শুনেছি, মফস্বল শহরে বা শহর থেকে কিছু দূরে যেখানে তখনকার জমিদার বা ওই শ্রেণীর বর্ধিষ্ণু উচ্চবিত্ত মানুষরা থাকতেন, তাঁদের চোঙাওয়ালা কলের গানের রেকর্ড জোগান দিতেন শহরের রেকর্ড ডিলাররা তাদের লোক মারফত। এই ফেরিওয়ালার চাকরি পেতে গেলে তার প্রধান গুণ হবে, তাকে অবশ্যই গাইয়ে হতে হবে। দ্বিতীয় গুণ, তার চেহারাও ভাল হওয়া চাই। মনে করুন ঢাকা জেলার এক জমিদার বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলেন একজন রেকর্ডের ফেরিওয়ালা। যার সঙ্গে রয়েছে এক মালবাহক। যার কাঁধের শক্ত বাঁশের বাঁকের দুধারে ঝোলানো রয়েছে বেশ কয়েক বাক্স গ্রামাফোন রেকর্ড। কলের গানের ফেরিওয়ালা এসেছে খবর পেয়ে, যে ঘরে জমিদারবাবু বসবেন সেই ঘরেরই চিকের আড়ালে আশপাশের বারান্দায় এসে জমায়েত হবেন সেই বাড়ির পর্দানশীন মেয়ে বউরা।
ফেরিওয়ালাকে প্রশ্ন করা হবে কী গান এনেছ?
ফেরিওয়ালা সবিনয়ে বলবেন, বাবুমশাই, ঠাকুর দেবতার গান। ভাটিয়ালি গান। আর অন্য গানও আছে। আপনার যেমন ইচ্ছা তেমনটিই পাবেন।
বাবুমশাই আরামকেদারায় টানা পাখার বাতাস খেতে খেতে বলবেন, বেশ তো, প্রথমেই শোনাও ঠাকুর দেবতার গান।
আপনারা ভাবছেন রেকর্ডের ফেরিওয়ালা নিশ্চয় তখন বাবুমশাইয়ের চোঙাওয়ালা কলের গানে ঠাকুর দেবতার গান বাজিয়ে শোনাবেন। তা কিন্তু নয়। ফেরিওয়ালা তখন স্বকণ্ঠে গেয়ে শোনাবেন ওই নতুন গানের রেকর্ডের খানিকটা।
বাবুমশাই বলবেন, আরও একটা শোনাও। ফেরিওয়ালা গেয়ে শোনাবেন আরও একটা গান। এ এইভাবে শুনতে শুনতে যে গানগুলো বাবুমশাইয়ের পচ্ছন্দ হবে, সেই রেকর্ডগুলো বাক্স থেকে বার করে বাবুমশাইয়ের চরণে রেখে দিয়ে তাঁকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াবেন রেকর্ডের ফেরিওয়ালা।
এ বার বাবুমশাই-এর প্রধান মোসাহেব বা তাঁর প্রধান খিদমতগার খুশিমতো রেকর্ডগুলোর কিছু কিছু অংশ ওই কলের গানে বাজাবেন। তরপর জমিদারের উদ্দেশে বলবেন, সত্যি আপনার কান আছে। যে সব গান কিনলেন সে সব গান এই জেলায় আর কারও ঘরে নেই। কথাটা বলেই রেকর্ডের ফেরিওয়ালার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মোসাহেব বলবেন, এই, আর কাউকে এই রেকর্ডের গানগুলো বেচবি না। খবর পেলে লাঠিয়াল লাগিয়ে দেব। ফেরিওয়ালা সঙ্গে সঙ্গে কান ধরে জিভ কেটে বলবেন, কী যে বলেন বাবু। গান তো কলকাতা থেকে একটা করেই এসেছিল। আপনাদের কৃপাদৃষ্টি পেল। তাই এগুলো এখানেই রয়ে গেল। আর কোথায় পাব যে এই জেলায় ফেরি করব?
এ বার বাবুমশাই বলে বসবেন, যাও নায়েবের কাছ থেকে পাওনা গণ্ডা বুঝে নাও।
এ বার তাঁর খাস চাকরকে বলবেন, এই, নায়েবকে বলে দে তো একে বিদায় দিতে।
আবার এক দফা প্রণাম করে চলে যাবেন রেকর্ডের ফেরিওয়ালা। যাবার আগে ফাউ হিসাবে প্রণামী দিয়ে যাবেন একটা ছোট অর্থাৎ পরবর্তীকালে ই পি রেকর্ডের মাপের ওই গালারই একটা রেকর্ড। যে রেকর্ড তখন খুব অল্প দামে বিক্রি হত।
এই রকম রেকর্ডের ফেরিওয়ালারা তখন ভারতবর্ষের সর্বত্র ছিল। প্রথম জীবনে নাকি এমন কাজই করতেন পরবর্তীকালের বিখ্যাত গায়ক তালাত মামুদ। এইচ. এম. ভি-র তখনকার এক অধিকর্তা পি কে সেন স্বয়ং তাঁর পার্ক সার্কাসের বাড়িতে সন্ধ্যার মজলিসে গল্প করতে করতে এই ঘটনা শুনিয়েছিলেন পি কে সেন স্বয়ং। উনি ইউ পি-র এইচ. এম. ভি-র এক নামী দোকানে দেখা পান সুপুরুষ তরুণ তালাত মামুদের। ডিলারই ওঁকে বলেন তালাতের গান শুনতে। ওই দোকানে বসেই তালাতের অপূর্ব কণ্ঠের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে পি কে সেন এইচ. এম. ভি.-তে গান রেকর্ড করার সুযোগ দেন। ওখানে রেকর্ডিং-এর সুফল দেখে পি কে সেন, তালাতকে তখনকার কলকাতার এইচ. এম. ভি.-তে রেকর্ড করতে কলকাতার অধিকর্তা ইউরোপিয়ান মালিক গোষ্ঠীর কাছে পাঠান।
৫৭
তখন সারা ভারতবর্ষে এইচ. এম. ভি-র সব কিছু বড় কাজই কলকাতা থেকে হত। এইচ. এম. ভি-র নিজের স্টুডিয়ো, নিজের মিউজিশিয়ান এবং সব থেকে বড় ব্যাপার এইচ. এম. ভি-র রেকর্ড প্রিন্টিং মেশিনটা ছিল দমদমে অর্থাৎ কলকাতাতেই। শুধু ভারতবর্ষেই নয় এইচ. এম. ভি-তে রেকর্ড প্রিন্ট করতে অর্ডার আসত এশিয়ার নানা জায়গা থেকে।
তালাত মামুদের গান শুনে মুগ্ধ হলেন কমল দাশগুপ্ত। ওঁকে দিয়ে বাংলা গাওয়ানো মনস্থ করলেন। কিন্তু তখনকার এইচ. এম. ভি. আশঙ্কা করলেন, তালাত মামুদের নাম থাকলে যদি রেকর্ড বাংলাতে না চলে। তাই তালাতের নতুন নাম রাখা হল তপনকুমার। সম্ভবত এই কারণেই একদা বিখ্যাত গায়ক মহম্মদ কাশেম, শ্যামাসংগীত এবং ভক্তিমুলক গান রেকর্ড করার সময় নাম বদলে হয়েছিলেন কে মল্লিক। যতদূর আমার স্মরণে আসছে কে মল্লিকের পর শ্যামাসংগীতের গানের আসরে অবতীর্ণ হন মৃণালকান্তি ঘোষ। উনি অনেক বাংলা ছায়াছবিতে অভিনয়ও করেছিলেন, আবার গানও গেয়েছিলেন। ওঁর গাওয়া একটি গান আমাদের ছোটবেলায় সর্বত্র শুনতাম ‘বল রে জবা বল/কোন সাধনায় পেলিরে তুই মায়ের চরণ তল’? যাই হোক কমল দাশগুপ্তের সুরে পর পর হিট হল তপনকুমারের বাংলা গান। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য গিরিন চক্রবর্তীর কথায় ‘দুটি পাখি দু’টি তীরে/মাঝে নদী বহে ধীরে’ এবং প্রণব রায়ের কথায় ‘ঘুমের ছায়া চাঁদের চোখে’
আগেই বলেছি তখনকার ছায়াচিত্রে প্রবেশ করার একটা বিরাট গুণ ছিল নায়কের গান জানা। তালাত মামুদ ছিলেন সুদর্শন। তাই সহজেই কলকাতার নিউ থিয়েটার্সে মাস মাহিনাতে চুক্তিবদ্ধ শিল্পী হয়ে গেলেন। মনে অনেক আশা নিয়ে নিয়মিত স্টুডিয়োতে যান। শুটিং দেখেন। বহু লোকের সঙ্গে আলাপ করেন। কিন্তু তখনকার নিউ থিয়েটার্সে কোনও পরিচালকই ওঁকে কোনওদিন কোনও ছবিতে একদিনেরও কাজ দেন না। রোজ আসেন এবং সন্ধ্যার পর চলে যান। এই সব কথা তালাত অনেক পরে হাসতে হাসতে আমাকে শুনিয়ে ছিলেন।
সুদীর্ঘদিন নিউ থিয়েটার্সে চাকরি করেও একটা ছবিরও প্লে-ব্যাক ওখান থেকে পাননি। এদিকে বাংলা গানের জগতে ওঁর নাম দিন দিন বাড়তে থাকে। সুরকার রবীন চট্টোপাধ্যায় এই তালাত মামুদকে ছবিতে কাজে লাগিয়েছিলেন ওঁর সুরে ‘সাত নম্বর বাড়ি’ ছবিতে। সুপারহিট সেই গানটি প্রণব রায়েরই লেখা ‘কথা নয় আজি রাতে’।
তখনকার নিউ থিয়েটার্সে ‘কাশীনাথ’ ছবির নায়িকার নাম ছিল সম্ভবত লতিকা চট্টোপাধ্যায়। এই লতিকা দেবীর সঙ্গে বিয়ে হয় তালাত মামুদের। তারপর উনি চলে যান মুম্বই-তে। ওখানে প্রচুর ছবিতে প্লে-ব্যাক করেন। রবীন্দ্রনাথের ‘একদা তুমি প্রিয়ে’— গানের সুরের ছায়ায় গড়ে ওঠা শচীন দেববর্মণের সুরে বিমল রায়ের ছবির সেই বিখ্যাত গান ‘জ্বলতে হ্যায় জিসকা লিয়ে’ আজও অনেকের স্মরণে আছে।
মুম্বই-তে কিছু হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেন তালাত। কিন্তু ওঁর গান লোকে যেভাবে গ্রহণ করেছিল, ওঁর অভিনয় সেভাবে গ্রহণ করেনি। এদিকটাতে অসফল হন তালাত মামুদ।
মুম্বই-তে থাকলেও তালাত কিন্তু বাংলা গান ছাড়েননি। ভি বালসারার সুরে শ্যামল গুপ্তের লেখা ‘তুমি সুন্দর নাই যদি হও’ এবং ‘যেথা রামধনু ওঠে হেসে’ গান দুটো আজও সবাই শোনেন। এই তালাতের খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নিকট আত্মীয় রঞ্জিত সিংহ। রঞ্জিতের মাধ্যমেই তালাতের সঙ্গে আমাদের আলাপ।
এবার শোনাই, তালাতের গান নিয়ে আমার জীবনের এক অদ্ভুত ঘটনা। একবার পুজোতে ঠিক হল, আমি মুম্বইয়ের মান্না দে এবং তালাত দুজনেরই গান লিখব। মান্না দে নিজের সুরে গাইবেন। আর তালাত গাইবেন কানু ঘোষের সুরে।
সেইমতো আমি আমার গানের খাতা থেকে বাছাই করে দুটো দুটো চারটে গান পোস্টে মান্না দে এবং কানু ঘোষকে পাঠিয়ে দিলাম।
পুজো রেকর্ডিং-এর কিছুদিন আগেই, অন্য কী একটা ছবির কাজে আমাকে মুম্বই যেতে হল। গিয়েই দেখা করলাম মান্না দে’র সঙ্গে। উনি বললেন, আমার গান গত পরশু দিন রেকর্ডিং হয়ে গেছে। শুনুন না কেমন হয়েছে।
কথাটা বলেই উনি যেন কাকে টেলিফোনে এখনই আসতে বললেন। তারপর যথারীতি মুড়ি মান্নাদা হারমোনিয়াম নিয়ে বসে শোনালেন, আমার লেখা গান দুটি ‘আমার না যদি থাকে সুর’ এবং ‘জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই’। গান শেষ হওয়ার পরেই সেখানে এলেন সুরকার কানু ঘোষ। আমাকে দেখতে পেয়েই হাসি মুখে বলে উঠলেন, আপনি কী রকম ভুলো লোক মশাই। আপনাকে আজই কলকাতায় ফোন করতাম।
কথাটা শুনেই খুবই ঘাবড়ে গেলাম। উত্তর দেওয়ার আগেই মান্নাদা বললেন, ভাগ্যিস তালাতের গান রেকর্ড হওয়ার আগেই কানুবাবু আমার বাড়িতে এসেছিলেন। তা না হলে একটা কাণ্ড ঘটে যেত। এবার প্রশ্ন করলাম, কী হল বলুন না খুলে। মান্নাদাই হাসতে হাসতে জবাব দিলেন, কানুবাবু একদিন আমার বাড়িতে এসে বললেন, মান্নাবাবু, পুজোর কী গান বানিয়েছেন শোনান। খুব মনযোগ দিয়ে গান শুনে কানুবাবু বললেন, দারুণ সুর করেছেন মান্নাবাবু। ‘জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই’ গানটা চমৎকার সুর। আমার সুরের থেকে অনেক ভাল। পুলকবাবু একই গান দুজনকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
কানুবাবুর কথা শুনে আমি শিউরে উঠলাম। বললাম, তাই নাকি? সত্যিই তাই। ভাগ্যিস তালাতের গান রেকর্ড হয়ে যায়নি। না হলে মুশকিলে পড়তাম। একই গান দুরকম সুরে তো আর প্রকাশিত হতে পারত না। আমার সৌভাগ্য যে সেদিন মান্নাদার বাড়িতে কানুবাবু এসে পড়েছিলেন।
আমি অসহায়ভাবে বললাম, এরকম ঘটনা আমার জীবনে আগে কখনও ঘটেনি। আশা করি আর ঘটবেও না। কিন্তু এখন কী করা উচিত?
মান্না দে বললেন, আর একটা গান লিখে দিন তালাতের জন্য। তা হলেই সমস্যা মিটে যাবে।
কানুবাবু বললেন, একটা পিঠ তো ঠিকই আছে। শুধু অন্য পিঠটা বদলে দিন।
আমি ওখানে বসেই লিখলাম ‘বউ কথা কও গায় যে পাখি’। গানটা লেখা শেষ হতেই এক গ্লাস জল খেয়ে নিশ্বাস নিয়ে বাঁচলাম।
এর তিন-চার দিন পরেই পুজোর জন্য গান দুটি রেকর্ড করেছিলেন তালাত
এর বেশ কিছু বছর পরে আবার এক পুজোয় কানু ঘোষ, আমি আর তালাত মামুদ মিলিত হয়েছিলাম। সেবার দুটি গান লিখেছিলাম তালাতের জন্য। তার একটি গানের লাইনে ছিল তুমি এসো ফিরে এসো/যদি আসে ছেলে বেলা’।
না। সেই হারানো ছেলেবেলা আর এ জীবনে ফিরে আসেনি। সেটা বুঝতে পেরেই হয়তো এর কিছুকাল পরেই, তালাত গানের জগৎ থেকে সসম্মানে অবসর নিয়ে সুখী জীবনযাপন করেছেন।
সেদিন আজকের তালাতের একটি উক্তি শুনলাম। আজকের হিন্দি গান কেমন হচ্ছে সে সম্পর্কে মতামত দিতে গিয়ে বলেছেন, আজকের গান হচ্ছে ফার্স্ট ফুড। ফার্স্ট ফুডের দোকান তো আগে এ দেশে ছিল না। তেমনি এই ফার্স্ট ফুডের গানও আগে ছিল না। এ দেশে নতুন আবির্ভাব হয়েছে।
একটু আগেই উল্লেখ করেছি, তালাত মামুদ যেমন তপনকুমার হয়েছিলেন তেমনি মহম্মদ কাশেম রেকর্ডে নাম বদলে হয়েছিলেন কে মল্লিক। আবার আমার মনে পড়ছে অনেক বাঙালি শিল্পীও হিন্দি উর্দু রেকর্ড করার সময় নাম বদলেছিলেন। জগন্ময় মিত্ৰ হলেন জগমোহন, গায়িকা হরিমতী হলেন রাবেয়া খাতুন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় হলেন হেমনকুমার।
শুনেছি কমল দাশগুপ্ত, সুবল দাশগুপ্তও গজল, গীত ও বিশেষ করে যখন কাওয়ালি গান গাইতেন তখন নাম নিতেন চাঁদ খাঁ, সুরজ খাঁ। এই প্রসঙ্গে মনে আসছে এই কাওয়ালি গানের সুরের স্টাইলেই কমল দাশগুপ্ত সৃষ্টি করেছিলেন কানন দেবীর সুপার হিট বাংলা গান ‘আমি বনফুল গো’।
একই কণ্ঠশিল্পীর অন্য নামে রেকর্ড করার আরও নজির আছে। যেমন গৌরীকেদার ভট্টাচার্যের ছদ্মনামে রেকর্ড আছে। হিন্দি সিনেমার গানের বাংলা ভার্সানে উনি নাম নিতেন গোলাম কাদের। সত্য চৌধুরীর রেকর্ড আছে রীতেন চৌধুরীর নামে। অপরেশ লাহিড়ির পল্লীগীতির রেকর্ড আছে ভোলা মাঝি নামে।
যখন শ্যামবাজারের নলিনী সরকার স্ট্রিটের পাশাপাশি দুটি আলাদা বাড়িতে এইচ. এম. ভি. এবং কলম্বিয়ার অফিস ছিল সেই সময় এইচ. এম. ভি বাংলা গানের দিকটা দেখাশোনা করতেন নিমেষ ঘোষ। সেই সময় আমার এইচ. এম. ভি-র রেকডিং এবং স্টুডিয়ো দেখার প্রথম অভিজ্ঞতা হয়। তখন আমি স্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্র। একদিন কোনও কারণে তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল। ছুটির পর আমি চলে গিয়েছিলাম, আমার ভগ্নিপতি প্রযোজক পরিচালক সরোজ মুখোপাধ্যায়ের ধর্মতলা স্ট্রিটের অফিসে। ওখানেই আলাপ হয়েছিল নিমেষ ঘোষের সঙ্গে। এই নিমেষ ঘোষই পরবর্তীকালে উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত ‘হার মানা হার’ ছবির অন্যতম প্রযোজক হয়েছিলেন। আমাকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন ছবির গান।
নিমেষবাবু ছিলেন তখনকার নামী প্রযোজক এবং পরিবেশক প্রতিষ্ঠান, অ্যাসোসিয়েটেড ডিস্ট্রিবিউটার্সের কর্তা নরেশ ঘোষের ছোট ভাই। এঁরা ‘বন্দিতা’, ‘ভাবীকাল’ ইত্যাদি বহু জনপ্রিয় ছবি করেছিলেন। নীরেন লাহিড়ি পরিচালিত ‘ভাবীকাল’ ছবির সুরকার ছিলেন বিখ্যাত কমল দাশগুপ্ত। অথচ ছবিতে একটাও গান ছিল না। এটা একটা বিরাট রেকর্ড।
যাই হোক, তখন বিনয় বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত সরোজদার ছবি ‘মনে ছিল আশা’র কমপ্লিমেনটারি গ্রামাফোন রেকর্ড আনতে গিয়েছিলাম নলিনী সরকার স্ট্রিটে এইচ. এম. ভি-র রিহার্সাল রুমে। ওখানেই দেখেছিলাম জগন্ময় মিত্র এবং সুরকার সুবল দাশগুপ্তকে। নিমেষবাবুকে অনুরোধ করলাম, একদিন ভাল শিল্পীর রেকর্ডিং দেখাবেন?
উনি বললেন, বেশ তো। অমুক তারিখে দমদমে আসুন। জগন্ময় মিত্রের রেকর্ডিং আছে। আমি আর আমার স্কুলজীবনে সংগীতে উৎসাহদাতা বন্ধু শৈলেন চট্টোপাধ্যায় দুজনে হাজির হলাম এইচ. এম. ভি.-র দমদমের স্টুডিয়োতে। এখন ফ্যাক্টরির যে অনেক উঁচু চিমনিটাকে উজ্জ্বল রং লাগিয়ে অতীত দিনের সাক্ষী একটি স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে, তখন সেটা দিয়ে অনবরত কালো ধোঁয়া বার হত। তখন রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে প্রধান গেট দিয়ে ঢুকতে হত না। যেতে হত পাঁচিলের পাশের গেটের রাস্তা দিয়ে।
আমাদের সালকিয়ার বসত বাড়ি ‘সালকিয়া হাউস’ যা দেখে আমি লিখেছিলাম ‘খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার’, আমিও কিন্তু ওই খিড়কির দরজা দিয়ে জীবনে প্রথম প্রবেশ করি রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে। তখন গালা দিয়ে রেকর্ড তৈরির যুগ। ক্যাসেট ফ্যাসেট তখন আসেইনি। যতদূর স্মরণে আসছে সম্ভবত তখনও একটা মাইকে রেকর্ডিং হত। রেকর্ডিং-এর যে হলঘরটা ছিল তার দু দিকে দুটো কাচের জানালা। একটি জানালা এইচ. এম. ভি.-র অন্যটি কলম্বিয়ার। যে দিন এইচ. এম. ভি.-র শিল্পীরা ওখানে গান করবেন সেদিন এদিকের জানলাটা খোলা হবে। আবার কলম্বিয়ার রেকর্ডিং হলে উল্টো দিকের জানালাটা খুলে যাবে।
জগন্ময় মিত্রের সেদিনের গান দুটির সুরকার ছিলেন দুর্গা সেন। দুর্গা সেনের সুর আমার ভাল লাগত। নিমেষবাবু আলাপ করিয়ে দিতেই তাই ওঁকে সেদিন প্রণাম করেছিলাম। পরবর্তীকালে আমার ওঁর সুরে সবথেকে প্রিয় গান, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ওরে ও বিজন রাতের পাখি।’ জগন্ময় মিত্রকে দেখেছিলাম রিমলেস চশমা আর গিলেকরা আদ্দির পাঞ্জাবিতে। অপূর্ব গাইলেন জগন্ময় মিত্র।
পরবর্তীকালে দুর্গাদার সুরে আমি কিছু গান লিখেছিলাম। আমার ‘আমার প্রিয় গান’ নামের বাছাই করা গানের সংকলনটি প্রকাশিত হওয়ার পর অনেকেই প্রশ্ন করেছিলেন, জগন্ময় মিত্রের গাওয়া কোনও গান নেই কেন? সেটাই আমার দুর্ভাগ্য। এর প্রধান কারণ, আমি যখন বাংলা গান লিখতে শুরু করেছি তখন জগন্ময় মিত্র বাংলা গান গাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন মুম্বই-তে। একবার অবশ্য কলকাতা বেতারে ‘রম্যগীতি’তে আর ‘এ মাসের গান’ পর্যায়ে নিখিল চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ওঁর জন্য কিছু গান আমি লিখেছিলাম। আর কোনও গান লিখিনি। জানি না এ জীবনে আর কখনও আমাদের যোগাযোগ হবে কি না।
ওখানেই দেখলাম এইচ. এম. ভি.-র অর্কেস্ট্রার কর্ণধার অস্ট্রেলিয়ান নিউম্যান সাহেবকে। ওখানে দেখেছিলাম বংশীবাদক কমল মিত্রকে। আর ভারতবর্ষের প্রথম সারির স্যাক্সোফোন ও ইংলিশ-ফ্রুট প্লেয়ার সদ্য কলকাতায় আসা মনোহারিকে। এই মনোহারি যিনি পরবর্তীকালে এস ডি বর্মণ ও আর ডি বর্মণের সঙ্গে কাজ করে তোলপাড় করে দিয়েছিলেন ভারতীয় সংগীতের বাণিজ্যিক বাজার। যতদূর জানি ওই মনোহারিকে নেপাল থেকে নিয়ে এসেছিলেন ওই নিউম্যান সাহেব।
৫৮
এইচ. এম. ভি.-র পুরনো দিনের স্টুডিয়োর কথা বলছিলাম। পাখা চললে হাওয়ার শব্দ মাইকে গান-বাজনাকে ব্যাঘাত করে বলে পাখা বন্ধ করে রেকর্ডিং চলেছিল বহুদিন। পরে অবশ্য স্টুডিয়োর রূপান্তর হল। নতুন টেপ মেশিন এল। আস্তে আস্তে গোটাটাই ঠাণ্ডা ঘরে পরিণত হয়ে গেল। আমার এখনও মনে আছে, যে বার পুজোর গানের জন্য নচিকেতা ঘোষের সুরে আমি লিখেছিলাম ‘লজ্জা/মরি মরি একি লজ্জা’। গানটি গাইছিল আরতি। আমরা দিব্যি ঠাণ্ডা ঘরে বসে আরতিকে বলছি এই করো। এই ভাবে কথাটা বলো। আর ও বেচারি দারুণ গ্রীষ্মকালে পাখা বন্ধ স্টুডিয়োতে বসে ঘামে স্নান করতে করতে গেয়ে চলেছে ‘লজ্জা/ মরি মরি একি লজ্জা।’
আমি কী কাজে থিয়েটারের ভেতরে ঢুকতেই আরতি হাসতে হাসতে বলে উঠল, বেশ আছেন পুলকদা। আপনি তো লিখেই খালাস। এখন দেখুন তো গরমে আমার কী অবস্থা। আমি দেখলাম, আরতি যেন বৃষ্টি ভেজা এক রমণী। গান লেখার আগে ভাবিনি ওর এমন অবস্থা হবে। পরের বছর ওর পুজোর গানের সময় অবশ্য এইচ. এম. ভি.-র স্টুডিয়োতে ঠাণ্ডা মেশিন বসে গেছে।
মনে আছে, প্রথম দিন এইচ. এম. ভি.-র স্টুডিয়োতে জগন্ময় মিত্রের একটা গান রেকর্ডিং শোনার পর নিমেষবাবু একজনকে নির্দেশ দিলেন, আমাদের গোটা ফ্যাক্টরিটা ঘুরিয়ে দেখাতে। ওঁর সঙ্গে ঘুরলাম। দেখলাম ওই উঁচু চিমনি দিয়ে কালো ধোঁয়া ওঠার আসল কারণ হচ্ছে, গালার সঙ্গে অন্যান্য কেমিক্যাল দিয়ে বিশাল কয়লার আঁচে গলানো হচ্ছে। সারা ভারতবর্ষে শুধু নয়, এশিয়ারও অনেক দেশের গালার পিণ্ড থেকে রেকর্ডের গালার চাকতি তখন বানাতেন এইচ. এম. ভি। সেই কিশোর বয়সেই স্বচক্ষে রেকর্ড প্রিন্টিং দেখে বেশ আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। একটা মেশিনের দু-ধারে দুটো পিতল জাতীয় জিনিসের মাদার প্লেট। যাতে রেকর্ডের থ্রেড মুদ্রিত রয়েছে। একজন মাপ মতো একটা গরম এবং স্বাভাবিক কারণেই নরম গালার পিণ্ড ওই দুটি মাদার প্লেটের মাঝখানে রেখে দিচ্ছেন। দুদিকে দুটো কোম্পানির নাম, শিল্পী, সুরকার, গীতিকার প্রমুখের নাম মুদ্রিত বিশেষ কাগজের লেবেল উল্টো করে রেখে দিয়ে তারপরে মেশিনের একটা সুইচে চাপ দিচ্ছেন। দুদিকের প্লেট দুটো গ্রামোফোন রেকর্ডের উচ্চতার ব্যবধান রেখে এক হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে আপনা থেকে এসে যাচ্ছে একটা ঠাণ্ডা হাওয়া। জুড়িয়ে যাচ্ছে গরম গালার চাকতি।
আবার উনি অন্য সুইচ টিপছেন। ফাঁক হয়ে গিয়ে আবার আগের স্থানে ফিরে যাচ্ছে মাদার প্লেট দুটো। তৎক্ষণাৎ তৈরি হয়ে যাচ্ছে একটা রেডি রেকর্ড। অবশ্য রেকর্ডের মাপ থেকে বাড়তি কিছু গালা তার চারপাশে থাকছে। অন্য একজন অন্য মেশিনে ওই রেকর্ডটা রেখে তৎক্ষণাৎ সেটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পরিষ্কার করে দিচ্ছেন। এবং পালিশ করে দিচ্ছে আর এক জন। আমার সামনেই এইভাবে বোধহয় দু-আড়াই মিনিটেই একটা রেকর্ড তৈরি হল। পাশে রাখা একটা গ্রামাফোনে তা বাজিয়ে শুনিয়ে দিলেন আর একজন লোক।
এ ধরনের মেশিন একটা শেডের নীচে অনেকগুলো দেখেছিলাম। এখন এইচ. এম. ভি.-তে সেই শেডও আর নেই, সেই প্রিন্টিং মেশিনও আর নেই।
সেদিন সেই সদ্য প্রসূত রেকর্ডটা নিয়ে বাড়ি ফেরবার দারুণ ইচ্ছা হয়েছিল। কিন্তু ওঁরা অম্লানবদনে আমার মতো অবুঝকে বলেছিলেন, এখান থেকে কোনও রেকর্ড বিক্রিও করতে পারি না। উপহার দিতেও পারি না। সুতরাং রেকর্ড তৈরির স্মৃতিটুকু নিয়েই সেদিন বাড়ি ফিরতে হয়েছিল।
ঠিক এই রকমই পরবর্তীকালে দেখেছিলাম সুপার ক্যাসেট অর্থাৎ টি সিরিজের কর্ণধার গুলশন কুমারের নওদার ফ্যাক্টরিতে। সে বার পশ্চিমবঙ্গ সরকার আমায় নিউদিল্লি পাঠিয়েছিলেন কলকাতা তিনশো বছরের ওপর পণ্ডিত রবিশঙ্করের সুরে একটা সমবেত সংগীত রচনা করতে। ‘সারে জাহাসে আচ্ছা’, এশিয়াডের, গান্ধী, পথের পাঁচালি-র সুরকার পণ্ডিত রবিশঙ্কর মানে সত্যিকারের ব্যতিক্রমী স্রষ্টা।
পণ্ডিতজির সুরে আমি এর আগে কিছু বাংলা আধুনিক গান লিখেছিলাম গ্রামাফোন রেকর্ডের জন্য। এর মধ্যে আমার সব থেকে প্রিয় গান হল হৈমন্তী শুক্লার গাওয়া ‘আর যেন সেদিন ফিরে না আসে’। অতএব আমি এক কথাতে দিল্লি যেতে রাজি হয়ে গেলাম। গিয়ে উঠলাম নিউদিল্লির বঙ্গভবনে।
পণ্ডিতজির সুন্দর সবুজ ঘাসের লন, আর বাগানে ঘেরা সরকারি বাসভবনটিতে দেখতে পেলাম ওঁর ছ-সাত জন তরুণ বিদেশি শিষ্যকে। যাঁরা একেবারে ভারতীয় প্রথায় গুরু পণ্ডিতজির কাছে নাড়া বেঁধেছেন।
আমি যখন ওখানে পৌঁছালাম তখন ওঁরা শিক্ষা শেষ করে সবে বাদ্যযন্ত্র নামিয়েছেন। কিছুক্ষণ অন্যান্য কথাবার্তা বলে আমরা কাজে বসলাম। পণ্ডিতজি যথারীতি প্রথমে সেতারে তারপর হারমোনিয়ামে গানের সুর দিলেন। সুরের উপর লিখলাম ‘কলকাতা/ কলকাতা/ কলকাতা/তিনশো বছর ধরে করলে লালন/স্নেহময়ী তুমি মা/মমতাময়ী জননী/সবার আপন/সবার স্বজন’।
বেশ অন্য ধরনের সুর হল। মুখড়াটা লিখতেই বেশ সময় নিলাম। পণ্ডিতজি বললেন, দারুণ হয়েছে। তবে আজ আর নয়। কাল আবার সন্ধ্যায় আমরা বসব। আপনি এখানেই আজ খেয়ে যাবেন। তবে অবশ্য নিরামিষ খাবার।
রবিশঙ্করের সেক্রেটারি রবীন বাবু আমার কানে কানে বললেন, খাবার সময় একটা নতুন জিনিস দেখবেন
সত্যি খেতে বসে দেখলাম, পণ্ডিতজির বাড়িতে কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও আমার মতো একজন অভ্যাগতকে খাওয়াতে খাঁটি ভারতীয় আশ্রমের আদর্শে ওঁর বিদেশি শিষ্যরা নিজেরাই লুচি বেললেন। নিজেরাই ভাজলেন। নিজেরাই সবজি পরিবেশন করে আমাকে, রবীনবাবুকে আর এঁদের গুরুজিকে সমাদরে আহার করালেন।
একটু আগে যে আমেরিকান ছেলেটির হাতের আঙুল দিয়ে ঝরে পড়ছিল সেতারের তারের মীড়, গমক, মূর্ছনা এখন তারই হাতের আঙুলে রয়েছে বেলনা। যা দিয়ে সে এখন লুচি বেলছে। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম এক শিক্ষাগুরুর শিক্ষালয়ে অনন্য আবাসিকদের।
আমি যে অবাক হয়ে গেছি পণ্ডিতজি বোধহয় সেটা লক্ষ করেছিলেন। ওঁর সেই অপরূপ মিষ্টি হাসিটি হেসে আমায় বলে উঠলেন, না বললে চলবে না। আর দুখানা গরম লুচি খেতেই হবে। সেদিনের সেই সুখস্মৃতি মনে নিয়েই বঙ্গভবনে ফিরলাম।
পরদিন ভাগ্যটা খুবই প্রসন্ন ছিল। সকালে আমার এক পরিচিত নিউদিল্লির বাসিন্দাকে ফোন করে, তার গাড়ি চেয়ে নিয়ে, দিল্লির চেনাজানাদের সঙ্গে একটু দেখাশোনা করার বাসনায় অপেক্ষা করছিলাম। গাড়ি বঙ্গভবনে এসেছে শুনেই আমি নীচে নামলাম। বেরিয়েই সামনেই দেখি আমাদের কলেজের সহপাঠী তখনকার মুখ্যসচিব তরুণ দত্ত। তরুণবাবু আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রথমেই বললেন, গাড়ি আছে তো? সঠিক রাস্তা জানা না থাকলে দিল্লির ট্যাক্সিওয়ালা কিন্তু চরকি পাক খাওয়াবে। গাড়ি না থাকলে বলুন ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
আমি বললাম, আমার বন্ধুর গাড়ি এসেছে। আমাদের কথার মধ্যেই সেখানে আসতে দেখলাম মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে। ওঁকে নমস্কার জানাবার সঙ্গে সঙ্গে উনিও একই প্রশ্ন করলেন, গাড়ি আছে তো?
তরুণবাবু বললেন, হ্যাঁ স্যার। আছে।
দিল্লি ট্যাক্সিওয়ালাদের চরকি বাজি নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে। নতুন আর কিছু বলতে চাই না।
সেদিন কলকাতা তিনশো বছরের গানটি লেখার জন্য সন্ধ্যায় পণ্ডিত রবিশঙ্করের বাড়িতে পৌঁছে শুনলাম পণ্ডিতজি আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলেছেন। কারও সঙ্গে রুদ্ধদ্বার কক্ষে কিছু আলোচনা করছেন। চা খেতে খেতে অপেক্ষা করতে লাগলাম। খানিক বাদেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন পণ্ডিতজি আর সুপার ক্যাসেটের প্রাণপুরুষ গুলশন কুমার। গুলশনের সঙ্গে মুম্বইতে শানুর জন্য ‘অমর শিল্পী কিশোরকুমার’ লেখার সময় পরিচয় হয়েছিল।
আমাকে দেখে খুশি হয়ে বললেন, কোথায় উঠেছেন? নিশ্চয় বঙ্গভবনে? চলে আসুন আমার এ সি গেস্ট হাউসে। দু-তিন দিন আরাম করুন। খুব ভাল লাগবে। আমার ওখানে অবশ্য নিরামিষ খাবার।
আমি বললাম, ধন্যবাদ। এ বার আর হল না। পরের বার হবে। পরশুর ফ্লাইটেই ফিরতে হবে কলকাতায়।
গুলশন কুমার বললেন, তা হলে কালকে সকালেই বঙ্গভবনে গাড়ি পাঠিয়ে দিই। দেখে যান আমার কাজ কারবার।
আমি বললাম, আজই আপনার দিল্লির মিউজিক অ্যারেঞ্জার আর সুরকার গৌতম দাশগুপ্তের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। উনি কাল লাঞ্চে ডেকেছেন। কাল সকালে গাড়ি নিয়ে আসবেন।
গুলশনজি বললেন, ওঁর বাড়ি তো আমার অফিসের কাছেই। আমার ওখানে হয়ে ওঁর কাছে চলে যাবেন। আমি ওঁকে বলে রাখব যাতে আপনাকে উনি নিয়ে আসেন।
কথা শেষ করে গুলশন কুমার, লেটেস্ট মডেলের মার্সেডিজ চেপে চলে গেলেন। শুনেছি প্রথম জীবনে গুলশনজি দিল্লিতে সামান্য একজন ফলের রস বিক্রিতা ছিলেন। সামান্য অবস্থা থেকে নিজের চেষ্টায় মানুষ কত উঁচুতে পৌঁছে যেতে পারে গুলশন কুমার তার একটা জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
পণ্ডিতজির সঙ্গে গান নিয়ে বসলাম। লেখা হল গান। গান শেষ হতে সেই অপূর্ব হাসি হেসে বললেন, আপনাকে কিন্তু মুম্বই-তে রেকর্ডিং-এর সময় আসতে হবে। অনেক কোরাল অ্যারেঞ্জমেন্ট দিয়ে রেকর্ড করব।
বললাম, নিশ্চয় যাব। যখন বলবেন তখনই।
রেকর্ডিং-এর সময় গিয়েছিলাম মুম্বই-তে। ওবেরয় টাওয়ার হোটেলে সেদিন পণ্ডিতজি আমাকে সঙ্গে নিয়ে ওপরের টাওয়ারের বারান্দায় ঘুরে ঘুরে শুনিয়েছিলেন ইহুদি মেনুহিনের জন্মদিনের ওঁরই বিদেশি বাজনাদারদের অসাধারণ বাজনা। সে বাজনা এখনও কানে বাজছে। আমার সৌভাগ্য ঠিক সেই সময় ওঁরা ভারতবর্ষে এসেছিলেন। মুম্বই-তে কি কলকাতায় কি নিউদিল্লিতে ঠিক স্মরণে নেই, একবার পাঠভবনের শিক্ষিকা আমার ভাগনি শম্পা রায়ের কন্যা রিঙ্কির অটোগ্রাফ খাতায় উনি যে কথাগুলি লিখে দিয়েছিলেন শুধু ওই টুকুতেই রবিশঙ্করজির সরল সুন্দর আন্তরিক শিল্পমাধুর্যের মানসিকতাটি যে কেউ সহজেই বুঝতে পারবেন। রিঙ্কির কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে আজ তাই এটা এখানে সবার জন্য উপহার দিলাম।
রিঙ্কি,
তোমার দাদুর মত নয়কো আমি কবি
সুর দিয়ে আঁকি শুধু ছবি
ইতি তোমার স্নেহের রবি
রবিশঙ্কর
29.4.89
যা হোক, আবার দিল্লির প্রসঙ্গেই ফিরে যাই। পরদিন সুরকার ও সংগীত আয়োজক গৌতম দাশগুপ্তের সঙ্গে এলাম দিল্লির কিছু দূরে ইউ. পি-র নয়দাতে। সত্যি, অকপটে বলছি, গুলশন কুমারের বিশাল কাণ্ডকারখানা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। ওঁর নিজস্ব অনেকগুলো ঝকঝকে বাস দাঁড়িয়ে রয়েছে। শুনলাম ওগুলো নিয়মিত শিফট অনুযায়ী দিল্লির বিভিন্ন জায়গা থেকে গুলশনের কর্মীদের নিয়ে অফিসে আসে এবং ছুটির পর বাড়িতে পৌঁছে দেয়। ওই রকম বাসের সংখ্যা নাকি উনিশ-কুড়িটা। অবশ্য ওখানে কেবল ক্যাসেট নয়, গুলশনের অনেক কিছুই রয়েছে, যেমন টিভি, ডিটারজেন্ট পাউটার, বিভিন্ন পত্রিকা ইত্যাদি অনেক কিছু। শুনেছি এখন নাকি সি ডি রেকর্ডেরও পরিস্থাপনা হয়েছে।
গুলশন আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন এবং একজন লোক দিয়ে দিলেন কারখানা ঘুরে ঘুরে দেখাতে। এক জায়গায় দেখলাম ক্যাসেট কভারের মেটিরিয়াল রয়েছে। আর এক জায়গায় সেগুলো প্রিন্ট হয়ে ক্যাসেট কভার হয়ে যাচ্ছে। আমার সঙ্গে যিনি ছিলেন তিনি ঘুরে ঘুরে ক্যাসেট তৈরির পুরো ব্যাপারটা দেখালেন।
ওখান থেকে বেরিয়ে আমি গেলাম গুলশনের চেম্বারে। সঙ্গী মানুষটি আমার সঙ্গে আসবার সময় একটি ক্যাসেট এনেছিলেন, সেই ক্যাসেটটি গুলশনকে দিলেন। গুলশন সেটি উপহার দিলেন আমায়।
আমি ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, শুধু স্টুডিয়ো ছাড়া সবই তো এখানে রয়েছে।
উত্তরে গুলশনজি বললেন, স্টুডিয়ো-ও আছে। এই গৌতম দাশগুপ্তের সুরে আপনি যে সব বাংলা গান লিখেছেন সেগুলো সবই তো দিল্লির সিংগারদের দিয়ে রেকর্ডিং হয়েছে এখানে। স্টুডিয়োর প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে, গুলশনের মুম্বই-এর খার অঞ্চলের সুদীপ স্টুডিয়োর আর পশ্চিম আন্ধেরির নিউ লিঙ্ক রোডের গোল্ডেন চ্যারিয়ট স্টুডিয়োর কথা। যেখানে ওঁর আর এক বিরাট অফিস।
চেন্নাইতে প্রসাদ স্টুডিয়োতে বালু সুভ্রমনিয়াম আর চিত্রা যখন আমার লেখা বাংলা গান রেকর্ড করছিল সেই সময় দেখেছিলাম, এক সুদক্ষ বাঙালি চিপ রেকর্ডিস্ট বিরাট চওড়া টেপে মাল্টি চ্যানেলে গান রেকর্ড করলেন। ঠিক সেই ধরনের চওড়া টেপে মাল্টি চ্যানেলে রেকর্ডিং হয় এই গোল্ডেন চ্যারিয়টে। লোকমুখে শুনেছি সারা ভারতবর্ষে এ ধরনের রেকর্ডিং মেশিন খুব বেশি নেই।
৫৯
গুলশনের গোল্ডেন চ্যারিয়টেরিই এই একতলার প্রকাণ্ড বড় হলঘরে বহুবার দেখেছি অনুরাধা পড়োয়াল সাধিকা গায়িকার বেশে ভিডিও রেকর্ডিং-এ শুটিং করছেন। কোনও কোনও সময় গুলশন কুমারকে দেখেছি সাধকের ভূমিকায়, কিন্তু ভক্তিমূলক বা ভজনাঙ্গের গান ছাড়া কোনওবারই অন্য কোনও রকম গানের পিকচারাইজেশন দেখিনি। বছর দেড়েক আগে দিল্লি থেকে হরিদ্বারে গিয়েছিলাম। সেখানে হর কি পৌরীর গঙ্গা কিনারে সন্ধ্যা আরতির পরক্ষণেই প্রত্যেক দোকানেই বেজে উঠতে শুনেছি শুধু অনুরাধা পড়োয়ালের ভজন গান। সারা ভারতবর্ষের আর কোনও শিল্পীর গানই ওখানে আমি তেমন শুনিনি।
এই ধরনের কাজে গুলশনের সত্যিই কোনও জুড়ি নেই। আমার তো একবার মনেই হয়েছিল হরিদ্বারে ওঁর কোম্পানি ছাড়া অন্য কোনও কোম্পানির ভজন গান বোধহয় নিষিদ্ধ। বৈষ্ণ দেবীর মন্দিরে গুলশন কুমারের নিয়মিত অর্থদানের কথা তো অনেকেই জানেন।
নিউদিল্লির আর এক বাঙালি শিল্পীর নাম মনে আসছে। তিনি হলেন সেবন্তী সান্যাল। ওখানকার বেতার এবং টিভিতে নিয়মিত গান তো করেছেনই, কলকাতা বেতারে অনেক সুন্দর অনুষ্ঠান করেছেন।
নিউদিল্লির বেতারের আর টিভির আর এক শিল্পী হলেন আমার বিশেষ বন্ধু অরুণ চট্টোপাধ্যায় অর্থাৎ অরুণকুমার। ওকে আমি ভবঘুরে অরুণ’ বলি। অরুণ পৃথিবীর বহু জায়গায় বাংলা এবং দেশ বিদেশের বিভিন্ন ভাষায় গানের অনুষ্ঠান করেছে। সেই এল পি রেকর্ডের প্রথম যুগে সুদূর আমেরিকার এক রেকর্ড কোম্পানি থেকে আমার লেখা আর ওর নিজের সুরে গাওয়া একটি বাংলা আধুনিক গানের এল পি রেকর্ড প্রকাশ করে আমায় রীতিমতো চমকে দিয়েছিল।
এইচ. এম. ভি.-তেও আমার গান নিয়ে একটি ক্যাসেট করেছে। নিউদিল্লিতে থাকলে রামকৃষ্ণ মিশনে সারা দিনে একবার আসবেই। ওখানেই ওর পাত্তা মেলে নইলে নয়। আমি যতবারই দিল্লি গেছি ততবারই ওর খোঁজ করেছি। তিন-চারবার ছাড়া ওকে ধরতে পারিনি। পৃথিবীর কোন দেশে কোনখানে তখন ওই ভবঘুরে বাঙালি শিল্পী অরুণকুমার ঘুরে বেড়াচ্ছে, কোন ভাষায় কোথায় তখন অনুষ্ঠান করছে এ-সব জানতে পারি ওর চিঠি পাওয়ার পর, তার আগে নয়।
দিল্লির হাউস খসের বাসিন্দা একজন মানুষের নাম মনে আসছে। তিনি হলেন পরিচালক প্রভাত মুখোপাধ্যায়। বিশিষ্ট অভিনেত্রী এবং সুগায়িকা অরুন্ধতী দেবীর প্রাক্তন স্বামী। শুনেছিলাম উনি এককালে গার্স্টিন প্লেসের কলকাতা বেতারের খুবই প্রভাবশালী মানুষ ছিলেন। প্রযোজক সরোজ মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রশ্ন’ ছবিতে আমি ছিলাম গীতিকার আর সহকারী পরিচালক। চন্দ্রশেখর বসু ছিলেন পরিচালক। অরুন্ধতী দেবী ছিলেন সেই ছবির নায়িকা। তখন প্রভাতদা প্রায়ই স্টুডিয়োতে আসতেন। সেই সময়ই আমাদের ঘনিষ্ঠতা হয়, সুন্দর, উচ্ছল এবং প্রাণবন্ত মানুষ। প্রভাতদা অসিত সেনের ‘চলাচল’ ছবির এক সার্থক অভিনেতাও ছিলেন। চিত্র পরিচালনাও করেছিলেন। তার মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য ছবিটি হল উত্তমকুমার ও অরুন্ধতী দেবী অভিনীত তারাশঙ্করের ‘বিচারক’।
প্রভাতদার কাহিনী এবং পরিচালনায় তৈরি হয়েছিল বন্দি বিধাতা’। প্রভাতদার ছবিতে সেই আমার প্রথম গান লেখা। সুরকার ছিলেন গোপেন মল্লিক। আমার অনুরোধে শ্রাবন্তী মজুমদারকে দিয়ে উনি গাইয়েছিলেন ছবির থিম সঙ। গানের প্রথম লাইনটি ছিল ‘কোথায় পালাবে তুমি। কোথায় পালাবো আমি’। ওঁর দারুণ পছন্দ হয়েছিল এই গানটি। উচ্ছ্বাসে বলে ফেলেছিলেন তোমায় কোনও দিনই পালাতে দেব না। ওই ছবিতে আরও একটি ভাল গান গেয়েছিলেন অভিনেতা মৃণাল মুখোপাধ্যায়।
এর পর প্রভাতদা করলেন প্রযোজক তারক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়ে বেশ বড় মাপের একটি ছবি ‘তুষার তীর্থ অমরনাথ’। প্রায় সারা ছবিটির শুটিং করেছিলেন কাশ্মীর ও অমরনাথ অঞ্চলে। এই ছবিরও সুরকার ছিলেন গোপেন মল্লিক। আমাকে উনি সত্যিই পালাতে দেননি। আমাকে দিয়েই ছবির গান লিখিয়েছিলেন। কিন্তু দুভার্গবশত ছবিটি জনপ্রিয় হল না। লম্বা ঋজু প্রাণচ্ছল মানুষটি স্বাভাবিকভাবেই একটু যেন বিপর্যস্ত হয়ে গেলেন।
অরুন্ধতী দেবীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদে উনি খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন। মাঝেমধ্যে কথাবার্তায় সেটা একটু আধটু প্রকাশও করে ফেলতেন। মনে পড়ছে সেবার গড়িয়াহাটার হিন্দুস্থান মার্টে, উস্তাদ আলি আকবরের বাংলা গান লেখার সময় দেখেছিলাম অরুন্ধতী দেবীর কন্যাকে। মুখের ভাব অনেকটা ওঁরই মতো। উনি তখন বিদেশে আলি আকবর সম্বন্ধে গবেষণা গ্রন্থ রচনা করছিলেন। এ দেশে এসেছিলেন সেই সম্পর্কে শেষ কিছু প্রসঙ্গ রচনা করতে। যাই হোক, তারপর প্রভাতদার সঙ্গে কলকাতায় আর আমার দেখা হয়নি।
হঠাৎ হঠাৎ দিল্লি থেকে অদ্ভুত সুন্দর সুন্দর সব চিঠি আসত। সেই সময় উনি ‘ডিটেকটিভ’ নামে একটি ইংরেজি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ওই পত্রিকায় নিজেই লিখতেন একাধিক রচনা। কিন্তু সব লেখাই নিজের নামে লিখতেন না। আমার নাম দিয়ে অনেক ইংরেজি গল্প লিখেছেন ওই পত্রিকায়। যেগুলো একটাও আমার লেখা নয়। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, এই সব গল্পের প্রশংসা এবং সমালোচনায় ভরা কিছু কিছু চিঠি আমি পেতাম। আর অবাক হয়ে ভাবতাম নিঃসঙ্গ, উচ্চশিক্ষিত, গুণী এই অদ্ভুত শিল্পী মানুষটির কথা। একা একা কী করে উনি সময় কাটাচ্ছেন, এ ধরনের মানুষ আজ পর্যন্ত আমি জীবনে আর পাইনি।
‘ডিটেকটিভ’ পত্রিকার ব্যাপারে একটি চিঠিতে উনি আমায় লিখেছিলেন— জীবনের মজা দেখ। কেউ একজন খুন করল, কাউকে। সেই গল্প লিখে আমার পেট চলল।’ এবার আসি অন্য প্রসঙ্গে।
বাংলা গানে যে সব শিশু কণ্ঠশিল্পীরা একদা অসাধারণ সাফল্য পেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রথমেই মনে আসছে রাণু মুখোপাধ্যায়ের নাম। রাণু অগ্রদূতের ‘বাদশা’ ছবিতে হেমন্তদার সুরে ‘লাল ঝুটি কাকাতুয়া’ এবং ‘শোন্ শোন্ মজার কথা ভাই’ গেয়ে তোলপাড় করে দিয়েছিল সব বয়সের শ্রোতাদের মন।
তার আগে অবশ্য আর একজন গায়িকা রাণুর মতো অত কম বয়সে না হলেও প্রায় উত্তর কৈশোরের কাছাকাছি সময়ে কমল দাশগুপ্তের সুরে গেয়েছিলেন ‘প্রজাপতি প্রজাপতি….’। এই সুপারহিট গানটির শিল্পী ছিলেন অসিতা মজুমদার। সম্ভবত তখন তিনি ছিলেন অসিতা বসু। যিনি পরবর্তীকালে নিউ থিয়েটার্সের ‘রূপকথা’ নামে প্রথম বাংলা ফ্যানটাসি ছবিতে অসিতবরণের বিপরীতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। পরে বিয়ে করেছিলেন সে যুগের বিখ্যাত আর্ট ডিরেক্টর ও ‘রূপকথা’ ছবির পরিচালক সুধীর মজুমদারকে।
এরপর সলিল চৌধুরীর কন্যা অন্তরা চৌধুরীও ছোট বেলায় গেয়েছিল সলিলদার সুরে বেশ কিছু ছোটদের গান। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ও কোলা ব্যাঙ’ গানটি।
আর একজন শিশু শিল্পী সুরকার অশোক রায়ের কন্যা চৈতি রায়। যে এখন কলকাতার অন্যতম বেহালাবাদক ‘বাউল’-এর স্ত্রী। সুধীন দাশগুপ্তের সুরে গেয়েছিল ‘এক যে ছিল বাঘ’ গানটি, সে সময় খুবই নাম করেছিল সে। বিখ্যাত ওয়েস্টার্ন রেকর্ড ‘পিঙ্ক প্যানথার’-এর আদলে সুধীনবাবু এই গানটি তৈরি করেছিলেন। চৈতির কণ্ঠে ও বাঘ’ তারপরে যন্ত্রসংগীতে বাঘের মতো হালুম ডাকটি সকলেরই খুব ভাল লেগেছিল।
এরপর কিন্তু কোনও শিশু কণ্ঠশিল্পী আর তেমন কিছু করতে পারেনি।
সম্প্রতি উদিত নারায়ণের পুত্র আদিত্য নারায়ণ ‘মাসুম’ ছবিতে গান গেয়ে সারা ভারতবর্ষ মাতিয়ে দিল। উদিত নারায়ণ, দীপা নারায়ণ, কুমার শানু, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, অলকা ইয়াগনিক, ঊষা উথুপ ও বাণী জয়রাম সহ বহু কণ্ঠশিল্পীর জীবনের প্রথম বাংলা গান আমি লিখেছি। সেই অনুপ্রেরণায় আমি মাসুমের গান শুনে আদিত্য নারায়ণের প্রথম বাংলা গান রেকর্ড করার যখন চেষ্টা করছি তখনই সৌভাগ্যক্রমে সুযোগ পেয়ে গেলাম। পরিচালক শচীন অধিকারীর ‘দানব’ ছবিতে নবীন সুরশিল্পী বি সুভায়ুর সুরে গান লিখলাম। একটি গান ছিল ‘আল্লা জিসাস মা কালীর কসম’। এই ছবির অর্কেস্ট্রা অর্থাৎ মিউজিক ট্র্যাক হল এবং কিছু গান কলকাতায়, কিছু গান মুম্বই-তে ডাবিং হবে। এই গানটি আদিত্য নারায়ণকে দিয়ে গাওয়াবার জন্য শচীনবাবুকে অনুরোধ করলাম। শচীন অধিকারীর আর আমার মানসিকতার মেলবন্ধন সাংঘাতিক। উনি এক কথায় রাজি হলেন। আদিত্যও ওর বাবা উদিত আর মা দীপার মতো তার জীবনের প্রথম বাংলা গান আমার লেখা কথায় রেকর্ড করল সেদিন।
আর একটা অদ্ভুত যোগাযোগের ঘটনা ঘটেছিল তখন। কলকাতার এক হোটেলে একদিন সপরিবারে বাঙালি খাবার খেতে গিয়ে লিফটের কাছে দেখা হয়ে গেল বাংলাদেশের বিখ্যাত গায়িকা সাবিনা ইয়াসিনের সঙ্গে। সাবিনার গান আমার দারুণ ভাল লাগে। এত বিশাল রেঞ্জের বাঙালি গায়িকা বিরল। যে কণ্ঠস্বর গানের অনেক অগম্য পর্দায় অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে। ওঁকেও ছাড়লাম না। ছাড়লাম না ওঁর সঙ্গে আসা বাংলাদেশের আর এক গায়িকা সাকিলা জাফরকেও। ওঁরাও কণ্ঠ দিলেন ‘দানব’ ছবিতে।
সাবিনার কণ্ঠস্বরে শুধু নয়, ওঁর অহংকারহীন ব্যবহারেও আমি বরাবরই মুগ্ধ।
এবার আমাকে কণ্ঠে এবং আচার আচরণে মুগ্ধ করল সাকিলা জাফর। বাংলাদেশের এই উঠতি গায়িকা আরও বড় হোক এই আমার একান্ত কামনা।
সম্প্রতি আমার চিত্রনাট্য, সংলাপ ও গানে তৈরি ‘রাজা রানি বাদশা’ ছবির গান রেকর্ডিং করতে বাংলাদেশের বুলিভাই আর এখানকার গৌতম সিংহরায়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম মুম্বই। বাবুল বসুর সুর করা এই ছবিতে শিশু শিল্পীর দুটি গান প্রয়োজন ছিল। গেলাম আদিত্য নারায়ণের জন্য ওর পিতা উদিত নারায়ণের কাছে। জহু-ভার্সোভা লিঙ্ক রোডের নতুন ফ্ল্যাট অভিষেক অ্যাপার্টমেন্টে ওরা থাকে। মনে পড়ল ‘কয়ামত সে কয়ামত তক’ ছবির হিন্দি গান শুনে মুগ্ধ হয়ে প্রযোজক অজয় বসুর ‘মনে মনে’ ছবিতে উদিত নারায়ণকে প্রথম বাংলা গান গাওয়াবার জন্য মুম্বই-তে ওর বাড়ি খুঁজতে প্রচুর ঘুরেছিলাম একদিন। শেষটায় উনি পাত্তা দিয়েছিলেন। গেয়েছিলেন কানু ভট্টাচার্যের সুরে আমার কথায় জীবনে প্রথম বাংলা গান—’বসলে এসে সাগর কূলে’।
যাই হোক এই ‘রাজা রানি বাদশা’-তে উদিতেরও গান ছিল। উদিত যেদিন গাইলে তারপর দিন আদিত্য নারায়ণ গাইবে ঠিক হল। উদিত আমায় বললে, আমি আর আমার স্ত্রী দীপা দুজনেই কিন্তু অনুষ্ঠান করতে যাচ্ছি সিঙ্গাপুরে। আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, তা হলে কী হবে?
উদিত বললে, দাদা, ভাবনা করবেন না। ও আমার ‘জেম বয়’। আমার লোক ঠিক সময় ওকে স্টুডিয়োতে নিয়ে যাবে। দেখবেন ওর সুরজ্ঞান, ওর এক্সপ্রেশন অর্থাৎ গানের অভিনয়, সুভাষ ঘাই-এর ছবিতে ও অভিনয়ও করছে। এমনি তো নয়, বিশেষ কিছু দেখেছেন বলেই তো ওকে ওঁরা ছবিতে সুযোগ দিয়েছেন। আর বাংলা উচ্চারণ? কথাটা বলেই হাসল উদিত। আমায় সোজাসুজি বললেন, দাদা, আপনি তো বার বার আমায় বলেন, আমার বউ দীপা আমার থেকে ভাল বাংলা বলে। দেখবেন আমরা না থাকলেও, ও আমাদের দুজনের থেকেও ভাল বাংলা বলছে। সবই দাদা আপনাদের আশীর্বাদ। বিনয়ী উদিত আমার কাছে মাথা নিচু করল।
মুম্বই-এর সংগীত জগতের খুবই প্রিয় স্টুডিয়ো হল জুহুর মিউজিশিয়ান স্টুডিয়ো এই স্টুডিয়োর মালিক তিন জন। সৌভাগ্যক্রমে তিনজনেই বাঙালি, একজন বিখ্যাত বেস গিটার বাদক সমীরবাবু। আর একজন নামী সংগীত শিল্পী কুমার শানু। আর একজন তাপস ঘোষ। স্টুডিয়োর গোটা বাড়িটির মালিক তাপসবাবু। রাজা সেনের ‘দামু’ ছবির কিছুটা মালিক এই তাপসবাবু। এবং ‘রাজা রানি বাদশা’র সহ প্রযোজক।
নির্দিষ্ট দিনে ঘড়ির কাঁটায় সময় মিলিয়ে উদিতের লোকের সঙ্গে আদিত্য নারায়ণ এল আমাদের স্টুডিয়োতে। হাতে একটা অ্যাটাচি।