কথায় কথায় রাত হয়ে যায় – ৪৫

৪৫

আমার আজও মনে আছে। তখন বিকেল শেষ হয়ে আসছে। একটু আগেই কিশোরদার মৃত্যুসংবাদটা শুনেছি। কী করব ভেবে না পেয়ে প্রথমেই রেডিয়োতে ফোন করে অসীমা ভট্টাচার্যকে খবরটা জানালাম। অসীমাই বোধহয় ওই খবর নিউজ রুমে জানিয়েছিল। রেডিয়োতে খবরটা সবাই শুনলেন। টিভিতেও ফোন করেছিলাম কিন্তু কিছুতেই লাইন পেলাম না। যাঁদের স্মরণশক্তি একটু প্রখর তাঁরা নিশ্চয় মনে করতে পারবেন, কেন টিভির সংবাদে এমন একটি খবর জানানো হয়নি, তা নিয়ে সেই সময় প্রচুর কথাবার্তা হয়েছিল। আমি তখন দিশেহারা। পরিচিত মহলে যাঁকে যাঁকে পেরেছি, সবাইকে ফোন করে খবরটা জানিয়েছি। তারপর নিজের ঘরে বসে বাজাতে লাগলাম আমার লেখা কিশোরদারই গাওয়া গান ‘আমার মরণ যাত্রা যেদিন যাবে…।’

গানে যতবারই ‘মরণ যাত্রা’ কথাটা শুনতে লাগলাম ততবারই বুক ভেঙে কান্না আসতে লাগল। মনে পড়তে লাগল কিশোরদার হাসিমুখে বলা কথাটা, কী পোলাওবাবু। একেবারে আমার মরণ যাত্রা করে দিলেন? অনেকবার রেকর্ডটা বাজিয়েছিলাম। কিছুই ভাল লাগছিল না। মনে হচ্ছিল, কেন এমন গান কিশোরদাকে আমি লিখে দিলাম? রাত বেড়ে যেতে লাগল। তবুও আমার গান শোনা বন্ধ হল না। একসময় রাত ভোর হল। আমার সঙ্গে একই ঘরে আমার স্ত্রীও গান শুনছিলেন। উনি হঠাৎ বললেন, ‘তুমি কত সুন্দর’ ছবিতেই তো তুমি কিশোরদার আর একটা গান লিখেছ। এবার সে গানটা বাজাও।

বাজালাম সে গানটা—‘জানি যেখানেই থাক/ এখনও তুমি যে/ মোর গান ভালবাসো।’ ভোরের আলোয় সে গান আমায় দিল আশ্চর্য প্রত্যয়। আমি তো অজান্তেই লিখে ফেলেছি এই সত্য কথা।

কিশোরদা যেখানেই থাকুন সেখান থেকেই গান শোনাবেন। শুধু আমি নই। আমরা সবাই যে গান শুনে তাঁর কাছে ছুটে যাব।

এই আত্মবিশ্বাসেই বোধহয়, কিছুদিন পরে লিখেছিলাম বাবুল বোসের সুরে কুমার শানুর গান ‘অমরশিল্পী তুমি কিশোরকুমার/তোমাকে জানাই প্রণাম’।

কিশোরদা চলে গেলেন। ওঁর চলে যাওয়ার পরেই নিষ্প্রভ হয়ে আসতে লাগল কলকাতার অনেক সুরকার। যাঁরা কিশোরদাকে দিয়ে গান গাইয়ে বহু গান সুপারহিট করিয়ে ছিলেন। ইতিহাস প্রমাণ করল, কিশোরদা শুধু হিন্দি গানেই নয় বাংলা গানেও কত অপরিহার্য ছিলেন।

উত্তমকুমার চলে যাওয়ার পর যেমন বহু চিত্রপরিচালকই নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছিলেন, তেমনি ঘটনা ঘটল কিছু সুরকারদের মধ্যে কিশোরকুমার চলে যাওয়ার পর।

এই ঘটনা অতিরঞ্জিত নয়। এটা ইতিহাস, এটা সত্য। কিশোরকুমার এসেছিলেন, ওঁর প্রাণ যৌবনের প্রাচুর্যে মাতিয়ে রেখেছিলেন জগৎকে। নিঃসংকোচে বলতে পারি, ওঁর চলে যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা সিনেমায় কোনও পুরুষ কণ্ঠের গান তেমন সুপারহিট করেনি। সত্যিই কিশোরকুমার এক অমরশিল্পী।

এবার প্রসঙ্গ বদলাই। কিছুদিন আগে সত্য চৌধুরী সম্পর্কে বলতে গিয়ে কিছু কিছু কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। এখন সেকথা বলতে মন চাইছে। সে সময়ে গানের জগতে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র, মান্না দে, যশোদাদুলাল মণ্ডল, সতীনাথ মুখোপাধ্যায় এরকম কয়েকজন শিল্পী ছাড়া গ্র্যাজুয়েট শিল্পী প্রায় ছিলেনই না। সত্যদা গ্র্যাজুয়েট ছিলেন। তাই রেকর্ড কোম্পানি ওঁর সেই কৃতিত্বটাকে রেকর্ডেও ব্যবহার করতেন। ওঁর সব রেকর্ডে লেখা থাকত সত্য চৌধুরী, বি এ।

পরবর্তীকালে ‘মন্দির’ ও ‘রাঙামাটি’ ছবির চিত্রনায়ক সত্য চৌধুরী বিদেশি চা চা চা সুরের স্টাইলে গেয়েছিলেন ‘সেই চম্পা বকুল তলে …।’

নিজের বিদেশি সুরের স্টাইলে ওঁর আর একটা বিখ্যাত গান ‘পথে পথে ওই বকুল পড়িছে ঝরিয়া।

গ্র্যাজুয়েট হওয়াটা কণ্ঠশিল্পীদের অবশ্য যোগ্যতা হিসেবে ধরা হয় না। তবুও এখনও কলকাতায় খুব বেশি গ্র্যাজুয়েট শিল্পী নেই। মুম্বইতেও অনিল বিশ্বাস, মান্না দে ছাড়া খুব বেশি শিল্পীর কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।

বহু পাঠক-পাঠিকাদের কাছ থেকে অনুরোধ আসছে। যদিও আমার স্মৃতিতে অনেক মানুষই এখনও অম্লান আছেন। তবুও অনেকেই চাইছেন, আমি যেন সেইসব মানুষদের নিয়েই কিছু লিখি, যাঁদের নিয়ে খুব বেশি লেখা হয়নি।

মনে পড়ছে এক শিল্পীর কথা, তিনি সুপ্রীতি ঘোষ। তখন শচীন গুপ্ত আমার বহু গান ওঁর গানের ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীদের শেখাতেন। অনেকেই সে সব গান নিয়মিত বেতারে পরিবেশন করতেন। তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্যা ছিলেন আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় আর এই সুপ্রীতি ঘোষ। অত্যন্ত স্বাভাবিক নিজস্ব কণ্ঠের অধিকারিণী ছিলেন উনি। আমরা সংগীত যাকে ‘ফল্স ভয়েস’ বলি উনি তার ত্রিসীমানায় ছিলেন না। ওঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হল সেবার, যেবার শচীন গুপ্তের সুরে উনি আমার লেখা মাদুর্গার আগমনী নিয়ে বড় একটি গান এইচ. এম. ভি. রেকর্ডে পুজোর সময় পরিবেশন করলেন।

গানটি ছিল ‘বরষ পরে পুজোর ঘণ্টা বাজল রে দেশ জুড়ে…’।

আমাদের ছেলেবেলায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী হিট ছবি ছিল বিমল রায়ের উদয়ের পথে’। এই ছবিতে চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’ এই রবীন্দ্রগীতিটি গেয়েছিলেন চিত্রনায়িকা বিনতা রায় স্বয়ং। তার কিছুদিন আগেই পরিবেশিত হয় সুপ্রীতি মজুমদারের গাওয়া (উনি তখনও সম্ভবত ঘোষ হননি) চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে…।’ পাইওনিয়ার রেকর্ডে গানটি প্রকাশ হওয়া মাত্র সুপারহিট হয়। ‘উদয়ের পথে’ ছবিতে আবার এই গানটি শুনে, শ্রোতারা আরও সমাদরে গ্রহণ করেন এই গানটি।

সে সময় এই রেকর্ডটি, রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড বিক্রির সেরা তালিকায় ছিল। চিরদিনই মহিলা শিল্পীরা বিবাহের পর সব মেয়েদের মতোই স্বামীর পদবিতেই পরিচিতা হতেন। সুপ্রীতি মজুমদার হলেন সুপ্রীতি ঘোষ। উৎপলা ঘোষ হলেন উৎপলা সেন। সুপ্রভা ঘোষ হলেন সুপ্রভা সরকার। ইলা চক্রবর্তী হলেন ইলা বসু। আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন আলপনা মুখোপাধ্যায়। এরকম অনেক দৃষ্টান্ত আছে।

বাঙালি কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে স্বামীর পদবি গ্রহণের এই চিরাচরিত প্রথা প্রথম ভেঙে দিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। স্বামী শ্যামল গুপ্তের, গুপ্ত পদবিটি গানের জগতে ব্যবহার না করে উনি মুখোপাধ্যায়ই রয়ে গেলেন।

একই ঘটনা ঘটল আরতি মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও। প্রথম বিবাহে, সুবীর হাজরার হাজরা পদবিটি যেমন ব্যবহার করেননি, দ্বিতীয় বিবাহেও স্বামীর পদবি গানের জগতে ব্যবহার না করেও মুখোপাধ্যায় রয়ে গেলেন।

আমার ধারণা, পদবি পরিবর্তন করলে শ্রোতাদের মধ্যে একটা বিভ্রান্তি আসতে পারে। চেনা শিল্পীটিকে হয়তো অচেনা মনে হতে পারে। সেই ভেবেই অনেকে পদবি পরিবর্তন করেননি। যদিও এটা আমার ধারণা, এগুলো সম্পূর্ণই ওঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।

যেমন মুম্বইতেও আশা মঙ্গেশকর মি. ভোসলেকে বিয়ে করে হয়েছিলেন আশা ভোঁসলে। কিন্তু রাহুল দেববর্মণকে বিয়ে করে পদবি বদলাননি। অন্যদিকে সুমন কল্যাণপুর এবং গীতা দত্ত বিয়ের পর পদবি বদলে ছিলেন। গীতা রায় থেকে গীতা দত্ত হয়েছিলেন। অলকা ইয়াগনিকও বিয়ের পর পদবি পাল্টাননি। আগের পদবিতেই রয়ে গেলেন।

আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে এইচ. এম. ভি-তে সুপ্রীতি ঘোষের গাওয়া সেই গানটি। শ্যামল গুপ্তের লেখা গানে সুর করেছিলেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। গানটি ছিল ‘যেথায় গেলে হারায় সবাই ফেরার ঠিকানা গো’।

সেই সঙ্গে মনে পড়ছে ‘এই বসন্ত জানালে বিদায়’ গানটির কথা। ওঁর সুপারহিট গানের তালিকায় আরও একটি গান, নচিকেতা ঘোষের সুরে গাওয়া ‘কৃষ্ণচূড়ার স্বপ্ন ঝরা’। সুপ্রীতিদির আরও অনেক ভাল বাংলা আধুনিক গান আছে। কিন্তু কেন জানি না উনি খুব বেশি প্লে-ব্যাক করেননি। আমার ভগ্নিপতি প্রযোজক সরোজ মুখোপাধ্যায়ের ‘অলকানন্দা’ ছবিতে উনি গেয়েছিলেন একটি রবীন্দ্রসংগীত, গানটি ছিল ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও’। অপূর্ব গেয়েছিলেন গানটি।

যে সব শিল্পী যে যে রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ, সেই শিল্পীর রেকর্ড করানোর দায় সেই কোম্পানির ওপর। তাই কণ্ঠশিল্পীরা ‘বেসিক রেকর্ডে’ সহজেই গান গাইতে পারেন। কিন্তু প্লে-ব্যাক তো প্রযোজকের সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। অতএব ওটা অনেকটা নির্ভর করে ভাগ্যের ওপর। কোনও শিল্পী ইচ্ছা করলেই প্লে-ব্যাক গাইতে পারেন না। যদি না কোনও পরিচালক প্রযোজক তাঁকে গ্রহণ না করেন।

সুপ্রীতিদির হয়তো এদিকে তেমন যাতায়াত বা যোগাযোগ অল্প ছিল। তবুও অত্যন্ত আনন্দের কথা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘লাল দরজা’ ছবিতে বাপি লাহিড়ির সুরে সম্প্রতি উনি একটি গান গেয়েছেন। গানটিতে কোনও বাজনা নেই। খালি গলায় সেই নিজস্ব স্টাইলে অকৃত্রিম কণ্ঠে গেয়েছেন সুপ্রীতিদি। গানটি আমার দারুণ লেগেছে। আমার ধারণা, অনেকেই এই গানটিতে হারিয়ে যাওয়া সুপ্রীতিদিকে আবার নতুন করে ফিরে পাবেন।

আগেই বলেছি আমার লেখা গান প্রথম রেকর্ড করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মুম্বইয়ের বিখ্যাত রামচন্দ্র পালের সুরে। আমার দ্বিতীয় গানটি রেকর্ড করেন সুপ্রভা সরকার অর্থাৎ চিত্রজগতের বড়দি। গানটি ছিল ‘শুধু গান আরও গান।

প্রথম জীবনে যখন গান শোনা শুরু করলাম তখন থেকেই শুনতে থাকি ওঁর গান। সেই সময় সুপ্রভা সরকারকে বলা হত ‘বাংলা চিত্রজগতের চির কুহরিত বুলবুল’। ছেলেবেলায় শোনা ওঁর ‘দিদি’ ছবির সেই গান ‘কভু যে আশায়/কভু নিরাশায়…’। শাপমুক্তি’ ছবির গান ‘বাংলার বধূ বুকে তার মধু’ সেই অন্তরার সংযোজন—বৈশাখে তার উদাস নয়ন/আমের ছায়ায় বিছায় শয়ন’ এখনও আমার কানে বাজে। এই গানটির কথা উঠলেই আমি চলে যেতে চাই, চিত্রনাট্যকার পরিচালক সলিল সেনের কাছে। তাঁর মুখে শোনা একটি কথায়।

গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য যখন ‘শাপমুক্তি’ ছবির এই গানটি চিত্রপরিচালক প্রমথেশ বড়ুয়াকে দিয়ে চলে যান, তখন বড়ুয়া সাহেব গানটি পেয়ে অভিভূত হয়ে তাঁর সহকারীদের নিয়ে নাকি একটি আলোচনাসভা শুরু করেন। বড়ুয়া সাহেব গানটি পড়তে পড়তে বলেন ‘বৈশাখে তার উদাস নয়ন/আমের ছায়ায় বিছায় শয়ন’—এই ‘আমের ছায়াটা’ আপনাদের কেমন লাগছে বলুন তো?

নতুন আসা বড়ুয়া সাহেবের এক সহকারী, বলা ভাল ওভারস্মার্ট সহকারী, অন্য সবাইকে বলতে না দিয়ে সবার আগে বলে ওঠেন, স্যার, এটা ভুল। এটা রীতিমতো কষ্টকল্পনা। আম ফল তো এইটুকু-টুকু। তার আর কতটুকু ছায়া হবে যে সে ছায়ায় শয়ন করা সম্ভব? অজয় ভট্টাচার্যকে বলুন, আমের ছায়ার বদলে আম গাছের ছায়ায় শব্দটা লিখতে।

খুশি হয়ে বড়ুয়া সাহেব বললেন, ঠিক বলেছ। তুমি কাল স্টুডিয়োতে এসেই আমার সঙ্গে দেখা করো।

ওই সহকারী ভদ্রলোক পরদিন স্টুডিয়োতে এসেই বড়ুয়া সাহেবের অফিস থেকে পেলেন একটা মোটা খাম। প্রবল উৎসাহে খামটি খুলে সহকারীটি দেখলেন তাতে লেখা ইয়োর সার্ভিস ইজ নো মোর রিকোয়ার্ড’।

সুপ্রভা সরকার অর্থাৎ বড়দির একটা মজার গানের কথা স্মরণে আসছে। গানটি ছিল মধু বসুর ‘রাজ নর্তকী’ ছবিতে। কীর্তনের সুরে সে গানটি, একদিন বাঙালি মনপ্রাণ দিয়ে হাসতে হাসতে উপভোগ করত। গানটি ছিল ‘রাধা আর শ্যাম যেথা করে খেলা/তারে কহে রাসমঞ্চ’।

কিন্তু দ্বিতীয় পঙক্তিটি ছিল অ্যান্টি ক্লাইমেক্স। এবং গানটি অদ্বিতীয় হওয়ার আসল উৎস-’তুমি আর আমি তেমতি করিলে/হবে তাহা ফাঁসি মঞ্চ’।

বড়দির গাওয়া অসাধারণ গান, শৈলেন রায়ের রচনা আর রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুর সংযোজনায় অগ্রদূতের ‘স্বপ্ন ও সাধনা’ ছবির দুটি গান। একটি হল ‘ গানের সুরে জ্বালব তারার দীপগুলি’। দ্বিতীয় গান হল ‘সে যেন দখিন হাওয়ার সাথী’। ‘স্বপ্ন ও সাধনা’ আরও একদিক দিয়ে স্মরণীয়। এই ছবিটি স্বাধীন ভারতে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম বাংলা ছবি। মধ্য রাতের বিশেষ প্রদর্শনীতে, পরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সন্ধ্যারানি অভিনীত এই ছবিটি মুক্তিলাভ করে।

৪৬

রায়চাঁদ বড়ালের সুরে বিমল রায়ের ‘অঞ্জনগড়’ ছবিতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় চিত্রজগতে সামনে আসেন। ওই ছবিতে সন্ধ্যার হিট গানটি ছিল ‘গুন গুন গুন মোর গান…’। তার আগে ছায়াছবিতে বেশি গান গাইতেন শৈলদেবী। শৈলদেবীর পর বাংলা নব্বুই ভাগ ছবিতে কণ্ঠদান করতেন আমাদের বড়দি। অর্থাৎ সুপ্রভা সরকার। একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আচ্ছা বড়দি, আপনাকে সবাই বড়দি বলেন কেন?

বড়দি উত্তরে বলেছিলেন, আমি তো ছিলাম হিন্দুস্থান রেকর্ডের শিল্পী। একদিন ওখানে একজন এমন একটা বাঁকা কথা বলেছিলেন যে আমার চোখে ফেটে জল এসে গিয়েছিল। অভিমানে আমি ভেঙে পড়েছিলাম। তখন হিন্দুস্থানের বিশেষ অধিকর্তা যামিনী মতিলাল বড়দিকে বুঝিয়েছিলেন ছিঃ, তোমার কি এত অভিমান সাজে। তুমি সবার বড়। সবার বড়দি। ওরা সব কত ছোট। ওদের কথায় কান দিতে আছে? এই ‘বড়দি’ কথাটা জাদুমন্ত্রের মতো কাজ করে। চোখ মুছে ফেলেন বড়দি। সেই ঘটনা সংগীতজগতের সর্বত্র রটে যায়। সেই থেকে উনি হয়ে যান ‘বড়দি’।

আমার এখনও মনে আছে ভবানীপুরে আমার দিদির বাড়িতে শুনেছিলাম হেমন্তদা বললেন, আজ আমার দারুণ দিন। আজ আমার সুরে ‘প্রিয়তমা’ ছবিতে বড়দি গাইলেন ‘আমলকী বন পেরিয়ে হাওয়া…।’

বড়দির আর একটি উল্লেখযোগ্য কণ্ঠদান আমার পিতৃবন্ধু সুশীল মজুমদারের ‘অভিযোগ’ ছবিতে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের রচনা আর শৈলেশ দত্তগুপ্তের সুরে গাওয়া ‘পথিক হেথা বারেক যদি থামতে/ছায়াবিহীন ধূসর মরুপ্রান্তে’।

বড়দির আরও একটি সাফল্য নরেশ মিত্রের ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ ছবির গান। এ ছবির সুরকার ছিলেন নিতাই মতিলাল। এখনকার চিত্রপ্রযোজিকা রত্না চট্টোপাধ্যায়ের পিতা। রত্নার মা লেখিকা বারিদেবীর নাম তো সবাই জানেন।

রবীন্দ্রসংগীতে বড়দি কিছু না করতে পারলেও নজরুলগীতি গেয়ে সাফল্য পেয়েছেন। আজও ‘কাবেরী নদীজলে/ কে গো বালিকা’ শুনে থমকে দাঁড়ান না এমন শ্রোতা আছেন কে?

বড়দি এপার বাংলার মানুষ। হাওড়া জেলার আমতার মেয়ে। কিন্তু চমৎকার পূর্ব বাংলার কথা বলতে পারতেন। আমার জিজ্ঞাসার জবাবে উনি একদিন বলেছিলেন, আমি কী করে এত ভাল বাঙাল কথা বলতে পারি জানো?

আমি নেতিবাচক ঘাড় নাড়লাম। বড়দি বললেন, আমি সংগীত জগতে ঢুকে দেখি এখানে পূর্ব বাংলার লোকেরাই সংখ্যাধিক্য। তখনকার দিনে ওপার বাংলার অনেকেই বেশ কষ্ট করে কলকাত্তাইয়া ভাষা ব্যবহার করতেন। স্বচ্ছন্দ ছিলেন পূর্ব বাংলার ভঙ্গিতে কথাবার্তায়। ওরা নিজেদের মধ্যে অধিকাংশ সময়েই ওই বাঙাল কথা বলতেন। আমি ওদের মধ্যে থেকে থেকে সহজে রপ্ত করে নিয়েছিলাম ওই বাঙাল ভাষায় কথা বলা।

কথা শেষ করেই, গড় গড় করে একটু বাঙাল ভাষা বলে নিয়ে পূর্ব বাংলার গ্রাম্যগীতির একটি কলি শুনিয়ে দিলেন।

পঙক্তিটি হচ্ছে ‘মাওড়া ভাতের লাইগ্যা আমার পরাণ কান্দেরে’।

আধুনিক বাংলা গানও অনেক অনেক হিট করিয়েছেন বড়দি। আমার মনে হয় ওঁর সব থেকে হিট বাংলা আধুনিক গান অনিল ভট্টাচার্যের কথায় আর নির্মল ভট্টাচার্যের সুরে ১। এ পথে যখনি যাবে/বারেক দাঁড়ায়ো ফুলবনে। ২। যে ব্যথা দিয়ে গেলে। ৩। স্মরণের এই সোনার পাতায়…

কুন্দনলাল সায়গল বড়দির গানে মুগ্ধ হয়ে ওঁকে উপহার দিয়েছিলেন একটি চমৎকার হারমোনিয়াম। সেই/ হারমোনিয়াম বাজিয়েই বড়দি আজীবন আমাদের গান শুনিয়ে গেছেন।

আজ উনি নেই। জানি না সেই হারমোনিয়ামটি আজও আছে কি না

বড়দির কাছেই শুনেছি তখন একটি মাত্র মাইক্রোফোনে রেকর্ডিং হত। এখনকার মতো সুবিধাজনক চ্যানেল সিসটেম ছিল না। স্টুডিয়োর ফ্লোরে শব্দযন্ত্রী খড়ি দিয়ে দাগ দিয়ে দিতেন। সেই দাগ দেখে দেখে বাদ্যযন্ত্রীরা এগিয়ে পিছিয়ে বাজনা বাজিয়ে অর্কেস্ট্রার ব্যালেন্স করতেন। এখনকার মতো চাবি ঘুরিয়ে ইচ্ছেমতো কণ্ঠস্বরকে কমানো বাড়ানো যেত না। এই জন্যই এক-একটি গানের রিহার্সালে লাগত আট দশ দিন। তারপর সে গান শুনে প্রত্যেকে যখন খুশি হতেন, সে গান তখন লাগানো হত ছবিতে।

গ্রামোফোন রেকর্ডের জন্য আবার নতুন করে একইভাবে গ্রামোফোন স্টুডিয়োতে রেকর্ড করতে হত সে সব গান। এত সাধনায় সিদ্ধিলাভ করা সে সব গান আজও আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনছি। বলতে দ্বিধা নেই গানের এই অধ্যবসায় আজ হারিয়ে গেছে। আধুনিক যন্ত্র আমাদের যতই এগিয়ে দিক। শিল্পীদের আন্তরিকতাকে কমিয়ে দিয়েছে।

যূথিকা রায় আমার গান না গাইলেও ওঁর প্রচুর গান আমি শুনেছি। আর ওঁর সম্পর্কে প্রচুর শুনেছি কমল দাশগুপ্তের কাছে। কমলদা একদিন আমাকে বললেন, বুঝলি পুলক, একদিন নম্র জড়সড় একটি মেয়ে এইচ. এম. ভি.-র রিহার্সাল রুমে আমার ঘরে আমাকে গান শোনাতে এল। মেয়েটির অডিশন নিলাম। গান শুনলাম। গান শেষ হয়ে গেলেও যে সুরের রেশ থাকে, যা নাকি তোরা গানের কথায় লিখিস, সেটা সেই মুহূর্তেই আমি অনুভব করলাম। গান শুনিয়ে চলে গেল মেয়েটি। কিন্তু রেখে দিয়ে গেল এক অতুলনীয় সুরের মূর্ছনা। সেদিন আমার ঘরে ছিলেন প্রণববাবু অর্থাৎ প্রণব রায়। তুই তো ছিলি না, তখন তো হামাগুড়ি দিচ্ছিস। তাই প্রণববাবুকে বললাম, লিখুন প্রণববাবু। প্রণববাবু বললেন, আপনি বলার আগেই লিখে ফেলেছি। কথাটা বলেই সামনে রাখা গানের কাগজটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। লিখেছেন দুটি পঙক্তি। গানেতে ব্যবহার করেছেন মেয়েটির নাম। ‘আমি ভোরের যুথিকা /কনকথালায় সাজায় রাখি কানন বীথিকা।’

এ গান আমি জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই শুনছি। কমলদাকে তৎক্ষণাৎ বললাম, এরই উল্টো পিঠে ছিল ‘সাঁঝের তারকা আমি’। একটি ভোরের রূপকথা আর একটি সন্ধ্যার। একটি রেকর্ডের এপিঠ ওপিঠ। সত্যি অসাধারণ গীতিকার এই প্রণব রায়। কমল দাশগুপ্তের সুরে যূথিকা রায়ের কত হিট গান আছে তা গুনে শেষ করা যায় না। মনে পড়ছে ‘চরণ ফেলিও ধীরে ধীরে প্রিয়/আমার সমাধি পরে’, ‘জানি বাহিরে আমার তুমি অন্তরে নও’, ‘এমনই বরষা ছিল সেদিন’, ‘স্বপ্নে দেখি একটি নতুন ঘর’, এরকম বহু কালজয়ী গান ওঁর কণ্ঠ থেকে বেরিয়েছে।

যূথিকা রায়ের বাংলা আধুনিক গান যত হিট ঠিক তেমনই হিট হিন্দি গীত আর ভজন। অধিকাংশ গানই কমল দাশগুপ্তের সৃষ্ট। তখনকার দিনে ওঁর গাওয়া বেসিক গান অর্থাৎ নন-ফিল্মি হিন্দি গান সারা ভারতে যা বিক্রি হত কোনও হিন্দিভাষী গায়িকার বেসিক গানের বিক্রি তার ধারেকাছেও আসতে পারত না। কিন্তু আশ্চর্য জেদি ছিলেন প্লে-ব্যাকের বেলায়। ফিল্মে গান গাইতে কিছুতেই উনি রাজি হননি। কমলদাকে কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছি। কোনও দিনই উত্তর দেননি, এড়িয়ে গেছেন। হয়তো কোনও একান্ত ব্যক্তিগত কারণ থাকতে পারে। থাকতে পারে সিনেমার ওপর ক্ষোভ। তখন কমল দাশগুপ্ত থাকলেই, কি ছবিতে কি রেকর্ডে যে কোনও শিল্পীই চমৎকার উতরে যেতেন। তবুও যূথিকা রায় কমলদার এত কাছের শিল্পী হয়েও কেন যে এত নির্বিকার রইলেন জানি না।

পরবর্তীকালে রাজেন সরকার অসাধ্য সাধন করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত ‘ঢুলি’ ছবিতে। ‘ঢুলি’ ছবিতেই উনি জীবনে প্রথম প্লে-ব্যাক করেন। সে গান বিশেষ জনপ্রিয়তাও লাভ করে। এখনও হিন্দি বলয়ের একটু বয়স্ক শ্রোতাদের মুখে শুনি যূথিকা রায়ের জয়গান। মাদ্রাজেও ওঁর প্রশংসা শুনেছি। লোকমুখে শুনেছি, সাঁইবাবা ওঁর আশ্রমে ওঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে ওঁকে হাত ঘুরিয়ে শূন্য থেকে একটি স্বর্ণহার উপহার দেন সবার সামনে। একটিও হিন্দি ছবিতে প্লে-ব্যাক না করেও শুধু বেসিক গান গেয়ে এত জনপ্রিয়তা, আমার মনে হয় সারা ভারতে কোনও কণ্ঠশিল্পী কখনও পায়নি। এ দিক দিয়ে বাঙালি যূথিকা রায়ের ভারত জয়ের এটি একটি রেকর্ড।

আর একজনের কথা মনে আসছে। তিনি গৌরীকেদার ভট্টাচার্য। সতীনাথ, শ্যামলের আগের যুগে প্রেম সংগীতে এইচ. এম. ভি.-র একজন টপ সেলার সিঙ্গার ছিলেন উনি। বিশেষ এক ধরনের আধুনিক গানে ওঁর সমকক্ষ কেউ ছিলেন না। এখানেও সেই কমল দাশগুপ্ত।

দেবকী বসু পরিচালিত ‘চন্দ্রশেখর’ ছবিতে ওঁকে দিয়ে উনি একটি গ্রাম্য গীতি গাওয়ান। প্রতিভা যাকে স্পর্শ করে সেই জীবস্তু হয় এর প্রমাণ পাওয়া যায় ওই গানটিতে। ছবিটির পরিচালক অপূর্ব একটি রোমান্টিক মুহূর্তে কমলদার গানটি আরোপ করেন। আজও বুকের মধ্যে ডুকরে ওঠে সেই নীরব কান্নার আকুতি ‘বন্ধুরে আমার মনের বনে বাউরি বাতাস/কান্দিয়া লুটায়রে কান্দিয়া লুটায়…।’ রেকর্ডে তখনকার প্রথামতো কণ্ঠশিল্পীর নাম না থাকায় খুব ঘনিষ্ঠ জন ছাড়া কেউই জানল না এ গানটি ওঁরই গাওয়া। ভাগ্যের বিচিত্র খেলায় এই শিল্পীও বেশি দিন সংগীতজগতে রইলেন না। আজ অনেকেই ভুলে গেছেন এই দরদীয়া কণ্ঠশিল্পী গৌরীকেদার ভট্টাচার্যের নাম।

এর পরবর্তী প্রজন্মের একজন গায়িকার কথা মনে আসছে। বেতারের কী একটা গীতিআলেখ্য নিয়ে সে রাতে সুরকার বন্ধু শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে আমার বসার কথা। শৈলেন যে সময় যেতে বলেছিল আমি তার অনেক আগেই সেখানে পৌঁছে গেছিলাম।

ঘড়িতে দেখি তখনও প্রায় এক ঘণ্টা বাকি। এতক্ষণ সময় কোথায় ঘুরব? তাই ভাবলাম শৈলেনেরই বাড়ি যাই। ও না থাকলে ওর বউ রানুর সঙ্গে আড্ডা দেব, চা খাব, সময় কেটে যাবে। আর শৈলেন যদি থাকে তা হলে আমরা আমাদের বেতারের গীতিআলেখ্য নিয়ে বসে যাব। আমি লিখতে থাকব। শৈলেন সুর করতে থাকবে।

শৈলেনের বাড়িতে ঢুকে দেখি শৈলেন রয়েছে। আমাকে দেখে শৈলেন জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার। এত আর্লি? তুমি তো দেখছি খুব ঘড়ি মেনে চল? উত্তরে আমি বললাম, এটা আমি শিখেছি চিত্রপরিচালক চিত্ত বসু আর হেমন্তদার কাছে। একটু দেরি হলে হেমন্তদার মধ্যে যে উৎকণ্ঠা আমি স্বচক্ষে দেখেছি তা নিয়ে অনেক ঘটনা আছে। সেগুলো পরে বলব যখন হেমন্তদা প্রসঙ্গে আসব।

এখন চিত্ত বসুর ব্যাপারটা বলি। চিত্তদা ‘জয়া’ ছবির সময় আমায় বললেন, তুমি সকাল দশটার সময় আমার ভবানীপুরের বাড়িতে এসো। আমার ঘরে আমার সামনে বসে গান লিখবে। সে গান আমি সুরকার রবীন চট্টোপাধ্যায়ের কাছে পাঠিয়ে দেব।

ঠিক হিসেব করেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। ভবানীপুরে এসে দেখি মাত্র সাড়ে ন’টা বাজে। চিত্তদার বাড়ির কাছেই আমার এক বন্ধুর বাড়ি। ভাবলাম আধ ঘণ্টা ওখানে কাটিয়ে তারপর ঠিক সময়ে চিত্তদার কাছে পৌঁছে যাব।

আমায় দেখে আমার বন্ধু তো খুবই খুশি। আমায় বলল, আগে চা জলখাবার খা, তারপর ওখানে যাবি। দুজনার আড্ডা জমে গেল। ঘড়িতে দেখি দশটা বাজতে দশ। এবার আমায় উঠতে হয়।

বললাম, এ বাড়িতে আসা-যাওয়ার পথে আর একদিন আসব। আজ উঠি।

বন্ধু ছাড়ল না। সে বলল, অত ভাবছিস কেন? কলকাতার রাস্তায় ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে সময় রাখা সম্ভব নাকি? সবাই আধ ঘণ্টা গ্রেস দিয়ে রাখে। চিত্তবাবুও তাই রাখবেন।

যখন আমি চিত্তদার বাড়ি পৌঁছলাম তখন দশটা বেজে সতেরো। দরজার ঘণ্টি বাজালাম। একটু বাদে দরজা খুলে একজন বেরিয়ে এলেন তার হাতে একটা চিরকূট। তাতে লেখা ‘কলকাতার রাস্তায় জ্যাম লেগেই থাকতে পারে। তাই একটু সময় হাতে রেখে চলাফেরার অভ্যেস করো। সময় পেলে কাল সকালে ঠিক দশটায় এসো। এখন আমি অন্য কাজ নিয়ে বসেছি। আজ তুমি বাড়ি ফিরে যাও। ভবদীয় চিত্ত বসু।’

মাত্র সতেরো মিনিটের জন্য খেসারত দিতে হল। ভবানীপুর থেকে সালকিয়াতে ফিরতে হল মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে।

সারাটা পথ বন্ধুর বাড়ির চা জলখাবারের ঢেকুর উঠতে লাগল। তবে সুফল হল একটা, বাকি জীবনে চিত্তদার সঙ্গে আর কোনও ছবিতে আর কখনও সময়ের একটুও হেরফের হয়নি। এ শিক্ষাটা আজীবন আমার কাজে লেগেছে। শুধু একবার ঘটনাচক্রে আমি আবার এই ব্যাপারে একটা অদ্ভুত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম। ঘটনাটা ঘটেছিল রফি সাহেবকে নিয়ে।

৪৭

সেবার রফি সাহেবের সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল বিকাল সাড়ে পাঁচটায়। দাদারের কাছে একটা হোটেলে উঠেছিলাম। দাদার থেকে বান্দ্রায় রফি সাহেবের বাড়ি যেতে যে সময় লাগতে পারে সেটা মনে মনে হিসাব করে ট্যাক্সিতে উঠলাম। বান্দ্রায় এসে ড্রাইভারকে নিউ টকিজের রাস্তা নিতে বললাম। আমায় বাঙালি দেখেই বোধ হয় ড্রাইভার সাহেব একটা বেশ বড় চক্কর দিয়ে গাড়ি চালালেন। যখন বুঝলাম তখন বেশ দেরি হয়ে গেছে। যা হোক রফি সাহেবের বাড়ি পৌঁছে ছিলাম মিনিট পনেরো পরে। আমি ট্যাক্সি ছেড়েই দেখি রফি সাহেবের শ্যালক জাহেদ সাহেব, যিনি ওঁর প্রাইভেট সেক্রেটারির কাজ করতেন তিনি বেরিয়ে যাচ্ছেন। আমায় দেখেই জাহেদ সাহেব বললেন, আজ আর হবে না। দাদা এখনি বের হচ্ছেন আপনি কাল সকালে ফোন করুন। নতুন টাইম দেব।

রীতিমতো বিমর্ষ হয়ে গেলেও আর একবার লাস্ট ট্রাই নিতে রফি সাহেবের দরজায় নাড়া দিলাম। দরজায় খুললেন শিল্পী স্বয়ং। আমাকে দেখে বললেন, আরে আপনি! আমি তো ভাবলাম আপনি আর এলেন না। বেরিয়ে যাচ্ছিলাম।

সেদিন বোধ হয় ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল আমার। তাই বললেন, আসুন, আসুন। আমার স্ত্রী কাবাব বানিয়েছেন। আগে একটু মুখে দিন তার পরে কাজের কথা হবে।

সেদিন রফি সাহেবের বাড়িতে সুগন্ধি ওই কাবাব খেয়ে এত ভাল লেগেছিল যে, আর কোথাও খেয়ে এত ভাল লাগেনি। রফি সাহেব নিজে খেতে যতটা ভালবাসতেন, খাওয়াতে ভালবাসতেন তার চেয়ে অনেক বেশি।

আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শৈলেন মুখোপাধ্যায় এই দুটো ঘটনাই, আমার কাছে শুনেছিল। তাই বলল, বোস, চা বলি।

জাঁকিয়ে বসলাম ওর ফ্ল্যাটের ড্রইং রুমে। তখনও চা আসেনি। এসে গেল বেশ রোগা একটা কমবয়েসি মেয়ে। শৈলেন ওকে দেখেই বলল, আজ তোমার ক্লাস হবে না। পুলক এসে গেছে। পুলকের সঙ্গে অন্য কাজে বসব। তুমি আজ বাড়ি যাও।

মেয়েটি হাসি মুখে সেই আদেশ মেনে নিয়ে, হাসি মুখেই আমাকে প্রণাম করে চলে যাওয়ার উদ্যোগ করল। আমি স্বাভাবিক ভদ্রতায় জিজ্ঞাসা করলাম, কী নাম তোমার? খুব দূরে থাক নাকি?

রোগা মেয়েটি উত্তর দিল, আমার নাম হৈমন্তী শুক্লা। বাগবাজারের দিকে থাকি। আমি নিজেও দূরে থাকি। দূর থেকে আসা যাওয়ার কষ্ট বুঝি। তাই আমি বললাম, না, তুমি যেয়ো না বোসো।

শৈলেনকে অনুরোধ করলাম, মেয়েটি অত দূর থেকে এসেছে। ফিরিয়ে দিচ্ছ কেন? আমি আগে এসেছি। আমিই তো দোষী, ও তো নয়। নাও ক্লাস করো। ও গান শিখে বাড়ি চলে যাক। আবার এক রাউন্ড চা খেয়ে আমরা কাজে বসব।

অগত্যা শৈলেন আমার সামনেই গান শেখানো শুরু করল। আমি বসে বসে শুনতে লাগলাম। একসময় গান শেখানো শেষ হল। আমাকে আর শৈলেনকে প্রণাম করে চলে গেল অনামী অপরিচিতা হৈমন্তী শুক্লা। ও চলে যাওয়ার পর আমি শৈলেনকে বললাম, এতো ভাল গলা। ওকে দিয়ে রেকর্ড করাও। ও দারুণ গাইবে।

শৈলেন বলল, এইচ. এম. ভি.-কে তো বলেছি। কিন্তু ওরা বলল, ওদের এ বছরের সব প্রোগ্রাম কমপ্লিট। নেকস্ট ইয়ারে ভেবে দেখবেন।

এইচ. এম. ভি.-র একথাটা অন্যায় নয়। তখন সম্ভবত জুলাই মাস। পুজোর সব কিছু রেডি হয়ে গেছে। আমার মধ্যে একটা জেদ এসে গেল। সেটা শৈলেনকে না জানিয়ে আমাদের কাজে বসে গেলাম। কাজে বসেই শৈলেন বলল, লক্ষ করলি ওর গলার সূক্ষ্ম মোচড়গুলো? কেন থাকবে না বল। ওর রক্তে যে রাগাশ্রয়ী গান। ও যে বিখ্যাত রাগ সংগীত শিল্পী হরিহর শুক্লার মেয়ে।

শৈলেনের মুখে একথা শুনে আমার যেন আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেল।

বোধ হয় পরদিনই আমি গিয়েছিলাম অক্রুর দত্ত লেনে হিন্দুস্থান রেকর্ডের অফিসে। হিন্দুস্থান রেকর্ডের অধিকর্তা যামিনী মতিলাল আমাকে দেখে একটু টিপ্পনী দিয়ে বললেন, কী ব্যাপার পুলক? তুমি এইচ এম ভি ছেড়ে এখানে?

আমি কোনও ভণিতা না করে যামিনীদাকে বললাম, এসেছি একটা অনুরোধ নিয়ে।

যামিনীদা গম্ভীর হয়ে বললেন, তুমি তো কখনও কোনও অনুরোধ নিয়ে আস না। আমরাই তো অনুরোধ করে তোমাকে ডেকে এনে গান লেখাই। এবার বলো অনুরোধটা কী?

এবার ভরসা পেয়ে বললাম, এবারের পুজোতে একটি নতুন মেয়ের গান রেকর্ড করতে হবে।

মেয়ে শুনেই যামিনীদা রসিক হয়ে উঠলেন। বললেন, মেয়ে! কেমন দেখতে? ক’দিন ওকে নিয়ে সিনেমা দেখেছ?

আমিও রসিকতা করে উত্তর দিলাম, দারুণ দেখতে। মোট উনিশটা ছবি ওকে নিয়ে দেখেছি। হল তো? আপনি ওর রেকর্ড করবেন কি না বলুন।

যামিনীদা এ রসিকতার সূত্র ধরেই বললেন, দাঁড়া দাঁড়া। আমি আগে ওকে চাক্ষুষ দেখি। তারপর একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, আগে ওর গান একটু ভাল করে শুনি।

আমি বললাম, আমি শুনেছি। আপনি আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারেন। দারুণ গলা ওর। দারুণ গায়। হরিহর শুক্লার মেয়ে ও।

হরিহর শুক্লার নামটা শুনেই রাজি হয়ে গেলেন যামিনীদা। বললেন, তা হলে তো করতেই হয়। কে ট্রেনিং করবে?

আমি বললাম, শৈলেন মুখোপাধ্যায়। যামিনীদা খুশি হয়ে বললেন, ভাল সুর করে গন্ধা (শৈলেনের ডাক নাম গন্ধা)। আমি আগেই বলেছি, হেমন্তদার সঙ্গে আমিও সম্পূর্ণ একমত। ভাগ্যের একটা ভূমিকা থাকে। যেটা হৈমন্তীর ক্ষেত্রে পুরোপুরি সত্য। যামিনীদা প্রায় রাজি হয়ে গেলেন। পাছে আবার কখনও ওঁর মত বদলে যায় তাই ওঁর টেবিল থেকেই তৎক্ষণাৎ ফোন করলাম শৈলেনকে। পেয়েও গেলাম। ওরা দুজনে কথা বলে নিল। খুব তাড়াতাড়ি রেকর্ডটা করতে হবে।

রেকর্ড তো করতেই হবে। কিন্তু গান কোথায়?

পরের দিন শৈলেন বলল, হৈমন্তীকে গান শিখিয়ে যামিনীদাকে শোনাব। উনি সংগীতবোদ্ধা। কোনও অসুবিধা হবে না। কিন্তু কোথায় সিটিংটা করা যায় বলো তো? আমার বাড়িতে এত লোক আসে যে মনোযোগ দেওয়া যায় না। আর তোমার সালকিয়ার বাড়ি নিরিবিলি হলেও জ্যাম এড়িয়ে যাওয়া-আসা দুঃসাধ্য। বরং মন্টুদিকে ফোন করি। মঈদির যোধপুর পার্কের ফ্ল্যাটে বসব। মন্টুদি বিখ্যাত চিত্রাভিনেতা পাহাড়ী সান্যালের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া। উত্তমকুমারের বাড়িতে ছিল ওঁর নিত্য আনাগোনা। উত্তম ওঁকে বোন বলে ডাকত।

শৈলেন তখনই ফোন করল মণ্টুদিকে। মন্টুদি এক কথায় রাজি। উনি আরও বললেন, গান তৈরি করে পালিয়ে গেলে চলবে না। আমার এখানে খাওয়া-দাওয়া করে বাড়ি ফিরতে পারবে।

আমাদের জীবনে এমন অনেক মানুষকে পেয়েছি যাঁরা নিজের কোনও স্বার্থে নয়, শুধু আমাদের গানকে ভালবেসে আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। যাই হোক নির্দিষ্ট দিনে মন্টুদির বাড়িতে আমরা দুজন হাজির হলাম। উনি ওঁর এসি রুমটা আমাদের ছেড়ে দিলেন।

কোথায় একটা আনন্দ উচ্ছ্বাসের গান বানাব তা নয়, কী কারণে জানি না বানিয়ে ফেললাম হৈমন্তীর জীবনের প্রথম গান, মান্না দে’র ভাষায় কান্নাকাটির গান। গানটি ছিল ‘এতো কান্না নয় আমার/এ যে চোখের জলের মুক্তা হার/আমার পরতে ভাল লাগে। বঁধু তোমারই পথ চেয়ে।’

গানটি প্রকাশ মাত্রই জনপ্রিয়তা লাভ করল। এসে গেল বাংলা সংগীত জগতে আর একজন প্রকৃত শিল্পী হৈমন্তী শুক্লা।

শৈলেন আর আমি আড়াল থেকে সার্থকতার আনন্দে ভরপুর হয়ে রইলাম।

এরপরই অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যখন ‘দুষ্টু মিষ্টি’ এবং ‘বালক শরৎচন্দ্র’ ছবির জন্য গান লিখছি তখন অভিজিৎবাবুকে অনুরোধ করেছিলাম হৈমন্তীকে দিয়ে প্লে-ব্যাক করাবার জন্য। এক্ষেত্রেও হৈমন্তীর ভাগ্য প্রসন্ন। একটা ছবিতে নতুন শিল্পীকে দিয়ে গাওয়ানোর জন্য যে কটা দিক থেকে অনুমোদনের প্রয়োজন হয়, সব দিক থেকে তৎক্ষণাৎ তা এসে গেল। সংগীত পরিচালক, চিত্র পরিচালক, চিত্র প্রযোজক সকলেই শুধু আমার কথাতে রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু এমনটা সচরাচর হয় না।

সবাই যেন মনে না করেন আমি বললেই সব ক্ষেত্রেই সুফল ফলে। ভাগ্যই সুফল ফলায়। যা হোক, হৈমন্তী খুবই আত্মবিশ্বাসে টেকনিশিয়ান স্টুডিয়োতে এসে কৃতী শব্দযন্ত্রী সত্যেন চট্টোপাধ্যায়ের মাইকের সামনে দাঁড়াল।

অভিজিৎবাবুর সুরে আমার লেখা ‘শিব ঠাকুরের গলায় দোলে বৈঁচি ফলের মালিকা’ গানটা হিট হয়ে গেল। অর্থাৎ প্লে-ব্যাকেও সাফল্য লাভ করল হৈমন্তী। ওকে নিয়ে আমার স্মৃতি বিশাল। তাই অনেক কথা মনে আসছে।

এরপর হিন্দুস্থান রেকর্ডে শৈলেন আর আমি পর পর ওর অনেক রেকর্ড করালাম। তার মধ্যে একটি গান খুব সুন্দর হয়েছিল ‘পেলাম সাত মহলা ঘর/ঘর তো পেলাম না।

হিন্দুস্থান রেকর্ডিং কোম্পানিতে মহিলা গায়িকাদের মধ্যে তখন হৈমন্তীর স্থান অনেক উঁচুতে। সেই সময় বিমান ঘোষ রেডিয়ো ছেড়ে এইচ. এম. ভি.-তে যোগ দিলেন। বিমানদা হৈমন্তীকে এইচ. এম. ভি.-তে আসতে বললেন। ব্যাপারটা জানতে পেরে আমি সরাসরি হৈমন্তীকে বলেছিলাম, তুমি হিন্দুস্থানে প্রায় রানির মতো আছ। এইচ এম ভিতে যেয়ো না। ওখানে ভিড়ে হারিয়ে যাবে। কিন্তু তখনকার এইচ. এম. ভি.-র আকর্ষণ এড়াতে পারল না হৈমন্তী। হিন্দুস্থান ছেড়ে চলে এল।

বিমানদা অনেক শিল্পী তৈরি করেছেন। উনি ছিলেন প্রকৃত সংগীতবোদ্ধা, রেডিয়োর মানুষ, রেকর্ডের বাণিজ্যিক মানুষ নন। উনি যে সব গান হৈমন্তীকে দিয়ে এইচ. এম. ভি.-তে রেকর্ড করালেন, তার একটা গানও চলল না। শেষটায় বাধ্য হয়ে হৈমন্তীর মতোই আরও কিছু শিল্পীকে দিয়ে সবাইকে দুখানা করে গান দিয়ে একটা এলপি রেকর্ড সেবার পুজোতে বার করবেন বলে ঠিক করলেন। স্বভাবতই এই ব্যাপারটা হৈমন্তীকে দারুণ আঘাত দিল। ও আমার কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলল, পুলকদা এইচ. এম. ভি.-তে এসে অবধি আপনি তো আমার একটা গানও লেখেননি। এবারের দুটো গান আপনি লিখুন।

আমি বিমানদার সঙ্গে কথা বললাম। বললাম, এ কী করছেন। এল পি তে গাইলে তো হৈমন্তীর কেরিয়ার শেষ। বিমানদা বললেন, কী করব? ওর গান যদি বিক্রি না হয় আমি কী করে ওর গান রেকর্ড করি? এ তো রেডিয়ো নয়। এখানে বিক্রিটা বলতে গেলে শিল্পীর আসল পরিচয়।

সবিনয়ে বললাম, আপনার যুক্তি মেনেই বলছি বিমানদা। এই একটা শেষ সুযোগ ওকে আপনি দিন। আমি মান্না দেকে অনুরোধ করব, আমার লেখায় ওর গান তৈরি করে দিন।

বিমানদা আর মান্না দে আমার বেশ কিছুদিন আগে একই সঙ্গে ওই স্কটিশ চার্চ কলেজেই পড়তেন। মান্নাদার কথা শুনে বিমানদার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। উনি বললেন, বেশ তুমি যদি রাজি করাতে পারো তবে আমি ওকে শেষ সুযোগ দিতে রাজি।

পর দিনই হৈমন্তীকে বললাম, মান্নাদা এখন কলকাতায় আছেন। তুমি সক্কাল বেলাতেই ওঁর বাড়ি চলে যাও। আমার একটা গান দারুণ সুর করেছেন। অনুনয়-বিনয় করে সেটা আদায় করো। আমিও মান্নাদাকে বলে রাখব।

পরদিন সকালেই মান্নাদার ফোন এল। হ্যাঁ মশাই, একটা ইয়াং মেয়েকে পাঠিয়েছেন। তার জন্য ও রকম একটা কান্নাকাটির গান কেন? ওর যদি ট্রেনিংই করি তা হলে খুশি আনন্দের গানই করব।’

তখন ই পি রেকর্ডের যুগ। আমি বললাম, একটা গান তো নয়, আরও তিনটে গান করতে হবে। সেগুলো না হয় তাই করব। কিন্তু যে গানটা আমি ওকে দিতে বলছি অনুগ্রহ করে ওটাই ওকে দিয়ে দিন।

মান্নাদার প্রশ্ন: ওই কান্নাকাটির গানই ওকে দিতে হবে? আমি বললাম, দিয়েই দেখুন না। আমাকে নাছোড় দেখে মান্নাদা গানটি ওকে দিয়ে দিলেন। যে গানটি উনি নিজে গাইবার জন্য বানিয়েছিলেন সেই দুর্লভ গানটি। স্বার্থত্যাগের এমন দৃষ্টান্ত সংগীত জগতে বিরল।

৪৮

গানটি ছিল ‘আমার বলার কিছু ছিল না/ চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে।’ যে শিল্পী এইচ. এম. ভি.-র করুণার পাত্রী হয়ে সেবার সুযোগ পেল, রাতারাতি সে চলে গেল অনেক উঁচুতে। ওই একটা গানেই হয়ে গেল তার গল্ফ গ্রিনের ফ্ল্যাট আর গাড়ি। তারপর আর একবছর মান্নাদা ওকে দিয়ে গাওয়ালেন আমার আর একটা গান ‘ঠিকানা না রেখে ভালই করেছ বন্ধু’। সে গানও হিট করে গেল। ইতিমধ্যে চিত্রশিল্পী বিকাশ রায়ের অনুরোধে আমি লেকের অ্যান্ডারসন ক্লাবের জন্য একটি জল-নাটিকা রচনা করি। নাটিকাটির নাম দিয়েছিলাম ‘সমুদ্র মন্থন’। বিকাশ রায় ছিলেন ওটির পরিচালক। সুর দিয়েছিলেন শৈলেন মুখোপাধ্যায়। ওখানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় শুনেছিলেন হৈমন্তীর গান। হেমন্তদা আমায় বললেন, মেয়েটির গানে বেশ একটা স্টাইল আছে। সে সময় উনি আমার কাহিনী ও গানের ‘রাগ অনুরাগ’ ছবির সংগীত পরিচালনা করছেন। ওই ছবির ‘কী গান শোনাব বল/ওগো সুচরিতা’ গানটিতে একটি সরগম ও তান ওকে দিয়েছিলেন। চমৎকার গাইল হৈমন্তী। এরপর হেমন্তদা বানালেন, আমার কথায় ওর পুজোর গান ‘ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না …’।

হেমন্তদা অনেক ছবিতে হৈমন্তীকে গাওয়ালেন। গাওয়ালেন অভিজিৎবাবু ‘সন্ধি’ ছবিতে। আমার কথায় আরও অনেক আধুনিক গান মান্নাদা ওকে দিয়ে রেকর্ড করালেন। হৈমন্তীর জীবনের আরও উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও উস্তাদ আলি আকবরের সুরে গাওয়া বাংলা গান। ওই এল পি রেকর্ডটিরও গীতিকার ছিলাম আমি।

সব সময়ই একটা ভাল নতুন কিছু করার আগ্রহ আছে ওর মধ্যে। তাই একবার ভারত বিখ্যাত নৌশাদ আলির সুরেও বাংলা গান গেয়েছিল।

সেখানেও গান লিখেছিলাম আমি। সম্প্রতি ও গাইল সুমন চট্টোপাধ্যায়ের কথায় ও সুরে ‘জীবনমুখী’ ধরনের আধুনিক গান ‘সবুজের প্রতিশোধ’। হয়তো এ ধরনের গান ওর স্টাইল নয়, তাই সেটা জনপ্রিয়তা পেল না। তবু ওর এই নতুন কিছু করার প্রচেষ্টাকে আমি সাধুবাদ না জানিয়ে পারছি না।

পরেও একবার পুজোয় করেছে আমার লেখা আটখানি গান। ক্যাসেটটির নাম ‘তোমার মন দিয়েছি’।

মনে পড়ছে ওই ওস্তাদ আলি আকবর আর পণ্ডিত রবিশঙ্করের সুরে আমার গান লেখার সময়কার ঘটনা। এই দুজন বিশ্ববরেণ্য সুরশিল্পীকে বাংলা আধুনিক গান করাতে রাজি করানোর পেছনে তখন বিশু চক্রবর্তীর ভূমিকাও কম ছিল না। ও আর হৈমন্তী দুজনেই প্রথম এই দুঃসাহসিক কাজটা করতে তৎপর হল। বিশু হঠাৎ একদিন আমায় বলেই ফেলল—পুলকদা, এখন কাউকে বলবেন না—এবার পুজোয় আলি আকবর আর রবিশঙ্কর বোধহয় হৈমন্তীর লং প্লেয়িং-এ সুর দেবেন। ব্যাপারটা অনেকটা এগিয়েছে। আপনি প্রস্তুত থাকুন। যথা সময়ে আপনাকে জানাব।

এই বিশু এখন সংগীতজগৎ থেকে সরে এলেও ওর অনেক আশ্চর্য ঘটনা আমার স্মরণে আসছে। আমার যতদূর ধারণা, ওরই উদ্দীপনায় নৌসাদ আলিও জীবনে প্রথম বাংলা গান করতে সম্মতি দিয়েছিল। ওঁর সুরের ওই এল.পি-তেই আমি লিখেছিলাম আমার জলকে যাবার পথে কেন/দাঁড়ায় এসে শ্যাম’ এবং ‘প্রেমকে প্রণাম’ ইত্যাদি অনেক ভাল গান।

যা হোক, হঠাৎ একদিন হৈমন্তীর টেলিফোন এল। আলি আকবর এসেছেন কলকাতায়, রয়েছেন ওঁর হিন্দুস্থান মার্টের পুরনো বসতিতেই। যথা সময়ে হাজির হলাম। আলি আকবর যখন এমন পাকাপাকিভাবে বিদেশে চলে যাননি তখন কলকাতায় এলে ওইখানেই থাকতেন। অনেক বাংলা ছবিতে উনি সুরও দিয়েছেন, তার মধ্যে উত্তম অঞ্জনা ভৌমিক অভিনীত ছবিও ছিল। আমিও ওঁর অনেক ছবিতে গান লিখেছিলাম। কিন্তু ‘বেসিক সঙ’ অর্থাৎ তথাকথিত আধুনিক গান ওঁর সুরে লেখা আমার এই প্রথম। হৈমন্তীর সঙ্গে আমাকে দেখেই আমায় খুশি মনে অভ্যর্থনা জানালেন উনি। যতদূর মনে পড়ছে প্রথমে সরোদে কী একটা সুর বাজিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, এ রাগটা আমারই সৃষ্টি। লিখুন এই রাগে। ওঁর ছবিতে যখন গান লিখেছিলাম তখন উনি আমাকে লেখা গান পড়ে শোনাতে বলতেন। আর সুর করতেন। আমার অসুবিধা হবার কথা নয়। এবারে আগে সুর পরে কথা। কিন্তু আলি আকবর সাহেব অস্পষ্ট কণ্ঠে কী যে গাইছেন তা অনুধাবন করা সত্যিই কষ্টকর। তবু লেগে গেলাম। ওঁর ওই সুরের ওপরই লিখে ফেললাম প্রথম গানটির মুখড়া। হৈমন্তী আমার কানে কানে বললে, পুলকদা, বুঝতে পারছেন কিছু? আমি তো কিছুই বুঝছি না। আমি ফিসফিস করলাম, মনে হচ্ছে, ধরে ফেলেছি। একটা কাগজে লেখা সেই মুখড়াটি এগিয়ে দিলাম ওকে। আবার গাইলেন খাঁ সাহেব। হৈমন্তী ওই সুরটা শুনে আমার কাগজটি মিলিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেয়ে উঠল, ‘স্মৃতিই শুধু থাকে/স্মৃতিই শুধু থাকে।’ আমাকে কমপ্লিমেন্ট দিল হৈমন্তী, সত্যিই পুলকদা, সুরের ওপর গান লেখার আশ্চর্য গুণটা আপনার আছে। এইভাবেই পরপর বেশ কয়েকটি গান সেবার লিখেছিলাম আলি আকবরের সুরে।

পণ্ডিত রবিশঙ্করের সুরে লতাজির গাওয়া একটি বিখ্যাত হিন্দি গানের সুরে বাংলা কথা আমি আগে থেকেই লিখে রেখেছিলাম। রবিশঙ্করের কাছে গিয়ে শুনলাম ওই গানটিই হৈমন্তীর অ্যালবামে উনি করতে চান। কী মনে করে সঙ্গে গানটি নিয়েই গিয়েছিলাম। ওঁর প্রস্তাব শুনেই দেখালাম ওই গানটি। হৈমন্তী সুর জানত। গেয়ে শোনাল—’আর যেন সেদিন ফিরে না আসে।’ সুপুরুষ রবিশঙ্কর অপরূপ হাসি দিয়ে অনুমোদন করলেন সে গানের কথা। পরের গান উনি কিন্তু সেতার বাজিয়ে সুর দিলেন না, হারমোনিয়াম বাজিয়ে দিলেন। আমি অবশ্য বিভিন্ন সুরশিল্পীর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা রাখি। জীবনে অনেক গানই সেতার, সরোদ, বাঁশি, পিয়ানো, কি-বোর্ডের ওপর লিখেছি। কিন্তু হারমোনিয়ামে গান লেখায় আজও নিজেকে সবচেয়ে সহজ, সরল ও সাবলীল লাগে।

অনেকেরই ধারণা মুম্বইয়ের কবিতা কৃষ্ণমূর্তি মান্না দের আত্মীয়া। ধারণাটির মূল কারণ হয়তো যেহেতু মান্না দের স্ত্রী সাউথ ইন্ডিয়ান। অতএব ওঁর স্ত্রীর সম্পর্কেই কবিতা মান্না দের আত্মীয়া। গানের সূত্রে অবশ্যই কবিতা মান্নাদার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া কিন্তু অন্য প্রচলিত সূত্রে নয়। কবিতারই এক আত্মীয়া বাঙালি। ওঁর কাছেই ছোটবেলা থেকে কবিতা বাংলা শিখে এসেছে। তাই এত স্বচ্ছন্দে বাংলা বলতে পারে। মান্নাদার কাছে কিন্তু নিয়মিত গান শিখেছে কবিতা। ওর আজকের এই এত বড় সাফল্যের পিছনে মান্নাদার ভূমিকা অনস্বীকার্য।

মান্নাদাই একদিন হঠাৎ বললেন—পুলকবাবু, একটি সাউথ ইন্ডিয়ান মেয়ে, নিশ্চয়ই নাম শুনেছেন, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি আজকাল দারুণ গাইছে। তখন কবিতা সবে উঠতি। অবশ্য ইতিমধ্যেই আমি ওর নাম শুনছিলাম। তার ওপর মান্নাদা স্বয়ং যাকে ভাল বলছেন—স্বাভাবিকভাবেই তার ওপর আস্থা আমার বেড়েই গেল। মান্নাদাই বললেন ওকে দিয়ে বাংলা গান করাব। আপনি গান ভাবুন!

আগেই বলেছি নতুন কিছু সৃষ্টি করতে আমার উৎসাহ অদম্য। সেই সময় মান্নাদাকে সবসময়েই ওই গানের সুর সৃষ্টি নিয়ে মগ্ন থাকতে দেখেছি।

তখন অবশ্য ই পি-র যুগ। আজকের মতো ক্যাসেটের দিন নয়। তাই চারখানি গানই যথেষ্ট ছিল। মনে আছে সম্ভবত ওই ই পি রেকর্ডের শঙ্খ নদীর বাঁধা ঘাটে’ গানটি মান্নাদা চার রকম সুর করে আমায় শুনিয়েছিলেন।

কিন্তু আমাদের এত পরিশ্রম বিফল হল। রেকর্ডটি বাণিজ্যিক সাফল্য পেল না। তারপর দিনে দিনে কবিতা অনেক অনেক জনপ্রিয়তা পেল। বিভিন্ন ধরনের গান অনায়াসে গেয়ে অনেক নাম করল। কিন্তু মান্নাদার সুরে ওর আধুনিক গান করার যোগাযোগ হল খুবই সম্প্রতি। ওর জন্য আবার আমরা আটটি গানের ক্যাসেট বানাতে পেরেছি।

কিছুদিন আগেই কবিতার আর একটি অ্যালবাম আমি করতে পেরেছি—একটু ভক্তিভাবের ওপর, যার নাম দিয়েছি পূজারিণী। সুর দিয়েছেন নবীন চট্টোপাধ্যায়।

এই পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চলে মাঠে ঘাটে বিভিন্ন অফিসে যত্রতত্র যত ফাংশন হয় সারা ভারতবর্ষে কেন সারা পৃথিবীতে কোথাও তত হয় না। এ কালের শিল্পীদের অনেক শিল্পীকেই আজকাল বলতে শুনি, বাংলা ছবির সিংহভাগ গানই তো এখন গাইছেন মুম্বইয়ের কণ্ঠশিল্পীরা। আমাদের প্লে-ব্যাক কোথায়? তাই অর্থ উপার্জনের জন্য ফাংশনের দিকে জোর দিতেই হয়। এ বক্তব্য অবশ্যই যুক্তিযুক্ত এবং এও মানি গানের জগতে কে কখন কোথায় আছেন তা জানেন ওই ওপরওয়ালা। তা-ই নিশ্চয়ই সময় থাকতে কিছু গুছিয়ে নেওয়া একান্তই প্রয়োজন, কিন্তু এ কথাটাও নির্মম সত্য, পরপর ফাংশন করলে কণ্ঠস্বরের ক্ষতি হয়। এই কথাটি স্মরণে রেখেছেন বলেই মুম্বইতে লতা মঙ্গেশকর আর কলকাতার সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, এই বয়সেও এত ভাল গান গাইতে পারছেন। ওঁরা সারা বছরে তিন-চারটের বেশি ফাংশন করেন না। বেশি ফাংশন করলে অবশ্যই বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারতেন। কিন্তু ওঁরা সে ফাঁদে পা দেননি। এড়িয়ে গেছেন যখন তখন মোটা টাকার হাতছানি।

আজকালকার তথাকথিত শিল্পীরা আগের ক্যাসেট জনপ্রিয়তা না পেলেও, ওরা যে আবার নতুন ক্যাসেটে গান গেয়েছেন এর বিজ্ঞাপন দেখেই আবার নতুন ফাংশনের ডাক আসবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকেন। ফাংশনের এই প্রলোভন না থাকলে আমার ধারণা আজকালকার অনেক শিল্পী ক্যাসেট করা থেকে বিরত থাকতেন। ওঁরা বিন্দুমাত্র চিন্তা করেন না যে ভাল করে বানাতে পারলে একটা ক্যাসেট কতটা ভাল হতে পারে। আর স্বভাবতই ওই ভাল গানের ক্যাসেট যদি ভাল বিক্রি হয় তার রয়ালটিও যে বিরাট হতে পারে ওঁরা নিশ্চয় প্রত্যেকে তা জানেন। জানি না কীসের অভাবে হারিয়ে ফেলেন নিজেদের আত্মবিশ্বাস। যুথিকা রায়, হাতে গুনে বলা যায় জীবনে কটা ফাংশন করেছেন। প্লে-ব্যাক তো সম্ভবত ‘ঢুলি’ ছাড়া করেনইনি অথচ ওঁর রেকর্ড রয়াল্টি সে সময় একটা বিস্ময়কর মাত্রা ছুঁয়ে গিয়েছিল।

রমা দেবীর কথা আজ হয়তো কারও মনে নেই। উনি অবশ্য হাতে গোনা ছবিতে প্লে-ব্যাক করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কৃষ্ণচন্দ্র দে প্রযোজিত এবং সুরারোপিত ‘পূরবী’ ছবির গান, শৈলেন রায়ের লেখা ফুলে ফুলে মধু কাঁদে’, ফাংশন উনি প্রায়ই করেনইনি। গেয়েছেন বেসিক গান। রমাদেবীর আশ্চর্য বিক্রি ছিল হিন্দি হিট গানের বাংলা রূপান্তর। প্রায় সবকটি ছিল বিক্রিতে সুপারহিট। একসময় এইচ. এম. ভি.-র তিনি মহারানি ছিলেন। সেই বিখ্যাত গান, হিন্দি গান ‘চলে যানা নেহি নয়না মিলাকে’–বাংলা ভাষান্তর চলে যেও না গো’ গানটি আমরা আমাদের হাফ প্যান্ট পরা ছেলেবেলায় যত্রতত্র শুনতাম। ওই সব বেসিক হিট গানের রেকর্ড বিক্রির রয়াল্টিতে উনি সেই সময় কিনতে পেরেছিলেন দেওদার স্ট্রিটে একটি বাড়ি।

৪৯

ওই রমাদেবীর সময়েই এইচ. এম. ভি.-তে আরও একজন জনপ্রিয় গায়িকা ছিলেন কল্যাণী দাশ। শৈলজানন্দের অনেক ছবিতে উনি বিখ্যাত সব গান গেয়েছেন। একেবারে ভিন্ন ধরনের কণ্ঠস্বর ছিল ওঁর। আমাদের স্কুল জীবনে সুপারহিট ছিল শৈলজানন্দের ‘মানে না মানা’ ছবিটি। ওই ছবিতে মোহিনী চৌধুরীর লেখা শৈলেশ দত্তগুপ্তের সুর দেওয়া ‘মানে না মানে না মানে না মানা/চাঁদের আলোয় কোথা/এল রে জোয়ার/ও চাঁদ জানে না।’ গানটি গেয়েছিলেন কল্যাণী দাশ।

ছেলেবেলায় এই গানটি আমি প্রচুর শুনেছি। জগন্ময় মিত্রের সঙ্গে কল্যাণী দাশের দ্বৈতকণ্ঠে একটি সুপারহিট গান ছিল, ‘জয় হবে জয় হবে জয় হবে হবে জয়/মানবের তরে মাটির পৃথিবী দানবের তরে নয়।’ এই গানটিরও সুরকার শৈলেশ দত্তগুপ্ত। এবং গীতিকার মোহিনী চৌধুরী।

ছবির নাম দিয়ে গান লেখা সম্ভবত মোহিনীদাই প্রথম শুরু করেন। শৈলজানন্দের সঙ্গে সহকারী চিত্রপরিচালকের কাজ করতেন উনি। এবং গানও লিখতেন। ওঁদের সব ছবিতেই থাকত ছবির নাম দিয়ে একটি গান। ‘মানে না মানা’, ‘রং বেরং’, ‘অভিনয় নয়’, এ ধরনের সব ছবিতেই ছবির নাম দিয়ে একটা গান থাকত।

প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘আনারকলি’ ছবির গান, ‘এ জিন্দেগী উসি কি হ্যায়’ গানটির বাংলা ভার্সান গেয়েছিলেন। বাংলা রূপান্তর ও রচনা মোহিনী চৌধুরীর। বাংলায় কথা ছিল, ‘সে দিনগুলি ফিরিয়ে দাও’। খুবই হিট ছিল গানটি। আরও একটি এরকম ভাষান্তরিত গান ছিল যেমন ‘বড়ে আরমান সে রাখা/হ্যায় বালম তেরি কসম’।

বেচু দত্তের গাওয়া এবং প্রণব রায়ের লেখা এই গানটির কথা ছিল ‘হৃদয়ের নবীন আশা/দুই নয়নে নতুন স্বপন….’

কল্যাণী দাশেরও হিট গান ছিল ‘বরসাত’ ছবির ‘লাল দুপাট্টা মলমল’-এর বাংলা রূপান্তর ‘ও আমার অন্তর ঝলমল ঝলমল করে গো’।

ফাংশনের প্রসঙ্গে মনে আসছে, আমাদের অতি জনপ্রিয় গায়িকা কাননদেবীও কিন্তু কোনওদিন ফাংশনে গান করেননি। বিশেষ কারণে একটি বার ছাড়া আজকালকার চিত্রনায়িকাদের মতো যখন তখন ফাংশনে দাঁড়িয়ে গান না শেখা গলায় গান শোনাননি সুচিত্রা সেন।

.

হঠাৎ আমার হাতটা ধরে কে যেন টানল। অন্যমনস্ক ছিলাম, চমকে গেলাম। দেখি সুধীন দাশগুপ্ত। ওঁরই ডোভার কোর্টের বাড়ির মিউজিক রুমে আমাদের গান সৃষ্টির তখন একটু বিরতি ছিল। তখনই ঘটল এই ঘটনাটা।

সুধীনবাবুর সর্বসময়ের সঙ্গী ছিল একটি ছোট অ্যাটাচি। তাতে থাকত একটা ছোট কাঁচি। কিছু ওষুধ। দুটো কলম। ওঁর সাইনাসের জন্য ন্যাজাল ড্রপ ইত্যাদি। ওর মধ্যে যে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাসও থাকত তা জানতাম না। ওই অ্যাটাচিটা থেকে ওটি বার করে সুধীনবাবু ওঁর চিরাচরিত গম্ভীর কণ্ঠে আমায় বললেন, ডান হাতটা পাতুন। প্রাক্তন হকি খেলোয়াড় এখনকার সুরশিল্পী সুধীন দাশগুপ্ত রীতিমতো হস্তরেখাবিদের ভঙ্গিমায় আমার ডান হাতটা অনেকক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বললেন, আপনি একটা বড় হিরে পরুন। কী ফল হয় তা দেখবেন।

আমতা আমতা করে বললাম, এতেই রক্ষা নেই। দামি হিরে আঙুলে দেখলে তথাকথিত দুষ্কৃতিরা তো আমার আঙুলটিই কেটে নেবেন।

এবার হাসতে হাসতে সুধীনবাবু বললেন, আজকে হয়তো আপনার আঙুল কাটবে। কিন্তু কালকেই পেয়ে যাবেন পাঁচ লক্ষ টাকা। হাতজোড় করে বললাম, আমার আঙুলটা থাক। চাই না পাঁচ লক্ষ টাকা।

এই জ্যোতিষবিদ্যা শেখার বা চর্চা করার অভ্যাস একটা সময়ে গানের জগতের অনেকেরই ছিল। অনেকেই কিন্তু ঠিকঠাক বলেও দিতে পারতেন। অতীতটা সঠিক হলেই স্বাভাবিকভাবে বিশ্বাস এসে যেত ভবিষ্যৎবাণীটাও ঠিক হবে। এই প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে আসে কণ্ঠশিল্পী বিমলভূষণের কথা। ওঁর অভ্রান্ত উক্তি অনেকের জীবনে সঠিক মিলে গেছে। তারপরে মনে আসে গীতিকার শ্যামল গুপ্তের কথা। এই চর্চাতে উনিও মশগুল। ওঁরও অনেক উক্তি অনেকের জীবনে মিলে গেছে। এমনকী আমিও হাতে হাতে তার প্রমাণ পেয়েছি। বাংলা ছবিতে আগে যিনি ছিলেন নায়ক এখন হয়েছেন খলনায়ক, সেই দীপঙ্কর দে-ও কিন্তু দারুণ জ্যোতিষ জানেন। হাত দেখে কুষ্ঠির ছক দেখে চমৎকার বলে দিতে পারেন অনেক কিছু। আমাকে শুধু নয়, আমার স্ত্রীর ছক দেখে উনি বলেছেন। আমার গোটা পরিবারের অনেক কিছু মিলেও গেছে। আপনাদের কিছু জানবার থাকলে যোগাযোগ করুন না ওঁর সঙ্গে। ভয় নেই, ব্যক্তিগত জীবনে টিটো অর্থাৎ দীপঙ্কর মোটেই খলনায়ক নন। একান্ত ভদ্রলোক।

আরও একজন হস্তরেখাবিদ বিখ্যাত গায়িকার কথা পরে বলব। এখন বলেনি সুধীনবাবুর হিরে পরানোর কথাটি।

সেদিন বাড়িতে এসেই মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল। কে না চায় উন্নতি? দেখাই যাক না একটা বড় হিরে পরে কী সুফল হয়। কয়েকদিন সাবধানে চলাফেরা করে তারপর না হয় সেটা খুলে ফেললেই হবে।

পরদিন মাকে বললাম, মা, একটা বড় হিরের আংটি যদি থাকে দাও না। কয়েকদিন পরব।

হিরের আংটি পরার কারণটা শুনে আমার নাস্তিক মা বললেন, ওর জন্য দেব না। তবে তোমার যদি বড় হিরে পরার শখ হয় আমার আছে, আমি দেব। ফেলে রেখে আর কী হবে।

আংটিটা সুধীনবাবুর কথামতো এক মঙ্গলবার স্নান করে পরলাম। দেখা যাক কতটা মঙ্গল হয় আমার।

সুধীনবাবু প্রথম যৌবনে পাথরের দোকানে কাজ করতেন। কমলহিরে চিনতেন। আমার আংটিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বললেন, ভালই। পাথরটা আরও একটু বড় হলে কাটিংটা আরও ভাল হলে, আরও ভাল হত।

কয়েকদিন পরেই সুধীনবাবুর সুরে আমার লেখা গানে ‘হংসরাজ’ মুক্তিলাভ করল। সুপারহিট হল ছবি আর তার গান। সে সময় মুক্তিলাভ করল আমার কাহিনীতে এবং আমার গানে হেমন্তদা সুরারোপিত ‘রাগ অনুরাগ’ ছবি। এ ছবিও হিট করল। গানও হল সুপারহিট। এমনই বিস্ময়কর আরও অনেক সুঘটনা পর পর আমার জীবনে ঘটে যেতে লাগল। আংটিটাকে আমি যখন তখন প্রণাম করতে লাগলাম। এর কিছুদিন পরেই পরিচালক স্বদেশ সরকার আমাকে ওঁর নির্মীয়মাণ ‘নন্দিতা’ ছবির চিত্রনাট্য রচনা করতে এবং লোকেশন দেখাতে নিয়ে গেলেন উত্তরবঙ্গের একটি গ্রামে ওঁর পরিচিত একজনের বাড়িতে। রাতের ট্রেনে যাচ্ছিলাম। চারজনের বার্থের একটিতে আমরা। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

মাঝরাতে কে যেন আমার আঙুলটা ধরে টানল। ধড়মড় করে উঠে বসলাম। দেখি অপরিচিত এক ভদ্রলোক, কামরার নীল আলোয় আমার দিকে ভর্ৎসনা-ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।

আমাকে উঠে বসতে দেখে আমাকে রীতিমতো ধমক দিয়ে বললেন, এত দামি হিরে পরে কেউ ট্রেনে ওঠে? দেখে তো মনে হচ্ছে খুব চালাকচতুর। কিন্তু এমন বোকা মানুষ আমার জ্ঞানে আমি তো দেখিনি। খুন হয়ে যাবেন মশাই, খুন হয়ে যাবেন।

আমি বিনীত কণ্ঠে তৎক্ষণাৎ বলে ফেলেছিলাম, সুধীনবাবু বলেছেন আঙুল কেটে নিলেও পাঁচ লাখ টাকা পাব।

সেই ভদ্রলোক প্রচণ্ড রাগ আর বিরক্তির সঙ্গে বললেন, আমিও তো খুনি ডাকাত হতে পারতাম। আমারও তো পকেটে থাকতে পারত রিভলবার।

কথাটা বলেই ভদ্রলোক পকেটে হাত ঢোকালেন। আমি বিদ্যুৎগতিতে সরে বসলাম। ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা রুমাল বার করে মুখ মুছে নিয়ে আবার বললেন, খুন হয়ে গেলে না হয় পনেরো লাখ টাকা আপনার লাভ হবে। কিন্তু স্বর্গ থেকে নেমে এসে ওই টাকাটা কেমন করে নেবেন, তা কি বলেছেন আপনার ওই সুধীনবাবু?

আর উত্তর এল না আমার মুখে। ভদ্রলোক ধমকের সুরেই বললেন, আংটিটা খুলে সুটকেসে ভরে রাখুন। ওটা পরে আর জীবনে এভাবে রাত বিরেতে পথেঘাটে বার হবেন না।

বাড়ি এসে মাকে বললাম ঘটনাটা। মাও একই কথা বললেন। বললেন, ঠাকুরের পা ছুঁয়ে ওটা ব্যাঙ্কের লকারে তুলে রেখে দাও। ওখান থেকে তোমার হিরে তোমায় আশীর্বাদ করবে। সুফল পাবে।

পণ্ডিতিয়াতে থাকতেন এক গায়িকা। ওঁরও সুনাম ছিল হাত দেখার। গানের জগতে মহিলাদের মধ্যে উনি ছিলেন হাত দেখাতে সর্বোত্তমা। একদিন ও পাড়াতে যাচ্ছিলাম। দেখলাম উনি বাড়িতে। ব্যস, কোনও কথা না বাড়িয়ে মেলে দিলাম হাতটা। উনি বিব্রত হয়ে বললেন, আরে বোসো। চা খাও। তারপর ওসব হবে এখন।

আমি বললাম, সাবিত্রী ঘোষকে হাত দেখাবার ইচ্ছা আমার বহুদিন ছিল। আজ সামনাসামনি সুযোগ পেয়ে গেলাম। উনিও কিন্তু হাত দেখে অনেক কথাই বলেছেন যা আমার জীবনে আগে ঘটেছে এবং ওঁর বলার পর প্রায় অভ্রান্তভাবে ঘটেছে। এই সাবিত্রী ঘোষের ডাকনাম চামেলী। ওঁর গাওয়া গ্রামোফোন রেকর্ডের অনেক গানেও লেখা আছে শিল্পী সাবিত্রী ঘোষ (চামেলী)। লোকমুখে শুনেছি সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, ওঁর নাম দিয়ে প্রচুর গান বানিয়েছিলেন। হারানো দিনের সে সব বিখ্যাত গানের মধ্যে আমার মনে পড়ছে সম্ভবত সুপ্রভা সরকারের গাওয়া ‘চাঁদ ভোলে নাই চামেলীরে তার/ চামেলী ভোলেনি চাঁদে।’

আরও অনেক শিল্পীই সে সব গান গেয়েছেন, যেমন একটি গান ‘বনের চামেলী ফিরে আয়।’ আর একটি গান গীতা দাশের গাওয়া ‘ছিল চাঁদ মেঘের পারে’। এই গানের দ্বিতীয় অন্তরায় ছিল চামেলী কহিল তবে।’

শচীন দেববর্মণের ‘প্রেমের সমাধি তীরে তাজমহল’ গানটিতে ছিল এই চামেলী শব্দটি।

আগেকার ‘পরশমণি’ চিত্রে শৈলদেবীর গাওয়া শৈলেন রায়ের লেখা এবং হিমাংশু দত্তের সুরে একটি সুপারহিট গান ছিল ‘রাতের ময়ূর ছড়ালো যে পাখা/আকাশের নীল গায়/তুমি কোথায়।’এই গানের সুরে অনুপ্রাণিত হয়ে শচীন দেববর্মণ বানিয়েছিলেন ‘তুম না জানে/কিস যাহা মে খো গয়ে তুম কাহা, তুম কাহা…’। এর মূল বাংলা গানের অন্তরাতেও চামেলী শব্দটা ছিল। ‘তারার আঁখির কোলে/স্বপনে শিশির দোলে/চামেলী যে হায় চাঁদের পরশ চায়/তুমি কোথায়’। শুনেছি সে সময়ের প্রায় প্রত্যেক গীতিকারকেই হিমাংশু দত্তকে গান দিতে গেলে, গানে ওই ‘চামেলী’ শব্দের প্রয়োগ করে তবেই গান দিতে হত। তাই হিমাংশু দত্তের ‘চামেলী’ যুক্ত বহু গান একটু ভাবলেই মনে আসা সম্ভব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *