কথায় কথায় রাত হয়ে যায় – ৩৫

৩৫

কাজী সাহেবকে নিয়ে আরও একটু আলোচনা করা যাক। আগেই বলেছি কাজী সাহেবের স্বভাব ছিল মাঝে মধ্যে বেপাত্তা হয়ে যাওয়া। উনি বেপাত্তা হলে স্বভাবতই গ্রামাফোন কোম্পানির কাজকর্ম ব্যহত হত। একবার কাজী সাহেব ফিরে আসার পর হেম সোম অভিমানে বলেছিলেন, বেশ তো ছিলেন শান্তিনিকেতন। আবার অশান্তি ঘটাতে এখানে ফিরে এলেন কেন?

কাজী সাহেব বললেন, কী করব। মনটা হঠাৎ আকুলি বিকুলি করে উঠল বিজটুর জন্য (এইচ এম ভি-র বাড়ি বিষ্ণু ভবন। তাই উনি বলতেন বিজটু)। হেমবাবু বললেন, বিজটু অর্থাৎ দুটো মৌমাছির মৌ-এর জন্য আপনার মন কেমন করল তো? এবার আমরা যদি আপনাকে ‘বিষটু’ দিই অর্থাৎ পরিবেশন করি বিষের ঝোল, তা হলে অনুগ্রহ করে গ্রহণ করবেন তো? কাজী সাহেব আবার হো হো করে পরিচিত সেই দিলখোলা হাসিটি দিয়ে উত্তর দিলেন, ‘কদম বুশি আস সালাম/তাইতো ছুটে আসলাম/গরল পানে গর রাজি নয়/কাজী নজরুল ইসলাম।’

সত্যি ভাবলে রোমাঞ্চ লাগে। কী অপূর্ব ছিল এই বাংলা গানের জগৎ আর সেখানকার বাসিন্দারা। যাই হোক আবার ফিরে আসি নতুন এক কথায়। সেদিন হঠাৎ টেলিফোন পেলাম। ‘আমি বলছি। আমিও শেষটায় লেজ কাটলাম।’ আমি কিছুই বুঝলাম না কে কার লেজ কাটল। আমাকে নিরুত্তর দেখে ও প্রান্ত থেকে জবাব এল আমি বীরেশ্বর সরকার বলছি, উত্তম-অপর্ণাকে নিয়ে ‘সোনার খাঁচা’ নামে একটি ছবি করছি। খোকাবাবু (অগ্রদূত) পরিচালনা করবেন। আপনাকে গান লিখতে হবে। আসুন দ্বিজেন মুখার্জির শ্যামপুকুরের বাড়িতে।

নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে গেলাম। ঘনিষ্ঠ সুহৃদ দ্বিজেনবাবুর নীচের ঘরে বিখ্যাত বি. সরকার জহুরির দোকানের মালিক বীরেশ্বর সরকার আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। দ্বিজেনবাবু বসে ছিলেন। আমার আসার পরই দ্বিজেনবাবু বললেন, আমার একটু অন্য কাজ আছে, আমি ঘুরে আসছি। চা-টা সব সময়মতো আমার কাজের লোক দিয়ে যাবে।

দ্বিজেন মুখার্জি চলে গেলেন। বীরেশ্বরবাবু ওঁর স্বরচিত কাহিনীর চিত্রনাট্যটি শোনালেন টেপ রেকর্ডে। আমি শুনলাম। উনি বললেন, সুরগুলো আমি ‘ডামি বোল’ দিয়ে বানিয়ে রেখেছি। আপনি সুরের উপর মিটারে লিখে দিন। দেখলাম উনিও সুধীন দাশগুপ্তের মতো কট্টর মিটারবাদী। এতটুকুও কমপ্রোমাইজে রাজি নন। শোনালেন ডামি বোলে প্রথম গানটি। গানটি ছিল ‘এই হায়রে কলকাত্তা/দিল মেরা বেপাত্তা।’ ছবির সিচুয়েশন, নাটক সব মিলিয়ে যথারীতি আমি ওই সুরের মিটার বজায় রেখে লিখলাম গানটির মুখড়া ‘এই হায়রে কলকাত্তা/ দিল মেরা বেপাত্তা’–আমার কলমে হল ‘কে জানে ক ঘণ্টা/পাবে রে জীবনটা/যেটুকু চোখে পড়ে মনে ধরে নিয়ে যা/ যে মনে মন দিতে চাস দিয়ে যা।’ পুরো গানটি হয়ে যেতেই বীরেশ্বরবাবু বার কতক গাইলেন তারপর আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, মান্না দে কবে আসছেন? একটা ডেট নিতে হয়। এদিকে আমি তখন একটা অদ্ভুত অন্তর্জালায় দিন কাটাচ্ছিলাম। একদিন সন্ধ্যায় ‘বিকেলে ভোরের ফুল’ ছবির গান লিখছিলাম হেমন্তদার বাড়িতে। সে সময় ওখানে হেমন্তদার পরিচিতা একজন প্রশ্ন করলেন, হেমন্তদা এখন উত্তমকুমারের কোন ছবিতে আপনি গাইছেন? হেমন্তদা প্রশ্নটি ঘুরিয়ে দিলেন আমার দিকে। জিজ্ঞাসা করলেন, পুলক, উত্তমের লিপে কোন ছবিতে আমি গাইছি? তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলাম, এই তো ‘বিকেলে ভোরের ফুল’ ছবিতে। মহিলা বললেন, সে তো রবীন্দ্রসংগীত। আধুনিক কোন গান রিসেন্ট কোন ছবিতে গাইছেন হেমন্তদা? আমি বা হেমন্তদা কেউই এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেলাম না। তখন উত্তমের সব ছবিতেই গাইতেন মান্না দে।

আগেই বলেছি শঙ্খবেলা’ ছবিতে উত্তমের লিপে মান্না দেকে আনার ব্যাপারে আমার সক্রিয় ভূমিকার কথা। কিন্তু এর ফল যে এমন হবে তা ভাবিনি। ভাবিনি, যেখানে উত্তম মানে ছিলেন হেমন্তদা সেখানে এইভাবে সর্বত্র মান্না দের অনুপ্রবেশ ঘটবে। যে নচিকেতা ঘোষ কোনও দিনই মান্না দের গান সহ্য করতে পারতেন না, বলতেন, ওঁর কথা বোলো না। ওঁর গান শুনলেই আমার যাত্রা দলের বিবেকের গানের কথা মনে পড়ে যায়। সেই অন্ধ হেমন্ত-ভক্ত নচিকেতা ঘোষও হঠাৎ শঙ্খবেলা’, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’র পর মত বদল করে সব ছবিতেই উত্তমের লিপের জন্য বেছে নিলেন মান্না দেকে। সুধীন দাশগুপ্তের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। কমল দাশগুপ্তের অর্কেস্টায় যিনি প্রখ্যাত সেতারবাদক ছিলেন সেই হেমন্ত অনুরাগী পবিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সুরে পিনাকী মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘আলো আমার আলো’ ছবিতে উত্তমের লিপের জন্য যেই লিখলাম ‘এই এত আলো/এত আকাশ আগে দেখিনি।’ অমনি পবিত্রদা আমায় বললেন, কী পুলক। মান্নাবাবু গাইলে দারুণ জমবে মনে হচ্ছে না? তোমার কী মত? সুতরাং গানটি গাইলেন মান্না দে এবং দারুণ জমল!

‘সন্ন্যাসী রাজা’ ছবিতে উত্তমের একটি গান বাধ্য হয়ে নচিকেতা ঘোষ হেমন্তদাকে দিয়ে গাওয়ালেও পরের পর বহু ছবিতে গাওয়াতে লাগলেন মান্নাদাকে। ফলে বিকেলে ভোরের ফুল’ ছবিতে শুধু রবীন্দ্রসংগীত নিয়েই সেই সময় সন্তুষ্ট থাকতে হল হেমন্তদাকে। হেমন্তদার বাড়িতে ওই মহিলার প্রশ্ন আমায় যেন তাড়া করতে লাগল। এটা হেমন্তদার ভাগ্য নয়। মনে হতে লাগল আমারই অনধিকার হস্তক্ষেপ। আমি যেন এর জন্য মূলত দায়ী। যে করেই হোক এই দোষ থেকে মুক্তি লাভের সুযোগ খুঁজছিলাম আমি। আমাকে নিরুত্তর দেখে বীরেশ্বরবাবু বললেন, কী ভাবছেন পুলকবাবু?

আমার চমক ভাঙল। বীরেশ্বরবাবু আবার বললেন, কিন্তু একটা রিসক মনে হচ্ছে। এই তো আর ডি বর্মণ কিশোরকুমারকে দিয়ে ‘রাজকুমারী’ ছবিতে উত্তমের লিপে সবকটি গানই গাওয়ালেন। কিন্তু একটা গানও চলল না। শ্রোতারা বললেন হেমন্তদা গাইলে চলত। কিশোরদার গলা উত্তমের লিপে একদম মানায়নি। আজ অকপটে স্বীকার করছি। তৎক্ষণাৎ লুফে নিলাম এই সুযোগটা। বললাম, দরকার নেই রিসক নিয়ে। হেমন্তদাই গান করুন। ‘কে জানে ক ঘণ্টা’ দারুণ গাইবেন হেমন্তদা। বীরেশ্বরবাবুকে আর ভাববার সময় না দিয়ে ওখান থেকেই ফোন করলাম হেমন্তদাকে। বললাম, হেমন্তদা, বীরেশ্বরবাবু দারুণ সুর করেছেন উত্তমের লিপের জন্য আপনার গান। কবে উনি তোলাতে যাবেন? জবাবে হেমন্তদা বললেন, ওঁকে আসতে হবে না, আমি গান তুলতে যাব।

হেমন্তদার এই অভাবিত প্রস্তাবে বীরেশ্বরবাবু খুশি হয়ে বললেন, তা হলে গাড়ি পাঠিয়েদি? গান তুলে খেয়েদেয়ে যাবেন আমার বাড়ি থেকে। সেদিন রাতে যতটা নিশ্চিন্তে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, জীবনে এমন সুনিদ্রা আর কোনও দিনও আমার হয়নি।

‘সোনার খাঁচার পর মান্নাদার উত্তমকণ্ঠে গানের মনোপলি ভেঙে হেমন্তদা আবার এসে দাঁড়ালেন। উত্তমের লিপে চলতে থাকল মান্নাদা এবং হেমন্তদা দুজনের গান। ‘অমানুষ’ ছবিতে শ্যামল মিত্র আবার নিয়ে এলেন কিশোরকুমারকে। শ্যামল মিত্র নিজের মৃত্যুবাণটিকে নিজেই কিন্তু এরই মাধ্যমে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে এলেন। নিজে উত্তমের লিপে একটিও গান না গেয়ে কণ্ঠশিল্পী এবং সুরশিল্পী শ্যামল ‘অমানুষ’, ‘আনন্দ আশ্রম’, ‘বন্দি’, ‘নিশান’ প্রভৃতি সব ছবিতেই উত্তমের গানগুলো দিয়ে দিলেন কিশোরকুমারকে। হেমন্তদা হলে একাজটি কখনওই করতেন না। হেমন্তদা খুবই প্র্যাকটিক্যাল ছিলেন। দারুণ দূরদৃষ্টি ছিল ওঁর। তাই ওঁর সুরে ‘লুকোচুরি’ এবং কিশোরকুমার অভিনীত শ্যাম চক্রবর্তী পরিচালিত ‘দুষ্টু প্রজাপতি’ ছবিতে এবং এমন আরও অনেক ছবিতেই কিশোরকুমার গান গাইলেও দুই-একটি দারুণ সিচুয়েশানে হেমন্তদা নিজেও গেয়েছেন। পুরোপুরি শ্যামল মিত্রের মতো কিশোরদার হাতে সমস্ত অস্ত্র তুলে দিয়ে উনি গায়ক হেমন্তকুমারকে হারিয়ে যেতে দেননি কোনও দিনই। শ্যামল হয়তো সেই সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শুধু সুরকার হিসাবেই উনি বাকি জীবনটা কাটাবেন। কিন্তু তা হল না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ওঁর মুম্বই-এর সুরকার জীবনটাতে তো ছেদ হলই সেই সঙ্গে হয়ে গেল কণ্ঠশিল্পী জীবনেরও প্রায় পরিসমাপ্তি। মুম্বই-এর ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়ে কলকাতায় ফিরে এলেন শ্যামল। এসে একরকম আত্মসমর্পণ করে আমায় বললেন, পুলক আমার জন্য প্লে-ব্যাক আর মিউজিক ডিরেকশনের কাজ দেখ। আমি আবার কলকাতায় কাজ করতে চাই।

অনেক পরিচালক প্রযোজককে বলতেই অনেকেই হাসিমুখে শ্যামলকে সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব দিতে রাজি হলেন। কিন্তু প্লে-ব্যাক শিল্পীর ভূমিকা দিতে রাজি হলেন না। কোনও কোনও প্রযোজক পরিচালক আমার মুখের উপর বলে দিয়েছিলেন মিউজিক ডিরেক্টর শ্যামল মিত্র নিজের ছবির বেলায় গাওয়াবেন কিশোরকুমারকে আর আমরা কেন গাওয়াব শ্যামল মিত্রকে? আমরাও নেব কিশোরকুমারকে।

নিজের ভুলেই এই অবলুপ্তির পথে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন শ্যামল মিত্র। জীবনে নেমে এল প্রচণ্ড হতাশা। অপূর্ব গায়ক শ্যামল মিত্র ক্রমশ দূরে হারিয়ে যেতে লাগলেন। সেই সময় ইন্দর সেনের পরিচালনায় আমার কাহিনী নিয়ে ‘বন্দি বলাকা’ ছবিতে পরিবেশক প্রণব বসুকে আমিই রাজি করিয়েছিলাম শ্যামল মিত্রকে সুরশিল্পী হিসেবে নিতে। ওঁরা নিয়েছিলেন। কিন্তু মোটেও চাননি শ্যামল গান করুন। ওঁরা চেয়েছিলেন কিশোরকুমারকে। এরপর আমিই রাজি করিয়েছিলাম পরিমল ভট্টাচার্যকে ‘মায়ের আশীর্বাদ’ ছবিতে সুরকার হিসাবে নিতে। গান রেকর্ডিং হয়েছিল মুম্বইতে। নারী-কণ্ঠে গান গেয়েছিলেন আশাজি। ছেলেদের গান গাইবার কথা ছিল কিশোরদার। যাতে শ্যামল প্লে-ব্যাক করেন তাই আমি সবাইকে মিথ্যা বলেছিলাম কিশোরদা মুম্বইতে নেই, আছেন বাঙ্গালোরে। কিন্তু শ্যামলের গাওয়া গান চলেনি। চলেছিল আশাজির গান।

যাই হোক বীরেশ্বর সরকারের বাকি গানগুলো লিখেছিলাম দমদম এয়ারপোর্টের কাছে ওঁর সুন্দর বাগান বাড়িতে। ওই পরিবেশে গান আপনি এসে যায়। তাই লিখতে পেরেছিলাম ‘শুধু ভালবাসা দিয়ে বলে যাই/আমি তোমারে বেসেছি ভাল।’ হেমন্তদার কণ্ঠে এ গানটিও খুবই জনপ্রিয় হল।

উত্তমের ঠোঁটে হেমন্তদার ‘কে জানে ক ঘণ্টা’ও সুপারহিট হয়ে গেল। অপর্ণার ঠোঁটে ছিল লতা মঙ্গেশকরের গান। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য ‘যা যা ভুলে যা/এ হৃদয়ের যত ব্যথা।’ এরপর বীরেশ্বরবাবুর ‘মাদার’ ছবির জন্য গান লিখেছিলাম। ‘সোনার খাঁচা’র গান সুপারহিট হওয়ায় স্বভাবতই বহু প্রযোজক ওঁকে তাঁদের ছবির সংগীত পরিচালনায় দায়িত্ব দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বীরেশ্বরবাবু প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। নিজের ছবি ছাড়া কারও ছবি উনি করবেন না। সংগীত পরিচালনাটা ছিল ওঁর নেশা, পেশা নয়। তখনই এইচ. এম. ভি.-র বহু শিল্পী ওঁকে পুজোর গানের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। সবাইকে একই উত্তর দিয়েছিলেন উনি। নাছোড় তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে হাজির হয়েছিল ওঁর কাছে। তখন উনি হাসিমুখে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। নিজের ছবি বা নিজস্ব গান ছাড়া অন্য কোনও গানে উনি সুর করবেন না এই ছিল ওঁর প্রতিজ্ঞা।

৩৬

এবার আসি ‘মাদার’ ছবির সুর করার প্রসঙ্গে। সুর করতে বসে বীরেশ্বরবাবু বললেন, এবার কিন্তু আমার কিশোরদাকে চাই। তখন লক্ষ করেছিলাম বহু সাধারণ গানই কিশোরদার গাওয়ার গুণে অসাধারণ হয়ে যাচ্ছে। শ্রোতাদের প্রথম পছন্দ কিশোরকুমার। আমিও তাই সেই প্রস্তাব সম্পূর্ণ সমর্থন করে কিশোরদাকে ভেবেই কলম ধরলাম। অসাধারণ সুর করেছিলেন বীরেশ্বরবাবু। আমার লেখা কিশোরদার প্রথম সুপারহিট গানটি ছিল ‘আমার নাম অ্যান্টনী/কাজের কিছুই শিখিনি’। বিদেশি ‘ওভার দ্য ওয়েভস’-এর সুরের ওপর কিশোরদা আশার জন্য লিখলাম ‘এক যে ছিল রাজপুত্তুর’। লতাজির জন্য লিখলাম ‘হাজার তারার আলোয় ভরা/চোখের তারা তুই’। গানগুলো আজও নতুন লাগে।

‘মাদার’ ছবিতেই একটা গান কিশোরদার কণ্ঠে ছিল। গানটার শুরুতে কোনও বাজনা ছিল না, ছিল শুধু ‘আ-হা কী দারুণ দেখতে।’ ‘মাদার’ ছবিতে আমার লেখা মীনা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘আমার তুমি আছো’ গানটিও হিট।

‘মাদার’ ছবির পর বীরেশ্বরবাবু করলেন ‘রাজনর্তকী’। লিখলাম সে ছবির গান। এ ছবিতে সুধা চন্দ্রন রাজনর্তকীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ছবিতে একটি ভাল গান গেয়েছিলেন মীনা মুখোপাধ্যায়। ‘এসেছে তোমারই রাধা/মঞ্জুল মধু বনে’। লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে ছিল ‘সেই যদি স্বপনে এলে/এসো নয়নে’। আশা ভোঁসলের কণ্ঠে ‘বাঁশরী বাজ না’। এই গানগুলো আমার নিজেরও প্রিয় রচনা।

মনের দিক থেকে বীরেশ্বরবাবু খুবই বড় মাপের মানুষ ছিলেন। সেদিন যখন আমরা গান নিয়ে বসেছিলাম তখন ওখানে আমাকে খুঁজতে হাজির হয়েছিলেন আর এক বিখ্যাত সুরকার রতু মুখোপাধ্যায়। বীরেশ্বরবাবু ওঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। নির্দ্বিধায় শুনিয়েছিলেন আমাদের তৈরি কিন্তু তখনও রেকর্ড না হওয়া নতুন গান। খুব কম সুরশিল্পীই এরকম কাজ করেন। এটা সম্ভব হয়েছিল এ জন্যই যে দুজন সুরকারই ছিলেন নেশায় কাজ করা সুরকার। একজন বি সরকার জহুরির মালিক বীরেশ্বর সরকার আর একজন তখনকার ইনচেক টায়ারস এবং আজকের টাইগার সিনেমা লেসলি হাউসের অংশীদার রতু মুখোপাধ্যায়। আমি যতদূর জানি বীরেশ্বরবাবু নিজের তিনটি ছবি ‘সোনার খাঁচা’, ‘মাদার’, ‘রাজনর্তকী’ এবং মীনা মুখোপাধ্যায়ের আধুনিক গান ছাড়া অন্য কারও আধুনিক গান করেননি। তেমনি রতু মুখোপাধ্যায়ও জীবনে কোনও ছায়াছবি করেননি। বা অজ্ঞাত কোনও কারণে তেমন কোনও প্রযোজক পরিচালক পাননি যিনি ওঁকে ছবির গানের সুর করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তবে উনি বেশ কিছু অসাধারণ আধুনিক গান তৈরি করেছেন। যে সব গানের শতকরা পঁচানব্বইটি আমার লেখা। আজকের এই হই হট্টগোল গানের বিরুদ্ধে নির্বাক প্রতিবাদ জানিয়ে উনি আজ সুখের অবসর নিয়েছেন। কিন্তু আধুনিক বাংলা গানকে দিয়ে গেছেন অনেক সম্পদ।

কুন্দনলাল সায়গলের অগ্রজ আর এক সায়গল সাহেব কলকাতায় তখন ‘কোহিনুর রেকর্ড কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন। সায়গল সাহেব আমাকে ওঁর বাংলা গানের নিয়মিত লেখক হিসাবে নিয়ে যান। আমি নিয়ে যাই রতু মুখোপাধ্যায়কে। রত্ন কোহিনুরে তখনকার নামী গায়ক অনন্তদেব মুখোপাধ্যায়ের গানের ট্রেনিং করেন। গান দুটি লিখেছিলাম ১। ‘যেখানে নীল আকাশে’, ২। কার রিনিঝিনি কাঁকনের ঝঙ্কার’।

এরপর রতুকে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য ওঁর পুজোর গান করার জন্য এইচ এম ভি-তে আহ্বান জানান। রতু মুখোপাধ্যায়ের সুর করা আমার গান দুটি ছিল ১। চামেলি মেল না আঁখি, ২। তোমার ভাল লাগাতে।

এবার রতু শ্যামল মিত্রের গান করেন। ১। ‘মন মেতেছে নীল আকাশে রাজহংসীর ঝাঁকে’, ২। ‘সূর্যমুখী সূর্য খোঁজে সুর যে খোঁজে বীণা’। এ রেকর্ডটি বেশ জনপ্রিয় হয়। এরপর মান্না দে-কে আমি অনুরোধ করি রতুর ট্রেনিং-এ গান করতে। মান্নাদার জন্য সেবার লিখেছিলাম ১। ‘হৃদয়ের গান শিখে তো গায় গো সবাই’, ২। ‘দেখি ওই হাসির ঝিলিক/ঝরে চোখের প্রান্তে’। সুপারহিট হয় রেকর্ডটি।

খুব সম্ভব তারপরেই হেমন্তদা ওঁর প্রিয় বন্ধু শান্তি মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে রতুর সুরে গান করতে রাজি হন। হেমন্তদার জন্য দুটো গান আমরা বানিয়ে নিয়ে যথাসময়ে গেলাম ভবানীপুরে শান্তি মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে। হেমন্তদার প্রথম গানটি ‘বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা’। হেমন্তদা শুনেই বললেন চমৎকার। উল্টো পিঠটা শোনাও। উল্টো পিঠের গান কিন্তু অম্লানবদনে রিজেক্ট করলেন হেমন্তদা। রতু তখন ওঁর স্টক থেকে আমার লেখা অনেকগুলো গান হেমন্তদাকে শোনালেন। কোনওটাই পছন্দ হল না ওঁর। শেষটায় হেমন্তদা সোজাসুজিই আমায় বললেন, পুলক, তুমি বন্ধুকে ভাল গান দাওনি।

শুনে মর্মাহত হলেন রতু। ভাগ্যক্রমে সেদিন একটি ছোট গানের খাতা সঙ্গে ছিল। ওখানে ছিল রতুর সুর করা আমার একটি গান। শেষ চেষ্টা হিসাবে রতুর সেই গানটি হেমন্তদাকে দেখালাম। উনি পড়েই বললেন, এটা তো আবৃত্তি করলেই হিট হয়ে যাবে। গাওয়ার দরকার নেই। তারপরে হেসে আমায় বললেন, সবাই ঠিকই বলে দেখছি। তোমাকে খোঁচা না দিলে জিনিস বার হয় না। রতুবাবু শোনান সুরটা। দেখলাম জ্বলজ্বল করে উঠল রতুর বিমর্ষ মুখটা। ও সানন্দে গেয়ে শোনাল আমার লেখা গানটি। ‘কী দেখি পাই না ভেবে গো/ওই মেঘের কালো বরণ/নাকি তোমার দুটি কাজল কালো নয়ন’?

কিন্তু গোলমাল বাঁধল এইচ. এম. ভি.-তে গানটি রেকর্ড করতে গিয়ে। তখন এইচ. এম. ভি. ‘রেকর্ড সঙ্গীত’ নাম দিয়ে স্বরলিপি সমেত কিছু গান নিয়ে নিয়মিত একটা পত্রিকা প্রকাশ করত। এঁরা একটি গানের সম্পূর্ণ রাইট পেলেই তবে সেটা রেকর্ড করবে এই সিদ্ধান্ত নিল। কারণ ‘সম্পূর্ণ রাইট’ পেলে স্বাভাবিকভাবেই এসে যাবে পাবলিশিং রাইটও। গীতিকারকে আলাদা পয়সা দিয়ে বা অনুরোধ করে সে রাইট নিতে হবে না। আমি এবং আমরা যাঁরা রেডিয়োতে ‘ব্রডকাস্টিং রাইট’ দিয়ে চুক্তিবদ্ধ ছিলাম তাঁরা স্বভাবতই সম্পূর্ণ রাইট দিতে পারলাম না। এইচ. এম. ভি. তখন আমি, গৌরীপ্রসন্ন, শ্যামল গুপ্ত এবং প্রণব রায়ের মতো বেতারে চুক্তিবদ্ধ গীতিকার ছাড়া যাঁরা তখনও বেতারের অনুমোদন পাননি শুধু তাঁদেরই গান রেকর্ড করতে লাগলেন। কিন্তু কিছুদিন বাদেই যখন দেখলেন আমাদের গান ছাড়া তেমন সুফল ওঁরা পাচ্ছেন না তখন এই সিদ্ধান্ত ওঁরাই তুলে নিলেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই ‘রেকর্ড সঙ্গীত’ পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেল। আমরা আবার সসম্মানে ফিরে এলাম এইচ. এম. ভি.-তে।

যাই হোক, ওই গণ্ডগোলের মুখে প্রথম পড়ল আমার ওই দুটি গান। যা হেমন্তদার রেকর্ড করার কথা। কিন্তু এইচ. এম. ভি. আন্দাজ করেছিল এ রেকর্ডটি সুপারহিট হবেই। তাই ওঁরা আমায় আলাদাভাবে অনুরোধ করল আমার ছদ্মনামে এ গানটি প্রকাশের অনুমতি দিতে। বন্ধু রতু মুখোপাধ্যায়ের বিমর্ষ মুখটার কথা মনে করে, নিজের নামটি বিসর্জন দিয়ে, আমি এইচ. এম. ভি-র এই প্রস্তাবটি মেনে নিলাম। আমার নাম আর পদবির ইংরেজি দুটি আদ্যাক্ষর দিয়ে ছদ্মনাম বানালাম পি বি। পি বি থেকে নাম করলাম প্রিয়ব্রত। হেমন্তদার ওই সুপারহিট রেকর্ডটির গীতিকার হিসাবে আমার নামের জায়গায় ঝলমল করতে লাগল ‘প্রিয়ব্রত’। তখনকার রেকর্ডটির প্রিয়ব্রত নামেতে যদি আমার বন্ধুত্বের বুক ভরা ভালবাসা আমি দেখে থাকি সেটা কি আমার অন্যায় অপরাধ? অবশ্য গান দুটি শুনে আমার বহু অনুরাগী শ্রোতারা আমায় ধন্যবাদ জানালেন। আমি বুঝলাম আমি ধরা পড়ে গেছি। ওঁরা বুঝে নিয়েছেন গানের এই বিশেষ ভঙ্গিমা আমার ছাড়া আর কারও নয়। এই নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বহু লেখালেখিও হয়েছিল। অচিরেই খুলে পড়ে গিয়েছিল আমার ছদ্মনামের মুখোশ।

এর আগে ও পরে আমার স্বনামে রতুর সুর করা উল্লেখযোগ্য গান হল সুমন কল্যাণপুরের ‘মনে কর আমি নেই’, ‘দুরাশার বালুচরে’, ‘তোমার আকাশ থেকে’, ‘বাদলের মাদল বাজে’। মুকেশের গলায় ‘দেহেরি পিঞ্জিরায়’, ‘ওগো আবার নতুন করে’।

রতুর সুরে আমার লেখা আরও অনেক গান সুপারহিট হয়। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মান্না দের ‘আবার হবে তো দেখা’, ‘রিম ঝিম বৃষ্টি’, ‘রাত জাগা দুটি চোখ’, ‘অভিমানে চলে যেও না’, ‘তুমি আঁধার দেখ’, ‘পার যদি এস ফিরে’ এবং শ্যামল মিত্রের গলায় ‘চোখের আর এক নাম’, ‘তোমাকে দূরের আকাশ’, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মন যে খুশি খুশি আজ’ মাধুরী চট্টোপাধ্যায়ের ‘চোখে চোখ রেখে বলতে গেলাম’, ‘মনে কর মনে মনে’, ‘আকাশে নেই তারার দীপ’ (নির্মলা মিশ্রের)। আমি আবারও বলছি এত অজস্র সুপারহিট গান বানানোর পরেও একটা ছবির সংগীত পরিচালনার সুযোগ রতু পেলেন না। এর কারণ কাকে জিজ্ঞাসা করব? বাংলা গানের শ্রোতাদের? বাংলা ছবির পরিবেশক, প্রযোজক, পরিচালকদের? নাকি রতু আর আমার ভাগ্যকে? জানি না এই জিজ্ঞাসার জবাব কোনও দিন কোথাও পাওয়া যাবে কি না? তবু রেখে গেলাম এ প্রশ্ন।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ইচ্ছা করলেই দারুণ গান লিখতে পারতেন। প্রচুর গানের মুখড়া জুগিয়ে গেছেন উনি নিয়মিত আমাদের। ওঁর সঙ্গে যে গীতিকারই যখন কাজ করেছেন এ কথাটা তাঁরা নিশ্চয় মানবেন। কিন্তু হেমন্তদা কেন একটা গানও রচনা করছেন না আমি বার বার তাঁর কাছে এ প্রশ্ন করেছি। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ‘দেশ’ পত্রিকার ছোট গল্পের লেখক হেমন্তদা এর উত্তরে আমাকে প্রতিবারই বলেছেন, সুরকার ও গায়ক আমি দুটোই ঘটনাচক্রে হয়ে গেছি। কিন্তু গীতিকার আর হতে চাই না। তা হলে আমি একটা গণ্ডিতে আটকে যাব। কিছুতেই নতুন দিকের সন্ধান পাব না। এবং তাতে আমার কোনও দিকটাই পূর্ণতা পাবে না।

আগেই বলেছি সুধীন দাশগুপ্ত আর আমার একাত্মতার কথা। বেশ কিছু ভাল গানও সুধীনবাবু রচনা করেছেন। কিন্তু ভরাডুবিও করে ফেলেছেন বেশ কিছু গানে। একদিন বন্ধুবরকে হাসতে-হাসতে বলেছিলাম, আশা ভোঁসলের জন্য ‘নাচ ময়ূরী নাচ রে’ তো লিখে ফেললেন। কিন্তু একটুও ভেবে দেখলেন কি ময়ূরী নাচে না, নাচে ময়ূর। উনি উত্তর করেছিলেন আপনার মতো শুধু গীতিকার ছাড়া আর কারও চোখে সে ভুল ধরা পড়বে না। আপনি তো এইচ. এম. ভি.-র প্রায়-কর্ণধার পবিত্র মিত্রের লেখা উৎপলা সেনের ‘দোলা দিয়ে যায়’ গানের শেষ পঙক্তিতে ‘পলাশ কুমকুম গন্ধে বনছায়’ সমালোচনা করে নিজের চরম ক্ষতি করতে বসেছিলেন। আপনার ওপর চটে গিয়েছিলেন এইচ. এম. ভি.। এবার উত্তর দেওয়ার মওকা ছিল আমার। মনে আছে, বলেছিলাম, ছোটবেলায় পড়েছি, ‘দেখ না পলাশ ফুল/রূপে নাহি সমতুল/গন্ধ নাহি বলে কেউ/করে না আদর’—এটা কি মিথ্যে হয়ে যাবে নাকি?

আধুনিক গীতিকার যদি পলাশ কুমকুম গন্ধে বন ভরাতে পারেন এটা তাঁর একার কৃতিত্ব। সমগ্র গীতিকারদের চিন্তাভাবনার সত্যিকারের প্রতিচ্ছবি নয়।

৩৭

দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ও গায়ক এবং সুরকার। গীতিকার হতে চাননি হেমন্তদার মতো। দ্বিজেনবাবু আমার গান প্রথম রেকর্ড করেন ‘মহিষাসুর বধ’ ছবিতে দক্ষিণামোহন ঠাকুরের সুরে।

সেই থেকে আলাপ, সেই থেকে ঘনিষ্ঠতা। একাধারে সংগীত এবং ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ গানের জগতে খুব বেশি নেই। আবার তাঁর মতো হঠাৎ রেগে যাওয়া মানুষও গানের জগতে প্রায় বিরল। বহুদিন আগে যখন ক্রুশ্চেভ বুলগানিন কলকাতায় এসেছিলেন তখন তাঁদের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তখনকার সেই তরতাজা তরুণ দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় তৎকালীন প্রচার ও জনসংযোগের অধিকর্তা মাথুর সাহেবের এক অশোভন উক্তিতে তেড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মাথুর সাহেবের ওপর। এর জন্য পরে স্বয়ং বিধান রায় দ্বিজেনকে ডেকে পাঠান জবাবদিহি করার জন্য। দ্বিজেনের মুখ থেকে সব শুনে ডা. রায় যখন বুঝলেন দোষটা মাথুর সাহেবের তখন নাকি দ্বিজেনকে অম্লানবদনে বলেছিলেন, ওহে, তুমি তো বাঙালি। তা ওইটুকুতেই দোষীকে ছেড়ে দিলে কেন? যদিও আইন নিজের হাতে নিতে নেই।

যতদূর জানি দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের প্রথম গান মেগাফোন রেকর্ডে আধুনিক গান। বন্ধু নচিকেতা ঘোষের সুরে। সে গান চলেও ছিল ভাল। তারপর সুরকার গায়ক নচিকেতা ঘোষ এইচ. এম. ভি.-তে যোগদান করলেন। টেনে নিয়ে এলেন দ্বিজেনবাবুকেও এইচ. এম. ভি-তে। সেই সময় দ্বিজেনবাবুর ‘আমি কবি এই বিশ্ব জনে’র সমাদৃত হয়েছিল। তারপরেই গাইলেন সলিল চৌধুরীর সুরে শ্যামল বরণী তুমি কন্যা’ এবং ‘ক্লান্তি নামেগো রাত্রি নামেগো’। এই দুটি গানেই রাতারাতি সংগীত রসিকদের মন জয় করে নিলেন দ্বিজেনবাবু। এরপর গাইলেন সলিলদারই সুরে হেমন্তদার বিখ্যাত গান ‘কোনও এক গাঁয়ের বঁধুর কথা তোমায় শোনায় শোন’র একটি প্রতিবাদ সংগীত। সম্পূর্ণ নতুন বিষয়বস্তুর গানটি ছিল ‘কে বলে গো গাঁয়ের বঁধুর জীবনের সুখের নীড়ে বসন্ত সেই দোল আনে না আর’। গানটি রচনা করেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। সুর দিয়েছিলেন অনুপম ঘটক। এ গানটি নিয়ে তখন কলকাতার বিদগ্ধ মহলে বেশ একটা চাপান-উতোরের ঝড় উঠেছিল।

তখন দ্বিজেনবাবুকে প্রায় বলতাম, কবে বিয়ের নিমন্ত্রণ খাচ্ছি? হেসে এড়িয়ে যেতেন দ্বিজেনবাবু। একদিন একটি মেয়ের ফটো দেখালেন আমায়। বললেন, অনেক সম্বন্ধই আসছে। এই মেয়েটির নাম সবিতা। দেখতে কেমন? বললাম, ভালই তো।

যথাসময়ে সবিতা দেবীর সঙ্গে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ লিপি পেলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার তখন মুম্বই যেতে হল। দ্বিজেনবাবুর বিয়ের বউভাতে হাজির হতে পারলাম না। তার কিছুদিন পরেই গেলাম দিল্লিতে। দিল্লিতে কুতুবমিনার দেখতে গিয়ে দেখতে পেলাম দ্বিজেনবাবুর দেখানো ফটোগ্রাফের সেই মেয়েটিকে। তখন ওঁর কপালে সিঁদুর। কিন্তু দেখলাম দ্বিজেনবাবুর সঙ্গে নেই। রয়েছেন অন্য মানুষ। ঘনিষ্ঠতা দেখেই বুঝলাম উনি সবিতারই স্বামী। দারুণ খটকা লাগল আমার। তবু কী যেন একটা অসাধারণ লেখার বিষয় পেলাম আমি। লিখে ফেললাম ‘আবার দু’জনে দেখা/যমুনার ওই কিনারে। না না বৃন্দাবনে নয়/নয় ওই ব্রজপুরে/তার চেয়ে কিছু দূরে, কুতুবের মিনারে।

কলকাতায় এসেই গানটি দিলাম নচিকেতা ঘোষকে। তৎক্ষণাৎ লুফে নিয়ে দারুণ সুর করে ফেললেন তিনি। কিন্তু গানটি লেখার কারণ জানতেই নচিবাবু তাঁর সেই বিখ্যাত হাসিটি হেসে বললেন, ও তুমি তো বিয়েতে ছিলে না। তাই জান না। ওই সবিতার সঙ্গে দ্বিজেনের বিয়ে হয়নি। বিয়ে হয়েছে অন্য সবিতার সঙ্গে। তাই চিঠিতে দেখেছ সবিতারই নাম।

আমি চমকে উঠে বললাম, আরে বাস! এ যে রীতিমতো কমেডি অফ এররস।

সেবারে পুজোর গান হিসাবে নচিবাবু এ গানটি শিখতে ডাকলেন দ্বিজেনকে দ্বিজেনকে ব্যাপারটা খুলে বলে আবার হো হো করে হেসে নিয়ে গানটা তোলাতে চাইলেন নচিবাবু। দ্বিজেন বললেন, নচি এ গান আমি কিছুতেই গাইব না। এ তোর আর পুলকের বদমাইশি। অন্য গান দে।

আমি রগচটা দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে এড়িয়ে বাড়ি পালিয়ে এলাম। পরের দিন নচিবাবুর ফোন পেলাম। ফোনে বললেন, দ্বিজেন কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। শেষটায় ওর গিন্নি সবিতাকে, সব খুলে বলতে সবিতাই ওকে রাজি করিয়েছে। সবিতা কিন্তু তোমার বিষয়বস্তুকে এবং তোমার লেখাকে খুবই প্রশংসা করেছে। তুমি ওকে ফোন করো।

পরবর্তীকালে দ্বিজেনবাবুর শান্তিনিকেতনের বাড়িতে আমি সস্ত্রীক বেড়াতে গিয়েছিলাম। সবিতাদেবীর সে আন্তরিক আতিথ্য জীবনেও ভুলব না।

আজ উনি নেই। দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে ওঁকে অসময়ে পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন পরিবেশে, বিভিন্ন সময়ে ওঁর সুন্দর ব্যবহারের স্মৃতির আঁচড় রয়ে গেছে আমার মনের খাতার পাতায় পাতায়। আমার অনেক গানই দ্বিজেনবাবু গেয়েছেন। তার মধ্যে আমার প্রিয় ওঁর নিজের সুর দেওয়া (১) ঝাউ বনটাকে পেরিয়ে’। সতীনাথের সুর দেওয়া (২) ‘যেদিন তোমায় আমি দেখেছি।’ (৩) ‘তুমি এলে কি আমার ঘরে’।

চিনের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষের সময় এইচ. এম. ভি.-র বিশেষ নিবেদন ভূপেন হাজারিকার সুরে আমার লেখা ‘বড় ভয় ছিল যাবার বেলায়’ এবং ‘আগামী প্রেমিকা সুখী হয় যদি তাতেই আমরা সুখী’। এরকম আরও বহু গান রয়েছে দ্বিজেনবাবুর। ‘দুই নারী’ নামে একটি ছবির সংগীত পরিচালনাও করেছিলেন দ্বিজেনবাবু। তাতেও গীতিকার ছিলাম আমি। রেকর্ডিং-এর দিন আঁচ করেছিলাম আমার পেমেন্টের একটা অংশ দ্বিজেনবাবুর জন্য খরচ করতে হবে। রেকর্ডিং-এর পরে আমাদের কোনও হোটেলে যেতে হবে। ওখানে নির্ঘাত যোগ দেবেন নচিকেতা ঘোষ। এই আন্দাজ করে বাড়ি থেকে বার হবার সময় আমার প্রতিবেশী শ্রীমনু বোসকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে হাজির হয়েছিলাম রেকর্ডিং থিয়েটারে। পেমেন্ট পেতেই মনুকে দিয়ে আমার টাকাটা আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর দ্বিজেনবাবু আমার আঁচ করা ঘটনাটা ঘটালেন। ফোনে ডাকলেন বন্ধু নচিকেতা ঘোষকে পার্ক স্ট্রিটে। আমিও গেলাম। খাওয়ার দাওয়ার পর বিল আসতেই দ্বিজেনবাবু দেখিয়ে দিলেন আমাকে। বললাম, টাকা কোথায় আমার? দেখুন সার্চ করুন।

আমায় রীতিমতো সার্চ করে নিরাশ হয়ে পেমেন্ট করতে হল দ্বিজেনবাবুকে। এখনও এই ঘটনাটা আলোচনা করলেই দ্বিজেনবাবু হাত জোড় করে আমায় নমস্কার করেন।

সেবার মুম্বাইতে গিয়ে সলিল চৌধুরীর সহকারী আমাদের পাড়ার কানু রায়ের সঙ্গে হঠাৎ দেখা। কানুবাবু বললেন দ্বিজেন এসেছে সলিলদার হিন্দি ছবি ‘মায়া’-তে প্লে-ব্যাক করতে। আছে সলিলদারই আন্ধেরি ইস্টের বাড়িতে। পরদিন ভোর হতে হাজির হলাম সলিলদার আন্ধেরি ইস্টের বাড়িতে।

তখনকার আন্ধেরি মুম্বই-এর নিতান্ত শহরতলি। গ্রাম্য পরিবেশ। সলিলদা থাকতেন একটি বাড়ির দোতলায়। নীচের তলায় প্রায় ধর্মশালার মতো লোকজন। তখন সলিলদার ‘মধুমতী’ সুপারহিট হয়ে গেছে।

ওপরে উঠে পেলাম সলিলদাকে আর দ্বিজেনবাবুকে। সাদর অভ্যর্থনার পর ব্রেকফাস্ট খাইয়ে সলিলদা বললেন, চলো মোহন স্টুডিয়োতে। কলকাতার পিয়ানোবাদক পুঁটেদা আমার মিউজিক রুমের পার্মানেন্ট হয়ে রয়েছেন। তুমি ওঁর পিয়ানো শুনবে, আমরা কাজ করব। তারপর সন্ধ্যায় তোমাকে আমি চার্চ গেটে পৌঁছে দেব।

আমরা একসঙ্গে নীচে নামলাম। নীচের তলার এক একজন অতিথিকে সলিলদা বলতে বলতে চললেন, আরে বিষ্টু কবে এলে? ও হরিদাস তোমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো? আবার একজনকে বললেন, আরে শোভন তুমি তো আজ‍ই চলে যাবে? তোমার জ্যোতিবউদিকে বলো রাতের ডিনারটা যাতে সঙ্গে দিয়ে দেয়।

দ্বিজেনবাবু আমাকে কানে কানে ফিস ফিস করে বললেন, প্রায় মিনি কসবা, সলিলের এখানে প্রত্যহ আসা যাওয়া করে। (মুম্বই যাবার আগে সলিলদা কলকাতার কসবাতে থাকতেন।) দ্বিজেনবাবু বলে চললেন, মুম্বইতে ঘর সংসারের কাজ করা ছাড়া সলিলের বউ জ্যোতির আসল কাজ প্রত্যেক অতিথিকে রোজ ব্রেকফাস্ট খাওয়ানো। এমন লোকও আসে এখানে সলিল যাকে চেনেও না। সবাই আসে কাজের ধান্ধায়। বিরাট মনের মানুষ সলিল চৌধুরী সবাইকে দেন আশ্রয় এবং ব্রেকফাস্ট।

মুচকি হাসলেন দ্বিজেনবাবু। মোহন স্টুডিয়োতে যাওয়ার জন্যে সলিলদার বিরাট গাড়িতে উঠলাম। সলিলদাই চালাতে লাগলেন। আমি পেছনে বসে ছিলাম। হঠাৎ আমাকে বললেন, পুলক, তুমি নাকি গীতিকার শৈলেন্দ্রর থেকে ভাল গাড়ি চালাও। কথাটা বলেই হাসতে লাগলেন। আমরা পৌঁছলাম বিমল রায়ের মোহন স্টুডিয়োতে।

একতলাতেই সলিলদার এয়ারকন্ডিশন মিউজিক রুম। একদিকে পিয়ানো, বঙ্গো, নানা দেশি-বিদেশি বাদ্য যন্ত্র। এপাশে সলিলদার হারমোনিয়াম। মুম্বইতে যার কথ্য নাম পেটি। আর একদিকে রেকর্ডপ্লেয়ার। আলমারিতে সাজানো দেশ-বিদেশের গানের রেকর্ড, অর্কেস্ট্রার রেকর্ড।

পুঁটেদা ওখানে পিয়ানো বাজাচ্ছিলেন। আমরা চুপ করে সে বাজনা শুনছিলাম। হঠাৎ সলিলদা ওকে থামিয়ে নিজে বসলেন পিয়ানোতে। অদ্ভুত একটা সুরতরঙ্গ তুললেন পিয়ানোতে উনি। সলিলদার দ্বিতীয় সহকারী কানু রায় সেই সুর লিখে নিতে লাগলেন। কিছুক্ষণ বাদে থামলেন সলিলদা। তুলে নিলেন একটা বাঁশি। বাজাতে লাগলেন গ্রাম্য সুর। তারপরই আগের পিয়ানোর ওই বিদেশি সুরটা এসে গেল ওঁর হাতের বাঁশিতে। শুরু হল সুন্দর এক অভিনব সংগীতের প্রাণ প্রতিষ্ঠা। তারপরই কফি এল। কফি খেতে খেতে শুনতে লাগলেন লেটেস্ট একটি বিদেশি এল পি রেকর্ড।

সলিলদার ওই মিউজিক রুম এখন আর নেই। নেই বিমল রায়ের মোহন স্টুডিয়ো। ওখানে তৈরি হয়ে গেছে মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং। ওখান দিয়ে যেতে যেতে কেউ কেউ হয়তো এখনও শুনতে পান পরিণীতার কোনও কোনও সংলাপ। দেবদাস বা বন্দিনীর কোনও কোনও গান। আমার মতো কেউ হয়তো শুনতে পান পুঁটেদার পিয়ানো, সলিলদার বাঁশি আর হারমোনিয়ামের সুর।

আমি ওখান দিয়ে গেলে এখনও থমকে দাঁড়াই। কান পেতে শুনতে চেষ্টা করি দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের হিন্দি ‘মায়া’ ছবির গান। যার পেছনে লতাজির অপূর্ব হামিং, যার ভার্সান সলিলদা নিজেই লিখেছিলেন। হয়তো বুঝেছিলেন তাঁর স্বাধীন মিউজিক রুম একদিন থাকবে না। তাই বোধ হয় লিখে ফেলেছিলেন ‘একদিন ফিরে যাব চলে/এঘর শূন্য করে/বাঁধন ছিন্ন করে। যদি পার যেও ভুলে’। কিন্তু সলিলদা আমি ভুলতে পারিনি। ভুলতে পারব না।

মাদ্রাজে এখনও কিছু কিছু থাকলেও দেশের আর সর্বত্র স্টুডিয়ো থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নির্দিষ্ট মিউজিক ডিরেক্টরের মিউজিক রুম। সবাই এখন যার যার তার তার। নির্দিষ্ট মিউজিক রুম এখন সবারই বাড়িতে। স্টুডিয়োতে নয়। সেদিন বিকালে দ্বিজেনবাবু অন্য কোথাও কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্টে চলে গেলেন। সারাদিনের কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় সলিলদা চার্চ গেটে আমাকে নামাতে এসে নিয়ে গেলেন চার্চ গেটেরই বাসিন্দা সবিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাটে। সবিতা তখনও চৌধুরী হননি। বললেন, চলো তোমায় আমার নতুন কিছু বাংলা গান শোনাই। আমার মনে থাকে না, সবিতার সব কণ্ঠস্থ। তখন মুম্বাইতে দীপাবলি আসন্ন। গাড়ি থেকে নামতেই সশব্দে একটা বাজি ফাটল। সলিলদা চমকে উঠে বললেন, এখানকার আতসবাজিতে আলো নেই শুধু আওয়াজ। এখন হয়তো বলতেন, এখনকার হিন্দি ফিল্মি গানে সুর নেই শুধু শব্দ। লিফটে চড়ে আমরা এলাম ওঁদের ঘরে।

৩৮

সলিলদার সঙ্গে আমরা এলাম সবিতা দেবীর ফ্ল্যাটে। সবিতা দেবী এবং তাঁর মার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন সলিলদা।

(সবিতা দেবী তখন যত দূর জানি প্রথম স্বামীকে ছেড়ে মুম্বইতে মায়ের সঙ্গে বন্দ্যোপাধ্যায় হয়েই আছেন। তখন চৌধুরী হননি।) তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, পুলক এবারের পুজোয় আমার সুরে লতার গান নাকি কলকাতায় দারুণ হিট? খবর পেয়েছ কিছু?

আমি বললাম, শুধু কলকাতায় নয়, সারা ইস্টার্ন জোনে সুপারহিট হয়ে গেছে আপনার ‘সাত ভাই চম্পা জাগরে’ গানটি। এরপর সবিতার সুকণ্ঠে শুনলাম সলিলদার নতুন বেশ কয়েকটা গান। কিন্তু কোনও গানই পুরো শোনা হয়নি। কোনওটার শুধু মুখড়া, কোনও কোনও গানের অন্তরা অবধি। রেকর্ড হওয়ার আগে কোনও একটি পরিপূর্ণ গান শুনিনি সলিলদার। প্রায় সব গানেরই শেষ অন্তরা উনি লিখতেন নিতান্ত বাধ্য হয়ে। স্টুডিয়োতে শিল্পী আসার পর তাকে শেখাতে গিয়ে চমকে উঠে দেখতেন গানটি শেষ করা হয়নি।

সলিলদা অন্যের কবিতায় সুর করেছেন। কিন্তু সব সুরকরা গানই ওঁর নিজের রচনা। আমি বোধহয় সেই একমাত্র ব্যতিক্রমী গীতিকার যার সলিলদার সুরে গান লেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। সলিলদার সুরে আমি লিখলাম, ‘এই মন মোর জানি না হারালো কোথা যে…।’

যেই প্রথম অন্তরাটি শেষ করেছি সলিলদা বললেন, আজ এই পর্যন্ত থাক পুলক। বাকিটা পরে করব।

আমি বললাম, দোহাই সলিলদা, আমি পারব না। আমায় শেষ করতে দিন।

আমার অনুরোধে বাধ্য হয়ে সলিলদা রাজি হলেন। আমার আর একটি গান ‘আমার এ বেদন মাঝে তুমি অশ্রু হয়ে এলে’ লেখার সময় ওই একই কাণ্ড হয়েছিল। সেবারও আমার অনুরোধে বাধ্য হয়ে ধৈর্য ধরে উনি হারমোনিয়াম নিয়ে শেষ করেছিলেন গানটি।

সলিলদা ছিলেন প্রকৃত ক্রিয়েটিভ মানুষ। শ্রদ্ধেয় শিল্পী। দুরন্ত এবং দুর্বার। ওঁর সুরের গ্রাফ যদি নেওয়া যায় তা হলেই ওঁর মানসিকতাটিকে সহজেই ধরে ফেলা যাবে। এই আরোহণ, এই অবরোহণ। এই এখানে আবার ওই ওখানে। কোথাও এতটুকু থেমে নেই ওঁর সুর, ওঁর মন। শুধু গতি, অনন্ত গতি।

সলিলদা প্রসঙ্গে কিছু বলতে গেলে আমার আর একটি সৌভাগ্যের কথা নিশ্চয় বলতে হয়। সেটি হল সবিতা চৌধুরীর প্রথম বাংলা গান রেকর্ডিং হয় নচিকেতা ঘোষের সুরে। সলিলদাই এটা চেয়েছিলেন। রেকর্ডের একটি গান উনি নিজেই রচনা করেছিলেন ‘আঁধারে লেখে গান/হাজারো জোনাকি’। উল্টো পিঠের গানটি আমাকে লিখতে বলেছিলেন সলিলদা স্বয়ং। লিখেছিলাম একটি ছড়ার ঢঙে গান ‘ডাগর ডাগর নয়ন মেলে…’।

আমার গান শুনে দারুণ খুশি হয়েছিলেন সলিলদা এবং নচিকেতা ঘোষ দুজনেই। সে সব একটা দিন গেছে আমাদের সংগীত জগতে। আজ সবই যেন হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু দিন যাচ্ছে আর দিন আসছে। পুরনো চলে গিয়ে আসছে নতুন। চিরদিনই এই নিয়মে জগৎ চলেছে এবং চলবেও। কিন্তু ওই আসা-যাওয়ার মধ্যে আমরা কী পাচ্ছি। জানি না মথুরা বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ কীসের বাঁশি বাজিয়েছিলেন। কিন্তু বাঙালি চিরদিনই বাজিয়েছেন বাঁশের বাঁশি। বিখ্যাত হিন্দুস্তান রেকর্ডের লোগোটাই ছিল বটের ছায়ায় বসে রাখাল ছেলের বাঁশি বাজাবার ছবি।

বেশ কিছুদিন ধরে দেখছিলাম দিনের পর দিন কলকাতায় এই বাঁশের বাঁশিটা গানের যন্ত্রানুষঙ্গ থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। যা বাজছে সবই স্টিলের। অর্থাৎ ইংলিশ বাঁশি। ওই বাঁশিতে বাংলার সেই মেঠো সুর বাজানো অসম্ভব। আর আছে সিনথেসাইজার অথবা কি-বোর্ডের মাধ্যমে বাঁশি। সেই যান্ত্রিক সুর বাংলার আকাশ, বাতাস, মাটি, নদী কিছুই ছুঁয়ে যায় না। আজও কেন এল না পান্নালাল ঘোষের বাঁশির কোনও উত্তরসূরি? কেন কুমার শচীন দেববর্মণের দুজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় কুমার বীরেন্দ্রনারায়ণ আর গোপেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে গেল ত্রিপুরার বাঁশির সেই অন্তরস্পর্শী সুর।

সুরশ্রী অর্কেস্ট্রায় বাঁশি বাজাতেন শৈলেশ রায়। অর্কেস্ট্রার রিহার্সালের ঘর ছিল লেনিন সরণির চারতলার ঘরে। আর ছিল গণেশ অ্যাভিনিউতে ক্যালকাটা অর্কেস্ট্রা ছ’ তলায়। কোথাও লিফট ছিল না। ওখানে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে মাঝে মাঝে আমরা উঠতাম। নিয়মিত উঠতেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, শ্যামল মিত্র, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, গায়ত্ৰী বসু, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। হেমন্তদা ওই সময়টাই মুম্বইতে খুবই ব্যস্ত। তাই উনি নিয়মিত নয় মাঝে মাঝে ওই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেন। ন্যাশনাল অর্কেস্ট্রার ঘর ছিল ভবানীপুরে। ওখানেই প্রথম দেখলাম রেডিয়োর বাদ্যযন্ত্রবিদ তারকনাথ দে-র পুত্র বংশীবাদক অলকনাথ দে-কে। মনে আছে সেদিন ছিল সুপ্রভা সরকারের গানের রিহার্সাল। গানটি ছিল আমারই লেখা। ওই অর্কেস্ট্রা রিহার্সালের ওপর ওভারল্যাপ করছিল সুপ্রভা সরকার অর্থাৎ বড়দির কণ্ঠস্বর—ওই অলক ছেলেটি দারুণ বাজায়। বিরাট নাম করবে ওই ছেলেটি। অক্ষরে অক্ষরে ফলেছিল সেই ভবিষ্যৎ বাণী। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য অলকনাথ দে চিরতরে চলে গেলেন। সেই সঙ্গে নিয়ে গেলেন ওঁর বাঁশিটি। এইচ. এম. ভি.-তে ছিলেন আর এক কৃতী বংশীবাদক তাঁর নাম কমল মিত্র। আমি খুব অল্প দিনই তাঁকে কলকাতার অর্কেস্ট্রায় দেখেছিলাম, তিনি চলে গিয়েছিলেন মুম্বইতে।

আমাদের গানের জগতে আর একজন দারুণ বাঁশি বাজাতে পারতেন, তাঁর নাম ছিল হিমাংশু বিশ্বাস। শুধু বাঁশি নয়, অন্য বাদ্যযন্ত্রও খুবই দক্ষতার সঙ্গে বাজাতেন। তিনিও চলে গেলেন অকালে। সেই সঙ্গে থেমে গেল তাঁর বাঁশিটিও।

তবলিয়া রাধাকান্ত নন্দীর ভাই চন্দ্রকান্ত নন্দীও ভালই বাঁশি বাজাতেন। এখনও বাজিয়ে যাচ্ছেন পুলুবাবু, (ভাল নামটি জানি না) ওঁরাও রেখে যাচ্ছেন না উত্তরাধিকারী। কুমার বীরেন্দ্রনারায়ণ অর্থাৎ আমাদের চানুদার বাঁশির ফুঁ-এ যেমন ছিল অন্য মেজাজ তেমনি কথাবার্তায় কাজকর্মেও ছিল অপূর্ব মেজাজ। একবার চানুদা ওঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় কুমার শচীন দেববর্মণের আহ্বানে মুম্বই গিয়েছিলেন। শচীনদার ছবির গানে বাঁশি বাজাতে। দাদার স্টেশনে নেমে দেখলেন ওঁকে নিতে লোক এসেছে কিন্তু ওঁকে যেতে হবে ট্যাক্সিতে। শচীনদা ওঁর জন্য গাড়ি পাঠাননি। অভিমানে আহত চানুদা শুধুমাত্র গাড়ি না পাঠানোর কারণে ফিরতি ট্রেনেই কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন। এক মুহূর্তও আর থাকতে চাননি ওখানে।

মদিরায় ওঁর আসক্তি ছিল খুবই বেশি। একবার নাকি কোন এক প্রডিউসার এক হোটেলে পানীয়ের টেবিলে ওঁকে ডেকেছিলেন। আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন চানুদা। ভদ্রলোক চানুদাকে সিগারেট দেন। চানুদা সিগারেট ঠোঁটে লাগান। এরপর ওই প্রোডিউসার ভদ্রলোক নিজের সিগারেটের আগুনে একটা দশ টাকার নোট জ্বালিয়ে সেই আগুনটা দিয়ে চানুদার সিগারেট ধরিয়ে দেন। চাদা সিগারেট ধরিয়ে সুখটান দেন এবং প্রোডিউসারের দিকে একবার তাকান। কিন্তু একটু পরেই আমাদের চানুদা যে কাণ্ডটি করেছিলেন সেটা শচীনদা জীবনে কখনও করতেন না। হয়তো পঞ্চমের দ্বারা সম্ভব হলেও হতে পারত।

পরের বার সিগারেট খাবার সময় ওই ব্যবসায়ী প্রোডিউসারের সিগারেটে চানুদা আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন তখনকার দিনের একটা নতুন কড়কড়ে একশো টাকার নোট পকেট থেকে বার করে। এই রকম মেজাজি ছিলেন উনি।

হিন্দুস্থান রেকর্ডের গানে এবং সেনোলা রেকর্ডের বহু গানে একটু কান পাতলেই যে অপূর্ব ব্যতিক্রমী বাঁশির সুরগুলো শ্রোতারা শুনতে পাবেন সেগুলো এই দুই বিখ্যাত বংশীবাদক দুই ভাই কুমার বীরেন্দ্রনারায়ণ অর্থাৎ চানুদা নয়তো কুমার গোপেন্দ্রনারায়ণ অর্থাৎ রাজাবাবুর।

আজকের বাংলাদেশের বিখ্যাত সুরশিল্পী সত্য সাহা তখন কলকাতায়। এই সত্য সাহাকে নিয়ে প্রচুর জায়গায় ঘুরেছেন চানুদা। বলেছেন, দেখিস এ একদিন কোথায় পৌঁছে যাবে। আমার কিশোরবেলার বন্ধু সত্য সাহা হয়তো কলকাতায় কিছু করে উঠতে পারেনি। কিন্তু সার্থক হয়ে উঠেছে ঢাকায়। ঢাকায় সত্য সাহা একজন বিখ্যাত লোক। প্রযোজক, পরিবেশক এবং পরিচালক। ঢাকায় ওঁর নিজস্ব অফিসও রয়েছে। সুরশিল্পী সত্য সাহার সঙ্গে সম্প্রতি আমি কিছু ছবিতে কাজ করেছি। এখন ওঁকে দেখলেই আমি যেন চানুদার পরিতৃপ্ত হাসি মুখটি দেখতে পাই।

হিন্দুস্থান রেকর্ডের বর্তমান মালিক প্রয়াত চণ্ডীবাবুর ছেলে মোহনবাবু সেদিন এক পার্টিতে জানালেন হিন্দুস্থান রেকর্ডের সব গান উনি এইচ. এম. ভি.-কে দিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ হিন্দুস্থানের গান এখন থেকে পুনর্মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হবে এইচ. এম. ভি. রেকর্ডে। সংবাদটা শুনেই আমার যেন মনে হল হিন্দুস্থানের সেই বিখ্যাত ছবি বটের ছায়ায় বাঁশি বাজানো রাখাল ছেলেটির হাতের বাঁশের বাঁশিটা মড়মড় করে ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়ল। আজ এই বাঁশের বাঁশিতে বিশ্ব জয় করছেন ওড়িশার হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। যিনি শিবকুমার শর্মাকে সঙ্গে নিয়ে শিব-হরি নাম নিয়ে এক সুরকার গোষ্ঠী বানিয়ে হিন্দি ছবিতে প্রচুর সুপারহিট গান দিয়েছেন।

মুম্বইতে রয়েছেন বেনারসের প্রবাসী বাঙালি রোনো। যাঁর ফুঁয়ের তুলনা এখন সত্যিই বিরল। কিন্তু বাংলায় অর্থাৎ কলকাতায় বাঁশুরিয়া কোথায়?

আজকের অর্কেস্ট্রাতেও বাঁশির কতটা প্রয়োজন হয় তার প্রমাণ তো মুম্বইয়ের বাঙালি বাঁশুরিয়া রোনোর কর্মব্যস্ততা। বাঙালির অনেক কিছু হারানোর তালিকায় রয়ে গেছে এই বাঁশের বাঁশিটিও।

ক্ল্যারিওনেটও তাই। রাজেন সরকারের প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় কোনও যন্ত্রানুষঙ্গেই শোনা যায় না ক্ল্যারিওনেট। অথচ আজ পর্যন্ত মুম্বইতে প্রায় প্রতিটি রেকর্ডিং-এ অবশ্য প্রয়োজনীয় হচ্ছে এই বাদ্যযন্ত্রটি। কেন এমন হল? বাঙালি ক্ল্যারিওনেট বাদক কি সিনেমা বা ক্যাসেটে আসছেন না? নাকি তাঁদের আনা হচ্ছে না। তাই যে কজন আছেন তাঁরা সবাই যোগ দিচ্ছেন যাত্রা পার্টিতে। ভাল বাজাতে পারছেন না বলে এই যন্ত্রটা এখন হেলাফেলার বস্তু হয়ে গেছে। অথচ বিখ্যাত কমল দাশগুপ্তের যে কোনও রেকর্ডের গান শুনলে শোনা যাবে রাজেন সরকারের ক্ল্যারিওনেট। রাইচাঁদ বড়ালের সুর করা নিউ থিয়েটার্সের যে কোনও রেকর্ড শুনলে শোনা যাবে অমর সিংহের ক্ল্যারিওনেট।

সানাইয়েরও সেই একই অবস্থা। আলি সাহেব ছাড়া একজনও সার্থক সানাইবাদক আজ পর্যন্ত এলেন না। যে আলি সাহেব আমার লেখা প্রচুর গানে সানাইকে সুন্দরভাবে ব্যবহার করেছেন। যেমন মান্না দের গাওয়া ‘সুন্দরী গো দোহাই, দোহাই মান কর না’ হেমন্তদার ‘খিড়কি থেকে সিংহ দুয়ার’ ইত্যাদি অজস্র সুপারহিট বাংলা গানে সেই আলি সাহেব ছাড়া আর কাউকেই আবিষ্কার করতে পারলেন না আজকের কলকাতার কোনও সুরকার অথবা অ্যারেঞ্জার। অথচ এই সেদিন মুম্বইতে আমার লেখা গানে যতীন-ললিতের সুরে ‘বিয়ের ফুল’ ছবিতে বিয়ের সানাইবাদক দেখলাম একাধিক। কেউ কারও চেয়ে কমতি নন। আর কলকাতায় এই ধরনের (বিশেষ করে বিয়ে-টিয়ের গান) যদি সানাইবাদক আলি সাহেবকে না পাওয়া যায় অ্যারেঞ্জাররা আশ্রয় নেন ইলেকট্রনিক্সে। ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রে আর যাই বাজুক সানাই বাজে না। তাই স্বাভাবিকভাবেই বাঙালি শ্রোতারা এখন আর এ ধরনের গান পছন্দ করছেন না। যদি ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রে সানাই বাজানো যেত তা হলে বিদেশি যন্ত্রে সানাইকে মুম্বই সবার আগে লুফে নিত।

সব কিছু কলকাতায় কেন এ ভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কে তার জবাব দেবে?

আর একটা জিনিস আমি আজকাল অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি, যে দুজন সর্বভারতীয় বাঙালি পুরুষ কণ্ঠের শিল্পী আজ শ্রোতাদের কাছে বিশেষ ভাবে সমাদৃত সেই কুমার শানু আর অভিজিৎ কলকাতার অনুষ্ঠানে বাংলা গান প্রায় গাইতেই চান না। কুমার শানু অবশ্য মাঝে মাঝে শ্রোতাদের আবদারে গেয়ে ফেলেন বাংলা গান। কিন্তু একটি অনুষ্ঠানে তার সংখ্যা একটি বা দুটি। অথচ গায়ক হিসেবে ওঁর প্রথম স্বীকৃতি বাংলা গান দিয়েই। বাবুল বসুর সুর করা এবং আমার লেখা ‘অমর শিল্পী তুমি কিশোরকুমার/তোমাকে জানাই প্রণাম।’ মানছি বাংলা ছবির গান ওঁর হিট হচ্ছে না কিন্তু আধুনিক গান তো হচ্ছে। ‘সুরের রজনীগন্ধা’ বা ‘প্রিয়তমা মনে রেখ’ বা ‘সোনার মেয়ে’ এই সব গানগুলো বাংলার অনুষ্ঠানে গাইতে ওঁর আপত্তি কোথায়? শানুর কিন্তু এ ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখা দরকার।

৩৯

অভিজিৎ পুজোর সময় বিভিন্ন কোম্পানি থেকে চার-পাঁচটি ক্যাসেট করে কিন্তু কলকাতায় এসে একটাও বাংলা গান গায় না। বাংলা গান গাইতে ওর যদি ভালই না লাগে তবে বিভিন্ন বাংলা ছবিতে বা বাংলা ক্যাসেটে কীসের আনন্দে ও বাংলা গান গেয়ে চলেছে আমি তার উত্তর খুঁজে পাইনি। ওকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছি, ও বলেছে, কলকাতার অনুষ্ঠানে কেউ বাংলা গান শুনতে চায় না। আমার প্রশ্ন, তা হলে শ্রোতারা ওর বাংলা ছায়াছবির গান বা ক্যাসেটের গান শুনছে কী জন্যে?

এ ব্যাপারে একটা আদর্শ দৃষ্টান্ত প্রত্যেককে জানানো কর্তব্য বলে আমি আমার জীবনের দু-একটি ঘটনার কথা বলি। লতা মঙ্গেশকর কলকাতায় এলে উনি দু-একটি বাংলা গান না গেয়ে কোনও অনুষ্ঠান করেন না। প্রচুর গান উনি গান। ওঁর অসাধারণ স্মরণশক্তি হলেও প্রতিটি ডিটেল হয়তো আরও সুন্দরভাবে প্রকাশ করার জন্য কয়েক বছর আগে একবার এখানে এসে আমায় খবর দিলেন আমার লেখা ‘নিঝুম সন্ধ্যায় পা পাখিরা…’ গানটির রেকর্ড নিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে। উনি রেকর্ড বাজিয়ে রিহার্সাল করে গানটি নিখুঁতভাবে জলসায় গাইবেন। এবং গাইলেনও। এরকমভাবে আমি ওঁর কাছে নিয়ে গেছি আরও কিছু গানের রেকর্ড।

কিছুদিন আগে এইচ. এম. ভি.-র অনুষ্ঠানে এসে যথারীতি আমায় আহ্বান জানালেন। সেবার ছিলেন গ্র্যান্ড হোটেলে। আমি গেলাম। জানতে চাইলেন এখন আমার লেখা ওঁর কোন বাংলা গান সব থেকে হিট। আমি বললাম, ‘মন্দিরা’ ছবির সব লাল পাথরই তো চুনি হতে পারে না। ও গানটি এড়িয়ে গিয়ে বললেন, পুলকবাবু আপনি এখনই আমায় লিখে দিন ‘ম্যায়নে প্যায়ার কিয়া’-র দিল দিওয়ানা গানটির বাংলা ভার্সান।

আমি বললাম, তথাস্তু।

উনি হিন্দিটা গাইতে লাগলেন আমি লিখতে লাগলাম ‘মন মানে না প্রাণ মানে না মানে না’। গানটি লেখা শেষ হয়ে যাওয়ার পর উনি রীতিমতো রিহার্সাল করে তবেই অনুষ্ঠানে গেয়েছিলেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কী দরকার ছিল লতা মঙ্গেশকরের বাংলা গান গাইবার? যেহেতু আজকাল উনি খুবই অল্পসংখ্যক গান রেকর্ড করেন, বাংলা গান প্রায় করেনই না। তাই পছন্দমতো নতুন বাংলা গান না খুঁজে পেয়ে, হিন্দি গানের বাংলা রূপান্তর আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়ে অনুষ্ঠানে গাইলেন। সবাই জানেন উনি অবাঙালি। উনি বাংলা গান নাও গাইতে পারেন। কিন্তু এখানেই বিখ্যাত শিল্পীর বৈশিষ্ট্য। কলকাতায় এসেছেন বাংলা গান গাওয়া ওঁর কর্তব্য।

আবার এক প্রশ্নের উত্তরে উনি খোলাখুলিই জানিয়েছিলেন, ভারতের প্রথম নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন বাঙালি। প্রথম অস্কারও পেয়েছেন বাঙালি। আমি বাঙালিকে শ্রদ্ধা করি। অথচ বাঙালি শিল্পীরা যাঁরা বাংলা অনুষ্ঠানে বাংলা গান প্রায় বর্জন করে ফেলেছেন, তাঁরা কতটা শ্রদ্ধা করেন বাঙালিকে?

কিশোরদা তো এখানে অনুষ্ঠানে বাংলা গান গেয়েছেন। মান্না দে তো আজও গান। রফি সাহেবও গাইতেন। প্রায়ই অনুষ্ঠান করতে এসে আমায় আমন্ত্রণ জানাতেন রফি সাহেব। ফাংশনের গানে গিমিক করার জন্য ওঁর সাম্প্রতিক হিট হিন্দি গানের মুখড়ার পঙক্তিটি আমায় বাংলায় লিখে দিতে বলতেন। কণ্ঠস্থ করে রাখতেন মুখড়ার বাংলা কথাগুলো। হিন্দি গানটি গেয়ে শেষ করে, যেই শেষবারের মতো ‘সাইন লাইনটি অর্থাৎ মুখড়াটি রিপিট করতেন তখন ওটা গাইতেন আমার বাংলা কথায়। শুনে হই হই করে উঠতেন শ্রোতারা। এ কাজটি অবশ্য অলকা ইয়াগনিকও করে। বিশেষ করে যখনই ‘সাজন’ ছবির ‘দেখা হ্যায় পহেলি বার’ গানটি অলকা গায় তখনই প্রথমে হিন্দিটা গেয়ে নিয়ে তারপর রিপিট করে আমার বানানো ‘সাজন’ ছবির বাংলা গানটি। বাংলা শুনে শ্রোতারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে লাফিয়ে ওঠেন। কিন্তু বাংলার জলসায় বাংলা গানে আজও নীরব কেন বাংলার অভিজিৎ?

সুরকার অনল চট্টোপাধ্যায়ের সুর আমার খুবই প্রিয়। অনেক ছবিতে ওঁর সুরে আমি গান লিখেছি। দারুণ আনন্দ পেয়েছি অনলদাকে সুরকার হিসেবে পেয়ে। বিশেষ করে তপন সাহা পরিচালিত এবং মিঠুন চক্রবর্তী অভিনীত ‘উপলব্ধি’ ছবির দুটি গান। একটি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘গোলাপের আতর আছে’ অন্যটি এরই জবাবে মান্না দে-র গাওয়া ‘ও গোলাপ ও গোলাপ’।

এরপরে উল্লেখযোগ্য আমার কথায় ওঁর সুর করা ‘জি টি রোড’ ছবির গান যেটি শ্যামল মিত্র গেয়েছিলেন ‘এই পথেই জীবন/এই পথেই মরণ::’।

আর একটি ঘটনার কথা আমার মনে পড়ছে। একবার তৈরি হল রাগ অঙ্গের একটি গান। গানটি ছিল দুটি মহিলার কণ্ঠে। অনলদা জিজ্ঞেস করলেন, পুলক কাদের দিয়ে গাওয়াই বলো তো?

সে সময়টা হৈমন্তী শুক্লা আর অরুন্ধতী হোমচৌধুরীর খুবই কমপিটিশন। আমি বললাম, ওদের দুজনকে লড়িয়ে দিন। রেকর্ডিং থিয়েটারে আমি যখন ঢুকলাম দেখি ওরা দুজনে গানটি নিয়ে রীতিমতো লড়াই করছে। অনলদা আমায় দেখেই হাসতে হাসতে বললেন, পুলক দুজনকে লড়িয়ে দিতে বলেছে। আমি লড়িয়ে দিলাম। তোমরা লড়ে যাও। আমি বললাম, যে জিতবে, সে পাবে একটা গোটা ক্যাডবেরি পুরস্কার।

অনলদা আমায় একবার নিয়ে যান তখনকার বাণিজ্যিক সফল পরিচালক কনক মুখোপাধ্যায়ের কাছে। কনকবাবুর ‘মায়াবিনী সেন’ ছিল প্রায় গানের ছবি। প্রতিটি গানই আমাদের খুব ভাল হয়েছিল। এইচ. এম. ভি. সে বার সুবীর সেনের আধুনিক গানের সুর করতে বললেন অনলদাকে। অনলদা আমায় ডাকলেন। প্রিয়া সিনেমার পাশে বাণীচক্রে। গিয়ে দেখি ওখানে রয়েছেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। অনলদা বললেন, অভিজিৎ‍ই তোমায় দিয়ে সুবীর সেনের গান দুটি লেখাতে বলেছেন। তাই ওঁকেও ডেকেছি। ওঁর সামনে তুমি গান দুটি তৈরি করো।

দুটি গানই অভিজিতের সামনে বসে আমরা বানিয়ে ফেলেছিলাম। একটি গান খুবই জনপ্রিয়। গানটি হচ্ছে ‘চন্দন আঁকা ছোট্ট কপাল’। মনে আছে গান দুটি শুনতে এল সুবীর সেন। গান দুটো খুব পছন্দ হল। জিজ্ঞেস করল কী খাবেন? খাবার আনাই।

এরপর অনলদা, আমার উল্লেখ্য যোগাযোগ অনলদার পুত্র ইমনকল্যাণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘রাজপুরুষ’ ছবিতে। ইমনকল্যাণের রক্তে গান। দেখলাম ও খুবই ভাল বোঝে গান। ‘রাজপুরুষ’ ছবির জন্য আমি গান লিখেছিলাম।

আরতি মুখোপাধ্যায়ের ‘মনের দুয়ারে দাঁড়িয়ে থেক না, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছলকে পড়ে কলকে ফুলের’, গীতা দত্তের ‘কৃষ্ণ নগর থেকে আমি কৃষ্ণ খুঁজে এনেছি’-র মতো বহু হিট গানের সুরকার অনলদা আজকের গানের জগৎ থেকে নিঃশব্দে যেন হারিয়ে যেতে বসেছেন। অভিমান না করে ওঁর উচিত আজকের দিনেও ভাল ভাল সুর করা। প্রমাণ করে দেওয়া, ভাল গান পেলে শ্রোতারা আজও তা সাদরে গ্রহণ করে।

তখনকার আই. পি. টি.-এর তিনজন সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, অনল চট্টোপাধ্যায় এবং প্রবীর মজুমদার এই ত্রয়ীর মধ্যে একজনকে আমরা হারিয়েছি। তিনি প্রবীর মজুমদার। প্রবীর মজুমদারের সুরের স্টাইল কিন্তু একেবারে ভিন্ন। ওঁর সুরে এবং কথায় ধনঞ্জয়বাবুর ‘মাটিতে জন্ম নিলাম’ নির্মলা মিশ্রের ‘ও তোতা পাখিরে’ বাঙালি কোনও দিনও ভুলবে না।

আমার লেখা গান উনি প্রথম করেন অখিলবন্ধু ঘোষের কণ্ঠে। তারপর আমরা আর কিছু গান করি। ওর মধ্যে স্মরণীয়, রাজেন তরফদারের ‘জীবন কাহিনী’ ছবির গান। দুটি গানই ভিন্ন ধরনের সুর করেছিলেন প্রবীর মজুমদার। একটি ‘আমি তোমার মাঝে পেলাম খুঁজে/বাঁচার ঠিকানা’ আজও ভুলিনি।

একটা জিনিস আমি লক্ষ করেছি যে কোনও সুর শিল্পীর কন্যা যদি গায়িকা হয় তা হলে সেই সুরশিল্পী পিতা তাকেই প্রায় সর্বোত্তমা মনে করে। একমাত্র ব্যতিক্ৰম হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সলিলদার মতো মানুষও এই দুর্বলতা মাঝে মাঝে প্রকাশ করে ফেলতেন। লক্ষ করেছি প্রবীর মজুমদারেরও এই দুর্বলতা, আমি ওঁর সঙ্গে ছবির গান লেখার সময়ে।

অনেক প্রতিকূলতা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে জীবন কাটিয়ে গেছেন প্রবীর মজুমদার। আমার ধারণা যা ওঁর প্রতিভা ছিল যা ওঁর প্রাপ্য ছিল তার অনেক কিছুই জীবনে পাওয়া হয়নি। এটাই বোধহয় শিল্পীর প্রকৃত জীবন। কে যে কখন সাফল্য পাবে কে যে পাবে না, কেউই তা বলতে পারে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *