২৫
পঞ্চম যত বড়ই সুরকার হোক বা কিশোরদা পঞ্চমের যত প্রিয় আর বড় গায়কই হন ওই উক্তি আমি সেদিন হজম করিনি। প্রতিবাদ করেছিলাম যুক্তি তর্ক প্রমাণ দেখিয়ে। পরে অবশ্য পঞ্চম বাধ্য হয়ে অন্তত আমার কাছ থেকে ফিরিয়ে নিয়েছিল কথাটা।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, যে কিশোরদাকে নিয়ে এই তুলনামূলক বিতর্কের উৎপত্তি সেই কিশোরদা ছিলেন হেমন্তদার সুরের এবং কণ্ঠের প্রশংসায় সরব। সেই জন্যই কিশোরদা প্রযোজিত ‘লুকোচুরি’ ছবিতে সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হয়েছিল হেমন্তদাকে। কিশোরদার ওই ছবিতেই গাইতে হয়েছিল একক কণ্ঠে একটি গান মুছে যাওয়া দিনগুলি আমারে যে পিছু ডাকে’। শুধু তাই নয়, মেগাফোন রেকর্ডে পুজোর গান গাইবার সময় কিশোরদা চেয়েছিলেন হেমন্তদারই সুর—অন্য কারও নয়। সেই সুরেই সৃষ্টি হয়েছিল ‘আমার পূজার ফুল ভালবাসা হয়ে গেছে।’ পঞ্চম, আশাজি সম্বন্ধে একটি ঘটনা মনে পড়ছে। কিছু দিন আগে মুম্বই-তে একটি রেকর্ডিং-এ আশাজির সঙ্গে আমার দেখা হল। আশাজি এসেছিলেন আমারই একটি গান ডাবিং করতে। ওঁর অভ্যাসমতো আমার কাছ থেকে গানটি শুনে শুনে খাতায় লিখে নিলেন উনি। ঠিক করে নিলেন বাংলা উচ্চারণ, বুঝে নিলেন গানের প্রকৃত বক্তব্য। এর পর সুরকারের কাছ থেকে সুরটি তুলে নিয়ে ‘সঙ ভায়োলিন’ শুনে শুনে আগে থেকে রেকর্ড করা বাজনার ওপর অপূর্ব গাইলেন আশাজি। তখনই ফাইনাল মিক্সিং হওয়া সম্ভব নয়। তবুও শব্দযন্ত্রী যতটা সম্ভব তাৎক্ষণিক মিক্সিং করে গানটি আমাদের শোনালেন। যথারীতি গান শুনে উঠে দাঁড়াতেই ওঁর পেমেন্টটা দেবার জন্য এগিয়ে এলেন প্রযোজক পক্ষ। আশাজি হঠাৎ হাতের ইশারায় প্রযোজকদের কাছ থেকে সময় নিয়ে আমাকে ডাকলেন। আমাকে নিয়েই আবার থিয়েটারে ঢুকলেন। ওখানে একটা নিরিবিলি কক্ষে আমায় সোজাসুজি প্রশ্ন করলেন, কলকাতায় আমার নামে খুবই বদনাম শুনছেন তো।
বদনাম? চমকে উঠলাম আমি।
আশাজি দৃঢ়ভাবে বললেন, হ্যাঁ, বদনাম। শোনেননি? আমি পঞ্চমের সম্পত্তির লোভে এখন গানটান ছেড়ে দিয়ে পাগলের মতো ছোটাছুটি করছি।
আমাকে কিছু বলবার অবকাশ না দিয়েই আশাজি বলতে লাগলেন, হ্যাঁ, আমি ছোটাছুটি করছি ঠিকই তবে আমার নিজের জন্য নয়। প্রয়াত পঞ্চমের যে সব তথাকথিত বন্ধুবান্ধবদের কাছে পঞ্চমের টাকা আছে সেগুলি আমি উদ্ধার করবই। টাকাগুলো পঞ্চমের নামে কোনও সেবাপ্রতিষ্ঠানে দান করব। আমি জানি, কলকাতা, মাদ্রাজ এবং বোম্বাইতে পঞ্চমের কিছু প্রতারক বন্ধু সেই টাকাগুলো সব হজম করে রেখেছে। আমি যোগাযোগ করলে এখন আমায় এড়িয়ে যাচ্ছে। আর আমার নামে বদনাম রটাচ্ছে আমি নাকি প্রচণ্ড অর্থলোভী।
উত্তেজনায় হাঁফাতে লাগলেন আশাজি। এ সব কথা শুনে আমার কী লাভ আমি তো ভেবে পাচ্ছিলাম না। উনি বোধহয় আমার মনের ভাব বুঝতে পারলেন। বললেন, দেখুন, মুম্বই-তেই আমার চারটে বাড়ি আছে। যাদের অ্যাভারেজ ভ্যালুয়েশন অনেক টাকা। আর কোথায় কী আছে নাইবা শুনলেন। শুধু একটা কথা শুনে রাখুন আমার আর নতুন করে পঞ্চমের টাকার কীসের প্রয়োজন। কেন এই পঞ্চমের টাকার পেছনে ঘুরে বেড়াব? শুধু পঞ্চমের বুকের রক্তঢালা পরিশ্রমে অর্জন করা অতগুলো টাকা ভণ্ড বন্ধুরা মেরে দেবে তা আমি সহ্য করব না কিছুতেই। কলকাতায় কেউ যদি আপনাকে এ ব্যাপারে কিছু বলে তা হলে তাদের মুখের ওপর আমার এই কথাগুলো বলে দেবেন। আপনি শুধু আমার নয় আমাদের সবার বহুদিনের চেনা লোক বলেই আপনাকে এ সব কথা খোলাখুলি জানালাম।
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে আশাজি তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে গেলেন থিয়েটার থেকে।
.
আমি মাঝে মাঝে ভাবি গান-পাগলদের কথা। কতরকম গান-পাগল পৃথিবীতে আছে। আমরা যাঁরা গান লিখি, যাঁরা সুর করেন, যাঁরা বাজনা বাজান, যাঁরা রেকর্ড করেন তাঁরা সকলেই এক-এক ধরনের গান-পাগল। আর শ্রোতা? কত রকমের যে গান-পাগল শ্রোতা পৃথিবীতে আছে তার পরিসংখ্যান নিতে গেলে কমপিউটার যন্ত্রও হার মেনে যাবে। প্রথমেই আমি কলকাতার বাসিন্দা হারু মুখোপাধ্যায়ের নাম করছি। যাঁর কাছে রয়েছে বাংলা গানের সংগ্রহ সেই আদি যুগ থেকে। রেকর্ডগুলো আজও সযত্নে রক্ষিত আছে। কোনও রেকর্ড কোম্পানির স্টোররুমেও সে সব রেকর্ডের অর্ধেক ভাগও নেই। বহু পুরনো গান ওঁর কাছ থেকেই নিয়ে ক্যাসেটে ট্রান্সফার করছেন রেকর্ড কোম্পানি। আর এক ভদ্রলোকের সঙ্গে মাদ্রাজে বাঙালি চরিত্রাভিনেতা অমিতের মাধ্যমে সেবার মাদ্রাজেই আলাপ হল। তাঁর নাম ভি এ কে রঙ্গারাও, ডম। ভদ্রলোকের মাতৃভাষা তেলুগু। একবার মাদ্রাজে থাকার সময় অমিতের সঙ্গে আমার হোটেলে এলেন। আর আলাপের পরেই আমাকে হোটেল থেকে ধরে নিয়ে গেলেন ওঁর বিশাল অট্টালিকায়। বসবার ঘরে আমায় বসিয়ে রেখে বললেন, বলুন দাদা। কোন সালে আপনার লেখা কোন গান প্রথম রেকর্ডে প্রকাশিত হয়?
আমি বললাম, ১৯৪৯। বাংলা ‘অভিমান’ ছবির গান। গায়িকা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। আমার কথা শোনার পর রঙ্গারাও ঘর থেকে উঠে গেলেন। এবং একটু পরে ঘরে ঢুকলেন একটি ৭৮ ডিস্ক হাতে করে। চমকে উঠলাম। সুদুর মাদ্রাজে এক তেলুগুভাষীর সংগ্রহশালায় আমার প্রথম গান। উনি রেকর্ড কভারে আমার অটোগ্রাফ নিলেন। তার পর সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখালেন ঘরে ঘরে রক্ষিত গ্রামোফোন রেকর্ডগুলি। বিভিন্ন ভাষার রেকর্ড। তামিল, তেলুগু তো আছেই। বাংলাও রয়েছে অজস্র অসংখ্য। ক্যাসেট কিন্তু একটিও উনি রাখেননি।
আমায় বললেন, আপনার গানের বোধহয় সমস্ত ৭৮, ই পি, এস পি, এল পি এবং নতুন কমপ্যাক্ট ডিস্কগুলোও আমার কাছে আছে। দরকার হলে বলবেন।
খেতে খেতে ওঁর এই রেকর্ড সংগ্রহের বাতিকের গল্প শুনতে লাগলাম। বাড়ি দেখেই বুঝেছিলাম উনি আমার মতোই কোনও পুরনো জমিদার বংশের উত্তরাধিকারী। প্রচুর কাজের লোকজন। ঝকঝকে তকতকে বাড়ি। ওঁর সামনেই দক্ষিণের চিত্রাভিনেতা অমিত বাংলায় আমাকে বললেন, উনি একা। ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। এই রেকর্ড সংগ্রহ আর এর জন্য অতিরিক্ত মনোযোগই নাকি বিচ্ছেদের মূল কারণ। যার জন্যে স্ত্রীর অভিযোগ। উনি তাঁর প্রতি কোনও সময় দিতে পারেন না।
খাওয়ার পর বললাম, আচ্ছা, লতা মঙ্গেশকরের প্রথম বাংলা পুজোর গানটি দেখান তো।
উনি সালটি আমার কাছ থেকে জেনে নিয়ে একটি বিশেষ ঘরে চলে গেলেন। নিয়ে এলেন আমার লেখা ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে’ রেকর্ডটি। সঙ্গে নিয়ে এলেন সে বার পুজোয় প্রকাশিত আমার লেখা আরও দুটি পুজোর রেকর্ড। একটি আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তারাদের চুমকি জ্বলে আকাশে’ আর একটি গায়ত্রী বসুর গাওয়া দূর বনপথে ছায়াতে আলোতে’। এরই সঙ্গে নিয়ে এলেন অন্য সময়ে প্রকাশিত সতীনাথের নিজ কণ্ঠের গান যা আমার রচনা ‘কারে আমি এ ব্যথা জানাবো’। রঙ্গরাও বললেন, আমার এক বাঙালি বন্ধু এ গানের অর্থ কী আমায় ইংরাজিতে লিখে দিয়েছেন। আমি এখনও এই গানটা শুনি আর মনে মনে কাঁদি।
‘দূর বনপথে’ গানটির সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। আগেই বলেছি অভিজিৎবাবুই আমায় রেকর্ডের আধুনিক জগতে নিয়ে আসেন। আমার রচিত প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তোমার দু চোখে আমার স্বপ্ন আঁকা’ গানটি সুর করে। তারপর কত গান আমরা করেছি। তখন কিন্তু রেকর্ড জগতে সুরকারকে বলা হত ট্রেনার। অমুক শিল্পী অমুক সুরকারের সুরের গান রেকর্ড করেছেন এমনটা কেউ বলত না। বলত অমুকের ট্রেনিং-এ। সিনেমার গানে অভিজিৎবাবুর সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ ‘জীবন রহস্য’ ছবিতে। ছবি না চললে গান চলে না এ কথা যে সব সময় সত্যি নয় এটা প্রমাণ করে দিয়েছিল ‘জীবন রহস্য’ ছবিটি। ছবিটা তেমন চলেনি। কিন্তু আমাদের চারখানি গানই সুপারহিট হয়ে গেল। যেমন আশা ভোঁসলের গাওয়া ‘যদি কানে কানে কিছু বলে বঁধুয়া’, এবং আর একটি গান ‘ও পাখি উড়ে আয় উড়ে আয়’। আর দুটি ছিল মান্নাদার গাওয়া! একটি হচ্ছে ‘পৃথিবী তাকিয়ে দেখ’ অন্যটি হল ‘কে তুমি শুধুই ডাকো’। এ সব গান আজও শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শোনেন।
শ্রদ্ধেয় পঙ্কজ মল্লিকের কোনও গান লেখার সুযোগ আমি না পেলেও ছাত্রজীবনেই তাঁর কিছুটা সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। দেখেছিলাম সেই ঝকঝকে রোভার গাড়ির মালিক এক অতি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাংলা গীতিসাহিত্যের এক বিরাট পণ্ডিত মানুষকে। একবার হাসতে হাসতে বলেছিলেন ওঁর বাসস্থান সেবক বৈদ্য স্ট্রিট দিয়ে যেতে যেতে ওঁর গাড়ির মধ্যে বসা দুজন বিদেশি অতিথি, সরস্বতী পুজোর প্যান্ডেল দেখে আর মাইকের গান শুনে ওঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এই যে অ্যামপ্লিফায়ারে এত জোরে রেকর্ডে গান বাজছে এটাও কি গডেস অফ লার্নিং-এর আরাধনার অঙ্গ? রেকর্ডে তখন সর্বত্র বাজছিল ‘লারে লাপ্পা লারে লাপ্পা’। পঙ্কজ মল্লিককে তখন দেশের মান বাঁচাতে বাধ্য হয়ে বলতে হয়েছিল, ইয়েস। এটা এক ধরনের হিম অর্থাৎ স্তবগান। শুনলেন তো কত পুজো প্যান্ডেলে এ গান বেজে চলেছে।
২৬
পঙ্কজ মল্লিক সম্বন্ধে একটি দারুণ গল্প শুনেছি বিশিষ্ট গায়ক বিমলভূষণের কাছে। একবার বিমলভূষণ আমাকে বলেছিলেন, একদিন কালোদা মানে অসিতবরণকে (তখন তিনি বেতারে তবলিয়ার কাজ করতেন) তিনি শিয়ালদহের সর্বজনীন দুর্গোৎসবের জলসায় বেতার কেন্দ্র থেকে সোজা নিয়ে গিয়ে হাজির করলেন। বিমলবাবু দেখলেন সামনে শচীন দেববর্মণ, পঙ্কজ মল্লিক এবং তারাপদ চক্রবর্তীর মতো মানুষরা বসে রয়েছেন। বিমলবাবু অনুষ্ঠান শুরু করেন বাণীকুমারের লেখা গান দিয়ে। ‘তুমি হৃদয় আমার করলে সচেতন। তারপর গাইলেন বাণীকুমারেরই রচনা ‘বাঁধন দিয়ে গেলে মোহিনী মায়াডোরে’। বিমলবাবুর গান শচীন দেববর্মণের খুবই ভাল লাগল। উনি পাশে বসা পঙ্কজ মল্লিককে জিজ্ঞাসা করলেন, সুন্দর গায় তো। কার সুর? পঙ্কজ মল্লিক উত্তর দিলেন, রবীন্দ্রনাথের। অর্থাৎ রবীন্দ্রসংগীত।
কথাটা শুনতে পেয়ে বিমলভূষণ অবাক হয়ে পঙ্কজ মল্লিককে বলেছিলেন, সেকী পঙ্কজদা। এ দুটোই তো আপনার সুর করা গান। নিজের গান নিজেই ভুলে গেছেন। উত্তরে পঙ্কজবাবু শুধু বলেছিলেন, বুঝলে বিমল এতক্ষণ এই জন্যই গান দুটো এত চেনা চেনা লাগছিল। অথচ ঠিক ধরতে পারছিলাম না।’
বাংলা গানের জগতে পঙ্কজ মল্লিকের মতো এত পণ্ডিত মানুষ বোধহয় আর আসেনি। রবীন্দ্র সাহিত্য তো ছিলই। বৈষ্ণব সাহিত্য নিয়েও প্রচুর পড়াশুনা করেছিলেন পঙ্কজ মল্লিক। পঙ্কজ মল্লিকের নানা কথায় এই পাণ্ডিত্য প্রকাশ হয়ে পড়ত। যেটুকু শুনতাম তাতেই আমি শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে যেতাম। আমার জানা মানুষদের মধ্যে এর পরে যাঁর নাম করতে হয় তিনি অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও পঙ্কজবাবুর মতো অত বড় পণ্ডিত না হলেও ওঁর প্রায় প্রতিটি গানেই ওঁর শিক্ষা ওঁর রুচির ছাপ পাওয়া যায়। ওঁর সুরের সর্বাঙ্গে সলিল চৌধুরীর (উনি সলিল চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সহকারী ছিলেন) ছাপ প্রকট হলেও বেশ কিছুটা স্বতন্ত্র ভাব আমি লক্ষ করে এসেছি। এই প্রসঙ্গে খুব একটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যদি সলিলদার মুম্বই-এর সহকারী কানু ঘোষের নাম করি। কানুবাবু সলিলদার সঙ্গে তখন দিনরাত ছায়ার মতো লেগে থাকলেও ওঁর সুরে কিন্তু সলিল চৌধুরীর কোনও প্রভাব নেই। সম্পূর্ণ ভিন্ন। অনলদা মানে অনল চট্টোপাধ্যায় ও আমার রচিত গীতা দত্তের অনেক বাংলা গানে তাঁর প্রমাণ পাওয়া যাবে। বিশেষ করে তালাত মামুদের গাওয়া শ্যামল গুপ্ত রচিত ‘এই তো বেশ এই নদীর তীরে বসে গান শোনা’ এবং তালাত মামুদের গাওয়া আমার লেখা ‘বউ কথা কও গায় যে পাখি বউ কি কথা কয়? এবং ‘অনেক সন্ধ্যা তারা’ এ দুটি গানে।
এরপর আমি আবার তালাত মামুদের জন্য কানু ঘোষের সুরে তুমি এস ফিরে এস’ এবং ‘দেখি নতুন নতুন দেশ’ ইত্যাদি গানগুলো লিখতে লিখতে কানুবাবুর একান্ত নিজস্ব ভাবটি বিশেষভাবে উপলব্ধি করি। অভিজিৎবাবু আর আমার পরের ছবি ‘দুষ্টু মিষ্টি’ এবং ‘বালক শরৎচন্দ্র’। দুটো ছবিতেই আমার অনুরোধমতো অভিজিৎবাবু প্লে-ব্যাকে নবাগতা শিল্পী হৈমন্তী শুক্লাকে সুযোগ দেন। হৈমন্তী সে সুযোগের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে নেয় ‘শিবঠাকুরের গলায় দোলে বৈঁচি ফলের মালিকা’ গানটি দারুণ গেয়ে হিট করিয়ে দিয়ে। এর পরের উল্লেখযোগ্য ছবি ‘হারায়ে খুঁজি’। তখন আমাদের টিউনিং অর্থাৎ দু জনের মানসিক মিলন এত সুন্দর হয়ে গিয়েছিল যে আমরা দেশপ্রিয় পার্কের কাছে বাণীচক্রের চারতলায় ভরদুপুর থেকে রাতদুপুর অবধি মাত্র একদিন সিটিং করে ‘হারায়ে খুঁজি’-র সব কটি গান তৈরি করে ফেলেছিলাম। আমার পরের দিন বোম্বে যাবার কথা। গভীর রাতে অভিজিৎবাবু আমাকে বললেন, না, আর বাধা নেই। আপনি কাল যেতে পারেন বোম্বে।
‘হারায়ে খুঁজি’ ছবিতে আরতির গাওয়া টুং টাং পিয়ানোয় সারাটি দুপুর’ এবং ‘ঋন বাজে রে’, অনুপ ঘোষালের গাওয়া ‘ফুলে ফুলে অলি দুলে দুলে’ এবং হেমন্তদার গলায় ‘সে ভাবে সবুজ পাথর আমি ভাবি পান্না।’ এই গানগুলো আশা করি শ্রোতারা মনে রেখেছেন। এর পরের ছবি ‘সেলাম মেমসাহেব’। এ ছবিতে আমাদের টিমের দুখানা গান এখনও যত্রতত্র শোনা যায়। যেমন ঊষা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘শুনো সখি মোহনিয়া’ এবং মান্না দের গাওয়া ‘ঝর্না ঝরঝরিয়ে…’। আমরা অন্য আধুনিক গানও অনেক করেছি। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য একবার পুজোয় হেমন্তদার আধুনিক গানের এল পি রেকর্ডের দুটি গান। যার টাইটেল ছিল ‘নতুন সুরে নতুন গান’। গান দুটি হল ‘ও যে বলতে বলতে থেমে গেল’, আর ‘দিন চলে যায় সবই বদলায়’। এই গানের অনুভবটিই তো আমার সারা জীবন, আমার গানের জীবনী। এরপর আমরা মিলিত হলাম অজয় বসু প্রযোজিত দীনেন গুপ্তের ‘তিলোত্তমা’ ছবিতে। আমি দীনেন গুপ্তের প্রচুর ছবিতে গান লিখেছি। আমি বুঝি, দীনেনবাবু কোন সিচুয়েশনে কী গান চান। উনি প্রকৃতই গানের সুর বোঝেন অভিজিৎবাবুর সঙ্গে ওঁর প্রথম কাজ। উনি স্বাভাবিকভাবেই ওঁকে বোঝেন না জানেন না। প্রথমেই আমরা বসলাম ‘গোলাপের অলি আছে’ গানটির সিচুয়েশন নিয়ে। আমি এক লহমায় বুঝে নিলাম দীনেনবাবু কী গান চাইছেন। কিন্তু অভিজিৎবাবু কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। অভিজিৎবাবু বরাবরই সুরের উপর গান লিখিয়ে এসেছেন। তাই অনেক ধরনের সুর শোনাতে লাগলেন। একটাও পছন্দ হল না পরিচালক দীনেন গুপ্তের। শেষে অভিজিৎবাবুর সুবিধা হবে মনে করে লিখে ফেললাম, ‘গোলাপের অলি আছে/ ফাগুনের আছে বাহার/ সকলেরই সাথী আছে/ সাথী কেউ নেই আমার/ হায়রে কেউ নেই আমার।’ দীনেনবাবু শুনেই বললেন, ঠিক এই গানটাই আমি চাইছিলাম। সুর করে ফেলুন না।
অভিজিৎবাবু ‘কেউ নেই আমার’ কথাটা পেয়েই বোধহয় স্যাড সঙ বানিয়ে ফেলতে লাগলেন। দীনেনবাবুর অপছন্দ হতে লাগল। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে এসে গেল দীনেনবাবু এক সময় আমায় পাশের ঘরে ডেকে বললেন, না, এঁকে দিয়ে হবে না। আর একদিন সিটিং করতে হবে অন্য মিউজিক ডিরেক্টর নিয়ে। আপনাকে খবর দেব।
আমি বললাম, আমায় ওঁকে ব্যাপারটা বোঝাতে একটু সময় দিন। উনি একটু গোঁড়া মানসিকতার মানুষ। যেটা করে ফেলেন কিছুতেই বদলাতে পারেন না। আটকে থাকেন সেখানে। এ মানসিকতা বাণিজ্যিক গানের জগতে একদিকে যেমন খুব ভাল অন্যদিকে আবার খুব খারাপ। বিশেষ করে সেই সব ক্ষেত্রে যেখানে সমন্বয়টাই সার্থকতার মাপকাঠি। অনেক কিছু মিললে-মিশলে তবেই এখানে সাফল্য লাভ করা যায়। অভিজিৎবাবুকে আলাদা ডেকে নিয়ে গিয়ে বললাম, ক্লাব ঘরের আড্ডায় নায়ক গান গাইছে। গানের ভাষায় সে বন্ধুকে রসিকতা করে বলছে রাম তোর বান্ধবী আছে, শ্যাম তোরও বান্ধবী আছে…যদু, তুই শালা বেঁটে বামুন তোরও বান্ধবী আছে—মধু, তুই শালা, কানা শুদ্দুর, তোরও বান্ধবী আছে, হরি, তুই শালা হ্যাংলা রোগা—তোরও বান্ধবী জুটেছে। আর আমার? একলা আমার বেলাতেই টু টু কোম্পানি? কেউ নেই কিছু নেই? চিত্রনাট্যে এ সবের উল্লেখ না থাকলেও সিনটা ভেবে ঠিক এই অ্যাঙ্গেলে আমি গানটা লিখেছি। এই অ্যাপ্রোচটা মাথায় রেখে আপনি সুরটা বানিয়ে ফেলুন।
কথাটা শোনামাত্র অভিজিৎবাবুর সুগৌর মুখমণ্ডলে দেখতে পেলাম সলজ্জ হাসির উচ্ছ্বাস। উনি তৎক্ষণাৎ হারমোনিয়াম নিয়ে আবার বসলেন। মান্নাদার কণ্ঠে সুপারহিট হয়ে গেল ‘গোলাপের অলি আছে। ‘তিলোত্তমা’-তে আমাদের প্রতিটি গানই দারুণ জমেছিল। তার মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য মান্নাদা আর অরুন্ধতীর গাওয়া রং শুধু দিয়েই গেলে’। অরুন্ধতীর গাওয়া ‘খুব কি মন্দ হত…’ এবং আরতির গাওয়া ‘আমায় তোমার মতোই পাষাণ করে গড়’। শেষের দুটো গানই আমার অনুরোধমতো লেখার ওপর সুর করেছিলেন অভিজিৎবাবু। আরতির গাওয়া গানটির বাণী খুব পছন্দ হল। অনেক নাড়াচাড়া করেও কিছুতেই বাগে আনতে পারছিলেন না। হঠাৎ বলে উঠলেন, শুনুন তো। হেমন্তদার গাওয়া আর সুর করা আপনার লেখা ‘ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না’ গানটির স্টাইলে সুর করলে কেমন হয়? আমি শুনলাম। খুব ভাল লাগল। পরিচালক প্রযোজক সবাই শুনলেন। সবারই ভাল লাগল।
অভিজিৎবাবুর বলা ওই যে আমার লেখা হেমন্তদার ‘ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না’ স্টাইলের সুর ওই কথাটা নিয়ে আমাদের দুই বন্ধুর মধ্যে খুব আন্তরিকভাবে হাসি-ঠাট্টা হত। সেই হাসি ঠাট্টার ছলে ওঁকে একদিন বলেছিলাম অনুপম ঘটকের সুর হীরেন বসুর রচনা ‘প্রিয়ার প্রেমের লিপি লেখনী তরে’—এই স্টাইলেই তো আপনার সুরে শ্যামল মিত্রের ‘হংস পাখা দিয়ে’ গানটির জন্ম। ‘আনন্দ’ ছবিতে সলিলদার সুরে মান্নাদার গাওয়া ‘জিন্দেগী এই সা পহেলি’ এই স্টাইলেই তো আমাকে দিয়ে মান্নাদার জন্য লেখালেন ‘পৃথিবী তাকিয়ে দেখ/ আমরা দুজনে কত সুখী।’ আবার মান্নাদার সুরে আমার লেখা ‘রামধাক্কা’ ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘দেখনা আমায় ওগো আয়না’ গানটির স্টাইলেই তো গান বানিয়ে আপনি নির্মলা মিশ্রকে দিয়ে গাইয়েছেন ‘বলতো আরশি আমার মুখটি দেখে’।
বিরাট মনের মানুষ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। আমার এরকম ঠাট্টা মেশানো কথায় এতটুকু বিরক্তি বা আপত্তি প্রকাশ করেননি। আমার ধারণা অধিকাংশ সুর শিল্পীরা করতেন একমাত্র কালীপদ সেন ছাড়া। কালীদা প্রযোজক পরিচালককে জোর গলায় হাসতে হাসতে সবার সামনেই বলতেন, আপনারা কেউই বুঝতে পারলেন না আমি এ সুরটা কোনখান থেকে কার স্টাইল থেকে নিয়েছি। স্টাইল অর্থ অবশ্যই নকল করা নয়, অনুকরণ করা নয়। শুধুমাত্র অনুসরণ। সেজন্যই আমার উক্তি শুনে অভিজিৎবাবু আমাকে বলেছিলেন, আমি অনুজ হয়ে অগ্রজদের দেখানো পথেই এগিয়ে এসেছি। এটাই তো চলমান জীবনের ধর্ম। আপনার শুধু কান নয় প্রাণ আছে। আপনি ছাড়া একথা কেউই বলেননি। আজ থেকে আপনার ওপর আমার বিশ্বাসের মাত্রা আরও বেশি বাড়ল।
২৭
অভিজিৎবাবুর ব্যাপারে আশ্চর্যের ঘটনা হল অভিজিৎবাবুর সমকালীন অনেক সুরকারদের কপালে কত সংবর্ধনা জুটেছে। অথচ অভিজিৎবাবুর ভাগ্যে আজ পর্যন্ত কিছুই জোটেনি। যাই হোক অভিজিৎবাবু আর আমার জুটির আরও একটি ভাল কাজ পরিচালক অমল দত্তের ‘সন্ধি’। এ ছবিতে অনেক গান ছিল। প্রতিটি গানই ভাল হয়েছিল। বিশেষ উল্লেখ্য তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও হৈমন্তী শুক্লার ‘বাবা বুড়ো শিবের চরণে…’। মান্নাদার কাণ্ডারী গো পার কর’ এরকম আরও অনেক গান। কিন্তু এই ছবিতেই একটি গান নিয়ে গণ্ডগোল বাঁধল। এবার সেই গণ্ডগোলের ঘটনাটা বলি।
ছবিটির ছ’ নম্বর গানটি পিন্টু ভট্টাচার্যকে দিয়ে গাওয়ানো হবে এমন একটা অনুরোধ প্রযোজকদের তরফ থেকে করা হয়েছিল। আমরা আমাদের মনের মতো করে ছ’ নম্বর গানটি বানালাম। নির্দিষ্ট দিনে অভিজিৎবাবু গান শোনাতে লাগলেন প্রযোজক—পরিচালককে। ওঁরা পর পর পাঁচখানি গান আন্তরিকভাবে গ্রহণ করলেন। কিন্তু ছ’ নম্বর গানটি শুনে সরাসরি বললেন আমাদের পছন্দ হচ্ছে না। অন্য গান তৈরি করুন।
অভিজিৎবাবু কিন্তু কিছুতেই গান বদলাতে রাজি হলেন না। শেষে আমি ওঁদের বললাম, একটু সময় দিন। নতুন গান তৈরি করে খবর দেব।
ওঁরা চলে গেলেন।
অভিজিৎবাবুকে শান্ত করে বোঝালাম, ওঁরা আমাদের অতগুলো গানের প্রশংসা করলেন। মাত্র একটি গান বাদ দিয়ে। নিশ্চয়ই আমাদের কোনও খামতি আছে। যে খামতিটা আমরা বুঝতে পারছি না কিন্তু ওঁরা পারছেন। এঁরা বুঝতে পারছেন কিন্তু বোঝাতে পারছেন না। আসুন আর একটা গান বানাই।
বাণীচক্রের যে ঘরে ওঁরা গান শুনতে এসেছিলেন ওখানেই লিখলাম ‘আসা যাওয়ার পথের ধারে/ সুখের সাথে ভাব হল যে/ দুখের সাথে জানাশোনা হল/ আমাকে তোমরা সবাই/ পথের পথিক বোলো।’ এ গান যে শুনল তারই ভাল লাগল। পিন্টুর গলায় গানটিও হিট হয়ে গেল। এরপর আমরা করেছিলাম ‘পূজারিণী’ এবং আরও কয়েকটি ভাল গানের ছবি।
এখন একটু অন্য কথায় যাই। গানের সার্থকতার যদি পরিসংখ্যান নেওয়া যায় তা হলে সহজেই বোধগম্য হয় এক একটি বিশেষ জুটিতে যতটা সাফল্য লাভ হয়েছে, অন্য নতুন জুটিতে চট করে ততখানি সার্থকতা পাওয়া যায়নি। যেমন আজকের দিনেও নাদিম—শ্রাবণ ও সমীর জুটি বা আনন্দ-মিলিন্দ ও সমীর জুটি। সমীর ওঁদের ছাড়া অন্য কোনও সুরকারের গান লিখে ততখানি সার্থকতা দেখাতে পারেননি। ঠিক তেমনি নাদিম-শ্রাবণ এবং আনন্দ-মিলিন্দও ততখানি সার্থকতা দেখাতে পারেননি অন্য গীতিকারের গান নিয়ে। এই যে কম্বিনেশন একে ‘টিম ওয়ার্ক’ই বলুন বা ভাগ্যই বলুন এটা কিন্তু স্বীকৃত সত্য। কেন জানি না অভিজিৎবাবু ক্রমশ আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেলেন। আমার বলা উচিত নয় তবু বলছি, কিশোরকুমার গলা দিলেই যখন বাংলা গান হিট হচ্ছে। তখন অভিজিৎবাবু কিশোরদাকে দিয়ে গাইয়েও ‘মৌনমুখর’ ছবির একটা গানও হিট করাতে পারেননি। অথচ আর ডি বর্মণ, বাপি লাহিড়ির কথা নয় ছেড়েই দিলাম। কলকাতার সব সুরকারের সুরেই কিশোরদার গান তখন সুপারহিট। যেমন শ্যামল মিত্র, বীরেশ্বর সরকার, অজয় দাশ, মৃণাল ব্যানার্জি, কানু ভট্টাচার্য, গৌতম বসু সকলেরই সুরে গান হিট শুধু ওঁর ছাড়া।
এরপর অভিজিৎবাবুর মতো প্রতিভাবান সুরশিল্পী কী এক অজ্ঞাত কারণে বাণিজ্যিক গানের জগৎ থেকে নিঃশব্দে প্রস্থান করলেন। কিন্তু আমি জানি, বিশ্বাস করি আবার অচিরেই তিনি বাংলা গানের জগতে ফিরে আসবেন। আমি সেই শুভ দিনটির প্রতীক্ষায় আছি।
গানের জগতে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম পদক্ষেপ গোপেন মল্লিকের সুরে ‘বলো ভুলেছো কি মোরে ভুলেছো’ আধুনিক গানটি গেয়ে। তবুও কণ্ঠশিল্পী সতীনাথের ধ্যান-জ্ঞান ছিল সুরশিল্পী হওয়ার। সবাই জানেন পরবর্তীকালে সতীনাথ সুরশিল্পী ও কণ্ঠশিল্পী দুটোতেই সমান সাফল্য লাভ করেছিলেন। সতীনাথের প্রসঙ্গে পরে আসছি। এখন এই দ্বিমুখী ব্যাপারটায় আসি। এ ব্যাপারটা সাধারণত কলকাতার অনেক শিল্পীর মধ্যেই দেখেছি। কিন্তু মুম্বই-তে তেমন নয়। মুম্বই-তে হেমন্তকুমার ছাড়া কেউই পুরোপুরি এ কাজটা করেননি। এস ডি বর্মণ ও আর ডি বর্মণ, সি রামচন্দ্র, বাপি লাহিড়ি, অনু মালিক এরকম গাইতে জানা সুরকাররা কদাচিৎ সুর ও গান একসঙ্গে করেছেন। হেমন্তদা ছাড়া মুম্বই-এর এই সব সুরকাররা কেউই কিন্তু অন্যের সুরে একটাও গান গাননি। হেমন্তদাই সৌভাগ্যবান বা এক অর্থে স্বতন্ত্র যিনি এই ধরনের দ্বিমুখী কাজ করেছেন। অন্যের সুরে গেয়েছেন এবং নিয়মিত সংগীত পরিচালনাও করেছেন।
কে. এল. সায়গল, পঙ্কজ মল্লিক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কিশোরকুমার এবং প্রথম দিকে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রসংগীত এবং আধুনিক গানে সমানভাবে সার্থক। কিন্তু আবার অনেক আধুনিক গায়কই রবীন্দ্রসংগীত গাইতে গিয়ে সফল হননি। আবার সুচিত্রা মিত্র, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের মতো রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীরা আধুনিক গানের ক্ষেত্রে তেমন জনপ্রিয় হননি। তবুও সুচিত্রাদির গাওয়া সলিল চৌধুরীর ‘সেই মেয়ে’, রেকর্ডটি চলেছিল। কিন্তু কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায় আধুনিক গান তাঁর শ্রোতারা শুনতে পান না। কণিকাদি অল্প বয়সে একবার সম্ভবত নীহারবিন্দু সেনের, দুটি গানের একটি রেকর্ড করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেটা চলেনি। উনি যখন রবীন্দ্রসংগীতের এক অন্যতমা শিল্পী হয়ে গেছেন সেই উজ্জ্বল সময়ে এইচ. এম. ভি.-তে পি কে সেনের আমলেই মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সুরে শ্যামল গুপ্তের কথায় কণিকাদি একটি বাংলা আধুনিক গানের রেকর্ড করেন। রেকর্ডের স্যাম্পেল কপি বিভাগীয় কর্তারা সানন্দে অনুমোদন করেছিলেন। কিন্তু তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের তৎকালীন এক বিরাট কর্তা। কণিকাদি অর্থাৎ মোহরদি নিজে আমায় বলেছেন ওই অধিকর্তা ওঁকে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, মোহর, বেছে নাও তুমি কোন দিকে যাবে। তোমার দু নৌকোয় পা দেওয়া আমরা বরদাস্ত করব না। মোহরদি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আমায় বলেছিলেন, সাধ ইচ্ছে কার না থাকে। আমারও ইচ্ছে ছিল তোমাদের ওদিকটায় যোগ দেবার। এতে সাফল্য পাই বা না পাই সেটা অন্য ব্যাপার। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য তৎকালীন শান্তিনিকেতনের ওই কর্তার কথায় আমি আধুনিক গান রেকর্ড করেও সে গান কাউকে শোনাতে পারলাম না। কেউ জানতে পারল না আমি আধুনিক গান গাইতে পারি কি পারি না। এমন ঘটনা বোধহয় আমার জীবনেই ঘটল।
এই সেদিন কথাটা শুনতে শুনতে আজকের কণিকাদির পুরু কাচের চশমা পরা চোখের আড়ালেও দেখতে পেলাম চিক চিক অশ্রু লেখা।
যাক এবার আবার সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কথায় ফিরে আসি। বিখ্যাত প্রযোজক সরোজ মুখার্জির ‘মর্যাদা’ ছবিতে (এই ছবিতে উত্তমকুমার ‘অরূপকুমার’ নামে অভিনয় করেছিলেন।) সংগীত পরিচালক রামচন্দ্র পাল একজন সহকারী সুরশিল্পীর খোঁজ করেছিলেন। তার কাছে সহকারী সুরকার হিসাবে কাজ করার জন্য চুঁচুড়া থেকে সতীনাথকে নিয়ে এলেন গীতিকার শ্যামল গুপ্ত। তখনকার গানের জগতে এখনকার মতো সরাসরি ফ্রিল্যান্স মিউজিক ডিরেক্টর কেউই হতে পারত না। এবং আজকের মতো ফিন্যান্স আনতে পারলেই সরাসরি চিত্র পরিচালকও হওয়া যেত না। প্রত্যেককে বেশ কিছু দিন সহকারী হয়ে কাজ শিখে যোগ্যতা অর্জন করতে হত। ‘মর্যাদা’ ছবিতে আমার লেখা একটি গান আমাদের সকলের অনুরোধেই রামচন্দ্র পাল সতীনাথকে দিয়ে গাইয়ে ছিলেন। এটাই সতীনাথের প্রথম প্লে-ব্যাক। রামবাবুর পরবর্তী ছবি বোম্বের সুলোচনা চ্যাটার্জি ও প্রদীপকুমার অভিনীত বাংলা ‘অপবাদ’। আগেই বলেছি এই ছবিতে প্রথম আমার গান প্লে-ব্যাক করেন হেমন্তদা। এই ছবিতেও সহকারী সংগীত পরিচালক ছিলেন সতীনাথ। এর পরেই প্রযোজক সরোজ মুখার্জির সঙ্গে মতান্তর হতে থাকে সংগীত পরিচালক রামচন্দ্র পালের। সরোজদা সতীনাথ মুখোপাধ্যায়কে প্রথম ছায়াছবিতে সংগীত পরিচালনা করার সুযোগ দেন তাঁর পরবর্তী ছবি ‘অনুরাগ’-এ। অপূর্ব সুর করেছিলেন সতীনাথ। ইহুদি মেয়ে রমলাদেবী ছিলেন এ ছবির নায়িকা। চমৎকার অভিব্যক্তি দিয়ে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানগুলো চিত্রায়িত করেছিলেন রমলাদেবী। তবে নায়কের ঠোঁটে কিন্তু সতীনাথ গাননি। গেয়েছিলেন তখনকার জনপ্রিয় গায়ক তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়। গানটির কথা লিখেছিলাম ‘অভিমানী গেলে চলে/ বুক ভরা · অভিমানে/ আমার শুরুর পালা/ সারা হল অবসানে।’
ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োতে ওই প্রোডাকসনের অফিসঘরে সতীনাথকে গানটি দিয়েছিলাম। গান নিয়ে চলে গেলেন সতীনাথ। উনি তখন চুঁচুড়া ছেড়ে চলে এসেছেন কালীঘাটে। একটা মেসে বোধহয় চারজন বোর্ডারের সঙ্গে একটা ঘরে থাকতেন। বাকি সবাই অফিসে চাকুরি করেন। সারাদিনই ঘরটা খালি থাকত। সতীনাথ তক্তপোশের তলায় রাখা ছোট একটা হারমোনিয়াম বার করে বিছানায় রেখে আমাকে শোনালেন গানটির সুর। মুগ্ধ হয়ে গেলাম শুনে। বললাম দুর্দান্ত হয়েছে। সতীনাথ তখনই মেসবাড়ির কাজের লোককে ডেকে বললেন, এই বাবুর আমার সুর পছন্দ হয়েছে রে। যা যা এখনই বাবুর কাছ থেকে পয়সা নিয়ে লক্ষ্মীর দোকান থেকে চারটে খুচরো গোল্ডফ্লেক সিগারেট আমার নাম করে নিয়ে আয়। দেখিস যেন ড্যাম্প না লেগে থাকে।
কিন্তু এই গান খুব কম লোকই শুনল। কারণ ‘অনুরাগ’ ছবিটি দর্শক নেয়নি। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য।
এর পরে এল সতীনাথের জীবনের সেই সন্ধিক্ষণ। সেবার কলকাতাতেই রাজ্যপালের একটা সাহায্য তহবিলের জন্য সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। যখন লতা মঙ্গেশকরের গানের অনুষ্ঠানের পর স্থানীয় কোনও নামী শিল্পীই গান শোনাতে সাহস করছিল না তখনই উৎপলা সেনের আন্তরিক প্রেরণায় প্রায় অনামী কণ্ঠশিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায় নির্ভয়ে মঞ্চে এসে মাইকের সামনে বসলেন। সিনেমার তথাকথিত গানের সিচুয়েশনের মতো সেদিনের অনুষ্ঠানেই রাতারাতি সতীনাথ হয়ে উঠলেন অনন্য কণ্ঠশিল্পী। পেয়ে গেল অনন্ত আত্মবিশ্বাস। আর আরও প্রাণের কাছে পেয়ে গেলেন অনুপ্রেরণাদাত্রী উৎপলা সেনকে।
সারা ভারতবর্ষের গানের জগতের যদি পরিসংখ্যান নেওয়া যায় তবে বোধহয় সহজেই প্রমাণিত হবে, যে পুরুষ শিল্পী তার প্রথম পরিণয়ে গ্রহণ করেছেন অন্যপূর্বাকে। সেই শিল্পী আজীবন রয়ে গেছেন পুরোপুরি ‘সিঙ্গল উওম্যান ম্যান।’ এমন কিছু উদাহরণ, কিছু নজির হাতের কাছেই আছে। যেমন জগজিৎ সিং, যিনি স্ত্রী ছাড়া জীবনে বোধহয় অন্য নারীর মুখটাও ভাল করে দর্শন করেননি। সতীনাথ কিন্তু এ ব্যাপারে আরও বিরাট আরও বিশাল দৃষ্টান্ত। এবং আরও বিরাট উদাহরণ দিকপাল শিল্পী মান্না দে।
সিনেমার পর্দায় যেমন উত্তম-সুচিত্রা পাশাপাশি উচ্চারিত হয় তেমনি গানের জগতের বাস্তব জীবনেও পাশাপাশি উচ্চারিত দুটি নাম সতীনাথ-উৎপলা। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সতীনাথের এই দিকটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেল যে লতা মঙ্গেশকরের প্রথম সুপারহিট আধুনিক বাংলা গান ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে’ এবং সুপ্রীতি ঘোষের ‘যেথায় গেলে হারায় সবাই’ ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘স্বপ্নভরা অন্ধকারে’-তে সুর সংযোজনা করার পরেই বলে দিলেন সতীনাথ, উৎপলা সেন ছাড়া অন্য কোনও মহিলা শিল্পীর গানে সতীনাথ আর সুর করবে না। সত্যি এ একটা অভিনব ব্যাপার। এবং এই নিয়েই এইচ. এম. ভি.—র সঙ্গে ওঁর প্রথম মন কষাকষির শুরু।
তখন সতীনাথের সুরে আমি নিয়মিত গান লিখতাম বেতারে পরিবেশনের জন্য। সতীনাথ নিজে এবং ওঁর প্রিয় বহু ছাত্ররা ও বহু নামী পুরুষ কণ্ঠশিল্পীরা সে সব গান নিয়মিত বেতারে পরিবেশন করত। মহিলা কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে সে সব গান গাইতেন শুধুমাত্র একজন। তিনি উৎপলা সেন। রেডিয়োর জন্য বানানো সে সব গানগুলো থেকেই পরে বাছাই করা হত রেকর্ডের জন্য গান। এবং ওই বাছাই করা গানগুলি কেবল রেকর্ড হত। রেডিয়োকে ভীষণ ভালবাসতেন সতীনাথ। এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে হাসতে হাসতে উত্তর করতেন, চিন্ময় লাহিড়ীর ছাত্র হয়েও পাঁচবার রেডিয়োর অডিশনে ফেল করে তারপর পাশ করে আমি রেডিয়োতে ঢুকেছি। একদম এর শেষ দেখে যাবরে।
সতীনাথের সুরে এবং কণ্ঠে আমার লেখা প্রথম আধুনিক গান কারে আমি এ ব্যথা জানাবো।’ এই গানটির কথা আগেই বলেছি। ইংরাজি সেভেন এইট বিটে অর্থাৎ তেওড়া তালে চমৎকার সুর করেছিলেন সতীনাথ। গানটি প্রকাশিত হয়েই তখনকার এইচ. এম. ভি.-র ভয়েস পত্রিকায় টপ সেলার হিসাবে উল্লেখিত হল। তারপর আমাদের কত গান যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে তা বলে শেষ করতে পারব না। তার মধ্যে আমার নিজের প্রিয় কিছু গান উল্লেখ করছি। যেমন ‘আজ মনে হয় এই নিরালায়’ দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘তুমি এলে কি আমার ঘরে’ এবং ‘যেদিন তোমায় আমি দেখেছি’। শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘এত যে শোনাই গান তবু মনে হয়।’ এ ছাড়া আমার বিশেষ পছন্দের গান সতীনাথেরই নিজের সুরে গাওয়া ‘দুটি জলে ভেজা চোখ’, ‘যশের কাঙাল নইতো আমি’ এবং ‘যদি সহেলী আমায় কানে কানে কিছু বলে’। ‘এমন অনেক কথাই বলো তুমি/ মন থেকে যা বলো না।’ এরকম আরও প্রচুর গানের কথা আমার মনে পড়ছে।
২৮
‘অনুরাগ’ ছবির পর সতীনাথ ‘ভাগ্য চক্র’ ছবিতে সুর দিয়েছিলেন। এ ছাড়া আর কোনও ছবিতে সুর দিয়েছিলেন কি না সে কথা মনে আসছে না। খুব কম ছবিতেই প্লে-ব্যাক করেছিলেন সতীনাথ। প্রায় অখিলবন্ধু ঘোষের মতো সতীনাথও কিন্তু সারা জীবন নন-ফিল্মি গান শুনিয়েই শেষ দিন পর্যন্ত জনপ্রিয়তার শিখরে কাটিয়ে গেলেন যথেষ্ট গৌরব এবং মর্যাদার সঙ্গে।
আগেই বলেছি, সতীনাথ-উৎপলা প্রায় একই সঙ্গে উচ্চারিত এই দুটি নামের কথা। এবার একটা নগ্ন সত্যকে জনসমক্ষে উন্মোচন করছি বন্ধু সতীনাথের ভালবাসার প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জানিয়ে। প্রত্যেক শিল্পীরই ওঠা-নামার সময় থাকে। দু-একজন ছাড়া জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কেউই সমান জনপ্রিয় থাকতে পারেননি। বহু শিল্পীর জীবনে এটা বাস্তব সত্য। এই সত্যকে না মেনে উপায় নেই। উৎপলা সেনেরও এক সময় রেকর্ডের বিক্রি ক্রমশ কমে এল। সেই কারণেই এইচ. এম. ভি. উৎপলা সেনের রেকর্ড আর করতে চাইলেন না। সতীনাথ ওঁদের অনেক বোঝালেন। কিন্তু ওঁরা কিছুতেই রাজি হলেন না। সতীনাথকে ওঁরা বললেন, আপনার বিক্রি দারুণ। আপনি রেকর্ড করে যান। আপনাকে সবিনয়ে অনুরোধ জানাচ্ছি আমাদের প্রতিষ্ঠানে থেকে আপনি পর পর রেকর্ড করুন।
এই কথা শুনেই দপ্ করে জ্বলে উঠল সতীনাথের ভালবাসার আগুন। সতীনাথ বললেন, না, এইচ. এম. ভি. ছাড়লে শুধু উৎপলা নয় আমিও ছাড়ব। সেদিন এক কথায় শুধু ভালবাসার খাতিরে তখনকার এইচ. এম. ভি.-র মতো অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান থেকে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে এলেন সতীনাথ। দুজনে একসঙ্গে যোগদান করলেন মেগাফোন কোম্পানিতে। এ ধরনের নিখাদ ভালবাসা কোনও শিল্পীর মধ্যে আমি আজ পর্যন্ত খুঁজে পাইনি।
ঘটনাটা যখন আমার কানে এল, চোখের ওপর ভেসে উঠল সতীনাথের মুখটা। সেই মুখের ওপর সিনেমার মতো ওভারল্যাপ করতে লাগল সতীনাথেরই সুরে উৎপলা সেনের গাওয়া আমার রচিত একটি গান। ‘গানে গানে কতবার এই কথা কয়েছি/ আমরা দুজনে শুধু দুজনার/ এই গান শুনে ওরা দিয়ে গেছে অপবাদ/ হাসিমুখে তাই আমি সয়েছি।’
উৎপলাদি কিন্তু আমার কাছে এক স্বতন্ত্র সত্তা। সারা সকাল এখানে ওখানে ঘুরে দুপুরে ওঁর কেয়াতলার বাড়িতে অথবা পরবর্তীকালে সাউথ এন্ড পার্কের বাড়িতে যখনই হাজির হয়েছি তখনই বলেছি, চা দিন। একান্ত মমতাময়ীর মতো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছেন, পুলক, তোমার খাওয়া হয়েছে? ধরা পড়ে গেছি উৎপলাদির কাছে। পরম পরিতৃপ্তিতে খেয়েছি ওঁর রান্না কতদিন কত বার। বিকেলের দিকে হঠাৎ বলেছেন, চলো, তোমার গাড়িতে একটু ঘুরে আসি। সতীনাথের গাড়িতে তো রোজই চাপছি।
কপট চোখে সতীনাথের দিকে তাকিয়ে বলেছেন, সতীনাথ তুমি থাকো। আমরা ঘুরে আসছি। সতীনাথ হাসিমুখে বলেছেন, বেশ তো। বিকেলে লেকের ধার দিয়ে ঘুরেছি বোধহয় পাঁচ বা ছ’ মিনিট। তার মধ্যে দুবার আমায় ধমকেছেন ও মেয়েটার দিকে অমন করে তাকিয়ো না। সোজা গাড়ি চালাও। অ্যাকসিডেন্ট করবে। আবার আর একটি মেয়ের বেলায় বলেছেন, ধুস, ও তো বুড়ি। ওভাবে দেখলে কেন? তারপরই বলে উঠেছেন, চলো সতীনাথ বোধহয় আমাদের চা তৈরি করে ফেলেছে। আর দেরি করলে জুড়িয়ে যাবে। এমনই ছিল আমাদের দিন। এই উৎপলাদিই কিন্তু বদলে যেতেন যখন সতীনাথ আর উৎপলার জন্য পুজোর গান লিখতাম।
কিছু না ভেবেই কীসের তাগিদে কী কারণে জানি না প্রতিবারই প্রথমে লিখতাম সতীনাথের গান। দুটো গান যখন তৈরি হয়ে যেত স্বাভাবিকভাবেই আমরা খানিকটা ভরসা খানিকটা উদ্বেগ নিয়ে হঠাৎ উপস্থিত কোনও কোনও স্বজনবন্ধুকে শোনাতাম। তারিফ করতেন ওঁরা। অনেক কমে আসত উদ্বেগ। তারপর বসতাম উৎপলাদির গান নিয়ে। মনের মতো দারুণ একটা গান লিখলাম। চমৎকার সুর করলেন সতীনাথ। গানের ঘরে কেউ যদি ঢুকত শুনে ভাল বলতে বাধ্য হত। কিন্তু যাঁর গান তাঁর মতামত নিতে গিয়ে সবিস্ময়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতাম তিনি গানের ঘরে নেই। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সতীনাথের মুখের দিকে চাইতেই উনি ইশারা করে বুঝিয়ে দিতেন ছাদে আছে। যেতাম ছাদে। দেখতাম লেকের হাওয়ায় চুল উড়িয়ে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছেন শিল্পী। অস্ফুট স্বরে বলতে হত, কী হল।
হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠতেন তিনি। বলতেন, তোমাদের সবাইকে আমি জানি। তোমরা দারুণ ভাল লেখ সবাই সতীনাথের গান। আমার গানে একটুও নজর দাও না। এইমাত্র সতীনাথের যে গানটা তুমি লিখলে এক কথায় অপূর্ব। কিন্তু আমি জানি আমার গান অত ভাল তুমি লিখবে না।
আমি বলতাম, কী আজেবাজে বলছেন, নীচে চলুন। গান শুনুন। তারপর তো বলবেন? ‘এক হাতে মোর পূজার থালা’, ‘বনফুল জাগে পথের ধারে’, ‘দূরে গেলে মনে রবে না জানি’, ‘হরিনাম লিখে নিয়ো অঙ্গে’–এই রকম অজস্র সুপারহিট গানের গায়িকা উৎপলাদির চোখের জল মোছাতাম তাঁরই আঁচল দিয়ে। হঠাৎ দু চোখের কোনায় আগুন জ্বলে উঠত উৎপলাদির। বলে উঠতেন, সতীনাথ আমার স্বামী হতে পারে। আমি ওকে বা ও আমাকে প্রাণ ভরে ভালবাসতে পারে। কিন্তু কমার্শিয়াল জগতে থেকে আমি কিছুতেই চাইব না কেউ আমার থেকে ভাল গান গেয়ে যাক। কারও গান আমার থেকে ভাল হোক এটা আমি কিছুতেই বরদাস্ত করব না। এ ব্যাপারে আমি প্রচণ্ড স্বার্থপর। আমি আমার একান্ত আপন সতীনাথকেই সহ্য করব না। তোমরা, সতীনাথের বন্ধুরা আমার নামে যা খুশি বলতে পার। আমি পরোয়া করি না।
অকপটে সত্য কথা বলা, এক অদ্ভুত শিল্পীর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার আর কিছু করার থাকত না। বোধহয় সেই কারণেই প্রত্যেকবারই যে গানই লিখি না কেন সতীনাথ বা অন্য সবার দারুণ পছন্দ হলেও ওঁর কিছুতেই পছন্দ হত না। যতদূর মনে পড়ছে দুবার এর ব্যতিক্রম হয়েছিল। একবার এইচ. এম. ভি.-তে যখন লিখেছিলাম আজ থেকে সেই অনেক দিনের পরে/ এমনি করে বকুল যদি ঝরে/ সেদিন তুমি থাকবে তো/ আমায় মনে রাখবে তো?’
উৎপলাদি গান শেষ হতে আমাকে এলিট সিনেমায় নিয়ে গিয়ে সিনেমা দেখিয়েছিলেন।
সতীনাথ দারুণ গ্রীষ্মকালে এয়ারকন্ডিশনের ভয়ে গরম শাল জড়িয়ে সিনেমায় ঢুকেছিলেন।
আর একবার মেগাফোনে সুধীন দাশগুপ্তের সুরে যখন লিখেছিলাম ‘ছোট্ট একটা দুষ্টু মেয়ে নামটি সোনালি’। গানটা শুনেই বলেছিলেন, চলো, আজ পার্ক স্ট্রিটে ডিনার খেতে যাব। ফোন করে তোমার পতিব্রতা সুন্দরী বউকে বলে দাও বাড়িতে খাবে না।
প্রায়ই সতীনাথ ওঁর পছন্দ হবে না মনে করে ওঁর পুজোর গান তৈরি করতে চাইত না। একবার পুজোয় বরং ওঁরই সুরে সতীনাথ গেয়েছিলেন আমার গান ‘শুধু তোমার জন্যে ওই অরণ্যে পলাশ হয়েছে লাল’।
অনেকবারই সতীনাথ নিজের সুরে নিজের গান বানিয়ে উৎপলাদির গানের জন্য অনুরোধ করতেন অন্য সুরকারদের। তাই মান্না দের সুরে লিখেছিলাম ‘আমি ভুল তো করিনি ভালবেসে/ ভুল যে করেছি ভালবাসা আশা করে।’
শ্যামল মিত্রের সুরে লিখেছিলাম ‘মেঘ এসেছে আকাশে।’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে লিখেছিলাম, ‘এ আমার কি যে হল।’
সতীনাথের সুরে আমার লেখা এবং উৎপলাদির গাওয়া গানের মধ্যে সব থেকে প্ৰিয় গান আমার ‘তুমি কত সহজেই ভুলে গিয়েছো আমায়।’
সার্থক সুরশিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায় বাধ্য হয়ে একবার নচিকেতা ঘোষকে অনুরোধ করেছিলেন দুজনারই গান তৈরি করতে। সেবার সতীনাথের জন্য নচিবাবুর সুরে লিখেছিলাম ‘সূর্যমুখী আর সূর্য দেখবে না’ এবং ‘কিছু কালিই না হয় লাগল গালে/ ব্যস্ত হাতে কাজল চোখে পরাতে/ নতুন ক্ষতি কি হবে আর কলঙ্কিনীর বরাতে?’
উৎপলাদির জন্য লিখেছিলাম ‘কিংশুক ফুল হিংসুক ভারি’। আর একবার উৎপলাদির জন্য অলকনাথ দে-র সুরে লিখেছিলাম, ‘পাখিদের এই পাঠশালাতে’। আজ সতীনাথ নেই। উৎপলা একা—দারুণ একা। যতই জোর করে মুখে হাসি এনে কথাবার্তা বলুন। কিন্তু আমি জানি, এই নিঃসঙ্গতা আকাশের মতো অনন্ত-অসীম।
কিশোরকুমার, কুমার শানু, বাপি লাহিড়ি, সুধীন দাশগুপ্ত এবং বিশেষ করে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং মান্না দে শেষের যে দুটি স্তম্ভের উপর আমার গীতিকার জীবনের প্রতিষ্ঠা তাঁদের কথা পরে বলব। কিন্তু এখনও বলিনি তাঁদের কথা, যাঁরা না থাকলে আমি হয়তো গান লেখার উদ্দীপনা বা উৎসাহই পেতাম না। আমার স্মৃতিতে তাঁরা এখনও উজ্জ্বল। এঁদের মধ্যে একজন উমাশঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। যাঁর কাছে প্রায় নিয়মিতই গান শিখতেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। আর একজন উমাশঙ্করবাবুর ছাত্র হিমাংশুশেখর ঘোষ। আমার ভাইঝি পরবর্তীকালে কমল দাশগুপ্তের সুরে ও প্রণব রায়ের কথায় এইচ. এম. ভি.-র গায়িকা সবিতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে (মুখোপাধ্যায়) গান শেখাতে আসতেন ওঁরা দুজনেই। স্কুলের ক্লাশ। নাইনে পড়া তথাকথিত ডেঁপো ও পাকা ছেলে আমি ভয়ে ভয়ে উমাশঙ্করবাবুর হাতে তুলে দিয়েছিলাম আমার লেখা একটি আধুনিক গান—’জীবন নদীর মাঝখানে জাগে, ভাললাগা বালুচর/ ভুলবোঝা এক জোয়ারের টানে/ মুছে যায় তারপর।’
উমাশঙ্করবাবু বিরক্তি প্রকাশ করে গানটি গ্রহণ করলেন। পড়লেন। বললেন, লিখেছ তো ভালই। পরশু ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে আমার একটা অনুষ্ঠান আছে। গাইব এটা। তুমি এসো। গান লেখার প্রচণ্ড উৎসাহদাতা আমার পাড়ার আবাল্য সুহৃদ, অধুনা নামী ডাক্তার শৈলেন চট্টোপাধ্যায়কে পর্যন্ত বলিনি ব্যাপারটা। গাইবেন বলে যদি উনি না গান। তাই একাই গেলাম অনুষ্ঠান শুনতে। উমাশঙ্করবাবু গাইলেন আমার গান। গীতিকারের নাম বলেননি। কেউই জানলেন না এ গান কার লেখা। কিন্তু আমি তো জানলাম। শিরায় শিরায় সে কী উদ্দীপনা। হৃৎপিণ্ডে সে কী ধ্বনি, উল্লাস। চোখের চেনা বহু দেখা প্রেক্ষাগৃহটা মনে হতে থাকল বিরাট এক আনন্দের সমুদ্র। উত্তাল তার তরঙ্গ। শুধু ঢেউ আর ঢেউ। আমি যেন তার মাঝে ডুবে গেলাম।
এ গানটা শুনেছিলেন হিমাংশুবাবু। তিনি আমায় প্রেরণা দিতে লাগলেন। বন্ধু শৈলেন আর হিমাংশুবাবুর তাগাদায় ওই স্কুলের ছাত্রজীবনেই তৈরি হয়ে গেল একটা গানের সংকলন। হিমাংশুবাবুর সুর স্বরলিপিতে সেই বইটির নাম হল আধুনিকা। যদিও এর একটি গানও রেকর্ড হয়নি। কিন্তু বেতারে প্রায় সব কটি গানই পরিবেশিত হয়েছিল। গাইত আমাদেরই এক বন্ধু পরবর্তীকালে বিখ্যাত শিল্পী সনৎ সিংহ। অবশ্য তখনই তার প্রথম রেকর্ডের গান নচিকেতা ঘোষের সুরে ‘কালনাগিনীর কাল মাথার মণি’, ‘আমার ঝুমুর ঝুমুর নাচ’ হিট হয়ে গেছে। সনতের কথামতোই ক্লাস টেনের ছাত্র আমি পঁচিশটি আধুনিক গান শৈলেনকে দিয়ে কপি করিয়ে পাঠিয়ে দিলাম রেডিয়োতে। কিছুদিনের মধ্যে উত্তর এল আমি রেডিয়োর অনুমোদিত গীতিকার হয়ে গেছি। রেডিয়ো আমায় ডাকল চুক্তি করার জন্য।
২৯
প্রায় কিশোর বয়সে আমি রেডিয়ো থেকে গীতিকার হওয়ার আমন্ত্রণ পাই। রেডিয়ো অফিসে যাবার পর এক ভদ্রলোক আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অনেকগুলো কাগজে আমাকে সই করিয়ে নেন। আমি জানতে পারলাম রেডিয়োতে কোনও শিল্পী যখনি আমার লেখা গান গাইবেন তার জন্য প্রতি রডকাস্টিং-এ আমি পারিশ্রমিক পাব চার আনা। এখন হয়তো অনেক বেশি পাচ্ছি কিন্তু তখন ওই চার আনা একসঙ্গে যোগ হয়ে যখন তিন মাস অন্তর সতেরো টাকা বা একুশ টাকা আমায় এনে দিত তখন কী যে আনন্দ পেতাম তা এখন আর ভাষায় বোঝাবার শক্তি আমার নেই।
তখন কিছুদিন হিন্দি গানের ভার্সানে বাংলা গান গাওয়ার খুব প্রচলন হয়েছিল। ‘আয়েগা আনেবালা’র সুরে ধনঞ্জয়বাবুর ‘শোন গো শোন গো প্রিয়তম শোন গো’। গায়ত্রী বসুর ‘কোন দূরের বনের পাখি বারে বারে আমায় ডাক দেয়’ ইত্যাদি গান খুবই জনপ্রিয় হয়। তখন আমি লিখেছিলাম তদির সে বিখ্রে হুয়ে’—সুরে ‘স্বপ্নেরই লগ্নে কে স্বপন রাঙালে’। সনৎ সিংহ যেদিন গানটি রেডিয়োতে গাইল সেদিনই তোলপাড় হয়ে গেল সব রকমের শ্রোতাদের মন। কিন্তু সে সময় লতা মঙ্গেশকরকে বলতে শুনেছিলাম কলকাতায় এত ভাল সুরকার এত ভাল গীতিকার থাকতে আমার গাওয়া হিন্দি গানের সুরে বাংলা গান কেন গাইছেন সবাই? বাঙালির হল কী?
কথাটা শুনেই আমরা অনেকেই কলম নামিয়ে ফেলেছিলাম। আর একবার এই ঘটনার অনেক দিন পরে সনতের পুজোর গান লিখতে গেলাম শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের সুরে। সেদিন সুরকার ও শিল্পী শৈলেনের দেশপ্রিয় পার্কের বাড়ির কাছেই কোনও বিয়েবাড়ি ছিল। সনৎকে বললাম, শৈলেন আর আমার দুজনেরই ঘটকালির বিয়ে, বিয়ের সানাই শুনলেই দুজনেই কেমন যেন উদাস হয়ে যাই। তুই তো প্রেম করে বিয়ে করেছিস। তোরও কি তাই হয়? সনৎ বলল, থাম তো তুই। বরং এই সাবজেক্টটা নিয়ে আমার জন্য গান লেখ।
সনতের আইডিয়াটা ভাল লাগল। লিখে ফেললাম ‘ক’ বছর আগের সে রাত মনে করো না/ তুলে রাখা বেনারসীটা পর না।’ সঙ্গে সঙ্গে সুন্দর সুর করল শৈলেন। সনত্ত খুব ভাল গাইল। খুবই জনপ্রিয় হল রেকর্ডটি। আর সব থেকে খুশি হল সনৎ পত্নী রাধাদেবী। সনৎ হেমন্তদার সুরে আমার লেখা ‘মান করে নয় রাগ করে আজ চলে গেলেন রাই’ গেয়েছে ‘হংসমিথুন’ ছবিতে।
আমার অনেক ভাল ভাল ভক্তিগীতিও দারুণ ভাল গেয়েছে বিভিন্ন রেকর্ডে। আর গেয়েছে ছোটদের গান।
ছোটদের গানেই ও কিন্তু বেশি জনপ্রিয়। আমার লেখা—আমার প্রিয় ছোটদের দুটি গান মনে পড়ছে। একটি-’এসেছে সার্কাস’ আর একটি ‘ম্যাজিক।’ দুটো গানই রতু মুখোপাধ্যায়ের সুরে সৃষ্টি! ওর বন্ধুবান্ধবরা তাই ওকে চাইল্ড স্পেশালিস্ট’ বলে ডাকে। সনৎ হাসতে হাসতে জবাব দেয়, এই চাইল্ড স্পেশালিস্টের ফিজ বা রেট কিন্তু একটু বেশি।
আর একজনের নাম মনে পড়ছে। আমার পাড়ার লোক বিনয়দা। অর্থাৎ বিনয় অধিকারী। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের খুবই কাছের লোক। আমার লেখা শ্যামাসংগীত প্রথম গেয়েছিলেন রেডিয়োতে। হিন্দুস্তান এবং কোহিনুর রেকর্ডে গেয়েছেন আমার অনেক গান। ওঁর হিট গান ‘গুনগুনিয়ে যাও হে ভ্রমর কোথায় বলে যাও’। অনেক ছবিতেও নেপথ্যে কণ্ঠ দিয়েছেন।
কত সহজ সরল মানুষ ছিলেন সে যুগের এই সব শিল্পীরা। প্রকৃতই ভালবাসতেন গান শোনাতে। যে কোনও অনুষ্ঠানে যখনই কেউ ডাক দিতেন হাসিমুখে আসতেন। আজকের তথাকথিত শিল্পীদের মতো প্রথমেই পয়সা নিয়ে দরাদরি করতেন না। অনুষ্ঠানের পর যে খামটি দেওয়া হত তাই নিয়েই খুশি মনে বাড়ি গিয়ে খুলে দেখতেন কে কী দিয়েছে। কোনও অনুযোগ কোনও অভিযোগ কারও বিরুদ্ধে কখনও করেননি। তাই আজকাল আনাচে কানাচে তথাকথিত বড়লোক শিল্পীকে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না কোনও বড়মাপের মনওয়ালা শিল্পীকে।
এই প্রসঙ্গে আরও একজনের কথা মনে পড়ছে। তার নাম ধীরেন বসু। বিখ্যাত সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী শচীন গুপ্তের শ্যালক হলেও শচীনবাবুর মাধ্যমে নয়, আমার ভাগ্নে ভবানীপুরের সুনীল চক্রবর্তীর মাধ্যমে ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ। তখন আধুনিক গান গাইত ধীরেন। প্রায়ই আমার কাছে গান নিত রেডিয়োতে গাইবার জন্য। বেতারে নিয়মিত পরিবেশন করত আমার গান। কিন্তু আধুনিক গানে নাম করতে পারল না। নাম করল ওর যৌবনে নয়, প্রায় উত্তর যৌবনে নজরুলগীতি গেয়ে। কিন্তু নাম করলে কী হবে স্বভাবটা আজও পাল্টাতে পারল না। আমাদের দেখা হলে সে আগেকার আড্ডাটা আজও নতুন করে তেমনি জমজমাট হয়ে যায়।
আর একজন তার নাম মৃণাল চক্রবর্তী। প্রথম আলাপ থেকেই গাঢ় বন্ধুত্ব হয়ে যায় আমাদের মধ্যে। গানে এবং সুরে খুবই যখন নাম তখন আমার কিছু গান খুবই ভাল গায়। আমি দেখলাম রোমান্টিক গানেই ওর স্বাচ্ছন্দ্য বেশি।
শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের সুরে আমার দুটি গান আজও ভুলতে পারিনি। যেমন দু হাতে আর এনো না/ কণক চাঁপার ফুল তুলি/ ভেবে মরি/ ফুল নেব কী নেব তোমার কণক চাঁপা অঙ্গুলি’। আর একটি ‘ভুলে থাকা কথা ছিল তোমারই আমার তো নয়’।
জয়ন্ত ভট্টাচার্য অগ্রগামী গোষ্ঠীর অর্থাৎ কালুদার খুবই আপন জন। আমার খুবই শুভানুধ্যায়ী ও বন্ধু। অগ্রগামীর সুপারহিট ছবি ‘সাগরিকা’ ও ‘শিল্পী-তে সুর দিয়েছিলেন রবীন চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু ‘ডাক হরকরা’ ছবি থেকে কালুদা নিয়ে এলেন সুধীন দাশগুপ্তকে। কালুদার ‘নিশীথে’ এবং ‘কান্না’ পর পর দুটো ছবিরই সুরকার ছিলেন সুধীন দাশগুপ্ত। ‘শঙ্খবেলা’-তেও সুধীন দাশগুপ্তকেই নিলেন। ‘কান্না’-র পর থেকেই জয়ন্ত যখন তখন আমায় বলত, সুধীনবাবুকে কেন গান দিচ্ছ না। অপূর্ব সুর করেন উনি।
আমি বলেছিলাম, মানলাম। কিন্তু উনি যদি না ডাকেন তবে আমি যাই কী করে।
শেষটায় জয়ন্তর পীড়াপীড়িতে বোধহয় সুধীনবাবু আমায় ফোন করলেন। বসলাম ওঁর সিঁথির বাড়িতে। ওঁর হারমোনিয়াম বাজানো শুনেই ওঁর প্রেমে পড়ে গেলাম আমি। বললাম কথাটা। খুব রসিক ছিলেন উনি। অবশ্য খুব কম কথা বলতেন। শুধু বললেন, দাস ফার নো ফারদার। গানের খাতা সঙ্গে ছিল দেখাতে গেলাম। বললেন, প্লিজ, না সুরের ওপর লিখুন। নতুন ছন্দ দিয়ে।
তাই করতে হল। সুর শুনে লিখতে শুরু করলাম গান। কিন্তু দেখলাম সুধীনবাবু, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, বাপি লাহিড়ি বা আর ডি বর্মণ নন। ওঁর সুরের একটা ‘নোট’-ও উনি একটুও এদিক ওদিক করতে দেবেন না। যে ওজনে উনি সুর দেবেন ঠিক সেই ওজনে কথা দিতে হবে। এতটুকুও কম্প্রোমাইজ করবেন না।
আমারও জেদ সাংঘাতিক। অসম্ভব মনের জোর এসে গেল আমার। সুধীনবাবু ঠিক যা ‘মিটার’ দিলেন হুবহু সেই মিটারেই আমি লিখতে লাগলাম। শেষটায় হাসি ফুটল ওঁর।
বললেন, ঠিক হয়েছে।
লিখলাম ওঁর সুরে আমার প্রথম গান ‘চাঁদের আলোয় রাতের পাখি কী সুর শিখেছে/ তারায় তারায় ওই যে আকাশ কী গান লিখেছে।’
এ গানটি পুজোয় এইচ. এম. ভি.-তে রেকর্ড করল বন্ধুবর শৈলেন মুখোপাধ্যায়।
এরপর আমি বুঝে নিলাম সুধীন দাশগুপ্তকে। বুঝে নিলাম ওঁর স্টাইলকে। হয়ে গেল আমাদের টিউনিং। যতদূর মনে আসছে এরপরে লিখেছিলাম তারাশঙ্করের ‘মঞ্জরী অপেরা’র গান।
এরপরে এল শঙ্খবেলা’ ছবিতে একসঙ্গে কাজ করার যোগাযোগ। পরিচালক অগ্রগামীর কাছে চিত্রনাট্য শুনেই আমি সুধীনবাবুকে বললাম, এত চমৎকার রোমান্টিক গানের সিচুয়েশন সচরাচর হয় না। সুধীনবাবু, প্লিজ আমি এ ছবির গান সুরের উপর লিখব না আমার লেখার উপরে আপনি সুর দেবেন। অবশ্য একেবারে ভিন্ন ধরনের ছন্দ দেব। সুধীনবাবু একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, বেশ তাই হবে।
জীবনে সব থেকে কম সময়ে যে গানটা আমি লিখেছি সেটি হল ‘মণিহার’ ছবির ‘নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখিরা বুঝিবা পথ ভুলে যায়।