কথায় কথায় রাত হয়ে যায় – ১৫

১৫

বিধায়ক ভট্টাচার্য অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। ওই খাটো মানুষটি দারুণ নাটক লিখতে জানতেন—জানতেন দারুণ সংলাপ, দারুণ অভিনয়— আর জানতেন দারুণ ভালবাসতে। ওঁর সঙ্গে প্রথম আলাপ আমার একটি গীতিনাট্যে। উনি সেদিন সভাপতি হয়ে এসেছিলেন। আমার প্রণামের উত্তরে উনি বলেছিলেন—তোর নাম আমি শুনেছি। তোর গান তো কাজে লাগাবই, তোর নামটাও কাজে লাগাব। লাগিয়েও ছিলেন। ওঁর রাজবংশী উপন্যাস যখন সিনেমায় ‘ঢুলি’ হয়ে এল সেখানে একটি প্রধান চরিত্রের নাম দিয়েছিলেন—পুলক।

বিধায়কদা তখন থাকতেন হাওড়ায়। কিন্তু কেউ-ই ওঁকে সময়মতো লেখাতে পারত না। মনে আছে—পাড়ার বন্ধু মুণ্ডি ও বিনু ভাই (প্রযোজকরা) ওদের ‘অসমাপ্ত’ ছবির সময় ওঁকে আমাদের পাড়ায় রীতিমতো নজরবন্দি করে রেখেছিলেন। লিখতে লিখতে হঠাৎ ‘আসছি’ বলে বিধায়কদা উধাও হয়ে যেতেন। ঘণ্টা দুয়েক বাদে ফিরে এসে কোনও কোনও দিন বলতেন—তোদের সালকিয়ার হরগঞ্জবাজারে যা ছিপ আর বঁড়শি পাওয়া যায়—শেয়ালদাতেও তেমন পাওয়া যায় না। কোনও কোনও দিন বলতেন, সালকিয়ার চৌরাস্তার ওই পানের দোকানটায় নিজে না দাঁড়িয়ে থেকে পান সাজালে ঠিক জমে না।

বিধায়কদার চিত্রনাট্য, সংলাপ উত্তম দারুণ পছন্দ করত। তরুণকুমাররা যখন ‘অবাক পৃথিবী’ ছবি করছিল তখন একদিন উত্তমের বাড়িতে গল্প নিয়ে সিটিং হয়েছিল। উত্তম বুড়োকে বলল—আমি তো পকেটমার। আমার জন্য পকেটমারের ‘জয়গান’ দিয়ে মামাকে একটা গান লিখতে বল। বুড়ো সঙ্গে সঙ্গে সায় দিল। তারপর দিনই আমি লিখে ফেললাম—’সূর্পণখার নাক কাটা যায়/উই কাটে বই চমৎকার/খদ্দেরকে জ্যান্ত ধরে গলা কাটে দোকানদার/আমরা কাটি পকেট ভাই/কাঁচি নিয়েই আমরা বাঁচি, কাঁচিই মোদের ঠাকুর তাই।’

কিন্তু লিখে ফেললে কী হবে? যেদিন ফাইনাল স্ক্রিপ্ট ‘রিডিং হল, শুনলাম—এ গানটির কোনও সিচুয়েশন-ই করা যাচ্ছে না ছবিতে। বিরস বদনে বসে আছি। ছোট্টখাট্টো বিধায়কদা হঠাৎ তীব্র দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। বললেন—গানটা মনে আছে তোর? পকেটেই ছিল গানটা। গড়গড় করে পড়ে গেলাম। আশীর্বাদ করলেন—দারুণ লিখেছিস। হিট করবে গানটা। আমি সিচুয়েশন পেয়ে গেছি। বিধায়কদার তৈরি অপূর্ব সিচুয়েশনে অমল মুখার্জির সুরে হেমন্তদার গাওয়া উত্তমের ঠোঁটে আমার লেখা— ‘সুর্পণখার নাক কাটা যায়’ বা ‘এক যে ছিল দুষ্টু ছেলে মায়ের কথা মানতো না’ ইত্যাদি গানগুলো কত ভাল হয়েছিল তা যাঁরা ‘অবাক পৃথিবী’ দেখেছেন—নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন।

বিধায়কদার সঙ্গে আরও বহু ছবিতে কাজ করেছি। কিন্তু স্মরণীয় হয়ে আছে ‘ভ্রান্তিবিলাস’।

ভ্রান্তিবিলাসের সময়কার সব ছবিতেই বিধায়কদা শেয়ালদা স্টেশনের কাছে একটা হোটেলে কিছুদিনের জন্য থেকে চিত্রনাট্য লিখতেন। টাকা-পয়সার শর্ত ছাড়া ওঁর প্রধান শর্ত ছিল—প্রতি প্রযোজককে ওঁকে দুটো লুঙ্গি আর দুটো হাফ হাতা ছিটের পাঞ্জাবি দিতে হবে। সব প্রযোজকই তা-ই দিতেন। ‘ভ্রান্তিবিলাস’-এর প্রযোজক উত্তমকুমারও তাই দিয়েছিল। বিধায়কদা ফুল স্কেপ’ কাগজে লিখতেন না, স্কুলের ছোট-ছোট খাতায় নম্বর দিয়ে চিত্রনাট্য লিখতেন।

আর ওঁর ‘আলসেমি’ টালিগঞ্জের সবাই জানত। উত্তম অনেক অনেক তাগাদায় ‘ভ্রান্তিবিলাস’-এর চিত্রনাট্য ওঁকে দিয়ে শেষ করিয়ে ওঁর মুখ থেকে সেটা আমাদের শোনাতে ওর ভবানীপুরের বাড়িতে ডেকেছিল।

শেয়ালদায় গাড়ি পাঠিয়ে যথাসময়ে বিধায়কদাকে নিয়ে এল উত্তম। এক রাউন্ড চা খেয়ে—সামনে এক প্লেট পান নিয়ে ঘরের এক কোণে বসলেন বিধায়কদা। উত্তম বললেন—ও কী? ওখানে বসলেন কেন? আলো কম। পড়তে অসুবিধে হবে যে। উত্তমকে থামিয়ে দিয়ে বিধায়কদা বললেন—তুই থাম। আমার চোখ তোর থেকে পাওয়ারফুল। চোখের ওপর খাতা তুলে তুলে একটার পর একটা খাতা পড়ে শেষ করে বিধায়কদা থামলেন। গানের সিচুয়েশন বুঝিয়ে দিলেন আমাকে আর শ্যামল মিত্রকে। উত্তম দু-একটা সামান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করল। পরিচালক মানু সেন আর উপস্থিত সবাই বললেন—চমৎকার চিত্রনাট্য।

ভ্রান্তিবিলাসে উত্তমের সংলাপ সমৃদ্ধ সন্ধ্যা রায়ের ঠোঁটে সন্ধ্যা মুখার্জির গাওয়া আমার লেখা গান ‘অ্যাতো ভোরে যেয়ো না গো জাগেনি সজনী’ কিংবা ‘তুমি কি সে তুমি নও’ ইত্যাদি গান নিশ্চয়ই অনেকেই ভোলেননি।

যা হোক, সেদিন চিত্রনাট্য শোনার পর খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই উত্তম ওর গাড়ির চালক ন্যাপা-কে বলল—বিধায়কদাকে শেয়ালদায় ছেড়ে আসতে।

আমার সঙ্গে গাড়ি ছিল। আমারও ওদিকেই যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। বললাম— ন্যাপাকে পাঠানোর দরকার নেই। আমি ওদিকেই যাব। বিধায়কদাকে হোটেলে পৌঁছে দেব। বিধায়কদা চিত্রনাট্যের খাতাগুলো বগলদাবা করে হোটেলে গাড়ি থেকে নামতে-নামতে বললেন—পুলক, ওপরে আমার ঘরে আয়। তোকে আর একটা ছবির গানের সিচুয়েশন দেব। সানন্দে গেলাম ওঁর সঙ্গে। বিধায়কদা বললেন—একটু বোস, আমি ধুতিটা ছেড়ে লুঙ্গি পরে আসি। আমার সামনের টেবিলটাতেই রেখে গেলেন ‘ভ্রান্তিবিলাস’-এর চিত্রনাট্যের খাতাগুলো। টেবিলে আরও কাগজপত্র ছিল। হঠাৎ পাখার হাওয়া লেগে ‘ভ্রান্তিবিলাস’-এর খাতাগুলো মেঝেতে পড়ে গেল। দু-একটা খাতার পাতাগুলো খুলেও গেল। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম—মাত্র দুটো কি তিনটে খাতায় পুরোপুরি লিখেছেন বিধায়কদা, বাকিগুলো শ্বেতশুভ্র—একটা কালির আঁচড়ও নেই।

হতবাক হয়ে বসে আছি। বাথরুম থেকে লুঙ্গি পরে বিধায়কদা এলেন। এসেই বুঝতে পারলেন তিনি ধরা পড়ে গেছেন। কিন্তু কোনওই তাপ-উত্তাপ নেই। বললেন—সমস্ত স্ক্রিপ্টটা তো মগজে রেকর্ড করা আছে। তোদের শোনালাম। তোদের মতামত পেলাম। বাকি খাতাগুলোতে ওসবগুলো লিখতে বড়জোর সময় লাগবে দুদিন!

আমি শুধু বললাম—সাদা খাতা দেখে কী করে সিকোয়েন্স সিন—এমন নিখুঁতভাবে পর পর বলে গেলেন? এগুলো মনে থাকবে?

উত্তরে বললেন—উত্তমের স্মৃতিশক্তি দারুণ। একপাতা সংলাপ—দুবার শুনেই মুখস্থ বলতে পারে। ওর কাছে শুনে নিস—যা বলেছি তার একটুকুও অদল-বদল হবে না। মন দিয়ে শোন, অন্য যে ছবিটার গানের সিচুয়েশন দিতে তোকে ডেকে আনলাম—সেটা।

বিধায়কদা টেবিল থেকে আর একটা খাতা তুলে নিয়ে পাতা ওল্টাতে লাগলেন। উঁকি মেরে দেখলাম—ওটাও কালির আঁচড়হীন শ্বেতশুভ্র কি না? নিশ্চিত হলাম—ছোট ছোট হাতের লেখা দেখে।

মধু সংলাপী বিধায়কদা এ আপনার এক ধরনের অনন্য প্রতিভার পরিচয়। এতদিন এ কথাগুলো কাউকে বলিনি—আজকে এগুলো বলে আপনাকে প্রণাম জানালাম!

আমার সঠিক অভিজ্ঞতা তো শুরু পাঁচের দশকের মাঝ থেকে। তখন থেকে সাতের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চিত্রনাট্যকার বা পরিচালকরা আমার মতো গীতিকারদের বলতেন—ইনটারাপটেড মেলোডি’ দেখেছেন। বা ‘রেড সুজ’ দেখেছেন? বা পিলো টক’ কিংবা টু ক্যাচ এ থিভ’ দেখেছেন? ওই ধরনের একটা গান আমরা চাই। গীতিকার সুরকার দুজনেরই বিখ্যাত ওই সব ছবির খবর রাখতে হত। সৃষ্টি করতে হত ওগুলোকে বাঙালির জারক রসে ভিজিয়ে সম্পূর্ণ নতুন বাংলা গান। আটের দশক থেকে (দু-চারজন ছাড়া) আজ পর্যন্ত প্রায় সব চিত্রনাট্যকার বা পরিচালকদের কাছে শুনি—’পাপ কি দুনিয়া’ দেখেছেন? বা ‘খুন কা বদলা খুন’ বা ‘দিওয়ানা তুমহারা লিয়ে’ কিংবা ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যিই আজকের বাঙালি অনেক অনেক এগিয়ে গেছে। আগেকার চিত্রনাট্যকারদের আর একটা স্টাইল ছিল—ওঁরা নাটকের সঠিক গানের সিচুয়েশন বোঝাবার জন্য রবীন্দ্রনাথের কোনও গানের উল্লেখ করে রাখতেন। রবীন্দ্রনাথের সেই গানের উল্লেখ দেখে আমরা খুব সহজেই সিনেমার নাটক মিলিয়ে গান বানাতাম! শ্রদ্ধেয় নৃপেন্দ্ৰকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় প্রায় সব চিত্রনাট্যেই এইভাবে গান বোঝাতেন। আর ছিলেন অসাধারণ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। নৃপেনদা ‘হারানো সুর’ ছবিতে উল্লেখ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের— ‘আমার এ পথ তোমার পথের থেকে/অনেক দূরে গেছে বেঁকে।’

হেমন্তদা যদি গীতিকার হতে চাইতেন, তিনি অসাধারণ এক গীতিকার-ও হতে পারতেন। কিন্তু তা কোনও দিনই চাননি, শুধু প্রচুর গানের মুখড়া বানিয়ে রাখতেন। হেমন্তদা ওই আমার এ পথ’ গানটির প্রথম পঙক্তিটা একটু রকম ফের করে বানিয়ে রেখেছিলেন—আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে।’ অবশ্য গীতিকারকে এই মুখড়া পরিবর্তনের সুযোগ দিতেন। কিন্তু সুরের সঙ্গে জমাট বেঁধে যাওয়া—রবীন্দ্রনাথের কথা ব্যবহার করা এমন পক্তি বদলানো কোনও গীতিকারেরই সহজসাধ্য ছিল না। প্রত্যেকেই বিনা দ্বিধায় তার পর থেকে গানটা লিখতেন।

ঠিক এই রকম করতেন চিত্রনাট্যকার পরিচালক সলিল সেন-ও। ‘অজানা শপথ’ ছবিতে তাঁর চাহিদা ছিল—রবীন্দ্রনাথের ‘আজি বিজন ঘরে/নিশীথ রাতে আসবে যদি শূন্য হাতে/আমি তাইতে কি ভয় মানি/জানি বন্ধু জানি/তোমার আছে তো হাতখানি।’ হেমন্তদা রবীন্দ্রনাথের কথা ব্যবহার করে নিজের সুরে তৈরি করেছিলেন—ও বন্ধু আঁধার রাতে যদি এলে/হাতখানি রাখো মোর হাতে/আমি নির্ভর তোমার হাতের ছোঁয়া পেলে।’ গীতিকারের হাসিমুখে ওই পক্তি রেখে দিয়ে তারপর থেকে গানটি না-লিখে কিছু করার ছিল না।

হেমন্তদার এমন অজস্র ঘটনার কথা বলব। যখন আমার স্মৃতিকথায় বিশদভাবে আসবেন এই অসাধারণ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আমি আগেই বলেছি—প্রতিটি কাজে কিছু নতুনত্ব করার বাসনা আমার চিরদিনের। রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় প্রথম আধুনিক গান রেকর্ড করে আমারই কথায় প্রবীর মজুমদারের সুরে গানটি ছিল, ‘যদি নিজেরে হারাই আমি তোমার চোখে।’

যদিও সুচিত্রা মিত্রের আধুনিক বাংলা গানের রেকর্ড ‘এ কী লিপিকা হল লেখা আজি রাতে’ আমাদের বাড়িতে ছিল কিন্তু পরবর্তীকালে সুচিত্রাদি রবীন্দ্রসংগীতেরই পূর্ণাঙ্গ শিল্পী হয়ে রইলেন। তবুও এই সেদিন যখন সুচিত্রাদি নিখিল চট্টোপাধ্যায়ের সুরে বেতারের ‘এ মাসের গান’ আর ‘রম্যগীতি’-তে আমার গান গাইলেন—খুবই উদ্দীপনা পেয়েছিলাম।

এই নতুনত্ব করার উৎসাহ দেখেই আমি পরিচালক অগ্রগামী গোষ্ঠীর সরোজ দে-র (কালুদা) এত কাছের মানুষ হয়ে গেছি। উনিই প্রথম সুযোগ দেন নতুন সুরশিল্পী সুধীন দাশগুপ্তকে। ‘ডাক হরকরা’ ছবিতে কালুদার ইচ্ছামতোই মান্না দে সুধীনবাবুর সুরে কোনও বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই পুরোপুরি খালি গলায় শুধু একটিমাত্র দোতারার রিদম্-এ গেয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত রচনা—’ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায় আমি বসে আছি’। তথাকথিত মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট ছাড়াই যে গান সুপারহিট। উনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন ভাল কথা, ভাল সুর, ভাল গাওয়াই হল ভাল গানের আসল প্রাণ। ভাল বাদ্যি বাজনা নয়! এরপরে অপরেশ লাহিড়ি এই সত্যটা আবার প্রমাণ করে দিয়েছিলেন। ‘সুভাষচন্দ্র’ ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের স্বর্ণকণ্ঠে, প্রচলিত সুরে ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ গানটি রেকর্ড করিয়ে। ও গানটিতেও ছিল একটিমাত্র দোতারার রিদম

কালুদার নতুনত্বের পরীক্ষা প্রবৃত্তিতেই আরতি মুখোপাধ্যায় সুযোগ পায় ওঁর ‘কান্না’ ছবিতে। আরতি রবীন্দ্রসংগীত গায় ওঁর ‘নিশীথে’ ছবিতে। ওঁর ‘বিলম্বিত লয়’ ছবিটির আমার কথায় আর নচিকেতা ঘোষের সুরে-—আঁকাবাঁকা পথে যদি/মন হয়ে যায় নদী’, ‘সোনার রোদের গান আমার বেলা শেষের গান/অস্তরাগের রঙিন সুরে ভরাও আমার প্রাণ’ এবং বিশেষ করে ‘এক বৈশাখে দেখা হল দুজনার/জষ্ঠিতে হলো পরিচয়’ গানটিতে পরিবেশক-প্রযোজক এবং ইউনিটের প্রায় সবাই চাইছিলেন লতা মঙ্গেশকরের প্লে-ব্যাক কণ্ঠ। কিন্তু কালুদা একরকম জেদ ধরেই আরতি মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে ‘বিলম্বিত লয়ে’র সবকটি গানই গাইয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এই আরতিরই একটু ভিন্ন ধরনের ব্যবহারে আহত হন কালুদা। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা আমাদের জানান। ওঁর তখনকার নির্মীয়মাণ ছবি ছিল ‘যে যেখানে দাঁড়িয়ে’। যেখানে নায়করূপে দীপঙ্কর দে-র প্রথম আবির্ভাব এবং ভিন্ন নামে কিশোরী মহুয়ার আগমন। কালুদা ওই ছবির জন্য নতুন মহিলা কণ্ঠশিল্পীর সন্ধান চান। আমি বলেছিলাম—হৈমন্তী শুক্লাকে নিন। এই ক’দিন আগে ও আমার কথায় ‘শিব ঠাকুরের গলায় দোলে বৈঁচি ফলের মালিকা’—দুর্দান্ত গেয়েছে। ছবির রেকর্ডটা বেরুলেই হিট করবে। কালুদা বললেন—না, না উনি তো এসে গেছেন! আমি সম্পূর্ণ নতুন কোনও মহিলা কণ্ঠশিল্পী আনতে চাই।

কালুদার ছায়া আমার ছোটবেলার বন্ধু জয়ন্ত ভট্টাচার্য কলকাতা বেতারের কর্মী প্রয়াত অতন্দ্র ঘোষ দস্তিদারের মাধ্যমে দীনেন্দ্র চৌধুরির পল্লীগীতির ‘গ্রুপ’ থেকে এক রোগা লম্বা গায়িকাকে নিয়ে হাজির করল ‘যে যেখানে দাঁড়িয়ে’র সুরকার বাহাদুর খানের বাড়িতে। মেয়েটির গান আমাদের সকলেরই ভাল লাগল। কালুদা হঠাৎ বললেন—না, না, আধুনিক গান নয়, এই পল্লীগীতি গায়িকাকে দিয়ে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়াব। তাই হল। চিত্রসংগীত জগতে ভূমিষ্ঠ হল অরুন্ধতী হোমচৌধুরির রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে। শুধু কালুদারই পৃষ্ঠপোষকতায়। আরতি মুখার্জির ওপর প্রচণ্ড অভিমানের প্রতিক্রিয়ায়।

১৬

এবার আসি কালুদার ‘স্বাতী’ ছবির প্রসঙ্গে। কেন ‘স্বাতী’ ছবির কথা বলছি তার একটা কারণ আছে।

কালুদা যখন ‘স্বাতী’ ছবি করেন ওঁর সঙ্গে প্রথম কাজ করেন হেমন্তদা। স্বাতীর নায়িকা হিসাবে উনি একটি নবাগত তরুণ নায়কের বিপরীতে হেমন্তদার মেয়ে রাণু মুখোপাধ্যায়কে নায়িকা নেবেন মনস্থ করেছিলেন। লোক মারফত কথাবার্তাও হয়েছিল। রাণু ও হেমন্তদা দুজনেই রাজিও হয়েছিলেন। যেদিন কালুদা আর আমি প্রথম হেমন্তদার বাড়ি গেলাম, টিন এজার লাভের গল্প ‘স্বাতী’ ছবির আইডিয়াটা হেমন্তদা আর রাণুকে শোনালেন কালুদা। তারপর হঠাৎ বললেন— হেমন্তবাবু, একটা কথা আপনাকে আগেই বলে রাখি। স্বাতীর প্লে-ব্যাক গান কিন্তু গাইবে অরুন্ধতী হোমচৌধুরি। হেমন্তদা আমতা আমতা করলেন—কিন্তু আমি যে ওর কোনও গানই এখনও পর্যন্ত শুনিনি। আমার দিকে ফিরে হেমন্তদা জিজ্ঞাসা করলেন—কেমন গায় অরুন্ধতী? স্বভাবতই বললাম—বেশ মিষ্টি গলা—ভাল রেঞ্জ। তবে আপনি তো শিখিয়ে নেবেন।

হঠাৎ দেখি, রাণু এ ঘর ছেড়ে অন্য ঘরে চলে গেছে। ও ঘর থেকে কে যেন এসে আমায় ও ঘরে যেতে অনুরোধ করল। গেলাম। রাণু বললে—কালুবাবুকে বলে দিন— ওঁর ছবিতে আমি অভিনয় করব না। আমি গান করি। ছবিতে আমি ঠোঁট নাড়ব, আমার গান গাইবে অন্যজন? তা হতে পারে না।

‘কালুবাবু’-কে যথাসময়ে রাণুর বক্তব্যটি জানিয়ে দিলাম। নতুনত্বের পিয়াসি কালুদা ‘স্বাতী’র নায়িকা করলেন আনন্দশঙ্করের স্ত্রী নৃত্যশিল্পী তনুশ্রীকে।

কালুদার এখন পর্যন্ত সবশেষ ফিচার ফিল্ম সাঁতারুর ছবি ‘কোনি’-তেও নিয়েছিলেন নতুন নায়িকা আর সংগীত পরিচালক নিয়েছিলেন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হিসাবে খ্যাত চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়কে।

‘স্বাতী’-তে আমার কথার আর হেমন্তদার সুরের প্রতিটি গানই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। মান্নাদার গাওয়া—ওই আকাশ খুঁজতে যারা চলেছে।’

মান্নাদা, হেমন্ত আর অরুন্ধতীর গাওয়া—যেতে যেতে কিছু কথা।’ অরুন্ধতীর গাওয়া—’গোধূলির স্বর্ণরাগে’—নিশ্চয়ই এখন অনেকেই ভুলতে পারেননি। এরপর কালুদা অরুন্ধতীকে নিয়ে রীতিমতো স্পনসরশিপ করেন। অরুন্ধতীকে ওঁর বন্ধু দীনেশ দের ছবিতে গাওয়ান। ওঁরই অনুরোধে বিমল দে ‘দত্তা’ ছবিতে সুচিত্রা সেনের লিপে অরুন্ধতীর গান দেন। এই কালুদাই ওঁর শঙ্খবেলা’ ছবিতে উত্তমের লিপে প্রথম দিয়েছিলেন মান্নাদার গান। সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত কালুদাকে বলেছিলেন—আপনার মতো আমারও বড় একঘেয়ে লাগছে উত্তমকুমারের গান মানেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান। যদি পরিবর্তনই করছেন—পুলকবাবু আর আমি যে সব গান বানিয়েছি সেগুলো কিশোরকুমারকে দিয়ে গাওয়ান। আমার ধারণা ‘বেটার রেজাল্ট’ হবে। কালুদা আমার মতামত চাইলেন। বহুদিন ধরে আমি সুযোগ খুঁজছিলাম। উত্তমের লিপে মান্না দের একটা গান হোক। তৎক্ষণাৎ আমি বললাম, ‘আমি আগন্তুক, আমি বার্তা দিলাম’, মান্নাদার মতো ভারতবর্ষে কোনও শিল্পীই গাইতে পারবে না। কালুদা মেনে নিলেন। মান্নাদাই গাইলেন শঙ্খবেলা’-র গান। সংগীতজগতে সকলেরই যে ধারণা আছে মান্না দেকে উত্তমের লিপে এনেছিলেন সুধীনবাবু, তা কিন্তু সর্বাংশে সঠিক নয়। কালুদা না-থাকলে হয়তো কিশোরদাই গাইতেন শঙ্খবেলা’র গান। মান্না দে এভাবে বাংলা গানে জনপ্রিয় হতে পারতেন না।

‘র‍্যাপ’ কী? আমরা তখনও কেউ জানতাম না। এই র‍্যাপের স্টাইল কিন্তু ওই ‘আমি আগন্তুকের’ মধ্যে অজান্তেই এসে গিয়েছিল। মনে করুন তো—আমি আগন্তুক গানটার সঞ্চারী। যেখানে রয়েছে—’মাঝখানে গোটা দুই স্টেডিয়ামে ফুটবল নেই/সাহারার দুপুরেতে কেন গায়ে কম্বল নেই/আল্পসের চুড়োতে উটপাখি উড়ছে। ভদ্‌গার ডুব জলে সিগারেট পুড়ছে/কার টুপি হলো যে নীলাম।’ এটা আজকালকার ‘র‍্যাপ’ গানের থেকে কতটা দূরের? অবশ্য এই ক্রান্তদর্শনের আদি ও অকৃত্রিম উদাহরণ রেখে গেছেন আমাদের অনেক আগেই প্রণব রায় আর কমল দাশগুপ্ত। ‘দম্পতি’ ছবিতে কমলদার সুরে গেয়েছিলেন রবীন মজুমদার। গানটির প্রথমেই ছিল —নীলপরীগো নীলপরী/স্বপ্নলোকের অপ্সরী/বাসন্তিকার সঙ্গিনী গো কল্পলতার মঞ্জরী/নীলপরী/যৌবনের-ই কুঞ্জবনে/ছন্দ মধুর গুঞ্জরনে/চাঁদের আলোর ঢেউ তুলে আজ মর্তে এসো রূপ ধরি/নীলপরী/এই অ্যাতোটা অংশ ইদানীং কালের র‍্যাপের স্টাইলে গেয়েছেন রবীন মজুমদার। তারপর এসেছে ‘সাইন’ অর্থাৎ গানের মুখড়া এবং ভারতীয় মেলোডি—নীলপরী স্বপ্নে জাগালোরে জাগলো।’ এ দেশের গানের কোনও প্রকৃত গবেষক নেই, তা হলে সহজেই প্রমাণ হয়ে যেত এই ‘নীলপরী’ গানটিই পৃথিবীর প্রথম ‘র‍্যাপ’ গান যা সৃষ্টি করেছে বাঙালিরাই।

যা হোক, শঙ্খবেলার আরও একটু ঘটনা বাকি আছে। সেটা ঘটেছিল উত্তমের দেওয়া একটা পার্টিতে। তখন উত্তমের যে ছবিটির কাজ শেষ হয়ে যেত সেই বিশেষ ছবিটির প্রধানদের নিয়ে এবং আরও দু-চার জন নিমন্ত্রিত অতিথি নিয়ে উত্তম ওর বাড়িতে একটা করে পার্টি দিত। শঙ্খবেলার পার্টিতে কালুদা, জয়ন্ত, আমি, অজয় বসু (প্রযোজক) ইত্যাদিরা হাজির ছিলাম। ওখানে সেদিন বিশেষ নিমন্ত্রিত ছিলেন ‘উদয়ের পথে’র বিখ্যাত নায়ক-অভিনেতা রাধামোহন ভট্টাচার্য। উত্তমের পার্টি মানেই গানের আসর। ও প্রচণ্ড ভালবাসত গান। দ্রব্যরসে বিশেষ অতিথিরা সবাই যখন মশগুল কার যেন গান শেষ হতেই উত্তম হারমোনিয়ামটা এগিয়ে দিল রাধামোহনদার দিকে। রাধামোহনদা ধরলেন ঠুংরি তারপর গজল। অপূর্ব গান। তখন আজকালকার মতো মুঠো মুঠো টেপরেকর্ডারের ছড়াছড়ি ছিল না। আজও আমার আক্ষেপ অভিনেতা রাধামোহন ভট্টাচার্য কত নিপুণ কণ্ঠ সংগীত শিল্পী ছিলেন তার কোনও প্রমাণ রইল না। কোনওদিনও কেউ তাঁর গানকে রেকর্ড করে কেন রাখল না আমি ভেবে অবাক হই আজও।

এরপর স্বয়ং উত্তমকুমার হারমোনিয়াম টেনে নিল। গাইতে লাগল রবীন্দ্রসংগীত। সবশেষে একাই গাইল ‘শঙ্খবেলা’র লতাজি আর মান্নাদার গাওয়া ‘কে প্রথম কাছে এসেছি/কে প্রথম চেয়ে দেখেছি/কিছুতেই পাই না ভেবে/কে প্রথম ভালবেসেছি/তুমি না আমি?’

উত্তমও চমৎকার গাইল। গান শেষ হতেই আমার দিকে চেয়ে ঘটনাটি ঘটাল। হাসতে হাসতে বললে—পুলক মামা দারুণ লিখেছে গানটা। কিন্তু নিজেই নিজের সর্বনাশ করেছে। ওর বন্ধু মান্না দেকে দিয়ে গানটি গাইয়েছে। আমার গলার সঙ্গে মান্না দের গলা মিলবে না, গানটা মার খাবে। দোষ কিন্তু আমার নয় পুলক মামার। ঘামতে শুরু করলাম আমি। যেন কোনও বিচারালয়ে আমার খুনের বিচার হচ্ছে এমন অবস্থা। সবাই আমার দিকে কেমন যেন ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আমার ঠিক পাশেই বসেছিলেন পরিচালক কালুদা আর জয়ন্ত ভট্টাচার্য। কালুদা এক ফাঁকে আমার কানে কানে বললেন যা খুশি বলুক, শুনবেন না। গান হিট করবেই।

শঙ্খবেলার গান আজও হিট। শুরু হয়ে গেল বাঙালির ঘরে ঘরে মান্না দের আন্তরিক অভিনন্দন।

এর কিছুদিন পরেই একদিন উত্তমের ফোন পেলাম!-মামা, মান্নাদা কবে আসছেন কলকাতায়? চমকে গেলাম —মান্নাদা? কী ব্যাপার, জলসা করবে নাকি? উত্তরে উত্তম বলল—না, ‘এ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’-র গানগুলো গাওয়াব, ওরা অন্য আর্টিস্ট চাইছে। উনি বড্ড ‘আড়ি তে (অফ বিটে) গান করেন লিপ দিতে অসুবিধা হয়। মান্নাদার ‘বিটে বিটে’ গানে লিপ দিতে খুব সুবিধে। এবার আমার কথা শোনানোর মওকা। বললাম—সে কী? মান্না দেকে গাওয়াবে? তোমার গলার সঙ্গে ওঁর গলা মিলবে? উত্তম এড়িয়ে গেল। বললে—ছাড়ো তো। ওঁর বম্বের বাড়ির টেলিফোন নাম্বারটা দাও। ফোন করাই। মান্নাদার মুম্বই-এর টেলিফোন নাম্বারটা দিলাম উত্তমকে।

আগেই বলেছি আমার স্মৃতির কোনও সময়ের পরম্পরা নেই। আবার কবছর পেছিয়ে যাই। দেবকী বসুর সহকারী রতন চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘অসমাপ্ত’ ছবির নায়ক ছিল—সরোজ মুখার্জির আবিষ্কৃত ‘প্রশ্ন’ ছবির নায়ক প্রবীরকুমার, নায়িকা কাবেরী বসু। ওই ‘অসমাপ্ত’ ছবির গান করতে ভূপেন হাজারিকা কলকাতায় এলেন। আগেই বলেছি ভুপেনবাবু আর তাঁর স্ত্রী প্রীয়ম হাজারিকা আমার বাড়ির কাছেই রইলেন প্রযোজকদের লিলুয়ার চমৎকার বাগান বাড়িতে। প্রীয়ম নৃত্যশিল্পী ছিলেন, ছবিতে অভিনয়ও করেছিলেন। সার্কাসের ওপর একটি বাংলা ছবিতে (ছবির নামটি স্মরণে আসছে না সম্ভবত ‘তেরো নদীর পারে’) উনি নায়িকার ভূমিকাতেও ছিলেন।

স্বভাবতই ওঁদের সঙ্গে আমার খুবই ঘনিষ্ঠতা হল। এর কিছুদিন পরেই আমার খুবই পরিচিত সরোজ মুখার্জির ‘ঘুম’ ছবির সহ-প্রযোজক কলকাতার ইস্টার্ন ইন্ডিয়া মোশান পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন অধিকর্তা প্রয়াত কে.কে. চৌধুরিরা একটি বাংলা ছবি আরম্ভ করছিলেন—ছবির নাম ‘কড়ি ও কোমল’। নায়ক রবীন মজুমদার আর নায়িকা ছিলেন বোম্বাইয়ের কমলা চট্টোপাধ্যায়। ওঁরাই পরবর্তীকালে আমার কাহিনী আর গানের ‘সুপার হিট’ ছবি ‘রাগ-অনুরাগ’ করেন।

ওঁদের ছবির চিত্রনাট্য শুনলাম ওঁদের নিউ আলিপুরের বাড়িতে। প্রশ্ন করলাম— মিউজিক কে করছে? সবাই বললেন–বলুন না কাকে নিলে ভাল হয়? বললাম—ভূপেন হাজারিকার নাম। কে.কে. চৌধুরি আসলে গৌহাটির বাঙালি। ভূপেনবাবুর নাম বলতেই বললেন—করেক্ট। এটাই ফাইনাল। আমিও ওঁরই কথা ভাবছিলাম!

ভূপেনবাবু তখন অহমিয়া ‘এরা বটের সুর’, ‘শকুন্তলা’ ইত্যাদি ছবি পরিচালনা করতে টালিগঞ্জে উঠে এসেছেন। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে ভূপেনবাবুর বহুদিনের সম্ভাব। ভূপেনবাবু বললেন—কে. কে. চৌধুরিকে রাজি করান—নায়িকার গানগুলো লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে গাইয়ে আনি। লতা মঙ্গেশকর? চমকে উঠলাম আমি। তখন লতাজি নরেশ মিত্রের ‘বৌ ঠাকুরানীর হাট’ ছবিতে প্রথম বাংলা গান গেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের শাঙন গগনে ঘোর ঘন ঘটা’, তারপর আরও গেয়েছেন ভি. শান্তারামের বাংলা ডাবিং ছবি ‘অমর ভূপালি তে (নীতীন বসুর তত্ত্বাবধানে গৃহীত) এই ছবিতেই মান্না দে-ও প্রথম বাংলা গান করেন। যত দূর মনে হয়, তখন লতাজি আরও দু-একটি বাংলা ছবিতে গেয়ে ফেলেছেন। কিন্তু আমার গান একটাও গাননি। তাই, দারুণ উদ্দীপনায় রাজি করিয়ে ফেললাম ‘কড়ি ও কোমল’ ছবির প্রযোজকদের। ভূপেনবাবুর মাধ্যমেই সংগীত সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ। ‘কড়ি ও কোমল’ ছবিটা কিন্তু চলল না। ছবি না চললে শতকরা নিরানব্বইটি ক্ষেত্রেই ছবির গান চলে না। ‘কড়ি ও কোমল’-এর ভূপেনবাবুর সুর করা অনেকগুলি গানের মধ্যে লতাজির গাওয়া অপূর্ব দুটি বিশেষ গান ‘তীর বেঁধা পাখি/আমি জেগে থাকি/আহত একাকী নীড়ে’ এবং ‘অস্ত আকাশে দিনের চিতা জ্বলে’র রেকর্ড আমি আমার বাড়িতে আজও শুনি। অবশ্য, ‘অস্ত আকাশে দিনের চিতা জ্বলে’ গানটির সুরে অন্য বাংলা কথা বসিয়ে অনেক বছর পরে ভূপেনবাবু লতাজিকে দিয়ে একবার পুজোয় এইচ.এম.ভি-তে আধুনিক বাংলা গান রেকর্ড করেন। কিন্তু স্বীকার করতে কারও কোনও দ্বিধা থাকা উচিত নয়—সে গানটিও তেমন জনপ্রিয় হয়নি।

একটা কথা আগে বলতে ভুলে গেছি—লতাজির প্রথম পুজোর বাংলা গান হিসাবে আমার ও ভূপেন হাজারিকার ‘মনে রেখো’ আর ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে’ যেমন একটা রেকর্ড—তেমনই আর একটা রেকর্ড ওইটাই ওঁর কলকাতায় রেকর্ড করা জীবনের প্রথম গান। মনে আছে—লতাজির কথাটা। উনি গান শুরু করবার আগেই স্টুডিয়োতে মাইকের সামনে বলেছিলেন—আজ আমি ধন্য যেখানে কে.এল. সায়গল প্রথম রেকর্ড করে গেছেন—সেই কলকাতায় আমি গান রেকর্ড করছি। সেই রেকর্ডিং-এ মুম্বই-এর কল্যাণজি-আনন্দজির কল্যাণজিও লতাজির সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন। কল্যাণজি সম্ভবত তখনও সুরশিল্পী হননি—বাদ্যযন্ত্রীই ছিলেন। লোকমুখে শুনেছিলাম উনিই নাকি ‘নাগিন’ ছবির ‘মন ডোলে রে, প্রাণ ডোলে রে’ সেই বিখ্যাত সাপুড়িয়া বীণ ওই বাঁশিটি বাজিয়েছিলেন। ওখানে উপস্থিত ছিলেন উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পী এ.টি. কানন এবং নির্মীয়মাণ ‘জীবন-তৃষ্ণা’ ছবির পরিচালক অসিত সেন। এক ফাঁকে অসিতবাবু আমায় বললেন—আপনার ‘চৈতালী চাঁদ যাক যাক ডুবে যাক’—গানটা আমার খুব ভাল লেগেছে। ‘জীবন তৃষ্ণা’য় ওটা লাগাব।

চমকে উঠলাম-সে কী? ও গানটা যে শ্যামল রেকর্ড করে ফেলেছে। শিগগিরই বাজারে আসবে। কী হবে?

১৭

পরিচালক অসিত সেনকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ‘চৈতালী চাঁদ যাক যাক ডুবে যাক’-এর সুরের ওপর কাছাকাছি কথায় অন্য একটি গান লিখলাম। সেটা রইল ‘জীবন তৃষ্ণা’ ছবিতে। ওই ছবিতেই ভূপেন হাজারিকার একটি অসমিয়া ছবির বিখ্যাত গান ‘সাগর সঙ্গমে কতোনা হাতিরু’ বাংলায় করলাম ‘সাগর সঙ্গমে সাঁতার কেটেছি কতো।’ উত্তমের ঠোঁটে ও গানটি গেয়েছিলেন ভূপেনবাবু স্বয়ং। ওটাই ভূপেনবাবুর অসমিয়া থেকে রূপান্তরিত প্রথম বাংলা গান।

তখনকার ভূপেনবাবুর সঙ্গে আমার গানের জীবনের বহু ঘটনা আছে। বলে শেষ করা যাবে না। উনিই একদিন পাঁচ মিনিটেই সুর করে দিয়েছিলেন আমার কথার ওপর প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গান—তোমায় কেন লাগছে এতো চেনা/এতো আপন ভাবছি কেন তোমায়?’ উনি-ই ‘কড়ি ও কোমল’ ছবিতে প্রথম গাওয়ান আমার কথায় লতা মঙ্গেশকরের গান। উনিই ‘দুই বেচারা’ ছবিতে প্রথম গাওয়ান আমার কথায় গীতা দত্তের গান। যাক গে, একটা ঘটনা বলি। তখন গ্র্যান্ড হোটেলের ‘শেরাজাদে’ আর ‘প্রিন্সেস’-এ অনেক বিদেশি ক্যাবারে আসত। অদ্ভুত সব নতুন নতুন সুরের নতুন নতুন ছন্দের গান আমরা দুজনে মাঝে মাঝে শুনতে যেতাম। ওখানেই হয়তো আমরা মণিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের (লেখক শঙ্কর) ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাসের ‘কনি দ্য ওম্যান’-কে দেখে থাকব।

একবার কী একটা বিদেশি কৃষ্ণাঙ্গ শিল্পীর দল ‘ক্যালিপসো’ সংগীত ও নৃত্য পরিবেশন করতে এসেছিল। ওদের অনুষ্ঠান ভাল লেগেছিল। আমরা বোধহয় পরপর দুদিন ওখানে হাজির ছিলাম। ওদের ওখানে গান শুনতে শুনতে ভূপেনবাবু মশগুল হয়ে গেলেন। মিউজিক ব্রেকের সময় গুনগুন করতে করতে বললেন লিখুন পুলকবাবু। লিখুন। দারুণ ‘মুড’ আমার। লিখে ফেললাম-ক্যালিপসো সুরেরই খুব কাছাকাছি— ‘কী যেন বলবে আমায় গো/কী কথা নয়ন তারায় গো/আহা কী লাজের বাধায় গো/সে কথা বলে গেলে না/ এখনও?’

গানটি রেকর্ডে গাইল তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় যার উল্টোপিঠে ছিল অহমিয়া ‘বিহু’সুরের ‘কাজল লতা মেয়ে শোনো/কৃষ্ণকলি নয়গো তোমায় দেব নতুন নাম’। তখনকার দিনে আধুনিক গান শোনার একমাত্র মাধ্যম ছিল রেডিয়ো। রেডিয়োর তখনকার সংগীতের এক অধিকর্তা গান গাইতেন, সুর করতেন—গান লিখতেন। এইচ. এম. ভি. তাঁকে পাত্তা না দেওয়ায় উনি বদলা নিতে সেই সময়কার বহু সুন্দর সুন্দর গান রেডিয়োতে ‘স্ক্রিনিঙের’ (এক ধরনের সেন্সর) দোহাই দিয়ে শিল্পী সুরে গাননি বা সুরে বিদেশি ছাপ বা লেখা দুর্বল ইত্যাদি অজুহাতে প্রচুর ভাল ভাল বাংলা গানকে খুন করে গেছেন। ওই অধিকর্তা এখন ইহলোকে নেই তাই ভদ্রলোকের নাম উল্লেখ করলাম না। তাঁরই ষড়যন্ত্রে ওই রেকর্ডটি কেউ শুনতে পেল না। ভুপেনবাবুর অবশ্য ওই সুরটির ওপর খুবই নির্ভরতা ছিল। উনি পরে ওটি অহমিয়া কথায় গাইলেন ‘মনু মনুহারি জন্য’ ওই অহমিয়া গানের কথাগুলোই বাংলায় অনুবাদ করিয়ে লিখিয়েছিলেন—’মানুষ মানুষের জন্য’। ভূপেনবাবু দাদাভাই ফালকে’ প্রাইজ পেয়েছেন—সবাই জানেন। কিন্তু আমাদের মতো অন্তরঙ্গ ছাড়া কেউ-ই জানেন না উনি কত সারপ্রাইজ দিয়ে কত প্রাইজ জিতেছেন সারা পৃথিবীতে। একদিন সন্ধ্যায় গ্র্যান্ডের প্রিন্সেসের সেই বিখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ স্টুয়ার্ট — যতদূর মনে হচ্ছে তাঁর নাম ব্ল্যাকি—ওঁকে আমার সামনে বিলিতি ‘ওক’ কাঠের বাক্স থেকে একটা সুপ্রাচীন পানীয় উপহার দিয়ে বললেন—এটা এই হোটেলের পক্ষ থেকে আপনাকে দেওয়া উপহার। অনুগ্রহ করে গ্রহণ করুন। প্রাইজের কারণটা হল ভূপেনবাবু ওঁদের দেওয়া ওঁর পানীয়টি যে নির্ভেজাল নয় তা একটা সুতো আর একটা দেশলাই কাঠির আগুন দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন। তখনকার বিদেশি অধ্যুষিত গ্র্যান্ড হোটেল সেটা হাসি মুখে মেনে নিয়ে হাতে হাতে পৌঁছে দিলেন এই উপঢৌকন। জানি না, আর কজন ভাগ্যবান এই পুরস্কার পেয়েছেন।

এই প্রিন্সেসেই আমি জীবনে প্রথম দেখি বিশাল বিশাল ‘ট্রিপল কঙ্গো। কী অদ্ভুত ছন্দে বাজাচ্ছিলেন বিদেশি কৃষ্ণাঙ্গ বাদ্যযন্ত্রীরা। ভূপেনবাবু সেদিনও কানে কানে বলেছিলেন—পুলকবাবু, ছন্দটা ধরে ফেলুন। আমি ওই বাজনার মিটারে তালে তালে লিখেছিলাম—’কালো মেঘে ডম্বরু / গুরু গুরু ওই শুরু। ভূপেনবাবুর প্রাণবন্ত সুরে সুবীর সেন ও গানটি রেকর্ড করেন। যার উল্টোপিঠে লিখেছিলাম—ওগো শকুন্তলা চলে যেও না’। বাংলা ‘কালো মেঘে ডম্বরু’, ভূপেনবাবু পরে অহমিয়াতেও গেয়েছিলেন। গানটি ছিল— ডুব ডুব ডুবডুব ডম্বরু।’

ভূপেনবাবুর সুরে পরে ওই ছন্দে আবার লিখেছিলাম দ্বিজেন মুখার্জির জন্য বড় ভয় ছিল যাবার বেলায়/এত ভালবেসেছো আমায়/অজান্তে যদি পিছু ডাকো।’ রেকর্ডটির উল্টোপিঠে লিখেছিলাম—আগামী প্রেমিক সুখী হয় যদি তাতেই আমরা সুখী।’ বিগত বিশ্বযুদ্ধের সময়কার একটি ‘সুপারহিট’ ইংরেজি গান শুনিয়ে এইচ.এম.ভি-র পি.কে. সেন আমাকে ওই বিশেষ ‘আইডিয়া’টি দিয়ে ভারত-চিনের যুদ্ধের সময় লিখিয়েছিলেন ওই গান দুটি। আর একদিন ভূপেনবাবু হঠাৎ বললেন—আচ্ছা, রুমাকে দিয়ে বাংলা গান রেকর্ড করালে হয় না? রুমা দেবী তখন সদ্য কিশোরকুমারের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ করে রয়েছেন কলকাতায় মুদিয়ালি অঞ্চলে সত্যজিৎ রায়ের পুরনো ফ্ল্যাটটিতে। ওঁর মায়ের সঙ্গে থাকতেন। বম্বেতে রুমাদেবীর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন শচীন ভৌমিক। ‘লুকোচুরি’ ছবিতে রুমাদেবীর রবীন্দ্রসংগীত শুনেছিলাম। ভাল লেগেছিল।

রুমাদেবীর মা ছিলেন বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী কনক দাশের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া। উনিও গান গাইতেন দারুণ। রুমাদেবীর রক্তে গান, ঘরানায় গান। তা ছাড়া বম্বেতে তৈরি ‘রজনী’ অবলম্বনে ‘সমর’ আর ‘মশাল’ ছবিতে ওঁর অভিনয় (সম্ভবত নাচও) দেখেছিলাম। সেদিনই আমরা হাজির হলাম রুমা দেবীর কাছে। উনিও রাজি হয়ে গেলেন আধুনিক বাংলা গান গাইতে। তবে আমায় আলাদাভাবে বললেন তথাকথিত ‘প্রেমসংগীত’ তৈরি করবেন না। আমি কী ধরনের গান গাই জানেন-ই তো!

বুঝে নিলাম ওঁর বক্তব্য। লিখলাম—ওরা আজ করবে আঘাত/ তবুতো ভেঙে পড়া চলবে না/তোমাদের সইতে হবে/না হলে বুকের আগুন জ্বলবে না।’ উল্টোপিঠের জন্য ভূপেনবাবুর একটি মাটির সুরের ওপর লিখলাম—’রুম ঝুম নূপুর পায়/কে বাউরি মেয়ে যায়/ময়নামতীর গাঁয়/রূপসী নদী কিনারে’।

আগেই বলেছি সে সময় এইচ.এম.ভি.-র গান বিশেষ কারণে রেডিয়ো বর্জন করেছিল। আমরা তাই রুমা গুহঠাকুরতার ওই প্রথম বাংলা আধুনিক গানের রেকর্ডটি ‘মেগাফোন রেকর্ডে’ প্রকাশ করালাম। স্বভাবতই ‘মেগাফোন’ রুমাদেবীকে চুক্তিবদ্ধ করে ফেলল।

তখন যে শিল্পী যে কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকতেন তাঁর ফিল্মের গাওয়া গানও বিধিবদ্ধভাবে সেই কোম্পানিতেই প্রকাশিত হত। এখনকার মতো ‘বেসিক’ আর ‘ফিল্ম সঙে’র এই ছাড়াছাড়ি ছিল না। তাই মেগাফোনে কানন দেবী, রবীন মজুমদারের সব ফিল্মের গান-ই প্রকাশিত হত। হিন্দুস্থান রেকর্ডে হত কুমার শচীনদেব বর্মণ, পঙ্কজ মল্লিক (নিউ থিয়েটার্স লেবেলে) সুপ্রভা সরকার, উৎপলা সেনের গান। সেনোলা রেকর্ডে হত বিখ্যাত গায়িকা শৈল দেবী আর দিলীপ রায়ের (কান্ত কবির দৌহিত্র) গান। গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য পরিচালিত শচীন দেববর্মণের সুর দেওয়া ‘ছদ্মবেশী’ ছবিতে (প্রথম বারের চিত্রায়ন—যাতে নায়ক-নায়িকা ছিলেন জহর গাঙ্গুলি আর পদ্মা দেবী) একটা অদ্ভুত ব্যাপার আমি লক্ষ করেছিলাম। অজয় ভট্টাচার্য পরিচালিত ছবিতে একটি হাসির গান লিখেছিলেন অজয়বাবু নন, একজন ভিন্ন ব্যক্তি। তাঁর নাম পতিতপাবন বন্দ্যোপাধ্যায়। গানটি—আরে ছো ছো ছো ছো ছো ছো ছো ছো কেয়া সরম কি বাৎ/ভদ্দোর ঘরকা লেড়কি ভাগলো ড্রাইভার কো সাথ।’ ও গানটি গেয়েছিলেন রঞ্জিৎ রায়। ওই রেকর্ডটি এইচ.এম.ভি-র চুক্তিবদ্ধ আর্টিস্ট রঞ্জিৎ রায়ের কল্যাণে প্রকাশিত হয়েছিল এইচ.এম.ভি-তে। পরের বার উত্তমকুমারের ‘ছদ্মবেশী’তেও পতিতবাবুর এই গানটি অনুপ ঘোষালের কণ্ঠে ছিল।

এই প্রসঙ্গে পতিতপাবন বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরেকটি সুপার হিট গান-রচনার কথা মনে আসছে। সেটি ছিল গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীপ্তি রায় অভিনীত নরেশ মিত্র পরিচালিত ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ ছবিতে। গানটি—ও মা ছি /ছি ছি ছি একী বরগো/লাগেও না/রাগেও না/যতই মারো চড়গো।’

ডি.এল. রায়, (রবীন্দ্রনাথেরও) অনেক হাসির গান আছে। গল্প শুনেছি কাজী নজরুল সাহেব চারখিলি পান একসঙ্গে মুখে পুরে এইচ.এম.ভি.-র রিহার্সাল রুমে হাসির গানের বিখ্যাত শিল্পী রঞ্জিৎ রায়ের জন্য প্রথম ‘ননসেন্স রাইমের’ স্টাইলে লিখেছেন বাংলায় এক অভিনব গান—’কালো কুচকুচে কেঁচো কোঁচকায়/ছিঁচকে চোরের চোখ বোঁচকায়।’ কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, ওঁরা ছাড়া তখনকার আধুনিক গানের কোনও লব্ধপ্ৰতিষ্ঠিত গীতিকারই হাসির গান লিখতেন না। অজয় ভট্টাচার্য, সুবোধ পুরোকায়স্থ, তখনকার প্রণব রায়ের হাসির গান আমার স্মরণে আসছে না। তখনকার কোনও লব্ধপ্রতিষ্ঠিত কণ্ঠশিল্পীও ‘কমেডি সঙ’ গাইতেন না। জগন্ময় মিত্র, গৌরীকেদার, সত্য চৌধুরি, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য বা তখনকার হেমন্তদা। সুপ্রভা সরকার, কানন দেবী, শৈল দেবী, উৎপলা সেন কেউ কোনওদিন কোনও হাসির গান ‘প্লে-ব্যাক’ করেননি। হাসির গান যেমন রচনা করতেন একটি বিশেষ গোষ্ঠীর গীতিকারেরা—তেমনি হাসির গান গাইতেনও একটি আলাদা দলের কণ্ঠশিল্পীরা।

এই ‘বরফ’টা প্রথম ভাঙা শুরু হয় মুম্বইতে। মহম্মদ রফি, মান্না দে এবং কিশোরকুমারই-ই এ ব্যাপারে অগ্রগণ্য।

বাংলাতেও এই ঢেউ লাগে। প্রথম লব্ধপ্রতিষ্ঠিত গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন ওই ‘কালো কুচকুচে কেঁচো কোঁচকায়’ স্টাইলে লেখেন লুকোচুরিতে কিশোরদার ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’। আমি লিখি ‘প্রথম কদম ফুল’ ছবিতে মান্নাদার ‘আমি শ্রীশ্রী ভজহরি মান্না’। ‘মায়াবিনী লেন’ ছবিতে ‘তুঙ্গি আমার বৃহস্পতি।’ তারপরই শুরু হয় যে কোনও প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর যে কোনও ধরনের গান গাওয়া আর যে-কোনও প্রতিষ্ঠিত গীতিকারের যে কোনও ধরনের গান লেখা। অবশ্য, দুটোই পারদর্শিতা সাপেক্ষ।

অসাধারণ সত্যজিৎ রায় ‘গুপী গায়েন বাঘা বায়েন’-এ অনুপ ঘোষালকে ‘প্লে-ব্যাক’ জগতে নিয়ে আসেন মূলত এই ‘কমেডি সঙ’ দিয়েই। আবার অজয় ভট্টাচার্যের ‘ছদ্মবেশী’তে ফিরে আসি। আগেই বলেছি, এ ছবির একটি গান প্রকাশিত হয় এইচ.এম. ভি.-তে।

১৮

শচীনদেব বর্মণের সুরে এবং কণ্ঠে ‘ছদ্মবেশী’র আর একটি রেকর্ড প্রকাশিত হয় হিন্দুস্থানে। যাতে ছিল—-অন্ধ ব্রজেনবাবুর আবিষ্কৃত ‘ডুগি’র মতো বিখ্যাত বাদ্যযন্ত্র। শুনেছি এর নাম কুমার শচীনদেব বর্মণ দিয়েছিলেন ‘ব্রজ-তরঙ্গ’। ওঁর বাজানো ওই বাজনাটির বহু রেকর্ড রয়ে গেছে। বাজনাটি ব্যক্তিগতভাবে আমার দারুণ প্রিয় ছিল। আমি সুযোগ পেলেই ওটি আমার গানের সুরশিল্পীদের ব্যবহার করতে বলতাম। নচিকেতা ঘোষের সুরে আমার লেখা আরতি মুখার্জির আধুনিক গান—’আমি বুঝি না কী ক্ষতি ছেলেবেলার মনটি ধরে রাখলে?’ রেকর্ডটিতে ওঁর বাজনা ছিল!

নচিকেতার সুরেই ‘ধন্যি মেয়ে’তে আরতির গাওয়া আমার— যা যা বেহায়া পাখি যা না’ এবং ‘তিলোত্তমা’ ছবিতে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে অরুন্ধতীর গাওয়া আমার ‘খুব কি মন্দ হতো? যদি আজ সন্ধে থেকে’ গান দুটিতে ওই বাজনা আছে। অবশ্য ব্রজেনবাবু তবলাও বাজাতেন অপুর্ব।

নচিতেকার সুরে সন্ধ্যা মুখার্জির গাওয়া আমার লেখা—না না না, নেবো না সোনার চাঁপা কনক চাঁপা ফেলে’ এবং ‘দিন নেই ক্ষণ নেই/এখন তখন নেই।’ দুটো গানেই উনি তবলা সঙ্গত করেছিলেন। ‘ছদ্মবেশী’ ছবিতে ব্রজেনবাবুর ওই বিশেষ বাজনা দিয়ে ‘প্রিলিউড মিউজিক’ বানিয়েই শচীনদা গেয়েছিলেন অজয় ভট্টাচার্যের বিখ্যাত রচনা— ‘বন্দর ছাড়ো যাত্রীরা সবে জোয়ার এসেছে আজ, এর উল্টোপিঠে ছিল—নূতন ঊষার সৈনিক তুমি গৈরিক তব গায়!’

সেনোলা রেকর্ডে প্রকাশিত হয় ‘ছদ্মবেশী’র শৈল দেবীর গাওয়া বিখ্যাত গান—‘কোন দেশে ছিলো চাঁদ/গেলো কোন দেশে’ এবং দিলীপ রায়ের সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে — ‘ফুল যদি ফুটলো/অলি যদি জুটলো/মন চাহে মন যে’।

এই ‘সেনোলা’ রেকর্ডে সবচেয়ে বেশি বিক্রির শিল্পী ছিলেন নবদ্বীপ হালদার। ওঁর কমিক গান আর স্কেচ সারা বাংলার ঘরে ঘরে চলত। ওঁর হাসির গান—আর খেতে পারি না মা গো/ফ্যান্তা ফ্যাচাং তরকারি/আলুভাতে বেগুন পোড়া শুধুই ডাঁটার চচ্চড়ি।’ এবং এর উল্টোপিঠের-শরীরটা আজ বেজায় খারাপ/বিশেষ কিছুই খাবো না।’ অথবা সুরশিল্পী কমল দাশগুপ্তের সম্পর্কীয় ভাই খগেন দাশগুপ্ত (বিশুবাবু) রচিত—ও বাবা শালগ্রাম/তুমি কোন মুখেতে বাঁশরী বাজাও/আবার আপন মনে হেসে হেসে সিংহাসনে গড়গড়াও’ ছিল অনাবিল সুন্দর হাসির গান।

এইচ.এম.ভি-র রঞ্জিৎ রায়ের অর্কেস্ট্রা সম্বলিত’ ননসেন্স রাইমের স্টাইলে বানানো একটি গান আজও আমি শুনি—লম্ পম্ পম পম্/দীরঘল গেছে হংকং/ভুঁড়ি কম্পম্‌।’ তারপর এলেন যশোদাদুলাল মণ্ডল বেশ ভিন্ন স্টাইলের হাসির গান নিয়ে। ওঁর রচিত ও সুরসংযোজিত ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত ‘ক্যালকাটা নাইনটিন ফরটি থ্রি অক্টোবর’ এবং ১৯৪৫ সালের—’টেন ইয়ার্স ব্যাক ক্যালকাটা/সে সময়টা যে নাই/নাউ নাইনটিন ফরটি ফাইভ/একটু সামলে চলো ভাই’ এসব এইচ.এম.ভি-র সুপারহিট তালিকা। উনিই এইচ.এম.ভি-তে রবীন্দ্রনাথের ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে উছলে পড়ে আলো’র হাসির প্যারোডি গান করেন—’মোর প্রেয়সীর মান হয়েছে গুমরে কেঁদে মলো।

এরপর গ্রামোফোনে হাসির প্যারোডি গানের সার্থক ‘সেলার’ মিন্টু দাশগুপ্ত। কিন্তু পরবর্তীকালে এই প্যারোডি গানগুলো হয়ে উঠল ‘পলিটিকাল স্যাটায়ার’ বা রাজনীতির হাতিয়ার। গান থেকে হাসিটাই চলে গেল। শ্রোতারা মোটেই সেটা গ্রহণ করলেন না। আরও দু-একজন তাই এই বিভাগে প্রবেশের পরেই প্রস্থান করলেন। এ দেশ থেকে প্রায় পুরোপুরি উঠেই গেল প্যারোডি গান।

যা হোক, আবার তখনকার বিভিন্ন রেকর্ড কোম্পানির কথায় ফিরে আসি। পাইওনিয়ার আর ভারত রেকর্ডে ছিলেন বেচু দত্ত আর ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। বেচু দত্তের ফিল্মের গান ‘যাই তবে চলে যাই’ আর ধনঞ্জয়বাবুর ‘মাটির এ খেলাঘরে’ বা রাধে, ভুল করে তুই চিনলি না তোর প্রেমিক শ্যামরায়। আমার বিশ্বাস, আজও বাংলার মাটিতে কান পাতলেই বাঙালি শুনতে পাবে। এইচ.এম.ভি, কলম্বিয়ায় (একই প্রতিষ্ঠান) ছিলেন— কৃষ্ণচন্দ্র দে, জগন্ময় মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, অণিমা দাশগুপ্ত আর কল্যাণী দাস (শৈলজানন্দের ‘মানে-না-মানা’ খ্যাত)। যা হোক, রুমাদেবীর মেগাফোনে যোগদানের পরেই তরুণ মজুমদারের ‘পলাতক’ ছবি হয়। রুমাদেবীর সেই বিখ্যাত গান ‘মন যে আমার কেমন কেমন করে’ পেয়ে গেল বন্ধুবর কমল ঘোষ। এর ধন্যবাদটা নিশ্চয়ই আমাদের প্রাপ্য। মেগাফোনেই প্রকাশিত হল তাই আমার কথায় আর হেমন্তদার সুরে রুমা গুহঠাকুরতার গাওয়া ‘বাঘিনী’ ছবির গান—’শুধু পথ চেয়ে থাকা’। বিজ্ঞন পালের সুরে আমার কথায় ওঁর গাওয়া ‘আলো ও ছায়া’ ছবির গান—’জানি না পথের সীমা/তবু আমি পথ চলি/পরাণে কাঁদে যে রাধা/কাঁদে যে চন্দ্রাবলী। ‘

এই সময়েই ভূপেন হাজারিকা আর আমি মেগাফোনে প্রচুর কাজ করি। তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য অপরেশ লাহিড়ির গাওয়া—’জলের জাহাজ জল কেটে যায় সোঁ সোঁ/কলের বাঁশি বাজিয়ে চলে ভোঁ ভোঁ/এই আজব দেশে পা চলে না মোটে/যাদুর কলে মাটিই নিজে ছোটে।’ যার উল্টোপিঠে ছিল—বিখ্যাত ‘জিঙ্গল বেল, জিঙ্গল বেল’ স্টাইলে—’থাক থাক পিছু ডাক সাড়া দিও না’।

বাপি লাহিড়ি তখন অল্পবয়েসি হলেও তবলায় খুবই নাম করেছে। রিহার্সালে ও তো তবলা বাজাতই রেকর্ডিং-এও বোধহয় বাজিয়ে ছিল।

পরবর্তীকালে এই বাপি লাহিড়ি আর আমার বহু ঘটনা আছে। যথাসময়ে বলব।

আগেই বলেছি—আমি পড়তাম স্কটিশ চার্চ কলেজে। তখন স্কটিশ কলেজ যেমন লেখাপড়ায় বহু বিদ্বান মানুষের জন্ম দিয়েছিল –তেমনি দিয়েছিল চিত্র এবং গানের জগতের বহু মানুষের পরিচিতি।

আমি ওখানে পড়তে আসার আগে ওখানে পড়ে গেছেন—মান্না দে, বেতারের বিমান ঘোষ, গায়ক-নায়ক রবীন মজুমদার, গায়িকা উৎপলা সেন, সুচিত্রা মিত্র। আমার সময়ে ছিল চিত্রনাট্যকার জয়ন্ত ভট্টাচার্য, গায়িকা আরতি মুখার্জির প্রথম স্বামী গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার সুবীর হাজরা। চিত্রগ্রাহক দিলীপ মুখোপাধ্যায়, নজরুলগীতির বিমান মুখোপাধ্যায়, অভিনেতা রুদ্রপ্রসাদ প্রমুখ। আমাদের পরেই ছিল প্রয়াতা অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তী, পরিচালক পার্থপ্রতিম চৌধুরি এবং তার কিছুদিন পরেই ছিল আজকের মেগাস্টার মিঠুন চক্রবর্তী।

মিঠুন চক্রবর্তীর ‘ভাগ্যদেবতা’ ছবিতে এই স্কটিশের বাঙালি মিঠুনের জন্যে স্কটিশের বাঙালি আমি একটি দারুণ মজার গান লিখে দিয়েছি। মিঠুন সেটি নিজের গলায় মধু গোপাল বর্মণের সুরে গেয়েছে ভাগ্যদেবতায়। গানটি শুরু ওই স্কটিশের বসন্ত কেবিন নিয়েই। গানের কথাটা এই—বসন্ত কেবিনের ধারে/ হেদুয়ার রেলিঙের পারে/ভিক্টোরিয়ার গাছের তলায়/তোমায় আমায় যে মেলায়/এর-ই নাম ভালবাসা/এর-ই নাম ভালবাসা।’

গান রেকর্ডিং-এর পর খুশি হয়ে আমার ভালবাসা দিয়েছিলাম মিঠুনকে।

আমাদের সময়ে আড্ডা জমত মাঝে-মাঝে কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে— মাঝে-মাঝে বিখ্যাত বসন্ত কেবিনে। সনৎ সিংহ তখন উঠতি গায়ক,—ও এবং যতদূর মনে আসছে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় পড়ত সিটি কলেজে। আমাদের আড্ডায় প্রায়ই ওরা আসত। ম্যাট্রিকে ফার্স্ট, ইন্টারমিডিয়েটে ফার্স্ট, পরবর্তীকালের মুখ্যসচিব তরুণ দত্ত, আর পরবর্তীকালের মন্ত্রী অজিত পাঁজাও সে সময়ে স্কটিশে। ওরাও মাঝেমধ্যে উঁকিঝুঁকি দিত।

আমাদের সঙ্গেই স্কটিশে পড়তেন আজকের রজনীকান্ত-অতুলপ্রসাদের গানে বিখ্যাত নিশীথ সাধু! নিশীথ সাধু তখন থাকতেন উত্তর কলকাতার ‘চোরবাগান’ অঞ্চলে। আমাদের আড্ডায় ও পদার্পণ করলেই ঠাট্টা করে বলতাম—আসুন আসুন চোরবাগানের নিশীথ সাধু’। ও অবশ্যই সে ঠাট্টা একমুখ মিষ্টি হাসি হেসে গ্রহণ করত! ওই স্কটিশ কলেজেরই প্রাক্তন ছাত্র পার্থপ্রতিম চৌধুরিকে ‘দোলনা’ ছবির পরিচালক হিসেবে মনোনীত করলেন সুরকার গায়িকা অসীমা ভট্টাচার্যর (এখন মুখোপাধ্যায়) প্রথম স্বামী প্রয়াত দিলীপ ভট্টাচার্য। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুরকার ও গায়ক শৈলেন মুখোপাধ্যায় গান শেখাতেন অসীমাকে। সুর সংযোজনের ভার পড়ল শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের ওপর। ‘দোলনা’ ছবিতে তনুজার দ্বিতীয়বার বাংলা ছবিতে আত্মপ্রকাশ।

সবাই বলল—দোলনা ছবির একটি গান যেন লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে গাওয়ানো হয়। সে গান করানোর দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। আমি মান্নাদাকে টেলিফোনে অনুরোধ করলাম লতাজির একটি ‘ডেট’ নিয়ে বম্বে ফিল্ম ল্যাবরেটরির স্কোরিং বুক করে রাখতে। শৈলেনের স্ত্রী রাণু মুখোপাধ্যায় দক্ষিণামোহন ঠাকুরের ঘনিষ্ঠা আত্মীয়া অর্কেস্ট্রার দিকটা ওঁকেই সামলাতে বলার জন্যও অনুরোধ করলাম। মান্নাদা চিরকালই পরোপকারী। অনুরোধ রাখলেন আমার। যথাসময়ে লতাজির ডেট জানালেন, আর শৈলেনকে আমাকে মুম্বইতে হাজির হতে বললেন।

আমি আর শৈলেন মুম্বই গেলাম। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম প্রযোজক দিলীপ ভট্টাচার্য নেই, পরিচালক পার্থপ্রতিমও নেই। শৈলেন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই বললে—ঘাবড়িও না, আমার সঙ্গে টাকা আছে। সব ফাইনাল করে দিলীপবাবুকে জানাব। ওঁরা তৎক্ষণাৎ এসে যাবেন। মান্নাদার বাড়ি তখন বান্দ্ৰায়— মুম্বই-এর নিউ টকিজ সিনেমার কাছে। এপারে মান্না দে ওপারে মহম্মদ রফি, মধ্যিখানে একটা সুন্দর পার্ক। ওখানে হাজির হলাম আমি আর শৈলেন একটা বিশেষ ছুটির দিনে। সবে কফিতে চুমুক দিয়েছি মান্নাদা বললেন—একটু আগেই লতাজির ফোন এসেছিল। ওঁর দারুণ দাঁত কনকন করছে। উনি বোধহয় রেকর্ডিং করতে পারবেন না।

আমাদের দুজনেরই কফিটা তখন চলকে জামায় পড়ে গেল। মান্নাদা সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে হঠাৎ জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন—দাঁড়ান, দাঁড়ান, রফি বেড়েছে (অর্থাৎ গায়ক রফি সাহেব ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন)।

মান্নাদা তৎক্ষণাৎ ভেতরের ঘর থেকে একটা বোমা লাটাই আর ঘুড়ি নিয়ে তাঁর তিনতলার ফ্ল্যাটের সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেটা ওড়াতে লাগলেন। আমিও পায়ে পায়ে বারান্দায় দাঁড়ালাম। আমাকে পাশে দেখেই বললেন—-ধরুন তো লাটাইটা—-টেনে কেটে দিই রফিকে, প্রমাণ করে দি-ই আমি শ্যামবাজারের ছাওয়াল।

অবাক বিস্ময়ে দেখলাম মুহূর্তের মধ্যে উনি রফি সাহেবের ঘুড়ির নীচে ওঁর ঘুড়িটা ফেলে দিয়েই সুতো ধরে টানতে লাগলেন। সে কী টান। সমুদ্র মন্থনের সময়েও বোধহয় দেবতা বা অসুর কোনও পক্ষই এত শক্তি প্রয়োগ করেননি। কেটে গেল রফি সাহেবের ঘুড়ি। আমরাও রেকর্ডিং-এর টেনশন ভুলে চিৎকার করে উঠলাম-ভো কাট্টা-ভো কাট্টা। রফি সাহেব ভো কাট্টা!

মান্না ঘুড়িটা নামাচ্ছেন—ফোন এল রফি সাহেবের। মান্নাদা ফোনটা ধরে এসে হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন—রফি বলছে কী করে ওই ‘টেনে’ প্যাঁচ খেল একটু শিখিয়ে দেবে?

এই ছিল তখনকার প্রতিদ্বন্দ্বী গায়ক শিল্পীর সম্পর্ক। মান্না দে, মুকেশ, তালাত, রফির যে অপূর্ব বন্ধুত্ব আমি চাক্ষুষ দেখেছি—তা আজকের মুম্বই বা কলকাতার কোনও শিল্পীদের মধ্যে যদি কেউ আমাকে দেখিয়ে দিতে পারেন—আমি তাঁকে প্রণাম করে আসব! যা হোক, শৈলেন তখন কাঁদো কাঁদো গলায় বললে—লতাজি গাইবেন না? মান্নাদা অভয় দিলেন—চলুন, পেডার রোডে যাই, আজ তো ছুটির দিন, কোনও রেকর্ডিং নেই, ওঁকে বাড়িতে পেয়ে যাব। আমরা পেডার রোডে যাবার জন্য উঠলাম মান্নাদার গাড়িতে। উনি নিজে গাড়ি চালাতে লাগলেন। শহরতলি ছেড়ে চললাম মুম্বই-এর উদ্দেশে।

১৯

কিন্তু পেডার রোডের দিকে না গিয়ে গাড়ি সোজা চলে এল গেট অফ ইন্ডিয়ায়। মান্নাদা বললেন, চলুন, আগে পেট ভরে একটু সমুদ্রের হাওয়া খাই।

আমাদের টেনশন তখনও বেড়েই চলেছে। মুখে কিছু না বলে বাধ্য হয়েই সমুদ্রের হাওয়া খেতে হল। তারপর চার্চগেট স্টেশনের কাছে এসে বললেন, চলুন, আমাদের ফেবারিট আড্ডাখানার রেস্টুর‍্যান্ট ‘গেলর্ডে’ কিছু খাই।

শৈলেন বলল, আমার একদম খিদে নেই মান্নাদা। ভ্রূক্ষেপ করলেন না উনি। বললেন, চলুন তো, এদের ছানাভাজা খেলে চক্ষু যদি ছানাবড়া না হয় তখন বললেন। অগত্যা দুজনকেই গিলতে হল গেলর্ডের দামি ছানাভাজা। মান্নাদার ওই খাবারের তারিফ আর শেষ হয় না। শৈলেন চুপিচুপি আমার হাতটা স্থুল। বরফের মতো ঠাণ্ডা। তারপর এক সময়ে রীতিমতো কাঁপতে কাঁপতে লতাজির দোতলার ফ্ল্যাটে প্রবেশ করলাম আমরা। আমি নমস্কার জানাতে উঠে দাঁড়াতেই লতাজি গালে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে হিন্দিতে বললেন—পুলকবাবু, কী গান লিখেছেন আমার জন্য? ও গান আমি গাইব না। আমি আঁতকে উঠলাম—সে কী? লতাজি বললেন আমি কাল রেকর্ড করব দাঁত-কনকনের গান। আমার গানের মুখড়া চাই—দাঁত কনকন, দাঁত কনকন।

সবাই হেসে উঠলাম। আমি আমার হিন্দিতে কী একটা বলতে যেতেই লতাজি আমায় থামিয়ে দিয়ে বললেন –বাংলায় বলুন—আমি মাস্টারমশাই রেখে বাংলা শিখছি। রবীন্দ্রনাথের গান আর শরৎচন্দ্রের নায়িকার হাতপাখা নেড়ে নায়ককে ভাত খাওয়ানো আমায় পাগল করে দিয়েছে। জানেন, শরৎচন্দ্রের মারাঠি ভাষার অনুবাদ প্রায় সব বইগুলোই আমি পড়ে ফেলেছি। অদ্ভুত লেখা। বাঙালি মেয়ে আর মারাঠি মেয়ে একেবারে এক।

মুখে এসে গিয়েছিল—মুম্বইতেও ব্যবসা-বাণিজ্যে মারাঠি কোণঠাসা—কলকাতাতেও বাঙালির সেই একই অবস্থা। সত্যি, বাঙালি আর মারাঠি এক। কিন্তু প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে বাংলাতেই বললাম—দাঁত কনকনের গানটা হবে সেকেন্ড রেকর্ডিং— ফার্স্ট রেকর্ডিং হবে শৈলেনের সুরে দোলনা ছবির গানটা।

লতাজি ওঁর ঘরে স্বামী বিবেকানন্দর ছবিকে দুহাত জোড় করে প্রণাম করে বললেন—যদি রাতে আর দাঁতের ব্যথা না-বাড়ে তা হলে আমি ঠিক কাল সকাল দশটায় রেকর্ডিং-এ আসব। পরদিন ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় লতাজি স্টুডিয়োতে এলেন। আমাকে পরিহাস তরল কণ্ঠে বললেন—আমি কিন্তু ‘সেকেন্ড সঙটা আজই করব। দাঁত কনকন দাঁত-কনকন।

‘রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে’ গানটিতে ‘চাঁদ’ কথাটা লতাজি ‘ চান্দ’ বলেছিলেন। অবাঙালি শিল্পীদের দেখেছি এই ‘চন্দ্ৰবিন্দু’ যুক্ত শব্দগুলো কিছুতেই ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারেন না।

একবার আমার কী একটা গান রেকর্ডিং-এ বাঙালি কিশোরকুমারকেও আমাকে বারবার আমার নাকে আঙুল দিয়ে ‘ভাঙগা’ নয় ‘ভাঙা’ উচ্চারণ বোঝাতে হয়েছিল। কিশোরদা বলেছিলেন—আমি খোট্টা বনে গেছি। দোহাই, আমার গানে ‘বিন্দি’ দেওয়া শব্দ দেবেন না। যাঁরা বাংলা ‘মালতী’কে ‘মাল্লি’ বলেন, সেই অবাঙালি শিল্পীদের আর একটা বিপদ ঘটে পরপর দুটি অকারান্ত স্বরান্ত শব্দ পেলে। ওঁরা ‘রজনী’কে ‘রোজেনী’ বলবেন-ই।

আশাজির একটা গানে লিখেছিলাম-’শোনো হে বঙ্গবাসী’ উনি কিছুতেই ‘বঙ্গ’ উচ্চারণ করতে পারছিলেন না—বলছিলেন—’বোঙ্গোবাসী’। রেকর্ডিং-এর একজন বাঙালি বাদ্যযন্ত্রী রিদম সেকসান থেকে ‘বঙ্গো’ বাজনাটি তুলে আশাজিকে দেখালেন। ওঁর কী হাসি। কিন্তু সুফল হল। স্পষ্ট বললেন—শোনো হে ‘বঙ্গোবাসী।

আমি সেইজন্যই অবাঙালি শিল্পীদের গানে আজীবন একটু সন্তর্পণে শব্দ প্রয়োগ করে এসেছি। কিন্তু লতাজির ‘দোলনা’র গানটিতে একটু বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিলাম।

লিখেছিলাম—’আমার কথা শিশির ধোয়া হাসুহানার কলি/নীরব রাতে মৃদুল হাওয়ায় হয়তো কিছু বলি।’

কিন্তু সেদিন দেখলাম লতা মঙ্গেশকরকে বাংলা শেখার জন্য কিনা জানি না—নির্ভুল নিখুঁত উচ্চারণে গেয়েছিলেন গানটা। প্রশ্ন উঠতে পারে কে.এল. সায়গল-ও তো অবাঙালি ছিলেন—শান্তা আপ্তে (যিনি অসাধারণভাবে গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের—দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে), রাজেশ্বরী দত্ত (কবি সুধীন দত্তের পত্নী) যাঁর গাওয়া অপূর্ব রবীন্দ্রসংগীত আজও আমরা শুনছি—ওঁরা অত সুন্দরভাবে বাংলা উচ্চারণ করলেন কী করে? এর একটাই উত্তর—ওঁরা যত সময় দিয়ে যত অজস্রবার রিহার্সাল করে বাংলা গান রেকর্ড করতেন পরবর্তীকালের অবাঙালি শিল্পীরা কেউই সে সময় দেননি বা দেন না।

আমি আগেই বলেছি আমি ‘একলব্য’ ছিলাম প্রেমেন্দ্র মিত্র আর অজয় ভট্টাচার্যের। শেষ জনকে আমি চোখে দেখার সুযোগ পাইনি। কিন্তু প্রথমজনের খুবই কাছে পৌঁছোবার সৌভাগ্য পেয়েছিলাম।

একদিন প্রেমেনদা আমায় বললেন—তোমার ‘জিপসী মেয়ের গানের সমালোচনা আমি পড়েছি। ওদের কথা রাখো—ঠিক স্টাইলেই গান লিখেছ—জিপসী মেয়ে কি চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’ গাইবে?

একটু থেমে প্রেমেনদা কলকাতা বেতারকেন্দ্রের ওঁর নির্দিষ্ট ঘরটার ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে বললেন—আমিও লিখেছিলাম ‘রিক্তা’ ছবিতে ও ধরনের দুটো গান। তোমাদের জিপসী মেয়ের নায়িকা ইহুদি মেয়ে, রমলাই ছিল আমাদের রিক্তা ছবিতেও। ও আবার গায়িকাও ছিল। দুমাস ধরে রিহার্সাল দিয়ে বাংলাগান দুটো রেকর্ড করেছিল। তৎক্ষণাৎ বললাম—এখনও আমার কাছে আছে সে গানের রেকর্ড। একটা—’জানি না কোথায় আছি/রাশিয়া কিম্বা রাঁচি/শুধু জানি কাছাকাছি দুজনে’ অন্যটি ছিল—’আরও একটু সরে বসতে পারো/আরও একটু কাছে/দূরে থাকা শুধু ছলনা/ছলো ছলো নয়ন যারে যাচে’। (ভাবতে পারা যায়—এই লঘু গান দুটিতে চটুলতম সুর সংযোজনা করেছিলেন বিখ্যাত উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়?)

মনে আছে, ‘সংসার সীমান্তে’ ছবিতে যখন পতিতাপল্লীর চোর জামাইকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) নিয়ে সবাই উৎসব করছে তখন বাড়িউলির (মাসি) মুখের জন্য প্রচলিত একটি গানের আশ্রয় নিয়ে লিখেছিলাম—ও সাধের জামাইগো তুমি কেন নাগর হইলে না। গানটি শুনতে শুনতে পরিচালক তরুণ মজুমদার গানের কাগজটি আমার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে ‘নাগর’ শব্দটি কেটে দিয়ে লিখে দিয়েছিলেন ‘ভাতার’। হেমন্তদা সেই গানটিতে সুর সংযোজনা করেছিলেন নির্দ্বিধায়। আসলে, ছবির যেমন সিচুয়েশন থাকবে সেই পরিবেশের ধরনেরই তো গান রচনা করতে হবে। অনেক ‘অশোভন’ শব্দও ‘সিচুয়েশনে’ শোভন হয়ে যায়। কিন্তু বেসিক গানেও (আধুনিক গানে) আজকাল যা-খুশি তাই লেখা হচ্ছে। এর নিশ্চয়ই তীব্র প্রতিবাদ হওয়া উচিত। কিন্তু হচ্ছে না! বিদগ্ধ বন্ধু বান্ধব শুভানুধ্যায়ী ভক্তরা যখন আমায় আমার লেখা সুপারহিট গান ‘আমি কলকাতার রসগোল্লা’র বিরূপ সমালোচনা করতে শুরু করেছিলেন—তাদের প্রত্যেককেই যুক্তি দিয়েই বুঝিয়েছি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সিচুয়েশনের চাহিদায় চিরকুমার সভায় লিখেছেন—অভয় দাও তো/বলি আমার উইশ কী! একটি ছটাক জলের সাথে/বাকি তিন পোয়া হুইস্কি।’ সুতরাং আমার ক্ষেত্রে কী করে আশা করেন একজন স্ট্রিট সিঙ্গার গাইবে— আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে।’ সঙ্গে জুড়ে দিয়েছি প্রেমেন মিত্রের ওই উক্তিটি—রাস্তার মেয়ে পকেটমারের গান—সে কি চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে গাইবে’? কেউ-ই আর কথা বাড়াননি। কিন্তু জানি না আজকালকার কিছু সুপারহিট ননফিল্ম বাংলা গানের ‘যা খুশি লেখা’ সম্বন্ধে তাঁরা কেউ কোনও কথা তুলছেন না কেন? আর একদিন এই প্রেমেন মিত্রকেই বলেছিলাম—সুরশিল্পী কমল দাশগুপ্ত আমায় বলেছিলেন—’যোগাযোগ’ ছবির কানন দেবীর গাওয়া আপনার লেখা হারামরুনদী’ গানটার একটা পঙক্তি নাকি উনি বদলাতে বলেছিলেন, আপনি বদলাননি। শেষে আপনার অনুমতি নিয়ে অন্য এক গীতিকারকে দিয়ে এ কাজটি করেছিলেন উনি—এটা যদি সত্যিই হয় কাজটা ভাল হয়নি।

প্রেমেনদা বললেন—ঠিক কথাই বলেছ। যদি কারও কাছে পুরনো ‘যোগাযোগ’-এর বুকলেট থাকে। দেখে নিয়ো ওখানে আমার আসল লেখাটাই আছে। হাসপাতালে যাঁরা অসুস্থ তাঁদের পাশে রয়েছেন আমার নায়িকা নার্স। সেই উদ্দেশেই লিখেছিলাম-—হারামরু নদী/ডানা ভেঙে যাওয়া পাখি/নিভু নিভু দীপ/আধো আলো/নহো একাকী নহো একাকী’। আমি বলেছিলাম—কিন্তু ফিল্মে বা রেকর্ডে ‘ডানা ভেঙে যাওয়া পাখি’ নেই—আছে ‘শ্রান্ত দিনের পাখি’। ‘শ্রান্ত দিনের পাখি’ মানে তো যার দিনের পরিক্রমা শেষ! বিপর্যয় কোথায় তার? তার তো সব কিছু পাওয়া হয়ে গেছে। প্রেমেনদা উত্তর দিয়েছিলেন—ঠিক তাই। আমি প্রতিবাদ করেছিলাম—কিন্তু স্বয়ং মুরলীধর চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে ব্যাপারটা হজম করে নিয়েছিলাম। দ্যাখো, পুলক, তোমার এখনও অনেক বাকি। দেখবে সুরকাররা অনেক কথাই সুর করতে পারছে না বলে বদলাতে বলবে। যদি দ্যাখো সে কথা বদলালে গানের বক্তব্যের বিচ্যুতি হচ্ছে কখনও তা করবে না। আমিও জীবনে এ ভুল আর করিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *