কথায় কথায় রাত হয়ে যায় – ১

মাত্র তিন মিনিট দশ সেকেন্ড। হ্যাঁ। এই ছিল একটি ডিস্ক রেকর্ডের সময়সীমা। আমাদের তখন বলা হত, গান এর বেশি বড় করবেন না। বড় করলে রেকর্ড-ছাপার ‘থ্রেড’ বেশি হয়ে যাবে। রেকর্ডের গান সুস্পষ্ট হবে না। অর্থাৎ আর পি এম মানে রোটেশন পার মিনিট যত কম হবে ততই ডিসকের পক্ষে মঙ্গল। গীতিকারকে গান লেখবার সময় সুরকারকে সুর করবার সময় এবং কণ্ঠশিল্পীকে গাইবার সময় সর্বদা এই নির্দেশের কথা মনে রাখতে হত এবং ঘড়ির কাঁটার অনুশাসন মেলে চলতে হত। তখন এল পি ছিল না, সি ডি মানে কমপ্যাক্ট ডিস্কও ছিল না। ক্যাসেট তো কেউ ভাবতেই পারত না। আজকের খোলামেলা অনুশাসন মুক্ত সময়ে নয়, তখনকার সেই বিধিবদ্ধ সময়েই আমার সংগীতজগতে প্রবেশ।

আমি আধুনিক গানই লিখতাম। আধুনিক গানই লিখছি আর যতদিন বাঁচব ততদিন এই আধুনিক গানই লিখে যাব। বাংলা গানের এই গীতিকবিতার ওপর কে যে কবে এই আধুনিক লেবেলটি এঁটে দিয়ে গেছেন তার হদিশ আমি কেন, অনেক গবেষকও খুঁজে পাবেন না। রবীন্দ্রনাথের গানকেও সেই যুগের এক ধরনের আধুনিক গানই বলা হত। পরে রেকর্ড কোম্পানিতে নিধুবাবুর গানের মতো গুরুদেবের গানকেও শুধু একটু বিশেষিত করা হয়েছিল রবিবাবুর গান বলে।

যাই হোক, আমি যে সময়ে গান লিখতে এলাম তখন রবীন্দ্রনাথের গান রবীন্দ্রসংগীত হয়ে গেছে এবং দ্বিজেন্দ্রলাল ও নজরুলের গানও তখন সবার কাছে দ্বিজেন্দ্রগীতি ও নজরুলগীতি হয়ে গেছে। আমি কবি ছিলাম কি না জানি না, তবে কৈশোর থেকে বুঝে নিয়েছিলাম, গান লেখা কবিতা লেখারই একটা অঙ্গ। এখনকার কবিরা আমাদের ‘গীতিকার’ আখ্যা দিয়েছেন। যার ফলে আমরা গীতিকার হয়ে গেছি কবি হতে পারিনি। আমাদের বাংলা সাহিত্যে যে বইটি নোবেল প্রাইজ পেয়েছে সেটি কিন্তু গীতাঞ্জলি। আমি জানি না, কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র আর গীতিকার প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পর্কে এঁদের কী ধারণা? আমি যখন স্কুলের নিচু ক্লাসে পড়ি তখন থেকেই কবিতা লেখার চর্চা শুরু করেছিলাম। সেগুলি আদৌ কবিতা হচ্ছে কি না সেই বোধ তখনও আমার আসেনি। তবু লিখতাম। বিশেষ করে ছোটদের কবিতা। ক্লাস ফাইভ কিংবা সিক্সে পড়ার সময়ে আমার লেখা একটি কবিতা আমি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম আনন্দবাজারের আনন্দমেলায়। সেটি প্রকাশিত হয়। সেই দিনটি আমার কাছে চিরস্মরণীয়। পাঁচটি আনন্দবাজার কিনে ফেলেছিলাম। তখন জেরক্স ছিল না তাই বন্ধুবান্ধবদের ওই কাগজগুলি দেখিয়েছিলাম। শুধু তাই নয় কিছুদিন পরে মানিঅর্ডারে পেলাম পাঁচ-পাঁচটি টাকা। তখন আর আমায় পায় কে? আনন্দের আতিশয্যে সদ্য কেনা নতুন জুতোটা পরে সারা বাড়ি মসমস করে বারকতক ঘুরে বেরিয়েছিলাম। আজ পর্যন্ত জীবনে গান লেখার সুবাদে অনেক টাকাই হয়তো রোজগার করেছি। কিন্তু ওই পাঁচটি টাকা আজও আমার কাছে মহার্ঘ হয়ে আছে।

আমার পিতৃদেব কান্তিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন নির্বাকযুগের চিত্রনায়ক। তিনি শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তর নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। নিউ থিয়েটার্সের এই শ্রীকান্ত দিয়েই চিত্রা সিনেমার দ্বারোদঘাটন হয়। বাবা ছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রথম যুগের ছাত্র। তারই সূত্রে অনেক শিল্পী, অনেক জ্ঞানী ও গুণীজন আমাদের বাড়ি ‘সালকিয়া হাউসে’ আসতেন। বাবার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন চিত্রপরিচালক সুশীল মজুমদার, সাংবাদিক মনুজেন্দ্র ভঞ্জ এবং গীতিকার ও সুরকার হীরেন বসু। ওঁরা যখন আসতেন তখন গান-বাজনা-সিনেমা নিয়ে অনেকরকম আলোচনা হত। কিন্তু বড়দের আসরে আমাদের মতো ছোটদের প্রবেশাধিকার ছিল না। তাই ওঁদের আলোচনা শোনার সুযোগ আমি সেই সময় পাইনি। বাবার বৈঠকখানায় একখানা ভাল পিয়ানো ছিল। বাবা বেশ ভালই বাজাতেন। একদিন সন্ধ্যায় শুনলাম, বাবা পিয়ানো বাজিয়ে আমার দিদিকে গান শোনাচ্ছেন, ‘শেফালী তোমার আঁচলখালি বিছাও শারদপ্রাতে’। বাবার কাছ থেকে দিদি গানটা তুলছেন। আমি পায়ে পায়ে ঢুকে পড়েছিলাম সেখানে। গান তো আমরা খুবই শুনতাম। কিন্তু এ গানের যেন একটা কোথায় বিশেষত্ব ছিল। গান শেষ হতেই বাবা বললেন, এটা কার সুর কার লেখা জানো? দিদি উত্তর দিল, জানি। হীরেনবাবুর। আর গেয়েছেন মিস লাইট। এর রেকর্ড আমি শুনেছি।

আমার কানে তখন কিন্তু বাজছিল একটাই কথা, তা হল, হীরেনবাবুর লেখা। তা হলে গানও লেখা যায়! বোধ হয় তখনই নিজেকে বোঝাতে পেরেছিলাম। তাই তো, মাসে মাসে এত যে নতুন গান বের হচ্ছে সেগুলি কেউ না কেউ নিশ্চয়ই লিখছে। গানও লেখা যায়, গানও মানুষ লেখে। সম্ভবত ক্লাস নাইন থেকেই আমার গান লেখা শুরু হল। বাবার একটা সুন্দর চার্চ অর্গান ছিল। বাবা সেটিও বাজাতেন। পিতৃস্মৃতি হিসেবে আজও আমি অর্গানটি সযত্নে রেখে দিয়েছি। তখন আমিও অর্গান বাজাতে শিখেছিলাম। ফাঁক পেলেই আমি অর্গান বাজাতাম আর লিখতাম গান। ক্লাস নাইনের ছেলে লিখছে প্রেম-বিরহের গান। সে সময় এটাকে অকালপক্কতা ছাড়া অভিভাবকরা আর কিছু ভাবতেন না। আমার লেখা গান শুনে বন্ধুবান্ধবরা খুবই বাহবা দিত। কিন্তু সেই গান কাউকে দেখানো বা শোনানোর সাহস আমার ছিল না। আমার জামাইবাবু সরোজ মুখার্জি তখন চিত্র প্রযোজক হয়ে অনেক ছবি করছেন। উনি আমার সঙ্গে খোলামেলা ব্যবহার করতেন। ওঁর সঙ্গে ওই বয়সেই আমি ক্লাবোবে যাতায়াতের সৌভাগ্য অর্জন করতে শুরু করেছি। একদিন সাহস করে ওঁকে দেখালাম কিছু গান। ওঁর প্রযোজনায় তখন ‘অলকানন্দা’, ‘মনে ছিল আশা’, ইত্যাদি ছবি রিলিজ করে গেছে। শ্যামলের স্বপ্ন’র কাজ শেষ করেছেন। এবার যে ছবিটা করতে চলেছেন তার নাম ‘অভিমান’। ছবির প্রধান তিনটি চরিত্রে আছেন পরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্ধ্যারানি ও স্মৃতিরেখা বিশ্বাস।

আমার গান দেখে উনি নিজেই আমায় উৎসাহ দিলেন। আমায় বললেন, তুমি তো ভালই গান লেখ দেখছি। আমাদের চিত্রনাট্য শেষ হতে চলেছে। একদিন অফিসে এসো। তোমায় কয়েকটা সিচুয়েশন দেব। যদি ভাল লিখতে পারো তা হলে তোমার গান আমি রাখব। তবে এবার আমার মিউজিক ডিরেক্টর বোম্বের। বোম্বে টকিজের বিখ্যাত আর সি পাল (রামচন্দ্র পাল)। ওঁর সিদ্ধান্তই কিন্তু চরম। আমাদের অ্যাপ্রুভালের পর উনি যদি তোমার গান অ্যাপ্রুভ করেন তবেই তোমার গান থাকবে। আমি তো আবেগে সরোজদাকে প্রণাম করে ফেললাম। সরোজদা বললেন, দাঁড়াও দাঁড়াও। আরও শর্ত আছে। গান রামবাবুকে তুমি পোস্টে পাঠিয়ে দেবে। তবে একবারের জন্যও জানাবে না তুমি আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। যদি জানতে পারি তুমি ওঁকে কিছু বলেছ তা হলে গান রিজেক্ট করে দেব।

আমি বললাম, আমি রাজি। সেদিনই শুধু বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। আচ্ছা বাবা রামচন্দ্র পাল কেমন সুর করেন? বাবা উত্তর দিয়েছিলেন, দারুণ। ‘বন্ধন’, ‘কঙ্কন’ ‘পুনর্মিলন’ সবই তো ওঁর সুর করা। উনি আমার একমাত্র টকি কল্পনার মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন। ওই যে পুনর্মিলন-এ স্নেহপ্রভার গান ‘নাচো নাচো প্যায়ারি…’ ওই সুরটা কাফি ঠাটের। এখনও সেটা সব বাঙালির ঘরে ঘরে। সেই ঠাকুরদাদা পেয়ারা খায়…’, মনটা চলে গেল স্বপ্নের রাজ্যে। কাফি, বেহাগ, ইমন, জয়জয়ন্তী, মল্লার, বাহার, সব যেন একসঙ্গে বেজে উঠতে লাগল আমার বুকের মধ্যে। পরে একদিন সরোজদার কাছ থেকে ‘অভিমান’ ছবির গানের সিচুয়েশনগুলি নিয়ে এলাম। রাত জেগে জেগে লিখে ফেললাম গান। ওঁদের ভাল লাগল।

মনে আছে এক নভেম্বর মাসে বোম্বাইতে পোস্ট করে গানগুলি পাঠিয়ে দিলাম। কয়েকদিন কেটে গেল। কিন্তু কোনও উত্তর এল না। আমার স্কুলের ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে টেস্ট পরীক্ষা। পরীক্ষার ছ’দিন আগে ফোন পেলাম। রামবাবু কলকাতায় এসেছেন। এবং কালই শ্যামবাজারের নলিনী সরকার স্ট্রিটের কলম্বিয়ায় গিয়ে আমাকে দেখা করতে বলেছেন। তখন এইচ. এম. ভি. আর কলম্বিয়া পাশাপাশি দুটি বাড়িতে ছিল। টেস্ট পরীক্ষার পাঁচদিন আগে মাকে মাস্টারমশাই-এর বাড়ি পড়তে যাচ্ছি বলে যথাসময়ে হাজির হলাম কলম্বিয়ায়। রামবাবু একটা ঘরে লাল বুশ শার্ট আর সাদা প্যান্ট পরে হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছিলেন। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই ভুরু বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে তুমি? কাকে চাও? তখন আমার সবে গোঁফ ওঠার বয়স। যথাসম্ভব স্মার্ট হয়ে বললাম, আপনি আমাকে ডেকেছেন তাই এসেছি। উনি বললেন, আমি ডেকেছি? কী নাম তোমার? নাম বললাম।

নাম শুনেই রামবাবুর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অস্ফুট স্বগতোক্তি করে বলে ফেললেন, কী হবে! আমি যে গানগুলো সুর করে ফেলেছি। সবাই খুব তারিফ করছে। আমি বিনীত কণ্ঠে বললাম আমি শুনব না? রামবাবু আর কথা বাড়ালেন না। পর পর শুনিয়ে গেলেন গানগুলো। তারপরেই বললেন, একটা গান আমি বদলাব। গানটা সবাই ভাল বললে কী হবে, আমার ভাল লাগছে না। আমি সুর দিচ্ছি, তুমি সুরের ওপর লেখো।

কথা শেষ করেই সামনে রাখা মেট্রোনাম যন্ত্রটি দম দিয়ে বাজিয়ে দিলেন। মেট্রোনাম এখন উঠে গেছে। এটি হল ঘড়ির কাঁটার মতো একটা যন্ত্র। যা দিয়ে ইচ্ছে মতো মিউজিকের তালগুলো টকটক করে বাঁধা গতে বাজানো যায়। কাহারবা, দাদরা, তেওড়া, প্রায় সব তালগুলিই শোনানো যায়। এতে তবলা ছাড়াই সুরশিল্পীরা কাজ করতে পারেন। আজকের দিনের রিদম বক্সের মতো এত শোরগোল হয় না। আমি আগেই বলেছি অর্গানের সুরে গান লেখা আমার অভ্যাস ছিল। এ ব্যাপারে পরবর্তীকালে আরও একটা ঘটনা ঘটে ছিল কুমার শচীনদেব বর্মণের সঙ্গে। সেটা পরে যথাসময়ে বলব। আমি তো রামবাবুর সুরের ওপর লিখে ফেললাম গান। আমার গান দেখে উনি খুশিই হলেন। ‘অভিমান’ মুক্তিলাভের পর আমায় বলেছিলেন, প্রথমদিন এই বয়স্ক গীতিকারকে দেখে উনি নাকি ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। ওঁর মনে হয়েছিল গানগুলো অন্য কারও লেখা। আর আমি সেইগুলি চুরি করে আমার নামে চালাতে এসেছি। সেজন্যই আমাকে উনি হাতেনাতে পরীক্ষা নিয়েছিলেন। যাই হোক, আসবার আগে রামবাবু বললেন, তুমি বাড়ি গিয়ে আবার ভাববে। যদি আরও কিছু বেটার হয় তবে তোমারই নাম হবে। পরশু এই সময়ে এসো।

পরশু? তার মানে আমার টেস্টের তিনদিন আগে। কিন্তু আমি দমে যাইনি। গানের পরীক্ষা আর স্কুলের পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, পরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুপ্রভা সরকারের কণ্ঠে জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল ছবির গানগুলো। তবে এই গান রেকর্ডিং-এর সময়ে আমাকে আবার ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল। এখন যেমন টেপ-এর ওপর সিনেমার গান রেকর্ডিং এবং ফাইনাল মিক্সিং হয়ে গেলেই সে গান সিনেমায় এবং ক্যাসেটে বা ডিস্কে পরিবেশন করা যায় তখন তা হত না। সিনেমার প্রতিটা গানই একবার সিনেমার জন্য ফিল্মি স্টুডিয়োতে আর একবার রেকর্ডে প্রকাশের জন্য গ্রামোফোন স্টুডিওতে রেকর্ড করা হত। প্রতিটি গানই কণ্ঠশিল্পীকে দুবার দু জায়গাতে গাইতে হত। যন্ত্রশিল্পীদেরও দুবার দু জায়গাতে বাজাতে হত। কিন্তু এই দুবার কাজটা করার জন্য কেউই কিন্তু দুবার পয়সা পেত না। ‘অভিমান’ ছবির গান রেকর্ডিংয়ের সময়ে আমি দমদমের এইচ. এম. ভি. স্টুডিয়োতে হাজির ছিলাম। এইচ-এম.ভি.-র তদানীন্তন অধিকর্তাও এই অল্পবয়সি গীতিকারকে দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করেছিলেন গান আপনার লেখা তো? গানের কথা কিন্তু কপিরাইট অ্যাক্টের আওতায় পড়ে। মামলা হলে মুশকিলে পড়ে যাবেন। আমি বলেছিলাম, রামবাবুকে জিজ্ঞেস করুন। রামবাবুর সুরের ওপর লিখেছি। এই রামচন্দ্র পাল সম্ভবত প্রথম বাঙালি সুরকার যিনি স্যুট-টাই পরে কলকাতায় বাংলা গান রেকর্ড করেছিলেন। এবং সম্ভবত তিনিই প্রথম কলকাতায় বাংলা গানে ‘ঢোল’ এবং পরবর্তীকালে ‘নাল’ ব্যবহার করেছিলেন। ‘অভিমান’ ছবি এবং গান দুই হিট করেছিল। তারপর ওঁরাই করেছিলেন বিখ্যাত অভিনেত্রী রমলাদেবীকে নিয়ে ‘জিপসি মেয়ে’। রামবাবুই ছিলেন সুরকার। তখন আমি স্কটিশ চার্চ কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। ‘জিপসি মেয়ে’ কলকাতার চাইতে ঢাকাতে বেশি হিট করেছিল। পরবর্তীকালে ওই ঢাকাতে গিয়ে আমি বহু পুরনো লোকের কাছে আমার লেখা ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও সুপ্রভা সরকারের গাওয়া ‘ওই প্রীতম এল তোর প্রেমের মায়ায়’—গানের সুখ্যাতি শুনেছি।

ইতিমধ্যে কলকাতায় বেতারে আমি গীতিকারদের তালিকায় তালিকাবদ্ধ হয়ে গেছি। কেন জানি না, বেতারের বিমান ঘোষ আমায় খুবই ভালবাসতেন। একদিন কলেজের ছুটির পর গার্স্টিন প্লেসে গেছি। আমাকে দেখে বিমানদা বললেন, পুলক এসো। আমাকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে স্টুডিয়োর একটা ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি লাকি। ওস্তাদ আলাউদ্দিন সাহেবের বাজনা শোনো। দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে বিমানদা চলে গেলেন। আলো জ্বলে উঠল। শুরু হল বাজনা। আমি দমবন্ধ করে বসে রইলাম। ভয় হচ্ছিল উনি কতক্ষণ বাজাবেন জানি না। যদি কথা বলে ফেলি, যদি নিশ্বাসের শব্দ করে ফেলি তবে আমার থেকেও বেশি বদনাম হবে বিমানদার। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে কোথায় যেন তলিয়ে গেলাম জানি না। ওই অপূর্ব সুরতরঙ্গ ছাড়া কিছুই মনে এল না। সংবিৎ ফিরল আলো নেভার পর। কিন্তু বেতারে আমার গান চললে কী হবে? রেকর্ড কোম্পানি বা অন্য ফিল্ম কোম্পানি কেউই আমার প্রতি আগ্রহী নয়। শুধু সরোজদার ছবিতেই গান লিখছি। এই সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে আমি ছটফট করতে থাকলাম। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পরবর্তীকালে একটা কথা আমাকে প্রায়ই বলতেন, কথাটা হল, এই লাইনে থাকতে গেলে দুটি জিনিসের খুব দরকার। তা হল, যোগ্যতা আর যোগাযোগ। তাঁর এই উক্তিটির কথা আমি এখনও উপলব্ধি করি।

ফিরে আসি আগের প্রসঙ্গে। সরোজদার ‘অলকানন্দা’ ছবিতে সুদর্শন প্রদীপকুমার প্রথম অভিনয় করেন। উনি পরে সরোজদার ‘অপবাদ’ ছবিতে বোম্বের নায়িকা সুলোচনা চ্যাটার্জির বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন। ওই ছবিতেই হেমন্তদা প্রথম আমার লেখা গান করেন। তখনই প্রদীপকুমারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। একদিন আমি এলিট সিনেমায় কী একটা ছবি দেখতে গেছি। ছবি ভাঙার পর বাইরে এসে দেখি প্রদীপকুমার ওঁর গাড়িতে বসে আমায় চিৎকার করে ডাকছেন। তখনও প্রদীপকুমার মেগা হিট নাগিনের প্রদীপকুমার হননি। তাই ততটা ভিড় জমেনি। তবুও কিছু কৌতূহলী জনতা ওঁকে দাঁড়িয়ে দেখছে। আমি দৌড়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। সোজা নিয়ে গেলেন ওঁদের বাড়িতে। যেতে যেতে বললেন, ফোন করে শুনলাম, এলিটে সিনেমা দেখছ। তাই এখানে এসে অপেক্ষা করছিলাম। গাড়িতে ছিলেন ওঁর দাদা কালিদাস বটব্যাল। উনি বললেন, তোমার লেখা গান আমার ভাল লেগেছে। আমি ছবি করছি ‘পলাতকা’। বুবু (প্রদীপকুমার ওরফে শীতল বটব্যালের ডাকনাম) হিরো আর মঞ্জু দে, লীলা দাশগুপ্তা দুজনেই হিরোইন। তোমায় গান লিখতে হবে। দক্ষিণামোহন ঠাকুর সুর করবেন। সেই মুহূর্তে মনে হল এটা কলকাতা নয় যেন স্বর্গধাম। আমি যেন হাওয়ায় ভাসছি।

অতি সুদর্শন বিখ্যাত যন্ত্রসংগীত শিল্পী দক্ষিণামোহন ঠাকুরের সঙ্গে আমি সিটিং করতাম ওঁর সহকারী নির্মলেন্দু বিশ্বাসের এলগিন রোডের বাড়িতে। তিনিও কিন্তু খুব নামকরা যন্ত্রসংগীত শিল্পী ছিলেন। এই দক্ষিণাবাবুর (মুম্বই-এর জনপ্রিয় দুখিবাবুর) ছেলে অভি ঠাকুর আজ শব্দযন্ত্রী হিসেবে এ দেশের গর্ব। আর ওই যে কালিদাসবাবুর ‘পলাতকা’ পরে সেটা ওঁরই নির্দেশনায় হিন্দিতে তৈরি হল ‘এক ঝলক’ নাম দিয়ে। খুবই হিট ছবি। সুরকার ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। নায়ক-নায়িকা প্রদীপকুমার আর বৈজয়ন্তীমালা।

এই ঘটনার কিছুদিন পর যোগাযোগ হল দেবনারায়ণ গুপ্তর সঙ্গে। দেবুদা ভারতবর্ষ মাসিক পত্রিকায় কাজ করতেন। কলেজ জীবনের শুরুতেই আমার লেখা ছোট গল্প দেবতা তাঁর পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। ‘পলাতকা’-র গান লেখার সময়েই একদিন রঙমহলে ডাকলেন দেবুদা। বললেন, বিখ্যাত গায়িকা এবং অভিনেত্রী রানিবালাকে দিয়ে তোমার গান থিয়েটারে গাওয়াব। তুমি এসো। বাবার মুখে সে যুগের অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীর নাম শুনতাম। প্রায়ই শুনতাম রানিবালা আর দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। এখনও ছোটবেলাকার কথা মনে পড়ে, দুর্গাবাবু আমাদের বাড়িতে রাতদুপুরে প্রায়ই আসতেন। সেই আশ্চর্য অভিনেতা দুর্গাবাবুর একটি চমকপ্রদ ঘটনার কথা এবার বলি।

বাবার কাছে গল্প শুনতাম কিংবদন্তি শিল্পী দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বাবাকে উনি খুবই ভালবাসতেন, বাবা ওঁকে ডাকতেন ‘দুর্গাদা’ বলে। বাবার কাছেই শুনেছি একবার কলেজ স্ট্রিটের মোড়ের নাট্যভারতী থিয়েটারে সম্ভবত দুইপুরুষ নাটকের ‘সুশোভন’ (দুর্গাদাস) অনুপস্থিত হন। কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেন অনিবার্য কারণে শিল্পী অনুপস্থিত। পরিপূর্ণ প্রেক্ষাগৃহের প্রায় সব দর্শকই হল থেকে বেরিয়ে টিকিট কাউন্টারের সামনে টিকিটের দাম ফেরত নিতে ভিড় করেন। হঠাৎ একটা খোলা ফিটন গাড়ির ওপর কোচম্যানের জায়গায় বসে দুর্গাদাস প্রেক্ষাগৃহের সামনে এসে বলে ওঠেন—শুনুন সবাই, আমি এখানে হাজির, কিন্তু থিয়েটারে ঢুকিনি। কারণ মালিক আমায় এখনও আমার আগের পাওনা মেটায়নি।

এই হলেন দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর হুড খোলা টুরার মটোর-এ নাকি চাঁদনি রাতে চন্দননগর যাবার পথে আমাদের বাড়িতে যখন খুশি আসতেন বাবাকে তুলতে। নিজে গাড়ি চালাতেন। বাবা তো ভয়ে জড়সড় হয়ে গাড়িতে বসে ‘দুর্গানাম’ জপ করতেন। আমরাও দু-একবার সে-গাড়িতে খুব ছোটবেলায় উঠেছি। খুব ভাল ছবি আঁকতেন তিনি। আমার বাবাও শান্তিনিকেতন থেকে ছবি আঁকা শিখেছিলেন।

দুর্গাদাসের উপহার দেওয়া কিছু ‘রং’ এবং ‘তুলি’ বাবা আজীবন সযত্নে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন।

যা হোক, এই দেবনারায়ণ গুপ্তর নাটক ‘জিজাবাই’-এ রানিবালার মুখে কলেজ ছাত্র আমার গান খুবই সাড়া তুলেছিল। তারপরই দেবুদা সিনেমায় যোগ দেন এবং ওঁর পরিচালিত প্রায় প্রতিটি ছবিতেই আমাকে দিয়ে গান লেখাতেন। শুধু তাই নয়, রঙমহল ছেড়ে যখন তিনি এদেশে প্রথম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত থিয়েটার স্টার-এ যোগদান করেন তখনও আমায় ভোলেননি। শৈলেন রায়ের মৃত্যুর পর স্টার-এ তাঁর পরিচালিত সব শেষ নাটকেরও গীতিকার ছিলাম আমি। দেবুদার মিনার্ভা থিয়েটারের কাছের বাড়িতে ওইসময়েই কী একটা ছবির গান লিখতে এসে মাস্টার সুখেনের দেখা পাই। সুখেন তখন ‘আশ্রম’ থেকে পালিয়ে এসে দেবুদার কাছে বাড়ির ছেলের মতো থাকে। দেবুদা বললেন, অপূর্ব ট্যালেন্টেড’ কিশোর শিল্পী। যেমন অভিনয় তেমন গানের গলা এবং তেমনই দ্রুত সংলাপ মুখস্থ করার ভগবানদত্ত ক্ষমতা। দেখো পুলক, এ খুব বড় হবে। দেবুদা ওঁর ছবিতে সুখেনকে দিয়ে গান-ও গাইয়েছিলেন। সেই ওর জন্য প্রথম গান লিখেছিলাম— ‘ওরে মুটি গয়লানীরে কবে তুই মরবি রে—’

কলেজের ওই থার্ড ইয়ার আমার সংগীতজীবনে খুবই স্মরণীয়। সরোজদার ‘কামনা’ ছবিতে উত্তমকুমার নায়কের ভূমিকায় ছিল। ছবি চলেনি। ‘ওরে যাত্রী’-তেও ছিল তা-ও চলেনি। উত্তম আর আমার ছোট ভাগ্নে আমার বড়দির ছোটছেলে ভবানীপুরের (অধুনা দেনা ব্যাঙ্কের বাড়ির) সুনীল চক্রবর্তী ছিল হরিহর আত্মা। আর হেমন্তদা ছিলেন আমার বড় ভাগ্নে প্রয়াত সুশীল চক্রবর্তীর ঘনিষ্ঠতম সুহৃদ। ওঁরা আমাদের হাওড়ার বাড়িতেও প্রায়ই আসতেন। একদিন ভবানীপুরে বড়দির বাড়িতে গিয়ে দেখি উত্তম বিরস বদনে বসে আছে। আমায় আগে যে-উচ্ছ্বাসে সংবর্ধনা করত তা তো করলই না উপরন্তু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল—এই যে মামা, (উত্তম আজীবন আমায় ওই ‘মামা’ বলেই ডেকেছে) এসো।

বুঝলাম, কিছু একটা হয়েছে। সুনীল বললে, ওর খুবই মন খারাপ। একটা ছবিও চলল না। ও নাকি ‘অপয়া’। প্রতিবাদ করলাম, কে বললে? নিউ থিয়েটার্সের ‘দৃষ্টিদান’ ছবির ‘বর’ উত্তমকুমার যদি অপয়া হত তা হলে ‘দৃষ্টিদান’ ফ্লপ করত।!

সুনীল হঠাৎ বললে—চলো মামা, মেসোর (সরোজ মুখার্জি) কাছে যাই। ওর নতুন ছবিতে যাতে উত্তম হিরো হয় তুমি আমি দুজনে অনুরোধ করি। তৎক্ষণাৎ আমি উত্তম আর সুনীল তিনজনে চলে গেলাম সরোজদার কাছে। নাছোড় আমাদের অনুরোধে সরোজদা উত্তমকে ওঁর নির্মীয়মাণ ‘মর্যাদা’ ছবিতে নায়কের ভূমিকায় স্মৃতিরেখা বিশ্বাসের বিপরীতে নিতে রাজি হল, কিন্তু একটা শর্তে। শর্তটা ছিল উত্তমকুমার স্বনামে অভিনয় করতে পারবে না। নামটা বদলে দিলেন সরোজদাই। করে দিলেন —অরূপকুমার। ‘এনি পোর্ট ইন দ্য স্টর্ম’। উত্তম রাজি হল সেই শর্ত মেনে নিতে। সরোজদা গম্ভীর গলায় বললেন, কী করব? আমি সিনেমা হাউস থেকে অ্যাডভান্স নিয়ে ছবি করি। তারা উত্তম আছে শুনলে কেউ-ই টাকা অগ্রিম দেবে না।

এই ‘মর্যাদা’-তে আমার লেখা একটা কোরাস গানে কণ্ঠ দিয়েছিল সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। জিপসি মেয়ে ছবি থেকেই সতীনাথ রামচন্দ্র পালের সহকারী হিসাবে কাজ করছিল। রামবাবু ‘মর্যাদা’-তে ওকে গান গাইবার সুযোগ দিলেন। ‘মর্যাদা’ ছবিতে নায়কের গান ছিল। নায়ক উত্তম-এর গানে কণ্ঠ দিয়েছিল তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ই উত্তমকুমারের প্রথম প্লে-ব্যাক শিল্পী। তারপর এম. পি. প্রোডাকসন্সের ‘সহযাত্রী’ ছবি থেকেই উত্তমের ঠোঁটে কণ্ঠ দিতে শুরু করেন হেমন্তদা

এরপর আমার স্মরণীয় ছবি ‘অনুরাগ’। ‘অনুরাগ’ স্মরণীয় এই কারণে যে এই ছবিতেই সতীনাথ প্রথম ‘ফ্রিলান্স’ সংগীত পরিচালনার সুযোগ পায়। কিন্তু নায়কের গান ও নিজে গায়নি। গাইয়েছিল তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়েই।

আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেই সময়েই মুক্তিলাভ করে আমার গানলেখা ছবি তারাশঙ্করের ‘না’। এই ‘না’ ছবিতে প্রথম সুর করেন তখনকার বিখ্যাত গায়ক শচীন গুপ্ত। ‘না’র গান খুবই হিট করেছিল। এখনও আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় এ ছবির ‘তারার চোখে তন্দ্রা এলো চাঁদ ঘুমালো ওই’ গেয়ে শোনায় বিভিন্ন স্থানে।

শচীন গুপ্ত সংগীত জগতে এসেছিলেন প্রায় ঝড়ের মতো, চলেও গেলেন সেই ভাবেই। মানুষ বড় নির্মম। কেউ আর মনে করে না ওঁকে। ওঁর গানের কোনও একটা সংকলনও আজ পর্যন্ত বের করেনি রেকর্ড কোম্পানি। অথচ ওঁর গাওয়া ‘এবার আমি আমার থেকে আমাকে বাদ দিয়ে’, ‘বন হরিণীর চকিত চপল আঁখি’, ‘সারারাত জ্বলে সন্ধ্যাপ্রদীপ’ প্রভৃতি বহু গান একদিন লোকের মুখে মুখে ফিরত। আমার গান লেখা এরপরের আরও দুটি ছবি ‘ঘুম’ আর ‘প্রশ্ন’-তেও চমৎকার সুর দিয়েছিলেন শচীন গুপ্ত।

চরম নিঃসঙ্গতায় কারও প্রতি কোনও অনুযোগ না রেখে পৃথিবী থেকে চলে গেলেন শচীন গুপ্ত। আমার কানে আজও বাজে ওঁর আর একটি ভাল গান—’খেলাঘরখানি ভেঙে দিয়ে গেল ঝড়।’ আগেই রেডিয়োর বিমান ঘোষের প্রসঙ্গ বলেছি। এই বিমান ঘোষ-ই আমায় সেসময় হঠাৎ ডেকে বললেন তুমি এবারের রেডিয়োর ‘দোলের’ প্রোগ্রামটা করো। তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলাম। বিমানদা আরও বললেন, জানো তো রেডিয়োতে এই সংগীতানুষ্ঠানের মর্যাদা ‘মহালয়া’র পরেই। তোমাকে চান্স দিলাম সদ্ব্যবহার করো। আর সুর কে করবে জানো তো? অনুপম ঘটক।

অস্ফুটভাবে বলে ফেললাম —অনুপম ঘটক? যাঁর সুর করা, খুব ছোটবেলায় শোনা—প্রমথেশ বড়ুয়ার ছবি ‘শাপমুক্তি’র ‘একটি পয়সা দাও গো বাবু’?

বিমানদা উত্তর করলেন—হ্যাঁ, হ্যাঁ যাঁর সুরে ‘তুলসী দাস’ ছবি।

তখনও আমার ঘোর কাটেনি। বলে চলেছি—আমি যাঁর ‘একলব্য’ শিষ্য সেই অজয় ভট্টাচার্যের লেখা—’বাংলার বধূ বুকে তার মধু নয়নে নীরব ভাষা’, যাঁর সুরে সুপারহিট? যাঁর সুরে বড়ুয়া সাহেবের ‘উত্তরায়ণ’-এর আমার স্কুল জীবনের সযত্নে রক্ষিত রেকর্ড—‘চৈতালী বনে মহুয়া কাঁদিছে।’

বিমানদাকে বললাম, আপনার মুখ রাখব বিমানদা।

বাড়ি এসেই ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ পড়ে পড়ে লিখে ফেললাম একটা সংগীতালেখ্য। ভুল ত্রুটি আছে কিনা পরখ করার জন্য আমার কলেজের বাংলার প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক কনক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে হাজির হয়ে গেলাম। কনকবাবু মন দিয়ে আমার স্ক্রিপ্টটা পড়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে আমায় খুবই উৎসাহ দিলেন।

বিমানদার কাছে এলাম স্ক্রিপ্টটি নিয়ে। বিমানদা একপলক দেখেই বললেন—অ্যাতো বড়? তোমায় তো বললাম আধঘণ্টা সময়।

আমি সবিনয়ে বললাম—পড়ে দেখুন, ধরে ধরে আধঘণ্টা লাগবে।

হেসে উঠলেন বিমানদা: ‘রিডিং টাইম’ আর ‘ব্রডকাস্টিং টাইম’ সমান হয় নাকি? এমনভাবে করো যাতে গাওয়া গান আর ন্যারেশ্যান-এর টাইম হয় আধঘণ্টার মধ্যে। এরপর আবার বাকি রাখতে হবে ক্রেডিট টাইটেল অর্থাৎ তোমাদের নাম শোনানোর জন্য চল্লিশ সেকেন্ড সময়।

বিমানদা তাঁর কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও আমায় সময় দিয়েছিলেন। ওঁর টেবিলে বসেই শুরু করলাম এডিটিং-এর কাজ।

রেডিয়োর ওই অনুষ্ঠানেই কিছুটা ঘনিষ্ঠতা হয় অনুপমদার সঙ্গে। তখন অনুপমদার পরপর আধুনিক গান হিট করছে। নন-ফিল্ম অর্থাৎ তথাকথিত আধুনিক গানের বুভুক্ষু আমি। কিছু আধুনিক গান ওঁকে দিয়ে রেকর্ড করাবার অনুরোধ জানালাম।

অনুপমদা খুবই গম্ভীর রাশভারী প্রকৃতির মানুষ ছিলেন।

আমার দিকে একটু তাকিয়ে উত্তর করলেন, লাফ দিয়ে যখন পড়েছেন, দেখবেন, তখন অবস্থিতির জায়গা একটা মিলবেই।

কিছুদিন পরেই শচীন গুপ্তের ছাত্র ও সহকারী নিখিল চট্টোপাধ্যায় (চিত্র পরিচালক নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের দাদা) আমায় ডাকলেন ওয়েলিংটন স্কোয়ার অঞ্চলের বিখ্যাত হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানিতে। ওখানে গিয়ে দেখি যামিনীদা (হিন্দুস্থানের সর্বাধ্যক্ষ যামিনী মতিলাল) আমার জন্য অপেক্ষমাণ। আমায় দেখেই বললেন—যাও, যাও স্টুডিয়োতে যাও। অনুপম তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। গানের কী কী সব কথা বদলাতে হবে।

সুরকার ও শিল্পী নিখিল চট্টোপাধ্যায়কে আমি তখন প্রায়ই গান দিতাম। বিভিন্ন বেতার শিল্পীরা নিখিলবাবুর কাছ থেকে সে-সব গান তুলে রেডিয়োতে নিয়মিত গাইত। ওঁকে আমার কিছু শ্যামা সংগীতও দেওয়া ছিল। তার থেকেই দুটো গান পছন্দ হয়েছে অনুপমদার, গাইছেন নিখিল চট্টোপাধ্যায়। সুরের সাবলীল ছন্দের খাতিরে দুটো কথার পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল, করে দিলাম। ওই হিন্দুস্থান স্টুডিয়োতেই রেকর্ড হল আমার প্রথম নন-ফিল্মি দুটো গান, অনুপম ঘটকের সুরে—প্রথমটি ‘এবার আমি মা চিনেছি, অন্যটি ‘মন্ত্রতন্ত্র নেই মা জানা/নেই মা জানা আচার বিচার।’ আমার সংগীত জগতের এই বিশেষ বিভাগে প্রবেশ ঘটল মায়ের গান দিয়ে মাকে প্রণাম করে—মায়ের আশিস নিয়ে। তার জন্যই হয়তো পরবর্তীকালে মান্না দে-র জন্য মাকে নিয়ে এত গান লিখতে পেরেছি।

আমার গান দিয়ে অনেক শিল্পী, অনেক সুরকারই সংগীত জগতে প্ৰথম পদক্ষেপ করেছে। এটা আমি বারবার বিস্ময়করভাবে উপলব্ধি করেছি। ভি. বালসারার সুরের প্রথম বাংলা ছবি ‘রাতের অন্ধকারে’। এতে গান লিখেছিলাম আমি। এই ছবিতে মুম্বই-এর হেলেনের একটা অপূর্ব নাচের আইটেম ছিল।

গানটির মূল ‘বেসটাকে বাংলায় লিখে বিভিন্ন অংশ লিখেছিলাম বিভিন্ন ভাষায়। হেলেন বিভিন্ন সাজে সেজে গানের বিভিন্ন পঙক্তিতে নেচে-নেচে হাজির হয়েছিলেন। এটাও আমার একটা চমৎকার অভিজ্ঞতা। বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে চিনের জুতোর দোকানের এক দোকানদারকে বললাম—-সাহেব, বলো তো আই লভ ইউটা চিনে ভাষায় কী হবে? সাহেব সোনা বাঁধানো একটা দাঁত দেখিয়ে ঝিলিক দিয়ে হেসে উত্তর করলেন—সিন আই দ উ আই নি।

চমৎকার ছন্দ পেলাম। স্থির করে ফেললাম গানটি চিনে ভাষা দিয়েই প্রথমে শুরু করব। লিখলাম ‘সিন্ আই দ্য/উ আই নি/চিনে ভাষা জানো কী?/শোনো তবে ইংরাজিতে তোমায় বলেছি/ও মাই ডার্লিং আই লভ দি।’

চমৎকার সুর করে ফেললেন বালসারা। সবাই শুনে বলল, চমৎকার হয়েছে। কিন্তু গাইবে কে?

বালসারা সাহেব তাঁর স্বভাবপ্রসিদ্ধ ভঙ্গিতে দাঁত দিয়ে হাতের নোখ কাটতে কাটতে বললেন—আশা ভোঁসলে হলে চলবে? আমি ওঁকে কলকাতায় নিয়ে আসতে পারি, ওঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই ভাল।’ তা-ই ঠিক হল। এই ‘আইটেম’ সংগীতটি এবং আর একটি রোমান্টিক গান গাওয়ার জন্য বালসারা সাহেব রাজি করিয়ে ফেললেন আশা ভোঁসলেকে কলকাতায় এসে গেয়ে যাবার জন্য।

তক্ষুনি আমার মাথায় হঠাৎ ঝলসে উঠল একটা দুর্ভাবনা। বন্ধুবর প্রয়াত মানিক দত্ত (জীবানন্দ দত্ত, চিত্রাভিনেত্রী অনীতা গুহের স্বামী) আমাকে একবার দারুণ ঠকিয়ে ছিল। ওর এক আত্মীয়ের বাড়িতে একবার আমায় ডেকেছিল। ওখানে ওই আত্মীয়টির শ্বেতাঙ্গি বিদেশিনী পত্নীকে ‘হ্যালো, হাউ ডু ইয়ু ডু’র মানে বলে, একটা চলতি অশ্লীল বাংলা কথা মুখস্থ করিয়েছিল।

ভদ্রমহিলা তো বাংলা জানেন না। মনে করেছিলেন এই বাংলা কথাটাই বাঙালিরা প্রথম আলাপে বলে। বাংলা বলে, আমাকে চমকে দেবার জন্য যেই আমার সঙ্গে আলাপ করলেন, প্রয়োগ করে ফেললেন সেই কথাগুলো। এক বিদেশিনীর মুখে পরিষ্কার বাংলায় সেকথা শুনে আমি দরদর করে ঘামতে লাগলাম। আর ঘরের বাঙালি মেয়েরা কানে আঙুল দিয়ে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেল। হেসে লুটিয়ে পড়ল মানিক দত্ত আর অন্য পুরুষেরা।

ভয় হল। চিনে সাহেব-ও যদি সেরকম কিছু করেন? আমি তো চিনা ভাষার কিছুই জানি না।

আবার বেন্টিক স্ট্রিট। আবার জুতোর দোকান। এবার অবশ্যই অন্য দোকান। দোকানদার এক চিনা সাহেবকে সরাসরি বললাম—বলো তো সাহেব, ‘সিন আই দ্য উ আই নি’র মানে কী?

সাহেব পাশে উপবিষ্টা এক যুবতী চিনা মহিলার দিকে তাকালেন। মহিলাও তাঁর ছোট ছোট চোখ দুটি কুঁচকে ফর্সা গালে একটু টোল ফেলবার চেষ্টা করে এক চিলতে হাসলেন। বুঝলাম গানটায় ভুল নেই। তবু সাহেবকে আমার গানের প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে বললাম—আপনি ইংরেজিতে বলুন এই কথাটা।

চিনা সাহেব এবার রীতিমতো চিনাবাজারি ইংরেজিতেই সেটা অনুবাদ করে শোনালেন। যাক, নিশ্চিন্তমনে বাড়ি ফিরলাম। আশা ভোঁসলে কলকাতায় প্রথম এলেন সঙ্গে তাঁর প্রথম স্বামী মিস্টার ভোঁসলেকে নিয়ে। ভদ্রলোক সদালাপী মিশুকে ছিলেন। ওঁরা দুজনেই মারাঠি। বম্বে থেকেই জানতেন কলকাতার ‘মহারাষ্ট্র নিবাস’-এর নাম। ওঁদের কথামতোই ওঁদের নিয়ে যাওয়া হল হাজরা রোডের ওই নিবাসে। কিন্তু আশাজির ওটা পছন্দ হল না। ওঁদের তোলা হল সম্ভবত গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে।

পরদিন দুপুরে বালসারাজির কাছে গান শিখলেন আশাজি। আমাকে বাংলা উচ্চারণ শেখাতে প্রাণান্ত পরিশ্রম করতে হল। তখন মোটেই বাংলা জানতেন না আশা। ভরসন্ধেয় পরিশ্রান্ত আমরা আশাজিরই কথামতো চৌরঙ্গিতে হেঁটে বেড়ালাম। তখন পত্র-পত্রিকায় প্লে-ব্যাক আর্টিস্টের এত ছবি বের হত না। টিভির নাম তো কেউ শোনেইনি। তাই কেউ আমাদের দিকে ফিরেও তাকাল না। আমরা স্বচ্ছন্দে হেঁটে বেড়াতে লাগলাম। সুধীন দাশগুপ্ত তখন গুরু দত্তের ছবি করার জন্য দীর্ঘদিন মুম্বইতে রয়েছেন। আশা ভোঁসলে হোটেলে ফিরেই আমায় বললেন—সুধীন দাশগুপ্ত কেমন সুর করেন?

বললাম, চমৎকার! আমার খুবই পরিচিত বন্ধু।

উনি বললেন—সুধীনবাবু আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। ওঁর সুরে বোধহয় আমি বম্বেতে ফিরে গিয়েই এবার বাংলা আধুনিক গান গাইব।

সুতরাং আশা ভোঁসলের জীবনে প্রথম বাংলা গান, ছবিতে। যার সৌভাগ্যবান গীতিকার আমি। সুরকার ভি. বালসারা। এবং আধুনিক গান সুধীন দাশগুপ্তের কথায় ও সুরে। ‘নাচ ময়ূরী নাচ রে’ ও ‘আকাশে আজ রঙের মেলা’। আশাজির প্রথম বাংলা গান আর. ডি. বর্মণের বলে আজকালকার পত্রপত্রিকায় যেসব লেখা বের হচ্ছে, সে-তথ্য সম্পূর্ণ ভুল। এরপর আশাজি এইচ. এম. ভি-তেই বিনোদ চট্টোপাধ্যায়ের সুরে পবিত্র মিত্রের কথায় পর পর দুটি আধুনিক গানের রেকর্ড করেন। মান্না দের সুরে আমার লেখা দুটি গান (১) ‘যখন আকাশটা কালো হয় বাতাস নীরব থাকে’(২) ‘আমি খাতার পাতায় চেয়েছিলাম একটি তোমার সই গো’। তারপর করেন পঞ্চমের সুরে বাংলা আধুনিক গান।

একটা কথা উল্লেখ করা এখানে প্রয়োজন। আশা ভোঁসলের ‘রাতের অন্ধকারে’র প্রথম বাংলা গান রেকর্ড করেন সত্যেন চট্টোপাধ্যায়। টেকনিসিয়ান্স স্টুডিওর ভ্যান গাড়িতে বসে রেকর্ড করা সে গান কত সুন্দর হয়েছিল। ওই ছবিতেই হেমন্তদারও গান ছিল। কী চমৎকার হেমন্তদার গলা এনেছিলেন সত্যেনবাবু। আর আজকের টেকনিসিয়ান্স স্টুডিয়ো? থাক সে-কথা।

ভি. বালসারার মতো এত রকম বাদ্যযন্ত্রের এত পারদর্শী বাজনদার বোধহয় এদেশে আসেননি। বালসারা মুম্বাই-এর একজন ডাকসাইটে বাজিয়ে ছিলেন। হঠাৎ অনিবার্য কারণে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। তাঁর বাজানো ‘আওয়ারা হুঁ’র পর ওই বাদ্যযন্ত্রের ‘ওঁয়া’ আওয়াজটি তখনও ‘আওয়ারা হুঁ’র সঙ্গে জোড় বেঁধে পথে ঘাটে ঘুরত। আমরা জানলাম এটি ওঁরই আঙুলের অপূর্ব কৃতিত্বের সুফল।

বালসারাজি কলকাতায় এসেই রবীন্দ্রসংগীতের সুরে ওঁর ঝুলি ভরে নিলেন। অসাধারণ মেধায় পরিষ্কার বাংলা বলতে লাগলেন। শুধু তাই নয়, পরিষ্কার হাতের লেখায় আমাকে বাংলায় চিঠিও লিখে ফেলেছিলেন।

ওঁর সুরে পরে অনেক বাংলা ছবিতেই আমি গান লিখেছি। লিখেছি অনেক সুপারহিট গানও। বাংলায় প্রথম ‘পপ’ গান ওঁরই সুর আর আমার লেখা। গেয়েছিল রানু। রানু মুখোপাধ্যায়। কনি ফ্র্যান্সিসের তখনকার গান ও খুবই ভাল গাইত। একদিন হেমন্তদার বাড়িতে শুনে আমরা দুজনেই মুগ্ধ হয়েছিলাম।

যখন এইচ. এম. ভি-র তখনকার অধিকর্তা এ. সি. সেন আমাদের বাংলা ‘পপ’ গান বানানোর আহ্বান জানালেন, বালসারাজি তখনই বললেন রানুর নাম। আমি সর্বান্তঃকরণে সে প্রস্তাব সমর্থন করলাম। এই এ. সি. সেনের কাছেই আমি শুনেছিলাম পার্ক স্ট্রিটের ট্রিংকাজ রেস্টুরেন্টের সিঙ্গার উষা উথুপের ইংরিজি গান। এইচ. এম. ভি. রেকর্ডে সে গান ইন্টারন্যাশনাল হিটও হয়েছিল। ওর গান শুনলেও ওকে দিয়ে বাংলা গান গাওয়ানোর সদিচ্ছা তখনও আমার আসেনি। অবশ্য পরে এই ঊষাই প্রথম বাংলা গানের রেকর্ড করেছিল আমারই কথায়, এই এইচ. এম. ভি-তেই। সেই গানের শুরু ‘মন কৃষ্ণ বলে’ নিয়ে পরের বছর ক্যালেন্ডার-ও বেরিয়েছিল।

সেদিন এ. সি. সেনের কাছ থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠেই চিন্তা হল কী নিয়ে লিখব? আমার গাড়ি চালাচ্ছিলাম আমিই। বাড়ির গেটের কাছেই প্রাণপণে ব্রেক কষতে হল। একটা কুকুর বাচ্চা! আর একটু হলেই চাপা দিতাম। গ্যারেজে গাড়িটা তুলে রেখে ওপরে উঠতে উঠতে মনে পড়ল আমাদের একটা পোষা কুকুর হঠাৎ বাড়ির গেট দিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় বেরুতেই গাড়ি চাপা পড়ে মারা গিয়েছিল। সারারাত তার দুঃখে আমি জেগে কাটিয়েছিলাম।

পরদিন বালসারাজি ফোন করে আমায় বললেন—আমার একটা আইডিয়া মাথায় আসছে। জুনিয়ার স্টেটসম্যানে প্রকাশিত একটা ঘটনা উনি শোনালেন। ওটা আমারও পড়া ছিল।

উত্তেজিত হয়ে বলে ফেলেছিলাম-এ একদম টেলিপ্যাথি। এ বিষয়টা আমিও ভাবছিলাম।

লিখে ফেললাম—’বুসি বল্‌ বুসি বল্‌ তুমি যে আমার’ ওর অপর পিঠে লিখলাম আমার এক আত্মীয়র সঙ্গে পর পর দু বছর পুরী বেড়ানোর অভিজ্ঞতার কথা। ওর মেয়ের সঙ্গে তার মায়ের দু বছরের বিভিন্ন আচরণ! একটি বছর কাটলো/সমুদ্র ফের ডাকলো/আমি আবার এলাম পুরীর সী বিচে।

এইচ. এম. ভি. কর্তৃপক্ষ গান দুটো শুনলেন। পরের গানটির খুবই তারিফ করলেন কিন্তু প্রথম গানটিতে ভুরু কুঁচকোলেন। পোষা কুকুর চাপা পড়া নিয়ে এ আবার কী গান?

কিন্তু আমরা অনড় ছিলাম।

অগত্যা ওই দুটি গানই প্রকাশিত হয়ে সুপারহিট হয়ে গেল।

পরের বছর রানুই বললে—আমি ‘জর্জি গার্ল’ আর কনি ফ্র্যান্সিসের ‘সামার ওয়াইনের’ বাংলা গাইব। আপনি সোজাসুজি ভার্সান’ বানিয়ে দিন।

বললাম—ও গান দুটো আমি শুনেছি। ওর পুরো ভার্সান বানালে সেটা রক্ষণশীল বাঙালির মনঃপুত হবে না। আমি ওই গানদুটো হুবহু সুরের ‘মিটারে’ আমার মৌলিক চিন্তায় দুটো নতুন বাংলা গান লিখে দিই।

সেইমতো দুটো গান রেকর্ড করল রানু। (১) ‘একা আমি যাই’, (২) ‘যখনি বেড়াই আমি পাইন বনে।’ রানু অপূর্ব গাইল গানদুটো। হেমন্তদা পর্যন্ত প্রশংসা করে ফেললেন। আমরা তো মুগ্ধ।

রেকর্ডিং-এর পরই বালসারাজি এইচ. এম. ভি-কে বললেন—রেকর্ডে কিন্তু সুরকার হিসেবে আমার নাম দেবেন না। আমার যখন সুর-ই নয় তখন আমার নাম কেন দেবেন?

এইচ. এম. ভি. বলল—তা হলে হেমন্তদার নাম থাক!

রাজি হলেন না হেমন্তদাও। যথাসময়ে রেকর্ডটা বের হল সুরশিল্পীর নামহীন হয়ে শুধু গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম বুকে করেই। আমার অন্য সব রেকর্ডের মতোই এটাই একটা এদেশে সর্বকালীন রেকর্ড

কিন্তু ভাবতে পারিনি সেই রেকর্ডের কী সাংঘাতিক পরিণাম।

একদিন দুপুরে বাড়িতে বসে লেখার কাজ করছি টেলিফোন বাজল। এইচ. এম. ভি.-র এ. সি. সেনের গলা: তুমি আজ এখনি আমাদের ডালহৌসির অফিসে এসো। খুব দরকার। টেলিফোনটা কেটে দিলেন এ. সি. সেন। এ ধরনের কণ্ঠস্বর কখনও শুনিনি। যথাসময়ে গেলাম। আমায় দেখেই মিস্টার সেন ফাইল থেকে মুখ তুলে বললেন, তুমি তো আইন পড়েছ, এটুকু জানতে না?

ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম ওঁর মুখের দিকে

উনি বললেন, যে-সব গান—ই. এম. আই. গ্রুপের নয় তা ব্যবহারের এক্তিয়ার এইচ. এম. ভি.-র নেই। তুমি অপরের সম্পদ পুরোপুরি নিয়ে নিলে?

আমতা আমতা করে বললাম-কিছুই বুঝছি না।

উনি বলে চললেন—নাও ঠ্যালা সামলাও। রানুর যে রেকর্ড করেছ তা হুবহু কপি করলে কেন? তালের চারটে ‘বারের’ পর সুরটা একটু বদলে দিতে পারলে না?

এবার পরিষ্কার হল ব্যাপারটা। বুক ফুলিয়ে বললাম—শুনে দেখুন। ওদের গানের কথা আর আমার গানের কথায় একবর্ণও মিল নেই। সম্পূর্ণ ‘ওরিজিন্যাল’। আমি ট্র্যানস্লেট করিনি।

এবার ধমক দিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ সেন সাহেব: তুমি থামো! রেকর্ডে শুধু তোমার নাম আছে। অর্থাৎ ‘কম্পোজার’ তুমিই, আর কেউ নয়। ওদের কপিরাইট অ্যাক্টে কথা ব্যবহার করা যেমন অপরাধ, সুর ব্যবহার করাও তাই। ‘কম্পোজিশন’ মানে কথা ও সুর দুই-ই! সুরটা যদি একটু বদলে দিতে কোনও ঝামেলাই থাকত না। এবার কষো ওদের দাবি করা ডলারের হিসেব।

শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত ঘরে গদি-মোড়া চেয়ারে বসে দর দর করে ঘামতে লাগলাম। মুখে কোনও কথাই এল না।

এবার একটু হেসে আমার দিকে একটা কাগজ বাড়িয়ে দিলেন। সই করো।

পড়তে যাচ্ছিলাম কাগজটা। আবার ধমক খেলাম। শুনলাম: আর বিদ্যে জাহির করতে পড়ে দেখতে হবে না—সই করে দাও।

সই করে দিলাম কাগজটায়।

উনি বললেন—আমি ‘করেসপন্ডেন্স’ করে সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। তোমার রয়্যালটির ফিফটি পার্সেন্ট ওদের দিয়ে দিতে হবে। তা হলেই তুমি ফ্রি।

মুক্তির যে কী আনন্দ সেদিন ওখানে মনপ্রাণ দিয়ে অনুভব করেছিলাম। যাকগে, ফিফটি পার্সেন্ট রয়্যালটি দিয়ে আমি তো স্বাধীন—আমি তো মুক্ত!

ওই রেকর্ডটি প্রচুর বিক্রি হয়েছিল। তখনই একদিন মাথায় এল এরপরে রানু আর হেমন্তদাকে নিয়ে গান বানাব। আমার সারাজীবনই যেই কথা সেই কাজ। লিখে ফেললাম, ‘বাবা-মেয়ের গান’। ‘আয় খুকু আয়।’ বাংলা গানে একটা সম্পূর্ণ নতুন সংযোজন।

হেমন্তদাকে দেখালাম গানটি। উনি বললেন—অপূর্ব লিখেছ। কিন্তু রানু এ গান গাইবে না। আমায় ও ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে ও নাকি স্ট্যাম্পড হয়ে যাচ্ছে ‘পপ সিঙ্গার’ বলে। ও তাই ক্ল্যাসিকাল গান শিখছে। এবার অন্য ধরনের গান গাইবে ও। তবে আমার নিজের দারুণ ভাল লেগেছে গানটা, তুমি যার সঙ্গে বলবে, আমি তার সঙ্গেই গাইব।

বললাম—বাবা-মেয়ের গান—আপনি রানু গাইলে ব্যাপারটা আপনা থেকেই যতটা এগিয়ে থাকবে অন্য কেউ গাইলে ততটা হবে কী?

হেমন্তদা উত্তর করলেন: সে তোমার ব্যাপার। যা ভাল বোঝো, করো।

গানটা বালসারাজিকে দেওয়া ছিল। চমৎকার সুর করে রেখেছিলেন উনি। কিন্তু পড়েই রইল গানটা।

অনেক পরে যখন শ্রাবন্তী মজুমদারের এ ধরনের গানে একটু নাম হয়েছে, তখন বালসারাজি বললেন—পুলকদা, (উনি বয়সে আমার থেকে বড় হলেও চিরদিন দাদা বলেই ডেকেছেন বলেছেন, এ এক ধরনের আদর) হেমন্তদা আর শ্রাবন্তীকে দিয়ে গানটা করাই।

গানটার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। বালসারাজি মনে করিয়ে দিতেই বললাম— খুব ভাল হবে।

সময়ের সঙ্গে ঠিক পরম্পরা রাখতে পারছি না। এগিয়ে এসেছি অনেকটা। এবার ফিরে যাই।

আগেই বলেছি আধুনিক গানের জগতে ঢুকতে আমাকে যে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তা বলে বোঝানো যাবে না।

আমি যখন সেই বন্ধ দরজায় করাঘাত করছি তখন এইচ. এম. ভি.-র প্রায় সর্বাধ্যক্ষ ছিলেন পি. কে. সেন আর তাঁকে বাংলা গানের সব কিছু পরিচালনা করতে সাহায্য করতেন গীতিকার পবিত্র মিত্র—উনি এইচ. এম. ভি.-তেই শেষজীবন পর্যন্ত চাকরি করে গেছেন।

চিত্রজগতে তখন আমার অনেক গান চালু। প্রায় প্রতিটি কণ্ঠশিল্পী প্রতিটি সুরশিল্পী-ই আমাকে চেনেন। কিন্তু কেউই কিছু তখন আমার জন্য করেননি।

পবিত্র মিত্র-র কাছে প্রায়ই যেতাম। উনি পাত্তাই দিতেন না। তবু হাল ছাড়িনি। আবার গেছি। একদিন বললেন, আমাদের শনিবারের দুপুরের আড্ডায় আসবেন।

আড্ডার এই টিকিট প্রাপ্তিটা কাজে লাগল।

আমার সহপাঠী অজয়ের বড়দা অনল চট্টোপাধ্যায়। উনি আমাদের বাড়ির পাশেই থাকেন। ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ হত। উনি তখন গান লিখতেন, সুর-ও করতেন। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই—ওঁর গান লেখা আমার তেমন ভাল লাগত না।

সুরগুলো লাগত দারুণ। প্রায়ই বলতাম-অনলদা, আপনি গান লেখা ছেড়ে দিন। সুর করা নিয়েই থাকুন।

অনলদা বলতেন, কিন্তু এইচ. এম. ভি. যে আমার লেখাই রেকর্ড করে, সুর তো রেকর্ড করতেই চায় না।

তখন অনলদা আমার অনেক গান সুর করেছিলেন। কিন্তু বেতারে ছাড়া একটা গানও

কোথাও কাজে লাগাতে পারেননি। আমার অবস্থা বুঝে হঠাৎ একদিন বললেন—পুলক, আমি পারব না। তবে অভিজিৎকে বলেছি। ও চেষ্টা করবে বলেছে। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়-কে চিনতাম কিন্তু তখনও কোনও গান লিখিনি।

অনলদা আমায় সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন অভিজিতের ঢাকুরিয়ার বাড়িতে। কথায় কথায় অভিজিতের সঙ্গে আত্মীয়তাও বেরিয়ে গেল। বয়সেও জানলাম আমরা প্রায় সমান-সমান। যা হোক, অভিজিৎই পবিত্রদাকে শোনালেন আমার লেখা রেকর্ড হতে যাওয়া প্রথম আধুনিক গান। অভিজিৎবাবু পবিত্রদাকে জোর গলায় বলেছিলেন—আপনি বলুন পবিত্রদা, এ গানটা কীসে খারাপ? কেন আপনি রেকর্ড করবেন না?

এবার বোধহয় আমার প্রতি একরকম করুণা করেই পবিত্রদা গ্রহণ করলেন সেটা।

প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় গাইলেন সে গান—’তোমার দু’ চোখে আমার স্বপ্ন আঁকা’। দারুণ হিট।

এ-ঘটনার বেশ কিছুদিন আগে আমাদের পাড়ার পারিজাত সিনেমার মালিক মুণ্ডিভাই ছবি করতে এলেন। ছবির নাম অসমাপ্ত। অসমাপ্তে পাঁচজন গীতিকার, পাঁচজন মিউজিক ডিরেক্টর। শেষজনটি অর্থাৎ ভূপেন হাজারিকার নামের প্রস্তাব করলাম আমি-ই ভূপেনবাবুর গান তখন কোথায় যেন শুনেছিলাম। দারুণ নতুনত্ব লেগেছিল। অলকা সিনেমার রমেন মুখার্জি (রামু) তৎক্ষণাৎ তাকে সমর্থন করল।

গৌহাটিতে খবর পাঠানো হল ভূপেন হাজারিকাকে। ভূপেনবাবু তখন পত্নী প্ৰিয়ম হাজারিকাকে নিয়ে এলেন। ওঁর তখন কলকাতায় কোনও আস্তানা নেই। ওঁরা রইলেন পারিজাত সিনেমার-ই লিলুয়ার চমৎকার বাগানবাড়িতে। প্রায়ই দেখাশোনা হত। শুনতাম না-শোনা অনেক অসমিয়া গান।

ভূপেনবাবুর সুরে অসমাপ্ত ছবিতে সতীনাথের গাওয়া আমার লেখা যে গানটি বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেটি ছিল—’কন্যা তোমার কাজল ধুলো কী সে?/কোন্ বেহায়া খোঁপা খুলে/কুসুম দিল এলো চুলে/লাল হলো গাল ছাঁচি পানের কোন রাঙা রস মিশে?’

মনে আছে ‘অসমাপ্ত’-এর কাহিনীকার চিত্রনাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্য আমায় সিচুয়েশন বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন— লেখো, ‘অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে—এই ভাবটা নিয়ে। পল্লীগীতির স্টাইলে সেই ভাবটা প্রকাশ করেছিলাম অসমাপ্তের ওই গানটিতে।

তখন বাংলা আধুনিক গান খুবই জনপ্রিয় ছিল। টিভি তো আসেনি। রেডিয়োই ছিল বাংলা গান শোনার একমাত্র মাধ্যম। কণ্ঠশিল্পীরা কেউ কেউ রেডিয়োতে মাসে দুবার করেও প্রোগ্রাম করতেন। বেতারে যে গানটা বোঝা যেত শ্রোতারা খুবই পছন্দ করলেন সেই গানটাই সাধারণত রেকর্ড করা হত।

আর ছিল শনিবার আর রবিবারের দুপুরের রেকর্ড শোনার অনুরোধের আসর। বাছাই করা জনপ্রিয় গানই ওখানে নিয়মিত বাজানো হত। কালক্রমে এই বিখ্যাত আসরটাই রেডিয়ো কর্তৃপক্ষ নষ্ট করে ফেললেন। বিভাগীয় অধিকর্তাদের কাছের মানুষ অর্থাৎ স্বজন পোষণে। প্রকৃত সুরসমৃদ্ধ শিল্পী ছাড়া কারও গানই যে আসরে পরিবেশন করা হত না—সে আসরে ঢুকে পড়ল বেনোজল। এই সব তথাকথিত গলা কাঁপানো নিজের টাকায় রেকর্ড করা শিল্পীরা মুঠো মুঠো বেনামি চিঠি ছাড়তে লাগলেন—ওঁদের নিচুমানের গান পরিবেশন করার অনুরোধ জানিয়ে। অনেক ক্ষেত্রে তাই বাধ্য হয়েও ওঁদের গান বাজানো হতে লাগল। শ্রোতারা কিছুই বুঝলেন না। কিন্তু ক্রমশ বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠলেন। আরও কিছু রেকর্ড কোম্পানি থাকলেও প্রায় মনোপলিই ছিল এইচ. এম. ভি.-র কারণ রেকর্ড ছাপাবার মেশিন আর কারও ছিল না। ওঁদের এইচ. এম. ভি.-কে তুষ্ট করেই চলতে হত!

এই এইচ. এম. ভি-র পি সি সেন আর পবিত্র মিত্রর অঙ্গুলি হেলনেই নির্ভর করত প্রায় সমস্ত কণ্ঠশিল্পীর ভাগ্য। ওঁরা সুরকারদের কাছে গান শুনতেন। যে-গানটা ওঁদের পছন্দ হত সেই গানটাই ওঁদের পছন্দমতো শিল্পীকে দিয়েই রেকর্ড করাতেন। নবাগত বা নবাগতা শিল্পীদেরও ওঁরাই নির্বাচন করতেন।

কড়ি ও কোমলের গান শুনে ভূপেন হাজারিকাকে পি. কে. সেন, এইচ. এম. ভি.-তে আহ্বান জানালেন। তখন বাংলা গানে অনেক অনেক গীতিকারের নক্ষত্রের মেলা। ভূপেনবাবু কিন্তু আমাকে ডাকলেন এবং আমায় শোনালেন ওঁর একটি অসমিয়া গান— ‘ভাঙ ভাঙ ভাঙ ঘটা ভাঙ’। আমি ওই সুরের ওপর লিখলাম—শ্যামল মিত্রের জন্য ‘চৈতালী চাঁদ যাক্ যাক্ ডুবে যাক্।’ এর পরই করলাম আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তারাদের চুমকি জ্বলে আকাশে।’ এমনি অনেক গান।

তখনই ভূপেনবাবু হেমন্তদার ছবি ‘নীল আকাশের নীচে’ চিত্রপরিচালনা করার ভার নিয়েছিলেন। ছবির নায়ক তখন নির্বাচিত ছিল উত্তমকুমার। যদিও পরে পরিচালনা করেছিলেন মৃণাল সেন ও নায়ক ছিলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। মহরত হয়েছিল। মহরতে ক্ল্যাপস্টিক দিতে লতাজি কলকাতায় এলেন। আমরা দমদমে ওঁকে অভ্যর্থনা জানাতে হাজির হলাম। পি কে সেন পবিত্র মিত্রও ছিলেন।

এয়ারপোর্টেই লতাজি আমাকে এক ফাঁকে বললেন—আমি আমার জীবনের পুজোর প্রথম বাংলা গান রেকর্ড করে যাব। আপনার ‘কড়ি ও কোমল’ আমার খুবই ভাল লেগেছে। ভূপেনদাকে দুটো গান দিন। লতাজির সঙ্গে অনেকেই আলাপচারী করছিলেন। উনি প্রত্যেককেই বলছিলেন কাল মহরত, পরশু সকালেই ফিরে যাব বোম্বাই। আমায় বললেন বাংলা গান রেকর্ড করে যাবেন। তা হলে রেকর্ড করবেন কবে? মনকে বোঝালাম বিখ্যাতরা এমন অনেক কথাই বলেন, এ হল কথার কথা।

পর দিন মহরতের এক ফাঁকে লতাজি বললেন, সবাই জানে আমি গ্র্যান্ডে আছি, কিন্তু আছি, ভূপেনদার টালিগঞ্জের গলফ ক্লাবের ফ্ল্যাটে। ওখানে কাল সকালেই চলে আসুন।

ডুবে যাওয়া চাঁদটা আবার হাতের মুঠোয় পেলাম। টালিগঞ্জে আসতেই লতাজি হাসতে হাসতে বলে ফেললেন—পি. কে. সেন ওঁর সাকরেদ পবিত্রবাবুর গান চাইছিলেন। আমি আর ভূপেনদা দুজনেই বলেছি আপনার নাম।

বললাম—কিন্তু রেকর্ড করবেন কবে? আজই তো ফিরে যাবেন। উনি বললেন—না, না সবাইকে বলেছি আজকে ফিরে যাবার কথা। আসলে আমি যাচ্ছি না। অমুক তারিখে রেকর্ডটা করে ফিরব। আমি থাকছি জানলে এখানের সব মিউজিক ডিরেক্টর, সব রাইটার-ই আমায় গান করার জন্য ধরবেন, আমি কাকে ফেরাব বলুন তো?

এবার মুখোমুখি হলাম আর একটা সঙ্কটের। ভূপেনবাবু আমায় বেশ বিরক্তির সঙ্গেই বললেন—কিন্তু রেডি গান কোথায়? নতুন গান সুর করার আমার সময় নেই এখন। বললাম—-একটা গান তো আমাদের আছে। ‘মনে রেখো ওগো আধো চাঁদ।’

বললেন—ওটা আপনার লেখার ওপর সুর করেছিলাম। একটুও মনে নেই। এখনই একটু যে বসব তারও উপায় নেই। হারমোনিয়ামটা সারাতে দিয়েছি এখনও দিয়ে গেল না।

ভূপেনবাবুকে ধরে নিয়ে গেলাম আমার বড়দির ভবানীপুরের বাড়িতে। ও বাড়িরই উঠোনে উত্তম ব্যাডমিন্টন খেলত। আমরা ক্লাব করেছিলাম মরশুমী ক্লাব। ভূপেনবাবুও এখানে যোগ দিয়েছিলেন। আমার বড় ভাগ্নে—আমার থেকে বয়সে বেশ বড়—সুশীল চক্রবর্তীর বন্ধু ছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, হেমন্তদা, সুধীরলাল চক্রবর্তী প্রমুখ। ওর একটা চমৎকার হারমোনিয়াম ছিল। হেমন্তদা এই হারমোনিয়ম বাজিয়ে বহু জনপ্রিয় গান ওই বাড়িতে বসে সৃষ্টি করে গেছেন।

ভূপেনবাবু ‘মনে রেখো ওগো আধো চাঁদ’ গানটা আবার নতুন করে সুর করে ফেলেই বললেন, অসম্ভব। আর সময় নেই। রেকর্ডিং ক্যানসেল করে দিতে হবে। আমার জনতা পিকচার্সে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। ওখান থেকে বেরিয়ে চাংওয়া রেস্টুরেন্টে খেয়ে আমি আর একটা কাজে যাব।

বাধা দিলাম না ওঁকে। দুজনে একসঙ্গে চৌরঙ্গিতে নামলাম। উনি চলে গেলেন জনতায়। আমি কিছুক্ষণ চৌরঙ্গি অঞ্চলে ঘুরে ফিরে পায়ে পায়ে হাজির হলাম চাংওয়াতেই। ধরে ফেললাম ভূপেনবাবুকে একটা কেবিনে। ভূপেনবাবু প্রথমটা চমকে গেলেও আমাকে হাসিমুখে ওখানে বসালেন। আমার জন্য খাবারও বললেন।

আমার উদ্দেশ্য কিন্তু খাওয়া নয়—–আমার উদ্দেশ্য আর একটা গান লেখা। ভূপেনবাবুর আর একটা গান ওঁর মুখে প্রায়ই শুনতাম। ভারী ভাল লাগত। শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল গানটা। ‘পরছ পুয়াতে তুলো না’। মনে হল, এই সুরের ওপর আমি এখনি একটা গান লিখতে পারব, লতাজি গাইলে দুর্দান্ত হবে।

কলম সঙ্গে ছিল, কিন্তু কাগজ কোথায়? খাবার বিলের ওপরই লিখে ফেললাম—রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে। এবার ভূপেনবাবু অন্য সত্তায় চলে গেলেন। কেবিনের মধ্যেই গাইতে লাগলেন। ওই চাওয়াতেই জন্ম হল লতা মঙ্গেশকরের পুজোর প্রথম বাংলা গান।

স্বভাবতই পর পর কিছু গান ‘হিট’ হওয়াতে আধুনিক গানের বন্ধ দরজাটা হাট করে খুলে গেল।

পূর্ণ সিনেমার পাশে সাস্তুদার বাড়িতে একদিন হেমন্তদাকে নিরিবিলিতে পেয়ে বলে ফেললাম—লতাজি আমার গান করলেন অথচ আপনি আজ পর্যন্ত আমার একটাও নন্-ফিল্ম গান করলেন না?

হেমন্তদা বললেন—গান কই? দেখাও?

জামার পকেটে তখন সব সময়েই দু-চারটে গান থাকতই। বার করলাম। উনি বললেন—পড়ে শোনাও।

প্রথম গানটিই পড়লাম—’ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না/ও বাতাস আঁখি মেলো না/আমার প্রিয়া লজ্জা পেতে পারে/আহা, কাছে এসেও ফিরে যেতে পারে।’

হেমন্তদার তখন প্রতিটি মুহূর্ত দামি। ওইটুকু শুনেই বলে উঠলেন—ব্যস, ব্যস, আর শোনাতে হবে না। এই গানটা আর তোমার পছন্দমতো আর একটা গান আমাকে পোস্টে মুম্বইতে পাঠিয়ে দাও। আমি পরের বারই কলকাতায় এসে রেকর্ড করব। মুশকিলে পড়লাম। আমার পছন্দ মতো গান? যদি হেমন্তদার পছন্দ না হয়, তা হলে তো রেকর্ডিংটা পেছিয়ে যাবে। হয়তো হবেই না। যা হোক, অনেক চিন্তা ভাবনা করে অনেক বেছেবুছে উল্টোপিঠের গানটা কপাল ঠুকে পাঠিয়ে দিলাম হেমন্তদাকে। উনি আজীবন এক কথার মানুষ। জীবনে কোনও কথা ওঁকে নড়চড় করতে দেখিনি। পরের বার এসেই রেকর্ড করলেন—’ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না’ আর ‘কতো রাগিণীর ভুল ভাঙাতে।’ সেই কবেকার গান। কিন্তু আজও লোকে শুনছে। এবারেও তার রয়্যালটি পেয়েছি। এই হেমন্তদার কথা বলে শেষ করতে পারব না। পরে আবার বলব।

আমার সঙ্গে এবার যোগাযোগ হল নচিকেতা ঘোষের সঙ্গে। গানের জগতে দুজন ডাক্তার নাম করেছিলেন। একজন হাসির গানের শিল্পী যশোদাদুলাল মণ্ডল আর একজন সুরকার নচিকেতা ঘোষ। নচিকেতা ঘোষের সুরের মেলোডি চিরদিন বাংলা গান মনে রাখতে বাধ্য হবে।

দারুণ মজার মজার কথা বলতেন নচিবাবু। আমি কতদিন সকালে কত নতুন নতুন গান ওঁর সঙ্গে করেছি তার শেষ নেই। দ্বিজেন মুখার্জিও প্রায়ই ওই গানের আড্ডাতে শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড়ের কাছে ওঁর বাড়ির ছাদের ঘরে জমায়েত হতেন। বেশ ছিল দিনগুলো। রবীন মজুমদার যখন দারুণ অসুস্থ তখন এই নচিবাবুই ওঁকে রেখেছিলেন ওই বাড়ির ছাদের ঘরে। ওঁরই জন্য রবিদা নতুন জীবন ফিরে পান।

নচিবাবু ওখানেই হঠাৎ বললেন—জানো পুলক, পুলিশ ফোর্স উঠে গেছে। হান্ড্রেড ফরটি ফোর আর নেই।

বললাম—কোথায়? হা হা করে হাসলেন নচিবাবু: কোথায় আবার, শ্যামবাজারেই এইচ. এম. ভি.-তে। পি. কে. সেন তোমার গান নিতে বলছেন।

তার আগের দিন রাতেই আমাদের বাড়ির বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম জ্যোৎস্না রাতের চন্দ্রমল্লিকাকে। বাগানের সেই মনোমুগ্ধ পরিবেশ দেখে লিখেছিলাম— ‘ও আমার চন্দ্রমল্লিকা বুঝি চন্দ্র দেখেছে।’ গানটা ওঁকে দিতেই তৎক্ষণাৎ সুর করে ফেললেন উনি। রেকর্ড করেছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।

এই নচিকেতাই একদিন সিরিয়াসভাবে বললেন—জানো? যে-সব ফিল্মে শ্যামল সতীনাথ উৎপলা আলপনা গেয়েছে, এইচ. এম. ভি. আর সে সব রেকর্ড প্রকাশ করবে না। ওরা চারজন আউট! কিন্তু কেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *