কথামুখ
আমার প্রিয় বন্ধু, প্রিয় অভিনেতা এবং খুব কাছের মানুষ অনুপ— অনুপকুমারের অভিনয় জীবনের পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেল। এটা ভাবতে আমার যেমন বিস্ময় লাগছে তেমনি আনন্দও হচ্ছে। কিন্তু এই সত্যটাও গোপন করে রাখতে পারছি না, যে এই ঘটনাটা আরও আরও বেশি করে লোকচক্ষুর সামনে আসা উচিত ছিল এবং প্রয়োজনও ছিল। সকলের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, যে মানুষটা পঞ্চাশ বছর ধরে একটানা দর্শকদের থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে অভিনয় করে যাচ্ছেন তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন করার মতো দৃষ্টিভঙ্গি বা ইচ্ছা অনেকেরই নেই। ফলে অনুপের পঞ্চাশ বছর অভিনয় পূর্তি নিয়ে যে উৎসাহ, আলোচনা অথবা স্বীকৃতি প্রত্যাশিত ছিল তা হয়নি এবং এটা, আমার মতে, অনুপের নয়— আমাদেরই দুর্ভাগ্য।
পরিচালক-অভিনেতা এই সম্পর্কের ভিত্তিতে অনুপ আমার কুড়িটি ছবিতে কাজ করেছে। কিন্তু অনুপ শুধুই একজন অভিনেতা হিসাবে আমার পরিচালক জীবনের কুড়িটি ছবিকে ভরিয়ে দিয়ে গেছে এটুকু বললে একধরনের কৃপণতা এবং অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। আমি সেই সমস্ত কথাই বলতে চাই যা একান্ত আমারই কথা, সেকথা অনেকেরই জানা নেই, হয়তো অনেকের জানার প্রয়োজনও নেই অথবা ইচ্ছাও নেই। কিন্তু যেহেতু সেগুলো আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত মূল্যবান তাই আমি অনুপের পঞ্চাশ বছর অভিনয়-জীবন পূর্তি উপলক্ষে কোনও ফুলের তোড়া নয়— সেই কথাগুলো দিয়ে সাজানো কথার তোড়া গভীর প্রীতির সঙ্গে অনুপের হাতে তুলে দিতে চাই। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলা দরকার যে অনুপ সম্পর্কে কোনও মূল্যায়ন করা আমার পক্ষে অত্যন্ত অসুবিধাজনক। কারণ যে লোকটা চোখের অত্যন্ত কাছে থাকে সে লোকটার আকার, চরিত্র এগুলো সম্পর্কে মাপজোক করা খুব মুশকিল। একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। দূর থেকে হিমালয়কে পরিপূর্ণভাবে দেখতে পারেন, কিন্তু হিমালয়ের একেবারে কাছে চলে গেলে দেখবেন শুধু একটা পাথরের টুকরো। অনুপও আমার কাছে অনেকটা সেরকম। এতো কাছ থেকে এত বছর এত সুখ-দুঃখে আমরা একসঙ্গে আছি যে ওর সম্পর্কে আমার বৈজ্ঞানিক বিচারে ত্রুটিটুকু মেনে নেব, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই কাছাকাছি থাকার আনন্দটাকে ত্যাগ করতে পারব না।
সত্যি কথা বলতে কী— অনুপের সঙ্গে আমার কবে কিভাবে আলাপ হয়েছিল তা আজ আর মনে নেই। তবে শ্রীমতী পিকচার্সে১ আমি যখন সহকারী পরিচালক (শিক্ষানবিশ বলাই সঙ্গত) হিসাবে কাজ করছিলাম তখন ‘দেবত্র’ ছবিতে অনুপ একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করতে এসেছিল। সেই সময়ই সম্ভবত আলাপ। এমন একজন মানুষ যে সবসময় নির্মল আনন্দে সবাইকে ভরিয়ে রাখে, মনে কোনও প্যাঁচ নেই, কোন কথাটা ওজন করে বললে ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে সেই হিসেবনিকেশ নেই— সুতরাং প্রথম পরিচয়েই ভালো লেগে গেল। কোথায় যেন একটা টান অনুভব করলাম। এই ‘দেবত্র’ ছবি তৈরি হওয়াকালীন ওর সঙ্গে আমার কিছু কথা হয়। আমি ওঁকে বলেছিলাম— ‘তুমি এত ভালো অভিনয় করো, কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই একই রকম চরিত্রে অভিনয় করো কেন?’ উত্তরে অত্যন্ত খেদের সঙ্গে অনুপ বলেছিল— ‘পাই না তো কি করব।’ একথাটা আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু আমাদের প্রথম তিনটি ছবিতে অনুপকুমার ছিল না। এরপর আমাদের চতুর্থ ছবির জন্য গল্প নির্বাচন করা হল মনোজ বসুর ‘আংটি চাটুজ্যের ভাই।’২
‘আংটি চাটুজ্যের ভাই’ গল্পটা আমি যখন পড়ি, প্রথমেই যেটা আমাকে নাড়া দেয় তা হল গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রটি। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে ‘আংটি চাটুজ্যের ভাই’ গল্পটি একটি চরিত্রভিত্তিক গল্প, কাহিনিভিত্তিক নয়। ওই চরিত্রটি আমার মনে ভীষণ নাড়া দেয়। একটা ছেলে যার জীবনে জাগতিক অর্থে সবই আছে, বাড়ির অবস্থা ভালো, দাদা তাকে ভীষণ ভালোবাসেন, বউদি অসম্ভব স্নেহময়ী, খাবার-শোবার কোনও অসুবিধাই নেই। রাজার হালে যে থাকতে পারে সে কিন্তু এই বন্দিদশার মধ্যে কোনও সুখ পায় না। এই সোনার শেকল তাকে পীড়িত করে এবং মাঝেমাঝেই সে এই শেকল কেটে পালিয়ে যায়। পালিয়ে সে প্রকৃতির মধ্যে চলে যায়। সাধারণ মানুষের মধ্যে চলে যায়। সে নিজের পরিচয় গোপন করে এবং সে এমন অভিনয় করে যে, সে সাধারণের চেয়েও অনেক বেশি সাধারণ। এই করতে করতে তার জীবনের একটা নতুন দিক খুলে যেতে থাকে। সে নিজেকে প্রথমত এমনভাবে লোকের কাছে উপস্থিত করে যে লোকটি আসলে খুব ঝগড়াটে আর তা না হলে অত্যন্ত তেএঁটে। কিন্তু একটু পরেই আমরা ক্রমশ বুঝতে পারি যে, এগুলো আসলে কোনোটাই নয় আসলে সে অত্যন্ত ভালো মনের একটি ছেলে। এই গল্পটি যখন আমার ভালো লেগে গেল তখন আমার মনে হল চরিত্রটাকে রেখে চিত্রনাট্যে গল্পের কাঠামোটা কাহিনিভিত্তিক হওয়া দরকার। ফলে চিত্রনাট্যে আমাকে গল্প অনেক বদলাতে হল, প্রয়োজনে বাড়াতে হল, নতুন নতুন চরিত্র সংযোজিত হল। তখন লেখক মনোজ বসু জীবিত ছিলেন। এই পরিবর্তনে ওঁর পূর্ণ সমর্থন এবং সম্মতি পাওয়া গিয়েছিল। এরই ভিত্তিতে তৈরি হল ‘পলাতক’ ছবির চিত্রনাট্য।
আমার সঙ্গে অনুপের এই যে দীর্ঘ সম্পর্কের সোপান, তা তৈরি হয় ‘পলাতক’ ছবির মাধ্যমে। এখানে বলা প্রয়োজন ‘পলাতক’ ছবিতে নায়কের চরিত্রে অনুপকে কেন নির্বাচিত করা হল, সেটা বলতে গেলে ‘পলাতক’-এর নায়ক চরিত্রকে একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। ‘পলাতক’-এর নায়ক বসন্ত আমাদের প্রচলিত নায়ক-ধারণা থেকে স্বতন্ত্র। বসন্ত একজন ইমপারফেক্ট হিরো। এর আগে আমরা বুঝতাম নায়ক মানে তাকে সর্বগুণসম্পন্ন হতে হবে। রূপবান, গুণবান, সুগায়ক, খেলোয়াড়, কৃতী ছাত্র আবার প্রেমে পটু ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বসন্তের চরিত্রটি কিন্তু অসম্পূর্ণ নায়কের চরিত্র। যে ধরনের অসম্পূণর্তা সাধারণ মানুষের জীবনে থাকে, বসন্ত তার ব্যতিক্রম নয়। আসলে আমাদের জীবনে কেউই তো একশো ভাগ সঠিক নয়। কোনো-না-কোনো ত্রুটি আমাদের সম্পূর্ণ সঠিক হওয়া থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আর সেখানেই মানুষের চরিত্রের সৌন্দর্য, বৈচিত্র্যগুলো ফুটে ওঠে। মানুষের চরিত্রে সাদাও থাকবে আবার কালোও থাকবে, আবার তার সঙ্গে সঙ্গে এটাও খুব জরুরি যে একটা বড়ো অংশ জুড়ে নানান শেডের রঙগুলো মিশে থাকবে। আমার ‘পলাতক’ ছবির নায়কও সেইরকম। তার অনেক গুণ আছে, আবার অনেক খামতিও আছে। বসন্ত ঘরের বাইরের মানুষকে আপন করে নিল, আবার ঘরের প্রতি চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিল। এই দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কথা প্রথমে সে বুঝতে পারেনি। আর তাই অভ্যাসের দাস হয়ে সে পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছে আর চলার পথে বড়ো বড়ো ভুল করে গেছে। ঘরের বাঁধনকে সে উপেক্ষা করছে। অবহেলা করেছে সংসারকে, তার সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীকে, আর তাই ভুল বুঝতে পেরে ঘরে ফিরে আসার মুহূর্তে ঘর কিন্তু তাকে প্রত্যাঘাত করে। ঘরকে অগ্রাহ্য করার প্রতিশোধ সুদে-আসলে ঘরই তুলে নেয় আর বসন্তকে ফেলে দেয় এক গভীর ট্র্যাজেডির আবর্তে।
‘পলাতক’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্রটি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অতএব আমরা পাই এক অসম্পূর্ণ নায়ক চরিত্রকে। যার অনেক সৎ গুণ আছে কিন্তু তার দু-একটা মারাত্মক ভুলের জন্য তাঁকে এতবড়ো মূল্য দিতে হল। তবে মূল্য দেবার সময় সে সবাইকে কাঁদিয়ে যায় এবং সেই অর্থেই সে নায়ক। এই চরিত্রটির জন্য আমার যে অভিনেতার দরকার ছিল তার অভিনয়ের একটা বিরাট রেঞ্জ থাকা প্রয়োজন। তাকে লোক ভুলিয়ে, লোক হাসিয়ে, ঝগড়া করে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে হবে যে দর্শক বিশ্বাস করে নেবে এরকম বিচিত্র জীব পৃথিবীতে খুব কমই আছে। এখান থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে তাকে কিন্তু চলে যেতে হবে সেখানে, যেখানে অসীম নদী, অনন্ত আকাশ আর ভাসমান নৌকায় সে একা। মৃত। আমার কেন যেন মনে হয়েছিল চেহারা, অভিনয়-দক্ষতা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল চরিত্রের চকিত বদলগুলো আনার জন্য অনুপ সবথেকে ভালো অভিনেতাই নয়, সেই মুহূর্তে আমার দেখা অভিনেতাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অভিনেতা। আর তাই অনুপকে ভেবেই এই ছবিটা করতে আমি এগিয়েছিলাম।
এই প্রসঙ্গে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করে নেওয়া দরকার। কোনও পরিচালক যখন কোনও একজন শিল্পীকে একাধিকবার ব্যবহার করেন অথবা সেই শিল্পীর জীবনে নতুন ধরনের কোনও চরিত্রে সুযোগ দিয়ে তাঁকে নতুন পরিচয়ে দর্শকদের কাছে তুলে ধরেন, তখন সেই কৃতিত্বের দাবিদার কে? এ প্রশ্ন অনেকেই আমার কাছে করেছেন। আমার মতে পরিচালক যদি সেই চরিত্রটি সেই বিশেষ শিল্পীকে দেবার ফলে শিল্পীর জীবনে কোনও উপকার হয়, তাহলে পরিচালক নিজেও কিন্তু সমানভাবেই উপকৃত হন। কিন্তু এই কথাটা সাধারণত বলা হয় না। কিন্তু আমি বলতে চাই যে ‘পলাতক’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘ঠগিনী’ কি ‘ভালোবাসা-ভালোবাসা’ ইত্যাদি আমার কুড়িটি ছবিতে অভিনয় করে অনুপ যদি কিছুটা উপকৃত হয়ে থাকে তাহলে আমিও সমানভাবে উপকৃত হয়েছি। এই কথাটা স্বীকার না করলে নিজের সততার প্রতি অবিচার করা হবে, একধরনের ছলনা করা হবে।
‘পলাতক’ প্রসঙ্গে আরও একটা কথা বলা অত্যন্ত জরুরি। ওই ছবির টাইটেল কার্ডে ‘পলাতক’ আসবার পরই আসে আর একটা কথা— ‘একটি অবাস্তব অতিনাটকীয় কাহিনি’। ‘পলাতক’ ছবির প্রযোজক বিখ্যাত চিত্রনির্মাতা শ্রদ্ধেয় ভি. শান্তারাম৩ আমায় প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি এই কথাটা কেন দিলে?’ আমি বলেছিলাম, ইচ্ছে করেই দিয়েছি। দিয়েছি সমালোচকদের আগে থেকেই উৎসুক করে রাখার জন্য। কেননা কোনটা অভিনয় আর কোনটা অতি-অভিনয় অথবা কোনটা নাটকীয় কোনটা অতি-নাটকীয় এই সম্পর্কে আমরা সীমারেখা কিছু ঠিক করতে পারিনি। খুব একটা সাবজেকটিভ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা বলে থাকি— এটা একটু অতি-নাটকীয় হয়ে গেল। তাহলে তো আগে জানতে হবে কেন জায়গাটা নাটকীয় হবে কিন্তু অতি-নাটকীয় হবে না। তাই আমি একটু আক্রমণাত্মকভাবেই শুরু করতে চেয়েছিলাম। আমি তো খারাপ জিনিস বেছে নিয়েছি। খারাপ অভিনেতা বেছে নিয়েছি। সুতরাং আগে থেকেই ঘোষণা করে দেব যে এটা একটা অবাস্তব অতি-নাটকীয় কাহিনি। কিন্তু চ্যালেঞ্জ একটা ছিল। তা হল আমরা সবাই জানি, যে গল্প অবাস্তব, তার সঙ্গে দর্শকের কোনও আত্মীয়তা থাকতে পারে না। আবার অতি-নাটকীয় গল্প দেখতে দেখতে প্রতি মুহূর্তে হোঁচট খায় দর্শক। সুতরাং এই ‘অবাস্তব অতি-নাটকীয় কাহিনি’ ঘোষণা করে দেবার পরেও দর্শকের মনে আমরা এর মূল চরিত্রকে গেঁথে দিতে পারছি কিনা, শিল্পী পারছেন কিনা। ‘পলাতক’ ছবিকে যাঁরা আজও মনে রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে শতকরা ক’জনই বা আজও ওই টাইটেল কার্ডে লেখা ঘোষণাটির কথা মনে রেখেছেন।
যাইহোক, ‘পলাতক’ ছবির কাজ শুরু হল। এই ছবির কাজ করতে করতে আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম। না, বন্ধু বললে ভুল হবে— একেবারে পার্ট অ্যান্ড পার্সেল যাকে বলে তাই। এরকমও হয়েছে, একটা শট নেওয়া হয়েছে, পরবর্তী শটের জন্য অন্য জায়গায় ট্রলি পাতা হয়েছে— তখন ট্রলি ছিল অন্যরকম, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ভেঙে নিয়ে যেতে গেলে অনেক সময় লাগত। আমরা তাই ওইগুলো কাঁধে করে নিয়ে যেতে বলতাম। দেখতাম সবার সঙ্গে অনুপও একটা দিক কাঁধে নিয়েছে। ‘পলাতক’ ছবিতে অনেক গান ছিল এবং হেমন্তবাবু সুর দিয়েছিলেন, গানও গেয়েছিলেন। শুটিং চলাকালীন হেমন্তবাবু একদিন সেট-এ এলেন। সেদিন অনুপের গানে লিপ দেওয়া দেখে উনি বললেন, ‘ছেলেটা করছে কী? শুধু যে ঠোঁট নড়ছে তাই নয়, আমি যেখানে নিশ্বাস নিচ্ছি অনুপও সেখানে নিশ্বাস নিচ্ছে। দেখবে এর এফেক্ট কী সাংঘাতিক হবে ছবিতে। মনে হবে না ও কারুর ধার করা গলায় গান গাইছে’। সেই ‘পলাতক’ মুক্তি পেল। নানান ধরনের সমালোচনা বের হতে শুরু করল। কিছু কিছু জায়গায় এটাও বলা ছিল— ‘হ্যাঁ, অনুপ করেছে বটে কিন্তু একটু অতি-নাটকীয়তার ঝোঁক আছে কোনও কোনও জায়গায়।’ বছরের শেষে আবার তারাই কিন্তু অনুপের হাতে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান তুলে দিয়েছিলেন। কেন দিয়েছিলেন সেই উত্তর দেবার দায়িত্ব আমার নয়, তাঁদের।
‘পলাতক’-এর পর হল ‘আলোর পিপাসা’। এই ছবিতে আমি অনুপকে দিয়ে ভিলেনের চরিত্র করিয়েছি। এই ভিলেন চরিত্রে অনুপের নির্বাচন আসলে অনুপের সম্পর্কে আমার শ্রদ্ধার প্রকাশ। তার কারণ আমি কখনওই চাইনি ‘পলাতক’ করার পর অনুপ অনবরত ‘পলাতক’ ছবির মতো চরিত্র পেতে থাকবে। আর অনুপও সম্ভবত তা চায়নি। কারণ আমার মনে হয়েছিল অনুপ একজন ভার্সেটাইল অ্যক্টর। সুতরাং লোকে দেখুক ও কী করতে পারে। আর তাই ‘আলোর পিপাসা’র সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে অনুপ নিজেও সম্ভবত খুশি হয়েছিল।
এরপর এল হইহই হাসির ছবি ‘একটুকু বাসা’। তাতে অনুপের একটা মাঝারি ধরনের চরিত্র ছিল। কিন্তু ওই চরিত্রটা আমার মনে হয়েছিল একমাত্র অনুপ ছাড়া আর কারুর পক্ষে করা সম্ভব নয়। গুণী শিল্পী অনেকেই আছে। আমি কারুর গুণ ছোটো করছি না। কিন্তু বিশেষ বিশেষ চরিত্র করার জন্য বিশেষ বিশেষ ক্ষমতার দরকার হয়। তাই যখনই কোনও বিশেষ চরিত্র আমার সামনে এসে গেছে, আমি তখনই বলেছি— ‘অনুপ তোমাকে এই চরিত্রটা করতে হবে।’
এরপর আসে ‘বালিকা বধূ’। ‘বালিকা বধূ’তে একটা বিচিত্র ঘটনা ঘটেছিল। ‘বালিকা বধূ’র প্রথম যে কাস্টিংটা হয় তাতে অনুপ ছিল না। কিন্তু ততদিনে একটা ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল— আমার যে-কোনো ছবির চিত্রনাট্য যখন পড়া হতো অনুপ তাতে থাকত, পরামর্শ দিত। যেহেতু এই ছবিতে বাচ্চা তেরো বছর বয়সি একটি মেয়ে এবং সতেরো বছর বয়সি ছেলে, আবার আর একটি পনেরো বছর বয়সি মেয়ে ও তার স্বামীকে নিয়ে গল্প, তাই আমি প্রাথমিকভাবে অন্য একজন শিল্পীকে অনুপের জায়গায় নির্বাচিত করেছিলাম। কিন্তু ছবির শুটিং শুরু হবার পর একটা দুর্ঘটনা হয় ফলে ক্যাম্পটা গুটিয়ে আনতে হয় এবং পরবর্তীকালে অনুপ যে চরিত্রে অভিনয় করে সেই চরিত্রের শিল্পী এমন ব্যবহার করেন এবং এমন কতগুলো অসুবিধার কথা জানান যে আমি তাকে নাকচ করতে বাধ্য হই। এইসময় অনুপের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব যথেষ্ট গাঢ়, তাই আমি অনুপকে ওই চরিত্রটা করতে বলি। আমার মনে হয়েছিল বয়স একটু বেশি হলেও মেকআপ ঠিকমতো করলে অনুপকে অবশ্যই মানিয়ে যাবে। আর অভিনয়ের তো কথাই ওঠে না। আমার ধারণাই সত্যি হয়। অনুপকে মানিয়েছিল এবং দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল ‘বালিকা বধূ’।
এরপর আমি বম্মে চলে যাই ‘পলাতক’ ছবির হিন্দি রূপান্তর ‘রাহগীর’ ছবি করতে। বম্বে নতুন জায়গা। সর্বভারতীয় কর্মক্ষেত্র। ট্রেডের দাবিও অনেক। তাই প্রচুর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনুপকে নিতে পারিনি। কিন্তু মনে তো সর্বদাই অনুপের অভিনয়ের প্রভাব থাকছেই। এইসময় অনুপের একটা চিঠি পাই। ছোটো চিঠি কিন্তু অত্যন্ত দামি— অন্তত আমার কাছে। অনুপ লিখেছিল— ‘তনুদা, তুমি এরকম মনে করছ কেন? তুমি মনে করে নাওনা এই ছবিতে আমিও আছি। কিন্তু ছবিতে থাকলেও প্রত্যেক অভিনেতার যেমন কলশীট পড়ে না, তেমনি মনে করে নাও এই দিনগুলোয় আমার দরকার হচ্ছে না। এই কারণে আমি অনুপস্থিত। না হলে আমি তো আছিই।’ এ চিঠির কথা এতদিন পরে অনুপ ভুলে যেতে পারে কিন্তু আমি পারি না।
এরপর একসঙ্গে আমরা যে ছবিতে কাজ করি তা হলো ‘নিমন্ত্রণ’। ‘নিমন্ত্রণ’-এও কিন্তু সেই মিসফিট ইমপারফেক্ট হিরো ফিরে এসেছে— অন্যরকম রূপ নিয়ে। একটা শহরের ছেলে যে জীবনে গ্রাম দেখেনি আর অসম্ভব বকবক করতে ভালোবাসে। তার সব বিদ্যা কেতাবি। গ্রাম সম্পর্কেও একটা কেতাবি ধারণা নিয়ে সে গ্রামে যায় এবং সেখানে গিয়ে একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়, যে তার থেকেও বেশি বকবক করে। বকবক করার দুজনের এই যে অভ্যাস তার ফলে দুজনের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের জন্ম নেয়। সেই মেয়েটির চোখ দিয়েই সে গ্রামকে দেখে। বন্ধুত্ব গভীর হয়। কিন্তু এত বকবক করে যে মানুষ দুটো, তারা শুধু একটা ছোট্ট কথা সারাটা জীবনেও বলতে পারে না— ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ এবং এই সামান্য অনুচ্চারিত কথার জোর সারাটা জীবন ঠেলে যেতে হয় তাদের। তারপর সে জীবনের নানা টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যায় এবং শেষ অবধি এক অন্যধরনের ট্র্যাজেডির সম্মুখীন হতে হয় তাকে। যে ট্র্যাজেডির কোনও সমাধান নেই। ‘পলাতক’-এর ট্র্যাজেডির একটা সমাধান ছিল। নায়কের মৃত্যু হয়েছিল, কিন্তু ‘নিমন্ত্রণ’-এ নায়কের ট্র্যাজেডি আরও গভীর আরও মর্মস্পর্শী। সমাধানহীন এক ট্র্যাজেডির বোঝা বয়ে সারাটা জীবন তাকে চলতে হয়।
‘নিমন্ত্রণ’ ছবিতে অনুপ যে অভিনয় করেছে তা অনেকের কাছে ঈর্ষণীয় ও দৃষ্টান্তস্বরূপ হয়ে থাকা উচিত। যাঁরা বলেন অনুপ অতি-অভিনয় করে, ‘নিমন্ত্রণ’ ছবিতে অনুপের সংযত অভিনয় তাঁদের অভিযোগের যোগ্য জবাব দিয়ে দেয়। অথচ ‘নিমন্ত্রণ’ ছবিতে চাইলে ও অন্যরকম অভিনয় করতেও পারত, কিন্তু তা ও করেনি। সুতরাং এমন একজন শিল্পী যার স্বভাবই নাকি তথাকথিত অতি-অভিনয় করা, সেই অতি-অভিনয়ের ছাপ আমরা ‘নিমন্ত্রণ’ ছবিতে পেলাম না কেন? অতএব আমার মতে— যে চাইলেই সংযত অভিনয় করতে পারে তার কোনও অতি-অভিনয়, শুধুমাত্র তাঁর দোষ বলে চিহ্নিত হবে কেন? কেন পরিচালকদেরও সৎ সাহস থাকবে না একথা বলার, যে আমি ওর কাছে এই রকম অভিনয়ই আশা করেছিলাম। পরিচালকের দাবি মেটাতে গিয়েই তাঁকে বদনাম কুড়োতে হয়েছে। আমি ওঁর অভিনীত সব ছবি দেখিনি। তাই কোনও ছবিতে অতি-অভিনয় করেছে তার বিচার করাও সম্ভব নয়, তবে মূল যেটা বিচার্য বিষয় সেটা হচ্ছে শিল্পী হিসাবে তার একটা পরিচয় আছে কিনা? স্রোতের টানে সে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছে কিনা? আমার ‘নিমন্ত্রণ’ ছবিতে অনুপের অসাধারণ অভিনয় প্রমাণ করে দেয় যেখানে সে পায়ের তলায় জমি খুঁজে পেয়েছে সেখানেই সে থমকে দাঁড়িয়েছে। সব ছিঁড়েখুঁড়ে তার একটা নিজস্ব পরিচয় দেবার চেষ্টা করেছে।
‘নিমন্ত্রণ’-এর পর আবার একটা ছবি করি— ‘ঠগিনী’। এই ছবিরও নায়ক অনুপ। সেটা একেবারে সম্পূর্ণ অন্য ইমেজ। একজন চিত্রকর যে কমার্শিয়াল পেন্টার হয়ে গেছে কিন্তু তার ভেতরের শিল্পীসত্তাটা অটুট রয়েছে, সজাগ রয়েছে। এই ধরনের চরিত্র অনুপ আর করেছে বলে মনে হয় না।
এরপর ‘ফুলেশ্বরী’। ‘ফুলেশ্বরী’ ছবিতে অনুপ করেছিল এক সাহেব ইঞ্জিন ড্রাইভারের পাশে এক ফায়ারম্যানের চরিত্র। সে মাঝেমাঝে একটু মদ্যপান করে এবং তখন সে পৃথিবীটাকে খুব বড়ো আকারের দেখে। খরখরে রোদ্দুরকেও তখন তার জ্যোৎস্না বলে মনে হয়। এই চরিত্র প্রসঙ্গে আলোচনায় একটু আগে বলা অনুপের অতি-অভিনয়ের কথা টেনে আনি। কারুর কি মনে হয়েছে অনুপ এতে অতি-অভিনয় করেছে। আমার ধারণায় কিন্তু মাটির মানুষেরা এরকমই হয়। আমার একটু গ্রামগঞ্জে যাওয়ার অভ্যাস আছে এবং সেই সূত্রে এই ধরনের মানুষদের দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি অনুপ যদি এতে অতি-অভিনয় করে থাকে তো আমার নির্দেশেই করেছে, নিজে থেকে করেনি।
এবার আসি ‘গণদেবতা’র পাতু বায়েন চরিত্রে। অত্যন্ত সিরিয়াস চরিত্র। সেখানে আমরা অন্য অনুপকুমারকে পাই। অতি-অভিনয়ের যে সীলমোহর তার গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার বিন্দুমাত্র ছাপও কি এই চরিত্রে দেখা গেছে। সমস্ত কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাবার পর একমাত্র ঢোলটাল চামড়াটাও যখন পুড়ে গেছে, তখন সে পোড়া বাড়ির আঙিনায় বসে থাকে, কোনও কথা বলতে পারেনা। শব্দহীন, নির্বাক, যে অভিনয় অনুপকুমার ওখানে করেছিল তা এককথায় অসাধারণ। অনুপ সম্পর্কে যাঁদের অভিযোগ, অনুপকুমার স্রোতে গা ভাসিয়ে অভিনয় করেন— পাশাপাশি কি অনুপের এই সমস্ত অভিনয়ের কথাও তাঁদের বলা উচিত নয়?
এরপর আরও অনেক ছবিতে অনুপ আমার সঙ্গে কাজ করেছে। ‘শহর থেকে দূরে’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘মেঘমুক্তি’, ‘খেলার পুতুল’, ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’, ‘আগমন’, ‘পথ ও প্রাসাদ’, ‘সজনী গো সজনী’ এবং আমার শেষ ছবি ‘কথা দিলাম’। এক একটা ছবি, আর তার এক এক রকম চরিত্রে অনুপ অভিনয় করেছে। ওকে শিল্পী হিসাবে আমার সবসময়ই দরকার পড়েছে। অনুপ থাকলে আমি মানসিক শান্তি পেয়েছি কারণ আমি জানি আমাদের এমন একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে, যে-কোনোও কাজের ভার ওর ওপর চাপিয়ে দিলে কখনওই না বলবে না। কারণ আমি তো জানি আমার ছবিতে কাজ করার জন্য দু-দুবার অনুপ স্টার থিয়েটারে তার বাঁধা কাজ, যেখানে সে চুটিয়ে অভিনয় করেছে, তা ছেড়ে দিয়েছে। অথচ সে যে কাজটা ছেড়ে আসার জন্য বিরাট একটা ত্যাগ স্বীকার করল, এমনও মনে হয়নি কখনও। এসব কথা তো আমার পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়।
তাই আমি আগেই বলেছি অনুপ সম্পর্কে খুব একটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করা হয়ত আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। কারণ আমি অনুপকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছি। অথচ একটু দূর থেকে না দেখলে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে নৈর্ব্যক্তিক আলোচনা সম্ভব নয়। অনুপ আমার ছবির অভিনেতা, অনুপ আমার প্রোডাকশনের টিমম্যান। অনুপ আমার সুখদুঃখের বন্ধু। তাই তাঁর সম্পর্কে কোনও নৈর্ব্যক্তিক আলোচনা নয়, আমার বন্ধুর কাছে আমার আজ কিছু চাওয়ার আছে। আমি চাই পঞ্চাশ বছর ধরে দর্শকদের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগ রেখে অনুপ যে ধারাবাহিকভাবে একটা কাজ করে আসছে, সেটা সে ভবিষ্যতেও বজায় রাখবে এবং যে রকম ভালোমানুষ দেখে এসেছি তাকে, সেইরকম ভালোমানুষ হয়েই থাকবে। আমার এই ইচ্ছাটুকু যদি পূরণ হয় তাহলেই আমার জীবনের অন্তত একটা দিক অসম্ভব খুশিতে ভরে থাকবে।
তরুণ মজুমদার
অনুলিখন: জয়দীপ মুখোপাধ্যায়
জীবনপুরের পথিক
অনেকেই আমার কাছে একটা প্রশ্ন করেন যে শিল্পী জন্মায়, না শিল্পী তৈরি হয়। এর উত্তর দুটোই। সবার বড়ো সত্যি হচ্ছে শিল্পী জন্মায়। বাকিটা হচ্ছে তাকে তৈরি করে পরিশীলিত করতে হয়। যেমন ইস্পাত, জিনিসটা ইস্পাত হওয়া চাই তারপর তাকে ধার করে টেম্পার করে ধারালো অস্ত্র তৈরি হয়। এটা শুনে নয়, আমার নিজের জীবনের উপলব্ধি। আমার নিজের মধ্যে দিয়ে এটাকে আমি আবিষ্কার করেছি বলা চলে।
প্রথম থেকেই শুরু করি। আমি কোথায় জন্মালাম, কী পরিবেশের মধ্যে। আমার বাবা৪ তিরিশ দশকের শুরু থেকে গায়ক হিসেবে, সংগীত শিল্পী হিসেবে প্রচণ্ড নাম করেছিলেন এবং সেই যুগের প্রত্যেকেই তাঁকে চিনতেন। হরি ঘোষ স্ট্রিটে, হাতিবাগান অঞ্চলে আমার জন্ম যে পাড়াতে, কাজি নজরুলও থাকতেন সেই পাড়াতে। বাবার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ থাকার সুবাদে এবং বাবা ‘কাজিদা’ বলতেন বলে, আমরা জ্যাঠামশাই বলতাম। আমাদের বাড়িতে মাঝেমাঝেই কাজি জ্যাঠামশাই আসতেন এবং নানা হাসি গল্পের মধ্যে দিয়ে সংগীতচর্চা হত, নাটকেও কিছু কিছু আলোচনা হত। যদিও আমি তখন খুবই ছোটো তবু আমাকে এগুলো ভীষণ আকৃষ্ট করত। আর একটা ব্যাপার, সেই পরিবেশেই কিন্তু আমার অন্য ভাইয়েরাও ছিল। যেমন আমার দাদা। দাদা জীবনে কখনও অভিনয় করল না, আমি করলাম। ছেলেবেলায় ছেলেরা ফুটবল, ক্রিকেট নিয়ে খেলে এবং তার মধ্যে থেকেই কোনও খেলা প্রিয় হয়। আমার মধ্যে কিন্তু একটা খেলা ভীষণ প্রিয় ছিল, সেটা হল থিয়েটার-থিয়েটার খেলা। মনে পড়ে কোনও একটা নাটক নিশ্চয়ই আমি আমার পরিবারের সঙ্গে দেখতে গিয়েছিলাম— হয়তো মোগল মসনদও হতে পারে সে নাটকের নাম, তাতে সৈন্যদের একটা যুদ্ধ ছিল একটা পুলের ওপরে এবং পুলটা ভেঙে যাবে, সেই স্মৃতিটা ছিল। আমি আমার বন্ধুবান্ধবদের নানাভাবে বুঝিয়ে নিয়ে এসে দুটো একটা সংলাপও তখন তৈরি করে নিতাম, নিয়ে থিয়েটার-থিয়েটার খেলতাম। আমাদের একটা বাইরের বসার ঘর ছিল। দুটো চৌকি দিয়ে সেই ঘরটা ভরা ছিল এবং দুটো চৌকির মাপ যেহেতু এক নয়, সেইজন্য একটা চৌকির পায়ের তলাতে ইট দিয়ে দুটোকে সমান করা হত। অতগুলো ছেলের দাপাদাপিতে কোনোদিন সেটা উল্টে ভেঙে যেত, মানে ইটগুলো সরে পড়ে যেত, কিছু দুর্ঘটনা ঘটত। তাতে করে আমি খুব উল্লসিত হতাম যে সত্যি সত্যি থিয়েটার হয়েছে, পুল ভেঙে গেছে। আমাদের বাড়ির সামনে একটা ফটো বাঁধানোর দোকান ছিল। কাচগুলো ভেঙে গেলে সেটা ছুরি মতো একটা চেহারা হয়— সেগুলো তলোয়ার হিসেবে ব্যবহার করতাম এবং খুব সঙ্গত কারণেই কেউ কেউ হয়তো আহত হত, আর তার পরিণামে আমি প্রচুর মার খেতাম। কিন্তু মার খেলে কষ্টটা গায়ের ব্যথার জন্যে হত না, আমার অবাক লাগত যে এই যারা নালিশ করল, তারা এটা কেন বুঝল না যে এটা সত্যিকারের থিয়েটার হল, রক্ত বেরুল, এটাতে তো কোথায় আনন্দ হবে! এটা ছিল আমার একটা খুব প্রিয় খেলা। আর একটা ব্যাপার আমি পারতাম, সেটা হচ্ছে যে খুব তাড়াতাড়ি অনুকরণ করতে। সে সময় বা পরবর্তীকালে, নবদ্বীপ হালদার৫, ভানুদা, জহরদা কমিক রেকর্ড করতেন, তখন প্রফেসর বিমল দাশগুপ্ত৬ ও তাই করতেন। সেগুলো শুনে আমি প্রায়শই হুবহু তুলে নিতাম এবং হয়তো ভালোই করতাম। নইলে বাড়িতে লোকজন এলে কেন আমায় বলা যে তুমি ওইটা করে শোনাও। আর আমার সম্পর্কে পরিবারের কার কী ধারণা ছিল আমি জানি না, বাবা বোধহয় খুব আগে থেকেই একটা কিছু অনুভব করেছিলেন যে আমার মধ্যে একটা অভিনয় করার সহজাত ক্ষমতা আছে। যেমন, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমার কাকার এক বন্ধু থিয়েটারে মেয়ের পার্ট করবেন। তাঁর একটা ভালো ডায়ালগ ছিল— ‘গোপাল ভারি দুষ্টু ছেলে’। বারেবারেই বাবা যখন বোঝাচ্ছেন, বলছিলেন যে ‘ভারি’র ওপরে জোরটা দাও। কিন্তু তিনি বারে বারে গোপালের ওপর জোর দিচ্ছেন, হয়তো দুষ্টুর ওপর জোর দিচ্ছেন, ঠিকমতো পারছেন না। বাবা রেগে গিয়ে বললেন যে, ‘তুমি একটা গর্দভ। ওইটুকু একটা ছেলে কিন্তু বলে দিতে পারবে’। কেন বলেছিলেন বাবা আমি জানি না। কিন্তু আমাকে বললেন বলতে। বাবা যেভাবে শেখাচ্ছিলেন সেভাবে আমি বললাম। তাতে বাবা বললেন, ‘দেখলে তো ও তোমার কান মুলে দিতে পারে’।
এবারে পরের একটা ধাপে যাই। সে সময়ে আমাদের হরি ঘোষ স্ট্রিটের বাড়ি বিক্রি হয়ে যায়। আমরা চলে যাই বরানগরে। বরানগরে যে স্কুলে আমি ভর্তি হলাম সেখানে আমাদের একজন মাস্টারমশাই ছিলেন। তিনি ছোটো ছোটো কবিতা আবৃত্তি বা কমিক স্ক্রিপ্ট নিজেই হয়তো তৈরি করতেন এবং সেটা ছাত্রদের শেখাতেন। মাঝেমাঝে যখন প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন হত সে সময় আমাদের করে দেখাতে হত। সেখানে আমাকে তিনি শিখিয়েছিলেন একজন উড়িষ্যাবাসী নতুন কলকাতায় এসেছে, রাস্তাতে তার বিপর্যয়, গাড়ি-ঘোড়ার মধ্যে দিয়ে সে কীভাবে যাবে। তা সেটা উনি শিখিয়েছিলেন, আমি করেছিলাম এবং ছ-সাতটা মেডেল পেয়েছিলাম। সালটা হবে সম্ভবত আটত্রিশ সাল।
তার আগে, কথাটা যদিও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, তবু বলি, আমি কিন্তু চলচ্চিত্রে মোটামুটি এসে গেছি। সে সময় ‘হালবাংলা’ বলে একটা ছবি হচ্ছিল, ধীরেন গাঙ্গুলী৭—যাঁকে আমরা ডি.জি. জানি, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারও পেয়েছে তিনি— একটা ছবি করবেন, তাতে তাঁর অনেকগুলি ছেলেমেয়ে দরকার। তা এখন যেমন ছেলেমেয়ে ইচ্ছে করলেই পাওয়া যায়, টাকাপয়সা দিয়ে পাওয়া যায়, তখন সেই অবস্থাটা ছিল না। আর বেশ ভদ্র চেহারার ছেলে দরকার, সেজন্যে যারা কাজের সঙ্গে জড়িয়েছিল তাদেরকে অনুরোধ করা হয়েছিল। কেন জানি, বাবা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সেটা আমার মনে আছে এবং হয়ে যাবার পর সকলে খুব মজা পেয়েছিল। পিঠ চাপড়ে বলেছিল খুব সুন্দর। এই হচ্ছে আমার প্রথম জনসাধারণের কাছে চেহারা দেখানো। একটা কথা প্রসঙ্গত বলা যায় যেই আমার বাল্যস্মৃতি বড়ো সজাগ। সেই শুটিংয়ের পুরো ব্যাপারটা আমার মনে আছে। বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম। বর্তমানে যেটা টেকনিসিয়ান্স নং— ১, সেটা কালী ফিল্মস৮ ছিল। একটা মেকআপ রুম ছিল টিনের চালা দেওয়া আর সামনে একটা বিরাট খেলার মাঠ ছিল। একটা কাঠের তৈরি এরোপ্লেন ছিল। সেটা কী কাজে লেগেছিল জানি না। আর মাঠের মধ্যিখানে বাড়িটা তৈরি হয়েছিল। তখন বুঝিনি, এখন কাজ করছি বলে বুঝেছি— একটা ট্রলি ছিল। ট্রলির ওপর ক্যামেরাটা, আর সেটা আজকের দিনের মতো শৌখিন হালকা ক্যামেরা নয়। ডেবরি ক্যামেরা, বিলক্ষণ ভারি, লম্বাটে, চার চৌকো। সেই ক্যামেরাটায় একজন চোখ লাগিয়ে বসে ছিলেন, আর রিফ্লেক্টার দিয়ে আলো করা হয়েছিল, চোখে খুব লাগছিল। বোর্ডের ওপর রাংতা লাগিয়ে মুখের ওপর ফেলা হচ্ছিল। আর একটা ব্যাপার আমার ভীষণ মনে পড়ে— ওই দিনের স্মৃতিটা এলে নাকে ওই গন্ধটা আজও পাই— পাউডারের গন্ধ। লালচে লালচে পাউডার মুখে মাখানো হয়েছিল, চোখ এঁকে দেওয়া হয়েছিল, লিপস্টিক লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের কাজ ছিল এইরকম যে একজন জিজ্ঞেস করল, আমি বললাম, ”বাবা বাড়ি নেই। আর দেখা গেল যে আমি মুখে খুব পাউডার মাখছি। আর একবার বাবা ঘরের মধ্যে খাটের ওপর পাশবালিশের ওপর উঠে বসেছেন। বসে এপিটাইজার না কী একটা ঘোড়ার নাম— তিনি যেন নিজে ঘোড়সওয়ার হয়ে চিৎকার করছেন, মা তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা করছেন, জাগাবার চেষ্টা করছেন, আর আমরা উচ্চৈঃস্বরে কাঁদছি— এটাই ছিল মোটামুটি কাজ। বাবা মানে আমার নয়, চরিত্রের বাবা— ডি. জি। ডি.জি. নিজেই অভিনয় করেছিলেন। ডিরেকশানও তাঁরই ছিল। নিজে নায়ক ছিলেন এবং গল্পটাও তাঁর তৈরি। এই হচ্ছে আমার প্রথম দিন স্টুডিওতে ঢোকা এবং বেরিয়ে আসা। এরপর আমার সঙ্গে আর এই জগতের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ বহুদিন ধরে ছিল না। বরানগরেই আমার প্রথম দর্শকের সামনে কিছু করা। এটা বেশ মনে আছে যে খুব খুশি হয়েই করেছিলাম। লোকজন দেখেছে খুব উৎসাহ নিয়ে। কোনোরকম ভীতির লক্ষণও ছিল না বা কথাবার্তা ভুলে গেছি এমনও কোনও ব্যাপার ছিল না।
তারপরে আমরা বেলগাছিয়াতে চলে আসি কৃষ্ণ মল্লিক লেনে। তখন আমাদের চরম আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে সংসার চলছে। একটা ফ্ল্যাটবাড়িতে আমরা উঠেছিলাম। এখানে একটা পরিবারের সঙ্গে আমরা খুব ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম। সেই বাড়িতে দুজন মহিলা ছিলেন। আমরা ‘প্রতিমাদি’ ও ‘নীলিমাদি’ বলতাম, আর ছিলেন জ্যাঠামশাই আর জ্যাঠাইমা। জ্যাঠামশাইয়ের নাম ছিল বীরেন ঘোষ। ওই পরিবারে আমার বিশেষ একটা মৌরসিপাট্টা ছিল যেহেতু ওই বাড়িতে কোনও ছেলে ছিল না। আমি সেই জায়গাটা অত্যন্ত সসম্মানে দখল করেছিলাম এবং আমরা হই-চই গল্প ঠাট্টা করতাম আর জেঠিমা বেচারি খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে প্রায় ভিক্ষে করার মতো করে ঘুরে বেড়াতেন আর বলতেন, ‘খেয়ে নিয়ে গল্প কর বাবা’। আমরা খুব বিরক্তি প্রকাশ করতাম। জ্যাঠামশাই খুব উৎসাহ দিতেন, আমাদের সঙ্গে গপ্পো-টপ্পো করতেন। এমনও হয়েছে যে আমি সন্ধেবেলা ওখানে পড়তে গেছি, মনে হয়েছে আজ আর বাড়ি ফিরব না। খাওয়া-দাওয়া করে ওখানেই শুয়ে পড়েছি। ওঁরা খবর পাঠিয়ে দিয়েছে যে এখানে আছে। পরের দিন খেয়েদেয়ে স্কুলে চলে গেছি। যেহেতু নীলিমাদি আর প্রতিমাদি পড়াশুনায় অত্যন্ত ভালো ছিলেন, আমরা ঠিক করলাম যে আমরা সরস্বতী পুজো করব ওই বাড়িতে। জ্যাঠামশাই খুব উৎসাহ ভরে বললেন যে খুব ভালো কথা, পুজো হোক। উনি ঠাকুর এনে দিলেন। আমাদের পুজো হল এবং সরস্বতী পুজো ওইরকম শুধু ‘অং বং’ করে শেষ হয়ে যাবে এ তো হয় না— তাই কেউ আবৃত্তি করল, কেউ-বা দু-চারটে কথা বলল, কেউ গান গাইল, যার যতটুকু জানা আছে। যাহোক হয়ে যাবার পর আমরা ঠিক করলাম এবার হঠাৎ সিদ্ধান্ত করা হয়েছে বলে আগে থেকে প্রস্তুত হওয়া যায়নি। পরেরবার (সরস্বতী পুজো করলে নাকি পর পর তিন বছর করতেই হয়) আমরা তৈরি হয়ে একটা থিয়েটার করব। থিয়েটার হল, আমার মনে আছে, ‘চম্পট চম্পু’ বলে একটা বই হয়েছিল। তখন ইভাকুয়েশন চলছিল— তার ওপরে। মামা, মামার কাছে ভাগ্নে থাকে— ওরা চলে যাচ্ছে, মামা স্টেশনেতে সব ছেড়ে দিয়ে তেঁতুলের হাঁড়ির খোঁজ করছেন। পরের দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে তিনি অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছেন। ডাক্তার তাঁর পরীক্ষা করছেন আর তিনি চেঁচাচ্ছেন যে আমার তেঁতুলের হাঁড়ি নিয়ে সর্বনাশ করলে। তো সকলে বললেন যে ‘তেঁতুলের হাঁড়ি’ ‘তেঁতুলের হাঁড়ি’ করছো কেন। না, ‘ওর মধ্যেই তো আমি সব সোনা ভরে রেখে দিয়েছি। ভাগ্নেটা নিয়ে পালিয়েছে।’ তাতে আমি তিনটে রোল করেছিলাম। জ্যাঠামশাই এই বইয়ের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন। পরের বছর আমরা অত্যন্ত উৎসাহভরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের একটা ছোট্ট একাঙ্কিকা, ‘জামাইষষ্ঠী’ অভিনয় করলাম। জামাইরা এসেছে জামাইষষ্ঠীতে, তারপর এক এক করে তাদের তাড়াতে হচ্ছে। ছোটো কিছুতেই যাবে না, তাকে মেরে তাড়াতে হল। এটাতে আমরা আরও উৎসাহ পেলাম কেননা দারুণ ভালো করেছি আমরা।
বাবা আমাদের এই নাটক দেখেছিলেন। একদিন আমাকে ডেকে বললেন, ‘তুমি কাল সকালে তৈরি থাকবে, আমার সঙ্গে যাবে এক জায়গায়, বাবার সঙ্গে তখন আমাদের একটা ভীষণ দূরত্ব ছিল। বাবা গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন আমাদের কাছে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য এ ধারণার পরিবর্তন হয় আমার। বাবা অত্যন্ত রসিক, আমি যখন একসঙ্গে থিয়েটারে কাজ করেছি তখন বাবাকে তাঁর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি। অত্যন্ত রসিক মানুষ ছিলেন, ভীষণ রসিক। যাহোক, বাবা বলেছেন, আমি পরের দিন যাবার জন্যে তৈরি। তবে সেদিন আমার গলার বিলক্ষণ খারাপ অবস্থা। এক জায়গায় গেলাম, সে অফিসটা অস্পষ্ট মনে আছে,বাবার সঙ্গে অফিসের সকলের ছবির একটা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা হল। সম্ভবত ছবিটা ‘বিদেশিনী’ বা এরকম কিছু, মোট কথা কানন দেবীর ছোটোভাই— এই ছিল আমার ভূমিকা। কথা প্রসঙ্গে ওঁরা আমি গান জানি কিনা জিজ্ঞেস করাতে বাবা বললেন, ‘ছোটোবেলায় ডিপথিরিয়া হওয়ার ফলে ওকে গান শেখানো হয়নি।’ ওরা খুব আতঙ্কিত হয়ে বললেন, ‘গলাটা কি ওর এইরকম?’ চেঁচামেচি করে গলাটা ভেঙেছে বলে বাবা মন্তব্য করলেন। কিন্তু কাজটা আমি পাইনি। আমার ধারণা যে ওরা বাবার কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেননি। বাবা আমাকে চলচ্চিত্রে আর কখনও কোনোভাবেই সাহায্য করেননি। আমাকে নিয়ে গেলেন তখন স্টার থিয়েটারে। আমি কেন শিল্পী হলাম— প্রয়োজনের তাগিদে হলাম, না মনের তাগিদে হলাম— এটা বোঝার আগেই কিন্তু আমি প্রফেশনাল থিয়েটারের একজন শিল্পী হয়ে গেলাম। আমার চাইতে আমার বাবা বোধহয় বুঝেছিলেন যে আমার মধ্যে একটা শিল্পীসত্তা রয়েছে— যেটা পরবর্তীকালে একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পারে। আমাদের তখন পারিবারিক অবস্থা খারাপ। বাবা বোধহয় দেখতে চেয়েছিলেন যে তিনি যাবার আগে সংসারের একটা সুব্যবস্থা হোক, যাতে তাঁর অবর্তমানে সংসারটা ভেসে না যায়। সেই ভেবে তিনি আমাকে থিয়েটার জগতে নিয়ে এলেন।
১৯৪২ সাল হবে বোধহয় তখন, স্টার থিয়েটারে ‘টিপু সুলতান’ নাটকের তোড়জোড় চলছে। আমার সঙ্গে মহেন্দ্র গুপ্ত৯-র কথা হল। উনি কিছু প্রশ্ন করলেন। আমার কাছ থেকে তার উত্তর পেয়ে সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে পেশোয়ার চরিত্র— বেশ বড়ো চরিত্রে অভিনয় করার জন্য নির্বাচিত করলেন এবং লেখা পার্টটা আমার হাতে দিয়ে দিলেন। বাবা রয়ে গেলেন থিয়েটারে। দাদা ছিল আমার সঙ্গে। আমি আর দাদা ট্রামে করে বাড়ি ফিরছি। কিন্তু আমার মনের মধ্যে তখন এমন একটা আনন্দ, একটা খুশির মেজাজ ছিল যে আমি ঠিক করলাম এই মুহূর্তে বাড়ি যাবো না। এই অবস্থায় বাড়ি গেলে খুব লজ্জার ব্যাপার হবে কারণ আমি তখন নিজের মনে হাসছি। দাদাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। আমাদের বাড়ির কাছেই টালা পার্ক, সেখানে চলে গেলাম এবং একদম মাঝখানে বসে নিজের মনে হাসলাম, মাটিতে গড়াগড়ি খেলাম। অনেকক্ষণ পরে যখন উচ্ছ্বাসটা একটু কমল, ধীরে ধীরে বাড়িতে এসে পৌঁছোলাম। কিন্তু তার একটা অ্যান্টিক্লাইমেক্স দেখা দিলো। দু একদিন পরে জানতে পারলাম, নিত্যান্তই একটা বাজে কারণে আমি এখন পার্ট করতে পারছি না। যাহোক, মোটামুটি এর কলকাঠি যিনি নেড়েছিলেন তাঁর একটা যুক্তি ছিল যে এত অল্পবয়সে থিয়েটারে এসেই একটা বড়ো রোল করলে ভবিষ্যতে তাতে আমার ক্ষতি হতে পারে। স্টেজের পরিবেশটা ভালোভাবে না বুঝে হঠাৎ অভিনয়ে নেমে গেলে হয়তো স্টেজ ফ্রাইড যেটা বলা হয়— তাতে ভুগতে পারি। তখন ঠিক হল যে আপাতত আমি থিয়েটারের নিয়মিত শিল্পী হয়ে থাকব। মাসে কুড়ি টাকা মাইনে পাবো, শনি ও রবি ডবল শো হয়— তাতে জলপানি হিসেবে তিন আনা করে পাবো। তিনটের আগেই থিয়েটারে আসব আর সাড়ে ছ’টার পর যখন দ্বিতীয় শো আরম্ভ হবে তখন আমার ছুটি।
সেইসময় আমার পাশে আর একজন এসে বসতে শুরু করলেন, তিনি হচ্ছেন কমল মিত্র। বিপিন গুপ্ত১০ করতেন টিপু সুলতানের চরিত্র। বম্বেতে একটা সুযোগ পাওয়ায় তিনি চলে গেলেন। তাঁর জায়গায় কমল মিত্রকে মনোনীত করা হল। আমরা দু’জনে মিলে অভিনয়টা দেখতাম। কমল মিত্র নিশ্চিত ছিলেন যে টিপু সুলতানের পার্ট তিনিই করছেন। কিন্তু আমার মনে এ নিয়ে সংশয় ছিল। তাই মনে মনে চাইতাম (যদিও এ-চাওয়াটা ভালো নয়) যে ছেলেটি করত তার নাম ছিল মাস্টার সতু— তার একটা কোনও না কোনও বিপদ হয়, প্রচণ্ড জ্বর হয় যাতে ওর অনুপস্থিতিতে আমি ওই পার্টটা করতে পারি। শুধু পেশোয়ারের চরিত্রই নয়, গোটা ‘টিপু সুলতান’ বইটাই আমার কণ্ঠস্থর ছিল এবং যে যেভাবে অভিনয় করতেন আমি করে দেখাতাম। যাই হোক, সতুর ওপর বিরক্ত হয়ে মহেন্দ্র গুপ্ত নিয়মিত ওই পার্টটা আমায় করতে দিলেন।
প্রথম যে নতুন পার্টটা আমি পেলাম তা হল ‘কেদার রায়’১১-এ। আবার নতুন করে স্টার থিয়েটার এ নাটক শুরু হল, আমি পেলাম কেদার রায়ের ছেলের পার্ট। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলতেই হয়— একটা রীতি ছিল, নতুন কোনও পার্ট পেলে আমি সরাসরি রিহার্সালে যেতাম না। মহেন্দ্র কাকা (মহেন্দ্র গুপ্ত) আমাকে দিয়ে আগে পার্ট বলিয়ে নিতেন, আমি সেইভাবে বলতাম। এইরকম করেই চলছিল। নাটকের পর নাটক করেছি ওইভাবে। কিন্তু একবার একটা অসুবিধে দেখা দিলো। পর পর তিনদিন আমাকে আসতে বলা সত্ত্বেও নানা কাজের জন্য মহেন্দ্র কাকা রিডিং দেওয়াতে পারেননি। তখন আমার একটা চিন্তা হল মহেন্দ্র কাকার অবর্তমানে, আমাকে না দেখিয়ে দিলে তো আমি পার্ট করতে পারব না। এরকম তো সকলে করে না। সবাই তো নিজের নিজের মতো করে পার্ট বলে। তাহলে আমি কেন পারি না। এই পার্ট বলার পেছনে গুপ্ত রহস্যটা কী? কী করে হয়? যেটা আর সকলে পারে তা আমি পারি না কেন? তাঁরা কী জানেন? আমি কী জানি না? এইসব ‘কী জানি না’-র খোঁজ করতে শুরু করলাম। আস্তে আস্তে দেখা গেল যে আমি নিজে নিজেও কিছু করতে পারছি। মহেন্দ্র কাকা বলে দেবার পর সেটাকে আর একটু এদিক-ওদিক করে নিতে পারছি। পরবর্তীকালে দেখা গেল মহেন্দ্র কাকার জন্যে আর আমাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। আমি বলতাম, উনি মাঝে মাঝে শুধরে দিতেন— এটা এসেছিল বোধহয় অশিক্ষিত পটুতা থেকে। আমার মনে হতো রাগের কথা হলে রেগে বলি, কাঁদার কথা হলে কেঁদে বলি। কিন্তু চরিত্র বিশ্লেষণ বলে যে ব্যাপারটা, সেটা তখনও আমার ধারণায় আসেনি। একটা স্মরণীয় ঘটনার কথা বলি।
আমার বাবা মূলত সংগীতশিল্পী হলেও উঁচুদরের অভিনেতাও ছিলেন। শিশির ভাদুড়ী ছিলেন তাঁর অভিনয়-জীবনের প্রথম শিক্ষাগুরু। গান গাইতেন বলেই যেসব ক্ষেত্রে গান অভিনয় দুই-ই থাকত, সেসব ক্ষেত্রে অনেকগুলো পার্টই করতে হতো ওঁকে। স্টারে থাকাকালীন ‘শ্রীরামচন্দ্র’১২ বলে একটা নাটক হয়েছিল। তাতে রাম এবং লক্ষ্মণ করেছিলাম সিধু গাঙ্গুলি১৩ ও আমি। আমি ছেলেবেলাতে দেখতে মোটামুটি খুব একটা খারাপ ছিলাম না। গোলগোল চেহারা ছিল, ফর্সা রঙ ছিল, চোখমুখ ভালোই লাগত— অন্তত মেকআপ করলে তো বটেই। নাটকের শুরুতে রাম বনবাসে যাচ্ছে। বনবাসের পরে দুজনে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছে। সঙ্গে সীতা নেই। নৌকো করে পেরোবেন, এমন সময় বিশ্বামিত্র মুনি এসে শ্রীরামচন্দ্রকে খুব কড়া কথা বললেন। শ্রীরামচন্দ্র চুপ করে থাকলেও লক্ষ্মণ দাদার এই অপমান সহ্য করতে না পেরে অত্যন্ত কড়া ভাষায় তাঁকে জবাব দেন, তারপর দৃশ্যটা শেষ হয়। রাম-লক্ষ্মণ বেশে আমাদের দুজনকে খুব সুন্দর লাগত বলে অনেকেই মন্তব্য করতেন ‘দেখলেই পয়সা উঠে যায়, পার্ট দেখার প্রয়োজন নেই।’ তা সত্ত্বেও অভিনয়েরও একটা সুখ্যাতি পেতাম। এর ফলে অল্প বয়সে যা হয়— সবাই যখন বলছে আমি অভিনয়টা ভালোই শিখে গেছি, এরকম একটা অহংবোধ আমার মধ্যে জন্ম নিল।
আমি যখন প্রথম স্টারে যুক্ত হই তখন বাবাও ওখানে সংগীতশিল্পী, সুরকার এবং অভিনেতা হিসেবে ছিলেন। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ স্টারে যখন ‘শ্রীরামচন্দ্র’ অভিনীত হচ্ছিল, তখন বাবা অভিনেতা পদটা ছেড়ে সুরকার হিসেবে যুক্ত ছিলেন। হঠাৎ একদিন শুনলাম বাবা থিয়েটার দেখতে এসেছেন। শুনে আমার মনে হল বাবাকে একটু দেখিয়ে দেওয়া দরকার যে বাবা আমাকে থিয়েটারে এনে ভুল করেননি। সেদিন অন্যান্য দিনের চেয়েও বেশ জোরালো অভিনয় করলাম। বীররসের সঙ্গে বীরদর্পে বিশ্বামিত্রকে প্রায় নস্যাৎ করে দিলাম। নাটক শেষ হল। সেদিন অনেক দেরি করে পোশাক খুলে মেকআপ তুলে বাড়ি গেলাম যাতে বাবা আগে বাড়ি পৌঁছে যান। তারপর মায়ের কাছ থেকে শুনে নেব যে বাবা আমার পার্ট দেখে কতটা অভিভূত হয়েছেন।
আমার বরাবরের অভ্যেস ছিল একা ঘরে শোয়া এবং আমার ঘরে আমার খাবার থাকত, সেদিন গিয়ে দেখলাম আমার ঘরে খাবার নেই। একটু পরে মা এসে বললেন যে বড়োবাবুর ঘরে আমার খাবার দেওয়া হয়েছে (বড়োবাবু মানে বাবা, বাবাকে মা ওইভাবে সম্বোধন করতেন)। বাবার সামনে সাধারণত দাঁড়াতেই আমরা ইতস্তত করি আর বাবার সামনে বসে খাব, এটা কি ব্যাপার— ভীষণ অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। যাহোক, উপায়ান্তর না দেখে বাবার ঘরে গিয়ে খেতে বসলাম। বাবাও বসলেন। নিঃশব্দে বাবা খেয়ে যাচ্ছেন আর আমার শুধু মুখ নাড়াই হচ্ছে, খাওয়া হচ্ছে না। হঠাৎ বাবা বললেন, ‘আজ আমি তোমাদের নাটক দেখতে গিয়েছিলাম’, আমি বললাম ‘আজ্ঞে হ্যাঁ’। ‘কী নাটক যেন?’ আমি বললাম, ‘ওই রামচন্দ্র’। বললেন, ‘হ্যাঁ, তাতে কী পার্ট তুমি করলে?’ আমি তো বিশবাঁও জলে পড়লাম! বাবা অভিনয় দেখে এসেও জিজ্ঞেস করছেন। আমি বললাম— ‘আজ্ঞে ওই লক্ষণ।’ বললেন, ‘লক্ষণ কি কলাবাগানের গুণ্ডা ছিল? তুমি প্রথম সিনেতে বিশ্বামিত্র মুনির সঙ্গে যে কথাগুলো বললে ওতে মনে হল তুমি কুস্তি করছ। ওইভাবে কথাগুলো বললে কেন?’ আমি অনেকক্ষণ মাথা চুলকে বললাম, ‘না, মানে দাদাকে মানে রামচন্দ্রকে ওইরকম কথা বললেন তাই জন্যে… আর কথাগুলো তো রাগের কথা’। বললেন, ‘নিশ্চয়ই রাগের কথা, কিন্তু রাগের কথাটা বলছ কাকে এবং কে বলছে? আর তুমি লক্ষ্মণ, একজন রাজার ছেলে, অশিক্ষিতও নও। বাড়ির ছোটোদের ওপর তুমি রেগে গেলে যে ভাষায়, যে ভঙ্গিতে কথা বলো, ঠিক ততখানি রেগে গেলেও আমার সঙ্গে সেই ভাষায় বা সেই ভঙ্গিতে তুমি রাগ প্রকাশ করো? এটা তোমার মাথায় ঢুকল না?’ আমি কিছু বলতে পারলাম না, কিন্তু একটা চরম শিক্ষা পেলাম। আর হঠাৎ যেন চোখের সামনে একটা আলো দেখতে পেলাম। এতদিন ধরে আমি খুঁজছিলাম যে অভিনয়ের মূল কথাটা কী? কী করলে একজন অভিনেতা একটা চরিত্রকে রূপ দিতে পারবে— তার ক্ল্যু-টা খুঁজে পেলাম। চরিত্রটাকে বিশ্লেষণ করে নিজেকে বিশ্লেষণ করতে হবে, আমার পরিবেশ, আমার শিক্ষা, আমার স্ট্যাটাস এবং যাকে আমি বলছি তার সঙ্গে আমার পরিচয় অর্থাৎ স্থান কাল পাত্রের সমন্বয়ে একটা চরিত্রকে গড়ে তুলতে হবে। একদিনেই অবশ্য এ উপলব্ধিটা আসেনি, কিন্তু বাবার কথাটা বারেবারেই আমার মনকে আঘাত করেছে, আমি ভাববার চেষ্টা করেছি যে বাবা ঠিক কী কথা বলতে চেয়েছিলেন। আস্তে আস্তে এটা আমার কাছে খুব পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল এবং পরবর্তীকালে এটাকেই কালটিভেট করার চেষ্টা করেছি। অভিনয় শিক্ষার প্রথম পাঠ আমার বাবার কাছে। সে সময়ে স্টার থিয়েটারে অনেক নামী-দামি অভিনেতা ছিলেন— যেমন অহীন্দ্র চৌধুরী, কমল মিত্র, জহর গাঙ্গুলি, সন্তোষ সিংহ১৪,রবি রায়১৫, ভূমেন রায়১৬, জয়নারায়ণ মুখার্জি১৭, সিধু গাঙ্গুলি আর মহিলাদের মধ্যে ছিলেন সরযূবালা দেবী১৮, শান্তি গুপ্তা১৯, হরিমতী দেবী২০, অপর্ণা দেবী২১, ফিরোজাবালা২২, সুশীলাবালা২৩, পূর্ণিমা দেবী২৪ প্রভৃতি, কিন্তু এদের কারো কাছ থেকেই আমার নেবার মতো কিছু ছিল না।
মনে আছে, স্টারে অভিনীত ‘সমুদ্রগুপ্ত’২৫ নাটকে আমার ভূমিকার বেশিরভাগ অংশ আমি নিজেই তৈরি করেছিলাম। সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের ছেলে। কিন্তু অত্যন্ত বাল্যকালে একজন জংলি রাজা (বাঘ রাজা) আমাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। আমি জানি যে সেই বাঘরাজই আমার বাবা। আর তার শালী ছিলেন পূর্ণিমা দেবী। তাকে হঠাৎ দেখে সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের ভালো লাগে এবং বিয়ে করে ঘরে নিয়ে আসেন। মাসি এবং বোনপো প্রায় সমবয়সি হওয়ায় বিয়ের খবরেতে খুব মজা করে, ঠাট্টা করে মাসিকে বলেছিল এবং সেখানে বেশ ঘুরে ঘুরে লাফিয়ে লাফিয়ে নাচের ভঙ্গি করে নানানভাবে আমি কথাগুলো বলেছিলাম। এই বলার ধরন, চলাফেরা সবটাই আমার নিজের এবং সেটার সমর্থন পেয়েছিলাম আমাদের ডিরেক্টর, নাট্যকার এবং প্রধান অভিনেতা মহেন্দ্র গুপ্তর কাছ থেকে। তখন থিয়েটারে অদ্ভুত একটা অভিনয়ের ধারা ছিল। বেশিরভাগটাই সুর নির্ভর। চরিত্রের রাগ প্রকাশের সময় কান্না বা হাসি ছিল না, কিন্তু রাগ প্রকাশ পেত অদ্ভুত ধরনের একটা সুরেলা ভঙ্গিতে। আবেগপূর্ণ কথা বলার সময় গলার স্বর নিম্নগ্রাম থেকে আস্তে উচ্চগ্রামে উঠে হঠাৎ খাদে নামিয়ে আনা হতো— এই বিশেষ ধারাটি এখনও বজায় আছে যাত্রা জগতে। আর চলাফেরা, আসা-যাওয়া এর কোনও নির্দিষ্ট ছক ছিল না। চরিত্রটাকে ফুটিয়ে তোলার জন্যে বা ড্রামাটিক এফেক্ট আনার জন্যে কোনও কোরিওগ্রাফি বা কম্পোজিশন হতো না। কতকগুলো অদ্ভুত অদ্ভুত বাঁধাধরা নিয়ম ছিল তখন। আমার সঙ্গে একজন প্রবীণ অভিনেতার এ নিয়ে অত্যন্ত মতভেদ হয়েছিল একসময়। এক জায়গায়, অত্যন্ত ধনী পরিবারে বাবা মন থেকে পুত্রবধূকে গ্রহণ করতে পারছেন না, মা তো একেবারেই না। কারণ পুত্রবধূটি নিতান্তই নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। ছেলে বাবা-মা’র কাছে মেয়েটিকে নিয়ে আসে। বাবা মাকে বোঝাবার চেষ্টা করছেন যে মেনে নিতে হবে। এই সময়ে প্রবীণ অভিনেতার বক্তব্য ছিল মেয়েটি কাছে এসে প্রণাম করলে ওনাদের আশীর্বাদ করতে সুবিধে হয়। কিন্তু এ প্রস্তাব আমি সমর্থন করতে পারিনি। আমি ওনাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম। যে শ্বশুর-শাশুড়ির ক্ষেত্রে মেয়েটির চরম সংকোচ আছে। শ্বশুরবাড়ি আসার আগে ছেলেটিকে সে বলে যে সে এ বাড়িতে বেমানান। শ্বশুরবাড়িতে এসে সে শুনছে শাশুড়ি প্রতিবাদ করছেন সেক্ষেত্রে তার তো দরজার কাছে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কথা। শ্বশুরের বরং তাকে ডেকে নেওয়া উচিৎ। কারণ তিনি মোটামুটি এ ব্যাপারটা সমর্থন করছেন। প্রবীণ অভিনেতাটি কিন্তু আমার এ প্রস্তাবে খুব অসন্তুষ্ট হলেন এবং যেহেতু তিনি বয়স্ক এবং প্রবীণ তাই শেষপর্যন্ত আমার কথা থাকেনি। যাহোক এ ধরনের অভিনয়ের চিন্তা তখন থেকেই আমার মাথায় এসেছে, এসেছে তার কারণ সে সময় থেকে শ্রীরঙ্গমে নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ী মহাশয়ের সংস্পর্শে আমি।
নাট্যাচার্যের সংস্পর্শে আসার প্রসঙ্গে কিছু বলি। তখন আমাদের ‘সমুদ্রগুপ্ত’ নাটক হচ্ছে। নাট্যাচার্য হঠাৎ ঠিক করলেন ‘ঘরে বাইরে’২৬ নাটক করবেন। এর জন্যে একজন দক্ষ শিশু অভিনেতার প্রয়োজন। ওর দুই ভাই হৃষিকেশ ভাদুড়ী ও ভবানী ভাদুড়ীর আমার নাটক দেখে ভালো লাগায়, ওঁর কাছে শিশু অভিনেতা হিসেবে আমাকে মনোনীত করতে বলেন।
নাট্যাচার্য আমার বাবার মাধ্যমে আমাকে ডেকে পাঠান। তার আগে আমি শিশিরকুমারের অভিনয় দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। ওঁর সম্পর্কে একটা কথা আছে যে ওঁর অভিনয় দেখতে গেলে চারপাশের আর সব কিছু ভুলে যেতে হয়। একথা শুনে আমি মনে মনে হেসেছিলাম। ভেবেছিলাম, ভুলবটা কী করে? আমি প্রথমে যাব। মন স্থির করব। টিকিট কাটব, হলে গিয়ে বসব, আলো জ্বলবে, আলো নিভবে, চরিত্র আসবে, চরিত্র বেরিয়ে যাবে। ভুলে যাবটা কী? কিন্তু ওঁর অভিনয় দেখতে গিয়ে আমার ভুল ভাঙল। হঠাৎ কখন আমি আমাতে ছিলাম না, হারিয়ে গেছিলাম। অভিনয়ের মধ্যে শুধু ওঁর ভূমিকাটা দেখা ছাড়া আশপাশের আর কিছুই নজরে পড়েনি। শিশিরকুমারের অনুভূতিতে আমার সারা মন ভরে গেল।
যা হোক, যথাসময়ে তাঁর কাছে গেলাম। বাবার সঙ্গে ওঁর দু’-চার কথা হল। সেই ফাঁকে আমি দেখতে লাগলাম মানুষটিকে। সেই তো একটা মানুষের চেহারা— দুটো চোখ, একটা নাক, ঠোঁট নেড়ে কথা বলছেন, হাত নাড়ছেন, তো বিশেষত্বটা কোথায়? সেইটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। উনি আমার সঙ্গে দু’-একটা কথা বলার পর একটা কবিতা শোনাতে বললেন। আমি ‘দুই বিঘা জমি’ বলতে শুরু করলাম। ‘হাটে মাঠে বাটে যখন যেখানে ভ্রমি/তবু নিশিদিন ভুলতে পারিনে সেই দুই বিঘা জমি’। *তারপর… ‘কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি রথতলা করি বামে/রাখি হাটখোলা নন্দীর গোলা মন্দির করি পাছে/তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে’— এই পর্যন্ত বলেছি। মাঝখানে উনি আমায় থামিয়ে দিলেন— ‘না-না, না-না, তা কী করে হবে?
এতদিন ধরে একটা লোক সারা দেশে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছে। কিন্তু যার কথা ভুলতে পারেনি, সেই গ্রামের কাছে এসে দেখছে সেই জিনিসগুলো, তার মধ্যে সেই আকুলতাটা তো আসবে’— বলেই উনি কবিতাটা বলতে আরম্ভ করলেন। এই আমার প্রথম শিক্ষা ওঁর কাছে। যাহোক, ওঁর কাছে আমি মনোনীত হলাম। স্টারে জানানো হল। তাঁরা অত্যন্ত খুশি হলেন। বললেন, ‘ও তো কলেজে পড়তে যাচ্ছে, ও তো শিখবে ওখানে, সেটাতো আমরাই ফেরৎ পাবো।’
শ্রীরঙ্গম২৭-এর পাট শুরু হল। ওখানে কিন্তু ওই নাটকটা হয়নি আদপেই। আমি প্রথমে গিয়ে পুরোনো নাটকগুলিতে অভিনয় করতাম এবং সেখানেও উনি আমায় দেখিয়ে দিতেন, বুঝিয়ে দিতেন। বলে দিতেন কোথায় ভুল হচ্ছে, কেন ভুল হচ্ছে। আমি যেটা বললাম সেটা তো বলা যায়— কিন্তু এইভাবে বললে কেন ভালো লাগবে। আমার মনে আছে ‘জনা’ বইতে আমি বৃষকেতু করলাম। উনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোর বাবা এই দিয়ে শুরু করেছিল, তুইও কর।’ তারপরে ওখানে বহু পার্ট করেছি। ‘জনা’তেই বাণীব্রত মুখোপাধ্যায়২৮ কৃষ্ণের পার্ট করতেন। উনি চলে যাওয়াই আমি করলাম। এরপর ‘দুঃখীর ইমান’ (‘দুঃখীর ইমান’-এর একটা স্মৃতি মনের মধ্যে আছে, সেটা গুরুর আশীর্বাদ বলেই আমার মনে হয়েছে)। তখন শিবরাত্রি বা ওই ধরনের কোনও উৎসবে সারারাত ধরে নাটক অভিনয় হতো। সেবার শিবরাত্রি উপলক্ষে দুটো নাটক হয়েছিল— ১. ‘তখত এ-তাউস”২৯ ২. ‘দুঃখীর ইমান’৩০। শিশিরকুমার শুধু ‘তখত-এ তাউস’-এই অভিনয় করবেন, পরেরটা অর্থাৎ ‘দুঃখীর ইমান’-এ করবেন না। ‘তখত-এ-তাউস’ নাটকে আমার ভূমিকা ছিল সম্রাটের বড়ো ছেলের এবং একটু জড়বুদ্ধি সম্পন্ন। তাতে একটা জায়গায় একটা হাসার কথা মনে হয়েছিল। আমি ইতস্তত করে ওরকম করে হাসব কিনা জিজ্ঞেস করায় উনি করে দেখাতে বললেন। করে দেখালাম— উনি হেসে সস্নেহে বললেন, ‘কর। খুব ভালো, কর।’
দ্বিতীয় নাটক ‘দুঃখীর ইমান’। ‘দুঃখীর ইমান’-এ রাম অউতারের চরিত্রে যিনি করতেন তিনি অনুপস্থিত থাকায় আমি ওই চরিত্রটা করতে ইচ্ছে প্রকাশ করায় উনি রাজি হয়ে গেলেন। যে কোনো কারণেই হোক সেবার বিশেষ রিহার্সাল কারুর করা হয়নি। সকলেরই মোটামুটি জানা। আমি ভেবেচিন্তে একটা ঠিক করেছিলাম খৈনি খাব। প্রথমেই আসব মাথায় গামছাটা খুলে নিয়ে হাওয়া খেতে খেতে। তারপরে কোমরে ওই যে বেল্ট থাকে সেটা কাঁধে ঝুলিয়ে নেব। এসে কথাবার্তা বলতে বলতে খৈনি খাব, খেয়ে থুথু ফেলব, ফেলে বাকি কথা বলব। মহানন্দে পার্ট করছি। হঠাৎ খৈনি খেয়ে থুথু ফেলতে গিয়ে চোখের সামনে দেখি জ্বলন্ত দুটো কাচ। অর্থাৎ নাট্যাচার্য একেবারে প্রথম সারিতে বসে অভিনয় দেখছেন। সারা শরীর শিউরে উঠল। সর্বনাশ! একে তো অনেকগুলো কায়দাকানুন করে ফেললাম যেটা নাটকের চরিত্রে লেখা নেই। তারপর সেগুলো ঠিক হল কিনা, বাড়াবাড়ি হল কিনা! কিন্তু সেটা ক্ষণিকের জন্যে, তারপরেই মনে হল— না ওটা ভাবব না। অভিনয়টা করছি, অভিনয়টাই করতে হবে। যথাসময়ে অভিনয় শেষ হল। লজ্জায়, সংকোচে ওনার সঙ্গে দেখা করব কি না ভাবছি, এমন সময় নাট্যাচার্য সশরীরে উপস্থিত। লবিতে এসে আমার খোঁজ করতে লাগলেন। ওঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি সস্নেহে আমার মাথায় হাত রাখলেন, বললেন, ‘খুব ভালো করেছিস, খুব ভালো হবে তোর’; সেদিন মনে হয়েছিল এ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।
শিশিরকুমার ভাদুড়ীর একটা বিষয় আমার প্রথম প্রথম পছন্দ হত না— তা হলো রিহার্স করানো। মনে হত এত রিহার্সালের কি প্রয়োজন? স্টারে তো ছ-সাতদিন মাত্র রিহার্সাল হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বুঝেছি উনি একটা চরিত্রকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করে বিশ্লেষণ করে বোঝাবার চেষ্টা করতেন। সে প্রসঙ্গে ইবসেন, শেক্সপিয়ার, জর্জ বার্নাড শ’— এঁদের প্রসঙ্গ আসত। উনি যেভাবে ব্যাখ্যা করতেন বা শেখাতেন, আমি সেভাবে বোঝার চেষ্টা করতাম। উনি বলতেন, আমি মাথায় ধরে রাখার চেষ্টা করতাম। ভাবতাম, উনি এই কথাটা কীভাবে বলছেন, কেন বলছেন, এর ভেতরের কথাটা কী এবং একসময় সেগুলো আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি।
রিহার্সালের সময় উনি যাকে যা যা বলতেন, আমি একেবারে গোগ্রাসে গিলতাম। রিহার্সালে একবার বাণীব্রতের অনুপস্থিতিতে ওঁর ভূমিকাটা করার অনুমতি চেয়ে যখন করে দেখলাম, তখন উনি খুব আনন্দ পেয়েছিলেন এবং আশীর্বাদ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে একটা মজার কথা বলি। একবার ‘তখত-এ-তাউস’-এর রিহার্সাল চলছে। সকলে এসে চুপচাপ বসে আছেন। মুরারীদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘রিহার্সাল হচ্ছে না কেন’?
উনি বললেন, ‘বড়দা (শিশিরকুমার) এখনো আসেননি’।
আমি বললাম, তাতে কী হয়েছে, উনি যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছেন ওইভাবে আমরা আমাদের সিনগুলো করি।
‘উনি বললেন, বড়দার ভূমিকাটা কে করবে? তুই করবি?’
আমি রাজি হয়ে গেলাম। আমি শিশিরকুমারের পার্ট বলতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পরে দেখি মুরারীদা মুচকি-মুচকি হাসছেন আর আমার মাথার ওপর দিয়ে পেছন দিকে তাকাচ্ছেন। আমি বললাম, ‘এটা হাসির দৃশ্য নয়, উত্তর দাও, উত্তর জানতে চাই। অন্যদিকে তাকাচ্ছো কেন?’ বলে ঘুরে তাকিয়েই দেখি যে শিশিরকুমার মিটিমিটি হেসে দাঁড়িয়ে আছেন। এই দেখে আমি তো দৌড়ে ওই ত্রিসীমানার বাইরে। ভাবছি হয়ে গেল আজ। কে যেন এসে বলল যে বড়দা ডাকছেন। চোরের মতো গুটি গুটি গিয়ে হাজির হলাম তাঁর কাছে। উনি হেসে বললেন, ‘তুই পালিয়ে গেলি কেন? খুব ভালো হচ্ছিল, খুব খুশি হয়েছি।’ এটাও আমার জীবনে আর একটা অমূল্য পাওনা। আবার ফিরে আসি তাঁর অভিনয় শিক্ষার প্রসঙ্গে। একবার স্থির হল উনি ‘মালিনী’ নাটকটা করবেন। আমি সুপ্রিয় করব, ভবানীকিশোর ভাদুড়ী করবেন ক্ষেমঙ্কর আর ঝর্ণাদি করবেন মালিনী। কয়েকটা দিন রিহার্সাল হয়েছিল কিন্তু শেষপর্যন্ত নাটকটা করা সম্ভব হয়নি।
যাহোক, রিহার্সালের সময় সুপ্রিয়র ভূমিকায় অভিনয় করছি— প্রথমেই আমি বলছি যে, ‘পথ আছে লক্ষ শত শুধু আলো নেই… জ্যোতির্ময়ী তাই আমি চাই একটা আলোর রেখা।’
শিশিরকুমার আমায় সংশোধন করে দিলেন, বললেন, ‘তুই কাঁদছিস কেন? গলার মধ্যে কান্না আসছে কেন? এখানে কান্না আসবে না, এটা ক্ষোভ’,— এইভাবে উনি বোঝাতেন। আর একটা জায়গায় ‘তীক্ষ্ন’ বলে একটা শব্দ ছিল। আমি ‘তীক্ষ্ন’ বলছি। উনি বললেন, ‘না, না, তীক্ষ্ন কী করে হবে? তী…ক্ষ্ন’ মানে একটা সরু জিনিস বিঁধছে। তীক্ষ্ন মানে বুঝিস তো। তাহলে গলার মধ্যে সেই তীক্ষ্নতা আসবে না কেন? প্রতিটি শব্দের প্রকাশভঙ্গি তাই গলার মধ্যে চাই।’
এরপর ওখানে নাটক করা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। কারণ টাকাপয়সা নেই, বিক্রি প্রায় বন্ধ। হঠাৎ ঠিক হলো ‘সাজাহান’৩১ নাটক করবেন। আগে ‘সাজাহান’ করতেন ছবিদা, ঔরঙ্গজেব করতেন শিশিরকুমার আর সোলেমান করতাম আমি। সোলেমানের ভূমিকায় আমি খুব প্রশংসা পেয়েছি। বিশেষ করে মাধবীকে (মুখোপাধ্যায়) জিজ্ঞেস করলে ও বলবে আমি অনুপদার অনেক পার্ট দেখেছি কিন্তু সোলেমানের মতো পার্ট কখনও দেখেনি। অনেকের সোলেমান দেখেছি, এরকম নয়।
তখন ঠিক হল ছবি বিশ্বাসকে আনতে গেলে দুশো আড়াইশো টাকা লাগবে। সেটাও যোগাড় করা সম্ভব নয়, পথ ছিল না, তাই শিশিরকুমার দুটো চরিত্রেই অভিনয় করবেন, সাজাহান এবং ঔরঙ্গজেব। ভাবা যায় একই সঙ্গে দুটো বিপরীত চরিত্রে অভিনয়! সামান্য খালি রদবদল হতো। ওই চুলটা আর দাড়িটা পালটাতেন, আর জোব্বাটার খালি রঙের পরিবর্তন হতো। শেষ দৃশ্যে আছে ঔরঙ্গজেব আর সাজাহান। সেখানে উনি সাজাহান করতেন। ঔরঙ্গজেব করত সুবোধ মুখার্জী বলে একটি ছেলে। এ অভিজ্ঞতা আমি কাউকে বলে বোঝাতে পারব না। এ প্রসঙ্গে একটা চালু কথা আছে যে অহীন্দ্র চৌধুরির মতো সাজাহান হয়নি, হয় না। শিশিরকুমার অভিনীত সাজাহানও কিন্তু অহীনবাবুর সঙ্গে তুলনা করলে একটু নিম্ন— আমি বিশ্বাস করি না। অহীনবাবু যেটা করতেন গ্যালারির কথা ভেবে একটা পঙ্গু চেহারা এনে এবং ওঁর কণ্ঠস্বর ভালো ছিল না। কি বলব, গ্যালারি অ্যাকটিং বলতে যা বোঝায়, একটা গমক করে অভিনয় করতেন। আর শিশিরকুমারকে যখন সাজাহান করতে দেখেছি তখন তা মনে হয়েছে মূর্তিমান সাজাহান ঘুরছেন। তার অক্ষমতা, তার অক্ষম রোষ, ক্ষুদ্ধ হওয়া, নিরুপায় অবস্থা…।
যেখানে এসে মোহম্মদ বলছে যে রক্ষীদের আমি বার করে দিয়েছি এবং উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে কথা বলছে, উনি ক্ষেপে যেতেন, দুনিয়াটা কি একদিনে বদলে গেছে? তুমি আমার নাতি, আমার সামনে নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে কথা বলছ। সম্রাটের সামনে খোলা তলোয়ার? তলোয়ার তো বাইরে রেখে আসার নিয়ম। তলোয়ার খুলে কে কথা বলছে? এবং তারপরে তাকে লোভ দেখাতেন যে তুমি একবার, একবার আমাকে তুমি দুর্গের বাইরে নিয়ে চলো। শুধু আমার সৈন্যদের সামনে গিয়ে আমি একবার দাঁড়াব। এই জরাজীর্ণ সাজাহান এখনও যদি তার সৈন্যদের সামনে দাঁড়াতে পারে, তিরিশ বছর ধরে সে দেশ শাসন করেছে, তাদের সম্মিলিত জয়ধ্বনিতে ঔরঙ্গজেব ধুলো হয়ে উড়ে যাবে এবং সর্বসম্মুখে আমি তোমায় এই রাজমুকুট পরিয়ে দেব, কেউ আপত্তি করতে পারবে না। এ বৃদ্ধের প্রলাপ নয়, এই আমি পবিত্র কোরান ছুঁয়ে শপথ করছি তুমি হবে সম্রাট। এবং তারপরে মোহম্মদের কথা আছে যে হৃদয় বড়ো দুর্বল, প্রলোভন বড়ো অধিক, আমি এখানে আর থাকব না— বলে বেরিয়ে যাচ্ছে অর্থাৎ প্রলুব্ধ হচ্ছে এবং এই প্রলুব্ধ করাটা একটা গ্রেট পলিটিশিয়ানের মতো উনি বলতেন এবং সত্যি সত্যি লোভ সংবরণ করা সেখানে খুব শক্ত হতো। চলে যাবার পর হঠাৎ তিনি শিশুর মতো বলতেন, ‘চলে গেল’! ‘চলে গেল’! বিশ্বাস করতে পারেন না যে, মোগল সাম্রাজ্যের মোগল সম্রাটের বংশধর হয়ে এই লোভ কেউ দমন করতে পারবে। আর একটা জায়গায় যখন খবর পেলেন যে দারা বন্দি এবং তাকে হাতির পিঠে চাপিয়ে সারা দেশ ঘোরানো হচ্ছে। আমরা শুনেছিলাম যে জাপানি কাবুকি একটা প্যাটার্ন আছে। কিছু নেই কিন্তু ভঙ্গি করে বোঝানো হয়। উনি করতেন স্টেজে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে— যেখানে জাহানারা কথা বলে যাচ্ছেন, উনি থেকে থেকে বলতেন, ‘দেবো নাকি লাফ? দিই লাফ’— এবং লাফাবার একটা ভঙ্গি করতেন। জাহানারা বলছেন, ‘আপনি করছেন কী?’ উনি বলতেন, ‘ওই দেখ না নীচ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আমি দেখি না চেষ্টা করে যদি ওকে ফেরানো যায়। লাফ দিই, দিই লাফ?’ বলে ভঙ্গিটা করতেন। তখন জাহানারা বলতেন, ‘আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন?’ হ্যাঁ, হঠাৎ সম্বিত ফিরত— ‘আমি পাগল হয়ে গেলাম! ইয়ে আল্লা, তুমি একি করলে, দ্যাখো, দ্যাখো বৃদ্ধ সাজাহানকে দ্যাখো, তোমার দয়া হয় না! তোমার দয়া হয় না—’ বলতে বলতে নিল ডাউন হয়ে বসে পড়তেন।
আমি বলতে পারি, আমি বিদেশের থিয়েটারে কারো অভিনয় তো দেখিনি, ভারতবর্ষে এ ধরনের কল্পনা করার শক্তি কারুর আছে কিনা জানি না। আমি বিশ্বাস করি না। সে যে কী অভিনয় তার তুলনা হয় না। এই পরিবেশটা আমি চার বছরের অধিককাল ধরে পেয়েছিলাম, আমার অভিনেতা হওয়ার বুনিয়াদ ওইখানে পাকা হয়েছিল। এমন অনেক সময় হয়েছে— উনি চরিত্রটা বিশ্লেষণ করেননি। কিন্তু আমি বিশ্লেষণ করতে শিখে গেছি। চরিত্রটা কী, কেন এরকম করলেন ইত্যাদি।
চাণক্য৩২ যেখানে থেকে থেকেই বলত— ‘তুমি কী বল, প্রেয়সী’? তখন ক্যাতায়ন জিজ্ঞেস করত— ‘তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ’? এ ব্যাপারে দানীবাবুর৩৩ খুব নাম ছিল। উনি এমনভাবে বলতেন যেন উনি ভৌতিক কারও সঙ্গে কথা বলছেন। কিন্তু শিশিরকুমার তাকে রূপ দিয়েছিলেন, তিনি নিজের মাথাতে টোকা দিয়ে দিয়ে বলতেন— তুমি কী বলো প্রেয়সী? অর্থাৎ তাঁর কূটবুদ্ধিকে তিনি জিজ্ঞাসা করতেন। ওটা বাইরের কোনও ব্যাপারে নয়— এই যে দেখতে পাওয়া এবং দেখানো দর্শককে যে এটা সত্যি ঘটনা, বাস্তব ঘটনা, বাস্তবের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া— এটা অসাধারণ।
ওঁর যতগুলো অভিনয় দেখেছি দেখে শুধু পাগল হওয়া ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না। ‘ষোড়শী’ নাটকে একটা রোমান্টিক দৃশ্যে ছিল— উনি আস্তে আস্তে ওখানে খাবেন এবং শোবেন— সেরকম ঠিক হয়েছে। মেয়েটি খাবার আনতে গেছে। মাদুরটা পাতা আছে। মাদুরে বসে চিঠি পড়ছিল, ডাক শুনে চিঠিটা মাদুরের তলায় রেখে উঠে কথাবার্তাগুলো হয়েছিল। তো চিঠিটা উনি পড়বেন। কীভাবে পড়বেন? উনি শিখিয়েছিলেন যে মাদুরটা সিধে থাকলে হবে না— কোঁচকানো থাকলে তবেই পা দিয়ে টানতে গেলে মাদুর সরে যেত, কাগজটা দেখতেন, কাগজটা তুলে পড়তেন, পড়ে তাঁর কমপ্লিট চেঞ্জ হতো এবং তখন অ্যাটাক করতে শুরু করতেন ষোড়শীকে। তারপর কমপ্লিট হেরে গিয়ে কনফেস করা, একটি মেয়েকে। দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার, যে কাউকে ভয় করে না, তার অ্যাপিল করা— ‘আমার সমস্ত ভার তুমি নেবে অলকা? নাও না।’
তারপর বলতে বলতে মেয়েটি যখন অ্যাটাক করে যে, ‘তুমি এই করে পালিয়ে গিয়েছিলে, তখন আমি পালাইনি— হ্যাঁ, এটা ঠিক। তোমার মা যখন বিয়ে দিতে চেয়ছিলেন তখন আমার লক্ষ্য ছিল টাকাগুলো কিন্তু সেদিন যখন হাতে হাতে তোমাকে পেলাম তখন তো আর না করতে পারিনি।’
এই যে হঠাৎ ওনার চেঞ্জ গলার মধ্যে এটা আমি আর একজনের মধ্যে শুধু পেয়েছিলাম— প্রভা দেবী৩৪। আমার দুর্ভাগ্য, নাটকে আমি প্রভা দেবীর সঙ্গে অভিনয় করার সুযোগ পাইনি। তবে একটা ছবিতে ওনাকে পেয়েছিলাম। তাঁর কাছে বহু বিষয় শেখার চেষ্টা করেছিলাম। একসময় ওনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম— ‘এই যে কথায় কথায় আপনি কেঁদে ফেলেন। এত বড়ো বড়ো চোখ কী করে হয়, আমি তো পারি না।’ বলেছিলেন— ‘তুমি তো পারবে না বাবা, তোমরা তো ছেলে, কখনও দেখেছ যে ছেলেরা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদছে? বাড়িতে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে দেখবে মেয়েরা লুটিয়ে পুটিয়ে কাঁদে। ছেলেরা তো কাঁদে না, চোখ দিয়ে অল্প অল্প একটু জল পড়ে। সেইজন্যে ওটা তোমাদের অসুবিধে হয়।’
আমি বললাম— ‘আপনিই বা পারেন কি করে, মেয়েরাই বা পারে কি করে’। বললেন— ‘কেন বাবা, এই তো—’ উনি কথা বলছেন আর অত বড়ো বড়ো চোখদুটো মুহূর্তের মধ্যে জলে ভরে গেল, টপ টপ করে জল পড়ছে।
এই যে অসাধারণ ক্ষমতাগুলো আমি দেখেছি তার থেকে শেখার চেষ্টা করেছি। কারণ আমাদের তখন স্কুল বা কলেজে অভিনয় শেখানো ছিল না। ওই গুরুমুখি বিদ্যা ছিল। কিন্তু সেই গুরুর সংখ্যাও পরবর্তী, সময়ে ভীষণ কমে গিয়েছিল। প্রথম দিকে আমরা যেগুলো পড়ে জানতে পারি যে গিরীশচন্দ্র এবং অর্ধেন্দুশেখর৩৫, তারপরে অমৃতলাল বসু৩৬, অপরেশচন্দ্র৩৭, এইরকম কিছু কিছু শিক্ষক তখন ছিলেন। শিশিরকুমারের তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু তারপরে নরেশ মিত্র৩৮ মহাশয় কিছু শেখাতেন, কিন্তু আর তো অভিনয় শেখানোর কাউকে পাইনি। কাজেই কি মঞ্চে কি ছবির জগতে— সেই ধরনের শিক্ষকতার অভাবে ভালো অভিনেতা তৈরিও হয়নি।
পুরোনো কথায় ফিরে আসি। শ্রীরঙ্গমে যখন প্রায় প্রোডাকশন হয় না, বৃহস্পতিবারে তো হয়ই না— কোনও শনিবারে হয়তো একটা শো হয়, কখনও বন্ধ থাকে, কখনও শুধু রবিবারে হয়— এরকম সময় মিনার্ভা থিয়েটারে ‘ক্ষত্রবীর’ বলে একটা নাটক হবার কথা। তাতে ‘তরণীসেন’-এর পার্টটা কে করবে তার একটা খোঁজ চলছিল, তাতে আমার নাম প্রসঙ্গত উঠেছিল। অহীন্দ্র চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে এই নাটকটা হবে। আমার ডাক পড়ল, আমি গেলাম। তো উনি বললেন— ‘ব্ল্যাঙ্কভার্স তুমি বলতে পারো’? আমি বললাম— ‘স্টারে, শ্রীরঙ্গমে দু’জায়গায়ই তো ছিলাম, ওখানে ব্ল্যাঙ্ক-ভার্সই বেশি ছিল, আমি বলেছি’। বললেন— ‘শ্রীরঙ্গমে বড়দার ওখানে কী পার্ট করেছ’? আমি বললাম— ‘জনা’তে ‘শ্রীকৃষ্ণ’। বললেন— ‘বলো তো’।
শ্রীকৃষ্ণের প্রথম এনট্রান্সেই একটা বড়ো স্পীচ ছিল ব্ল্যাঙ্ক-ভার্সে। আমি সেটা বললাম। এমন সময় ছবিদা ঢুকলেন ঘরে। দেখে বললেন— ‘কে, অনুপ। হ্যাঁ, বড়দার ওখানে ওর সঙ্গে আমি অভিনয় করেছি। খুব ভালো, খুব ভালো, ওকে নিতে পারেন অহীনদা।’ (বাবা মাকে এসে বলেছিলেন, যে তোমার ছেলের ভাগ্য সুপ্রসন্ন, ওখানে ঠিক হয়ে গেছে, আড়াইশো টাকা মাইনে পাবে, ফ্লাইং পোস্টার পড়বে ‘অনুপকুমার’ স্থায়ীভাবে যোগদান করলেন। অহীনদা তো খুব সুখ্যাতি করলেন দেখলাম।)
তারপর ঠিক হল যে শিশিরকুমারের একটা অনুমতি নেওয়া দরকার। যদিও ওখানে কিছু হচ্ছে না, কিন্তু তখনও আমি তো ওখানকার স্টাফ হিসেবেই আছি। ওখানে কোনও মাইনের ব্যাপার ছিল না। কখনও সখনও ঋষিবাবু এসে আমার হাতে দশটা টাকা দিয়ে গেলেন হয়তো— এই হচ্ছে মাইনে। তো শিশিরকুমারের কাছে বাবা বলতে গেলেন। ফিরে এসে মাকে বললেন, ‘তোমার ছেলেকে দেখে হিংসে হয়। বড়দার কাছে গিয়েছিলাম, বড়দা রাজি হলেন না। বললেন, তোর ছেলেকে আমি ভালো পার্ট দিতে পারছি না ঠিকই, কিছু টাকাও দিতে পারছি না, তুই নিয়ে গেলে আমি তো না করতে পারব না, কিন্তু আমি হ্যাঁ বলব না। ও যখন এসেছিল তখন ও স্টেজে দাঁড়াতে জানত না, গলা ঝিম ছিল। এখন এসে ওর পার্ট দেখে যাস। নিয়ে গেলে আমি কিছু করতে পারব না, কিন্তু আমি হ্যাঁ বলব না। আমি ভেবে দেখলাম বুঝলে, গুরুর গুরু— তাঁকে অমান্য করা ভালো হবে না। মিনার্ভার অফারটা থাকা। ও যদি অভিনয় শিখতে পারে, গুরুর আশীর্বাদ থাকে তাহলে এর চেয়েও বড়ো কিছু করতে পারবে’।
সেই সিদ্ধান্তই বহাল রইল। তারপরে সেদিন আমি থিয়েটারে গেছি, উনি এসে জিজ্ঞেস করলেন— ‘অনু কোথায়’? আমি বললাম— ‘আজ্ঞে এই যে আমি’। উনি বললেন, ‘শোন তোর সঙ্গে কথা আছে’— বলে আমার কাঁধটা জরিয়ে ধরে উইংসের দিকে নিয়ে গেলেন। উনি আমার কাঁধ জড়িয়ে ধরেছেন! তখন আমার অবস্থা হচ্ছে কোনও কারণে কাঁধটা না নড়ে যায়। তারপর বললেন— এ ব্যাপারে বলতে গেলে আমার কান্না পেয়ে যায়— ‘তোর বাবা এসেছিলেন আমার কাছ থেকে তোকে নিয়ে যাবার জন্যে, আমি না করে দিয়েছি। তোকে আমি ভালো পার্ট দিতে পারিনি, কিন্তু তুই আমায় ছেড়ে যাসনি। আমি নাটক করব, তুই অনেক বড়ো হবি, তুই থাক, আমায় ছেড়ে যাসনি।’
আমার তখন মনে হচ্ছে উনি আমায় ছেড়ে দিলে আমি গিয়ে একটু কেঁদে অন্তত শান্তি পাবো। উনি বললেন, ‘তুই থাক, আমি ভালো নাটক করব, তোর হবে।’ বারে বারে এই কথাটা বলছেন তোর হবে। তারপর উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে আমার ওপর রাগ করলি না তো?’ আমার তখন মনে হচ্ছে যে এক্ষুনি ডুকরে কেঁদে ফেলব। তারপর উনি আমায় ছেড়ে দিয়ে বললেন— ‘যা’। আমি মেকআপ রুমে গিয়ে হাউহাউ করে কাঁদলাম অনেকক্ষণ ধরে এবং সে কান্নায় যে কি তৃপ্তি এটা আমি কাউকে বোঝাতে পারব না। জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ পাওয়া বলতে যা বোঝায় সেদিন আমি তা পেয়েছিলাম।
তারপর এমনিতেই থিয়েটারটা বন্ধ হয়ে গেল। আবার ফিরে এলাম স্টার থিয়েটারে। তখন নতুন করে স্টার থিয়েটার হচ্ছে। উত্তম এল, সাবিত্রী এল। কিন্তু গতানুগতিক থিয়েটারই হলো— নতুন কিছুরই সন্ধান পাইনি। ‘শ্যামলী’৩৯ নাটক, তারপর আরও অনেকদিন— স্টার থিয়েটারে সব মিলিয়ে কুড়ি বছর আমি অভিনয় করেছি এবং শেষের দিকে আমার তো আর পার্ট শিখে নেবার দরকার ছিল না। নিজের পার্ট নিজেই করতাম। পরে স্টার থিয়েটার ছেড়ে অন্যান্য যে-কোনো থিয়েটারেই গেছি, নিজের পার্ট নিজের চলাফেরা হাঁটা আমি নিজেই করতাম।
পরবর্তীকালে প্রফেশনাল থিয়েটারেও আমি নাটক পরিচালনার কাজ করেছি। আমি একটা খুব ভালো নাটক করে শেষ অবধি রাখতে পারিনি। আঠারোটা শো হবার পর স্টেজটা পুড়ে গিয়েছিল। এটা বলা হয় যে দুর্ঘটনায় পুড়ে গিয়েছিল, আসলে কিন্তু পোড়ানো হয়েছিল। নাটকটা ‘সম্রাজ্ঞী নূরজাহান’। এ নাটকটা করে আমি যেমন সুখ্যাতি পেয়েছিলাম তেমনি করে মানে আমি নিজে করতে পেরে প্রচণ্ড আনন্দ পেয়েছিলাম। ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে নাটকটা হয়েছিল। ওখানকার এ্যাকোআস্টিক খুব খারাপ ছিল। আমরা সেটা বেশ কিছু টাকা খরচ করে (যার মধ্যে আমার ব্যক্তিগত টাকাও অনেকখানি ছিল)। সারিয়েছিলাম এবং বেশবাস, যাবতীয় সরঞ্জাম যেগুলো প্রয়োজন, বহুদিন ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়ে বই থেকে ডিজাইন নিয়ে ড্রেস তৈরি করিয়েছি, সেট তৈরি করিয়েছি, সুরেশ (দত্ত)৪০ সেট তৈরি করেছিলেন, খুব ভালো হয়েছিল। আমার কিছু কিছু চাহিদা ছিল— সেটাই উনি রূপ দিয়েছিলেন, বড়ো সুন্দর হয়েছিল।
ওই নাটকটা করার পর আমার নিজের প্রতি একটা বিশ্বাস জন্মেছিল যে আমি একজন পরিপূর্ণ পরিচালক হতে পেরেছি। লোককে দেখাতে পারার যোগ্যতা আমি অর্জন করেছি। এছাড়া অভিনেতৃ সংঘের৪১ কিছু কিছু নাটক আমি পরিচালনা করেছি। আমার পরিচালনার ক্ষেত্রে যে-কেউ আমার দলে থাকুন— ছোটো-বড়ো, অভিনয়টা আমি শিখিয়ে নিই। আমি মনে করি একটা প্রকৃষ্ট উপায়, কারণ পরিচালক একটা সুতোয় গাঁথেন মালাটা, ভালো ফুলও ঠিক কোনও জায়গায় দেবেন— সেটা পরিচালকের দায়িত্ব। সে ফুল মানাবে কিনা সেখানে, সেখানে কি অভিনেতার কোনও বক্তব্য থাকবে না, থাকবে, পরিচালকের সঙ্গে যদি তার মতভেদ হয় সে কনভিন্স করবে পরিচালককে যে কেন সে এটা করতে চাইছে এবং কেন সে এটা করতে চাইছে না। গোঁড়ামি না রেখে সেটা মেনে নিতে হয় যদি সত্যি সত্যি সেটা যুক্তিগ্রাহ্য হয়।
আমি যখনই কোনও নাটক করেছি, আমি করিয়েছি এইভাবে। তাতে একটা উপকার হয়েছে। একটা ধারা বজায় থেকেছে এবং পরিচালক হিসেবে আমার সবসময় মনে হয়েছে চরিত্রগুলোকে পড়ানো প্রয়োজন। আমরা যেভাবে প্রফেশনাল থিয়েটার দেখতে অভ্যস্ত তা হল মোটামুটি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে অল্প চলাফেরা। আমি মনে করি মঞ্চে অপ্রয়োজনীয় বলে কিছু নেই। আমি যদি চলি, তার পেছনে একটা কারণ থাকবে, আমাকে বলতে হবে কেন চলছি। আমি যদি না চলি, সেটাও আমাকে বিশ্লেষণ করে বলতে হবে আমি কেন চলছি না। কথা বললে বলতে হবে কেন বলছি, আর না বললে বলতে হবে কেন বলছি না। সবার পেছনে একটা যুক্তি থাকে। আর থাকে বলেই আমার ধারণা ওই ভাবটাকে ফুটিয়ে তুলতে গেলে এর সমন্বয়ের একটা দরকার হয়, তা না হলে প্রকৃত ভাবটাকে দর্শকের মধ্যে চালিত করা যায় না, প্রকাশ করা যায় না। পরিচালক হিসেবে এই পদ্ধতিটাকে আমি ফলো করি। অভিনেতা হিসেবে চরিত্রটাকে ডিসেক্ট করি এবং বিভিন্ন পরিবেশে ফেলে বিভিন্ন চরিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে তার চলাফেরা, কথা বলা, রাগ-অনুরাগ সবকিছুই গড়ে তুলি। মঞ্চ সম্বন্ধে আপাতত এখানে থামি।
এবার চলচ্চিত্রের কথায় আসা যাক। চলচ্চিত্রে প্রথম আমার ছবি ওঠে ‘হালবাংলা’ ছবিতে। সেটা চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ সাল। তখন আমার চার-পাঁচ বছর বয়স। কিন্তু এটা শিল্পী হয়ে শিল্পজগতে আসার কোনও প্রস্তাবনা নয়। আমি যখন স্টার থিয়েটারে বেশ কিছুদিন ধরে অভিনয় করছি, এমন সময় রাজেন চৌধুরী৪২, আমার কাকার বন্ধু ছিলেন, এডিটর যাকে বলা হয়, তিনি আমাকে বললেন যে, ‘অর্ধেন্দু মুখার্জি৪৩ একটা ছবি করছেন, তাতে একটা ছেলের পার্ট আছে, তুই ওনার সঙ্গে দেখা করবি।’
আমি গেলাম দেখা করতে। অর্ধেন্দুদা আমাকে সামান্য কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করলেন, তারপর বললেন যে ‘বাবাকে বলিস আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে।’
বাবার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। কিন্তু পরে জেনেছিলাম যে চরিত্রের জন্য আমি নির্বাচিত হয়েছিলাম, বয়স কম হওয়ার দরুণ আমার পক্ষে সেটা করা সম্ভব নয়। অর্ধেন্দুদা বাবাকে বলেছিলেন, ‘ও চরিত্রটা খুব সুন্দর করে দেখাল। তা আমি ওর জন্যে একটা ছোটো পার্ট লিখে দিই তাহলে, ও কি করবে? আপনার আপত্তি হবে?’ বাবা সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন, ‘কোনও প্রশ্নই ওঠে না। ও শিখুক, আস্তে আস্তে ওর অভিজ্ঞতা হবে।’
সেই ‘সংগ্রাম’ দিয়েই আমার চলচ্চিত্রের হাতেখড়ি। ছবিতে আমি যখন এলাম তখন সেখানে শিখিয়ে দেবার লোক নেই, নিজে নিজেই করতাম।
‘সংগ্রাম’ ছবির ভূমিকাটা ছিল যিনি নায়ক, তিনি একটা ছোটো ছেলেকে চাপা দিয়ে ফেলেছেন। তাই নিয়ে খুব হৈ চৈ। কাছে একটা আশ্রম ছিল, সেখানে উনি গেছেন এবং ওই গাড়িটা ঘিরে গ্রামেরই কতকগুলো ছেলে খালি গা, ইজের পরা, কারো বা গামছা পরা, তার মধ্যে একটি ছেলে গাড়িটির পাদানিতে বসে সবাইকে শেখাচ্ছে যে এ গাড়িটা কী জিনিস। একজন বলল এটা কলের ঘানি, অন্যজন বলল দূর এ গাড়িটা হচ্ছে হাওয়া গাড়ি, এর ভেতরে একটা ভূতকে শেকলে করে বেঁধে রেখেছে, সেটাকে খিদে পেলে টিন টিন তেল খায় আর তেষ্টা পেলে বালতি বালতি জল খায়। আছে তো আছে বেশ আছে, কিন্তু একবার ক্ষেপে গেলে ওই শিবুর মতো মানুষ খুন করবেই করবে। এমন সময় নায়ক ফিরে এসে মোটরের হর্ণটা বাজিয়েছে, তখন দৌড়, দৌড়, দৌড়। এটাই ছিল আমার প্রথম দিনের কাজ, সালটা ছিল ‘৪৪-এর শেষের দিকে। ‘৪৫ সাল নাগাদ আমি একটি নায়কের ভূমিকা পেয়েছিলাম।
কালীপ্রসাদ ঘোষ৪৪ পুরোনো স্টার থিয়েটারের ডিরেকটার ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি স্টার ছেড়ে দেন এবং ছবি করেন। উনি ‘ধাত্রীদেবতা’ বলে ছবিটা করেছিলেন। তাতে ‘শিবনাথ’ নায়কের রোলের জন্যে অনেককে পরীক্ষা করেছিলেন। আমি ছিলাম বত্রিশ নম্বর ক্যান্ডিডেট। আমি তখন স্টারে অভিনয় করছি। আমার নাটক দেখে উনি আমায় পছন্দ করেন এবং আমাকে দিয়ে কিছু কিছু ডায়ালগ বলান এবং শেষ অবধি রোলটা আমিই করেছিলাম। এই সময়ে দেবকীবাবুর৪৫ ছবিতে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। সেটা হচ্ছে ‘চন্দ্রশেখর’৪৬ ডবল ভার্সান। অশোককুমার করেছিলেন বড়ো ‘প্রতাপ’, আমি ছোটো ‘প্রতাপ’।
এরপর থেকে একের পর এক ছবিতে আমি কাজ পেতে শুরু করি এবং কিছু কিছু বেশ ভালো ছবি পেয়েছিলাম যাতে অভিনয় করে আনন্দ পেয়েছি। কিছু কিছু ট্র্যাজিক রোল ছিল যেমন ‘বাঁকালেখা’। একটি জমিদারের ছেলে হঠাৎ একদিন জানতে পারল যে তাদের জমিদারি বিক্রি হয়ে গেছে। সেই রাতে বাবা সুইসাইড করেছেন। কানন দেবী করেছিলেন দিদি, ভাইকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। গান গাইতে পারতেন। রেডিওতে গান গাইবেন ঠিক হয়েছে, এমন সময় সেই বাড়িরই দোতলায় একজন প্রফেসার— যে চরিত্রটা জহর গাঙ্গুলি করেছিলেন— এসে খুব চোটপাট করেন যে ওই বাড়ির মধ্যে চিৎকার করে গান গাওয়া কেন? মেয়েটি জানায় রোজগারের জন্যে তাকে এই পথ বেছে নিতে হয়েছে। একথা শুনে উনি মেয়েটিকে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেন এবং মেয়েটিকে ঘরের চাবি দিয়ে বলেন যে এবার থেকে সব দায়িত্ব ওনার। মেয়েটি বিনম্রভাবেই জানায় যে পায়ে হাত দিয়ে ওনাকে প্রণাম করা যায় কিন্তু কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা যায় না। এই রোলে প্রথম দিকে ছিল খুব হুল্লোড়, কিন্তু শেষের দিকে প্রচণ্ড ট্র্যাজেডি। খুবই ভালো রোল এবং এটাই সম্ভবত আমার সিরিও-কমিক রোলের সূচনা।
তারপর ‘সংকল্প’তে নায়ক হবার সুযোগ এল। এরপর উত্তম এল, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘পথে হল দেরী’ ইত্যাদি ইত্যাদি— উত্তম-সুচিত্রা-অনুপ একটা ব্র্যাকেটের মধ্যে পড়ে গেল। ‘বরযাত্রী’ অবশ্য তার আগে। এটা হবে’৪৮ বা ‘৪৯ সালের ছবি। সত্যেন বোস৪৭ ছিলেন পরিচালক। আমি কিভাবে ডাক পেয়েছিলাম মনে নেই। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি। ফিল্মে বা স্টেজে আমাকে নিজেকে কখনও কাজ চাইতে হয়নি। শুধু একটা ব্যতিক্রম হয়েছে— সেটা পরে বলব। যাহোক, আমাকে ডেকেছে, গেছি। আমাকে গোরাচাঁদের রোলে সিলেক্ট করা হয়। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম ভালো কমেডি বলতে প্রমথেশ বড়ুয়া-র ‘রজত জয়ন্তী’৪৮ ধরা হয়, তার পরবর্তীকালে নিঃসন্দেহে ‘বরযাত্রী’। ‘বরযাত্রী’র পরিচালক সত্যেন বোস ছিলেন খুব রসিক মানুষ। নানারকম রসিকতা আমাদের দিয়ে করাতেন। কিন্তু নিজে দূরে থাকতেন। শুটিংয়ের সময় চারপাশের মানুষেরা বলতেন, এরা সবসময় রসিকতা করে, কাজ কিছু হয় না। কিন্তু খুব ভালো সময়ে কাজ শেষ হয়েছিল। ছবি রিলিজ হতে সবাই ধন্য ধন্য করেছিল। এ ছবিতে আমি খুব সুনাম পেয়েছিলাম এবং এটা ছিল ন্যানশনাল প্রগেসিভ লিমিটেড কোম্পানি।
সুধীর মুখার্জি৪৯ প্রোডাকশান কন্ট্রোলার হিসেবে ওখানে কাজ করতেন। ‘বরযাত্রী’র প্রায় পুরো স্টাফ নিয়ে উনি করলেন ‘পাশের বাড়ি’। ছবিটা দারুণ হিট করল। কিন্তু আমরা যারা অভিনেতা, আর্থিক দিক দিয়ে কিছুই পেলাম না। ‘পাশের বাড়ি’র পর যখন আমরা নিজেরা ভাবলাম প্রোডাকশান করব, তখন করলাম ‘শ্বশুরবাড়ি’। ছবিটা অবশ্য বিশেষ সাফল্য পায়নি। এর পরই টিমটা ভেঙে যায়। এরপর আর এই দুর্বুদ্ধি হয়নি কখনও।
এই যে পরপর কতকগুলো কমেডি ছবি করলাম, তার ফলে কমেডি করার জন্যে আমার কাছে অনেক অফার আসতে লাগল। আমার কাছে তখন অর্থ উপার্জনটা বিশেষ প্রয়োজনীয় ব্যাপার ছিল। অনেক খরচের দায়িত্ব আমার ওপর এসে পড়েছিল কাজেই সিলেক্টেড ছবি করার সুযোগ আমার জীবনে কখনও আসেনি। যদি নিজের ইচ্ছেমতো ছবিতে কাজ করতে পারতাম, তাহলে আমার আজকের পরিচয়টা অন্য এক মাত্রা পেত। হয়ত একটা পরিচিত নায়কের পর্যায়েই থাকতাম। যাই হোক, যখন ওই ছবিগুলো আসতে আরম্ভ করল, করতে লাগলাম। করে করে দেখা গেল যে ওইগুলোই বেশি আসছে। কিন্তু যেহেতু আমার একটা ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল যে আমি সিরিয়াস রোল করেছি, সেই জন্যে কিছু কিছু চরিত্র আসতে শুরু করল যেটাকে সিরিও-কমিক বলা যায়। অর্থাৎ প্রথম দিকের খুব হৈ-হুল্লোড়ে আনন্দ পেল দর্শক, শেষ অধ্যায়ে একটা শ্যাড নোট আচ্ছন্ন করে রাখল। এ ব্যাপারে জহর গাঙ্গুলি খুব দক্ষ ছিলেন। বলা হতো এই রোল উনি খুব ভালো করেন। পরবর্তীকালে ওই সুনাম আমিও পেয়েছি। এ চরিত্রে আমাকে দেখতে দর্শকের খুব ভালো লাগে। আমারও এ রোল করতে খারাপ লাগত না, ভালোই লাগত। কিন্তু তখনও আমি অনেক নায়কের রোল করেছি। একটা সময় এসেছিল, যখন আমি ও সন্ধ্যা নায়ক-নায়িকা হিসেবে অনেকগুলো সিরিয়াস ছবি করেছিলাম।
আমি যখন এম পি৫০-তে গেলাম, পরে উত্তমও এল, তখন একটা ফেজ গেল যে উত্তম-সুচিত্রা-অনুপ। সেখানে আমার হাল্কা ধরনের চরিত্র থাকত। মজাদার চরিত্র, কখনও হয়তো শেষের দিকে একটু সিরিয়াস নোট আসত। যেমন নরেশ মিত্রের পরিচালনায় আমরা ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ করলাম। উত্তম, সাবিত্রী, সুচিত্রা সেন আর আমি ছিলাম। প্রথম দিকে খুব একটা হেলাফেলা ছেলে। পরের দিকে একটা বেদনাহত অবস্থায় এসেছি। ‘রাস্তার ছেলে’ বলে একটা ছবি করেছিলাম। সেটা আবার একেবারেই অন্য ধরনের। সেটা কমেডি বলব না। সিরিয়াস নোট থেকেই অত্যন্ত ট্র্যাজেডি। একটা মার্ডার করে এবং একটা ছোটো ছেলেকে বাঁচাবার জন্যে শেষ পর্যন্ত কোর্টে দাঁড়িয়ে কনফেস করে যে সে-ই মার্ডারার। শুধু একটা না, আরও অনেকগুলো মার্ডার করেছে এইভাবে। শেষে সে কনভিকটেড হয়। এছাড়া সাবিত্রীর সঙ্গেও করেছি কমেডি চরিত্র, হিরো-হিরোইন, যেমন ‘কানামাছি’, ‘কাঁচামিঠে’, ‘শশীবাবুর সংসার’ ইত্যাদি সিরিয়াস ছবি। আবার তারই সঙ্গে করেছি ‘বাঁকালেখা’, ‘বাঁশের কেল্লা’ ইত্যাদি। রাজেন তরফদার৫১ আমাকে খুব পছন্দ করতেন। রাজেনবাবুর তিনটে ছবি আমি করেছি। ‘জীবনকাহিনী’ খুবই ভালো, ‘অগ্নিশিখা’ আর একটা যেন কী ছবি। রাজেনবাবু আমার অভিনয়ের খুব সুখ্যাতি করতেন। এতে চরিত্রটা ছিল সিরিয়াস।
‘মুখুজ্যে পরিবার’ বলে একটা ছবি করেছিলাম। সেটা ছিল— ছেলেটি হাসিখুশি দিয়ে ভরিয়ে রাখার চেষ্টা করত, একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙনটাতে তাতে যদি বাঁচানো যায়। পরে অনেকগুলো ট্র্যাজিক রোল করেছি চিত্তবাবুর৫২ ছবিতে। তারপর একটা সময় এল আমি আর সন্ধ্যা নায়ক-নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করছি। সেটা আমি যদি বজায় রাখতে পারতাম যে অন্য ছবির কাজ নেব না, শুধু ওই নায়ক হিসেবেই কাজগুলো করে যাব তাহলে একটা ভালো জুটি তৈরি হতো। যাই হোক, সে তো করা সম্ভব হল না। এই করতে করতে দেখা গেল যে আমি বেশিরভাগ কমেডি করছি রোলগুলো উতরে যেত। যদিও রোলগুলো নেবার সময় করতে ভালো লাগেনি। কিন্তু যখন অ্যাকসেপ্ট করেছি তখন চরিত্রটা বিশ্বাস করে মনপ্রাণ দিয়ে করেছি। আর একটা ব্যাপার আমি বজায় রাখার বরাবর চেষ্টা করেছি। কমেডির মধ্যে একটা চরিত্র থাকে, সে এই কথা বললে ওইরকম করে বলে, ওই কথা বললে এই রকম করে বলে। কিন্তু একটাই চরিত্র, অনেকের স্বভাব আছে যে ওই তাৎক্ষণিক সিনটা বা ডায়ালগটা ধরে নেয়। কিন্তু আমি চরিত্রটার থ্রু আউট কনটিনিউটি বজায় রাখার চেষ্টা করি। এর ফলে দর্শকের মধ্যে আমার সম্পর্কে একটা আস্থা, বাড়তি ভালো লাগা তৈরি হয়েছে।
আগে আমি বলেছি যে একটা ব্যতিক্রম ছাড়া কখনওই কোন রোলের কথা কাউকে বলিনি। ষাটের দশক, কি তারও আগে ‘৫৮ সাল হবে, বোধহয় শ্রীমতী পিকচার্সের ‘দেবত্র’ বলে একটা ছবিতে আমি অভিনয় করেছিলাম। পরিচালক ছিলেন হরিদাস ভট্টাচার্য৫৩। সেখানে ওই ইউনিটের ফার্স্ট অ্যাসিসটেন্ট দিলীপ মুখার্জী৫৪, সেকেন্ড অ্যাসিসটেন্ট শচীনবাবু৫৫ এবং থার্ড অ্যাসিসটেন্ট ছিলেন তরুণ মজুমদার। তনুবাবু আমার চেয়ে এক বছরের ছোটো হলেও আমি ওকে দাদা বলে ডাকি। ওখানে কাজ করতে গিয়ে ওঁর সঙ্গে আমার ভীষণ একটা প্রীতির সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। তবে তনুদার মধ্যে কোথায় একটা মিষ্টি গাম্ভীর্য ছিল ফলে ‘তুই’ সম্পর্কটা হয়নি। কিন্তু পরিচালক-অভিনেতার মধ্যে এত আন্ডারস্ট্যানডিং আর কোনও পরিচালক এবং শিল্পীর মধ্যে আছে কিনা আমার জানা নেই। এমন বহুদিন ঘটেছে যে আমি কাজ করতে গেছি, আমি একটা সিন করছি— দূর থেকে তনুদা বলছে ‘অনুপ’, আমি বললাম, হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি, দ্যাখো আমি করছি। আবার আমি যখন জিজ্ঞেস করতে গেছি, তনুদা বলল, হ্যাঁ, ঠিক আছে করো দেখছি। ওর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি— হয়ত কিছু বলতে এল, যখন সেটা আমি করে দেখালাম— বলল, না, না, তুমি তোমার মতো করো। পরবর্তী সময়ে আমায় ও বলেছিল যে তোমাকে বাঁধা ঠিক নয়। তুমি তোমার নিজের মতো করো। সেটাই ঠিক। এইরকম আমাদের মধ্যে একটা বিশ্বাস, আস্থা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা জন্মেছে, দারুণ প্রীতি ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক চলে আসছে।
একসময় যখন আমার মনে হচ্ছে শিল্পী হিসেবে আমি মরে যাচ্ছি, মাথার উপরে দু’হাত পরিমাণ জল, নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, বেরোতে চাইছি বদ্ধ জায়গা থেকে কিন্তু কাউকে তা বলতে পারছি না— সেইসময় একদিন আমি শুটিং করে আসছি, দেখি ওদের অফিসঘরে ও একা বসে আছে। আমি যেতে বলল ‘কী শুটিং চলছে’?
আমি বললাম— ‘হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে। আমি শটটা দিয়ে আসছি, তুমি একটু অপেক্ষা করো।’ বললে— ‘ঠিক আছে তুমি এসো।’
আমি কাজ শেষ করে এসে ওর ঘরে বসে বলতে শুরু করলাম যে, ‘দ্যাখো, আমার প্রবলেম হয়েছে যে আমি অনুপকুমার হয়ে গেছি। কারও কাছে গিয়ে আমি কাজ চাইতে পারি না। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি মারা যাচ্ছি। আমার মনে হয়েছে তোমাকে বলা যায় তাই বলছি— তুমি আমাকে এর থেকে বাঁচাতে পারো। আমার এই স্ট্যাম্পটা মুছে দাও। ছোটো রোল হোক, তবু যে-কোনো একটা রোল দাও যেখানে ওই হাসানোর কোনও দায়িত্ব থাকবে না। যেমন, নায়কের বন্ধু, এসে কোনও ইনফরমেশন দিলাম— দু’দিনের কাজ।’
তনুদা অনেকক্ষণ ধরে শুনল। শুনে হঠাৎ বলল, ‘তুমি করবে ছোটো পার্ট হলে?
আমি বললাম’, তাহলে এতক্ষণ ধরে কী বললাম। বললে— ‘আমি এর পরে যে ছবিটা ভেবেছি তাতে দু’দিনের একটা রোল আছে। হাসাতে হবে না। কিছুটা কাজ আছে।’
আমি রাজি হয়ে গেলাম। কিছুদিন বাদে ও আমাকে টেলিফোন করে বাড়িতে থাকতে বলল। কিছুক্ষণের মধ্যে এল, বললে, ‘তোমাকে একটা স্ক্রিপ্ট শোনাতে এলাম—’ বলে ‘পলাতক’ স্ক্রিপটা পড়ে শোনালো। ও ভারী সুন্দর স্ক্রিপ্ট পড়ে। যেখানে যেখানে গান আছে যেগুলো ও নিজে লিখেছে সেগুলো নিজের মতো সুর করে শোনালো। পরিচালকদের মধ্যে এত ভালো রবীন্দ্রসংগীতের কালেকশান আমি আর কারুর দেখিনি।
যাই হোক, ও পুরোটা শোনালো। শোনবার পর অনেকক্ষণ আমি কথা বলতে পারিনি। কেমন লাগল জিজ্ঞেস করাতে আমি বললাম, ‘এর উত্তর দিতে গেলে কী উত্তর দেব। তুমিও জানো, আমিও জানি যে এক কথায় এর উত্তর দেওয়া যাবে না।’
হেসে বলল, ‘কোন রোলটা তুমি করতে চাও?’ ‘আমি বললাম,’ যে রোলটাই দেবে। বললে— ‘যদি তোমাকে বসন্ত করতে বলি?’
আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম— ‘তুমি খুব কষ্ট দিচ্ছো আমাকে।’
ও বলল— ‘না, আই হ্যাভ ডিসাইডেড, ওই রোলটাই তুমি করবে। এটা তোমার সঙ্গে আমার ফাইনাল কথা হয়ে রইল। আর একটা কথা— আমি না বলা পর্যন্ত তুমি একথা বোলো না।’
তারপর এর একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। আমি নাকচ হয়ে গিয়েছিলাম। ওই ছবিটা এখানকার কোনও প্রোডিউসারেরা করেননি। পরে শান্তারাম একটা বাংলা ছবি করতে চেয়েছিলেন। তনুদার সঙ্গে ওনার যোগাযোগ হয়, উনি স্ক্রিপ্ট শোনেন এবং এই ছবির প্রোডিউসার হতে রাজি হয়ে যান। এই প্রসঙ্গে তনুদা শান্তারামকে জানান যে এ ছবির হিরো হিসেবে যাকে নির্বাচিত করেছেন, তার কিন্তু হিরোর রোলে সেরকম পরিচিতি নেই। শান্তারাম বললেন যে, তনুবাবুর প্রতি তাঁর সম্পূর্ণ আস্থা আছে। তিনি যেন কাজটা আরম্ভ করে দেন। এই কাজটা বম্বেতে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কলকাতাতেই এর শুটিং হয়।
যাই হোক, ‘পলাতক’ ছবিতেই আমার একটা উত্তরণ হয়, একজন নতুন ‘অনুপকুমার’ তৈরি হয়। তারপরে অবশ্য আমি ওঁর কাছেই আরও ভালো ছবির কাজ পেয়েছি।
আমার প্রিয় ছবিগুলির মধ্যে ‘গণদেবতা’, ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’, ‘শত্রু’, ‘নিষ্কৃতি’, ‘উত্তরপুরুষ’, ‘ডাক দিয়ে যাই’ ইত্যাদি। ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’তে আমার চরিত্রটা আমার নিজের খুব ভালো লাগে। দীর্ঘদিন ধরে অনুপকুমারকে যেভাবে দর্শক দেখে আসছে তার বিন্দুমাত্র ছায়াও তার মধ্যে নেই। ওই যে সদানন্দ— আপন ভোলা একটা মানুষ। তার মধ্যে গভীরতা আছে, বেদনাবোধ আছে। তার নিজের জীবনে একটা ব্যথা আছে— এ সবকিছুই এই চরিত্রে আমি ফোটাতে চেষ্টা করেছি। এসব ছবিতে কাজ করে ব্যক্তিগতভাবে আমার খুব ভালো লেগেছে।
আমার শিল্পীজীবনের পঞ্চাশ বছর পার হল। এখনও আমি থামব না, থেমে যেতে পারি না। আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় যদি কিছু থাকে সেটা হচ্ছে আমার এই অভিনয়শিল্প। আমি এমনিতে মেজাজে গল্প করতে ভালোবাসি, কিন্তু গল্প করতে করতেও সেই ঘুরে-ফিরে অভিনয়ের প্রসঙ্গে চলে আসি। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো চাওয়া। আমার ভবিষ্যৎ একটা কর্মসূচি মনে মনে ভেবে রেখেছি। শিল্পী হিসেবে আমার একটা পরিচিতি মোটামুটি হয়েছে। হয়ত আরও কিছু ভালো রোল পাবার আশা করব, বুদ্ধিজীবী মানুষ যা দেখে খুশি হবেন। তাদের খুশি করার মতো সামর্থ্য আছে বলে আমার মনে বিশ্বাস আছে। আর একটা কাজ করতে চাই— সেটা হচ্ছে অভিনয় শেখানোর একটা ইনস্টিটিউশন, যেখানে আমি আমার নিজের ধারায় অভিনয় শেখাবো। এত দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় আমি যা সঞ্চয় করেছি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তা দিয়ে যেতে চাই। জানি না ঠিক কতখানি আমি জানি, তবে যতটুকু জানি ততটুকু দিয়ে যাবার একটা দায়িত্ব অনুভব করি। আর শিক্ষক হিসেবে আমার নিজের ওপর যথেষ্ট আস্থা আছে। আমি খুব ভালো শেখাতে পারি। কিভাবে বললে ছাত্র বুঝবে— সেটার একটা আমার নিজস্ব ধারা আছে। যতদিন না আমি অক্ষম হব, ততদিন এই অভিনয় জগৎ থেকে সরব না, কোনও মূল্যেই না।
স্টার থিয়েটারে যখন কাজ করছি তখন আমি পথ খুঁজেছি— একজন শিল্পী কিভাবে তার শিল্প সৃষ্টি করবে, তার রাস্তা কী? কিছু কিছু জানতে পেরেছি, বেশিটাই অন্ধকারে। সেইসঙ্গে আর একটা প্রশ্নও আমার মাথায় এসেছিল যে শিল্পীদের কী শুধু অভিনয় করাটুকুই কর্তব্য? অভিনয় ছাড়া কি তার নিজস্ব কিছু দেবার আছে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে? একসময় আমি গণনাট্যের৫৬ সংস্পর্শে আসি। তখন পর্যন্ত গণনাট্য সম্পর্কে আমি খুব বেশি ওয়াকিবহাল ছিলাম না। ‘নবান্ন’৫৭ নাটকটা পুরোটা দেখার সুযোগ আমার হয়নি। নবান্নর পরে গণনাট্যের চেতনা অনেকের মনের মধ্যেই এসেছিল। গণনাট্য সংঘের কার্যকলাপ কী? কী উদ্দেশ্য? এবং মনে হয়েছিল এটা সঠিক, এটাই আসল দিক। এর আগে আমি একজন পেশাদার শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেছি। কাজেই গ্রুপ থিয়েটারে কোথায় কী অভিনয় হচ্ছে সে খবর রাখা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। প্রথম এই ব্যাপারে আমাকে একটা নাড়া দিয়েছিলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়৫৮।
আমি তখন স্টারে নাটক করছি,’ ৪৬ সাল নাগাদ হবে। দেশপ্রিয় পার্কে কালীদার একটা ক্লাবের সঙ্গে তখন যুক্ত হই। সেখানে উনি কম্যুনিজমের প্রতি আমাকে উৎসাহিত করতে চেষ্টা করতেন। সেই থেকে কিরকম মনে হল— আচ্ছা ব্যাপারটা জানা যাক না। তারপর মৃণালবাবুর সূত্র দিয়ে তাপস সেন৫৯ ইত্যাদির সংস্পর্শে আসি এবং তাদের মুখে গণনাট্যের কথা, এদের নাটকের কথা শুনতাম এবং আমরা যখন উত্তরপাড়ায় গেলাম সেখানে কিছু বন্ধুকে পেয়ে আমার মনে হল এদের, বাম ধারায় নিয়ে আসতে আমরাও কিছু ভালো নাটক করতে পারি, যে নাটক করার সুযোগ আমার প্রফেশনাল বোর্ডে হবে না। তখন সেখানে আমরা ‘ভদ্রকালী নাট্যচক্র’ নাম দিয়ে একটা নাট্য সংগঠন তৈরি করি। সেখানে মাঝে মাঝে মৃণালবাবু, তাপসবাবুরা আসতেন। আমার বোন গীতা৬০ তো একজন প্রধান শিল্পী হিসেবেই ছিল, আমি পরিচালক। তখন আমি পেশাতে খুব বেশি জড়িয়ে থাকতাম বলে হয়তো সব নাটকে অংশগ্রহণ করতে পারতাম না। কোনও কোনও সময় করেছি, আবার সেই চরিত্রে অন্যজনও করেছে। আমাদের ওই হুগলি জেলাতে ঘুরে ঘুরে কৃষক সম্মেলন বা ওই ধরনের ব্যাপারগুলো কভার করার একটা ব্যাপার ছিল। এটা ছিল গণনাট্যের অনুমোদিত। সেটা আমরা করেছিলাম। সেই সময়ে গণনাট্যের যত কাছে এসেছি তত যেন আমার মনে হতে শুরু করেছে, বুঝতে শিখছি যে প্রকৃত নাটক কী এবং একজন শিল্পী হিসেবে রাজনীতির বাইরে থেকে কিছু করলে সেটা সম্পূর্ণ হবে বলে আমার বিশ্বাস ছিল না। রাজনীতির বাইরে থেকে মানুষ বাঁচতে পারে না। আমি কোন নীতিকে বিশ্বাস করব তা বেছে নেবার অধিকার আমার নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু আমি জীবন কাটাব অথচ রাজনীতির ধার ধারবো না— এটা পালিয়ে থাকা মানুষ ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়। একেবারেই যারা নিজের দিক ছাড়া কিছু দেখেন না, তারা ছাড়া যে-কোনও সাধারণ মানুষের পক্ষে রাজনীতির আওতার বাইরে যাওয়া যায় না। একেবারে সারাদিন রাজনীতির মধ্যে ডুবে থাকব, রাজনীতিকে পেশা ও নেশা করব— এটা ছাড়াও তো রাজনীতির মধ্যে থাকা যায়। আমি যখন থেকে জেনেছিলাম যে শিল্পীর সব থেকে বড়ো হাতিয়ার তার নাটক, নাটকের মধ্যেই তার একটা রাজনৈতিক আদর্শ থাকবে, সেটাকে সে প্রতিফলিত করবে নাটকের মধ্যে দিয়ে— তাহলে তার সামাজিক দায়বদ্ধতার কিছুটা পূরণ করা সম্ভব হবে। সমাজের কাছ থেকে শুধু নেব, কিছু দেব না— এটা সম্ভব নয়। সে সময় আমার মার্কসীয় মতবাদে একটা বিশ্বাস জন্মেছিল এবং আমার যৎসামান্য পড়াশুনার মধ্যে দিয়ে এবং মার্কসবাদী মানুষগুলোর সংস্পর্শে এসে ধীরে ধীরে আমার স্থির বিশ্বাস এসেছিল যে এটাই সঠিক পথ। প্রথম দিকে অল্পস্বল্প কাজ করতাম, পরবর্তীকালে আরও ঘনিষ্ঠভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি।
আমার বামফ্রন্টের প্রতি আনুগত্য এবং ইলেকশানে পথনাটিকা, প্রচার নাটিকা করা, বক্তৃতা করা, সবকিছুর মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে আমি একটা জায়গায় পৌঁছে গেছি। আমার পরিচিতিটা এখন ভীষণই প্রকাশ্যে এসে গেছে যে আমি বাম ধারায় বিশ্বাসী এবং এর জন্যে অবসর মুহূর্তকেও আমি কাজে লাগাই। এর বাইরে আমি থাকতে পারি না। আমি স্ত্রী হিসেবে পেয়েছি অলকা৬১কে। অলকার মধ্যেও দেখেছি এই বাম চেতনাটাই কাজ করে। আমরা গত কয়েক বছর ধরে একসঙ্গে ইলেকশানের কাজ করেছি। সেখানে পথনাটিকা, শ্রুতিনাটক করেছি, বক্তৃতা করেছি এবং এক একদিনে তিন চার জায়গায়। ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে। সেটা করার মধ্যেও একটা অসীম আনন্দ। যেন মনে হয় একটা ঋণ শোধ করছি। যে ঋণ আমি দু’হাত পেতে নিয়েছি সমাজের থেকে, মানুষের কাছ থেকে। তার কিছুটা অন্তত পরিশোধ করার প্রচেষ্টা আমার আছে— মানুষকে আমি বোধহয় তা বোঝাতে পেরেছি।
*আসলে পংক্তিটি হবে :
‘ভূধর সাগরে বিজন নগরে যখন যেখানে ভ্রমি
তবু নিশিদিন ভুলিতে পারিনে সেই দুইবিঘা জমি।
হাটে মাঠে বাটে এই মতো কাটে বছর পনেরো ষোলো
একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়োই বাসনা হল।’
টীকা
১. শ্রীমতী পিকচার্স— কানন দেবী প্রতিষ্ঠিত একটি চিত্র-প্রযোজক সংস্থা। এই সংস্থা প্রযোজিত প্রথম ছবি ‘অনন্যা’ (১৯৪৯)। কৃষ্ণচন্দ্র দে ‘রাধে’ বলে ডাকতেন কানন দেবীকে, আর কালী ফিল্মসের প্রিয়নাথ গাঙ্গুলি তাঁকে বলতেন ‘শ্রীমতী’। এইসবের প্রভাবেই কানন দেবী সংস্থার নামকরণ করেন ‘শ্রীমতী পিকচার্স’। প্রথম ছবি ‘অনন্যা’-র পরিচালক ছিলেন সব্যসাচী গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীতে ছিলেন তিনজন— কানন দেবী, অজয় কর (ক্যামেরাম্যান) ও বিনয় চট্টোপাধ্যায় (চিত্রনাট্যকার)। কয়েকটি পরের ছবি থেকে পরিচালক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন, কানন দেবীর স্বামী হরিদাস ভট্টাচার্য।
২. ‘আংটি চাটুজ্যের ভাই’— মনোজ বসু রচিত উপন্যাস। এই কাহিনির উপর ভিত্তি করেই তৈরি হয় ‘পলাতক’ ছবিটি।
৩. ভি. শান্তারাম— ১৯০১ সালে জন্ম মুম্বইয়ের হিন্দি ছবির জগতের এই স্বনামধন্য চিত্রপরিচালকের। ১৯২৬ সালে প্রথম নির্বাক ছবি ‘নেতাজি পলাকর’-এর প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন। সবাক যুগে প্রথম ছবি— ‘অমরজ্যোতি’। এরপর, ‘দুনিয়া না মানে’, ‘দহেজ’, ‘ডাঃ কোটনীশ’, ‘শকুন্তলা’, ‘অমর ভূপালি’, ‘সুবহ কা তারা’, ‘নবরঙ’, ‘তিন বাত্তি চার রাস্তা’, ‘ঝনক ঝনক পায়েল বাজে’ প্রভৃতি অনেক জনপ্রিয় ছবি প্রয়োজনা ও পরিচালনা করেন। ‘রাজকমল স্টুডিও অ্যান্ড পিকচার্স’-এর মালিক ছিলেন ভি. শান্তারাম। বর্তমানে প্রয়াত।
৪. বাবা (ধীরেন দাস)— (১৯০৩-১৯৬১) : পুরো নাম ধীরেন্দ্রনাথ দাস। বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র থাকার সময় ওই কলেজের অধ্যাপক শিশিরকুমার ভাদুড়ীর সংস্পর্শে এসে অভিনয়ের নেশা ঢুকলো মনে। অসাধারণ গান গাইতে পারতেন। ১৯২৬ সালে ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে শিশিরকুমারের নাট্যদলে যোগ দেন ধীরেন দাস। গান শিখেছেন রাধিকাপ্রাসাদ গোস্বামী, সাতকড়ি মালাকার, জ্যোর্তিপ্রসাদ প্রমুখ গুণীজনের কাছে। ‘ঋষির প্রেম’, ‘যমুনা পুলিতে’, ‘বেকার নাশন’, ‘বড়দিদি’, ‘হালবাংলা’, ‘মায়ের প্রাণ’, ‘প্রিয়তমা’ ইত্যাদি চলচ্চিত্র অন্যদিকে ‘সীতা’, ‘পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস’, ‘কেদার রায়’, ‘প্রফুল্ল’, ‘কবি কালিদাস’, ‘টিপু সুলতান’, ‘শ্যামলীর স্বপ্ন’ প্রভৃতি নাটকে সুনামের সঙ্গে অভিনয় করেন। সংগীত পরিচালনাও করেছেন চলচ্চিত্রে ও নাটকে। গ্রামোফোন রেকর্ডে অজস্র গান গেয়েছেন ধীরেন দাস। কাজী নজরুলের গানের ভাণ্ডারী ছিলেন এবং কাজীসাহেব তাঁকে অসম্ভব স্নেহ করতেন। হীরেন বসুরও সহকারী ছিলেন। হীরেনবাবুর কথায় ও সুরে ধীরেন দাসের গাওয়া ‘আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও…’, আজও জনপ্রিয়। HMV-র ট্রেনার হিসেবেও কাজ করেছেন। শ্রীযুক্ত ধীরেন্দ্রনাথ দাসেরই সুযোগ্য পুত্র হলেন অনুপকুমার।
৫. নবদ্বীপ হালদার— ১৯১১ সালে বর্ধমান জেলার শোনপলাশী গ্রামে জন্ম এই অসামান্য কৌতুকাভিনেতার। ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের কর্মী ছিলেন। এরপর দেবকীর বসুর ডোমিনিয়ন ফিল্ম কোম্পানির ‘পঞ্চশর’ ছবিতে প্রথম সুযোগ পেলেন ১৯৩০ সালে। ১৯৩৬ সালে ওই দেবকীবাবুই নবদ্বীপ হালদারকে সুযোগ দিলেন ‘সোনার সংসার’ ছবিতে। এরপর ‘অভিসারিকা’, ‘মানে না মানা’, ‘কালোছায়া’, ‘গ্রহের ফের’, ‘হানাবাড়ি’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘মানিকজোড়’ ইত্যাদি অজস্র ছবিতে অভিনয় করেছেন। তবে, নবদ্বীপ হালদার আজও যে কারণে মানুষের মনে বিরাজ করছেন, তা হল রেকর্ডে পরিবেশিত হাস্যকৌতুক নকশাগুলির জন্যে। ‘পাঁঠার গরম’, ‘কাপড়ে আগুন’, ‘রসগোল্লায় ইঁদুর’, ‘যাত্রার বায়না’, ‘যাত্রা-বিভ্রাট’ ইত্যাদি কিছু উল্লেখযোগ্য নবদ্বীপ হালদার পরিবেশিত কৌতুকনকশা।
৬. প্রফেসার বিমল দাশগুপ্ত— এক অদ্ভুত প্রতিভা। একাধারে মিউজিসিয়ান, ম্যাজিসিয়ান, কমেডিয়ান। HMV-র ‘টুইন’ বিভাগের ট্রেনার ছিলেন। সারা ভারত ঘুরে ম্যাজিক দেখাতেন। ‘প্রো.বিমল গুপ্ত’ নামে রেকর্ডে অনেক হাসির গান, প্রহসন ইত্যাদি পরিবেশন করেছেন। প্রখ্যাত সুরকার কমল দাশগুপ্ত ও সুবল দাশগুপ্ত এনারই আপন ভাই। এঁদেরই ছোটো বোন সুধীরা দাশগুপ্ত-ও একজন ভালো কণ্ঠশিল্পী ছিলেন। বিমলবাবুর শিক্ষায় ও উৎসাহেই কমল দাশগুপ্তরা গড়ে উঠেছেন। বিমল দাশগুপ্ত-র সুরে তৎকালীন অনেক শিল্পী রেকর্ডে গেয়েছেন।
৭. ধীরেন গাঙ্গুলি (১৮৯৩-১৯৭৮)— এক বহুমুখী প্রতিভাধর। একাধারে অভিনেতা-পরিচালক-প্রযোজক-সংগীত পরিচালক-অঙ্কনশিল্পী-কণ্ঠশিল্পী। বাংলা পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রের জনক। ‘ডি.জি’ নামে বিখ্যাত। প্রথম জীবনে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের কাছে গান, আঁকা, বাজনা শিখেছেন। ওখানে থাকার সময় ‘বাল্মিকী প্রতিভা’য় ‘মায়া’ (মহিলা চরিত্র)-র চরিত্রে অভিনয় করেন। রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন ‘বাল্মীকি’-র চরিত্র। ধীরেন গাঙ্গুলি ‘ম্যাডান’ কোম্পানির নীতীশ লাহিড়িদের সঙ্গে ‘ইন্দো ব্রিটিশ ফিল্ম কোং’ নামে স্টুডিয়ো খোলেন। এরাই তৈরি করে ‘বিলেত ফেরত’ ছবি (‘ডিজি’ পরিচালিত), যা রসা থিয়েটারে (বর্তমান ‘পূর্ণ’ সিনেমা) ১৯২১ সালের ২৬ জানুয়ারি মুক্তি পায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘অলীকবাবু’ নাটকে প্রায় ১০০ রজনী অভিনয় করেন ধীরেন্দ্রনাথ।
৮. কালী ফিল্মস— এই চিত্র প্রযোজনার সংস্থাটি গড়ে তোলেন প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ১৯৩৫ সালে বর্তমানে যেখানে টেকনিসিয়ান স্টুডিও, সেখানে প্রিয়নাথবাবু অক্লান্ত পরিশ্রম করে গড়ে তোলেন ‘ইন্ডিয়ান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রীজ’। পরে এর নাম পালটে হয় ‘কালী ফিল্মস’। প্রিয়নাথবাবুর ছেলে কালীধন গাঙ্গুলির অকাল প্রয়াণের পর, তাঁর নামে প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়। এই প্রতিষ্ঠান তৈরির আগে প্রিয়নাথবাবু যুক্ত ছিলেন বিখ্যাত চিত্র-প্রতিষ্ঠান ‘ম্যাডান কোম্পানি’-র সঙ্গে। কালী ফিল্মসের ব্যানারে নির্মিত অনেক জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য— ‘সাবিত্রী’ (বাংলা ও তামিল), ‘বিল্বমঙ্গল’, ‘টকী অব টকীজ’, ‘কালপরিণয়’, ‘রেশমি রুমাল’, ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’, মডার্ন লেডি (হিন্দি)’, ‘আশিয়ানা’, ‘সীতার বিরহ’ (ওড়িয়া), ‘আমিনা (উর্দু), গুল বকাওয়ালি (গুজরাটি) ইত্যাদি।
৯. মহেন্দ্র গুপ্ত (১৯১০-১৯৮৪)— বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্ম। প্রখ্যাত নাট্যকার-পরিচালক-অভিনেতা। ইতিহাসে এম.এ পাশ করে কলেজে অধ্যাপনা করেন এবং এইসময় থেকেই নাটক লিখতে শুরু করেন। ১৯৩৭ সালে এনার লেখা নাটক প্রথম অভিনীত হয় মিনার্ভা থিয়েটারে। ১৯৪০ সালে প্রথম নাট্য পরিচালক হিসেবে স্টার থিয়েটারে যোগ দেন। নিজের লেখা নাটকের মধ্যে ‘টিপু সুলতান’, ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’, ‘মহারাজা নন্দকুমার’ ইত্যাদি জনপ্রিয় নাটকের তিনিই ছিলেন পরিচালক। শেষোক্ত নাটকটির জন্য তিনি কারাবাস করেন। ১৯৪৭ সালে ‘সপ্তপর্ণ’ নামে নিজে নাটকের দল গড়ে জেলায় জেলায় নাটক করে বেড়ান। যাত্রাও করেছেন। শেষজীবনে আবার, দীর্ঘদিন স্টার থিয়েটারে নিজেকে যুক্ত রাখেন। পূর্বোল্লিখিত নাটকগুলির ছাড়াও, ‘শতবর্ষ আগে’, ‘মাইকেল মধুসূদন’, ‘অভিযান’, ‘উত্তরা’ ইত্যাদি মহেন্দ্র গুপ্ত রচিত কিছু উল্লেখযোগ্য নাটক।
১০. বিপিন গুপ্ত (১৯০৫-১৯৮১)— প্রখ্যাত নাট্য ও চিত্রাভিনেতা। মীরাটে জন্ম। বেশ কিছুদিন এখানেই কাটে তাঁর। পরে ব্যারাকপুরের পৈতৃক বাড়িতে এসে ওঠেন। অভিনয় করার দিকে বরাবরই ঝোঁক ছিল। পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে স্ট্র্যান্ড রোডে বি. দাস অ্যান্ড কোম্পানিতে কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন বিপিন গুপ্ত। এই কোম্পানি থিয়েটার ও সিনেমায় সাজপোশাক ও রূপসজ্জা সরবরাহের কাজ করতেন। কোম্পানির হয়ে মালপত্র নিয়ে বিপিন গুপ্ত একবার একটি উর্দু ছবির শুটিংস্থল আগ্রায় যান। ছবিটির নাম ছিল ‘নূরী’। নায়কের চরিত্রাভিনেতা হঠাৎ অনুপস্থিত হওয়ায় প্রযোজকের অনুরোধে বিপিন গুপ্ত নায়ক চরিত্রে রূপদান করেন। এইভাবে শুরু। ১৯৪৩ সালে স্টার থিয়েটারে যোগ দেন বিপিনবাবু। প্রথম মঞ্চে ওঠেন ‘মহারাজা নন্দকুমার’ নাটকে ‘মীরকাশিম’ চরিত্রে। এরপর, ‘দেবী চৌধুরানী’, ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কেদার রায়’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘মিশরকুমারী’, ‘ঝাঁসির রাণী’ ইত্যাদি আরও অনেক নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৪৬-৪৭ সালে মুম্বই চলচ্চিত্রজগতে গিয়ে ‘বৈজু বাওরা’, ‘নাগপঞ্চমী’, ‘শ্বশুরাল’, ‘সৌতেলা ভাই’, ‘খিলোনা’, ‘জীবনমৃত্যু’, ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ ইত্যাদি আরও বেশ কিছু হিন্দি ছবিতে অভিনয় ও ‘ডালমে কালা’ (হিন্দ-১৯৬৪) ছবিটি অভিনয়সহ প্রযোজনা করেন বিপিন গুপ্ত। বিপিন গুপ্ত অভিনীত বাংলা ছবির মধ্যে ‘গোরা’, ‘অনন্যা’, ‘পরিচয়’, ‘সমাপিকা’, ‘অঞ্জনগড়’, ‘লুকোচুরি’, ‘লব-কুশ’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
১১. ‘কেদার রায়’— রমেশ গোস্বামীর লেখা এককালের অত্যন্ত জনপ্রিয় নাটক ‘কেদার রায়’। নাটকটি প্রথম অভিনীত হয় ১৯৩৬ সালের ৪ এপ্রিল, রঙমহলে। এরপর, বহুদিন ধরে অনেক জায়গায় নাটকটি অভিনীত হয়।
১২. ‘শ্রীরামচন্দ্র’— অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের লেখা একসময়ের জনপ্রিয় নাটক ‘শ্রীরামচন্দ্র’। অপরেশবাবু ‘আর্ট থিয়েটার’ যখন ১৯২৭ সালে ‘মনোমোহন থিয়েটার’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সেই রঙ্গমঞ্চে ১৯২৭ সালের ১ জুলাই মঞ্চস্থ হয়— ‘শ্রীরামচন্দ্র’। পরবর্তীকালে, অনেক নাট্যব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে মঞ্চস্থ করেছেন এই নাটক।
১৩. সিধু গাঙ্গুলি (১৯১১-১৯৫৭)— এককালের নামী নাট্যাভিনেতা। চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। উজ্জ্বল গৌরবর্ণের অধিকারী ও শ্রুতিমধুর কণ্ঠস্বরসম্পন্ন ছিলেন। ১৯৩৮ সালের ৭ অগস্ট চিৎপুরে নতুন বাজারের কাছে (বর্তমান রবীন্দ্রসরণীর ওপর) ‘রঙ্গমহল’ (রঙমহল নয়) থিয়েটারে মহেন্দ্র গুপ্ত-র ‘উত্তরা’ নাটকে ‘শ্রীকৃষ্ণ’ চরিত্রে প্রথম মঞ্চে অবতীর্ণ হন সিধু গঙ্গোপাধ্যায়। এরপর, রঙ্গমহল, নাট্যনিকেতন, রঙমহল (বিধান সরণী), স্টার, মিনার্ভা প্রভৃতি রঙ্গমঞ্চে বিভিন্ন সময়ে সিধুবাবু তাঁর অভিনয়ের সাক্ষ্য রাখেন, ‘মীরকাশিম’, ‘পথের দাবী’, ‘মাটির ঘর’, ‘বিশ বছর আগে’, ‘রাণী ভবানী’, ‘অলকানন্দা’, ‘রাণী দুর্গাবতী’, ‘মহারাজা নন্দকুমার’, ‘টিপু সুলতান’, ‘পিতা পুত্র’ ইত্যাদি জনপ্রিয় নাটকে। নৈহাটির বাসিন্দা এই সুদর্শন অভিনেতাকে মঞ্চে দেখে তৎকালীন দশর্কদের প্রখ্যাত দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ে যেতো। কয়েকটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন সিধু গঙ্গোপাধ্যায়।
১৪. সন্তোষ সিংহ (১৮৯৯-১৯৮২)— এক শক্তিশালী নাট্য ও চিত্রাভিনেতা। একইসঙ্গে একজন ভালো অভিনয়শিক্ষক। ‘আর্য নাট্যসমাজ’ কর্তৃক অভিনীত ‘মেবার পতন’ নাটকে প্রথম মঞ্চাবতরণ। এরপর কিছুদিন মার্কেন্টাইল ব্যাঙ্কে চাকরি করে, শিশির ভাদুড়ির আর্ট থিয়েটারে যোগ দিয়ে প্রথম অভিনয় করলেন ‘কর্ণার্জুন’ নাটকে। এরপর, বিভিন্ন মঞ্চে ‘চণ্ডীদাস’, ‘মা’, ‘চিরকুমার সভা’, ‘অভিষেক’ ইত্যাদি অজস্র নাটকে তিনি অভিনয় করেন। তাঁর প্রথম চিত্রাবতরণ ১৯২৭ সালে ‘কৃষ্ণসখা’ (নির্বাক) ছবিতে। সবাক ছবি ‘যমুনা পুলিনে’-তে অভিনয় করলেন। এরপর, কয়েকদশক জুড়ে ‘ব্যবধান’, ‘নিমাই সন্ন্যাস’, ‘গরমিল’, ‘সার্বজনীন বিবাহ উৎসব’ ইত্যাদি অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন সন্তোষবাবু। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ (১৯৭৭) ছবিটিই সন্তোষ সিংহ অভিনীত শেষ ছবি। প্রসঙ্গত, মহানায়ক উত্তমকুমার তাঁর অভিনয় শিক্ষার গুরু হিসেবে মানতেন সন্তোষ সিংহকে।
১৫. রবি রায় (১৮৯৫-১৯৫৬)— পুরো নাম রবীন্দ্রমোহন রায়। বর্তমান বাংলাদেশের রংপুর জেলার কাকিনা গ্রামে জন্ম। কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে (তখন মেট্রোপলিটান অ্যাসেমব্লিজ) পড়াকালীন শিশিরকুমারের নজরে পড়েন এবং অভিনয়ের সুযোগ হিসেবে রবি রায় অভিনয় করলেন নির্বাক ছবি ‘কমলেকামিনী’ ও ‘আলমগীর’ নাটকে। এ নজির হয়তো বিরল। এরপর, সেই ‘চন্দ্রগুপ্ত’ থেকে শুরু করে, পরবর্তীকালে ‘শ্যামলী’ পর্যন্ত অজস্র নাটকে রবি রায়কে মঞ্চে দেখা গেছে। সবাক ছবিতে প্রথম অবতরণ ‘শ্রীগৌরাঙ্গ’ (১৯৩৩) ছবিতে। এরপর, ‘হরিভক্তি’ (হিন্দি), ‘শচীদুলাল’, ‘দক্ষযজ্ঞ’, ‘বাসবদত্তা’, ‘যোগাযোগ’, ‘ছদ্মবেশী, ‘দম্পতি’ ইত্যাদি অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন রবি রায়।
১৬. ভূমেন রায় (১৮৯৯-১৯৫৩)— এক বিশিষ্ট অভিনেতা। অভিনেতা রবি রায়ের ভাই। ১৯১৬ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে ৪৭ নং বেঙ্গলি রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে মেসোপটেমিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে অসম্ভব কর্মনিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে, পদে উন্নতি হলো ভূমেন রায়ের। হঠাৎ চাকরি ছেড়ে যোগ দিলেন বাংলা রঙ্গমঞ্চে। দাদা রবি রায়ের উদ্যোগে ১৯২৬ সালে নাট্যমন্দিরে ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘প্রতাপাদিত্য’ নাটকে ‘রডা’-র চরিত্রে প্রথম মঞ্চাবতরণ ঘটলো ভূমেন রায়ের। এরপর, ‘সত্যের সন্ধান’, ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘জাতিচ্যুত’, ‘মহারাজা, নন্দকুমার’, ‘সাজাহান’, ‘টিপু সুলতান’, ‘কেদার রায়’ প্রভৃতি অনেক নাটকে এবং ‘অপহৃতা’ (নির্বাক), ‘দেনা পাওনা’, ‘চিরকুমার সভা’, ‘বিদ্রোহী’, ‘বিষবৃক্ষ’, ‘মহানিষা’ ইত্যাদি বেশকিছু ছবিতে তাঁর শক্তিশালী অভিনয়ের সাক্ষ্য রেখেছেন ভূমেন রায়।
১৭. জয়নারায়ণ মুখোপাধ্যায় (১৯০৩-১৯৮১)— নাট্য ও চলচ্চিত্র জগতের এই অভিনেতার জন্ম বিহারের কাটিহারে। বাবা নারায়ণদাস মুখোপাধ্যায় ই.বি. রেলে (বর্তমান ইস্টার্ন রেল) চাকরি করার পাশাপাশি মাঝে মাঝে অপেশাদার নাটকে দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করতেন। বাবার হাত ধরে বালক জয়নারায়ণ রেলের রিক্রিয়েশন ক্লাবে যেতেন যেখানে প্রথম ওই বয়সেই তাদের প্রযোজিত ‘প্রফুল্ল’ নাটকে যাদব চরিত্রে অভিনয় করেন। কলেজে পড়াকালীন নাট্যোচার্য শিশির ভাদুড়ির সঙ্গে দেখা করেন। শিশিরবাবুর ‘সীতা’ নাটকে, প্রথম পেশাদার থিয়েটারে অভিনয় করলেন জয়নারায়ণবাবু। এরপর ‘জনা’, ‘পণ্ডুরীক’, ‘রঘুবীর’ ইত্যাদি নাটকে পরপর অভিনয় করে, জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। পরবর্তীক্ষেত্রে, মনোমোহন, স্টার, মিনার্ভা, বিশ্বরূপা প্রভৃতি রঙ্গমঞ্চে দীর্ঘদিন ধরে, ‘শ্রীরামচন্দ্র’, ‘মগের মুলুক’, ‘সাজাহান’, ‘সরলা’, ‘গৈরিক পতাকা’, ‘দেবযানী’, ‘গয়াতীর্থ’, ‘রাণী ভবানী’, ‘টিপু সুলতান’, ‘মহারাজা নন্দকুমার’, ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘ক্ষুধা’, ‘সেতু’ ইত্যাদি আরও অজস্র নাটকে অভিনয় করেন জয়নারায়ণ মুখোপাধ্যায়। ১৯৬৬ সালে শেষবারের জন্য মঞ্চে ওঠেন কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে ‘অ্যান্টনী কবিয়াল’ নাটকে। ১৯২৬ সালে ম্যাডান কোম্পানির নির্বাক ছবি ‘দুর্গেশনন্দিনী’-তে প্রথম চিত্রাবতরণ ঘটে জয়নারায়ণবাবুর। সবাক ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন নায়ক চরিত্রে ‘জোর বরাত’ (১৯৩১) ছবিতে নায়িকা কানন দেবীর সঙ্গে। এরপর কয়েক দশক ধরে ‘ঋষির প্রেম’, ‘কংস’, ‘প্রহ্লাদ’, ‘হারানিধি’, ‘টকি অব টকিজ’, ‘সদানন্দের মেলা’, ‘হারজিৎ’, ‘দেয়া নেয়া’, ‘অজানা শপথ’ ইত্যাদি প্রায় শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন জয়নারায়ণ মুখোপাধ্যায়।
১৮. সরযূবালা দেবী (১৯১৩-১৯৯৪)— নাট্যজগতের সম্রাজ্ঞী ছিলেন ইনি। দক্ষিণেশ্বর এলাকায় জন্ম। পরিবারের সঙ্গে পরিচিত মণিমোহনবাবুর সরযূবালাকে তাঁর ১২-১৩ বছর বয়সে নিয়ে যান বাণীবিনোদ নির্মলেন্দু লাহিড়ির কাছে। এনারই সংস্পর্শে দীর্ঘদিন থেকে সরযূবালা দেবী হয়ে ওঠেন এক অবিস্মরণীয়া অভিনেত্রী। নাট্যাচার্য শিশিরকুমারের সঙ্গেও বহু নাটকে অভিনয় করেছেন। প্রথম পেশাদার মঞ্চে অভিনয় করেন ‘বিষবৃক্ষ’ নাটকে ‘কুন্দনন্দিনী’-র ভূমিকায়। এর আগে অবশ্য ‘দক্ষযজ্ঞ’ নাটকে ‘সতীর ভূমিকায় সরযূবালা অভিনয় করেন তাঁর মাত্র ১৪ বছর বয়সে; ‘শিব’-এর চরিত্রে রূপদান করেছিলেন গিরিশচন্দ্রের পুত্র প্রখ্যাত অভিনেতা দানীবাবু (সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ)। বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চে ‘সাজাহান, ‘চন্দ্রশেখর’, ‘শ্যামলী’, ‘আমি মন্ত্রী হবো’ ইত্যাদি অজস্র নাটকে সরযুবালা দেবীর অসামান্য অভিনয় দেখা গেছে। নির্বাক ছবি ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (১৯২৬)-এ প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন সরযূবালা দেবী। এরপর, ‘ঋষির প্রেম’, ‘শাপমুক্তি’, ‘মায়ের প্রাণ’, ‘দাসীপুত্র’, ‘পুনর্মিলন’, ‘মঞ্জরী অপেরা’, ‘ফুলশয্যা’ ইত্যাদি বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেছেন সরযূবালা দেবী। অভিনয় জীবনের শেষদিকে প্রখ্যাত অভিনেতা জহর রায়ের সঙ্গে যুগ্ম সত্ত্বাধিকারী হিসেবে ‘রঙমহল’ প্রেক্ষাগৃহের দায়িত্বে ছিলেন সরযূবালা দেবী।
১৯. শান্তি গুপ্তা (১৯১৪-১৯৭৩)— এই অভিনেত্রীর জন্ম কলকাতার এক অভিজাত বংশে। হাজরা রোডের ‘চিত্তরঞ্জন নাট্য সম্প্রদায়’ প্রযোজিত ‘চন্দ্রশেখর’ নাটকে ‘সুন্দর’-র ভূমিকায় মঞ্চাভিনয় দিয়ে অভিনয় জীবনের শুরু শান্তি গুপ্তার। পেশাদারি রঙ্গমঞ্চের আগেই নির্বাক ছবি ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৯২৯)-য় অভিনয়ের সুযোগ মেলে। ১৯৩২ সাল পর্যন্ত ‘গিরিবালা’, ‘কাল-পরিণয়’, ‘নৌকাডুবি’, ‘চোরকাঁটা’ ইত্যাদি ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৩০ সালে প্রথম ‘রঙমহল’ প্রেক্ষাগৃহে পেশাদার থিয়েটারে যুক্ত হন শান্তি গুপ্তা। প্রথম নাটক ছিল ‘অশোক’। এরপর, বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চে ‘পতিব্রতা’, ‘বাংলার মেয়ে’, ‘চরিত্রহীন’, ‘গোরা’, ‘ঘূর্ণি’, ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘ক্ষুধা’ ইত্যাদি অনেক নাটকে বহুদিন ধরে অভিনয় করেন। পূর্বোল্লিখিত ছবিগুলি ছাড়াও, ‘প্রভাত মিলন’, ‘অপরাধ’, ‘মাটির ঘর’, ‘ছদ্মবেশী’, ‘সমর’, ‘পণ্ডিতমশাই’, ‘মন্ত্রশক্তি’, ‘অপরাজিত’, ‘শুন বরনারী’ ইত্যাদি আরও কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন শান্তি গুপ্তা।
২০. হরিমতী দেবী— ইনি একজন অসাধারণ কণ্ঠশিল্পী। তাঁর গানের ক্ষমতার কারণেই থিয়েটারে অভিনয় করতেন। বেতারে নিয়মিত গাইতেন। দেবী দুর্গার আবাহনমূলক সংগীতালেখ্য বেতারে সম্প্রচারিত ‘মহিষাসুরমদির্নী’-র একেবারে শুরুর দিকে অন্যতম প্রধান গায়িকা হিসেবে অংশ নিতেন হরিমতী দেবী। রেকর্ডে অনেক গান গেয়েছেন। ইসলামী পদ গাইতেন মুসলিম নামে।
২১. অপর্ণা দেবী (১৯১৯-১৯৮২)— মঞ্চ ও চলচ্চিত্রজগতের অভিনেত্রী। কলকাতায় জন্ম। ইস্কুলে ‘বিন্দুর ছেলে’ নাটকে প্রথম অভিনয়। ১৯৩৭ সালে ‘বড়বাবু’ ছবিতে প্রথম চিত্রাবতরণ। শিশিরকুমারের সান্নিধ্যে এসে নবনাট্যমন্দিরে ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে ‘হেলেন’ চরিত্রে প্রথম পেশাদারি মঞ্চে অভিনয়। এরপর ‘রাণী দুর্গাবতী’, ‘মহারাজা নন্দকুমার’, ‘টিপু সুলতান’, ‘রাজসিংহ’, ‘শ্যামলী’ ইত্যাদি বহু নাটকে অভিনয় করেন। এছাড়া ‘ব্রাহ্মণকন্যা’, ‘সহযাত্রী, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘ইন্দ্রাণী’, ‘জীবন মৃত্যু’, ‘সোনার খাঁচা’ ইত্যাদি শতাধিক ছবিতে কয়েকদশক জুড়ে অভিনয় করেছেন অপর্ণা দেবী।
২২. ফিরোজবালা — এককালের মঞ্চজগতে নৃত্য-গীতপটীয়সী এক বিশিষ্ট অভিনেত্রী। বাবা সতীশচন্দ্র মল্লিক ছিলেন তবলা শিল্পী। ফিরোজবালার দিদি চারুবালা ও বোন পূর্ণিমা প্রত্যেকেই ছিলেন অভিনয় জগতের শিল্পী। ‘মহনিশা’, ‘দুই পুরুষ’, ‘নৌকাডুবি’, ‘বালাজি রাও’ ইত্যাদি আরও অনেক নাটকে প্রায় প্রত্যেকটি পেশাদার মঞ্চে অভিনয় করেছেন ফিরোজবালা। যাত্রাও করেছেন— ‘ঝড়ের দোলা’, ‘দেবতার মৃত্যু’ ইত্যাদি কয়েকটি পালায়। ‘বন্দী’ (১৯৪২), ‘সমাধান’ (১৯৪৩)’, দুটি সবাক চলচ্চিত্রে ফিরোজবালা অভিনয় করেন।’
২৩. সুশীলাবালা— ইনি বিশিষ্ট অভিনেত্রী সুশীলাবালা (ছোটো)। নটগুরু গিরিশচন্দ্রের সময়ে একই নামের আর একজন অভিনেত্রীর দেখা মিলেছিল, তাঁকে বলা হতো সুশীলাবালা (বড়ো)। ছোটো সুশীলাবালার আসল নাম পুষ্পকুমারী। নট ও নাট্যকার অমরেন্দ্রনাথ দত্ত-র কাছে নাট্যশিক্ষা। অমরেন্দ্রনাথেরই প্রশিক্ষণে ‘সাজাহান’ ও ‘প্রেমের জেপেলিন’ নাটক দুটিতে পরপর অভিনয় করেন। এছাড়াও সুশীলাবালা আর্ট থিয়েটারের অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং নটসূর্য অহীন্দ্র চৌধুরীর কাছেও নাটকগুলির মধ্যে আছে, ‘শ্রীরামচন্দ্র’, ‘চাঁদ সদাগর’, ‘চণ্ডীদাস’, ‘শকুন্তলা’, ‘ফুল্লরা’ ইত্যাদি।
২৪. পূর্ণিমা দেবী (১৯২৬-১৯৯৯)— নাট্য ও চলচ্চিত্রাভিনেত্রী। বাবা ছিলেন দক্ষ তবলাশিল্পী সতীশচন্দ্র মল্লিক। দুই অভিনেত্রী চারুবালা দেবী ও ফিরোজবালা দেবী ছিলেন দুই দিদি। ছোটো থেকেই পূর্ণিমা দেবীর নাচ-গানের প্রতি আকর্ষণ ছিল। গান শিখেছেন পণ্ডিত গৌরীশঙ্কর মিত্র, পণ্ডিত ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, উস্তাদ জমীরুদ্দিন খাঁ প্রমুখ দিকপাল সংগীত গুরুর কাছে। নাচ শিখেছেন ললিত গোঁসাইয়ের কাছে এবং এনার হাত ধরেই স্টার থিয়েটারে ‘শ্রীগৌরাঙ্গ’ (১৯৩১) নাটকে অভিনয় করেন। স্টারে আসার পর পূর্ণিমা দেবী অভিনয়শিক্ষা পেলেন অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও তারাসুন্দরীর কাছে। এরপর, বহু বছর ধরে স্টারসহ বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চে, ‘কৃষ্ণভামিনী’, ‘ঊষাহরণ’, ‘দুই পুরুষ’, ‘পরিণীতা’, ‘কালিন্দী’, ‘গোলকুণ্ডা’, ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ ইত্যাদি অনেক নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৩৩ সালে ‘শ্রীগৌরাঙ্গ’ ছবিতে বালক নিমাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করে ও গান গেয়ে ছবির জগতে প্রবেশ ঘটলো পূর্ণিমা দেবীর। এরপর প্লেব্যাকের যুগে অনেক বিখ্যাত সুরকারের সুরে বাংলা, হিন্দি, উর্দু, তামিল, তেলেগু ইত্যাদি ভাষায় গান গেয়েছেন। ‘সাথী’ ছবিতে কানন দেবীর সঙ্গে তাঁর গাওয়া গান আছে। ১৯৪০ সালে ‘রাজকুমারের নির্বাসন’ ছবিতে শেষ মুহূর্তে পূর্ণিমা দেবীকে সরিয়ে অন্য এক শিল্পীকে গান গাইতে দেওয়া হলে, তিনি সারাজীবনের মতো গান গাওয়া ছেড়ে দেন। পূর্ণিমা দেবী প্রায় ছয় দশকজুড়ে অজস্র ছবিতে অভিনয় করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ‘বিদ্রোহী’, ‘রাঙা বউ’, ‘সাথী’, ‘দেশের মাটি’, ‘সমাধান’, ‘বলয়গ্রাস’, ‘গণদেবতা’, ‘ভোম্বল সর্দার’ ইত্যাদি চলচ্চিত্র।
২৫. সমুদ্রগুপ্ত— সুধীন্দ্রনাথ রাহা রচিত একটি জনপ্রিয় নাটক ‘সমুদ্রগুপ্ত’। অরোরা কর্পোরেশনের কর্ণধার অনাদি বসুর আমলে ১৯২৯ সালের ২৫ অক্টোবর মনোমোহন থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় এই নাটক।
২৬. ‘ঘরে বাইরে’— রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘নিখিলেশ-বিমলা-সন্দীপ’ চরিত্র সংবলিত বিখ্যাত উপন্যাস। এটি নাট্যরূপে ও চিত্ররূপেও প্রকাশিত হয়েছে।
২৭. ‘শ্রীরঙ্গম’— এটি আগে ছিল ‘নাট্যনিকেতন’ মঞ্চ। ১৯৪১ সালে নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ি, এই মঞ্চটিকে নানাভাবে পরিবর্তন করে অনেক আধুনিক করে তোলেন এবং এর নাম হয়— ‘শ্রীরঙ্গম’। ১৯৫৩ পর্যন্ত এভাবেই চলে। ওই বছর রাসবিহারী সরকার প্রমুখের প্রেক্ষাগৃহটির সত্ত্ব কিনে নেন। শিশিরকুমার চলে যান। মঞ্চটির নতুন নাম হয়— ‘বিশ্বরূপা’।
২৮. বাণীব্রত মুখোপাধ্যায়— একসময়ের নাট্যাভিনেতা। একক অভিনয়ে ছিলেন অসামান্য পারদর্শী। মঞ্চেই পোশাক পরিবর্তন করে, একক অভিনয়ে একাধিক চরিত্রে রূপদান করার মতো ব্যতিক্রমী ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারতেন এই বিত্তশালী অভিনেতা।
২৯. ‘তখত-এ-তাউস’— প্রেমাঙ্কুর আতর্থী রচিত এই নাটকটি প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ি। নিজে অভিনয় করেন ‘জাহান্দার শা’-র চরিত্রে। ১৯৫১ সালে নাটকটি মঞ্চস্থ হয় ‘শ্রীরঙ্গম’ মঞ্চে।
৩০. ‘দুঃখীর ইমান’— এটি তুলসী লাহিড়ির লেখা একটি ব্যতিক্রমী নাটক।১৯৪৭ সালে সেই সময়ের বাংলার এক চূড়ান্ত টালমাটাল রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে লেখা এই নাটকটি মঞ্চস্থ করেন নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ি। এতদিনের প্রযোজিত নাটকগুলির পাশে সম্পূর্ণ অন্য এক আবেদনের নাটক, তাঁর প্রযোজনার জন্য নির্বাচন করে, সময়টাকে ধরতে, চেয়েছিলেন নাট্যাচার্য, একথা বলাই যায়। ১৯৪৭ সালে ‘শ্রীরঙ্গম’ মঞ্চে প্রথম প্রদর্শিত হয়, ‘দুঃখীর ইমান’।
৩১. ‘সাজাহান’— দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা একটি বিখ্যাত নাটক ১৯০৯ সালে লেখা। এটি প্রথম মঞ্চস্থ হয়, ১৯০৯ সালের ২২ অগস্ট, মিনার্ভা থিয়েটারে। পরবর্তীকালে, বহুবার মঞ্চস্থ হয় এই নাটক। শিশিরকুমার, অহীন্দ্র চৌধুরীসহ অনেক দিকপালের অভিনয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে ‘সাজাহান’।
৩২. ‘চাণক্য’— ১৯১১ সালে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত নাটক ‘চন্দ্রগুপ্ত’-র প্রধান চরিত্র হলো ‘চাণক্য’। দ্বিজেন্দ্রলালের ইভনিং ক্লাবে প্রথম অভিনীত হয় এই নাটক। পেশাদার থিয়েটারে ‘চন্দ্রগুপ্ত’ প্রথম অভিনীত হয় ২২ জুলাই’ ১৯১১ মিনার্ভায়। পরবর্তীকালে, নাট্যাচার্য শিশিরকুমার প্রযোজিত এই নাটক অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। ‘চাণক্য’-র চরিত্রে অবিস্বরণীয় অভিনয় করেন স্বয়ং শিশিরকুমার। একই কাহিনি অবলম্বনে শিশির ভাদুড়ির পরিচালনায় ১৯৩৯ সালে মুক্তি পায় ‘চাণক্য’ চলচ্চিত্র, যাতে নামভূমিকায় রূপদান করেন শিশিরকুমার।
৩৩. দানীবাবু (১৮৬৮-১৯৩২)— প্রখ্যাত নাট্যাভিনেতা ও নির্দেশক। ভালো নাম সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ। নটগুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষের বড়ো ছেলে। ১০ বছর বয়সে থিয়েটারের দল খোলেন। আর্ট স্কুলে আঁকা শিখেছেন। গিরিশবাবুর অজান্তে, অমৃতলাল মিত্র দানীবাবুকে গোপনে অভিনয় শিক্ষা দিতে শুরু করেন। বাবা গিরিশচন্দ্রের প্রযোজনা ‘চণ্ডা’ নাটকে ‘রঘুদেব’-এর ভূমিকায় অভিনয় করে খ্যাতিলাভ করেন। এরপর, ‘সিরাজদ্দৌল্লা’, ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘প্রফুল্ল’, ‘পোষ্যপুত্র’ ইত্যাদি অজস্র নাটক সমৃদ্ধ হয়েছে দানীবাবুর অভিনয়ে।
৩৪. প্রভা দেবী (১৯০৩-১৯৫২)— এক বিরাট প্রতিভাসম্পন্ন অভিনেত্রী। প্রভা দেবীর মা বিন্দ্যাবাসিনী দেবী থাকতেন অভিনেত্রী তিনকড়ির কাছে। তিনকড়ির উদ্যোগে ছোট্ট প্রভা নাচ শেখেন ললিত গোস্বামীর কাছে। বালিকা বয়সে ‘জয়দেব’ নাটকে প্রথম অভিনয় করলেন মিনার্ভায়। নির্মলেন্দু লাহিড়ির বিপরীতে ১৬ বছর বয়সে নায়িকা হিসেবে প্রথম ‘রত্নেশ্বরের মন্দির’ নাটকে অভিনয় করেন প্রভা দেবী। নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ির সঙ্গে প্রথম অভিনয় করেন ‘আলমগীর’ নাটকে। এরপর শিশিরকুমারের সঙ্গে একের পর এক অবিস্মরণীয় প্রযোজনায় তাঁর অভিনয়দীপ্তিতে ভরিয়ে দেন প্রভা দেবী। অন্যান্য দলেও পরবর্তীকালে অভিনয় করেন। প্রভাদেবীর শেষ নাট্যাভিনয় রঙমহল প্রেক্ষাগৃহে ‘সেই তিমিরে’ নাটকে (৬/১/১৯৫২)। ম্যাডান থিয়েটারে জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালতি নির্বাক ছবি ‘মাতৃস্নেহ’ (১৯২৩) ছবিতে প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন প্রভা দেবী। এরপর, দুটি নির্বাক ছবি ‘পাপের পরিণাম’ (১৯২৪), ‘বিষবৃক্ষ’ (১৯২৮)-এ অভিনয় করে সবাক চলচ্চিত্রজগতে প্রবেশ করে অনেকদিন ধরে বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেন। ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘নাগরিক’ (১৯৫২)-এ শেষবারের মতো প্রভা দেবীকে চলচ্চিত্রে দেখা যায়, যা মুক্তি পায় অনেক পরে। প্রভা দেবী অনেক গান লিখেছেন। গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স থেকে ‘গীতায়ন’ নামে তাঁর একটি গীতি-সংকলন প্রকাশিত হয়। শিশির ভাদুড়ির ভাই অভিনেতা তারাকুমার ভাদুড়ির সঙ্গে বিবাহ হয় প্রভা দেবীর।
৩৫. অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি (১৮৫০-১৯০৯)— কলকাতার বাগবাজারে জন্ম এই অবিস্মরণীয় নাট্যাভিনেতা ও অসামান্য নাট্যশিক্ষকের। প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অর্ধেন্দুশেখরের অসম্ভব দখল ছিল। ‘মুস্তোফীসাহেব’ নামে পরিচিত ছিলেন। পাথুরিয়াঘাটা রাজবাড়ির নাট্যমঞ্চে ১৮৬৭ সালে ‘কিছু কিছু বুঝি’ নামক প্রহসনে প্রথম অভিনয় করেন অর্ধেন্দুশেখর। কিছুদিন পরেই গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে অভিনয় করেন ‘সধবার একাদশী’ নাটকে। এরপর, ‘নীলদর্পণ’, ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘প্রফুল্ল’, ‘রিজিয়া’ ইত্যাদি বহু নাটকে অর্ধেন্দুশেখর অতুলনীয় অভিনয়ের সাক্ষ্য রাখেন। একবার মঞ্চে দাঁড়িয়েই দাঁড়িয়েই কয়েক মিনিটের মধ্যে তৈরি করে, বিনোদিনী প্রমুখদের নিয়ে ‘মুস্তাফিসাহেব কা পাক্কা তামাসা’ নামক একটি হাসির ছোটো নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি।
৩৬. অমৃতলাল বসু (১৮৫৩-১৯২৯)— বসিরহাট অঞ্চলে জন্ম। বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের আদিযুগের এক অসাধারণ নাট্যকার, কৌতুকরসের স্রষ্টা ও শক্তিশালী অভিনেতা। ১৮৬৯ সালে জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশন থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন। এরপর মেডিকেল কলেজে দু’বছর ডাক্তারি পড়ে, তা ছেড়ে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার শিক্ষা গ্রহণ, কিছুকাল শিক্ষকতা, কেশবচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত ‘ব্রাহ্মনিকেতন’ ছাত্রাবাসে অধ্যক্ষের কাজ (১৮৭৩), আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ারে সরকারি চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন ইত্যাদি নানারকম কাজ করেন অমৃতলাল বসু। অবশেষে, জোড়াসাঁকোর মধুসূদন সান্যালের বাড়িতে ৭/১২/১৮৭২ তারিখে প্রথম পেশাদারি থিয়েটার হিসেবে প্রদর্শিত ‘নীলদর্পণ’ নাটকে রঙ্গমঞ্চে প্রথম অভিনয় করেন অমৃতলাল বসু। এরপর, তৎকালীন প্রায় সমস্ত প্রতিষ্ঠিত রঙ্গমঞ্চে অজস্র নাটকে অভিনয়, নাট্যশালার অধ্যক্ষের কাজ, নাট্য-পরিচালনা ইত্যাদি কাজ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করেন। ‘তিলতর্পণ’, বিবাহ-বিভ্রাট’, ‘খাসদখল’, ‘ব্যাপিকা-বিদায়’ ইত্যাদি প্রায় ৩৪ খানা নাটকের নাট্যকার ছিলেন অমৃতলাল। তাঁর কৌতুকরসের ক্ষমতার জন্য তাঁকে ‘রসরাজ’ আখ্যা দেওয়া হয়।
৩৭. অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (১৮৭৫-১৯৩৮)— প্রথিতযশা অভিনেতা, নাট্যকার, নাট্যপরিচালক ও নাট্যসংগঠক। পড়াশুনায় ইস্তফা দিয়ে বীণা’ প্রেক্ষাগৃহ ভাড়া নিয়ে ‘প্যান্ডোরা থিয়েটার’ নামে পেশাদার থিয়েটারের পরিচালনা করেন। পরে, স্টার থিয়েটারে যুক্ত হলেন। স্টারের পরিচালক সংস্থা আর্ট থিয়েটার-এর ম্যানেজার হয়ে, অনেক জনপ্রিয় প্রযোজনা মঞ্চস্থ করেন অপরেশচন্দ্র। অনেক মঞ্চসফল নাটকের নাট্যকার ছিলেন অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। যার মধ্যে ‘রঙ্গিলা’, ‘রামানুজ’, ‘শ্রীরামচন্দ্র’, ‘ইরানের রাণী’ ইত্যাদি আরও কিছু নাটক উল্লেখের দাবি রাখে। এছাড়া, অনুরূপা দেবীর উপন্যাস ‘মন্ত্রশক্তি’, ‘পোষ্যপুত্র’ ইত্যাদি আরও কিছু কাহিনির সার্থক নাট্যরূপ দেন অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। অপরেশচন্দ্রের স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ ‘রঙ্গালয়ে ত্রিশ বছর’।
৩৮. নরেশ মিত্র (১৮৮৮-১৯৬৮)— পুরো নাম নরেশচন্দ্র মিত্র। বাংলা নাট্য ও চলচ্চিত্রজগতের এক প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা ও পরিচালক নাট্যাচার্য শিশিরকুমারের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। ছাত্রজীবনে (১৯০৮) কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে ‘কুরুক্ষেত্র’ নাটকে নরেশচন্দ্র ‘দুর্বাসা’ ও শিশিরকুমার রূপদান করেন ‘অভিমন্যু’ চরিত্রে। পরবর্তীকালে, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘পুনর্জন্ম’, ‘প্যালারামের স্বাদেশীকতা’, ‘প্রফুল্ল’, ‘কর্ণার্জুন’ ইত্যাদি বহু নাটক সমৃদ্ধ হয়েছে নরেশচন্দ্রের কখনও পরিচালনাসহ অভিনয়, আবার কখনও শুধুই অভিনয়গুণে। নরেশচন্দ্র মিত্রকে আখ্যা দেওয়া হয় ‘নটশেখর’ উপাধিতে। নাটকের পাশাপাশি চলচ্চিত্রজগতেও নিবার্কা যুগের ‘মানভঞ্জন’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘দেবদাস’ এবং সবাক যুগের ‘গোরা’, ‘স্বয়ংসিদ্ধা’, ‘কঙ্কাল’, ‘উল্কা’ ইত্যাদি বেশকিছু জনপ্রিয় ছবির পরিচালক ছিলেন নরেশচন্দ্র মিত্র। শেষজীবনে, নরেশবাবু ‘প্রেতচর্চা’ করতেন।
৩৯. ‘শ্যামলী’— স্টার রঙ্গমঞ্চের একটি অতি জনপ্রিয় নাটক। এই নাটকে নায়ক ‘অনিল’-এর চরিত্রে ১৯৫৩ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে একটানা ১৯৫৫ সালের ১৩ জানুয়ারি অবধি ৪৮৪ রাত্রি যাপন করেন মহানায়ক উত্তমকুমার। নিরুপমা দেবীর কাহিনিতে নাট্যরূপ দেন দেবনারায়ণ গুপ্ত। নাটকটির পরিচালকদ্বয় ছিলেন শিশির মল্লিক ও যামিনী মিত্র। নামভূমিকায় মূক ‘শ্যামলী’-র চরিত্রে ছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। তাছাড়া ছিলেন অনুপকুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সরযূবালা দেবী, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, মিহির ভট্টাচার্য, রবি রায় প্রমুখের মতো অভিনেতাকূল। পরে ১৯৫৮ সালে ‘অনিল’ চরিত্রে নবকুমার লাহিড়ীকে নির্বাচন করে, পুনরায় ‘শ্যামলী’ মঞ্চস্থ হয়েছিল। কিন্তু, তা আগের মতো জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি।
৪০. সুরেশ দত্ত— ১৯৩৪ সালে জন্ম এই অসাধারণ মঞ্চশিল্পীর। বাংলা পেশাদারি ও মূলত গ্রুপ থিয়েটার মঞ্চের মঞ্চসজ্জার ক্ষেত্রে এক আলোড়ন ঘটিয়েছিলেন এই শিল্পী। খালেদ চৌধুরীর পরে সুরেশ দত্তকেই আলাদা ভাবে চেনা যায় থিয়েটারের মঞ্চসজ্জার ক্ষেত্রে। দ্য অ্যালবার্ট লিগ টেম্পল অব আর্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে আর্ট-এ ডিপ্লোমা, রবীন্দ্রভারতীতে নৃত্যনাট্যের শিক্ষা এবং সবশেষে মস্কোর স্টেট পাপেট্রি থিয়েটার থেকে পাপেটে শিক্ষা এবং সবশেষে মস্কোর স্টেট পাপেট্রি থিয়েটার থেকে পাপেটে শিক্ষা নেন পাপেটের বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ওবরাৎসব-এর কাছে (১৯৬২)। চিলড্রেনস লিটল থিয়েটার-এ যোগ দিয়ে ‘অবন পটুয়া’, ‘সোনার চাবি’ ইত্যাদি পুতুল নাটক তৈরি করেন। এর পর ‘ক্যালকাটা পাপেট থিয়েটার’ (সি.পি.টি) তৈরি করেছিলেন সুরেশ দত্ত। সুরেশ দত্তের পরিচালনায় এই সংস্থা প্রযোজিত ‘আলাদিন’, ‘রামায়ণ’ ইত্যাদি আরও কিছু পুতুলনাটক এক অসামান্যতা দাবি করে। পুতুল দিয়ে যে অভাবনীয় কাজ করেছেন সুরেশ দত্ত, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
৪১. ‘অভিনেতৃ সংঘ’— এটি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের একটি সংগঠন। অভিনয়জগতের শিল্পীদের দাবিদাওয়া, দুঃস্থ শিল্পীদের সাহায্য ইত্যাদি আরও কিছু সেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল এই সংগঠন। বিভিন্ন অনুষ্ঠান নাট্যপ্রযোজনা ইত্যাদি সংগঠিত করেছে ‘অভিনেতৃ সংঘ’। পরে, এই সংগঠন ভেঙে তৈরি হয় ‘শিল্পী সংসদ’।
৪২. রাজেন চৌধুরী— বিশিষ্ট চিত্র-সম্পাদক (এডিটার)। সম্ভবত একটি ছবিই পরিচালনা করেন— ‘ওরে যাত্রী’। ছবিটি মুক্তি পায় ২/২/১৯৫১ তারিখে। মহানায়ক উত্তমকুমারের এটি অভিনয় জীবনের চতুর্থ ছবি। বিপরীতে নায়িকা ছিলেন করবী গুপ্তা।
৪৩. অর্ধেন্দু মুখার্জী— ১৯০৮ সালে বিহারের ভাগলপুরে জন্ম এই চিত্র পরিচালকের। প্রথম জীবনে অভিনেতা ও সহকারী চিত্রপরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রজগতে প্রবেশ করেন। অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় পরিচালিত প্রথম ছবি হলো ‘সংগ্রাম’ (১৯৪৬)। এরপর, ‘পূর্বরাগ’, ‘পদ্মা প্রমত্ত নদী’, ‘সন্দীপন পাঠশালা’, ‘দস্যু মোহন’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন’ ইত্যাদি আরও কয়েকটি ছবি পরিচালনা করেন। কয়েকটি ছবিতে অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় অভিনয়ও করেন। এছাড়া, মঞ্চে অভিনয় ও পরিচালনার কাজ করেছেন অর্ধেন্দুবাবু।
৪৪. কালীপ্রসাদ ঘোষ— ১৮৯৯ সালে জন্ম এই চিত্র ও নাট্যপরিচালকের। বাংলা থিয়েটারের অন্যতম উজ্জ্বল নাট্যব্যক্তিত্ব উপেন্দ্রনাথ মিত্রের ভাগ্নে ছিলেন কালীপ্রসাদ। কালীপ্রসাদ ঘোষ, ঘনশ্যাম দাস চৌখানী ও ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (ডি.জি) মিলে তৈরি করেন ‘ইন্ডিয়ান সিনেমা আর্টস’। এই সংস্থা প্রযোজিত গিরিশচন্দ্রের কাহিনি নির্ভর নির্বাক ছবি ‘শঙ্করাচার্য’ মুক্তি পায় ২৫.৩.১৯২৭ কর্ণওয়ালিশ থিয়েটারে (বর্তমান ‘শ্রী’ সিনেমা)। ১০ রীলের এই ছবিটিই কালীপ্রসাদ ঘোষ পরিচালিত প্রথম ছবি। এরপর, সবাক যুগে ‘জজ সাহেবের নাতনি’, ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘বিদ্যাসাগর’, ‘কার পাপে’, ‘রাণী রাসমণি’ ইত্যাদি জনপ্রিয় ছবির পরিচালক ছিলেন কালীপ্রসাদবাবু। বাংলা রঙ্গমঞ্চে ‘গয়াসুর’, ‘সতীতীর্থ’ ইত্যাদি বেশ কয়েকটি মঞ্চসফল নাটকেরও পরিচালক ছিলেন কালীপ্রসাদ ঘোষ।
৪৫. দেবকীবাবু— চিত্রপরিচালক দেবকীকুমার বসু (১৮৯৮-১৯৭১)। বর্ধমানের শক্তিগড়ে জন্ম। প্রথমে ‘শক্তি’ নামক পত্রিকার সম্পাদনা করেন। পরে, ডি.জি.-র ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন ফিল্মস কোম্পানিতে যোগ দিয়ে ‘কামনার আগুন’ ও ‘ফ্লেমস অব ফ্লেস’ ছবির চিত্রনাট্য লেখেন এবং নায়ক হিসেবে পর্দায় আত্মপ্রকাশ করেন। নাট্যাচার্য শিশিরকুমারের সান্নিধ্যলাভ হয় দেবকীবাবুর। প্রথম পরিচালনা করেন ডি.জি. প্রযোজিত নির্বাক ছবি ‘পঞ্চশর’ (১৯৩০)। ১৯৩১-এ মুক্তিপ্রাপ্ত প্রমথেশ বড়ুয়া প্রযোজিত ‘অপরাধী’ (নির্বাক) ছবিটিরও পরিচালক ছিলেন দেবকী বসু। সবাক যুগে ‘চণ্ডীদাস’, ‘মীরাবাঈ’, ‘বিদ্যাপতি’, ‘পুরাণ ভকত’ (সিন্ধি), ‘কবি’, ‘রত্নদীপ’, ‘সাগর সঙ্গমে’, ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’ ইত্যাদি আরও বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় ছবি পরিচালনা করেন দেবকী বসু। ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক অন্যতম যুগের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা যায় এই বিশিষ্ট চিত্র পরিচালককে।
৪৬. ‘চন্দ্রশেখর’— ১৪/১১/১৯৪৭ তারিখে মুক্তি পায় সেই সময়ের নিরিখে অত্যন্ত ব্যয়হুল ছবি— ‘চন্দ্রশেখর’। বঙ্কিমচন্দ্রের কাহিনিনির্ভর ছবিটির পরিচালক ছিলেন দেবকীকুমার বসু। সংগীত পরিচালনা করেন কমল দাশগুপ্ত। মুখ্য চরিত্রে ছিলেন, অশোককুমার (বম্বে), কানন দেবী, ভারতী দেবী, নীতীশ মুখার্জী, অনুপকুমার প্রমুখ শিল্পীরা।
৪৭. সত্যেন বোস— বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রজগতের একজন চিত্রপরিচালক। প্রথম পরিচালিত ছবি ‘পরিবর্তন’ (১৯৪৯) এই ছবিতে সত্যেনবাবু নিজে অভিনয়ও করেন। এরপর ‘বরযাত্রী’, ‘ভোর হয়ে এলো’, ‘রিক্সাওয়ালা’ (সলিল চৌধুরীর লেখা এই গল্পটি নিয়েই হিন্দিতে বিমল রায় তৈরি করেন ‘দো বিঘা জমিন’ ছবিটি) ইত্যাদি বাংলা ছবি এবং ‘জাগৃতি’, ‘বন্দিশ’, ‘বন্দী’, ‘মাসুম’, ‘গার্ল ফ্রেন্ড’ প্রভৃতি হিন্দি পরিচালক ছিলেন সত্যেন বসু।
৪৮. ‘রজত জয়ন্তী’— ‘নিউ থিয়েটার্স প্রযোজিত, প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত, রাইচাঁদ বড়াল সুরারোপিত মিষ্টি হাসির ছবি ‘রজত জয়ন্তী’ মুক্তি পায় ১২/৮/১৯৩৯ তারিখে। মুখ্য চরিত্রে ছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া, মলিনা দেবী, পাহাড়ী সান্যাল, শৈলেন চৌধুরী, ইন্দু মুখোপাধ্যায়, মেনকা দেবী, সত্য মুখোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পীরা।
৪৯. সুধীর মুখোপাধ্যায়— স্বনামধন্য চিত্রপরিচালক ও প্রযোজক। তৎকালীন ২৪ পরগণায় জন্ম। ‘পাশের বাড়ি’, ‘বাঁশের কেল্লা’, ‘শাপমোচন’, ‘দুই ভাই’ ইত্যাদি আরও কিছু জনপ্রিয় ছবির পরিচালক।
৫০. এম. পি. প্রোডাকসন্স— ১৯৪১ সালের ২৮ জুন ‘মায়ের প্রাণ’ নামে যে ছবিটি মুক্তি পায়, তার প্রযোজক সংস্থা হিসেবে প্রথম দেখা গেল ‘এম.পি. প্রোডাকসন্স’ নামটি। মালিকের নাম মুরলীধর চট্টোপাধ্যায়। সম্ভবত, উপরোক্ত ছবির নামের আদ্যক্ষর নিয়ে সংস্থার নাম নির্ধারিত হয়েছিল। এই সংস্থায় ক্যামেরাম্যান ও পরিচালক হিসেবে যোগ দেন প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়া। পরে, সংস্থার অনেক বড়ো দায়িত্ব নেন বড়ুয়াসাহেব। মুরলীধরবাবু কিছুদিন পরে (১৯৪৮ সালে) সাউথ সিঁথি রোডের মোড়ে স্টুডিওসহ প্রযোজনা সংস্থাটিকে পাকাপাকিভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। উত্তর-সুচিত্রা জুটির প্রথম ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ (১৯৫৩) এই সংস্থারই নির্মিত। ‘শেষ উত্তর’, ‘যোগাযোগ’, ‘সহযাত্রী’, ‘বসু পরিবার’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সবার উপরে’ ইত্যাদি আরও অনেক জনপ্রিয় ছবির প্রযোজক ছিলেন ‘এম.পি. প্রোডাকসন্স’।
৫১. রাজেন তরফদার (১৯১৭-১৯৮৭)— চিত্রপরিচালক। বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহীতে জন্ম। কলকাতার গভর্মেন্ট আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে ‘জে. ওয়াল্টার থম্পসন’ সংস্থায় শিল্প নির্দেশক হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। রাজেন তরফদার পরিচালিত প্রথম ছবি— ‘অন্তরীক্ষ’ (১৯৫৯)। এরপর, তাঁর পরিচালিত ছবির মধ্যে আছে, ‘গঙ্গা’, ‘অগ্নিশিখা’, ‘জীবন কাহিনি’, ‘আকাশ-ছোঁয়া’ ‘পালঙ্ক’, ‘নাগপাশ’ ইত্যাদি। রাজেনবাবু চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন। এর মধ্যে আছে, ‘গঙ্গা’, ‘অগ্নিশিখা’, ‘আকালের সন্ধানে’ প্রভৃতি ছবি।
৫২. চিত্তবাবু— ইনি হলেন চিত্রপরিচালক ও প্রযোজক চিত্ত বসু। ১৯০৭ সালে বর্তমান বাংলাদেশের খুলনার মাগুরা গ্রামে জন্ম। ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশন থেকে প্রবেশিকা, বঙ্গবাসী কলেজ থেকে আই.এ ও ল’ পড়েছেন। বন্ধু চিত্রপরিচালক সুকুমার দাশগুপ্ত-র সহকারী হয়ে প্রথম ‘রাজগী’ (১৯৩৭) ছবিতে কাজ করেন। চিত্ত বসুর একক পরিচালনায় প্রথম ছবি ‘যতদূর’ (১৯৪৫)। এরপর, ‘পূরবী’, ‘মেঘমুক্তি’, ‘ছেলে কার’, ‘মন্ত্রশক্তি’, ‘কল্কাবতীর ঘাট’, ‘একটি রাত’, ‘বন্ধু’, ‘মায়ামৃগ’, ‘জয়া’ ইত্যাদি আরও কিছু ছবির পরিচালক ছিলেন চিত্ত বসু।
৫৩. হরিদাস ভট্টাচার্য — চিত্রপরিচালক। প্রথম দিকে গভর্নরের ‘এ.ডি.কং’ ছিলেন। চিত্রাভিনেত্রী কানন দেবীকে বিয়ে করেন। কানন দেবীর সঙ্গে চিত্রপ্রযোজক সংস্থা ‘শ্রীমতী পিকচার্স’ তৈরি করেন। এই সংস্থা নির্মিত প্রথম ছবি— ‘মেজদিদি’ (১৯৫০)। হরিদাস ভট্টাচার্য পরিচালিত ছবির মধ্যে ‘নববিধান’, ‘দেবত্র’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, শেষ অঙ্ক’, ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
৫৪. দিলীপ মুখোপাধ্যায়— অভিনেতা, চিত্রপরিচালক ও প্রযোজক। ১৯৩২-এ ভাগলপুরে জন্ম। পড়াশুনাও সেখানে। ভাগলপুরেই আলাপ হরিদাস ভট্টাচার্য ও কানন দেবীর সঙ্গে। পরে, কলকাতায় এসে হরিদাস ভট্টাচার্যের সহকারী হয়ে প্রথম পরিচালনার কাজ করলেন ‘নববিধান’ (১৯৫৪) ছবিতে। এই ভাবেই কিছুদিন চললো। এর মধ্যে একটি ছোট্ট চরিত্রে প্রথম চিত্রাবতরণ ঘটলো ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ ছবিতে (১৯৫৮)। দিলীপবাবু ১৯৫৯ সালে তরুণ মজুমদার ও শচীন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলিতভাবে তৈরি করলেন ‘যাত্রিক’ গোষ্ঠী। প্রথম পরিচালিত ছবি— ‘চাওয়া পাওয়া’ (১৯৫৯)। ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘কাচের স্বর্গ’, ‘পলাতক’ ইত্যাদি কয়েকটি জনপ্রিয় ছবির পরিচালক ছিল ‘যাত্রিক’ গোষ্ঠী। ‘পলাতক’ ছবির পর এই গোষ্ঠী ভেঙে যায়। তারপর, দিলীপ মুখোপাধ্যায় নিজেই ‘যাত্রিক’ নাম দিয়ে পরিচালনা করেন, ‘এখানে পিঞ্জর’, ‘ছিন্নপত্র’, ‘নগর দর্পণে’, ‘চাঁদের কাছাকাছি’ ইত্যাদি কিছু জনপ্রিয় ছবি। দিলীপ মুখার্জী অভিনীত ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ‘কাঁচের স্বর্গ’, ‘এখানে পিঞ্জর’, ‘অশান্ত ঘূর্ণী’, ‘থানা থেকে আসছি’, ‘ছিন্নপত্র’, ‘রাতের রজনীগন্ধা’ ইত্যাদি আরও বেশ কয়েকটি ছবি।
৫৫. শচীনবাবু— ইনি ‘যাত্রিক’ গোষ্ঠীর অন্যতম চিত্রপরিচালক শচীন মুখোপাধ্যায়। ১৯৫৯ সালে এই গোষ্ঠী তৈরি হয়। শচীনবাবু ছাড়া এই গোষ্ঠীতে ছিলেন তরুণ মজুমদার ও দিলীপ মুখোপাধ্যায়। এই গোষ্ঠী পরিচালিত প্রথম ছবি উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত ‘চাওয়া পাওয়া’ (১৯৫৯)। এরপর, ‘কাঁচের স্বর্গ’, ‘পলাতক’ ইত্যাদি কিছু ছবি পরিচালনার পর এই গোষ্ঠী ভেঙে যায়।
৫৬. গণনাট্য— ১৯৪১ সালে ‘প্রগতি লেখক সংঘ’ ও ১৯৪২ সালে ‘ফ্যাসীবিরোধী লেখক-শিল্পী সংঘ’ তৈরি হওয়ার পর, নবীন বুদ্ধিজীবীরা বামপন্থী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৪৩ সালের ২৫ মে সাংস্কৃতিক গণসংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’ ওরফে ‘ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন’ (আই.পি.টি. এ) সংস্থার। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, বিনয় রায়, বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, দেবব্রত বিশ্বাস, রবিশংকর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বেরা যোগ দিয়েছিলেন এই সংগঠনে। গান-নাচ-নাটক ইত্যাদির মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে এইসব শিল্পীরা ঘুরে ঘুরে সমাজের নিম্নস্তরের মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেন সেইসব মানুষের হিতকর বার্তা। ৪০ দশকের শেষ থেকে আস্তে আস্তে এইসব বিশিষ্টজন এই সংগঠন ছাড়তে থাকেন।
৫৭. ‘নবান্ন’— বিজন ভট্টাচার্য রচিত তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিকায় এক বিখ্যাত নাটক। ১৯৪৪ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের তরফে শম্ভু মিত্র ও বিজন ভট্টাচার্যের পরিচালনায় প্রথম অভিনীত হয় ‘নবান্ন’। বাংলা নাট্য আন্দোলনে এক দিক-নির্দেশ করে এই নাটক। বলা হয় ‘গ্রুপ থিয়েটার’ ধারণার শুরু এই নাটক থেকেই। যদিও, তা নিয়ে কিছু কথা থেকেই যায়। তবুও, এই নাটক সে যুগে নাট্যধারায় এক নতুনত্বের ছোঁয়া এনেছিল, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। পরে, ‘বহুরূপী’ নাট্যগোষ্ঠী এই নাটক আবারও সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থ করে।
৫৮. কালী বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯২১-১৯৯৩)— এক অসামান্য ক্ষমতাসম্পন্ন অভিনেতা। যেমন মঞ্চে, তেমনি চলচ্চিত্রে। কলকাতার কালীঘাট অঞ্চলে জন্ম। কলেজে পড়াকালীন ‘কেদার রায়’ নাটকে ‘কার্ভালো’ চরিত্রে অভিনয়ে নজর কাড়েন। এরপর, এয়ারফোর্সে যোগ দিয়ে যুদ্ধে যান। প্রথম ১৯৪৫ সালে ‘শ্রীরঙ্গম’ মঞ্চে এক রাত্তিরের জন্য অভিনয় করলেন, ‘তাইতো’ নাটকে। এরপর, মহেন্দ্র গুপ্তর সান্নিধ্যে গিয়ে স্টারে অভিনয় করেন ‘টিপু সুলতান’ সহ কয়েকটি নাটকে। কালীবাবুর প্রথম চিত্রাবতরণ ‘বর্মার পথে’ (১৯৪৭) ছবিতে। বামপন্থী মনোভাবাপন্ন এই অভিনেতা সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন আই.টি.টি.এ-তে। রবীন্দ্রনাথকে কমিউনিস্টদের একাংশ ‘বুর্জোয়া’ কবি বলেছিলেন বলে তার প্রতিবাদে কালী ব্যানার্জীরা মঞ্চস্থ করলেন ‘বিসর্জন’। এরপর, সারাজীবন অজস্র নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন। চলচ্চিত্রজগতে ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘বাদশা’, ‘পরশপাথর’, ‘অযান্ত্রিক’, ‘গুরুদক্ষিণা’ ইত্যাদি অজস্র ছবিতে দেখা গেছে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
৫৯. তাপস সেন— ভারতীয় থিয়েটারজগতে এক যুগন্ধর আলোকশিল্পী। ১৯২৪ সালে জন্ম। থিয়েটারে আলোক প্রক্ষেপণে এক নতুন যুগের সূচনা করেন। ‘রক্তকরবী’, ‘সেতু’, ‘কল্লোল’, ‘অঙ্গার’ থেকে শুরু করে পরবর্তীকালের অনেক নাট্যপ্রযোজনা সমৃদ্ধ হয়েছে তাপস সেনের আসমান আলোকে প্রক্ষেপণে অন্তরঙ্গ আলো নামে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ আছে। তাপসবাবুর পুত্র জয় সেনও একজন থিয়েটারের আলোকশিল্পী। তাপস সেনের স্ত্রী গীতা সেন বাংলা নাট্যসংগীতের একজন গবেষক ছিলেন।
৬০. গীতা— ইনি বিশিষ্ট অভিনেত্রী গীতা সেন। ১৯৩০-এ জন্ম। বেশকিছু নাটকে অভিনয় করেছেন। চলচ্চিত্রজগতে আসেন ১৯৫০ সালে ‘জীবন সৈকতে’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে। এরপর, প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক মৃণাল সেনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। অনেকদিন পরে, গীতা সেন আবার অভিনয় করেন মৃণাল সেন পরিচালিত ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘আকালের সন্ধানে’ ইত্যাদি আরও কয়েকটি ছবিতে। গীতা সেন সম্পর্কে অনুপকুমারের বোন।
৬১. অলকা— ইনি বিশিষ্ট অভিনেত্রী অলকা গঙ্গোপাধ্যায়। ১৯৪৫ সালে জন্ম। কলকাতার সিঁথির আর.বি.টি. স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৭১ সালে ‘জীবন জিজ্ঞাসা’ ছবিতে প্রথম একটি ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করেন। কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে ‘সওদাগর’ নাটকে প্রথম পার্শ্বচরিত্রে ও পরে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন অলকা গাঙ্গুলি। এরপর, বেশ কয়েকটি নাটকে ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। মর্জিনা আবদাল্লা’, ‘নিশিকন্যা’, ‘সংসার সীমান্তে’, ‘স্বীকারোক্তি’, ‘অমরগীতি’, ‘নিষ্কৃতি’ ইত্যাদি অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন অলকা গঙ্গোপাধ্যায়। ১৯৮৬ সালে এনার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন অনুপকুমার।