কথকতার নানা কথা – গৌতম ভদ্র

কথকতার নানা কথা – গৌতম ভদ্র

১ কথকের জন্ম: পাঠ থেকে ‘কথা’

বাংলাদেশে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কথকদের বোলবোলা ছিল বলেই মনে হয়। সুরধুনী কাব্যে গঙ্গা-প্রবাহের যাত্রাপথের সঙ্গে সঙ্গে দীনবন্ধু মিত্র বিখ্যাত জায়গা ও তাদের খ্যাতির কারণ বলছেন। তাঁর মতে, বাঁশবেড়িয়া (বংশবাটি) বা ভাটপাড়ার খ্যাতির পিছনে আছেন শ্রীধর কথক বা রামধন ‘কথকরতন’। অপরপক্ষে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রতিপক্ষদের জব্দ করতে কৃষ্ণহরি শিরোমণি নামে কথক চূড়ামণি সম্পর্কে চালু লোকগল্পকে মোক্ষম অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। গৌড়দেশ-খ্যাত কথকদের জন্ম ও কৃতি এই সময়কালে আবদ্ধ।

‘বাগ্‌জীবন’ বা কথোপজীবীরা মানুষজনকে আনন্দ দিয়ে দুই পয়সা কামাই করে এবং সেইজন্য কর দিতে তারা বাধ্য, কৌটিল্য সেইদিকে সজাগ দৃষ্টি কতকাল আগেই রেখেছিলেন। তবে উনিশ শতকে প্রচলিত দেশজ রীতিতে পুথি তৈরি করে পৌরাণিক আখ্যান বলার চল অষ্টাদশ শতকের আগে চালু ছিল বলে মনে হয় না। উনিশ শতকের, প্রারম্ভে ওয়ার্ড সাহেবের বর্ণনায় স্পষ্ট যে, সকালে মূল গ্রন্থ পাঠ বা পারায়ণ হত। বিকেলে সাধারণের জন্য বাংলায় মূল গ্রন্থের অনুবাদ ও ব্যাখা করতেন যাঁরা ‘কথক’ বলা হত তাঁদেরই। সংস্কৃত ও বাংলা, দুই ভাষার দুই গোত্রের পড়ুয়া: পাঠক ও কথক। ঊনবিংশ শতকের গোড়াতে জয়নারায়ণ ঘোষাল তাঁর ‘করুণা নিধান বিলাসে’ (১৮১১) পাঁচালি, রামায়ণ, তরজা ইত্যাদি অবসর বিনোদনের নানা অনুষ্ঠানের তালিকাতেও কথকতাকে স্থান দিয়েছিলেন।

লোকগ্রাহ্য জনশ্রুতি অনুসারে প্রতিযোগিতার চাপে ভাগবত চিত্তাকর্ষক করতে বাঁকুড়ার সোনামুখীর গদাধর শিরোমণি বঙ্গদেশে কথকতার ঢঙ চালু করেন। অন্ততপক্ষে বাংলা সাহিত্যের আদি ইতিহাসের চটি বইগুলিতে এই কথা বার বার লেখা হয়েছে।

বৈকালে শিরোমণি মহাশয় বেদীতে বসিয়া ভাগবতের কোন কোন স্থান ব্যাখ্যা করিতেন। তিনি উত্তম ব্যাখ্যাতা ছিলেন। অন্যান্য স্থানে তাঁহার ব্যাখ্যা শুনিতে বিস্তর লোক উপস্থিত হইত। কিন্তু ঐ স্থানে অধিক শ্রোতা আসিতেছে না দেখিয়া শিরোমণি মহাশয় তাঁহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। শুনিলেন, নিকটে একস্থানে রামায়ণ গান হইতেছে। শিরোমণি মহাশয় বলিলেন ‘আচ্ছা, সকলকে বলিবে কল্য হইতে আমার নিকট ভাগবত গান শুনিতে পাইবে।’ তিনি যেমন সুপণ্ডিত তেমনি গায়ক ও কবি ছিলেন। রাত্রিতে পরদিনের ব্যাখ্যেয় অংশকে তাঁহার স্বকপোল উদ্ভাবিত কথকতার রীতিতে পরিণত করিয়া রাখিলেন। পরদিন বৈকালে নতুনরীতির কথকতা আরম্ভ করিলেন; চারিদিক হইতে লোক ভাঙ্গিয়া পড়িল। তাঁহার স্বরসংযোগ, বাক্যবিন্যাস, ব্যাখ্যা ও সঙ্গীত পদাবলী শুনিয়া লোকে বিস্মিত ও মোহিত হইল। এইরূপে শিরোমণি মহাশয় প্রতিদিন ধ্রুবচরিত্র, প্রহ্লাদচরিত্র, দক্ষযজ্ঞ, বামনভিক্ষা প্রভৃতি শ্রীমদ্ভাগবতের অংশ সকল ব্যাখ্যা করিতে লাগিলেন। ইহাই কথকতার প্রথম সৃষ্টি।

প্রচলিত এই কাহিনীর সত্য-মিথ্যা নিরূপণ করা শক্ত। কিন্তু গ্রন্থ পাঠের ব্যাখ্যাংশ গীত ও গল্প সংযোগে পুনর্কথনই যে কথকতা এই ধারণা স্পষ্ট। গ্রন্থের পাঠ এই প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হচ্ছে। ওয়ার্ডের সাক্ষ্যও অনুরূপ ধারণাকে সমর্থন করে। পরে দেখব পুথির প্রকরণ বিচারও একই ধরনের সিদ্ধান্তের অনুযায়ী। নির্দিষ্ট স্থান ও পাত্র নিয়ে অবশ্য বিতর্কের সুযোগ থেকে যাবে। স্থানমাহাত্ম্যের ক্ষেত্রে স্মর্তব্য যে পশ্চিমবঙ্গে আজও পেশাদার কথকদের অন্যতম প্রবীণের বাসস্থান হল বাঁকুড়ার সোনামুখি।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধের নামকরা কথক শ্রীধর ও রামধন শিরোমণি। তাঁদের জীবনীর তথ্য বিচার করলে কথক তৈরি হবার একটা ছক পাওয়া যায়। জীবনীগুলি মৃত্যুর পর লিখিত, পারিবারিক আত্মীয়দের কাছ থেকে সরেজমিন তদন্তে সংগৃহীত। ব্যক্তি বিশেষে তথ্যের হেরফের হতে পারে কিন্তু ঊনিশ শতকের আদর্শ কথক চরিত্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সংগৃহীত সাক্ষ্যগুলির ঐতিহাসিক তাৎপর্য অনস্বীকার্য।

১২২৩ সনে বাঁশবেড়িয়াতে এক পণ্ডিত বংশে শ্রীধরের জন্ম। বংশে কথকতা বা ভাগবত পাঠের ধারা ছিল। পিতা রতনকৃষ্ণ শিরোমণি সংস্কৃত চর্চা করতেন। তবে পিতামহ লালচাঁদ শিরোমণি ছিলেন কথক। ছেলেবেলা থেকে শ্রীধর ভাগবত পাঠে দীক্ষা পেয়েছিলেন হুগলির মালিপাড়া গ্রামের রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে। শ্রীধরের ভ্রাতুষ্পুত্র অতুলচরণ ভট্টাচার্যও কথকতাকে পেশা হিসাবে নিয়েছিলেন। অতএব পরম্পরা ছিল, বংশের আবহাওয়ায় শ্রীধর শিক্ষিত হয়েছিলেন। কিন্তু এই পাঠের ঘরানায় শ্রীধর পাঁচালি গানে মেতে উঠলেন। ঘরানার প্রতিভূ জ্যেষ্ঠতাত জীবনকৃষ্ণ শিরোমণি আদৌ তা পছন্দ করলেন না। বিবাদ দেখা দিল। বহরমপুরে শ্রীধর ব্যবসায়ে দু-পয়সা উপার্জনের চেষ্টা করলেন। সেইখানেই তিনি কথক কালীচরণ ভট্টাচার্যের কাছে তালিম নিলেন। তালিম প্রধানত অভিনয়ের, মুখভঙ্গিমার। জীবনীকারের ভাষায়:

কথকতা নাট্য ভাবরসাদির অভিব্যক্তি। কোন অবস্থায় মানুষের কিভাব হইয়া থাকে, কথকতার অঙ্গভঙ্গে বা বাক্যরঙ্গে তাহা বিকশিত করিতে হয়। কথকতা শিক্ষার কালে শ্রীধর কখনো কোন বালকের ও তখনকার সেভাব তুলিয়া লইতেন। আবার কখন বা বৃদ্ধের দন্তহীন মুখের কথার ভাব গ্রহণের জন্য কোন বৃদ্ধের সঙ্গে কথা কহিয়া, নির্নিমেষে তাঁহার রসনার গতিপ্রকৃতি পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করিতেন। সর্ববিধি ভাবাভিব্যক্তির বিকাশ সাধনায় তাহার এমনই সাধনা ছিল। তাই তিনি আদর্শ কথক হইয়াছিলেন।

বর্ণনায় পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, শ্রীধর কথকতার রীতিতে ভাবাভিনয় যোগ করেন, সুরতালে গীত বসান। পাঠ্য কাহিনীর চরিত্রানুযায়ী অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলায় তিনি দক্ষ ছিলেন। নানা বিষয়ে গান লিখেছিলেন। দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল তাঁর গান, নানা লোকের নামে গানগুলো চলে আসে। কথকতার জন্য বিশেষভাবে পদাবলীও লেখেন। আদর্শ কথক গান গাইবেন ও অভিব্যক্তি অনুযায়ী করবেন, তা প্রত্যাশিত। পাঠ থেকে উনিশ শতকীয় কথকতার রূপান্তরের দুটি সূত্র এইভাবে পরিস্ফুট হল।

শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের পিতা রামধনের জীবনী প্রসঙ্গে আমরা আর একটু বেশি খবর পাই। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে তাঁর জন্ম, চব্বিশ পরগণার বারাসত মহকুমায় অবস্থিত খাঁটুরার লব্ধপ্রতিষ্ঠ বড় বাড়িতে রামপ্রাণ বিদ্যাবাচস্পতির তৃতীয় পুত্র রামধন তর্কবাগীশ। রামচন্দ্র ন্যায়বাচস্পতির টোলে কৃতী ছাত্র ছিলেন রামধন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাদের আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বেশ পসার হয়েছিল অথচ রামধনের অবস্থা অনুরূপ ছিল না। শিক্ষক রামরুদ্রের পরামর্শে সুকণ্ঠী ও পণ্ডিত রামধন কথকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নেন, কারণ ‘ইহাতে বিলক্ষণ দুই পয়সা উপার্জনের সম্ভাবনা আছে।’ পণ্ডিতবংশে তিনিই প্রথম কথক কারণ জ্যেষ্ঠ রামরতন সুকণ্ঠী ও বাগ্মী হওয়া সত্ত্বেও কথকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেননি।

কথকতার রীতিতে রামধনও পরিবর্তনের কথা ভেবেছিলেন। ১৮ বছর বয়স থেকে পেশায় নামবার কথা তাঁর মাথায় ঢুকেছিল। কিন্তু প্রতিযোগিতা জোরদার, কৃষ্ণহরি ও গদাধরের রীতিকে টেক্কা দিতে হবে, শুধু মিষ্টি গলার জোরে পার পাওয়া যাবে না। প্রথমে তিনি ভাগবতীয় পণ্ডিতের কাছে পুরাণাদি পাঠ করে ভাগবতের গল্পকে নিজে সাজান এবং নিজস্ব বর্ণনা বা সাট বা চুর্ণী তৈরি করেন। কথকতার রীতিতে আখ্যানের টানে অনুপ্রাসবহুল বর্ণনার টুকরো টুকরো ছক জুড়ে দিলেন।

এরপরে তিনি সঙ্গীতে পারদর্শী চাকদ্বীপের (চাকদহ) নিকটবর্তী নারায়ণপুর গ্রামের পতিত ব্রাহ্মণ ভ্রাতৃদ্বয় রাম-শ্যামের সঙ্গে পরামর্শ করেন ও তাঁদের মতামত চান এবং তাঁরা ‘রামধনের স্বরচিত ভাগবত ও চর্ণিকা শুনিয়া মোহিত হইল।’

তাঁদের উপদেশ মতো রামধন কথকতার রীতিতে দ্বিতীয় অভিযোজন করলেন। শিমূলিয়ার কাঁসারিপাড়ার রাধানাথ দত্তের আনুকূল্যে একজন হিন্দুস্তানি গায়কের কাছে দুই বৎসর সঙ্গীত শিক্ষা করেন ও রাগ-রাগিনীসহ কথকতার আখ্যানে ‘মহাজনী পদাবলী’ যুক্ত করেন। এটা রামধনের ‘প্রণালী’ যাকে উনিশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে ‘অদ্ভুত সৃষ্টি’ বলা হয়েছিল। মনে হয় যে ভাগবত থেকে কথকতার জন্য নির্দিষ্ট আখ্যান বাছা ও লেখা এবং সেই কাহিনীর মাঝে মাঝে পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট গানের বিন্যাসের রীতি রামধনের হাতে পূর্ণ পরিণতি লাভ করেছিল। রামধনের কথকতার এই ধারা তাঁদের পরিবারের কেউ কেউ অনুসরণ করেছিলেন। লোকশ্রুতি অনুসারে কথকতায় উমাকান্তের সহজাত ক্ষমতা ছিল। কিন্তু মাত্র ৩৫ বৎসর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। ভ্রাতুষ্পুত্র ধরণীধর শিরোমণি (১৮১৩-১৮৭৫) কথকতা করতেন। ধরণীধরের পসারের সীমা ছিল না, লক্ষাধিক টাকা আয় করেছিলেন, বর্ধমান রাজসভার কথক ছিলেন তিনি। আবার বঙ্কিমচন্দ্রের বাবা যাদব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতেও তিনি ডাক পেতেন। ধরণীধরের গলা সুরেলা ও পাঠে দক্ষতা ছিল অসাধারণ কিন্তু ‘বিদ্যাসাধ্য’ সেরকম ছিল না, নিষ্ঠাও পিতৃব্যতুল্য নয়। নতুনত্বের জন্য রামধনের পদাবলী বা সাট নানা লোকে ব্যবহার করত। কিন্তু ধরণীধরের রচনায় সেইরকম কোনও অভিনবত্ব ছিল না। চরিত্রদোষও নাকি ছিল। কিন্তু কথকতার অতুলনীয় গলাতেই তিনি আসর মাত করতেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর স্মৃতিতে সেই ছবি ধরা পড়েছে।

ধরণী কথক মহাশয় খুব ভালো কথা কহিতেন তাঁহার সুমিষ্ট অথচ গম্ভীর উচ্চ স্বরে প্রথম হইতেই আসর গম গম করিত। কিন্তু তিনি যখন হাঁ করিয়া গালের কাছে হাত আনিয়া ধরিতেন, তখন সমস্ত লোক মুগ্ধ হইয়া যাইত। আমরা তখন গানের কি বুঝি? কিন্তু এখনো সে সুর কানে লাগিয়ে আছে।১০

চূর্ণী বা সাট তৈরি, গান রচনায় দক্ষতা ইত্যাদি নানা প্রকরণে রামধনী রীতি ও শৈলী গড়ে ওঠে।

ধরণীধর শিষ্য-প্রশিষ্য সৃষ্টি করেন। ঝোঁক ভাগবতী কাহিনীতে। অপরপক্ষে রাঢ় অঞ্চলে গদাধরী রীতি চালু ছিল। জোর দেওয়া হয়েছিল রামায়ণী কথকতায়। অন্যান্য অঞ্চলেও কথকতার নিজস্ব রীতি গড়ে উঠেছিল। যেমন কথকতার শিক্ষকরূপে উদ্ধব চূড়ামণির নামডাক ছিল। হাওড়ার বাগনান বা হুগলির ধনিয়াখালিতে তাঁর জন্ম হয়। হাটখোলার ভৈরবচন্দ্র বিদ্যালঙ্কারের টোলে তিনি পড়েন এবং পণ্ডিত রঘুনাথ শিরোমণির কাছে পাঠের শিক্ষা নেন। চন্দননগরে রঘুনাথ শিরোমণির টোল ছিল। প্রথম জীবনে রঘুনাথ গুণ্ডিয়াতে ও বরানগরে ব্যাকরণ পড়াতেন। পরে গোন্দলপাড়া নিবাসী গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের মাতার আগ্রহে চন্দননগরে বাস করতে শুরু করেন। দক্ষিণেশ্বরে তাঁর কথকতার আসর বসত। উদ্ধব চূড়ামণি তাঁর শ্রেষ্ঠ ছাত্র। এই উদ্ধব ঠাকুরেরই ছাত্র মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৩২০ সালে উদ্ধবের মৃত্যু হয়। রঘুনাথ শিরোমণির পুত্র রামনাথ চট্টোপাধ্যায়ও যশস্বী কথক ছিলেন। ১৩৩১ সালে তিনি জীবিত, চন্দননগরে বাস করেছেন এবং হুগলির অগ্রগণ্য কথক। সঙ্গে সঙ্গে টপ্পা গেয়েও তিনি আসর জমাতেন।১১

পূর্ববঙ্গের কথকদের মধ্যে কৃষ্ণকান্ত পাঠকের বেশ নামডাক ছিল। ১২২৮ বঙ্গাব্দে ফরিদপুর জেলার কাসাভোগে তাঁর জন্ম ও ১২৯৮ বঙ্গাব্দে মৃত্যু হয়। ৭০ বৎসর বয়স পর্যন্ত তিনি গান তৈরি করেছিলেন ও দাপটে গান গাইতেন। ঢাকা জেলার বিক্রমপুর ফুরশাইল বা ফুল্লশালী গ্রামের কালাচাঁদ বিদ্যালঙ্কারের খ্যাতি ছিল অভিনব আখ্যান ও শ্লোক ব্যাখ্যায়। ভাগবতের কাহিনীর তাক লাগানো ব্যাখ্যা করতেন তিনি। অঞ্চলে ‘কিশোরী ভজন’ সম্প্রদায়ও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন, ভক্তরা তাঁর নিজস্ব পাঠ ও ব্যাখ্যাকে মান্য করত। উনিশ শতকে কথক হিসাবে ধর্মসম্প্রদায় তৈরি করার কৃতিত্ব তাঁর।১২

কথকদের রাজত্বে পুরুষদেরই আধিপত্য ছিল। দ্বারকানাথের আমলে ঠাকুরবাড়িতে নিয়মিত এক জন বৈষ্ণব ঠাকুরানি আসতেন। এ প্রসঙ্গে স্বর্ণকুমারী দেবীর সাক্ষ্য:

সংস্কৃত বিদ্যায় ইহার যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি ছিল অতএব বাঙ্গালা ভাল জানিতেন ইহা বলা বাহুল্য। উপরন্তু ইহার চমৎকার বর্ণনাশক্তি ছিল, কথকতা-ক্ষমতায় ইনি সকলকে মোহিত করিতেন। যাঁহাদের বিদ্যালাভের ইচ্ছা নাও বা থাকিত, তাঁহারও বৈষ্ণবী ঠাকুরাণীর দেবদেবী বর্ণনা, প্রভাত বর্ণনা, শুনিতে কুতূহলী হইয়া পাঠগৃহে সমাগত হইতেন।১৩

বৈষ্ণবী ঠাকুরানি অন্তঃপুরে বৈঠকী কথকতা করতেন। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ও বিপিন পালের লেখা থেকে জানা যায় যে বৃন্দাবনে একজন বাঙালি মহিলা আসরে ভাগবত পাঠ করতেন। তাঁর ব্যাখ্যা ও পাঠ শুনতে জনসমাগমও হত। বিংশ শতকের গোড়ায় হাওড়ার আমতা অঞ্চলের রামচন্দ্রপুর গ্রামে কলকাতা থেকে একজন পেশাদার গায়িকা এসে কয়েকদিন ধরে ভাগবত পাঠ করেছিলেন।১৪ কিন্তু পুরুষ কথকদের নাম জানলেও মহিলা কথক ও পাঠকদের নাম ধাম কোনও কিছুই জানা যায় না। সভায় পেশাদার মহিলা কথক হিসাবে এই শতকে চন্দননগরের ক্ষান্তিলতা দেবীই বোধ হয় প্রথম। পরে কোন্নগরের বাসন্তী দেবী, কৃষ্ণা বকসী প্রমুখ বিদূষী মহিলারা আসরে পাঠ ও কথকতা করে সুনাম অর্জন করেছেন। কথকতায় পরিবার ও পরম্পরার কথা ঘুরে ফিরে আসছে। দেখা যায় যে কথকতার রবরবার যুগে কথকতার শিক্ষক হিসাবে কয়েকজন নাম করেছেন। অধিকাংশই ব্রাহ্মণ, পরন্তু কথকতা বৈষ্ণবদের একচেটিয়া। শাক্ত সাধনার ধারায় পেশাদার কথক হিসাবে কাউকে দেখা যাচ্ছে না।১৫ ডাকসাইটে কথকদের সবাই পণ্ডিত, সংস্কৃতে কিছু না কিছু অধিকার সকলেরই আছে। তবে সংখ্যায় অল্প হলেও কিন্তু অন্য ধরনের কিছু কথকেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। অষ্টাদশ শতকে মেদিনীপুরের হরিহরপুর গ্রামে ভরদ্বাজ গোত্রের দে বংশীয় কায়স্থ ছিলেন দুঃখী শ্যামদাস। সংস্কৃত জানতেন না। ভাগবতের পাঠ শুনে নিজেই পাঠ ও গাইবার উদ্দেশ্যে গোবিন্দ মঙ্গলকাব্য লেখেন এবং সেই গ্রন্থটি তার পরিবারে পূজিত হয়। পাঠক ও গায়ক হিসাবে তাঁরা গুরুবংশ, অধিকারী পদে সম্বোধিত। শিষ্যরা প্রায়শই নিম্নবর্ণের। গ্রামে গ্রামে ঘুরে গ্রন্থ পাঠ করা শ্যামদাসের (আমৃত্যু ১৭৮৩) জীবিকা ছিল, গেয় গ্রন্থে আখ্যান তাঁরই সৃষ্টি।১৬

আধুনিককালে শান্তিনিকেতনের ভুবনডাঙা নিবাসী অবনী অধিকারী অনুরূপ আরেকটি চরিত্র। জাতে শূদ্র, আদি নিবাস বীরভূমের থানা মেজিয়া, গ্রাম রাইডিহি। পূর্বপুরুষ রামদুর্লভ অধিকারী ও মাঘা রাম অধিকারী রামায়ণ গান গাইতেন, নিজেদের দল ছিল। তিনি নিজে পড়েছেন অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। পরে গানের দলে পাচকের কাজ করেন, সঙ্গে সঙ্গে বাজনা বাজাতে শিখলেন। দাদা কানাই অধিকারী প্রধান গুরু, তাঁর কাছ থেকে পালা তৈরি করার কায়দা অবনী আয়ত্ত করেন।১৭ শ্যামদাস ভাগবতী গাইতেন। অবনী গান রামায়ণী।

কিন্তু শ্যামদাস বা অবনীর পরম্পরাতেও পরিবারগত শিক্ষানবিশির চিহ্ন আছে। অবশ্য একক প্রচেষ্টাতে কথক হয়ে ওঠার নিদর্শন পাওয়া যায়। শিবপুরের লব্ধপ্রতিষ্ঠ মুন্সেফ বসন্তকুমার পাল-এর বিশেষ পরিচিত ছিলেন রানাঘাটের মাঝের গ্রামের বাসিন্দা উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। গলা খুব ভাল, গান গাইতেন। হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত জজ রমেশবাবু [সেনের?] আনুকূল্যে তার ভাই পাখোয়াজবাদক কেশববাবুর কাছে সংগীতে কিছুটা শিক্ষা নেন। পরে কথকতা করাটাই পেশা হিসাবে বেছে নেন। রমেশবাবুর সুপারিশে প্রেসিডেন্সি কলেজের নীলমণি পণ্ডিতের কাছে কিছুটা সংস্কৃতও শেখেন। ভাল কথক হবার অন্যতম প্রাকশর্ত ভাল সংস্কৃত জানা। ১৮৯৫ সন নাগাদ ঢাকায় তিনি বসন্তবাবুর পরিবারে আশ্রয় নেন এবং নতুন পেশায় হাতে-কলমে নেমে পড়েন। ঢাকার উকিল ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষ দুর্ঘটনায় বিপর্যস্ত, তাঁদের বাড়িতেই আসর বসানোর বন্দোবস্ত হল। বসন্তবাবুর তত্ত্বাবধানে ও উৎসাহে উপেন্দ্রনাথ কথক হিসাবে জীবন শুরু করলেন।১৮

সংস্কৃতে খুব বড় পণ্ডিত না হোলেও গলাটি ছিল অতি মধুর, তাই যত সময়োচিত গান বেশী হয়, তার জন্যে আমি তাঁকে অনুরোধ করি, কারণ তাহাতেই লোক বেশী আকৃষ্ট হবে।

আমি তখন বেকার বসে থাকি—সমস্ত দুপুরবেলা কথক মহাশয়ের রিহারসেল দেওয়া—কথকতার মহলা শুনতাম, আর যেখানে পরিবর্তন করলে ভাল মনে লাগত তা তাঁকে বলে দিতাম। সন্ধ্যা থেকে আরম্ভ হয়ে ৩/৪ ঘণ্টা পাঠ হতো সহরের গণ্যমান প্রায় সকলেই আসতেন, স্বামীজীও এসে বসতেন। চির প্রথামত দুই চারটি সংস্কৃত পদাবলী না গাইলে নয়, প্রচুর বাংলা গান, অমনকি আধুনিক গানও সময়মত লাগিয়ে দিতেন তাতে সকলের আরো মনোরঞ্জন করতেন। এক মাস সেখানে কথকতা হয়েছিল সকলেই বেশ খুশি হয়েছিলেন ব্রাহ্মণের প্রাপ্তিও আশাতীত হয়।

উপেনী কথকতা স্পষ্টতই পরম্পরা বহির্ভূত, রামধনী বা গদাধরের রীতির সঙ্গে বড় একটা মিল নেই। কিন্তু জমাটি গানের জোরে তাঁর বেশ পসার হয়েছিল। বর্ধমান রাজবাড়িতেও ‘বাঁধা বেদি’ পেয়েছিলেন। ১৯১৪ সালে অসুখে তাঁর কণ্ঠস্বর নষ্ট হয়, কথকতার পেশাও তিনি আর করতে পারেন না। উনিশ শতকের শেষে উপেনী কথকতার ঢঙ ঐতিহ্যানুসারী রীতি তরলীকরণের নিদর্শন। এই রীতির বিরুদ্ধে এই সময় প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।১৯ কথকতা ও পাঠের ধারায় তৃতীয় প্রতিসরণ আসে। যদি গদাধর প্রথম এবং রামধন ও শ্রীধর দ্বিতীয় প্রতিসরণের জনক হন, তবে তৃতীয় রীতির উদ্ভাবক হলেন প্রভুপাদ অতুলকৃষ্ণ গোস্বামী (১৮৬৬-১৯৪৪) ও তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্যরা। প্রথমত, উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজে একটি সংগঠিত আন্দোলন শুরু হয়। নিখুঁত সম্পাদনাসহ বৈষ্ণব গ্রন্থ মুদ্রণ, বিধিবদ্ধ নিময় প্রবর্তন ইত্যাদি পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রভুপাদ অতুলকৃষ্ণ গোস্বামী নানা স্থানে ‘হরিসভা’ প্রতিষ্ঠিত করতে লাগলেন ও শ্রীপাটগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে যত্নবান হলেন। ভাগবত পাঠ ও কাহিনী বর্ণনা, বৈষ্ণব মহোৎসবের আয়োজন করা ইত্যাদি হরিসভাগুলির নিত্যকর্ম ছিল।

গ্রন্থাগার স্থাপন করাও শুরু হল। অন্যত্র নানা বৈষ্ণব ‘উপসম্প্রদায়ের’ উপর আক্রমণ চলল, গৌড়ীয় বৈষ্ণবসম্প্রদায়ের মতানুগ ‘নিষ্কলুষ’ ‘শাস্ত্রসম্মত’ ব্যাখ্যার জন্য গোস্বামীরা একজোট হলেন, হাত মেলালেন বিমানবিহারী মজুমদারের মতো সুপণ্ডিত।২০ এই প্রেক্ষাপটে গৌড়ীয় সম্মিলনীর (১৪ বৈশাখ, ১৩৩৮ সন) উদ্যোগে প্রচলিত কথকতা ও পাঠ-রীতিকে সংশোধিত করার কথাও ভাবা হয়। দীনেশচন্দ্র সেনের সহযোগিতায় প্রভুপাদ অতুলকৃষ্ণ কীর্তন ও কথকতাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমের অন্তর্গতও করতে চেয়েছিলেন; পরীক্ষা নেবার ও ডিগ্রি দেবার কথা ভেবেছিলেন।২১

দ্বিতীয়ত, এই আন্দোলনে পাশ্চাত্য শিক্ষিত পণ্ডিতরা অংশ নিলেন। টোলে পড়া সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের জায়গায় এলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিত, অধ্যাপনা পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিরা। ঢাকার প্রভুপাদ প্রাণকিশোর গোস্বামী (১৮৯৯-১৯৮০) এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পূর্ব বাংলার মফস্বলে বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের মাধ্যম হিসাবে পাঠ ও কথকতাকে তিনি ব্যবহার করেন। কৃতী ছাত্র অধ্যাপকরূপে তখন ননী ঠাকুরের নামডাক ছিল।২২ পাশ্চাত্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত কথক ও পাঠকদের ধারা বৈষ্ণব সম্মিলনী আন্দোলনের সময় থেকে শুরু হয়। আধুনিককালে অধ্যাপিকা বাসন্তী চৌধুরী এই রীতির পদাঙ্কানুসারী।

প্রভুপাদ অতুলকৃষ্ণ গোস্বামীর জন্ম নিত্যানন্দ বংশে। পাঠ ও কথকতার আবহাওয়ায় তিনি মানুষ হয়েছেন। পিতা মহেন্দ্রনাথ গোস্বামী স্বয়ং যশস্বী পাঠক ছিলেন। চাকরি ছেড়ে পাঠকতা তাঁর পেশা হয়। কাঁসারিপাড়ার তারকনাথ প্রামানিকের বাড়িতে কথকতা, পাঠ, কীর্তন লেগেই থাকত এবং সেই বাড়িতে অতুলকৃষ্ণের নিত্য যাতায়াত ছিল। কিন্তু নীলকান্ত গোস্বামীর ব্যাখ্যাই তাঁকে অভিভূত করত। ঘটনাচক্রে পাটনার বাঁকিপুরে মথুরবর্মনের বাড়িতে তাঁকে একটি অনুষ্ঠানে ব্যাসাসনে বসতে হয় ও স্মৃতির উপরে নির্ভর করে ‘ধর্মঃ প্রোজ্বিত’ (ভাগবত, ১ম স্কন্ধ, ১ম অধ্যায়) শ্লোকের ব্যাখ্যা নীলকান্ত গোস্বামীর অনুসরণে প্রদান করেন। ‘পুঁজির ভিতর একটি মাত্র শ্লোক।’ তবুও সেই দিনের প্রশংসা ও বাহবা যুবক অতুলকৃষ্ণকে পাঠক হিসাবে আবির্ভূত হতে প্রণোদিত করে। ডাকও আসতে লাগল, কারণ ‘গোঁসাইয়ের ছেলে, ভাগবত জানে না, এ কখন হতে পারে!’ নানা অন্য খেয়ালে অতুলকৃষ্ণ ছেলেবেলায় মত্ত ছিলেন। গুরু বংশের এই দায়িত্বে তাঁর, সেই অর্থে, শিক্ষা ছিল না, জানতেন মাত্র একটি শ্লোকই। তাই দিয়ে কতদিন চালানো যায়! কিন্তু অবস্থা বেগতিক। এ প্রসঙ্গে অতুলকৃষ্ণের নিজের জবানি শোনা যাক:

মনসাতলাগলির ৮ নং দর্প নারায়ণ ঠাকুরের স্ট্রীট। ৺গয়া প্রসাদ মল্লিক বাবার শিষ্য। তাঁহার স্ত্রীর ইচ্ছা হইল—নিয়মসেবার সময় একটু করিয়া ভাগবত শুনেন। আমাকে অনুরোধ করায় রাজি হইলাম। দশম স্কন্ধ পাঠ আরম্ভ হইল। পাঠের শেষে তাঁহারা একটু ব্যাখ্যা শুনিবার আবদার করিলেন। তাহাও পূর্ণ করিতে হইল। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করিয়া ব্যাখ্যার উপকরণ সংগ্রহ করিতে লাগিলাম। রাত্রে নীলকান্ত গোস্বামী মহাশয়ের ব্যাখ্যা এখানে ওখানে শুনিয়া বেড়াইতে ও বেদান্ত আলোচনা করিতে লাগিলাম। আমার ব্যাখ্যা সকলের পছন্দসই হইতে লাগিল। কিছু টাকাও পাইতে লাগিলাম। উৎসাহ খুব বাড়িয়া যাইতে লাগিল। এইরূপে আমি ক্রমশ এক জন ব্যাখ্যাতা হইয়া পড়িলাম।২৩

ছেলেবেলায় বখাটে ছেলে অতুলকৃষ্ণ ধীরে ধীরে বংশগত পেশায় ফিরে এলেন। ভূদেব কবিরত্নের অনুরোধে ও যোগেন্দ্রনাথ কবিরাজ প্রমুখ পণ্ডিতদের উপস্থিতিতে ১৩০১ সনে অতুলকৃষ্ণ রামকানাই অধিকারীর ঠাকুরবাড়িতে হরিসভার সাংবাৎসরিক উৎসবে ‘যমলাৰ্জুন ভঞ্জন’ ব্যাখ্যা করলেন, শিষ্যবাড়ির আঙিনা ছাড়িয়ে এতদিনে সভাসমিতিতে অতুলকৃষ্ণ তাঁর স্বীকৃতি পেলেন, নিজস্ব রীতিও উদ্ভব করলেন। প্রচলিত পাঠ ও কথকতার রীতি থেকে তা ভিন্ন। হরিসভা আন্দোলন গড়ে ওঠার সময় ঢাকা জেলার বুধনী গ্রামের প্রাণগোপাল গোস্বামী তাঁর সহযোগী হন। অতুলকৃষ্ণের তালিমে সতেজ কণ্ঠের অধিকারী প্রাণগোপাল হরিসভার আসরে পাঠের এই রীতিকে প্রতিষ্ঠিত করায় সচেষ্ট হলেন। প্রাণকিশোর প্রাচীনের সঙ্গে নতুন ও প্রচলিত রীতির সুন্দর তুলনা টেনে লিখেছেন:

সেই প্রাচীন কথকরা দিনের পর দিন ভাগবতীয় প্রসঙ্গ লইয়া কথকতা করিতেন। এই কথকতার রীতি ব্যাখ্যা-রীতি হইতে সম্পূর্ণ পৃথক ধরনের। কথকেরা গান গাহিতেন, অঙ্গভঙ্গি করিতেন, অযথা প্রায়শঃ রসিকতার অবতারণা করিতেন, পুরাণকথা অবলম্বন করিয়া বিচিত্র উপন্যাস সৃষ্টি করিতেন, শুধু তাহাই নয় এক পুরাণের কথায় বহু পুরাণের কথা ও দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করিয়া কখনও বা ভাষার ছটায় কখনও বা গুরু গৌরবকণ্ঠের গাম্ভীর্যে পুরাণ কথাকে একটি অভিনয়ের পর্যায়ে নিয়া ফেলিতেন। গীতিনাট্যের মত এই কথকতা আগাগোড়া ধারাবাহিক সঙ্গীতের মতই মনে হইত। কথকগণের কথকতায় নানা রাগ-রাগিনীর আলাপ হইত—কখনও কখনও বা প্রাণগলানো কীর্তন আবার কখনও বা হাসির ফোয়ারা ছুটিত শ্রোতৃবৃন্দের মহলে। প্রাণগোপাল প্রভু পাঠ আরম্ভ করিলেন পূর্বাচার্যগণের ব্যাখ্যা টীকার মাধুর্য পরিবেশন রীতিকে অবলম্বন করিয়া। শ্রীরূপসনাতন শ্রীজীব ভাগবতের ব্যাখ্যায় যে সিদ্ধান্ত সম্পুটিত করিয়াছেন, শ্রীপাদ বিশ্বনাথ যে রসবিন্যাস পরিপাটী দেখাইয়াছেন, সেই সকল বিষয় হইল প্রাণগোপালের পাঠের মূল উপাদান। এই অভিনব রীতি প্রদর্শনে শ্রোতাদের চমক লাগিল, ভাবুকের ভাব উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল, ভক্তের প্রাণ গলিয়া গেল আর সর্বসাধারণের মনে ভাগবতের মহিমা প্রসারলাভ করিল দ্রুতগতিতে।২৪

প্রাণকিশোরও এই রীতিভুক্ত। কথকতার আদর্শ সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব বক্তব্য:

যে যত আবোলতাবোল বলতে পারবে সেই-ই তত ভালো কথক হে।…এখন ছাপা বই থেকে কিছু টুকে নিলে আর নিজের মনোমত কতগুলো গান ছড়া, রচনায় একটু রঙ্গরস জমাতে পারলেই হল। কাজেই গান আর গল্পই হয় কথকতার প্রধানতম অঙ্গ। যথার্থ শাস্ত্র তাৎপর্য, সে পড়ে থাকে অনেকটা পশ্চাতে। যারা নিছক শাস্ত্র কথা নিয়ে এ বাজারে নামবে তাদের জমায়েত ঘটাতে একটু বেগ পেতেই হবে।২৫

আসলে অতুলকৃষ্ণ, প্রাণগোপাল ও প্রাণকিশোর ফিরতে চেয়েছিলেন তত্ত্বসমালোচনায়। কথকতার দুটি মেরু আছে, শ্রোতাদের চিত্ত বিনোদন এবং ভাব ও তত্ত্বের ব্যাখ্যা। লোক মনোরঞ্জনের জন্য কথার সুকুমার বিন্যাস কথকরা করতেন। কিন্তু উনিশ শতকের প্রান্তে সংস্কারবাদী ভাগবতী পণ্ডিতদের মনে হল যে এই বিন্যাসে তত্ত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। কথকতাটা তো কাব্য নয়; তার উদ্দেশ্য ধর্মপ্রচার, শুকদেব পরীক্ষিৎকে যেভাবে পরকালের পথ চিনিয়েছিলেন। তাঁরা গদ্য বিন্যাসকে মেনে নিলেন, টীকা অনুমোদিত পাঠে নিজেদের বিন্যাস আনলেন। সংস্কৃত ভাষাকে পরিহার করে টুকরো টুকরো ছোট বাক্যে কথা সাজালেন। কিন্তু উদ্দেশ্য কথকতার বিন্যাসকে তত্ত্ব আলোচনার কাঠামোয় আনা। উদাহরণ দেওয়া হল কোনও গভীর তত্ত্বের অনুষঙ্গে, গল্পও বলা হল সেই প্রসঙ্গে। গল্পের অনুঙ্গে তত্ত্ব এল না। প্রাণকিশোর ঘরোয়া ধরনের সংলাপে তত্ত্ব ব্যাখ্যা করার রীতি নিলেন, জীবের ব্রহ্মসাযুজ্য দেখাতে গিয়ে বললেন:

‘তেল সলতে যতক্ষণ আছে, প্রদীপ জ্বলিতেছে। কামকামনা আছে। জীব একযোনি হতে অন্য যোনিতে চলিতেছে। তেল সলতে গেল, প্রদীপ নির্বাপিত।’২৬

পাঠের এই রীতি বরানগরের পাঠবাড়ির কেদারনাথ রায় কাব্যপুরাণ—ব্যাকরণতীর্থও নিয়েছিলেন। তাঁর ভাষণ বিন্যাস চিরাচরিত আখ্যান অনুযায়ী নয়, বরং তত্ত্ব অনুযায়ী, সমস্যা অনুযায়ী। যেমন—গুরুতত্ত্ব, জীবস্বরূপ ইত্যাদি। সমস্যা তোলা হয়েছে, ভাগবতে ভক্ত চরিতের প্রবেশ কেন? উত্তর দিতে লৌকিক উদাহরণ টানা হল:

চিকিৎসক যখন রোগী দেখেন, তখন রোগ সম্পূর্ণ না হলে শক্ত জিনিশ খেতে দেন না। তরল জিনিশ খাইয়ে রাখেন, ক্ষুধা বাড়লে ধীরে ধীরে শক্ত জিনিশ খেতে দেন। শিশু ভূমিষ্ঠ হলেই তার অন্নপ্রাশন হয় না। ছ মাস দুধ খাইয়ে অন্ন হজমের পাকস্থলী তৈরী করা হয়। তারপর অন্নভক্ষণ। তেমনি করেই শুকদেব পরীক্ষিতের কৃষ্ণতৃষ্ণা জাগাবার জন্য ভক্তচরিত বলেছেন।২৭

এই পাঠেও বক্তার নিজস্ব বিন্যাস আছে, ক্রম তিনিও অনুসরণ করেছেন। কিন্তু স্বর গীতি বা নাটিকার প্রবন্ধে গ্রন্থনা নেই, বরং তত্ত্ব প্রচারের বন্ধনে আবদ্ধ।

আসলে পাঠক ও কথকের মধ্যে, তত্ত্ব বিন্যাস ও গল্পের দাবির মধ্যে টানাটানি, কামড়াকামড়ি আছে। রামধনের জীবনের দুটি প্রচলিত কাহিনীতে এই টানাপোড়েন সুস্পষ্ট। পাঠক বা পণ্ডিতরা যে জনপ্রিয় কথকদের সবসময় খুব পাত্তা দিতেন, তা নয়। প্রচলিত লোক কাহিনী অনুসারে রামধনের জীবনে এই রকম অভিজ্ঞতা বার বার হয়েছে। ঊনিশ শতকের ধনিয়াখালি ছিল পাঠক ও কথকদের বড় আড্ডা। এক সভায় এক দিন রামধন বেদিতে বসে ভাগবত ব্যাখ্যা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে ‘পাঠক মহাশয় প্রত্যাখ্যান করিয়া বলিলেন যে কথকতা করাই কথকের কর্তব্য; কথক কর্তৃক ভাগবত ব্যাখ্যা করিবার প্রয়োজন নাই।’ সে দিনের শাস্ত্র আলোচনায় পরাস্ত রামধন কাশীতে বেদ ও বেদান্ত অধ্যয়ন করে তাঁর জ্ঞানের খামতি পূর্ণ করেন। আবার আর একবার রামধনের কথকতা শুনে ভট্টপল্লীবাসী পণ্ডিতগণ ‘রামধন লেখাপড়ায় জল দিয়াছেন বলিয়া ব্যঙ্গ করেন।’ প্রত্যুত্তরে রামধন সংস্কৃতে আলোচনা শুরু করেন। পুরুষরা তুষ্ট হলেও মেয়েরা এক বর্ণ কিছু বুঝল না। ‘তখন রামধন পুনরায় সাধুভাষায় কথা কহিয়া ভট্টপল্লীবাসিনী বামাগণকে পরিতৃপ্ত করিয়া স্বকীয় বাসভবনে প্রত্যাগত হইলেন।’২৮

কথকতা আখ্যানমূলক। কথাকাহিনী ও সঙ্গীতে বিধৃত পাঠে এই সব থাকতে পারে কিন্তু তা বিধিমার্গে আবদ্ধ, তত্ত্ব আলোচনা ও সমস্যা নিরসন পাঠকের উদ্দেশ্য। পাঠ একটি ওজনে বাঁধা, সেখানে হালকা হবার জো নেই। কথকতা এবং পাঠে নিজস্ব বিন্যাস বিংশ শতকে সবাই করেন কিন্তু স্বর ও কাঠামোতে থেকে যায় বেশ কিছু ফারাক। প্রকরণ বিচারের সময় এই শাস্ত্রে আবার ফিরে আসব।

২ কথকতার পেশা: পোষ্টা ও প্রণামী

কীর্তন বা রামায়ণী গানের দল থাকে, কথক বা পাঠক একই অনুষ্ঠান জমান। কিন্তু দুটোই পেশা, দুটোর জন্য প্রতিযোগিতা আছে, দুটোর পোষ্টা দরকার। সমাজের অবয়বে রদবদলের সঙ্গে সঙ্গে পোষ্টাও বদলে যায়। জমিদার পরিবাররা কথকদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিল। কিছু কিছু জমিদারিরবাড়ির বাঁধা কথক ও পাঠক থাকত। বিক্রমপুরের তেলিরবাগের ভূঁইঞারা যখন বসতি স্থাপন করেছিলেন তখন ‘বৃত্তি’ বা চাকরান জমি দিয়ে গ্রামে লোক বসিয়েছিলেন—যেমন, নাপিত, ধোপা, ভূঁইমালি ইত্যাদি। এদের সঙ্গে নিয়ে আসা হয়েছিল সংস্কৃতজ্ঞ গোলকচন্দ্র চক্রবর্তীকে। বাবুদের বাড়িতে কথকতা ও পাঠ করা তাঁর কাজ। গ্রামে তাঁর ভিটাকে সবাই পাঠবাড়ি বলত। রামকৃষ্ণ পরমহংসের কাছে বরানগর থেকে আসতেন যুবক নারায়ণদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, কথকতা ছিল তাঁর পেশা। সেই সূত্রে বেলঘরিয়ার জয়নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে দেবোত্তর জমি দেন এবং বরানগরের কুঠিঘাটে তাঁর বসতবাটি সেই ভূখণ্ডের উপরে আজও আছে।২৯ হুগলির রাধানগরের জমিদার তীর্থভ্রমণ প্রণেতা যদুনাথ সর্বাধিকারীর প্রত্যেকদিন সান্ধ্য আসরে নিয়মিত হাজিরা দিতেন গ্রামের পাঠক ও কথক গোপাল চূড়ামণি। প্রত্যেকদিন অনেক রাত্রি পর্যন্ত ভাগবতের পাঠ হত। কিন্তু কার্তিক মাসে বিশেষ উৎসব উপলক্ষে গোঁসাই মালপাড়া গ্রাম থেকে একজন গোস্বামী আসতেন। ঠাকুর দালানে সমস্ত কার্তিক মাস ধরে সকালে ভাগবত পাঠ ও ব্যাখ্যা এবং অপরাহ্নে কথকতা হত। জমিদার বাড়িতে এই সময় পাঠ করার জন্য তাঁর আসর বাঁধা থাকত।৩০ কথা ব্যবসায়ী হিসাবে ঢাকা জেলার সাভার নিবাসী ভারতচন্দ্র রায় ত্রিপুরার রাজসভায় নিয়োজিত ছিলেন। তার মাসিক বেতন ছিল ৬০্‌। তবে দীনেশচন্দ্র সেনের বর্ণনা থেকে মনে হয় যে ভারতচন্দ্র ঠিক কথক নয়, গল্প বলিয়ে ছিলেন।৩১ লক্ষ করার বিষয়, ছেলের গানের খ্যাতির খবর শোভাবাজারের রাজবাড়িতে অনুষ্ঠিত এক কথকতার আসরে নিধুবাবুর মা শুনেছিলেন।৩২ নানা উপলক্ষে এই রকম আসর বসত। শ্রাদ্ধ ইত্যাদি দশকর্মাদিও উপলক্ষ হতে পারত, তীর্থভ্রমণ সমাপ্তি শেষেও গিন্নিমা আসর বসাতে পারতেন। আবার ব্রত উদযাপন সংকল্পে ও পারিবারিক বিপর্যয়ে মনে শান্তি পাবার জন্য কথকদের ডাকা হত। কথকরা আসতেন। দোল, রাস ইত্যাদি বাৎসরিক উৎসবেও কথকদের ডাক পড়ত। তবে পুরাণ পাঠ ও কথকতার নাকি উৎকৃষ্ট সময় ছিল অন্তৰ্জলি যাত্রা। মৃত্যুর প্রাকমুহূর্তে শুকদেব পরীক্ষিৎকে ভাগবত পাঠ ও ব্যাখ্যা করে শুনিয়েছিলেন। তাই কৃষ্ণমোহন শিরোমণি বা কৃষ্ণহরি কথক গঙ্গাতটে ওইরকম কথকতার আসরে দানগ্রহণ পর্যন্ত করতেন না।৩৩

সময়মাফিক আসর নানা রকম হতে পারত: বৈঠকী আসর, একদিনের কথা বা মাসাধিক পাঠ। আয়োজন বা দক্ষিণাও সেই অনুযায়ী হত। কথকদের অবশ্য আসর পাবার জন্য চুক্তি করতে হত, চুক্তির খেলাপ হলে আসর হাত ছাড়া হবার সম্ভাবনা ছিল। তাই ‘দেহকৃৎ ঠাকুরকে’ (পিতাকে) বীরভূমের সেবক ঈশ্বরচন্দ্র দেবশর্মা লিখছেন—

সাঁখপুর হইতে মনুষ্য আসিতেছে ৪ রোজ জৈষ্ঠ না জয়া হইলে জবাব হইবে দ্বিতীয় কথক আসিবে অতএব ৩ রোজ জৈষ্ঠ সাঁখপুরে মোকাম জাইতে হইবেক জানিবেন…পুনুছ নিবেদন কুনুক মোতে ওজর না হয় তাহা করিবেন সে স্থানেতে দিন দুয় কথা কহিয়ে আসিবেন য়াধিক কি লিখিব।৩৪

জমিদার ছাড়াও গ্রামে উঠতি সম্পন্ন গৃহস্থরা কথকদের বেশ বড় পৃষ্ঠপোষক ছিল। উনিশ শতকে নানা জাতি সমাজে মর্যাদা লাভে সচেষ্ট হয়েছিল। উন্নতিকামী ‘নবশাখ’ গোষ্ঠীরা বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেছিল। নানা উপলক্ষে তাঁরা কথকতার আসর বসাতেন। এই পরিস্থিতিতে রামধন তর্কবাগীশ কথকতার পেশায় ঢুকে পড়ার সুযোগ পান। খাঁটুরার সিদ্ধিরাম রক্ষিত জাতে তাম্বুলি, দালালির কাজে বেশ কিছু উপার্জন করেন। পাঁচ টাকা বায়না নিয়েও শেষপর্যন্ত গদাধর শিরোমণি তাঁর বাড়িতে কথকতা করতে অস্বীকার করেন। শেষ মুহূর্তে কৃষ্ণহরিকে ধরে আনা হয়, রামধনকে কথকতার ধারক হিসাবে নিযুক্ত করা হয়।৩৫ তারাশঙ্করের লাভপুর গ্রামে ব্যবসায়ীরা কথকতার আসর দিতেন।৩৬ কানুঠাকুরের বংশধর নদীয়ার ভাজনঘাটের কৃষ্ণকমল গোস্বামীর প্রধান পৃষ্ঠপোষক তো ছিলেন সুবর্ণ বণিক সম্প্রদায়। ঢাকা নিবাসী মদনমোহন পোদ্দার সাহাদের নেতা, তিনি ঢাকাতে কৃষ্ণকমলের থাকার প্রথম বন্দোবস্ত করেন। সুবর্ণ বণিকদের আনুকূল্যে তিনি ‘পৌরাণিক বৃত্তি’ অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এই ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের যোগাযোগ সূত্রে কলকাতাতেও তাঁর ডাক আসে, ঢাকা নিবাসী ব্যবসায়ীগণের যত্নে তিনি বড় বাজারে কথকতা করেন। আবার সেই আসরে উপস্থিতির সূত্রে টালিগঞ্জে রামদিয়াবাসী কুণ্ডুদের আড়তবাটিতে তিনি পাঠের আমন্ত্রণ পান। এক আসর থেকে অন্য আসরে যাবার যোগাযোগ হয়। সেখান থেকে খিদিরপুর নিবাসী কায়স্থ নীলরতন সরকারের ভবনে এক সপ্তাহ ধরে তাঁর পাঠ ও কথকতা চলে।৩৭ ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের নিজস্ব যোগাযোগ, আসরে উপস্থিত ভক্ত শ্রোতাদের আগ্রহ এবং নিজ বাড়িতে কথকতার আয়োজন করবার ইচ্ছা, এইগুলি ছিল কথকদের পসার বৃদ্ধি হবার সূত্র। ক্ষান্তিলতা দেবীও এইভাবে আসরে মুগ্ধ শ্রোতাদের কাছ থেকে নিত্যনতুন জায়গায় বলতে যাবার আমন্ত্রণ পেতেন। একটা আসরে ভাল পাঠ করা হয়ে ওঠে অন্য আসরে বসবার অন্যতম শর্ত।

পরবর্তীকালে বারোয়ারি পূজা অনুষ্ঠানে কথকদের ডাক পড়ত। প্রথম মহাযুদ্ধের পরে হাওড়ার ব্যাঁটরার কদমতলার বারোয়ারি দুর্গাপুজোর সময় কথকতা হত। বারোয়ারি থেকে কথককে প্রত্যেকদিন পারিশ্রমিক দেওয়া হত।৩৮ একবার মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ও গ্রামের বারোয়ারিতলায় ‘তরণীসেন বধ’ কথকতা করেছিলেন।৩৯ উনিশ শতকের শেষে ও বিংশ শতকের গোড়ায় স্থাপিত হরিসভাগুলিতে কথকরা প্রায়ই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেতেন। ১৯২৮ সালে বেহালা হরিভক্তি প্রদায়িনী সভার ৭৬তম সাংবাৎসরিক উৎসব দুর্গাচরণ সাংখ্যতীর্থ, প্রমথনাথ তর্কভূষণ প্রমুখ পণ্ডিতদের গুরুগম্ভীর বক্তৃতার শেষে কথকতার অনুষ্ঠান রাখা হয়েছিল। তখন, ‘শেষে আড়িয়াদহ নিবাসী প্রসিদ্ধ কথক শ্রীযুক্ত নেপালচন্দ্ৰ ভাগবত রত্ন মহাশয় উঠিয়া সরস বাগবিন্যাসে সমাগত জনগণের চিত্ত বিনোদন করেন।’ নানা কথক এই সব হরিসভায় আসতেন। খিদিরপুরের ক্ষীরোদচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বা কথক গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য কোনও কোনও বৎসরে নিযুক্ত হতেন। আবার কোনও বছর উল্লেখ পাওয়া যায় যে বিশ্বেশ্বর শাস্ত্রী মহাশয় শাস্ত্র ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে দুই মাস কথকতা করেছিলেন। ১৯৬১ সালেও আমরা খবর পাই যে ‘চুঁচড়ো নিবাসী সীতা রাম ভাগবতাচার্য আষাঢ় ও শ্রাবণ প্রায় দুই মাস কাল ভাগবতীয় উপাখ্যানগুলি কথকতার মাধ্যমে অতি সুন্দরভাবে সভায় পরিবেশন করিয়াছেন।’ হরিসভায় এই সব আসরের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে যাঁদের নাম পাচ্ছি তাঁরা সবাই উঠতি গোষ্ঠী, ‘আঢ্য, সাহা, কুণ্ডু, নস্কর, শীল, দাশ, কৰ্ম্মকার’ ইত্যাদি। এক বার নীলমণি মান্না কথকতার আসরের জন্য বিশেষ দান হিসাবে পাঁচ টাকা দিয়েছেন।৪০

জমিদার বা উঠতি ব্যবসায়ীদের টাকার জোর আছে, সমাজে প্রতিষ্ঠা পাবার ইচ্ছা আছে, তাঁরা শহরে ও গ্রামে কথকতার আসর বসাবেন, কীর্তন গানের বন্দোবস্ত করবেন, যাত্রার দল খুলবেন, এই সব তথ্যে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কিন্তু কথকতা শোনা ও শোনানো পুণ্য লাভের পথ, শুধু শুনতেও ভাল লাগে। কথকতার বোলবোলাওয়ের সময় গ্রামের সাধারণ গৃহস্থ বাড়িরাও এই শিল্পের গুণগ্রাহী ছিল। এই সব আসরের পৃষ্ঠপোষকতা করতে বাড়ির মেয়েরা বেশি করে এগিয়ে আসতেন। প্রসঙ্গক্রমে বীরভূমের হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় স্মৃতি-নির্ভর রচনায় লিখেছেন,

বেশী দিনের কথা নয়, পঞ্চাশবৎসর পূর্বেও দেখিয়াছি—কথক গ্রামে আসিয়াছেন, কিন্তু একবৎসর পূর্বে গ্রাম হইতে বাহির হইতে পারেন নাই। দক্ষিণা ছিল দিন দুইটি টাকা মাত্র। কখনো একাকী আসিতেন, কখনো সঙ্গে একজন মাত্র সেবক থাকিত। সঙ্গতিপন্ন গৃহস্থ যাহারা তাঁহারাই পাঁচ দিন দশ দিন পনের দিন পর্যন্ত কথক ঠাকুরকে সযত্নে গৃহে রাখিতেন। ব্রাহ্মণেতর জাতি হইলে কোন ব্রাহ্মণবাড়িতে তাঁহার আহার ও বাসের ব্যবস্থা হইত। কখনো বা নিজেদের চণ্ডীমণ্ডপে বা বৈঠকখানায় স্থান দিয়া আহারের ব্যবস্থা করিতেন ব্রাহ্মণগৃহে। অতিদুঃখিনী শূদ্র বিধবা অন্ততঃ একটা দিনও কথকতা দিতেন। সন্ধ্যায় গ্রামের কোন দেবস্থানে অথবা গ্রাম্য প্রধানের কিম্বা কোন ভক্তিমান গৃহস্থের চণ্ডীমণ্ডপে কি বিষ্ণুমন্দিরে কথকতা করিতেন।৪১ (নজরটান আমার)

সময়কালে গ্রামে কথকতার পৃষ্ঠপোষকতার ব্যাপ্তি উদ্ধৃতাংশের ছত্রে ছত্রে ধরা পড়ে। সে রকম কিছু না জুটলে কলকাতা শহরে কথকরা নিজেরাই বসে যেতেন এবং শ্রোতা সমাগমও হত। কথকতার রসজ্ঞ যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি তাঁর একটি অভিজ্ঞতা এইভাবে লিখেছেন,

সাত আট বছর পূর্বে একবার কলিকাতায় কয়েকমাস ছিলাম, বৈকালে গোলদীঘিতে বেড়াতে যেতাম। দেখতাম দীঘির দক্ষিণ পাড়ের মণ্ডপে একটি লোক কি বলত, বিশ পঁচিশজন একমনে শুনত। কথক কৃষ্ণবর্ণ, কিঞ্চিৎ স্থূলকায়, চল্লিশ পঁয়াল্লিশ বৎসর বয়স। গা খোলা, উড়ানী কখনও কোলে, কখনও ভূমিতে পড়ত। দক্ষিণবাহু কখনও প্রসারিত, কখনও বক্ষলগ্ন; স্বর কখনও উদাত্ত কখনও অনুদাত্ত হ’ত। লোকটির দেবদত্ত শক্তি ছিল, নইলে এতগুলি লোক প্রত্যহ শুনতে আসত না।৪২

বিংশ শতকে যানবাহনের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কথকের চাহিদা অঞ্চলে আবদ্ধ নেই। আসরের ডাক দূর-দূরান্ত থেকে আসে। প্রয়াত ফেলারাম বন্দ্যোপাধায় ‘বাংলা বিহার উড়িষ্যা, অধুনা বাংলাদেশ, আসাম, উত্তরপ্রদেশ’ প্রভৃতি এলাকায় রামায়ণী কথকতা করেছেন। অধুনা তাঁর পুত্র দ্বিজরাজ বন্দ্যেপাধ্যায়ের ভৌগোলিক পরিক্রমা একই ধরনের। গত জুন মাসে, (১৯৯৩) এক মাস ধরে উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জের রাজালোকায় শ্রীশচন্দ্র দাসের বাড়িতে দ্বিজবাবু কথকতা করেছেন; সভায় মাইক ছিল, আসরে সহস্রাধিক লোক হত। বাসন্তী দেবী বিদেশেও পাঠ করেন। প্রবাসী বাঙালিরা সাধারণত আসর বসায়। আবার ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি মাসে নিউ-আলিপুরের এন-ব্লক-এ রঙিন পোস্টার দেখা যায়। লন্ডননিবাসী বিশ্ববিখ্যাত ‘যুবমানস প্রবক্তা’ শ্রীকিরীট ভাই কলকাতায় ‘সঙ্গীতময় ভাগবত প্রবচনের’ অনুষ্ঠান করবেন। প্রচার মাধ্যম ও সময়ের সঙ্গে সবাইকে মানিয়ে নিতে হয়।

১৮৩৪ সালে কার্তিক মাসে বীরভূমে কথকতায় আয় কীরকম হত? বীরভূমে প্রাপ্ত একটি জমাখরচের হিসাবে দেখা যাচ্ছে যে কথকের আয় নিজস্ব এক টাকা এক আনা।৪৩ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পাদ্রি রেভারেন্ড জেমস লং কথকদের স্মৃতিশক্তি ও বলার ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন।৪৪ সেই প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন যে দক্ষ কথকদের কয়েকজন মাসে ৫০০্‌ আয় করতেন। কোনও কোনও ঋতুতে কেউ কেউ ২০০০ টাকা পর্যন্ত উপার্জন করেছেন। এঁদের মধ্যে দু-একজন কোনও বাড়ির বাঁধা কথক হয়ে থাকতেন। ঘরে জনা পঞ্চাশেক মহিলাকে দৈনিক দুঘণ্টা কথা শোনাবার জন্য কলকাতার এক জন ধনী লোক কথক নিযুক্ত করেছিলেন। কথকতার জনপ্রিয়তা এই সময় তুঙ্গে উঠেছিল। বিংশ শতকের গোড়ায় বাঁকুড়ায় যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির মা গ্রামে নারায়ণী কথকতার আসর দিয়েছিলেন। তিন ক্রোশ দূর থেকে কথক ঠাকুর শিষ্য নিয়ে এসেছিলেন; ওই অঞ্চলের নামকরা কথক। এক মাস পাঠ চলেছিল, ৩০০্‌ দক্ষিণা নিয়েছিলেন।৪৫ ১৩১১-১২ সনে ১৩ ফাল্গুন থেকে বৈশাখ পর্যন্ত কবিরাজপুরে পার্বতীচরণ রায়ের স্ত্রী বগলাসুন্দরী দেবী মহাভারত পাঠ ও কথকতার আসর বসান। পাঠক ছিলেন হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ও কথক ছিলেন তাঁর কাকা জানকীনাথ শিরোমণি। পাঠ ও কথকতা বাবদ তাঁদের প্রাপ্তি হরিদাসবাবুর হিসাবের খাতা থেকে উদ্ধৃত করা যাক।৪৬

পূর্ব সনের ১৭ ফাল্গুন৫্‌
৭ চৈত্র২০্‌
মোট২৫্‌
১১ বৈশাখ লক্ষ্মী বাটি আসিবার কালে তাহার মাং২৫্‌
২ জৈষ্ঠ খুড়া বাটি আসিবার কালে তাহার মাং২্‌
৫ জৈষ্ঠ্য মহাভারতের দক্ষিণাদি১১০্‌
সোনা একভরি সাড়ে ছয় আনা (মুং অং)৩৪॥০
শাল এক জোড়া (মুং অং)২০্‌
গরদ এক থান ঐ৪্‌
চেলির জোড়া ১টা, ,,৪্‌
চেলির সাড়ি ১ খানা ,,৩্‌
কাঁসার বাটি ৭টা (মুং অং)৩॥০
পিতলের ঘটি ৩টা ,,১॥০
কাঁসার থাল ১ খানা ,২॥০
সূতার কাপড় মোট ,,২৫্‌
সংসারে পিতৃঠাকুরের নিকট দত্ত মোট—২৫০্‌
মাং = মারফত, বাং = বাবদ, মুং অং = মূল অনুমান

আসলে আয় দুই রকমের। কথকতা বা গানের জন্য যজমানের কাছে বরাদ্দ দক্ষিণা ও আসরে পাওয়া প্রণামী। রামায়ণী গান দলবদ্ধ; রামায়ণী কথকতা একক কিন্তু দক্ষিণাদির বন্দোবস্ত একই রকম ছিল। কলকাতার পুরনো এক বাসিন্দা লিখছেন, ‘তখন [উনিশ শতকের শেষপাদে] মধ্যবিত্ত গৃহস্থ বা গরীবগুরবো যাদের বাড়িতে একটু উঠান আছে তাঁরাই বাড়ীতে রামায়ণ গান দিতেন।’ এর জন্য বন্দোবস্তের নাম ছিল ‘মালা নাবানী’, অবস্থা বিশেষে তা হতে পারত ‘পাঁচ টাকা থেকে পনের টাকা পর্যন্ত।’

মালা নাবানী ব্যাপারটা হ’ল, কথক ঠাকুর জামাকাপড় ছেড়ে গলায় পৈতে বার করে বেগুনী রংয়ের বেনারসী জোড়, গলায় চাদর, খালি গায়ে বসলেন, যিনি গান দিয়েছেন তিনি এসে কথক ঠাকুরের গলায় এক ছড়া গোড়ে মালা পরিয়ে দিলেন। গান শেষ হলে তার গলা থেকে মালা ছড়াটা খুলে নিয়ে চুক্তি মোতাবেক টাকা দিয়ে দেবেন। কথক ঠাকুর তখন হাতের চামরটা কর্তার মাথায় বার তিনেক ছুঁইয়ে আশীর্বাদ করলেন। শ্রোতারা গান শুনে যে প্যালা কথক ঠাকুরের থালায় দিয়েছেন, সেটা তাঁর উপরি প্রাপ্য। যদি কেউ সিদে দিয়ে থাকেন সেটাও ধর্তব্যের মধ্যে নয়।

এই প্যালা দেওয়া আসরের অপরিহার্য অঙ্গ। প্যালা না দিলে, না নিলে কোনও কথকতার আসর সিদ্ধ হয় না।

অনুপম ভঙ্গিতে বনেদী বাসিন্দাটি লিখেছেন,

বাড়ীর বিধবা ঠাকুমা বা জ্যাঠাইমারা একখানি চাদর জড়িয়ে দুই একটি নাতি নাতনীর হাত ধরে কথা শুনতে যেতেন। সঙ্গে দুটো এক আনি বা দোয়ানী নিতেন বা দুচারটে পয়সা আঁচলের খুঁটে বেঁধে নিতেন, প্যালা দিতে হবে। ‘রামায়ণ গান শুনে মুল্য না দিলে কানে কালা হয়ে যাবে। তিনকাল গিয়ে এককাল ঠেকেছে প্যালা না দিয়ে গান শুনে এসে কানে কালা হয়ে নরকে যাবে নাকি?’ ছোট উঠান, তার উপর সতরঞ্চি পাতা, ফরসা চাদর দিয়ে মোড়া, শ্রোতারা সব অধিকাংশ ঠাকুমা ও জ্যাঠাইমার দল। গুটি গুটি এসে কথক ঠাকুরের জায়গাটা ফাঁক রেখে, গোল হয়ে বসে গেল।৪৭

প্যালা আদায় করার কায়দাও কথকদের জানতে হত। মেহেরপুরের কথক ঠাকুর কালীনাথ ভট্টাচার্য এই কাজে বেশ পোক্ত ছিলেন। যেমন,

এক কথকতা উপলক্ষে মধ্যে মধ্যে তাঁহার উপরি প্রাপ্তিও মন্দ হত না। সন্ধ্যার পর কথা শেষ হইলে কোনওদিন চিকের অন্তরালস্থিত পুরমহিলাগণকে লক্ষ্য করিয়া বলিতেন, ‘মা সকল, কাল রামের বিবাহ, বিবাহে ‘নকতা’ দিতে হয়,—তা যেন মনে থাকে।’ কোন দিন বলিতেন, ‘কাল লক্ষ্মণভোজন, সিধা আনিতে ভুলিও না।’—কেহ নূতন কাপড় দিত, কেহ কাঠের বারকোশ পূর্ণ করিয়া সিধা দিত, কেহ নূতন কাঁসার ডিসে নানা মিষ্টান্ন দিত; এতদ্ভিন্ন ডাব, পেঁপে, তরমুজ, সুপক্ক কলা, এবং নানাবিধ তরকারিও তাঁহাকে উপহার দেওয়া হইত।৪৮

প্রণামী ও সিধার মাধ্যমে কথকের নানা প্রাপ্তিযোগ হত। আসর জমাতে পারলে লোক আসবে, আয়ত্ত হবে। আসরে প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা ধরা পড়ে এক কথকের নিজের জবানিতে,

…গিন্নীমার একটু আগেই বাড়ী ফিরে যেতে হচ্ছে। তিনিই সবার আগে দাঁড়ালেন সিধের ডালাটি দুহাতে করে। তার ডালার ভেতর চাল ডাল তেল নূন মশল্লা গব্যঘৃত তৈল আলু কুমড়ো সবই আছে। সঙ্গে একখানা ছোট গীতা, একটি পৈতে আর একটি ক্ষুদ্র চামরও রয়েছে দেখা গেল।

…কাপড় একখানা, তার সঙ্গে রূপোর টাকা, একটি তামার পয়সা আর একটি সোনার তুলসীপাতা কাগজে মোড়া, এগুলিও ঠাকুরের হাতে দিলেন নন্দর মা। ঠাকুর এগুলি নিজের পাশেই আসনের উপর রেখে দিলেন। বামনভিক্ষার কথা তো পড়ে রইল সেদিনের মত ঐ পর্যন্ত। নন্দী গিন্নীর পর মেয়েমহলে ক্রমশই চঞ্চলতা ঘনিয়ে উঠলো। এক এক মায়েরা সব ডালা থালা চুপরি রেকাব করে সিঁধে নিয়ে এগুতে শুরু করলেন, আর তখন কথকতা চলে? ডাব আর নারিকেল স্তূপীকৃত হতে লাগলো ঐ তুলসী মঞ্চের একপাশে।৪৯

সফল কথকের স্বপ্ন এটা। বাস্তবে কাপড় বা সিধে পাওয়া যায় কিন্তু অনেকদিন ধরে কথকতা চললে প্যালার পরিমাণ ৫ পয়সা বা ১০ পয়সা। চালতাবাগানের আসরে দ্বিজবাবুর থালায় ওইভাবেই পাড়ার জ্যাঠাইমা বা মাসিমারা তাঁদের সাধ্যমতো প্যালা দেন। দ্বিজবাবুর হাতে চামর থাকে, তাই বুলিয়ে তিনি তাঁদের আশীর্বাদ করেন, সেটা রীতি। আসরে বাসন্তীদেবীকে যিনি যাই দেন, বাসন্তীদেবী হাসিমুখে তাই নেন। শ্রোতারা ভক্ত, দান তাঁদের শিরোধার্য। সেই দানকে ফিরিয়ে দেওয়া অসম্মানের কাজ, ধর্মবিগর্হিত। এই শোভনতা কথকদের আচরণে প্রত্যাশিত।

জনপ্রিয়তার পট পরিবর্তন: একটি বিতর্ক

উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে কথকতার জনপ্রিয়তায় ভাটা দেখা দিচ্ছে। সঞ্জীবচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখদের চোখে সেটা ভাল করে ধরা পড়েছে। বিংশ শতকের তৃতীয় দশকে দীনেশচন্দ্র সেন ‘কথকতাকে’ বাংলা ‘লুপ্ত সম্পদ’ বলছেন। অধুনা কথকতার ক্ষীণ ধারা দেখা যায়। সোনামুখীর কথক রাজকৃষ্ণ গঙ্গোপাধ্যায় নিজেদের প্রজন্মকে এই পেশার শেষ প্রতিনিধি বলে মনে করেন। দ্বিজবাবুর বংশেও আগামী প্রজন্মে এই পেশা কেউ অবলম্বন করবে না। রাজকৃষ্ণবাবুদের বংশের সবাই কথক; প্রয়াত হেরম্বনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও ফকিরনাথ গঙ্গোপাধ্যায় এই পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর জ্ঞাতি ভ্রাতা বিশ্বনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ও কথকতা করেন। রাজকৃষ্ণবাবুর বাঁধা আসর আছে, শান্তিনিকেতনেও গৃহস্থবাড়িতে তাঁর আসর বসে। কিন্তু উপার্জন কমেছে। আগে যেখানে জমাটি সময়ে আয় হত আট হাজার, এখন সেখানে আয় দুই হাজারের বেশি হয় না। রাজকৃষ্ণবাবুর কথায় এক বংশানুক্রমিক পেশাদার শিল্পীর আক্ষেপ স্পষ্ট।৫০

এই জনপ্রিয়তার হ্রাসবৃদ্ধি প্রসঙ্গে আমেরিকার গবেষকদের কিছু বক্তব্য আছে। মিলটন সিঙ্গারের নির্দেশে ডামলে মহারাষ্ট্রে কতকগুলি হরিকথা পাঠের আসর সমীক্ষা করেছিলেন, কথকদের ও শ্রোতাদের জাতপাত-এর একটা হিসাব তাঁর রচনায় পাওয়া যায়। সাম্প্রতিককালের একটি সুলিখিত প্রবন্ধে ফিলিপ লুটগেনডর্ফ বারাণসী শহরে রামচরিতমানসের পাঠের জনপ্রিয়তাকে ব্যাখ্যা করেছেন উচ্চবর্গের পৃষ্ঠপোষকতার সূত্রে; তাঁর লেখায় পাঠের রীতিবদলও বিশ্লেষণ করা হয়েছে পোষ্টাদের রদবদলের কার্যকারণ সম্পর্কে। এই প্রসঙ্গেই কথকদের চাহিদা ও আয়ের তেজি বা মন্দাভাব আলোচিত হয়েছে। সমাজ ‘সংস্কৃতায়নের’ নির্দেশক হল রামায়ণ পাঠের জনগ্রাহ্যতা।৫১

কথকতা প্রসঙ্গে আমেরিকার পণ্ডিতদের বক্তব্যের সঙ্গে বৈমত্য আছে। সমাজে কিছু লোক সব সময় ওঠে, কিছু লোক সবসময় পড়ে। প্রকৃতপক্ষে, ওঠা-পড়া, পোষ্টাদের খাই, উচ্চবর্ণের সংস্কৃতির অনুবৃত্তি, কোনওটাই নির্দিষ্ট শিল্পের প্রতি সামাজিক আনুকূল্য বা উদাসীনতার ‘করণ’ হতে পারে না। শিল্পের নিজস্ব ভূমিকা আছে, শ্রোতাদের রুচি ও রসবোধ আছে।

সংস্কৃতায়ন ও পোষ্টাদের সামাজিক বিবর্তনের ছকের বিচারে শিল্পরীতির নিজস্ব সামাজিক ভূমিকা এবং শ্রোতাদের রুচি ও রসবোধের পরিবর্তনের সমস্যা একদম আমল পায় না। গোষ্ঠীর ওঠানামার সমান্তরাল প্রতিফলন বলে বিবেচিত হয় কথকদের পেশার জোয়ার-ভাটা।

উনিশ শতকের প্রাসঙ্গিক সাক্ষ্যগুলি খুঁটিয়ে পড়লে আপত্তির সারবত্তা বোঝা যাবে। লুটগেনডর্ফের গবেষণার অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয় হল—হিন্দি ছাপাখানার আগমন রামায়ণ পাঠের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। ছাপাখানা আসার ফলে সুলভ মূল্যে রামায়ণ কাশীর মধ্যবিত্তের হাতে এল, বাড়িতে বাড়িতে রামায়ণ পাঠের দৈনিক আসর বসতে শুরু হল, ‘রামায়ণীজী’দের শিক্ষা আরও সহজসাধ্য হল।৫২ পাঠের জনপ্রিয়তার পেছনে সুলভে বই পাবার চাইতেও বড় প্রশ্ন হল, বারাণসী শহরের মধ্যবিত্তদের পাঠের রুচি, বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ। বাজারে চাহিদা আছে বলে সস্তায় বই ছাপা হচ্ছে, উলটোভাবে শুরু নয়। অনুরূপ অবস্থায় বটতলার ছাপাখানাও সুলভ মূল্যে রামায়ণ ছাপিয়েছিল, হাজারো অন্যরকম ধর্মগ্রন্থও ছাপানো হয়েছিল। আজও সেই ধারা অব্যাহত আছে। কিন্তু তারও মধ্যে পাঠের রুচিতে বদল দেখা দিল, বাঙালি পাঠক বদলাতে শুরু করল। তাতে ছাপাখানার ভূমিকাও বদলে গেল। দীনেন্দ্রকুমারের প্রাসঙ্গিক মন্তব্য শোনা যাক।

আমাদের পল্লী হতে কথকতা উঠিয়াই গিয়াছে। সে কালে যাহারা কথকতা দ্বারা সংসার প্রতিপালন করিতেন, একালে তাহাদের বংশধররা অন্য বৃত্তি অবলম্বন করিয়াছেন। গার্ল স্কুলের কল্যাণে একালের মেয়েরা লেখাপড়া শিখিয়া সেকেলে রামায়ণ, মহাভারত আর স্পর্শ করেন না; এখন তাহারা সাহিত্যে আর্ট ও মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষণসূচক, নব্য ঔপন্যাসিকগণের প্রণীত কামায়ণ পাঠে তৃপ্তিলাভ করিতেছেন, রামায়ণে আর মন ওঠে না।৫৩ (নজরটান আমার)

নবীনচন্দ্র সেন নিজে পাঠে সুনিপুণ ছিলেন। পাঠ উঠে যাওয়ার গাওনা গাইতে গিয়েও তিনিও হুবহু এক কথা বলেছেন।

…দেখিলাম আমার বাল্যকালে যাহারা পাঠক ছিল, তাহাদের মধ্যে এখন ২/৪ জন যাহারা জীবিত আছে, তাহারাই এখনকার খ্যাতনামা পাঠক। তাহাদের উত্তরাধিকারী আর কেহ গ্রামে জন্মে নাই। কারণ জিজ্ঞাসা করিলে শুনিলাম—দেশে পুঁথি কে শুনে যে পাঠ করিতে কেহ শিক্ষা করিবে। কোন বাড়ীর স্ত্রীলোকেরা আর এ পুঁথি শুনে না। বুঝিলাম স্ত্রীশিক্ষায় দেশ যথার্থই টলায়মান। এ সকল পুঁথির স্থান উপন্যাস গ্রহণ করিয়াছে।৫৪

‘নবেল পড়া মেয়েদের’ উপর দীনেন্দ্রকুমার ও নবীন সেনদের জাতক্ৰোধ কতটা উনিশ শতকের পুরুষতন্ত্রের স্বভাবজ ফল, সেই প্রসঙ্গ বর্তমানে আলোচ্য নয়। প্রাসঙ্গিক শুধু এই ইঙ্গিত যে কথকতার প্রধান শ্রোতা মেয়েরা, কিন্তু তাঁদের রুচিতে বদল হয়েছে; তাঁরা নিজেরা পড়তে সক্ষম হয়েছেন ও বাদ-বিচার করছেন, রসবোধ অন্যদিকে মোড় নিয়েছে, সাহিত্য বদলে গেছে, উপন্যাস পাঠ জনপ্রিয় হচ্ছে। পৃষ্ঠপোষকতার পরিবর্তনের পেছনে সামাজিক গোষ্ঠীর ওঠা নামার চাইতে অনেক বেশি সক্রিয় রসের আস্বাদের রূপান্তর, উপন্যাস নামে নতুন শিল্পের প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহ।

অন্যদিকে ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কথকদের সামাজিক ভূমিকা প্রসঙ্গে প্রত্যাশায় খামতি ঘটেছিল, আচার-অনুষ্ঠানের মূল্যায়নেও প্রশ্ন উঠেছিল। কথকতা ও পুরাণপাঠ ধর্ম-সাধনার সঙ্গে যুক্ত, পাঠে পুণ্য হয়, শুনলে পাপ কেটে যায়, এই জাতীয় বিশ্বাসে তার আবেদনের একটি দিক জড়িত আছে। কথক ঠাকুর বিশেষ গুণ বিশিষ্ট হবেন, এই ধারণা প্রত্যাশিত। রামগতি ন্যায়রত্ন কথকদের প্রতি গৃহস্থের বিরক্তির কথা উল্লেখ করেছেন।

সম্প্রতি কিছু নিরক্ষর বা স্বল্পাক্ষর লোক এ ব্যবসায় অবলম্বন করিয়াছেন, এবং তাহাদের অনেকের পানাসক্তি, বিশেষতঃ পরদারানুরক্তি দর্শনে ঐ শ্রেণীর উপরেই লোকের অভক্তি জন্মিয়া গিয়াছে। এখন আর কোন ভদ্রলোক নিজ বাটীর মধ্যে কথা দিতে পার্যমানে সম্মত হন না।৫৫ (নজরটান আমার)

শ্রীহট্টে পুরাণপাঠ প্রচলিত ছিল, পুরোহিতরাও যেমন তেমন করে পাঠ সেরে দুপয়সা আয় করতেন। কিন্তু এই রীতি যে আচার সর্বস্বতায় পরিণত হচ্ছে, শিল্প কুশলতা যে হারিয়ে গেছে, সেই বিষয়েও গৃহস্থরা সজাগ হচ্ছিল। বিপিনচন্দ্র পাল লিখেছেন,

আমার মনে পড়ে দু’ একবার আমার জেঠতুত ভাই, ইনি বাবার মুহুরী ছিলেন এবং বাবার সংসারের কাজকর্মের তত্ত্বাবধান করিতেন—বাঙলা নজির খড়োয়া দিয়া মুড়িয়া পুরাণ বলিয়া এই পাঠের সময় রাখিতেন। কখনও কখনও আমাদের পরিবারে হয় নাই কিন্তু অন্যত্র এমনও শুনা গিয়াছে—দুষ্ট বালকেরা ছেঁড়া চটি এইরূপে মুড়িয়া পুরাণের আসনে স্থাপন করিত। লোকেদের ধর্মবিশ্বাস কতটা যে নষ্ট হইয়া গিয়াছিল, এই সকল ঘটনা ও কাহিনীতে তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়।৫৬

ময়মনসিংহে পুরাণ পাঠের দুরবস্থা, পাঠক ও কথকদের নিরক্ষরতা ইত্যাদি অভিজ্ঞতার কথা কৃষ্ণকুমার মিত্রও লিপিবদ্ধ করেছেন।৫৭ বিপিন পাল বা কৃষ্ণকুমার মিত্রের লেখায় ব্রাহ্ময়ানির ছোঁয়াচ থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু রামগতি নিশ্চয় ব্যতিক্রম। পূর্বের কথকরা সবাই দক্ষ বা নিষ্কলুষ ছিলেন, এমন মনে করারও কারণ নেই। কিন্তু কথকরা আর আগের মতো নেই, পুরাণ পাঠের মাহাত্ম্য কমে যাচ্ছে, ভদ্র গৃহস্থের মনে এই ধারণার জন্ম, তজ্জনিত অশ্রদ্ধা ও তাচ্ছিল্যের ভাব, পেশাকে আঘাত হানার পক্ষে যথেষ্ট। মনে রাখা দরকার যে জমাটি দীর্ঘস্থায়ী আসর বসাবার উদ্যোগ জমিদার বা উঠতি ব্যবসায়ীরা নিত। কিন্তু আসরে গৃহস্থবাড়ির মেয়েদের, সাধারণ শ্রোতাদের উৎসাহ ও অংশগ্রহণের কথা সাক্ষ্যে বার বার বলা হয়েছে। সাধ্যমতো প্যালা তারাই দিত, তাদের আগ্রহও কম ছিল না। তাই ‘গেরস্তদের’ ও বাড়ির মেয়েদের মনোভাবের পরিবর্তন এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপুর্ণ। আবার অশ্রদ্ধা বা তাচ্ছিল্য যে সবসময় সার্বিক ধর্মবিশ্বাসে শিথিলতার পরিচায়ক, তা না হতে পারে। বরং ঠিক এই সময়ে ‘নব্য হিন্দু’ পুরনরুত্থানবাদীরা যেভাবে ধর্মকে বিন্যস্ত করতে লাগলেন, তার সঙ্গে পুরাতনী কথকতার রূপ ও ব্যাখ্যা হয়তো তাল রাখতে পারল না।

অন্যদিকে যাত্রা ইত্যাদির উদ্ভব হচ্ছে, বাংলা রঙ্গমঞ্চেও পৌরাণিক পালা জাঁকিয়ে বসেছে, বিনোদনের ক্ষেত্রে কথকতার নানা প্রতিযোগী বেড়েই চেলেছে।

বাংলার সামাজিক ইতিহাসে রুচির ও অনুভূতির পট পরিবর্তন নিয়ে লেখা সবে শুরু হয়েছে। পোষ্টা-র সামাজিক অবস্থান বা তার পণ্য ক্রয়ের ক্ষমতা বা বাজারি চাহিদা, শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতাকে নির্ধারণ করার একমাত্র শর্ত হতে পারে না। নানা স্তরে সহৃদয়ের মনের রূপান্তর, রসের আস্বাদে রদবদল, নন্দন বোধে পরিবর্তনও সমভাবে বিবেচ্য। বর্তমান পর্যায়ে কোনগুলি ‘কারণ’, কোনটাই বা ‘ব্যাপারবৎ কারণ’ বা ‘করণ’ তা ঠিক করা মুশকিল। এই ক্ষেত্রে আপাতত জয়ন্ত ভট্টের অনুগামী হয়ে বলা যেতে পারে যে সামগ্রীর ‘করণত্বই’ প্রাসঙ্গিক। কোনও কারণই এককভাবে কার্যের ‘করণ’ নয়। যেহেতু সামগ্রী (কারণকূট বা নিখিল কারণের সমষ্টি) থাকলে কার্য অবশ্য উৎপন্ন হয়, সেটাই অসাধারণ কারণ বা ‘করণ’। ইতিহাসবিচারে জয়ন্ত ভট্টের ধারণা অনেক এঁড়ে তর্কের অবসান ঘটাতে পারে।

৩ কথকতার কৃৎকৌশল: আসর বিন্যাস

পদ্মপরাণের পাতালখণ্ডের একটা পরো অধ্যায় জড়ে আছে পাঠের আসর কীরকম হবে তার বিবরণ। উনিশ শতকে ওয়ার্ডের বিবরণীতেও আসর সাজানোর কথা প্রাধান্য পেয়েছে। আসর জমাটি না হলে কথকতা মার খাবে। ঊনবিংশ শতকের সাতের কোঠায় একটি গ্রামের কথকতার আসরের বর্ণনা এইরকম:

একবার চাটুয্যে গিন্নী তীর্থ পর্যটন করিয়া আসিয়া বাড়ীতে তিনমাস ‘কথা’ দিয়াছিলেন; এই উপলক্ষ্যে তাঁহাদের বাড়ীর বাহিরের আঙ্গিনায় বাঁশের ‘চ্যাটাই’-এর আচ্ছাদন দ্বারা একটি প্রকাণ্ড মণ্ডপ নির্মিত হইয়াছিল। তাঁহার নীচে দক্ষিণপ্রান্তে কথক ঠাকুরের উপবেশনের জন্য একখানি কাঠের তক্তপোষ সংস্থাপিত ছিল। সেই আসনে ‘উত্তরমুখো’ হইয়া বসিয়া কথক ঠাকুর কথকতা করিতেন, তাঁহার দক্ষিণ পার্শ্বে অনুচ্চ টুলে শালগ্রামশিলা সংস্থাপিত হইতেন। কথক ঠাকুরের সম্মুখে মৃত্তিকার উপর প্রসারিত সতরঞ্চিতে বসিয়া শ্রোতারা কথা শুনিতেন। আঙ্গিনায় উত্তর সীমায় একখানা খড়ো ঘর ছিল, তাহার সম্মুখে চিক টাঙ্গাইয়া পল্লী রমণীগণ সেই চিকের অন্তরালে বসিতেন। অপরাহ্নে চারিটার সময় কথারম্ভের সংবাদ প্রচারের জন্য চাটুয্যে বাড়ীতে কাঁসরঘন্টা বাজিয়া উঠিত। আমরা ছেলের দল সেই শব্দ শুনিয়া কথা শুনিতে ছুটিতাম। বিলম্ব হইলে স্থানাভাব হইতে পারে ভাবিয়া আমরা সর্বাগ্রে সেখানে উপস্থিত হইয়া ‘ফরাস’ অধিকার করিতাম। গ্রামস্থ অধিকাংশ লোক পাঁচটা বাজিবার পূর্বেই সেখানে উপস্থিত হইতেন। নিম্নশ্রেণীর লোকেরা মাটীতে বসিয়া নিস্পন্দভাবে কথা শুনিত।৫৮

চাঁদোয়া ব্যাসাসন, বেদি, শালগ্রাম শিলা—ইত্যাদি সব আসরেই সাধারণ অঙ্গ ছিল। কথকের আসন উঁচু হবে, তা পবিত্র, এই কথা পদ্মপুরাণে বলা আছে। কথকী পরিভাষায় ‘ব্যাসাসন’ আজও চালু শব্দ। আসনকে কথক প্রণাম করে বসেন কারণ আসন তাঁর পূজার সামগ্রী। বিক্রমাদিত্যের সিংহাসনের উপর গড়ে ওঠা ঢিবিতে বসে যেমন রাখাল বালক সেরা বিচারকে রূপান্তরিত হয়, ওই আসনের প্রসাদে কথক ঠাকুর হয়ে ওঠেন পরম্পরাগত ব্যাস। তাই ক্ষমতা থাকলে ব্যাসাসন তৈরিও করা হত তরিবৎ করে। এক কথকের জবানিতে এই তরিবতের কথা শোনা যাক:

চাঁদোয়ার তলায় তক্তপোষের উপর গালিচা, গালিচাখানা কাশ্মীরী কিন্তু শতবর্ষেরও অধিক তার বয়স। স্থানে স্থানে একটু ছিন্ন হয়েছে। গেলবারে কুম্ভমেলায় গিয়েছিলেন বড় বউমা। তিনি কথক ঠাকুরের বসবার জন্য আগ্রা থেকে সুন্দর ঝালর দেওয়া একখানা রেশমের আসন এনেছেন। সেই আসনখানা গালিচার উপর দেওয়া আছে। পাশেই একটা তাকিয়া। তুলো দেখা যায় [।] নতুন ওয়াড় দেওয়া হয়েছে।”৫৯

কথকতা সাধনার অঙ্গ, ঠাকুরের কাজ। চালতাবাগানে রাধারানি বিগ্রহের কথা মনে রেখে দ্বিজরাজবাবু মাসাধিককাল কথকতা করেন। মেহের-হরের কথকঠাকুর কালীনাথ ভট্টাচার্য বা প্রবাদপ্রতিম ধরণীধরের মজলিশে শালগ্রাম শিলার সামনে বসতেন কথক। আর আসর বিন্যাসেও থাকবন্দি সমাজের রূপ থাকত, ব্রাহ্মণ ও শূদ্রদের বসার আসন আলাদাই হত। নৈহাটির কাঁঠালপাড়ায় বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়িতে কিশোর হরপ্রসাদের অভিজ্ঞতা দীনেন্দ্রকুমারের মতোই:

রায় বাহাদুরের বাহিরবাড়ির পাঁচ ফুকরে দালানের সামনে যে উঠান আছে, সেই উঠানে কথা হইত। কথকের জন্য যেমন সবজায়গায় ইটের বেদি হয়, এ বাড়িতে তাহা হয় নাই। একখানা বড় চৌকি ও একখানা বড় তাকিয়া বেদির কাজ করিত। ঐ বেদির উপর একখানি ভালো গালিচা পাতা থাকিত। সামনে একটি বড় টিপায়ের উপর একখানি পিতলের সিংহাসনে শালগ্রাম থাকিতেন, তিনি কথার প্রধান শ্রোতা। উঠানময় গালিচা ও শতরঞ্চ পাতা থাকিত; ব্রাহ্মণেরা গালিচায় বসিতেন, শূদ্রেরা শতরঞ্চে বসিত।৬০

গ্রামের আসর, সাধ্য কি যে ক্ষমতাবিন্যাসের থাককে অগ্রাহ্য করে? এইরকম আসরের মধ্যমণি হলেন কথক ঠাকুর। দীনেন্দ্রকুমারের বর্ণনায়,

কথক ঠাকুরের ললাট চন্দনচর্চিত, নাসিকায় দীর্ঘ তিলক, শিখার গ্রন্থিতে একটি ফুল। দেহ রেশমী নামাবলী দ্বারা আচ্ছাদিত, কষ্ঠে পুষ্পমাল্য। তিনি তুলটের কাগজে লিখিত ও পাতলা কাষ্ঠের আবরণাবৃত প্রায় এক হাত দীর্ঘ পুথিখানি সম্মুখে খুলিয়া রাখিয়া মধ্যে মধ্যে এক একটি শ্লোক দেখিয়া লইতেন, এবং তাহা আবৃত্তি করিয়া ব্যাখ্যা করিতেন; কখন গান করিতেন, ব্যাখ্যা উপলক্ষে নানা গল্প বলিতেন; কখনও হাসাইতেন, কখনো কাঁদাইতেন। কথা কহিতে কহিতে শ্রান্তিবোধ হইলে ট্যাঁক হইতে নস্যপূর্ণ শামুক বাহির করিয়া দুই এক টিপ নস্য লইতেন, এবং সম্মুখস্থিত তো-করা গামছাখানি দ্বারা নাকমুখ মুছিয়া পুনৰ্ব্বার সঙ্গীতের সুরে কথা আরম্ভ করিতেন।৬১

আসর বসতে পারত নানা উপলক্ষে। উৎসবে তো বসতই। আবার তীর্থ পর্যটন সমাধা করে, ছেলের অন্নপ্রাশন, বা শোক দুঃখ উপশমের উদ্দেশ্যে কিছু দক্ষ কথক চাই, আর মুমুক্ষু পাঠক চাই। আদর্শ পাঠক শুকদেব আর শ্রেষ্ঠ শ্রোতা পরীক্ষিৎ।৬২ আসর জমাতে গেলে কিছু তৈরি শ্রোতাও চাই। দুঁদে কথক তাই লেখেন,

…এর মধ্যেই দেখুলম, কোনো ভক্তের চক্ষে জল গড়াবার উপক্রম হয়েছে। এদের বড় তাড়াতাড়ি ভাব হয়ে যায়। এসব লোক কথক ঠাকুরের খুব প্রিয়। তিনি গুটিকয়েক এরকম ভক্ত খুব কাছে নিয়ে বসেন।

তিনি বলেন, এরাই তাঁর যথার্থ সমজদার শ্রোতা। এদের মুখ না দেখে তিনি কথাই বলতে পারেন না।৬৩

কিন্তু আসর যতই সাজানো হোক না কেন, শ্রোতারা যতই উন্মুখ থাকুক না কেন, শেষপর্যন্ত জমানোর দায়িত্ব গিয়ে পড়ে কথকের উপরই। একদিন ঠাকুরবাড়িতে জসীমউদ্দীন এই কথা মর্মে মর্মে বুঝেছিলেন। ‘গল্পের আসরের উপলক্ষ করিয়া হলটিকে একটু সাজান হইয়াছে। কথক ঠাকুরের মত সুন্দর একটি আসনও রচিত হইয়াছে আমার জন্য!’

সেইদিন আসরে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া হাজির ছিলেন সবাই। অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, দীনেন্দ্রনাথ, রথীন্দ্রনাথ, এবং ঠাকুরবাড়ির সুসজ্জিতা বধূরা। আর গ্রামদেশের জসীমউদ্দীন এই রকম আসরে যেন ‘বলির পাঁঠা’।

গল্প বলিতে বলিতে গল্পের খেই হারাইয়া ফেলি। পরের কথা আগে বলিয়া আবার সেই ছাড়িয়া-আসা কথার অবতারণা করি। দশ পনের মিনিট বাদে দিনুবাবু উঠিয়া গেলেন। সামনের শাড়িতে ঝকমকিতে দোলা দিয়া কৌতুকমতীরা একে অপরের কানে কানে কথা বলিতে লাগিলেন। কেউ কেউ উঠিয়া গেলেন।৬৪

গ্রামের কবি জসীমউদ্দীনের বলার ধরন ঠাকুরবাড়ির শহুরে মনের হৃদয়-সংবাদী হয়নি। আসর জমল না, যদিও বহিরঙ্গে ত্রুটি ছিল না। আবার এই আসরই মহিম কথক বা ক্ষেত্র কথকের কথায় কীভাবে জমে উঠত তার স্বীকৃতি আছে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিচারণায়।

এ যে মহিম কথকের পুঁথি, একটি একটি পাতা পড়ে যেতেন কথক ঠাকুর আর একটি একটি ছবি যেন চোখের সামনে ভেসে উঠত। লাল বনাত একখানা গায়ে দিয়ে বসতেন পুঁথি হাতে, হাতে রূপোর আংটি, হাত নেড়ে নেড়ে কথকতা করতেন। রূপোর আংটির ঝকঝকানি আজও দেখতে পাই।…

ক্ষেত্ৰনাথ কথকের বলার ধরন চমৎকার, গলাটাও ছিল সুমিষ্ট। দক্ষিণের বারান্দার গায়ে নাচঘরটা তখন অস্তমিতমহিমা গন্ধর্বনগরের মধ্যে ম্লান শোভা ধারণ করেছে। তারই মধ্যে ক্ষেত্ৰনাথ কথক মায়ের মনের অবস্থানুযায়ী এক একটি কথা ভাগবত থেকে বলে চলেছেন, এইভাবে গেল প্রায় একবছর।৬৫

গল্প ফাঁদার মুনশিয়ানা

চাঁইবুড়োর সাতরাজার ধন যে একমানিক, সেটা যে পুথি এই কথা সবাই জানে, পুষ্পিকাতেও বার বার তাই লেখা আছে। তাই নানা ঝামেলা, নানা নিষেধ। যেমন,

পুস্তক পড়িতে দিবে সুবুদ্ধির ঠাই।

সবাগুনা গ্রন্থ জেন গোবরায় নাই।

মাতুলমহাশয়ের বাহির বাটির মণ্ডপে বসিয়া পুথির অনুলিপি করা হয়েছে, ‘ঘাড়ের মধ্যে সাল হইয়া বড় বেতা পাইয়া এহি পুস্তক সমাপ্ত করিলাম—এহি পুস্তক আর কেহর এলাকা নহি,’ ১২৪০ (১৮৩৩) সনে শ্রীকৃষ্ণকান্ত এই কথা লিখেছেন। তাই আর এক জনের ভাষায়, ‘দুঃখেন লিখিতং গ্রন্থং পুত্রবৎ পরিপালয়েৎ।’ তাই এরকম কোনও পুথি অপহরণ করার পাপ প্রসঙ্গে অভিশাপ স্পষ্ট: ‘এ পুস্তক জে চুরি করে সে শাশুড়ির শৃঙ্গার করে’ বা ‘শাশুড়্যা হইবেক’। কিন্তু পুথি তো লেখা হয় পাঠের জন্য। ১১৮০ (১৭৭৩) সনে জগন্নাথ ঘোষ গদাপর্ব লিখতে গিয়ে বলছেন, ‘শ্রবণ কারণ ইহা লিখিলাম সব।’ ‘সঙ্কর ঘোষ’ তাঁকে দিয়ে প্রতিলিপি করাচ্ছেন: ‘জত্ন কড়ি লেখাইলে কড়ি করে ব্যয়॥’ ১২৩০ সনে শ্রীমদ্ভাগবত (১৮২৩) ‘মহাপৌরাণ’-এর পঞ্চম স্কন্ধের প্রতিলিপি করতে গিয়ে রামপ্রসাদ দাস বোস বলেন, ‘কিন্তু এক নিবেদন। বক্তা ঠাকুর মহাশয়দিগকে আমার শতং কোট নমস্কার। আমার দোশাদোশ ক্ষমা করিবা।’৬৬

পুথি লেখাতে পুণ্যও আছে, অর্থ প্রাপ্তিও আছে। লিপিকররা জানে পুথিতে ‘দোশাদোশ আছে’, ‘বক্তা মহাশয়েরান’ ‘তাহাকে সুদ্ধ করিবেন।’ লেখা শুদ্ধ হবে পাঠে, পাঠ প্রধান, লেখা পড়া নয়, পড়ালেখা। তাই সুবুদ্ধিই পড়তে পারবেন, অন্যরা পড়তে গেলে হয়ে যাবেন গোবর-গণেশ। আগে জানতে হবে কী লেখা আছে, হৃদয়ে ভক্তি থাকতে হবে, তবে তো পড়া-লেখা হবে। শুদ্ধ মনে পাঠ করতে হয়। তাই একসময়ে পুথিকে পুজো না করে কথকতার আরম্ভ বা শেষ অকল্পনীয় ছিল। এ হেন কথকতা করার অধিকারের একটা সূত্র পরম্পরা, পেশার ধারাবাহিকতা, এক কথক ঠাকুরের চেখে পুথির মাহাত্ম্য ধরা পড়েছে এইভাবে,

দেখলুম কথক ঠাকুর নবীন হলেও তাঁর পুঁথিখানা নতুন নয়। অনেক দিনের হাতে লেখা পুঁথি…ভাগবতের সবখানি এই পুঁথির মধ্যে ললিতাক্ষরে লেখা আছে। ধারে ধারে তিনপুরুষের হাতের লেখার নিদর্শন, ক্ষুদ্র টিপ্পনী। কোথাও শ্লোকের একপাদ, কোথাও পূর্ণশ্লোক আর কোথাও কোনো দৃষ্টান্তের সংকেত। যারা এই পুঁথি নিয়ে কথকতা করেছেন, তাদের রুচি ও শিক্ষা অনুসারে নানা শাস্ত্রের প্রমাণ পাশে পাশে সংগৃহীত।

গুরুদেব বলেছেন, পুরাণ যেমন ষট সংবাদ না হলে রুচিজনক হয় না, তেমন পুঁথিও তিন পুরুষের না হলে শোধন হয় না। এ সব পুঁথিও তিন চার হাত বদল হয়ে অনেক তথ্য পূর্ণ হয়, আর লিপিকর প্রমাদও সংশোধিত হয়ে যায়।৬৭

পুথি কথকের নিজস্ব কিন্তু সেই পুথি ধারা-বহির্ভূত নয়, পরম্পরায় বিধৃত। পাঠে পুথির সার্থকতা, পুরুষানুক্রমে পাঠের মাধ্যমে পুথি পোক্ত হয়। অবিরত পাঠে পুথির গৌরব বৃদ্ধি পায়, পুথি শুদ্ধ হয়। সেই জন্যই আসরে পুথির স্বচ্ছন্দ লেনদেন আছে। পুথি বলাটাই তো কথকতার একরূপ। কথক কালীপ্রসাদ দেবশর্মার চিঠির বয়ান হল, ‘এখানে আমার পুথি আরম্ভ হইয়াছে, কিছুকাল বিলম্ব হইবেক।’৬৮ আবার ১২৫৩ (১৮৪৬) সনের পৌষমাষে কথকতা করতে গিয়ে লক্ষ্মীনারায়ণ দেবশর্ম্মা ঠ্যাকায় পড়েছেন। শ্যামাচরণ ভট্টাচার্যকে অনুরোধ করে তিনি লিখেছেন, ‘কীন্তু লঙ্কাকাণ্ড পুস্তক এখানে অর্পাপ্ত হইআছে য়তেব ষুনিলাম জে আপকাদের গ্রামে এই পুস্তক আছে আপনি মম পিতি অনুগ্রহ পিকাস করিঞা ঐ পুস্তক এই লোক সমীভারে পাঠাইক্রে দিব।’৬৯

যেহেতু পুথি পাঠ করা হয়, তার চাহিদা আছে, তাই সবসময় মালিকের কাছে পুথি ফেরত যোগ্য। তাড়া খেয়ে ১২১৫ (১৮০৮) সনে মাণিকচন্দ্র দেবশর্ম্মা ‘যুদ্ধে মঞ্জরী ঠাকুর জীউ’ স্থানে একরারনামা লিখতে বাধ্য হচ্ছেন। ‘সন ১২০৫ পাচ সাল শ্ৰীযুত পিতা ঠাকুর আপনকার স্থানে হইতে শ্রীশ্রীভাগবৎ পুথী লইয়া আসীয়াছিলেন। সন ১২১৩ সালে সেহী পুথী নতুনবাজার মোকামে পাট করিয়া এখানে ছিল সে পুথী লইয়া সহরের সেবকবাটিতে রাখিয়াছি প্ৰকাষ করিয়া জাইবার কালে সহর হৈতে পুথী লইয়া আপনকার নিকট দিবো।’৭০

পুথি না হলে পাঠ হবে না। পুথি পরম্পরাগত কিন্তু পুথির মালিক আছে, তার উপরে কোনও না কোনও স্বত্ব আছে। পরম্পরার কাঠামোতে পুথির চরিত্র নির্ধারিত হচ্ছে, অথচ বিন্যাসে থাকছে বিন্যাসকারের দক্ষতা, নিজস্বতা। পাঠ সামূহিক, পুথিও সামূহিক পাঠের জগতে প্রোথিত, তার সার্থকতা সেখানে। তাহলে কথকের নিজস্ব মুনশিয়ানা কোথায়, তার সরহদ্দই বা কত দূর সেটা বিচার্য হয়ে ওঠে।

যেভাবে পাঠকের রূপান্তর ব্যাখ্যাকার ও কথকের মধ্যে হয়েছে, ঠিক সেইভাবে কথকের পুথি রচনাও, মূল গ্রন্থের অনুসারে, একটি মাধ্যমিক স্তরের মধ্য দিয়ে দানা বেঁধেছে। এশিয়াটিক সোসাইটিতে রক্ষিত আলোচনা প্রসঙ্গে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই জাতীয় রচনার কথা উল্লেখ করছেন। রামায়ণ, মহাভারত বা ভাগবত আয়তনে বিশাল, নানা শ্লোকে ও জটিলতত্ত্বে পরিপূর্ণ। ফলে কোনটা রাখব আর কোনটা বাদ দেব, সেটা কথকরা ঠিক করতেন, মূল গ্রন্থ থেকে বেছে বেছে আখ্যান ও শ্লোক সাজিয়ে একটা নির্বাচিত সংকলন তৈরি করতেন। রমাপতি এইভাবে উত্তরাকাণ্ডের কথা সংগ্রহ করেছেন, কেশব পঞ্চানন ভট্টাচার্য এইভাবে ভাগবতের কথা চয়ন করেছেন, গালভরা নাম দিয়েছেন ‘হরি-ভক্তি তরঙ্গিনী’। উনিশ শতকের গোড়ায় গণেশ বিদ্যাবিনোদ একই পদ্ধতিতে ৫৯০টি শ্লোকে রামায়ণের আদিকাণ্ডের কাহিনীর চুম্বক দিয়েছেন। এই সংগ্রহ গ্রন্থগুলি আখ্যানের মূল কাঠামো, কোন কোন বিষয় আলোচিত হবে তার নির্দেশ। এই কাঠামোর উপরে প্রলেপ দেওয়া হয়, তৈরি হয় কথা এবং আখ্যান। এই সংগ্রহগুলি লেখা হত সংস্কৃতে। মূল শ্লোক থাকত, সঙ্গে সঙ্গে সহজ সংস্কৃত গদ্যে গল্পসারও দেওয়া হত। সম্ভবত ওইগুলির উপর ভিত্তি করেই দিবাকালের পাঠকে প্রথমদিকের কথকরা সন্ধেবেলায় লোকের সামনে অনুবাদ করতেন; এই জাতীয় সংগ্রহ করার প্রথম উদ্দেশ্য হয়তো তাই ছিল।৭১ কথকের ভূমিকা প্রসারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে এই সংগ্রহের কাঠামোও পরিবর্তিত হয়।

‘আদিকাণ্ড’ কথা পুথিতে নানা আখ্যানের চুম্বক দেওয়া আছে, ‘কথকস্য কথা’ যেমন গঙ্গাবতরণ, ‘রামাদয়ো মিথিলায়াং চলিতাঃ।’ আবার তারই সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে জটায়ু-মারীচবধ অথবা ‘জনস্থানে রমতা রামেন শূর্পনখা বিরূপিতা।’ এমনভাবে বাক্যবিন্যাস করা হচ্ছে যাতে করে বাংলায় রূপান্তরিত করতে কোনও অসুবিধা না হয়, ‘সরযূতীরে কোষলো নাম জনপদস্তু অযোধ্যানাম নগরী’। আখ্যানের কাঠামোর সূত্রটি সাজানো হয়ে রইল।৭২

আবার এইরকম সহজ সংস্কৃতে আখ্যানভিত্তিক আরেকটি পুথির মাঝে জনকের মুখে একটা সংস্কৃতগন্ধী বাংলা শ্লোক জুড়ে দেওয়া হয়, বোধহয় শ্রোতাদের কাছে লাগসই শোনাতে পারে। যেমন,

‘জনক উঃ জগদম্বার শ্লোক

নম অন্নদা অন্নপ্রদান করা।

ত্বয়ী দিনদয়াময়ী দুঃখহরা।

হে শুভঙ্করী সঙ্কট শান্তিকরা।

জগদম্বে জগন্মাতা যোগধরা॥

হে কাশীশ্বরী শঙ্করি অন্নদাতা।

শমনস্য ভয়ে সদা রক্ষ মাতা॥

ত্বয়ি শিব সনাতনী শক্তি প্রদা।

এ অশক্তজনে বরদে বরদা ॥

অতি অকৃতি দুৰ্ম্মতি দিন হীনে।

ওগো দিনময়ি কর ত্রাণ দিনে।৭৩

আবার আরেকটি ‘সংগ্রহের’ পুথিতে ‘দেশে দেশে কলত্রাণি’র মতো রামায়ণের বিখ্যাত শ্লোকগুলির মধ্যে হঠাৎ কুম্ভকর্ণের একটি সংলাপ বিচ্ছিন্ন পাতায় দেওয়া হল: ‘কুম্ভ উঃ দিকপালান্ ভক্ষয়িষ্যামি ২ পাবকং। দেবান্ বিপ্রান্ বধিষ্যামি।…পাতয়িষ্যামি নক্ষত্রঞ্চ মহীতলে। শতক্রতুং বিজেষ্যামি পশ্যামি বরুণালয়ং। পবর্তন চূর্ন্তুয়িষ্যামি। দারয়িষ্যামি মেদিনীং। মহাদেবং বধিষ্যামি পশ্যাদা বিক্রমং মম।’ বলাবাহুল্য, পাঠের মজলিশে সংস্কৃতে লেখা এই ধরনের সংলাপকে মুখে মুখে বাংলায় করে দেওয়া আদৌ দুঃসাধ্য নয়। এই বিশেষ সংগ্রহ পুথিটিতে স্থানে স্থানে বিচ্ছিন্ন পাতায় বাংলায় লেখা সাটও আছে, যেমন, ‘অশ্বমেধ যজ্ঞাবসানে অযোধ্যা মণ্ডল মধ্যবর্তী সৌধ নিকর মণ্ডিত প্রাঙ্গণে বিবিধ ক্ষৌমরাদি [?] বসনোনির্মিতাসনোপরি নৃপ নৃপতিগণ স্ত্রিয়গণ দিব্যসিংহাসনোপবিষ্ট…গাওরে কি রামায়ণ গান শিখেছো।৭৪ সহজ সংস্কৃতে লেখা গদ্য সংলাপের পাশাপাশি বাংলা সাটও লেখা হচ্ছে, সংগ্রহের কাঠামোয় নানাভাবে যোজনা চলছে, যোজনা কাঠামোকে রূপান্তরিত করছে স্বতন্ত্র পুথিতে। এই রদবদলের প্রক্রিয়া ধরা পড়ে এক কথকের লেখায়:

আমি মনে করেছিলুম, ভাগবতের মূল শ্লোক আর কোন প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যা বোধহয় পুঁথিখানায় আছে। ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করে জানলুম, তা নয়। মাঝে মাঝে কোথাও ভাগবতের মূল শ্লোক আছে, আর প্রায়শঃ নানা শাস্ত্রের প্রমাণ, উপাখ্যান আর তার সঙ্গে দৃষ্টান্তগুলির উল্লেখ করা হয়েছে। দেখলুম, কয়েকখানা পাতায় সমাসবহুল সুদীর্ঘ বাক্যাবলীর সমষ্টি আছে। সেগুলি মূল পুঁথির অংশ নয়, কিন্তু খোলা পাতা হিসাবে ঐ সঙ্গেই আছে। ঠাকুর বলেন, ঐগুলি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এই পাতাগুলির মধ্যে কোনটা বনের বর্ণনা, কোনটা পর্বতের বর্ণনা আর কোনটা রাজসভা বা নগরের বর্ণনা। এই বর্ণনাগুলো কথা জমানোর জন্য খুব প্রয়োগ হয়ে থাকে।৭৫

পুরাণকাব্য থেকে সংগ্রহ, আবার সংগ্রহ থেকে নানাভাবে প্রসারিত ও যোজিত হয়ে কথকের পুথি—এই স্তরে উপনীত হবার প্রক্রিয়ায় যোজনার কয়েকটি সাধারণ সূত্র ধরা যেতে পারে। প্রথমত, আখ্যান বিন্যাসে আমরা লোককথা ও পৌরাণিক কাহিনীর মিশ্রণ দেখি, দৃষ্টান্ত হিসাবে লোকগল্পকে বার বার হাজির করা হয়। এই কায়দাকে অগ্নিপুরাণের ভাষায় বলতে পারে ‘কথান্তরম’, এক কথার মধ্যে অন্য কথা ঢুকিয়ে দেওয়া যাতে করে মূল কাহিনীটা জোরদার হয়। দ্বৈপায়ন ব্যাস বনে যাচ্ছেন। মায়ের কান্না শুনে থেমে গেলেন। মাতৃভক্ত। তাই মাকে গল্প শোনালেন। বলা হল কিন্তু ‘ইতিহাসং শৃণু’। ঠিক যেমন ঘটেছিল, ঠিক তাই। শুদ্ধমতি বামুন, তার বৃদ্ধা মা এবং হিংসুটে বউ। ‘ইতিহাসং শৃণু’র পরেই ভাষা বদলে গেলে, তার রওয়ানি হয়ে গেল অন্যরকম। মায়ের বিরুদ্ধে বৌ-এর হিংসা ও স্বামীকে উত্তেজিত করার নমুনা: ‘ওর স্ত্রী বলে মলো আমি কেয় নই। বানে ভেসে এসেছি। শাশুড়ি বুড়ি ঘরের বালাই। থাকতে সুখ হবে না। দূর করে দেবো। তবে বাঁচবো।’ আর রাত্রে স্বামীর পা টেপার সময়

চকের জল শুদ্ধমতির পায়ে পড়লো। ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। কেন? প্রিয়ে কাঁদ কেন। কি জন্যে স্ত্রী যদি কাঁদে পুরুষ টো ব্যস্ত হয়। কি চাই বল। আমি মলেই বাঁচি। আমার কপালে আর সুখ নাই। পাড়া প্রতিবেশিনীরে দুদে ভাত খায় একদিন দুগ্ধো অন্নে খেতে পেলাম না। আর শোনার কি রূপোর আঁচোড় গায়ে হলো না। বলে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। হাবি কাঁদিসনে, সব দেবো।

লোককথায় ঝগড়াটে বউ-এর রূপও এসেছে। স্বামী রোজগারে বেরুলে শাশুড়ির প্রতি স্ত্রীর মূর্তি,

প্রাচীনা বলে ও বৌমা বড় ক্ষুধা পিপাসা দেয় না খাই। ও ঘরে’ হতে বেরিয়ে ভিমরুলের চাকের মত মুক ফুলিয়ে বলে মাথা নেড়ে মরহ, আকন্দ ডাল [sic] মুড়ি দেরমোচো তোমার মরণ নাঞি মা ককুণ্ডর’ প্ৰেমাই পেয়েচো যম বা তোর পাঁজি পুতি ভুলে গেছে।

শাশুড়ি ডাইন, বনে ছেড়ে দেওয়া উচিত, তাই স্বামীকে বলা হয় ও তুক করা হয়,

ওমা কি হবে? মরণ কেন হলো না। পাড়ায় কাকে খেয়ে এসেছেন। নজ্জায় মুক পাততে পারি না। আমার সোনার ঠাকরুণকে কে আড়ি করে চোষকা মন্ত্র দিয়ে গেছে হে।… তুমি বাঁচালে হয়। সাবধানে থেকো। ওয়ো হলে নাকি আপনারই ঘরেই আসে। আমাদের কপালে জা থাক তুমি বেঁচে থাকো। হাতের কগাচি থাক।…এই বলে সাঁড়ের গোবর কেঁচোর মাটি পিদ্দিমের শিশ। কপালে দিলে আর ফু ২ করে বুকে ফুৎকুড়ি

স্বামীকে ভজিয়ে বনে শাশুড়িকে পাঠাবার পরে বউয়ের আনন্দ আর ধরে না।

দুর করেচি ঘরের আপদ। এখন একলা একেশ্বরি। সৃষ্টিধরী হয়ে বসেছি। খাবো দাবো নাচবো গাবো।…বার বার পথ দেকচে। স্বামি ফিরে এলে হয়। আর আহ্লাদে মাজখানাটা ভেঞে ২ ফেটে ২ পড়ছে।…জেন ফুটি ফটা কাঁকুড় ফাটা ফুটকড়াই আটখানা হয়ে দুটি বুড়ো আঙুলে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে পৃথিবী সরা দেখছে।৭৬

দ্বৈপায়নের জন্ম ও জীবনবৃত্তান্তের মধ্যে এই কাহিনী নিয়ে আসা হল মাতৃভক্তির মাহাত্ম্য প্রচার করতে; সত্যবতীর প্রতি ব্যাসদেবের চিরন্তন আনুগত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা উদ্দেশ্য। কিন্তু গল্পের ভাষা ও বস্তুর অভিমুখে ভাগবতী আখ্যানের বিপরীত, লোকগল্পের মেজাজ ও ছক স্পষ্ট। তাই মার্গ ও লোকের মিশ্রণ দেশজ রীতির জন্ম দেয়, সেই রীতিতে কথকতা করা হয়। আধুনিককালে দ্বিজরাজবাবুও এই রীতির ব্যতিক্রম নন। রামের সভায় লবকুশ রামায়ণ গাইতে এসেছে। সকালে তারা অযোধ্যানগরী ঘুরে বেড়াচ্ছে। তখন ময়রার দোকান থেকে বিনা পয়সায় মিষ্টি খাওয়ার যে ফন্দি লবকুশ বার করেছিল, তা আমাদের ছেলেবেলার শোনা গল্প: ‘বাবা, মাছি রসগোল্লা খাচ্ছে’ বা ‘পিঁপড়ে রসগোল্লা খাচ্ছে।’ আসরে বাচ্চারা গল্পটা শুনে হেসে ফেলে, আমাদেরও ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়, কাহিনীতে মৌতাত ধরে যায়। কিন্তু যতই কথান্তর হোক না কেন, সুতো যতই ছাড়া হোক না কেন, গোটাবার কায়দা জানতে হবে, মূলে ফিরতেই হবে।

আখ্যানের মধ্যে চরিত্রায়নের জন্য ছোট ছোট ‘চুটকির’ মতো রচনা থেকে যায়। এইগুলিতে থাকে লৌকিকের স্পর্শ, কথকের উদ্ভাবনা। কয়েকটা নিদর্শন দেওয়া যেতে পারে। দেবকীর প্রথম সন্তানকে ভাগবতী কংস বধ করতে অনীহা প্রকাশ করে। পরে নারদের কাছে দৈবী চক্রান্তের কথা শুনে সব ক’টি সন্তানকেই হত্যা করল। কথক এই সূত্রকে নিজের মতো করে সাজিয়েছেন। কংসের কাছে বসুদেব প্রতিশ্রুত, তাই দেবকীর গর্ভের প্রথম সন্তানকে নিয়ে এসেছেন।

‘কংস উঃ সদ্যজাত সন্তান, অচ্ছিন্ন নাড়ী। রুধিরাক্ত এ সন্তান লএে সভায় কেনো। তুমি কি খেপেচো নাকি।

বসুদেব প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিলেন। তখন,

ওহে বসুদেব ও কথাটা আমার মনে নাই। মিথ্যাতে তোমার এতো ভয়। আমরাত প্রতিদিন কতো মিথ্যা বলে থাকি। ওহে বসুদেব তোমার বাড়িতে কি সত্যের গাচ আছে। তোমাকে আমার পণ্ডিৎ বলে জ্ঞান ছিলো। এখন জাল্লেম জে তোমার তুল্য মূর্খ আর জগতে নাই।…আকাশবাণি হয়েছিলো। দেবকীর অষ্টম গর্ভের পুত্র হতে আমার বিনাশ হবে। প্রথম জাতো শন্তান কি অপরাধ করে। তোমার হৃদীএে কি দয়া নাই। লএ জাও ২ গৃহে ললে যাও।

ভাগবতী কংস ও কথকতার কংসে প্রভেদ প্রচুর। কংসের মুখে এইরকম বিচারবোধ তাকে অনেক স্বাভাবিক করেছে, সত্য ও মিথ্যা দৈনন্দিনতার ছাপ লেগেছে। আবার ‘টাইপ’ চরিত্র হিসাবে নারদকে আনা হয়েছে, তার পরামর্শে কংস শিশুকে হত্যা করল। পরামর্শটাও একটি লৌকিক হিসাবের ধাঁধা। কথকতা পুথিতে বেশ বিস্তৃত করে লিখেছেন:

নারদ উ। বটে তুমি অষ্টম কারে বলো। কংস উ॥ সপ্তমের পর জে তারে অষ্টম বল্লি। নারদ উ॥ সপ্তমের পর তারে অষ্টম বলো। ভালো আট্টা মণি আনওয়েন করি দেখি। কংস মহারাজ তৎখনাৎ মণি আনওয়েন কল্লেন। নারদ উ॥ এখানে রক্ষ্যা করে গণনা করে দেখি। কংস গণনা করতে লাগলো। একো দ্বি তৃ চত্তূঃ পঞ্চ শষ্ঠ সপ্তম অষ্টম, এইটি অষ্টম হলো। নারদ বলেন বটে ওইটা বাদিকে রেখে গণনা করো। কংস পুনরায় গণনা করে। পূর্ববৎ এক দ্বি ত্তৃ চত্তু পঞ্চ শষ্ঠ সপ্তম অষ্টম। আজ্ঞা হল সপ্তমটা অষ্টম হলো জে।…এইরূপ পণপুরাণ নাত্রে দ্বারায় দেবর্শী নারদ শকলগুলোকে অষ্টম করে দেখালেন। পণপুরাণ ন্যায় কেমন। জেমন একগণ্ডা দুই গণ্ডা করে কুড়ি গণ্ডা করে এক পণ হলো। আবার সেই সকল একত্র করে পুনরায় গণনা কত্তে গেলে আবার এক গণ্ডাতে কুড়ি গণ্ডা হয় সেইরূপ সকলগুলি অষ্টম হলো।

শ্রোতার কৌতূহল উস্‌কে দিকে কথক নিজে লেখেন, ‘বলো দেব ঋষি-নারদ কংসকে এমন উপদেশ কেন কর্লেন।’ কারণ লোকবিশ্বাস ও দেবরোষ। ‘মৃতবৎশা’ স্ত্রী নাকি শীঘ্র গর্ভধারণ করে তাই ছটি সন্তান বিনাশ হলেই ‘অবিলম্বে বৈকুণ্ঠনাথ হরি ভূতলে অবতীর্ণ হবো।’ আর ‘কংস বালক বিনাশ করে প্রচুর পাপ সঞ্চার করুক। তাহলে শীঘ্রই জমালয়ে গমন করবে।’৭৭ যুক্তির ফাঁক নেই। পরিকল্পনাটিও নারদের লোকগ্রাহ্য কুঁদুলে স্বভাবের সঙ্গে মিলে যায়, তাঁর পাতা ফাঁদে বোকা কংস পা দেয়, দৈবী জগতের চক্রান্ত রূপান্তরিত হয় লৌকিক জগতের প্যাঁচ-পয়জারে। আর সেই বুনটটি কথক নিজেই বানিয়ে তোলেন, পৌরাণিক আখ্যানের টানেতে লোক অভিজ্ঞতা সহজে খাপ খায়।

পৌরাণিক আখ্যানের ধারার মধ্যে এই রকম ছোট বুনটের কাজ, গায়কীর মতো কথকী ‘গিটকিরি’ পালায় গতি সৃষ্টি করে, বৈচিত্র্যও বাড়ায় দৈবী চরিত্রের মহিমায় মানবিক মাত্রা যোগ করে। এই বুনটের কাজগুলি ঘটনা ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াভিত্তিক, মূল কাহিনীর ইতি-উতিতে আবদ্ধ। লঙ্কায় রাম সীতাকে অগ্নি-পরীক্ষার আদেশ দিয়েছেন। কথকের বর্ণনায় হনুমান সেই মুহূর্তে অকুস্থলে নেই, কুবেরের উদ্যান থেকে ফুল আনতে গেছে। ফিরে এসে সাজানো চিতা দেখে হনুমান চটে আগুন।

‘এই কথা শ্রবণ করে হনুমানের ভাবোন্মাদ হল। আমার মা অশতি। অশতি বলে রাম তারে ত্যাগ করেছেন আজ দেখিবো রাম কেমন বির।’

পুথিতে হনুমান বলে ‘রামং যমগৃহং নয়ামি।’ শালগাছ তুলে রামকে আক্রমণ করেন, লক্ষ্মণের সঙ্গে লড়াইয়ের প্রবৃত্ত হন। অনুযোগ করেন,

‘জদি মাকে প্রতিপালন কর্তে পারবে না আমায় কেনো বল্লে না। আমি ভিক্ষা করে মাকে খায়াতেম।’ রামের সব কৃতিত্ব হনুমান নাকচ করে এইভাবে।

‘জদি বলো রাম হরধনু ভঙ্গ করেছেন। শে ধনু বহুকালের পুরাতন জির্ন্ন হয়েছিলো।’৭৮

হনুমানের এই মূর্তি প্রচলিত তুলসীদাসী, বাল্মীকি বা কৃত্তিবাসী রামায়ণে নেই, সুত্রাকারেও উল্লিখিত হয়নি। কিন্তু ভক্ত হনুমানের এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক লোকগ্রাহ্য, ওই রকম এক পরিস্থিতিতে রামের অপ্রত্যাশিত আচরণে যে নাটকীয়তার সম্ভাবনা ছিল কথক সেই সুযোগ ছেড়ে দেননি। ভক্ত হনুমানকে দিয়ে রামের আচরণের প্রতিবাদ কথক করিয়েছেন। ন্যায়পরায়ণ ও সীতাভক্ত বলে হনুমান লোকগ্রাহ্য চরিত্রে মিশেও গেছেন।

এই রকমই আর একটি টুকরো ঘটনার কথাও কথক উল্লেখ করেছেন, একটি ভাবকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। স্বর্ণলঙ্কায় লক্ষ্মণ মোহগ্রস্ত, অযোধ্যায় ফিরতে ইচ্ছুক নন। তাই লঙ্কার বাইরে বেড়াতে গিয়ে দেখলেন যে মাথায় আগুনের পাত্র ও পায়ে লৌহবর্ম্ম পরে এক দল কৃষক চাষ করছে। মাংসাশী পাখি ও বিষধর সাপের উপদ্রবের জন্য তাদের ওই রকম বেশ। তখন,

লক্ষ্মণ উ ॥ এইস্থানে জদি এতো ভয় এস্থান ত্যাগ করে অন্যত্র বাশ করো না। কৃশকেরা বলেন শে শত্য। কিন্তু জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী। এই নিমিত্ত আমরা এস্থান পরিত্যাগ করে অন্যত্র গমন করতে পারি না, লক্ষ্মণের মনে? আমারো জননী জন্মভূমি আছে।৭৯

এইভাবে নানা জায়গা থেকে শোনা, তুলনামূলকভাবে অপ্রচলিত সূত্র থেকে নেওয়া বা নিজেরই তৈরি করা গল্প কথার বুনটে ধরা থাকে, অভিযোজনের মধ্য দিয়ে কথকের বৈশিষ্ট্য বোঝা যায়। আখ্যানগুলোর মার্গীয় কাঠামো, এই রকম সংযোজন ও কথান্তরের ফলে লোভাবনার নানা স্তরে প্রসারিত হয়। পরিবর্তিত হয়ে দেশজ রীতির অঙ্গ হয়ে ওঠে। হুতোমি ঠাট্টায়, কথকঠাকুর বস্তুত যা বলেন, ‘সকলি কাশিরাম খুড়োর উচ্ছিষ্ট ও কোনটা বা স্বপাক’।

কথার অন্য লক্ষ্মণ বিচারে দণ্ডী নির্দেশ দিয়েছেন প্রাকৃতেও কথা গ্রাহ্য। ভারতের শ্রেষ্ঠ কথা সংগ্রহই তো লেখা হয়েছে, ‘ভূতভাষায়’। যে কোনও কথকতার পুথিতে নানা ভাষার সমন্বয় চোখ এড়াবার নয়। এক দিকে সমাসবদ্ধ দীর্ঘ বাক্য, বর্ণনা, সাট অন্য দিকে যথাস্থানে সুযোগ মতো পরিস্থিতি বুঝে একেবারে লোকজ সংলাপ। একটা নজির দেওয়া যাক:

ক্রমশ দেবকীর গর্ভ বর্ধিত হতে লাগিল। একদা মথুরাবাশিনী স্ত্রি শকল কুম্ভকক্ষে যমুনার জল আনয়ন করিতে গমন করিতেছে পথিমধ্যে মনে ২ ‘অ দিদি চল ন্না একবার দেখে যাই কারাগৃহে বসুদেব দেবকী কি কর্চে। অম্নি জাৎ লোকের ভাল্লয় হগ, আর মন্দই হগ, না দেখলে যাবেন না।’ পথিমধ্যে কুম্ব রক্ষ্যা করে কারাগৃহদ্বারে গমন করে দ্বারের উভয় পার্শ্বে হস্তার্পণ করে দাড়িএে দেখেন দেবকীর বশুদেবের রূপেতে করে কারাগৃহ জেন আলোকিত হএেচে। দেখে বলেন মাগো বসূদেব রূপেতে জেনো ফেটে মরচে। মাগির কিরূপ হএেচে। মাগিদিগে চাও জায় না। মিনশে জেন রূপের কাঁদি হয়েছে। কোন স্ত্রি বলেন তা অমন হয়। জতো বেটা বেটি মরে বাপ মাএের রূপ হয়, গতর লাগে।৮০

বর্ণনা সাধুভাষায়, তৎসম শব্দযুক্ত সংলাপে শব্দ প্রয়োগের ধরন একদম অন্যরকম ‘মাগি’, ‘গতর’, ‘রূপের কাঁদি’ ইত্যাদি প্রাকৃত শব্দ প্রয়োগে বাছ-বিচার নেই। যা কথায় স্বাভাবিক, পুথিতে হুবহু তাই বসানো হয়েছে। এই স্বচ্ছন্দ ‘গুরুচণ্ডালি’ কথকতার ভাষার জোর; কেবল স্ত্রীদের সংলাপেই নয়, পরিস্থিতি বর্ণনাতেও এর লাগসই প্রয়োগ দেখা যায়। বৃন্দাবন থেকে মথুরায় কৃষ্ণকে আনার জন্য দূত চাই; দূত খোঁজার আয়োজনের বিবৃতি লক্ষণীয়:

বৈষ্ণব না হলে বিশ্বাস করে আসবে না। একজনা বৈষ্ণব দেখ। এই সুনে মালা ছিঁড়ে তিলক পুছে সব পলায়ন। একজন দেখে বলেন ঐ বৈষ্ণব কিহে তুমি বৈষ্ণব নও। কোন পুরুষেই নই। অপ্রলাপ কথা জাকে জা নয় তাই বল। উুহু মসয় পাওয়া যায় না। একজন বলে অক্রূর মালা হাতে করে না। হাঁ হাঁ ডেকে আন। উনি শুনে বাড়ী গিয়ে লুক্কাইত। অক্রূরের স্ত্রী বলে বড় হাঁপিয়ে এলে জে। চুপ কর ২। তুমি হাতের কগাছি রাখবে না খুয়বে বলত। কংস দূত ধর্তে আসছে। তুমি জেন প্রকাশ করো না। আ মলো পোড়া কপালের দশা। তেমন মেয়ে নই বলবার জন্য মর্চ্চি। এমন কালে কংস দূত আগমন কোথা গো অক্রুর বাড়িতে আছ।৮১

সংলাপ ও ভাষার বিন্যাসে নাটকীয়তা সৃষ্টি করা হল। মথুরায় ত্রাস ও শোরগোল, সেই মেজাজের সঙ্গে তাল রেখে ভাষা ও সংলাপ সাজানো হচ্ছে যাতে করে বলার সঙ্গে সঙ্গে ওই ভাব কথার বাঁধুনিতে ধরা পড়ে। বিবৃতির বয়ানটা প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ নয়। ‘যদুশ্রেষ্ঠ’ কংস-পার্ষদ অক্রূর রূপান্তরিত হচ্ছেন ভক্ত কিন্তু ভীরু বৈষ্ণবে।

আবার আর্তির ও আসন্ন অপমানের ভয়ের মেজাজকে ধরা হয়েছে সরাসরি সংস্কৃত শ্লোক ও টেনে টেনে বাক্য রচনার মিশেলে। পাশাখেলায় পাণ্ডবরা পরাজিত হবার পর। একটি পুথিতে দ্রৌপদীর অবস্থা ও মানসিকভাবের পরিচয় দেওয়া হয়েছে এইরকম ছত্রে:

মহারাজ জন্মেজয় কি কর্বো। রাজসূয়াবভূমে জনেন মহাক্রতৌমন্ত্রপূতেন শিক্তাঃ। সা পাণ্ডবানাং পরিভূয়বীর্যবলাৎ প্রমূষ্যাধৃতরাষ্ট্রিয়েন। উ॥ মৃত্যু উপস্থিত বুঝি॥ কি হলো রে॥ বাড়িতে ডেকে এনে এই করলে। ধন নিলে॥ এই অপমান॥ গোবিন্দভিষিক্ত এ কেশ। কালশাপ দংশিলে সে বিষত্রাণ পাবি নে।৮২

কথকতায় ভাষা বদলের এই নজরকাড়া রীতি বঙ্কিমের সমজদারিতে ধরা পড়েছে। তাঁর মতে, কথকতায় নানা অঙ্গ, ব্যাখ্যা, বর্ণনা, পদাবলী ও গান। প্রথম অঙ্গে ভাষা সংস্কৃতানুসারী, জমাট ভাবকে শিথিল করে। পরিস্থিতি বর্ণনায় আবার ভাষা প্রয়োজন বোধে জমাটি, সংস্কৃত-অভিসারী। পদাবলীর উদ্দেশ্য ঝঙ্কার ও লালিত্য তৈরি করা; রসানুযায়ী গানের ভাষার রকমফের হয়। কিন্তু এই সবের মধ্যে কথকতার ভাষার নিজস্বতা দেখা যায় পরিস্থিতি বর্ণনায়, ‘রসোদ্দীপন’ যার লক্ষ্য। বঙ্কিমচন্দ্রের নিজস্ব কথায়:

ইহার বাক্য (Sentence)-গুলি ক্ষুদ্রাবয়বের হয়, অনেক ক্রিয়াপদ অনুক্ত থাকে, অনেক ক্রিয়া বিশেষণও অনুক্ত থাকে, ক্ষুদ্র বাক্যের পর দীর্ঘচ্ছেদ থাকে, কখন কখন কোন বিশেষ কথায় শ্রোতার (বা পাঠকের) মনঃসংযোগ করার জন্য পুনরুক্তি থাকে, আর কথকদের স্থানে এই ভাষার সহাকারী নানা ভঙ্গী থাকে। এই ভাষা হৃদয়চ্ছেদ করিয়া পাটে পাটে বসিতে থাকে।…ইহাতে ছোট ছোট জমাট বাক্যের গাঁথনি থাকে। জমাট পদগুলিকে পৃথক করিয়া লইলে সংস্কৃত পদ বলিয়া বোধ হইতে পারে, কিন্তু সমস্ত গাঁথনি ভাগবতের ন্যায় জটিল রীতি যুক্ত নয়।৮৩

কথকের মুনশিয়ানার আর একটি পরিচয় হল তত্ত্বকথা আলোচনা করা, নানাভাবে সামাজিক মূল্যবোধ ও আচারের সঙ্গে কাহিনীকে সংযুক্ত করা। সরাসরি কথক ব্যাখ্যার মাধ্যমে, প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে, এই জাতীয় ক্ষেত্র তৈরি করতে পারেন বা অনেকসময় চরিত্ররা সংলাপের মাধ্যমে নানা পরিস্থিতির উপর মন্তব্য করেন। যাকে চিরন্তন ও শাশ্বত বলে মনে করা হয়, তাকে দৈনন্দিনতার মধ্যে মেশাতে হবে, তা না হলে কথকতার সামাজিক গ্রাহ্যতা বিপন্ন হবে, যৌথের ধারণার সঙ্গে কথকতার বিযুক্তি ঘটবে।

শিবের বিবাহের পর শিব বাড়ি যান না, ঘর জামাই হয়ে থাকেন, মেনকার জ্বালার অন্ত নেই। কথক রামপদ ভট্টাচার্য নিজে একটি বাক্যে প্রেক্ষিত ঠিক করেন, পরে মেনকার উক্তি বসান:

এখন শশুর বাড়িতে অধিককাল থাকলে সকলে বিরক্ত হয়। একদা মেনকা উ॥ আমি একলা মেয়েমানুষ কদিক করবো। প্রত্যহ আর জামাই আদর কর্ত্তে পারি না। উমাও ঘরের একখানি কাজ করবে না। কেবল দুজনে খাবেন আর ঘরের ভিতর রাতদিন বসে থাকবেন, দেখে দেখে গা জ্বলে যাচ্ছে। জামাইটি মানুষ হয় না। কেবল ভাঙা ধুৎরা খাবে আর চিরকাল শশুরবাড়ি বসে থাকবে। এদের উপায় হবে কি।৮৪

‘ইতিহাস শৃণু’, এই বললেন একজন কথক। ‘এখন শশুর বাড়িতে অধিককাল থাকলে সকলে বিরক্ত হয়’, এই কথা লিখলেন আর একজন। অতীত ও বর্তমান দুটোই বলা যেতে পারে, পৌরাণিক সময়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে। বর্তমানকে মাথায় রেখে মেনকা উচ্চারণ করেন লাখ কথার এক কথা ‘এদের উপায় হবে কি? উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে গ্রাম বাংলার বা মফস্বলী শ্রোতার কাছে প্রশ্নটা পরিচিত, তাৎক্ষণিক। পৌরাণিক আখ্যানের মধ্যে বাস্তব উঁকি মারে।

আবার কতকগুলি আখ্যানের ঝোঁক এইরকম, যে তত্ত্বকথা আনতে হয়, না হলে মূল্যবোধের সঙ্কট দেখা যাবে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে লালিত নৈতিকতা মার খাবে। ‘রাসলীলা’ কথকতার অতি জনপ্রিয় আখ্যান, বৈষ্ণবীয় তত্ত্বের কেন্দ্রবিন্দু অথচ লৌকিক ক্ষেত্রে তার তাৎপর্য ‘উচ্ছৃঙ্খলতার’ জন্ম দিতে পারে। নানাভাবে কথকতার পুথিতে এই সমস্যাকে মোকাবিলা করতে হয় কারণ শ্রোতাদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা তো আর কম নয়। তাই পুথিতে সরাসরি সমস্যা উত্থাপন করতে হয়, পূর্বপক্ষ ও সিদ্ধান্ত পক্ষের ধাঁচে তাকে নিরসনও করতে হয়। উদাহরণ দেওয়া যাক।

এক উপপতি শেবা অতি ভয়াবহ কৰ্ম্ম। কোন গৃহস্থের গৃহে গমন করলে পর তাকে সমাদর করে না। নিকটে বশতে দেয় না। সকলের নিকট খাটো হয়ে থাকতে হয়। অধিক কি বাড়ির কর তাকে বলতে হয় চাকর বাবা ভাৎ খাও এসে। সে বলে জায় না ঠাকরুণ তোমার স্বভাব ভালো নয় তোমার হাতের অন্ন ব্যঞ্জন ভোজনে ইচ্ছা হয় নাই। দেখোদেখি এমনি কর্ম্ম চাকরের নিকট খাটো হয়ে থাকতে হয়।৮৫

এইরকম সামাজিক অবস্থায় গোপীদের প্রেম কেন সমর্থনীয়? যুক্তি দেওয়া হচ্ছে:

এক জে অমৃত তারে বিশ জ্ঞানে পান কল্লেও অমর করে। এক অমৃতজ্ঞানে পান কল্লেও তাতেও অমর করে। অমৃতের কার্জ যে অমরত্ব প্রদান ত্তাই করে থাকে। তেম্নি পরমাত্বা জে হরি তাকে গপি শকল উপপতি বুদ্ধিতেও চিন্তা করেও গুণময় দেহ ত্যাগ করে নিত্য দেহ পেয়ে কৃষ্ণ নিকটে সর্বাগ্রে গমন কল্লেন। …জে কাম নরকপ্রদ সেই কাম জদি ঈশ্বরে অর্পণ করতে পারো তাহলে সে মুক্তি লাভ করে। জে জেভাবে চিন্তা করুগ। তা হল্লেও তো ঈশ্বর চিন্তা হয়॥৮৬

কিন্তু কৃষ্ণের তরফে যুক্তি কী? সমস্যা প্রশ্নাকারে রাখা হল, পূর্বপক্ষ স্থাপিত হল।

পর স্ত্রি জে গোপীসকল তাহার সহিৎ রাশ ক্রিড়া কল্লেন। এতে ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ হলো। জদি বলেন আপ্তকাম পুরুষের ইহা অধর্ম্ম নয়।… আমার এই জিজ্ঞাশ্যো। জদি। জদুপতি শ্রীকৃষ্ণ আপ্তো কাম তবে কি অভিপ্রায়ে নিন্দিত কৰ্ম্ম করলেন। এ বিষয়ে আমার সংশয় উপস্থিত হয়েছে।৮৭

সংশয় নিরসন করা হল, পূর্বপক্ষের আপত্তি খণ্ডন করা গেল।

ধর্ম ব্যতিক্রমো দৃষ্ট।…জেমন শর্বভুক অগ্নি সকল ভোজন করেন বিষ্ঠাও ভোজন কর্চ্ছেন এবং গো-মহিশাদি ভোজন কর্চ্ছেন। তা বলে কি তিনি অপবিত্র হন। সেই অগ্নি আবার যজ্ঞিয় হবি ভোজন করে থাকেন।

…জদি বলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আপ্তকাম হয়েও॥ তিনি এরূপ কার্জে কেননা প্রবিত্ত হয়েন ॥ এ বিষয়ে আপনি শ্রবণ করন। জদিও ভগবান আপ্তকাম তথাপি ভক্তজনের প্রতি অনুগ্রহ করার নিমিত্ত মনুষ্যদেহ আশ্রয় করে এইরূপ রাশক্রিড়া করেন।৮৮

আর শেষ কথা হল সব কাজ সবার সাজে না, ক্ষমতার তারতম্য আছে। দেবতা বলে কথা। ক্ষমতার ভাষাকে শেষপর্যন্ত রূপান্তরিত করা হয় যুক্তিতে,

…জেমন রুদ্র মহাদেব ব্যতিরেকে অন্য ব্যক্তি বিশ পান কল্লে তৎক্ষণাৎ মুত্যু হয় তেমনি কোন মূঢ় ব্যক্তিরা জদি মনে করেন ॥ জে কৃষ্ণ রাসলীলা করেছেন এবং বস্ত্রহরণ করেছেন আমরা তাই করবো অই কথা মনে করো॥ জদি সেই কার্যে প্রবৃত্ত হয় তৎক্ষণাৎ তার মৃত্যু হবে।৮৯

যুক্তিগুলি আদৌ নতুন নয়। ভাগবতে রাসলীলা প্রসঙ্গে অনুরূপ কথা বলা হয়েছে। পরীক্ষিৎ প্রশ্ন করেছেন, শুকদেব বলেছেন; আত্মকামত্ব, অগ্নির সর্বভুকত্ব, রুদ্রের বিষপান ইত্যাদি অনুষঙ্গগুলি উল্লেখ ভাগবতসম্মত। কিন্তু ভাষার প্রয়োগে বলার ঝোঁকে তারতম্য ধরা পড়ে। শাপমন্যি নতুন করে পাঠক্রমে ঢোকানো হলে। ভূত্যরা যে গিন্নির হাতে খেতে চায় না, ঠাকরুনকে অমর্যাদা করে, এটা সংযোজিত। থাকবন্দী সমাজে কর্ত্রীর মর্যাদা, অধিকারভেদ যে ভক্তির পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে, ভাগবতী আখ্যানের এই সূত্রকে বিশেষভাবে নজরে আনাটা কথকের কাজ। তত্ত্বকথা পরিবেশনের ক্ষেত্রে ভাষ্যকার ও টীকাকারের সঙ্গে কথক মিশে যাচ্ছেন।

সমাজে পাতিব্ৰত্য এবং গোপীদের পরকীয়া প্রেম, এর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব মেটাতে কথায় নানা যুক্তি আনতে হয়, উপমাকে, দৃষ্টান্তকে ব্যবহার করা হয় যুক্তি হিসাবে, শেষে শাপের ভয়ও দেখাতে হয়। কথক ধর্মবক্তাও বটে, তাকে পরম্পরাগতভাবে গল্পও বলতে হবে আবার লক্ষ্য রাখতে হবে যে সামাজিক স্থিতি না ভেঙে যায়, তাহলে শ্রোতার সমাজই বদলে যাবে, আসরের উদ্দেশ্য মার খাবে।

সময় সময় কথান্তরে যাবার খাতিরেও প্রশ্নোত্তর রাখা হত, যাতে করে বলাটা বেখাপ্পা না হয়ে যায়। যেমন কালিয়দমন পালার একজায়গায়,

রাজা উ॥ গুরো গা এ কেমন হলো। এই আপনি পূর্বে বললেন ফানী-এর বিশ তেজেতে জমুনার উভয় তীরে বৃক্ষলতা ঔষধি তৃণ পর্জন্ত জলিত হয়েছিলো। কিন্তু সে স্থানে কদম্ববৃক্ষ কিরূপে জীবিত ছিল। শুদেব উ॥ মহারাজ কি শ্রোতা॥ আপনি॥ আপনারে শ্রোতা পেত্রে আমি কৃতার্থ হলাম। মহারাজ শুন শুন। এই কদম্ববৃক্ষ কিরূপে জীবিত ছিল তাহার কারণ শুন..৯০

এই কথার পরে অন্য কথা শুরু হয়, গরুড়ের অমৃত আহরণ ও কদম্ববৃক্ষে রেখে ক্লান্তি অপনোদন। প্রাসঙ্গিক ভাগবতী শ্লোকে কদম্ববৃক্ষের উল্লেখ আছে, একটানে গল্পের ফাঁকে ঘটনাটি একটি শ্লোকে বলা হয়েছে। প্রশ্নোত্তরের রীতি ভাগবতে আছে, প্রথাসিদ্ধ। কথক ঠাকুর সেই রীতি ব্যবহার করে কথান্তরে গেলেন। ভাগবতে অনুষঙ্গ একটি শ্লোকে সারা হত, কথকতায় সেটা এক পাতা জুড়ে চলল, বেতালা মনে হল না। প্রশ্নের উত্তর হিসাবে যে আখ্যানটা বলা হয়েছে।

সংস্কৃত রসশাস্ত্রের বিচারে ‘কথা’ ও ‘আখ্যায়িকার’ বহিরঙ্গ নিয়ে ভামহ ও দণ্ডির কুটকচালি তর্ককে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছিলেন বাণভট্ট। একটি নিবন্ধে এই তর্কের বিবর্তন নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা করেন সুশীলকুমার দে। শেষপর্যন্ত ‘রসেই’ কথার পরিণতি। আলোচনা থেকে ‘কথার’ দুইটি নান্দনিক সূত্র পরিষ্কার।৯১ মহাভাষ্যের টীকাকারেরা আলোচনায় বার বার ‘গ্রন্থিক’ শব্দটিকে কথকের প্রতিশব্দ হিসাবে ব্যবহার করেছেন, ধারণা গ্রন্থনের, কথনের।

বাঁধুনি ও ‘গাঁথনি’টা জরুরি। শ্রোতাদের মজলিশে ‘কথা’কে গেঁথে তোলা কথকের কাজ। সেইখানে কাহিনীর উৎসবিচার ততটা প্রাসঙ্গিক নয়। কথা জমাটি হচ্ছে কিনা, জমাটি কথা জমায়েতকে ধরে রাখতে পারছে কিনা, সেইটা বিচার্য। এই জমাট বাঁধার গুণ আবার নির্ভর করছে কথকের বুদ্ধিতে বিষয় কীভাবে অধিগত হল, তার উপর। কথকী রীতি কেবল গ্রন্থগত নয়, স্বকীয় বুদ্ধিতেও বটে।৯২

তাঁর বিচারে ভামহ জানিয়েছেন যে কথা হল পুরোটা রচা কিন্তু কথায় প্রবাহ থাকতে হবে।৯৩ প্রবন্ধের ‘ভাবিকা’ গুণ থাকে, তার প্রসাদে অতীত ও ভবিষ্যৎ মানসচক্ষে প্রত্যক্ষ হয়। এই ‘ভাবিকত্ব’ বা ভাবিকা সিদ্ধ হবার অন্যতম শর্ত ‘কথায়াঃ স্বভিনীততা’, কথাপ্রবাহ। উর্দুতে ‘স্বভিনীততার’ সুন্দর প্রতিশব্দ হল ‘রওয়ানি’। ‘বাঁধুনি’ ও ‘রওয়ানি’, এই দুটি গুণ যখন পরস্পরের প্রতি স্পর্ধা নিয়েও ‘সাম্যে’ অবস্থান করে তখন কথা হয়ে ওঠে শিল্প রসে ভরপুর। ‘কথায়াং সরসং বস্তুং গদ্যৈরৈব বিনির্মিতম্‌।’৯৪

ভামহী ধারণানুসারে সরসবস্তু গদ্যে লিখিত হলেও তাকে ‘শ্ৰব্য’ বা শ্রবণমনোহর হতে হবে। স্বর ও সুর সংযোগে শ্রবণীয় কথার চমৎকারিত্ব বা মনোহারিত্ব বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে সহযোগের, ঘটকালির চিন্তা কার্যকর। ‘সহিতের’ তত্ত্বে স্বর ও সুর সংযোগে শব্দ গ্রন্থনা ও তার পাঠ হয়ে ওঠে কথকতা।

স্বরের কথা, সুরের খেলা

মন্দিরের পুরোহিত ও টোলের অধ্যাপকের পদ নিয়ে দুই ব্রাহ্মণ যুবকের মধ্যে জবর প্রতিদ্বন্দ্বিতা। লাজুক অম্বরনাথ এবং চতুর ও বাকপটু আদ্যনাথ। এই লড়ায়ের ক্ষেত্র হল কথকতার আসর। জমিদার কন্যা বাণী সমজদার, ছেলেবেলা থেকে কথকতা শুনে তার কান তৈরি। স্নানযাত্রা থেকে ঝুলন পর্যন্ত মাসাবধিক কাল আসর বসে, গ্রামবাসীরাও শোনার অভিজ্ঞতায় কম যান না, তাঁদের গ্রামে ভাগবতী কথকতা প্রতি বৎসরে অনুষ্ঠিত হয়।

‘মুখচোরা অম্বর’, নিজের চিত্তরঞ্জনের জন্য ‘শুধু নীরবেই পাঠকার্যে’ অভ্যস্ত। ফলে কথকতার আসরে বসে তার করুণ অবস্থা হয়। পাঠকার্যে অনভ্যাসের দরুণ,

সে ঘামিতে লাগিল। কথা বলিতে বলিতে মধ্যে মধ্যে সে থমকিয়া থামিয়া পড়ে, কণ্ঠ যেখানে তারায় তুলিতে হইবে, সেখানে উদারায় নামিয়া আসে, যেখানে হর্ষে উচ্ছ্বসিত হইয়া কহিতে হইবে, সেখানে কণ্ঠ বাধিয়া নবোঢ়া বধূর মত লজ্জায় অস্ফুটতর হইয়া আসিয়া হয়ত শেষে থামিয়ে যায়।… শ্রোতার দল প্রসন্ন হয় না, বক্তা লজ্জায় মাটি হইয়া যাইতে চাহে।৯৫

আদ্যনাথ দক্ষ কথক, তাঁর কথকতা স্বরক্ষেপণে সিদ্ধ। তাঁর কথকতা শুরু থেকেই জমে ওঠে।

স্ফীতবক্ষে টগর ফুলের মালা পরিয়া কন্ঠস্বর কখনো পঞ্চমে কখনো ভৈরবীতে কখনো বেহাগে কখনোও বা আবার ললিত রাগিণীতে উঠাইয়া নামাইয়া হাসাইয়া কাঁদাইয়া নদীতরঙ্গের মত অবলীলায় যে বাহিত করিয়া দিয়াছে, সে আদ্যনাথ।৯৬

ভুদেবের পরিবারের মেয়ে লেখিকা অনুরূপা দেবী, কথকতা তাঁর পরিচিত শিল্প। তিনি জানেন যে কথকী দক্ষতার অন্যতম উৎস হল স্বরের কুশলী নিয়ন্ত্রণ।

ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্রে ‘কাকুস্বররঞ্জক’ অধ্যায়ে স্বর প্রয়োগের রীতিনীতি নিয়ে আলোচনা আছে। ভাব সৃষ্টির সঙ্গে স্বর প্রয়োগের যোগ নিবিড়। ভাব অনুযায়ী, পরিস্থিতি অনুযায়ী, কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন। কোথায় তা হবে মন্দ্র (কণ্ঠস্থ বিলম্বিত ধ্বনি), আবার কোথায় হবে দীপ্তা। প্রযোক্তৃদের প্রতি অনুপুঙ্খ নির্দেশ আছে। ‘ভাবেষেতেষু নিত্যং হি নানারসসমার্শয়াৎ।’ কণ্ঠস্বরের ওঠানামার সম গুরুত্বপূর্ণ বিরাম। বিরামের প্রযত্ন আবশ্যক, বিরাম অর্থসূচক। বিরামই ‘অর্থসমাপ্তি নিমিত্তং’ এইকথা অভিনবগুপ্ত তাঁর টীকায় মনে করিয়ে দিয়েছেন।৯৭ বিরামে গোলযোগ হলে অন্য অর্থ হবে।

নাট্যশাস্ত্র একটি সংগ্রহ গ্রন্থ। এর শিকড় নিহিত আছে ব্যবহারিক ও লৌকিক অভিজ্ঞতায়। টীকায় অভিনবগুপ্ত চেষ্টা করেছেন তাঁর নিজের দর্শন চাপাতে।৯৮ লোকবৃত্তি বা লোকস্বভাবের অনুসরণে বিরামের জন্য কথকরা বলার ভঙ্গি চালু করেছিলেন, যে ভঙ্গির কথা নাট্যশাস্ত্রেও উল্লিখিত হয়েছে।৯৯ এই ভঙ্গি প্রসঙ্গে তারাশঙ্করের সাক্ষ্য হল,

নিশাপতি গম্ভীরভাবে বললে, দেবর্ষি নারদকে দেখে ব্যাস বললেন—অহো ভাগ্য! আসুন-আসুন-আসুন, দেবর্ষি সমস্কার।

নিশাপতি তখন ভাগবত কথকতার এ ষ্টান্টটুকু আয়ত্ত করেছে। সেকালে ভাগবতের আসরে এইভাবে অনেকজন আগন্তুক কথকের সাদর সম্বর্ধনায় আপ্যায়িত হয়ে বিনয় প্রকাশ করে অপ্রস্তুত হতেন। ১০০

স্বরক্ষেপণ ও স্বরভঙ্গি কথকরা অভ্যাস করতেন, আসরে সেইভাবে বলতেন। বিক্রমপুরের বাসাইলনিবাসী রাখালচন্দ্র গোস্বামী হলেন বংশগতগুরু, শিষ্যবাড়িতে তাঁকে পাঠ করতে হত, কথকতা করতে হত। গলার স্বরক্ষেপণে স্বাভাবিক নিপুণতা ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে একজন সাক্ষ্য দিয়েছেন যে ভাওয়ালে আসরে বসে বলার ঝোঁকে বলেছেন, ‘তোমার বাড়ী কোথায়?’ সামনে বসে থাকা শ্রোতা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছে, ‘হ্যাপার পরাণ গ্রাম।’১০১

এই কৃৎ-কৌশলকে মাথায় রেখে কথকরা পুথি লিখতেন। পুথির বিন্যাসে ও ভাষায় তার ছাপ আছে। পুথিসংলগ্ন হরিনাম মাহাত্ম্যের একটি চূর্ণীতি টানা বাক্য সমষ্টি লেখা আছে। অর্থ অনুযায়ী বিরামপূর্বক পড়া বিধেয়। যেমন,

ভাইরে বেদেয় হরি রামায়ণেয় হরি আদ্যে হরি অন্তে হরি হরি চলো কোন ভয় নাঞি কোন শ্রম নাঞি কোন ক্লেশ নাই মুখে হরি বললেই হয় রে অনাআশে, পরমপদ পাবে রে। ভেবে দেখো দেখি ছিলেই বা কথা এলেই বা কথা সেখানে কি কথা বলে এলে বিষয় পেয়ে ভুলে গেলে কিছু মনে নেই ধনোপার্যেণ করো গৃহ ব্যাপার করো স্ত্রী পুত্রাদির লালনপালন করো তা যত বারণ করেন নাঞি তায় করো আর থেকে ২ মুখে একাকার হরি ২ বলে ডাক গো জন্ম সফল হবে কুল পবিত্র হবে।১০২

লেখায় কোনও যতিচিহ্ন নির্দেশ নেই। অথচ পড়লেই বোঝা যায় কোথায় থামতে হবে, কোথায় বা শুরু করতে হবে। এইবার কথোপকথনের একটা নমুনা পেশ করা যেতে পারে।

এখানে দ্রৌ পাকগৃহে দ্বারে অঞ্চল পেড়ে সয়ন। নিদ্রা। এই সময় দুঃস্বা ছুটে গিয়ে চরণে পড়েছে। চোকবুজে উ॥ কেয় ঠাকুর পো? কেন? একি। চক্ষে জল কেন। উ॥ তামাদের সর্বনাশ হয়েছে। এলোকেশে সোনার প্রতিমা আঃ এই দণ্ড খানিক নিদ্রা হয়েছে কেন ঞেদের সঙ্গে বিবাদ হয়েছে। না। তবে কি মুখ ম্লান কিছু খাও নাই।… দুঃস্বা চকে হাত দিয়ে রোদন। ঘরে থেকে সাব করে বৌ এনেছিলাম। বৌরে বৌ। তাদের কেশ ধরে নিয়ে গেল। বৌরে বৌও ও। এনে দে তোর পায়ে পড়ি। বৌরে বৌ। উ॥ ভয় নাই।১০৩

উপযুক্ত অনুচ্ছেদে দ্রৌপদী ও দুঃশাসনের মুখোচ্চারিত বাক্য এক স্বরে পড়লে চলবে না, তাল ও বিরামে পার্থক্য আছে, তাই দিয়ে পরিচিতি অনুযায়ী চারিত্রিক মেজাজ বোঝা যাবে। বাক্যবন্ধ ও যতির মধ্যে রীতিনির্দেশ স্পষ্ট। পাঠ্যস্বর অনুযায়ী শ্রোতাদের কাছে বিশেষ আবেদন বিজ্ঞাপিত হবে, এই কথা মনে রাখা আবশ্যক।

বাঙালি কথকদের পাঠরীতিতে একটি বিশেষত্ব নজর এড়াবার নয়। সংস্কৃতবহুল বাক্যাবলী বা ‘সাট’ বা ‘চূর্ণীর’ প্রয়োগ বাঙালি কথকতার রীতি ছিল। অনুপ্রাস ও সংস্কৃতবহুল শব্দ পাঠের ঝোঁকে ঝংকার তোলে, অর্থ ব্যতিরেকে শ্রোতাদের অভিভূত করে থাকে। এই কায়দায় কথকরা নিপুণ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,

আমাদের দেশের কথকরা এই তত্ত্বটি জানিতেন, সেইজন্য কথকতার মধ্যে এমন অনেক কান-ভরাট করা সংস্কৃত শব্দ থাকে এবং তাহার মধ্যে এমন তত্ত্বকথাও অনেক নিবিষ্ট হয়, যাহা শ্রোতারা কখনই সুস্পষ্ট বোঝে না কিন্তু আভাসে পায়—এই আভাসে পাওয়ার মূল্য অল্প নহে।১০৪

সাটের সব শব্দের অর্থ বোধগম্য হয় না। সময় সময় অর্থও সামান্য, পুনরুক্তিতে ভরা। অথচ শব্দ ঝংকারে যে সৌন্দর্য আভাসে সৃষ্টি করে, তা শ্রবণ তৃপ্তিদায়ক। অর্থের বোধ সেক্ষেত্রে ততটা প্রয়োজনীয় নয়, হয়তো রস উপভোগের বাধক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির বাল্য বয়সের অভিজ্ঞতাও রবীন্দ্রনাথের রসবিচারের অনুসারী। যোগেশচন্দ্রের জবানীতে,

মনে পড়ে, নয় বৎসর বয়সে রামায়ণ নিয়ে কাড়াকাড়ি করেছি। বছর পাঁচ ছয় পরে রামায়ণ কথা প্রথম শুনি। সে কি আনন্দ! কথক ঠাকুরের বাক্যচ্ছটা বুঝতে পারতাম না, কিন্তু তা-তে কিছুই এসে যেত না, খেই হারাত না।১০৫

উনিশ শতকে ‘কথকতার সুর’ বেশ চালু শব্দ। স্বরের সঙ্গে আছে সুর, গান বাঁধার কাজ। কিছু পালা তো সুরে ছন্দে লেখা হত, তাদের শিল্পীরা হতেন গায়েন। কথকদের বানানো গান বেশিরভাগ সময়ে পৃথকভাবে লেখা হত, পুথিতেও আলাদা সংযোজিত হত। গান নানা সূত্র থেকে নেওয়া হত, টুকে রাখা হত, প্রয়োজনে কাজে লাগতে পারে। কথক মহানন্দের হাতে লেখা গানের খাতা সবচেয়ে বড় প্রমাণ। শ্রীমদ্ভাগবতের পালায় লেখা থাকত হরি মাহাত্ম্য নিয়ে গান,

গৌড় শারং

হরে হর মম ভব যাতনাং নাশায়াসু বসুদেব বিশয় বশনাং। অহম্মদ মত্ত তব জ্ঞান বিহীনে দীন হীন রামধনে সদাবিষয় নিপুণে বিতর করুণাং। ১॥ আলিয়া। ইহ মে ভবে রাঘবে কিম্ভবে। অহমিহ সদামত্তো বিশয়াসবে। তব ভজন পূজন মনাদযত্য মম মনঃ॥ মুহ্যতি সতত মহং মামতি রবে॥ নিবাস সংসার বনে ছিদ্রবহুল ভবনে॥ নিত্যভয়ে কলিকাল চোর সম্ভাবে ॥ সদা মহা মোহনিশী তেন দীনোদ্ধব ত্রাসি রাম তব তব শুনৈশি পদপল্লবে ॥ ১ ॥

রামপদ ভট্টাচার্য গানটা লিখেছেন, ‘রাম’ কথাটি ভণিতায় আছে।১০৬ কিন্তু গানটা লেখা আছে আলাদাভাবে, পালার কোনও অনুচ্ছেদের সঙ্গে যুক্ত নয়। ভাগবতী পালা। ফলে চূর্ণীর মতো সময় বা জায়গা বুঝে গানটা গাওয়া যাবে, বেমানান হবে না।

আবার সময় সময় পালার সংলাপের মধ্যে গান রাখা হত।

কোন গপি রাধিকারে বলছেন শখিরে আর কালার প্রেমে কাজ নাই। তখন রাধিকা শখিরে অমন কথা বলিশ নে। শখী॥

গান॥ শে কালো সামান্য কালো নয়। বেদাগমে কয়॥ মহাজোগী মহাকালো কালোভবে জোগী হয়॥ কিবা দিবা রাত্রো কালো না ভাএে কালাকালো সর্বদা জে ভাবি। কালো নাহি তারো কালো ভয় ॥১০৭

দ্বিজরাজ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি কথকদের আসরে বসলে মনে হয় সে আখ্যানে গানের ভূমিকা সবসময় গল্পের অঙ্গ নয়, বরং অলঙ্কার। কাহিনী বলার ফাঁকে ফাঁকে বিরতির জন্য, গান দেওয়া হয়, বৈচিত্র্য আনা হয়, তা না হলে বিবৃতি একঘেয়ে লাগতে পারে। কথা থেকে গান, গান থেকে আবার কথায় যাওয়া যেতে পারে। হনুমান ভরদ্বাজের আশ্রমে যাচ্ছেন, যেতে তো সময় লাগবে, ওই সময়ে আকাশপথে বর্ণনা না দিয়ে, হনুমানের মুখে দ্বিজবাবু গান বসিয়ে দিলেন,

‘বিমল আনন্দে, সুললিত ছন্দে জগদানন্দে ডাকোনারে’১০৮

আবার লঙ্কায় হনুমান বৃদ্ধবেশে শিবভক্ত রূপে প্রবেশ করবেন, তখন মুখে শিবস্তোত্র স্বাভাবিক, হনুমান শিবস্তোত্র আবৃত্তি করতে লাগলেন, দ্বিজবাবুও স্তোত্র সুরে গেয়ে উঠলেন,

‘শঙ্কর হর পরমেশ, পতিত পাবন দীনেশ।’১০৯

কিন্তু কোনও কোনও সময় গানের মাধ্যমে তত্ত্বকথাও বলা হয়। কাহিনীর অন্তর্নিহিত ভাব সুরেলা কথায় যত সহজে গ্রাহ্য হবে, আর অন্যরূপে হওয়া সম্ভব নয়। বাসন্তী দেবী এই রীতিতে সিদ্ধা, দ্বিজবাবুও প্রয়োজনে গানের এইরকম ব্যবহার করেন। হনুমান তাঁর বুক চিরে রাম-সীতার যুগল মূর্তি দেখাচ্ছেন, সেটা রূপক, তার তাৎপর্য গানে ব্যাখ্যা করা হল, ‘জয় মহাবীর জয়॥’ কথকতায় গান এখানে যাত্রার প্রচলিত বিবেকের কণ্ঠে সঙ্গীতের ভূমিকা পালন করেছে।১১০

গান সংগ্রহ করা রীতি, একজনের লেখা গান অন্যে গাইতে পারতেন। গানও নানারকম, রামপ্রসাদী, কীর্তন, বাউলাঙ্গ, রাগপ্রধান, স্তোত্র ইত্যাদি। সব সুরই যে সহজ সরল, এই কথা মনে করার কোনও সঙ্গত কারণ নেই। অধুনা নিব্রত ব্রহ্মচারী তাঁর। ভাগবত পাঠে স্বচ্ছন্দে রজনীকান্তের গান সুযোগ মতো ব্যবহার করেন।১১১ মহানন্দও গান প্রযোগে উদার মতাবলম্বী ছিলেন। দাশরথি রায়ের গান কথকরা গাইতেন কারণ ভাব ও সুরের ক্ষেত্রে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, জনপ্রিয়ও বটে।১১২ পুথিতে দেখা যায় যে গান যেন শুনতে শুনতে লেখা হচ্ছে, আঁকাবাঁকা লেখা, আবার অপর পৃষ্ঠায় একই গানের পরিষ্কার অনুলিপি করা হচ্ছে। এক পাতায় এক পিঠে চূর্ণীর কয়েকটা ছত্র, ‘পরমধার্মিক দ্বের্দণ্ড প্রবল বল প্রতাপান্নিত, দুষ্টদমন শিষ্টপালন’ ইত্যাদি বলে পরীক্ষিতের বর্ণনা, অপর পিঠে গানের কয়েকটা টুকরো ছত্র ‘সোনার চাঁদ গোঁড়াচাঁদকে পাণল করিলে’ ইত্যাদি।১১৩ এইগুলি নানা জায়গা থেকে চলতি অবস্থায় নেওয়া হচ্ছে, এইটা স্পষ্ট। ষষ্ঠীর দিনে স্থানীয় কথক এসেছেন, তম্বুরা নিয়ে প্রচলিত আগমনী গীত গাইলেন। ফরমায়েশ মতো একটি নতুন গান গাইলেন, গানটি ওই আসরের এক ১৪/১৫ বৎসরের কিশোরের লেখা, কিশোরটির নাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।১১৪

গান যাই হোক না কেন, যেই শিক্ষক হোক না কেন, কথকতার আসরে গানের আবেদন সামগ্রিক। পাঠক্রমে স্বরগুলির একক প্রয়োগ বিবেচ্য। কিন্তু যখন সংগীতের মাধ্যমে রসসৃষ্টি হবে, তখন প্রযুক্ত স্বরগুলির সামগ্রিক আবেদনে ভাবটি ধরতে হবে। স্বরলিপি কাঠামো মাত্র। গায়কী, কণ্ঠ, পদ ও সুর মিলিয়ে ভাব রূপপরিগ্রহ করে, শ্রোতাকে মগ্ন করে। কথকের আসরে সংগীতের সামগ্রিকতা অনুভবের বিষয়, লেখা বা বলার মধ্যে সব ধরা যায় কিনা সন্দেহ। তবুও রসভুক্তির একটি পরিস্থিতির বর্ণনা দেওয়া যেতে পারে। অনুরূপা দেবীই আমাদের ভরসা।

সেদিন কথা শেষে সঙ্গীত হইয়া সভা ভঙ্গ হইল। সেই তাল লয় যুক্ত স্বর ও সঙ্গীতের উদ্দীপনা সঙ্গীত শেষ হইলেও বাণীকে অনেকক্ষণ অবধি মন্ত্রমুগ্ধ করিয়া রাখিল। ভ্রাতৃরূপে পরিকল্পিত শ্রীভগবানের উদ্দেশ্যে সদ্য-পুত্র-শোকাতুরা সুভদ্রার গীত, গীতটির মর্ম্ম এইরূপ…জান নাকি তোমার দেওয়া এ জীবন সকল আলোক যদি নিবিয়া যায় তথাপি তোমার আলো এ জীবন হইতে নিমেষের তরেও নিবিবে না। তুমিই আমার অভিমন্যু, তুমিই আমার অর্জুন, তুমিই আমার বাসুদেব, তুমিই আমার সব, আমার সবই তুমি প্রভু।…সঙ্গীতের শেষ কম্পন বৃহৎ খিলানের মধ্যে বিলীন হইয়া গেল। ইহার পরও কিছুক্ষণ কেহ বাক্যোচ্চারণ করিল না।…কথক থামিয়া গিয়াছে, সে (বাণী) এতক্ষণ কিছুই জানিতে পারে নাই। এতক্ষণ সে মন্ত্রমোহে আচ্ছন্নবৎ হইয়া সুভদ্রার কথাই ভাবিতেছিল।১১৫

কথকতায় তাৎক্ষণিকতা

উনিশ শতকের প্রথমদিকে রাইপুর থেকে নীলকণ্ঠ দেবশর্মা নানুরে জানাচ্ছেন:

নিবেদনমিদং, শ্রীযুক্ত দাদামহাশয় ৮ রোজ এ বাটিতে পৌচিআছেন এবং ৯ রোজ পুরাণ আরদ্ধ বাবুদিগ্যের বাটিতে হইআছে জানিবেন লাভাদির কিছু হয় নাই কথকথা উত্তম হইতেছে সকলের মনহিৎ হইআছে আর উত্তর উত্তর ভাল হইতেছে…১১৬

‘উত্তর উত্তর ভাল হইতেছে’, আসর জমে উঠেছে, কথকের সঙ্গে শ্রোতার ঘটকালি হয়েছে, কথক তাদের মনোমত হয়েছে। পুথিতে গ্রন্থনা থাকে, কাহিনী গ্রন্থনে আবদ্ধ। অথচ অনুষ্ঠান রোজ হয়, পুথিকে ঘিরে থাকে শ্রোতা ও পাঠক। সব শ্রোতাও সমান নয়, আসরের আবহাওয়াও সব জায়গায় এক নয়। কথকতার ভাল বা মন্দে তারতম্য ঘটে, কথককে সতর্ক থাকতে হয়, চিঠির বয়ানে তা ধরা পড়ে। তাই বাঁধা পুথির তারতম্য ঘটবে; পুথি মূল খুঁটি। কিন্তু আসরে কথককে পুথির এদিকে-ওদিকে যেতে হয়, হুবহু পুথি ধরে চললে আর ‘উত্তর উত্তর’ ভাল হবার সম্ভাবনা কম। পুথি দেখতে হয়, ছুঁতে হয়, এবং তার পরে বলতে হয়। দীনেন্দ্রকুমারের বর্ণনায় ছবি স্পষ্ট,

তিনি (কথক ঠাকুর) তুলটের কাগজে লিখিত ও পাতলা কাঠের আবরণাবৃত প্রায় একহাত দীর্ঘ পুথিখানি সম্মুখে খুলিয়া রাখিয়া মধ্যে মধ্যে এক একটি শ্লোক দেখিয়া লইতেন, এবং তাহা আবৃত্তি করিয়া তাহার ব্যাখ্যা করিতেন; কখন গান করিতেন, ব্যাখ্যা উপলক্ষে নানা গল্প বলিতেন; কখনও হাসাইতেন, কখনও কাঁদাইতেন।১১৭

পুথিতে শ্লোক দেখা ও শ্রোতাদের হাসানো-কাঁদানোর মধ্যে ফাঁক অনেক। কথক গান গাইছেন, ব্যাখ্যা করছেন, গল্প বলছেন সবই মুখে, সঙ্গে সঙ্গে চলছে। শ্লোকগুলি সব পুথিতে লেখা। শ্লোক বা মূল কাহিনী কথায় পল্লবিত হচ্ছে, গানে অলঙ্কৃত হচ্ছে, গল্পে বিস্তৃত হচ্ছে। ফলে অনুষ্ঠানের তাগিদে সফল কথকরা আসরে বসে শ্রোতার মনোভাব বুঝে গান তৈরি করেন, গল্পের রদবদল ঘটে, স্বরের পরিবর্তনে ভাবের আবেদনেও রকমফের হয়। আসরের এই তাৎক্ষণিকতা অনুযায়ী মুখে মুখে রদবদল ঘটানো তাঁর দেখা সেরা বাঙালি কথকদের গুণবিশেষ। এই কথা দীনেশচন্দ্র সেন স্পষ্ট বলে গেছেন।১১৮

কথকদের নিজস্ব অভিজ্ঞতায় এই রীতি স্বীকৃত। দ্বিজরাজ বাবু বলেন যে, ‘আসরে আসার আগে ভাবলাম এক আর আসরে বসে এমন কথা বললাম যা ভেবে আসিনি। জানি না কি করে বললাম।’১১৯ আর এক কথক ঠাকুর লিখেছেন,

অনেকদিন ধরে একই ধরনের বাঁধা নিয়মের গানগুলো মাঝে মাঝে একটু অদলবদল করে ঠাকুর গান করেন। মাঝে মাঝে নতুন গানও তিনি তৈরী করে শুনিয়ে দেন। ঠাকুরের এখন এমন একটা শক্তি হয়েছে যে কথা বলতে বলতে সুর ধরলেন—আর সঙ্গে সঙ্গে পদযোজনা।…ঠাকুর কথা বলে গেলেই গান হয়ে যায়।১২০

আসরে রসে সৃষ্টি করা, রদবদল করা তো শ্রোতার রুচিনির্ভর, শ্রোতার প্রতিক্রিয়া কথক ঠাকুরকে বক্তব্যের তারতম্য ঘটাতে প্রণোদিত করে। তাতে শ্রোতাদের রস আস্বাদনে খিঁচ লাগতে পারে, কারও কারও বিরূপ মন্তব্য আসতে পারে। কথক ঠাকুরের আত্মজৈবনিক রচনায় আসরে শ্রোতার প্রতিক্রিয়া ও কথকের বাচকতার মধ্যে টানাপোড়েন ধরা পড়ে,

এই যে মুখুটিমশায় আসুন, আজকের কথকতা কেমন শুনলেন? দেখুন, সভায় আপনাদের মত জ্ঞানীগুণী লোক থাকলে কথার সুরই পালটে দিতে হয়। এই ধরুন ছন্দা, সে লেখাপড়া শিখেছে। একটা কথা বলে সে বোঝে। কাজেই ওদের মত শ্রোতা যদি কাছে বসে কেমন করে আর সাধারণ গল্প বলে কথা শেষ করি? অবশ্য তাতে করে সাধারণ শ্রোতার পক্ষে একটু কিরকম মনে হয়, হলোই বা তা বলে কি রোজই একসুরে গান আর গল্প করে যেতে হবে, তবে শাস্ত্র ব্যাখ্যার যেটুকু রহস্য সেটুকু আর কোথায় বলব? সাধুদের দল থেকে আজ আমায় একজন কে বলছিল—ঠাকুর কথাগুলি বড় শক্ত হয়ে যাচ্ছে। আজ যে একটাও গান হল না, কেবল কোথাকার কোন পণ্ডিত কি বলেছেন সে কথা, ওগুলি শুনে আমাদের কি হবে? …ঠাকুরমহাশয়, সে কথা তো ঠিকই—মুখুটি মশায় বলল; তবে কিনা সাধারণ লোকে যাতে বেশ মেতে যায়, সেভাবেই আপনাকে কথা লাগাতে হবে।১২১

শ্রোতার শোনার ইচ্ছা, শ্রোতার প্রস্তুতি, কথকের বলার ইচ্ছা, কথকের নিজস্ব প্রস্তুতি—এর মধ্যে ব্যবধান আছে, বিরোধ আছে, আবার যোগও আছে। দুটি মিলেই তৈরি হয় আসরের তারতম্য, তা আবার ঠিক করে দেয় বলার তারকে।

আসর সমাজস্থিত, তার বাইরে নয়। ফলে পরিস্থিতি অনুযায়ী কথকের বাচকতা অতিরিক্ত মাত্রা পেতে পারে। প্রতিমা দেবী তাঁর স্মৃতিতে এর সাক্ষ্য ধরে রেখেছেন:

স্বদেশী যুগের আরম্ভের সঙ্গে সঙ্গেই ‘সখি কেবা শুনাইল শ্যাম নাম’ আর মৃদঙ্গের বোল, শ্রোতাদের আবেগের ধ্বনি এ’ল নীরব হয়ে। ক্ষেত্রচূড়ামণি কথক তখনো কুরুক্ষেত্রের বর্ণনা ও গীতার ব্যাখ্যা করে শ্রোতাদের চিত্তকে রুদ্ররসে উত্তেজিত করে রেখেছিলেন। সেটা স্বদেশী আন্দোলনের যুগের সঙ্গে তখনো বেখাপ্পা হয়নি।১২২

বাইরের সামগ্রিক পরিস্থিতি বদলাচ্ছে, ক্ষেত্রচূড়ামণির কথকতা নতুন মাত্রা পাচ্ছে, গীতা বা কুরুক্ষেত্রের বর্ণনার রুদ্ররস তখন নতুন অর্থে মণ্ডিত হচ্ছে। স্থানীয় পরিস্থিতিতেও এইরকম প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা স্বীকার করা যায়। আত্মজৈবনিক রচনাতে প্রাণকিশোর গোস্বামীর মতো ‘পুরাণ-বক্তা’ এইরকম অবস্থার বিবৃতি দিয়েছেন। ‘বামন ভিক্ষা’ পালায় কথক দানের প্রশংসা করছেন, বলছেন ‘দানের মত আর কি আছে?’ গ্রামের বাঁরুয্যে পরিবার, শীল পরিবার এদের দানের কথা বলা হল। দীঘি কাটানোর কাহিনী উল্লেখ করা হল। তাতে সভা থেকে রেগে সাধু সান্ন্যাল উঠে গেলেন। কারণ,

এই গ্রামের সকলেই জানে সাধু সান্ন্যালের মত কৃপণ আর কেউ নেই। সেই সান্ন্যালের সামনে অত দানের কথা, তাই ওই কথা তার ভালো লাগেনি। তিনি আরো ভয় করছিলেন। এর পর কথক যদি সভার দিকে লক্ষ্য করে দানের কথা কিছু বলে ফেলেন তাতে বেশী করে লাগবে এই সন্ন্যালের।১২৩

এইরকম কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা কথক প্রাণকিশোরের ছিল কিনা বলা মুশকিল। কিন্তু কথক ও শ্রোতার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে এতাবৎকাল বাংলা ভাষায় লেখা একমাত্র বইতে এই রকম পরিস্থিতিকে বাদ দেওয়া হয়নি, সেটা ভুললে চলবে না। সামাজিক মূল্যবোধের উপর গল্পের টানে কথক মতামত প্রকাশ করেন, গল্প ও কাহিনীতে মন্তব্য জুড়ে দেন। আসরের শ্রোতারা সমাজস্থ, তাতে তাদের প্রতিক্রিয়া হতে পারে, বাচকতা অভীষ্ট অর্থে না পৌঁছোতেও পারে।

আসরে নানা লোকের কাছে কথকতার গল্প নানা অর্থ নিয়ে আসে, শ্রোতারাও তাদের মত করে কথকের বয়ানের মধ্যে নিজের মানে খুঁজে পায়। শ্রোতা এ কথকের যৌথ চেষ্টার মধ্যে কথকতার বয়ান গ্রাহ্য হতে পারে। যোজিতের সঙ্গে ব্যবধান অতিক্রম করাই তো যোজকের কাজ।

লেখা থেকে বলার প্রক্রিয়া, কথার ঝোঁকে বাক্য বদলে যাওয়া, শ্রোতার দাবিতে গল্প বানিয়ে তোলা, এইসব রওয়ানির মধ্যে পড়ে। কিন্তু কোথাও এইরকম হলে চলবে না যে মূল রস বদলে যাবে, রাম হবে কাপুরুষ ও রাবণ হবে পরম সুশীল, দেশরক্ষায় রত। তাহলে কথকতায় অনৌচিত্য দোষ ঘটবে, রসাভাব হবে। সীমা যেখানে টানা হয়, বাঁধুনি সেখানে রওয়ানির সঙ্গে মেলে। এই ক্ষেত্রেও লেখা ও বলার সাম্য দরকার, টানাপোড়েন সেই সাম্যকে জোরদার করার জন্য, ভেঙে দেবার জন্য নয়।

কথকতার শৈলীতে আধুনিকতা ও ধারাবাহিকতা

কথকতা সম্পর্কিত একটি মূল্যবান প্রবন্ধে হরিপদ চক্রবর্তী মহাশয় বেশ জোরের সঙ্গে বলেছেন যে কথকতা ‘একটি অপরিবর্তিত শিল্পধারা।” যাত্রা, ঢপ গান বা পাঁচালিতে পরিবর্তনের তুলনায় প্রাচীন কথকতার সঙ্গে প্রচলিত আধুনিক কথকতার পার্থক্য খুব কম। কাঠামোর কোনওরকম তুলনামূলক আলোচনা তিনি করেননি। প্রবন্ধের উপসংহার তিনি মতামত জানিয়েছেন মাত্র।১২৪

হরিপদ চক্রবর্তীর মন্তব্য হয়তো তুলনামূলক বিচারে সঠিক। যাত্রা, পাঁচালির অনুষ্ঠান দলগত। অভিনয় ও মঞ্চেও নানা কৌশলের প্রয়োগ আজকে সিদ্ধ। ফলে পরিবর্তনের গতিও দ্রুত। পক্ষান্তরে কথকতার ব্যবহারিক শিল্প চাতুর্য কথকের উপর নির্ভরশীল। কণ্ঠস্বরের চড়াই-উতরাই দিয়ে এবং সংগীত ও শব্দযোজনা করে সব বোঝাতে হয়। কিন্তু কথকতাতেও বিবর্তনের ছাপ আছে। যতই ধীর গতিতে হোক, কথকতাও পরিবর্তন থেকে পুরোপুরি মুক্ত নয়। পরিবর্তনের উৎস দুটি। এক, শ্রোচার রুচি ও আধুনিক প্রচার-মাধ্যমের প্রভাব। দ্বিতীয়ত, শিল্পীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।

নব্বইয়ের দশকে দেখছি যে দ্বিজবাবু, বাসন্তীদেবী অথবা অবনী অধিকারী হারমোনিয়ম ব্যবহার করেন। উনিশ শতকের কথকের আসরের নানা বিবৃতিতে স্বভাবত হারমোনিয়মের উল্লেখ নেই, কারণ তখনও সেটা চালু হয়নি। এটা অবশ্যই একটি পরিবর্তন। মাইক্রোফোনও কথকরা ব্যবহার করেন।

যে সব আধুনিক কথকতার আসর শুনেছি বা তাদের পুথি দেখেছি, তাতে বলা যায় যে ‘চূর্ণীর’ প্রয়োগ আজকাল অনুপস্থিত। ওই জাতীয় বর্ণনা বা বিবৃতির সঙ্গে আধুনিক শ্রোতা আদৌ অভ্যস্ত নয়, তাদের কানই তৈরি হয়নি। কবে থেকে চুর্ণীর প্রয়োগ কমতে শুরু করল, বলা মুশকিল। কিন্তু কুমদবন্ধুর পুথিতে ‘সাট’ নেই। পঞ্চাশের দশকে ক্ষান্তিলতার খ্যাতি, ফলে তখন থেকে চুর্ণীর ব্যবহার কমে আসছে বলে অনুমিত হয়। হয়তো বাংলা ভাষা ও সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে সাধারণের সামগ্রিক পরিচয় ও তার সঙ্গে সঙ্গে ভাষা প্রয়োগ প্রসঙ্গে রুচির বদল ‘চুর্ণীকে’ ধীরে ধীরে অপ্রয়োজনীয় করে তুলেছে।

প্রচার-মাধ্যমের চাপও এক-আধটু বদল আনে। দ্বিজবাবু যুগলমন্ত্রে দীক্ষিত, ‘সীতার পাতাল প্রবেশ’ পালা আসরে কোনওদিন করেননি। শুধু একবার বেতারে করেছিলেন। ধারক বা শ্রাবকও আজকাল দেখা যায় না। সবাই যে সব আসরে পুথি বা খাতা সামনে রেখে পড়েন, তাও নয়। সকলেরই একটি পাঠ লেখা আছে, তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু আসরে অনেকেই আজকাল স্মৃতি-নির্ভর। ধারাবাহিকতা থেকে যায় ভাব-বস্তুতে, রসবিন্যাসে। আধুনিক কথকদের রীতি লক্ষণীয়। দ্বিজবাবু প্রথাসিদ্ধ মঙ্গলাচরণ করেন। দ্বিজবাবুর মঙ্গলাচরণ এইরকম: সুরে পর পর পরিচিত সংস্কৃত শ্লোক আবৃত্তি; রামের বন্দনা স্তোত্র, বাল্মীকি বন্দনা, শিবস্তোত্র, ভগবতী স্তোত্র (সৰ্ব্ব-মঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সৰ্ব্বার্থ- সাধিকে ইত্যাদি), কৃষ্ণস্তোত্র (হে কৃষ্ণ করুণাসিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপতে ইত্যাদি), মারুতি বন্দনা (নমামি অঞ্জনাসুতং বায়ুপুত্ৰং মহাবলং ইত্যাদি), ব্রহ্মা বন্দনা, পর পর বলা হচ্ছে। এঁদের কৃপায় মূক বাচাল হয়, পঙ্গু গিরি লঙ্ঘন করে। তারপরে বাংলা গান, ‘রাম নাম বল, বল, এই নাম কর সার’ (কীর্তনাঙ্গ সুর)। বাংলা গদ্যে তুলসীদাসী বচন আবৃত্তি, পরে বচনটির বিস্তৃত অনুবাদ: রামায়ণ পাঠ সর্বমঙ্গলকর ও পাপহর, বৈতরণী পারের তরণীস্বরূপ। কৈলাসে শিবের মুখে পার্বতী অপূর্ব রামকথা শ্রবণ করছেন, সেইটা যেন কৃপাপ্রাপ্ত দ্বিজবাবু বলছেন। গদ্যে আবেগ মিশিয়ে দ্বিজবাবু বলেন, রামকৃপাতেই তাঁর পাঠ করা সম্ভব হচ্ছে, ‘যন্ত্র আমি, যন্ত্ৰী তুমি, রথ আমি, রথী তুমি, যেমন পরিচালনা করবে তেমনিই পরিচালিত হব, যেমন বাজাবে তেমনিই বাজবো’। আবার গান, ‘আমার হৃদয়-মন্দির মাঝে এসো রাম ধনুধারী’ ইত্যাদি। তার পরে আখ্যান শুরু।১২৫

পালার শেষও প্রথাগত। ‘রাম বল মন’ গানের কলি। তারপরে চিরপরিচিত,

যে গায়, যেবা গাওয়ায় যেবা করায় শ্রবণ,

অনায়াসে হয় তাদের পাপের বিমোচন।

চিরজীবী হনুমানকে সেইদিনের মতো বিদায় দেওয়া হয়, তিনি তো আসরে হাজির ছিলেন। (‘নিজস্থানে গমন করুন পবন নন্দন।’) কৃত্তিবাস পণ্ডিতের জন্ম শুভক্ষণ, তাঁকে প্রণাম জানানো কর্তব্য। এরপরে আগামী দিনের পালার বিষয় বলা হয়। সবার শেষে আসরে ‘ভক্তজনের’ সম্মিলিত কণ্ঠে ‘রামধুন’ দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি করা হয়। ‘ঈশ্বর আল্লা তেরে নাম’ এই ছত্রটি গাওয়া হয় না।

একভাবে বিন্যস্ত মঙ্গলাচরণ ও সমাপ্তিকরণ-এর মাধ্যমে দ্বিজবাবু প্রত্যেকটি পালার ‘ফ্রেমটি’ বেঁধে দেন। এই সরহদ্দটি প্রথাগত। ‘রামধুন’ অবশ্য সংযোজিত, বাঙালি কথকতায় এর প্রয়োগ ঊনবিংশ শতকে ছিল কিনা সন্দেহ। কিন্তু দ্বিজবাবুর উদ্দেশ্য স্পষ্ট। পালাটি রামময়, রাম-পরিকররা সবাই আছেন, আছেন ভক্ত কবিরা, আদি কবি বাল্মীকি, গোস্বামী তুলসীদাস ও পণ্ডিত কৃত্তিবাস। এঁদের বার বার দ্বিজবাবু ছুঁয়ে যান, ‘সনাতন কাব্যবীজ’-এর আধার তো এই মহাকবিরা।

দ্বিজবাবুর কথকতা গল্পপ্রধান। আখ্যানটা বড় কথা, তত্ত্বকথা মাঝে মাঝে থাকে, গান ফাঁকে ফাঁকে আসে।কথা ভক্তিরসপ্রধান। রাক্ষস বা হনুমান চরিত্র দিয়ে প্রয়োজনমাফিক দ্বিজবাবু হাস্যরস আনেন। রামের সেতুবন্ধনে কাঠবেড়ালিকে হনুমানের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা ও তাই নিয়ে কাঠবেড়ালির অভিযোগ, দ্বিজবাবু গম্ভীর স্বরে বলেন ও আসরে বাচ্চারা হেসে উঠছে, এইটা আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।১২৬ দ্বিজবাবুর সূত্রও বিভিন্ন, তুলসীদাসী কৃত্তিবাসী থেকে যোগবাশিষ্ট রামায়ণ, রামরসায়ন ইত্যাদি। কিন্তু আখ্যানে লম্বা সংস্কৃত শ্লোক তিনি বলেন না, কথায় দীর্ঘ বাক্যও নেই। রামায়ণের মধ্যে প্রয়োজনে মহাভারতের গল্প এনেছেন, শবরীর উপাখ্যানে বিদুরের কৃষ্ণ সেবার কথা সাজিয়েছেন।১২৭

একটি দেশজ উপাখ্যানে কীভাবে অভিযোজন করা হয়েছে, দেখা যেতে পারে। তরণীসেন কৃত্তিবাসের নিজস্ব সৃষ্টি। রামের প্রশ্নের উত্তরে বিভীষণ ঠারে-ঠোরে তরণীর পরিচয় দিয়েছেন, ‘প্রকারেতে দিলেন প্রকৃত পরিচয়।’ এর পরে যুদ্ধ। কৃত্তিবাসের আখ্যানের মাঝে দ্বিজবাবু নিজের কথা জুড়লেন, ‘এই হল ত্যাগ…ঘর-দোর নেই, বিয়ে থা হল না, সংসার ত্যাগ করে বেরিয়ে গেলাম, আর মহাপ্রভুর মত সংসারত্যাগ, বুদ্ধদেবের মত রাজ্যধন ঐশ্বর্যপূর্ণ সংসার ত্যাগ, এ দুটো সংসারত্যাগে পার্থক্য নেই? আজ একমুঠো অন্নের সংস্থান করতে পারলাম না, বহু চেষ্টা করলাম, ভাঁড়ে ভবানী, বললাম আজকে আমি আহারে সংযম করেছি আর চতুর্বিধায় [?] সামনে পড়ে আছে তবু আহারে সংযম করেছি, এ দুটোর পার্থক্য নেই?’১২৮ দ্বিজবাবু তত্ত্বের প্রসঙ্গে বেশি বাক্য ব্যয় করেন না। কিন্তু গল্পের নাটকীয়তা ও নিগূঢ়ার্থ বাড়াবার জন্য কাহিনীতে মোচড় দেন, কৃত্তিবাসের রওয়ানির রদবদল করেন। বিভীষণের পরামর্শে রাম ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করেন ও তরণী মারা যাবার পর বিভীষণ কাঁদেন, বলেন,

প্রভু করি নিবেদন।

মরিল তরণীসেন আমার নন্দন।

রাম সান্ত্বনা দিলেন। তখন বিভীষণ বলেন,

বিভীষণ বলে, প্রভু, নিবেদি চরণে।

পুত্রশোকে কান্দি হেন না ভাবিহ মনে॥

ধন্য ধন্য পুণ্যবন্ত আমার সন্তান।

মরিয়া তোমার হস্তে পাইল নির্বাণ।

…. …. ….

শত্রুভাব করি সবে পাইলা উদ্ধার।

শ্রীচরণ সেবা করি কি লাভ আমার॥

যদি পারিতাম দেহ করিতে পাতন।

বৈকুন্ঠনগরে মম হইত গমন ॥১২৯

পালায় দ্বিজবাবু বিভীষণের আক্ষেপকে অন্যভাবে রেখেছেন। পুত্রের মৃত্যুর পর সরাসরি বিভীষণ ধনুর্বান হস্তে রামকে আহ্বান করেছেন। ‘তরণীর যুদ্ধ শেষ—এবার আমার পালা। তরণী বালক, সে যুদ্ধ শেখেনি, ধরো ধনুর্বাণ, যুদ্ধ করো মোর সনে,…না তুমি আমার মিতা নয়, তুমি আমার পুত্রহন্তা॥’ পালায় রাম বিভীষণকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে তরণীকে তিনি বাঁচিয়ে দেবেন। বিভীষণ তখন জানালেন যে, অন্তর্যামী হলেও রাম ভক্তহৃদয়ের মর্ম বুঝছেন না। রামের মিত্রতায় লাভ নেই, লাভ শত্রুতায় আছে, কারণ শত্রুতা করেই তো তরণী বৈকুণ্ঠে গেল। কৃত্তিবাসে বৈকুণ্ঠে না যাবার জন্য রাম বিভীষণকে সান্ত্বনা দেন এই বলে,

শ্রী রাম বলেন দুঃখ ত্যজ বিভীষণ॥

যেই তুমি সেই আমি ইথে নাহি আন।

সাধুর জীবনমৃত্যু একই সমান॥

যতদিন রবে তুমি অবনীভিতরে।

আমার সমান দয়া তোমার উপরে॥

দ্বিজবাবুর পালায় রাম বিভীষণকে বলেন—‘বৈকুণ্ঠ যে তোমার মধ্যে এসে গেছে। বিগত কুণ্ঠা যেখানে, সেখানেই তো বৈকুণ্ঠ।’ তরণীসেনকেও ছাপিয়ে যান বিভীষণ। দ্বিজবাবুর তরণীসেন বধ পালা প্রকৃতপক্ষে বিভীষণের ভক্তির পরীক্ষার ইতিবৃত্ত। কৃত্তিবাসের মূল রসকে ব্যাহত না করে বিভীষণের ব্যবহারকে একটু বদলে দিয়ে দ্বিজবাবু গল্পে প্রতিসরণ আনলেন।

দ্বিজবাবুর পাঠভঙ্গির সঙ্গে বেতারে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহাভারতের গল্প বলার ভঙ্গির মিল আছে। প্রভাবের কথা বলছি না, সাযুজ্যের কথা আনছি। দ্বিজবাবু গান করেন, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ গল্পে আদৌ গান গাইতেন না কিন্তু উভয়ে ভাষাকে এক তারে বাঁধেন। শিষ্ট, সাধু অথচ সহজ ভাষা। চরিত্রানুযায়ী যে ভাষার রদবদল হত তা কিন্তু নয়। স্বরে অভিনয়াংশ কম, মেয়েদের সংলাপও এক স্বরে বলেন, কোনও ‘মেয়েলি’ ভাব আনেন না। দ্বিতীয়ত ঘটনানুযায়ী ছোট ছোট ভাগে আখ্যানকে বিভক্ত করে বলা হয়। নিজের মন্তব্য, প্রশ্ন বা গান (দ্বিজবাবুর ক্ষেত্র) এই ছোট ছোট ভাগগুলির সংযোজক। ফলে গল্পের রওয়ানি তৈরি হয়, পরের ঘটনাটি শোনার জন্য কৌতূহল উসকে দেওয়া হয়। বিভূতিবাবু কথকতার ও গল্প বলার এই শৈলীকে ধরতে পেরেছিলেন। বাবা হরিহরের পাঠ শোনে অপু,

এদিকে আবার যখন সিন্ধু সৌবীরের রাজা রহুগন তাঁহার স্বরূপ না জানিয়া রাজর্ষি ভরতকে শিবিকাবাহক নিযুক্ত করেন—তখন হইতে কৌতূহলে ও উৎকণ্ঠায় তাহার (অপুর) বুক দুরু দুরু করে, মনে হয় এইবার একটা কিছু ঘটিবে, ঠিক ঘটিবে।১৩০

ছোট ছোট ঘটনাগুলির নিজস্ব ভাব আছে। কোনওটা হাসির উদ্রেক করে, কোনওটা বা দুঃখের। এই সব টুকরো টুকরো ভাব মিলে গোটা পালাটার মধ্যে যখন এক সামগ্রিক রস ফুটে ওঠে, তখনই কথকতা শিল্পোত্তীর্ণ হয়, গল্প বলাটা হয়ে ওঠে আর্ট।

অবনীবাবুর কথকতাটা প্রথানুগ তবু শৈলীতে দ্বিজবাবুর ‘রামায়ণীর’ সঙ্গে তাঁর পার্থক্য আছে। অবনীবাবুর পাঠ অনেকটা পাঁচালির ঢঙে, আখ্যানে গানের চাইতে পয়ারে লেখা পদ্যাংশ বেশি।১৩১ অবনীবাবুর মূল উৎস জগৎরামী-রামপ্রসাদী রামায়ণ, অষ্টাদশ শতকে রাঢ় অঞ্চলের বিখ্যাত সাধকের লেখা। ‘অদ্ভুত-অধ্যাত্ম মত, একত্র করিয়া যুত, রচনা বিবিধ রসুধাম।’১৩২ মঙ্গলাচরণের বিন্যাস এক, খালি সংস্কৃত পদগুলির বেশিরভাগ বাংলা পয়ারে গীত। আখ্যান ছন্দে বিধৃত, সংলাপও প্রায়শ তাই। পালার আগে একটি দীর্ঘ বন্দনাগান আছে। তাতে পরিচিত সমস্ত মার্গীয় দেবতা আছেন, তদতিরিক্ত কেউ কেউ আছেন। দীর্ঘ বন্দনাগানের শেষ অংশ তুলছি,

পিতামাতা চরণকমলে প্রণাম জানাই।

পিতামাতার সম গুরুভাই এই জগতে আর কেহ নাই॥

আর শিক্ষাগুরু দীক্ষাগুরু বন্দিনু চরণ।

এই আসরে আসুন শ্রীরাম লক্ষ্মণ॥

এই আসরে এসো মাগো বীণাবাদিনী।

সঙ্গে করি লয়ে এসো ছয় রাগ আর ছত্রিশ রাগিণী॥

মাগো মা, তোমার কৃপাতে মাগো রামের গুণ গাই।

তুমি মুখ ফিরালে বাক্য নাহি পাই॥

… … …

কলিযুগের দেবতা বন্দি দেবী বিষহরি।

পদ্মফুলের উপর জন্ম হয় যার শিবের কুমারী॥

কোনও পরিশীলিত আসরে, হরিসভায়, রাময়ণী বন্দনাগানে মনসার প্রবেশ অপ্রত্যাশিত। কিন্তু অবনী অধিকারীর বন্দনা দেখায় যে রামায়ণী পালাতে, বন্দনার বিন্যাসে আঞ্চলিক সংস্কৃতির নানা সূত্রে, সবকিছু ঢুকে পড়তে পারে। গ্রামে যাদের ক্ষমতা স্বীকৃত, লৌকিক আসরের বন্দনাগানে তাদের বাদ দেওয়া বিপদজনক।

ইন্দ্র ব্রাহ্মণ নন, তাই গৌতম মুনি তাঁকে সামগান শেখাননি। তখন ছদ্মবেশী ইন্দ্র অহল্যার কাছে সামগান শেখেন। অবনীবাবুর পালায় শৃঙ্গার বা জৈবিক আকর্ষণ গৌণ। অবনীবাবুর পালার বিন্যাসও একটু আলাদা। ছোট কথা, মূল সংলাপ গানে, আবার ছোট কথা, নমুনা দেওয়া যাক,

এমন সময় দেবরাজ ইন্দ্র গৌতম মুনির বেশ ধারণ করিয়া অহল্যার কুটিরে এসে উপস্থিত হইল। আর এখানে,

অহল্যা গৌতম জ্ঞানে তারে করে সম্ভাষণ।

বলে, আজি কেন প্রাতঃকালে গৃহে আগমন॥’

দেবরাজ ইন্দ্র বলে।

‘ওগো তব রূপ হইল স্মরণ।’

তোমার গানের রূপ আমার মনে পড়ল।

তাই, ‘কেমনে করি বল তপস্যা আচরণ॥’

আমি শুনেছিলান ভগবান তিনি গানে বড় সন্তুষ্ট হন। …অভিধানে পণ্ডিতগণ অর্থ করেছেন সামবেদ মানে হল গান, গানের সুরে ভগবানকে ডাকা, এর নাম সামবেদ। দেবী তুমি আমাকে একখানি গান শোনাও।

‘একদিন এ কারণে দিলেন অহল্যাদেবী তারপরে গাহিলেন গান।

গানের সুর শিখন করি দেবরাজ ইন্দ্রপুরে যান॥’

অবনীবাবুর কথকতায় পাঁচালি গানের প্রভাব আছে। গান গদ্য সংলাপের অনুসারী নয়। বরং গানের মধ্যে ঘটকালির কাজ গদ্য করেছে।

ক্ষান্তিলতা দেবীর কথা গদ্যে। তাঁর কথার চলন আখ্যায়িকার ঢঙে নয়। দ্বিজবাবুর কথকতায় গল্পের আধারে ব্যাখ্যা থাকে। কিন্তু তত্ত্ব ব্যাখ্যার প্রমাণ ও দৃষ্টান্ত হিসাবে ক্ষান্তিলতা দেবী গল্পের উপস্থাপনা করতেন বা কুমুদবন্ধু পালা লিখতেন। দুইজনের ভঙ্গি ও মেজাজে পার্থক্য এইখানে।

‘কুন্তীস্তব’ পালায় ক্ষান্তিলতা দেবীর সব গুণ, কুমুদবন্ধুর লেখার সব বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। প্রসঙ্গ নির্দেশ, দীর্ঘ ব্যাখ্যা ও সংলাপ, শ্লোক ও নানা ভাষ্যের অংশ এবং নানা গান। পালার আরম্ভে তিনি বলেন যে কুন্তীদেবীর স্তবাবলীর মধ্য দিয়ে কুন্তীদেবীর বর প্রার্থনা প্রসঙ্গে ‘ভগবান লীলাগুণ কথা’ বিষয়ে ‘কিছু আলোচনা’ করবেন। এই ‘আলোচনাই’ হল তাঁর কথকতার বিন্যাস। অর্জুনের হাতে অশ্বত্থামার পরাজয় ও পরীক্ষিতের জীবনরক্ষা হল প্রেক্ষাপট। দ্বৈপায়ন হ্রদে দুর্যোধনের উরুভঙ্গ থেকে অশ্বত্থামার পাণ্ডব শিবিরে নিশি অভিযান ও পরাজয়, উত্তরার ভ্রূণরক্ষা ইত্যাদি একটানা গদ্যে বলা হয়েছে, প্রসঙ্গ নির্দেশ করা হয়েছে। যখন প্রভাতে কৃষ্ণ পাণ্ডব শিবির ত্যাগ করতে উদ্যত তখন তাঁর সঙ্গে কুন্তী কথোপকথনে লিপ্ত হলেন। বিবৃতিতে বোঝানো হয়েছে যে কেন কৃষ্ণ পাণ্ডববন্ধু, কেন কৃষ্ণ পরীক্ষিৎকে রক্ষা করলেন। কুন্তীর মুখে ধুয়ার মতো ফিরে এসেছে, কেবল একটি বিষয়: কৃষ্ণকে দেবার মতো পাণ্ডবদের দুইটি বস্তু আছে, ‘ব্যথা মাখা অশ্রুজল’ ও ‘অবনত মস্তকে প্রণাম’, এই দুইটিকে নানাভাবে নানাগানের সংযোগে ক্ষান্তিদেবী তাঁর কথায় ব্যাখ্যা করেছেন। ব্যাখ্যাতে প্রায়শই সংলাপ দীর্ঘ। কৃষ্ণের প্রতি সম্বোধনের উদাহরণ দেওয়া যাক, ‘হে আমার করুণানিধান, হে আমার বিপদভঞ্জন, হে আমার দীন দয়াল, হে আমার পাণ্ডবসখা, হে আমার কাঙ্গালের ঠাকুর’ ইত্যাদি।১৩৩

একই বিষয়ের নানা বিচার কথকতাকে ব্যাখ্যামূলক করে তোলে। গল্পের রওয়ানির চেয়ে ভাবের তাৎপর্য প্রতিষ্ঠা হয়ে ওঠে লক্ষ্য। ক্ষান্তিদেবীর কথকতার শৈলী তাই। একটি কেন্দ্রীয় ভাবকে নানা ভঙ্গিতে আলাপ করার মধ্যে নিহিত আছে তাঁর পাঠের আঙ্গিক। নানা টুকরো টুকরো ভাবকে নিয়ে অন্য এক সামগ্রিক ভাবের আবেদন ফোটানো তাঁর অভীষ্ট নয়।

বাসন্তীদেবীর বৈশিষ্ট্য মঙ্গলাচরণে।১৩৪ তিনি এখানে নতুন ভঙ্গি উদ্ভাবন করেছেন। প্রথমে তিনি কোনও একটি দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে পালা আরম্ভ করেন। মালদহের এক সভায় গিয়ে আরম্ভ করেন যে তাঁর দামি জিনিস হারিয়েছে, চোরের নামও জানেন, কেউ খুঁজে দিতে পারবে কিনা। সভায় সাড়া পড়ে যায় তখন তিনি বলেন যে তাঁর হৃদয় হারিয়েছে, চোর শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং। আমার শোনা আসরে তিনি আরম্ভ করেন যে একজন পরিচিতের (রামবাবু) সঙ্গে তাঁর অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ হয়নি, কারণ তাঁর মেয়ের বিয়ে ছিল। সেই বিয়েতে অলঙ্কার দেওয়া হয়েছে, ‘কৃষ্ণ নাম শ্রবণ কুণ্ডল’, যাতে মেয়ে সবসময় কানে দিতে পারে। সেই বিয়ের অনুষঙ্গে বলেন যে শ্রোতারাও প্রত্যেকে কন্যাদায়গ্রস্ত, তাঁদের ঘরে দুইটি বয়স্থা কন্যা আছে। রতি ও মতি তাদের নাম, তাদেরও সুপাত্রস্থ করতে হবে। এইভাবে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাকে রূপক হিসাবে ব্যবহার করে তিনি পালার উপস্থাপনা করেন।

প্রণাম জানানো হয় গুরুকে, গ্রন্থকে, গ্রন্থ প্রতিপাদ্য শ্যামসুন্দর ও রাধারাণীকে, রচয়িতা ব্যাসদেবকে, বক্তা শুকদেব ও শ্রোতা পরীক্ষিৎকে। এবং অবশেষে অতীত ও বর্তমানের উপস্থিত ও অনুপস্থিত বৈষ্ণব ভক্ত শ্রোতাকে প্রণাম করে তিনি ভাগবতী কথা শুরু করেন। তাঁর এই রীতি প্রথানুগ।

বাসন্তীদেবীর কথকতাও ব্যাখ্যামূলক। গোবিন্দ অধিকারীর গান, মহাভারতের কাহিনী, লৌকিক দৃষ্টান্ত সবই আনা হয় তত্ত্ব প্রতিবেদনের উদ্দেশ্যে। বাসন্তীদেবীর পাঠে কিন্তু নাটকীয় সংলাপ কম। তার বর্ণনা গীতি-নাটিকার আকারে বিন্যস্ত নয়। বরং গীতি-কথিকার ঢঙে তিনি তাঁর বক্তব্য সাজান।

শৈলীতে আধুনিক কথকদের মধ্যে পারস্পরিক পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। ধরণীধর বা ক্ষেত্রমোহনের শৈলী কী ছিল, বলা যায় না। যাঁরা বর্তমানে কথকতা করছেন, তাঁরা কেউ উনিশ শতকের কথক পরম্পরার লোক নন। অতএব ধারাবাহিকতার কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। বহিরঙ্গে পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু কথকতা পৌরাণিক আখ্যানমূলক, তার মূল রস ভক্তি। এই অন্তরঙ্গে বোধ হয় পরিবর্তন আসেনি। কিন্তু শ্রোতা বদলেছে, ভাষায় রুচি একরকম নেই, দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় নানা পরিবর্তন এসেছে। অনুষঙ্গ বোঝাতে গিয়ে, ‘ঘটকালি’ করার সময়, গান, পালার সংলাপ ও বিন্যাস, উদাহরণ চয়ন যুগোপযোগী না হলে আসর জমানো অসম্ভব। আজকের কথকরা এই কথা জানেন।

৪ শ্রোতার জগৎ

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের পিতৃকুলের আর্থিক অবস্থা যে রকমই হোক না কেন, মামার বাড়ি বেশ সচ্ছল ছিল। মাতামহ ছিলেন হাওড়ার শিবপুরের ছোটখাটো জমিদার, ইংরেজ সওদাগরের হউসে বড়বাবু। এমন অবস্থায় যা হয়। উনিশ শতকীয় যৌথ পরিবারে জুটে গিয়েছিল এক গরিব পোষ্য জ্ঞাতি। সুনীতিবাবুর মানিকাকা। এই অর্ধপোয্য গরিব আত্মীয় সবার উপহাসের পাত্র। ফাই-ফরমায়েশ খাটা তাঁর অবশ্যকর্তব্য। যে কোনও বৃহৎ কাজ-কর্মে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ করার দায় বর্তাত মানিকাকার উপরই। সাদামাটা গেঁয়ো মানুষ, বিদ্যার দৌড়ও সামান্য। দুপুর বেলা একপাল বাচ্চাকে তিনি তাঁর গাঁয়ের গল্প বলতেন। জমাটি নিমন্ত্রণ রক্ষার মজাদার কাহিনী আর মাঝে মাঝে যাত্রায় দেখা, ‘কথকতায় শোনা পালা, অজামিলের কথা, রুক্মাঙ্গদ রাজার একাদশী, ধ্রুবের তপস্যা’ ইত্যাদি। সেই মুহূর্তে ভাইপো-ভাইঝি বা ভাগনে-ভাগনিদের কাছে মানিকাকাই কথক হতেন, ‘এ সব গল্প বেশ শ্ৰতিরোচক আর মনোমোহন করে শোনাতেন’। কথক ঠাকুরের দৌড় কেবল আসরে সীমাবদ্ধ থাকে না। মানিকাকার মতো মানুষের মাধ্যমে একনিষ্ঠ শিশু শ্রোতাদের জমাটি আসর বসে।

মানিকাকা কথকতার আসরে হাজিরা দিতেন। কারণ ভাল ‘আক্ষেপের কথা’ শোনা তাঁর বাই ছিল। ‘চৌধুরি পাড়ায় কথকতার আসরে কথক ঠাকুর যখন কোন গম্ভীর বিষয় নিয়ে বাগাড়ম্বর করে বলে যেতেন, মানিকাকা নিবিষ্ট চিত্তে শুনতেন, আর অনেক সময়ে চোখ দিয়ে তাঁর ঝর ঝর করে জল পড়ত। তিনি তখন একাগ্র মনে, তাঁর বর্ণনা অনুসারে, দুটো “আক্ষেপের কথা” শুনছেন। তাঁর এই “আক্ষেপের কথা” শোনার আগ্রহ আমাদের কছে একটা রসিকতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।’১৩৫

অবজ্ঞেয় মানিকাকা খুঁজে বেড়াতেন কোথায় ‘আক্ষেপের কথা’ শুনতে পাওয়া যাবে। বড়লোক আত্মীয়রা তাই নিয়ে ঠাট্টা করতেন। পরিবারের ক্ষমতা বিন্যাসের নিম্নতম বিন্দুতে অবস্থিত দুর্ভাগা বোকাসোকা মানিকাকা কিন্তু বার বার ওই রকম আসরে ছুটে যেতেন, এমনকি বাড়ির গুরুদেবকেও রেহাই দিতেন না। তাঁর কাছ থেকেও ‘গোটাকতক “আক্ষেপের কথা” শোনবার দাবি জানাতেন। ওই রকম আসরে তিনি তাঁর মনের আশ মেটাতে পারতেন, কাঁদতেন, তাঁর ‘একাগ্রতা’ তাঁর বিদ্রূপকারীদেরও চোখ এড়াত না।

বড়লোক আত্মীয়রা হাসতেই পারেন, কিন্তু ভট্টনায়ক, আনন্দবর্ধন, অভিনবগুপ্তদের কাছে এই জাতীয় অভিজ্ঞতার মূল্যের শেষ ছিল না। রস-সৃষ্টির আলোচনায় ভুক্তিবাদী, ধ্বনিবাদী বা রসধ্বনিবাদীরা সহৃদয়, সামাজিক বা রসজ্ঞকে আলোচনার কেন্দ্রে বসিয়েছেন। রসের প্রতীতি রসচর্বণ বা রস আস্বাদনে, সহৃদয় বা সামাজিক সেই রস আস্বাদনে সক্ষম। সহৃদয়ের রসচর্বণা ভিন্ন রসের অনুভব প্রকাশবেদ্য নয়। কাব্যরসের আধার কবিও নন, কাব্যও নয়, সহৃদয় পাঠকের মন। সঙ্গীত ও অভিনয় প্রসঙ্গেও একই কথা প্রযোজ্য।

জবরদস্ত কথক নন, অলোচনার আসরে রসবোধের বিষয়ী হিসাবে অভাজন মানিকাকাই জাঁকিয়ে বসবেন। কিন্তু কীভাবে? আমাদের কথকরা কি এতটা জানতেন? রসের ধারণা কি তাঁদের আয়ত্তে ছিল? বেশির ভাগ কথকই বৈষ্ণব। ভাগবতী কথকতার বহু পুথিতে শ্রীধর স্বামী ও বিশ্বনাথ কবিরাজের টীকার উল্লেখ পাওয়া যায়। বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্ব রসতত্ত্বের নামান্তর, ভক্ত ও ভগবানের সম্পর্ককে নানা রসের মাধ্যমে বর্ণিত করা হয়েছে। সুতরাং কথক ঠাকুর রসতত্ত্বের ঐতিহ্য সম্পর্কে অনবহিত থাকতেন, একথা মনে করা সঙ্গত নয়। সরাসরি প্রমাণও আছে। কথকদের রচিত সংগ্রহ গ্রন্থে আখ্যানাংশ নির্বাচন ও ভাগ রস অনুযায়ী করা হত। যেমন:

‘রামায়ণ কথা সংগ্রহঃ’তে আরম্ভেই বিন্যাস এরকম: ‘নবরসঃ কিং। শৃঙ্গারোষথা সীতাহরণ শূর্পনখাঃ গমনাদি্‌ঃ ॥ ১ ॥ বীরো যথা রাবণ কুম্ভকর্ণবধাদয়ঃ ॥ ২॥ করুণো যথা রামস্য বনগমনাদিঃ ॥ ৩॥ অদ্ভুতো যথা সাগরবন্ধনাদিঃ ॥ ৪ ॥ হাস্যোযথা দশরথগৃহে রাম জন্ম ॥ ৫॥ ভয়ানকোযথা রাবণমারীচ সম্বাদঃ’ ইত্যাদি ॥১৩৬

আবার বর্ষীয়ান কথক কুমুদবন্ধু বলেন যে, ‘কথকতা খুব শক্ত বাবা, কথায় নবরসের বিন্যাস করতে হবে তো।’১৩৭

সরাসরি ঐতিহাসিক প্রমাণসূত্র ছাড়াও বলা যেতে পারে যে কথকতা একটা বিশেষ রকমের পাঠ। এই পাঠের মাধ্যমে কীভাবে সহৃদয় বা সামাজিক ভরতের হরিণ শিশুর হারানোর বেদনায় আকুল হন, লঙ্কায় হনুমানের কীর্তিকলাপে হেসে খুন হন? ভরত বা হনুমান কেউ পরিচিত নন, তাঁদের অভিজ্ঞতার তিনি সরাসরি শরিকও নন। শ্রোতার নিজের বোধ স্বগত, ভরত বা হনুমানের ভাব পরগত। লৌকিক ভাবের পরিমিতত্ব ছাপিয়ে যাওয়া যায় কীভাবে, কীভাবে কথকের উচ্চারিত শব্দের জোরে, পাঠের ঝোঁকে অন্য বিষয় ‘সহৃদয় হৃদয়-সংবাদী’ হয়, বিষয়ের ‘চমৎকৃতিতে’ সামাজিক-এর ‘তন্ময়ীভবনতা’ দেখা যায়, অতি সাধারণ শব্দ রসধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়? এই প্রশ্ন তাত্ত্বিক। নবম থেকে একাদশ শতকে, নানা প্রস্থানের নানা বিতর্কের মধ্য দিয়ে হারিয়ে যাওয়া পুস্তক হৃদয় দর্পণে-র লেখক ভট্টনায়ক অথবা ‘ধ্বন্যালোকের’ অজ্ঞাতনামা কারিকাকার, বৃত্তিকার আনন্দবর্ধন এবং লোচন, টীকাকার অভিনবগুরা সদলবলে এই প্রশ্নের মোকাবিলা করেছেন। এই প্রসঙ্গে কথকরা এই তত্ত্বের সব অনুপুঙ্খ সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন ছিলেন কিনা, তা অবান্তর, রসসৃষ্টির ক্ষেত্রে শ্রোতার ভূমিকার সাধারণ বিচারেই। রয়ে গেছে তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা।

তাঁদের রচনানুসারে, শব্দের সংকেতিত করার ক্ষমতা মান্য, বলা হয়েছে “ধ্বননং শব্দস্যৈব ব্যাপার॥” ‘শব্দজাঃ শব্দা’ ধ্বনি বলে অভিহিত। কিন্তু শব্দের মধ্য দিয়ে অভিধা ও লক্ষণার বা তাৎপর্যের শক্তি ছাপিয়ে যে ব্যঞ্জনাজন্য বোধ বা ব্যঙ্গ অর্থ সৃষ্টি হয়, ধ্বনিবাদীদের কাছে সেটাই ধ্বনির বিশেষ পারিভাষিক অর্থ। শব্দের নিজস্ব শক্তিতে এই ব্যঞ্জনার ক্ষমতা নিহিত আছে, ব্যঞ্জনার স্বতন্ত্র বোধে রস জাগ্রত হবার সম্ভাবনা থাকে। ‘শব্দনং শব্দঃ শব্দব্যাপারঃ, ন চাসাবভিধাদিরূপঃ, অপি ত্বাত্মভুতঃ, সোহপি ধ্বননং ধ্বনিঃ।’ বক্তার উচ্চারিত শব্দ ব্যঞ্জনা নামক বিশিষ্ট শক্তির দ্বারা শ্রোতার বা সহৃদয় বা সামাজিকের মনে অভিজ্ঞতাজনিত বাসনাদি সংস্কারের উদ্রেক করে, বর্ণিত বিষয়ের সঙ্গে তন্ময়ীভবনতার প্রাপ্তিযোগ হয়।১৩৮

কিন্তু এই স্তরেই ভট্টনায়ক বা অভিনবগুপ্ত ব্যঞ্জনার দ্বারা রসসৃষ্টির দুইটি ধারণার নির্দেশ করেছেন। এই তন্ময়ীভবনতা বা চিত্তবৃত্তির সঙ্গে একাত্মতা অলৌকিক, এই অনুভবনের আস্বাদনের সঙ্গে লৌকিক সুখ-দুঃখবোধের অনুভবের পার্থক্য আছে। রসচর্বণা লৌকিক ভাবের পরিমিতত্বকে অতিক্রম করে, শব্দ ব্যঞ্জনার এতই ক্ষমতা। বাল্মীকির আদি শ্লোক নিয়ে আলোচনাকালে বলা হল যে ‘ইহা লৌকিক শোক হইতে পৃথক (লৌকিকশোক ব্যতিরিক্তাং) এবং নিজের চিত্তবৃত্তির যে বিগলিত অবস্থায় ইহা আস্বাদিত হইতেছে, তাহাই ইহার একমাত্র সারবস্তু। পরিপূর্ণ কুম্ভ থেকে যেমন জল উছলাইয়া পড়ে (রসপরিপূর্ণকুম্ভোচ্চলন) তেমনই চিত্তবৃত্তির স্বাভাবিক নিঃষ্যন্দিতার জন্য বিলাপবাক্য ক্ষরিত হয়।’১৩৯ রসের এই উচ্ছলন প্রবণতার জন্য শোক আর ক্রৌঞ্চের একান্ত শোক নয়, বাল্মীকির নিজস্ব দুঃখ নয়, শোক সহৃদয়ের চর্বণযোগ্য। কিন্তু এই চর্বণা সম্ভব, লৌকিক অনুভবের পরহগত্ব বা আত্মগতত্ব অতিক্রম করা যায়, ‘রসাদি বিয়ে ভাবকত্বের দ্বারা’। রস ভাবিত হলেই ভোগ (অনুভব) করা সম্ভব। ভট্টনাকের মতে, ‘রসের সম্পর্কে যাহা বিভাবাদির সাধারণত্ব সম্পাদন করে তাহাই ভাবকত্ব।’১৪০ এই ভাবকত্বের ধারণাকে অভিনবগুপ্ত বাতিল করতে পারেননি। প্রচলিত পাঠ্যপুস্তক সাহিত্য দর্পণে বিশ্বনাথ কবিরাজ এই ‘ভাবকত্বের’ অপর পারিভাষিক নাম দিয়েছেন ‘সাধারণীকৃতিঃ’। উচ্ছলন প্রবণতা ও রসধ্বনির মাধ্যমে রসের অনুভবকে আদর্শায়িত করা ও ব্যাপ্তি দেওয়া হয়। ফলে রস সামাজিক হৃদয়সংবেদ্য হতে পারে, বহুজনীন হতে পারে। রসবোধের আলোচনায় শব্দের ব্যঞ্জনার শক্তির মাধ্যমে লৌকিক সীমা, নিছক ব্যক্তি-অভিজ্ঞতার সীমাকে অতিক্রম করার বাসনা এই তত্ত্বে বার-বার স্বীকৃত হয়েছে।১৪১

কথক বাগাড়ম্বরের মাধ্যমে, শব্দ শক্তির মাহাত্মের জন্য, ধ্বনি বা রস সৃষ্টি করেন। মানিকাকার আত্মগত শোকানুভবে হৃদয় সিক্ত ছিল, মানসপ্রক্রিয়ায় তিনি রসধ্বনিজাত বিষয়ে তন্ময়ত্ব পান, রসচর্বণা শুরু হয়। এই অনুভবন লৌকিক নয়, ‘মানসপ্রক্রিয়া’; এই রস কাহিনী বা কথকে আবদ্ধ নেই, রস ব্যাপ্ত, ‘সহৃদয় হৃদয়সংবেদ্য।’ মানিকাকার মতো আসরে অনেকেই এর অংশগ্ৰাহী। আসর রসবোধের ক্ষেত্র হিসাবে রূপান্তরিত হয়েছে রামের অযোধ্যায়, কৃষ্ণের বৃন্দাবনে বা ভরতের তপোবনে।

কথকতার আসরে রসভোগের বা সীমা অতিক্রমের আরও নানারকম উদাহরণ হাজির করা যেতে পারে। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সদ্য বিবাহিত বড় ছেলের অকালমৃত্যুতে সমস্ত পরিবার শোকে মুহ্যমান। মুশকিল আসানের পথ বাতলালেন দীনেশচন্দ্র সেন।১৪২

আমি একদিন বলিলাম, ‘আপনারা যদি সান্ত্বনা চান, তবে আমি একজন ভাল কথককে নিযুক্ত করতে পারি, তাহার কথায় আপনারা শান্তি পাইবেন।’ সমুদ্রে পতিত ব্যক্তি যেরূপ তৃণটিকেও আশ্রয় করিতে হাত বাড়ায়, গগনবাবু এই প্রস্তাবটির সফলতা সম্বন্ধে আস্থাহীন হইয়াও ইহাতে রাজী হইলেন। বাড়ির মেয়েরা সাগ্রহে এই প্রস্তাবে সায় দিলেন।’

কোন পরিস্থিতিতে কথকদের ডাকা হয়, তার আভাস পাওয়া গেল। মেয়েরা এই বিষয়ে যথারীতি উৎসাহী, দীনেশবাবু তাও জানাতে ভোলেননি। কথক ক্ষেত্ৰনাথ চূড়ামণিকে দেখতে আদৌ নয়নাভিরাম নয়।

কিন্তু কথা বলিবার ইহার আশ্চর্য শক্তি! প্রথম দিনই আসর জমিয়া গেল। গগনবাবুর বাড়িতে ছেলে বুড়া সকলেই মৌতাত ধরিলেন, সন্ধ্যায় বড় হল-ঘরটায় ক্ষেত্ৰচূড়ামণির কালোকণ্ঠে ঔজ্জ্বল্য প্রদান করিয়া ফুলের মালা দুলিতে থাকিত, এবং তিনি ধ্রুব, প্রহ্লাদ, জড়ভরত, দক্ষযজ্ঞ, রুক্মিনী হরণ, বৰ্কাসুর বধ প্রভৃতি কত পালা যে বলিয়া যাইতেন, তাহার অবধি ছিল না। তিনি কথায় কথায় ছবি আঁকিয়া যাইতেন; বর্ণনার ছটায় মেঘ, বৃষ্টি, বসন্ত সমীরণ এবং পদ্মবন যেন চোখের সম্মুখে উপস্থিত করিতেন, কখনও শ্রোতৃবর্গ অশ্রুসিক্ত হইয়াছে, কখনও হাসির স্রোতে ভাসিয়া গিয়াছে। এরূপ অপরূপ বক্তাকে পাইয়া ধর্মের কথায় পৌরাণিক প্রসঙ্গে মন হইতে শোক ধীরে ধীরে মুছিয়া যাইতে লাগিল।

…প্রায় একমাসের মধ্যে গগনবাবুর মন এরূপ লঘু হইয়া গেল যে যখন ক্ষেত্র কথক কথা বলিতেন, তখন গগনবাবু লুকাইয়া তাঁহার চেহারা ও ভঙ্গীগুলি আঁকিতেন।

ক্ষেত্রচূড়ামণির কথকতা হৃদয়সংবেদ্য হয়েছিল। বলার কারুকৃতিতে, পৌরাণিক গল্পের ব্যঞ্জনায় গগনবাবুর শোকসন্তপ্ত পরিবার সবাই রসের আস্বাদনে সমর্থ হয়েছিলেন, যাঁদের ব্যক্তিগত শোকভার ‘লঘু’ হয়ে গিয়েছিল এমন কী ক্ষেত্র কথক নিজে গগনবাবুর শিল্পের বিষয় হয়ে গেলেন। এই ক্ষেত্রে রসচর্বণার দ্বারা ব্যক্তি-শোকানুভবের সীমা অতিক্রম করা সম্ভব হয়েছিল। এই অতিক্রম্যতা কেবল গগন বাবুর মধ্যেই সীমিত ছিল , তা জনগ্রাহ্য হয়েছিল, ‘ছেলেবুড়া সকলের মৌতাত ধরেছিল।’ ক্ষেত্র কথক বলেছেন আর রস আস্বাদনের ভাগীদার হয়েছেন বাড়ির আমজনতা।

এই আমজনতার সঙ্গে কথকের ঘটকালি কীরকম পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, তার ছবি অনুরূপা দেবীর লেখাতেও ধরা পড়ে। নায়িকা বাণী রসজ্ঞ, তার দৃষ্টিতে কথকের অনুষ্ঠান দেখানো হচ্ছে। শ্রোতার প্রতিক্রিয়া, কথকের নৈপুণ্য সব কিছু বর্ণনায় ধরা পড়েছে।

…সেদিন কথকতার বিষয় ছিল ‘অভিমন্যুবধ’। ক্ষমতাশালী বক্তা…ভাষা প্রাণস্পর্শী, স্বর অনন্য-সাধারণ। বীর বালকের অতুল সাহস, অমিত পরাক্রম, শ্রোতৃদলকে উত্তেজিত করিয়া যেন রণক্ষেত্রে টানিতেছিল। তারপর সে কি উৎকণ্ঠা, কি বিপুল উদ্বেগ। খাস বুঝি কণ্ঠের মধ্যে চাপিয়া আসে। সপ্তরথী আসিয়া একা অসহায় বালককে একসঙ্গে ঘিরিল। পিশাচ, পিশাচ! দন্তে দন্ত নিষ্পেষিত ও হস্ত দৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ হইয়া গেল। প্রতিকার নাই! ইহার কি প্রতিকার নাই! ধিক! যদি না অন্যায়কারী শত্রুপক্ষকে দলিত করিয়া সপ্তরথীর লৌহ-নিগড়-মধ্য হইতে সোনার হরিণটিকে উদ্ধার করিয়া আনিতে পারা যায়, তবে শতধিক এই জীবন। কিন্তু হায়! কোন উপায় রইল না, অন্যায় সমরে ভারতের ভবিষ্যরবি অকালে অস্তমিত হইল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মাতুল, পিতা সব্যসাচী, পিতৃব্য মহাবল ভীম যাহার সহায়, সে আজ অসহায় অনাথভাবে সপ্তরথীর সপ্তশরে শোণিতরঞ্জিত বিক্ষতাঙ্গে বসুধা আলিঙ্গন করিল।…

দর্শকগণ নীরবে অশ্রুমোচন করিতেছিল। কোন কোন পুত্রশোকাতুরা জননী হৃদয়ের আবেগ সংবরণ করিতে না পারিয়া ডুকরিয়া কাঁদিয়া উঠিতেছিলেন। বাণী নীরবে চক্ষু মুছিয়া কথকের মুখে চাহিল। সে মুখে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য হইল না। চিত্রকরের তুলি যেমন চিত্রের ভাবপ্রদান করে, বর্ণ সমাবেশে ইন্দ্রালয় নন্দন কানন রচনা করে, নিজে সে ভাবসম্পদের ধারও ধারে না, যে এতগুলি লোকের বক্ষতলে শোকস্মৃতি জাগ্রত করিতেছিল, সে নিজে যেন তাহার মধ্যে ধরা ছোঁয়াও দেয় নাই।১৪৩

এই উদ্ধৃতিতে ফুটে উঠেছে বৈপরীত্য, পালার ধাপেধাপে, কী করে শ্রোতা তন্ময়তা পায় ও কীভাবে কথক নিরাসক্ত থাকে, ফলে কীভাবে আসর রসোত্তীর্ণ হয়।

উনিশ শতকের শেষের দিকে কথকতার বড় পৃষ্ঠপোষক ছিল কলকাতায় গড়ে ওঠা হরিসভা। আসর বসত সেখানে। বেহালার প্রাচীন হরিভক্তি প্রদায়িনী সভার পুরাতন কার্যবিবরণীর পাতা থেকে টুকরো খবর তোলা যাক।১৪৪

সভার উদযোগে বিগত মাঘমাস হইতে বৈশাখের শেষ পর্যন্ত শ্রীযুক্ত গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য কথক মহাশয় শ্রীমদ্ভাগবতীয় কথা কহিয়াছিলেন। ইহাতে প্রত্যহ শ্রোতৃসংখ্যায় সভাগৃহ পরিপূর্ণ হইত। দূরপল্লী হইতে অসংখ্য স্ত্রীলোক এই কথা শ্রবণ করিতে প্রত্যহ উপস্থিত হইতেন।

পরের বছরের প্রতিবেদনও একই রকম:

গত মাঘ মাসের ও ফাল্গুনের কিয়দ্দিন পর্যন্ত খিদিরপুর নিবাসী শ্ৰীযুক্ত ক্ষীরোদচন্দ্র মুখোপাধ্যায় কথক মহাশয় মাসাধিককাল শ্রীমদ্ভাগবতীয় কথা কহিয়াছিলেন। ইহাতে প্রত্যহ শ্রোতৃসংখ্যায় সভাগৃহ পূর্ণ হইত। বলা বাহুল্য শ্রোতৃগণের মধ্যে স্ত্রীলোকের সংখ্যাই অধিক হইত।” (নজরটান আমার)

১৯৯২ সালে চালতাবাগান গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্মিলনীর আসরেও একই দৃশ্য দেখা যায়।১৪৫ রাধারাণীর কাছে কথক দ্বিজরাজবাবুর মানসিক করা আছে। পৌষ বা মাঘ মাসে একমাস ধরে রামায়ণী কথকতা করেন তিনি।

শ্রোতাদের শতকরা ৯৫ ভাগ পাড়ার বৃদ্ধা বা বয়স্কা মহিলা, তিন-চার ভাগ বৃদ্ধ। তাঁরা নিয়মিত আসতেন, দু-চার পয়সা প্যালাও দিতেন। আসরে জোকার দেওয়া, কান্না, ভাবে অভিভূত হওয়া, সবই তাঁদের মধ্যে দেখা যেত। ষাট বছর আগেকার বেহালার হরিসভা বা এখনকার চালতাবাগানের হরিসভার আসরে শ্রোতার চরিত্রে বা পরিবেশে পার্থক্য খুব আছে বলে মনে হয় না।

আসরে বেমানান একমাত্র আমি। ফলে অনেকের প্রশ্নের জবাব দিতে হত, আলাপও জমে গিয়েছিল। বছরের পর বছর দ্বিজবাবুর কথকতা শুনছেন, শুনতে শুনতে গান মুখস্থ হয়ে গেছে, এমন একজন বললেন, ‘নাতনি কোন স্কুলে পড়ে খোঁজ রাখি না। ওর পড়াও বুঝতে পারি না। রামকথা বুঝি, তাই আসি।’ আর একজন আগে আসতে পারতেন না। সংসারে কাজ ছিল। এখন সবাই বড় হয়েছে, কাজ কম, ফাঁক পেলে চলে আসেন। এখনও কাজ থাকলে আটকে থাকতে হয়। তখন মন খারাপ করে। মন ভার হলে কথকতা শোনেন, মন হাল্কা হয়ে যায়।

আবার একজন বাল্যবিধবা। কষ্টেসৃষ্টে ছেলে মানুষ করেছেন, বিয়ে দিয়েছেন। তা অনেক হয়েছে। রান্নাঘরে আর ঢুকবেন না। শেষ কয়েকটা দিন, ধর্মকর্ম নিয়ে থাকবেন।

আবার কেউ বললেন যে, বাড়ির ছেলের কথা বলার সময় হয় না, সবাই সবসময় ব্যস্ত। এখানে আসেন। অনেক লোকের সঙ্গে কথাবার্তা হয়। সময় কাটে। আবার কথকতায় মনও শান্ত হয়, ভাল ভাল কথা শোনেন।

সবাই বৃদ্ধা, সবাই মহিলা, বৃহৎ পরিবারে সকলের দায়িত্ব ছিল। আজ সেই ভার নেই, নাতনি ও ছেলেদের সঙ্গে আড়ো-আড়ো ভাব, আগের বাঁধন শিথিল হয়েছে। সময়ও আসন্ন, শেষ পারাণির কড়ি চাই, জীবনের দায়বোধের কৈফিয়ৎ হয়তো দিতে হবে। কথকতায় বর্ণিত মূল্যবোধের জগতে তার উত্তর পাওয়া যেতে পারে। আবার কথকতার রস আস্বাদন অনেকে মিলে করেন, আলাপ আলোচনায়, আদানপ্রদানে সেখানে সমাজ গড়ে ওঠে, এককত্ব কেটে যায়। রস আস্বাদনের প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে এসে এখানে শ্রোতা হয়ে ওঠেন সামাজিক, সমূহে বা গোষ্ঠীতে তিনি স্থিত হন।

আবার কোনও না কোনওভাবে এঁরা নিজেদের বঞ্চিত ভাবেন। এঁদের এই বঞ্চনা। রসের ‘সাধারণীকৃতির’ জন্য, শব্দের ব্যঞ্জনা শক্তির প্রভাবে, কোনওদিন মিলে যায় শবরীর সার্বিক দুঃখে, তার প্রাপ্ত সামাজিক তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে। আবার পরম ভক্তিতে শবরীর যখন চরম প্রাপ্তি হয়, এঁরা মাটিতে কেঁদে লুটিয়ে পড়েন, বার বার হরিধ্বনি করেন। দ্বিজরাজ বাবুর বলা আখ্যানের শবরী তখন আদর্শায়িত হয়ে সর্বজনগ্রাহ্য হয়েছে।

লক্ষণীয় যে ভট্টনায়ক বা অভিনবগুপ্তদের রচনায় সহৃদয় ও সামাজিক সমার্থক, একটির পরিবর্তে অপরটি ব্যবহৃত হয়। সহৃদয়-এর সঙ্গে সামাজিকের এই যোগ তাৎপর্যপূর্ণ, একজন জরন্মীমাংসক যোগী সহৃদয় হতে পারেন না, বাসনার সংস্কার তাঁর নেই, শৃঙ্গার রসের আস্বাদন তার পক্ষে কী করে সম্ভব? রসাস্বাদন অলৌকিক কিন্তু যে বাসনাখ্য সংস্কার চিত্তবৃত্তিতে বিভাবাদিরূপে থাকে, যা রসবোধে অভিব্যক্ত হয় তা সামাজিক অভিজ্ঞতাপ্রসূত। অভিজ্ঞতা একক নয়, তা সমাজস্থ। সহৃদয়কে বার বার ‘সামাজিক’ নামাখ্যায় ভূষিত করে। তার নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে যেন বাস্তবের মধ্যে বেঁধে রেখে দেওয়া হয়।১৪৬

এই বাস্তবতা ক্ষমতা বিন্যাসের দ্বারা আবদ্ধ। মানিকাকা সামাজিক বা সহৃদয় কিন্তু বাস্তবে তিনি পরান্নভোজী, বড়লোক আত্মীয়ের গলগ্রহ। হরিভক্তি প্রদায়িনী সভা বা চালতাবাগানের হরিসভার অধিকাংশ শ্রোতাই পুরুষ শাসিত সমাজে মেয়ে; নানা দৈনন্দিন বঞ্চনার অবশ্যম্ভাবী শিকার। চালতাবাগানের বৃদ্ধারা আবার নানা অর্থে সংসারের প্রান্তবাসী। সম্পন্ন গগন ঠাকুররাও শোকে বিপর্যস্ত। নানাভাবে লৌকিক অভিজ্ঞতা এঁদের আহত করেছে, নানাভাবে এঁরা পর্যুদস্ত। নিষ্পেষণের, হতাশার তাড়নায় এরা কথক ঠাকুরের কাছে যায়, দাবি জানায়,

আমরা চাই একটু প্রাণ জুড়ানো হরিকথা যাতে চোখে জল আসে, প্রাণে ভরসা জাগে। এইসব তত্ত্বকথায় যে শুধু প্রাণ শুকিয়ে যায়, কোন ভরসা পাই না। মনে হয় আমরা ভগবানের কাছ থেকে অনেক দূরে পড়ে আছি।১৪৭ (নজরটান আমার)।

রসের উচ্ছলন ক্ষমতা ও সাধারণীকৃতি এই লৌকিক ক্ষেত্রকে মানসক্রিয়ায় অতিক্রম করায়, শ্রোতারা রসভুক্তির মাধ্যমে একক বোধকে সাধারণ বোধে রূপান্তরিত করেন। সাধারণীকৃতির ধারণার মধ্যে আছে একদিকে আদর্শায়িত করার ঝোঁক অন্যদিকে আছে ব্যাপ্ত করার বৃত্তি। উচ্ছলনের মধ্য দিয়ে, ব্যাপ্ত হবার মধ্য দিয়ে সীমা অতিক্রম করা যায়। ক্ষমতা বিন্যাসের নানা সীমা একক শ্রোতাকে লোকজীবনে নানা নিষেধের মধ্যে আবদ্ধ করে, তার সত্ত্বা বা বোধকে খণ্ডিত করে। রসধ্বনির মাধ্যমে, শব্দশক্তির মাধ্যমে রাম বা শবরীর কাহিনীতে শ্রোতা একাত্ম হয়, লৌকিক বোধের উত্তরণে, অলৌকিক বোধের জগতে তার সাযুজ্য ঘটে। অলৌকিক জগতে এই সাযুজ্যতার মাধ্যমে, আস্বাদনের মাধ্যমে, তার ‘চিৎ সম্বিত’ হয়। সাংখ্য মতাবলম্বী ভট্টনায়ক বর্ণিত সম্বিতের অর্থ ‘চৈতন্য’। নিম্নকোটির প্রতিনিধি মানিকাকার চৈতন্য দৈনন্দিন জীবনে নিয়মিত খণ্ডিত হয়, ক্ষমতার চাপে তাঁকে অস্বীকার করা হয়, ঠাট্টা করা হয়। রসধ্বনির ভোগে সেই চৈতন্য ফিরে পাওয়া যায়, তা স্ফুটিত হয়। চৈতন্যের প্রাপ্তি, অভিব্যক্তি, রসভোগের সাধারণীকরণের মাধ্যমেই সম্ভব। সংসারের অন্য সব ক্ষেত্র মানিকাকার কাছে, বুড়িদের কাছে সংকুচিত, প্রবেশাধিকার সেখানে সীমিত, কিন্তু রসভোগের এই ক্ষেত্র খোলা রয়েছে। আসরে তারা স্বরাট, কারণ তারা সামাজিক, রসের অনুভব সেখানে ‘সহৃদয় হৃদয় দর্পণমধ্যাস্তে।’ শব্দময় ধ্বনিময় কথকতার আসরে তাই দেখা যায় তাদের ভিড়।

আশির কোঠায় নৃতত্ত্ববিদ ভিক্টর টার্নারের ‘সীমা অতিক্রমের’ (Liminality) তত্ত্ব অনেক সমাজবিজ্ঞানীকে নাড়া দিয়েছিল। দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপের মধ্যে এমন আচার অনুষ্ঠান আসে, নানা শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে এমন ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া সম্ভব যেখানে গ্রাহ্য কাঠামো মুহূর্তের মধ্যে নাকচ হয়ে যায়, সমূহের অবস্থিতি বড় হয়ে ওঠে, মুক্তির অনন্ত সম্ভাবনা দেখা যায়। মুহূর্তগুলি হয়তো ক্ষণস্থায়ী কিন্তু সেইগুলির পুনরাবৃত্তি হয়, নানা আচারে, আন্দোলনে, উৎসবে, তীর্থযাত্রায় কাঠামো থেকে বাইরে যাবার পথ খুঁজে পাওয়া যায়, এমন কী কাঠামো নাকচ হতেও পারে। মানসিক ও ব্যবহারিক, উভয়ক্ষেত্রে, এই প্রক্রিয়া কার্যকর হয়।১৪৮

ভারতীয় রসতত্ত্বের ব্যাখ্যায় এই প্রক্রিয়ার অন্যতর মাত্রা দেখা যায়। রসের আলোচনায় আছে ‘চমৎকারিত্ব’, ও এই চমৎকারিত্ব নিহিত আছে বিস্তৃতির ধারণায়। ভরত নাট্যশাস্ত্রে স্পষ্ট বলা হচ্ছে,

যোহৰ্থো হৃদয় সংবাদী তস্য ভাবো রসোম্ভবঃ।

শরীরং ভ্যাপ্যতে তেন শুষ্কংকাষ্ঠমিবাগ্নিনা॥

আগেই দেখেছি, অভিনবগুপ্ত এই রসব্যাপ্তির তত্ত্বে কীভাবে সায় দিয়েছেন। বিশ্বনাথ কবিরাজ লিখেছেন, ‘চমৎকারশ্চিত্তবিস্তাররূপো বিস্ময়াপর পর্যায়ঃ।’ (চমৎকার শব্দের অপর নাম হচ্ছে চিত্ত বিস্তাররূপ বিস্ময়)।১৪৯

রসপ্রস্থানের ব্যতিক্রমী চরিত্র কুন্তকও রসের এই সামান্য গুণকে স্বীকার করেছেন। তাঁর ভাষায় ‘চমৎকারো বিতন্যতে, চমৎকৃতিবিস্তাৰ্যতে।’ ফলে মুহূর্তে মুহূর্তে রসাস্বাদন হয়, সেই আস্বাদন ক্ষণকালের নয়।১৫০ কবি-হৃদয় থেকে রস ক্ষরিত হয়, উচ্ছলিত হয়। আবার রসাস্বাদনে সহৃদয় চিত্তের বিস্তার হয়। এই তত্ত্বে কাঠামোর মধ্যে থেকেও মানসক্রিয়ায় কাঠামোকে অতিক্রম করার কথা থাকে; সামাজিক সংস্কারে আবদ্ধ হয়ে। লৌকিকভাবে তটস্থ থেকেও রসাস্বাদনে অলৌকিকভাবে রূপান্তরিত হওয়া যায়। ভ্যান গেনেপ বা টার্নার বার বার কাঠামোর বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে নানা পর্ব বা ভাগের কথা বলেছেন, সীমা অতিক্রমের মুহূর্তগুলিকে সেই পৰ্বান্তরের মধ্যে প্রোথিত করার চেষ্টা করেছেন।

রসানুভূতির ভারতীয় ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এইরকম পর্বভাগের বা মুহূর্তের অনুসন্ধানের প্রয়োজন উপলব্ধ হয় না। রসব্যাপ্তির বা উচ্ছলনের মধ্যে সহৃদয় ডুবে যান, চমকৃত হন, তটস্থের সীমা অতিক্রান্ত হয়, মুহূর্ত ও ক্ষণকে আলাদা করে চেনার সুযোগ থাকে না, কাঠামোর বাইরে তার বিরোধী রূপ দাঁড়িয়ে থাকে না, কাঠামোর মধ্যে হাজির ও গায়েব অনুযোগী-প্রতিযোগী রূপে আবদ্ধ, একটার সঙ্গে অন্যটা সমবায় সম্বন্ধে থাকে, মুহূর্তের মধ্য দিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা যায় না। সহৃদয়ের রসাস্বাদনের সামগ্রিকতার রূপ তাই এই তত্ত্বে ধরা পড়ে।

৫ কথকতার সামাজিকতা: লোকশিক্ষার চরিত্র বিচার

বঙ্কিমচন্দ্র বা সঞ্জীবচন্দ্র, দীনেশচন্দ্র সেন বা হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, সবাই ঐতিহ্যানুসারী সমাজে কথকদের শ্রেষ্ঠ লোকশিক্ষক বলেছেন। কথকের সম্বল কথা। মজলিশে সেই কথার মাধ্যমে শ্রোতারা নানা নীতি উপাখ্যান শুনতেন, আখ্যানের বয়ানে, গানের কথার পরতে পরতে থাকত জীবনচর্চার নানা মূল্যবোধের ইঙ্গিত, কী করলে ভাল হয়, কী করলেই বা মন্দ হয়, এইসবের নির্দেশ। এই ভালমন্দ ত্রিকালব্যাপ্ত। কথকের বয়ানে ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান সমভাবে বিরাজ করে। অথচ শ্রোতারা তো সাম্প্রতিক। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা ও জীবনচর্চার মধ্যেই তাদের নীতিবোধ স্থিত। তাই ঘটকালি করার সময় কথকও দৈনন্দিনকে ভুলতে পারেন না, পৌরাণিক চরিত্রে বাস্তবের মিশেল দিতে হয়; কথা যত ‘অসম্ভব’ হোক না কেন, তাকে ‘সহজের’ সমে, সমাজের পথে, ফিরতে হবে। বার-বার শ্রোতারা কাল্পনিক আখ্যানে খুঁজে বের করেন নিত্য প্রাসঙ্গিকতা, প্রাত্যহিক জগতের তুলনায় বা প্রতিতুলনায় পৌরাণিক চরিত্রগুলো ফিরে আসে, ঢুকে পড়ে প্রবাদ ও প্রবচনে, ধারণা হয়ে ওঠে লোকগ্রাহ্য, ‘বিদুরের খুদ’ বা ‘রাবণের চিতা’, ‘কংস মামা’ বা ‘দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ’; পৌরাণিক কথা জন্ম দেয় ধারণার, ধারণা রূপ পায় লৌকিক ছড়ায়, সামাজিক মন্তব্যে,

ভীম, দ্রোণ, কর্ণ গেল, শল্য হল রথী,

চন্দ্র সূর্য অস্ত গেল জোনাকি ধরে বাতি।

উনিশ শতকের দ্বিতীয় পদে, লোকবৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে, ইংরেজের পিঠ চাপড়ানোর কাঙাল, ইংরেজি নবীশ, ‘নদের ফটিক চাঁদ’দের বিরুদ্ধে বঙ্কিম প্রায়ই গালমন্দ করতেন। সমাজে ‘শিক্ষিত’ ও ‘রামাদের’ মধ্যকার দূরত্ব ক্রমশ যোজন-প্রমাণ হচ্ছে। বঙ্কিম চিন্তিত। এই ব্যবধান কমাবার জন্য যে ‘সুশিক্ষিতের’ উদ্যোগ কাম্য। লোকশিক্ষার প্রকল্পে তাঁর অগাধ আস্থা। স্বভাবত তাঁর আলোচনার অনুষঙ্গে হাজির হন আশৈশব পরিচিত কথক ঠাকুর,

গ্রামে গ্রামে, নগরে নগরে, বেদী পিঁড়ির উপর বসিয়া, ছেঁড়া তুলট, না দেখিবার মানসে সম্মুখে পাতিয়া, সুগন্ধ মল্লিকামাল শিরোপরে বেষ্টিত করিয়া নাদুস্‌নুদুস্‌ কালো কথক সীতার সতীত্ব, অর্জুনের বীরধর্ম্ম, লক্ষ্মণের সত্যব্রত, ভীষ্মের ইন্দ্রিয়জয়, রাক্ষসীর প্রেমপ্রবাহ, দধীচির আত্মসমর্পণবিষয়ক সুসংস্কৃতের সন্ধ্যাখ্যা সুকণ্ঠে সদলঙ্কার সংযুক্ত করিয়া আপামর সাধারণ সমক্ষে বিবৃত করিতেন। যে লাঙ্গল চষে, যে তৃলা পেঁজে, যে কাটনা কাটে, যে ভাত পায় না পায়—সেও শিখিত যে ধর্ম্ম নিত্য, যে ধৰ্ম্ম দৈব, যে আত্মান্বেষণ তাশ্রদ্ধেয়, যে পরের জন্য জীবন, যে ঈশ্বর আছেন, যে বিশ্ব সৃজন করিতেছেন, বিশ্ব পালন করিতেছেন, বিশ্ব ধবংস করিতেছেন, যে পাপ পুণ্য আছে, পাপের দণ্ড, পুণ্যের পুরস্কার আছে, যে জন্ম আপনার জন্য নহে, পরের জন্য, যে অহিংসা পরমধর্ম্ম, যে লোকহিত পরম কার্য—সে শিক্ষা কোথায়? সে কথক কোথায়? ১৫১ (নজরটান আমার)

ইংরেজি শিক্ষিত নব্য যুবকের লোকশিক্ষার প্রতি অনীহার বিপরীতে কথকের সামাজিক ভূমিকাকে বঙ্কিম ব্যাখ্যা করেছেন। সংস্কৃতির যোজক হলেন কথক; তাঁর যোজনার ফলে সমাজে মূল্যবোধের সৃষ্টি হয়, চিত্তবৃত্তির প্রসার ঘটে।

মুল্যবাধের আবৃত্তি নিঃসন্দেহে কথকের কাজ। কিন্তু সেটা এক বিশেষ প্রকারের মুল্যবোধ। তাঁর আলোচনায় দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন যে লোকগাথার প্রেমকাহিনীকে ব্রাহ্মণরা বাতিল করলেন এবং কথকদের মাধ্যমে দেবলীলার কথা চালু করলেন।১৫২ এক হাতে নিলেন, আর এক হাতে দিলেন। মনোরঞ্জনের ক্ষেত্রটি ‘নিম্নশ্রেণীর’ হাত থেকে চলে গেল পৈতা ঝোলানো কথক ঠাকুরের খপ্পরে। ভাল মন্দের তর্ক-বিচার দীনেশচন্দ্র সেন স্পষ্টত এড়িয়ে গেলেও এই পরিবর্তনের কথা বলেছেন।

ঐতিহাসিক কালক্রম, নৃতাত্ত্বিক তত্ত্ব, এই সবের ফিকিরে দীনেশচন্দ্র সেনের বক্তব্যে ফাঁক পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু কথকদের বর্ণিত পালার খুঁটি ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে প্রোথিত ছিল। কথকরা সমাজরক্ষণে ব্রতী ছিলেন, সমাজ পরিবর্তনে নয়।

প্রয়াত দার্শনিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় চার্বাক দর্শনের অবলুপ্তির পিছনে কথকদের ভূমিকাকে বেশ বড় করে দেখিয়েছেন।১৫৩ মহাভারতে-র শান্তিপর্বের একটি আখ্যানে ইন্দ্ররূপী শেয়াল নাস্তিক্যধর্মে বিশ্বাসের ভয়াবহ পরিণতি হাতেনাতে দেখিয়েছে, তর্কবিদ্যার প্রতি অনুরক্তির কর্মফল নিজমুখে বলেছে। কর্মফল কী? আগের জন্মে বামুন কিন্তু পরের জন্মে শেয়াল। আর এই গল্পটি নিপুণভাবে কথকঠাকুর ‘নিরক্ষর’ চাষাভুষোদের কাছে বলে কী মারাত্মক ‘প্রোপাগান্ডা’ই না করেছেন। কথকরা এইরকম প্রচারক, সাবেক কালের শাসকশ্রেণীর হাতের প্রচারমাধ্যম; অক্ষরজ্ঞানহীন ‘চাষাভূষোদের’ চেতনায় ‘নাস্তিক্যবুদ্ধির বিভীষিকাটা’ ‘কথকঠাকুর মারফৎ’ শাসকরা গেঁথে দিতেন। গল্পকারদের ও কথকদের প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদের শেষ প্রাসঙ্গিক মন্তব্য হল ‘আজকের দিনে এরকম কুশলী প্রোপাগান্ডিস্ট-এর খবর পেলে শাসক সম্প্রদায় পুরস্কারের ঝুড়ি উপুড় করে দেবেন।’

দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের যে কোনও মন্তব্য অনুধাবনযোগ্য। উনিশ শতকে বঙ্কিমী মূল্যায়নের সঙ্গে তাঁর বিবৃতির অনেক ফারাক, এমনকি দীনেশ সেনের লেখার মেজাজের সঙ্গেও তাঁর চিন্তা স্বভাবত খাপ খায় না। বঙ্কিমের কাছে যা লোকশিক্ষা, দেবীবাবুর কাছে সেটা শাসকশ্রেণীর প্রোপাগান্ডা। বঙ্কিমের ধারণা যে, নদের ফটিকচাঁদদের দাপটে কথকদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। হালকাভাবে হলেও দেবীবাবুর মনে হয়েছে যে জানা নেই, তাই, নতুবা কথকদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, খবর পাওয়া মাত্র শাসকদের দয়া তাদের উপর ঝরে পড়বে।

দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বিচারের সঙ্গে বৈমত্যের সুযোগ আছে। ঐতিহাসিক-গত ভাবে কথকরা লোকায়তিকদের বিরুদ্ধে কতটা লড়েছিলেন বা ব্যবহৃত হয়েছিলেন, সেটা আলোচ্য নয়। মহাভারত বা রামায়ণে-এর সব আখ্যান কথকরা ব্যবহার করতেন না, সংগ্রহের মাধ্যম দিয়ে কিছু আখ্যানমাত্র নির্বাচিত করতেন, সেই ভিত্তিতে পুথি নিজেদের মতো করে লিখতেন। কোনও কথকতার পুথিতে শান্তিপর্বে লেখা ইন্দ্ররূপী শেয়ালের আখ্যান উল্লিখিত করার কোনও ঐতিহাসিক নিদর্শন আছে কিনা, সেই তথ্য বিচারও গৌণ। আপত্তি আছে অন্যখানে, সমস্যাটাকে যেভাবে সাজানো হয়েছে—সেইখানে।

যে কোনও যুগে শাসক শ্রেণীর চিন্তাধারা সামগ্রিকভাবে সমাজে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে, মার্কসের এই উক্তি মান্য। আমাদের আজকের সমাজেও ডাক্তার, আইনজীবী, বিজ্ঞানী ও কবিরা বুর্জোয়াদের বেতনভুক, এই দামি কথাটাও মার্কস বলে গেছেন। বেশির ভাগ ব্রাহ্মণ ব্রহ্মোত্তর, দেবোত্তর জমি ভোগ করেন। জমিদার বাড়ির ডাকা আসরে তাঁরা কথক। পালার অন্যতম উৎস ব্রাহ্মণদের লেখা পৌরাণিক আখ্যান। বৌদ্ধিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের নিগড় কোথায় বাঁধা, সেইটা বুঝতে কোনও অসুবিধা নেই।

অথচ সীমা অতিক্রান্ত হয়, অন্তত হবার সম্ভাবনা থাকে। কথা বলার আর্ট হল কথকতা। আসর সামাজিক অনুষ্ঠান, বক্তা ও নানা রকমের শ্রোতা উভয়ে উপস্থিত থাকে। শ্রোতারা মান্য বামুন, ‘নিরক্ষর চাষাভূষা’ ‘গোলা মেয়েমানুষ’ সবরকম হতে পারে। কিন্তু আসরে রসভোগের প্রক্রিয়ায় তাদের সাধ্যানুযায়ী শ্রোতারাও সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। নানা শ্রোতার সংবেদনশীলতাকে কথক তার পাঠক্রমে মোকাবিলা করেন, তা না হলে আসর মাটি হবে। এই মোকাবিলার নানা সাক্ষ্য প্রভুপাদ প্রাণকিশোর গোস্বামীর আত্মজৈবনিক রচনায় লব্ধ।

ফলে ইচ্ছানুসারে বক্তব্যকে চেতনায় গেঁথে দেওয়া যায় না; তেমন তেমন শ্রোতার চোখে পাঠরত কথকের দাড়ি মরা পোষা ছাগলের দাড়ির কথা মনে করিয়ে দেয়, তার শোক উছলে ওঠে, এই কথাও গল্পে শোনা যায়।১৫৪ সব মতের কথক থাকতে পারে। নাস্তিক বৌদ্ধ ও জৈনদেরও ‘কথা’ ছিল, তাই কথকও ছিল। কিন্তু ‘রক্ষণশীল আস্তিক’ কথকরাও মজলিশ চাহিদার তাগিদে, শিল্পের নীতিতে, এমনকি পেশার খাতিরে সবসময় বাঁধাধরা পথে চলবেন, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। অভিযোজন চলছে, তাৎক্ষণিকতা বয়ানের অভিমুখ বদলাচ্ছে, এই সবের কিছু কিছু উদাহরণ প্রসঙ্গান্তরে আলোচিত হয়েছে। পুরুষ শাসিত সমাজের ভ্রূকুটি অবহেলা করে কুমুদবন্ধু তাঁর পালা ‘রিঙ্গনলীলার’ মধ্যে মহিলা শিক্ষার পক্ষে জোর সওয়াল শুরু করেন, এইরকম নজিরও আছে।

স্বার্থ যাই থাকুক না কেন, অভীষ্ট যে ভাবে ছকা হোক না কেন, কথকদের সত্তা আছে, শ্রোতাদের বোধ আছে, আছে সামাজিক অভিজ্ঞতা। যোজক ও যোজিতের পারস্পরিক সংঘাত (দ্বিবিধ অর্থে) রসভোগের ক্ষেত্র তৈরি হয়, সেই ক্ষেত্রে টানাপোড়েন আছে, প্রতিসরণ হয় আখ্যানবিন্যাসে ও ভাববোধে। শাসকশ্রেণীর হাতে কথকদের ক্রীড়নক—তাদের আদর্শ প্রচারের ‘মাধ্যম’ মাত্র মনে করা, অন্যদিকে ‘নিরক্ষর’ (দেবীবাবু বার-বার কেন জানি না এই বিশেষণটা গ্রামবাসী ও চাষীদের আগে ব্যবহার করেছেন; যেন অক্ষর জ্ঞানটা বুদ্ধি-বিবেচনা ও বুদ্ধিবোধের সমার্থক) চাষীদের চৈতন্যকে আঁক টানার স্লেট হিসাবে দেখানোর মধ্যে আদর্শ ও মূল্যবোধ গড়ে ওঠার পথে বৈপরীত্যের নানা মুহূর্তকে অবহেলা করা হয়, যোজনার আদান-প্রদানের প্রক্রিয়াকে বাদ দেওয়া হয়। আসরে পাঠের ও শোনার নানা স্তরে যে ভিন্ন বয়ান তৈরি হতে পারে, মুল্যবোধের রঙে তারতম্য ঘটতে পারে—এইরকম কোনও সম্ভাবনা এই জাতীয় আলোচনায় আমল পায় না।

কথক ঠাকুর ও সামূহিক চৈতন্য

এই মূল্যবোধ নিমার্ণ-প্রক্রিয়া সমূহের স্থান কোথায়? কী করে বা যোজিতের অবস্থান পরিবর্তন যোজকের ঘটকালি রীতিতে পরিবর্তন আনে, উভয়ের টানাপোড়েন আখ্যানের বিন্যাস, রসভোগকে করে তোলে ভিন্নতর? তুলনা, প্রতি তুলনার মাধ্যমে সমস্যা বিচারে প্রবৃত্ত হওয়া যেতে পারে? সমূহের উপস্থিতি কথকতার আসরের পরিমণ্ডল কীভাবে নির্ধারিত করে, সেই বিষয়ে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল। তাঁর সাক্ষ্য থেকে বিস্তৃত উদ্ধৃতি দেওয়া আবশ্যক:

আশী বৎসর পূর্বে মাতাঠাকুরাণী রামায়ণ পাঠ করাইয়াছিলেন। তখন ইস্কুলে পড়ি। সমুদয় ঘটনা এখনও প্রত্যক্ষ প্রতীয়মান হইতেছে। তিনি গৃহদেবতা রঘুনাথজীউর সম্মুখে সঙ্কল্প করিলেন, তিনি সমস্ত বৈশাখমাস রামায়ণ পাঠ করাইবেন। আটচালায় বেদী নির্মিত হইল, গ্রামস্থ সকলকে রামায়ণ পাঠ শ্রবণ করিতে আহ্বান করা হইল। মা পাঠক ঠাকুরকে ধুতি, উড়ানী আর কি কি দিয়া বরণ করিলেন। অপরাহ্নে পাঠক বেদীতে বসিয়া রামায়ণের পুথি খুলিলেন। গ্রাম ছোটো, ইতোমধ্যে পঞ্চাশ ষাটজন পুরুষ এবং ত্রিশ চল্লিশ জন নারী যথাস্থানে উপবিষ্ট হইয়াছিলেন। পাঠক রামায়ণ হইতে দুইটি, তিনটি, চারটি শ্লোক পাঠ করিলেন, তারপরে ব্যাখ্যা করিতে লাগিলেন। কত প্রকারে তাৎপর্য বুঝাইতে লাগিলেন, কখন তিনি অভিনয় করেন, কখন পুরুষোচিত ভাষা ব্যবহার করেন, কখন নারীসুলভ কণ্ঠে খেদ করেন ইত্যাদি প্রায় দেড় ঘণ্টা এইরূপ চলিতে থাকে। শ্রোতৃবর্গ নিবিষ্ট চিত্তে শুনিতে থাকে। প্রতিদিন যে একই লোক আসিত তাহাও নয়। রাঢ়ের গ্রামে বর্ষীয়সী বিশেষতঃ গ্রামের ঝিউড়ি, এ পাড়ায় সে পাড়ায় স্বচ্ছন্দে আসে। শ্রোতাদিগের মধ্যে অনেকেই অত্যল্প লেখাপড়া জানিতেন, তাহাও পাঠশালায় সমাপ্ত। কিন্তু পাঠকের ভাষা সংস্কৃত শব্দ বহুল হইলেও ভাবার্থ গ্রহণ করিতে পারিতেন৷ এইরূপ বৈশাখ মাস অতিবাহিত হইল। সমাপ্তি দিবসে ব্রত উদযাপিত হইল, পাঠক দক্ষিণান্ত হইলেন।…পরদিন ব্রাহ্মণ ভোজন। মায়ের সঙ্কল্প সিদ্ধ হইল। শ্রোতারা দুই কারণে আসিত—রামায়ণ পাঠ শ্রবণ করিলে পুণ্য হয়, তাহারা পুণ্য অর্জন করিতে আসিত। আর দ্বিতীয় কারণ, তাহারা না আসিলে মায়ের সঙ্কল্প ভঙ্গ হইত। তাঁহার পাপ হইত৷ তাঁহারা তাঁকে পাপের ভাগী করিতে পারিত না। এই কারণেও তাঁহারা না আসিয়া পারিত না। তাহাদের আসাতে মা কৃতার্থ বোধ করিতেন৷ রামায়ণ শ্রবণ করিলে পুণ্য হয়, ইহা কি অন্ধ বিশ্বাস? যিনি একথা বলেন তিনি রামায়ণ পড়েন নাই, শ্রদ্ধা সহকারে পড়েন নাই,। রামাদির চরিত ধ্যান করেন নাই। আর তিনি পুণ্য শব্দের অর্থও জানেন না।১৫৫ (নজরটান আমার)

কথকতা ইতিহাসে, সমাজে বিবর্তিত। আসরে উদ্যোক্তা ও শ্রোতারা পাপ ও পুণ্যে বিশ্বাসী। পাপ-পুণ্য একার নয়, তার ছোঁয়াচ সবার লাগে, সবার তাতে অংশ আছে। সঙ্কল্প করেন একজন, ডাকেন একজন কিন্তু আসতে হয় সবাইকে, আসরে হাজির থাকা হল সামাজিক দায়। যোগেশচন্দ্র রায়ের ধমকানিটা তাৎপর্যপূর্ণ্য। রস উপভোগ-এর শর্ত আছে, শ্রদ্ধা থাকতে হবে, পুণ্যে আস্থা রাখতে হবে। শ্রদ্ধার আভিধানিক অর্থ তো বিশ্বাস, প্রত্যয়, স্পৃহা, আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি। পুণ্য অর্থ শুভকর্ম, পবিত্র ধর্ম। এই সব গুণের শর্তাধীনে যোজক-যোজিতের মোকাবিলা হয়, তা না হলে রসভোগের সম্ভাবনাই নাকচ হয়ে যায়। ‘কাশীরাম দাস ভনে, শুনে পুণ্যবান।’ শ্রোতারা পুণ্যবান, তাই তো তাঁরা কথা শুনছেন।

যখন সমুহ বদলে যায়। শর্ত পালটে যায়, তখন কথকও বাতিল হয়ে যান। যোগেশচন্দ্রের সমসাময়িক কলকাতার এক বাসিন্দা লিখছেন,

বৃদ্ধ ও বৃদ্ধারা তাহাদের কথকতা ও পালাগান শুনিতে যাইতেন। অন্যান্য ভদ্র লোকেরা কখনো যাইতেন না। কথাবার্তার প্রচলিত মাত্রাই ছিল—এ যেন ‘কথকের কথা’, অর্থাৎ বিশ্বাসযোগ্য নয়।১৫৬

প্রতিতুলনা আনা যেতে পারে। ‘কথার’ একটি রূপ কথকতা। আরও অনেক প্রজাতি আছে—রূপকথা, গীতকথা, কিস্যা, ইত্যাদি সেইগুলিও বাচ্য। এই বাচনীয় প্রজাতি ছাপার অক্ষরে এল, বঙ্গ শিশুসাহিত্যে শোরগোল পড়ে গেল।

বিংশ শতকের গোড়ায় ডিকটাফোন নিয়ে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার একশ বছরের বৃদ্ধার কাছ থেকে গীতকথা সংগ্রহ করেছেন, যেমন শুনেছেন তেমন লিখেছেন, সেইমত ছাপিয়েছেন। পরে সমালোচকদের চাপে, ‘গল্পভুক সামান্য শিক্ষিত পাঠকবর্গের’ চাহিদা মেটাতে ঠাকুরদাদার ঝুলির প্রথম সংস্করণ (১৯০৮) পুনর্লিখিত হল, সেই মার্জিত সংস্করণেরই বাজারে কাটতি হল। পুনর্লিখনে মূল গল্প বদলায়নি।১৫৭ কিন্তু অপ্রচলিত শব্দ পালটানো বা ভাষার মার্জিতকরণে দক্ষিণারঞ্জনের কলম সীমাবদ্ধ থাকেনি। কথ্য গল্পের সংহত লেখ্য রূপ দেওয়া হয়েছে, রকমফের ঘটে গেছে গল্প আস্বাদনের তারে।

মনে রাখতে হবে ঠাকুরদাদার ঝুলির গল্প গীতিকথার সংকলন। বিশেষ আয়োজন ও সমাবেশে সমূহের সামনে কথাগুলি বলা হত। আঁতুড়ঘর গল্প বলার অন্যতম জায়গা। আসন্নপ্রসবা জননী যেদিন থেকে আঁতুড়ে যান সেই দিন থেকে গীতকথা-অভিজ্ঞরা প্রতি রাত্রে মজলিশ বসাতেন।

রাত্রি দ্বিপ্রহরে আসর শেষ হত। কথকদের মধ্যে কেউ সম্রান্ত বিধবা, অনেকে কৃষক। ‘রোজের রাত যোগান’ তারা কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নিত। ষষ্ঠীর দিন ঘটা বেশি হত, সারারাত ধরে পালা বলা চলত। অন্য গায়ক-গায়িকা ‘মূল কথকের’ সঙ্গে যোগ দিত, কথার সঙ্গে সঙ্গে গান চলত। ছেলে, মেয়ে, বুড়ো, আসরে সবাইয়ের আবাধ প্রবেশাধিকার।১৫৮

বৈলক্ষণগুলিও স্পষ্ট। কথকতা মার্গ থেকে জন-অভিমুখী, ব্রাহ্মণের পুথি থেকে প্রাকৃতজনের আসরে তার যাত্রা। লোককথার কথ্য রূপকে দক্ষিণারঞ্জন মার্জনা করেছেন, আঁতুড়ঘর থেকে গল্পকে তুলে আনছেন ব্যক্তি পাঠকদের শহুরে বৈঠকখানায়; কথকতার আখ্যানের যোজনার অভিমুখের বিপরীতে ঠাকুদাদার ঝুলির গল্পের যাত্রা, কথার রওয়ানি হয়ে ওঠে অন্যরকম।

কথকতার নানা গল্প

বর্তমান প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ যথেষ্ট। দীনেশচন্দ্র সেনের সাক্ষ্যানুযায়ী, প্রথম সংস্করণে ‘মালঞ্চমালা’ গল্পটি শুনে হুবহু লেখা হয়েছিল, তাই ওই গল্পটি থেকে একটি অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করা হল:

প্রথম পাঠ : ১৯০৮

‘কোটালিনী ছিল ঘরে, কোটালিনী আসিয়া কয়,—কি বারোদিনের আয়ু তারি কাছে। দিব কন্যা আমার,—যুগ জন্ম হবিষ্যি।—মা গেলেও না, ছা গেলেও না! কপাল আমার,—বারোবছরের তিনবছর গেল রোগে, চারবছর গেল শোকে,—আরও যে বচ্ছর আছে তা যদি না যায় ভোগে, তো মেয়ের জন্ম কি? হাঁড়ীর মাছ হাঁড়ীতে জিয়াই, শাখা সিঁদূরের বড়ি খোয়াইতে একবেলা খাই একবেলা না খাই—এক কোলের কন্যা—তাই দিব শিশুপুত্রের কাছে।—সেও পুত্র বাঁচে কি না বাঁচে?—‘কুড়ে বাঁধি, কুঁড়েয় থাকি তার তলেও রাজার হাঁচি!’ রাজাকে গিয়া কও, কন্যা যে আমি দিব না ‘আহা, কিবা আমার পাড়লেন গিয়া ফল, তারি জন্য দেখি আমি কন্যার চক্ষের জল!’ কোটালিনী পোঁটলা পুঁটলী বাঁধিয়া কন্যাকে ডাকে—‘মালঞ্চ লো মালঞ্চ! আয় মা, আমরা এ জনমের মত রাজ্য ছেড়ে যাই।’১৫৯

মার্জিত পাঠ: ১৯০৯

কোটালিনী বলে,—কুঁড়ে বাঁধি কুঁড়েয় আছি। তার তলেও রাজার হাঁছি।: বারো দিনের আয়ু শিশুর কাছে কন্যা দিব? রাজাকে গিয়া বল কন্যা আমি দিব না।১৬০

দুইটিতেই কোটালিনীর আপত্তির কথা অক্ষুণ্ণ আছে, বদলে গেছে শুধু ঢঙ; ব্যঞ্জনের তার হয়ে গেছে পানসে। প্রথম বয়ানে আছে আশা ও আশঙ্কা, বঞ্চনা ও সাধ, রাজার প্রতি ছুঁড়ে দেওয়া ব্যঙ্গ, সংসারে দৈনন্দিন লড়াই, অত্যাচার থেকে মেয়েকে বাঁচাবার জন্য পথে বেরিয়ে পড়বার তাগিদ। রাজার অন্যায় আবদারের বিরুদ্ধে, জোর-জবরদস্তির বিরুদ্ধে এইসব অনুভূতির মিশ্রণে গড়ে উঠেছে কোটালিনীর আপত্তি। মার্জিত পাঠে শব্দ বদলায়, গান বাদ দেওয়া হয়, বলার রওয়ানিকে সংক্ষিপ্ত করা হয় সরাসরি নেতিবাচক বাক্যে; লৌকিক স্বাদের আভাস দেবার জন্য বজায় রাখা হয় একটা প্রবাদ। ফলে কোটালিনীর আপত্তি একমাত্রিক ঘোষণার মতো শোনায়। বাগর্থ যে সম্পৃক্ত, আলাদা। করা মুশকিল।

নতুন গড়ে ওঠা ‘শিশু সাহিত্যের’ অন্যতম রূপকার দক্ষিণারঞ্জন। জোর তর্ক চলছে, কোনটা পাঠ্য কোনটা অপাঠ্য, কোনটা বোধগম্য, কোনটা বা দুর্বোধ্য। এই গোষ্ঠীতে দক্ষিণারঞ্জনও আছেন, লিখছেন দেশগঠনের বই, চারু ও হারু, লাস্টবয়, ফার্স্টবয়।

তার চেয়ে বড় কথা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ উদ্যোগ নিয়েছে, খাঁটি দেশজ বস্তুর উদ্ধার করতে হবে, স্বদেশী ব্রতে নিজস্ব অনুসন্ধানে লিপ্ত হতে হবে, ‘ভারতীয় প্রাণধারা’, ‘বাঙালীর জাতীয় চিত্তরসের’ সঙ্গে শিক্ষিতের পরিচয় করানো কর্তব্য। এই প্রকল্পের তিনি পুরোপুরি শরিক, এই কথা দক্ষিণারঞ্জন ভূমিকায় বার-বার স্বীকার করেছেন। ‘আমার দেশ’, ‘বাঙ্গালীর আপন প্রাণ’, ‘বাঙ্গালা ভাষার প্রকৃত আকৃতি’ (নজরটান মিত্র মহাশয়ের) সব কিছু ঠাকুরদাদার ঝুলিতে পাওয়া যাবে, এই বিশ্বাসে তিনি কাহিনী সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছেন।

এর অর্থ এই নয় যে দাবিগুলি যথার্থ নয়, মিত্র মহাশয়ের বানানো। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে ‘কথার’ বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা হচ্ছে নতুনভাবে। বোধের এই রূপান্তর স্মর্তব্য। সমালোচনা দরকার। ‘পাশ্চাত্য শিক্ষা’, ‘পাশ্চাত্য আদর্শ’ ও ‘উপন্যাস’ জাঁকিয়ে বসেছে, তার তুলনীয় কিছু ‘আমার দেশ’ দিয়েছিল, যেমন ‘শিশুসাহিত্য (রূপকথা)’ মেয়েলি সাহিত্য (ব্রতকথা) ইত্যাদি। জিনিস খাঁটি হওয়া চাই, মেকি হলে চলবে না। জড়িত আছে ‘জাতির বেদনা উল্লাসের মৰ্ম্মমর্যাদা’, ‘দেশে ও বিশ্বে’ প্রতিষ্ঠা কামনা, প্রমাণ করার উদগ্র ইচ্ছা ‘ভারতেরই মধুচক্রের মোম, অপর দেশ হইতে ক্যান্ডেলরূপে আসিয়া, আলো জ্বালাইতেছিল।’ ফলে জিনিস আমাদের, কিন্তু প্রতি পদক্ষেপে তুলনা দিতে হবে বিদেশের, তা না হলে স্বদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে কী করে?১৬১

এই আদিকল্প যে রাজনৈতিক ও সামাজিক বাতাবরণে গড়ে উঠেছে, তা সুপরিচিত। ফলে যোজনার ক্ষেত্রে প্রতিসরণ ঘটেছে। সমসাময়িক অনেকের মতো দক্ষিণাবাবুও মনে করছেন খাঁটি আছে পল্লীতে, বঙ্গজননী হচ্ছেন পল্লী নিবাসী। পল্লী ও শহরের ব্যবধান-এর ধারণা প্রধান হয়ে উঠছে। পল্লী ‘খাঁটি স্বদেশী’, শহর মেকি বিদেশি। পল্লীর আতুঁড়ঘর গল্পের উৎস, ভূমিকার ৩নং পাদটীকায় আঁতুড়ঘরকে জায়গাও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু উদ্দিষ্ট হচ্ছেন শহরের আধুনিক পাঠকরা। দক্ষিণাবাবুও ‘ঘটকালি’ করছেন, শহুরে পাঠকদের পড়াচ্ছেন ‘পল্লীর শ্রুতিসাহিত্য।’ রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাব দিচ্ছেন যে ‘আধুনিক দিদিমাদের জন্য অবিলম্বে স্কুল খোলা হউক’। সেইখানে দক্ষিণাবাবুর বই হবে পাঠ্য।১৬২

কথকের উদ্দেশ্য একেবারে আলাদা। শহর বা পল্লীর দ্বৈধতা তাঁর পালার কেন্দ্রীয় ভাব নয়, মথুরা ও বৃন্দাবন, রাখাল রাজা ও দ্বারকার রাজা এক লীলাময়ের প্রকার মাত্র। আসরে শ্রোতার পরিচয় বাঙালি নয়, ভক্ত; বিপরীতাচারীরা হল পাষণ্ড। আজও পাঠের শেষে দ্বিজবাবু ভক্তমণ্ডলীর নামে জোকার দেন, পাঠের প্রারম্ভে বাসন্তী দেবী উপস্থিত ও অনুপস্থিত, গত ও বর্তমান ভক্তবৃন্দের চরণে কোটি কোটি প্রণাম জানান। গোস্বামী কবিরাজের অনুসরণে সপ্তদশ শতকে যদুনন্দন তো বলে দিয়েছেন পাঠের সার্থকতা, পাঠকের কামনার কথা:

মোর মুখ মরুস্থল, বাণীখিন্নরূপচর গোকুলা উন্মুখা বাক্যগণ।

বৈষ্ণবের কর্ণ নদী, প্রবেশ করয়ে যদি, পুষ্ট স্নিগ্ধ হইবে তখন ॥১৬৩

বাচ্য থেকে পঠনীয়, কথ্য লেখ্য, শ্রুতি থেকে মুদ্রণ। তাই যোজিতের পড়ার সুবিধের জন্য সংস্করণকে মার্জিত করা হল। পল্লী ‘গীতকথা’ হয়ে যাচ্ছে। তাকে হতে হচ্ছে ‘বঙ্গোপন্যাস’। আধুনিক শিশু সাহিত্যের তালিকায় সেইটা অবশ্য পাঠ্য, ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হল ‘বঙ্গোপন্যাস’-এর ষোড়শ সংস্করণ। আর কথকতার আখ্যান খুঁজে পাওয়া যাবে শুধু পুথিতে। ওইগুলির অমার্জিত পাঠ তো এককের নয়, পাপ-পুণ্যে বিশ্বাসী ভক্তসমূহের, যে সমূহ আজ ‘জাতিতে’ পর্যবসিত, যার সত্তা আজ ‘এককে’ বিভক্ত, স্বগত পাঠে যে অভ্যস্ত।

… … …

আসরে ঝাঁপ পড়ে গেছে, ধীরে ধীরে পুথি পাতড়া গুটিয়ে ফেলছেন, লাল বনাত গায়ে চাঁই বুড়ো, উঠে যাবার সময় হল তাঁর, কোনওদিন আর ডাক আসবে কিনা, কে জানে। সেই কবে খবর পেয়েছি কাশীতে মারা গেছেন হরু ঠাকুর, নিশ্চিন্দিপুরের হরিহর রায়। আর কে পালা বাঁধবে তাঁর মতো? মনটা কি একটু আনচান করে? জানি ‘দুর্ভাবনাময় জটিল সাম্প্রতিকের?’১৬৪ মুখোমুখি আমরা, লোকে ধমক দেবে। এইসব ক্ষেত্রে বিষণ্ণতাকে প্রশ্রয় দেওয়া কাজের কথা নয়, সেইটা রোমান্টিকতা, অলস ‘নস্টালজিয়া’। ইতিহাসের আধুনিকতার, অনিবার্যতার বিরোধিতা। যা অবস্থা আজকাল, এই অতীতবিলাস বিপদজনকও হতে পারে, ব্রাহ্মণ্যবাদকে প্রশ্রয় দেবে, হয়তো বা দুর্বল করে তুলবে ধর্মনিরপেক্ষতার লড়াইকে। কিন্তু এও তো মনে হয় যে সমূহের রসভুক্তির ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাকে যথাযথ সামাজিক ও নান্দনিক মর্যাদা না দেওয়াটা কৃতঘ্নতা। আরও শুনেছি যে অপু আজও স্বপ্ন দেখে, এই দরিদ্র, নিষ্পেষিত দেশে, নিষ্ক্রিয় সময়ে প্রতিদিন তার কানে ভেসে আসে তার বাবার, কথক হরিহরের, আশীর্বচনের রেশ:

কালে বৰ্ষতু পর্জ্জন্যং পৃথিবী শস্যশালিনী…’

লোকাঃ সন্তু নিরাময়াঃ…

টীকা

সংকেত সূচী:—বিশ্ব—পুথিশালা, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।

ক. বি.—পুধি সংগ্রহ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

পাঠবাড়ি—শ্রীগৌরাঙ্গ গ্রন্থমন্দির, পাঠবাড়ি, বরাহনগর।

এশিয়া—পুথি সংগ্রহ, এশিয়াটিক সোসাইটি, কলিকাতা।

তালিকার ক্রমিক সংখ্যা ও ফোলিও সংখ্যা দ্বারা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

দীনবন্ধু মিত্র, রচনা সংগ্রহ, সাক্ষরতা প্রকাশন (কলিকাতা ১৯৭৩), পৃ. ৪৮৪, ৪৯০

‘ব্রজবিলাস’, দ্বিতীয় সংস্করণের বিজ্ঞাপন, বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ, সাক্ষরতা প্রকাশন, দ্বিতীয় খণ্ড (কলিকাতা, ১৯৭২), পৃ. ৪৫৪-৪৫৫।

বাধাগোবিন্দ বসাক সম্পাদিত ও অনুদিত, কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র, ২/২৭ (কলিকাতা ১৯৬৪), ১ম খণ্ড, পৃ. ১৯০-১৯১। প্রাচীনকালে কথকদের প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য, সুকুমার সেনের নিবন্ধ, ‘কথকতা’, ভারতকোষ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ১৫০-১৫১।

‘কথকতা’, বিশ্বকোষ, তৃতীয় ভাগ, নগেন্দ্রনাথ বসু, ১৮৮৬, পৃ. ১৯১ (পুনর্মুদ্রণ, দিল্লী, ১৯৮৮)।

Willian Ward. Views of the History Literature, Religion of the Hindus 2nd ed.. Vol II. Seranipxone, 1815. 244-29০।

হরিপদ চক্রবর্তী, ‘কথকতার পুঁথি’, সুবর্ণলেখা, আশুতোষ ভট্টাচার্য ও অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭৪), পৃ, ৫৮০-৫৯২।

ভোলানাথ চক্রবর্তী, সেই একদিন আর এই একদিন, অর্থাৎ বঙ্গের পূর্ব ও বর্তমান অবস্থা, সুরাপান নিবারণীসভায় বক্তৃতা, ৯ই শ্রাবণ, আদি ব্রাহ্মসমাজ যন্ত্রে মুদ্রিত, ১৮৭৫ সন, পৃ. ১৩-১৪। বাজ নারায়ণ বসু দ্বারা অভিব্যক্ত, বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা, সারদাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক বাঙ্গালা যন্ত্রে মুদ্রিত, শোভাবাজার গ্রে স্ট্রিট, ১৮০০ শকাব্দ (১৮৭৮) পৃ. ৬২-৬৪। কথক ঠাকুরের নাম পুস্তিকাটিতে ভ্রমবশত লেখা হয়েছে গঙ্গাধর শিরোমণি।

দুর্গাদাস লাহিড়ী, বাঙ্গালীর গান (কলিকাতা, ১৩১২), পৃ. ২৭৭-২৭৯।

বিপিনবিহারী চক্রবর্তী, খাটুরা ইতিহাস ও কুশদীপের কাহিনী, (কলিকাতা, ১৩০৮), পৃ. ১৬৪-২০৭।

১০ ‘বঙ্কিমচন্দ্র কাঁটাল পাড়ায়’, হরপ্রসাদ রচনা সংগ্রহ, দ্বিতীয় খণ্ড, সত্যজিৎ চৌধুরী ও অন্যান্য সম্পাদিত (কলিকাতা, ১৯৮১), পৃ. ১৫।

১১ হরিহর শেঠ, ‘চন্দননগরের কথক, কবিওয়ালা ও যাত্রা’, প্রবাসী, মাঘ, ১৩৩১, ২৪শ ভাগ, ২য় খণ্ড, ৪র্থ সংখ্যা, পৃ. ৫০৬-৫০৭।

১২ শশিভূষণ বিদ্যালঙ্কার, জীবনীকোষ, ভারতীয় ঐতিহাসিক, ২য় খণ্ড, (কলিকাতা, ১৩৪৫), পৃ. ৫১, ১৫১-১৫২। কিশোরীভজন সম্প্রদায়ের জন্য দ্রষ্টব্য, অক্ষয়কুমার দত্ত, ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়, বিনয় ঘোষ সম্পাদিত, (কলিকাতা, ১৩৭৬), পৃ. ৩২৪-৩২৬।

১৩ ‘আমাদের গৃহে অন্তঃপুর শিক্ষা ও সংস্কার’, প্রদীপ, ভাদ্র, ১৩০৫, উদ্ধৃত সাহিত্য সাধক চরিতমালা, ২য় খণ্ড, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃ. ৬।

১৪ বিপিনচন্দ্র পাল, সত্তর বৎসর। আত্মজীবনী, (কলিকাতা ১৩৬২), পৃ. ৩২-৩৩। গোপালচন্দ্র রায়, জীবনস্মৃতি (কলিকাতা, ১৯৯২), পৃ. ৬ রামধনের কন্যা বিদুষী ছিলেন, পুথিও লিখতেন। কিন্তু কথকতা করতেন তার কোনও প্রমাণ নেই।

১৫ Dinesh Chandra Sen, History of Bengali Language & Literature (Calcutta, 1911) p. 590

১৬ ঈশানচন্দ্র বসু সম্পাদিত, গোবিন্দমঙ্গল, দুঃখী শ্যামদাস বিরচিত দ্বিতীয় সংস্করণ, বঙ্গবাসী, (কলিকাতা, ১৩১৭)। কালিদাস রায়, প্রাচীন বঙ্গসাহিত্য ১ম খণ্ড, নিউ প্রেস, তারিখ অনুল্লেখিত, পৃ. ৩১৩-৩১৪, ৩৩১। অধিকারী বংশ মেদিনীপুরে আজও কথকতা করেন। তমলুকের অনাথবন্ধু দাস অধিকারী নামজাদা কথক। শ্রীমতী বিদ্যুতা সামস্তের নামও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। আমরা এই কথক-কথকীদের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ করতে পারিনি।

১৭ অবনী অধিকারীর সহিত সাক্ষাৎকার, রতনপল্লী, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৩।

১৮ বসনত্‌কুমার পাল, স্মৃতির অর্ঘ্য (শিবপুর, ১৩৪৬), পৃ. ২৩৫ ২৩৬।

১৯ সটীক হুতোম প্যাঁচার নকশা, সম্পাদনা অরুণ নাগ, (কলিকাতা ১৩৯৮), পৃ. ৮১।

২০ উনিশ শতকের শেষ প্রান্তে ও বিংশ শতকের গোড়ায় বৈষ্ণবসমাজে প্রভুপাদ অতুলকৃষ্ণ গোস্বামীর দোর্দণ্ডপ্রতাপ ও ভূমিকার কথা আজও অনালোচিত। অতুলকৃষ্ণ জবানির উপরে ভিত্তি করে প্রাণকিশোর রচিত অতুলকৃষ্ণের জীবনী একটি প্রাসঙ্গিক উৎস। হরিসভা আন্দোলনের ইতিহাসও অনালোচিত রয়েছে। উদ্দেশ্য ও কার্যক্রমের জন্য দ্রষ্টব্য, প্রভুপাদ শ্রীপ্রাণকিশোর গোস্বামী, ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্মিলনী’ (১৩৩৭ সন, পৌষ, ঢাকায় প্রদত্ত ভাষণ), আদর জানাই, সম্পাদনা শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (কলিকাতা, প্রকাশ তারিখ অনুল্লেখিত), পৃ. ১৩৪। বিমানবিহারী মজুমদারের ভূমিকার জন্য দ্রষ্টব্য, শ্রীচৈতন্যচরিতের উপাদান (কলিকাতা, ১৯৫৯), পৃ. ৫০৮।

২১ দীনেশ চন্দ্র সেন, ‘বাঙালার বিলুপ্ত সম্পদ কথকতা’, প্রবর্তক, ২২ বর্ষ, ১ম খণ্ড, ৪র্থ সংখ্যা শ্রাবণ, ১৩৪৪।

২২ প্রভুপাদ প্রাণকিশোরের জীবনী ও কার্যাবলীর জন্য দ্রষ্টব্য, আদর জানাই, প্রাগুক্ত; গুরুরাজকিশোর গোস্বামী সম্পাদিত আচার্য প্রভু প্রাণকিশোর (কলিকাতা, ১৩৮৮)।

২৩ প্রাণকিশোর গোস্বামী, প্রভু অতুলকৃষ্ণ (কলিকাতা, ১৩৫৮), পৃ. ৪৬-৪৭। পাঠক ও ব্যাখ্যাকার অতুলকৃষ্ণ সম্পর্কিত তথ্যাদি এই পুস্তক থেকে সংগৃহীত।

২৪ ঐ, পৃ. ১০৮-১০৯।

২৫ প্রাণকিশোর গোস্বামী, কথকতার কথা (কলিকাতা, ১৩৭৫), পৃ. ১৩৪।

২৬ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বাংলা গদ্যে শ্রীযুক্ত প্রাণকিশোর গোস্বামী’, আদব জানাই, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৯-২৫২।

২৭ দ্বাদশ ভাষণ, সঙ্কলয়িতা, বাসন্তী চৌধুরী ও কথাসেবিকা (কোন্নগর, ১৩৯০), পৃ. ১০০।

২৮ বিপিনবিহারী চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭০-১৭২।

২৯ সুধীররঞ্জন দাস, যা দেখেছি, যা পেয়েছি, (কলিকাতা, ১৯৬৯), পৃ. ১২৩। নির্মল কুমার রায়, শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ তীর্থপরিক্রমা, প্রথম খণ্ড, (কলিকাতা, ১৯৮৫), পৃ. ১৭০। কথক ঠাকুরদার উল্লেখ আছে, শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণকথামৃত, চতুর্থ ভাগ, (কথামৃত ভবন, ১৩৭৭), দ্বাদশ খণ্ডের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে, পৃ. ৮২।

৩০ দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী, স্মৃতিরেখা (কলিকাতা, ১৩৪০), ৩০-৩২, ৫১।

৩১ দীনেশচন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, ১ম খণ্ড (১৯৩৫, পুনর্মুদ্রণ, ১৯৯৩), পৃ. ৩৮৬।

৩২ রাজ্যের মিত্র, ‘নিধুবাবুর গানের উৎস’, প্রসঙ্গ বাংলা গান (কলিকাতা, ১৯৮৯), পৃ. ২৩।

৩৩ বঙ্গের শ্রেষ্ঠ পুরাণবক্তা (কথক) নদীয় ‘পিতৃদেব কৃষ্ণমোহন শিরোমণির কথা’, (১) বামাবোধিনী পত্রিকা, জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭, জুন ১৯১০, ৪৫। প্রবন্ধটি অসমাপ্ত। বৈবাহিক সুত্রে দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের আত্মীয় ছিলেন কৃষ্ণমোহন শিরোমণি। এঁর কথাই ঠাট্টা করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লিখেছেন। তারাকুমার কবিরত্ন হয়ত প্রবন্ধটির লেখক। প্রবন্ধটির হদিস দিয়েছে মৃদুলকান্তি বসু।

৩৪ পঞ্চানন মণ্ডল সম্পাদিত, চিঠিপত্রে সমাজচিত্র, দ্বিতীয় খণ্ড (কলিকাতা, ১৯৫৩), নং ১৪৩, ৯৯।

৩৫ বিপিনবিহারী চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৬।

৩৬ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার কালের কথা, (কলিকাতা, ১৩৫৮), পৃ. ১০।

৩৭ দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের ভূমিকাসহ, নিত্যগোপাল গোস্বামী সঙ্কলিত, কৃষ্ণকমল গীতিকাব্য, (কলিকাতা, ১৩১৭)। তথ্যগুলি পুত্র রচিত কৃষ্ণকমলের জীবনী থেকে আহৃত হয়েছে।

৩৮ গেীরমোহন দাস দে, পিছনে তাকাই (কলিকাতা, ১৯৯১), পৃ. ৪২।

৩৯ গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য, অপুর পাঁচালী, (কলিকাতা, ১৩৮১), পৃ. ৪৮।

৪০ বিভিন্ন সময়ের কার্যবিবরণী ও সাম্বৎসরিক প্রতিবেদন, হরিভক্তি প্রদায়িনী সভা, বেহালা। এই সুত্র ব্যবহারের জন্য সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও হরিসভার কর্তৃপক্ষের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

৪১ হরেকৃষ্ণ মুখখাপাধ্যায় ‘শ্রীধর কথক’, উজ্জীবন, আশ্বিন, ১৩৭৯, ১১শ বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যা, ৩০২। এই প্রবন্ধটির হদিস দেবার জন্য দেবাশিস বসুর কাছে আমি ঋণী।

৪২ যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, ‘গল্প’, কি লিখি?-তে সঙ্কলিত, (কলিকাতা, ১৩৬৩), পৃ. ১২৯।

৪৩ চিঠিপত্রে সমাজচিত্র, ২য় খণ্ড, প্রাগুক্ত, ১২৯ নং, পৃ. ৮৯।

৪৪ James Long, ‘Returns Relating to Publication in Bengali Language in 1859’, Selection from the Records of Bengal. Govt, No XXXII, Calcutta, para 17.

৪৫ ‘অপ্রকাশিত আত্মচরিত’, দিন যাত্রা, আনন্দবাজার, 6 March 1983।

৪৬ পাঁচুগোপাল ভট্টাচার্য, শ্রীমদ্‌ হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ স্মরণে (কলিকাতা, ১৩৮৩), পৃ. ৩৬-৩৭।

৪৭ প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়, আমার দেখা কলকাতা, (কলিকাতা, ১৩৮০), পৃ. ১৩৫-১৩৬।

৪৮ দীনেন্দ্রকুমার রায়, সেকালের স্মৃতি, আনন্দ সংস্করণ, (কলিকাতা, ১৩৯৫), পৃ. ৪০।

৪৯ প্রাণকিশোর গোস্বামী, কথকতার কথা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৩-৩৪।

৫০ রাজকৃষ্ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, সোনামুখী, ১৩ জুন ১৯৯৩।

৫১ Y.B. Damle, ‘Harikatha—A study in Communication’, Bulletin of Deccan College Research Institute, S.K. De Felicitation Volume. Ed. by NG. Kalelkar (Poona, 1960). p. 63-107. Philip Lutgendorf, ‘Rama’s Story in Shiva’s City: Public Arenas and Private Patronage’, in Sandria Freitag ed. Benaras: Power, Community and Culture (Delhi, Oxford Univercity Press, 1991). RCR CEU ৩৪-৬০, ৩৯-৪২, ৫৬-৬১।

৫২ Lutgendorf, ঐ, পৃ. ৪০-৪১।

৫৩ সেকালের স্মৃতি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৩।

৫৪ ‘আমার জীবন’ নবীনচন্দ্র রচনাবলী, শান্তিকুমার দাস সম্পাদিত প্রথম খণ্ড, (কলিকাতা, ১৩৮১), পৃ. ১৬৪।

৫৫ শ্রী রামগতি ন্যায়রত্ন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব, হুগলী বুধোদয় যত্র কাশীনাথ ভট্টাচার্য দ্বারা মুদ্রিত, ১৮৭২-১৮৭৩, পৃ. ১৩৫।

৫৬ সত্তর বৎসর প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৬।

৫৭ কৃষ্ণকুমার মিত্র, আত্মচরিত (কলিকাতা, ১৩৮০), পৃ. ৪১-৪২।

৫৮ দীনেন্দ্রকুমার রায়, সেকালের স্মৃতি, প্রাগুক্ত, পু, ৪২।

৫৯ কথকতার কথা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯-১০, ১২।

৬০ ‘বঙ্কিমচন্দ্র কাঁটাল পাড়ায়’, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা সংগ্রহ, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪।

৬১ দীনেন্দ্রকুমার রায়, প্রাগুক্ত।

৬২ কথক ও শ্রোতার শাস্ত্রীয় লক্ষণ ও গুণের বিবৃতির জন্য দ্রষ্টব্য জিতেন্দ্রনাথ গোস্বামী সম্পাদিত, রাসলীলা, (নবদ্বীপ, ১৩৬২), পুস্তিকায় হরিদাস দাসের ভূমিকা।

৬৩ কথকতার কথা, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮।

৬৪ জসীমউদ্দীন, ঠাকুরবাড়ীর আঙিনায়, (কলিকাতা, ১৩৭৬), পৃ. ৪৮-৪৯।

৬৫ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রাণী চন্দ, জোড়াসাঁকোর ধারে, (কলিকাতা, ১৩৫১), পৃ. ৪৩, ৪৮।

৬৬ চিঠিপত্রে সমাজচিত্র, প্রথম খণ্ড অপরার্ধ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৯১-৪০৪। এই পুস্পিকা সঙ্কলন থেকে উদ্ধৃতিগুলি নির্বাচিত করা হয়েছে। লিপিকার প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য, অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত, বাঙ্গালা প্রাচীন পুথির বিবরণ, পরিষৎ পুথিশালায় সংগৃহীত, তৃতীয় খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা, (কলিকাতা, ১৩৩৩), পৃ. ৯।

৬৭ কথকতার কথা, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০।

৬৮ চিঠিপত্রে সমাজচিত্র, প্রাগুক্ত, ২য় খণ্ড, পৃ. ৯৮।

৬৯ ঐ, পৃ. ৯৩।

৭০ ঐ, পৃ. ১০০-১০১।

৭১ H. P. Sastri, A Descriptive Catalogue of Sanskrit Manuscripts in the Collections of the Asiatic Society of Bengal, Vol. V, Purana Manuscripts. (Calcutta, 1928). পৃ. XXVII. CXXVII, 36-39, 363-364.

৭২ গণেশ বিদ্যাবিনোদ, আদিকাণ্ড কথা, এশিয়াটিক ৩৩১০, পৃ. ৪০ক। ৮-১১ক।

৭৩ রামায়ণ কথা, ঐ, ৬৬০১, পৃ. ২৩-২৪ক।

৭৪ রামায়ণ কথা সংগ্রহ, ঐ, ৩৭৮৭। ১৭৩৮ শকাব্দ (১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে) পুথিটি রচিত হয়।

৭৫ কথকতার কথা, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০-২১।

৭৬ দ্বিজরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথকতা, গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্মিলনী, চালতাবাগান, ১৯/১২/৯২।

৭৭ কথকতার পালা (শ্রীকৃষ্ণের জন্ম), তারিখবিহীন, পাঠবাড়ী, ২৭৮৪/১৪, পৃ. ২৬-৩০ক।

৭৮ কথকতার পালা (রামরাজা), খণ্ডিত, তারিখবিহীন, পাঠবাড়ী, ২৭৮৯/১৭, পৃ. ১৯-২০ক।

৭৯ ঐ, পৃ. ২৭ক-২৭খ।

৮০ কথকতার পালা (শ্রীকৃষ্ণের জন্ম), প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬-৩৭ক।

৮১ কথকতার পুথি (ভাগবত), খণ্ডিত, তারিখবিহীন, ক. বি. ৫০০৭, পৃ. ২ক।

৮২ কথকতার পুথি (সভাপর্ব), খণ্ডিত, রামগোপাল শর্মা লিখিত, বিশ্ব, ৬২৩১, পৃ. ১ক, পুথিতে সংস্কৃত শ্লোক যেমন আছে, তেমন উদ্ধৃত হল।

৮৩ ‘বাঙ্গালা ভাষা’, (রামগতি ন্যায়রত্ন লিখিত বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব নামক পুস্তকের সমালোচনা), বঙ্গদর্শন, কার্ত্তিক ১২৭৯, পৃ. ৪৫৩-৪৫৪। কথকতা, পালাগান ইত্যাদিতে বঙ্কিমের সংস্কার ও শিক্ষা পরিবারগত, পিতৃদত্ত। বাল্যকালে যিনি কথকতার গান বাঁধনে, প্রাপ্ত বয়সে তিনি দেশজ গান, পালার বিশাল সংগ্রহ গড়ে তুলেছেন। নানা সাক্ষ্যের মধ্যে একটি স্মৃতিচারণের উল্লেখ করা যেতে পারে। অক্ষয়চন্দ্র সরকারের ‘বঙ্কিমচন্দ্র’, অক্ষয় সাহিত্য সভার, কালিদাস নাগ সম্পাদিত (কলিকাতা, ১৯৬৫), পৃ. ১৪৮-১৪৯।

৮৪ কথকতার পালা (মহাভারত—নানা আখ্যান), ১২৯০-১৩০৬ (১৮৮৩-১৮৯৯-এর মধ্যে লিখিত। মথুরাবাটির রামপদ ভট্টাচার্য ছাত্র রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সাহায্যে পালাগুলো লিখেছেন। শিবের বিবাহবর্ণন , পৃ. ২৬ক-২৬খ। খণ্ডিত, ২৭৮৭/ ১৫ক, পাঠবাড়ি।

৮৫ কথকতার পালা(রাস) তারিখ বিহীন, ২৭৮৫/১৫, পাঠবাড়ি, পৃ. ৩২খ।

৮৬ ঐ, পৃ. ২০-২৩খ।

৮৭ ঐ, পৃ. ৯১খ।

৮৮ ঐ, পৃ. ৯২ক, ৯৫খ।

৮৯ ঐ, পৃ. ৯৩ক।

৯০ কথকতা : বিভিন্ন পালার অংশ বিশেষ; কালিয়দমন পালা, ৭, ২৭৮৬/১৫ক, পাঠবাড়ি, আদিনিবাস কৃষ্ণনগর, হাল নিবাস ফরাসডাঙ্গার হাটখোলা, শ্রীরামপদ ভট্টাচার্য লিখিত। ১২৯২ (১৮৮৫) সাল নাগাদ পালাটির লেখার কাল বলে অনুমিত হয়।

৯১ The Akhyayika and The Katha in Classical Sanskrit in S. K. De, Some Problems of Sanskrit Poetics, (Calcutta, 1981) pp. 65-79.

৯২ তুলনীয় S. N. Dasgupta and S. K. De, A History of Samskrit Literature, Classical Period, Vol. 1 (Calcutta, 1977), pp. 636-639.

৯৩ ‘ভাবিকা’ বা ‘ভাবিকত্ব’ সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রের মূল্যবান ধারণা। ভামহ পরবর্তী আলঙ্কারিকরা নানাভাবে এই ধারণাকে আলোচনা করেন। প্রাসঙ্গিক শ্লোক, কাব্যালঙ্কার, ৩নং পরিচ্ছেদ, পৃ. ৫২-৫৩। উদ্ধৃত অংশ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনর জন্য দ্রষ্টব্য V Raghavan, Studies on Some Concepts of the Alumkara Sastra. (Madras. 1973). pp. 132.146. এই প্রসঙ্গে রানের ব্যাখ্যার উপর আমি নির্ভরশীল।

৯৪ বিশ্বনাথ কবিরাজ, সাহিত্য-দর্পণঃ, ৬/৩৩৩, বিলাকান্ত মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত, (কলিকাতা, ১৩৮৬), পৃ. ৪৭৯।

৯৫ অনুরূপা দেবী, মন্ত্রশক্তি, (কলিকাতা, ১৩২২), পৃ. ৬৪। রমাকান্ত চক্রবর্তী উপন্যাসটির কথা আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন।

৯৬ ঐ, পৃ. ৭৫।

৯৭ ভরত নাট্যশাস্ত্র, সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও ছন্দা চক্রবর্তী সম্পাদিত ও অনুদিত, ৩/১৯। ৪৩-৬২, (কলিকাতা, ১৯৮২), পৃ. ৮-১৫। অভিনবগুপ্তের প্রাসঙ্গিক টীকা, নাট্যশাস্ত্রম, Ed. M, R. Kavi, (Baroda, 1934), Vol. II,সদশোনুধ্যায়, পৃ. ৩৯৯।

৯৮ নাট্যশাস্ত্রে স্বর ও সুর নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যামূলক আলোচনা, রাজেশ্বর মিত্র, ‘নাট্যশাস্ত্রে সঙ্গীতচিন্তা’, প্রাগুক্ত, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ২৯৮-৩৫২।

৯৯ আচার্যপ্রদত্ত উদাহরণ এইরূপ : ‘কিং! গঙ্গ! না বিশ! সুদুর্জন। বারিতোহলি কার্যং ত্বয়া ন মম। সর্বদনোপভুক্ত।’ ছন্দ অনুসারে বিরাম নয়, অর্থানুসারে থামতে হচ্ছে। ফলে পাঠকালে এক, দুই, তিন বা চার অক্ষরের পরও বিরামের প্রয়োজন হতে পারে। ভরত নাট্যশাস্ত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ১৪-১৫। ৬১ন শ্লোক।

১০০ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার কালের কথা, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৭।

১০১ রাখালচন্দ্র গোস্বামী পুত্রবধূ শান্তিরানি গোস্বামীর সাক্ষ্য, নিত্যগোপাল গোস্বামীর সৌজন্যে প্রাপ্ত, ২৯/৯/৯৩

১০২ কথকতার পালা (শ্রীমদ্ভাগবত), পাঠবাড়ি, ২৭৮৩/১৩, রামপদ ভট্টাচার্যের পুথি (১৮৮৩ সালে লিখিত)।

১০৩ কথকতার পুথি(বনপর্ব), খণ্ডিত, তারিখ অজ্ঞাত, বিশ্ব, ১৫২৫, পৃ. ৮৬ক-৮৬খ।

১০৪ ‘জীবনস্মৃতি’ রবীন্দ্র রচনাবলী, বিশ্বভারতী সংস্করণ, সপ্তদশ খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০৮-৩০৯।

১০৫ যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, ‘গল্প’, কি লিখি? প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৮।

১০৬ কথকতার পালা (শ্রীমদ্ভাগবত) প্রাগুক্ত, পাঠবাড়ি, ২৭৮৩/১৩। আলাদা পাতায় গানটি লিখিত।

১০৭ কথকতার পালা (প্রভাসতীর্থ যাত্রা), ২৭৮৬/১৬, পাঠবাড়ি, পৃ. ৮ক।

১০৮ ‘রামের অযোধ্যা প্রত্যাবর্তন’, সীতারামকুটীর, টালিগঞ্জ ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৩।

১০৯ ঐ, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৩। এইরকম গান আরও আছে। যেমন, ‘রামায়ণ দেহতত্ত্ব’, রামায়ণাচার্য ফেলারাম বন্দ্যোপাধ্যায়, বিরচিত, শ্রীরামনামাবলী, বাঁকুড়া, ১৩৮৩, ২২ নং গান।

১১০ এই পত্রিকায় ‘কথকতার গানে’ সম্পূর্ণ গানটি আছে। রচয়িতা ফেলারাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের গীতগুলি উপযুক্ত পুস্তিকা থেকে গৃহীত হয়েছে।

১১১ সাধক নবব্রত ব্রহ্মচারীর ভাগবতপাঠ, (কথা ও সঙ্গীতে) ৩৭-এর পল্লী হরিনাম সংকীর্তন সম্প্রদায়ের উদ্যোগে শ্রীশ্রীরাধাগোবিন্দ জীউ-এর মন্দির প্রাঙ্গন, বৈঠকখানা, কলকাতা, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৩।

১১২ কথকতার কথা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৫-৯৬।

১১৩ কথকতার পাতড়া, ৫০৬৫ ও ৫০৬৭, বিশ্ব।

১১৪ পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘সেকালের দুর্গোৎসবের প্রারম্ভে পল্লীচিত্র’, আশ্বিন, ১৩২২, মর্মবাণী, ১ম বর্ষ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৫৫।

১১৫ মন্ত্রশক্তি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৬-৭৭।

১১৬ চিঠিপত্রে সমাজচিত, ২য় খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৩।

১১৭ সেকালের স্মৃতি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪২।

১১৮ Dinesh Chandra Sen. History of Bengali Language and Literature, 196. pp. 589-90.

১১৯ দ্বিজরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রদত্ত সাক্ষাৎকার, ২০ নভেম্বর, ১৯৯২। চালতাবাগান, কলকাতা।

১২০ কথকতার কথা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭।

১২১ ঐ, পৃ. ৭৩-৭৪।

১২২ প্রতিমাদেবী, স্মৃতিচিত্র, (কলকাতা, ১৩৫৯), পৃ. ৮৫-৮৬।

১২৩ কথকতার কথা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২-৩৩।

১২৪ হরিপদ চক্রবর্তী, কথকতার পুথি, সংস্কৃতি বৃত্ত, সুবর্ণলেখা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৯২।

১২৫ তরণীসেন বধ পালা, দ্বিজরাভ বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্মিলনী, চালতা বাগান, কলিকাতা, ৫/১২/৯২। অন্যান্য পালাতেও মঙ্গলাচরণের ছক এক থাকে। ক্যাসেটে সংক্ষিত।

১২৬ সেতুবন্ধ পালা, ঐ, ৩/১২/৯২। অনুলিখন।

১২৭ শবরীর প্রতীক্ষা পালা, ২৭/১১/৯২, ঐ, অনুলিখন।

১২৮ তরণীসেন বধ পালা, প্রাগুক্ত।

১২৯ তরণীসেনের যুদ্ধ ও পতন, কৃত্তিবাস বিরচিত কামায়ণ, সাক্ষরতা প্রকাশন, পৃ. ২৯৫-২৯৬।

১৩০ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, পথের পাঁচালী, কলিকাতা, ১৩৭২, পৃ. ২৯৩।

১৩১ অবনী অধিকারীর কথকতা, অহল্যাব শাপমোচন, ২৬ কেব্রুয়ারি, ১৯৯৩, শান্তিনিকেতন। ক্যাসেটে রক্ষিত।

১৩২ অনেক চেষ্টা করেও এখনও জগৎরামী রামায়ণের কোনও সংস্করণ পড়তে সক্ষম হইনি। তথ্যাদির জন্য দ্রষ্টব্য, D.C. Sen, The Bengali Runavaias (Calcutta, 192)), সুকুমার সেন, বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ড, (আনন্দ সংস্করণ, ১৩৯৮), পৃ. ৩৬৩-৩৬৪।

১৩৩ ক্ষান্তিলতা দেবী, কুম্ভীস্তব (ভগবতী), বছর দশেক আগে শ্যামাপূজার দিনে আয়োজিত পাঠ, ক্যাসেটে রক্ষিত, শ্রীযুক্ত করুণকান্তির সৌজন্যে প্রাপ্ত।

১৩৪ বাসন্তী চৌধুরী, রাসলীলা, সপ্তম পর্ব, নিঃসম্বলানন্দ কলেজ, ভদ্রেশ্বর, ৫ জুলাই, ১৯৯৩। ক্যাসেটে রক্ষিত।

১৩৫ ‘মানি কাকা’, জীবনকথা, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখিত (কলিকাতা, ১৯৭৯), পৃ. ১৪২-১৫০।

১৩৬ রামায়ণ কথা সংগ্রহঃ, নং ৩৭৮৭, এশিয়া, ১ক-১খ।

১৩৭ চন্দননগরেব ফটকগোড়ায় কথক কুমুদবন্ধুর প্রথম সাক্ষাৎকার ১৫ জুলাই, ১৯৯৩। উল্লেখ্য এই যে, এই জাতীয় ধারণা শ্রুতির মাধ্যমে শিল্পীরা তাঁদের চেতনায় গেথে বাখেন। ১৯২৫ সালে কলকাতায় কালকা বিন্দাজি ঘরাণার চৌধুরান বাইজি নৃত্যের নানা অঙ্গভঙ্গিকে নাট্যশাস্ত্র মতে ব্যাখ্যা করে অমিয়নাথ সান্যালকে হকচকিয়ে দিয়েছেন। অমিয়বাবু তখনও নাট্যশাস্ত্র গ্রন্থটি চোখেই দেখেননি আর বাইজি জানেনই না, ভরত লোকটি কে। দ্র. ‘নৃত্যের বস্তুতত্ত্ব’, সমকালীন, আষাঢ়, ১৩৬৮, পুনর্মুদ্রিত। ভরত নাট্যশাস্ত্র, সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, ২য় খণ্ড, (কলকাতা, ১৯৮২), পৃ.। ২৮০-২৮১।

১৩৮ ধ্বন্যালোক, অনুবাদক সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও কালীপদ ভট্টাচার্য (কলকাতা, ১৯৮৬), পৃ. ১৫, ৪৪, ৪৬। প্রথমোদ্‌দ্যোতঃ।

১৩৯ ঐ, পৃ. ২৫-২৬, ৪০-৪১। পঞ্চম কারিকার বৃত্তি ও ভাষ্য প্রথমোদ্‌দ্যোতঃ।

১৪০ ভট্টনায়কের ‘ভূক্তিবাদ’ ও অভিনবগুপ্তের ‘অভিব্যক্তিবাদ’ সম্পর্কিত তুলনামূলক আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য—বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য, সাহিত্য মীমাংসা, বিশ্বভারতী, ১৯৭৫, পৃ. ৭৬-১০৬।

১৪১ বিশ্বনাথ কবিরাজ, সাহিত্যদর্পণঃ, সম্পাদনা ও বঙ্গানুবাদ, বিমলাকান্ত মুখোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, ৩/৯, ৯৫-৯৬।

১৪২ দীনেশচন্দ্র সেন, ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য, (কলকাতা, ১৯৬৯), পৃ. ১৮১-১৮২।

১৪৩ মন্ত্রশক্তি, প্রাগুক্ত, পৃ ৭৫-৭৬।

১৪৪ বেহালা হরিভক্তি প্রদামিনী সভা, (স্থাপিত ১২৫৯ সাল/সন ১৮৫২)। দ্রষ্টব্য—৬৫ তম সাষৎসরিক পত্রিকা (১৩২৪) ও ৬৬তম সাক্ষৎসরিক পত্রিকা, ১৩২৫, পৃ. ১৭ ১৫।

১৪৫ অনুচ্ছেদটি ৪/১১/৯২ সালে চালতাবাগানে দ্বিজরাজবাবুর কথকতার আসরে সমাগত শ্রোতাদের কথোপকথন-ভিত্তিক।

১৪৬ বিশ্বনাথ কবিরাজ, পূর্বোল্লিখিত, ৩/৮, পৃ. ১৪-৯৫। নাট্যশাস্ত্রে-র পরিভাষায় শ্রোতার সমাবেশরূপে সমাজ কথাটি প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত, অশোকের শিলালিপিতে শব্দের এই জাতীয় প্রয়োগ দেখা যায়। দ্রষ্টব্য, দেবদত্ত ভাণ্ডারকর ও ননীগোপাল মজুমদারের আলোচনা, Indian Antiquary, 1913. pp. 255-258 Indian Antiquary, 1918, pp. 221-223.

১৪৭ কথকতার কথা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৩।

১৪৮ Victor Turner. Dramas, Fields and Metaphors, (Ithaca, 1974). Partha Chatterjee, ‘More on Modes of Powers and the Peasantry’. Subaltern Studies, Vol. II. edited by Ranajit Guha, (Delhi, 1983), pp. 338-339.

১৪৯ ভরত নাট্যশাস্ত্র, প্রথম খণ্ড, প্রাগুক্ত, সপ্তম অধ্যায়, ৭ নং শ্লোক, পৃ ১৫৪। সাহিত্য দর্পণ, তৃতীয় পরিচ্ছেদঃ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৬। একজন আধুনিক গবেষকের মতে ‘চমৎকার’ ধারণাটি উৎপন্ন হয়েছে ভাল খাবার পর জিভ দিয়ে টাক্‌রার যে তৃপ্তিবিধায়ক আওয়াজ করা হয়, তার থেকে। রামায়ণ চর টীকাতেও আছে। “চমদিত্যনূকরণ শব্দঃ।” পরে শব্দের অর্থ বিস্তার হয়েছে, রসাস্বাদনে চিত্তবৃত্তির বিস্তার অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে। Raghavan, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৯৪।

১৫০ রাজানক কুম্ভকাচার্যের বক্রোক্তিজীবিত, রবিশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, ১/৫ প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০। Sushil Kuniur pe. Makroktijivita of Kanaka. প্রথমেন্মেযঃ, শ্লোক নং ৫, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫।

১৫১ ‘লোকশিক্ষা’, বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত, সংসদ সংস্করণ, ১৩৭১, পৃ. ৩৭৬-৩৭৭।

১৫২ দীনেশচন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, প্রথম খণ্ড, দে’জ সংস্করণ ১৯৯৩, পৃ. ৩৮৬।

১৫৩ দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ‘ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে’, অনুষ্টুপ, (কলকাতা, ১৯৮৭), পৃ. ১৯২-১৯৫।

১৫৪ রমাকান্ত চক্রবর্তী, ‘কথকতা পাঠকত’, যোগসূত্ৰ।

১৫৫ যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, পৌরাণিক উপাখ্যান, (কলকাতা, ১৩৯০), পৃ. ৮৮-৮৯।

১৫৬ মহেন্দ্রনাথ দত্ত, শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের অনুধ্যান, সম্পাদনা ধীরেন্দ্রনাথ বসু, (কলিকাতা, ১৩৫০), পৃ. ১২।

১৫৭ দীনেশচন্দ্র সেন, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য(অষ্টম সংস্করণের পুনর্মুদ্রণ, রাজ্য পুস্তক পর্ষদ প্রকাশন) অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, ১ম খণ্ড, (কলকাতা, ১৯৯১), পৃ. ৭১-৮০।

১৫৮ দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, ভূমিকা, (১৩১৫), ঠাকুরদাদার ঝুলি, (কলকাতা, ষোড়শ সংস্করণ, ১৩৯৩), পৃ. ৯৪।

১৫৯ ঠাকুরদাদার ঝুলি, প্রথম সংস্করণ, ১৩১৫, পৃ. ১৩৮-১৩৯।

১৬০ ঐ, দ্বিতীয়, সংস্করণ, ১৩১৬, পৃ. ৯৬।

১৬১ অনুচ্ছেদের অধিকাংশ শব্দাবলী ঠাকুরদাদার ঝুলি-র ভূমিকা (১৩১৫) থেকে উদ্ধৃত; প্রচ্ছদের পেছনের কাগজে ছাপা সমসাময়িক সমালোচকদের নানা মন্তব্য ও দক্ষিণারঞ্জন লিখিত অন্যান্য বইয়ের বিজ্ঞাপনও কৌতুহলোদ্দীপক। বইয়ের আখ্যাপত্র পুরোনাম—ওপরে ছোট অক্ষরে ‘মাতৃগ্রন্থাবলী চতুর্থ সংখ্যা’, দক্ষিণে কোণায় ‘বাংলার কথা সাহিত্য’, মাঝে বড় অক্ষরে ‘বাংলার উপন্যাস ঠাকুরদাদার ঝুলি’। মলাটে কিন্তু ‘বঙ্গোপন্যাস’ লেখা আছে। প্রাগুক্ত সংস্করণ।

১৬২ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভূমিকা (১৩১৪), ঠাকুমার ঝুলি, দ্বাত্রিংশতি সংস্করণ, ১৩৯১, পৃ. ১২।

১৬৩ যদুনন্দন দাস, গোবিন্দলীলামৃত, কৃষ্ণদাস কবিরাজ কর্তৃক সংস্কৃতে প্রণীত, (কলিকাতা, ১২৭৪), পৃ. ২।

১৬৪ শঙ্খ ঘোষ, কল্পনার হিস্টিরিয়া, (কলকাতা, ১৯৮৪), পৃ. ৫০।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *