কত না অশ্রুজল

১৬ ডিসেম্বর, ভোর। ১৯৭১।
আমার বুক ধক ধক করছে। বাজিছে বুকে সুখের মতো ব্যথা। বিশ্বাসই হচ্ছে না, আমরা স্বাধীন। এখন আর
মাথা উঁচু করে হাঁটতে সমস্যা নেই।… ‘নিজের দেশের মাটি/দবদবাইয়া হাঁটি।’
আমি দবদবিয়ে হাঁটার জন্যে বের হলাম। প্রথমে খুঁজে বের করতে হবে আমার ছোট ভাইকে (জাফর ইকবাল)। শুনেছি, সে যাত্রাবাড়ীতে আছে। গর্তে বাস করে। যাত্রাবাড়ীতে আমার দূরসম্পর্কের এক মামা বাড়ির পেছনে গর্ত করেছেন। তিনি তাঁর স্ত্রী এবং দুই ছেলে নিয়ে গর্তে বাস করেন। জাফর ইকবাল যুক্ত হয়েছে তাদের সঙ্গে। পরিবারটি দরিদ্র। গত ঈদে সে বাসায় পোলাও রান্না হয়নি। মামা তার বাচ্চাদের বলেছেন, দেশ যেদিন স্বাধীন হবে, সেদিন পোলাও-কোর্মা রান্না হবে। আজ হয়তো সে বাড়িতে পোলাও রান্না হচ্ছে।
আমার সঙ্গে আছেন আনিস ভাই (আনিস সাবেত)। আমরা দু’জন এতদিন জিগাতলার এক বাড়িতে বাস করেছি। বাড়ির গৃহকর্তা এবং গৃহকর্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অচেনা দুই যুবককে আশ্রয় দিয়েছিলেন। আজ এই মহানন্দের দিনে তাদের ছেড়ে যাচ্ছি কেন? জানি না, কেন। আজ ঘরের ভেতর থাকতে ইচ্ছা করছে না। অনেকদিন তো বন্দি থাকলাম। আর কেন!
বিজয়ের দিনটা কেমন ছিল? ঘোরলাগা দিনের স্মৃতি কখনও স্পষ্ট থাকে না। জলরঙে আঁকা ছবি পানিতে ভিজিয়ে রাখলে সব ঝাপসা হয়ে যায়। একটা রঙের সঙ্গে অন্যটা মিশে কুয়াশা কুয়াশা ভাব হয়। সেদিন কিন্তু কুয়াশাও ছিল। কুয়াশার ভেতর থেকে হুট করে একটা জিপগাড়ি উদয় হলো। গাড়িভর্তি মুক্তিযোদ্ধা। আশেপাশের বাড়ি থেকে ছুটে আসছে মহিলারা, শিশুরা। সবার মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। তাদের গলায় বিস্ময় ধ্বনি_ মুক্তিযোদ্ধা! মুক্তিযোদ্ধা। গোপন যোদ্ধারা আজ প্রকাশিত। আহা কী আনন্দ!
মুক্তিযোদ্ধারা ভালোবাসার প্রতিদানে গলা ফাটিয়ে জয়ধ্বনি করল, জয়বাংলা! উপস্থিত সবাই গলা মিলাল, জয়বাংলা! কুয়াশার ভেতর থেকে জিপগাড়ি এসেছিল, সেই গাড়ি মিলিয়ে গেল কুয়াশায়। রাস্তার মাথায় একটা চায়ের দোকান খুলেছে। আনিস ভাই বললেন, চলো, স্বাধীন দেশে প্রথম চা খাই।
আমরা এগিয়ে গেলাম। চা খাওয়া হলো না। চায়ের পানি গরম হয়নি। আনিস ভাই বললেন, দু’টা ক্যাপস্টেন সিগারেট দাও। আজ সিগারেট খাব। দু’জনই গম্ভীর ভঙ্গিতে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে লাগলাম। আমার জীবনের প্রথম সিগারেট খাওয়া। দিনটাকে মনে রাখার জন্যে নতুন কিছু করা। অদ্ভুত কিছু করা। কী করলে আনন্দ প্রকাশ করা যায়, তাও মাথায় আসছে না।
জিগাতলার বাজারের গলির ভেতর দিয়ে আসছি, হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হলো। আটকেপড়া বিহারিরা গুলি ছুড়ছে। গলি দিয়ে লোক চলাচল বন্ধ। আনিস ভাই বললেন, আজ আমাদের গায়ে গুলি লাগবে না, চলো যাই।
সেদিন গোলাগুলির ভেতর দিয়ে গিয়েছিলাম, নাকি গুলি থামার জন্যে অপেক্ষা করেছি, তা আর মনে করতে পারছি না। সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে এসে দু’জন থমকে দাঁড়ালাম। রাস্তা এবং ফুটপাতে একটি পুরো পরিবারের মৃতদেহ। এরা বিহারি। ছোট শিশু আছে। একটি কিশোরীও আছে। কিশোরীর মুখশ্রী কত না সুন্দর! আমার বুকের ভেতর প্রচণ্ড হাহাকার তৈরি হলো। সেই হাহাকারের কিছুটা আমি এখনও বহন করি।
এই স্বাধীন দেশের পেছনে কত না অশ্রুজল। আজকের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কি এই ব্যাপারটা বুঝবে? ১৯৭১-এর কথা এলেই রক্তের কথা চলে আসে। ‘রক্তস্নাত বাংলা’, ‘রক্তের ঋণ’ এইসব। অশ্রুর কথা সেভাবে আসে না।
আমার বাবাকে মিলিটারিরা গুলি করে মেরেছিল। সেই ভয়ঙ্কর দিনে তাঁর শরীর থেকে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। একই সঙ্গে গত আটত্রিশ বছর ধরে তাঁর স্ত্রী, তাঁর ছেলেমেয়ে চোখের পানি ফেলছে। তারা যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিনই অশ্রু বর্ষণ করবে। শুধু রক্তের হিসাব রাখব, অশ্রুর হিসাব রাখব না_ তা কি হয়?
মহান বিজয় দিবসে আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে আমার ভেতর গভীর বেদনাবোধও তৈরি হয়। বারবার মনে হয়, ‘কত না অশ্রুজল।’
‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে/কত প্রাণ হল বলিদান/লেখা আছে অশ্রুজলে’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *