কণ্টকিত স্বপ্নের বিছানা

কণ্টকিত স্বপ্নের বিছানা

পেছনে স্কুটার রেখে, ঘুরে এসে সামনের পর্চ দিয়ে বাড়ি ঢুকলো অরণ্য। প্যারাপেটের ওপরটা মাধবীলতা আর লতানে জুঁইয়ে ছেয়ে গেছে। বেশ একটা চিকের মতো আড়াল হয়েছে। ও পাশে স্থলপদ্মর গাছটা চোখে পড়ছে না আর। লতাগুলো একটু ছাঁটা দরকার। হিরুকে বলে দিতে হবে। এই জন্যেই বোধহয় কদিন ব্রততী এখানে বসছে না। কদিন বলতে অবশ্য ছুটি-ছাটা আর দীর্ঘ ভেকেশন ছাড়া শনিবারগুলোতেই বোঝায়। অন্যান্য দিন ও-ও তো কলকাতায় স্কুলে চলে যায়, দুজনে একসঙ্গে হেভি ব্রেকফাস্ট করে, ব্রততী নিজের জন্য একটা টিফিন হোক, লাঞ্চ হোক, তৈরি করে নেয়। অরণ্য বাড়ি ফেরে না। অফিস ক্যানটিনে ব্যবস্থা ভালোই। বললে, হাল্কা মশলা ছাড়া রান্না-টান্না করে দেয়। নাহলে বাড়ি ফিরে একলা একলা খেতে বিশ্রী লাগে। নিজের সামান্য খারাপ লাগার কারণে ব্রততীর এই একটু মুক্তির খুশিটা বন্ধও করে দেওয়া যায় না। করতে চাইলেই যে সঙ্গে সঙ্গে মেনে নেবে তা অবশ্য নয়। গুঁইগাঁই করবে। সারাদিন বাড়ি বসে বসে করবেই বা কি? অরণ্য ওকে বলেছিল—‘নাসার্রি স্কুলের ওই চাকরিটা না করে বরং রিসার্চ-টিসার্চ একটা ধরো।’

ব্রততী বলেছিল—‘নিজের নামের আগেও একটা ডক্টরেট বসাও তাহলে। আমি পি এইচ ডি করি তারপর তুমি কমপ্লেক্সে ভুগে ভুগে আমার অবস্থা কাহিল করে দাও আর কি!’

ব্রততীর অনুমানটা সত্য নয়। অরণ্য চায়, ব্রততীর একটা খুব সুন্দর, স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবন হোক। লেখাপড়া করে যদি সেটা সম্ভব হয় তো তাই-ই হোক। পড়াশোনা অবশ্য করে ও। কিন্তু ওরকম লক্ষ্যহীন পড়াশোনায় কি ফল?

কিছুদিন ধরেই অরণ্য লক্ষ করছে ব্রততীর মুখে একটা কালো মেঘ। এতো চাপা স্বভাব যে, ওর পেটের কথা বার করা শক্ত। যুধিষ্ঠিরের অভিশাপটা অন্তত এ মেয়ের ক্ষেত্রে সত্য হয়নি। অন্যান্য শনিবার অরণ্য দেখতে পায় ও পর্চে প্যারাপেটের ওপর বসে আছে হাল্কা রঙের শাড়ির ওপর লতাপাতার ছোট ছোট ছায়া ফুটিয়ে খোলা চুল। হয় চুপচাপ বসে আছে, নয় কোনও বই-টই হাতে রয়েছে। পৰ্চটা ব্রততীর খুব প্রিয় জায়গা। সামনে ফ্যাক্‌টরি যাবার পথ আগাগোড়া গুলঞ্চ, দোলনচাঁপা আর করবীতে মোড়া। ডানদিকে বাইরে যাবার গেটের দিকে চলে গেছে একটা রাস্তা, মেহেদির বেড়া। বাঁদিকে কলোনির ভেতর দিকে যাবার পথ। এদিকটায় বড় বড় গাছ। সকাল-বিকেল দুপুর কখনও মিঠে কখনও তীব্র সুগন্ধ ভেসে আসে। শুধু ফুলের নয়, গাছেরও শরীরের একটা নিজস্ব গন্ধ আছে। লতার আড়ালে বসে, তিনটে রাস্তার বীথিকা, পাখির ডাক, প্রজাপতিদের আসা-যাওয়া, মানুষের চলাচলের শব্দ উপভোগ করা যায়। নিজেকে দৃশ্য না করলেও চলে। অরণ্যকে দেখে মুখ তুলে হাসে ব্রততী, বইটি মুড়ে ভেতরে চলে যায়। কপালে এমনিতে কখনও টিপ দেয় না ব্রততী। সরু সিঁথিতে সিঁদুর প্রায় না থাকার মতোই। গলায় কিছু পরে না। দুহাতে শুধু দু গাছি চুড়ি। বিয়ের আগেও ওকে এমনি দেখেছিল অরণ্য। ভালো লেগেছিল। আকাশের মতো নিরাভরণ। তাই-ই মেঘ, গোধূলি, ইন্দ্রধনু, বিদ্যুৎ-ঝলক। পাখিদের উড়ে-যাওয়া, তাই-ই এতো বৈচিত্র্য।

রেজিস্ট্রেশনের দিন ব্রততী এলো, লম্বা একটা বেণী। কানে ছোট্ট নীল পাথর। গলা, হাত সমস্ত খালি। গাঢ় নীল একটা শাড়ি পরণে। দুজনে মিলে একসঙ্গে রেজিস্ট্রি অফিসে যাবার কথা, বাকিরা সেখানেই আসবে। অরণ্য ওর সাজপোশাক দেখে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল।

বুঝে নিয়ে ব্রততী বলেছিল—‘সালংকারা কন্যা-সম্প্রদান চেয়েছিলেন নাকি?’

—‘সালংকারা প্রয়োজন হলে আমি করে নেবো, কিন্তু আজকের দিনে তোমার একটা লাল শাড়ি-টাড়ি পরা উচিত ছিল।’

—‘আমি শাড়িকে পরবো, না শাড়ি আমাকে পরবে, অরণ্যদা। তাছাড়া লাল আমার সহ্য নয় না।’

—‘সহ্য হয় না? তোমার আবার এসব কুসংস্কার আছে নাকি?’

—‘কুসংস্কার-টার নয়। লাল পরলে অ্যালার্জি হয়।’

—কিন্তু তুমি আজও অভিসারিকার সাজ পরে এসেছ যে!’

হেসে ফেলে ব্রততী বলেছিল—‘তাতে তো আপনারই সুবিধে। একটা পরকীয়া পরকীয়া গন্ধ থেকে যাচ্ছে।’ তারপরই গম্ভীর হয়ে বলেছিল—‘কোথাও কোনও আতিশয্য যে আমার ধাতে সয় না, কি করি বলো!’

—‘কি আশ্চর্য! সামান্য জিনিস নিয়ে এতো ভাববার কি আছে? আসলে আমাদের অনেক দিনের অভ্যাস তো। কোনও কোনও কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়।’

সেদিন কিন্তু সত্যিই ব্রততীকে লাল শাড়িতে দেখতে ইচ্ছে করেছিল।

কদিন হল ব্রততী প্যারাপেটটায় বসছে না। রাস্তাটা বাড়ির মুখোমুখি বলে অনেক দূর থেকে এই শূন্যতা দেখতে পাওয়া যায়। পর্চের মুখখামুখি দাঁড়িয়ে অরণ্য দেখতে পেলো সদর দরজা খুলে ও একটু পাশে সরে দাঁড়িয়েছে। খোলা দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে ঘড়িতে একটা বাজার আওয়াজ পেলো অরণ্য। বলল—‘তোমার শরীর ঠিক আছে?’

—‘আমার কি কিছু হয়েছে?’ অবাক হয়ে ব্রততী বলল।

—‘ভেতরে বসেছিলে বলে মনে হল—’

—‘রোদের তাত ভালো লাগে না—’ সংক্ষেপে কথা সেরে ব্রততী দরজা বন্ধ করে দিল।

—‘সেনগুপ্তকে আসতে দেখলে নাকি?’

—‘কি আশ্চর্য! আমি কি করে দেখব?’ পেছন ফিরে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল ব্রততী।

হঠাৎ অরণ্যর মনে হল সেনগুপ্তর জন্যই ব্রততী পর্চে বার হচ্ছে না এ সময়। সেনগুপ্ত দম্পতিকে একেবারে পছন্দ করে না ও। ওর পছন্দ অপছন্দগুলো বড় নির্বিচার। কিন্তু এটা ঠিক নয়।

সোফায় বসে জুতো খুলতে খুলতে অরণ্য জিজ্ঞেস করল—‘আজ মেনু কি?’

ব্রততী টেবিল সাজাচ্ছে, বলল—‘মাছের ধোঁকা আছে।’

—‘আমাকে ধোঁকা খাওয়াছো না তো? মাছের ধোঁকা···সোনার পাথরবাটি!’ ব্রততী হেসে ফেলে বলল—‘আমি কি বাচ্চা মেয়ে যে, আমার মেজাজ ভালো করবার জন্য ছেলেমানুষি করতে হবে!’

বেসিনের কলে মুখ-হাত ধুতে ধুতে অরণ্য বলল—‘আরে, আমিও তো এগজ্যাক্টলি তাই বলি,! একটা বুদ্ধিশুদ্ধিওলা মেয়ে বিনি নোটিসে যখন তখন এরকম গম্ভীর হয়ে যাবে কেন?’

ব্রততী মিটি মিটি হেসে বলল—‘আগে ধোঁকাটা তোমাকে দিই। তারপরে ঘোল খাওয়াবো, তারও পরে যদি জানতে চাও তো ভেবে দেখা যাবে সব কেনর উত্তর তোমার পাওনা কিনা।’

চেয়ারে বসে অরণ্যর দিকে একটা মোটা তোয়ালে এগিয়ে দিল ব্রততী।

—‘প্লীজ, কোলের ওপর রাখো!’

—‘কি আশ্চর্য! আমি কি বাচ্চা?’

—‘তুমি বাচ্চার বাড়া। সেটা নিজেও জানো। এক ফোঁটা পড়লেও কেলেঙ্কারি হবে। সাদা পরেছো।’

অরণ্য কাঁধ নাচাল। মুখে একটু ধোঁকা ভেঙে দিয়ে বলল—‘ইস্‌স্‌ দারুণ হয়েছে তো? মিষ্টান্ন কিছু করেছো?’

—‘ফলের পায়েস।’

—‘গ্র্যান্ড। আঙুর দিয়েছো? বাঃ বাঃ, আচ্ছা, ব্রততী, এক কাজ করলে হয় না? ওদের একটু যদি পাঠিয়ে দেওয়া যায়!’

—‘কাদের?’

অরণ্য ওপরের দিকে চোখ তুলল, বলল—‘আফটার অল গেস্ট তো!’

—‘ওমা! গেস্ট কিসের?’ ব্রততী রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেলল।

—‘তুমি এমন এক একটা কথা বলো না!’

—‘আমরা আগে থেকে এ বাড়িটায় আছি। ওরা এসেছে পরে। সেই হিসেবে গেস্টই তো! তাছাড়া, আমাদের কাছে ওদের একদিন খাওয়া পাওনা আছে। ব্রততী, ব্রততী ভেবে দ্যাখো, চৌধুরীকে খাইয়েছ, ঘোষালকে খাইয়েছো, রায়দের তো যখন-তখন খাওয়াছো!’

ব্রততী মনোযোগ দিয়ে মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে বলল—‘অত দেনা-পাওনার হিসেব আমি কষতে পারি না গো। ইচ্ছে হয় বোলো। তবে আমার শরীরটা কিছু দিন থেকে খুব, খুব খারাপ যাচ্ছে। স্কুলেও নতুন নতুন দায়িত্ব এসে পড়ছে মাথার ওপর। একটু সময় দিও।’

অরণ্য বলল—‘কি আশ্চর্য! আমি কি ঘোড়ায় জিন দিয়ে এসেছি? এই যে তখন বললে তোমার শরীরে কিছু হয়নি!’

ব্রততী সে কথার জবাব না দিয়ে বলল—‘কিছুক্ষণ আগে পারমিতা সেনগুপ্ত এসেছিল।’

—‘তাই নাকি?’ অরণ্য চেয়ারে হেলান দিয়ে হাত গুটিয়ে বসল—‘কেন?’

—‘ওদের ফ্ল্যাটের একটা ডুপ্লিকেট চাবি আমার কাছে রেখে গেল। বলল দুজনেই নাকি ওরা ভীষণ ভুলো। যদি দুটো চাবিই এক সঙ্গে হারায়, তাই। আজ নাকি কলকাতা যাবে।’

অরণ্য বলল—‘এতো ভুলো? আচ্ছা তোক তো!’

ব্রততী গম্ভীর হয়ে বলল—‘আমি নিলুম। কিন্তু আমার ভালো লাগছে না।’

—‘ভালো লাগা-না লাগার কি আছে? রেখে দাওগে তোমার চাবির হুকে।

—‘বোঝ না তুমি। এটা একটা দায়িত্ব!’

—‘আর কিছু বলল?’

—‘আলাপ-সালাপ করল সামান্য। একটু কৃত্রিম টানে কথা বললেও মেয়েটি, খারাপ না। বলল আবার আসবে।’

—‘ব্রততী, তুমি তোমার এই পায়েস আর ধোঁকা একটু পাঠিয়ে দাও প্লীজ।’

—‘তুমি বড্ড পাবলিসিটির ভক্ত। পরমার্থদার মতোই। এরকম করো না।’

—‘যে প্রোফেশনের যা। মজ্জাগত হয়ে গেছে হয়ত। কিন্তু এটা প্লেন অ্যান্ড সিম্পল নেবারলি জেসচার।’

—‘কাকে দিয়ে পাঠাবো?’

—‘বাঃ খাবার আর কাকে দিয়ে পাঠাবে? নিজেই যাবে!’

—‘কি করে যাবো। আমি এখন খাচ্ছি না!’ ব্রততী দুটো আঙুল চাটতে লাগল মনোযোগ দিয়ে।

অরণ্য উঠে গিয়ে জানলার ধারে দাঁড়াল। এ সময়ে, ওপরের কাজ সেরে রামের মা বাড়ি ফেরে। ওকে দেখতে পেয়ে একটা ডাক দিল। রামের মা এলে অরণ্যই ছোট ছোট বাটিতে খাবারগুলো সাজিয়ে দিল একটা ট্রেতে, আর একটা ছোট ট্রে ঢাকা দিয়ে পাঠিয়ে দিল ওপরে।

ব্রততী বলল—‘বাসনগুলো ফেলে এসো না।’

রামের মা চলে গেলে অরণ্য বলল—‘বাসনগুলো কি তোমার এক্ষুনি দরকার ছিল?’

—‘না। কিন্তু রেখে এলে আবার বাসন ভর্তি করে কিছু পাঠাবে-টাঠাবে। এসব ফর্ম্যালিটি আমার ভালো লাগে না।’

খাওয়া শেষ করে সিগারেট ধরিয়ে, জানলার পর্দাটা টেনে দিয়ে পাশেই বসল অরণ্য। ছোট্ট একটু পনের মিনিটের নিদ্রা, তারপর আবার অফিস যেতে হবে। ব্রততী খাবার টেবিলটা পরিষ্কার করছে। সদর দরজাটা খোলাই থাকে এই সময়ে। দরজার কাছে ছায়া পড়ল, দুজনেই মুখ তুলে তাকাল। পারমিতা, পেছনে সুমন্ত সেনগুপ্ত। রোদ আড়াল করে দাঁড়িয়ে।

সেনগুপ্ত দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল—‘অপূর্ব খেলাম মিসেস মুখার্জি, অনেক অনেক ধন্যবাদ।’

পারমিতা বলল—‘আপনি যা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দেখতে এবং খেতে এক্কেবারে টিভির অ্যাড থেকে উঠে এসেছে।’

সেনগুপ্ত বলল—‘মিঃ মুখার্জি, আমরা একটু কলকাতা যাচ্ছি। রাতে আমি ফিরব, পারমিতা পার্ক সার্কাসে ওর বাবার কাছে থাকবে। মনে রাখতে চেষ্টা করব, তবু যদি ভুলে যাই, তাই ফ্ল্যাটের চাবিটা রেখে গেলাম। অসুবিধেয় ফেললাম না তো?’

অরণ্য বলল—‘কিছুমাত্র না। ডোন্ট ওয়ারি। ঘুরে আসুন।’

পারমিতা বলল—‘বলতে খুব খারাপ লাগছে মিসেস মুখার্জি, বাসনগুলো শূন্যই দিয়ে গেলাম। পূর্ণ করে দেবার বিদ্যে আমার নেই। এক্কেবারে আনাড়ি।’

অরণ্য বলল—‘ওসব ফর্ম্যালিটির কথা একদম ভাববেন না ব্রততী দিয়ে যাবে, আপনি খেয়ে যাবেন। আমিও অবিকল তাই করি।’

পারমিতা হাসল। ব্রততী রান্নাঘরের দিকে চলে গেছে, সেদিকে একবার তাকাল। তারপর লুটিয়ে-পড়া শাড়ি সামলাতে সামলাতে চলে গেল। পেছনে সেনগুপ্ত—মন্থর। অন্য কোথাও যেন যাবার ছিল। কিছু বলার ছিল। মনে করতে করতে যাচ্ছে।

রান্নাঘর থেকে এসে ব্রততী সদর দরজা বন্ধ করে দিল। পর্দাগুলো সব টেনে দিল। ঘরের মধ্যে পর্দার রঙের ছায়া। উল্টো -দিকের সোফাটায় বসল। অরণ্য বলল—‘দারুণ অ্যাট্রাকটিভ পার্সন্যালিটি, না?’

ব্রততী জবাব দিল—‘হ্যাঁ, মেয়েটি খুব সুন্দর দেখতে।’

অরণ্য বলল—‘আমি সেনগুপ্তর কথা বলছি। অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব! পারমিতার মতো মেয়ে যে কোনও লেডিজ বিউটি পার্লারের সামনে দাঁড়ালেই দেখতে পাবে। সেই আইসবার্গের কথা জানো তো? আট ভাগ জলের তলায়, একভাগ খালি জেগে থাকে! আচ্ছা, ভদ্রলোকের বোধহয় এক সময়ে চশমা ছিল, না?’

ব্রততী বলল—‘আমার জানার কথা নাকি?’

অরণ্য বলল—‘নাকের দুপাশে দাগ আছে বেশ। অত বসা দাগ শুধু সান-গ্লাসে হওয়ার কথা নয়। বোধহয় কনট্যাক্ট লেন্‌স্‌ পরেন।’

ব্রততী বলল—‘আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে। ঘরে যাচ্ছি। তুমি যাবার সময়ে দরজাটা টেনে দিয়ে যেও। আমাকে জাগিও না।’

অনেক সময় ব্রততী জেগে জেগে ঘুমোয়। চোখ খোলা থাকে, মস্তিষ্ক কোন কিছুর ছাপ নেয় না। দেখব না, শুনব না, বুঝব না। শুধু নিজের ভেতরে তলিয়ে স্থির হয়ে থাকব। একে জাগ্রত নিদ্রা ছাড়া আর কি বলা যায়? যখন চারপাশের আবহাওয়া প্রতিকূল, কিম্বা অপছন্দের, তখন টুক করে এই নিদ্রার জগতে ডুব দেওয়া ব্রততীর কাছে কিছু না। অভ্যেস আছে। কলকাতায় নিত্য স্কুলে যাবার পথটা এইভাবে জেগে জেগে ঘুমোয় ও। চালের পুঁটলি নিয়ে গাদাগুচ্ছের বুড়ি ওঠে, অল্পবয়সী মেয়েও। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে, দুহাতে উকুনে-মাথা চুলকোয় পাশে বসে, কারও কারও শরীর দিয়ে তীব্র রসুনের গন্ধ, মাঝে মাঝে পুলিস ওঠে —‘এ বুঢ়িয়া, উঠ্‌।’ রুলের গুঁতো মারে। বুড়ির জায়গায় বসে হাতে খইনি ডলতে ডলতে দাঁত বার করে হাসে। দেখবার কিছু নেই, শোনবার কিছু নেই।

কিন্তু এখন ব্রততী ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে জেগে আছে। চোখ বোজা। সমান তালে দুলছে শরীর। মন্থর আলস্যে মগ্ন দুপুর জাবর কাটছে বাইরে। ঘুমন্ত ব্রততীর মাথার মধ্যেও রোমন্থন। কিছুতেই ডুব দিতে পারছে না। নিজেকে নিশ্চিহ্ন করতে পারছে না। তাই ঘুমের মধ্যে শুনতে পেলো বাইরের দরজা টেনে দিয়ে অরণ্যর বেরিয়ে যাওয়ার শব্দ। মিনিট খানেক পরে স্কুটারের আওয়াজ। ব্রততীর বন্ধ জানলার পাশ দিয়ে ধুলো উড়িয়ে চলে গেল।

মাথার মধ্যে দিয়ে এইভাবে শব্দের বল গড়িয়ে যায়। অর্ধচেতন শরীর কি এক স্নায়বিক বিকারে হঠাৎ ধড়ফড়িয়ে ওঠে। কানের মধ্যে দিয়ে যেন বোমার পলতে গলিয়ে দিয়েছে কেউ। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি, তবুও মুখে একফোঁটা শব্দ করতে পারে না, একটু নড়ে নিজের এই স্নায়বিক বিভ্রমকে ঝাঁকিয়ে ফেলে দিতে পারে না। ঘুমোতে ঘুমোতেই শুনছে ব্রততী। বেল বাজছে, আস্তে। মিউজিক্যাল বেল। এক একটা স্পর্শে এক এক রকম সুর মৃদু মায়াময় হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে মাথার ভেতর। প্রচণ্ড ভয়ে বিবশ হয়ে যায় মস্তিষ্ক। তোমরা কে? কেন এমন করে মাথার ভেতরে ভয়াবহ বাজনা বাজাও! কালীপুজোর বলির বাজনা বাজছে, রক্ষাকালীর দংস্ট্রাকরাল মূর্তি। ঢং ঢং ঢং। ঘড়িতে তিনটে বাজল। শোবার ঘরের জানলায় টোকা।

—‘কি ঘুম ঘুমোচ্ছিস রে ব্রততী, শীগগির খুলে দে।’

অনেক কষ্টে উঠে বসতে পারল ব্রততী। ধীরে সুস্থে মুখে চোখে জল দিল, তারপর গিয়ে দরজা খুলল। ফুরফুরে শাড়ির আঁচল দুপুরের হাওয়ায় উড়ছে। মাথার ঘনকুঞ্চিত চুল বয়কাট। সোজা ঘাড়, ডান দিকে একটা লাল তিল। নীলচে চোখে ভয়।

—‘কবে থেকে এতো দুপুর-ঘুমোনি হলি? শরীর ঠিক আছে তো?’

—‘বেঠিক থাকলে চলে?’

—‘রাগ করেছিস আমার ওপর?’

—‘তোমার ওপর রাগ করা যায়? তুমি সম্রাজ্ঞী। তোমার মর্জিমতো তুমি চলবে, চালাবে। নাই বা হল দিনের বিশ্রাম, রাতের ঘুম! নাই বা হল সাঁঝের খেয়ায় ঘরে ফেরা···’

“রাত্রি মোর শান্তি মোররহিল স্বপ্নের ঘোর

সুস্নিগ্ধ নির্বাণ

আবার চলিনু ফিরেবহি ক্লান্ত নত শিরে

তোমার আহ্বান।”

তীব্র জ্বালাময় আবেগের সঙ্গে বলে থামল ব্রততী। জয়ন্তী রায়ের মুখ দেখে মনে হল কেঁদে ফেলবেন!

—‘ভেতরে ঢুকতে বলবি না?’

দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল ব্রততী।

জয়ন্তী ভেতরে ঢুকে ওর চিবুকে হাত ছুঁইয়ে বললেন—‘অমন করে আমাকে লজ্জা দিবি? দুঃখ দিবি? ব্রততী, আমি কি কোনদিন তোর দিদির মতো কিছু করতে পারিনি? তোকে কি শুধু খাটিয়েইছি? প্রাণভরা ভালোবাসা, আশ্রয়, নিরাপত্তা, আনন্দ, শান্তি কিছুরই উপলক্ষ্য হতে পারিনি। এইট্টি ওয়ানে যখন আবার দেখা হল? ভাবতে পেরেছিলুম আবার দেখা হবে? কিন্তু হল তো! এগুলো সব আমাদের ভাগ্যের নির্দেশ। এই দ্যাখ, তোর মুখার্জির জন্যে কেমন ফন-কালারের সোয়েটার বুনছি।’ ঝোলা থেকে জয়ন্তী রায় আধ-হওয়া। সোয়েটারের খানিকটা অংশ বার করে দেখালেন। খুব কাঙালের মত চেয়ে বললেন—‘ব্রততী, আমি তোর বন্ধু, তোর দিদি, বুঝিস না কেন কিছুতেই!’

—‘কি দরকার এসব কথার?’ ব্রততী আড়ষ্ট স্বরে জবাব দিল।

—‘দরকার আছে বলেই তো বলছি! আমার ওপর বিশ্বাস রাখ্‌।’

ব্রততী একটু চুপ করে রইল, তারপর নিঃশ্বাস ফেলে বলল—‘চা-টা কিছু করে নিয়ে আসি, ঘুমটা ছাড়ছে না।’

জয়ন্তী হাসি-হাসি মুখে ঝোলার ভেতর থেকে একটা ফ্লাস্ক বার করলেন —‘তোর অপেক্ষায় আমি আছি নাকি? তোর পরমার্থদাকে দিলুম, আমাদেরটা ফ্লাস্ককে ভরে নিলুম। যা, শুধু দুটো পেয়ালা-পিরিচ নিয়ে আয়।’

কফিতে চুমুক দিতে দিতে জয়ন্তী বললেন—‘সৌম্য শীর্ষকে আসতে বলিস না কেন রে?’

—‘ওরা আসবে না —ব্রততী অন্যদিকে তাকিয়ে বলল।

—‘আসবে, আসবে। আমার নাম করে ডেকে পাঠা। দিন সাতেক থেকে যাক।’

—‘তুমি কি এই কথাই বলতে এসেছিলে?’

—‘আমি কি আসি না? যখন তখনই তো আসি।’

—‘আজ এই কথাই বলতে এসেছ।’

—‘ধর তাই। ওদের তুই কালই লিখে দে, কিম্বা একটা ফোন কর।’

—‘অত তাড়া কিসের? তাছাড়া, ফোনে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়।’

—‘কেমন মনে হচ্ছে তাড়া করা দরকার। খুব তাড়া। পৃথিবীটা যখন গোল তখন সব শুরুর শেষ যেখানে, সেখান থেকেই আবার শুরুও, তাই না?’

দরজার বাজনা আবার বাজল। ব্রততী চমকে তাকাল। জয়ন্তী বললেন —‘যে-ই হোক না কেন, তোর এতো ফ্যাকাশে হয়ে যাবার কি আছে? তুই কেন ভয় পাস? কোনও বাজে লোক এমন অসময়ে তোর কাছে আসতে সাহস করবে না। দাঁড়া, আমি খুলছি।’

ব্রততী যেখানে ছিল সেখানেই বসে রইল। হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে। দরজার কাছ থেকে চাঁছা-ছোলা গলা ভেসে এলো—‘এখান দিয়েই তো ফ্যাক্টরি ফিরি রোজ, ভাবলাম একবার দেখেই যাই, মুখার্জিসাহেবের গিন্নিকে। একলা থাকেন। দেখ্‌-ভাল তো করা দরকার। তা স্বয়ং স্বামিনী উপস্থিত বুঝতে পারিনি।’

মার্কেটিং ম্যানেজার চৌধুরী। নিচু গলায় দুজনে অনেকক্ষণ ধরে কিসব বলছেন, ব্রততী শুনতে পেল না। শেষে অধৈর্য হয়ে খাট থেকে নামল, দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

ওকে দেখেই চৌধুরী বলল—‘ব্রততী বাঁচাও। আমাকে বাঘিনীতে খেয়ে ফেললে।’

ব্রততী ফিকে হাসল, বলল—‘খাওয়াই উচিত।’

জয়ন্তী বললেন—‘ইয়ার্কি পেয়েছো, না? দুপুর বেলায় মুখার্জি বাড়ি নেই, এখন তুমি ব্রততীর সঙ্গে আড্ডা দেবে, কাজ ফেলে? আর এই ছোট্ট কুয়োর মতো কলোনি, লোকে যা-তা বলবে!’ জয়ন্তী চড় মারার ভঙ্গিতে হাতটা তুললেন।

চৌধুরী বলল —‘ভদ্রমহিলার অপযশ করবার কোনও বদুদ্দেশ্য আমার ছিল না। বিশ্বাস করুন ইয়োর হাইনেস! আমার খালি কদিন মনে হচ্ছে ব্রততীদের মাথাটা ভর্তি হয়ে গেছে। কোন ভাগ্যবান এই দেবদুর্লভ ফ্ল্যাটবাড়িটি পেলেন জানবার জন্যেই ব্রততীর কাছে ছুটে আসা।

—‘কে আবার পাবে? চীফ এঞ্জিনিয়ারের জন্য তৈরি হয়েছিল, তিনিই পেয়েছেন,’— জয়ন্তী মারমুখী এখনও।

—‘চীফ এঞ্জিনিয়ারের জন্যই তৈরি? এক্কেবারে এক্সক্লসিভ? কোন মতেই মার্কেটিং ম্যানেজারের হতে পারে না?’

জয়ন্তী রায় আবার চড় তুললেন—‘তুমি সেই দরের মানুষ? ফাজিল কোথাকার! পরমার্থ রায় তোমার মতো ফাজিল ব্যাচেলরকে যা দিয়েছে খুব দিয়েছে!’

—‘আরে বাবা, আজ ব্যাচেলর বলেই কি আর চিরটাকাল ব্যাচেলর থাকব?’

—‘তোমার গলায় ঘুঁটের মালা ছাড়া আর কিচ্ছু জুটবে না, বুঝলে? সে গুড়ে বালি।’

চৌধুরী বলল—‘তাই ভাবি যেন আমার বিয়ে-সাদির ফুলটি ফুটব ফুটব করেও ফুটছে না কিছুতেই। এখান থেকে একজন যে ক্রমাগত ভাঙচি দিয়ে যাচ্ছে এতদিনে বোঝা গেল। তা চীফ এঞ্জিনিয়ারকে সেদিন দূর থেকে দেখলাম। চেহারাপত্তর বেশ ভালো। প্রসপারাস-লুকিং। নামটা কি সুমন্ত সেনগুপ্ত? ঠিক শুনেছি?’

জয়ন্তী বললেন ‘তুমি আবার ভুল শুনবে? ঠিকই শুনেছো। ও ফ্ল্যাট সেনগুপ্ত ছেড়ে দিলেও তুমি পাছো না। পরমার্থ রায় নিজে নিয়ে নেবে সে ক্ষেত্রে। বুঝলে?’

চৌধুরী দুহাতে একটা হতাশার ভঙ্গি করে বলল—‘চলি তাহলে, ব্রততী।’

জয়ন্তী নিজের ঝোলাটা কাঁধে তুলে নিয়ে বললেন—‘চলি রে, ছেলেদের আসবার সময় হল। না দেখতে পেলে তুলকালাম করবে। তুই ঘুমোগে যা। তোকে ভীষণ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। একটা ভালো দেখে টনিক খা তো! রোজ এই লম্বা ট্রেন-জার্নি! সহ্য হয় না কি? সময় কাটানোটা যদি প্রবলেম হয় তো আমার কফি-ক্লাব কি দোষ করল?’

দু সেকেন্ড উত্তরের অপেক্ষা করে চলে গেলেন ম্যানেজার-গৃহিণী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *