৪
মা যে এমন করে হঠাৎ চলে আসবে তা কল্পনাও করতে পারেনি দীপঙ্কর। দীপঙ্করের কাছে মা শুধু মা-ই নয়, ছিল দীপঙ্করের অস্তিত্ব। মা’কে বাদ দিলে যেন দীপঙ্করের আর কিছুই থাকে না। মা নেই। এ-কথা যেন ভাবতেও পারতো না দীপঙ্কর। সেই মা বাড়িতে এসেছে আর দীপঙ্কর জানতেই পারেনি।
নতুন পাড়ার ডাক্তারবাবুও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন—একটু অসুখ- বিসুখ হবে না তা বলে? আপনি অত ভাবছেন কেন?
দীপঙ্কর বলেছিল—আপনি বলছেন কী ডাক্তারবাবু, মা’র অসুখ, আর আমি ভাববো না?
ডাক্তারবাবু তো জানতেন না যে, মা দীপঙ্করের কতখানি। ডাক্তারবাবু তো জানতেন না মা’কে বাদ দিয়ে দীপঙ্কর নিজের অস্তিত্বও কল্পনা করতে পারে না। কিন্তু আশ্চর্য, মানুষের জীবনে বাপ-মায়ের আয়ু চিরস্থায়ী নয় কারো। বাপ-মা চিরদিন বেঁচে থাকা সুস্থও নয়, স্বাস্থ্যকরও নয়। তবু সেই ক’দিন দীপঙ্করের সে-যুক্তি মনে আসেনি। ডাক্তারখানার ভিড়ের মধ্যে গিয়ে দীপঙ্কর কেমন যেন শিশুর মত অসহায় হয়ে উঠতো।
বলতো—মা’র যে জ্বর এখনও ছাড়ছে না ডাক্তারবাবু, কী হবে?
ডাক্তার বলতেন—অত ভাবছেন কেন? ভাল হয়ে যাবেন ঠিক—
অন্যান্য যারা থাকতো, তারা চেয়ে দেখতো দীপঙ্করের দিকে। এতখানি ব্যাকুলতা, এতখানি অধৈর্য তারা আগে দেখেনি কারো। কিন্তু সেদিকে দীপঙ্করের লক্ষ্য ছিল না। উন্মাদের মত হয়ে উঠেছিল দীপঙ্কর সে-কদিন। কোথা দিয়ে যে সকাল হতো, কোথা দিয়ে যে সন্ধ্যে নামতো টের পেত না। সকাল থেকে অনেক রাত পর্যন্ত নিজের অস্তিত্বটুকুও ভুলে গিয়েছিল।
মা বলতো—তুই অত ভাবিসনি দীপু—
দীপঙ্কর বলতো—তুমি একটু ভালো হয়ে ওঠো মা শিগগির শিগির —
মা বলতো—এইবারে আমি ভাল হয়ে যাবো বাবা—দেখিস্—
প্রথম দিন মা’র অবস্থা দেখে দীপঙ্কর ভয় পেয়ে গিয়েছিল সত্যি-সত্যিই! বলেছিল—এ কি মা, তুমি চলে এলে যে হঠাৎ?
মা বলেছিল—না বাবা, আমি তোকে ছেড়ে থাকতে পারলাম না বাবা সেখানে-
—কিন্তু তুমিই তো যেতে চেয়েছিলে অত করে?
মা বলেছিল—বাড়ির বিশ্বনাথ ছেড়ে আমি কাশীর বিশ্বনাথ নিয়ে কী করবো বাবা-
সন্তোষকাকা এসেই একেবারে রান্নাঘর নিয়ে পড়েছে। বলেছে—বাবাজী, তুমি এদিকে মন দিও না—আমি আছি ক্ষিরি আছে, খাওয়া-দাওয়ার দিকে ভাবতে হবে না তোমাকে। আর বাজারের ব্যাপারটাও আমার হাতে ছেড়ে দাও—আমি বুঝে-সুঝে এমন বাজার করবো, দেখবে কোনও অসুবিধে হবে না তোমার—
সেই যে একদিন সন্তোষকাকা এসেছিল রসুলপুর থেকে, তারপর একেবারে এ- বাড়ির লোক হয়ে গেছে। শুধু এ-বাড়ির নয়, এ-পাড়ার লোকদের সঙ্গেও আলাপ-পরিচয় করে ফেলেছে। সকালবেলাই এক-একদিন গয়লার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে। বলে—দাম পাবে না বাপু তোমার দুধের, এই বলে রাখছি-যা ইচ্ছে করোগে যাও তুমি, দাম তুমি পাবে না—
পাড়ার লোকেরা এ-লোকটাকে চিনে গেছে। বলে—কী দত্তমশাই, কী বাজার করলেন?
সন্তোষকাকা বলে—যাই বলুন, এ দেশ আপনাদের সুবিধের নয়—আড়াইপো আলু বলে কিনা সাত পয়সা! কলকাতা আমার মাথায় থাকুক মশাই—রসুলপুরই আমার ভাল—
কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে—তা রসুলপুরে কবে নাগাদ ফিরছেন?
সন্তোষকাকা বলে—এই ক্ষিরির বিয়েটা দিয়েই যাবো—সামনের অঘ্রাণেই কাজটা করবো ঠিক করেছি—
—তা শুভ কাজ এত দেরি করছেন কেন আর?
—আজ্ঞে, আমার বৌদির আবার ব্যামো হলো কি না? নইলে তো কাজটা আগেই চুকিয়ে ফেলতাম! মা’র অসুখ…ছেলেই বা বিয়ে করে কেমন করে বলুন! দেখেছেন তো, জামাই-এরও মাথার ওপর কর্তা বলতে কেউ নেই—আমাকে দুপক্ষের দিকটা দেখতে হবে!
রাস্তায় চলতে চলতে কথা না বলে থাকতে পারে না সন্তোষকাকা। কেউ ফেরিওয়ালা রাস্তা দিয়ে গেলেই ডাকে। বলে—ওহে, ও ফেরিওয়ালা, কী ওতে? কী বেচছো তুমি?
ফেরিওয়ালা কাছে আসে। মাথার ঝাঁকাটা নামায়। বলে—ছেলে-মেয়েদের খেলনা—
—দেখি, কীরকম জিনিস?
নানা ধরনের পুতুল। রবারের ছোট-ছোট বেলুন, ইঁদুর, খরগোশ। পেট টিপলে ট্যাঁ-ট্যা শব্দ করে। একটা-একটা করে নাড়া-চাড়া করে সন্তোষকাকা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। পেট টেপে। হরেক রকমের জিনিস। বাহারি মাল।
সন্তোষকাকা বলে—কী রকম দাম গো সব?
দাম শুনে চমকে ওঠে। বলে—য়্যাঁ, তোমরা যে ডাকাত দেখছি গো, এইটুকুন-টুকুন খেলনা, এই পলকা জিনিস—চার-আ-না? তুমি যে দিনে ডাকাতি করতে জানো দেখছি। এ তো একবার খেললেই গোল্লায় গেল—
ফেরিওয়ালা বলে—কোন্টা আপনি নেবেন বলুন না—
সন্তোষকাকা বলে—আমি নিতে যাবো কেন, আমি কি ছেলেমানুষ হে? আমার আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই, আমি তোমার এই খেলনা নিয়ে খেলবো ভেবেছ?
লোকটা তো অবাক। বলে-আপনি নেবেন না তো আমাকে ডাকলেন কেন মিছিমিছি?
—মিছিমিছি মানে? মিছিমিছি মানে কী?
সন্তোষকাকা একেবারে আগুন হয়ে যায় রাগে। বলে—মিছিমিছি কথার মানেটা কী? তুমি জিনিস বেচবে আর আমি জিনিসের দর জিজ্ঞেস করতে পারবো না? দর জিজ্ঞেস করাতেই অপরাধ হয়ে গেল?
ফেরিওয়ালা তখন গজ্ গজ্ করতে আরম্ভ করেছে—যদি মাল না কিনবেন তো আমার মালে হাত দিলেন কেন আপনি?
—এই দ্যাখ, মজা তো মন্দ নয়,—
ফেরিওয়ালা বলে—তা তো বলবেনই মজা, আপনারা ভদ্দরলোক, আপনাদের টাকা আছে, আপনারা যা ইচ্ছে করবেন আর আমাদের বলতে গেলেই যত দোষ —
সন্তোষকাকা তখন সত্যি-সত্যিই রেগে যায়। চিৎকার করে বলে—চেঁচিও না, চেঁচিও না, এই তোমায় সাবধান করে দিচ্ছি। খবরদার বলছি ভদ্দরলোকের পাড়ায় চেঁচাবে না, এ কলকাতা শহর, এ পাড়া গাঁ নয় যে যা-ইচ্ছে করবে—
—যা-ইচ্ছে আমি করলুম না আপনি করছেন? আপনিই তো আমার হয়রানি করলেন ঝুটমুট—
—আবার চেঁচায়? জানো, ওপরে বাড়িতে অসুখ, এখানে চেল্লাচেল্লি করো না। এর পর যদি একটু চেঁচাও তো থানা-পুলিসে খবর দেব বলে রাখছি—
থানা-পুলিসের নাম শুনে লোকটা ক্ষেপে ওঠে। সন্তোষকাকাও মেজাজ গরম করে। আর থাকতে পারে না। শেষকালে দুজনের চিৎকারে পাড়া গরম হয়ে ওঠে। আশে- পাশের বাড়ি থেকে দু’চারজন গৃহস্থ লোক বেরিয়ে আসে।
তখন দু’জনে বাগ্-বিতন্ডা চলেছে।
—তোম্ চোপরাও—
—তোম্ চোপরাও—
এর পরেই হাতাহাতি শুরু হয়ে যেত হয়ত। কিন্তু পাড়ার ভদ্রলোকেরা এসে ঠেকায়। বলে—থামুন, করছেন কী?
সন্তোষকাকা বলে—দেখুন না মশাই, লোকটার আস্পর্ধাখানা একবার দেখুন। লোকটা দুপুরবেলা পাড়ার মধ্যে বেমক্কা চেঁচাচ্ছে। আমার দোষের মধ্যে দোষ হয়েছে, আমি ওকে বলেছি, বেশ ভদ্রভাবেই বলেছি যে আমাদের বাড়িতে অসুখ, একটু আস্তে চেঁচা বাবা, তা কথা-নেই-বার্তা-নেই একেবারে গালাগালি—। ভদ্দরলোকের বাড়ি বয়ে গালাগালি দিয়ে যাবে আর আমাদের তাই সহ্য করতে হবে?
সবাই বলে কয়ে ফেরিওয়ালাকে সরিয়ে দিলে। বললে—থাম বাবা, তুমি যেখানে যাচ্ছিলে চলে যাও, এখানে কেউ তোমার খেলনা কিনবে না—
লোকটা চলে গেল। তখন সন্তোষকাকার তেজ দেখে কে! বলে—এই তো, এই করে-করেই আপনারা ওদের মাথায় তুলছেন মশাই, আমাদের রসুলপুরে হলে এতক্ষণ রক্তগঙ্গা বয়ে যেত না!
দীপঙ্কর ওপরে মা’র পাশে বসে ছিল। গোলমাল শুনে সে-ও নিচে নেমে এসেছিল। সদর দরজার বাইরে এসে জিজ্ঞেস করলে—কী হলো?
সন্তোষকাকা হাসলো। বললে—হবে আবার কী বাবাজী! এই তোমাদের কলকাতার ফেরিওয়ালাদের আক্কেলখানা দেখছিলাম—
শেষ পর্যন্ত সব গোলমাল মিটে যায়। সন্তোষকাকা ভেতরে চলে আসে। দীপঙ্কর বলে—আপনি কেন ও-সব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামান কাকাবাবু, ওদের সঙ্গে আপনি ঝগড়া করে পারবেন না!
সন্তোষকাকা বলে—এই দেখ, বাবাজী, তুমিও ভুল করলে! আমি কেন ঝগড়া করতে যাবো ওদের সঙ্গে! আমার ঝগড়া করার দরকার কী! আমি কারো সাতে নেই পাঁচে নেই, আমি চুপ চাপ ঘুরে বেড়াই আর কাঁসি বাজাই! আমার দরকার কী কারো সঙ্গে কথা বলবার! আমার কথা বলতে বয়ে গেছে!
দীপঙ্কর নিজের ঘরে চলে যাবার পরই ক্ষীরোদা কাছে এল। বললে—তুমি কেন সব ব্যাপারে থাকো বাবা—
সন্তোষকাকা ক্ষেপে যায়। বলে—কী? কী বললি তুই? আমি সব ব্যাপারে থাকি? কখন আমাকে তুই সব ব্যাপারে থাকতে দেখলি? কখন থাকতে দেখলি, বল্? বল তুই?
মা বিছানায় শুয়ে শুয়ে বিরক্ত হয়। বলে—দীপু নিচেয় গোলমাল হচ্ছে কিসের রে?
দীপঙ্কর বলে—ও কিছু না মা, ও কিছু না—
এমনি রোজই একটা-না-একটা গোলমাল বাধে বাড়িতে। সামান্য উপলক্ষকে কেন্দ্ৰ করে গোলমাল বাধাতে সন্তোষকাকার জুড়ি নেই। খেতে বসে সন্তোষকাকা মেয়েকে বকাবকি করে—এ কী রেঁধেছিস রে ক্ষিরি? কী ছাই রেঁধেছিস্ শুনি? দীপু এ-ছাই-এর রান্না খেতে পারবে? তেল না দিরে চচ্চড়ি হয়? খাবো না, আমি—এই আমি উঠলুম—
বলে সত্যি-সত্যিই উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে সন্তোষকাকা।
ক্ষীরোদা রান্নাঘর থেকে দৌড়ে আসে। গলা নামিয়ে বলে—বাবা, তুমি কী বল তো, তোমার কি একটুও জ্ঞান নেই। দেখছো জ্যাঠাইমার অসুখ, আর তুমি চেঁচাচ্ছ এমন করে?
সন্তোষকাকা আরো জোরে বলে—চেঁচাবো না? চেঁচাবো না তো কী করবো। এই ছাই পাঁশ খাওয়া যায়? আমি যে হাঁড়ি হাঁড়ি তেল নিয়ে আসি বাজার থেকে, সে এই ছাই পাঁশ রান্নার জন্যে? এই দিয়ে দীপু কী করে খাবে বল্ দিকিনি? এ কেউ খেতে পারে?
আপিসে যাবার আগে সন্তোষকাকা সামনে আসে। বলে—কী রকম রান্না বাবাজী? খেতে কিছু অসুবিধে হচ্ছে না তো?
দীপঙ্কর বলে—না—
সন্তোষকাকা বলে—ক্ষিরি রাঁধে ভাল বাবাজী। বুঝলে, রান্নাটা করে ভাল। আমি তো তাই বলি—ক্ষিরি তোর রান্নাটা ঠিক তোর মায়ের মত হয়েছে—দেখবে, বিয়ের পর তোমার কোনও অসুবিধে হবে না। ও ভাত ক’টা আর ফেলে রেখো না, খেয়ে ফেল—
সন্তোষকাকা আসার পর থেকে বাজার করা, তদারক করা সমস্তই সন্তোষকাকা নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিয়েছে। কোনও দিকেই দীপঙ্করকে দেখতে হয় না আর। প্রথম প্রথম মার অসুখের জন্যে আপিসে যাবার ইচ্ছে ছিল না দীপঙ্করের। মা বলেছিল—না বাবা, আমার জন্যে আপিসে যাওয়া বন্ধ কোর না। আমি দু’দিনের মধ্যেই ভালো হয়ে যাবো—
আপিসে যাবার আগে দীপঙ্কর সন্তোষকাকাকে বলে গিয়েছিল—আপনি একটু মাকে দেখবেন কাকা, পাশে থাকবেন সারাদিন—তারপর আমি আপিস থেকে এসে আবার দেখবো—
.
আপিসে গিয়েই সেদিন গাঙ্গুলীবাবুকে ডেকে পাঠিয়েছিল। গাঙ্গুলীবাবু প্রথমে টাকা নিতে চায়নি। বলেছিল—কিন্তু আপনি কেন টাকা দিচ্ছেন সেনবাবু? আমার এ-অভাব তো ঘুচবে না জীবনে—
দীপঙ্কর বলেছিল—তা হোক, ধার হিসেবেই নিন্, ইচ্ছে হয় শোধ করবেন, আর না-পারলে শোধ করবেন না—
আটশো টাকা গাঙ্গুলীবাবু গুনে গুনে নিয়েছিল। গাঙ্গুলীবাবু যাবে, গাঙ্গুলীবাবুর স্ত্রী যাবে, গাঙ্গুলীবাবুর ছোট পাঁচ বছরের মেয়েও যাবে সঙ্গে।
টাকা ক’টা পকেটে পুরে গাঙ্গুলীবাবু বললে—কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আপনাকে আর ছোট করবো না সেনবাবু, কিছুই আমার বলবার নেই আপনাকে—
দীপঙ্কর বললে—গিয়ে যদি সময় পান তো চিঠি দেবেন। জানাবেন কেমন থাকেন আপনার স্ত্রী—
তারপর ছুটি নিয়ে পাস নিয়ে একদিন চলে গেল গাঙ্গুলীবাবু। কোথায় কত-দূরে কাশ্মীর! দীপঙ্কর নিজে কখনও কাশ্মীর যায়নি। হয়ত যাবেও না কোনদিন। কিন্তু দীপঙ্করের বড় তৃপ্তি হলো। মনে হলো দীপঙ্কর নিজেও যেন মুক্তি পেলে। সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্তি। সমস্ত গ্লানি থেকে মুক্তি। আপিসে সেদিন বড় আনন্দে কাটলো বহুদিন পরে। মনে হলো যেন দীপঙ্কর বহুদিন পর পবিত্র হলো। গাঙ্গুলীবাবু জানতেও পারলে না তাকে টাকা দিয়ে দীপঙ্কর কোন্ স্বর্গরাজ্য হাতে পেলে। মনে হলো সবাইকে যেন আজ ক্ষমা করতে পারে দীপঙ্কর। সমস্ত দিনটাই কেমন ভাল লাগতে লাগলো। আপিসে যে কাছে এল, সে-ই সেন-সাহেবের মেজাজ দেখে খুশী হলো। সুধীরবাবুকে ডেকে গাঙ্গুলীবাবুর ফাইলটা আনিয়ে নিলে। এতদিন পরে ক্ষমতা এসেছে দীপঙ্করের হাতে। এতদিনের অন্যায়ের প্রতিকার করতে হবে।
সুধীরবাবু বললে—কিন্তু স্যার, আপনি যে নোট দিচ্ছেন, এ নোটে তো কাজ হবে না—
—কাজ হবে না মানে?
সুধরিবাবু বললে—জার্নাল সেকশ্যানে তো গ্রেড্ তৈরি করতে হবে—গ্রেড্ যাতে হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে—
—যা করতে হবে করে ফেলুন।
—কিন্তু তাহলে তো ক্রফোর্ড সাহেবের স্যাংশান্ চাই-—
—তা স্যাংশান্ নিন্ আপনি! এতদিন স্যাংশান্ নেনি কেন? আপিসে কোথায় ইন্জাটিস্ হচ্ছে, কোথায় অবিচার হচ্ছে, সে-সব দেখা তো আপনাদেরই কাজ! এমন অনেক স্টাফ্ আছে যাদের প্রমোশন হওয়া দরকার, তাদের প্রমোশন দিতে হবে!
সুধীরবাবু বললে—তা দিতে তো আমাদের আপত্তি নেই স্যার! এখন ঘোষাল সাহেব এই সব ফাইল দেখছেন। তিনি যদি ক্রফোর্ড সাহেবকে দিয়ে স্যাংশান্ করান তো আমার আপত্তি নেই।
দীপঙ্কর বললে—আপনি মিস্টার ঘোষালের কাছে আমার নোট পাঠিয়ে দিন, তারপর আমার যা বলবার আমি বলবো—
ফাইলটা নিয়ে সুধীরবাবু চলে গেল। সমস্ত আপিসময় তোলপাড় পড়ে গেল সেদিন। গাঙ্গুলীবাবু গ্রেড্ পেয়ে যাচ্ছে। সেন-সাহেব নোট দিয়েছে। শুধু তাই নয়। সকলের জন্যে গ্রেডের ব্যবস্থা করতে বলেছে। কাজের জন্যে উৎসাহ না পেলে মানুষ কাজ করবে কেন? রবিনসন সাহেব নিজে যা করতে পারেনি, দীপঙ্কর একবার শেষবারের মত করবার চেষ্টা করবে! প্রাণমথবাবু বলেছেন—অবিচার দেখলে দূরে সরে দাঁড়ালে চলবে না। অবিচারের প্রতিকার করতে হবে। পালিয়ে গেলে সমস্যার সমাধান হয় না। সমস্যার সঙ্গে লড়াই করতে হয়। ক্ষমতা তার কেড়ে নেওয়া হয়েছে সত্যি কথা, কিন্তু ক্ষমতা আদায় করে নিতে হবে। সত্যিই তো, মর্যাদা কেই কাউকে দেয় না, মর্যাদা জোর করে আদায় করে নিতে হয়। মর্যাদা কেড়ে নিতে হয়! আদায় করত গেলে যদি ক্ষতি হয় দীপঙ্করের তো হোক!
যাবার দিন গাঙ্গুলীবাবু এসেছিল আপিসে। শেষবারের মত দেখা করে গেল। বললে—তাহলে কাল যাচ্ছি সেনবাবু অনেক ধন্যবাদ—
দীপঙ্কর বললে—আসুন—
গাঙ্গুলীবাবু বললে—চিরকাল আপনার কথা মনে থাকবে সেনবাবু, আপনি পরের দুঃখ বুঝতে পারেন, পরের ব্যথা অনুভব করতে পারেন, সবাই যদি আপনার মত হতো—
দীপঙ্কর বললে—সেখানে গিয়ে যদি আরো টাকার দরকার হয় তো আমায় টেলিগ্রাম করবেন, লজ্জা করবেন না—
গাঙ্গুলীবাবু বললে—আর টাকার দরকার হবে না সেনবাবু, শীতের জামা-কাপড় যা দরকার সবই কেনা হয়ে গেছে—এখন শুধু ওখানে থাকবার খরচটা—তা এতেই কুলিয়ে যাবে—
পৃথিবীর কোটি কোটি লোকের কেউই জানলো না, জার্নাল সেকশ্যানের এ-বি গ্রেড্ ক্লার্ক পি কে গাঙ্গুলী সেদিন মুক্তি পেলে তার ষোল বছরের বন্ধন থেকে। কোটি কোটি লোকের কেউই জানলে না যে তাদেরই মত একজন নগণ্য মানুষ সমস্ত দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে হাওড়া স্টেশন থেকে রাত্রি আটটার এস্প্লস্ ট্রেনে স্ত্রী-কন্যা নিয়ে দীর্ঘযাত্রার পাড়ি দিলে। স্টেশনের লোহার ঘন্টা ঢং ঢং করে নির্দেশ দিলে বিদায়ের। ইঞ্জিনের বাঁশী বেজে উঠলো। হুইস্ল বাজালো গার্ড সাহেব।
দীপঙ্করও মুক্তির নিশ্বাস ফেললে। একটা মানুষকেও তো কয়েকদিনের মুক্তি দিতে পেরেছে সে।
আজ এতদিন পরে সব ঘটনা ভাবতে গিয়ে সমস্ত খুঁটিনাটিগুলোও মনে পড়ছে সঙ্গে সঙ্গে! দীপঙ্করের বোধহয় অহঙ্কারই হয়েছিল সেদিন। পি কে গাঙ্গুলী যেন দীপঙ্করেরই আর এক সত্তা। দীপঙ্করই যেন জার্নাল সেকশ্যানের পি কে গাঙ্গুলীর মধ্যে এতদিন বন্দী হয়ে কারাবাস করছিল। প্রমোশন হয়েও যেন দীপঙ্করের বন্দী আত্মার মুক্তি হয়নি। আপিস থেকে বেরোবার পর কেমন যেন হাল্কা-হাল্কা মনে হলো সমস্ত কিছু। দীপঙ্করের যে-সত্তা সতীর মধ্যে বন্দী হয়ে আছে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে, যে-সত্তা লক্ষ্মীদির মধ্যে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে বিরাজ করছে গড়িয়াহাটের গলিতে, যে-সত্তা মিস্ মাইকেলের উদগ্র আকাঙ্ক্ষার মধ্যে ছট্ফট্ করছে ফ্রি-স্কুল স্ট্রীটে, যে-সত্তা তার মা’র মধ্যে স্থিতিশীল হয়ে আছে স্টেশন রোডের বাড়িতে, সব যেন ছুটি পেয়ে গেল এই একটা ফাঁকের মধ্যে দিয়ে। দীপঙ্করের সবগুলো সত্তা যেন বন্দীত্ব ঘুচিয়ে বন্ধন ঘুচিয়ে উধাও হয়ে গেল উন্মুক্ত আকাশের অবাধ স্বাধীনতায়। মনে হলো তার যে-সত্তা কিরণের মধ্যেও সম্ভাবনা হয়ে লুকিয়ে ছিল, তাও যেন সফলতার শিকরে গিয়ে পৌঁছুলো আজ। মনে হলো যেন পি কে গাঙ্গুলী নয়, দীপঙ্করই গার্ডের বাঁশীর সঙ্গে সঙ্গে মুক্তি পেয়ে গেল হাওড়া-স্টেশনের খাঁচা থেকে।