কঠিন শাস্তি
দুই বন্ধুই ক্লাস নাইনে পড়ে, কিন্তু আলাদা ইস্কুলে৷ ওদের মধ্যে টিটো খুব খেলাধুলো ভালোবাসে৷ পড়ার বই ছাড়া বাইরের বই বিশেষ পড়ে না, বড়জোর দু-একটা ইংরেজি কমিকস৷ আর পাপান খেলার মাঠে বিশেষ যায় না, যখনই একটু সময় পায় অমনই একটা গল্পের বই নিয়ে বসে৷ এমনকী একবার টিটোর সঙ্গে ক্রিকেট খেলা দেখতে গিয়েও পাপান একটা ডিটেকটিভ বই পড়ে শেষ করে ফেলেছিল৷ পাপান ইংরেজি বইও পড়ে৷ বাংলা বইও পড়ে৷
এখন একটানা দশদিন স্কুল ছুটি৷ সকালবেলা পড়াশোনা শেষ করে টিটো যায় ব্যাডমিন্টন খেলতে, আর পাপান বড় রাস্তার মোড়ে একটা বইয়ের দোকানে এসে নতুন-নতুন বই দেখে, একটা-দুটো কেনে৷ যাওয়া-আসার পথে রোজই প্রায় এক জায়গায় ওদের দু’জনের দেখা হয়ে যায়৷ গল্প হয় খানিকক্ষণ৷ টিটো বলে আগের দিনের ব্যাডমিন্টন ম্যাচে একজনকে হারিয়ে দেওয়ার কথা, আর পাপান বলে, ‘‘কাল রাত্তিরে একটা দারুণ বই পড়লুম, জানিস!’’
সকাল সাড়ে দশটায় ফুটপাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছে টিটো আর পাপান৷ টিটোর হাতে ব্যাডমিন্টনের র্যাকেট, পাপানের হাতে দু’খানা বই৷ পাশেই একটা ব্যাংক, সামনের রাস্তায় তিন-চারখানা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে৷
গল্পে-গল্পে ওরা যখন মশগুল, তখন ব্যাংক থেকে বেরিয়ে এল একজন লোক৷ বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা, স্যুট-টাই পরা, মাথায় আধখানা টাক৷ মুখে একটা কেউকেটা ভাব৷ লোকটির হাতে একটা চাবি, সেই চাবি দিয়ে একটা গাড়ির দরজা খুলতে গিয়ে হঠাৎ মুখ তুলে সে টিটো আর পাপানের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলল, ‘‘অ্যাই, আমার গাড়িতে ঠেসান দিয়েছিস কেন রে? সরে যা! সরে যা!’’
কথা বলতে-বলতে অন্যমনস্কভাবে পাপান একটা নীল রঙের গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল ঠিকই৷ তাতে কী হয়েছে, গাড়িটা ক্ষয়ে গেছে নাকি? একজন অচেনা লোক তাদের তুই বলবে কেন?
পাপান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গাড়িটা থেকে সরে গেল খানিকটা৷ লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘আপনার গাড়িটা ছুঁয়ে ফেলেছি, এজন্য দুঃখিত!’’
লোকটি গাড়িতে ঢুকতে গিয়েও এদিকে চলে এল৷ গাড়িটা যেন একটা পোষা জন্তু, এইভাবে এক জায়গায় হাত বুলোতে গিয়ে চমকে উঠল৷ গর্জন করে বলল, ‘‘আমার গাড়িতে আঁচড় কেটেছিস? গাড়িটা নষ্ট করে দিয়েছিস!’’
পাপান সেদিকে তাকাল, গাড়িটার গায়ে সে কোনও দাগ দেখতে পেল না৷ তা ছাড়া গাড়ির গায়ে সে আঁচড় কাটতে যাবে কেন? তাও অন্যের গাড়িতে? একটুখানি পিঠটা ঠেকিয়েছিল শুধু৷
লোকটি রাগে গরগর করতে-করতে বলল, ‘‘যত সব বিচ্ছু ছেলে! বদমাশ!’’
এবার টিটো বলল, ‘‘আপনি গালাগাল দিচ্ছেন কেন? আপনার গাড়ির কোনও ক্ষতি করা হয়নি!’’
লোকটি প্রচণ্ড জোরে চেঁচিয়ে বলল, ‘‘চোপ!’’
তারপর দুটো হাতের পাঞ্জা ঠিক থাবার মতন ওদের দু’জনের মুখের ওপর রাখল৷ এক ধাক্কায় ওদের দু’জনকেই ফেলে দিল মাটিতে৷ কঠিন ফুটপাথে মাথা ঠুকে গেল টিটো আর পাপানের৷
ওরা আবার উঠে দাঁড়াবার আগেই লোকটি গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেল৷
টিটো আর পাপানের যত না ব্যথা লেগেছে, তার চেয়েও ওরা আহত হয়েছে বেশি৷ বিনা দোষে একজন লোক ওদের গায়ে হাত দিল? এর আগে কেউ কোনওদিন ওদের সঙ্গে এরকম খারাপ ব্যবহার করেনি৷ ওরা কোনওদিন মারই খায়নি!
কলকাতার রাস্তায় এরকম কত কী ঘটে, অন্য কেউ ভ্রূক্ষেপও করে না৷ কত লোক হেঁটে যাচ্ছে, পাশ দিয়ে গাড়ি চলে যাচ্ছে৷ একদম কাছাকাছি দু-চারজন লোক ওদের ওরকমভাবে পড়ে যেতে দেখে একটু ভুরু কুঁচকে তাকাল, তারপর চলে গেল যে-যার নিজের কাজে৷ কেউ সেই লোকটিকে একটু বাধাও দিল না, কিছু জিজ্ঞেসও করল না৷
টিটো আর পাপান গায়ের ধুলো ঝেড়ে হতবাক হয়ে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইল পরস্পরের দিকে৷ এটা কী হল? কেন লোকটা এরকম অসভ্যের মতন ব্যবহার করে চলে গেল? লোকটা কে?
ব্যাংকের গেটে একজন বন্দুকধারী দরোয়ান থাকে৷ সে বন্দুকটা পাশে শুইয়ে রেখে নিশ্চিন্ত মনে খইনি খাচ্ছে৷ টিটো তার কাছে গিয়ে বলল, ‘‘এইমাত্র যে-লোকটি বেরোল ব্যাংক থেকে, তাকে আপনি চেনেন? এখানে প্রায়ই আসে?’’
দরোয়ান ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করল, ‘‘কোন লোক? কত লোক তো যাচ্ছে আর আসছে!’’
টিটো বলল, ‘‘বেশ লম্বা, খয়েরি স্যুট পরা৷’’
দরোয়ান বলল, ‘‘স্যুট এখন সবাই পরে৷ শীত পড়েছে, স্যুট পরবে না!’’
বোঝা গেল, এর কাছ থেকে কোনও সাহায্য পাওয়া যাবে না৷
পাপান বলল, ‘‘আমি গাড়ির নম্বরটা দেখেছি৷ 9837, তবে আগে কী ছিল? WMF, না WMB?
টিটো বলল, ‘‘আমি দেখিনি৷ আর ওকে ধরা যাবে না!’’
পাপান চোয়াল শক্ত করে বলল, ‘‘ওকে খুঁজে বার করতেই হবে৷ অকারণে একটা লোক অন্যায় করে যাবে? ওকে শাস্তি পেতেই হবে! ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে…’ তুই এই কবিতাটা পড়িসনি, টিটো?’’
টিটো বলল, ‘‘কিন্তু ওকে খুঁজে পাব কী করে?’’
পাপান বলল, ‘‘পৃথিবীর যেখানেই থাকুক, ওকে আমরা ঠিক খুঁজে বার করব৷ ওর মুখটা যেন ভুলে যাস না৷ দাঁড়া, একটু চোখ বুজে ওর মুখের ছবিখানা মনে গেঁথে রাখি৷’’
টিটো বলল, ‘‘ওর মুখটা আমার মনে না থাকলেও, দেখলেই চিনতে পারব৷’’
তারপর থেকে ওই ব্যাংকের সামনেটায় নজর রাখে দু’বন্ধুই৷ যদি সেই লোকটি বা গাড়িটাকে দেখা যায়! ব্যাংকটার সামনে দিয়ে মাঝে-মাঝে দু’জনেই হাঁটে৷ অন্য সময়েও রাস্তার যে-কোনো গাড়ির নম্বরটা ওরা একবার দেখে নেয়৷ লম্বা-চওড়া, খয়েরি কোটপরা একজন লোককে পেছন থেকে দেখে পাপান অনেকখানি ছুটে গেল তার মুখটা দেখার জন্য৷ সে অন্য লোক৷
লোকটি আর ব্যাংকে আসে না৷ রোজ-রোজ কেই-বা ব্যাংকে যায়৷ তবে পাঁচদিন পর অন্য একটি সুযোগ পাওয়া গেল৷
পাপান টিকিট কাটতে গিয়েছিল গ্লোব সিনেমায়৷ হঠাৎ তার নজর পড়ল একটা গাড়ির নম্বরের দিকে৷ 9837, তবে আগের অক্ষরগুলো WMD৷ আগের অক্ষরগুলো মেলাটাই বেশি দরকার, একই নম্বরের অনেক গাড়ি থাকতে পারে৷ কিন্তু এ-গাড়ির রংটাও নীল৷ গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে নিউ মার্কেটের সামনে৷
যদি এই গাড়িটাই সেই লোকটার হয়? কিন্তু পাপান একা-একা সেই লোকটাকে দেখতে পেলেই বা কী করবে? কী করে শাস্তি দেবে? টিটোকে একটা খবর দেওয়া দরকার৷ টিটোদের বাড়িতে টেলিফোন আছে৷
একটা দোকান থেকে ফোন করল পাপান৷ টিটো জিজ্ঞেস করল, ‘‘তুই ঠিক জানিস ওটা সেই গাড়ি? নীল রঙের অ্যামবাসাডর গাড়ি তো কতই আছে!’’
পাপান একটু দুর্বলভাবে বলল, ‘‘না, একেবারে ঠিক বলতে পারছি না৷ অন্য গাড়িও হতে পারে৷ কিন্তু যদি সেই গাড়িটাই হয়? গাড়িটাকে ফলো করলে সেই লোকটার বাড়িটা চিনে আসা হবে৷’’
টিটো বলল, ‘‘ঠিক আছে, তুই নজর রাখ৷ আমি আসছি!’’
একটু দূরে, অন্য একটা গাড়ির আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল পাপান৷ টিটোর আসতে কুড়ি-পঁচিশ মিনিট লাগবেই৷ তার আগেই যদি লোকটা বেরিয়ে আসে নিউ মার্কেট থেকে? অতবড় লোকটার সঙ্গে পাপান গায়ের জোরে পারবে না৷ তবে ছুটে গিয়ে পেছন থেকে একটা ল্যাং মেরে আছাড় খাওয়াতে পারে৷ তাতেই অনেকটা প্রতিশোধ নেওয়া হবে৷ কিন্তু ওর সঙ্গে যদি অন্য লোক থাকে?
ঠিক তাই৷ টিটো এসে পৌঁছবার আগেই নিউ মার্কেট থেকে বেরিয়ে এল সেই লোকটি৷ হ্যাঁ, কোনও ভুল নেই, সেই লোকটাই বটে৷ তার সঙ্গে রয়েছে আরও দু’জন লোক৷ তারা নীল গাড়িটার দিকেই এগিয়ে আসছে হাসতে-হাসতে৷ হাতে কয়েকটা প্যাকেট৷ পাপানের মনটা দমে গেল৷ এখনই তো ওরা গাড়িতে উঠে চলে যাবে, সে কী করবে?
লোকটিকে ভালো করে দেখবার জন্য পাপান অনেকটা কাছে এগিয়ে এল৷
সেই আসল লোকটাই গাড়ি চালাবে৷ একটা ভিখিরি বুড়ি জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল তার কাছে৷ লোকটা ধমকে উঠল, ‘‘এই যা! সরে যা!’’
বুড়ি তবু সরে না৷ ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল৷
তারপরের ব্যাপারটা দেখে আঁতকে উঠল পাপান৷ লোকটা সাঁ করে কাচ তুলে দিল গাড়ির জানলার৷ তাতে আটকে গেল ভিখিরি বুড়িটার হাত৷ বুড়িটা যন্ত্রণায় চিৎকার করে, ‘ওরে বাবা রে, মরে গেলাম রে’ বলতে লাগল, আর ভেতরে সেই লোকগুলো খলখল করে হাসছে৷
ঠিক এই সময় টিটো এসে ডাকল, ‘‘পাপান!’’
কাছেই একটা ট্যাক্সি থেমেছে, তার মধ্যে বসে আছে টিটো৷ পাপান দৌড়ে এসে ট্যাক্সিতে উঠে পড়ে বলল, ‘‘সেই গাড়ি, সেই লোক৷ ওকে ফলো করে বাড়িটা দেখে আসতে হবে৷’’
জানলার কাচ আবার নামিয়ে নীল গাড়িটা এবার স্টার্ট দিয়েছে৷
পাপান উত্তেজিতভাবে বলল, ‘‘ওই লোকটা, ওই লোকটা, ওর মতন খারাপ লোক আমি পৃথিবীতে আর দেখিনি৷ একটা ভিখিরিকে শুধু-শুধু কী কষ্ট দিল! ওকে ছাড়া হবে না, ওকে শাস্তি দিতেই হবে!’’
টিটো ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বলল, ‘‘আপনি আবার চলুন, শিগগির!’’
ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, ‘‘কোন দিকে যাব?’’
টিটো আর কিছু বলবার আগেই পাপান বলল, ‘‘ডান দিকে ঘুরিয়ে নিন৷’’
সে একটা গল্পের বইয়ে পড়েছে যে, অল্পবয়সি ছেলেরা কোনও ট্যাক্সিতে চেপে অন্য কোনও গাড়ি ফলো করতে বললে ট্যাক্সি-ড্রাইভাররা সন্দেহ করে৷ যেতে চায় না৷ সেইজন্য পাপান শুধু আগের গাড়িটা দেখে-দেখে বলতে লাগল, ‘‘ডান দিকে, এবার বাঁ দিকে৷’’
বেশ কয়েক মিনিট কেটে যাওয়ার পর টিটো ফিসফিস করে বলল, ‘‘গাড়িটা কত দূর যাবে রে? ট্যাক্সিভাড়া অনেক হয়ে গেলে কী করে দেব? আমার কাছে বেশি পয়সা নেই৷ তোর কাছে আছে?’’
পাপান বলল, ‘‘আমার কাছে তো পাঁচ টাকার বেশি নেই!’’
টিটো বলল, ‘‘এর মধ্যেই পনেরো টাকা উঠে গেল, আমার কাছে আছে মাত্র দশ টাকা৷’’
পাপান বলল, ‘‘একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবেই৷ এখন আর ওকে ছাড়লে চলবে না৷’’
নীল গাড়িটা এসে থামল টালিগঞ্জে, বড় রাস্তা ছেড়ে একটা ছোট রাস্তায় ঢুকে একটা পাঁচিল-ঘেরা বাড়ির সামনে৷ পাপান আর টিটো নেমে পড়ল একটু দূরে৷ ট্যাক্সি ড্রাইভারকে একটু অপেক্ষা করতে বলে ওরা ঠিকানা খোঁজার ভান করে একটু-একটু করে এগোতে লাগল৷
সন্ধে হয়ে এসেছে৷ এ-রাস্তাটা অন্ধকার অন্ধকার মতন৷ সেই বাড়িটার সামনে একটা লোহার গেট, ভেতরে একজন দরোয়ান বসে আছে৷ লোক তিনটে ভেতরে ঢুকে গেছে, ভেতরটায় কিছু দেখা যাচ্ছে না৷
এ তো বেশ বড়লোকের বাড়ি৷ এখন কী করা যায়?
পাপান ভাবল, লোকটা এমন বড়লোক হয়েও একটা বুড়ি ভিখিরিকে অমন কষ্ট দেয়? পাষণ্ড! ওকে শাস্তি দিতেই হবে!
বাড়িটার সামনে এমনই ঘোরাঘুরি করা যায় না৷ ট্যাক্সি ড্রাইভার হর্ন দিচ্ছে৷ পাপান ঠিক করে ফেলেছে যে, ওই ট্যাক্সিতেই বাড়ি ফিরতে হবে, না হলে ভাড়া দেবে কী করে? বাড়িতে গিয়ে দাদার কাছে টাকা চাইতে হবে৷ দাদা যদি এখন বাড়িতে না থাকে, তা হলে মায়ের কাছে!
টিটো বলল, ‘‘এখন আর তো কিছু করার নেই৷ বাড়িটা তবু চেনা হল৷’’
পাশ থেকে গায়ে চাদর জড়ানো একটি লম্বামতন ছেলে জিজ্ঞেস করল, ‘‘তোমাদের কী চাই ভাই? কাকে খুঁজছ?’’
টিটো বলল, ‘‘কিছু চাই না৷ একটা ঠিকানা খুঁজছি৷ আমার এক বন্ধু থাকে পঁয়তাল্লিশ নম্বর বাড়িতে, কিন্তু সে তো ওরকম লোহার গেটওয়ালা বাড়ি বলেনি, এমনই সাধারণ দোতলা বাড়ি৷ ওই বাড়িটা কার বলতে পারেন?’’
লম্বা ছেলেটি বিরক্ত ভাব করে বলল, ‘‘ওটা তো রঘু চৌধুরীর বাড়ি৷ কেন, তার সঙ্গে তোমাদের কী দরকার?’’
পাপান বলল, ‘‘না, না, কোনও দরকার নেই৷ এমনই জিজ্ঞেস করছিলাম৷’’
ছেলেটি বলল, ‘‘মহা-পাজি লোক! লোককে ঠকিয়ে-ঠকিয়ে অত বড় বাড়ি করেছে৷ এটা আগে ছিল একজন বিধবা ভদ্রমহিলার, তিনি হঠাৎ মারা গেলেন৷ তারপর বাড়িটা রঘু চৌধুরীর হয়ে গেল৷ লোকে বলে, ওই রঘু চৌধুরীই বিধবা মহিলাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে!’’
টিটো চোখ বড়-বড় করে বলল, ‘‘খুন? ওকে পুলিশে ধরেনি?’’
ছেলেটি বলল, ‘‘ওর সব বড়-বড় লোকের সঙ্গে চেনা আছে৷ কী সব কলকাঠি নেড়েছে, কেউ ওকে ছুঁতেও পারেনি!’’
টিটো আবার জিজ্ঞেস করল, ‘‘আপনারা পাড়ার লোক কিছু করতে পারেননি? ওকে শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল না?’’
ছেলেটি বলল, ‘‘ওকে ধরা-ছোঁওয়া অত সহজ নয়৷ আমরা কিছু করতে গেলে আমাদেরই পুলিশে ধরিয়ে দেবে৷ জানো, আমি ওর কাছে একবার চাকরি চাইতে গিয়েছিলাম৷ আমার কথা ভালো করে শুনলই না, দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিল, কুকুর লেলিয়ে দিল!’’
ট্যাক্সিওয়ালা অধৈর্য হয়ে গেছে, ওদের উঠে পড়তে হল৷ ফেরার পথে আগাগোড়া গম্ভীর হয়ে রইল পাপান৷
এর পর দু-তিনদিন দুই বন্ধু দেখা হলেই ওই রঘু চৌধুরীকে নিয়ে আলোচনা করে৷ লোকটা অসভ্য, নিষ্ঠুর, খুনি, অথচ তাকে কেউ শাস্তি দিতে পারে না! একটা খারাপ লোক মানুষের ক্ষতি করে ঘুরে বেড়াবে, এত বড় বাড়িতে থাকবে, অথচ কেউ জানতে পারবে না তার আসল রূপটা? একটা কিছু করতেই হবে, কিন্তু কী করা যায়?
ওরা দু’জন মাঝে-মাঝে চলে আসে টালিগঞ্জে৷ সেই বাড়িটার সামনে ঘোরাঘুরি করে৷ দু-একবার রঘু চৌধুরীকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতেও দেখেছে৷ একবার রঘু চৌধুরীর সঙ্গে পাপানের চোখাচোখিও হয়ে গেল৷ কিন্তু রঘু চৌধুরী তাকে চিনতেও পারল না৷ ও নিশ্চয়ই অনেক, অনেক লোকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে, তাদের মুখ মনে রাখতে পারে না৷
ওরা খবর জোগাড় করল যে, রঘু চৌধুরী এ-পাড়ার দুর্গাপুজো, কালীপুজোর সময় অনেক টাকা চাঁদা দেয়৷ তাই কেউ তাকে ঘাঁটায় না৷ তবে একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দুটি ছেলে বলছিল, রঘু চৌধুরী আসলে স্মাগলার, তাই ওর এত টাকা!
একদিন সকালবেলা ওই বাড়ির লোহার গেটের পাশ দিয়ে যেতে-যেতে ওরা দেখল, ভেতরে একটা সুন্দর সবুজ লন৷ সেখানে দুটি ফুটফুটে ছেলে, পাপানদের চেয়ে অনেক ছোট৷ মনে হয় ক্লাস ফোর আর ফাইভে পড়ে, একটা বল নিয়ে খেলছে, আর তাদের সঙ্গে খেলায় যোগ দিয়েছে রঘু চৌধুরী আর একটা কুকুর৷ বাবা ছেলেদের সঙ্গে খেলছে আর সবাই মজা করে হাসছে৷ এক-একবার ছোট ছেলেটাকে কাঁধে তুলে নিচ্ছে রঘু চৌধুরী৷ কুকুরটা লাফাচ্ছে পাশে৷
কী সুন্দর দৃশ্য! মনে হয় কী আনন্দময় এই বাড়ি৷ রঘু চৌধুরী তার ছেলেদের সঙ্গে এত ভালো ব্যবহার করে, আর খুব খারাপ ব্যবহার করে বাইরের লোকদের সঙ্গে৷
সেদিন ফেরার পথে টিটো বলল, ‘‘আর টালিগঞ্জে এসে কী হবে রে পাপান? কিছুই তো করা যাবে না!’’
পাপান বলল, ‘‘আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে৷’’
টিটো সঙ্গে-সঙ্গে উৎসুকভাবে বলল, ‘‘কী?’’
পাপান বলল, ‘‘ওকে বেনামী চিঠি লিখব! ওপরে একটা মানুষের মাথার খুলি এঁকে লিখব, ‘সাবধান রঘু চৌধুরী! তুমি যদি পাপ কাজ বন্ধ না করো, তা হলে তোমার মুন্ডু উড়ে যাবে! ইতি মেঘনাদ!’ মেঘনাদের তলায় একটা জ্বলন্ত তির আঁকা থাকবে!’’
টিটো বলল, ‘‘এই চিঠি পেলে ও হাসতে-হাসতে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দেবে! মোটেই ভয় পাবে না৷’’
পাপান বলল, ‘‘কেন ভয় পাবে না? তুই কী করে জানলি ওদের বাড়িতে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট আছে?’’
টিটো বলল, ‘‘সব বাড়িতেই থাকে৷ শুধু চিঠি পড়ে ভয় পাবে কেন? মুন্ডু ওড়াবার ক্ষমতা যে তোর আছে, তার কোনও প্রমাণ দিতে পারবি?’’
পাপান বলল, ‘‘আরও বেশি ভয় দেখিয়ে চিঠি লিখব!’’
টিটো বলল, ‘‘ধুত! ওতে কিছু হবে না৷ অন্য রাস্তা ভাব৷’’
পরদিন বিকেলে ব্যাডমিন্টন খেলতে না গিয়ে টিটো দৌড়ে-দৌড়ে চলে এল পাপানের বাড়িতে৷ ছাদে টেনে নিয়ে গেল৷ তারপর দারুণ উত্তেজিত ভাবে বলল, ‘‘আজ ইস্কুলে কী দেখলাম জানিস! ওই ছেলে দুটো আমাদের ইস্কুলেই পড়ে!’’
‘‘ওই ছেলে দুটো মানে?’’
‘‘রঘু চৌধুরীর দুই ছেলে৷ ওদের নাম অজয় আর সুজয়৷ আমাদের জয়দেবের ভাই গোগো ওই সুজয়ের সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ে৷ গোগো বলল, ওরা দুই ভাই-ই খুব ভালো৷ পড়াশোনায় ভালো, ব্যবহারও খুব ভদ্র! ওই নীল গাড়িটা ছুটির পর ওদের নিতে আসে৷’’
‘‘তা হলে তো খুব কাছাকাছি এসে গেল রে!’’
‘‘রঘু চৌধুরীও হয়তো কোনওদিন স্কুলে আসবে৷ তারপর ওকে পেছন থেকে ল্যাং মারব?’’
‘‘তার চেয়ে অনেক কঠিন শাস্তি দেওয়ার কথা আমার মাথায় এসে গেছে৷ শোন টিটো, মনে কর, তুই একদিন জানতে পারলি যে, তোর বাবা একজন চোর কিংবা খুনি—’’
‘‘অ্যাই, কী হচ্ছে কী? আমার বাবা কীরকম লোক, সবাই জানে৷’’
‘‘আহা, সত্যি-সত্যি বলছি না! ধর, যদি এমন হত! তোর কিংবা আমার বাবাকে সবাই খুব ভালো লোক বলেই জানে, হঠাৎ একদিন প্রমাণ বেরিয়ে গেল বাবা একজন খুনি, তা হলে তোর মনের অবস্থা কী হত?’’
‘‘বাবাকে আমি ঘেন্না করতাম৷’’
‘‘ঠিক তাই৷ রঘু চৌধুরী লোকটা তো সত্যিই খারাপ! ওর ছেলে অজয় আর সুজয় তা জানে না৷ ওরা বাবাকে ভালোবাসে৷ ওদের আমরা সব কথা জানিয়ে দেব৷ প্রমাণ দেব৷ তখন ওরা বাবাকে ঘেন্না করতে শুরু করবে৷ সেটাই হবে রঘু চৌধুরীর শাস্তি৷’’
‘‘গুড আইডিয়া, কিন্তু…’’
‘‘এর মধ্যে আবার কিন্তু কী?’’
‘‘অজয় আর সুজয় অত ছোট…বাবা সম্পর্কে হঠাৎ ওইসব জানতে পারলে ওদের মনে খুব আঘাত লাগবে না? ওদের তো কোনও দোষ নেই! অন্য কিছু করা যায় না, পাপান?’’
‘‘অন্য আর কী?’’
টিটো পাপানের কাছে মাথাটা নিয়ে এসে বলল, ‘‘তুই যে সেই চিঠির কথাটা বলেছিলি?’’
দু’জনে বুদ্ধি আঁটল অনেকক্ষণ ধরে৷
পরদিনই রঘু চৌধুরী তার বাড়ির লেটার-বক্সে একটা চিঠি পেল৷ সাদা খাম৷ ভেতরে একটা সাদা পাতায় গোটা-গোটা অক্ষরে লেখা:
‘‘রঘু চৌধুরী, সাবধান!
তোমার পাপের কথা,
কুকীর্তির কথা সব বলে দেব
তোমার দুই ছেলেকে!
ইতি মেঘনাদ’’
চিঠিটা পড়ে রঘু চৌধুরীর ভুরু কুঁচকে গেল৷ কুচি-কুচি করে ছিঁড়ে ফেলল বটে, কিন্তু সারাদিন তার মনটা খচখচ করতে লাগল৷
পরদিন আর-একটা চিঠি:
‘‘রঘু চৌধুরী, সাবধান!
তোমার ছেলে অজয় সুজয়
কোন ইস্কুলে যায়, আমরা জানি
তোমার বহু পাপের প্রমাণ আছে
আমাদের হাতে
অজয় আর সুজয়কে জানিয়ে দেব
সব কথা, সব কথা
লজ্জায় তাদের মাথা হেঁট হয়ে যাবে!
ইতি মেঘনাদ’’
এবারে চিঠিটা ছিঁড়তে গিয়েও ছিঁড়ল না রঘু চৌধুরী৷ ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিল৷ সারাদিন কাজের ফাঁকে-ফাঁকে চিঠিটা পড়তে লাগল বারবার৷ তার বুক ঢিপঢিপ করছে৷ জীবনে সে কখনও এত ভয় পায়নি৷ নিজের ছেলে দুটিকে সে সত্যিই খুব ভালোবাসে৷
এবার এল তিন নম্বর চিঠি:
‘‘রঘু চৌধুরী, সাবধান!
আর সময় নেই
তুমি চাও তোমার ছেলেরা তোমায়
ঘেন্না করুক?
সব বলে দেব, সব!
এখনও যদি বাঁচতে চাও
কাল সকাল সাতটায় দেখা করো
বিবেকানন্দ পার্কে বড় ছাতিম গাছের তলায়
ইতি মেঘনাদ
পুঃ একা আসবে!’’
এবার রঘু চৌধুরী ধরে নিল, যে তাকে ভয় দেখাচ্ছে, সে টাকা চায়৷ ব্ল্যাকমেইল! তার মুখখানা হিংস্র হয়ে উঠল, চিঠিখানা টুকরো-টুকরো করে পা দিয়ে মাড়িয়ে সে ড্রয়ার খুলে বার করল একটা রিভলভার!
পরদিন ঠিক সকাল সাতটায় রঘু চৌধুরী বিবেকানন্দ পার্কে এসে হাজির৷ বড় ছাতিম গাছটার কাছে এসে সে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে৷ সেখানে বসে আছে একটা তেরো-চোদ্দো বছরের হাফপ্যান্ট-পরা রোগা ছেলে, তাকে সে পাত্তা দিচ্ছে না৷ তার ধারণা, কোনও বিকট চেহারার গুন্ডা লুকিয়ে আছে কাছেই৷ পকেটে হাত দিয়ে সে চেপে ধরে আছে রিভলভারটা৷
পাপান হাতছানি দিয়ে ডেকে বলল, ‘‘এই যে চৌধুরীমশাই, এদিকে আসুন! আমিই মেঘনাদ!’’
রঘু চৌধুরীর মাথায় যেন আগুন জ্বলে গেল৷ দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘‘হতভাগা ছেলে! আমার সঙ্গে ইয়ার্কি? মেরে তোর মুখের সব ক’টা দাঁত ফেলে দেব!’’
একটুও ভয় না পেয়ে পাপান বলল, ‘‘আমাকে ওরকম শাসাবে না, কোনও লাভ নেই৷ একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে আমার বন্ধুরা৷ তুমি আমার ওপর আক্রমণ করতে এলেই তারা এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে৷ একজন পুলিশে খবর দেবে৷ তাতেই তোমার দুই ছেলে সব জেনে যাবে!’’
থমকে গিয়ে রঘু চৌধুরী বলল, ‘‘তুই কী চাস? কত টাকা?’’
পাপান হা-হা করে হেসে উঠল৷
রঘু চৌধুরী বলল, ‘‘শোন, আমি তোকে এক হাজার টাকা দেব৷ তারপর খবরদার আমার ছেলেদের কাছে ঘেঁষবি না৷ যদি ওদের কিছু বলতে যাস, তোকে খুন করে ফেলব৷ নির্ঘাত খুন করে ফেলব!’’
পাপান বলল, ‘‘আমাকে খুন করলেও আমার অন্য বন্ধুরা থাকবে৷ তারা তোমার ছেলেদের বলে দেবে, তুমি খুনি, তুমি স্মাগলার, তুমি বিনা কারণে অন্য ছেলেদের ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দাও! এইসব শুনে তোমার ছেলেরা তোমাকে ঘেন্না করবে৷ তোমাকে বাবা বলে মানতে চাইবে না৷’’
রঘু চৌধুরী এক পা এগিয়ে এসে বলল, ‘‘তুই কত টাকা চাস?’’
পাপান বলল, ‘‘এক পয়সাও চাই না! তোমাকে ক্ষমা চাইতে হবে! যদি ক্ষমা না চাও…’’
রঘু চৌধুরীর শরীরটা কেঁপে উঠল৷ সমস্ত মুখটা কুঁচকে গেল৷ হঠাৎ সে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বলল, ‘‘ক্ষমা চাইছি! আর কক্ষনো এসব করব না! কাউকে ঠকাব না, কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করব না৷ তুমি আমার ছেলেদের কিছু বোলো না৷ ওরা আমাকে এত ভালোবাসে, বলো না, প্লিজ, কিছু জানিয়ে দিয়ো না ওদের, আমি এখন থেকে আর কোনও অন্যায় করব না৷’’
বলতে-বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল রঘু চৌধুরী৷
—