কঠিন শাস্তি

কঠিন শাস্তি

দুই বন্ধুই ক্লাস নাইনে পড়ে, কিন্তু আলাদা ইস্কুলে। ওদের মধ্যে টিটো খুব খেলাধুলো ভালোবাসে। পড়ার বই ছাড়া বাইরের বই বিশেষ পড়ে না, বড়োজোর দু-একটা ইংরেজি কমিকস। আর পাপান খেলার মাঠে বিশেষ যায় না, যখনই একটু সময় পায় অমনই একটা গল্পের বই নিয়ে বসে। এমনকী একবার টিটোর সঙ্গে ক্রিকেট খেলা দেখতে গিয়েও পাপান একটা ডিটেকটিভ বই পড়ে শেষ করে ফেলেছিল। পাপান ইংরেজি বইও পড়ে। বাংলা বইও পড়ে।

এখন একটানা দশ দিন স্কুল ছুটি। সকালবেলা পড়াশোনা শেষ করে টিটো যায় ব্যাডমিন্টন খেলতে, আর পাপান বড়ো রাস্তার মোড়ে একটা বইয়ের দোকানে এসে নতুন-নতুন বই দেখে, একটা-দুটো কেনে। যাওয়া-আসার পথে রোজই প্রায় এক জায়গায় ওদের দুজনের দেখা হয়ে যায়। গল্প হয় খানিকক্ষণ। টিটো বলে আগের দিনের ব্যাডমিন্টন ম্যাচে একজনকে হারিয়ে দেওয়ার কথা, আর পাপান বলে, কাল রাত্তিরে একটা দারুণ বই পড়লুম, জানিস!

সকাল সাড়ে দশটায় ফুটপাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছে টিটো আর পাপান। টিটোর হাতে ব্যাডমিন্টনের র‌্যাকেট, পাপানের হাতে দু-খানা বই। পাশেই একটা ব্যাংক, সামনের রাস্তায় তিন-চারখানা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।

গল্পেগল্পে ওরা যখন মশগুল, তখন ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে এল একজন লোক। বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা, সুট-টাই পরা, মাথায় আধখানা টাক। মুখে একটা কেউকেটা ভাব। লোকটির হাতে একটা চাবি, সেই চাবি দিয়ে একটা গাড়ির দরজা খুলতে গিয়ে হঠাৎ মুখ তুলে সে টিটো আর পাপানের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলল, অ্যাই, আমার গাড়িতে ঠেসান দিয়েছিস কেন রে? সরে যা! সরে যা!

কথা বলতে বলতে অন্যমনস্কভাবে পাপান একটা নীল রঙের গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল ঠিকই। তাতে কী হয়েছে, গাড়িটা ক্ষয়ে গেছে নাকি? একজন অচেনা লোক তাদের তুই বলবে কেন?

পাপান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গাড়িটা থেকে সরে গেল খানিকটা। লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার গাড়িটা ছুঁয়ে ফেলেছি, এজন্য দুঃখিত!

লোকটি গাড়িতে ঢুকতে গিয়েও এদিকে চলে এল। গাড়িটা যেন একটা পোষা জন্তু, এইভাবে এক জায়গায় হাত বুলোতে গিয়ে চমকে উঠল। গর্জন করে বলল, আমার গাড়িতে আঁচড় কেটেছিস? গাড়িটা নষ্ট করে দিয়েছিস!

…অ্যাই,আমার গাড়িতে ঠেসান দিয়েছিস কেন রে? সরে যা! সরে যা !

পাপান সেদিকে তাকাল, গাড়িটার গায়ে সে কোনো দাগ দেখতে পেল না। তা ছাড়া গাড়ির গায়ে সে আঁচড় কাটতে যাবে কেন? তাও অন্যের গাড়িতে? একটুখানি পিঠটা ঠেকিয়েছিল শুধু।

লোকটি রাগে গরগর করতে করতে বলল, যত সব বিচ্ছু ছেলে! বদমাশ!

এবার টিটো বলল, আপনি গালাগাল দিচ্ছেন কেন? আপনার গাড়ির কোনো ক্ষতি করা হয়নি!

লোকটি প্রচন্ড জোরে চেঁচিয়ে বলল, চোপ!

তারপর দুটো হাতের পাঞ্জা ঠিক থাবার মতন ওদের দুজনের মুখের ওপর রাখল। এক ধাক্কায় ওদের দুজনকেই ফেলে দিল মাটিতে। কঠিন ফুটপাথে মাথা ঠুকে গেল টিটো আর পাপানের।

ওরা আবার উঠে দাঁড়াবার আগেই লোকটি গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেল।

টিটো আর পাপানের যত না ব্যথা লেগেছে, তার চেয়েও ওরা আহত হয়েছে বেশি। বিনা দোষে একজন লোক ওদের গায়ে হাত দিল? এর আগে কেউ কোনোদিন ওদের সঙ্গে এরকম খারাপ ব্যবহার করেনি। ওরা কোনোদিন মারই খায়নি!

কলকাতার রাস্তায় এরকম কত কী ঘটে, অন্য কেউ ভ্রূক্ষেপও করে না। কত লোক হেঁটে যাচ্ছে, পাশ দিয়ে গাড়ি চলে যাচ্ছে। একদম কাছাকাছি দু-চারজন লোক ওদের ওরকমভাবে পড়ে যেতে দেখে একটু ভুরু কুঁচকে তাকাল, তারপর চলে গেল যে-যার নিজের কাজে। কেউ সেই লোকটিকে একটু বাধাও দিল না, কিছু জিজ্ঞেসও করল না।

টিটো আর পাপান গায়ের ধুলো ঝেড়ে হতবাক হয়ে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইল পরস্পরের দিকে। এটা কী হল? কেন লোকটা এরকম অসভ্যের মতন ব্যবহার করে চলে গেল? লোকটা কে?

ব্যাংকের গেটে একজন বন্দুকধারী দরোয়ান থাকে। সে বন্দুকটা পাশে শুইয়ে রেখে নিশ্চিন্ত মনে খৈনি খাচ্ছে। টিটো তার কাছে গিয়ে বলল, এইমাত্র যে-লোকটি বেরোল ব্যাংক থেকে, তাকে আপনি চেনেন? এখানে প্রায়ই আসে?

দরোয়ান ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করল, কোন লোক? কত লোক তো যাচ্ছে আর আসছে!

টিটো বলল, বেশ লম্বা, খয়েরি সুট পরা।

দরোয়ান বলল, সুট এখন সবাই পরে। শীত পড়েছে, সুট পরবে না!

বোঝা গেল, এর কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে না!

পাপান বলল, আমি গাড়ির নম্বরটা দেখেছি। 9837, তবে আগে কী ছিল? WMF, না WMB ?

টিটো বলল, আমি দেখিনি। আর ওকে ধরা যাবে না!

পাপান চোয়াল শক্ত করে বলল, ওকে খুঁজে বার করতেই হবে। অকারণে একটা লোক অন্যায় করে যাবে? ওকে শাস্তি পেতেই হবে! ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে…’ তুই এই কবিতাটা পড়িসনি, টিটো?

টিটো বলল, কিন্তু ওকে খুঁজে পাব কী করে?

পাপান বলল, পৃথিবীর যেখানেই থাকুক, ওকে আমরা ঠিক খুঁজে বার করব। ওর মুখটা যেন ভুলে যাস না। দাঁড়া, একটু চোখ বুজে ওর মুখের ছবিখানা মনে গেঁথে রাখি।

টিটো বলল, ওর মুখটা আমার মনে না থাকলেও, দেখলেই চিনতে পারব।

তারপর থেকে ওই ব্যাংকের সামনেটায় নজর রাখে দু-বন্ধুই। যদি সেই লোকটি বা গাড়িটাকে দেখা যায়! ব্যাঙ্কটার সামনে দিয়ে মাঝে মাঝে দু’জনেই হাঁটে। অন্য সময়েও রাস্তার যে-কোনো গাড়ির নম্বরটা ওরা একবার দেখে নেয়। লম্বা-চওড়া, খয়েরি কোটপরা একজন লোককে পেছন থেকে দেখে পাপান অনেকখানি ছুটে গেল তার মুখটা দেখার জন্য। সে অন্য লোক।

লোকটি আর ব্যাংকে আসে না। রোজরোজ কেই-বা ব্যাংকে যায়! তবে পাঁচ দিন পর অন্য একটি সুযোগ পাওয়া গেল।

পাপান টিকিট কাটতে গিয়েছিল গ্লোব সিনেমায়। হঠাৎ তার নজর পড়ল একটা গাড়ির নম্বরের দিকে। 9837, তবে আগের অক্ষরগুলো WMD। আগের অক্ষরগুলো মেলাটাই বেশি দরকার, একই নম্বরের অনেক গাড়ি থাকতে পারে। কিন্তু এ-গাড়ির রংটাও নীল। গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে নিউ মার্কেটের সামনে।

যদি এই গাড়িটাই সেই লোকটার হয়? কিন্তু পাপান একা একা সেই লোকটাকে দেখতে পেলেই বা কী করবে? কী করে শাস্তি দেবে? টিটোকে একটা খবর দেওয়া দরকার। টিটোদের বাড়িতে টেলিফোন আছে।

একটা দোকান থেকে ফোন করল পাপান। টিটো জিজ্ঞেস করল, তুই ঠিক জানিস ওটা সেই গাড়ি? নীল রঙের অ্যামবাসাডর গাড়ি তো কতই আছে!

পাপান একটু দুর্বলভাবে বলল, না, একেবারে ঠিক বলতে পারছি না। অন্য গাড়িও হতে পারে। কিন্তু যদি সেই গাড়িটাই হয়? গাড়িটাকে ফলো করলে সেই লোকটার বাড়িটা চিনে আসা হবে।

টিটো বলল. ঠিক আছে, তুই নজর রাখ। আমি আসছি!

একটু দূরে, অন্য একটা গাড়ির আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল পাপান। টিটোর আসতে কুড়ি-পঁচিশ মিনিট লাগবেই। তার আগেই যদি লোকটা বেরিয়ে আসে নিউ মার্কেট থেকে? অতবড়ো লোকটার সঙ্গে পাপান গায়ের জোরে পারবে না। তবে ছুটে গিয়ে পেছন থেকে একটা ল্যাং মেরে আছাড় খাওয়াতে পারে। তাতেই অনেকটা প্রতিশোধ নেওয়া হবে। কিন্তু ওর সঙ্গে যদি অন্য লোক থাকে?

ঠিক তাই। টিটো এসে পৌঁছোবার আগেই নিউ মার্কেট থেকে বেরিয়ে এল সেই লোকটা। হ্যাঁ, কোনো ভুল নেই, সেই লোকটাই বটে। তার সঙ্গে রয়েছে আরও দুজন লোক। তারা নীল গাড়িটার দিকেই এগিয়ে আসছে হাসতে হাসতে। হাতে কয়েকটা প্যাকেট। পাপানের মনটা দমে গেল। এখনই তো ওরা গাড়িতে উঠে চলে যাবে, সে কী করবে?

লোকটিকে ভালো করে দেখবার জন্য পাপান অনেকটা কাছে এগিয়ে এল।

সেই আসল লোকটাই গাড়ি চালাবে। একটা ভিখিরি বুড়ি জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল তার কাছে। লোকটা ধমকে উঠল, এই, যা! সরে যা!

বুড়ি তবু সরে না। ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল।

তারপরের ব্যাপারটা দেখে আতঁকে উঠল পাপান। লোকটা সাঁ করে কাচ তুলে দিল গাড়ির জানালার। তাতে আটকে গেল ভিখিরি বুড়িটার হাত। বুড়িটা যন্ত্রণায় চিৎকার করে, ওরে বাবা রে, মরে গেলাম রে বলতে লাগল, আর ভেতরে সেই লোকগুলো খলখল করে হাসছে।

ঠিক এই সময় টিটো এসে ডাকল, পাপান!

কাছেই একটা ট্যাক্সি থেমেছে, তার মধ্যে বসে আছে টিটো। পাপান দৌড়ে এসে ট্যাক্সিতে উঠে পড়ে বলল, সেই গাড়ি, সেই লোক। ওকে ফলো করে বাড়িটা দেখে আসতে হবে।

জানালার কাচ আবার নামিয়ে নীল গাড়িটা এবার স্টার্ট দিয়েছে।

পাপান উত্তেজিতভাবে বলল, ওই লোকটা, ওই লোকটা, ওর মতন খারাপ লোক আমি পৃথিবীতে আর দেখিনি। একটা ভিখিরিকে শুধু শুধু কী কষ্ট দিল! ওকে ছাড়া হবে না, ওকে শাস্তি দিতেই হবে!

টিটো ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বলল, আপনি আবার চলুন, শিগগির!

ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, কোন দিকে যাব?

টিটো আর কিছু বলবার আগেই পাপান বলল, ডানদিকে ঘুরিয়ে নিন।

সে একটা গল্পের বইয়ে পড়েছে যে, অল্পবয়সি ছেলেরা কোনো ট্যাক্সিতে চেপে অন্য কোনো গাড়ি ফলো করতে বললে ট্যাক্সি-ড্রাইভাররা সন্দেহ করে। যেতে চায় না। সেইজন্য পাপান শুধু আগের গাড়িটা দেখে দেখে বলতে লাগল, ডানদিকে, এবার বাঁদিকে।

বেশ কয়েক মিনিট কেটে যাওয়ার পর টিটো ফিসফিস করে বলল, গাড়িটা কত দূর যাবে রে? ট্যাক্সিভাড়া অনেক হয়ে গেলে কী করে দেব? আমার কাছে বেশি পয়সা নেই। তোর কাছে আছে?

পাপান বলল, আমার কাছে তো পাঁচ টাকার বেশি নেই!

টিটো বলল, এর মধ্যেই পনেরো টাকা উঠে গেল, আমার কাছে আছে মাত্র দশ টাকা।

পাপান বলল, একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবেই। এখন আর ওকে ছাড়লে চলবে না।

নীল গাড়িটা এসে থামল টালিগঞ্জে, বড়ো রাস্তা ছেড়ে একটা ছোটো রাস্তায় ঢুকে একটা পাঁচিল-ঘেরা বাড়ির সামনে। পাপান আর টিটো নেমে পড়ল একটু দূরে। ট্যাক্সি-ড্রাইভারকে একটু অপেক্ষা করতে বলে ওরা ঠিকানা খোঁজার ভান করে একটু একটু করে এগোতে লাগল।

সন্ধে হয়ে এসেছে। এ রাস্তাটা অন্ধকার অন্ধকার মতন। সেই বাড়িটার সামনে একটা লোহার গেট, ভেতরে একজন দরোয়ান বসে আছে। লোক তিনটে ভেতরে ঢুকে গেছে, ভেতরটায় কিছু দেখা যাচ্ছে না।

এ তো বেশ বড়োলোকের বাড়ি। এখন কী করা যায়?

পাপান ভাবল, লোকটা এমন বড়োলোক হয়েও একটা বুড়ি ভিখিরিকে অমন কষ্ট দেয়? পাষন্ড! ওকে শাস্তি দিতেই হবে!

বাড়িটার সামনে এমনিই ঘোরাঘুরি করা যায় না। ট্যাক্সি-ড্রাইভার হর্ন দিচ্ছে। পাপান ঠিক করে ফেলেছে যে, ওই ট্র্যাক্সিতেই বাড়ি ফিরতে হবে, না হলে ভাড়া দেবে কী করে? বাড়িতে গিয়ে দাদার কাছে টাকা চাইতে হবে। দাদা যদি এখন বাড়িতে না থাকে, তাহলে মায়ের কাছে!

টিটো বলল, এখন আর তো কিছু করার নেই। বাড়িটা তবু চেনা হল।

পাশ থেকে গায়ে চাদর-জড়ানো একটি লম্বা মতন ছেলে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের কী চাই ভাই? কাকে খুঁজছ?

টিটো বলল, কিছু চাই না। একটা ঠিকানা খুঁজছি। আমার এক বন্ধু থাকে পঁয়তাল্লিশ নম্বর বাড়িতে, কিন্তু সে তো ওরকম লোহার গেটওয়ালা বাড়ি বলেনি, এমনই সাধারণ দোতলা বাড়ি। ওই বাড়িটা কার বলতে পারেন?

লম্বা ছেলেটি বিরক্ত ভাব করে বলল, ওটা তো রঘু চৌধুরীর বাড়ি। কেন, তার সঙ্গে তোমাদের কী দরকার?

পাপান বলল, না, না, কোনো দরকার নেই। এমনই জিজ্ঞেস করছিলাম।

ছেলেটি বলল, মহা পাজি লোক! লোককে ঠকিয়ে ঠকিয়ে অত বড়ো বাড়ি করেছে। এটা আগে ছিল একজন বিধবা ভদ্রমহিলার, তিনি হঠাৎ মারা গেলেন। তারপর বাড়িটা রঘু চৌধুরীর হয়ে গেল। লোকে বলে, ওই রঘু চৌধুরীই বিধবা মহিলাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে!

টিটো চোখ বড়ো-বড়ো করে বলল, খুন? ওকে পুলিশে ধরেনি?

ছেলেটি বলল, ওর সব বড়ো-বড়ো লোকের সঙ্গে চেনা আছে। কী সব কলকাঠি নেড়েছে, কেউ ওকে ছুঁতেও পারেনি!

টিটো আবার জিজ্ঞেস করল, আপনারা পাড়ার লোক কিছু করতে পারেননি? ওকে শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল না?

ছেলেটি বলল, ওকে ধরাছোঁয়া অত সহজ নয়। আমরা কিছু করতে গেলে আমাদেরই পুলিশে ধরিয়ে দেবে। জানো, আমি ওর কাছে একবার চাকরি চাইতে গিয়েছিলাম। আমার কথা ভালো করে শুনলই না, দূরদূর করে তাড়িয়ে দিল, কুকুর লেলিয়ে দিল!

ট্যাক্সিওয়ালা অধৈর্য হয়ে গেছে, ওদের উঠে পড়তে হল। ফেরার পথে আগাগোড়া গম্ভীর হয়ে রইল পাপান।

এরপর দু-তিন দিন দুই বন্ধু দেখা হলেই ওই রঘু চৌধুরীকে নিয়ে আলোচনা করে। লোকটা অসভ্য, নিষ্ঠুর, খুনি অথচ তাকে কেউ শাস্তি দিতে পারে না। একটা খারাপ লোক মানুষের ক্ষতি করে ঘুরে বেড়াবে, এত বড়ো বাড়িতে থাকবে, অথচ কেউ জানতে পারবে না তার আসল রূপটা? একটা কিছু করতেই হবে, কিন্তু কী করা যায়?

ওরা দুজন মাঝে মাঝে চলে আসে টালিগঞ্জে। সেই বাড়িটার সামনে ঘোরাঘুরি করে। দু-একবার রঘু চৌধুরীকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতেও দেখেছে। একবার রঘু চৌধুরীর সঙ্গে পাপানের চোখাচোখিও হয়ে গেল। কিন্তু রঘু চৌধুরী তাকে চিনতেও পারল না। ও নিশ্চয়ই অনেক, অনেক লোকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে, তাদের মুখ মনে রাখতে পারে না।

ওরা খবর জোগাড় করল যে, রঘু চৌধুরী এ-পাড়ার দুর্গাপুজো, কালীপুজোর সময় অনেক টাকা চাঁদা দেয়। তাই কেউ তাকে ঘাঁটায় না। তবে একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দুটি ছেলে বলছিল, রঘু চৌধুরী আসলে স্মাগলার, তাই ওর এত টাকা।!

একদিন সকালবেলা ওই বাড়ির লোহার গেটের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ওরা দেখল, ভেতরে একটা সুন্দর সবুজ লন। সেখানে দুটি ফুটফুটে ছেলে, পাপানদের চেয়ে অনেক ছোটো। মনে হয় ক্লাস ফোর আর ফাইভে পড়ে, একটা বল নিয়ে খেলছে, আর তাদের সঙ্গে খেলায় যোগ দিয়েছে রঘু চৌধুরী আর একটা কুকুর। বাবা ছেলেদের সঙ্গে খেলছে আর সবাই মজা করে হাসছে। এক একবার ছোটো ছেলেটাকে কাঁধে তুলে নিচ্ছে রঘু চৌধুরী। কুকুরটা লাফাচ্ছে পাশে।

কী সুন্দর দৃশ্য! মনে হয় কী আনন্দময় এই বাড়ি! রঘু চৌধুরী তার ছেলেদের সঙ্গে এত ভালো ব্যবহার করে, আর খুব খারাপ ব্যবহার করে বাইরের লোকদের সঙ্গে।

সেদিন ফেরার পথে টিটো বলল, আর টালিগঞ্জে এসে কী হবে রে পাপান? কিছুই তো করা যাবে না!

পাপান বলল, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।

টিটো সঙ্গে সঙ্গে উৎসুকভাবে বলল, কী?

পাপান বলল, ওকে বেনামি চিঠি লিখব! ওপরে একটা মানুষের মাথার খুলি এঁকে লিখব, সাবধান রঘু চৌধুরী! তুমি যদি পাপ কাজ বন্ধ না করো, তাহলে তোমার মুন্ডু উড়ে যাবে! ইতি মেঘনাদ! মেঘনাদের তলায় একটা জ্বলন্ত তির আঁকা থাকবে!

টিটো বলল, এই চিঠি পেলে ও হাসতে হাসতে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দেবে! মোটেই ভয় পাবে না।

পাপান বলল, কেন ভয় পাবে না? তুই কী করে জানলি ওদের বাড়িতে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট আছে?

টিটো বলল, সব বাড়িতেই থাকে। শুধু চিঠি পড়ে ভয় পাবে কেন? মুন্ডু ওড়াবার ক্ষমতা যে তোর আছে, তার কোনো প্রমাণ দিতে পারবি?

পাপান বলল, আরও বেশি ভয় দেখিয়ে চিঠি লিখব!

টিটো বলল, ধুত! ওতে কিছু হবে না। অন্য রাস্তা ভাব।

পরদিন বিকেলে ব্যাডমিন্টন খেলতে না গিয়ে টিটো দৌড়ে দৌড়ে চলে এল পাপানের বাড়িতে। ছাদে টেনে নিয়ে গেল। তারপর দারুণ উত্তেজিতভাবে বলল, আজ ইস্কুলে কী দেখলাম জানিস! ওই ছেলে দুটো আমাদের ইস্কুলেই পড়ে!

ওই ছেলে দুটো মানে?

রঘু চৌধুরীর দুই ছেলে। এদের নাম অজয় আর সুজয়। আমাদের জয়দেবের ভাই গোগো ওই সুজয়ের সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ে। গোগো বলল, ওরা দুই ভাই-ই খুব ভালো। পড়াশোনায় ভালো, ব্যবহারও খুব ভদ্র! ওই নীল গাড়িটা ছুটির পর ওদের নিতে আসে। তাহলে তো খুব কাছাকাছি এসে গেল রে!

রঘু চৌধুরীও হয়তো কোনোদিন স্কুলে আসবে। তারপর ওকে পেছন থেকে ল্যাং মারব?

তার চেয়ে অনেক কঠিন শাস্তি দেওয়ার কথা আমার মাথায় এসে গেছে। শোন টিটো, মনে কর, তুই একদিন জানতে পারলি যে, তোর বাবা একজন চোর কিংবা খুনি—

অ্যাই, কী হচ্ছে কী? আমার বাবা কীরকম লোক, সবাই জানে।

আহা, সত্যি-সত্যি বলছি না! ধর, যদি এমন হত! তোর কিংবা আমার বাবাকে সবাই খুব ভালো লোক বলেই জানে, হঠাৎ একদিন প্রমাণ বেরিয়ে গেল বাবা একজন খুনি, তাহলে তোর মনের অবস্থা কী হত?

বাবাকে আমি ঘেন্না করতাম।

ঠিক তাই। রঘু চৌধুরী লোকটা তো সত্যিই খারাপ!

ওর ছেলে অজয় আর সুজয় তা জানে না। ওরা বাবাকে ভালোবাসে। ওদের আমরা সব কথা জানিয়ে দেব। প্রমাণ দেব। তখন ওরা বাবাকে ঘেন্না করতে শুরু করবে। সেটাই হবে রঘু চৌধুরীর শাস্তি।

গুড আইডিয়া, কিন্তু…

এর মধ্যে আবার কিন্তু কী?

অজয় আর সুজয় অত ছোটো… বাবা সম্পর্কে হঠাৎ ওইসব জানতে পারলে ওদের মনে খুব আঘাত লাগবে না? ওদের তো কোনো দোষ নেই! অন্য কিছু করা যায় না, পাপান?

অন্য আর কী?

টিটো পাপানের কাছে মাথাটা নিয়ে এসে বলল, তুই যে সেই চিঠির কথাটা বলেছিলি?

দুজনে বুদ্ধি আঁটল অনেকক্ষণ ধরে।

পরদিনই রঘু চৌধুরী তার বাড়ির লেটার বক্সে একটা চিঠি পেল। সাদা খাম। ভেতরে একটা সাদা পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা

রঘু চৌধুরী, সাবধান!

তোমার পাপের কথা,

কুকীর্তির কথা সব বলে দেব

তোমার দুই ছেলেকে!

ইতি মেঘনাদ

চিঠিটা পড়ে রঘু চৌধুরীর ভুরু কুঁচকে গেল। কুচি-কুচি করে ছিঁড়ে ফেলল বটে, কিন্তু সারাদিন তার মনটা খচখচ করতে লাগল।

পরদিন আর একটা চিঠি:

রঘু চৌধুরী, সাবধান!

তোমার ছেলে অজয় সুজয়

কোন ইস্কুলে যায়, আমরা জানি

তোমার বহু পাপের প্রমাণ আছে

আমাদের হাতে

অজয় আর সুজয়কে জানিয়ে দেব

সব কথা, সব কথা

লজ্জায় তাদের মাথা হেঁট হয়ে যাবে!

ইতি মেঘনাদ

এবারে চিঠিটা ছিঁড়তে গিয়েও ছিঁড়ল না রঘু চৌধুরী। ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিল। সারাদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে চিঠিটা পড়তে লাগল বারবার, তার বুক ঢিপঢিপ করছে। জীবনে সে কখনো এত ভয় পায়নি। নিজের ছেলে দুটিকে সে সত্যিই ভালোবাসে।

এবার এল তিন নম্বর চিঠি:

রঘু চৌধুরী, সাবধান!

আর সময় নেই

তুমি চাও তোমার ছেলেরা তোমায়

ঘেন্না করুক?

সব বলে দেব, সব!

এখনও যদি বাঁচতে চাও

কাল সকাল সাতটায় দেখা করো

বিবেকানন্দ পার্কে বড়ো ছাতিম গাছের তলায়।

ইতি মেঘনাদ

পু: : একা আসবে!

এবার রঘু চৌধুরী ধরে নিল, যে তাকে ভয় দেখাচ্ছে, সে টাকা চায়। ব্ল্যাকমেইল! তার মুখখানা হিংস্র হয়ে উঠল, চিঠিখানা টুকরো টুকরো করে পা দিয়ে মাড়িয়ে সে ড্রয়ার খুলে বার করল একটা রিভলভার!

পরদিন ঠিক সকাল সাতটায় রঘু চৌধুরী বিবেকানন্দ পার্কে এসে হাজির। বড়ো ছাতিম গাছটার কাছে এসে সে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। সেখানে বসে আছে একটা তেরো-চোদ্দো বছরের হাফপ্যান্ট-পরা রোগা ছেলে, তাকে সে পাত্তা দিচ্ছে না। তার ধারণা, কোনো বিকট চেহারার গুণ্ডা লুকিয়ে আছে কাছেই। পকেটে হাত দিয়ে সে চেপে ধরে আছে রিভলভারটা।

পাপান হাতছানি দিয়ে ডেকে বলল, এই যে চৌধুরীমশাই, এদিকে আসুন! আমিই মেঘনাদ!

রঘু চৌধুরীর মাথায় যেন আগুন জ্বলে গেল।

দাঁত কিড়মিড় করে বলল, হতভাগা ছেলে! আমার সঙ্গে ইয়ার্কি? মেরে তোর মুখের সব ক-টা দাঁত ফেলে দেব!

একটুও ভয় না পেয়ে পাপান বলল, আমাকে ওরকম শাসাবে না, কোনো লাভ নেই। একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে আমার বন্ধুরা। আপনি আমার ওপর আক্রমণ করতে এলেই তারা এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে। একজন পুলিশে খবর দেবে। তাতেই তোমার দুই ছেলে সব জেনে যাবে!

থমকে গিয়ে রঘু চৌধুরী বলল, তুই কী চাস? কত টাকা?

পাপান হা-হা-করে হেসে উঠল।

রঘু চৌধুরী বলল, শোন, আমি তোকে এক হাজার টাকা দেব। তারপর খবরদার, আমার ছেলেদের কাছে ঘেঁষবি না। যদি ওদের কিছু বলতে যাস, তোকে খুন করে ফেলব। নির্ঘাত খুন করে ফেলব!

পাপান বলল, আমাকে খুন করলেও আমার অন্য বন্ধুরা থাকবে। তারা তোমার ছেলেদের বলে দেবে, তুমি খুনি, তুমি স্মাগলার, তুমি বিনা কারণে অন্য ছেলেদের ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দাও! এইসব শুনে তোমার ছেলেরা তোমাকে ঘেন্না করবে। তোমাকে বাবা বলে মানতে চাইবে না।

রঘু চৌধুরী এক পা এগিয়ে এসে বলল, তুই কত টাকা চাস?

পাপান বলল, এক পয়সাও চাই না! তোমাকে ক্ষমা চাইতে হবে! যদি ক্ষমা না চাও…

রঘু চৌধুরীর শরীরটা কেঁপে উঠল। সমস্ত মুখটা কুঁচকে গেল। হঠাৎ সে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বলল, ক্ষমা চাইছি! আর কক্ষনো এসব করব না! কাউকে ঠকাব না, কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করব না। তুমি আমার ছেলেদের কিছু বোলো না। ওরা আমাকে এত ভালোবাসে, বোলো না প্লিজ, কিছু জানিয়ে দিয়ো না ওদের, আমি এখন থেকে আর কোনো অন্যায় করব না।

বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল রঘু চৌধুরী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *