কচ্ছপের গল্প
ঔপন্যাসিক আসিফ নজরুল সেদিন আমার বাসায় এসেছে। গম্ভীর চেহারার একজন ছেলে। নিজের ওপর তার আস্থা সীমাহীন। কাটা কাটা কথা বলে আশপাশের মানুষদের চমকে দেয়ার সূক্ষ্ম চেষ্টা আছে। মানুষকে চমকে দিয়ে কথাশিল্পী মাত্রই আনন্দ পান। আসিফ তার ব্যতিক্রম হবে এটা মনে করার কোন কারণ নেই। ব্যতিক্রম কিছুটা আছে। তার কথায় অন্যকে আহত করার চেষ্টা আছে।
যাই হোক, তাকে আমি আনন্দিত স্বরে বললাম, কি খবর?
সে আমার আনন্দিত স্বরকে তেমন পাত্তা দিল না। কঠিন গলায় আমার স্ত্রীকে বলল, আচ্ছা ভাবী, হুমায়ূন ভাই কি হিপোক্রেট?
গুলতেকিন হকচকিয়ে গিয়ে বলল, কই না তো! ও যা বিশ্বাস করে তাই তো বলে। ভান তেমন করে না তো!
ভাবী, উনার ওপর একটি বই বের হয়েছে ঘরে বাইরে হুমায়ূন আহমেদ–আপনি কি সেটি পড়েছেন? যদি পড়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই আপনার চোখে পড়েছে–প্রশ্নকর্তা প্রশ্ন করলেন–বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস সম্পর্কে কিছু লেখা হয়নি–আপনি নিজে কেন লিখছেন না?
হ্যাঁ, চোখে পড়েছে।
তার উত্তরে হুমায়ূন ভাই যা বললেন তার ভেতরে হিপোক্রেসি কি আপনি ধরতে পারেননি?
না তো।
আপনার ধরতে পারার কথা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাস সম্পর্কে কোন উপন্যাস লেখা হয়নি এটা হুমায়ূন ভাই স্বীকার করে নিয়েছেন–কিন্তু তিনি জানেন। আমার একটি উপন্যাস এই প্রসঙ্গে আছে–নিষিদ্ধ কয়েকজন। তিনি বইটি পড়েছেন, তিনি আমাকে বলেছেন বইটি তার ভাল লেগেছে। অথচ ইন্টারভ দেয়ার সময় এই ব্যাপারটা তিনি উল্লেখ করেননি। এটা এক ধরনের হিপোক্রেসি নয়?
গুলতেকিন বলল, ইচ্ছে করে এড়িয়ে গেলে অবশ্যই হিপোক্রেসি।
ব্যাপারটা যে হিপোক্রেসি নয় আমি তা বোঝানোর চেষ্টা করলাম। বললাম—প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় কখনো খুব ভেবেচিন্তে দেয়া হয় না। যা মনে আসে তাই বলা হয়। নিজেকে ডিফেণ্ড করার একটা চেষ্টা থাকে। অন্য কারোর কথা মনে থাকে না। তোমার নিষিদ্ধ কয়েকজনের কথা সেই কারণেই উল্লেখ করা হয়নি। তবে তোমার ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে, আমি আমার একটি বই তোমাকে উৎসর্গ করেছি।
আসিফ আরো কিছু কঠিন কথা বলার জন্যে নিজেকে তৈরি করল–তার চোখ তীক্ষ্ণ হল এবং ভুরু খানিকটা কুঁচকে গেল। আমি তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বললাম–
তুমি লেখালেখি শুরু করেছ মাত্র দুতিন বছর হলো। এর মধ্যেই আমি তোমাকে একটি বই উৎসর্গ করেছি। আর আমার অবস্থাটা দেখ, আমি কুড়ি বছর ধরে লেখালেখি করার পর আমাকে বই উৎসর্গ করলেন কবি শামসুর রাহমান এবং সৈয়দ শামসুল হক। তাঁরা যে আমার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে এই কাজটি করলেন তাও কিন্তু না। আমি তাদের বই উৎসর্গ করেছিলাম, তারা ভদ্রতা করেছেন, উৎসর্গ ফেরত দিয়েছেন। তুমি আমাকে বই উৎসর্গ করবে, তার উত্তরে আমি করব তা কিন্তু হয়নি–আমি তোমার বই উৎসর্গের জন্যে অপেক্ষা করিনি।
আসিফ বলল, আমাকে কিছু কথা বলার সুযোগ দিন।
না, তোমাকে সুযোগ দেয়া হবে না। তুমি আমার কথা শোন। আমি দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলাম। দেশে কি লেখালেখি হচ্ছে সেই সম্পর্কে কোন ধরাণা ছিল না। দেশে এসে শুনলাম ইমদাদুল হক মিলন নামে একজন খুব লেখালেখি করছেন। মেলাতে আমি তাঁর বই কিনলাম। একটি বই পরাধীনতা পড়ে আমার এত ভাল। লাগল যে আমি সেই পরাধীনতা নিয়ে দীর্ঘ একটা প্রবন্ধ লিখলাম দৈনিক বাংলায়। তখনো এই লেখকের সঙ্গে আমার কোন পরিচয় হয়নি। কাজেই তুমি বলতে পার না আমার ভেতর কোন হিপোক্রেসি আছে।
দুটি উদাহরণ দিয়েই আপনি আপনার দায়িত্ব শেষ করেছেন। সেটা কি ঠিক হচ্ছে? আপনি কি এই প্রজন্মের লেখকদের সম্পর্কে আপনার দায়িত্ব পালন করেন? নিয়মিত তাদের লেখা পড়েন? তাদের উৎসাহ দেন? তাদের বিকশিত হতে সাহায্য করেন?
মা আমাকে স্বীকার করতে হল, আমি তা করি না। আমি তাকে হাসতে হাসতে বললাম, দায়িত্বে অবহেলার এই ব্যাপারটা আমি শিখেছি আমার অগ্রজদের কাছ থেকে। শওকত ওসমান স্যারের কথাই ধরা যাক। আমার শিক্ষক। ঢাকা কলেজে আমাদের বাংলা পড়াতেন। তার চোখের ওপর আমি লেখালেখি শুরু করেছি। তার সঙ্গে যখন দেখা হয়, তিনি আমার লেখালেখি সম্পর্কে অনেক ভাল কথা বলেন, কিন্তু কথা হচ্ছে, এই কুড়ি বছরে তিনি সাহিত্য-বিষয়ক অনেক কিছুই লিখেছেন কিন্তু। কোথাও হুমায়ূন আহমেদ এই নামটি নেই।
এ প্রসঙ্গক্রমে কবি শামসুর রাহমান সাহেবের কথা বলি। অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদের বাড়িতে আমি, কবি শামসুর রাহমান, দৈনিক বাংলার সালেহ চৌধুরী এবং হুমায়ূন আজাদ আড্ডা দিচ্ছি। আমি এক পর্যায়ে কবিকে বললাম, নির্মলেন্দু গুণকে কবি হিসেবে আপনার কোন স্তরের মনে হয়? কবি শামসুর রাহমান আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন–শুধু আপনাকেই বলছি–বাইরে কোট করবেন না– নির্মলেন্দু গুণকে আমার খুব বড় মাপের কবি বলে মনে হয়। আমি হতভম্ব হয়ে আমার দেশের প্রধান কবির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি যদি কাউকে বড় কবি মনে করেন তাহলে তা প্রকাশ করতে অসুবিধা কি? কেন এটা তাকে ফিসফিস করে বলতে হবে? তিনি হয়ত ভেবেছেন, তাঁর বক্তব্যে অন্য কবিরা তার ওপর ক্ষেপে যাবেন। খুব ভুল ভাবেন নি। চারদিকের আবহাওয়া বিচার করে তাঁর মত কবি মত প্রকাশ করবেন? কবিরা দেশের আত্মা, তারপরেও এত দ্বিধা?
কাকের মাংস কাকে খায় না, লেখকের মাংস লেখক খায়। বেশ মজা করেই খায়। ঈর্ষা নামক ব্যাপারটা বোধহয় সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে যুক্ত। এই ঈর্ষার জন্যেই হয়ত আমরা একজন অন্যজনকে অস্বীকার করি।
হাসন উৎসবে সুনামগঞ্জ গিয়েছিলাম। প্রথম দিন হাসন রাজার গান হল। পরের দিন কবিদের অনুষ্ঠান। যেসব কবি আসবেন নিমন্ত্রণপত্রে তাদের নাম ছাপা হয়েছে। একজন কবি সেই অনুষ্ঠানে এলেন না, কারণ তার নামের আগে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার নাম ছাপা হয়েছে। তিনি কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার সিনিয়র, তার নাম আগে যাওয়া উচিত ছিল। হায় রে সিনিয়রিটি! মহাকাল সিনিয়রিটি দেখে না। সে তার কঠিন পাল্লায় সবকিছু মাপে। সেই মাপে ভুল হয় না।
আমরাই শুধু তুচ্ছ জিনিস নিয়ে মাতামাতি করি। কচ্ছপের খোলসের ভেতর নিজেকে নিয়েই শুধু বাস করতে চাই। এই খোলস ছেড়ে আমাদের বেরুবার উপায় নেই, কারণ খোলসবিহীন কচ্ছপ পৃথিবীতে দেখা যায় না।
আমি নিজেও একটা শক্ত খোলসে নিজেকে আটকে ফেলেছি। নতুন প্রজন্মের শক্তিমান লেখকরা খোলসমুক্ত হবেন–এই আমার শুভ কামনা। আমার অগ্রজরা। এবং আমরা যে ভুল করেছি তারা তা করবেন না। বাংলা সাহিত্যকে অনেক দূর এগিয়ে। নেবার দায়িত্ব তাদের। যে মশাল আমরা তাদের হাতে তুলে দিতে পারিনি, সেই মশাল তাঁরা আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ছুটতে শুরু করবেন। শুধু মনে রাখবেন–তাঁদের কচ্ছপ হওয়া চলবে না। কচ্ছপরা ছুটতে পারে না।