কঙ্কাল সারথি
উঃ! . . . ম্যালেরিয়ার মতন ছ্যাঁচড়া অসুখ পৃথিবীতে আর কিছু আছে কি? উঁহু৷
এই দেখো না, শখ করে সেদিন ঢাকুরিয়ার লেক দেখতে গিয়েছিলাম, সন্ধ্যার একটু আগে৷ হঠাৎ কাঁপুনি দিয়ে আমার জ্বর এল৷
সেকি যে-সে জ্বর, যে-সে কাঁপুনি? না পারি দাঁড়াতে, না পারি বসতে, একেবারে ঘাসের উপর পড়লাম শুয়ে৷ কী শীত রে বাপ! পা থেকে মাথা পর্যন্ত চাদর মুড়ি দিয়ে, কাঁপতে কাঁপতে কেমন যেন আচ্ছন্নের মতো হয়ে রইলাম৷
সেই ভাবে কতক্ষণ ছিলাম, ভগবান জানেন৷ তবে একবার চাদরের ভিতর থেকে জুলজুল করে চোখ মেলে উঁকি মেরে দেখলাম, চারিদিকে গাঢ় অন্ধকারের মেলা বসেছে, কোথাও জনমানবের সাড়া নেই!
বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল৷ কোথায় বাগবাজারে আমার বাড়ি, আর কোথায় পড়ে আছি আমি, একলা৷ গুণ্ডায় গলায় ছুরি বসাতে পারে, সাপে কামড়াতে পারে, বিনা-চিকিৎসায় প্রাণপাখি ফুড়ুক করে পালিয়ে যেতে পারে৷ বাড়ির লোক এতক্ষণে হয়তো ভেবে সারা হচ্ছে৷
আর তো এখানে থাকা চলে না! যেমন করেই হোক আমাকে আজ বাড়ি যেতেই হবে৷
অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালাম৷ গায়ের ভিতর দিয়ে তখনও যেন আগুনের ঝলক ছুটছে, চোখের সামনে দিয়ে রাশি রাশি সর্ষে ফুল নাচতে নাচতে একবারে আঁধার-সাগরে ডুবে যাচ্ছে, আর একবার ভেসে ভেসে উঠছে! প্রতিবার পা ফেলি আর মনে হয়, এই বুঝি আমি দড়াম করে পপাত ধরণীতলে হলাম৷ তবু থামলাম না, মাতালের মতন টলতে টলতে এগিয়ে চললাম৷
রাত ঝাঁ ঝাঁ করছে! সেই রাত্রে আমি প্রথম বুঝতে পারলাম, পৃথিবী কত বেশি স্তব্ধ হতে পারে৷ শহরের হট্টগোলে রাগ হয় বটে, কিন্তু এ-স্তব্ধতাও সহ্য করা অসম্ভব! একটা ব্যাং, কি একটা ঝিঁ ঝিঁ পোকা, কি একটা পাহারাওয়ালার নাক পর্যন্ত ডাকছে না, গাছের পাতায় বাতাসের একটু নিশ্বাস পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না! সারি সারি কোম্পানির আলোর থামগুলো নীরবে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত চক্ষে যেন থমথমে অন্ধকারকে নিরীক্ষণ করছে! তিমির-তুলির প্রলেপ-মাখানো গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে বাড়ির পর বাড়ি দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু তারাও যেন প্রেতপুরীর মতো নিস্তব্ধ- তাদের ভিতর থেকে একটা ঘুম-ভাঙা খোকার কান্নার আওয়াজ পর্যন্ত জেগে উঠছে না৷ কে যেন আজ নিদুটীর মন্ত্র পড়ে সমস্ত জগৎকে বোবা করে দিয়ে গেছে!
জ্বরের ঘোরে চলেছি তো চলেছিই-এই নিঃশব্দ পল্লি ছেড়ে শহরের শব্দের রাজ্যে গিয়ে পড়বার জন্যে প্রাণ যেন আইঢাই করতে লাগল, তবু এ-পথ আর শেষ হতে চায় না৷ এ-পথ যেন আজও শেষ হবে না, কালও শেষ হবে না-আমাকে যেন কোনো অভিশপ্ত আত্মার মতন চলতে হবে অনন্তকাল ধরে! এক বেচারা ইহুদির গল্প পড়েছিলাম৷ কার শাপে তাকে নাকি অনন্তকাল ধরে সারা বিশ্বে ছুটোছুটি করে বেড়াতে হয়েছিল৷ আমার তাই হল নাকি?-
মাথাটা একবার নাড়া দিয়ে ভাবলাম, দূর ছাই, এ-সব কী উদ্ভট কথা ভাবছি? জ্বরে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?
মাঝে মাঝে এক-একটা মাঠ-যেন এক-একটা অন্ধকারের মায়া-সরোবর! সেখান দিয়ে যেন অন্ধকারের ঢেউ বইছে, অন্ধকারের স্রোত ছুটে আসছে আমাকে গ্রাস করবার জন্যে! অন্ধকারের তরঙ্গের ভিতরে গাছগুলোকে দেখাচ্ছে যেন বড়ো বড়ো দৈত্যদানবের মতো- পথিকের হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে খাবার জন্যে তারা ওত পেতে প্রস্তুত হয়ে আছে! কান্না-ভরা কনকনে বাতাস এসে চুপিচুপি যেন আমার কানে কানে বলে যাচ্ছে-ওহে নিঝুম রাতের অজানা মানুষ! এ-মৃত্যুপুরীর ভিতর দিয়ে কোথায় চলেছ তুমি? আমার কথা শোনো, ভূত-প্রেতেরা একে একে জেগে উঠছে, এই বেলা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যাও, পালিয়ে যাও, যাও গো! . . .
আরও খানিক অগ্রসর হয়ে মনে হল, পৃথিবীর সমস্ত শব্দ এসে আমার দুই পায়ের দুই জুতোর ভিতর আশ্রয় নিয়েছে! প্রত্যেকবার পা ফেলি, আর সেই শব্দগুলো জুতোর ভিতর থেকে চমকে উঠে রাজপথের উপর আছাড় খেয়ে পড়ে আমাকে চমকে চমকে তোলে! শব্দ শুনতে চাই, নিজের পায়ের শব্দ পাচ্ছি, কিন্তু কেন জানি না, সে-শব্দ শুনে শুনে মনে আমার খুশি হবে কী, আরও বেশি নেতিয়ে পড়তে লাগল!-সে যেন রাজপথে ঘুমন্ত কোনো অশরীরী প্রেতাত্মার চিৎকার, আমার পদাঘাতে সে যন্ত্রণায় গজরে গজরে উঠছে!
. . . . . . . . .
আঃ! এতক্ষণ পরে রসা রোডের মোড়ে এসে পড়লাম৷ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ট্রামওয়ের একটা লোহার থামে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিলাম৷
এখানটাও তেমনই নির্জন ও তেমনই নিস্তব্ধ হলেও আমার মন যেন অনেকটা আরাম পেল৷ এই তো ট্রামের রাস্তা, এই পথ ধরে সিধে গেলেই-যত মাইল দূরেই থাক-আমাদের পাড়া বাগবাজার পাওয়া যাবেই যাবে! খানিক দূর এগোতে পারলেই লোকজনেরও সাড়া পাব নিশ্চয়, আর ট্রাম ও বাস বন্ধ হলেও, ট্যাক্সি মেলাও তো অসম্ভব নয়!
তখন জ্বরে আমার চোখ ছলছল করছে, কান করছে ভোঁ ভোঁ, আর মাথা ঘুরছে বোঁ বোঁ করে! বার বার ইচ্ছে হতে লাগল, পথের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়বার জন্যে; কেবল বাপ-মায়ের বিষণ্ণ মুখের কথা ভেবেই, মনের সে ইচ্ছা দমন করলাম, অনেক কষ্টে৷ নিজে নিজেই বললাম, মন, তুমি শান্ত হও! এই পথের শেষেই আছে তোমার বাড়ি, তোমার আত্মীয়স্বজন, তোমার নরম তুলতুলে বিছানা! কোনো রকমে চক্ষু মুদে এই পথটুকু পার হতে পারলেই-ব্যাস, সকল কষ্ট, সকল ভাবনার অবসান!
হঠাৎ দূর থেকে একটা শব্দ জেগে উঠে চারিদিকের নিস্তব্ধতার মুখে যেন ভাষা দিল! ঘড় ঘড় ঘড় ঘড় করে একটা বাজ ডাকার মতন শব্দ আমার দিকেই এগিয়ে আসছে-তারপরেই শুনলাম ভেঁপুর আওয়াজ-ভোঁপ, ভোঁপ, ভোঁপ, ভোঁপ৷
ট্যাক্সি, না বাস? আহ্লাদে চাঙ্গা আর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম৷
তারপরেই দেখা গেল, নীচে দুটো আর উপরে একটা আলো৷ তিনটে আলো দেখেই বুঝলাম ট্যাক্সি নয়, বাস আসছে৷ . . . তাহলে জ্বরের ধমকে আমি ভুল বুঝেছিলাম, বাস যখন চলছে তখন রাত খুব বেশি হয়নি! কিন্তু আশ্চর্য, এরই মধ্যে এ-অঞ্চলটা এমন ভয়ানক নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে? বাবা, আমার কলকাতার গোলমাল বেঁচে থাক, এ-অঞ্চলে আবার ভদ্রলোক বাস করে?
কিন্তু বাসের আলো অত বেশি জ্বলছে কেন, সামনের সারাপথে সে যেন আগুনের ঢেউ বইয়ে ছুটে আসছে! আর এই নিরালা পথে অত জোরে ভেঁপু বাজাবারই বা দরকার কী? এ-অঞ্চলের সন্ধের পরেই ঘুমকাতুরে লোকগুলোর কানে যে তালা ধরে যাবে৷
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে ধুলোয় ধুলোয় পথ অন্ধকার করে একখানা রাঙা টকটকে মস্ত বড়ো বাস আমার কাছে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে একজন তীব্র, তীক্ষ্ণস্বরে চেঁচিয়ে উঠল-‘ধর্মতলা, ওয়েলেসলি, শ্যামবাজার!’
আমি তাড়াতাড়ি বাসে উঠে একখানা গদিমোড়া আসনের উপর গিয়ে ধুপ করে বসে পড়লাম৷ হোক শ্যামবাজারের বাস, এই স্তব্ধ মড়ার মুল্লুক থেকে এখন তো সরে পড়ি, শ্যামবাজার থেকে বাগবাজার পায়ে হেঁটে যেতে এমন বিশেষ দেরি লাগবে না!
. . . . . . . . .
কিন্তু কেন জানি না, বাসের ভিতরে ঢুকেই আমার বোধ হল, আমি যেন এক জগৎ ছেড়ে আর এক অচেনা জগতের ভিতরে প্রবেশ করলাম৷
বাস ছুটছে তার ভেঁপু বাজছে৷ এত বেগে বাস ছুটছে, তার জানলাগুলো সব খোলা রয়েছে, অথচ বাহির থেকে বাতাসের একটুখানি ঝলক পর্যন্ত আমার গায়ে লাগছে না! ভারি অবাক হয়ে গেলাম, আমার জ্বর কি এত বেশি উঠেছে যে, দেহের অনুভব করবার ক্ষমতাটুকুও আর নেই?
পথ তেমনই নির্জন আর অসাড়৷ কিন্তু বাতাসও কি আজ ঘুমিয়ে পড়েছে? আমার খালি মনে হতে লাগল, দম বন্ধ হয়ে সারা পৃথিবী আজ মারা পড়েছে-তার কোথাও আর জীবনের লক্ষণ নেই৷ বেঁচে আছি খালি আমি ও এই বাসের ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর৷
আমরা তিন জন ছাড়া বাসের ভিতরেও আরোহী ছিল না৷ থাকবেই-বা কেন? এত রাতে কার ঘাড়ে ভূত চাপবে যে, বাসে চড়ে বেড়াতে বেরোবে!
বাসের ভেঁপু বাজছে আর বাজছে আর বাজছে! কান যে ঝালাপালা হয়ে গেল! কন্ডাক্টরের দিকে ফিরে বিরক্ত স্বরে বললাম, ‘ড্রাইভারকে বারণ করে দাও৷ পথে লোকও নেই, গাড়িও নেই-তবু এত হর্ন বাজছে কেন?’
লোকটা শিখ৷ মস্ত বড়ো লম্বা দেহ, মস্ত বড়ো দাড়ি৷ সে কালা আর বোবার মতো আমার পানে তাকিয়ে রইল৷
আবার বললাম, ‘শুনছ? হর্ন দিতে বারণ করো!’
সে তবু জবাব দিল না, ড্রাইভারকে হর্ন থামাতেও বলল না৷ লোকটা সত্যি সত্যিই কালা ও বোবা নাকি? কিন্তু না, তাই বা হবে কী করে? এই খানিক আগেই তো সে ‘ধর্মতলা, ওয়েলেসলি, শ্যামবাজার’ বলে চেঁচিয়ে পাড়া মাত করছিল!
সে বোধ হয় আমার কথার জবাব দিতে চায় না৷ এরা কি ভেবেছে যে, এদের ভেঁপুর আওয়াজে সারা শহরের ঘুম ভেঙে যাবে, আর তাহলেই সবাই বিছানা থেকে লাফিয়ে পড়ে ছুটে এসে বাসের প্যাসেঞ্জার হয়ে বসবে?
কিন্তু শহর জাগবার কোনো লক্ষণ প্রকাশ করল না৷ পথের আশেপাশে লেড়ি কুকুরগুলো আরাম করে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল, কিন্তু এই বাসের সাড়া পেয়েই তারা তাড়াতাড়ি উঠে ল্যাজ পেটের তলায় ঢুকিয়ে ছুটে পালাতে লাগল-মহা ভয়ে কেঁউ কেঁউ করে কাঁদতে কাঁদতে! আজকে বাইরের জীবের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে কেবল ওই কুকুরগুলোর কাছ থেকে, কিন্তু তারাও দেখা দিয়েই অদৃশ্য হচ্ছে!
কুকুরগুলো কেন আমাদের বাস দেখে পালাচ্ছে? মনের ভিতরে কেবল এই প্রশ্নই জাগতে লাগল-কেন? কেন? কেন?
কন্ডাক্টর কেন আমার জবাব দিচ্ছে না?-কেন? কেন?
কন্ডাক্টরের দিকে ফিরে বললাম, ‘তোমার ভাড়ার পয়সা নাও৷’
সে মস্ত একখানা কালো হাত বাড়াল৷ ভাড়া দিয়ে টিকিট নেবার সময়ে আমার হাতে তার হাতের ছোঁয়া লাগল-উঃ, অমনি মনে হল কে যেন একখানা তীক্ষ্ণ বরফের ছুরি দিয়ে আমার হাতে খ্যাঁচ করে খোঁচা মারল! জ্যান্ত মানুষের হাত এমন ঠান্ডা কনকনে হয়!
আশ্চর্য হয়ে তার মুখের দিকে তাকালাম৷ তার লম্বা চুল আর দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলে ভরা মুখখানা বাসি মড়ার মুখের মতো স্থির৷ তার চোখেও পলক পড়ছে না, তার চোখ যেন পাথরে গড়া৷
আমার বুকটা গুড়গুড় করতে লাগল৷ আজকের শহরের এই নির্জনতা, পৃথিবীর এই নিঃশব্দতা, বাতাসের এই অভাব, ভাড়াটে বাসের এই ভেঁপুর আওয়াজ, কন্ডাক্টরের এই উদাসীন মূর্তি-সমস্তই যেন রহস্যময়, সমস্তই যেন অস্বাভাবিক!
কী কুক্ষণেই আজ বাড়ির বাইরে পা দিয়েছি!
যতবার ফিরে তাকাই, ততবারই কন্ডাক্টরের সেই মড়ার মতো স্থির মুখ আর পলকহারা পাথুরে দৃষ্টি চোখে পড়ে! কেমন একটা অমানুষিক ভাবে আমার মনটা ছেয়ে গেল-আর সহ্য করতে পারলাম না-সামনের বেঞ্চের উপরে, দুই হাতের ভিতরে মাথা রেখে চোখ মুদে আমি চুপ করে বসে রইলাম৷-ভাবলাম, শ্যামবাজারে পৌঁছোবার আগে আর মাথা তুলে চাইব না!
কিন্তু মাথা তুলতে হল-আবার চোখ খুলতেও হল৷
আধ ঘণ্টারও বেশি সময় কেটে গেছে, গাড়িও না থেমে ক্রমাগত ছুটছে, তবু এখনও শ্যামবাজার এল না কেন?
মুখ তুলে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আমার আর বিস্ময়ের সীমা রইল না৷ শ্যামবাজার তো অনেক দূরের কথা, গাড়ি এখনও ভবানীপুরেই আসেনি৷ অথচ গাড়ি এত বেগে ছুটছে যে পথের দু-পাশের বাড়িগুলো তিরের মতন পিছনে সরে সরে যাচ্ছে! এও কি সম্ভব?
হতভম্বের মতন মুখ ফিরিয়েই দেখি, গাড়ির ভিতরে দশ-বারোজন লোক বসে রয়েছে! নিজের চোখকেও আমি আর বিশ্বাস করতে পারলাম না!
আমি হলপ করে বলতে পারি, এতক্ষণের ভিতরে গাড়ি একবারও থামেনি, তবু কোত্থেকে এরা এল, কখন এরা গাড়িতে উঠল?
একে একে সকলকার মুখের পানেই তাকিয়ে দেখলাম, সব মুখই মড়ার মতন স্থির, নির্বিকার, সব চোখের পাথুরে দৃষ্টিই আড়ষ্ট হয়ে আছে৷ কে যেন শ্মশান থেকে কয়েকটা মৃতদেহ তুলে নিয়ে এসে বেঞ্চের উপরে সারি সারি বসিয়ে দিয়ে গেছে৷
তাদের ভিতরে বাঙালি আছে, খোট্টা আছে, সাহেব আছে৷ কিন্তু তারা সবাই চেয়ে আছে আমার দিকেই৷ সে চাউনিতে কোনো ভাবের আমেজ নেই, সে চাউনি যেন চাউনিই নয়-অথচ সে চাউনি দেখলেই গা ছমছম করে, দেহের রক্ত ঠান্ডা হয়ে যায়৷ তাদের চাউনি যেন চোখের ভিতর দিয়ে আসছে না,-আসছে আলোকের উপর ওপার থেকে, অন্ধকারের আত্মার ভিতর থেকে, যে দেশে জ্যান্ত মানুষ নেই-সেই দেশ থেকে; ভাবহীন অথচ ভয়ানক তাদের সেই চাহনি!
আর এক আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, গাড়ির ঝাঁকুনিতেও তাদের কারুর দেহ একটুকুও নড়ছে না৷ গাড়ির ভিতর বসেও তাদের দেহ যেন গাড়িকে না ছুয়ে শূন্যে বিরাজ করছে৷ মনে হতে লাগল, আমার অজ্ঞাতসারে যেমন হঠাৎ তারা গাড়ির ভিতরে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, তেমনই হঠাৎ তারা আবার হাওয়া হয়ে হাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে যেতে পারে, আমার অজান্তেই৷ যেন তারা ছায়ার কায়াহীন অনুচর-দেখা দেয়, ধরা দেয় না৷ তাদের দেখা যায়, ধরা যায় না৷
আমার সভয় দৃষ্টি আবার পথের দিকে ফিরিয়ে নিলাম! গাড়ি তেমনই হেঁচকি-তোলা আওয়াজের মতন ভেঁপুর শব্দ করতে করতে তিরবেগে ছুটছে-কিন্তু তখনও ভবানীপুর আসেনি! আমি শ্যামবাজার, না সোজা যমালয়ের দিকে চলেছি?
কী এক দুঃসহ, অজানা টানে অস্থির হয়ে চোখ আবার গাড়ির ভিতরে ফেরালাম৷ গাড়িতে ইতিমধ্যে লোকের সংখ্যা আরও বেড়ে উঠেছে-তারাও স্থির নেত্রে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে!
সমস্ত গাড়ির ভিতরে একটা বোটকা গন্ধ ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে-যেন বাসি মড়ার গন্ধ৷ হাসপাতালে মড়ার ঘরে গিয়ে আমি একবার এইরকম গন্ধই পেয়েছিলাম!
আমার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিল, বুকের কাছটা শিউরে শিউরে উঠতে লাগল-আমি কি জেগে আছি, না স্বপ্ন দেখছি?
আর থাকতে না পেরে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বললাম, ‘এই কন্ডাক্টর, গাড়ি বাঁধো!’
কন্ডাক্টর কোনো সাড়া দিল না, গাড়ি থামাবারও চেষ্টা করল না৷
আবার বললাম, কিন্তু কোনো ফল হল না৷
রেগে দাঁড়িয়ে উঠে কন্ডাক্টরের দেহ ধরে নাড়া দিতে গেলাম-কিন্তু তাকে ছুঁতেও পারলাম না! চোখের সামনে তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু তাকে স্পর্শ করতে পারছি না-সে দেহ যেন হাওয়া দিয়ে তৈরি!
হঠাৎ গাড়ির সব লোক এক সঙ্গে অট্টহাস্য শুরু করে দিল৷ সে অদ্ভুত বীভৎস হাসি আসছে যেন অনেক দূর থেকে, অনেক আকাশ-বাতাস ভেদ করে, অনেক সমুদ্র-পাহাড়-প্রান্তর পার হয়ে, অনেক নরকের অন্ধকারে ডুব দিয়ে-অথচ তার আওয়াজ এত স্পষ্ট যে, আমার কান যেন ফেটে যাবার মতো হল!
আমি পাগলের মতো চিৎকার করে বললাম, ‘গাড়ি থামাও, জলদি গাড়ি থামাও,-এই ড্রাইভার!’-গাড়ি থামানো ঘণ্টার দড়ি ধরে আমি ঘন ঘন নাড়তে লাগলাম!
ড্রাইভার এতক্ষণ পরে আমার দিকে মুখ ফেরাল-সে মুখে এক তিলও মাংস নেই, সে মুখ সাদা-ধবধবে হাড়ের মুখ-নাক-চোখের জায়গায় তিন-তিনটে গর্ত, দু-ঠোঁটের জায়গায় দু-সারি দাঁত বেরিয়ে আছে৷
এতক্ষণ তবে এই পোশাক-পরা কঙ্কালটাই গাড়ি চালিয়ে আসছে?
গাড়ির ভিতর অট্টহাসির আওয়াজ আরও বেড়ে উঠল!
আর সইতে পারলাম না-সেই ভীষণ অট্টহাসি শুনতে শুনতে আমি একেবারে অজ্ঞান হয়ে গেলাম!
. . . . . . . . .
জ্ঞান হয়ে দেখলাম, নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে আছি, আমার চারপাশে বসে মা, বাবা, ভাই আর বোনেরা৷
শুনলাম, আমি নাকি রসা রোডের ফুটপাথের উপরে জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ হয়ে শুয়েছিলাম৷
কালকের রাতের বিভীষিকার কথা সকলকে বললাম৷
বাবা বললেন, ‘ও-সব বাজে কথা৷-জ্বরের ঝোঁকে লেকের ধার থেকে রসা রোড পর্যন্ত এসেই তুমি বেহুঁস হয়ে পড়েছিলে৷ তারপর ওইসব খেয়াল দেখেছ!’
কিন্তু আমার মন বলতে লাগল-না, না, আমি যা দেখেছি তা খেয়াল নয়, খেয়াল নয়!