কঙ্কালের টংকার
ছেলেবেলায় আমি কবিতা লিখতাম৷ আমার আত্মীয়রা আমায় তিরস্কার করতেন৷ বন্ধুরা ঠাট্টা করতেন৷ মাস্টারমশাই প্রহার দিতেন এবং কাগজের সম্পাদকরা না ছেপে ফেরত দিতেন৷ কিন্তু বলে রাখি, একদিন সমূহ বিপদ থেকে যে আমার প্রাণরক্ষা হয়েছিল সে শুধু আমার ওই কবিত্ব শক্তির জোরে৷ তোমরা আশ্চর্য হচ্ছ, কবিতা আমার প্রাণ রক্ষা করল কেমন করে? সত্যি বলছি সেদিন কারও সাধ্য ছিল না যে মরণাপন্ন আমাকে রক্ষা করে! ভাগ্যে কবিতা লিখতে শিখেছিলাম তাই বেঁচে গেলাম৷ নইলে লোকের অত্যাচারে কবিতা লক্ষ্মীকে বাল্য বয়সে বিদায় দিলে, সেদিন আমার যে কী অবস্থা হত তা আমিই জানি৷ গল্পটা তাহলে খুলেই বলি৷
নানা স্থান ঘুরে আমি যাচ্ছিলাম জয়পুর থেকে দিল্লি৷ টাইম-টেবল খুলে দেখলাম, টানা দিল্লি যেতে হলে রাত্রের গাড়িটাই সুবিধে৷ কিন্তু সে ট্রেন অনেক রাত্রে ছাড়ে-প্রায় দুটো৷ একে জয়পুরের মতো জায়গা, তায় মাঘ মাসের শীত! তার ওপর রাত্রি দুটো-এই ত্র্যহস্পর্শ ঘাড়ে নিয়ে যাত্রা করতে আতঙ্কে আমার বুক কাঁপতে লাগল৷ কিন্তু উপায় কী? আমি স্টেশনমাস্টারকে বললাম-“কী উপায় করা যায় বলুন দেখি? এই দারুণ শীতে ভোররাত্রে বিছানা ছেড়ে উঠে ট্রেন ধরবার কথা মনে করতেই তো আমার কম্প দিয়ে জ্বর আসছে৷”
স্টেশনমাস্টার জিজ্ঞেস করলেন-“আপনি কী ফাস্ট ক্লাস প্যাসেনজার?”
তখন বড়োদিনের ছুটিতে রেল কোম্পানি আধা ভাড়ায় সর্বত্র যাতায়াতের ব্যবস্থা করায় আমি সস্তায় বড়োমানুষি করছিলাম৷ বুক ফুলিয়ে বললাম- “হ্যাঁ, আমার ফাস্ট ক্লাসের টিকিট৷”
স্টেশনমাস্টার বললেন-“প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের জন্যে খুব একটা ভালো ব্যবস্থা আছে৷”
আমি বললাম-“কী?”
তিনি বললেন-“আপনি এক কাজ করবেন৷ সন্ধ্যা আটটার মধ্যে খেয়েদেয়ে স্টেশনে আসবেন৷ আপনাদের জন্যে একখানা ফাস্ট ক্লাস গাড়ি ওই সাইডিঙে কেটে রেখে দেব, আপনি তাতে বিছানা পেতে শুয়ে পড়বেন লেপ মুড়ি দিয়ে৷ তারপর রাত্রে যখন মেল আসবে তাতে আপনার গাড়ি লাগিয়ে দেব-আপনি দিব্যি ঘুমোতে ঘুমোতে দিল্লি গিয়ে পৌঁছোবেন৷”
আমি বললাম-“বাঃ, এ তো বেশ!”
স্টেশনমাস্টার বললেন-“হ্যাঁ, শীতের রাতে গাড়ি ধরবার অসুবিধে বলেই তো কোম্পানি বড়োলোক যাত্রীদের জন্যে এই ব্যবস্থা করেছেন৷”
আমি বললাম-“খুব ভালো ব্যবস্থা৷ আমি তাহলে আটটার মধ্যেই আসব-আপনি গাড়ি ঠিক রাখবেন৷”
তিনি বললেন-“গাড়ি ঠিক থাকবে৷ কিন্তু আপনি দেরি করবেন না৷ আটটার পর আর ট্রেন নেই বলে আমরা আটটার সময় স্টেশন বন্ধ করে চলে যাই৷’
আমি বললাম-“আটটার মধ্যেই আসব৷” বলে আমি চলে গেলাম৷
তারপর সন্ধ্যা বেলা আহারাদি সেরে পায়ে তিন জোড়া ডবল মোজা, গায়ে দুটো গেঞ্জির উপর একটা মোটা ফ্ল্যানেলের কামিজ, তার উপর সোয়েটার তার উপর তুলো ভরা মেরজাই, তার উপর ওয়েস্ট কোট, কোট, ওভার কোট এবং সর্বোপরি একটা মোটা বালাপোশ মুড়ি দিয়ে, মাথাটাকে কানঢাকা টুপি ও পশমের গলাবন্ধ দিয়ে এঁটে কাঁপতে কাঁপতে ঠিক আটটার সময় স্টেশনে এসে হাজির হলাম৷ আমার মস্ত বড়ো লোহার তোরঙ্গটা দু-জন কুলি এসে ধরাধরি করে নামাতে গিয়ে একজন ফিক করে একটু হেসে ছেড়ে দিল৷
আমি বললাম-“কেয়া হল রে?”
সে বলল-“বাবুজির তোরঙ্গ দেখছি ফাঁকা৷ যা দু-একটো ধুতি-উতি আছে, সেগুলো গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বাক্সটা আমাদের বখশিশ করে যান বাবু-আপনার কুলিভাড়া, রেলমাশুল অনেক বেঁচে যাবে৷”
আমি বললাম-“যা যা, তোমকো আর ইয়ে করতে হবে না!” বলেই আমি হনহন করে স্টেশনমাস্টারের ঘরের দিকে চলে গেলাম৷ স্টেশনমাস্টার আমায় দেখেই বললেন-“গুড ইভনিং বাবু! আপনার ভাগ্য খুব ভালো- আজ আর কোনো প্যাসেঞ্জার নেই৷ সমস্ত গাড়িটাই আপনার একলার! চলুন আপনাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসি৷” বলে তিনি আমাকে নিয়ে প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে, পাঁচ-ছয়টা রেল লাইন টপকে, অনেক দূর চলে চলে একটা ফাঁকা মাঠের ধারে এনে দাঁড় করালেন৷ সামনে দেখলাম একখানা ধোঁয়াটে রঙের গাড়ি কাটা পড়ে রয়েছে-ঠিক যেন একটা কন্ধকাটা, অন্ধকারের আড়ালে গা লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে!
মাস্টারবাবু গাড়িটার চাবি খুলে দিয়ে বললেন-“নিন-উঠে পড়ুন৷ বিছানা পেতে শুয়ে পড়ুন৷” বলেই তাড়াতাড়ি তাঁর হাত বাতিটা তুলে নিয়ে ‘গুড নাইট’ বলে ছুট দিলেন৷ অন্ধকারে তাঁকে আর দেখতে পেলাম না, রেল লাইনের খোয়াগুলোর উপর তাঁর জুতোর খসখস শব্দ কেবল শুনতে লাগলাম৷ ছ্যাঁৎ করে আমার মনে হল-তাইতো, মাস্টারবাবু অমন করে পালালেন কেন?
ইতিমধ্যে দেখি কুলি দুটো আমার তোরঙ্গ ও বিছানাটা গাড়ির মধ্যে তুলে দিয়েই বলছে-“বাবুজি পয়সা৷” আমি তাদের হাতে পয়সা দিতেই, তারাও ছুট দিল স্টেশনের দিকে৷ ব্যাপার কী? আমি হতভম্ভের মতো দাঁড়িয়ে ভাবছি, দেখি দুটো কয়লামাখা কালো ভূত রেল লাইনের বাঁধের নীচে থেকে উঠে অন্ধকারের মধ্যে কেবল চারটে সাদা চোখ দিয়ে আমায় দেখতে দেখতে স্টেশনের দিকে চলে গেল৷ তাদের পিছনে একটা কুকুর ল্যাজ তুলে দৌড় দিল৷ তার পরেই সব একেবারে নিস্তব্ধ! একেবারে অন্ধকার!
অমাবস্যার রাত্রি-চারিদিক অন্ধকার ঘুটঘুট করছে৷ সেই অন্ধকারে একটা মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি এদিক-ওদিক চারদিক দেখতে লাগলাম- আশেপাশে কেউ নেই৷ দূরে কেবল গাছগুলো অসাড় হয়ে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে৷ গায়ের ভেতরটা কেমন ছমছম করতে লাগল৷
আমি আস্তে আস্তে গাড়ির মধ্যে গিয়ে উঠলাম৷ গাড়ির ভেতরটা একেবারে অন্ধকারে ঠাসা৷ তাড়াতাড়ি দেওয়াল হাতড়ে বিজলি বাতির চাবি টিপলাম-খুট করে শব্দ হল, আলো হল না৷ সর্বনাশ! আলো নেই না কি? আলোর সুইচ নিয়ে অনেক নাড়ানাড়ি করলাম, কোনো ফল হল না, যেমন অন্ধকার তেমনই! পকেট খুঁজলাম, দেশলাই নেই৷ কেমন করেই বা থাকবে? আমি তো চুরুট খাই না-লুকিয়েও না৷ হয়তো তোরঙ্গের মধ্যে একটা দেশলাই আছে৷ চাবি খুঁজতে লাগলাম, পইতেতে চাবি বাঁধা ছিল৷ বালাপোশ, ওভারকোট, কোট, ওয়েস্টকোট, সোয়েটার গেঞ্জির গোলক-ধাঁধার মধ্যে কোথায় যে পইতে গাছটা হারাল কিছুতেই খুঁজে পেলাম না৷ বামুনের ছেলে, বিপদে-আপদে বিদেশবিভুঁয়ে যজ্ঞোপবীতটাই মস্ত সহায়! সেটাকেও শেষে খোয়ালাম? সেই অন্ধকারে আমার যেন হাঁপ ধরতে লাগল৷ অন্ধকার যে জাঁতাকলের মতো মানুষের বুককে এমন করে পিষতে থাকে-এ আমি জানতাম না৷ আমি গাড়ির মধ্যে এদিক-ওদিক করে ছটফট করতে লাগলাম! মনে হল যেন প্রাণ বেরিয়ে যাবে৷ মাথা ঘুরতে লাগল- চোখের সামনে নানারকম ছায়া দেখতে লাগলাম, কানে কাদের সব ফিসফিস কথা এসে লাগতে লাগল! কোথায় একটু আলো পাই? আমি ছুটে গাড়ি থেকে বেরিয়ে রেলের লাইন থেকে দুটো পাথর তুলে ঠকঠক করে সজোরে ঠুকতে লাগলাব-যদি একটু আলোর ফিনকি পাই! কিন্তু হায় অদৃষ্ট, আলোর বদলে পাথর কুচির ফিনকি এসে আমার চোখ দুটোকেই ঝনঝনিয়ে দিল!
আমি দু-হাতে চোখ রগড়াতে রগড়াতে স্টেশনের দিকে ছুট দিলাম- যেমন করে পারি, সেখান থেকে একটা আলো নিয়ে আসব৷ স্টেশনমাস্টারটা কী পাজি! এই অন্ধকারে মাঠের মধ্যে আমায় একলা ফেলে গেল, একটা আলো দিল না! বলল কিনা, দিব্যি ঘুমোতে ঘুমোতে যাবেন! পাজি কোথাকার! আমি ছুটতে ছুটতে একেবারে স্টেশনের কাছে এসে হাঁপ নিয়ে দাঁড়ালাম- প্ল্যাটফর্মের কিনারায় যে একটা বাঁকা খেজুরগাছ ছিল, ঠিক তার সামনে৷ কিন্তু একী? এই তো সেই খেজুরগাছ৷ এই তো-এই তো রয়েছে৷ কিন্তু স্টেশন কোথায়? আমি এদিক-ওদিক চারদিক চেয়ে দেখলাম-স্টেশন নেই৷ মনে হল কালো স্লেটের গা থেকে ছেলেরা যেমন তাদের আঁকা ছবিগুলো মুছে ফেলে ঠিক তেমনি করে অন্ধকারের গা থেকে স্টেশনটাকে একেবারে কে মুছে ফেলেছে! আমার বুকটা ধক করে উঠল৷ আমি আর তিলমাত্র না দাঁড়িয়ে আবার ছুটলাম-যে পথে এসেছিলাম সেই পথে, আমার গাড়ির দিকে৷ টপাটপ পাঁচ-ছয়টা লাইন টপকে ছুটতে ছুটতে আমি যখন সেই মাঠের ধারে আমার গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম, তখন দেখি অতবড় গাড়িখানা নিয়ে কে উধাও হয়েছে৷ গাড়ির চিহ্নমাত্র সেখানে নেই৷ কী সর্বনাশ!
আবার ভালো করে চারদিক চেয়ে দেখলাম-স্টেশনও নেই, গাড়িও নেই৷ চারদিক খাঁ-খাঁ করছে! এখন উপায়? এই রাত্রে আশ্রয় পাই কোথা? করি কী? একবার মনে হল, যাই, আর একবার গিয়ে ভালো করে স্টেশনটা খুঁজে আসি৷ কিন্তু স্টেশনের দিকটার সেই খাঁ-খাঁ মূর্তি মনে হয়ে আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল৷ ছেলেবেলায় গল্প শুনতাম দৈত্যদানোরা রাতারাতি বড়ো বড়ো বাড়ি :উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে আবার সকালে যেখানকার বাড়ি সেইখানে রেখে যেত-এ কি তাই হল নাকি? মনে তো বিশ্বাস হয় না, কিন্তু চোখে তো দেখছি তাই৷
হঠাৎ বুকটা কেঁপে উঠে মনে হল এমন করে রেল লাইনের উপর দাঁড়িয়ে থাকা তো ঠিক নয়-আচমকা একখানা গাড়ি এসে চাপা দিয়ে যেতে পারে! যেই এই কথা মনে হওয়া তাড়াতাড়ি লাইন থেকে অন্যদিকে ছুটে গেলাম! কিন্তু যেদিকে যাই, সেইদিকেই রেলের লাইন! সামনে পিছনে, ডাইনে বাঁয়ে যে দিকে ছুটি, সেইদিকেই দেখি রেলের লাইন! সামনে পিছনে, ডাইনে বাঁয়ে যে দিকে ছুটি, সেইদিকেই দেখি রেলের লাইন লোহার জাল দিয়ে আমায় ঘিরে ফেলেছে-পালাবার উপায় আর নেই! আমার এই ছুটোছুটি দেখে অন্ধকার থেকে কারা যেন হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল৷ আমি চমকে উঠে থেমে দাঁড়তেই টাল সামলাতে না পেরে একেবারে বাঁধের উপর থেকে গড়াতে গড়াতে গিয়ে এক গাছতলায় এসে পড়লাম৷ মনে হল প্রাণটা যেন বাঁচল৷ ট্রেন চাপা পড়বার আর ভয় নেই৷
গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে চুপ করে বসে রইলাম৷ মনে হতে লাগল- কতক্ষণে রাত্রিটা কাটবে৷ কিন্তু রাত্রির যেন আর শেষ নেই৷ বসে বসে দেখতে লাগলাম, নিস্তব্ধ রাত্রি ঝিমঝিম করতে করতে আরও নিঝুম হয়ে আসছে৷ আর রাত্রের অন্ধকারটা তার কালো গায়ের উপর চামচিকের ডানার মতো একখানা কালো কুৎসিত কম্বল আস্তে আস্তে টেনে মুড়ে দিচ্ছে৷ পৃথিবীর গা থেকে একে একে সব জিনিস যেন মুছে আসছে৷ দেখতে দেখতে আমি সুদ্ধ যেন মুছে আসতে লাগলাম৷ কালো জুতো মোজা পরা আমার লম্বা পা দু-খানা একটু একটু করে মুছে গেল৷ কালো ওভারকোট ও নীল বালাপোশ মোড়া গা-তাও আস্তে আস্তে মুছতে লাগল৷ যখন প্রায় কোমর অবধি মুছে গেছে, আমি আর সে দৃশ্য দেখতে পারলাম না-তাড়াতাড়ি চোখ বুজে ফেললাম৷ চোখ বুজে মনে হতে লাগল-আমি আছি কি নেই? আছি কি নেই?
‘আছে, আছে-এইখানে আছে-‘ বলে কানের কাছে কে একজন চিৎকার করে উঠল৷ আমি চোখ চেয়ে দেখি, মানুষের দেহের মেদ মাংস ছাড়িয়ে নিলে যেমন হয়, তেমনিতর একটা কঙ্কাল তার কাঠির মতো সরু সরু লম্বা আঙুল নেড়ে ইশারা করে কাকে ডাকছে৷ দেখতে দেখতে ঠিক তারই জুড়ি আর একটা কঙ্কাল লাফাতে লাফাতে তার পাশে এসে দাঁড়াল৷ তারপর আর একটা৷
দ্বিতীয় কঙ্কালটা আস্তে সরে আমার খুব কাছে এসে ঘাড় হেঁট করে আমায় দেখতে লাগল৷ তার চোখের উপর চোখ পড়তে দেখলাম-না আছে পাতা, না আছে তারা, শুধু দুটো গোল গোল গহ্বর কালো কটকট করছে৷ সে আমাকে বেশ নিরীক্ষণ করে দেখে জিজ্ঞাসা করল-“এই নাকি সে?”
প্রথম কঙ্কালটা বললে-“সে না তো কে?”
দ্বিতীয়টা বলল-“বেশ বেমালুম লুকিয়েছে তো, একেবারে চেনবার জো নেই!”
শেষ কঙ্কালটা ছুটে এসে বলল-“কই দেখি৷” বলে তার হাড় বার করা আঙুলগুলো দিয়ে টিপে টিপে আমায় দেখতে লাগল৷
“ও আর দেখছিস কী? ও সেই! আমার চোখে কি ধুলো দেবার জো আছে-হাজারই লুকোক না!” বলে প্রথম কঙ্কালটা এতখানি হাঁ করে বিকট শব্দে হেসে উঠল৷ মুখের ভেতর থেকে তার সেই সাদা সাদা দাঁতগুলো বেরিয়ে অন্ধকারকে যেন কামড়ে ধরল৷
শেষ কঙ্কালটা বলল-“তবে একটু পরখ করে নেওয়া ভালো৷ কী জানি যদি ভুল হয়৷” প্রথম কঙ্কাল বলল-“নে আর পরখ করতে হবে না; ও দিকে লগ্ন বয়ে যায়৷” বলে সে আমার শিয়রের কাছে এসে দাঁড়াল! আমি ভাবলাম-ব্যাস, এইবার আমার শেষ!
দেখতে দেখতে বাকি দুটো কঙ্কাল এগিয়ে এসে আমার পা দু-খানা ধরল, প্রথমটা মাথার দিকটা ধরল৷ তারপর তিনজনে মিলে মাটি থেকে চ্যাংদোলা করে আমায় তুলে ফেলল৷ আমি তাড়াতাড়ি দু-হাত দিয়ে গাছের গুঁড়িটা চেপে ধরে বলে উঠলাম-“কোথায় নিয়ে যান মশাই!”
তারা বলল-“বিয়ে দিতে!”
আমি চমকে উঠে বললাম-“বিয়ে দিতে কী মশাই! এই বুড়ো বয়সে?”
একজন বলল-“বুড়ো বরই আমরা পছন্দ করি৷”
আমি বললাম-“মশাই, আমার চেয়ে ঢের বুড়ো আছে, তাদের কাউকে নিয়ে যান না, আমায় কেন মিছিমিছি কষ্ট দিচ্ছেন!” প্রথম কঙ্কালটা চেঁচিয়ে বলে উঠল-“তুমি ভেবেছ, পালিয়ে এসে লুকিয়ে থাকলে রেহাই পাবে? তোমাকে আমরা জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেব৷”
আমি বললাম-“আমি তো মশাই পালিয়ে এসে লুকিয়ে নেই৷ সেই ছোটোবেলায় একবার পালিয়েছিলাম বটে; তারপর তো জ্যাঠামশাই পুলিশ দিয়ে ট্রেন থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে আমার বিয়ে দেন৷”
সে বলল-“আমরাও পুলিশ এসেছি, ধরে নিয়ে গিয়ে তোমার বিয়ে দেব বলে৷” আমি কাঁচুমাচু হয়ে বললাম-“কিন্তু আমি তো আর বিয়ে করতে পারব না৷”
“পারবে না কী? বিয়ে তোমায় করতেই হবে৷”
“এমন কী তোমার গোঁ?” বলে সেই পয়লা নম্বরের কঙ্কালটা ভীষণ গর্জন করে উঠল৷
আমি বললাম-“রাগ করেন কেন মশাই! আমি ছাড়া কি পাত্র নেই? কত ছেলে হয়তো খুশি হয়ে বিয়ে করবে৷”
সে বলল-“এত রাত্রে এখন ভালো পাত্র পাই কোথা? যার-তার হাতে তো মেয়ে দেওয়া যায় না! চলো লগ্ন বয়ে যায়৷”
আমি কাঁদো-কাঁদো হয়ে বললাম-“তাহলে নিতান্তই কি আমাকে বিয়ে করতে হবে?”
শেষ কঙ্কালটা আমার কাছে আস্তে আস্তে এগিয়ে নরম সুরে বলল- “দুঃখ করছিস কেন ভাই ক্যাংলা৷”
আমি তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠে বললাম-“ক্যাংলা কে মশাই! আমি তো ক্যাংলা নই, আমি শ্রীমাধবচন্দ্র চক্রবর্তী৷ আমার পিতার নাম ঁমধুসূদন চক্রবর্তী৷’
প্রথম কঙ্কালটা হো হো করে হেসে উঠে বলল-“রাধে মাধব৷ রাধে মাধব৷”
আমি বললাম-“সে কী মশাই?”
সে বলল-“এই এত রাত্রে, এই শ্মশানের ধারে একটা জ্যান্ত শেয়াল-কুকুর থাকে না আর মাধব চক্রবর্তী আছে? তুই এতই বোকা পেলি আমাদের৷”
আমি বললাম-“এই তো আমি রয়েছি!”
সে বলল-“আরে ভাই, মাধব চক্রবর্তীর দেহের ভেতর থেকে কথা কইলেই কি তুই মাধব চক্রবর্তী হয়ে যাবি?”
আমি বললাম-“সে কী মশাই! মাধব চক্রবর্তীর দেহের ভেতর আবার কে এল?”
সে বলল-“আরে ক্যাংলা, তুই মাধব চক্রবর্তীর শূন্য দেহের মধ্যে সেঁধিয়ে আছিস, সে কি আমি টের পাইনি ভেবেছিস?”
আমি বললাম-“এসব কী হেঁয়ালি বকছেন মশাই? মাধব চক্রবর্তীর দেহের মধ্যে যদি ক্যাংলা এল তো মাধব চক্রবর্তী গেল কোথা?”
সে বলল-“আরে ভাই বামুনের ছেলে সে বৈকুন্ঠে গেছে৷”
আমি বললাম-“না মরেই সে বৈকুন্ঠে গেল?”
সে বলল-“মরেছে না তো কী!”
আমি বললাম-“মরেছে কীরকম! সে মরে গেল আর টের পেল না?”
সে বলল-“মানুষ কখন জন্মায় আর কখন মরে, সে কি তা টের পায় না কি!”
কথাটা শুনে বোঁ করে আমার মাথাটা ঘুরে গেল৷ আমার অজান্তে আমি মরে গেলাম নাকি-অ্যাঁ? সেই যে দেখলাম পৃথিবীর গা থেকে একে একে সব মুছে আসছে-সেই কি আমার মৃত্যু না কি? কিন্তু এই তো আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি৷ তা বটে৷ কিন্তু তবু কেমন সন্দেহ হতে লাগল৷ হয়তো এ আমি নই-এ আর কারও আত্মা শূন্য শরীর দখল করেছে৷ নইলে এই কঙ্কালগুলোর সঙ্গে এতক্ষণ কথা কইতে পারতাম? জ্যান্ত মানুষ কি কখনো তা পারে? কিন্তু মারা গেলাম কেমন করে? আমার তো কোনো রোগ হয়নি৷ হয়তো ওই বাঁধের উপর থেকে গড়িয়ে পড়ার সময় পাথরে মাথা লেগে আমার মৃত্যু হয়েছে-আমি টের পাইনি৷
ভাবতে ভাবতে আমার মাথা ঘুলিয়ে যেতে লাগল৷ কেমন মনে হতে লাগল-না, আমি মাধব চক্রবর্তী নই৷ এরা ঠিকই বলেছে-কাঙালিচরণের আত্মা আমার শূন্য দেহের মধ্যে এসে আসন পেতে বসেছে৷ তাইতে আমার দেহের ভ্রম হচ্ছে, মাধব চক্রবর্তীর জের বুঝি এখনও চলছে৷ কিন্তু কাঙালিচরণ লোকটা কে? আমি যদি কাঙালিচরণ হব, তবে আমি আমাকে চিনতে পারছি না কেন? এরা তো চিনতে পেরেছে৷
প্রথম কঙ্কালটা বলে উঠল-“কী হে ক্যাংলা, কী ভাবছ? বিয়ে করবার মতি স্থির হল?”
আমি বললাম-“আচ্ছা মশাই, আমি কি সত্যিই কাঙালিচরণ?” সে খানিক আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে বলল-“সে কীরে ক্যাংলা, তুই নিজেকে নিজে চিনতে পারছিস না?”
আমি বললাম-“না”৷
সে বলল-“সর্বনাশ হয়েছে৷ তুই আমাদেরও চিনতে পারছিস না?”
আমি বললাম-“একটুও না৷”
সে বলল-“তোর মনে পড়ছে না-আজ এই অমাবস্যার দিনে ঘুটঘুটে লগ্নে তোর বিয়ে-রাগেশ্বরীর সঙ্গে?”
আমি বললাম-“কই, আমার তো কোনো বিয়ের কথা হয়নি!” সে বলল-“সে কীরে! তোর গায়ে গোবর পর্যন্ত হয়ে গেছে, মনে পড়ছে না?”
আমি বললাম-“গায়ে গোবর কাকে বলে?” সে বলল-“তুই অবাক করলি! তোর কিছু মনে পড়ছে না? গায়ে গোবরের দিন ভোর রাত্রে তালপুকুরে তুই মাছ মারতে যাচ্ছিলি তত্ত্ব পাঠাবার জন্যে৷ তাল গাছের মাথায় বসে পা ঝুলিয়ে রাগেশ্বরী বর-পণের কড়ি বাচছিল৷ তুই রাগেশ্বরীকে দেখতে পাসনি, সেও তোকে দেখতে পায়নি৷ তারপর তুই যেমন ঠিক তাল গাছের তলাটিতে এসেছিস, অমনি রাগেশ্বরীর পা দুটো দুলতে দুলতে তোর কপালে এসে ঠক করে লেগে গেল৷ রাগেশ্বরী তো লজ্জায় সাত হাত জিভ কেটে, মাথায় ঘোমটা টেনে দৌড়৷ আর তুই বাড়িতে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসে বললি-ও মেয়েকে আমি বিয়ে করব না৷ কেন রে কেন-কী হয়েছে? তুই বললি, ওর পা আমার কপালে ঠেকেছে৷ তাতে কী হয়েছে কী? তুই বললি- হয়েছে আমার মাথা আর মুণ্ডু! বলে কপাল চাপড়াতে লাগলি! এসব তোর মনে পড়ছে না?”
আমি বললাম-“মনে পড়ছে, এই রকম একটা গল্প যেন কোথায় শুনেছিলাম৷ তারপর কী হল?”
সে বলল-“সর্বনাশ করলি! তারপরেও তোর মনে পড়ছে না? তারপর তো গুরুঠাকুর এলেন৷ এসে বিধেন দিলেন যে রাগেশ্বরীর পা তোর মাথায় একবার ঠেকেছে, তুই সাত একে সাত-শো বার তোর পা দিয়ে তার মাথাটা থেঁতলে দে, তা হলেই সব দোষ খণ্ডে যাবে৷ তুই বললি-ওরে বাপরে! রাগেশ্বরীর মাথায় লাথি মারা! সে আমি পারব না! বলে তুই ছুট দিলি৷”
আমি বললাম-“তারপর?”
সে বলল-“তারপর আজ বিয়ের সময় তোকে খুঁজে না পেয়ে, খুঁজতে খুঁজতে এই শ্মশান ঘাটে এসে দেখি, তুই এই মাধব চক্রবর্তীর মড়াটাকেই দানা পাইয়ে বসে আছিস৷ হাঁরে এই মাধব চক্রবর্তীকে যারা পোড়াতে এসেছিল, তারা গেল কোথায়? তোকে দেখে ভয়ে পালিয়েছে বুঝি?”
আমি বললাম-“মাধব চক্রবর্তীকে আবার পোড়াতে আসবে কারা? আমি তো তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না৷”
সে বলল-“তোর কিছুই মনে পড়ছে না? তুই সত্যি বলছিস? না মশকরা করছিস?”
আমি বললাম-“তোমার দিব্যি, আমি সত্যি বলছি৷”
সে বলল-“তবে সর্বনাশ হয়েছে-তোকে মানুষে পেয়েছে!”
আমি বললাম “মানুষে পেয়েছে কী গো!” সে বলল,-“জানিস না বুঝি, আমরা যেমন মানুষের ঘাড়ে চাপি, মানুষেও তেমনই আমাদের কারও কারও ঘাড়ে চাপে, তুই যখন মাধব চক্রবর্তীর দেহে সেঁধিয়েছিলি, তখন বোধ হয় তার একটুখানি প্রাণ ছিল, সেইটে তোকে পেয়ে বসেছে৷”
আমি বললাম-“তাতে কী হয়?”
সে বলল-“মানুষ যেমন তখন নিজেকে চিনতে পারে না, আপনার লোককে চিনতে পারে না, আবোলতাবোল বকে, কটমট করে চোখ ঘুরাতে থাকে, আমাদেরও ঠিক তেমনই হয়৷ তাই তো তুই অমন করছিস-নিজেকে চিনতে পারছিস না, আমাদেরও চিনতে পারছিস না৷’
আমি বললাম-“ও, তাই আমি নিজেকে ক্যাংলা বলে চিনতে পারছি না৷ ওগো তবে আমার কী হবে?”
সে বললে-“যেমন বিয়ে করব না বলে পালিয়ে এসেছিস, তেমনই ঠিক জব্দ!”
আমি বললাম-“ওগো, আমি রাগেশ্বরীকে বিয়ে করব-আমাকে তোমরা উদ্ধার করো৷”
সে বলল-“তবে বেরিয়ে আয় ওখান থেকে৷”
আমি বললাম-“বেরব কী করে গো?”
সে বলল-“পথ হারিয়ে ফেলেছিস বুঝি? মুশকিল করলি দেখছি৷ এক কাজ কর৷ মাধব চক্রবর্তীর ওই কোঁচার খুঁটটা এই গাছের ডালে বেঁধে গলায় একটা ফাঁস দিয়ে তুই ঝুলে পড়-তাহলেই সুড়ুৎ করে বেরিয়ে আসতে পারবি৷”
আমি আঁৎকে উঠে বললাম-“ওরে বাপরে-সে যে ফাঁসি! সে আমি পারব না!”
সে বলল-“ভয় কী! আমি তো কতবার ফাঁসি গেছি! তোর কোনো ভয় নেই, তুই ঝুলে পড়৷”
আমি ভয়ে শিউরে উঠে বললাম-“না গো না-সে আমি পারব না! গলায় ফাঁসি দিতে কিছুতেই পারব না৷”
যেমন এই কথা বলা, সেই প্রথম কঙ্কালটা তার সেই কালো গর্তের মতো চোখ দুটোকে বনবন করে ঘুরিয়ে বলল-“কী, তুই ফাঁসি যেতে পারবি না! আমরা হলাম গলায়-দড়ে! তুই আমাদের ঘরের ছেলে হয়ে, এমন কথা বলিস যে, ফাঁসি যেতে তোর ভয় হয়-কুলাঙ্গার কোথাকার!”
আমি কাঁচুমাচু হয়ে বললাম-“কী করব, আমার যে ভয় করছে!” সে দাঁতের দু-পাটি কড়মড় করতে করতে বলে উঠল-“ফের ওই কথা! এই বেলা ঝুলে পড়, নইলে তোর ভালো হবে না বলছি!”
আমি বললাম-“ওগো, তোমার দু-টি পায়ে পড়ি, আমি ফাঁসিতে ঝুলতে পারব না-আমার ভয় করছে!”
সে আরও রেগে বলল-“হতভাগা কোথাকার! দূর হ, আমাদের সামনে থেকে দূর হ!” বলে সে তেড়ে আমায় মারতে এল৷
দ্বিতীয় কঙ্কালটা এগিয়ে এসে বলল-“রাগ করেন কেন খুড়োমশাই! ও হয়তো ক্যাংলা নয়! নইলে ফাঁসিতে ভয় পাবে কেন?”
খুড়োমশাই বললেন-“কী! ক্যাংলা নয় ও? আমি সাত বচ্ছর টিকটিকি পুলিশে কাজ করেছি, কত বড়ো বড়ো ফেরার পাকড়াও করেছি-আমার ভুল হবে?”
শেষ কঙ্কালটা এগিয়ে এসে বলল-“যখন সন্দেহ হচ্ছে তখন একবার পরখ করে দেখতে ক্ষতি কী দাদামশাই?”
দাদামশাই বললেন-“আচ্ছা বেশ, পরীক্ষা হোক!” বলে আমার দিকে ফিরে বললেন-“কী হে, তুমি মাধব চক্রবর্তী না কাঙালিচরণ?”
আমি বললাম-“আজ্ঞে, আগে তো জানতাম আমি মাধব চক্রবর্তী, কিন্তু তারপর থেকে মনে হচ্ছে কাঙালিচরণ৷”
সে বলল-“কাঙালিচরণ যদি হও, তুমি আমার অবাধ্য হয়েছ বলে তোমায় শাস্তি নিতে হবে-তোমায় ফাঁসি দেব আমরা, এই শ্মশানে এই গাছের ডালে!”
আমি বললাম-“আজ্ঞে আমি তবে মাধব চক্রবর্তী!”
সে বলল-“বেশ, মাধব চক্রবর্তী বলে যদি নিজেকে প্রমাণ করতে পার, তাহলে তোমায় তিনবার সেলাম ঠুকে আমরা চলে যাব৷”
“আর যদি না পারি?”
“তাহলে এইখানে তোমার ঘাড় মটকে রেখে চলে যাব৷”
“ঘাড় মটকে দেবেন? সর্বনাশ! এই বিদেশবিভুঁইয়ে, এই অচেনা জায়গায় এত রাত্তিরে নিজেকে কী করে প্রমাণ করব মশাই?”
“না পার, ঘাড়টি মটকে দেব-শ্মশানের ভূত হয় থেকো৷”
সত্যি বলছি, এই কথা শুনে আমি কেঁদে ফেললাম৷ তখন সেই দ্বিতীয় কঙ্কালটা এগিয়ে এসে বলল-“কাঁদছ কেন? তোমার এমন কোনো চিহ্ন নেই, যাতে প্রমাণ হয়, তুমি মাধব চক্রবর্তী!” আমি বললাম-“আছে৷ এই দেখুন, আমার ডানহাতে একটা জড়ুলের দাগ৷”
সে হেসে বলল-“ও প্রমাণ তোমাদের পুলিশের কাছে চলে, এখানে আমাদের কাছে চলে না৷ কোনো ভেতরের প্রমাণ দিতে পার?”
আমি বললাম-“আমার ভেতরে কী আছে না আছে আমি তো জানি না মশাই! এই দেখুন না, আমার ভেতরে কাঙালিচরণ আছে, কি মাধব চক্রবর্তী আছে, আমি তাই ঠিক ঠাহর করতে পারছি না৷”
প্রথম কঙ্কালটা গম্ভীর স্বরে বলে উঠল-“কাঙালিচরণ হলে তোমায় ফাঁসি দেব কিন্তু৷”
আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম-“আজ্ঞে না, না, আমি মাধব চক্রবর্তী!”
সে বলল-“শিগগির প্রমাণ করো, নইলে ঘাড় মটকালাম বলে৷”
দ্বিতীয় কঙ্কালটা বলল-“অমন ভেবড়ে যাচ্ছ কেন? তোমার কি এমন কোনো গুণ নেই যাতে বোঝা যায় তুমি মাধব চক্রবর্তী?”
আমি বলে উঠলাম-“হ্যাঁ, আছে বই কী! আমার একটা মস্ত গুণ আছে, আমি কবিতা লিখতে পারি!”
প্রথম কঙ্কালটা এগিয়ে এসে বলল-“তুমি কবিতা লিখতে পার? নিজে লেখো? না পরের কবিতা নিজের বলে চালাও?” আমি বললাম-“না মশাই, আমি সেরকম কবি নই!”
সে বলল-“তোমার কবিতা কাগজে ছাপা হয়?”
আমি বললাম-“না, সম্পাদকরা ভয়ে ছাপেন না৷”
সে বলল-“ভয়ে ছাপেন না কীরকম?”
আমি বললাম-“আমার কবিতা এত উচ্চশ্রেণির যে একবার সে কবিতা ছাপলে পাঠকেরা অন্য কবিতা পড়তেই চাইবে না৷ কাগজ ভরতি করা তখন দায় হয়ে উঠবে৷ এ কথা এক সম্পাদক নিজের মুখে বলেছেন৷”
সে বলল-“আচ্ছ! কই দেখি, একটা কবিতা লেখো দিকিন৷” আমি তখনই আমার ওভারকোটের পকেট থেকে আমার পকেট বইখানা বার করে বললাম-“আলো একটা চাই যে!”
সে বলল-‘দিচ্ছি আলো৷” বলে খানিকটা ধুলোবালি একত্র করে একটা ফুঁ দিল আর অমনি আগুন জ্বলে উঠল৷ আমি সেই আলোয় বসে লিখতে লাগলাম৷ খানিকটা লিখেছি, সে বলল-“কই, কী লিখলে পড়ো৷”
আমি বললাম-“এখনও যে শেষ হয়নি মশাই!”
সে বলল-“কবিতার আবার শেষ আছে নাকি? যা লিখেছ পড়ো- ফাজলামি করতে হবে না৷”
আমি সুর করে পড়লাম-
পড়িয়ে বিপদে তারা
হয়েছি মা দিশেহারা!
উদ্ধারো এ দুঃখ কারা-
গার হতে মা জননী৷
শ্মশানে বসিয়ে ডাকি,
ভয়ে ঘোরে শির-চাকি,
খাবি খায় প্রাণ-পাখি,
শূন্য হেরি এ ধরণী!
কোথা মোর গেহ-খাঁচা,
কোথা পিতা, কোথা চাচা,
এসে মা, আমারে বাঁচা৷
দিয়ে তোর পা-তরণী!
এইটুকু শেষ হতেই সে বলল-“ঢের হয়েছে, ঢের হয়েছে! এরকম গান তো আমি অনেক যাত্রায় জুড়িদের মুখে শুনেছি৷ এ তোমার নিজের লেখা, না পুরোনো গান একটা মুখস্ত ছিল, তাই লিখে শোনাচ্ছ?”
আমি বললাম-“না মশাই এ আমার নিজের রচনা৷ একেবারে টাটকা৷ এতে আপনি পুরোনো গন্ধ কোথায় পেলেন? দেখছেন না একেবারে আধুনিক ধরনে লেখা!”
সে বলল-“থামো, তোমায় আর জ্যাঠাপনা করতে হবে না৷ পুরোনো একটা গান চুরি করে নিয়ে আমায় ফাঁকি দেবে ভেবেছ, তা হচ্ছে না৷ দেখি তুমি কত বড়ো ওস্তাদ! আমার নাম দিয়ে একটা কবিতা লিখতে পার?”
আমি বললাম-“খুব পারি৷ নাম দিয়ে আমি অনেক কবিতা লিখেছি৷ তেলের নাম দিয়ে, ওষুধের নাম দিয়ে অনেক ভালো ভালো কবিতা আমার লেখা আছে৷ একবার একটা জুতোর দোকানের কবিতা লিখে আমি প্রাইজ পেয়েছিলাম৷ আপনার নামটা কী বলুন, আমি এখনই লিখে দিচ্ছি৷”
সে বলল-“আমার নাম জাঁদরেল৷ লিখে ফেলো দেখি এই নাম দিয়ে একটা কবিতা চট করে৷ বুঝব কত বড়ো বাহাদুর তুই!”
আমি কাগজ পেনসিল নিয়ে লিখতে শুরু করেছি মাত্র, সে বলল-“কী লিখলে, পড়ো হে! আমি ও বড়ো কবিতা দু-চক্ষে দেখতে পারি না৷”
আমি বললাম-“মশাই, আর একটু সময় দিন৷” বলে আমি ঘসঘস শব্দে লিখে যেতে লাগলাম৷
একবার একটু থেমেছি, সে আমার খাতার দিকে ঝুঁকে দেখে বলল- “ঃউ অনেকটা লেখা হয়েছে৷ এইবার পড়ো৷”
অগত্যা আমি পড়লাম-
রেল আছে, জেল আছে,
আর আছে কদবেল;
পাশ আছে, ফেল আছে,
আর আছে শূল শেল;
ঢোল আছে, চোল আছে,
আর আছে সারখেল
সব সে বড়া হ্যায়
জাঁদরেল জাঁদরেল!
পড়া শেষ হতেই সে চিৎকার করে উঠল-“বাঃ, বাঃ, বেড়ে লিখেছ তো হে! আর একবার পড়ো তো, আর একবার পড়ো তো৷”
আমি আর একবার চিৎকার করে পড়লাম-“রেল আছে, জেল আছে ইত্যাদি৷”
সে আবার বলল-“বেশ হয়েছে! চমৎকার হয়েছে! যাও, প্রমাণ হয়ে গেল তুমি কবি মাধব চক্রবর্তী!”
আমি বললাম-“ঠিক বলছেন মশাই, আমি কাঙালিচরণ নই?”
সে বলল-“কাঙালিচরণের চোদ্দোপুরুষ এমন কবিতা লিখতে পারে না৷ মাধব চক্রবর্তী না হলে এমন কবিতা লেখে কে?”
আমি বললাম-“মশাই, আমার আর একটা কবিতা শুনবেন, এই খাতায় লেখা আছে-এই জয়পুরের শীত সম্বন্ধে৷”
সে বলল-“কই, শোনাও তো দেখি!”
আমি তাড়াতাড়ি পকেট থেকে বইয়ের পাতা হাতড়ে কবিতাটা বার করে পড়তে শুরু করলাম-
বস্তা বস্তা পুঞ্জ পুঞ্জ তীব্র হিম ঢেলে
ব্যোম মার্গে কে রচিল শীতের পাহাড়!
লেপ গদি বালাপোশ সর্ব বর্ম ভেঙে
কম্প এসে কাঁপাইছে শরীরের হাড়!
ঊর্ধ্ব-ফণা ক্রুদ্ধ শত নাগিনির প্রায়
কপালে কপোলে ভীম হানিছে ছোবল,
কিংবা কোন পিশাচিনী উন্মাদিনী-সমা
তীক্ষ্ণ-ধার ছুরিকায় করিছে কোতল৷
অথবা কী মেঘ দৈত্য ছোড়ে শার্পনেল-
হঠাৎ দূরে একটা বীভৎস কোলাহল উঠল-“ওরে ক্যাংলাকে পাওয়া গেছে!” আমি চমকে উঠে পড়া থামিয়ে চেয়ে দেখি আমার সামনের কঙ্কাল তিনটে লাফাতে লাফাতে ডিগবাজি খেতে খেতে মাঠের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল৷ আমি ‘রাম! রাম!’ বলতে বলতে সেখান থেকে উঠে পড়লাম৷ এতক্ষণ রাম নামটা যে কেন মনে আসেনি, কে জানে! আমি রেল লাইনের বাঁধ ঠেলে উঠতে যাচ্ছি এমন সময় দুটো কুলির সঙ্গে দেখা৷ তারা বলল-“বাবু, আপনাকে আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি৷ আপনি গাড়ি ছেড়ে কোথায় গিয়েছিলেন?”
আমি আর কী বলব? বললাম-“আমি এখানে ওই ইয়ে হচ্ছিল কি না তাই একটু দেখছিলাম৷”
তারা বলল-“আপনার গাড়ি ঠেলে আমরা ওই ওদিকে রেখে দিয়েছি৷ চলুন আপনাকে দেখিয়ে দিই৷” বলে তারা আমাকে গাড়িতে তুলে দিল৷ আমি গাড়িতে উঠে বললাম-“হ্যাঁরে, গাড়িতে আলো নেই কেন?”
সে বলল-“বিজলি বাতি আছে, মেল গাড়ির সঙ্গে লাগিয়ে দিলে তবে জ্বলবে৷”
আমি বললাম-“আমাকে একটা বাতি দিয়ে যেতে পারিস-বখশিশ দেব৷”
তাদের একজন ছুটে গিয়ে একটা বাতি এনে দিল৷ আমি সেইটে সামনে রেখে পকেট বই খুলে নিজের লেখা কবিতা পড়তে লাগলাম৷