কক্সবাজার

কক্সবাজার

প্রতি রাতেই এই বাসার বাচ্চা-কাচ্চারা তাদের লেখাপড়া শেষ করে দাদির (কিংবা নানির) ঘরে হাজির হয়। দাদি সাধারণত গভীর মনোযোগ দিয়ে টেলিভিশনে কোনো একটা সিরিয়াল দেখতে থাকেন, সেখান থেকে এক সেকেন্ডের জন্যে চোখ সরিয়ে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, লেখাপড়া হয়েছে ঠিকমতো?’ বাচ্চারা আসলে লেখাপড়া করে থাকুক আর নাই করে থাকুক চিৎকার করে বলে, হয়েছে দাদি (কিংবা নানি) দাদি তখন বলেন, “খবরদার কোনো গোলমাল চেঁচামেচি নাই। আমাকে নাটকটা দেখতে দে ঠিকমতো। বাচ্চারা চিৎকার করে বলে, “ঠিক আছে দাদি (কিংবা নানি) তারপর গোলমাল চেঁচামেচি চিৎকার শুরু করে দেয়।

আজকেও ঠিক এই ব্যাপারটা ঘটছিল তখন ছোটাচ্চু এসে হাজির হলো। বাচ্চারা তাদের অভ্যাসমতো তাদের চিৎকার, চেঁচামেচি গোলমাল থামিয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, তার হাতে কোনো খাবারের প্যাকেট নাই দেখে তারা যন্ত্রণার মতো শব্দ করল, একজন বলল, “ছোটাচ্চু, আজকেও তুমি কিছু আন নাই?”

ছোটাচ্চু মুখটা হাসি হাসি করে বলল, “কে বলেছে আনি নাই। অবশ্যই এনেছি।”

বাচ্চারা তখন এক ধরনের কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী এনেছ ছোটাচ্চু? তোমার হাতে তো কোনো প্যাকেট নাই।”

ছোটাচ্চু তার মুখের হাসিটা আরো বাড়িয়ে রহস্যের ভঙ্গি করে বলল, “আমি যেটা এনেছি সেটা আনতে কোনো প্যাকেটের দরকার হয় না।”

এবারে সবাই যথেষ্ট কৌতূহলী হয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দিল, “কী এনেছ ছোটাচ্চু? কী এনেছ? কী?”

ছোটাচ্চু তার পকেট থেকে খুব কায়দা করে তার মোবাইল টেলিফোনটা বের করে এনে বলল, “একটা এসএমএস।”

“এসএমএস?” বাচ্চারা এবারে অবাক হবে না হতাশ হবে বুঝতে পারল না।

“হ্যাঁ, একটা এসএমএস।” ছোটাছুর আরো বেশি রহস্যের মত ভঙ্গি করে বলল, “আমি কী পড়ে শোনাব এসএমএসটা?”

বাচ্চারা একটু সন্দেহের ভঙ্গি করে বলল, “পড়।”

ছোটাচ্চু মুখটা গম্ভীর করে বলল, “এসএমএস-টা পাঠিয়েছে আমার বন্ধু জয়ন্ত। সে লিখেছে, দোস্ত, আমি তোর বাসার বাচ্চাদের বলেছিলাম তাদেরকে কক্সবাজার না হয় রাঙামাটি বান্দরবান পাঠাব। তারা কী রেডি? সামনের ছুটিতে কী যেতে পারবে? আমি কী আমার সেক্রেটারিকে বলব তোদের সাথে কথা বলে প্লেনের টিকিট কিনতে? হোটেল রিজার্ভেশন করতে?”

ছোটাচ্চু এসএমএসটা পড়ে শেষ করতে পারেনি তার আগেই বাচ্চারা এমনই গগনবিদারী একটা চিৎকার দিল যে রান্নাঘর থেকে ঝুমু খালা ওপর থেকে বড় চাচা, মেজো চাচা এবং ছোট ফুপু ছুটে এলেন দেখার জন্যে কী হয়েছে। দাদির (কিংবা নানির) সিরিয়ালে খুবই একটা জটিল মুহূর্ত চলছিল, বাড়ির বউ শ্বাশুরির অত্যাচারে বাড়ির ছাদের কার্নিশে ঝাঁপ দেওয়ার জন্যে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীকে অভিশাপ দিয়ে অত্যন্ত নাটকীয় কিছু একটা বলছিল, বাচ্চাদের চিৎকারে সেটা দাদি শুনতে পেলেন না। সেই চিৎকার শুনে ফুটফুটে বউটি চমকে উঠে কার্নিশ থেকে পড়ে না যায় দাদির সেরকম আশঙ্কা হতে লাগল।

ছোটাচ্চুর বন্ধু জয়ন্ত কাকু বাসায় সব বাচ্চাদের কক্সবাজার বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে শোনার পর সবাই মেনে নিল এরকম একটা কথা শোনার পর এ ধরনের বিকট চিৎকার দেওয়াই যেতে পারে। সত্যিই জয়ন্ত কাকু এটা লিখেছে নাকি ছোটাচ্চু বাচ্চাদের সাথে রসিকতা করছে সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য সবাই একজন একজন করে এসএমএসটা পড়ল। বাসের টিকিট কিংবা ট্রেনের টিকিট লিখতে গিয়ে ভুলে প্লেনের টিকিট লিখে ফেলেছে কী না সেটা নিয়েও একটু আলোচনা হলো। শান্ত তখন সবাইকে মনে করিয়ে দিল জয়ন্ত কাকু ইচ্ছা করলে আস্ত প্লেনটাই রিজার্ভ করে ফেলতে পারে! তার জন্য আট-দশটা প্লেনের টিকিট কেনা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়ার মতো একটা ব্যাপার।

তখন তখনই কক্সবাজার যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল।সাথে কী কী নিতে হবে তার লিস্ট তৈরি করতে সবাই কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়ল। প্রথম লিস্ট যেটা তৈরি হলো সেটা দেখে ছোটাচ্চু বলল যে এত মালপত্র নিয়ে প্লেনটা উড়তে পারবে না। তখন সবাই দ্বিতীয় লিস্ট তৈরি করতে বসে গেল, কিন্তু পরদিন সকালে স্কুলে যেতে হবে সেজন্যে সবাইকে রীতিমতো জোর করে ঘুমাতে পাঠানো হলো। বিছানায় শুয়েও তাদের চোখে ঘুম আসতে চায় না, কক্সবাজার গিয়ে কী করবে সেটা নিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত সবাই ফিসফিস করে কথা বলতে থাকে।

.

পরদিন থেকে কক্সবাজার যাবার প্রস্তুতি পুরো উদ্যমে শুরু হয়ে গেল। সবার আগে ঠিক করতে হবে কে কে যাবে। এই বাসার কেউ ঝুমু খালাকে ছাড়া নড়তেও পারে না তাই তাকে নেওয়ার চেষ্টা করা হলো। ঝুমু খালা যখন জানতে পারল দাদি যাবেন না শুধু বাচ্চা কাচ্চারা যাবে তখন সে যেতে রাজী হলো না। মায়েরা যেভাবে তাদের ছেলে মেয়েদের বুক আগলে রাখে ঝুমু খালাও অনেকটা সেইভাবে দাদিকে বাচ্চার মতো বুক আগলে রাখে। প্রমি ঝুমু খালাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি সমুদ্র দেখেছ ঝুমু খালা?”

ঝুমু খালা বলল, “না দেখি নাই।”

প্রমি বলল, “তুমি যদি আমাদের সাথে যাও তাহলে সমুদ্র দেখতে পারবে।”

“সমুদ্রে আছে কী?” “পানি আর পানি।”

ঝুমু খালা ঠোঁট উল্টে বলল, “আমার পানি দেখার জন্যে কক্সবাজার যাইতে হবে? পাকঘরে ট্যাপ খুললেই তো আমি পানি দেখবার পারি। পানি আর পানি–যতক্ষণ খোলা ততক্ষণ পানি।”

ঝুমু খালার এই যুক্তি শুনে প্রমি এতই ঘাবড়ে গেল যে সে আর কোনো কথাই বলতে পারল না।

ঝুমু খালা যেহেতু যাবে না তাই বড় মানুষদের মাঝে ছোটাচ্চুকে নেওয়া হলো। শান্ত বেশ খোলামেলাভাবে ছোটাচ্চুকে জানাল যে এটা শুধু বাচ্চাদের ট্রিপ হওয়ার কথা। তারা যে ছোটাচ্চুকে সাথে নিচ্ছে সেটা তার প্রতি এক ধরনের দয়া দেখানো ছাড়া আর কিছু নয়। ছোটাচ্চু যেন সেটা মনে রাখে এবং কক্সবাজার পৌঁছানোর পর ছোটাচ্চু যেন বাচ্চা-কাচ্চাদের স্বাধীনভাবে যা ইচ্ছে তাই করতে বাধা না দেয়।

ঠিক কী কারণ জানা নেই শান্তর কথা শুনে ছোটাচ্চু রেগে উঠল, হাত-পা নেড়ে চিৎকার করে বলল, “তোদের লেজ বেশি মোটা হয়েছে? (শান্ত বুঝতে পারল না লেজের বিষয়টা কোথা থেকে এসেছে) তোরা জানিস আমি যদি ফোন করে জয়ন্তকে শুধু একবার বলি বাচ্চাগুলোর লেজ বেশি মোটা হয়েছে, ওদের ট্রিপ ক্যান্সেল করে দে সাথে সাথে জয়ন্ত তোদের পুরো ট্রিপ ক্যান্সেল হয়ে যাবে। সেটা জানিস?”

শান্ত ছোটাচ্চুর ব্যবহারে খুবই অবাক হলো–অন্যেরা অবশ্যি সেরকম অবাক হলো না, তাই সবাই মিলে ছোটাচ্চুকে শান্ত করে ফেলল।

বাসায় সবচেয়ে ছোটদের ভেতরে মুনিয়ার কক্সবাজার যাওয়ার অনুমতি হলো, এর আগে সে তার আবু-আম্মু ছাড়া কখনো কোথাও থাকেনি কিন্তু মুনিয়া বারবার সবাইকে জানাল সে যেহেতু এখন বড় হয়ে গেছে আন্ধু-আম্মু ছাড়া তার থাকতে কোনোই সমস্যা হবে না। ট্রিপের সবচেয়ে বড় সদস্য শাহানা, সে সার্টিফিকেট দিল যে সে মুনিয়াকে দেখে-শুনে রাখবে তখন মুনিয়ার আম্মু তাকে যেতে দিতে রাজি হলেন।

মুনিয়ার ছোট আর তিনজন আছে তাদের একজন একেবারেই ছোট, এখনো বেশির ভাগ সময় হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়ায় তাকে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। অন্য দুজন একটু বড় হয়েছে কথা-বার্তা বুঝতে শিখেছে তারাও কক্সবাজার যাবার জন্যে রেডি হয়ে গেল।

শান্ত সবাইকে অভয় দিয়ে বলল, সে এই দুজনকে সামলে নেবে যেন তারা কক্সবাজার যেতে না চায়। সত্যি সত্যি শান্ত তাদের কী বোঝাল কে জানে হঠাৎ করে তারা কক্সবাজার যাওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। যে পদ্ধতিতে এই দুজনকে শান্ত সামলে নিয়েছে সেটা অবশ্যি খুব প্রশংসা করার মতো পদ্ধতি নয়। কারণ শান্ত দুজনকে একটা অন্ধকার ঘরে ডেকে নিয়ে বলল, “কক্সবাজারে কী আছে তোরা জানিস, সেখানে যে যেতে চাচ্ছিস?”

বাচ্চা দুজন ভয়ে ভয়ে বলল, “কী আছে?”

“জঙ্গল। খালি কাটা কাটা গাছ। গাছের ওপর কন্ধ কাটা ভূত।”

বাচ্চা দুজন ফ্যাকাশে মুখে বলল, “কন্ধ কাটা ভূত কী?”

“যে ভূতের মাথা কাটা। মাথাটা হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।”

বাচ্চা দুজন শিউরে উঠল। একজন বলল, “কিন্তু সবাই যে বলছে কক্সবাজারে সমুদ্র?”

শান্ত বলল, “সমুদ্রও আছে, কিন্তু সেইখানে লোনা পানি মুখে গেলেই ওয়াক ওয়াক করে বমি।”

“তাহলে সবাই যে যাচ্ছে?”

“সবাই যাচ্ছে কারণ যেন বমি না হয় সেইজন্যে প্রত্যেক বেলা সবার দুই হাতে দুইটা ইনজেকশান দেবে। এই মোটা সুই–” শান্ত সুইয়ের যে সাইজ দেখালো সেটা দেখেই দুজনের কক্সবাজার যাওয়ার সব সখ মিটে গেল!

যেদিন কক্সবাজার যাওয়ার কথা তার আগের রাতে বাচ্চাদের ঘুমাতে অনেক দেরি হলো কারোই ঘুম আসছিল না। তবে পরদিন সকালে কারোই ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলো না। সকাল দশটায় ফ্লাইট কিন্তু অনেক আগেই সবাই গোসল করে জামা-কাপড় পরে রেডি হয়ে থাকল। জয়ন্ত কাকুর বড় ভ্যান আটটার সময় বাসায় পৌঁছে গেল, সবাই যখন ভ্যানে উঠছে তখন মুনিয়ার চোখ এক দুইবার ছল ছল করে উঠেছে কিন্তু কেউ সেটা দেখার আগেই মুনিয়া তাড়াতাড়ি চোখ মুছে ফেলেছে। ভ্যানে ড্রাইভারের পাশে মোটা সোটা একজন মানুষ বসেছে, মেটাসোটা মানুষেরা সাধারণত হাসি-খুশি হয় কিন্তু এই মানুষটা গোমড়ামুখী। শুধু যে গোমড়ামুখী তা নয় দেখে মনে হয় একটু হাবাগোবা টাইপ। সামনের সিটে বসে লম্বা লম্বা হাই তুলে সে সবার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকল।

বাসার বারান্দায় বড়রা সবাই দাঁড়িয়ে আছে, দাদি সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে সবার হাত ধরে বললেন, ‘ফি আমানিল্লাহ’ তারপর কী একটা দোয়া পড়ে ভ্যানের ভেতর ফুঁ দিয়ে দিলেন। ঝুমু খালা কক্সবাজার নিয়ে সবাইকে উপদেশ দিল, যে কেউ শুনলে সে মনে করবে ঝুমু খালা বুঝি কক্সবাজারে তার জীবনের বেশির ভাগ কাটিয়েছে। চাচা-চাচি খালা-খালু ফুপু-ফুপা সবাই হাত নেড়ে বাচ্চাদের বিদায় দিল, ঠিক ভ্যান ছেড়ে দেওয়ার মুহূর্তে কোথা থেকে জানি জয়ন্ত কাকু হাজির হলো। বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করে বলল, “জয়ন্ত কাকু। তুমি যাবে আমাদের সাথে?”

জয়ন্ত কাকু মাথা নেড়ে বলল, “না, না! তোমাদের শুধু এয়ারপোর্ট নামিয়ে দিয়ে আসি।”

ভ্যান ছেড়ে দিল। বাচ্চারা আনন্দে গান গাইতে থাকে চিৎকার করতে থাকে এবং এর মাঝেই মোটামুটি ফাঁকা রাস্তা দিয়ে ভ্যানটা এয়ারপোর্টের দিকে যেতে শুরু করে।

এয়ারপোর্ট পৌঁছানোর পর যখন সবাই ভ্যান থেকে নামছে, নিজের জিনিসপত্র নিয়ে টানাটানি করছে তখন জয়ন্তকাকু ছোটাচ্চুকে এক পাশে টেনে নিয়ে বলল, “তোদের সাথে যাবার জন্যে আমি কাজেম আলীকে দিয়ে দিলাম।”

ছোটাচ্চু বলল, “মোটাসোটা বেজার মানুষটার নাম কাজেম আলী?”

জয়ন্ত কাকু হাসল, বলল, “হ্যাঁ। খুব কম কথা বলে কিন্তু কাজেম আলী থেকে কাজের মানুষ দুনিয়াতে এখনো জন্ম হয় নাই। দেখে-শুনে মনে হবে কিছু বুঝেসুঝে না কিন্তু অসম্ভব বুদ্ধিমান। তোদের সব দায়িত্ব ওর হাতে। যেকোনো ক্রাইসিস সামাল দিতে পারবে।”

ছোটাচ্চু বলল, “গুড। ক্রাইসিস হলে আমি তাল খুঁজে পাই না।”

বাচ্চাদের কেউই আগে কখনো প্লেনে উঠে নাই, তাই ছোটাচ্চু সবাইকে লাইনে দাঁড়িয়ে আলাদা আলাদা ভাবে নিজের বোর্ডিং কার্ড নিতে বলল। কেউ স্বীকার করল না কিন্তু সবারই বুক ধুক ধুক করছিল যদি বোর্ডিং কার্ডের মহিলা হঠাৎ করে কাউকে বলে বসে যে তার টিকিটে গোলমাল আছে এবং সে যেতে পারবে না? তাহলে কী হবে? কিন্তু সেরকম কিছু হলো না সবাই একটা বোর্ডিং কার্ড পেয়ে গেল।

এক্স-রে মেশিনে তাদের ব্যাগ চেক করে সবাই ভেতরে ঢুকে গেল। এখন প্লেনের জন্য অপেক্ষা করা। একটু পরে পরে সবাই দেখছে প্লেনটা ঠিক সময়েই ছাড়বে নাকি ছাড়তে দেরি হবে। ভেতরে অপেক্ষা করার জায়গাটাতে অনেক মানুষ–একেকজন একেক জায়গায় যাবে। তবে বাচ্চাদের এই দলটার মতো আর কেউ নেই। বাচ্চারা প্রাণপণ চেষ্টা করছে উত্তেজনাটা দমিয়ে রাখতে কিন্তু কোনোভাবে সেটা সম্ভব হচ্ছে না।

শেষ পর্যন্ত প্লেন ছাড়ার সময় হলো। একটা বাসে সবাইকে তুলে নিয়ে তাদেরকে প্লেনের কাছে নামিয়ে দিল। সিঁড়ি দিয়ে প্লেনের ভেতরে ঢুকে সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। কী সুন্দর সারি সারি সিট, তারা দৌড়াদৌড়ি করে নিজেদের সিটে বসে এবং হঠাৎ করে আবিষ্কার করল শুধু অর্ধেকে জানালার কাছে সিট পেয়েছে। যারা জানালার পাশে সিট পায় নাই হঠাৎ করে তাদের মনে হলো এই জীবন বৃথা। যারা একটু ছোট তারা প্রায় কেঁদেই ফেলত, তখন ছোটাচ্চু সমাধান করে দিল। অর্ধেক সময় একজন জানালার কাছে বসবে, বাকি অর্ধেক সময় অন্যজন।

প্লেনে বসে সিট বেল্ট বেঁধে সবাই অপেক্ষা করতে থাকে। এয়ার হোস্টেস কখন কী করতে হবে সবকিছু বলে দিল। একটু পরেই গর্জন করে প্লেনটা নড়তে থাকে। যখন রানওয়ে দিয়ে প্লেনটা ছুটতে থাকে সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকে, আর কী আশ্চর্য সত্যি সত্যি এত বড় প্লেনটা দেখতে দেখতে আকাশে উঠে গেল। যারা একটু বড় হয়ে গেছে তার মুখটা গম্ভীর করে রাখার চেষ্টা করল, কিন্তু যারা ছোট তারা আনন্দে চিৎকার করে উঠে।

প্লেনের জানালা দিয়ে সবাই নিচে তাকিয়ে থাকে, প্রথমে শহরের দালান কোঠা, তারপর গ্রাম, নদী এক সময় সমুদ্র। একেবারে ঘড়ি ধরে মাঝামাঝি সময়ে জানালার পাশে যারা বসেছে তাদের সাথে সিট বদল করা হলো। শান্ত একটু গাই-গুই করছিল, ছোটাচ্চু তখন ধমক দিয়ে তার সিট বদল করাল।

দেখতে দেখতে তারা কক্সবাজার পৌঁছে যায়। এত তাড়াতাড়ি তাদের প্লেনের ভ্রমণ শেষ হয়ে যাবে কেউ আশা করে নাই। কক্সবাজার পৌঁছানোর পর যখন প্লেন থেকে নামার সময় হলো তারা অবাক হয়ে দেখল জয়ন্ত কাকু তাদের দেখভাল করার জন্য কাজেম আলী নামে যে মোটাসোটা বেজার মানুষটিকে দিয়েছেন সে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। প্লেনে জানালার কাছে সিট পেয়েও একজন

পুরো সময়টা নাক ডেকে ঘুমাতে পারে সেটা তাদের বিশ্বাসই হতে চায় না!

কাজেম আলী হঠাৎ ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠল। নিজের ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে সে সবার সাথে নামল। যেহেতু কারোই আলাদা লাগেজ নাই তাই তারা কাজেম আলী নামের মানুষটার পিছু পিছু এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে এলো। বাইরে তাদের নেওয়ার জন্যে হোটেলের বিশাল একটা গাড়ি অপেক্ষা করছে। তারা ওঠামাত্র সেটা ছুটে যেতে থাকে, খানিকদূর যেতেই তারা হঠাৎ করে দেখে সামনে সমুদ্র। কী আশ্চর্য ব্যাপার! মনে হচ্ছে একেবারে আকাশ থেকে বুঝি সমুদ্রটা নিচে নেমে আসছে।

এই বাচ্চাদের নিয়ে আগে যেটা কখনো ঘটেনি হঠাৎ করে সেটা ঘটে গেল, হঠাৎ করে সবাই চুপ হয়ে গেল। সমুদ্রের নিশ্চয়ই কোনো এক ধরনের ম্যাজিক আছে কারণ সবাই চুপ করে অবাক হয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রথমবার সমুদ্র দেখলে সবাই কেন যে অবাক হয়ে যায়! এত বড় সমুদ্র? কোনো শুরু নেই, শেষ নেই যতদূর তাকানো যায় শুধু পানি আর পানি? সেই পানিতে একটার পর একটা ঢেউ সাদা ফেনা তুলে তীরে এসে লুটিয়ে পড়ছে।

হোটেলে পৌঁছানোর পর কাজেম আলী নামের মোটাসোটা মানুষটা রিসেপশান ডেস্কে কিছু কাগজপত্র সাইন করে অনেকগুলো প্লাস্টিকের কার্ড নিয়ে এলো। এগুলোই নাকি হোটেল রুমের চাবি। কী আশ্চর্য!

লিফটে করে সবাই ছয় তলায় উঠে যায় সেখানে সারি ধরে অনেকগুলো রুম তাদের। তাদের সাথে হোটেলের একজন মানুষ এসেছে সে কীভাবে প্লাস্টিকের কার্ড দিয়ে রুমের তালা খুলতে হয় শিখিয়ে দিল।

হোটেল রুমের ভেতর ঢুকে বাচ্চারা আবার আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। বিশাল কাঁচের জানালা, সেই জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যায়। তারা ছোটাচ্চুটি করে জানালার কাঁচ খুলে ফেলল, সাথে সমুদ্রের লোনা বাতাস হু হু করে রুমের ভেতরে ঢুকে যায়, তার সাথে সমুদ্রের গর্জন! মনে হচ্ছে সমুদ্রটা কাঁদছে। কী আশ্চর্য!

কোন রুমে কে থাকবে সেটা নিয়ে আবার ঝগড়াঝাটি শুরু হয়ে যাচ্ছিল কিন্তু ছোটাচ্চু সেটা হতে দিল না। মোটামুটি ধমক দিয়ে রুম ভাগ করে দিল, প্রতিটা রুমে দুজনের জন্য দুটি বিছানা। একজন বড় এবং একজন ছোট। শাহানার সাথে মুনিয়া। টুনির সাথে টুম্পা। ছোটাচ্চুর সাথে শান্ত।

নিজেদের রুমে গিয়ে সবাই কাপড়-জামা বদলে তখন তখনই সমুদ্রে যাবার জন্যে বের হয়ে এলো। ছোটাচ্চু তখন বলল লাঞ্চের সময় হয়ে গিয়েছে, তাই সমুদ্রে যাওয়ার আগে সবাইকে খেয়ে নিতে হবে। খাওয়ার কথা শুনে এক সাথে সবার খিদে পেয়ে যায়। হোটেলের দোতলায় রেস্টুরেন্ট সবাই মিলে যখন যাচ্ছে তখন পাশের একটা রুম থেকে একজন মানুষ ছোট একটা মেয়েকে নিয়ে বের হলো। মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, কেন কাঁদছে কে জানে? মেয়েটা মুনিয়ার বয়সী, মেয়েটাকে কাঁদতে দেখে মুনিয়ারও আম্মুর কথা মনে পড়ে গেল আর তার চোখও ছল ছল করে উঠল।

রেস্টুরেন্টে কয়েকটা টেবিল এক সাথে লাগিয়ে তাদের সবার বসার জায়গা করা হয়েছে। কে কার পাশে বসবে সেটা নিয়েও একটু ঝগড়াঝাটি হলো, তখন ছোটাচ্চুর একটা রাম ধমক খেয়ে সবাই ঝগড়াঝাটি মিটিয়ে খেতে বসে গেল।

কাজেম আলী চাচা তখন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে প্রায় বক্তৃতা দেওয়ার মতো ভঙ্গি করে বলল, “সবাই আমার দিকে তাকাও, আমি কয়েকটা জিনিস তোমাদের সবাইকে জানিয়ে রাখি।”

তারা এই প্রথম কাজেম আলী চাচার গলার স্বর শুনতে পেয়েছে। এই মানুষটা কথা বলতে পারে কী না সেটা নিয়েই তাদের সন্দেহ হতে শুরু করেছিল। সবাই কৌতূহল নিয়ে কাজেম আলী চাচার দিকে তাকাল তখন কাজেম আলী চাচা বলল, “সমুদ্রে যাওয়ার কিছু নিয়ম-কানুন আছে সেগুলো না জেনে কেউ সমুদ্রে নামতে পারবে না। একটা নিয়ম হচ্ছে ভাটার সময় কখনোই সমুদ্রে নামা যাবে না। সমুদ্রে নামতে হবে জোয়ারের সময়।”

বাচ্চারা তখন সবাই এক সাথে প্রশ্ন করতে শুরু করল, প্রশ্নগুলো হলো এরকম:

“কেন ভাটার সময় সমুদ্রে নামা যাবে না?” “ভাটা কী?”

“কতক্ষণ ভাটা হয় কতক্ষণ জোয়ার হয়?”

“আমরা কেমন করে বুঝব কখন ভাটা কখন জোয়ার?”

“ভাটার সময় আমি যদি সমুদ্রে নামি তাহলে কী হবে?”

কাজেম আলী চাচা একটা একটা করে সবার প্রশ্নের উত্তর দিল:

“ভাটার সময় সমুদ্র সবকিছু নিজের দিকে টেনে নেয়, তাই ভাটার সময় সমুদ্রে নামলে সমুদ্র কাউকে টেনে নিয়ে যেতে পারে।”

“সমুদ্রের পানি যখন নেমে যেতে থাকে সেটা হচ্ছে ভাটা। সমুদ্রের পানি যখন বাড়তে থাকে সেটা জোয়ার।”

“ছয় ঘণ্টা ভাটা এবং ছয় ঘণ্টা জোয়ার থাকে।”

“ভাটার সময় হোটেলে সামনে একটা লাল ফ্ল্যাগ টানানো থাকে, এই ফ্ল্যাগ দেখেই বোঝা যাবে এখন ভাটা না জোয়ার।”

“আমার কথা না শুনে কেউ যদি ভাটার সময় সমুদ্রে নেমে যায় তাহলে আমি তাকে টেনে শুকনায় নিয়ে আসব। তারপর জোয়ার না আসা পর্যন্ত তাকে শুকনা বালুতে ঠেসে চেপে ধরে রাখব। স্যার আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন সবাইকে দেখে-শুনে রাখতে।

কথা শেষ করে কাজেম আলী চাচা জিজ্ঞাসা করল, “আর কোনো প্রশ্ন?

অনেকেরই প্রশ্ন ছিল কিন্তু কাজেম আলী চাচার চেহারা দেখে কেউ আর প্রশ্ন করার সাহস পেল না। কাজেম আলী চাচা থমথমে গলায় বলল, “টেবিলে মেনু রাখা আছে। মেনু দেখে সবাই ঠিক করো কে কী খাবে?”

শান্ত ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “যেটা ইচ্ছা তাই অর্ডার করতে পারব? “হ্যাঁ। যেটা ইচ্ছা তাই অর্ডার করতে পারবে।”

সবাই তখন খাবার অর্ডার করতে শুরু করল। বাসায় যে খাবার তারা জন্মেও মুখে দিতে চায় না এই হোটেলে এসে হঠাৎ করে সেই খাবারগুলোও তাদের কাছে সুস্বাদু মনে হতে থাকে। মনে হয় সমুদ্রের বাতাসের এই গুণ।

খাওয়া শেষ করে তারা যখন বের হয়ে যাচ্ছে তখন তারা আবার তাদের পাশের রুমের বাবা আর মেয়েটাকে দেখতে পেল। মেয়েটা তখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, বাবার মুখটা পাথরের মতো শক্ত।

বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে মুনিয়া দাঁড়িয়ে গেল। তাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে বলল, “আপু, তুমি কাঁদছ কেন?”

মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি আম্মুর কাছে যাব।”

মেয়েটার কথা শুনে তার বাবা কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল। বাবা মেয়েটাকে চুপ করানোর চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু মেয়েটা চুপ করে না, বলতে থাকে, “আম্মুর কাছে যাব। আম্মুর কাছে যাব।”

মুনিয়া জানতে চাইল, “তোমার আম্মু কোনখানে?”

“বাসায়।”

এবারে টুনি জিজ্ঞেস করল, “তোমার বাসা কোথায়?”

মেয়েটা কিছু বলার আগেই বাবা মেয়েটাকে কোলে তুলে নেয়, মাথাটা জোর করে নিজের ঘাড়ে চাপা দিয়ে সেখানে হাত বুলাতে বুলাতে ফিসফিস করে টুনিকে বলল, “ওর মা মারা গেছে। কিছুতেই সেটা মেনে নিতে পারছে না।”

মেয়েটা যেন না শুনতে পারে বাবা সেইভাবে কথাটা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু তারপরেও মেয়েটা কথাটা শুনে ফেলল, তখন চিৎকার করে কেঁদে উঠে বলল, “না, আম্মু মারা যায় নাই। তুমি মিথ্যা কথা বলছ। মিথ্যা কথা বলছ।”

বাবাটা তখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে মা আমি মিথ্যা কথা বলছি। তোমার আম্মু মারা যায় নাই।”

“আমি আম্মুর কাছে যাব।”

“ঠিক আছে মা, আমরা আম্মুর কাছে যাব।”

“এক্ষুনি যাব। এক্ষুনি”

“ঠিক আছে মা। এক্ষুনি তো যাওয়া যাবে না প্লেনের টিকিট কিনতে হবে তারপর যাব। ঠিক আছে? এখন মা এসো কিছু একটা খাও।”

“না, আমি খাব না, খাব না।” বলে মেয়েটা হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে। বাবা তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে রেস্টুরেন্টের দিকে এগিয়ে গেল।

মুনিয়া তবু হাল ছাড়ল না। বাচ্চা মেয়েটাকে ডেকে বলল, “আমরা সমুদ্রে গোসল করতে যাচ্ছি। তুমি আসবে আমাদের সাথে?”

মেয়েটা কিছু বলল কী না শোনা গেল না। ততক্ষণে বাবাটা তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে রেস্টুরেন্টের ভেতর ঢুকে গেছে।

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে সবাই সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। কেউ কোনো কথা বলছে না। এত ছোট একটা মেয়ের মা মারা গেছে মেয়েটা কোনোভাবেই সেটা মেনে নিতে পারছে না, বেচারা বাবা মেয়েটাকে কোনোভাবে শান্ত করতে পারছে না, পুরো ব্যাপারটা দেখে সবারই কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায়।

.

হোটেল থেকে বের হয়ে যখন তারা সমুদ্রের বালুবেলায় পা দিয়েছে তখন প্রমি একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বেচারি মেয়েটা, আহারে। এত ছোট? এখনই মা মারা গিয়েছে।”

মুনিয়া কাছাকাছি ছিল, সে হঠাৎ করে চিৎকার করে বলল, “না মারা যায় নাই।”

“মারা যায় নাই?”

“না।” মুনিয়া মুখে শক্ত করে বলল, “শোন নাই তোমরা মেয়েটা বলেছে তার আম্মু মারা যায় নাই?”

শান্ত ভুরু কুচকে বলল, “তুই বলছিস তার বাবা মিথ্যা কথা বলছে?”

“হ্যাঁ।” মুনিয়া জোরে জোরে মাথা নাড়ল।

“তাহলে তার মা কই?”

মুনিয়া বলল, “বাসায়। বাবা মেয়েটাকে জোর করে নিয়ে এসেছে।”

“কেন?”

“বাবাটা খারাপ মানুষ।”

শান্ত অবাক হয়ে বলল, “খারাপ মানুষ?”

“হ্যাঁ।”

“তুই কেমন করে জানিস?”

মুনিয়া মুখ শক্ত করে বলল, “আমি জানি চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। বাবার চোখগুলো দেখো নাই, কী রকম জানি নিষ্ঠুর।”

শান্ত শব্দ করে হাসল, বলল, “মুনিয়া, তোর মাথায় গোলমাল আছে।”

মুনিয়া চিৎকার করে বলল, “না, আমার মাথায় গোলমাল নাই।”

অন্যেরা তখন মুনিয়াকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে। প্রথমবার নিজের আম্মু-আব্বুকে রেখে একা একা এসেছে, তারই বয়সী একজন মেয়ের আম্মু নেই সেটা সে এখন চিন্তাই করতে পারে না!

গরম বালুর ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শুধু টুনি চিন্তা করতে থাকে, এমন কী হতে পারে মুনিয়ার ধারণাটাই সত্যি? বাবাটা আসলেই নিজের মেয়েকে মায়ের কাছ থেকে জোর করে সরিয়ে এনেছে? আসলে মা মারা যায়নি। এটা এক ধরনের কিডন্যাপ? কিন্তু নিজের বাবা কী কখনো নিজের বাচ্চাকে কিডন্যাপ করে? টুনি জোর করে মাথার ভেতর থেকে চিন্তাটা দূর করে দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু কেন জানি সেটা দূর হলো না। মাথার ভেতরে ঘুরঘুর করতে লাগল।

সমুদ্রের তীরের বালু যথেষ্ট গরম তার ওপর দিয়ে সবাই তাড়াহুড়া করে দৌড়াতে দৌড়াতে একেবারে পানির কাছে চলে এলো। বড় বড় সমুদ্রের ঢেউ আসছে, তার মাঝে অনেকে ঝাপাঝাপি করছে। মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “আমরা কি পানিতে নামব?”

শান্ত হুংকার দিয়ে বলল, “পানিতে না নামলে সমুদ্রে এসেছি কেন?” তারপর জুতো-শার্ট খুলে হাতের ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে পানির দিকে ছুটে যেতে থাকে।

মুনিয়া ভয়ে ভয়ে বলল, “জোয়ার কী শুরু হয়েছে?”

কাজেম আলী বলল, “হ্যাঁ। জোয়ার শুরু হয়েছে। তোমরা পানিতে নামতে পার। তোমাদের জিনিসপত্র রেখে যাও। আমি দেখব।”

সবাই তখন হইচই করে জামা-জুতো খুলে ব্যাগ রেখে সমুদ্রের ঢেউয়ের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কাজেম আলী সমুদ্রের তীরে রাখা সারি সারি বিচ চেয়ারের একটার ওপর তাদের সবার জিনিসপত্র রেখে পাশের বিচ চেয়ারে শুয়ে পড়ে এবং দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে যায়। মনে হচ্ছে এই মানুষটা ঘুমানোর মাঝে এক্সপার্ট।

মুনিয়া ভয়ে ভয়ে পানির কাছে এগিয়ে যায়। বড় বড় ঢেউ এসে তীরে ভেঙ্গে পড়ছে, মুনিয়া কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সেগুলো দেখে। ঢেউগুলো এসে তার পা ভিজিয়ে দিচ্ছিল। ঢেউগুলো ফিরে যাবার সময় পায়ের নিচ থেকে বালু সরিয়ে নিতে থাকে, তখন কেমন যেন সুড়সুড়ি লাগতে থাকে। টুনি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল, বলল, “আরো একটু বেশি পানিতে যাবি?”

মুনিয়া রাজি হলো। টুনির হাত ধরে সে সাবধানে হাঁটু পানি থেকে কোমরে পানি, কোমর পানি থেকে বুক পানিতে নেমে এল। ঠিক তখন কোথা থেকে জানি বিশাল একটা ঢেউ এসে মুনিয়ার মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। টুনির হাত থেকে মুনিয়ার হাত ছুটে গেল, বিশাল ঢেউয়ের ধাক্কায় সে একেবারে তীরে এসে আছাড় খেয়ে পড়ল। তার নাক-মুখ দিয়ে পানি ঢুকে একেবারে বিতিকিচ্ছি অবস্থা–প্রথমে মনে হলো সে বুঝি মরেই গেছে, পানি সরে যাবার পর বুঝতে পারল আসলে মরে যায় নাই। তারপরও সে একটু কেঁদে ফেলবে কি না বুঝতে পারছিল না, শেষ পর্যন্ত কাঁদল না। কিন্তু পানি থেকে সরে এসে সে বালুর মাঝে বসে রইল। টুনি টুম্পা প্রমি সবাই এসে ডাকাডাকি করল কিন্তু সে আর পানিতে নামার সাহস পেল না।

বালুর মাঝেও কত কি দেখার আছে। কত রকম ঝিনুক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, একটা তারা মাছ তির তির করে নড়ছে। সবচেয়ে মজার জিনিস হচ্ছে ছোট ছোট কাকড়া, ছোট ছোট গর্ত থেকে মাথা বের করে উঁকি দেয়, তারপর সাবধানে বের হয়ে ব্যস্ত হয়ে ছোটাচ্চুটি করতে থাকে। একটু ভয় দেখালেই সবগুলো আবার ছুটে গর্তে ঢুকে যায়! কী মজা লাগে দেখতে।

মুনিয়াকে একা বসে থাকতে দেখে টুনি তার পাশে এসে বসল। দুজনে মিলে ভিজে বালু দিয়ে খেলতে থাকে। বালু দিয়ে একটা ঘর বানাল। একটা কুমির বানাল, লম্বা একটা সাপ বানাল। ঢেউ এসে এক সময় সেগুলোও ভাসিয়ে নিয়ে গেল।

এভাবে কয়েক ঘণ্টা কেটে যায়। পানিতে ভিজে ভিজে সবার চোখ লাল, হাতের আঙুল শুকনো কিসমিসের মতো। বিকেল হয়ে আসছে তাই একটু একটু ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। কাজেম আলী চাচা এক সময় ঘুম থেকে উঠে সবাইকে ডাকল, বলল, “উঠে এসো সবাই। হোটেলে ফিরে নাশতা করবে, তারপর আবার সূর্যাস্ত দেখতে আসব।”

‘নাশতা নাশতা, সূর্যাস্ত সূর্যাস্ত’ বলে চিৎকার করতে করতে সবাই এবারে উঠে আসতে শুরু করে।

.

ঘণ্টাখানেক পরে সূর্য যখন ঢলে পড়েছে তখন সবাই আবার সমুদ্রতীরে ফিরে এলো। পুরো জোয়ার এসেছে বলে পানি এসে বালুবেলাটা প্রায় ভরে ফেলেছে। দুপুরের তুলনায় এখন মানুষ অনেক বেশি এবং সবাই মোটামুটি সেজেগুঁজে আছে। একটু ঠাণ্ডা পড়েছে বলে খুব বেশি মানুষ পুরোপুরি পানিতে নামেনি। কাজেম আলী চাচা আবার একটা বিচ চেয়ারে বসেছে, কিছুক্ষণ পর সে সেখানে শুয়ে গেল এবং আরো কিছুক্ষণের মাঝে তার নাক ডাকতে লাগল! এই মানুষটার ঘুমানোর ক্ষমতা রীতিমতো অসাধারণ।

সূর্যটা আস্তে আস্তে আরো নিচে নামতে থাকে, এটাকে এখন ডিমের কুসুমের মতো দেখায়। শান্ত হা করে সেটা খেয়ে ফেলছে সেরকম একটা ছবি তোলার পর সবাই হি হি করে হাসতে হাসতে এরকম আরো ছবি তুলতে লাগল। মুনিয়া যখন তার ছবিটা তুলছে ঠিক তখন দেখল মারা যাওয়া ছোট মেয়েটি আর তার বাবা সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটছে।

মেয়েটির চেহারায় একই সাথে দুঃখ আর ভয়। মুনিয়া খুবই মিশুক মেয়ে, সে ছবি তোলা বন্ধ করে সাথে সাথে মেয়েটার কাছে ছুটে গিয়ে কথা বলতে শুরু করে “আপু! তুমি এসেছ?”

মেয়েটি কোনো কথা না বলে মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। মুনিয়া বলল, “আমরা সূর্যটা খেয়ে ফেলছি এরকম ছবি তুলছি। তুমি তুলবে?”

মেয়েটি এবারেও কোনো কথা বলল না।

মুনিয়া বলল, “তুমি আসবে আমাদের সাথে? চল আমরা পানির ওপর দিয়ে হাঁটি?”

মেয়েটা তার বাবার মুখের দিকে তাকাল, বাবা সাথে সাথে মুখটা কেমন যেন শক্ত করে ফেলল। সেটা দেখে মেয়েটার মুখটাও কেমন যেন হয়ে গেল। সে মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল, কিন্তু কোনো কথা বলল না। বাবা তখন মেয়েটার হাত ধরে একটু টান দিয়ে তাকে নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করে দেয়। হাঁটতে হাঁটতে মেয়েটা কয়েকবার পেছন ফিরে তাকাল, সবাই দেখল তার চোখটা কেমন জানি ছল ছল করছে।

বাবা আর মেয়েটা মানুষের ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সবাই সেদিকে তাকিয়ে রইল। তারপর সবাই একসাথে লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলল। মুনিয়া বলল, “তোমরা দেখেছ বাবাটা কত খারাপ?”

শাহানা বলল, “হ্যাঁ। একটু রবোট টাইপ।”

প্রমি বলল, “রবোট না, পাষণ্ড টাইপ।”

মুনিয়া বলল, “মায়ের কাছ থেকে মেয়েটাকে কেড়ে এনেছে। কত খারাপ কত নিষ্ঠুর।”

সবাই মুনিয়ার দিকে তাকাল, আগেরবার যখন মুনিয়া এই কথা বলেছে। তখন কেউ সেটাকে গুরুত্ব দেয় নাই। এবারে কেন জানি অনেকেরই মনে হলো, হতেও তো পারে।

টুনি বলল, “ইচ্ছা করলে আমরা সেটা বের করতে পারি।”

শান্ত জিজ্ঞেস করল “কী বের করবি?”

“বাবা মেয়েটাকে কিডন্যাপ করে এনেছে কি না।”

শাহানা বলল, “ডিভোর্স হলে কোর্ট অনেক সময় বাচ্চা মা’কে দিয়ে দেয়, তখন বাবারা মাঝে মাঝে বাচ্চা কিডন্যাপ করে নিয়ে অন্য দেশে পালিয়ে যায়।”

শান্ত ভুরু কুচকে বলল, “এই বাবাটাও তাই করছে?”

টুনি বলল, “আমরা জানি না। কিন্তু বের করে ফেলা যায়।”

এবারে প্রায় সবাই একসাথে জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে বের করবি?”

টুনি বলল, “যদি আসলেই মা বেঁচে আছে তাহলে মা নিশ্চয়ই অনেক খোজাখুজি করছে। খুঁজতে খুঁজতে যদি এখানে চলে আসে তাহলে বাবাটা নিশ্চয়ই ঝামেলায় পড়বে।”

“কিন্তু মা জানবে কেমন করে যে বাচ্চাটা এখানে আছে?”

“জানবে না। কিন্তু যদি বাবাটাকে জানানো হয় যে ঢাকা থেকে একজন ভদ্রমহিলা এসে একজন বাবা আর তার সাথে ছোট একটা মেয়েকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাহলে বাবাটা নিশ্চয়ই অনেক ঘাবড়ে যাবে।”

কেউ কোনো কথা বলল না, কিন্তু সবাই মাথা নাড়ল।

টুনি বলল, “কিন্তু আসলেই যদি মা মারা গিয়ে থাকে তাহলে বাবা ঘাবড়ে যাবে না, মনে করবে অন্য কোনো মহিলা অন্য কাউকে খুঁজছে।”

এবারেও সবাই মাথা নাড়ল, টুম্পা বলল, “টুনি আপু তোমার মাথায় অনেক বুদ্ধি।”

টুনি বলল, “কিন্তু খালি বুদ্ধি দিয়ে তো হবে না। বাবাটাকে এই খবরটা কে দেবে? আমরা দিলে তো ঠিক হবে না বাবাটা আমাদের দেখেছে। বড় কোনো মানুষকে খবরটা দিতে হবে।”

সবাই ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল। ছোটাছু বলল, “বাবাটা আমাকে তোদের সাথে দেখেছে। তা ছাড়া জেনে-শুনে এভাবে মিথ্যা কথা বলা সোজা না।”

শাহানা জিজ্ঞেস করল, “তাহলে কে বলবে?”

“আমি বলব। কাজেম আলী চাচার গলার স্বর শুনে সবাই একেবারে চমকে উঠল। বিচ চেয়ারে যেখানে কাজেম আলী চাচা নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিল তারা তার পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। কাজেম আলী চাচা যে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তাদের কথা শুনছে তারা সেটা চিন্তাও করে নাই।

শাহানা বলল, “আপনি বলবেন?”

কাজেম আলী চাচা চোখ খুলল, “হ্যাঁ। কেসটা আমার কাছে ভালো লাগছে। কিছু একটা করা দরকার।”

“কখন বলবেন?”

“এই তো আজকেই। মানুষটাকে হোটেলে পেলেই বলব।”

টুনি বলল, “থ্যাংকু কাজেম আলী চাচা। যখন ছোট মেয়েটা সাথে নাই তখন বলতে হবে।”

“সেভাবেই বলব।”

কাজেম আলী কিছু না বলে আবার ঘুমিয়ে গেল। একজন মানুষ যে এভাবে ঘুমাতে পারে এবং ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সব কথা শুনতে পারে সেটা আগে কেউ কখনো দেখে নাই।

.

সন্ধ্যেবেলা বাবা ছোট মেয়েটাকে নিজের রুমে রেখে নিচে লবিতে এসে কাউন্টারে কিছু একটা বলে যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন কাজেম আলী তাকে থামাল, বলল, “ভাই সাহেব, আপনার সাথে একটা ছোট মেয়ে আছে না?”

“একজন মা এসে তার মেয়ে আর মেয়ের বাবাকে খুঁজছে।”

মানুষটা ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল, দূরে সোফায় টুনি মুনিয়াকে নিয়ে বসেছিল, তারা কথা শুনতে পাচ্ছিল না কিন্তু মুখের ভাব-ভঙ্গি দেখেই বুঝে গেল।

মানুষটার চেহারা কেমন জানি ফ্যাকাশে হয়ে যায়, কাঁপা গলায় বলল, “মহিলা? আমাকে খুঁজছে?”

“আপনাকেই খুঁজছে কী না জানি না, কিন্তু আপনার সাথে যেহেতু ছোট একটা মেয়ে আছে তাই আপনাকে জানালাম।”

“কোথায়? এখন কোথায় সেই মহিলা?”

“বিচে দেখেছি। এখন কোথায় সেটা তো জানি না।” “কী রকম মহিলা?

কাজেম আলী হাসার ভঙ্গি করল, বলল, “সেটা তো বলতে পারব না–তবে মহিলাকে খুব দুশ্চিন্তার মাঝে আছেন মনে হল। আপনার ওয়াইফ নাকি?”

“আ-আ-আমার?” মানুষটা কথাটা শেষ করল না।

একটু দূরে সোফায় বসে থাকা টুনি মুনিয়াকে ফিস ফিস করে বলল, “মুনিয়া, তুই ঠিকই ধরেছিস। বাবাটা দুই নম্বুরী। মেয়েটাকে কিডন্যাপ করে এনেছে।”

“এখন? এখন কী করব?”

“বাবাটাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না যে আমরা বুঝে গেছি।”

“কীভাবে করবে সেটা?”

“আয় আমার সাথে।” টুনি উঠে দাঁড়াল তারপর হেঁটে হেঁটে কাজেম আলী চাচা আর মানুষটাকে কাছে গিয়ে বলল, “কাজেম আলী চাচা–”

কাজেম আলী চাচা ঘুরে তাকাল, একটু অবাক হয়ে বলল, “কী ব্যাপার?”

“মনে আছে একটা মা তার মেয়ে আর বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল?”

কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে কাজেম আলী চাচা বলল, “হ্যাঁ। তার কী হয়েছে?”

“মা তার মেয়ে আর হাজব্যান্ডকে খুঁজে পেয়েছে।”

“খুঁজে পেয়েছে?”

“জী। একটু আগে দেখা হয়েছে। মেয়েটার আব্বুর মোবাইল হারিয়ে গেছে তো সেইজন্যে ফোন করতে পারছিল না।”

কাজেম আলীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা যেন হঠাৎ করে জীবন ফিরে পেল। বলল, “পেয়েছে? খুঁজে পেয়েছে?”

“জী।” বলে টুনি মুনিয়ার হাত ধরে টেনে বলল, “আয় মুনিয়া আমরা যাই।”

মানুষটার রক্তশূন্য মুখে ধীরে ধীরে রক্ত ফিরে আসতে থাকে, হাসি হাসি মুখে বলল, “এই সিজনে কক্সবাজারে এত মানুষ আসে যে সবসময় একজন আরেকজনকে হারিয়ে ফেলে।”

টুনি কিছু বলল না, মুনিয়াকে নিয়ে হোটেলের লিফটে ঢুকে গেল।

.

রাত্রে ডিনারের টেবিলে কাজেম আলী সবাইকে একটা খবর দিল। ছোট মেয়েটাকে নিয়ে বাবা পরদিন হোটেল ছেড়ে চলে যাচ্ছে। রাত্রে লবিতে একটা মানুষের সাথে বাবাটাকে পাসপোর্ট নিয়ে কথা বলতে দেখা গেছে। কাজেই মনে হচ্ছে মেয়েটাকে নিয়ে সে দেশ ছেড়ে চলে যাবে।

মুনিয়া বলল, “না, যেতে দেব না।”

অন্যরাও মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে।”

শান্ত বলল, “পুলিশে খবর দেই?”

ছোটাচ্চু বলল, “পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে পুলিশকে বললে, অন্য ঝামেলা হতে পারে।”

 “তাহলে? তাহলে কী করব?”

টুনি হাসিমুখে বলল, “কিডন্যাপ করা মেয়েটাকে আমরা কিডন্যাপ করব।”

সবাই চোখ বড় বড় করে তাকাল। বলল, “কীভাবে?”

টুনি বলল, “কয়েকটা উপায় আছে। একটা হতে পারে এরকম–”

টুনি তখন তার প্ল্যানটা বলতে থাকে, অন্যেরা মন দিয়ে শুনে।

.

সকাল দশটার দিকে হোটেলের ফোন দিয়ে মানুষটার কাছে শান্ত ফোন করল। শান্ত ফোনের ওপর এক টুকরো কাপড় রেখে কীভাবে জানি গলা মোেটা করে কথা বলতে পারে।

অন্যপাশে ছোট মেয়েটার বাবা ফোন ধরল, বলল, “হ্যালো।”

“ইমতিয়াজ সাহেব?” (চেক ইন কাউন্টার থেকে কাজেম আলী চাচা মানুষটার নাম জোগার করে দিয়েছেন।)

“কথা বলছি।”

“আপনি একটু লবিতে আসতে পারবেন?”

“আমি? লবিতে? কেন?”

“আপনার মেয়ের পাসপোটটা নিয়ে একটু কথা বলতে হবে। ভিসার তারিখ নিয়ে একটা সমস্যা আছে, দুই মিনিটের জন্য নিচে আসেন।”

“কী সমস্যা?”

“নিচে আসেন সামনাসামনি বলি।”

“আসছি। পাসপোর্ট নিয়ে আসব?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। নিয়ে আসেন।”

দুই মিনিটের ভেতর মানুষটা পাসপোর্ট নিয়ে নিচে নেমে গেল। সাথে সাথে টুনি মুনিয়াকে নিয়ে মানুষটার রুমের সামনে গিয়ে দরজার টোকা দিল।

ভেতর থেকে বাচ্চা মেয়েটার গলার স্বর শোনা গেল? “কে?”

“আমরা। দরজা খোলো। তাড়াতাড়ি।”

মেয়েটা দরজা খুলল, কেমন যেন ভয় ভয় চোখে তাকাল তাদের দিকে। জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে?”

“পরে বলব। এখন আস আমাদের সাথে। “কোথায়?”

“আমাদের রুমে।”

“কেন?”

“তোমাকে তোমার আম্মুর কাছে নিয়ে যাব।”

“সত্যি?”

টুনি বলল, “সত্যি।”

“দাঁড়াও জামাটা বদলে আসি।”

টুনি বলল, “না, না, কিছু বদলাতে হবে না। এইভাবে চলে এসো।”

টুনি মেয়েটার হাত ধরে টেনে বের করে নিয়ে আসে। তারপর দরজাটা বন্ধ করে প্লাস্টিকের কার্ড ঢোকানোর সুটের মাঝে এক টুকরো টিস্যু ভাঁজ করে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল। মানুষটা ফিরে এসে তার ঘরটা সহজে খুলতে পারবে না। আগে খিমচে খিমচে টিস্যুগুলো বের করতে হবে।

মুনিয়া মেয়েটার হাত ধরে টেনে নিতে থাকে। টুনি তাকে নিজের রুমে নিয়ে গেল। ভেতর অন্য সবাই অপেক্ষা করছে, ঢোকা মাত্র তারা দরজা বন্ধ করে ফেলল। শাহানার হাতে একটা কাঁচি, সে মেয়েটাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী আপু?”

“রিমঝিম।”

“রিমঝিম কী সুন্দর নাম! আমরা তোমার চেহারাটা বদলে দিই, যেন তোমাকে তোমার আব্বু চিনতে না পারে।”

রিমঝিম ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে বদলাবে? আমার আম্মু যদি। আমাকে না চিনে?”

শাহানা হাসল, বলল, “আম্মুরা সব সময় তার ছেলে-মেয়েদের চিনতে পারে।”

টুনি দরজায় ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল, এবারে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে রিমঝিমকে চুপ করতে বলল, তার আব্বু ফিরে আসছে।

নিচে কেউ নাই, তাই মানুষটা খুবই বিরক্ত মুখে উপরে উঠে এসেছে। দরজা খোলার জন্য পকেট থেকে প্রাস্টিকের কার্ডের চাবিটা বের করে স্লটে ঢোকানোর চেষ্টা করল, কার্ডটা ভেতরে পুরোপুরি ঢুকল না তাই দরজটাটা খুলল না। মানুষটা এবারে দরজাতে জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে ডাকল, “রিমঝিম! রিমঝিম!”

ভেতর থেকে কোনো শব্দ নেই। মানুষটার চেহারায় কেমন যেন ভয়ের ছাপ পড়ল। সে আরো কয়েকবার দরজায় ধাক্কা দিয়ে নিচে নেমে যায়।

এদিকে ঘরের ভেতরে শাহানা ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে রিমঝিমের চুল কেটে তাকে ছেলের মতো বানিয়ে ফেলল। তারপর তার ফ্রক বদলে একটা শার্ট আর প্যান্ট পরিয়ে দিল। পায়ে টেনিস শু। চেহারাটায় আরো পরিবর্তন আনার জন্য তখন টুনির চশমাটা পরিয়ে দিল। চশমাটা একটু ঢলঢলে হলো কিন্তু চেহারাটার মাঝে পরিবর্তনটা ঠিকই এলো। ঘরের মাঝে একটু ফুটবল ছিল, ফুটবলটা রিমঝিমের হাতে দিয়ে সবাই তাকে পরীক্ষা করল। তাকে দেখে এখন চেনার কোনো উপায় নেই, খুব ভালো করে লক্ষ না করলে কেউ তাকে চিনতে পারবে না।

টুনি দরজা ফাঁক করে বাইরে তাকিয়েছিল, এবারে ভেতরে তাকিয়ে বলল, “এখন কেউ নেই। রিমঝিম, চলো এখান থেকে বের হয়ে যাই।”

রিমঝিম ভয়ে ভয়ে বলল, “আবু যদি দেখে ফেলে?”

“দেখলেও তোমাকে চিনবেন না। তুমি শুধু কোনো কথা বলো না।”

“ভয় করে।” “কোনো ভয় নাই। করিডরে কেউ নাই। এসো আমরা যাই।”

শাহানা বলল, “শুধু ছোটদের নিয়ে যা টুনি।”

টুনি বলল, “ঠিক আছে।”

তারপর মুনিয়া, টুম্পা আর রিমঝিমকে নিয়ে টুনি বের হলো। রুম থেকে বের হয়ে মাত্র দুই পা গিয়েছে ঠিক তখন লিফটের দরজা খুলে গেল আর লিফটের ভেতর থেকে রিমঝিমের আব্বু বের হয়ে এলো। সাথে হোটেলের একজন মানুষ। দুজন একেবারে রিমঝিমের মুখোমুখি।

রিমঝিম ভয়ে দাঁড়িয়ে গেল, সে আর নড়তে পারছে না।

টুনি তখন তার পেছন ধাক্কা দিয়ে বলল, “চল, চল। দাঁড়িয়ে আছিস কেন? টুর্নামেন্ট শুরু করতে দেরি হয়ে যাবে।”

রিমঝিমের আব্বু ছোট দলটার ওপর চোখ বুলিয়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়, সাথের মানুষটাকে বলল, “আমার রুমের তালা খুলতে পারছি না–মেয়েটাও ভেতর থেকে কোনো কথা বলে না। কী যে হয়েছে।”

রিমঝিমের আব্বু, রিমঝিমকে চিনতে পারেনি।

হোটেলের মানুষটা বলল, “দেখছি। আমি দেখছি।”

টুনি অন্য তিনজনকে নিয়ে লিফটের সামনে দাঁড়াল। রিমঝিমের আব্বু আবার মাথা ঘুরিয়ে তাদের দিকে তাকাল। এখন রিমঝিমকে পেছন থেকে দেখছে, চিনতে পারার কথা না।

লিফটের বোম টিপে চারজন দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে হয় লিফটটা আসতে বুঝি অনন্তকাল পার হয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত লিফট এসে থামল, দরজা খুলল। চারজন শান্ত ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকল তারপর দরজাটা বন্ধ হতেই সবাই একসাথে আনন্দে চিৎকার করে উঠে। রিমঝিমকে তার আব্বু আর ধরতে পারবে না।

লিফট থেকে বের হয়ে তারা ছুটতে ছুটতে সমুদ্রের দিকে যেতে থাকে।

.

এদিকে অনেক কষ্ট করে রিমঝিমের আব্বুর রুমটা খোলা হলো। ভেতরে ঢুকে মানুষটা চারিদিকে তাকাল, বাথরুমের ভেতর উঁকি দিল, তারপর বলল, “আমার মেয়ে কোথায়?”

একজন মানুষের ছোট একটি মেয়ে যদি হারিয়ে যায় তাহলে তার যেরকম অস্থির হয়ে যাওয়ার কথা, মানুষটি সেরকম অস্থির হলো না। কেমন যেন রাগী গলায় বলল, “মেয়েটিকে কে নিয়ে গেল?”

হোটেলের মানুষটা বলল, “নিচে চলেন, সিসি ক্যামেরাতে দেখি। হোটেলের বাইরে গেলে আমরা দেখে ফেলব।”

গত আধা ঘণ্টা সময়ে কারা কারা হোটেলে ঢুকছে কারা কারা বের হয়েছে। সবাইকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হলো কিন্তু রিমঝিমের কোনো হদিস নেই। হোটেলের মানুষটা অবাক হয়ে দেখল, এরকম অবস্থায় মানুষটার দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু মানুষট দুশ্চিন্তিত না হয়ে আস্তে আস্তে কেমন জানি রেগে উঠছে। রেগে উঠছে কেন?

সমুদ্রের তীরে বালুবেলায় বাচ্চারা ছোটাচ্চুটি করে খেলছে। টুনির চশমা টুনিকে ফেরত দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত রিমঝিমের মনটা ভালো হয়েছে। তার আব্বু হঠাৎ করে এখানে চলে আসবে না কাজেই সে এখন কথাবার্তাও বলছে। শাহানা যেরকম বলেছিল তাই ঘটেছে। রিমঝিমের আম্মু আর আব্বুর মাঝে ডিভোর্স হয়ে গেছে, রিমঝিম তার আম্মুর সাথে থাকে। তার আব্বুর সেটা নিয়ে খুব রাগ। আম্মুকে শাস্তি দেওয়ার জন্যে তাকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকক না মালদ্বীপ কোথায় জানি যাবে।

ঠিক এরকম সময় দেখা গেল কাজেম আলী চাচা বালুতে লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে আসছে। তার পেছনে শাড়ি পরা একজন ভদ্রমহিলা, উদ্বিগ্ন মুখে হেঁটে হেঁটে আসছেন।

বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি থামিয়ে তাদের দিকে তাকাল এবং হঠাৎ করে রিমঝিম ‘আম্মু আম্মু বলে চিৎকার করে মহিলার দিকে ছুটে যায়। মা বালুতে বসে দুই হাত বাড়িয়ে রাখলেন আর রিমঝিম ছুটতে ছুটতে তার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার মেয়েটিকে এখন ছেলের মতো দেখাচ্ছে কিন্তু তার পরেও তার মায়ের চিনতে এতটুকু দেরি হলো না।

সবাই রিমঝিম আর তার মায়ের দিকে এগিয়ে যায়। টুনি বলল, “আপনি কেমন করে খবর পেলেন? এত তাড়াতাড়ি কেমন করে চলে এলেন?”

“আমি তো জানি না! একজন আমার বাসায় একটা প্লেনের টিকিট নিয়ে গেছে। বলেছে আমার মেয়েকে পাওয়া গেছে, এক্ষুনি আসতে হবে”

বাই কাজেম আলী চাচার দিকে তাকাল। কাজেম আলী চাচা বলল, “হ্যাঁ। আমি পাঠিয়েছি।”

“আপনি কেমন করে খুঁজে বের করলেন।”

“সবগুলো থানায় খোঁজ নিয়েছি, মেয়ে হারিয়ে গেছে এরকম জিডি আছে কী না। মোহাম্মদপুর থানায় পেয়ে গেলাম, সেখান থেকে ঠিকানা বের করে ম্যাডামকে খুঁজে বের করেছি। স্যারকে বলতেই স্যার টিকিটের ব্যবস্থা করলেন। আমি এখানে থানায় জানিয়ে দিলাম। খুবই সোজা।”

টুনি কাজেম আলী চাচাকে বলল, “আপনার নামটা একেবারে সঠিক।”

“মানে?”

“কাজের মানুষ–তাই নাম কাজেম আলী।”

কাজেম আলী চাচা একটু হাসল। তারপর ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, “ম্যাডাম, হোটেলে আপনার একটা রুম বুক করে রাখা আছে। ছয়তলার ছয় শ বারো। হোটেলের বিল নিয়ে মাথা ঘামাবেন না, আমাদের স্যার সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন।”

“সে কী? আমার হোটেলের বিল আমি দিতে পারব”

“অবশ্যই পারবেন। কিন্তু স্যার দিতে চাইছেন। এই বাচ্চাদের মাঝে বড় বড় ডিটেকটিভ আছে, স্যার তাদের সবাইকে নিয়ে এসেছেন। তাদের মাঝে রিমঝিমকেও ঢোকানো হয়েছে। রিমঝিমের গার্জিয়ান হিসেবে আপনি।”

ভদ্রমহিলা আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু কাজেম আলী চাচা কোনো সুযোগ দিল না। বড় একটা হাই তুলে কাছাকাছি একটা বিচ চেয়ারের দিকে হেঁটে যেতে যেতে বলল, “ঘুম পাচ্ছে। একটু ঘুমিয়ে নেই।”

সবাই দেখল, কাজেম আলী চাচা একটা বিচ চেয়ারে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। একটু পরেই তার নাক ডাকতে থাকে।

টুম্পা বলল, “কাজেম আলী চাচার নাম আসলে হওয়া উচিত ছিল ঘুমা ঘুমা আলী।”

টুনি বলল, “ঠিকই বলেছিস।”

অন্যেরাও তখন মাথা নাড়ল। তারপর মাথা ঘুরিয়ে রিমঝিমের দিকে তাকাল।

রিমঝিমের আম্মু রিমঝিমকে বুকে চেপে ধরে বালুতে পা ছড়িয়ে বসে আছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে হাতটা একটু আলগা করলেই রিমঝিম বুঝি আবার হারিয়ে যাবে, তাই কিছুতেই হাত ছাড়া করা যাবে না।

কিছুতেই না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *